মন্ত্রী বর যখন চাচাতো ভাই পর্ব ১২
সৌরভ চৌধুরী
সকালের হিমেল হাওয়া থেমে গেছে অনেক আগেই,
মাঠে এখন ঝলমল করছে রোদে ভরা দুপুরের আভা।
ছায়ারা ছোট হয়ে গেছে, আর পাখিরা নিঃস্তব্ধ দুপুরের নীলে হারিয়ে গেছে।
আবরাজ,আরহাম এবং আবরার বসে আছে একটা পুরাতন বটগাছের নিচে। তাদের কারো মুখে কোন কথা নেই তিনজনই গভীর ভাবনায় আছে।
তাদের ভাবনার কারণ হলো শাকিল এর বলা নাম গুলো।
তারা অত্যন্ত ক্ষমতাসীন। তারা ক্ষমতাসীন হলেও চৌধুরী পরিবারের তিন ছেলের কোন যায় আসে না।
কারণ তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা তাদের পরিবারের সাথে হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ নেবে।
তারা তিনজনই ভাবতেছে কিভাবে প্ল্যান করলে শত্রুরা জানার আগেই তাদেরকে ধরা যাবে।
কারণ তারা চায় না শত্রুরা তাদের প্ল্যান জেনে যাক। যদি জেনে যায় তাহলে তাদের পরিবারের উপর বিপদ ঘনিয়ে আসবে।
তো চলুন জেনে আসা যাক শাকিল কাদের নাম বলেছিল যে চৌধুরী পরিবারের তিন ছেলেকে এভাবে ভাবতে হচ্ছে। নতুন প্ল্যান তৈরি করতে হচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফ্লাসব্যাক,
শাকিল _____ আমাদের বস অত্যন্ত ক্ষমতাবান। তিনি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাশেদ খান। আর তার সহযোগী হিসেবে ছিলঃ-
সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল ইকবাল ভূঁইয়া, তৎকালীন বিজিবি এর ডিজি আসিফ মাহমুদ, Rab এর ডেপুটি ডিরেক্টর হাসান, পুলিশের IGP মেনন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম, টপ বিজনেসম্যান আজিজ গ্রুপের মালিক আজিজ।
ঢাকা শহরের মাফিয়াদের গডফাদার আলী ভাই। তবে আরো একজন আছে কিন্তু সে কে তা আমি জানি না। তার সম্পর্কে জানে শুধু ২জন ব্যাক্তি রাশেদ আর নাসিম ভাই।
শাকিলের কথা শেষ হতে চৌধুরী পরিবারের তিন ছেলে ভাবনায় পড়ে গেল এত এত ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা কেন তার চাচ্চুর পেছনে পড়েছিল। কি ছিলো তাদের উদ্দেশ্যে,
আবরাজ ______ এদের উদ্দেশ্য কি ছিল? এরা কেন চাচ্চুর পেছনে লেগেছিল? আর কেনই বা তাকে খুন করল? এতে তাদের কি লাভ?
শাকিল ____তোমাদের দাদা ছিল অত্যন্ত সাহসী একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ছিল সৎ অফিসার। উনি আমাদের বসের আরেক সহযোগী অর্থাৎ আমজাদ শেখ এর বাবার সকল অপকর্মের ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে অনেক গোপন তথ্য জেনে গিয়েছিল। তাই শেখ পরিবারের সহযোগিতায় আমাদের বসের নির্দেশে তোমাদের দাদাকে খুন করা হয়।
আরহাম ___ তাহলে আমাদের ছোট দাদুকে কেন খুন করা হলো?
আরহামের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে শাকিল একটু চুপ থাকলো অতঃপর একটা নিশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
শাকিল ____ আমরা জানতাম না তোমাদের ছোট দাদা কে ছিল। হঠাৎ করে একদিন খবর পায় বিদেশ থেকে অনেক লোক এসেছে তারা খোজ করতেছে তোমাদের দাদার মৃত্যু কিভাবে হলো? কে করেছে খুন? আমরা এ বিষয়ে জানতে পেরে অনেকটা ঘাবড়ে যায়। ততদিনে তোমাদের ছোট দাদা আমাদের বস পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তখন সে অনেক রেগে ছিল। তাই একাই আমাদের আস্তানায় প্রবেশ করে এবং আটকে যায়।
তারপর আমাদের বস তাকেও শেষ করে দেয়।
কিন্তু আমরা আজও জানতে পারিনি সে এত দ্রুত কিভাবে আমাদের বস পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। সে বড় ব্যবসায়ী হতে পারে কিন্তু এত দ্রুত কিভাবে সম্ভব? আজও আমাদের বস এ বিষয়টা মেলাতে পারেনি।
শাকিল এর মুখ থেকে এরকম আফসোস সূচক কথা শুনে আবরাজ মৃদু হাসলো এরপর বলল,
আবরাজ ____ তার পরিচয় শুনলে তুই এখন ভয়ে হার্ট অ্যাটাকও করতে পারিস।
কি শুনতে চাস তার পরিচয়? শুনবি নাকি?
আবরাজের মুখ থেকে এমন কথা শুনে শাকিল মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল অর্থাৎ সে শুনবে তার পরিচয়।
শাকিল এর সম্মতি সূচক মাথা নাড়ানো দেখে আবরাজ মৃদু হাসলো এরপর বলল,
আবরাজ _____ যা আজ তোকে তার আসল পরিচয় সম্পর্কে বলবো। তার আগে বল চাচ্চুকে কেন খুন করলি তোরা?
আবরাজের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে শাকিল একটু ভাবলো, তারপর বলতে শুরু করলো,
শাকিল _____ তোদের ছোট দাদা আমাদের বসের সকল অপকর্মের প্রমাণ রেখে গিয়েছিলো। যা আমরা জানতেই পারি নি।
তবে শেখ পরিবারের জন্য জানতে পারি।
কিন্তু ফাইলটা কোথায় তা আমরা জানতাম না।
তবে পরে অবশ্য জানতে পারি আয়মান চৌধুরীর কাছে ছিলো ফাইল।
আয়মান চৌধুরী আমাদের বসের সকল অপকর্ম সম্পর্কে অবগত ছিলো। ৫০০ জন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছিলো ঐটা ছিলো আমাদের বসের সবচেয়ে বড় চালান।
আয়মান চৌধুরী চালানটা আটকে দেয়।
বস অনেক রেগে যায়।
এর আগেই আয়মান চৌধুরী কে টার্গেট করা হয়েছিলো। তবে সে বেঁচে যায় এবং আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে যায়।
তবে তাও চুপ করে থাকে নি। আমাদের বসের সকল ব্যাবসা ধ্বংস করতে থাকে।
এরমধ্যে একদিন NSI হেডঅফিসে আসে আয়মান চৌধুরী।
আমি বিষয়টি বস কে জানালে। বস তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে বলে।
আমি তাই করি।
এর মধ্যে জানতে পারি আয়মান চৌধুরী আমি বাদে প্রায় সকলের তথ্য কালেক্ট করেছে,
এর ভেতর টপ ব্যাবসায়ী আজিজের আদম ব্যাবসা। নারী পাচার, ড্রাগস এর ব্যাবসা, সরকারী প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ সহ বিদেশে টাকা পাচার সব নথিই কালেক্ট করেছে,
এছাড়াও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিমের চিকিৎসা খাতের সিন্ডিকেটসহ সকল অবৈধ ব্যাবসার নথিও ছিলো।
আমি বিষঠি বসকে জানিয়ে দি।
বস নথিটি আমাকে নিতে বলে এবং আয়মানের ওপর নজর রাখতে বলে।
আয়মান আমাকে নথিটি দেয়৷ তবে আমি জানতাম না আয়মান আরেক কপি নথি তার কাছে রেখেছিলো।
পরে জানতে পারি তবে নথিটি কার কাছে আছে আজও তা জানি না।
আয়মান কে কিডন্যাপ করে আলী ভাই। তার আস্তানায় নিয়ে যায়। অমানসীক নির্যাতন করা হয়, তবুও আয়মান মুখ খুলে নি।
এক পর্যায়ে আয়মান মারা যায়। আলী ভাই এর সহযোগীতায় এক্সিডেন্টের নাটক বানিয়ে আয়মান কে ট্রাক দিয়ে পিষে দেওয়া হয়।
শাকিল শেষের কথাটি বলেই চৌধুরী বাড়ির ৩ ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো তারা তিনজনই চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।
মুখের অবস্থাও খারাপ, যেন তারা চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছে তাদের চাচ্চুর ওপর করা নির্যাতন আর ট্রাক দিয়ে পিষে দেওয়া।
একটু দম নিয়ে আবারো বলল,
সবাই যখন আয়মান কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। আমরাও পেছন পেছন নিয়ে যায়। তৎকালিন হাকিমপুর থানা ওসি জব্বার ও হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এর ডাক্তার সাহেদকে টাকা দিয়ে কেস ধামাচাপা আর এক্সিডেন্টে মৃত্যু বলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে বলা হয়। তারাও সেই কাজই করে।
এতটুকু বলেই শাকিল চুপ হয়ে যায়।
অন্ধকার রুমে নিরবতা যেন রুমটিকে আরো ভয়ংকর করে তুলতেছিলো।
নিস্তবদ্ধতা ভেঙ্গে আবরাজ বলল,
আবরাজ _____ ডেভিড যাও ওসি জব্বার আর ডাক্তার সাহেদ কে তুলে আনো।
ডেভিড ___ ok sir
আবরাজ _____ এলেক্স একে মারতে থাকো আর এর খাবার দেওয়া বন্ধ করে দাও। শুধু দিনে কয়েক ফোটা পানি দিবে যেন বেঁচে থাকে।
আবরাজের মুখে এমন ভয়ংকর কথা শুনে শাকিল ভয় পেলো না স্বাভাবিক থাকলো কারণ সে বুঝতে পেরেছে তার দিন শেষ হতে চলেছে।
চৌধুরী বাড়ির ছেলেরা তাকে শেষ করে দিবে। শুধু তাকে না তাদের সবাইকেই শেষ করে দিবে।
শাকিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আবরাজের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
শাকিল _____ তোমাদের ছোট দাদার পরিচয় কী?
আবরাজ শাকিলের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সড়িয়ে নিয়ে বলল,
আবরাজ __ লন্ডনের মাফিয়া সম্রাট স্যাডো কিং ছিলো আমার ছোট দাদা আহিয়ান চৌধুরী।
স্যাডো কিং নামটা শুনে শাকিলের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো, সে বলল,
শাকিল ____ তোমাদের ছোট দাদা তো মারা গিয়েছে তাহলে এখন স্যাডো গ্যাং কে চালায়? ( ভয় জড়িত কন্ঠে তুতলাতে তুতলাতে বলল)
আবরাজ ____ আমি ( ভাবলেশীন ভাবে বলল)
শাকিল ____ তুতুতুমি ( তুতলিয়ে বলল)
আবরাজ ___ হ্যা। আমি দাদুর ডায়েরী পড়ে একটা ঠিকানা পাই। সেই ঠিকানায় যেতেই আমি ছোট বেলায় চলে যায় লন্ডন।সবাই জানতো আমি পড়তে গিয়েছি৷ তবে শুধু আমি জানতাম আমি কেন লন্ডন যাচ্ছি?
লন্ডনে গিয়ে দাদুর লেখা ঠিকানায় গিয়ে দাদুর ডায়েরীর পাতায় লেখা কোড বলতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় দাদুর বন্ধু সেফিল্ড এর কাছে।
যে দাদুর অবর্তমানে দাদুর গ্যাং এর দায়িত্ব নিয়েছিলো।
এরপর সেফিল্ড আমাকে কিং বানানোর জন্য প্রস্তুত করে।
ধীরে ধীরে আমি প্রস্তুত হই।
স্যাডো গ্যাং কে লন্ডনের গন্ডী পেরিয়ে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়ে দি।
হয়ে উঠি আন্ডার ওয়াল্ডের সম্রাট।
আবরাজের মুখ থেকে এমন কথা শুনে শাকিল তো রিতিমতো ভয়ে কাপতেছে। কারণ সে জানে স্যাডো কিং কতটা হিংস্র।
সে ভাবতেছে তার মৃত্যুটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক হবে।
স্যাডো কিং হয়ে ওঠার গল্প বলেই চৌধুরী পরিবারের তিন ছেলে চলে যায় রুম থেকে।
তারা চলে যেতে এলেক্স শুরু করে তার নির্যাতন।
বর্তমানঃ
আবরাজ নিস্তবদ্ধতা ভেঙ্গে বলল,
আবরাজ ____ আগে জব্বার আর সাহেদ কে ধরবো।
ওদের আটকে রেখে চাচ্চুর মৃত্যুর সঠিক পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিবো। ওদের জবানবন্দী নিবো।
এরপর তা প্রচার করবো। আমাদের লক্ষ্য থাকবে ওদের বহিষ্কার।
কারণ আমরা যদি এভাবে ওদের সবগুলোকে শেষ করি আমাদের সরকার চাপে পড়ে যাবে। মানুষ সরকারের দিকে প্রশ্ন তুলবে।
কারণ সবাই ক্ষমতাশীন মানুষ। ওদের আগে জনগনের কাছে খারাপ বানাতে হবে।ওদের মুখোশ খুলতে হবে।
তবে এখানে আমাদের পরিবারের বিষয়গুলো হাইন্ড রাখবো। কারণ ওদের শেষ করার পর যেন কেউ আমাদের সন্দেহ না করে।
আবরাজের কথা শেষ হতেই আবরাজের কাধে হাত রেখে আরহাম বললো,
আরহাম ____ পাক্কা রাজনীতিবিদ।
রাজনীতিবিদের মাথা বলে কথা।
তবে প্ল্যানটা দারুন।
আবরার __ দেখেছো ভাইয়া, রাজনীতিবিদ কাকে বলে প্রতিশোধের সাথে সাথে দলকে ও বাচিয়ে দিলো যেন সাধারণ মানুষ প্রশ্ন না তুলে বাহবা দেয়।
আবরার আর আরহামের কথা শুনে আবরাজ মুচকি হাসলো।
অতঃপর তিন ভাই উদ্দেশ্যেহীন ভাবে হাটতে লাগলো গ্রামটা ঘুরে দেখার জন্য।
অন্যদিকে,
রাফি আর আসিফের অবস্থা খারাপ। মেয়েদের কথামতো সকল কাজ করতে করতে ওদের জীবন যায় যায় অবস্থা।
মেহেক, রুশা,আরিশা ওদের একের পর এক কাজ দিচ্ছে আর ওরা ও তা করতেছে। না করে উপায় আছে।
একপাশে দাড়িয়ে জারিন ওদের খুনসুটি দেখতেছে, তার অনেক ইচ্ছে করতেছে ওদের সাথে মজা করতে।
কিন্তু কেন যেন পারতেছে না?
এই পরিবারের ওপর করা অন্যায়ের জন্য?
হয়তো তাই।
তার নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। আরহামের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। আরহামের চোখের দিকে তাকালে দেখতে পারে ঐ চোখে তার জন্য ভালোবাসা না সহস্র ঘৃণা রয়েছে।
মেহেক লক্ষ্য করেছে জারিনকে।
আজ কেন জানি জারিনের চোখে তার জন্য হিংসা বা আগের মত অহংকারী ভাব দেখা যাচ্ছে না।
তার পরিবর্তে ফুটে উঠেছে হারানোর ভয়, অপরাধবোধ।
জারিনকে আপন মনে ভাবতে দেখে মেহেক তার দিকে এগিয়ে গেল এবং বলল,
মেহেক ______ ভাবি কোনো সমস্যা? অসুবিধা হলে বলতে পারো।
জারিন ______ না না কোনো সমস্যা নেই। আমি ঠিক আছি।
মেহেক _____ তো এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? আসো আমাদের সাথে মজা করো।
জারিন _____ না না আমি এখানেই ঠিক আছি। তোমরা মজা করো। ( হালকা গলায় বলল তবে মনে মনে চাইলো মেহেক যেন তাকে জোর করে নিয়ে যায়)
জারিনের ভাবনায় সঠিক হলো, মেহেক হাত ধরে জারিনকে বাকিদের কাছে নিয়ে গেলো।
মেহেকের সাথে জারিনকে দেখে আরিশা গম্ভীর হয়ে গেলো।
জারিন আরিশার মনোভাব লক্ষ্য করেছে,
সে জানে আরিশা বা আবরার কেউ তাকে পছন্দ করে না?
কেন পছন্দ করে না তাও তার জানা। আর সে তো তাদের মনে জায়গা করে নেওয়ার মতো কোনো কাজও করে নি।
তবে সে এখন খুব করে চায়, সবার সাথে মিশতে। সবার মন জুগিয়ে চলতে চায়।
তাই আজ আরিশার মনোভাব দেখেও নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে সবার সাথে মজা করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে আরিশা ও স্বাভাবিক হলো।
সবার সাথে মিশে গেলো।
সবাই যোহরের নামাজ পরে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতেছে,
তবে তিন বাদরের আসার নাম নেই।
মেহেক তো রেগে গজগজ করতেছে। সেই সকালে বের হয়েছে, বলে গেলো কি তারাতারি আসবে, নবাবদের এখনো আসার নাম নেই?
মেহেক রাগে গজগজ করতেছে আর পায়চারী করতেছে,
তার হাতে ফোন, অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে আবরাজ কে।
কিন্তু ওপাশ থেকে বারবার একই মেয়েলী কন্ঠ বলে উঠে, ” এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন”
আরিশা আবরার, আরহামকে কল দিচ্ছে তাদের ও একই অবস্থা।
জারিন দূরে দাড়িয়ে মেহেককে দেখতেছে।
আর ভাবতেছে, সে কি কোনো দিনও আরহামের জন্য এমন চিন্তা করেছে, না সে তো করে নি।
কেন করে নি? আরহামের ভাষায় শেখরা ভালোবাসতে না ছিনিয়ে নেওয়া কে ভালোবাসা বলে।
তাহলে কি আরহামকে সে ও ভালোবাসতে পারে নি।
সে তো তা চায় নি।সে তো আরহামকে ভালোবেসে ছিলো কিন্তু কেন সবার মতো ভালোবাসতে পারলো না? কেন আরহামের মনের মতো হতে পারলো না?
মেহেকের এখন রাগ থেকে চিন্তা হচ্ছে? ওদের কিছু হলো না তো?
ওরা তো এখানে ঘুরতে এসেছে তাহলে এখানে ওদের কি কাজ?
না সে আর ভাবতে পারতেছে না,
চিন্তায় চোখ দিয়ে অঝড়ে পানি পরতেছে, সে চেয়েও আটকাতে পারতেছে না।
ঠিক তখনি একটা গাড়ি হাজির হলো বাড়ির উঠোনে,
দেখতে পেলো গাড়ি থেকে নামতেছে চৌধুরী বাড়ির ৩ ছেলে।
মেহেক দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো আবরাজ কে আর বলতে লাগলো
মেহেক ____ আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার কিছু হয়নি তো? জানেন আমার কত টেনশন হচ্ছিলো? আমি তো মনে করেছিলাম এই অভিসাপ্ত দিনাজপুর আমার থেকে বোধ হয় আপনাকে ও কেড়ে নিবে।
( কাঁদতে কাঁদতে বলল)
আবরাজ _____ আরে আরে মেহেক আমি ঠিক আছি। আরে বোকা এভাবে কেউ কান্না করে।
তুমি না স্ট্রং, এতটুকুতেই ভেঙ্গে পরলে চলবে।
( মেহেকের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল আবরাজ)
দূরে দাড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখলো জারিন। সে ভাবতে লাগলো, সে কেন মেহেকের মতো টেনশন করতে পারলো না? সে কেন আরহামের জন্য কান্না করতে পারলো না? সে কেন মেহেকের মতো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারলো না?
দুপুরের গরম এখন হালকা হয়ে আসছে,
মাঠে ঘাসের ঢেউ আর পাখির নীড়—সবই বিকেলের নরম আলোয় ভিজে যাচ্ছে।
মাটির রঙ যেন বদলে বিকেলের সোনালি আভা ধারণ করেছে।
চৌধুরী বাড়ির সবাই বসে আছে আয়মান চৌধুরীর বাসার ড্রয়িং রুমে,
আর তাদের সামনে মেঝেতে বসে আছে, মহাসিন সিকদার, রাবেয়া সিকদার, রেশমা।
রেশমার মাথায় ব্যান্ডেজ লাগানো। এছাড়াও পুরো শরীরে ব্যাথা। শরীরের অনেক জায়গায় কেটে গেছে।
মেহেক সিকদার বাড়ির কাউকে সোফায় বসতে দেয় নি।
অগত্যা তাদের নিচে মেঝেতে বসতে হয়েছে।
রেশমা ড্রয়িং রুমে আসার পর থেকে ভয়ে সিটিয়ে আছে কারণ তার দিকে মেহেক আর রুশা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে আয়ান চৌধুরী বলল,
বাবা ____ আমার জানা মতে মেহেকের মায়ের কোনো পরিবার নেই। সে ছিলো এতিম। তাহলে আপনারা মেহেকের কেমন মামা মামি।
আয়ান চৌধুরীর মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে মহাসিন সিকদার আমতা আমতা করে উত্তর দিলো,
মেহেক মামা _____আমি আর মেহেরুন আপন ভাই বোন। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর মেহেরুনকে দেওয়া হয় এতিম খানায় আর আমাকে দাদা – দাদি লালন পালন করে।
মেহেরুন লেখাপড়া করে ১৮ বছর বয়স হলে চলে যায় ঢাকায়। ঐখানেই সম্পর্ক হয় আয়মানের সাথে। এরপর বিয়ে করে চলে আসে দিনাজপুরে।
আমার সাথে কথা বলে আগেই জায়গা এবং বাড়ি বানিয়ে রেখেছিলো আয়মান।
আয়মানের মৃত্যুর পর আমার ব্যাবসা ও লস হয়। ঋণের দায়ে সব বিক্রি করতে হয়। ভিটেমাটি হারিয়ে বোনের কাছে আশ্রয় নি।
তখন থেকেই মেহেকের এই সম্পত্তির ওপর আমার স্ত্রীর লোভ জন্ম নেয়।
দিনে রাতে আমাকে ফুসলাতে শুরু করে। শেষমেস আমিও এই ঘৃণ কাজে সঙ্গ দি।
মহাসিন সিকদারের সহজ স্বিকারক্তি শুনে আয়ান চৌধুরী গম্ভীর হয়ে যায়।
বাবা ______ তা এখন কী ভাবলেন? এখন কি করবেন?
মেহেকের মামা ______ মেহেক মা আমাদের ক্ষমা করে দে।
আমাদের তো কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। দয়া করে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে দে। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিলে আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে।
মহাসিন সিকদারের কথা শুনে মেহেক রেহেনা চৌধুরীর দিকে তাকালো অতঃপর রহ্যময় হাসী দিলো।
এই বিষয়টা আবরাজ লক্ষ্য করেছে। সে বুঝে গেছে সিকদার পরিবারের কপালে দুঃখ আছে। তার মা যে কতটা কঠিন মানুষ সে তো জানে। এরা তো তার আদরের মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে। এদের কপালে দুঃখ আছে।
রেহেনা চৌধুরী বলল,
মা _____ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত মেহেক না।আমরা নিবো। মেহেকের অভিভাবক আছে।
রেহেনা চৌধুরীর মুখ থেকে কথাটি শুনে রাবেয়া শিকদার বিদ্রুপের সাথে বলল,
মেহেকের মামি __ এতদিন অভিভাবক ছিলো না, আজ অভিভাবক হতে আসছে। যত্তসব ঢং।
রাবেয়া সিকদারের কথা শুনে মেহেক বলল,
মেহেক _______ আপনার তেজ তো কমে নি দেখছি। তবে চিন্তা নেই আপনার তেজ মাটির সাথে মিশে দিবো।
মেহেকের কথা শুনে রেহেনা চৌধুরী বলল,
মা _______আমি চাই না আপনারা আর এই বাড়িতে থাকেন। আশা করি ৩০ মিনিটের ভেতর আপনাদের সকল কিছু নিয়ে এই বাড়ি ছাড়বেন।
মেহেকের মামি ___ এমন ভাব করছেন যেন এই বাড়িতে না থাকলে আমরা মরে যাবো।
আমরা আমাদের দোকান ভাড়া, আর ক্ষেতের জমি দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে চলতে পারবো।
মেহেকের মামির কথা শুনে আবরাজ এতক্ষণ চুপ থাকলেও আর চুপ থাকলো না সে বলল,
আবরাজ _____ ওহহ রিয়েলি মিসেস সিকদার। ঐ দোকান আর জমিগুলো আপনাদের।
আবরাজের মুখ থেকে এমন কথা শুনে রাবেয়া সিকদার ভড়কে গেলো, ঐ জমি আর দোকান সম্পর্কে তো আবরাজের জানার কথা না। মেহেক ও তো তখন অনেক ছোট। ও তো জানে না তাহলে আবরাজ কীভাবে জানবে।
আবরাজ বলে উঠলো,
আবরাজ ___ ঐ জমি আর দোকান সব মেহেকের নামে। চাচ্চু আগেই সবকিছু মেহেকের নামে কিনেছিলো।
আপনারা হয়তো জানেন না আজ সকালেই আমার লোকজন আপনাদের ভাড়া দেওয়া ব্যাক্তিকে বের করে দিয়েছে, ক্ষেতের জমি দাদণ দেওয়া ব্যাক্তিদের থেকে ও বুঝে নেওয়া হয়েছে।
আবরাজের মুখে এমন কথা শুনে রাবেয়া সিকদার ভেঙ্গে পরলো, কারণ ঐ জমির ওপর ৩ লক্ষ টাকা দাদণ নিয়েছে তারা ঐ টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য ফোন, জমা কাপড় সহ কসমেটিকস কিনেছে।
নিজের জন্যও ফেসিয়ালসহ কেনাকাটা করতেই শেষ করেছে।
এখন যদি আবরাজ জমি নিয়ে নেয় তাহলে দাদণ দেওয়া ব্যাক্তিটি তাকে ছাড়বে না। আর এখন এতগুলো টাকা কই পাবে? কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
রাবেয়া সিকদার কে গভীর ভাবণায় দেখে রেহেনা চৌধুরী বলল,
মা ___ সবাই এখন নিজ নিজ রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।
আর হ্যা ৩০ মিনিট পর আপনাদের যদি এই বাড়িতে দেখি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।
কথাটি বলেই সবাই নিজ নিজ রুমে চলে গেলো।
ড্রয়িং রুমে থাকলো শুধু সিকদার পরিবার।
অপরদিকে,
বস লোকটির সামনে অন্ধকার রুমে বসে অজানা একজন ব্যাক্তি,
বস _____ শাকিলকে স্যাডো গ্যাং এর লোকজন ধরে নিয়ে গেছে? আমাদের RDX এর চালান আটকে গেছে।
অজানা ব্যাক্তি _____ এসব কি হচ্ছে?
আমি কিছু জানতে চাই না রাশেদ। প্রয়োজনে ওদের শেষ করে দাও। আমার এতদিনের সাম্রাজ্য আমি হারাতে চাই না।
বস ____ বস আমার মনে হচ্ছে আমাদের এখন কিছুদিন দেশের বাহিরে থাকা উচিত।
দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না।
অজানা ব্যাক্তি ____ চুপপ থাকো রাশেদ। আমাদের এই মাসে ১০০ মেয়ে দুবাই পাচার করতে না পারলে শেখরা আমাদের ছেড়ে কথা বলবো না।
আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। চোখ কান খোলা রাখতে হবে।
রাশেদ ______ বস আপনার কি মনে হয় এসব কি চৌধুরী বাড়ির তিন ছেলে করতেছে?
অজানা ব্যাক্তি _____ আমি বুঝতেছি না রাশেদ। ধরলাম ওরাই করতেছে তাহলে স্যাডো গ্যাং, আবার এসকে গ্যাং এসব কি! এরা কেন আমাদের পেছনে লেগেছে? এরা কি চায়? আমি কিছু বুঝতেছি না।
আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
বস _____ বস আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব দেখতেছি। ওরা যারাই হোক ওদের ধরা পরতেই হবে।
আনরা ওদের শেষ করে দিবো।
কথাটি বলে বস অর্থাৎ সরাষ্ট্রমন্ত্রী রাশেদ চলে গেলো।অন্ধকার রুমে চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় ভাবনায় আছে অজানা ব্যাক্তি।
অন্যদিকে,
সিকদার পরিবারের সকল সদস্য রাবেয়া সিকদারের বাবার বাসায় উঠেছে।
তাদের কে একবারে আসতে দেখে রাবেয়া সিকদারের ২ ভাই এর বউ তাদের স্বামীদের বলে দিয়েছে,
যদি তার বোন আর তার পরিবার এই বাড়িতে থাকে তাহলে তারা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আর হ্যা রান্নার সকল জিনিসপত্র তালা দিয়ে রাখা হয়েছে। ওরা যতদিন থাকবে, ততদিন এই বাড়িতে কোনো রান্না হবে না।
রাবেয়া সিকদারের মা কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো,
অন্যের মেয়েকে যখন অত্যাচার করেছে এই বুড়ি তখন মেয়েকে ভালো পরামর্শ না দিয়ে আরো উস্কে দিতো, এবার এই বুড়িকে সহ বের করবো। না হলে এই বুড়ি আমাদের ছেলে মেয়ের মাথাই ও এসব বিষ ঢুকাবে।
ছেলের বউয়ের কথা শুনে রাবেয়া শিকদারের মা ও চিন্তায় পড়ে গেল।
সে জানে সে ও ভুল করেছে, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সে মেয়েকে উসকে দিতো, আজ সেই কাজটি তারও গলার কাটা হয়ে দাঁড়ালো।
মহাসিন শিকদার রাবেয়া শিকদারের ভাই ও তার বউদের কথোপকথনের পুরো কথাটাই শুনেছে।
এরপর বউ এবং মেয়েকে নিয়ে একটা রুমে দরজা আটকে চুপ করে বসে আছে।
সে ভেবে পাচ্ছে না সে এখন কি করবে। তাদের সকল রাস্তায় বন্ধ।
দাদন দেওয়া ব্যক্তি তো তাদের দুই দিন সময় দিয়েছে এই দুই দিনের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে তার মেয়ে রেশমার সাথে তার মাতাল ছেলের বিয়ে দিতে হবে।
মহাসিন শিকদার এসব কথা ভাবতে ভাবতেই তাদের বন্ধ দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দেয়ার শব্দ হলো।
মহাসিন শিকদার আর কিছু না ভেবেই দরজা খুলে দিলো।
দরজা খুলে দিতে দেখতে পেল রাবেয়া শিকদারের দুই ভাইয়ের বউকে।
তারা ছুটে এসে তাদের সকল জিনিসপত্র বাইরে ছুড়ে মারল এবং রাবেয়া শিকদারের ঘাড় ধরে বাইরে বের করে বলতে লাগলো,
দ্রুত তোরা আমাদের বাড়ি ছাড়। আমি চাইনা তোদের মত পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের ছায়া আমার ছেলে মেয়েদের উপর পড়ুক।
তোরা দ্রুত এই বাড়ি থেকে চলে যায় না হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
মহাসিন শিকদার আর উপায় না পেয়ে মেয়ে এবং বউকে নিয়ে বের হয়ে এলো ওই বাড়ি থেকে।
রাতের বেলা কোথায় যাবে ভেবে পেলো না।
এখনো কোনো খাবার খাওয়া হয়নি। তার কাছে একটা পয়সাও নেই যে দোকান থেকে কোন খাবার কিনে নিজে খাবে বউ এবং মেয়েকে খাওয়াবে।
তারা অসহায়ের মত একটা মসজিদের বাসে বসে থাকলো।
এই কিছু মুহূর্তের মধ্যেই রাবেয়া শিকদারের সকল তেজ যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেল।
হ্যাঁ মেহেক তো বলেছিল রাবেয়া শিকদারের সকল তেজ মাটির সাথে মিশে দেবে। হ্যাঁ সে ঠিকই বলেছে সে পেরেছে রাবেয়া শিকদারের সকল তেজ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে।
আজ রাবেয়া শিকদার একদম নিঃস্ব হয়ে গেছে।
তার মাথা রাখার মত কোন ঠাইও নেই।
মন্ত্রী বর যখন চাচাতো ভাই পর্ব ১১
কি হতে চলেছে সিকদার পরিবারের সাথে? রেশমার সাথে কি মাতাল ছেলেটির বিয়ে হবে? নাকি তারা আবারো মেহেকের কাছে ফিরবে?
মেহেকের কাছে ফিরলেই কি মেহেক তাদের কাছে টেনে নিবে? তাদের ভাগ্য কি আছে?
