অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১৩
নুসাইবা ইভানা
সকালে বেশ বেলা করে ঘুম ভাঙল নয়নার। ঘুম থেকে উঠে দেখে জাহানারা বেগম নয়নার পাশে বসে আছেন।
“নয়না!” বলল জাহানারা বেগম।
তিনি নয়নাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কপালে, গালে চুমু দিয়ে বললেন, “কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলি মা? আমার কথা না ভেবে কেন হারিয়ে গেলি!”
নয়না জাহানারা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে, এই কয়েক মাসে শুকিয়ে গেছে মানুষটা। নয়না জাহানারা বেগমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিও আম্মু। আমার জন্য তোমার এমন অবস্থা হয়েছে।”
জাহানারা বেগম ছোট বাচ্চাদের মতো নয়নাকে জড়িয়ে রাখলেন বেশ অনেকটা সময়। এরপর বললেন, “তুই উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। তোর জন্য তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি।”
নয়না ফ্রেশ হয়ে খাবারের টেবিলে এলো। তখন বেলা দশটা ছুঁইছুঁই। নয়না চেয়ারে বসে আছে, জাহানারা বেগম নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। খাওয়া শেষ করে রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল—এখনো জিয়ানের ফোনে টেক্সট ডেলিভারি হয়নি। নিজের অজান্তেই নয়নার চোখের কোণে অশ্রু জমা হলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আচ্ছা, মানুষ কি এমনভাবে কারো স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে? যেন কোনোদিন সেই মানুষটা ছিলই না? আমার জীবন থেকে আপনার স্মৃতি, আপনার অস্তিত্ব—আমি এমনভাবে মুছে ফেলতে চাই, যেন আপনি পৃথিবীতে কোনোদিন ছিলেন না। আমার স্মৃতি থেকে আপনার অস্তিত্ব মুছে ফেলতে চাই। কেন পারি না বলুন তো! যত ভুলে যেতে চাই, ততই আপনার স্মৃতি আরো প্রখর হয়ে আমাকে যন্ত্রণা দেয়।”
নীলাঞ্জনা নয়নার পাশে এসে বসল। নয়নার হাতের ওপর হাত রেখে বলল, “আমাকে বল, তোর সঙ্গে কী হয়েছে?”
নয়না বলল, “আমি বাবাকে আর চাচ্চুকে বলতে চাই।”
“ওনারা তো বাসায় নেই, আদালতে গেছেন। আজ কেসের ফাইনাল শুনানি।”
“কিসের কেস?”
“তোকে হত্যা মামলার কেস। আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরী।”
নয়না অবাক হয়ে বলল, “মানে!”
“হুম, এটাই সত্যি। বড় আব্বু পাগলের মতো তোকে খুঁজেছে। এরপর হত্যা মামলা, নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দিয়েছে জিয়ানের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় না জিয়ান হত্যা করতে পারে। তুই তো বেঁচে আছিস, দিব্যি সুস্থ আছিস। তুই গিয়ে সাক্ষী দিলে রেজা হয়ত ফাঁসির হাত থেকে রেহাই পাবে। তুই কি যাবি কেস তুলে নিতে?”
“তোমার এত দরদ উথলে উঠছে কেন! মরুক, আমি সাক্ষী দেবো—যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয় তার।”
“দেখ, রেজা এরকম ছেলে না। ও খুবই ভালো মানুষ। রেজার চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখেছিলাম, তোকে হারানোর ভয় দেখেছিলাম।”
“যে ভালোবাসা আর হারানোর ভয় একসময় নিজের জন্য দেখতে?”
“নয়ন! রেজা তোর হ্যাসবেন্ড, আমার ছোট বোনের জামাই। অতীতের কালো অধ্যায় আমি অনেক আগেই মুছে ফেলেছি।”
নয়না চুপ করে রইল। রাগ হচ্ছে তার। কেন যেন সহ্য হচ্ছে না নীলাঞ্জনাকে। নয়না উঠে নিজের বোরকা বের করে পরে নিল। সাথে সুন্দর করে হিজাব বেঁধে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। থলামুয়ানার দেওয়া টাকাগুলো তার কাছে আছে।
নীলাঞ্জনা নয়নাকে থামাল না। নীলাঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ভালোবাসা সহজ, ভালোবাসার মানুষটাকে ধরে রাখা কঠিন।”
নয়না কোর্টরুমে ঢুকেই বলে উঠল, “জজ সাহেব, আমি জানি কে আসল অপরাধী!”
জজ সাহেব বললেন, “সাইলেন্ট ইন দ্য কোর্ট, প্লিজ। আপনার কিছু বলার থাকলে কাঠগড়ায় এসে বলুন।”
নয়নাকে দেখে জাহিনের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। জিয়ান যেন তার হৃদয়ে শান্তি অনুভব করল। দীর্ঘক্ষণ জ্বলতে থাকা অনলে যেন হঠাৎ তুষারপাত হলো।
নাজিম চৌধুরীও অবাক হলেন বেশ।
নয়না বলল, “ইউর অনার, আমি সুনয়না তালুকদার।”
সবার কানাঘুষা চলছে আদালতে।
অন্তর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। তারপর মনে মনে বলল, “নয়না ভাবি এতদিন পর কোথা থেকে আসল? জাহিনের শাস্তি তো এবার আর সম্ভব না।”
নয়না কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলল, “যাহা বলিব, সত্য বলিব। আমি সুনয়না তালুকদার। আমার হাসবেন্ড জিয়ান রেজা চৌধুরী সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার হারিয়ে যাওয়ার পেছনে পাইলট রেজা চৌধুরীর কোনো হাত নেই।”
জিয়ান মনে মনে এসব কল্পনা করছে—নিশ্চিত নয়না কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এমনটা বলবে। জিয়ানকে অবাক করে দিয়ে নয়না বলল, “ইউর অনার, আমার হ্যাসবেন্ড জিয়ান রেজা চৌধুরী নিজের হাতে আমাকে হত্যা করেছে। আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমি হয়ত এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছি, কিন্তু আমাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছিল।”
জিয়ান চিৎকার করে বলল, “কী বলছ এসব? আমি তোমাকে হত্যা করব? কেন এসব করছ? মিথ্যে কেন বলছ, জান?”
অন্তর দ্রুত এসে বলল, “প্লিজ চুপ করুন। এখন এসব আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন। কোনোভাবেই যেন কেউ না বোঝে এখানে কে আসল জিয়ান। প্লিজ।”
জিয়ান এবার হেসে বলল, “আপনার হ্যাসবেন্ড আপনাকে হত্যা করে আমাকে ফাঁসিয়েছে।”
নয়না সংক্ষিপ্তভাবে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রকাশ করল। সাক্ষী হিসেবে আদালতে উপস্থিত ছিল ঈশান।
সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আসামি জিয়ান রেজা চৌধুরীকে বারো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো।
জিয়ান বলল, “স্যার, দোষ জাহিন করেছে, তাহলে আমি কেন শাস্তি পাব?”
জাহিন বলল, “জজ সাহেব, আমার তো কোনো দোষ নেই, আমি কেন শাস্তি পাব?”
নয়না একবার জাহিনের দিকে, একবার জিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। খালি চোখে এদের আলাদা করার কোনো উপায় নেই।
দুজনেই বলে উঠল, “ভাবি, আমি জাহিন, আমি নির্দোষ, আমার কোনো দোষ নেই।”
নয়না বলল, “আপনাদের মধ্যে জিয়ান কে?”
দুজনেই চুপ।
নয়না সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের মধ্যে জিয়ান কে?”
দুজনে একসাথে বলে উঠল, “আমি জিয়ান।”
নয়না দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “যেকোনো একজন বলুন, জিয়ান কে?”
আবারও দুজনে একসাথে বলল, “আমি জিয়ান।”
নয়না রেগে বলল, “জজ সাহেব, দুজনকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিন।”
এবার দুজনেই চিৎকার করে বলল, “নাহহ! আমি জাহিন।”
“চেহারা এক, দেখে আপনারা কি আমাদের বোকা বানাতে চাচ্ছেন! আমি কিন্তু জাস্ট এক মিনিট জড়িয়ে ধরেই বুঝতে পারব—কে আসল, কে ভুয়া।”
দুজনে একসাথে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “জান, একবার জড়িয়ে ধরো।”
জজ সাহেব হাতুড়ি টেবিলে বাড়ি দিয়ে বললেন, “কী হচ্ছে এসব? এখানে কি শুটিং চলছে! এটা কোর্টরুম। বিহেভ ইউরসেলফ। এই আদালত আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হলো। এর মধ্যে জমজ ভাইয়ের মধ্যে ভেদাভেদ নিশ্চিত করার আদেশ দেওয়া হলো।”
সবাই চলে যেতেই নয়না প্রথমে জাহিনের সামনে এসে বলল, “আপনি কে?”
“আমি তোমার প্লেন ড্রাইভার। জান, আমি তোমাকে হত্যা করব? তুমি কেন মিথ্যে বললে আদালতে?”
নয়না কিছু না বলে জিয়ানের সামনে এসে বলল, “প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাহলে ভালোবাসার নাটক কেন করলেন! ভালোবাসার মানুষের দেওয়া আঘাত মানুষ সহ্য করতে পারে না। আমি কেন বেঁচে ফিরলাম বলুন তো? আমি মরে গেলেই বোধহয় ভালোই হতো।”
জিয়ান নয়নাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমি কোনোদিন তোমার সামান্য ক্ষতি করতে পারব না, সেখানে হত্যা তো প্রশ্নই ওঠে না, বাটার মাশরুম।”
নয়না নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আপনার ভালোবাসার ফাঁদে আমি আর আটকাব না।”
ওপাশ থেকে জাহিন গর্জে উঠল, “ছেড়ে দে আমার নয়নাকে। কোন সাহসে জাহিন আমার নয়নাকে জড়িয়ে ধরার?”
জিয়ান হেসে বলল, “তুই ভালো করে জানিস আমার অধিকার আছে। তুই মাঝখানে আসিস না।”
নয়নার এই প্রথমবারের মতো খটকা লাগল। নয়না দুজনের দিকে তাকাল। কিন্তু সেদিন তো জিয়ানই ছিল। সেই শার্ট, সেই পারফিউম, সেই প্যান্ট, সেই জুতো—সব কি কাকতালীয়? নাকি আমাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে? নয়না জাহিনের সামনে গেল, একদম কাছে। নয়না বলল, “আপনি তো জাহিন।”
জাহিন বলল, “নাহ, আমি জিয়ান।”
নয়না দূরে সরে এল। পুলিশ দুজনকে নিয়ে যাচ্ছে। জিয়ান নয়নার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল—যেন শত জন্ম পর প্রিয়তমাকে দেখতে পাওয়ার তৃপ্তির হাসি। জিয়ানের ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে নয়নার ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁট দিয়ে আঁকড়ে ধরতে।
অর্ধাঙ্গিনী দ্বিতীয় পরিচ্ছদ পর্ব ১২
নয়না সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
মাহবুব তালুকদার এসে বললেন, “তুই কেন এসেছিস আদালতে! তোকে এসব কে বলেছে! আজ চৌধুরীদের একটা উচিত শিক্ষা হতো। তোর জন্য সব ভেস্তে গেল।”
“বাবা, আমি কেস তুলে নেব।”
“মানে! আমি বেঁচে থাকতে তা কোনোভাবেই সম্ভব না। আমার মেয়েকে হত্যা চেষ্টা—শাস্তি তো চৌধুরীদের পেতেই হবে।”
নাজিম চৌধুরী নয়নার সামনে এসে বললেন, “ভালো আছ আম্মু? কোথায় ছিলে এতদিন?”
