The Silent Manor part 29
Dayna Imrose lucky
সোলেমান একবার একচোখার দিকে দেখল। দ্বিতীয়বার সুফিয়ান এর দিকে তাকিয়ে বলল “উনি এমন ভাবে আপনাকে দেখছিলো,যেন ওনার মেয়ের জন্য আপনাকে পছন্দ হয়েছে। অদ্ভুত লোক।”
“অদ্ভুত কর্মকাণ্ড যারা করে বেড়ায় তাঁদের চালচলন ও অদ্ভুতই হবে।”
“অদ্ভুত কর্মকাণ্ড মানে? সোলেমান কিঞ্চিত অবাক চোখে জিজ্ঞাসা করল।
“সেসব জেনে তোর লাভ কি!বাদ দে।বদরু, হাবলু লাল মিয়া ওরা কোথায়?
“ওঁরা সে-ই সকালে ক্ষেতে আসছে।কাজ করছে।”
“আমি ভেজা পোশাক বদলে আসছি।” বলে সুফিয়ান ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। সোলেমান রাঙার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।একটু পরপর ঘাড় উঁচু করে ক্ষেতের দিকে দেখছে।বদরু, হাবলু লাল মিয়া কাজ করছে। সোলেমান ক্ষেতের দিকে গেল।আইলের উপর দাঁড়িয়ে লুঙ্গিটা ভাঁজ করতে করতে ওদের তিনজনের লক্ষ্যে বলল “তোরা এদিকে আয়।কথা আছে।”
বদরুর হাতে বিচ।হাবলুর হাতে কোদাল।লাল মিয়া হাত থেকে জলের কলসি রেখে সোলেমান এর কাছে উপস্থিত হয়।বদরু হাবলু ও আসলো।লাল মিয়া লুঙ্গি কাছা দিতে দিতে বলল “তোরে যে কাজ টা দিয়েছি পারছো সম্পন্ন করতে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সোলেমান নত চোখে বলল “সুফিয়ান আমাদের তো ভালো পথে আনতে চাইছে।চু’রি ডাকা’তি ছেড়ে হালাল কাজে উৎসাহিত করছে।উনি তো খারাপ কিছু করছে না। তাহলে ওনাকে শুধু শুধু মারার দরকার টা কি?
লাল মিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল “ধুর, কিসের ভালো কাজ,এসব ক্ষেত খামারে কাজ করে কয় টাকা পাই, এতদিন চু’রি করলে মেয়ালা টাকা আয় করতে পারতাম।উনি আমাদের ভয় দেখাই রাখছে।এদিক সেদিক করলে জমিদার এর কাছে বিচার দেব, তাঁর আগে ওনার বিচার আমরা করে ফেলি।চল।” বদরু আপত্তি কন্ঠে বলল “দ্যাখ,উনি তো আমাদের সাথে খারাপ কিছু করছে না। শুধু শুধু ওনাকে মারবি কেন। দরকার হয় আমরা তাঁকে বলি,আমরা আর কৃষি কাজ করব না।”
লাল মিয়া বলল “তোর কি মনে হয়,তুই এত সহজে উনার থেকে পার পাবি?উনি এত সহজে আমাদের ছাড়বে না। আমাদের ব্যবহার করছে।তোরা এখনো এসব বুঝলি না।”
হাবলু বলল “আমারও এটাই মনে হয়,উনি আমাদের ব্যবহার করছে। আমাদের দিয়ে ওনার কাজ হাসিল করছে।এখন যদি আমরা বলি আপনার কাজ করব না,তবে উনি জমিদার বাবুর কাছে নালিশ করবে। জমিদার এর ছেলেরা আমাদের কি হাল করবে তা উপর ওয়ালা ভাল জানেন।”
লাল মিয়া পানের পিক ফেলল ক্ষেতের মধ্যে।বলল “জমিদার এর ছেলেরা আমাদের ধরতে পারলে আস্ত রাখবে না।আর ওই সুফিয়ান কে বিশ্বাস নাই। আমাদের কথা যখন তখন বলে দিতে পারে।সে বলে দেয়ার আগেই আমরা ওর জানটা কেড়ে নেই।ব্যস।আর কোন ঝুঁকি থাকবে না।”
সোলেমান বড্ড দ্বিধায় পড়ল। গম্ভীর মুখে বলল “আমার মনটা সায় দিচ্ছে না। সুফিয়ান বড্ড চালাক আছে।মনে হয় না এত সহজে কিছু করা যাবে।”
“শোন, কোন কাজই সহজ না। ঝুঁকি জীবনে নিতেই হয় অন্তত ভালো থাকার জন্য।” লাল মিয়া বলল।
“কাউকে জানে মেরে কেউ ভালো থাকে না।” সোলেমান কথাটা বলতেই ঝড়ের গতিতে এসে লাল মিয়া ওর কলার চেপে ধরল।বলল “তুই কাজটা করবি কি না বল?ভেবে দ্যাখ, চু’রি ডা’কাতি করে কত টাকা আয় করতাম। আর এখন?”
সোলেমান বলল “কিন্তু এই কাজ কিভাবে করব?
বদরু ফিসফিসিয়ে বলল “আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। সুফিয়ান এর দাঁড়ি বড় হয়েছে বলবি।তুই একটা পাত্রে জল নিয়ে তাঁর মুখখানা নিজেকে দেখতে বলে বলবি, আপনার শৌর্য দরকার।এই বলে তাঁকে মাটিতে বসতে বলবি।তুই দাড়ি কামানোর কথা বলে ছু’রিটা যখন গলার কাছে নিবি, তখনই এক টানে তাঁর গলাটা কে’টে দিবি।পারবি না?
সোলেমান মুখে শীতল ভাব এনে বলল “আচ্ছা।”
সোলেমান ছু’রি টা লুঙ্গির ভাঁজে রেখে সুফিয়ান এর বাড়ির দিকে হাঁটল। সুফিয়ান বেশ কিছুক্ষণ হয় ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে।এখনো বাইরে বের হয়নি।রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলল।যেন ও বিপদের আশঙ্কা পেয়েছে।সোলেমান রাঙার শরীরে হাত দিলে রাঙা ছিটকে ওকে এক লাত্থি মেরে ফেলে দেয়।সোলেমান দূরে গিয়ে পড়ে মৃদু আওয়াজ তুলল।রাঙা পুনরায় হ্রেষাধ্বনি তুলল। সোলেমান সুফিয়ান কে খু’ন করতে এসেছে।রাঙা যেন আগে টের পেয়েছে।ও ওর ভাষাতে সুফিয়ান কে সতর্ক করছে। কিন্তু তা পরিপূর্ণ স্পষ্ট নয়। সুফিয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সোলেমান কে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে বলল “তুই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছিস কেন?
“আপনার রাঙা আমাকে লাত্থি মারছে।”
“নিশ্চয়ই ওর শরীরে তুই আদর নয় বরং অন্য কিছুর ইঙ্গিতে হাত রেখেছিস।ওর রাগ উঠেছে আর ও লাত্থি মেরেছে।”
“অন্য কিছুর ইঙ্গিতে হাত রাখা যায়? সোলেমান মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো।
“হুম।রাখা যায়।” সুফিয়ান রাঙাকে আদর করে দিচ্ছে।ও বারবার হ্রেষাধ্বনি তুলছে। সোলেমান তাঁকে হ’ত্যা করতে এসেছে। সুফিয়ান কে বোঝাতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। সুফিয়ান ওকে আদর করলে এক পর্যায়ে রাঙা শান্ত হয়ে যায়।
সুফিয়ান এর পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি।চুল গুলো আর বড় নেই।বাবরি চুল গুলো কেটে ছোট্ট করে ফেলেছে।এতে যেন তাঁর সৌন্দর্য আরো বেড়ে গেছে। সোলেমান সুফিয়ান কে দেখে বলল “আপনি সবসময় সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়েন কেন?
“আমায় সাদা রঙের পাঞ্জাবিতে সুন্দর দেখায়। আমার মা বলেছে। আমার দাদাও সাদা রঙ পছন্দ করতেন। আমারও সাদা রঙ বেশ পছন্দ।”
“আপনার মা ঠিকই বলেছে। আপনাকে সাদা রঙে সুন্দর দেখায়।চুল গুলো ছোট্ট করলেন যে?
“কেন সুন্দর লাগছে না?
“হুঁ,জমিদার জমিদার লাগছে।” সোলেমান হাতে ব্যথা পেয়েছে। কনুইয়ে ছাল উঠেছে হালকা।ক্ষত স্থানটা দেখতে দেখতে বলল “কোথাও যাচ্ছেন।?
“তালুকদার বাড়িতে যাব।আদিব এর সাথে দেখা করতে।”
“আদিব এর সাথে না অন্য কারো সাথে? সোলেমান মাথা নত করে বলল।
সুফিয়ান সোলেমান এর সম্মুখে এসে বলল “অন্য কি কারণ হতে পারে?
সোলেমান দৃষ্টি এলোমেলো করে বলল “আপনার হবু বউয়ের কথা বলছিলাম।”
“একসাথে দুটো কাজই সেরে আসব।”
“দুটো কাজ সেরে আসবেন মানে?” সোলেমান চোখ তুলে প্রশ্ন করল।
“সেসব আমি তোকে বলব না।যা,আজ ওদের সাথে ক্ষেতে কাজে লেগে পড়।যত দ্রুত কাজ
শেষ হবে তোদের জন্যই ভালো।” বলে সুফিয়ান যেতেই সোলেমান পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল “এইভাবে যাবেন! আপনার দাঁড়ি গোঁফ বড় হয়েছে।শোর্য দরকার।”
সুফিয়ান দৃঢ়তার চোখে দাড়িতে হাত বুলাল।ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা পাত্রে জল নিয়ে নিজেকে দেখল। এরপর সোলেমান কে বলল “এখন পর্যন্ত দাঁড়ি গোঁফ ঠিকই আছে।পড়ে আমি ঠিক করে নেব।”
“না,ঠিক নাই। আগামীকাল আমি ঠিক করে দেব।”
“তুই কি নাপিত?
সোলেমান ভেবে বলল “এসব কাজে আলাদা উপাধি লাগে না। দাঁড়ি গোঁফ কাটা সহজ কাজ।”
“আচ্ছা, আগামীকাল কেটে দিস।” বলে সুফিয়ান তালুকদার বাড়ির দিকে রওনা হয়।দূর থেকে একচোখা ব্যক্তি সুফিয়ান কে তীক্ষ্ণ নজরে দেখল।বদরু হাবলু লাল মিয়া দেখল সুফিয়ান সুস্থ সবল অবস্থায় হেঁটে যাচ্ছে। সোলেমান কে ইশারায় ডাকল ওঁরা। লাল মিয়া ওকে জিজ্ঞাসা করল “একি,কাজ সম্পন্ন করলি না কেন? তাঁকে সুস্থ সবল দেখতে চাই নাই। তাঁর গলাটা কে’টে ফেলতে বলেছি।”
“আমিও এটাই চাইছিলাম।কিন্তু সে আগে থেকেই তৈরি হয়ে তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।বলেছে আগামীকাল শৌর্য করতে। আগামীকাল কাজ হয়ে যাবে।”
“আগামীকাল কাজ না হলে কিন্তু তোর গলাটা আমি কে’টে দেব।” বলল লাল মিয়া
সকাল আটটা নাগাদ তালুকদার বাড়ির রঙ যেন পাল্টে গিয়েছে। সূর্যের আলো পড়েছে বাড়ির ছাদে।রেলিং এর ফাঁক থেকে রোদের কড়া ঝিলিক পড়েছে উঠোনে।বেশ ক’জন দাসদাসী কাজ করছে। খামার থেকে গরুর ঘন্টার টুংটাং শব্দ আসছে। অশ্বশালা থেকে বেশ কয়েকবার অশ্বের হ্রেষাধ্বনি ভেসে আসছে।বাড়ির মূল ফটকে দু’জন পাহারাদার নিজেদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হতাশ ভঙ্গিতে কথা বলছে। বিষয়টি লক্ষ্য করেছে জেবুন্নেছা বারান্দা থেকে। তাঁর দৃষ্টিশক্তি বরাবরই কঠিন।কেউ চুপিসারে কথা বললে তিনি ধরে নেন,এই বোধহয় গোপন কিছু হয়ে যাচ্ছে।এমন কিছু যা তার থেকে লুকানো হচ্ছে। সমাজে এরকম অনেক মানুষ আছে যারা আড়ি পেতে কথা শোনে। তথ্য সংগ্রহ করে।যা মোটেই কাম্য নয়।আজ সে বাড়ির মূল ফটকের বাইরে দাঁড়ানো লোক দুটোকে দূর থেকে দেখছে।
রশীদ ঘুম থেকে উঠেছে আধঘন্টার মত হয়।মুখ হাত ধুয়ে ছড়ি হাতে বৈঠকখানায় আসে।সকাল হলেই কুদ্দুস তাঁর ঘরে এক কাপ চা নিয়ে যায়।আজ যায়নি। রশীদ লম্বা কন্ঠে কুদ্দুস কে কালু বলে ডাক দিতেই মনে পড়ে গতকাল রাতে ওকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে। নিশ্চয়ই ও চলে গেছে।সকাল থেকে একবারও ওর দেখা মিলেনি।রশীদ ছড়ি ঠুকতে ঠুকতে কুদ্দুস এর ঘরের দিকে হাঁটল।ওর ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে একটু সময় নিল। যদি কুদ্দুস ঘরের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে! তাহলে সে হেরে যাবে। কুদ্দুস জিতে যাবে তাঁকে রশীদ খুঁজছে বলে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কুদ্দুস এর ঘরে ঢুকল।বেশ পরিপাটি ও সাজানো ঘর।
রশীদ এক স্থানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকাল। কুদ্দুস কোথাও নেই।সে হেঁটে হেঁটে ঘরের চারপাশ দেখল। না। কোথাও নেই ও। রশীদ এর বড্ড খারাপ লাগছে এখন। কুদ্দুস চলে গেছে তো কি হয়েছে,ওর মত হাজার জনকে তার সেবা করার জন্য দাঁড় করিয়ে দেয়া সম্ভব।সে চাইছে না মন খারাপ করতে।তবুও মনটা যেন উদাসীন হয়ে গেল।ওর শোয়ার খাটের উপর বসল। ভাবলেশহীন ভাবে বলল “কালুরে তুই আমায় সত্যিই ফেলে রেখে গেলি।আমিত তোকে একটু বকাঝকাই করতাম।তাই বলে ছেড়ে চলে যাবি।” রশীদ থেমে যায় রুপার ছড়িটা মাটিতে বারবার ঢুকছে।এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল কুদ্দুস এর বালিশের নিচে সাদা পৃষ্ঠার মত কিছু একটা। রশীদ বলিষ্ঠ হাতে পৃষ্ঠা টা বের করে।ভাঁজ করা। ভাঁজ খুলল।দেখল চিঠি। নিশ্চয়ই কুদ্দুস লিখেছে। কুদ্দুস অল্প-স্বল্প পড়াশোনা শিখেছে।লিখতেও শিখেছিল। রশীদ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলাও শিখিয়েছিল। কুদ্দুস লেখালেখি শেখার পর এই প্রথম বোধহয় লিখেছে। রশীদ ছড়িটা পাশে রেখে পড়তে শুরু করল।
প্রিয়
সরদার।
আমি চলে যাচ্ছি।আর কখনো আপনার চোখের সামনে আসব না।আমি চলে গেলেও বা আপনার কি! আমার মতন হাজার ট কালু আপনি জোগাড় করে নিতে পারবেন। কিন্তু মনে রাখবেন আমার মত আর কাউকে পাবেন না।এই দুনিয়াতে বিশ্বস্ত কাউকে পাওয়া কঠিন। কিন্তু সে-ই কঠিন এর মধ্যেই আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করতাম।ভালোও বাসতাম। আপনার সেবা আমি টাকার জন্য না,মন থেকেই করতাম। কিন্তু প্রতিবারই আপনি আমাকে তুরতুর করে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছেন।একটু হলেই আপনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।আজ আমি আপনার কথা রেখেছি। সত্যি সত্যি আপনার বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।ভালো থাকবেন। আপনার শরীরের যত্ন নিবেন। নতুন যে আমার জায়গাটা দখল করবে তাঁকে আপনার ভালো মন্দ সম্পর্কে বুঝিয়ে দিবেন।আর হ্যাঁ আমি আপনাকে বাবার মত ভালোবাসতাম।
ইতি
আপনার কালু
রশীদ চিঠিটা পড়ে কেঁদে উঠল। চোখের কোণে জল জমেছে।না চাইতেও জল গাল বেয়ে পড়ছে। সারাদিন কুদ্দুস এর সাথে কত হাসিঠাট্টা,করত। তাঁর রাগের মাঝে লুকিয়ে ছিল ভালোবাসা।যা কুদ্দুস উপলব্ধি করতে পারেনি। কুদ্দুস কে সে নিজের সন্তানের মতই দেখত। স্নেহ করত। কিন্তু তা একমাত্র রাগ এবং বকাঝকার মধ্যে প্রকাশ করত। রশীদ হাত দিয়ে জল মুছে ফেলল চোঁখের। চিঠিটা হাতের মুঠোয় রেখে কুদ্দুস এর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। চোখের জল মুছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বৈঠকখানায় বসল। না চাইতেও একটা গভীর শ্বাস ফেলল।তখন তাঁর সামনে চা হাজির হয়। খানিকক্ষণ এর জন্য ভেবেছিল কুদ্দুস। কিন্তু না।অন্য কেউ। রশীদ চায়ের কাপ এর দিকে তাকিয়ে আছে।চা হাতে দাঁড়িয়ে শফিক।বলল “বাবু চা নেন।”
“আমার চা চাই না। আজকের পর আমার চোখের সামনে আর আসিস না।”
“এইডা কেমন কথা, কুদ্দুস বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে,অহন আমারই আপনার দেখভাল করতে হইবো।”
রশীদ বিরক্ত স্বরে বলল “বললাম তো,সরে যা আমার সামনে থেকে। দ্বিতীয়বার মুখে বলব না। লাত্থি মেরে সরিয়ে দেব।” শফিক চলে যায়। রশীদ এর মনটা উদাসীন লাগছে। কুদ্দুস নেই।সত্যি সত্যি তাঁকে ছেড়ে চলে যাবে সে ভাবতে পারেনি। তাঁর উদাস মনের ভাগীদার হতে যেন জেবুন্নেছা উপস্থিত হল। রশীদ এর সামনে বসল।মুখে একগাদা পান। রশীদ কে নির্বাক দেখে বলল “কি হয়েছে ভাই,মন খারাপ কেন, কিছু হয়েছে?
“না।তেমন কিছু না।বাকিরা কোথায়? রশীদ প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল।
“বাকিদের কথা বাদ দে।আমার প্রশ্নের জবাব দে,ঐদিন মেলা থেকে পনেরো টা বাচ্চা গা’য়েব হয়েছে,সেসব নিয়ে ভেবে দেখেছিস!আজ আমি জানতে পেরেছি গ্রামে হট্টগোল শুরু হয়েছে।তোর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসল বলে।”
“একটা না দুটো না, পনেরো টা বাচ্চা গা’য়েব। চিন্তার বিষয়।আমি সময় করে দারোগার সাথে কথা বলব।তুই এসব নিয়ে ভাবিস না।দে একটা পান খাই।”
জেবুন্নেছা পান এগিয়ে দিতে দিতে বলল “হুম। পনেরোটা বাচ্চা গা’য়েব।এটা কোন সাধারণ বিষয় না।যত দ্রুত সম্ভব কিছু কর। না জানি দোষ আমাদের ঘাড়ে আসে বাপু।”
“এটা কেমন কথা, দোষ আমাদের ঘাড়ে আসবে মানে,আমরা কি করেছি?”
“আমরাই তো এই গ্রামের জমিদার। কিছু একটা হলে দোষ আমাদেরই হবে।”
“তুই অনেক বেশি কথা বলিস। এইজন্যই বলে নারীরা বরাবরই এক কাঠি উপর দিয়ে চলতে চায়।নারী আর পুরুষের বুদ্ধির অনেক পার্থক্য বুঝলি।”
রশীদ এর মুখে কথাটা শুনতে মোটেই ভালো লাগেনি জেবুন্নেছার।সে মুখ ভেংচে দিল। দ্বিতীয় একটি শব্দ উচ্চারণ করার আগেই সুফিয়ান উপস্থিত হয়। সুফিয়ান রশীদ কে সালাম দিল। রশীদ মৃদু হাসল। এরপর সালামের জবাব দিল।বলল “তোর আদব কায়দা আমার বেশ ভালোই লাগে সুফিয়ান।তা,এই সময়ে এখানে?
“জ্বী,চাচা আদিব এর কাছে এসেছি।ওদিন মেলার পর আর দেখা হয়নি ওর সাথে।তাই..”
“উপরেই আছে হয়ত।যা দেখা করে আয়।” সুফিয়ান সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। জেবুন্নেছা অসন্তুষ্ট হল।সে অসহ্য মুখে বলল “তোর কিছু কাজ কর্ম আমার ভালো লাগে না। সুফিয়ান জোয়ান ছেলে। আমাদের ঘরে একটা যুবতী মেয়ে আছে। হুটহাট যাকে তাকে ঘরের ভেতরে জায়গা দেয়াটা মোটেই উচিত না।কি থেকে কি হয়ে যায় কে জানে।”
“ওকে যাকে তাকে বলছিস কেন, সুফিয়ান বড্ড কর্মমুখর ছেলে।ওর জন্যই আমাদের গ্রামের কৃষি কাজটা এত উন্নত হয়েছে।” বলে রশীদ হো হো শব্দে হেসে উঠল।
সুফিয়ান অন্দরমহল থেকে হাঁটছে আদিব এর ঘরের দিকে।যে পথে এগোচ্ছে সে পথে ফারদিনার ঘর পড়বে।আদিব এর ঘরের আগে ফারদিনার ঘর।ফারদিনা কি করছে এক নজরে দেখবে বলে সুফিয়ান নিশ্চিত করল।
সুফিয়ান ফারদিনার ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।ফারদিনার ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা। সুফিয়ান উঁকিঝুঁকি না মেরে সরাসরি দরজা সম্পুর্ন খুলে ফেলল।ফারদিনা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায়।পরনে কালো রঙের শাড়ি।শাড়ি এমন ভাবে পড়েছে তাঁতে ফারদিনার আবেদনময়ী অঙ্গ দেখা যাচ্ছে।একজন পুরুষ কে আকৃষ্ট করার জন্য এরুপ অভিব্যক্তি যথেষ্ট। তাঁর মুখে উজ্জ্বল হাঁসি।একা একা কেউ হাসে না। তাঁর হাসির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ থাকে। সুফিয়ান বা দিকে হালকা তাকিয়ে দেখল আজমাত ছবি অঙ্কন করছে।ফারদিনার ছবি।আজমাত ফারদিনাকে একটু পরপর নির্দেশনা দিচ্ছে।আর সে সেভাবে শরীরকে ঠিকঠাক করছে।
সুফিয়ান এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তাকে ফারদিনা বা আজমাত কেউই দেখেনি।সুফিয়ান এর প্রচন্ড রাগ উঠছে।চোখ বড় হয়ে গেছে তাঁর। চোখের পাতা যেন থরথর করে কাঁপছে।চোখের মণি সংকুচিত হয়ে গেছে।চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে মুহূর্তেই।কোন দিকে যাবে ঠিক বুঝতে পারল না। দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলল যেন।
নিজেকে কিছুক্ষণ এর জন্য শান্ত করে আদিব এর ঘরের দিকে গেল।আদিব ঘরে নেই। একজন দাসী জানিয়েছে আদিব ছাদে। সুফিয়ান ছাদে গেল।আদিব শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে সিগার ফুকছে। সুফিয়ান এর পায়ের আওয়াজ পেয়ে তাকাল। সুফিয়ান কে দেখে মুখের কোণে হাঁসি এনে বলল “তুই এসেছিস, ভালো হয়েছে।আমি আজকে তোর কাছে যেতে চেয়েছিলাম।নে সিগার টান।”
সুফিয়ান সিগার নিতে চাইল না। কিন্তু মাত্রই যে দৃশ্য সে দেখেছে তাঁর জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।মাথা ঠান্ডা করার জন্য হলেও সিগার দরকার।হাত বাড়িয়ে আদিব এর থেকে সিগারেট নিল।বলল “সেদিন নূরজাহান এর সাথে দেখা হয়েছে?
আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “হয়েছে। ভেবেছিলাম খুব সুখেই আছে। কিন্তু..”
“কিন্তু কি?
“ওর স্বামী একজন যোদ্ধা ছিল।শুনেছি যুদ্ধে মা’রা গেছে।”
“শান্তনা দিসনি?”
“আমি ওর প্রাক্তন হয়ে কি শান্তনা দিতে পারি?
“তোর পথ ফাঁকা। বিয়ে করে নে।”
“কি বলছিস তুই এসব? আব্বা জানতে পারলে শেষ করে ফেলবে আমাকে। একজন বিধবা নারীকে বিয়ে করা তিনি কখনোই মানবেন না।”
“ভালোবাসা ভালোবাসাই হয়, ভালোবাসার মানুষটিকে যদি তাঁর দুঃসময়ে সহায়তা না করে তবে সে কেমন ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসলে নির্দ্বিধায় ভালোবাসতে হয়। টানাপোড়েনে ভালোবাসা হয় না।” সুফিয়ান থেমে আবার বলল “নূরজাহান বিধবা হয়েছে সেটা তোর আব্বার সমস্যা।তোর না।তুই সংসার করবি।তোর আব্বা না।মনে রাখিস,একটি সম্পর্কে পূর্ণতা পেতে কষ্ট করতে হয়।”
“এত বছর পর পূর্ণতা?’ আদিব কিঞ্চিত অসন্তোষ প্রকাশ করল।
সুফিয়ান সিগার এর ধোঁয়া ছেড়ে বলল “ভালোবাসা সত্যি হলে বিচ্ছেদের হাজার যুগ পড়েও পূর্ণতা আসে। পূর্ণতার কোন মেয়াদকাল নেই।”
“তুই বলছিস আমি ওকে বিয়ে করব,এটা ঠিক হবে?আর ও কি রাজি হবে?”
“এই প্রশ্নটা আমাকে না, ওকে কর।ও যদি চায় তবেই তোদের পূর্ণতা মিলবে।”
সুফিয়ান রেলিঙ এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।আদিব তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল “তুই কাউকে ভালোবাসিস না? আদিব এর প্রশ্ন টা সুফিয়ান কে হঠাৎ করে যেন সজাগ করে তুলল।এই প্রশ্নের জবাবে সে কি বলবে?সত্য বলবে! হ্যাঁ,আমি একজনকে ভালোবাসি।আর সে ফারদিনা। বন্ধুর বোনকে ভালোবাসি শুনে ওর প্রতিক্রিয়া ঠিক কি হবে?নাকি মিথ্যা বলবে, না আমি কাউকে ভালোবাসি না। সুফিয়ান মিথ্যা বলতে চাইছে না।ফারদিনাকে সে ভালোবাসে।আর সে ফারদিনার ভালোবাসা নিয়ে জন্য ক্ষুদ্রতম মিথ্যাও বলতে চাইছে না।আদিব সুফিয়ান এর জবাব এর অপেক্ষা করে বলল “চুপ করে আছিস যে?
“হুম। একজনকে ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি।”
“কে সে?
“সময় হলে জানতে পারবি।”
“তাকে নিজের করে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তো? না আবার আমার মত অবস্থা হবে”
“যাকে ভালোবাসি তাঁকে নিজের করে পাব না,এমনটা ভাবতেও কষ্ট হয়।” সুফিয়ান এর মুখটি যেন ধোঁয়াশা হয়ে গেল।আদিব সুফিয়ান কে শান্তনা দিয়ে কিছু বলতে চাইল।তখনই ছাদে ফারদিনা হাজির হয়। সুফিয়ান একবার ফারদিনার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।ফারদিনা আদিব কে বলল “ভাই, আব্বা তোমাকে এখুনি ডাকছে।”
আদিব সুফিয়ান কে লক্ষ্য করে বলল “সুফিয়ান, আমার বোন নাকি আজকাল রত বেড়োতে ঘরের বাইরে বের হয়।প্রেমে পড়ল নাকি তুই জিজ্ঞেস কর দেখ। আমাদের কাছে তো কিছু বলে না।নে তোরা কথা বল।আমি আসছি।” আদিব চলে যায়।
সুফিয়ান মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল দূরে গাছের দিকে।ফারদিনা বেশ মোহময় কন্ঠে বলল “ঝিলমিল তোমাকে দেখেছে।ও বলল তুমি ছাদের দিকে এসেছো।এসে দেখলাম আদিব ভাইকে।আমি মিথ্যে বলে তাঁকে পাঠিয়েছি।”
“অনেক করেছো।এখন তুমি একা একা হাওয়া খাও। আমার কাজ আছে। যেতে হবে।” বলে সিগার টা ফেলে দেয় সুফিয়ান।যেন সবটুকু রাগ সিগার এর উপর ছিল।ফারদিনা বিস্ময়ে বলল “এরকম ভাবে আচরণ করছো কেন?আমি কোন অপরাধ করেছি?
“আমি তোমার সাথে কথাই বলতে চাই না। তোমার মুখ ও দেখতে চাই না।”
“তাহলে আসলে কেন,চলে যাও।” ফারদিনা কথাটা বলতেই সুফিয়ান ছাদ থেকে যেতে চাইল।ফারদিনা কিছুটা অবাক হল।সে বলল আর সুফিয়ান চলে যাচ্ছে!ফারদিনা দ্রুত সুফিয়ান এর পথ আটকে দাঁড়াল।বলল “কি হয়েছে বলবে তো?আমি কোন ভুল করলেও বলো।”
সুফিয়ান ক্রোধের হাতে ফারদিনার দু কাঁধ স্পর্শ করে বলল “তোর চরিত্রের ঠিক নেই। বিদেশি ছেলের প্রতি তোর বেশ টান। উ-লঙ্গ হয়ে আজমাত এর সামনে শুয়ে ছিলিস।কে জানে সবার আড়ালে তুই কি করিস” সুফিয়ান এর চোখের দিকে ফারদিনা তাকাতে পারল না। জলন্ত আগুনের মত তাপ সুফিয়ান এর চোখে ফুটে উঠল। নিকৃষ্ট ভাষার জন্য ফারদিনা কান্না শুরু করলো। হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল “আজমাত আমার ছবি অঙ্কন করছিল।আমিই বলেছিলাম করতে।সে বেশ সুন্দর করে ছবি অঙ্কন করতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই সেসব দেখে ফেলেছো।” ফারদিনার কন্ঠে কান্না।নাক লাল হয়ে গেছে। সুফিয়ান ফারদিনার কান্না সহ্য করতে পারছে না।তুই তুকারি ভাষা ব্যবহার করেছে।ফারদিনার কষ্ট হচ্ছে।সে মানতে পারছে না।রাগটা মাত্রারিক্ত হয়ে গেছে। স্বীকার করল সে।ফারদিনা বলল “তুমি না চাইলে আর তোমার সামনে আসব না।” বলে যেতেই সুফিয়ান ফারদিনার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।ফারদিনা তাঁতে বাঁধভাঙার মত কেঁদে উঠল। সুফিয়ান ফারদিনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল “মাফ কর মেয়ে।তোমাকে ওরকম অবস্থায় দেখে আমার মাথা ঠিক ছিল না। তোমার কান্না আমার হৃদয়ে ছু’রির মত আঘাত করে।”
The Silent Manor part 28
ফারদিনা কান্না থামিয়ে বলল “তুমি এখান থেকে আমাকে নিয়ে চলো। অনেক দূরে দুজনে চলে যাই।”
দুর্ভাগ্যবশত সুফিয়ান ও ফারদিনার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের দৃশ্য দেখে ফেলে বাড়ির নতুন কাজের লোক শফিক। শফিক হা হয়ে তাকিয়ে রইল। শফিক ছাদের মূল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক দেখল ছাদের দিকে রায়ান আর সায়েম বেশ দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছে। শফিক খুশি হল। সুফিয়ান আর ফারদিনাকে এরকম অবস্থায় দেখলে তাঁর ভাইয়েরা হাঙ্গামা তৈরি করবে।বড় ধরনের ঝড় হবে।আর শফিক সেটাই চায়।
