বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯+১০

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৯+১০
রানী আমিনা

“হ্যালো, ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। হ্যুম ড্যু ইয়্যু ওয়্যান্ট?”
“নূরিয়া তাজদিন, রুম থ্রি ট্যুয়েন্টি ওয়ান, বেড ট্যু। ”
কম্যিউনিকেশন রুমের এক কোণায় চেয়ারে বসে থাকা ফিমেইল কল অ্যাটেন্ডেন্ট এমন ভারিক্কি, গুরুগম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে ভড়কে গেলো যেন।
পাশে বসা অন্য ফিমেইল সহকর্মীর দিকে ভ্রু তুলে বিস্ময়ে ঘেরা চোখ তুলে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে সে বোঝালো এবারের ফোন কলের মালিকের অথোর‍্যিটেট্যিভ ভয়েসের গভীরতা।
পাশের জন কৌতুহল দমাতে না পেরে কান এগিয়ে নিয়ে এলো সেই কমান্ডিং ভয়েস শোনার আশায়।

“ক্যান ইয়্যু হোল্ড অন অ্যা স্যাকেন্ড প্লিজ!”
ফিমেইল অ্যাটেন্ডেন্ট ফোনে বলে উঠলো আরেকবার ওপাশের ব্যাক্তিটার ভারিক্কি কন্ঠস্বর শোনার আশায়,
“অফকোর্স, টেইক ইয়ো’ টাইম”
কান এগিয়ে দেওয়া মেয়েটা নিজেও চমকে গিয়ে পাশ ফিরে বিস্মিত নয়নে তাকালো তার সহকর্মীর দিকে। চুপিসারে জিজ্ঞেস করলো,
“নূরিয়া তাজদিন কে?”
“ওইযে, কিছুদিন আগে একটা সাদা চুলের মেয়ে এলোনা পুতুলের মতো দেখতে, ওই মেয়েটা। ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন ফারিশ জাবিনের আত্মীয় হয়।”
চুপিসারে উত্তর করলো অন্যজন।
“দাড়াও, আমি দেখছি। এসব সুন্দরী মেয়েদের শুধু ওই রাজবংশের লাইনেই পাওয়া যায়। বাবারে বাবা, অতোটুকু মেয়ে তার যে রূপের বাহার! এই মেয়ে বড় হলে পঞ্চদ্বীপের সমস্ত ছেলেকে একাই আঙুলে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়েটা কল লাগালো বোর্ডিংয়ের তৃতীয় তলার ফোনবুথে। দুবার রিং হওয়ার পরই কল ওঠালো সেখানে দায়িত্বরত ফিমেইল গার্ড। কল অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটি নূরিয়া তাজদিন কে চাইলো।
বোর্ডিংয়ের থ্রি ট্যুয়েন্টি ওয়ান রুমে খোঁজ পড়লো তখনি, কিন্তু যার খোঁজ পড়লো সে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো সে কথা বলবে না কারো সাথে। ফিমেইল গার্ডটি আরও দুবার কথা বলার জন্য রিকোয়েস্ট করে ফিরে এলো আবার ফোনবুথে। কলে জানালো নূরিয়া তাজদিন তার গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলতে চায়না৷
মীর এতক্ষণ ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো আনাবিয়ার কন্ঠস্বরটা একটুখানি শোনার জন্য, কিন্তু ওপাশ থেকে কল অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটা বিষণ্ণ কন্ঠে জানান দিলো,

“সর‍্যি স্যার, আ’ রিগ্রেট ট্যু ইনফ’ম ইয়্যু দ্যা’ শী ডাজন্ট ওয়ান্ট ট্যু ট’ক ট্যু এন্যিবাডি।”
ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা ডিসকানেক্ট করে দিলো মীর।
নয়দিন হয়ে গেলো মেয়েটা ওর সাথে একটা কথাও বলেনি, একটা শব্দও না। প্রত্যেকবারই হতাশ হয়ে কল কেটেছে মীর। ফারিশও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে আনাবিয়ার সাথে মীর কে একটু কথা বলিয়ে দিতে, কিন্তু আনাবিয়া নিজের জায়গায় অনড়। সে কোনো কথাই বলবে না মীরের সাথে, মরে গেলেও না!
ডিসকানেকটেড হয়ে যাওয়া ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিরাশ ভঙ্গিতে আনাবিয়ার বিছানার ওপর নিজের বলিষ্ঠ শরীরটা এলিয়ে দিলো মীর। তারপর আনাবিয়ার মাথার বালিশটাকে টেনে বুকের ওপর নিয়ে তাতে শব্দ করে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিলো উষ্ণ আলিঙ্গনে।

কামরা ফাকা, প্রাসাদ ফাকা, বুক ফাকা; সবকিছুই যেন আজ ফাঁকা! সারাটাক্ষন রয়্যাল ফ্লোর মাতিয়ে রাখা মেয়েটার সুমিষ্ট কন্ঠস্বর শোনার আর কোনো উপায় নেই। প্রাসাদটা যেন এই অল্পকদিনেই স্থানান্তরিত হয়েছে বায়ুহীন অন্ধকার মহাকাশের শূণ্যে, যেখানে কোনো আওয়াজ নেই, নেই কারো ডাক।
এই নিষ্ঠুর নিরবতা যেন কুরে কুরে খেয়ে চলেছে মীরকে।
সে একটা মুহুর্তের জন্যেও মীরের সাথে কথা বলতে নারাজ। একটা কথাও সে বলবে না, অভিমানের পাল্লাটা ভারী হতে হতে এতটাই গাঢ় হয়ে উঠেছে যে সেখানে মীর প্রবেশই করতে পারছে না!
হামদান মীরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলো বাইরেই, মুখ টা ওর অন্ধকার।
অভিমানী শেহজাদীর সাথে সাথে এই প্রাসাদের সমস্ত আনন্দ উচ্ছাসও ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নিয়ে ওদের সাথে আড়ি করে চলে গেছে কোথাও, হাতড়েও আর তাদেরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মীরের কামরার দরজা ঠেলে বিষাদে পরিপূর্ণ চেহারা নিয়ে বের হয়ে এলো নোমান, ওকে দেখে হামদান এগিয়ে এসে নরম সুরে শুধালো,

“হিজ ম্যাজেস্টি যাবেন না? ওদিকে রয়্যাল মিটিং রুমে সবাই বসে আছে ওনার অপেক্ষায়।”
“হিজ ম্যাজেস্টি শেহজাদীর কামরায় আছেন হামদান। শেহজাদী আজকেও কথা বলেননি ওনার সাথে। হিজ ম্যাজেস্টির মন খুব খারাপ, সারাক্ষণ শেহজাদীর কামরাতেই থাকছেন আজ কয়েকদিন ধরে, নিজের কামরায় ঘুমাচ্ছেন না। রাতে যখন তখন উঠে বারান্দা জুড়ে পায়চারী করছেন, সে তো তুই দেখছিসই!
বেলিন্ডারও খুব মন খারাপ, থেকে থেকে শেহজাদীর জন্য কাঁদছে ও। আমি ওকে স্বান্তনা দিয়ে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছিনারে হামদান।”

বলতে বলতে গলা ধরে এলো নোমানের, চোখের কোণ জোড়া পানিতে ভর্তি হয়ে এলো।
“প্রাসাদ যেন মরুভূমি হয়ে গেছেরে! কেউ আর কথায় কথায় হুমকি দিচ্ছে না আমাকে, কেউ আর বলছে না যে নোমান তুমি আমাকে মীরির কাছে নিয়ে না গেলে তোমাকে বারান্দা থেকে ফেলে দেবো, ছাদে না নিয়ে গেলে রেড জোনে রেখে আসবো, বেলিন্ডার সাথে ঝগড়া করলে ব্যিস্ট স্কোয়াডসের মাঝখানে ফেলে দেবো, হামদানের সাথে চিল্লাফাল্লা করলে গায়ে মাকড়সা উঠিয়ে দেবো!

কেউ আর রাগ করছেনা আমার ওপর, আনন্দ পেলে ঝাকাচ্ছেনা আমাকে, বিরক্ত হয়ে চুল ধরে টানছেনা!
এসব আমি কিভাবে সহ্য করবো হামদান? হিজ ম্যাজেস্টি আমাদের শেহজাদীকে ছেড়ে কিভাবে থাকছেন!”
“মন খারাপ করিসনা নোমান, শেহজাদী আবার ফিরে আসবেনতো কিছুদিন পর। আর খুব মনে পড়লে তোকে নিয়ে আমি কুরো আহমারে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসবো শেহজাদীকে।”
কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল হামদান, শেহজাদীর জন্য যে ওরও বুক পুড়ছে, কিন্তু কাকে বলবে ও!
যেখানে স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টিই তার শিনুর শোকে কাতর সেখানে ও কাকে বলবে নিজের মন খারাপের কথা!
“বেলিন্ডাকেও সাথে নিস হামদান, মেয়েটা খুব কান্না করছে সেদিন থেকে। শেহজাদীর জন্য খুব মন খারাপ ওর!”
“ঠিক আছে ওকেও নিবো, তুই আর মন খারাপ করিস না।”

ওদের কথার মাঝেই শব্দ করে কামরার দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো মীর। মুখ খানা স্বাভাবিকের চেয়েও স্বাভাবিক, যেন ও খুব ঠিক আছে। কিন্তু চোখ জোড়া বলছে ভিন্ন কথা, সেজোড়া বিষণ্ণতায় ডুবে ম্লান হয়ে আছে।
“চলো হামদান, যাওয়া যাক।”
বলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ভারী পা ফেলে সামনে এগোলো মীর। হামদান একবার চকিতে নোমানের দিকে তাকিয়ে দ্রুত গতিতে মাথা নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগোলো মীরের পেছন পেছন।

বোর্ডিং এর তৃতীয় তলার থ্রি ট্যুয়েন্টি ওয়ান রুমের সমান্তরাল ছয়টি বিছানার দ্বিতীয় বিছানার পাশে রাখা টেবিল চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে নিজের পড়া করে চলেছে আনাবিয়া৷
এখন প্রায় মধ্যরাত। কামরার দুজন ঘুমে, অন্য তিনজন এক বিছানায় বসে নিজেদের ভেতর কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করে চলেছে সিরিয়াস ভঙ্গিতে।
বোর্ডিংয়ের ডিসিপ্লিন রক্ষার্থে কোনো কামরাতে একই গ্রেডের দুজনকে কখনো রাখা হয়না। সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে মিশিয়ে প্রতিটা বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার বেড প্লান করে থাকেন।
আনাবিয়ার কামরায় সবচেয়ে সিনিয়র হলো টেন্থ গ্রেডের এভলিন। বর্তমানে তার বিছানাতেই গুরুত্বপূর্ণ শলাপরামর্শ টার আয়োজন করা হয়েছে। তাদের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু আনবিয়া, সাফিয়া এবং ফারিশ।
ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান ফারিশের পেছনে সাফিয়া মেয়েটা গত দুবছর ধরে আদা জল খেয়ে লেগেছে, যেভাবেই হোক ফারিশকে তার চাই।

আর এই ব্যাপারটা ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সমস্ত স্টুডেন্ট এবং টিচার কারোরই অজানা নয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফারিশ কখনো সাফিয়া কে পাত্তাই দেয়নি। কিন্তু এর কারণ টা সকলেরই অজানা।
সাফিয়া কলেজের নামকরা সুন্দরীদের ভেতরের অন্যতম একজন, তার ভিত্তি মজবুত, বাবা কুরো আহমারের ওয়ান অব দ্যা বেস্ট বিজনেইসমেন, অঢেল টাকা পয়সার মালিক।
তারপরও সাফিয়া কেন ফারিশের নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে সেটা কেউই জানতো না।
কিন্তু নূরিয়া তাজদিন নামক মেয়েটা আসার পর থেকে স্টুডেন্টস অ্যান্ড টিচার্স দের ভেতর একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে ফারিশ আর নূরিয়াকে নিয়ে।
তাদের ধারণা ফারিশ এতদিন সাফিয়াকে রাস্তায় পড়ে থাকা জড়বস্তুর ন্যায় ইগনোর করেছে শুধুমাত্র নূরিয়া মেয়েটার জন্য।

নূরিয়ার প্রতি তার কেয়ার, প্রতিটা মুহুর্তে নূরিয়ার বোর্ডিং ম্যানেজারের নিকট থেকে নূরিয়ার সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখা, তার ভালো লাগা খারাপ লাগা সম্পর্কে তটস্থ থাকা এই সমস্ত নজড় কেড়েছে সবার। ফারিশ এর আগে কখনোই কারো জন্য এতটা করেনি, সেটাও আবার মেয়ে।
কিন্তু সাফিয়া মেয়েটা প্রচন্ড ক্ষেপে আছে। সে ফারিশকে পছন্দ করতো ফিফথ গ্রেড থেকে। ফারিশের শরীরে সামান্য হলেও রাজবংশের রক্তের কিছুটা ঝাঝ বিদ্যমান। তার আচার ব্যাবহার, কথাবার্তা, কাজকর্ম বেশ খানিকটা দেমিয়ানদের মতোই যেটা মেয়েদেরকে আরও বেশি করে টানে ওর দিকে।

সাফিয়া শুরুর দিকে ফারিশকে ভয় পেলেও পরবর্তীতে সেই ভয়টা পরিণত হয়ে ওঠে ভালোলাগায়, সেখান থেকে ভালোবাসা, একতরফা! আর এরপর বছর দুই আগে ফারিশকে সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসে সাফিয়া।
কিন্তু ফারিশ সে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেয়, এবং সাফিয়াকে বুঝিয়ে বলে দেয় যেন দ্বিতীয় বার তাকে সাফিয়ার জন্য এই ধরণের কোনো পরিস্থিতিতে না পড়তে হয়।
কিন্তু সাফিয়া সে কথা শোনেনি এবং সে এরপর আর কখনো থামেনি। ফারিশকে এরপর কতশতভাবে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা গোণার বাইরে।

কত শত পাগলামি করে গেছে কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি, ফারিশের সেসবে মন গলেনি।
কিন্তু এত এত পাগলামির পরও ফারিশকে না পাওয়া সাফিয়া বর্তমানে ফারিশের এই কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেনা। নূরিয়ার প্রতি ফারিশের এত্ত এত্ত কেয়ার দেখে মন ভেঙে গেছে ওর, হয়ে উঠেছে আরও বেশি অ্যাগ্রেসিভ।

গত পরশুই নূরিয়াকে স্কুলের সকলের সামনেই থ্রেট দিয়ে গেছে সে। নূরিয়াকে বলে দিয়েছে যত দ্রুত সম্ভব এই স্কুল এবং ফারিশকে ছাড়তে, নয়তো সে এবার যা করবে তাতে নূরিয়ার প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কিন্তু নূরিয়া ওর বলা একটা শব্দকেও গ্রাহ্য করেনি। বরাবরের মতোই চোখ ঘুরিয়ে কোমর দুলিয়ে ঘুরে চলে গেছে, মুখ থেকে পালটা কোনো কথাই বের করেনি!

কিন্তু সাফিয়ার হুমকির পর থেকেই স্কুলের সকলে নূরিয়ার জন্য চিন্তিত, শুধুমাত্র নূরিয়া ছাড়া।
তার কোনো বিকার নেই, রোজকার মতো খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, পড়াশোনা করছে, ফারিশ কল দিলে কথা বলছে। তার ভেতর সামান্যতম ভীতিও কাজ করছেনা। এমনকি সাফিয়ার ব্যাপারেও ফারিশের সাথে তার সামান্য কোনো কথাও হয়নি, সাফিয়ার হুমকিকে পুরোপুরি সাইডে রেখে ফারিশের সাথে কথা শেষ করেছে সে।
এভলিন আর অন্য দুইটা মেয়ে এসবই আলোচনা করে চলেছে চাপা সুরে, আর ক্ষণে ক্ষণে আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে আনাবিয়াকে।

গভীর মনোযোগের সাথে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে পড়ে আছে সে। দুদিন পরই তার উয়্যিকলি টেস্ট, তার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে ও।
এমন সময় কামরায় দরজায় টোকা পড়লো, ওপাশ থেকে তৃতীয় তলার ফিমেইল গার্ডটি বলে উঠলো,
“ নূরিয়া তাজদিন, তোমার ফোন।”
আনাবিয়া পড়া রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে এগোলো দরজার দিকে। এভলিন তাকিয়ে রইলো ওর যাওয়ার দিকে। নূরিয়ার কাছে রোজ দুইটা ফোন আসে, একটা ফারিশ জাবিনের, অন্যটা অজ্ঞাত কারো। নূরীয়া অজ্ঞাত ব্যাক্তির ফোন ধরেনা, কথাও বলেনা। কিন্তু ব্যাক্তিটার ফোন রোজই আসে।
আনাবিয়া কামরা থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দার অন্য কোণায় থাকা ফোনবুথের নিকট এসে ফোনটা কানে ধরলো, কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ফারিশের কন্ঠস্বর শোনা গেলো,

“শেহজাদী!”
“জ্বি রুশি ভাইয়া, কেমন আছো তুমি? গতকাল রাতে তোমার জ্বর জ্বর লাগছিলো বলছিলে, এখন সুস্থ আছো?”
“জ্বি শেহজাদী, আমি সুস্থ আছি। আপনি ভালো আছেন জানি, আপনার ফ্লোরের গার্ডের সাথে দুবার কথা হয়েছে আমার। শুনলাম আপনি সকালের খাওয়া স্কিপ করেছেন আজ, গতকালও করেছিলেন। এগুলো কি ঠিক হচ্ছে? সকালের খাওয়া টা শরীরের জন্য অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ, জানেনতো!”
“জানি রুশি ভাইয়া, কিন্তু পড়া শেষ করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছিলো, ওদিকে ক্লাসে যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় আমি আর খেতে পারিনি, কাল থেকে খেয়ে যাবো সত্যি।”

“প্রমিস?”
“পাক্কা প্রমিস।”
ফারিশ হাসলো, স্নিগ্ধ হাসি। মিষ্টির খনিটার সাথে কথা বলা এখন ওর দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ কোনো একদিন এই স্বরটা না শুনলে হাঁসফাঁস লাগে ওর!
কিছু একটা মনে পড়তেই ফারিশ শুধালো,
“শুনলাম সোফিয়া মেয়েটা সেদিন আপনার সাথে মিসবিহেইভ করেছে! ওকে এতবার সাবধান করার পরও ওর বেপরোয়া ব্যাবহার দিনকেদিন বেড়েই চলেছে। ও কি আপনাকে আর বিরক্ত করেছে শেহজাদী?”
ফারিশের কন্ঠস্বরে তেজ স্পষ্ট। আনাবিয়া বুঝলো সেদিনের ঝামেলাটা সে ফারিশের কানে না তুললেও অন্যরা ঠিকই তুলে দিয়েছে।

“না রুশি ভাইয়া, ও মেয়েটা আর আসেনি। তাকে আমি কতবার করে বুঝিয়ে বলেছি যে তুমি আমার ভাইয়া তোমার সাথে আমার অন্য কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে চায়না। তাই এখন আমিও বোঝানো ছেড়ে দিয়েছি।”
ফারিশ ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা। সাফিয়া মেয়েটা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে, এমন চলতে থাকলে সে এবার ভয়াবহ কোনো স্টেপ নিবে মেয়েটার বিরুদ্ধে।
কিন্তু সাফিয়ার ধারণা একেবারেই ভুল নয়! ফারিশের মন আজকাল আর তার কথা শুনছে না।
বার বার নিজের বেহায়া মনকে বুঝিয়ে চলেছে ওই শুভ্র মেয়েটা অন্য কারো নামে লেখা, কেউ তার জন্মের পর থেকেই তাকে নিজের করে নেওয়ার জন্য আলতো হাতে, সযত্নে, আদরে আদরে বাড়িয়ে তুলেছে। এবং সে ব্যাক্তিটা সাধারণ কেউ নয়, স্বয়ং পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ!

তবে কি হিজ ম্যাজেস্টি জানতেন? তিনি কি জানতেন ফারিশ শেহজাদীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে? তার জন্যই কি শেহজাদীর প্রতি বেশি ঝুকতে মানা করে দিয়েছিলেন তিনি?
ফারিশের কানে বেজে উঠলো মীরের বলা কথাটা, “অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন নেই”
কিন্তু সে তো হিজ ম্যাজেস্টির কথা শোনেনি, শুনতে পারেনি! সে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে এবং ভয়াবহ ভাবে ফেসে গেছে।
ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফারিশ। ওপাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে আনাবিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,

“তুমি ঠিক আছো রুশি ভাইয়া? কথা বলছো না কেন?”
এই নিষ্পাপ আর প্রচন্ড মিষ্টি কন্ঠটা বাড়ি খায় ফারিশের বুকে। এই কন্ঠটা শোনার জন্যই তো চাতক পাখির ন্যায় সমস্ত দিনটা অপেক্ষা করে বসে থাকে ও৷
“আমি ঠিক আছি শেহজাদী, আপনি চিন্তা করবেন না।”
অতঃপর সামান্য বিরতি দিয়ে ফারিস আবার শুধায়,
“হিজ ম্যাজেস্টির সাথে কথা বলবেন না শেহজাদী?”
মীরের কথা মনে হতেই বুক কেঁপে উঠে আনাবিয়ার, ভারী হয়ে ওঠে গলা, টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার নিচের টা ফুলে ওঠে ভেতর থেকে উঠে আসা অভিমানের তোপে! চোখের কোণে বাষ্প জমে দ্রুত গতিতে। কেঁপে ওঠা গলায় উত্তর দেয়,

“না, আমি আর কখনোই কথা বলবোনা ওর সাথে! ও ভালোবাসেনা আমাকে, কষ্ট হয়না ওর আমার জন্য।
হলে কি আর আমাকে এইখানে পাঠিয়ে দিতো ও? আমি এখানেই থেকে যাবো বাকিটা জীবন। কলেজ শেষ হলে আমি জব নেবো অন্যদের মতো। প্রাসাদে আর ফিরবোনা কখনোই।”
ফারিস হাসে, মেয়েটার এত্ত অভিমান! অভিমানে ভরপুর। এই মিষ্টি মেয়েটাকে এইখানে রেখে হিজ ম্যাজেস্টি প্রাসাদে কিভাবে আছেন সেটা ওর মাথায় আসেনা৷
এই মেয়েটা ওর একান্ত ব্যাক্তিগত হলে ও হয়তো সারাটাক্ষন একে বুকের ভেতর ভরে রাখতো, আর কখনোই বের করতোনা!

“এত অভিমান করতে নেই শেহজাদী, বাচ্চাদের এত অভিমান করতে হয়না। অভিমান গিয়ে কোথায় দাঁড়ায় জানেন? মাথার ওপর। মাথায় দাঁড়িয়ে ওরা মাথার ওপর চাপ দেয়, যার অভিমান যত বেশি তার অভিমান তত ভারী। অভিমানের চাপে তারা আর লম্বা হয়না। আপনি যদি এভাবে এত এত অভিমান করেন তবে এখন যতটুকু লম্বা আছেন সেখানেই আটকে যাবেন, আর বাড়বেন না৷ সারাজীবন বাচ্চা থেকে গেলে কি আপনার ভালো লাগবে? আর আপনি বাচ্চা থেকে গেলে হিজ ম্যাজেস্টি বিয়ে করবে কাকে?”
বিয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় আনাবিয়া, অনেক অনেক দিন আগে মীরিকে জিজ্ঞেস করে ফেলা প্রশ্ন টা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে ওর।

বেলিন্ডার কথাতে মীরিকে বর’ কি জিনিস জিজ্ঞেস করে বসেছিলো ও। সেদিন মীরির বলা কথাগুলোর আগামাথা কিছু না বুঝলেও এখন বুঝে, আবছা স্বরণে আসা কথাগুলো মনের কোণে উঁকি দিয়ে ওঠে বারেবার।
আনাবিয়া এখন বুঝতে শিখেছে, আশেপাশের পরিবেশ, মানুষের কথাবার্তা, আচার আচরণের কারণে এখন ও বুঝতে শিখেছে ভালোবাসা ব্যাপারটা কেমন হয়।
সাফিয়া মেয়েটা ফারিশকে ভালোবাসে, ফারিশকে পেতে চায়। ফারিসের পাশে সে কাউকেই সহ্য করতে পারেনা। আনাবিয়াকেও না, বোন হওয়া সত্বেও।
কেমন হতো যদি মীরির পাশে কোনো মেয়ে থাকতো, ও কি সহ্য করতে পারতো? মনের মাঝে কল্পনা করে নিলো আনাবিয়া কিছুক্ষণ।

নাহ দৃশ্যগুলো চোখে দেখা যাচ্ছে না!
মীরির পাশে যদি অন্য কেউ থাকে আর মীরি যদি সেই মেয়েকে ওর মতো করেই ট্রিট করে তবে ও তো সেই মেয়ের ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেবে, একদমই সহ্য করবেনা, একটুও সহ্য করবেনা!
কিন্তু কেন? সে কি তবে মীরি কে ভালোবাসে? সাফিয়া যেমন ভালোবাসে ফারিশকে এমন?
কিন্তু মীরি? মীরি কি ওকে ভালোবাসে? ওর পাশে যদি অন্য কোনো ছেলে এসে দাঁড়ায় তবে মীরি কি করবে? মীরি কি রাগ হবে? মীরির কি তাকে মেরে ফেলতে মন চাইবে?
এখনো পর্যন্ত এমন কোনো ইন্সিডেন্ট না হওয়ায় আনাবিয়া ঠাহর করতে পারলোনা, দ্বিধান্বিত হয়ে ফারিশ কে জিজ্ঞেস করে বসলো,

“রুশি ভাইয়া, মীরি কি আমাকে ভালোবাসে?”
“খুব ভালোবাসেন শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। শিরো মিদোরির প্রাসাদের সবাই আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসে, আপনি যদি জানতেন তারা আপনাকে কতটা মনে করে তাহলে বুঝতেন! সবাই অনেক অনেক ভালোবাসে আপনাকে; জায়ান চাচাজান, আপনার নওয়াস চাচাজান! আমিও আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।”

ফারিশের কথা শেষ হওয়ার আগেই কেউ আনাবিয়ার হাত থেকে এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিলো ফোনটা। আর সাথে সাথেই ডিসকানেক্ট হয়ে কেটে গেলো কল।
ওপাশ থেকে ফারিশ হ্যালো হ্যালো করলো বার কয়েক, কিন্তু এপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ গেলো না৷
আনাবিয়া ঘুরে তাকালো পেছন দিকে। ওর সামনে চোখে মুখে ভয়ঙ্কর ক্রোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাফিয়া। আনাবিয়া বুঝলোনা সাফিয়ার এমন হঠাৎ ক্রোধের কারণ কি। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইলো সাফিয়ার দিকে।
“ফারিশ তোমাকে এই মাত্র কি বলল?”

চাপা হিসহিসে কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো সাফিয়া।
সাফিয়ার কামরা চতুর্থ তলাতে, ও এত রাতে এখানে কি করছে ভেবে পেলোনা আনাবিয়া।
ফারিশের বলা শেষোক্ত কথাটাই যদি শুধু শুনে থাকে তবে সাফিয়া ভুল বুঝছে ওকে। আনাবিয়া কিছুক্ষণ সাফিয়ার ক্রোধে জ্বলে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“বলল যে আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু আপনি যেভাবে ভাবছেন ব্যাপার টা তেমন নয়।”
সাফিয়ার শরীরের সমস্ত কোষে যেন আগুন ধরে উঠলো আনাবিয়ার কথায়। আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে দাঁত খিচিয়ে ও উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

“তুমিই না বলেছিলে ফারিশ তোমার শুধুমাত্র ভাই হয়, এর বাইরে তার সাথে তোমার আর কোনো ধরণের সম্পর্ক নেই! তবে ও কি বলল একটু আগে তোমাকে? এই তবে তোমার আসল চেহারা! নিষ্পাপ চেহারার আড়ালে এমন নিকৃষ্ট চরিত্র পুষে রাখো?”
আনাবিয়া বুঝলো সাফিয়ার মনের অবস্থা। কিন্তু এতরাতে এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলাটা ও মানতে পারলোনা, আগের মতোই শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“আপনি চিৎকার করছেন কেন? আমি তো বলেছি আপনি যেমনটা ভাবছেন সেরকম কিছুই নয়। রুশি ভাইয়া কথার কথা বলেছেন। আপনি যেমন ভাবছেন তেমন মিন করে কিছুই বলেননি। রাতের বেলা সবাই ঘুমাচ্ছে আপনি এভাবে চিৎকার চেচামেচি করে কোনো সিন ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ।”

ইতোমধ্যে সোফিয়ার উচ্চস্বর শুনে উৎসুক অনেকেই বের হয়ে এসেছে কামরা থেকে। আর বের হয়ে সোফিয়া আর আনাবিয়া কে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যাপার টা আঁচ করতে তাদের বেগ পেতে হয়নি। কাহিনী দেখার জন্য অনেকে ঘুমন্ত ব্যাক্তিবর্গ দের ঘুক থেকে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসছে বারান্দায়।
“আমি সিন ক্রিয়েট করছি? আমি? আমার সিন ক্রিয়েট করা উচিত নয়কি? তুমি সেদিন না আমাকে নিষ্পাপ গলায় বললে যে ফারিশের সাথে তোমার ভাইবোন ছাড়া আর অন্য কোনো সম্পর্ক নেই, তবে ফারিশ এখন এ কথা কেন বলল? কেন বলল যে সে তোমাকে ভালোবাসে?”

সাফিয়ার শেষোক্ত কথা শুনে আশেপাশে দাঁড়ানো মেয়েরা শিউরে উঠলো, তলে তলে তবে জল এতদূর গড়িয়ে গেছে অথচ ওরা কখনো টেরই পায়নি! ফারিশ আর নূরিয়া তবে পাকাপোক্তভাবে রিলেশনশীপে আছে! এবার তো সাফিয়া কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে।
আশেপাশে সকলের চাপা উৎকন্ঠা আর ফিসফিসিয়ে করা আলোচনা কান এড়ালোনা আনাবিয়ার। কিন্তু এসবের সময় নেই ওর এখন, ওর এক্সাম দুদিন পরেই। এখন এসব কাহিনী করতে গেলে ওর চলবে না।

“এ বিষয়ে আমি আপনার সাথে আগামীকাল কথা বলবো সাফিয়া, আপনি এখন আপনার জায়গায় ফিরে যান প্লিজ। এত রাতে সকলের এন্টারটেইনমেন্টের বিষয় হতে আমি মোটেই ইচ্ছুক নই।”
বলেই ফোনবুথ থেকে বের হয়ে নিজের কামরার দিকে যেতে নিলো আনাবিয়া। কিন্তু সাফিয়া কে পার করে যেতে পারলোনা ও, তার আগেই ওর হাত ধরে আটকে দিলো সাফিয়া।
“আদেশ দিচ্ছো তুমি আমাকে? এই সাফিয়া জাফরকে তুমি আদেশ দিচ্ছো?”
“আদেশ দিচ্ছিনা, সিচুয়েশন বোঝাচ্ছি।”

সোফিয়া এক টানে আনাবিয়াকে আবার নিজের সামনে টেনে নিয়ে এলো, তারপর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
“সিচুয়েশন এবার আমী তোমাকে বোঝাবো! সিনিয়রকে অসম্মান করার মূল্য আজ তোমাকে আমি হাড়েহাড়ে বুঝিয়ে দেবো।”
বলেই আনাবিয়াকে কিছু বলতে না দিয়েই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো কোথাও।
আনাবিয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলোনা ভুলেও, এখন ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গেলেই সাফিয়া টের পেয়ে যাবে যে ও সাধারণ কেউ নয়।

বিনা বাক্যব্যায়ে সাফিয়ার পেছন পেছন এগোলো আনাবিয়া।
গার্ড এসে একবার বাধা দিতে গেলো সোফিয়াকে, কিন্তু সোফিয়া সে বাধার বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এগোলো নিজের গন্তব্যের দিকে।
ইতোমধ্যে আশেপাশের রুম থেকে হল্লা শুনে বের হয়ে এসেছে অনেকেই, তারা সকলেই দেখছে আনাবিয়াকে নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু সোফিয়াকে কিছু বলার মতো সাহস করলোনা কেউ, চুপচাপ দেখে গেলো।
তৃতীয় তলা থেকে আনাবিয়াকে টানতে টানতে সিড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে একসময় বিল্ডিংয়ের ছাদে নিয়ে গেলো সোফিয়া। তারপর ছাদের মেঝেতে আনাবিয়াকে এক ধাক্কায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে চাপা গর্জনের সাথে বলে উঠলো,
“ফারিশ আমার, আর অন্য কাউকে আমি ফারিশের ভাগ দিবোনা কখনোই। তোমাকে অনেক বার সাবধান করেছি কিন্তু তুমি আমার কথা কানে তোলোনি।

আজ রাতটা এই ছাদেই কাটাবে তুমি। সকাল হওয়া পর্যন্ত সুস্থ সবল থাকলে আগামীকাল তোমার সাথে এই বিষয়ে কথা বলবো, আর আগামীকালই তোমার ভাগ্য নির্ধারণ হবে, হয় তোমাকে এই স্কুল ছেড়ে দিতে হবে নয়তো নিজের প্রাণ। কথাটা মাথায় রেখো।

আর নিজের এই দুর্গন্ধযুক্ত চরিত্রটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করো। এভাবেই যদি নিজের রূপ দেখিয়ে পুরুষ মানুষের মাথা খেতে থাকো তবে আর কিছুদিন পর থেকে অন্যের ভালোবাসার মানুষকে ফুসলিয়ে, রূপের লোভ দেখিয়ে নিজের করে নেওয়ার অপরাধে রাস্তার লোকজন তোমাকে বে*শ্যা বলে ডাকা শুরু করবে।”
কথাগুলো বলেই সাফিয়া সিড়িতে নেমে ধাম করে ওপাশ থেকে ছাদের দরজা লাগিয়ে দিয়ে প্রস্থান করলো সেখানে থেকে। আর আনাবিয়া স্থীর হয়ে গেলো সোফিয়ার শেষোক্ত বাক্যটা শোনা মাত্রই।

রাতের শেষ প্রহরের কেবল শুরু। কুরো আহমার জুড়ে শীতকালীন শীতল বাতাস বয়ে চলেছে শো শো করে। বোর্ডিং জুড়ে নিস্তব্ধত, নিজেদের ডুভেটের উষ্ণ ওমে শরীর ডুবিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে আছে সকলে।
বোর্ডিংয়ের ছাদের ঠান্ডা মেঝেতে অসাড় হয়ে শুয়ে আছে আনাবিয়া। বয়ে চলা ঠান্ডা বাতাসের হিমশীতল স্পর্শে লাল হয়ে আছে ওর নাক আর চোয়াল।
প্রচন্ড জ্বরে বসা থেকে ঢলে পড়েছে ও মেঝেতে। শরীরে জ্বরের কারণে হওয়া উষ্ণতাটা বয়ে চলা শীতল বাতাসের কাছে টিকে থাকতে পারছেনা। কনকনে ঠান্ডা বাতাসটা ওর শরীরের উষ্ণতা গুলোকে শুষে নিয়ে বয়ে চলেছে কোনো দূর অজানায়!
জ্বরের ঘোরে চেতনা লুপ্ত হওয়া আনাবিয়া অস্ফুটস্বরে, আকুল কন্ঠে একবার ডেকে উঠলো,

“মীরি!”
শিরো মিদোরির প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের রাজকীয় খাস কামরার পাশের কামরাটার সমুদ্রের ঝিনুকের খোলসের ন্যায় আকৃতির বিছানায় নরম, উষ্ণ উলের চাদরের নিচে ঘুমিয়ে থাকা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিষণ্ণতায় ডুবে থাকা মীরের কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলো কারো অস্ফুটস্বরের আহবানে।

জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মন্থর গতিতে হেটে চলেছে মীর। ওর ঘাড়ের ওপর বসে চারপাশের জঙ্গল টা মুগ্ধ নয়নে দেখে চলেছে আনবিয়া।
জঙ্গলের এই জায়গাটা অত্যাধিক মোহনীয় সুন্দর হওয়ায় আনাবিয়াকে এই অপূর্ব, মনোরম সৌন্দর্য দেখানোর জন্য নিজের গতি ধীর করে নিয়েছে মীর। আর আনাবিয়া বিস্মিত নয়নে দেখে চলেছে চারপাশ টা।
রাতের আকাশটাতে যেন কেউ গাঢ় নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে, তার মাঝে অসংখ্য হীরের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে তারার দল।

জঙ্গলের মাঝে চাঁদের আলো রুপালি কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। চাঁদের উপচে পড়া আলোয় গাছের পাতাগুলো ঝলমল করে উঠছে।
জঙ্গল জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক গভীর নীরবতা, কেবল হালকা বাতাসের সাথে মিশে দূর থেকে ভেসে আসছে জলের কলকল শব্দ। চারদিকে যেন জুড়ে আছে এক মায়াবী ঘোর।
বিশাল বিশাল রেডউড গাছগুলো যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে—তাদের পাতাগুলোয় জ্বলছে নীলাভ আলো, যেন তারা নিজেরাই হয়ে উঠেছে একেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্র ।
গাছগুলোর কাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ আর সোনালি রঙা মস, ডালপালা গুলো বেঁকে গেছে অদ্ভুতভাবে, সেগুলো থেকে ঝুলে আছে হালকা নীলাভ আলোর লতা, যেন আকাশের তারা চুরি করে এনে তাদের শরীরে খোদাই করে দিয়েছে কেউ।

জঙ্গলের মেঠোপথটি সাদা বালিতে ঢাকা, আর তার দু’পাশে ফুটে আছে নীলাভ আলোতে ঝলসানো ফুল। মাটি জুড়ে ফুটে আছে ছোট ছোট ফুলের ঝাড়, প্রতিটা ফুলের পাপড়ি যেন মোমবাতির শিখার মতো আলোকিত। ফুলগুলো থেকে ভেসে আসছে মৃদু সুগন্ধী যা বাতাসকে করে তুলেছে আরো রহস্যময়।
আশেপাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে মাঝে মাঝেই উঁকি দিচ্ছে কিছু রহস্যময় অদ্ভুত প্রাণী—যাদের নিশাচর চোখ গুলো জ্বলছে হীরের মতো।
শিরো মিদোরির পরাক্রমশালী বাদশাহ আর তার কাধের ওপর বসা ঝকমকে শেহজাদীকে মুগ্ধ, কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখে চলেছে তারা।

হঠাৎই ওদের আশেপাশে থাকা ঝোপঝাড় গুলোকে সচকিত করে দিয়ে সেগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক ঝাক সাদা হরিণ, নীল রঙা উজ্জল আলো ঠিকরে পড়ছে তাদের শিং গুলো থেকে।
নিজেদের কাজল কালো অনিন্দ্য সুন্দর চোখ জোড়া দিয়ে মীর আর তার কাঁধে বসা আনাবিয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে ধীরে সুস্থে তারা চলতে লাগলো ওদের সামনে সামনে—যেন এই দুই অত্যান্ত আকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তিকে পথ দেখিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছে তারা৷
ওদের আশপাশ জুড়ে ঘুরেফিরে বার বার উড়ে চলেছে একঝাঁক ছোট্ট নীল রঙের প্রজাপতি, স্ফটিকের ন্যায় ঝিকিমিকি করতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণারা ছড়িয়ে আছে ওদের ডানা গুলো জুড়ে। ডানার প্রতিটা ওঠানামায় ঝলমল করে উঠছে সেগুলো।

মাঝেমধ্যেই জঙ্গলের অন্ধকার মাটির ওপর দিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে চলেছে ময়ূরের মতো রঙিন লেজ ওয়ালা এক দল ছোট্ট প্রাণী, চাঁদের চকচকে আলো পড়ে বারবার বদলে যাচ্ছে তাদের লেজের উজ্জ্বল রঙের বাহার। কখনো সবুজ, কখনো বেগুনি আর কখনো বা সোনালি রঙে। কোনো এক অজানা, অদ্ভুত সুরে গান গেয়ে চলেছে তারা!
ঝোপঝাড়ের ওপর দিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সোনালি ডানার ছোট্ট পরীর মতো একঝাঁক প্রাণী।
আনাবিয়া কে দেখে নিজেদের জায়গা থেকে উড়ে এসে আনাবিয়ার শুভ্র কেশগুচ্ছকে নিজেদের ডানার ঝাপটানিতে তৈরি হওয়া মৃদু বাতাসে নাড়িয়ে দিয়ে আনাবিয়াকে বারবার ছুয়ে দিতে লাগলো ওরা। আনাবিয়াকে স্পর্শ করতে পারার আনন্দে ওদের সমস্বরে হাসি যেন সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিতে লাগলো চারদিকে।

কিন্তু আনাবিয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে আজ আর রেগে গেলো না, উলটো মজা পেলো অনেক। খুশিতে এক হাতে মীরের চুল গুলো খামচে ধরে পড়ে রইলো, অন্য হাত দিয়ে ছুয়ে দিতে লাগলো ছোট্ট প্রাণি গুলোকে।
পরী সদৃশ প্রাণী গুলো এসে বসলো ওর শরীরের ওপর, কেউ ওর মাথায়, কেউ ওর কাধে কেউ বা ওর হাতের ওপর।
খু্‌শিতে নির্মল হাসলো আনাবিয়া। ওর আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো মীর নিজেও।
জঙ্গলের মাঝ বরাবর আর একটু এগোতেই আনাবিয়ার চোখে পড়লো একটা চওড়া, গভীর খাদ। খাদের কিনার জুড়ে বয়ে চলেছে ছোট খাটো একটি জলপ্রপাত, ঝমঝম শব্দ তুলে সেখান থেকে জল গড়িয়ে খাদের তলদেশে পড়ছে মুক্তার মতো সাদা কণায়।

জলপ্রপাতটার চারপাশে তৈরি হয়ে আছে রঙিন ধোঁয়ার মতো মায়াবী কুয়াশা। সেখানে পানির প্রবাহের ওপর দিয়ে হাওয়ায় উড়ে পরম আনন্দে নেচে চলেছে এক ঝাঁক লাল ডানা বিশিষ্ট পাখি। তাদের পাখনার অনবরত ঝাপটায় জেগে উঠছে আভিজাত্যের রংধনু।
জলপ্রপাতের পানি গিয়ে জমা হচ্ছে খাদের পাদদেশে থাকা একটি স্বচ্ছ হ্রদে। হ্রদের উপর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এক ঝাক সাদা ডানার হংসরাজ, তাদের চলায় পানিতে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ, চাঁদের আলোর প্রতিফলনে রুপালি রঙে ঝলমল করে উঠছে ঢেউ গুলো।

জঙ্গলে জুড়ে গোলুমোলু সাইজের এক ঝাক জোনাকি মিটিমিটি আলো জ্বালিয়ে জঙ্গলটাকে আরও মোহনীয় করে তুলেছে—যেন অজস্র ছোট ছোট প্রদীপ, যা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে কোনো অদেখা প্রান্তরের দিকে। দূর থেকে ভেসে আসছে কোন অচেনা রাতের পাখির সুরেলা ডাক, যেন রাতের মায়ায় মিশে থাকা এক নিঃশব্দ প্রেমের বার্তা!
আনাবিয়া হা হয়ে দেখছে সবকিছু। জঙ্গলের এতটা গভীরে মীরি ওকে এর আগে কখনোই নিয়ে আসেনি। রেড জোন যে এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর হবে তা ও ভাবেনি কখনোই।
মুগ্ধ, বিস্মিত নেত্রে; হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়ার উজ্জ্বলতা আরও এক ধাপ বাড়িয়ে ও দেখে চলেছে সবকিছু।
মীর আনাবিয়ার এই মুগ্ধ দৃষ্টি খেয়াল করে স্নিগ্ধ কন্ঠে শুধালো,

“কেমন লাগছে শিনু তোমার?”
“অনেএএক ভালো! তুমি আমাকে এখানে আগে কেন নিয়ে আসোনি মীরি?”
আনাবিয়ার কন্ঠে বিস্ময়, চোখে মুগ্ধতা। মীরের গলা থেকে হাত জোড়া এখন মীরের ঘাড় বাবরি ঝাকড়া চুলে এসে পৌছেছে। দুই হাতে দুপাশ থেকে চুল গুলো খামচে ধরে আছে ও।
জায়গাটা পার হয়ে আরও সামনে গেলো ওরা। এখান থেকে জঙ্গলটা হঠাৎই ঘন হতে শুরু করেছে। মীর বলে উঠলো,
“অ্যানিম্যাল টাউনে আমরা প্রায় চলে এসেছি শিনু। তুমি আর একটুখানি অপেক্ষা করো।”
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মীরের চুল ছেড়ে দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরলো আবার। তারপর নিজের মাথাটা এলিয়ে বিশ্রাম দিলো মীরের মাথার ওপর।

“ঘুম আসছে শিনু তোমার?”
মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল মীর। আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই হঠাৎ করে মাথা তুলে শুধালো,
“নোমানের কিয়া নাই মীরি?”
মীর তব্দা মেরে গেলো। খচ্চরটা এখনো মনে রেখছে সেই কথা। হামদান যে কেন ফট করে ওই কথা বলতে গেলো! মনে মনে হামদানের উদ্দ্যেশ্যে একটা কঠিন গালাগাল দিয়ে মীর উত্তর দিলো,
“সবই আছে শিনু, শুধু স্নেইকটা নেই।”
শেষোক্ত বাক্যটা চাপা গলায় বলল মীর। বলে নিজেই নিজের কথা শুনে মনে মনে কপাল চাপড়ালো ও। কি বলতে গিয়ে কি বলে দিলো!

চাপা গলায় বললেও অ্যানার কান এড়ালোনা কথাটা। কৌতুহলী গলায় ও শুধালো,
“স্নেইক! স্নেইক দিয়ে কি করে? তোমরা ছেলেরা স্নেইক পালো নাকি?”
মীর এবার চরম অনুশোচনায় ভুগলো। শুধু শুধু হামদানকে দোষ দিলো, ওর নিজেরও তো এখন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
প্রাসাদে ক্যাস্ট্রেটেড গার্ড অনেক গুলো থাকলেও তাদের বেশিরভাগ অন্দরমহলেই থাকে।
তাদের ভেতর থেকে শুধুমাত্র নোমান রয়্যাল ফ্লোরের সাথে সংযুক্ত, পুরুষদের মাঝে ওর যাতায়াত আর তাই ওকে নিয়ে রয়্যাল ফ্লোরে আসা পুরুষ অতিথি দের ভেতরে সারাক্ষণ মজা মাস্তি চলতেই থাকে, সেখানে মীর নিজেও অংশগ্রহণ করে ফেলে মাঝে মাঝেই।
যদিও নোমান এই ব্যাপারটা নিয়ে একদমই খুশিনা, কিন্তু সেখানে বরাবরই নোমানের স্নেইক খোয়া গেছে বলে ওকে খোচানো হয়।

আর আজ ওই খোচাখুচির জের ধরেই ভুলবসত মুখ ফসকে ‘স্নেইক’ শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলেছে মীর। এখন এই মেয়ে যে কদ্দুর টেনে নিয়ে যাবে সেটাই দেখার বিষয়!
কিন্তু আনাবিয়ার প্রশ্নটা মনে করে মীরের এবার হঠাৎ করেই হাসি পেলো প্রচন্ড। প্রচন্ড কষ্টে মুখে ফুটে ওঠা হাসিটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে গলা খাকারি দিয়ে ও বলে উঠলো,
“এসব কথা এখন থাকুক শিনু, তুমি পরে একদিন শুনিও।”
কিন্তু আনাবিয়া নাছোড়বান্দা! সে মীরকে হুমকি দিয়ে বলে উঠলো,
“এখনি বলো, নইলে কিন্তু আমি নেমে যাবো মাটিতে। তারপর গড়াগড়ি করবো।”
মীর ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে নিজেকে সিরিয়াস করে নেওয়ার প্রয়াস করতে করতে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“জিদ কোরো না শিনু, পরে একদিন বলবো তোমাকে।”
“না এখনি, নইলে কিন্তু নামলাম”
সাপের মতো এঁকেবেকে, পা দুইটা গাইগুই করতে করতে নিচের দিকে কিছুটা নেমে এলো আনাবিয়া। মীর ওকে দু হাতে দ্রুত নিজের পিঠের সাথে চেপে ধরে বলল,
“একদম নামবেনা, পায়ে জুতা নেই তোমার কাঁদা মাটি লেগে যাবে। চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকো ”
“তাহলে বলো!”
” হু, আমরা স্নেইক পালি। আর কোনো প্রশ্ন নয়, চুপ থাকো এখন।”
কথা টা বলেই মীর ঠোঁট টিপে হাসলো। হঠাৎ করেই অদ্ভুতভাবে লজ্জা লাগছে ওর। এর আগে কোনোদিন কোনো কারণে ও কখনো লজ্জা পেয়েছে কিনা ওর মনে পড়ে না। কান দুটো গরম হয়ে উঠছে নাকি? কপালে ঘামও আসতে শুরু করেছে, এ কি বিপদ!

মীরের উত্তরে তবুও সন্তুষ্ট হলো না আনাবিয়া। বরং গলার স্বরে তেজ মিশিয়ে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি স্নেইক পালো সেটা আমাকে আগে কখনো বলোনাই কেন?”
মীরের এবার ভয়ানক হাসি পেলো। জঙ্গল কাপিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো ও। ওর হাসিতে আশেপাশের ঘুমন্ত পাখিগুলো হতচকিত হয়ে ঝাপাঝাপি করে উঠলো, একটা পাখি গাছের ডাল থেকে ধাম করে পড়ে গেলো মাটিতে। মাটিতে পড়েই ধড়মড় করে জেগে উঠলো পাখিটা, তারপর সে কোথায় আছে, কিভাবে এখানে এসে পড়লো সেটা বুঝতে না পেরে কয়েক সেকেন্ড একজায়গায় ফেলে চক্কর দিয়ে অতঃপর কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে স্ট্যাচুর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। সেটা দেখে মীরের আরও হাসি এলো।

মীর এবার ওর উচ্চ হাসিটা থামানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,
“সময় হলে ঠিকই জানতে পারতে শিনু। কিন্তু তুমি তো সবকিছুতে অ্যাডভান্স, তোমার তো দেরি সহ্য হয় না। এখন চুপ করো আর কোনো প্রশ্ন করবে না।”
মীরের মুখ থেকে হাসিটা সরছেই না—নিঃশব্দ মিচমিচে হাসিতে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হয়ে আছে ওর৷
আর কয়েকপা এগোতেই দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হলো একটা বিরাট বিশাল লৌহ নির্মিত প্রবেশ পথ, উঁচু প্রাচীর ঘেরা একটা বিরাট এলাকা।
প্রবেশদ্বারের দু পাশে দাউদাউ করে জ্বলছে দুইটা বিশাল মশাল, তার উপরিভাগে বড়বড় অক্ষরে লেখা ‘অ্যানিম্যাল টাউন’।

মীর হাস্যোজ্জ্বল চোখে সেদিকেই পা বাড়ালো।
পেছনে বসা আনাবিয়ার মাথায় এখনো স্নেইকই ঘুরছে। কৌতুহলী কন্ঠে সে মীরের হৃষ্টপুষ্ট গলাটা আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুধালো,
“তুমি কোন স্নেইক পালো মীরি?”
এতক্ষণের নিভে যাওয়া হাসিখানা এবার ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুর্ণি পাকিয়ে উঠে আসতে চাইলো মীরের গলা বেয়ে। কিন্তু মীর কোনোরকমে ঠোঁট চেপে হাসির দমকটাকে আবার পেছনে ঠেলে নামিয়ে দিয়ে গলা খাকারি দিয়ে উত্তর দিলো,
“কিং সাইজের কিং কোবরা পালি। আর কোনো প্রশ্ন নয়, একদম চুপ। আমরা অ্যানিম্যাল টাউনে এসে পড়েছি।”
মীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে আনাবিয়া তাকালো সামনের দিকে। আলো জ্বলছে সেখানে।
দূর থেকে স্বর্ণোজ্জল চোখের অধিকারী সুদীর্ঘ, সুঠামদেহী ব্যাক্তিটিকে লক্ষ্য করে প্রবেশদ্বারের আশেপাশে দায়িত্বরত গার্ড গুলো তড়িঘড়ি করে ছুটে এসে আনুগত্যের সাথে সাদর অভিবাদন জানালো ওদেরকে, আর তারপর শেহজাদীর প্রথমবার অ্যানিম্যাল টাউনে আগমন উপলক্ষ্যে হুলস্থুল পড়ে গেলো সমস্ত অ্যানিম্যাল টাউন জুড়ে।

ঘুম ভাঙতেই কোনো অজানা কারণে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো মীরের। ধড়মড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো ও বিছানায়, চোখের সামনে ভেসে উঠলো আনাবিয়ার শুভ্র, নিষ্পাপ মুখোশ্রি।
হঠাৎ করেই আনাবিয়াকে দেখতে চাওয়ার প্রচন্ডরকম তৃষ্ণায় গলা বুক শুকিয়ে আসতে শুরু করলো ওর। আচমকা এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ অনুধাবন করতে পারলোনা মীর।
নিমিষেই হৃদয় জুড়ে এক অজানা, অপ্রত্যাশিত ঝড় উঠলো ওর, শ্বাসরোধ হয়ে আসতে লাগলো যেন!
ঝটপট বিছানা থেকে নেমে এলোমেলো, দ্রুত পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো ও, তারপর বাইরের বরফশীতল বাতাস বুকের ভেতর টেনে নিতে শুরু করলো নিজের সমস্তটা দিয়ে।
হামদান পাশেই ছিলো, রাত অনেক হওয়ায় ঝিমুনি চলে এসেছিলো ওর। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ শুনে ঘুম উড়ে গেলো হামদানের।

এই পায়ের শব্দ ওর চেনা, খুব চেনা। কিন্তু এই ভারী পদধ্বনি জোড়ার মালিক এমন দ্রুত বেগে খুব কমই পা ফেলেন।
তার ধীর গতির পদক্ষেপের প্রতিটা ফেলেন অত্যান্ত সাবধানে, যেন নিচে থাকা বিপদকে সকলের অগোচরে পিষে ফেলে সামনে এগিয়ে যান যাতে সেই বিপদের আঁচটুকু পর্যন্ত তার কাছের মানুষ গুলোর শরীরে না লাগে।
সেই ধীর গতির ব্যাক্তিটার এমন দ্রুত গতিতে বিচলিত হয়ে উঠলো হামদান। সচকিত হয়ে উঠে তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে এগিয়ে গেলো মীরের দিকে।
মীরের চোখ জোড়া বন্ধ, নাক দিয়ে বরফশীতল বাতাস টেনে নিয়ে ঠোঁট গোল করে ভেতরের উদ্বিগ্নতা মিশ্রিত গরম বাতাস বের করে দিচ্ছে সে শিরো মিদোরির বুকে।
হামদান এগিয়ে গিয়ে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি ঠিক আছেন?”
“আমি ঠিক নেই হামদান, একটুও ঠিক নেই আমি!”
গম্ভীর, চাপা স্বরে বলে উঠলো মীর। ওর মুখনিঃসৃত বাক্যটার ভেতর এক সমুদ্র সমান আবেগের সুক্ষ্ম গোপনীয়তা টের পেলো হামদান।

শেহজাদী হিজ ম্যাজেস্টির সাথে কথা বলেননি সাত মাস হতে চলেছে, এই সাত মাসের একটা রাতও হিজ ম্যাজেস্টি নিজের কামরায় ঘুমাননি, রোজ রাতে এভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় চলে আসা তার নিত্যদিনের কাজে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আজ হিজ ম্যাজেস্টিকে একটু বেশিই অন্যরকম লাগছে কেন!
নিজেকে প্রশ্ন করলো হামদান, কিন্তু হাতড়েও কোনো উত্তর পেলোনা।
মীর দাঁড়িয়ে ছিলো বারান্দার রেলিঙ আকড়ে ধরে। হামদানের ভাবনার মাঝেই রেলিঙ ছেড়ে অস্থির গতিতে ও আবার ফিরে গেলো নিজের কামরায়, ব্যাস্ত হাতে কাবার্ড থেকে শীতের পোশাক নামিয়ে গায়ে জড়িয়ে ক্ষিপ্র, ভারী পায়ে কামরা থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দা ধরে এগোলো সামনে, প্রাসাদের এক্সিটের দিকে।
যাওয়ার আগে হামদানের উদ্দ্যেশ্যে গুরুগম্ভীর আদেশের সুরে বলে গেলো,

“এখানেই থেকো, আমার পেছনে আসার প্রয়োজন নেই।”
হামদান কয়েকপা মীরের পেছন পেছন এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এলো আবার। তারপর আনুগত্যের সাথে আবারও দাঁড়িয়ে গেলো নিজের জায়গায়।
হিজ ম্যাজেস্টির গন্তব্য স্পষ্ট। দুইটি বিষণ্ণ, অতৃপ্ত আত্মার এই মধ্যপরবর্তী রাতের সাক্ষাৎ যেন সুমধুরভাবে সম্পন্ন হয় তার জন্য অন্তর্যামীর নিকট নিরব মিনতি পেশ করলো সে!

শিরো মিদোরির জঙ্গল পেরিয়ে, সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে কুরোআহমারের দিকে চলে যাওয়া প্রধান সড়কের ওপর দিয়ে ঝড়ের বেগে নিজের রয়্যালব্লাক গাড়িখানা হাকিয়ে নিয়ে চলেছে মীর।
চোখের সামনে ওর প্লে হচ্ছে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের গার্লস বোর্ডিংয়ের তৃতীয় তলার গতরাতের সিসিটিভি ফুটেজ।
তীক্ষ্ণ শকুনি দৃষ্টিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে মীর, অতঃপর সময়টা আরএকটু অতিবাহিত হতেই ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো মীরের চোয়াল, দাঁতে দাঁত পিষে যেতে লাগলো ক্রমে, মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো ইস্পাত-দৃঢ়, পেশিবহুল হাতের নিম্নাংশ। সেই সাথে বাড়লো পীচব্লাক গাড়িখানার গতি, তীব্র বেগে বাতাস কেটে সামনে ছুটে চলতে লাগলো গাড়িটা।

ভোরের আলো এখনো ফোটেনি। ফারিশের ফাইনাল এক্সাম নিকটেই, ভোর বেলা উঠে কামরার তিনজনেই এক নাগাড়ে নিজেদের পড়া করে চলেছে৷
ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হওয়ায় পুরো বোর্ডিংয়ের স্টুডেন্টস ফারিশকে গুরুমান্য করে চলে, আর কামরায় থাকা অন্য দুজন সর্বদা থাকে পুরোপুরি স্থীর, যেন সামান্য ভুলত্রুটি হলেই ফারিশ জাবিন তার কঠিন চোখের দৃষ্টিতে ভস্ম করে দেবে তাদের।
পড়াশোনার মাঝেই হঠাৎ টেবিলের কোণায় থাকা যন্ত্রটা শব্দ করে বেজে উঠলো ফারিশের। অত্যান্ত মনোযোগের সাথে করা কাজে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তি নিয়ে সেদিকে চোখ তুলে তাকিয়ে মুখ থেকে একটা চ’ জাতীয় শব্দ করলো ও।

অতঃপর ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই চমকালো সে। মুহুর্তেই চেহারায় ফুটে ওঠা বিরক্তির জায়গায় ঝড়ের গতিতে এসে ভর করলো ভয়ে পরিপূর্ণ একরাশ শ্রদ্ধা।
হিজ ম্যাজেস্টি তো কখনোই এমন অসময়ে তাকে স্মরণ করেননা, তবে আজ কি হলো! তার আড়ালে কি গুরুতর কিছু ঘটেছে?
তড়িৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ফারিশ, পরক্ষণেই কল রিসিভ করে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি!”

ফারিশের মুখ থেকে ইয়োর ম্যাজেস্টি শব্দটা শোনা মাত্রই চমকে উঠলো ওর কামরার অন্য দুজন।
স্বয়ং বাদশাহ ফারিশকে কল করেছে সেটা ওদের মস্তিষ্কে প্রসেস করতে সময় লাগলো খানিকক্ষণ, আর ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝে উঠতে পেরেই বিস্ফোরিত নেত্রে একে অপরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওরা ফারিশের শ্রদ্ধায় মিইয়ে যাওয়া চেহারার দিকে।
ফারিশের গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো, ওপাশ থেকে এখনো কোনো উত্তর আসছে না, গোলমালটা কি তবে খুব জটিল?
কিন্তু ফারিশকে স্বস্তি দিয়ে পরক্ষণেই ওপাশ থেকে শোনা গেলো মীরের দৃঢ় কন্ঠ,

“ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট থেকে বেরিয়ে ডানের রাস্তা ধরে ফো’টি মাইল সোজা চলে এসে বায়ের জঙ্গলে ঢুকবে।”
বাক্যটা শেষ হওয়া মাত্রই খট করে কেটে গেলো কলটা, ফারিশকে দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ দিলোনা। এপাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ফারিশ। এই শীতেও ঘামতে শুরু করেছে ও, কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করে উঠছে কৃত্রিম আলোর স্পর্শে। কি হয়েছে তার অগোচরে? হিজ ম্যাজেস্টির কন্ঠের দৃঢ়তা তাকে কাঁপিয়ে দিলো কেন!
আর এক মুহুর্তও সময় নষ্ট না করে দ্রুত বেগে বাইরের পোশাকে নিজেকে তৈরি করে নিলো ফারিশ। তারপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
ওর কামরার অন্য দুজন তখনো আশ্চর্য নয়নে চেয়ে, বিস্ময় তাদের কাটছে না।

কুরো আহমারের ডাস্কমায়ার নামক জঙ্গলের গভীরে বীরদর্পে, নিশিথের অন্ধকার থেকে ছিটকে আসা এক টুকরো গুরুগম্ভীর শিল্পকর্মের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে মীরের রাজকীয় কালো রঙা গাড়িখানা৷
আকাশের মাঝে এক চাঁদহীন রাতের প্রতিচ্ছবির ন্যায় তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে মসৃণ, গভীর কালো রঙ।
গাড়ির সামনের অংশটাকে আলোকিত করে রাখা এলইডি হেডলাইট দুটি এক জোড়া শিকারি চোখের ন্যায়—তীক্ষ্ণ, শীতল, অপ্রতিরোধ্য।
অতন্দ্র প্রহরীর রূপে সেজোড়া সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলেছে তার সামনে থাকা প্রতিটি বস্তর প্রতি।
গাড়ির অভ্যন্তরে, পেছনের মুখোমুখি অবস্থানে থাকা বিলাসবহুল কালো চামড়ায় মোড়া আসনগুলোর একটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছে মীর, পা তুলে দিয়েছে বিপরীত দিকের আসনের ওপর।
গায়ের শীতের পোশাকগুলোর একটিও গায়ে নেই, সেগুলো দিয়ে আগলে নিয়েছে ওর বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে থাকা আনাবিয়ার শরীরটাকে।

এখনো জ্ঞান ফেরেনি আনাবিয়ার, গাড়ির ভেতরকার উষ্ণ বাতাস আর মীরের শরীরের তপ্ততায় ওর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
হাতের ধমনীর সাথে আইভি নিডল দ্বারা যুক্ত করা একটি অ্যানার্জি ফ্লুইড— তিন ভাগের এক ভাগ খালি হয়ে যাওয়া অ্যানার্জি ফ্লুইডের দিকে কিছুক্ষন পর পর তাকিয়ে তার গতিবিধিতে নজর রাখছে মীর।
ডান হাত টা ওর ঘুরে বেড়াচ্ছে আনাবিয়ার চুলের ভেতর, শীতল হয়ে যাওয়া মাথার মধ্যিখান, আর ঠান্ডায় ভিজে যাওয়া চুলগুলো গরম করে দিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করে চলেছে ওর হাতখানা।
ওর গভীর, সুক্ষ্ম দৃষ্টি অনবরত ছুটে চলেছে আনাবিয়ার ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া নাক, চোয়াল, তপ্ত কপাল, তিরতির করে কাঁপা চোখের পাপড়ি আর টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার ওপর দিয়ে।

ছুটে বেড়ানো দৃষ্টি এবার এসে স্থীর হলো আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়ার ওপর। মীরের মুগ্ধ দৃষ্টি হঠাৎ করেই হয়ে উঠলো লোভাতুর, চকচকে চোখ জোড়া দিয়ে অত্যান্ত মনোযোগের সাথে দেখতে লেগে গেলো ও আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া।
একখণ্ড সূর্যাস্তের মোলায়েম রঙ মেখে বসে আছে টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া। কোনো অত্যান্ত দক্ষ শিল্পীর তুলির শেষ আঁচড়ের ন্যায় আকারে নিখুঁত।
এতটাই নিখুঁত যে ছোঁয়ার সাহস হয় না, যেন ছুয়ে দিলেই ঘটে যাবে কোনো অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়!
ঠোঁটের কোমলতা ঠিক যেন গোধূলির মেঘের স্পর্শ, নিষ্পাপ অথচ গভীর আবেদনময়ী; যার এক ঝলকই হৃদয়ে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট!

টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মীরের বুকের ভেতর জেগে উঠলো উষ্ণতায় মোড়ানো এক আর্তি। আনাবিয়ার ঠোঁটের সেই নিঃশব্দ, দুর্দমনীয় আহ্বান যেন বন্দী করে ফেললো ওর আত্মাকে! মীর আজ এই মুহুর্তে হঠাৎ করেই অনুভব করলো, এই অধরজোড়ার কাছে সে তুচ্ছ— তুচ্ছ ওর সমস্তটা, তুচ্ছ এই পৃথিবী!
তীব্র আকর্ষণের কাছে পরাজিত হয়ে ধীর গতিতে নিজের ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিয়ে এলো ও আনাবিয়ার লাবণ্যপূর্ণ অধর জোড়ার দিকে! আর এক বিন্দু পরিমান, সামান্য পরিমাণ পেরোলেই আনাবিয়ার ঠোঁটের আদুরে স্পর্শে শিউরে উঠবে ও!

মুহুর্তেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো মীরের, ওর ভারী নিঃশ্বাসের ঝাপটা এসে পড়তে লাগলো আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর।
শব্দ করে একটা ঢোক গিললো মীর, আর তার পরমুহূর্তেই ক্ষিপ্র গতিতে নিজের ডান হাত খানা আনাবিয়ার ঠোঁটের ওপর রেখে চাপা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে অতৃপ্ত ঠোঁট জোড়া টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলো আনাবিয়ার কপালে!
কপালপরে সজোরে চেপে ধরলো অধরজোড়া, অতঃপর চোখ বুজে নিয়ে ঝড়োহাওয়ার ন্যায় দীর্ঘশ্বাস ফেললো একটা।
পরক্ষণেই জঙ্গলের ভেতর তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সজাগ হলো মীর, বেরিয়ে হলো সদ্য তৈরি হওয়া ঘোর থেকে। সোজা হয়ে বসে আনাবিয়ার শরীরের অবচেতনভাবে অনাবৃত হয়ে থাকা অংশগুলোকে আবৃত করে দিলো পুরোপুরি, যেন ওর শরীরের কোনো অংশই সেই তৃতীয় ব্যাক্তির দৃষ্টিগোচর না হয়ে পড়ে।
কিছু সময় পর ধীর গতির পদক্ষেপে গাড়ির বাইরে জানালার নিকট এসে দাড়ালো ফারিশ। ফারিশ এসে দাঁড়াতেই খট করে খুলে গেলো গাড়ির দরজা, ভেতর থেকে ভেসে এলো মীরের গুরুগম্ভীর কমান্ডিং ভয়েস,

“ভেতরে এসো।”
তৎক্ষণাৎ ফারিশ দ্রুত বেগে ঢুকে পড়লো গাড়ির ভেতরে, ও ভেতরে ঢুকতেই ধাম করে বন্ধ হয়ে গেলো গাড়ির স্বয়ংক্রিয় দরজাটা।
ভেতরে ঢুকে মীরের বিপরীতে বসে পড়লো ফারিশ আর বসতেই ওর চোখে পড়লো মীরের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মোটা কাপড়ে আবৃত আনাবিয়াকে।
ভয়ানকভাবে বিস্মিত হলো ফারিশ। হতবাক দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইল আনাবিয়ার দিকে।
শেহজাদী এই অসময়ে নিজের কামরা থেকে এখানে কিভাবে আসলেন? হিজ ম্যাজেস্টিই বা তাকে কোথায় পেলেন? শেহজাদীকে দেখে একদমই সুস্থ মনে হচ্ছে না।
মস্তিষ্কের ভেতর লক্ষ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে বেড়াতে শুরু করলো ফারিশের কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস ওর হয়ে উঠলো না।

মীর শীতল দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে, ওর চিন্তিত উদ্বিগ্ন দৃষ্টিটা পরখ করলো গভীর মনোযোগ দিয়ে।
হিজ ম্যাজেস্টি ওর দিকে তাকিয়ে আছে টের পেয়েই সংযত হলো ফারিশ, আনাবিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আনত নয়নে বসে রইলো স্থীর হয়ে।
ওর সুস্থির চেহারার দিকে তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো মীর,
“ড্যু ইয়্যু হ্যাভ অ্যানি অ্যাফেকশন ফ’ সাফিয়া জাফর?”
ফারিশ চমকালো ভিষণভাবে!

হিজ ম্যাজেস্টি হঠাৎ সাফিয়ার কথা তুললেন কেন? সাফিয়াকে তিনি কিভাবে চিনেন? তাছাড়া সাফিয়ার প্রতি তার কোনো অ্যাফেকশন আছে কিনা সেটাই বা তিনি হটাৎ জানতে চাইছেন কেন?
“নেগেটিভ ইয়োর ম্যাজেস্টি, তার প্রতি আমার কোনো ধরনের কোনো অ্যাফেকশন নেই। শি’জ নট মা’ টাইপ।”
মৃদুস্বরে, আনুগত্যের সাথে উত্তর করলো ফারিশ। পরক্ষণেই সাহস সঞ্চার করে ইতস্তত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্ষমা করবেন ইয়োর ম্যাজেস্টি, কৌতুহল দমাতে না পেরে জিজ্ঞেস ককরছি, আপনি হঠাৎ সাফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন? আর শেহজাদীই বা এখানে কিভাবে এলেন? আমার অগোচরে কি গুরুতর কিছু ঘটেছে?”
মীরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখনো ফারিশের মুখের ওপর নিবদ্ধিত। দৃষ্টি না সরিয়েই হাতের ইশারায় গাড়ির ড্রাইভিং সিটের সম্মুখে থাকা স্ক্রিন প্লে করার নির্দেশ দিলো মীর, অবিলম্বে প্লে হলো স্ক্রিন, সেখানে চলছে গতরাতের বোর্ডিংয়ের সিসিটিভি ফুটেজ।

টেলিফোন বুথের নিকট সাফিয়ার সাথে আনাবিয়ার কথা কাটাকাটি থেকে শুরু করে আনাবিয়াকে টেনে বিল্ডিংয়ের ছাদে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত দৃশ্যটুকু দাঁতে দাঁত পিষে দেখলো ফারিশ। স্ক্রিনপ্লে শেষ হতেই ফারিশ শক্ত কন্ঠে আনুগত্যের সাথে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি আদেশ দিলে এই মেয়েকে আমি নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই।”
“তার প্রয়োজন নেই ফারিশ, ওর শাস্তির ব্যাবস্থা আমি নিজেই করবো। তার প্রতি তোমার কোনো অ্যাফেকশন নেই এইটুকু তথ্যই আমার জন্য যথেষ্ট।”

শেষোক্ত বাক্যটা উচ্চারণ করে আনাবিয়ার ঘুমন্ত মুখখানার দিকে আদুরে দৃষ্টিতে তাকালো মীর, অতঃপর বলল,
“কারণ প্রেমিকের মন আমি আর কখনো ভাঙতে চাইনা। এখন তুমি আসতে পারো। আর হ্যাঁ, এখন থেকে আমার শিনুর প্রতি খেয়াল রাখার আর কোনো প্রয়োজন নেই।”
শেষোক্ত কথাটা আনাবিয়ার মুখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফারিশের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল মীর।
থমকালো ফারিশ, মীরের শকুনি দৃষ্টির দিকে তড়িৎ গতিতে তাকালো একবার।
ওই দৃষ্টি যেন পড়ে নিচ্ছে ওর ভেতরটা, পড়ে ফেলেছে! বুঝে ফেলেছে তার হৃদয়ে আনাবিয়ার জন্য তৈরি হওয়া দুর্বলতার পরিমাণ। অস্বস্তিতে দম আটকে আসতে চাইলো ফারিশের, শ্বাসযন্ত্র টা যেন আকস্মিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিতে চাইছে!

কিন্তু ওকে স্বস্তি দিয়ে অনতিবিলম্বে শব্দ করে খুলে গেলো গাড়ির স্বয়ংক্রিয় দরজা। মীরকে আনুগত্যের সাথে বিদায় জানিয়ে বিনা বাক্যব্যায়ে তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেকে নেমে গেলো ফারিশ, তারপর এতক্ষণের আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিয়ে বুক ভরে স্বস্তির বাতাস নিয়ে দ্রুত পায়ে এগোলো নিজের গন্তব্যের দিকে।
ফারিশ চোখের আড়াল হতেই মীর কল লাগালো কারো কাছে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই মীর বলে উঠলো,
“সাফিয়া জাফর, ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রুম ফোর স্যাভেন থ্রি, বেড ওয়ান। যেভাবে ইন্সট্রাকশন দিবো সেভাবেই কাজ করবে।”

কথাগুলো বলেই কল কাটলো মীর। তারপর ফোনটা পাশে সরিয়ে রেখে, জাগতিক সমস্ত বিষয়বস্ত মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে করে দিয়ে পূর্ণ মনোযোগ দিলো আনাবিয়ার দিকে।
গরম হয়ে উঠেছে আনাবিয়া, লাল হয়ে যাওয়া গাল আর নাকের ডগা আবার ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো রঙ। এনার্জি ফ্লুইড টা শেষ হতে আর বেশি সময় বাকি নেই।
মীর সমস্ত ভারী কাপড়ের ওপর দিয়ে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো আনাবিয়াকে। চুল গুলো শুকিয়ে এসেছে, অদ্ভুত মন মাতানো সুঘ্রাণ ভেসে আসছে রেশমসম কেশগুচ্ছ থেকে।
আনাবিয়ার মাথার নিকট নিজের মুখ খানা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শ্বাস টেনে ঘ্রাণ নিলো মীর৷

সাত মাস, সম্পুর্ন সাতখানা মাস পর আনাবিয়াকে আজ স্পর্শ করলো ও, জড়িয়ে নিলো নিজের বুকের ভেতর।
এতগুলো দিন শুধুমাত্র সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে ওর শিনজোকে দেখেই গেছে ও শুধু, কিন্তু সাউন্ডলেস হওয়ায় আনাবিয়ার কন্ঠস্বর শোনার কোনো সুযোগ মেলেনি ওর, আর না মিলেছে আনাবিয়াকে ছুয়ে দেখার সুযোগ।
আজ এই অল্প সময়ের ভেতরেই এতগুলো দিন ধরে আনাবিয়াকে স্পর্শ করার সমস্ত দুর্দমনীয় আকাঙ্খা গুলো পূরণ করে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে চলেছে ও। ধরে রেখেছে নিজের বুকের ওপর, মাথাটা চেপে রেখেছে নিজের হৃদপিণ্ডের এক্কেবারে কাছে, যেন তাতে আনাবিয়ার অনুপস্থিতিতে ওকে দেখতে পাওয়ার, স্পর্শ করার আশায় অস্থির হয়ে যাওয়া হৃদয়টা ওর একটু শান্ত হয়।

এমন সময় সামান্য নড়ে উঠলো আনাবিয়া। সচকিত হয়ে উঠলো মীর। আনাবিয়ার মুখখানা নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে! এই বুঝি চোখ মেলে ওর প্রাণটা, হীরকখন্ডের ন্যায় দৃষ্টির অদৃশ্য স্পর্শ বুলিয়ে দেয় ওর স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়ার ওপর!
মীরের তীব্র চাওয়াকে বিফলে যাওয়ার হাত থেকে বাচিয়ে ধীর গতিতে নিজের দ্বিধান্বিত, ব্যাথাতুর চোখ জোড়া মেলে তাকালো আনাবিয়া। চোখ মেলতেই দৃষ্টি আটকে গেলো মীরের কুচকুচে কালো রঙা মুখের ওপর জ্বলজ্বল করতে থাকা মুগ্ধতা মেশানো সোনা রঙা চোখ জোড়ার ওপর।
থমকালো আনাবিয়া, ভুলে গেলো সব অভিমান, চোখ জোড়া ভরে উঠলো লোনা পানিতে, ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠে লাফিয়ে, ঝাপিয়ে জড়িয়ে ধরলো মীরের গলা, কান্না জড়ানো আকুল কন্ঠে ডেকে উঠলো,
মীরি!

মুহুর্তেই মীর ওকে দুহাতে জড়িয়ে মিশিয়ে নিলো নিজের বুকের সাথে আবারও। অনবরত পাগলাটে চুমতে ভরিয়ে দিলো ওর কপাল আর চোয়াল।
আনাবিয়া কাঁদলো অনেক অনেক ক্ষণ, এতগুলো দিনের বিচ্ছেদের যন্ত্রণার সাথে আভিমানের সমস্তভার টুকু লোনা জলের প্রবাহের সাথে বের করে দিলো নিজের শরীর থেকে।
মীর ওর মাথার ওপর নিজের মাথার ভর ছেড়ে দিয়ে শুনে গেলো ওর ফোপানোর শব্দ। ক্ষণে ক্ষণে মুছে দিলো ওর চোখের পানির প্রবাহ।

শেষ মুহুর্তে এসে মাথা তুলে আনাবিয়ার মুখখানা এক হাতে উঁচু করে তুলে, আনাবিয়ার চোখ জোড়ার গভীরে দৃষ্টি রেখে অন্য হাত টা আনাবিয়ার ছোট্ট হাতের ভাজে জড়িয়ে এক নিঃশ্বাসে, গভীর, নমনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমাকে নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে আমি ভুল করেছি শিনু, এই বিচ্ছেদের আগ পর্যন্ত আমি ঘূর্ণাক্ষরেও অনুধাবন করতে পারিনি যে আমার হৃদয় জুড়ে তোমার এতটা আধিপত্য! আমার একমাত্র আশ্রয় তুমি, শুধুমাত্র তুমি।
আমি পরিস্থিতির চাপে তোমাকে দূরে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেই মুহূর্ত থেকে আমি হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে, হাজার খুঁজেও নিজের সত্তাকে ফিরে পাইনি!
আজ আমি আবার ফিরে এসেছি তোমার কাছে, যেন তোমার হাতের ভাজে আমার হাত দৃঢ়ভাবে মিশিয়ে দিতে পারি আবারও!

আমি জানি তুমি কষ্ট পেয়েছো, বুক ভর্তি অভিমানের তোপে তুমি কথা বলোনি আমার সাথে।
আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায়না শিনু? আবার একবার আমাকে তোমার আত্মার সন্নিকটে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়না প্রাণ আমার?
ওয়াদা করছি আর কখনোই তোমাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দিবো না, হৃদয়ের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে কাছে টেনে নেবো তোমাকে!”
শেষোক্ত কথাগুলো ব্যাথাতুর, বিপর্যস্ত কন্ঠে বলে উঠলো মীর। আনাবিয়া প্রতিউত্তরে কিছুই বলতে পারলোনা, মীরের আদুরে কথায় ঠোঁট ফুলে এলো ওর, ফুপিয়ে উঠে মুখ লুকালো ও মীরের বুকের মধ্যিখানে। অশ্রু মিশ্রিত নিরবতাকে আশ্রয় করে উত্তর দিলো মীরের প্রশ্নের!
হৃদয় জুড়ে প্রশান্তির লহরি বয়ে গেলো মীরের, ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো স্নিগ্ধ, নরম তৃপ্তির হাসিতে। বুকের ভেতর থেকে ঝাপটার ন্যায় বেরিয়ে এলো শান্তি, স্বস্তির নিঃশ্বাস। প্রগাঢ়, প্রেমপূর্ণ কন্ঠে ও বলে উঠলো,
“প্রাণ আমার, আমার শিনজো!”
আনাবিয়ার ফোপানো থামলো কিছুক্ষণ পর। মীর ওর শুভ্র কেশগুচ্ছ নিজের হাতের মুঠির ভেতর ভরে আঙুলে পেচিয়ে নিতে নিতে বলল,

“তুমি চাইলে আমার সাথে প্রাসাদে ফিরতে পারো শিনু, বা চাইলে এখানে থেকেই নিজের পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারো। কোনটা চাও তুমি শিনু? তুমি যা চাইবে তাই হবে।”
“আমি এখানেই থাকবো। কিন্তু তোমাকে যখনি আসতে বলবো তখনি আসতে হবে।”
মীরের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ধরা গলায় বলল আনাবিয়া।
“দিনের বেলা ব্যাস্ত থাকবো অনেক, রাতের বেলা যখনই তোমার প্রয়োজন হবে তখনি চলে আসবো। শুধু কোথায় আসবো বলে দাও।”
“যখন যেখানে বলবো সেখানে আসবে, কামরাতে আসতে বললে কামরাতে চলে আসবে। কিভাবে আসবে আমি জানিনা।”

“ঠিক আছে, আসবো। তুমি যে এতটা ধৈর্যশীল হতে পেরেছো তার রিওয়ার্ড হিসেবে যা পাওনা হয়েছে এটুকু আবদার তার কাছে কিছুইনা। গ্রেইট জব!”
আনাবিয়ার নাকের ডগা দু আঙুলে ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল মীর। আনাবিয়া চোখ বুজে নিলো আদুরে ভঙ্গিতে। মীর মিষ্টি হেসে আবার বলল,
“ছাদের ওপর থেকে ডাকাতি করে নিয়ে চলে এসেছিলাম তোমাকে। চলো এখন তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে আসি।”
মীরের কথাতে শব্দ করে প্রাঞ্জল হাসলো আনাবিয়া, তারপর প্রস্তুতি নিলো আবার বোর্ডিংয়ে ফিরে যাওয়ার।

সকাল বেলা অত্যান্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে নেমে এলো আনাবিয়া। ওকে দেখে বারান্দা জুড়ে বসে থাকা থার্ড ফ্লোরের ফিমেইল গার্ড, বোর্ডিংয়ের ম্যানেজার আর আনাবিয়ার রুমমেটেরা সহ আরও কিছু বোর্ডার এগিয়ে এলো ছুটে।
অত্যান্ত উদ্বিগ্ন চেহারায় সুস্থ সবল ভাবে ফিরে আসা আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে অতঃপর একে অপরের দিকে দ্বিধান্বিত দৃষ্টি ফেললো ওরা।
ভোর হওয়ার আগেই শঙ্কিত মনে ছুটে গেছিলো ওরা ছাদে, সাফিয়ার আক্রোশের শিকার হওয়া নূরিয়া তাজদিন ঠিক কতটা ভয়াবহ অবস্থায় আছে সেটা পরখ করতে। কিন্তু সমস্ত ছাদটা জুড়ে কোথাও নূরিয়া তাজদিনের দেখা মেলেনি, সে সম্পুর্ন উধাও!

তবে সে এখন কোন জাদুবলে ছাদ থেকে নেমে এলো সেটা ভেবে পেলোনা ওরা।
আনাবিয়া ওদের দ্বিধান্বিত দৃষ্টি দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে? তোমরা এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
এভলিন মেয়েটা এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“তুমি ঠিক আছো নূরিয়া? তোমার… তোমার কি ঠান্ডায় ধরেনি? আর তুমি ছাদ থেকে কিভাবে আসলে? আমরা ভোর বেলা গিয়ে সমস্ত ছাদ তন্ন তন্ন করে খুজেছি তোমাকে, কিন্তু কোথাও পাইনি!
ছাদেই যদি থাকো তবে কোথায় ছিলে তুমি? তোমাকে আমরা কেউ পাইনি কেন? আর… আর এটা তুমি কোথায় পেয়েছো? গতরাতে তো তোমার গায়ে এমন কোনো পোশাক ছিলোনা!”

শেষোক্ত কথাটা আনাবিয়ার পরণের ফুল স্লিভ ওভার সাইজ থার্মাল টি শার্টটার দিকে নির্দেশ করে বলল এভলিন।
কিন্তু টি শার্টটা ভালোভাবে লক্ষ্য করতেই চমকালো সে। এটা নূরিয়ার পোশাক কোনোভাবেই হতে পারেনা। উপরন্তু এটা কোনো পুরুষের পোশাক, কোনো লম্বাচওড়া, সুদীর্ঘ দেহের অধিকারী পুরুষের।
এভলিনের প্রশ্নের উত্তরে আনাবিয়া আগের মতোই মিষ্টি হেসে উত্তর করলো,
“আমি তো এখানেই ছিলাম এভলিন, কোথাও যাইনি।”

আনাবিয়ার কথা শেষ না হতেই ওপর তলা থেকে সাফিয়ার রুমমেট ছুটে এলো নিচে। তারপর তড়িঘড়ি করে যেটুকু কথা বলল তার সারমর্ম এইযে, সাফিয়াকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা এবং কামরার দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। কোনোভাবেই সাফিয়ার কামরার বাইরে বের হওয়ার কথানা।
কিন্তু সাফিয়া নেই, কোথাও নেই।

মুহুর্তেই সাফিয়ার খোঁজ পড়ে গেলো সমস্ত ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট জুড়ে, কিন্তু কোথাও তার ছাঁয়া পর্যন্ত পাওয়া গেলোনা।
দুপুরের আগেই ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট থেকে একশ পয়ত্রিশ কিলো দূরের একটি হ্রদের মাঝে বিভৎস অবস্থায় ভেসে থাকতে দেখা গেলো সাফিয়া জাফরের খণ্ডবিখণ্ড দেহ। সর্বমোট পয়ত্রিশ খন্ড দেহটুকরোকে মেটালিক থ্রেড দিয়ে সেলাই করে আবার জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৭+৮

ডান দিকের চোয়াল থেকে কেউ খুবলে নিয়েছে মাংস, মাড়ির দাঁত গুলো অনাবৃত হয়ে আছে তাতে।
শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে মাংস মিসিং, যেন সমস্ত দেহ থেকে কোনো হিংস্র জন্তু ধারালো দাঁতের সাহায্যে খুবলে খেয়ে নিয়েছে মাংস গুলো।
চোখ জোড়া ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত, যেন মৃত্যুপূর্বে সে জোড়া সাক্ষী হয়েছে কোনো বিভীষিকাময় ভয়াল দৃশ্যের….

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১১+১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here