বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯+২০

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯+২০
রানী আমিনা

ভেজা শরীরেই গাড়ির ভেতরে উঠে এলো মীর।
পরণের ট্রাউজার থেকে পানির ফোঁটা গাড়ির ভেতর পড়তে লাগলো টুপ টুপ করে।
কুচকুচে কালো রঙা শরীরের ওপর পানির বিন্দু বিন্দু কণা গুলো ভোরের সদ্য ফোটা আলোর স্পর্শে চিকচিক করে উঠছে শিশির ফোটার ন্যায়, কপালের ওপর এসে পড়েছে ভেজা চুলের কিছু অংশ!
নিজের ইস্পাত-দৃঢ় পেশিবহুল শরীরটা আনাবিয়ার বিপরীতে রেখে বসে শিকারীর ন্যায় গভীর, ভয়ংকর সুন্দর দৃষ্টি ফেললো ও আনাবিয়ার শুভ্র মুখোশ্রির ওপর!

আনাবিয়া গাড়ির সিটে ঠেস দিয়ে বসে চুক চুক করে জুস খাচ্ছিলো স্ট্র দিয়ে। মীরের এমন হুলিয়া দেখা মাত্রই বিষম খেলো ও, জুস আটকে গেলো গলায়! কেশে টেশে জুস টুস ফেলে সয়লাব করে ফেললো ও গাড়ির ভেতরটা।
মীর হতচকিত হয়ে আঁতকে উঠে দ্রুত হাতে পানি এগিয়ে দিলো ওর মুখের নিকট, তারপর উঠে গিয়ে ওর পাশে বসে হাত ঘষে দিতে থাকলো ওর পিঠে।
আনাবিয়া কোন রকমে পানিটা খেয়ে কিছুক্ষণ গলা টেনে অবশেষে স্থীর হয়ে বসলো।
মীর তখনো উদ্বিগ্ন চাহনিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। আনাবিয়া স্থীর হয়ে বসলে ওর তুলতুলে চোয়ালদ্বয় নিজের দুহাতের ভেতর নিয়ে ভ্রু তুলে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ঠিক আছো এখন? স্ট্র দিয়ে জুস খেতে খেতে বিষম খেলে কি করে?”
আনাবিয়া আবার জুস খেতে নিয়েছিলো কিন্তু মীরের কথা শুনে মুখের ভেতরে থাকা জুসটুকু তৎক্ষণাৎ গিলে ফেলে ভ্রুকুটি করে গলা টেনে বলে উঠলো,
“চোখের সামনে এরম স্যাক্সি বডি নিয়ে চলাফেরা করলে মানুষ বিষম খাবে না তো কি খাবে, তোমার মাথা?
ভেজা কাপড় পরে এখনো বসে আছো কেন? গাড়ি ভিজে যাচ্ছে দেখছোনা? ট্রাউজার খুলো, যাও।”
মীর ঠোঁট কামড়ে হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ঊর্ধ্বাংশ দেখেই বিষম খেয়েছেন, ট্রাউজার খুললে তো এবার গাড়ি সুদ্ধ আমাকেই খেয়ে ফেলবেন ম্যাম!”
“তোমাকে আমার সামনে খুলতে বলেছি? শালার ঘরের শালা! যাও, ওপাশে যাও!”

ধমক দিয়ে বলল আনাবিয়া। তারপর আবার জুসের স্ট্র মুখে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মীরকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে জুস খেতে লাগলো ও।
মীর ওর এমন রাক্ষুসে দৃষ্টি দেখে দাঁত বের করে হেসে পেছনের সিট থেকে এগিয়ে ড্রাইভিং সিটে গেলো। ট্রাউজার খুলে শুকনো কাপড় পরে নিলো।
আনাবিয়া ওর পাশের সিটে রাখা তোয়ালে টা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে খাবার গুলো বগলদাবা করে নিয়ে ঠেলে চলে এলো সামনে।
ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে খাবার গুলো দুম করে ফেলে তোয়ালে টা হাতে নিয়ে দুপা দুদিকে দিয়ে মীরের কোলের ওপর বসলো ও৷
তোয়ালেটা দিয়ে দুহাতে মীরের মাথা মুছে দিলো রগড়ে। তারপর আলতো হাতে একে একে মুছে দিলো ওর মুখ, গলা, হাত, বুক, সমস্ত শরীর।

পুরোটা সময় মীরের স্নিগ্ধ দৃষ্টি মুগ্ধতা নিয়ে ঘুরে ফিরে চলল আনাবিয়ার মুখের ওপর! ওর পিটপিট করতে থাকা হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া; বার বার ওঠানামা করতে থাকা ঘন, কালো রঙা পাপড়ি; থেকে থেকে কিঞ্চিৎ নড়ে ওঠা টেরাকোটা রঙা নরম ঠোঁট জোড়া, সবকিছুই অপলকে দেখে চলল মীর।
আনাবিয়ার হাত থেকে এবার হুট করেই তোয়ালেটা ছিনিয়ে নিলো ও, ছুড়ে দিলো সেটা গাড়ির পেছনের সিটে।
দুহাতে আনাবিয়াকে টেনে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মীর ওর মনোযোগী দৃষ্টি ফেললো আনাবিয়ার বা গালের ওপর।

আঙুলের দাগ গুলো এখন আর নেই। সেখানে আলতো করে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলিয়ে শব্দ করে পরপর কয়েকটা চুমু খেলো মীর। তৃপ্তির মিষ্টি হাসিতে প্রসারিত হলো আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া, ওর ফুলে ওঠা গোল গোল চোয়ালে এবার চুম্বনের বন্যা বইয়ে দিলো মীর।
আনাবিয়ার গ্রীবাদেশ, কোমর, হাতের কবজি, পায়ের গোড়ালির উপরিভাগের সমস্ত আঘাতপ্রাপ্ত স্থান গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো মীর। মেডিসিনের প্রভাবে ক্ষতস্থান গুলো খুব দ্রুতই সেরে উঠেছে, ক্ষতের আবছা আবছা ছোপ এখনো বিদ্যমান।

আনাবিয়ার ক্ষতস্থান গুলো পরখ করতে করতে মীরের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো আবারও। ওর প্রবল ইচ্ছে জাগলো ম্যাসনের টুকরো টুকরো করে ফেলা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুলো আরও একবার কুপিয়ে আসতে।
আনাবিয়া মীরের কঠিন হয়ে যাওয়া দৃষ্টি লক্ষ্য করে মীরের মুখ খানা নিজের দুহাতের ভেতর নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো ওর কপালে। আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো মীর। বুক থেকে উঠে এলো ওর খুব জোর এক তৃপ্তির নিঃশ্বাস।
মীরের কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে আনাবিয়া মুখ ডুবালো মীরের শক্তপোক্ত বুকে। দুহাতে মীরের কোমর জড়িয়ে ধরে ক্লান্ত গলায় বলল,

“প্রাসাদে চলো!”
মীর ওর চুলের ওপর দিয়ে মাথায় একটা চুমু খেয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। আনাবিয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে মীরের বুকে আরাম করে মাথা রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠলো,
“রুশি ভাইয়াকে বলে দিও আমার কোকোকে আমার কাছে দিয়ে যেতে।”
চলতে শুরু করলো মীরের কালো রঙা গাড়িখানা। স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মীর এগোলো শিরো মিদোরির দিকে। গাড়ির মৃদু মন্দ ঢুলুনিতে ঘুম চলে এলো আনাবিয়ার। মীরের অনাবৃত বুকে ঠিক ছোট্টবেলাটার মতো নিচের ঠোঁটখানা ফুলিয়ে লেপ্টে ঘুমিয়ে রইলো আনাবিয়া।
এক হাতে আনাবিয়ার শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে চলল মীর। ফারিশকে কল করে বলে দিলো আজকের দিনের ভেতরেই কোকোকে শিরো মিদোরিতে পৌছে দিতে।

ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের বোর্ডিংয়ের চতুর্থ তলায় ভীড় জমে আছে মেয়েদের। নওমি কামরার বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁপা-কাঁপি করছে ভয়ে। কামরার ভেতর থেকে কিয়ৎক্ষণ পরপর ভেসে আসছে কোকোর হিংস্র ফোসফোসানির শব্দ।
কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে ছুটে এলেন বোর্ডিং ম্যানেজার। নওমিকে এক কোণে আতঙ্কে চুপসে দাঁড়িয়ে থাকিতে দেখে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি ঘটেছে।
নওমি ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে যে উত্তর দিলো তার সারমর্ম এইযে,
কোকো নামের বাচ্চা কুমিরটা নূরকে কাছে না পেয়ে রেগে আছে ভয়ানক।
রাতের বেলা খেয়ে দেয়ে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছিলো, কিন্তু ভোর রাতের আগে হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে উদ্ভট আচরণ করা শুরু করে সে। রাগে ফোস ফোস করে রুম কাপিয়ে দেওয়ার অবস্থা করে ফেলে!
নওমি ঘুম ভেঙে উঠে এমন অবস্থা দেখে ভেবেছিলো যে হয়তো ওর ক্ষিদে পেয়েছে, নূরের ভেজে রাখা মাছ গুলো খেতে দিতে গিয়েছিলো ও কোকোকে।

কিন্তু কোকো উলটো ওর ওপরেই আক্রমণ করে বসে।
সঠিক সময়ে নিরাপদ দুরত্বে সরে যাওয়ায় কোকো আর তার ওপর আক্রমণ করতে পারেনি। কিন্তু সেই ভোর হওয়ার আগে থেকেই নওমি আর কামরায় ঢোকেনি ভয়ে, সেই থেকে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে নূর নিখোঁজ, সে রাতে আর ফেরেইনি বোর্ডিংয়ে।
কোকোকে কামরা থেকে কিভাবে বের করবে সেটা ভেবে না পেয়ে বোর্ডিং ম্যানেজার দ্রুত কল করলো শহরের অ্যানিম্যাল রেস্কিউ টিমের কাছে।

রেস্কিউ টিম এসে পৌছানোর আগেই ইম্পেরিয়ালে আরিশকে নিয়ে উপস্থিত হলো ফারিশ। ক্যাম্পাসের ছেলেমেয়েরা ফারিশের গাড়ি থেকে আরিশকে এমন অগোছালো অবস্থায় বের হতে দেখে অবাক হলো অনেক। ওদের চোখ গেলো আরিশের কপালের সেলাই দেওয়া ক্ষতস্থানে। গুঞ্জন শুরু হলো মুহুর্তেই।
আরিশ ওদের সবার প্রশ্ন উপেক্ষা করে চলল ওর বয়েজ বোর্ডিং এর দিকে। অন্য সবার থেকে ওর মাথার ভেতর ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নের সংখ্যাটা বেশি৷

সময় নষ্ট না করে ও চলে গেলো নিজের কামরায়, ফারিশের কড়া আদেশ, গতরাতের ব্যাপারে কাউকে যেন সে কিছুই না জানায়! কিন্তু এটা কি চাপা দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা?
ফারিশ গাড়ি থেকে বের হয়ে আনাবিয়ার বোর্ডিং ম্যানেজারের কাছে কল করে বলল সে নূরিয়া তাজদিনের পোষা কুমিরের বাচ্চাটা নিতে এসেছে।
ম্যানেজার ফারিশের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“বড় বাচালে বাবা তুমি! এটাকে যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে নিয়ে যাও, নূরের কামরায় ভেতর রাগে ফুসছে সে।
আমরা কেউ ভয়ে ওর কাছে যেতে পারছিনা, কেউ কাছে গেলেই তার ওপর অ্যাটাক করছে বাচ্চাটা। নওমি তো সেই ভোর রাতে থেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে।”

ফারিশ অনুমতি নিয়ে উঠে গেলো বোর্ডিং এর চতুর্থ তলায়।
ফারিশ আসছে শুনে মেয়েদের ভীড় সেখানে আরও একটু বেড়ে গেলো।
সাদা রঙা টানটান শার্ট পরিহিত ফারিশ দ্রুত পায়ে এলো আনাবিয়ার কামরার সামনে। মেয়েরা জায়গা করে দিলো ওকে যাওয়ার। ফারিশ একটু উকি ঝুকি মেরে দেখে নিলো কোকোর অবস্থান।
আনাবিয়ার বিছানার ওপর গোল হয়ে বসে আছে সে, নিঃশ্বাসের তোপে গা ফুলে উঠছে বার বার৷ জিনিসপত্র সব ছড়ানো ছিটানো, ভাঙা চোরা।

ফারিশ নরম পায়ে ভেতরে এগিয়ে গেলো। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো বিছানার ওপর পেছন ফিরে বসে থাকা কোকোর দিকে। কোকোর একটু কাছাকাছি গিয়ে ফারিশ চাপা, নরম গলায় বলল,
“কোকো, তোমাকে তোমার আম্মাজানের কাছে নিয়ে যেতে এসেছি আমি। রাগ কোরোনা আর, কয়েক ঘন্টার ভেতরেই পৌছে যাবো বাচ্চা!”

ফারিশের কথা শুনে কোকোর ফোসফোসানি কম হলো একটু। ঘাড় ঘুরিয়ে ও দেখে নিলো ফারিশকে। এই ব্যাডাকে ও চেনে, এখানে আসার সময়ে তো এর সাথেই এসেছিলো।
কোকো কিছুক্ষণ ভেবে শরীর দুলিয়ে হেটে এগিয়ে এলো ফারিশের কাছে। ফারিশ হাত বাড়িয়ে দিলো ভয়ে ভয়ে। কোকো ভদ্র বাচ্চার মতো এঁকেবেকে উঠে পড়লো ওর হাতের ওপর। ফারিশ কোকোর অগোচরে সন্তর্পণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো, ধীর গতিতে কোকোকে নিয়ে বেরিয়ে এলো আনাবিয়ার কামরা থেকে।
যে কাজ কেউ পারলোনা সেটা ফারিশ এক নিমিষেই করে ফেললো দেখে অবাক হলো ওরা। ফারিশ দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যেতেই বোর্ডিং ম্যানেজার ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“মানুষের কত কিছু পোষার শখ থাকে, আর এই মেয়ের কিনা কুমিরের বাচ্চা পোষার শখ! বাবারে বাবাহ, ও যে মেয়ে মানুষ তাতে এমন শখ অস্বাভাবিক নয় একদমই।”
ম্যানেজার এবার সব মেয়েদেরকে যার যার রুমে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়ে চলে এলো সেখান থেকে।
লোকজন একটু ফাঁকা হয়ে গেলেই নওমি ছুটলো নিচে। ফারিশ ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে। নওমি দ্রুত ছুটলো ফারিশের সাথে কথা বলতে।
ফারিশ কোকোকে নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে তখনি নওমি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হলো সেখানে, শুধালো,

“ভাইয়া! নূরকে পেয়েছেন? কোথায় আছে ও ? কি হয়েছিলো ওর?”
ফারিশ কোকোকে গাড়ির ভেতরে রেখে নওমির দিকে ফিরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“নূর ঠিক আছে নওমি। ও রাতে কফি শপ থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে গেছিলো, আমাকে জানায়নি তাই চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। চিন্তা কোরোনা ও ঠিক আছে৷”
শেষোক্ত কথাটা বলেই ফারিশ উঠে গেলো গাড়িতে। তারপর মুহুর্তেই প্রস্থান করলো ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট থেকে। গন্তব্য ওর শিরো মিদোরি।

আরিশ বসে আছে ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের হেড কোয়ার্টারে। চোখ মুখ ওর থমথমে। চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে।
কাল রাতের ঘটনা সাধারণ জনগণের থেকে সম্পুর্ন গোপন করে রাখা হয়েছে। রাতের বেলা যে কুরো আহমার একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো সেটা যেন বোঝাই যাচ্ছেনা!
চারপাশ একদম স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। কোথাও এই নিয়ে কোনো কথা নেই, অথচ কাল রাতে ওরা জলজ্যান্ত তিনজন কিডন্যাপ হলো।

ভোর হতে না হতেই ভোজবাজীর মতোন সমাধান হয়ে গেলো সবকিছু, কি দিয়ে কি হলো ও কিছুই টের পেলোনা। তবে এর ভেতর যে খুব বড়সড় কোনো ঘাপলা আছে সেটা ও টের পেলো খুব প্রকট ভাবে।
ইম্পেরিয়ালে ফেরার সময়ে ফারিশ জাবিন ওকে কড়া ভাবে বলে দিয়েছে রাতের ঘটনা গুলো সম্পুর্ন ভুলে যেতে। এই বিষয়ে কারো সাথে যেন কোনো রকম আলোচনা না করা হিয়। রাতে যে এত কাহিনী ঘটলো সেটা যেন কোনোভাবেই পাঁচকান না হয়, কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?
আরিশকে এমন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে অন্য ছেলে মেয়েগুলো এসে ঘিরে ধরলো ওকে। ইলেভেন্থ গ্রেডের একটা ছেলে এসে ওর পাশে বসে চাপা সুরে শুধালো,
“আরিশ ভাইজান, কাল রাতে আপনি কোথায় ছিলেন? শুনলাম নূরের সাথে ব্রিউ ব্লিসে গেছিলেন আপনি কিন্তু তারপর আর বোর্ডিংয়ে ফেরেননি, নূরও ফেরেনি! আপনারা কি কোনো রিলেশনশিপে গিয়েছেন? আমাদেরকে বলতে পারেন, আমরা তো আমরা আমরা!”
আরিশ কড়া চোখে তাকালো ওর দিকে, বলল,

“এ ধরণের ফালতু চিন্তাভাবনা করবেনা ব্যারন, নূরের সাথে আমার এমন কোনো বাজে সম্পর্ক নেই। নূরকে দেখে তুমি এটুকু অন্তত বুঝেছো যে সে অবশ্যই কোনো প্রেস্টিজিয়াস ফ্যামিলির মেয়ে, তার সম্পর্কে না জেনে শুনে এধরণের কথা বলা কি তোমার উচিত হয়েছে?
ব্যারন ছেলেটা দমে গেলো, আরিশ অন্যদিন এধরণের রশিকতায় নিজেও সায় দেয়, কিন্তু আজ তার টেম্পার হাই।
ব্যারন একটু ধাতস্থ হয়ে রয়ে সয়ে বলল,
“ঠিক আছে ভাইজান, এরকম আর বলবো না। কিন্তু কি হয়েছিলো সেটা আমাদেরকে বলুন একটু!”
ব্যারনের কথায় বাকিরাও নিজেদের ভেতরের গল্প বাদ দিয়ে ঝুকে এলো ওদের দিকে, আরিশ কি উত্তর দেয় শোনার জন্য। কৌতুহলী দৃষ্টিতে ওরা তাকিয়ে রইলো ফারিশের দিকে।
আরিশ ওদের সবাইকে পরখ করে নিয়ে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো,

“কালরাতে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে আমাদের সাথে।”
সবার কৌতুহল এবার আরও বেড়ে গেলো, পুরোপুরি নিরব হয়ে ওরা আরও ঝুকে এলো আরিশের কথা শোনার জন্য। কিন্তু আরিশ ওদের কৌতুহলে পানি ঢেলে দিয়ে বলে উঠলো,
“কিন্তু ফারিশ জাবিন কাউকে কিছু জানাতে পুরোপুরি মানা করে দিয়েছেন, সুতরাং আমি কাউকে কিছু বলছিনা।”
কিন্তু এসবের ভেতর ফারিশ জাবিন ইনভলভড শুনে ওরা রাতের ঘটনা শোনার জন্য একেবারে উন্মাদ হয়ে উঠলো। আরিশকে ধরে ঝাকাঝাকি করতে লাগলো কি হয়েছে শোনার জন্য।

আরিশ এবার ধৈর্য হারা হয়ে ওদেরকে ঝাড়া দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে স্থীর হয়ে বসতে বলে বলল,
“বলতে পারি, তবে একটাই শর্ত। এই ঘটনা এই কামরার পর্যন্তই যেন সীমাবদ্ধ থাকে। শপথ গ্রহণ কর সবাই।”
ফারিশের কথায় সকলে বুকে হাত দিয়ে শপথ নিলো, যে এই কথা এই চার দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ওদের থেকে শপথ নিয়ে ফারিশ বলতে শুরু করলো গত রাতের সমস্ত ঘটনা৷ ব্রিউ ব্লিসে ঢোকার পর থেকে লুমিরার তীরে এসে পৌছানো পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে থামলো ও।
ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের হেড কোয়ার্টারে তখন বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। হা হয়ে ওরা সকলে শুনছে কিডন্যাপিং গল্প। আরিশ থেমে যাওয়ায় ওরা তাড়া দিয়ে বলল,

“তারপর কি হলো? নূরকে ওরা কি করলো?”
“আমার মাথায় আঘাত লেগেছিলো আমি শুনতে পাচ্ছিলামনা কিছুই, কানের কাছে কেমন যেন বোবো শব্দ হচ্ছিলো শুধুই।
আমার চোখের সামনেই নূরের গায়ের লোহার শেকলের সাথে ইয়া ভারী ভারী পাথর বাধে ওরা, তারপর ওকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায় নদীর পাড়ে।

তারপরেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ওকে, সাথে সাথে তলিয়ে যায় ও! কিন্তু ওকে ফেলে দিয়ে ওদেরই একজন আবার ঝাপ দেয় পানির ভেতর। কেন দেয় আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু সে লোকটা উঠে আসে তখনি।
আর সেই মুহুর্তেই আকাশের ভেতর থেকে কিছু একটা বুলেটের গতিতে উড়ে এসে ঢুকে যায় পানির ভেতর!
আমি জানিনা আমি ঠিক দেখেছি কিনা বা তখন আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো কিনা, কারণ তার কিছুক্ষণ পর সেই ব্যাক্তিটা উঠে আসে পানির ভেতর থেকে, দেখতে কুচকুচে কালো, প্রচণ্ড লম্বা, আর ভীষণ শরীর!
আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সে লোকটা শূন্যে ভাসছিলো, ওর কোলে নূর ছিলো! নূরের সাদা রঙের চুল দেখতে পেয়েছিলাম আমি।

সেই সময়েই কারা যেন আমাকে আর আইলিনকে টেনে নিয়ে গাড়িতে তোলে। আর এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই, জ্ঞান ফিরে আমি দেখি আমি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি, মাথায় স্টিচ দেওয়া।”
আরিশের শেষোক্ত কথাগুলো শুনে ওরা সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
“তোর শালা হ্যালুসিনেশনই হয়েছে। নইলে কোন লোকটা শূণ্যে ভাসবে বল আমাদের! হ্যালুসিনেশনে তুই ভূত দেখেছিস, কুচকুচে কালো ভূত।”

আরিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“তাই-ই হবে। মাথায় বাড়ি খেয়ে আমার হ্যালুসিনেশনই হয়েছে! নইলে এমন উদ্ভট জিনিসপত্র কেন দেখবো? তবে কাল নূরকে নিয়ে এমন ইনসিডেন্ট হয়েছে এটাতে কোনো ভুল নেই! এটা সম্পর্কে আমি শতভাগ নিশ্চিত।”
“কিন্তু নূর এখন কোথায়?”
“জানিনা আমি, ফারিশ জাবিন নূরের ব্যাপারে কিছুই জানাননি আমাকে। শুধু বলেছে ও বাসায় চলে গেছে, আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে পানি থেকে কে তুললো, আমি এখানে কিভাবে এলাম, কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না উনি, শুধু বললেন ‘অতো প্রশ্ন করো কেন?'”

“তাহলে কি নূর আর আসবেনা কলেজে? ওর সাথে যোগাযোগই বা করবো কিভাবে? ওর তো ফোনও নেই কাছে।”
“আসবে হয়তো, বা যোগাযোগ করে নেবে আমাদের সাথে। কিন্তু আমাদের ইভেন্টের কি হবে? নূর ছাড়া তো ইভেন্ট কম্পলিট করা সম্ভব না! তবে কি সেটা এখানেই স্থগিত?”
আরিশ ওদের প্রশ্নের উত্তরে বলল,
“এত প্রশ্ন করো কেন? কিছুদিন যাক, নূর যদি এর ভেতরে আমাদের সাথে যোগাযোগ না করে তবে আমরাই দেখবো কি করা যায়।”

রাতের দশটার দিকে ফোন বেজে উঠলো নওমির। নোটস করা রেখে ফোন তুলে দেখলো আননোন নম্বর থেকে কল, কল রিসিভ করে চুপ করে রইলো নওমি,
তখনি ওপাশ থেকে ভেসে এলো আনাবিয়ার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর,
“নওমি, আমার কোকো কি তোকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে কোথাও?”
“না রে, আঁচড় লেগেছে সামান্য, কিন্তু ওটা ধরার ভেতরে না। তুই তোর কথা বল, কাল রাতে ওইভাবে গায়েব হয়ে গেলি কেন? আমি কত চিন্তায় ছিলাম জানিস? তোর জন্য কেঁদে পর্যন্ত ফেলেছি আমি ফাজিল মেয়ে কোথাকার!”
নওমির এমন কথায় হেসে উঠলো আনাবিয়া, বলল,

“শোন, আমি আর বোর্ডিংয়ে আসবো না। আমার বইপত্র গুলো ছেড়ে আর যত রকমের জিনিসপত্র আছে সবকিছু একসাথে কলেজের ডোনেশন এরিয়াতে রেখে আসিস। আমি কয়েকদিন পর গিয়ে বইপত্র গুলো নিয়ে আসবো।”
“তুই বাসা থেকে আসবি এখন থেকে? রোজ বাসা থেকে এসে এক্সাম দিতে পারবি? কষ্ট হয়ে যাবেনা?”
“ওটা কোনো ব্যাপার না, দিতে পারবো। কদিনই বা, আর গাড়ির ভেতর বসে বসে যেতে কিসের কষ্ট? একটু ক্লান্ত লাগবে কিন্তু ওটা কোনো ব্যাপার না”

“আচ্ছা, আসিস। এটা তোর নতুন নম্বর? সেভ করে রাখবো?”
“না, এটা সেভ করতে হবেনা, এটা আমার না। আমার টা হাতে এলে তোকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেবো। পড় তুই।”
বলে কল কেটে দিলো আনাবিয়া। তারপর মীরের ফোন টা পাশে রেখে বই নিলো হাতে।
ক্লাস গুলো মিস হবে, কিন্তু কিছুই করার নেই, মীর ওকে যেতে দেবেনা এখন আর কোথাও।
প্রাসাদে ফেরার পর থেকে ও নিজের কামরাতেই আছে, বাইরেও বের হয়নি। গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে গেছিলো ও, মীর ঘুমন্ত অবস্থাতেই ওকে বিছানায় রেখে চলে গেছিলো রয়্যাল মিটিং রুমে। সেই যে গিয়েছে, এখনো ফেরেনি। দুপুরের খাবার খেতেও আসেনি।

ঘুম থেকে উঠে এখনো মীরের চেহারাটা দেখেনি ও। ফোনটা রেখে গেছে আনাবিয়ার কাছে, পাশে চিরকুট রেখে গেছে যেন প্রয়োজন হলেই কল করে। আনাবিয়ার এখনো প্রয়োজন হয়নি কল করার। যদিও চিরকুটটা সযত্নে রেখে দিয়েছে ওর পার্পল মলাটের ডায়েরির ভেতর।
কোকো ঘুমিয়ে আছে ওর কোলে। বেচারা আনাবিয়াকে কাছে না পেয়ে কিছুই মুখে তোলেনি গতরাতের পর থেকে। ফারিশ এসে দিয়ে গেছে ওকে বিকেলের দিকে।

আনাবিয়াকে পেয়ে কোকোর সে কি আনন্দ, পারলে লাফিয়ে উঠে যায় আনাবিয়ার কোলে!
ফারিশের কোল থেকেই লাফালাফি শুরু করেছে আনাবিয়ার কোলে যাওয়ার জন্য। আনাবিয়া এসে কোলে নিলে নিজের মাথাখানা আনাবিয়ার মুখের সাথে ঘষে জানান দিয়েছে আনাবিয়ার জন্য তার কষ্ট হওয়ার কথা!
সেই থেকে আনাবিয়ার কোলের পরেই আছে ও, একটু আগে ভরপেট খেয়ে ফুটবলের মতো গোল হয়ে এখন মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে।

আনাবিয়া ওর পিঠে একটু হাত বুলিয়ে মনোযোগ দিলো বইয়ে। সেই মুহুর্তেই হুড়মুড়িয়ে কামরায় এলো মীর।
এসেই ওর চোখ গেলো আনাবিয়ার কোলে শুয়ে থাকা কোকোর দিকে, ভ্রুকুটি করে ঝড়ের গতিতে এসে কোকোর লেজ ধরে উঁচু করে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে দিয়ে এলো ও বাইরে, নোমানের গায়ে। তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো নোমান।
মীর কোকোকে ফেলে আবার তড়িতে এসে আনাবিয়ার হাত থেকে বইটা ক্ষিপ্রতার সাথে ছিনিয়ে নিয়ে ছুড়ে ফেললো কোনো একদিকে। পরমুহূর্তেই আনাবিয়ার পা জোড়া এক হাতে ধরে হ্যাচকা টানে ওকে ঠেস দিয়ে বসা থেকে শুইয়ে দিলো বিছানায়।

তারপর নিজে গিয়ে শুয়ে পড়ল আনাবিয়ার বুকের ওপর, শুয়েই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ও।
সবকিছু এত দ্রুত ঘটলো যে আনাবিয়া কিছুক্ষণের জন্য তব্দা মেরে শুয়ে রইলো, ঘটনা গুলো প্রসেস হতে সময় লাগলো ওর কিয়ৎক্ষণ। প্রসেস হয়ে যেতেই ক্ষেপে উঠলো আনাবিয়া,
“এটা কি হলো? তুমি কোকোকে বাইরে ফেলে দিয়ে এলে ক……”
আনাবিয়াকে পুরো বাক্যটা শেষ করতে দিলোনা মীর,তার আগেই ক্ষিপ্র বেগে দখল করে নিলো ওর ঠোঁট জোড়া, প্রগাড় চুম্বনে শুষে নিতে চাইলো আনাবিয়ার ঠোঁটের সমস্ত মিষ্টত্ব!

কিছু মুহুর্ত বাদেই ওকে এই দম বের করা চুম্বন থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওর বুকের ওপর মাথা রেখে সরু কোমর টা নিজের দৃঢ় আলিঙ্গনের ভেতর নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে গাঢ় ফিসফিসে কন্ঠে বলে উঠলো,
“ক্লান্ত আমি অনেক, আমাকে একটু ঘুমোতে দাও এখানটায়! আদর দাও, শান্তি দাও!”
আনাবিয়া দ্বিতীয় কোনো কথা বলল না, মীরের ঝাকড়া চুল আর প্রশস্ত পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো আলতো করে।

কিন্তু পরক্ষণেই মীর আবার ওর বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর স্বর্ণাভ চোখের দিকে।
মীর ওর চোখে চোখ রেখেই আনাবিয়ার পোশাকের বুকের কাছটা নিজের দৃঢ় হাতের শক্ত মুষ্টির ভেতর ধরে ছিড়ে ফেললো হ্যাচকা টানে।
আনাবিয়ার অপরিপক্ক বক্ষ সম্পুর্ন উন্মুক্ত করে এবার আবারও মাথা রাখলো সেখানে। চোখ জোড়া পরম আবেশে বন্ধ করে নিয়ে আনাবিয়াকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলো ও। কিছু মুহুর্ত বাদেই ভারী হয়ে এলো ওর৷ নিঃশ্বাস।
আর আনাবিয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়ে হতভম্ব দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের ঝাকড়া চুলের দিকে।

মীরের ঘুম ভাঙলো ঘন্টা দুই পর। আনাবিয়া তখনো জেগে, মীরের ঝাকড়া চুলের ভেতর বিচরণ ঘটিয়ে চলেছে নিজের সরু আঙুলগুলোর।
ঘুম ভেঙে মীর একটা জোর শ্বাস টেনে নিয়ে নাক ঘষলো আনাবিয়ার বুকে। বুকের মধ্যিখানে ছোট্ট করে একটা চুমু খেয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলে উঠলো,
“ক্ষিদে পেয়েছে আমার!”
“বেলা তোমার কামরায় খাবার রেখে গেছে একটু আগেই, খেয়ে নেবে চলো।”
মীরের উন্মুক্ত পিঠে নিজের দুহাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল আনাবিয়া।
আরও কিছুক্ষণ আনাবিয়ার বুকের ওপর আড়মোড়া ভাঙাভাঙি করে মীর উঠে পড়লো। আনাবিয়াকে প্রস্তুত হতে দিয়ে ও চলে এলো নিজের কামরায়।

বেলিন্ডা আর নোমান তখনও দাঁড়িয়ে সেখানে। মীর ওদের দেখে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
“বেলিন্ডা, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, খাওয়া শেষ হলে নোমানকে ডেকে নেবো।”
বেলিন্ডা খুশি হয়ে আনুগত্য জানিয়ে নোমানের দিকে তাকিয়ে মুখ বেকিয়ে চলে গেলো বাইরে। নোমান নাখোশ হলো। বেলিন্ডাকে পাঠিয়ে দিলো, অথচ নোমানকে পাঠালোনা! নোমানের কি ঘুম পায়না?
কিছু মুহুর্ত পর মীর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে নোমানকে এমন মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
“তোমার ঘুম পেলে তুমিও যেতে পারো নোমান। হামদান অন্য কাউকে দিয়ে এগুলো ফেরত পাঠিয়ে দিবে।”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমি ঠিক আছি। আমার ঘুম ধরেনি এখনো। আপনাদের খাওয়া শেষ হলে আমিই নিয়ে যাবো এগুলো।”

মীর বিছানায় বসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওর দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
“ঘুম ধরেনি তুমি শিওর? আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি ঘুমের কাছে ধরা খেয়ে উলটে পড়ে যাচ্ছো! কামরায় গিয়ে বিশ্রাম নাও নোমান, হামদান অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিবে।”
নোমান কৃতজ্ঞ হলো অনেক। মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো ওর চেহারায়। হিজ ম্যাজেস্টি তার মতো নগন্য দাসেরও কত খেয়াল রাখেন!

মীরকে মাথা নেড়ে আনুগত্য জানিয়ে ও চলে গেলো নিজের কামরায়।
নোমান বেরিয়ে যেতেই আনাবিয়া এলো কামরায়। গায়ে ওর মীরেরই একটা ছাই রঙা ওভার সাইজ টিশার্ট, হাটুর নিচে এসে পড়েছে সেটা। মীর বসে ছিলো মেঝেতে পেতে রাখা বসবার স্থানে। আনাবিয়াকে দেখে হাসলো ও, বলল,
“তোমাকে তো খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা!”

আনাবিয়া মুখ বেকিয়ে মীরের কোলের কাছে বসতে বসতে বলল,
“আমার এত পছন্দের টপটা তুমি ছিড়ে দিয়েছো, এখন তোমার সব টিশার্ট আমি নিয়ে নেবো।”
মীর মিষ্টি হেসে ওর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
“যেখানে পুরো আমিটাই তোমার সেখানে নতুন করে আমার টিশার্ট গুলোর মালিকানা দাবি করার কি আছে?”
আনাবিয়া কিছু বলল না, নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে লাগলো, ওর এমন আনত দৃষ্টি দেখে মীর হাত বাড়িয়ে ওর থুতনি ছুয়ে মুখখানা ওপরে তুলে শুধালো,
“কি হয়েছে? আমার দিকে তাকাচ্ছোনা কেন?”

আনাবিয়া এক পলক মীরের চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো আবারও। ভীষণ লজ্জা লজ্জা লাগছে ওর, বার বার মীরের তখনকার কর্মকাণ্ডের কথা মস্তিষ্কের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।
আনাবিয়ার রক্তিম হয়ে যাওয়া গাল দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো মীর, ওর চোয়াল টিপে দিয়ে বলল,
“তুমি আবার লজ্জাও পাও? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি তোমার বাপের স্বভাব পেয়েছো! এক্কেবারেই নিলাজ, অতিরিক্ত রোম্যান্টিকতায় আসক্ত শক্তিশালী নারী, উম্যেন দ্যা সুপ্র‍্যা। কিন্তু এখন দেখি আমার ধারণা ভুল!”
বাবার কথা উঠতেই লাজলজ্জা ভুলে ফুসে উঠলো আনাবিয়া, মীরের ওপর হামলে পড়ে বলল,
“অ্যাই মোটেও আমার বাপ কে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। তোমার শ্বশুর হন তিনি, শ্বশুর কে এই ধরনের কথা বলো কিভাবে তুমি? সম্মানের সাথে কথা বলবে! ”

“যা সত্যি তাই বলছি, আমি ছাড়া তোমার বাপকে হাড়ে হাড়ে আর কে চিনেছে বলোতো! ইনায়াও চিনেনি।”
মীরের কথা শুনে ওকে এক ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে ওর বুকের উপরে উঠে বসে ওর গলা টিপে ধরে চোখ পাকিয়ে গর্জে উঠে আনাবিয়া বলল,
“অ্যাই, শাশুড়ির নাম ধরে ডাকো তুমি! তোমার সাহস তো কম না!”
মীর চোকড হওয়ার অভিনয় করে চেপে যাওয়া হিসহিসে গলায় বলল,
“শাশুড়ি হাটুর বয়সী হলে আমার কি করার আছে? আমি নাম ধরেই ডাকবো।”
“অহ্‌ তাই? তোমার শাশুড়ী হাটুর বয়সী হলে আমি কিসের বয়সী?
“নখ!”
বলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো মীর। আনাবিয়া রেগেমেগে গিয়ে কামড়ে ধরলো মীরের চোয়াল। মীর চিৎকার দিয়ে উঠে উচ্চস্বরে বলল,
“লাগছে শিনু! আমাকে পরে খেয়ো আগে ডিনার শেষ করো!”

জঙ্গলের ভেতরের বিশাল দীঘিটির পাড়ে বসে দীঘির স্বচ্ছ পানির ভেতর পা ডুবিয়ে বসে আছে আনাবিয়া। চকচকে স্বচ্ছ পানির ওপর এসে পড়ছে নীল আকাশে তুলোর পেজার মতো উড়ে বেড়ানো মেঘের ছায়া, যেন আকাশটাই নিজেকে ঢেলে দিয়েছে দীঘির ভেতর।
জঙ্গলের মৃদু মন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে আনাবিয়ার দীর্ঘ সফেদ চুল। সূর্যকিরণ পড়ে ঝিকিমিকি করছে চুলগুলো।
পরনে ওর মীরের সাদা রঙা ফিনফিনা শার্টের একটা, হাটু ছাড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে, ঢেকে রেখেছে ওর উন্মুক্ত স্বাস্থবান উরুদ্বয়।

মীর এতক্ষণ ওকেই খুঁজছিলো, জঙ্গলের ভেতর এসে তার শিনু যেন উধাও হয়ে গেছে পুরাই।
দূর থেকে আনাবিয়াকে দীঘির ধারে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে দেখে ‘শিনু’ বলে ডেকে উঠলো ও।
ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আনাবিয়া, মীরকে দেখা মাত্রই ওর ঠোঁট জুড়ে ছেয়ে গেলো প্রশান্তির হাসি।
পানির ভেতর থেকে পা তুলে উঠে দাঁড়ালো ও, মীর এগিয়ে এলো ওর দিকে। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
“ভেবেছিলাম তুমি খুঁজে পাবেনা আমাকে, আমি তো তোমার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি।”
মীর ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের তর্জনি আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর থুতনি ধরে বলল,
“তুমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকোনা কেন, তোমার মীরি তোমাকে ঠিকই খুজে বের করবে প্রাণ আমার!”
মীরের কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ কালো হয়ে উঠলো দীঘির স্বচ্ছ পানি, আকাশের প্রখর দীপ্তিমান সূর্য হঠাৎই ঢেকে গেলো কালো মেঘে৷

ভড়কালো মীর, প্রকৃতির হঠাৎ এমন রূপ ধরার কারণ খুজে পেলোনা ও। মাথা তুলে ও এলোমেলো দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কালো হয়ে যাওয়া আকাশ!
আনাবিয়া ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারপাশে একবার তাকিয়ে এগিয়ে এলো ওর কাছাকাছি, মীরের বুকে ঠেস দিয়ে নিজেকে ওর বুকের ভেতর লুকিয়ে নেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে করতে মীরের দিকে ভ্রু তুলে তাকিয়ে ভীতিপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,

“ভয় লাগছে আমার মীরি, জড়িয়ে ধরো আমাকে!”
মীর আকাশের দিক থেকে তড়িতে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জড়িয়ে নিতে গেলো ওকে নিজের সাথে, কিন্তু মীর ওকে দুহাতে আগলে নেওয়ার আগেই দীঘির পানিতে ঘূর্ণন তুলে পানির ভেতর থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে এলো দুটো বিশাল কালো রঙা হাত!
আর মুহুর্তেই তাদের ধারালো থাবা দিয়ে আনাবিয়াকে মীরের বুক থেকে এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিয়ে আবার তীব্র গতিতে ফিরে গেলো পানির ভেতর।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো মীর, আঁতকে উঠে ও সেই মুহুর্তেই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপ দিলো দীঘির ভেতর! তীব্র গতিতে সাঁতরে চলল নিচের দিকে, ওর স্বর্ণাভ দৃষ্টি দিশেহারার ন্যায় আকুল হয়ে খুজে ফিরলো আনাবিয়াকে।
তখনি ওর নজর গেলো পানির গভীরে তলিয়ে যেতে থাকা আনাবিয়ার হীরকখন্ডের ন্যায় উজ্জ্বল চোখ জোড়ার দিকে, অবলম্বন হারিয়ে যে অসহায়ের ন্যায় তাকিয়ে আছে মীরের দিকে! কালো হাত জোড়া টেনে নিয়ে চলেছে ওর শিনুকে অতলে।

ওর শিনর চোখ জোড়া বিস্ফোরিত! মীরের নাগাল পাওয়ার জন্য ছটফটিয়ে চলেছে ও পানির ভেতর, হাত জোড়া প্রাণপণে বাড়িয়ে রেখেছে মীরের দিকে!
মীর গতি বাড়ালো নিজের, একবার ওর শিনুকে ও হারাতে বসেছিলো, দ্বিতীয় বার শিনুকে ও হারিয়ে যেতে দিবেনা!
সেই মুহুর্তেই পানির গভীর থেকে এক ঝাক কুচকুচে কালো রঙা লতা উঠে এসে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো আনাবিয়াকে! সেগুলো দ্বিগুণ বেগে আনাবিয়াকে নিয়ে যেতে থাকলো নিচের দিকে!
তলিয়ে যাচ্ছে ওর শিনু, ওরা টেনে নিয়ে চলেছে ওর প্রাণকে ওর থেকে! অতলে, আরও অতলে! মীর ধরতে পারছেনা ওকে, কোনোভাবেই ওর শিনুর কাছে পৌছাতে পারছেনা ও! শিনু হারিয়ে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে থেকে, ক্রমে ক্রমে!

সেই মুহুর্তেই আঁতকে ঘুম থেকে উঠে গেলো মীর! জোর নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো ওর ঘন ঘন, ঘেমে গেছে সম্পুর্ন। গলা টেনে একটা শুকনো ঢোক গিলে চকিতে পাশ ফিরে তাকালো ও, তাকাতেই ধীর, স্বাভাবিক হয়ে এলো ওর শ্বাস।
আদুরে বেড়ালছানার ন্যায় ওর শিনু ঘুমিয়ে আছে ওর পাশেই, মুখাবয়ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক অপরুপ স্নিগ্ধ নিরবতা! ঠোঁটের কোণে ওর খেলে চলেছে এক মধুর হাসির রেখা, শ্বাসের তালে তালে মৃদু গতিতে ওঠানামা করছে ওর উষ্ণ শরীর।
বিছানার সাদা চাদরের কিয়দংশ আনাবিয়ার কোমল বাহুডোরে আবদ্ধ, বাকিটা দিয়ে আবৃত ওর দেহ।
সেটুকুকেই অবলম্বন করে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে ও! টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়া ফুলে আছে আদুরে হয়ে।
জানালা দিয়ে চাঁদের এক ফালি নরম আলো এসে পড়ছে ওর মুখের ওপর, স্বপ্নের দেশের পরীর মতো দেখাচ্ছে ওকে!

মির শরীর ঘুরিয়ে পাশ ফিরে আনাবিয়ার দিকে ফিরলো, আনাবিয়ার মাথার বালিশটা আলতো করে টেনে নিয়ে এলো নিজের কাছে, নিজেও এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার বালিশের নিকট।
আনাবিয়ার মুখের একেবারে কাছে নিয়ে গেলো ও নিজের মুখ খানা। ওর পূর্ণ দৃষ্টি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলো আনাবিয়ার চাঁদের আলো পড়া মুখখানা জুড়ে।
আনাবিয়ার নরম শ্বাস এসে পড়তে লাগলো মীরের মুখের ওপর, মীর এক হাতে সন্তর্পণে, আলতো করে আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে এলো নিজের বুকের ভেতর, ছোট্ট করে চুমু খেলো ওর কপালে। তারপর আবার দেখতে লেগে গেলো আনাবিয়ার শুভ্র মুখশ্রি! আর ঘুমোবেনা ও, ঘুমানোর সাহস হচ্ছেনা ওর আর!

ঘুম ভেঙে উঠে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো আনাবিয়া। তাকাতেই ওর চোখে পড়লো মীরকে; মুগ্ধ, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলো আনাবিয়া, তিনটা বেজে পনেরো। ফিরে আবার মীরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় শুধালো,
“তুমি ঘুমাওনি?”
“ঘুমিয়েছিলাম, ঘুম ভেঙে গেছে। এখন আর ঘুম আসছেনা।”
আনাবিয়ার চোয়ালের ওপর নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলিখানা পরম মমতায় বুলোতে বুলোতে নরম গলায় বলল মীর। আনাবিয়া শুয়ে শুয়েই এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসলো ওর দিকে, মীরের বালিশের ওপর মাথা রেখে নিজের বা হাতটা মীরের কর্কশ চোয়ালের ওপর রেখে হাত বুলোতে বুলোতে শুধালো,

“ঘুমোবেনা আর?”
মীর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। আনাবিয়ার হাত মীরের মুখের ওপর থেকে চলে গেলো মীরের ঝাকড়া চুলের ভেতর, আদুরে ভঙ্গিতে আঙুল চালাতে লাগলো ওর চুলের গোড়ায় গোড়ায়।
মীর ওর ঝাকড়া চুলের ভেতর বিচরণ করে চলা আনাবিয়ার হাতখানা নিজের হাতের ভেতর নিয়ে আনাবিয়ার হাতের আঙুলের ডগাগুলোয় ঠোঁট ছুইয়ে অসহায় গলায় বলে উঠলো,
“ঘুমোতে ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে তুমি হারিয়ে যাবে আবার! মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করলেই তুমি নেই হয়ে যাবে, তোমাকে আমি আর খুঁজে পাবোনা!”

মীরের কথা শুনে ফিক করে আলতো হাসলো আনাবিয়া। শোয়া থেকে উঠে বসে গা থেকে খুলে ফেললো মীরের ফিনফিনা শার্টটা। তারপর মীরের গায়ের টি শার্টটা পেটের কাছ থেকে উচু করে ঢুকে গেলো ও টিশার্টের ভেতর।
গলার নিকট থেকে মাথা বের করে মীরের মুখের সমানে মুখ নিয়ে এসে ওর চোয়ালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলল,
“এবার আমি আর কোথাও যাবোনা, ঘুমোও তুমি। আমি এখানেই আছি তোমার একদম কাছে, বুকের ভেতর।”
আনাবিয়ার কান্ডে মীর স্নিগ্ধ হাসলো। মীরের ঝিলিক দিয়ে ওঠা স্বর্ণাভ চোখ জোড়ার দিকে প্রেমময়ী দৃষ্টি ফেলে আনাবিয়া বলল,

“জানো! তুমি উপন্যাসের সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত চরিত্র, যাকে সবাই নিজের করে পেতে চায়, যাকে ছুঁতে চেয়ে বহু হৃদয় বিরহে জ্বলে, যাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটায় কতো নারী; কিন্তু কখনোই পায়না!
কিন্তু আমার ব্যাপারটা ব্যাতিক্রম! আমি সেই উপন্যাসের স্বপ্নের পুরুষটিকেই নিজের করে পেয়েছি, প্রতিটা নারী হৃদয়ের অপূর্ণ স্বপ্নকে পূর্ণ করেছি।
তুমি আমার জীবনের সেই অবিচ্ছেদ্য অংশ যা শুধু আমার, অন্য কারো নয়। আমার সমস্ত কিছু তুমি; আমার বাবা মা, ভাই বোন সব তুমি, শুধুই তুমি!
আমাকে তুমি কখনোই কারো অভাব বুঝতে দাওনি, কারো ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপ আমার নেই, তুমি আক্ষেপ করার মতো সুযোগই দাওনি আমাকে কখনো!
তোমার অস্তিত্বের প্রতিটি ছায়ায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে আমি সর্বদা খুঁজে পাই এক মহাজাগতিক শান্তি, যা শুধুমাত্র আমার ভাগ্যে লেখা, আর অন্য কারো নয়!
তুমি আমার, শুধুই আমার। আমার এই হৃদয়ের গভীরতম প্রার্থনা তুমি, শাশ্বত হয়ে আমারই ভেতর বিরাজ করো সারাটাক্ষন! ভালোবাসি তোমাকে!”

মীর এলোমেলো দৃষ্টি ফেললো আনাবিয়ার চোখের তারায়, মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চুমু খেলো আনাবিয়ার চোখের পাতায়, নাকে নাক ঘষে বলে উঠলো,
“আমি তোমাকে তোমার চাইতেও বেশি ভালোবাসি শিনু! এতটা বেশি যে তুমি সে ভালবাসার বিশালতা কখনো কল্পনাও করতে পারবেনা!”
বলেই দুহাতে আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরে এক প্রকার পিষে ফেললো নিজের বুকের সাথে। মীরের এলোমেলো স্পর্শে সুড়সুড়ি লেগে মিহি সুরে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনবিয়া। মীর বলল,
“হেসোনা, ঘুম চলে যাবে কিন্তু, তখন আর ঘুম আসবে না।”
“ঘুম এমনিতেও চলে গেছে।

গল্প বলোনা একটা! তুমি তো ছোটবেলায় কত গল্প বলে ঘুম পাড়াতে আমাকে। আজ একটা গল্প বলো, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই!”
“গল্প! কি গল্প শুনতে চাও তুমি?”
“তোমার যে গল্প ভালো লাগে তাই বলো, আমি তাই শুনবো।”
“রবার্ট ব্রাউনিং এর নাম শুনেছো?”
“হু, বহির্বিশ্বের খুব নামি-দামি পোয়েট”
“তার একটা কবিতা আছে, ‘আন্দ্রেয়া দেল সার্তো’।
সার্তো অর্থ দর্জি, দেল অর্থ সন্তান। আন্দ্রেয়া ছিলো একজন দর্জির সন্তান।
আন্দ্রেয়া ছিলো একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। মানুষ তাকে ডাকতো ‘ত্রুটিহীন শিল্পী’ নামে কারণ তার আঁকা ছবিতে কোনো খুঁত থাকতোনা কখনো।
তার একজন স্ত্রী ছিলো, নাম লুক্রেজিয়া।

লুক্রেজিয়া সুন্দরী ছিলো প্রচন্ড। আন্দ্রেয়া লুক্রেজিয়ার প্রতি প্রচন্ড দুর্বল ছিলো, বউকে সে ভালোবাসতো অনেক।
কিন্তু লুক্রেজিয়া ওকে ভালবাসতো না। আন্দ্রেয়ার শিল্পকর্ম বা ওর প্রতি আন্দ্রেয়ার আবেগ, ভালোবাসা কোনোটাই লুক্রেজিয়া বুঝতেও চাইতোনা কখনো। সে ছিলো আত্মকেন্দ্রিক, সে ভালোবাসতো শুধু নিজেকে।
আন্দ্রেয়া বুঝতো যে ওর বউ ওকে ভালোবাসেনা, ওকে পাত্তা দেয়না, পরপুরুষের প্রতি তার আসক্তি ছিলো, কিন্তু তবুও আন্দ্রেয়া লুক্রেজিয়ার ওপর ছিলো সমানে দুর্বল, কখনো চেষ্টা করেও আন্দ্রেয়া লুক্রেজিয়ার ওপর থেকে নিজের ভালোবাসা কমাতে পারতো না।

এদিকে লুক্রেজিয়ার প্রভাবে আন্দ্রেয়া নিজের শিল্পে মনোনিবেশ করতে পারতোনা পুরোপুরি। লুক্রেজিয়ার জন্য ওর মনোযোগ নষ্ট হতো, লুক্রেজিয়ার খেয়াল খুশি মতো আচরণ আন্দ্রেয়াকে বিপাকে ফেলতো সর্বদা।
লুক্রেজিয়াকে খুশি করতে গিয়ে আন্দ্রেয়া একবার জীবনের অনেক বড় একটা সুযোগ হারিয়ে ফেলেছিলো।
তার শিল্পকর্মের এতটাই নামডাক ছিলো যে একবার ফ্রান্সের রাজা ‘ফ্রাঁসোয়া দ্যা ফার্স্ট’ আন্দ্রেয়াকে আমন্ত্রণ করেছিলো তার জন্য চিত্রকর্ম এঁকে দিতে।
আন্দ্রেয়া রাজার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফ্রান্সেও গিয়েছিলো। কিন্তু শুধুমাত্র লুক্রেজিয়ার জন্য সে চিত্রকর্ম টা অসমাপ্ত রেখেই ফিরে এসেছিলো আবার।

লুক্রেজিয়া তাকে বলেছিলো যে সে আন্দ্রেয়াকে কাছে চায়, আন্দ্রেয়াকে সে মিস করে। আর লুক্রেজিয়ার এই একটি মাত্র অনুরোধেই আন্দ্রেয়া ওর শিল্পি হিসেবে খ্যাতি অর্জনের সবচেয়ে বড় সুযোগ ছেড়ে চলে এসেছিলো লুক্রেজিয়ার কাছে।
আন্দ্রেয়া ওর শিল্পের উন্নতি আর খ্যাতির চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো লুক্রেজিয়াকে!
আন্দ্রেয়া জানতো যে তার যে দক্ষতা তাতে সে মাইকেল এঞ্জেলো বা রাফায়েলের মতো শিল্পীদের অনেক আগেই ছাড়িয়ে যেতে পারতো, কিন্তু তার শিল্পে ছিলো আবেগের অভাব।

সে খুব নিখুঁতভাবে আঁকতে পারতো, কিন্তু তার শিল্প কখনো জীবন্ত মনে হতোনা, তাতে কোনো প্রাণের ছোঁয়া থাকতোনা। এই অভাবের কারণ হিসেবে সে সর্বদা দায়ী করতো লুক্রেজিয়াকে।
আন্দ্রেয়া বুঝতে পারতো ওর জীবন একটি পাখির মতো, যে ডানা মেলতে চায় পৃথিবীর আকাশে, মুক্ত হিতে চায়, কিন্তু পারেনা। কারণ ওর ডানাজোড়া বাধা লুক্রেজিয়া নামক সত্বা দ্বারা! লুক্রেজিয়া ছিলো ওর এক আকাশ পরিমাণ দুর্বলতা!

আন্দ্রেয়া বিশ্বাস করতো লুক্রেজিয়া যদি ওকে ওর প্রাপ্য ভালোবাসা, গুরুত্ব, সময় দিতো, বা লুক্রেজিয়াকে যদি ও চিরকালের মতো নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারতো তবে আন্দ্রেয়া নিজেও একদিন রাফায়েলের মতো উচ্চতর কোনো শিল্পী হতে পারত!
কিন্তু এত না পাওয়া, এত ত্যাগ, এত আক্ষেপের পরও আন্দ্রেয়া লুক্রেজিয়ার কাছে কখনোই কোনো অভিযোগ করেনি! সারাজীবন নিজের সমস্তটা দিয়ে সে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে লুক্রেজিয়াকে। লুক্রেজিয়াকে সে নিজের থেকে আলাদা করতে সক্ষম হয়নি কখনো, সারাজীবন নিজের কাছেই রেখেছে, ভালোবেসেছে। বাকিটা জীবন লুক্রেজিয়ার টক্সিক ভালোবাসা আর নিজের প্রতিভা বিকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থেকেছে!
কবিতার শেষে আন্দ্রেয়া লুক্রেজিয়ার উদ্দ্যেশ্যে একটি কথা বলে,

“I am yours for better or worse, and yet
My work is mine, and no less I am me.”
এর মর্মার্থ হলো
তুমি যেমনই হও, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার কাজ আমার অস্তিত্ব, আমার সত্তা আমি কখনো হারিয়ে যেতে দেবোনা।

রবার্ট ব্রাউনিং আদ্রেয়া আর লুক্রেজিয়ার মাধ্যমে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে, যেটা তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়! সম্পর্কের জটিলতা একজন প্রতিভাবান মানুষকে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারে, এবং এই সময়ে তার নেওয়া সিদ্ধান্ত তার জীবিনের ওপর ফেলে মারাত্মক প্রভাব!”
গল্প শেষ করে মীর তাকালো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া তার এই কাটখোট্টা গল্পে ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। মীর স্নিগ্ধ হেসে ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে চাপা সুরে বলে উঠলো,
“তুমি আমার লুক্রেজিয়া, আমার একমাত্র দুর্বলতা! আন্দ্রেয়ার শিল্পকর্মের মতো আমার জিবনের অন্যদিকে আমার সাম্রাজ্য! যদি কখনো ভালবাসা আর দায়িত্বের টানাপোড়েনে আমাকে পড়তে হয় তবে আমার জন্য আমার ফার্স্ট প্রায়োরিটি নির্ধারণ করা খুব কষ্টকর হয়ে যাবে শিনু! আমি জানিনা আমি আন্দ্রেয়ার মতো ত্যাগস্বীকার করতে পারবো কিনা, কিন্তু তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনোই কমবে না, জেনে রেখো!
তোমাকে আমি হাজার জন আন্দ্রেয়ার থেকেও বেশি ভালোবাসবো সারাজীবন, এটা আমার তোমাকে দেওয়া ওয়াদা!”

সূর্য পশ্চিম কোণে হেলে পড়ে অস্ত যেতে চলেছে, আকাশটা হয়ে আছে লালে লাল। তার রক্তিম আভা এসে পড়েছে সমুদ্রের নীল পানির ওপর, ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি করে নিজের সমস্ত সৌন্দর্য জাহির করে চলেছে শিরো মিদোরির সমুদ্র।
শেষ বিকেলের ভেজা বালির ওপর দিয়ে একটা আকাশি রঙা পাতলা গাউন পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছুটে চলেছে আনাবিয়া। ওর খিলখিলে হাসিতে মেতে উঠেছে মৃদু মন্দ বাতাস, চুল গুলো উড়িয়ে নিয়ে চলেছে এক রহস্যময় আনন্দে!
ওর পেছনে ধীরে ছোটার জন্য সাবধানবানী দিতে দিতে এগোচ্ছে মীর। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আনাবিয়া ছুটে চলেছে ওর মতো।
এই সমুদ্র পাড়টাকে ও আত্মার মতো ভালোবাসে, এখানে এলেই ওর সমস্ত দুঃখ, মন খারাপ যেন সমুদ্রের ভেতর থেকে ভেসে আসা নোনাবাষ্প মিশ্রিত বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় কোন দূর অজানায়, ওর আর কোনো আক্ষেপই থাকে না!

কাল থেকেই এক্সাম শুরু, কিন্তু পড়তে পড়তে বেচারার অবস্থা কাহীল! মীর দুপুরে ওর কামরায় এসে দেখে তার বউ মেঝেতে মাথা দিয়ে পা জোড়া বিছানার ওপর তুলে শুয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে, মীর কে দেখেই বলে,
“আমার দ্বারা পড়াশোনা আর হচ্ছেনা আঙ্কেল! আমাকে ছুটি দিন, ঘুরতে নিয়ে চলুন। নইলে আমি কিন্তু গেলাম পাগল হয়ে।”
আঙ্কেল বলার অপরাধে আনাবিয়ার মাথায় একটা গাট্টা মেরে তাই এখন ওকে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে হাওয়া খেতে এসেছে মীর।
আনাবিয়া এখন সমুদ্রের পাড় ঘেষে ছুটে বেড়ানো গাঢ় নীল রঙা কাকড়া গুলো ধরছে, কাকড়া গুলো ওর শরীর বেয়ে উঠে ঘুরেফিরে বেড়িয়ে চলেছে ওর সারা শরীর জুড়ে, ভয় নেই তাদের।

কাকড়ক গুলোর ছোট্ট ছোট্ট পায়ের মৃদু স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগছে আনাবিয়া, খিলখিল করে হাসছে ও। মীর এগিয়ে এসে আনাবিয়ার গ্রীবাদেশের নিচের অংশে থাকা একটা কাকড়াকে আঙুলের টোকা মেরে ফেলে দিলো, কাকড়াটা ছিটকে দূরে গিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়লে তার দিকে আঙুল তুলে ও ধমকানো গলায় বলে উঠলো,
“সবগুলোর শুধু আমার বউয়ের বুকের ওপর থাকার শখ! দিস প্লেইস ইজ অনলি মাইন, মাইন্ড ইট।
আনাবিয়া মীরের বলার ভঙ্গি দেখে হেসে উঠলো উচ্চস্বরে, মীর আনাবিয়ার গায়ে ওঠা সমস্ত কাকড়া গুলোকে এবার একটা একটা করে ধরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাকড়ার দলের থেকে ছিনিয়ে নিলো আনাবিয়াকে এক প্রকার, তারপর এক ঝটকায় পাজাকোলে তুলে নিলো ওকে।
আনাবিয়া মীরের কাধের কোণে মাথা ঠেকিয়ে মীরের রাজকীয় চেহারাটার দিকে দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো,

“তুমি কি এখন ওই নিষ্পাপ কাকড়া গুলোকেও হিংসা করবে?”
“হু।”
সামনে তাকিয়ে হেটে যেতে যেতে উত্তর দিলো মীর। আনাবিয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“তাহলে নওমি যে আমাকে দেখা মাত্রই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে প্রত্যেকবার, তখন!”
মীরের চলা থেমে গেলো সাথে সাথেই, আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুটি করে ও গমগমে গলায় শুধালো,
“কেন? ও তোমাকে জড়িয়ে ধরে কিসের জন্য? মেয়ে মেয়ে এত জড়িয়ে ধরা ধরি কিসের? হোয়াই?”
পরমুহূর্তেই আবার সামনে তাকিয়ে হাটা শুরু করে মীর বলল,

“আজকের পর থেকে যেন আর না শুনি, নইলে কিন্তু তোমার প্রাণপ্রিয় নওমির ভবলীলা সাঙ্গ করে দিবো, মাইন্ড ইট। তোমাকে কেউ কখনো কোনোভাবেই স্পর্শ করুক সেটা আমি চাইনা।
ছোটবেলায় তো তুমিও মানুষের টাচের ব্যাপারটা নিয়ে খুব স্পর্শকাতর ছিলে, তবে এখন এমন গোল্লায় যাচ্ছো কেন?”

“আমার খুব প্রিয় মানুষ গুলো আমাকে স্পর্শ করলে সেটা আমার কাছে অসুবিধা মনে হয়না, কিন্তু অন্য কেউ স্পর্শ করলে আমার ঘেন্না লাগে, মনে হয় যেন আমি অশুচি হয়ে গেছি! আমার হয়তো ওসিডি আছে মীরি!”
“তুমি কখনো অশুচি হবেনা শিনু। যদি পৃথিবীর সমস্ত কিছুও অপবিত্র হয়ে যায় তবুও তুমি পবিত্র থাকবে, তুমি কখনো অপবিত্র হবেনা। অন্তত আমি হতে দেবোনা।

তুমি আমার, আমি তোমাকে য়্যোন করি, এটা মনে রাখবে সবসময়। আমার সাম্রাজ্য আর তুমি এই দুইয়ে আমি কখনো দ্বিতীয় কারো স্পর্শ লাগতে দিবোনা, কোনোদিনও না, প্রাণ থাকতে নয়!”
আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে, মীরের মুখখানা হঠাৎ করেই প্রচন্ড শক্ত হয়ে উঠেছে, গুরুগম্ভীর একটা আবহাওয়া বিরাজ করছে ওর সমস্ত চেহারাটা জুড়ে। ভড়কালো আনাবিয়া, এই মানুষটা চাইলে যা কিছু করে ফেলতে পারে, চাইলে সমস্ত কিছু শেষ করে দিতে পারে!
যদি কখনো সত্যি সত্যিই এই সাম্রাজ্য বা আনাবিয়ার ওপর দ্বিতীয় কারো ছায়া এসে পড়ে তবে এই লোকটা ঠিক কতটা ভয়ানক হবে?

আনাবিয়াকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মীর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ওর দিকে। আনাবিয়াকে এমন ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতে দেখে মীর মুহুর্তেই ঝেড়ে ফেললো নিজের সমস্ত কাঠিন্যতা, কুঞ্চিত ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে ও বলল,
“আমাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই শিনু! এই মীরি তার প্রাণ থাকতে তোমাকে কখনো কোনো বিপদের মুখে ফেলবে না, কোনো শাস্তির মুখে ফেলবে না। তোমার ফল্ট থাকলেও না!
তবে তোমার কোনো ফল্ট যেন কখনো না থাকে শিনু! আমি সব মেনে নিলেও কখনো তোমার ভেতর অন্য কারো অস্তিত্ব মেনে নিতে পারবোনা। তোমার শরীর, মন, মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুমাত্র আমি রাজত্ব করবো, অন্যকেউ না, কোনো কিছুই না। শুধুই আমি।”

আনাবিয়া স্নিগ্ধ হেসে মাথা ছোয়ালো মীরের বুকের ওপর, ওর কখনো কোনো ফল্ট না থাকার আশ্বাস দিলো মীরকে।
মনে মনে আজ ও এই মুহুর্তে প্রতিজ্ঞা করলো, মৃত্যুমুখে পড়লেও কখনো ও নিজের ওপর অন্য কারো ছায়া পড়তে দিবে না, পৃথবী উল্টে গেলেও না।

নোমান হামদান আর অন্যরা মিলে সমুদ্রের পাড়ে রান্নার জোগাড়যন্ত করছে। মাটির চুলা করে সেখানে বনের ভেতর থেকে শুকনো খড়ি নিয়ে এসে জমা করছে নোমান, অন্যরা রান্নার সরঞ্জামগুলো গোছগাছ করছে।
হামদান কিছুই করছেনা, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে কে কি করছে, আর তদারকির নামে মাঝে মাঝেই যাকে তাকে ধমকাচ্ছে।
নোমান কাধের ওপর থেকে খড়ির বোঝা নামিয়ে হামদানের কাছে এসে কোমরে হাত বেধে বলল,
“হামদানিয়া সাট্টাফানিয়া, তুই কাজ না করে ছেলেগুলোকে শুধু শুধু ধমকাচ্ছিস কেন? হতচ্ছাড়া! দাঁড়িয়ে না থেকে কাজে হাত লাগা!”

“এই, আমি কি করবো না করবো সেটা কি তোর থেকে শুনতে হবেরে নোমানিয়া সুদানির ফুয়া! মহিলা মহিলার মতো থাকবি, আমার কাজে বাগড়া দিতে আসবি না।”
হামদানের কথা শোনা মাত্রই ক্ষেপে গেলো নোমান, তেড়ে এসে বলল,
“এই কে রে মহিলা? তুই মহিলা! তোর চোদ্দগুষ্টি মহিলা!”
“প্রমাণ দেখতে চাস তুই?”
বলে হম্বিতম্বি করে নোমানের দিকে এগিয়ে গেলো হামদান নিজেও৷ এমন সময় পেছন থেকে একজন চাপা সুরে বলে উঠলো,

“আপনারা থামুন, হিজ ম্যাজেস্টি শেহজাদীকে নিয়ে চলে এসেছেন।”
মুহুর্তেই স্থীর হয়ে গেলো ওরা দুজনেই। ঝগড়া বিবাদ লুকিয়ে আবার কাজে লেগে পড়লো সাথে সাথে৷
রান্নার সরঞ্জাম সবই গোছানো শেষ। এখন জায়গা ছাড়ার পালা। কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টি যে কেন মাটির চুলার কথা বললেন! প্রাসাদের কিচেন থেকে তো ইলেকট্রিক ওভেন এনে তাতেই রান্না করা যেতো!
ওদের ভাবনার মাঝেই সেখানে আনাবিয়াকে কোলে নিয়ে উপস্থিত হলো মীর। তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে গেলো ওরা সকলে, মাথা রইলো নিচের দিকে, ভুলেও শেহজাদীর দিকে তাকানো যাবেনা, তাকালেই গর্দান খোয়াতে হবে! নোমান আনত দৃষ্টিতে এগিয়ে এসে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, সবকিছু প্রস্তুত। আপনি অনুমতি দিলে আমরা জায়গা ছেড়ে দেবো৷”
মীর উপর নিচে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। নোমান আর হামদান অন্য ছেলেগলোকে নিয়ে তখনি প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
ওরা চলে যেতেই আনাবিয়া প্রশ্ন করলো,

“তুমি রান্না করবে?”
“হু, কেন? আমার রান্না খারাপ?”
“এ কথা আমি কখন বললাম! তুমি হলে গিয়ে দ্যা বেস্ট শেফ অফ শিরো মিদোরি। তোমার হাতের রান্না খারাপ হতে পারেইনা!”
মীর কোল থেকে নামিয়ে দিলো ওকে বালির ওপর। নামতেই ওর পায়ে ফুটলো বালির ওপর থাকা ছোট ছোট ধারালো পাথর কুচি। মুখ থেকে একটা চাপা চিৎকার বের হলো ওর। মীর ওর পায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে ভর্ৎসনার কন্ঠ বলে উঠলো,
“এখানে আসার আগেই বলেছিলাম জুতা পরে আসো, কিন্তু না! উনি তো ওনার কথার বাইরে অন্য কারো কথা শুনবেনই না!”

বলে নিজের পায়ের জুতা জোড়া খুলে এগিয়ে দিলো ওর পায়ের কাছে, ইশারায় জুতাটা পরতে বলে মীর এগোলো রান্নার সরঞ্জাম গুলোর কাছে।
আনাবিয়া মীরের বিশাল সাইজের জুতায় নিজের ছোট ছোট পা জোড়া ঢুকিয়ে হাটতে লাগলো এদিক ওদিক টুকুটুক করে। বড় জুতা পরে হাটতে ভাল্লাগছে ওর।
রান্নার সরঞ্জাম গুলোর চারপাশ দিয়ে একটা চক্কর দিয়ে এসে ও এবার দাড়ালো চুলার পাশে বসা রান্নার সরঞ্জাম গুলো ঠিকঠাক আছে কিনা পরখ করতে থাকা মীরের পেছনে। মীরের কাধের ওপর হাতের ভর দিয়ে মীরের পিঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ও শুধালো,

“কি খাওয়াবে আজ তুমি আমাকে?”
মীর বসে বসে শুকনো লাকড়ি দিয়ে চুলার জ্বাল করতে করতে উত্তর দিলো,
“আজ তোমার পার্সোনাল শেফ তোমাকে গরুর কালাভুনা খাওয়াবে।”
“কালাভুনা? সেটা আবার কেমন?”
“গরুর মাংস তেল মশলা দিয়ে ভেজে কষাতে কষাতে যখন এক্কেবারে কালো হয়ে যায়……”
“তোমার মতো?”

মীরের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলো আনাবিয়া, বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো ও। মীর ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে সেন্টি খাওয়া চোখে তাকালো একবার, তারপর আবার কাজে মনোনিবেশ করতে করতে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমার মতো। দেখতে কালো বাট হেব্বি টেস্টি! একবার খেলে জিভে স্বাদ লেগে থাকবে সারাজীবন।”
আনাবিয়া মীরের পিঠের নিকট থেকে ঘুরে এসে বসলো মীরের পাশে তারপর কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আমি তো তোমাকে টেস্ট করে দেখিনি, তাহলে জিভে স্বাদ লেগে থাকবে কিনা বুঝবো কিভাবে?”
মীর ঠোঁট কামড়ে হেসে তাকালো ওর দিকে, আনাবিয়া ঠোঁট টিপে হেসে মীরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকালো অন্য দিকে। মীর আবার কাজে মন দিয়ে বলল,

“শরীর পাকেনি, কিন্তু মন আর মাথা পেকে ঝুনা হয়ে গেছে।”
“দেখতে হবেনা কার সাথে থাকি? দ্যা গ্রেটেস্ট অ্যান্ড টেস্টিয়েস্ট কালাভুনা! যাকে একবার খেলে সারাজীবন জিভে স্বাদ লেগে থাকে, ইয়াম!”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭+১৮

মীর এবার কাজ ফেলে এগোলো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো, এদিকে ফিরতেই মীর কে ওর দিকে লোভাতূর দৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও ছুটলো সমুদ্রের দিকে! মীর ওর পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে উঠলো,
“পালাচ্ছো কেন? আসো তোমাকে বুঝিয়ে দিই কালাভুনার স্বাদ জিভে কেমন লেগে থাকে!”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১+২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here