বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯+৩০
রানী আমিনা
রাতের এখন প্রায় তিনটা। মীর ওর কামরা থেকে বেরিয়ে এগোচ্ছে লাইব্রেরির দিকে। এতক্ষণ কাজে ব্যস্ত ছিলো। এখন ওর হুশ হয়েছে ওর বউ নেই আশেপাশে, সেই যে কামরা থেকে বেরিয়ে গেছিলো আর ফিরে আসেনি।ফোনের স্ক্রিন অন করে দেখে নিয়েছে একবার আনাবিয়া ঠিক কোথায় আছে। রাগারাগি করে মেয়েটা যে এই রাতে রেড জোনে চলে যায়নি এটাই অনেক।
লাইব্রেরির দরজা ভেতর থেকে ভেজানো। দরজা ঠেলে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো মীর। ঢুকতেই ওর দৃষ্টি গেলো টেবিলের ওপর রাখা খোলা বইয়ের বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে। টেরাকোটা রঙা ঠোঁটজোড়ার নিচেরটা ফুলে আছে অত্যন্ত আদুরে ভঙ্গিতে।
মীর এগিয়ে গিয়ে আনাবিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে একবার ভালো করে দেখে নিলো ওকে। গভীর ঘুমে ডুবে আছে ওর বউটা, নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।
ওর ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে মীরের বুকের ভেতরটা ছেয়ে গেলো ভালো লাগায়, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে প্রশান্তির হাসি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঝুঁকে আনাবিয়ার ফুলে থাকা ঠোঁটটায় ছোট্ট করে একটা চুমু খেলো। মীরের এই ছোট্ট চুম্বনে ঠোঁটটা ঘুমের মাঝেই কিঞ্চিৎ কুচকে নিলো আনাবিয়া, পরক্ষণেই আবার স্থির হয়ে তলিয়ে গেলো ঘুমের ভেতর।
মীর অবাকই হলো। অন্যদিন আনাবিয়া ওকে ছাড়া রাতে ঘুমায়ইনা, ঘুমালেও ওর একটা স্পর্শেই জেগে ওঠে। আর আজ ওর চুম্বনেও উঠলোনা!
অতশত না ভেবে আনাবিয়াকে কামরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে সন্তর্পণে আনাবিয়ার মাথাটা আলতো করে উঁচু করে বইটা বের করলো ও শেল্ফে রেখ্ব দেওয়ার জন্য। কিন্তু বইটা হাতে নিয়ে বন্ধ করার সময় ওপরে বড় বড় অক্ষরে ‘লাইফ ট্রি’ লেখা দেখা মাত্রই মীরের মুখে এতক্ষণ খেলে বেড়ানো হাসিটা মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই! গম্ভীর হয়ে গেলো ও।
আনাবিয়াকে ও বারবার করে বলেছে পঞ্চাশের আগে যেন কোনোভাবেই এসব বইয়ে সে হাত না দেয়। কিন্তু ওই মেয়েটা ওর কোনো কথাই শুনে না।
মীরের বুকভর্তি ভয়! লাইফ ট্রি শেহজাদীদের ওপর শুরু থেকেই একটা আলাদা আকর্ষণ রাখে। এমনটা ঠিক কি কারণে সেটা জানা যায়নি কখনো।
হয়তো শেহজাদীদের জিনকোডিংটা লাইফ ট্রি খুব যত্ন করে করেছিলো বলে তার সাথে শেহজাদীদের একটা আলাদাই সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়!
মীর খুব ভালোভাবেই জানে লাইফ ট্রি সবকিছুর ভালো চাইলেও শেহজাদীদেরকে সবসময় নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে চায়। এইসব বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে মীরের একদিন চোখ আটকেছিলো একটা লেখায়; শেহজাদীরা যদি কখনো একটানা মাসের পর মাস রেড জোনের ভেতর থাকে এবং একবারের জন্যও বাইরে বের না হয়, তবে ধীরে ধীরে সেই শেহজাদীকে রেড জোনের সাথে আবার মিশিয়ে নেয় লাইফ ট্রি। নিয়ে নেয় নিজের কাছে!
শুধুমাত্র এই ভয় থেকেই মীর কখনোই আনাবিয়াকে একা একা রেড জোনে যেতে দেয় না। নিজে নয়তো অন্য কাউকে সর্বদা ওর সঙ্গে রাখে।
ভয় হয়, ওর আদরের শিনুকে না লাইফ ট্রি লোভ সামলাতে না পেরে সত্যিই নিয়ে নেয়!
মীর জানে, লাইফ ট্রি কখনোই এমনটা করবে না, নিজের রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন্সের বাইরে যাবেনা৷ কিন্তু ভয় তো হয়!
ও কখনোই চায় না আনাবিয়া লাইফ ট্রির এই ডার্ক সাইডটা সম্পর্কে জানুক। নইলে যে বুকভর্তি খুশি নিয়ে ও রেড জোনে ঘুরে বেড়ায় সেই খুশি ও হারিয়ে ফেলবে!
মীর খেয়াল করে দেখেছে, লাইফ ট্রির আনাবিয়ার প্রতি এক আলাদা আকর্ষণ কাজ করে।
আনাবিয়া লাইফ ট্রির কাছাকাছি গেলেই সেটা ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় আষ্টেপৃষ্ঠে। লাইফট্রি এর আগে কখনো কোনো শেহজাদীর সঙ্গে এমনটা করেনি।
লাইফট্রির ঠিক কী পরিকল্পনা রয়েছে ওদের দুজনকে নিয়ে, সেটা বুঝে উঠতে পারে না মীর।
ওই বাচ্চা মেয়েটিকে সে কেন মীরের সঙ্গে বেঁধে দিলো, এটা কি কোনো পরিবর্তন নাকি কোনো ধ্বংসের সূচনা, কিছুই ও জানে না!
হাতের বইটা শব্দ করে বন্ধ করে সেটা তার নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে আনাবিয়ার কাছে এলো মীর, তারপর ওকে বাচ্চাদের মতো করে কোলে তুলে নিলো। তবুও আনাবিয়ার ঘুমে সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটলো না।
এটা যে ওই বইয়েরই সাইড ইফেক্ট, তা বুঝতে বাকি রইলো না মীরের। সকাল বেলা আনাবিয়ার সঙ্গে এটা নিয়ে একটা সিরিয়াস আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আনাবিয়াকে কোলে করে ওর কামরার দিকে এগোলো মীর।
বেলা প্রায় বারোটা। আনাবিয়ার হাতে লাইফ ট্রির বইখানা। বইয়ের একটি নির্দিষ্ট স্থান খুলে চোখের সামনে ধরে দ্রুত পায়ে ও এগোচ্ছে রেড জোনের ভেতর দিয়ে। ওর সঙ্গে ওর সমস্ত বাচ্চাগুলো, কোকো ব্যাতিত সবগুলো যে যার অ্যানিম্যাল ফর্মে এগোচ্ছে ওর সাথে সাথে। মাথা উঁচু করে হাঁটছে সবগুলো ওদের শেহজাদীর পেছন পেছন। প্রচণ্ড দায়িত্বশীল বডিগার্ডের মতো আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর ওদের।
অন্যমনস্ক আনাবিয়ার একপাশে বিরাট বিশাল সিংহ লিও, দ্যা রয়্যাল বেঙ্গল কাঞ্জি আর হাইনা। অন্যপাশে বিশালাকার বিষধর পাইথন আলফাদ, দানবের ন্যায় ব্লাক প্যান্থার জোভি আর অত্যন্ত শক্তিশালি ওকামি।
সবার পেছনে কোকো, কোকোর কাঁধের ওপর চুপচাপ বসে আছে ফ্যালকন। আজ ফ্যালকনকে উড়তে শেখার ফার্স্ট ট্রেইনিং দেওয়ার জন্য ধরে বেধে নিয়ে এসেছে ওরা সবগুলো। আর ওকে ট্রেইনিং দেওয়া হবে জানার পর থেকেই চুপসে গেছে ও। কোকো ওকে বারবার ভয় দেখাচ্ছে যে ওকে উঁচু গাছের ডাল থেকে দুড়ুম করে ছেড়ে দেওয়া হবে, উড়তে পারলে আলহামদুলিল্লাহ, না পারলে ফি আমানিল্লাহ। কোকোর কথার পর থেকেই থরথর করে কাঁপছে সে, কারণ তাদের সিনিয়র ভাই কোকো যাচ্ছেতাই ক্ক্রে ফেলতে পারে, শেহজাদীর আদরের বড় ছেলে কিনা!
আনাবিয়ার মনোযোগ বইয়ের দিকে, আজ একটা এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্দ্যেশ্যে মীরের অগোচরেই জঙ্গলে চলে এসেছে ও৷
ঘুম থেকে উঠেছে ঘণ্টা দুই হলো। কাল রাতে কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়েছে, টেরই পায়নি। সকাল বেলা নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে বুঝেছে মীরই নিয়ে এসেছে। হয়তো ওর কাছে লাইফট্রি বই দেখে মীর অসন্তুষ্টও হয়েছে। সকাল বেলা মীর ওকে না জাগিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই চলে গেছে নিজের কাজে। আর সেই সুযোগেই আনাবিয়া বই নিয়ে ছুটেছে জঙ্গলে। মীর জানলে ওকে আস্ত রাখবেনা! হয়তো কাল রাতে ও এই বই পড়েছে তার জন্য আজ লেকচারও মিলবে সন্ধ্যা বেলা, সোয়ামী তার নাইট স্কুল খুলবে আজ নিশ্চিত!
কিছুক্ষণ পর লাইফ ট্রির কাছে পৌঁছে গেলো ওরা। বাচ্চারা সব খেলতে চলে গেলো এদিক-ওদিক। দেমিয়ান শেহজাদীর ছায়াতলে বড় হওয়ার কারণে রেড জোনের অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় ওরা অনেকাংশে উন্নত। তার ওপর শেহজাদী নিজের হাতে তাদেরকে বড় করে তুলেছেন এই বিষয়টা নিয়ে তাদের গর্বের শেষ নেই।
অ্যানিম্যাল টাউনের অন্যান্য সদস্যরাও তাই ওদেরকে সমঝে চলে, সকলেই জানে এই বাচ্চাদের গায়ে টোকা পড়লেও শেহজাদীর ভয়ানক ক্রোধ নেমে আসবে তাদের ওপর! বাচ্চারাও তাই আশকারা পেয়ে পেয়ে এখন সমস্ত জঙ্গলজুড়ে চালিয়ে বেড়ায় নানান অরাজকতা!
আজ এখানে ঝামেলা, কাল ওখানে মারামারি, এক স্থানে কাটাকাটি আরেক জায়গায় মাথা ফাটাফাটি এসব এখন তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
আনাবিয়া তবুও ওদের কিছুই বলে না। ওর মতে, এসব কাজ কারবার না করলে বাচ্চারা কখনো লিডার হতে পারবে না। নেতৃত্ব দিতে হলে নিজেকে সেই স্থানে নিতে হবে। ওর বাচ্চারা জঙ্গলজুড়ে রাজত্ব করে বেড়াবে, ওর বাচ্চারাই সমস্ত কাজের হাল ধরবে এটাই ওর চাওয়া। ওর হাতে গড়া বাচ্চাদের দিয়েই রেড জোন সুরক্ষিত রাখবে ও।
লাইফট্রির কাছে পৌঁছে সবগুলো এদিক-ওদিক লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করতে করতে ছুটলো জঙ্গলের ভেতর। ফ্যালকনকেও ওসের সাথে দিয়ে দিলো কোকো, সবগুলোকে নিয়ে লিও ওকামি আর হাইনা তিন সিনিয়র ভাই এগোলো জঙ্গলের সবগুলোর পেছনে একটু খোঁচা মেরে আসতে।
কোকো রয়ে গেলো, কারণ শেহজাদীকে একা ছাড়লে হিজ ম্যাজেস্টি ওকে উদ্ধার করে ফেলবে। তাঁর কড়া আদেশ, তাঁর অবর্তমানে তাঁর বউকে দেখে রাখার দায়িত্ব সম্পুর্ন কোকোর, কোকো ছাড়া নিজের বউয়ের ক্ষেত্রে আর কাউকে বর্তমানে হিজ ম্যাজেস্টি বিশ্বাস করেন না।
আর সেখানে রেড জোনের ভেতর বউকে একা ছাড়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
সবগুলো চলে গেলে আনাবিয়া বইটা হাতে নিয়ে গিয়ে এবার বসলো লাইফট্রির সামনে। কোকো গিয়ে হাটু মুড়ে বসলো ওর পাশে। আনাবিয়াকে ওমন মনোযোগ দিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এত মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছেন শেহজাদী?”
আনাবিয়া বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই উত্তর দিলো,
“ এখন আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করবো, সেটারই স্টেপ গুলো মুখস্থ করছি।”
কোকো আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে দু’বার কৌতুহলী ভঙ্গিতে ভ্রু নাচালো আপনমনে। আনাবিয়া বই বন্ধ করলো এবার, তারপর লাইফট্রির দিকে মুখ তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও হঠাৎ করেই ধীর গতিতে শুরু করলো সুর তোলা। আস্তে আস্তে বাড়লো ওর গলার আওয়াজ, ওর মোহনীয় সুরের প্রচন্ড মিষ্টি স্পর্শে শিহরণ বয়ে গেলো লাইফট্রি সহ আশেপাশের সমস্ত গাছগুলোতে। ওক অদ্ভুত ঝিলিকে আলোকিত হয়ে উঠতে লাগলো সেগুলো।
জীবনে কখনো গানের গ’ ও না শেখা আনাবিয়াকে এভাবে এমন অদ্ভুত কঠিন মনমাতানো সুরগুলো এত সহজ ভঙ্গিমায় তুলতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো কোকো। বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ ফাঁকা হয়ে গেলো ওর ঠোঁটজোড়া।
আনাবিয়ার কণ্ঠনিঃসৃত মোহনীয় সুরে ওর চোখ জোড়া ঝিমিয়ে আসতে চাইলো, যেন রাজ্যের সমস্ত ঘুম এসে পড়েছে ওর চোখে! বন্ধ হয়ে আসা চোখ জোড়া প্রচণ্ড কষ্টে মেলে রাখার চেষ্টা করতে করতে ও শুনতে লাগলো আনাবিয়ার গাওয়া সেই হৃদয়গ্রাহী সংগীত।
আর তার কিছুক্ষণ পরেই ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি! এতক্ষণ আনাবিয়ার সুরের মোহে আচ্ছন্ন থাকা কোকো হঠাৎ বৃষ্টির ছাঁটে চমকে উঠলো। এই আকস্মিক বৃষ্টির কারণ খুঁজে পেল না ও। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আনাবিয়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“আম্মা, উঠুন এখনি! বৃষ্টি হচ্ছে ভিজে যাবেন তো!”
কোকোর কথায় সুর থামালো আনাবিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেলো বৃষ্টি! এবার আশ্চর্যের চোটে কথা বন্ধ হয়ে গেলো কোকোর, আনাবিয়ার দিকে বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও। ওর হতভম্ব চেহারার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো আনাবিয়া, বলল,
“ব্যাপারটা দারুণ, তাই না?”
“এ-এটা কি হলো আম্মা!”
“লাইফট্রির একটা ফাংশন আছে। এটা সাউন্ডে প্রতিক্রিয়া জানায়। তবে সবার সাউন্ডে নয়, শুধুমাত্র দেমিয়ান শেহজাদীদের কণ্ঠনিঃসৃত সাউন্ডে। এই বইটিতে লাইফট্রির প্রতিটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট নোটেশন লেখা আছে, যা লাইফট্রির জন্য কমান্ড হিসেবে কাজ করে, আর সেই অনুযায়ীই আমি সুর তুলেছি।
নোটগুলো যখন তোলা হয় তখন সেগুলো লাইফট্রির কমান্ড সেকশনে গিয়ে ধাক্কা খায়। আর সাউন্ডের ওয়েভ আর টোন অনুযায়ী কমান্ড পালন করে ও।
আমি চাইলে ওকে সব রকমের কমান্ড দিতে পারি, সাউন্ডের মাধ্যমে। আমি কান্না করলে যে বৃষ্টি হয় এটাও ওর সাউন্ড সিস্টেমেরই একটা অংশ। আমি যদি সম্পূর্ণ নিঃশব্দে কান্না করি, তবে কোনো বৃষ্টিই হবে না। আর শব্দের তীব্রতা অনুযায়ী বৃষ্টি হবে। কিন্তু এটা প্রাকৃতিক বৃষ্টি নয়, বলতে পারো কৃত্রিম, লাইফট্রির তৈরি।”
বলতে বলতে হাসি ফুটে উঠলো আনাবিয়ার মুখে। চুপিসারে আবার বলল,
“আমি যে একাজ করেছি সেটা যেন মীর কোনোভাবেই না জানে, ওকে?”
কোকো ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে ওকে আস্বস্ত করলো যে হিজ ম্যাজেস্টি কোনোভাবেই জানবে না।
হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় বাকি বাচ্চাগুলোও জঙ্গলের ভেতর থেকে ফিরে এসেছে আবার ওদের কাছে। ওদেরকে দেখে আনাবিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠলো,
“প্রাসাদে ফিরতে হবে এখনি। মীরের কামরায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। আমাদেরকে দেখতে না পেলে সে প্রাসাদ মাথায় তুলবে।”
স্বল্প সময়ের ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলো সব লাফালাফি করতে করতে এগোলো আগে আগে। ফ্যালকন বেজায় খুশি, কারণ ওকে আজ উড়তে শিখতে হয়নি। লিওর পিঠের ওপর আরামসে বসে ও এগোচ্ছে ওদের সাথে সাথে।
আনাবিয়া উঠে দাড়ালে কোকো নিজের গায়ের আধভেজা শার্টটা খুলে দিলো আনাবিয়ার নিকট। আনাবিয়া হাতের বইটা কোকোর হাতে দিয়ে, গায়ের সাথে লেপ্টে থাকা ভিজে পোশাকের ওপর চাপিয়ে দিলো কোকোর শার্টটা। তারপর কোকাকে সাথে নিয়ে এগোলো প্রাসাদের দিকে।
কোকো তখনও অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে বারবার দেখতে লাগলো আনাবিয়াকে। আনাবিয়া ওর এমন দৃষ্টি দেখে বললো,
“যা বলার বলে ফেল।”
“আপনি তো কখনোই গান শেখেননি শেহজাদী। তবে নোটগুলো চিনলেন কিভাবে?”
“আমি নিজেও জানি না। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হলো ওগুলো আমার জানা। সবই কেমন অটোমেটিক ভাবে হয়ে গেলো, কিভাবে হলো জানি না!”
“কিন্তু লাইফট্রি এত দ্রুত বৃষ্টি তৈরি করলো কিভাবে?”
“লাইফট্রির কমান্ড সেকশনে যখন নির্দিষ্ট টোনগুলো গিয়ে আঘাত করে, তখন লাইফট্রি ওর বিশেষ সিগন্যালের মাধ্যমে আশেপাশের সমস্ত গাছগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প নির্গত করে চারপাশের আর্দ্রতা বাড়িয়ে তোলে। জলীয় বাষ্প গুলো একসাথে জমা হয়ে অনেকটা মেঘের মতো দেখায়, যেটা মেইন ক্লাউডের স্তর থেকে বেশ অনেকখানি নিচের দিকে থাকে। প্রাকৃতিক মেঘের মতো অতটা ওপরে তৈরি হয় না।
লাইফট্রি এরপর শিরো মিদোরির মাটি, খনিজ আর সমুদ্রের পানি থেকে কাঁচামাল নিয়ে সিলভার আয়োডাইড, পটাসিয়াম আয়োডাইড আর লিকুইড প্রোপেন তৈরি করে ওই বাষ্পের ভেতর ছড়িয়ে দেয়। এতে বাষ্পটা আরও বেশি ঘন আর ভারী হয়ে যায় আর তারপরই শুরু হয় বৃষ্টি।
আর এই সম্পুর্ন প্রক্রিয়াটা লাইফট্রি করে প্রচন্ড দ্রুত গতিতে।”
কোকো অবাক হলো। এতদিন ও লাইফট্রিকে জাস্ট সামান্য অসাধারণ ভেবে এসেছিলো। কিন্তু ও যে এতটা অ্যাডভান্স টেকনোলজি নিয়ে কাজ করে সেটা কোকো ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি!
কোকোর হতভম্ব চেহারাকে উপেক্ষা করে আনাবিয়া পা বাড়ালো জোর কদমে, মীর প্রাসাদে ফেরার আগেই বইটা আবার রেখে দিতে হবে তার নির্দিষ্ট স্থানে।
দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিলো আনাবিয়া, গতরাতে মীর বিছানায় আসেনি বলে ও ঘুমাতে পারেনি ভালোভাবে। সারারাত না ঘুমানোর কারণে বেলা বারোটা বাজতে না বাজতেই চোখে ঘুম চলে আসছিলো ওর৷ দুপুরের খাবার না খেয়েই তাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো ও।
বিছানার পাশে থাকা সাইড টেবিলের ওপর কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ, পাতলা ছোট যন্ত্রটা শব্দ করে কেঁপে উঠে জানান দিলো কারো বার্তার।
অসময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দের কারণে ঘুম ভেঙে গেলো আনাবিয়ার, চোখ জোড়া কুচকে নিয়ে মাথা তুলে ও হাতে নিলো সেটা। স্ক্রিনে ভেসে রইলো একটা নাম, এলিজা।
আঙুলের স্পর্শ দিতেই সেটা নিয়ে গেলো সোজা মেসেজ বক্সের ভেতরে, এলিজা নামক মেয়েটা লিখেছে,
“ক্যাম্পিং এ চলনা দোস্ত প্লিজ! তুই না গেলে লেইলা, জারা, ইসাবেলা, গ্রেস কেউই যেতে চাচ্ছেনা।”
আনাবিয়া ফোস করে শ্বাস ফেললো একটা। অসভ্য গুলো ওকে ছাড়া একটা কাজও যদি নিজেরা করতে পারে! আনাবিয়া উঠে বসে দুহাতে স্বচ্ছ ফোনটা হাতে ধরে টাইপ করলো,
“তুই একাই যা, ওদেরকে সাথে নিতে হবে না।”
সেন্ড করতেই ওপাশ থেকে সাথে সাথে উত্তর এলো,
“হুউ! আমি ছেলেগুলোর সাথে একা একা যাবো নাকি? আর তাছাড়া ইসাবেলা না গেলে ইথান যাবেনা, আর ইথান আর ইব্রাহিম মায়ের পেটের ভাইয়ের চাইতে বলবৎ! ইথান না গেলে ইব্রাহিমও যাবেনা।
তাইলে কি শুধু আমি, অলিভার আর জিবরান যাবো? জিবরান না হয় ভালো ছেলে, অলিভার? ও কি লুইচ্চার লুইচ্চা তুই জানিস না?”
“আচ্ছা, আমি দেখছি কি করা যায়।”
“একটু ভালোভাবে চোখ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করেন ম্যাম, প্লিজ!”
“হু।”
সেন্ড করে ফোনটা আবার জায়গায় রেখে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো আনাবিয়া। ঘড়ির কাটা চারটা ছুই ছুই। বিছানা থেকে নেমে ও ঢুকলো ওয়াশরুমে।
ভার্সিটিতে ঢুকেছে আজ বছর দুই হচ্ছে। দ্বিতীয় বছরের ফাইনাল শেষে এখন একটু ফাঁকা সময় পাওয়া গেছে বলে ও প্রাসাদে এসেছিলো। কোকো, ফ্যালকন সবাইকে নিয়ে ও ওর ডাস্কমায়ারের রাজবাড়ীতেই থাকতো। মীর প্রায় প্রতি রাতেই গিয়ে উপস্থিত হতো সেখানে।
কিন্তু এখন ছুটি চলছে বলে ও বাচ্চাদের নিয়ে চলে এসেছে প্রাসাদে।
ছুটি পাওয়ার আগে থেকেই ওর বন্ধুবান্ধব গুলো সব ক্যাম্পিং করতে যেতে চাইছে অনেক দিন ধরে, কিন্তু আনাবিয়া যেতে চাইছিলোনা। মীর আর বাচ্চাদের সাথে ছাড়া অন্য কারো সাথে কোথাও ঘুরে মজা পায়না ও। তাছাড়া সেখানে এক দল ছেলে যাবে। মীর যতই ওকে বিশ্বাস করুক, ওকে সব ধরণের স্বাধীনতা দিক, আনাবিয়ার কাছে ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। তাই এই বিষয়ে মীরকে ও কিছুই জানায়নি। জানালে মীর কোকোকে সাথে দিয়ে ওকে ঠিকই পাঠিয়ে দিতো ঘুরতে।
মীরের কথা মনে পড়তেই আনাবিয়ার মাথায় এলো তিনি এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত! সারাটা দিন রয়্যাল মিটিং রুম, নয়তো অ্যানিম্যাল টাউন, নয়তো অন্য দ্বীপগুলোতে নিজের জনগণের সাথে গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়ে তিনি প্রাসাদে ফেরেন এক্কেরে মাঝ রাতে।
অন্যদিন তো ফিরে তবুও আনাবিয়ার কামরায় এসে ওকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমায়, গতরাতে সে নিজের কামরায় এসেছে ঠিকই কিন্তু আনাবিয়ার কামরাতে আসেনি। নিজের কামরাতেই ঘুমিয়ে গেছে। সেই রাগে পড়ে আনাবিয়া সারাদিন কথা বলেনি ওর সাথে।
কিন্তু মীরের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সে এতই ব্যস্ত যে বউ রাগ করেছে সেটা ও টেরই পায়নি। কিন্তু ওকে তো টের পাওয়াতে হবে।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে আনাবিয়া মীরের কামরায় শব্দ পেলো, তিনি কি আজ তবে সকাল সকাল ফিরে এসেছেন?
দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখে নিলো কি অবস্থা। সোয়ামী তার পোশাক চেঞ্জ করছে, তবে আর বাইরে যাবে না আজ?
আনাবিয়া দরজার নিকট থেকে ফিরে এলো আবার, তারপর নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো সামান্য। পাতলা একটা পোশাক পরে হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখ জোড়াতে স্মোকি করে কাজল পরে নিলো।
আয়নায় তাকিয়ে নিজের চোখ দেখে নিজেই টাস্কি খেলো আনাবিয়া, মীর আজ ওর দিক থেকে কিভাবে নজর ফেরায় সেটাই দেখবে ও।
ঠোঁট জোড়াতে সামান্য গ্লোস লাগিয়ে টেরাকোটা রঙা ঠোঁট জোড়াকে আরও লোভনীয় করে রেশমের ন্যায় চিকচিকে সাদা চুলগুলো পিঠময় ছেড়ে দিয়ে উঠে এসে দাঁড়ালো দরজার পাশে।
মীর ততক্ষনে বসে গেছে তার টেবিলে। চোখে-মুখে তার গম্ভীরতা ছাপানো, ভ্রু জোড়া কুচকে আছে কোনো দুর্বোধ্য বিরক্তিতে।
আনাবিয়া দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ধীর পায়ে। আওয়াজ পেয়ে কাগজপত্রের ওপর থেকে চোখ তুলে সেদিকে তাকালো মীর। তাকাতেই ওর বিরক্তিতে ভরা চোখ জোড়ায় ছেয়ে গেলো প্রশান্তি! দৃষ্টি আটকে গেলো আনাবিয়ার কামনা পূর্ণ চোখ জোড়ার ওপর।
আনাবিয়া ওর পাতলা কোমরে ঢেউ তুলে এগিয়ে এলো মীরের দিকে। কিন্তু মীর কিয়ৎক্ষণ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে মনোযোগ দিলো কাগজপত্রের দিকে।
মনোক্ষুণ্ণ হলো আনাবিয়া। এটা কি ধরণের বেডা মানুষ ওর মাথায় আসেনা! কাজের সময় তার কাজই প্রথম, অন্য সবকিছুকে সে তখন এক সাইডে রেখে দেয়, আনাবিয়াকেও!
আনাবিয়া তবুও মুখ ভার করে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মীরের টেবিলের পাশে। মীর কাগজের ওপর থেকে মুখ না তুলেই নরম গলায় শুধালো,
“কি চাই?”
“চুমু।”
অকপটে বলে দিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আনাবিয়া। মীর কাগজের ওপর থেকে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে আবার শুধালো,
“কোথায়?”
“সবখানে।”
নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিলো আনাবিয়া। মীর ভেবেছিলো, বউ তার এই মুহূর্তে অল্পে তুষ্ট হয়ে থাকবে। কিন্তু না, বউ তার সবখানে চুমু চায়। কিন্তু এখন ওর এসবের সময় নেই। আবার কাগজের দিকে মন দিয়ে ও বলে উঠলো,
“এখন সময় নেই শিনু! পরে দেই?”
“কেন? এখন কি সমস্যা?”
মীর কাজের ফাঁকে ওর দিকে একপলক তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আমার দিকেই তো তাকিয়ে আছো, কি দেখতে পাচ্ছো?”
“তোমার ঠোঁট।”
আবারও নির্বিকার গলায় উত্তর দিলো আনাবিয়া। মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“কাজ করছি তো শিনু!”
“ওহ! তোমার কাজ কি আমার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ? চুমু খাও এক্ষুনি নইলে কিন্তু এই অবস্থায় বাইরে চলে গেলাম!”
তেজি গলায় বলে উঠলো আনাবিয়া। মীর চোখ তুলে একবার নজর দিলো আনাবিয়ার পোশাকের অবস্থার দিকে। খুব খারাপ! চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা।
সোজা হয়ে বসে ঠোঁট গোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হাত বাড়িয়ে আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে ও বসালো নিজের কোলে, তারপর ওর ঠোঁটে সময় নিয়ে একটা প্রগাঢ় চুম্বন বসিয়ে দিয়ে বলল,
“হয়েছে? এবার কামরায় যাও শিনজো, আমার অনেক কাজ বাকি!”
“না, যাবো না। তোমার ওপর রেগে আছি আমি, তুমি এখন আমাকে আদর করো!”
“এখন না শিনু! পরে।”
“পরে কি আমার রাগ থাকবে? এখন রাগ আছে, তাই আদর এখন চাই।”
“নিজ দায়িত্বে আবার তোমার রাগ উঠিয়ে দিবো, তুমি একদমই চিন্তা কোরোনা! কামরায় যাও এখন।”
আনাবিয়ার এবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, রেগে মেগে মীরের কোলে থেকে উঠে গিয়ে বড় বড় পা ফেলতে ফেলতে নিজের কামরার দিকে যেতে যেতে তেজি গলায় বলল,
“চলে যাবো আমি, থাকবোনা আর এখানে!”
“ওহ তাই? কোথায় যাবেন আপনি ম্যাম, শুনি!”
“যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবো, তবুও তোমার মতো কালাভুনার সাথে আর থাকবোনা!”
বলে কামরার ভেতর গিয়ে ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো আনাবিয়া। মীর এপাশ থেকে উচ্চস্বরে শুধোলো,
“আমার বুকে যে বসতি গেড়ে রেখেছো তার কি হবে?”
ওপাশ থেকে আনাবিয়ার ঝাঝালো গলায় উত্তর এলো,
“তুমি ঢুকে বসে থাকো!”
পিঠের ওপর একটা হাইকিং ব্যাকপ্যাক নিয়ে কুরো আহমারের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে আনাবিয়া। সন্ধ্যা নেমে গেছে ইতোমধ্যে। কুরো আহামারগামী পানি পথের টানেলের ভেতর দিয়ে ধীর গতিতে হেঁটে চলেছে ও।
ওর উপস্থিতির কারণে সমুদ্রের ভেতরের প্রাণীগুলো ভিড় জমিয়েছে কাঁচের তৈরি টানেল রোডের চারপাশ দিয়ে, আনাবিয়ার সাথেই সাথেই ওরা অল্প অল্প করে এগোচ্ছে রাস্তার দুই ধার ঘেঁষে।
বের হওয়ার আগে এলিজাকে ও বলেছিলো যে ও আসছে ক্যাম্পিংয়ে। এলিজা বলল ওরা দশটার দিকে বের হবে কিমালেবের উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সকাল হয়ে যাবে। সারাদিন কিমালেবের ভারডানশিয়া জঙ্গলে হাইকিং করে রাতে সেখানেই ক্যাম্পিং করবে।
আনাবিয়া তাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কাউকেই বলে বের হয়নি, বাচ্চাদেরও না। মীরের বাচ্চা একটু বুঝুক কেমন লাগে। সে ব্যাস্ত লোক হয়তো টেরই পায়নি যে তার বউ কামরাতে নেই। কাজের চাপে সে এতটাই ব্যস্ত এখন!
কিছুদূর যাওয়ার পরই পেছন থেকে কোনো অ্যাম্বুলেন্সের সামান্য শব্দ শুনলো আনাবিয়া। হয়তো সেইফ জোনে থাকা ক্রিমিনালদের ওয়ার্কিং জোনে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে ভীষণ! এছাড়া ওদিক থেকে অ্যাম্বুলেন্স আসার কোনো রিজন নেই।
আনাবিয়া এক কোণে দাঁড়িয়ে গেলো চুপচাপ। হুডির হুডখানা তুল দিয়ে মাথার ওপর, পানিপথের ভেতরে অনেক দূর পরপর একটা করে স্ট্রিট লাইট, আনাবিয়া তাই সহজেই আড়াল করে নিতে পারলো নিজেকে।
অ্যাম্বুলেন্সটা বেশ দ্রুত গতিতেই চলছে, হয়তো ভেতরের জন একটু বেশিই অসুস্থ! অ্যাম্বুলেন্স আনাবিয়ার কাছাকাছি এসে ওকে পার হয়ে যেতেই আনাবিয়া লাফিয়ে উঠে পড়লো অ্যাম্বুলেন্সের ওপর। ঝাঁকিয়ে উঠে অ্যাম্বুলেন্সটা চলতে শুরু করলো আবার।
ভেতরের মানুষগুলো যে ভড়কে গেছে সেটা বুঝতে পারলো আনাবিয়া। কিন্তু চুপচাপ বসে রইলো ও অ্যাম্বুলেন্সের ছাদের ওপর। ভেতরের ফিসফিসানি শুনতে পেলো ও, সামনের ড্রাইভিং সিটে বসা দুজন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলোচনা করছে হঠাৎ গাড়ির ওপর কী এসে পড়লো সেটা নিয়ে। কারণ ওরা এখন পানিপথের ভেতর আর এখানে কোনো মানুষের উপস্তিতির কোনো সম্ভাবনাই নেই, অন্যান্য প্রাণীও না।
একজন নিচু গলায় পাশের জনের উদ্দেশ্যে বলল,
“আমি শুনেছি শিরো মিদোরির জঙ্গলের ভেতরে ঘেউল থাকে, এরা মড়া খায়, এমনকি জীবন্ত প্রাণীও খায়। পেছনেরটা মরেনি তো? দেখা গেলো গন্ধে গন্ধে চলে এসেছে!”
“ভাই, এরকম সময় এসব কথা বলিস না! এমনিতেই রোগীর সাথে কেউ আসেনি আর আমরা মাত্র তিনজন! পেছনেরটা একা একা রোগীর কাছে বসে আছে। এসব শুনতে পেলে ও আর পেছনে থাকতে চাইবে না, তখন আরেক জ্বালা হবে। চুপ থাক, আর ওকে যেন বুঝতে দিস না কিছু।”
ভড়কানো গলায় বলল অন্যজন। আনাবিয়া শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো। অ্যাম্বুলেন্সের ছাদের ওপর পিঠ ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো ও।
পানিপথের ওপর দিয়ে মাছেরা সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। স্ট্রিটলাইটের আলোতে আকৃষ্ট হয়ে প্রতিটা লাইটের কাছাকাছি এসে জটলা করে আছে এক এক ঝাঁক। বড়বড় মাছগুলো সব ধীরগতিতে সাঁতরে জানিয়ে বেড়াচ্ছে নিজের বড়ত্ব!
ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সের গতি বাড়ালো, ঝড়ের গতিতে চলতে শুরু করলো বাহনটা। যত দ্রুত এই টানেল থেকে বের হতে পারবে তত দ্রুত শান্তি পাবে ওরা। গাড়ির ওপর ঠিক কোন প্রাণী এসে বসেছে সেটা জানার কোনো উপায় নেই ওদের, কিন্তু যত দ্রুত সম্ভব সে প্রাণীর থেকে ওদের নিস্তার পেতে হবে।
চলতে চলতে একসময়ে গাড়িটা এসে ঢুকলো কুরো আহমারের ভেতর। এরপর লুমিরা নদী পার হয়ে সামনে যেতেই আনাবিয়া নেমে গেলো গাড়ি থেকে, মুহূর্তেই হালকা হয়ে গেলো এতক্ষণকার ভারী অ্যাম্বুলেন্স। শব্দ হলো কিছুটা। গাড়ির সামনে বসা দুজন ভড়কে গিয়ে এবার আরও জোরে টানলো গাড়ি।
আনাবিয়া পেছন থেকে চলন্ত গাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে তারপর এগোলো নিয়নভেলের দিকে।
নিয়নভেলের মেইন রোডের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা বড় সড় গাড়ি। গাড়ির ভেতরের আলোতে বসে সাজুগুজু করতে ব্যস্ত এক দল মেয়ে। গাড়ির বাইরে গাড়িটিকে ঘিরে এদিক ওদিক পায়চারী করে চলেছে চারজন ছেলে। আর তাদের মাঝখান দিয়ে একবার এদিক আর একবার ওদিক অস্থির হয়ে ঘুরঘুর করছে এলিজা নামের মেয়েটা।
তার প্রাণের বান্ধবী নূরিয়া তাজদিন এখনো আসেনি। সে মেয়েটার রাস্তায় কিছু হলো কিনা সেটাও জানে না ও। এমন সময়ে গাড়ির ভেতর থেকে ইসাবেলা নামক মেয়েটা বলে উঠলো,
“কিরে এলিজা, তুই না বললি নূর আসবে! ও যদি আজ না আসে তবে আমি কিন্তু তোর অবস্থা খারাপ করে দেবো বলে দিলাম। ও আসবে বলেই কিন্তু আমি আসতে রাজি হয়েছি।”
“আরে ভাই ও তো বলেছিল আসবে! এখন ও কোথায় আছে সেটাও তো জানতে পারছিনা। ফোনও তুলছেনা, যে একটু শুনবো ও কোথায় গিয়ে মরেছে!”
ওদের কথার মাঝেই অন্ধকারের ভেতর থেকে দৃশ্যমান হলো একটা লম্বা মেয়েলি অবয়ব। দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করে খুশি হয়ে এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো এলিজা। পাশে থাকা ইথানকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ওই দ্যাখ নূর আসছে, গাড়িতে উঠ সব।”
এলিজার কথা শুনে বাইরের ছেলেগুলো সব তাকালো সেদিকে। হ্যাঁ, এটা নূরই! ও ছাড়া এমন লম্বা মেয়েলি অবয়ব আশেপাশে কারো আছে বলে মনে হয় না।
ইথানের পাশ থেকে ইব্রাহিম ছেলেটা সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আনাবিয়ার জন্য।
ইথান গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো, ইসাবেলা গিয়ে বসলো ওর পাশের সিটে। লাভবার্ড দুটোকে সামনে রেখেই পেছনে বসলো ওরা কজন।
আনাবিয়া এসে গাড়ির কাছে দাঁড়াতেই গাড়ির দরজা খুলে দিলো ইব্রাহিম, আনাবিয়া কোনো কথা না বলে গাড়ির ভেতরে উঠে বসলো।
ওকে পেয়ে মেয়েগুলরো ভেতরে একটাকা ঝড় ভয়ে গেলো যেন! এলিজা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে টেনে নিলো ওকে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“তুই এসেছিস আমার কী যে ভালো লাগছে! ভেবেছিলাম আমাকে এদের সবার হাতে গণপিটুনি খাওয়ানোর প্লান করে তুই আর আসবি না। তোকে একগাদা চুম্মাহ!”
বলে এলিজা চুমু দিতে গেলো ওকে। আনাবিয়া বিরক্ত হয়ে সরে গিয়ে ওর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“সর তো সামনে থেকে, চুমা দিতে আসছে! ফাজিল!”
এলিজা দাঁত কেলিয়ে হেসে আবার গিয়ে বসলো নিজের সিটে। ছেলেগুলো গিয়ে বসলো ওদের পেছনের সিটে। চলতে শুরু করলো গাড়ি কিমালেবের উদ্দেশ্যে।
এদিকে আনাবিয়া নিজের কামরাতে আছে ভেবে নিশ্চিন্তমনে কোনোদিকে না তাকিয়ে কাজ করতে থাকা মীর কাজ শেষ করে ভোর বেলায় বউয়ের কামরায় গিয়ে দেখলো তার বউ উধাও!
ঝিরঝিরে কুয়াশা ভেদ করে সূর্যের প্রথম আলো জঙ্গলের সবুজ পাতায় ছড়িয়ে দিচ্ছে হালকা সোনালি আভা। চারপাশে ঘন গাছপালা, কাঁচা মাটির গন্ধ মিশে আছে ভোরের ঠান্ডা বাতাসে। দূরে থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে কাকের ডাক, গাছের ডালে ডালে কিচিরমিচির করছে পাখিদের ঝাক!
জঙ্গলের ভেতরের ছোট্ট একটা খোলা জায়গায় বসে শুকনো কাঠ আর পাতার আগুন করে তার চারপাশ ঘিরে বসে আছে আনাবিয়া আর ওর দলবল। কাঠের আগুনের ওপর একটা হাঁড়ি টগবগ করে ফুটছে। কফি হবে একটু পর।
এলিজার হাত কাপড়ে জড়ানো, ইসাবেলা আর ইথান মিলে আগুনের পাশে বসে বসে হাত গরম করছে। ধোঁয়া উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার সঙ্গে। একপাশে বসে ইব্রাহিম একটা ছুরি দিয়ে ফল কেটে দিচ্ছে সবাইকে, জিবরান বসে বসে পাউরুটি গরম করছে কাঠির উপরে।
কিছুদূরে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছে। ঘাসে জমে থাকা শিশির পায়ের নিচে ভিজে যাচ্ছে। গ্রেস আর জারা নিজেদের ভেতর টুক টুক করে কথা বলছে নরম গলায়।
কিমালেবের পাহাড় গুলো দৃষ্টিগোচর হচ্ছে এখান থেকে। পাহাড়ের চুড়ায় মেঘ জমে আছে। ভোরের আলো পড়ে এক অন্যরকম সৌন্দর্যে মুড়িয়ে আছে পাহাড়গুলো।
আনাবিয়া ওদের থেকে একটু দূরে এক কোণে একটা মরা গাছের গুড়ির ওপর বসে তাকিয়ে আছে পাহাড়ের চূড়ার দিকে৷
এমন সময় আনাবিয়ার হুডির পকেটে থাকা যান্ত্রিক বস্তুটা কেঁপে উঠলো নিঃশব্দে। পকেট থেকে সেটা বের করে এনে সামনে ধরলো আনাবিয়া। ওপরে কালাভুনা নামটা স্পষ্ট হয়ে উঠে আছে৷ আনাবিয়া ওর অদূরে বসা এলিজার দিকে একিবার তাকিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে গেলো ওর থেকে কিছুটা দূরে, তারপর কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো মীরের গভীর, প্রভাবশালী কন্ঠস্বর,
“তুমি কোথায়?”
“আমি নেই৷”
“অতো দূরে কেন গেছো? কে কে আছে তোমার সাথে?”
“ক্যাম্পিংয়ে এসেছি, ফ্রেন্ডদের সাথে৷”
“কেমন ফ্রেন্ড ওরা তোমার?”
“ভালো।”
“খেয়েছো কিছু?”
“এখনো না।”
ওপাশ থেকে মীরের একটা ছোট খাটো দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও আবার প্রশ্ন করলো,
“ফিরবে কখন?”
“বলতে পারিনা। যতদিন ভালো লাগবে থাকবো।”
“সকালের মেন্যুতে কি কি?
“টোস্ট, কফি আর অ্যাপল।”
“যাদের সাথে গেছো তাদের তোমাকে কিছু ভালো খাওয়ানোরও যোগ্যতা নেই?”
তাচ্ছিল্যের সাথে বলল মীর৷
“সবাই তো আর তোমার মতো শিরো মিদোরির বাদশাহ নয় যে সকালের মেন্যুতে প্রাসাদের দক্ষ, অভিজ্ঞ রয়্যাল কুকের রান্না করা অত্যন্ত এক্সপেন্সিভ প্রপার ডায়েট ম্যিল থাকবে!”
“আমি আসছি।”
“একদম আসবেনা, আমি এখানে আছি শান্তিতে আছি। তোমার যেদিন ব্যাস্ততা শেষ হবে সেদিন আমার সাথে যোগাযোগ করবে, তার আগে নয়৷”
“কামিং।”
বলে আনাবিয়াকে আর দ্বিতীয় কথাটা বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলো মীর৷ তারপর নিজের কামরা থেকে বেরিয়ে এগোলো দ্যা রয়্যাল জ্যু এর দিকে।
বাচ্চারা তখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। মীর সেদিকে এগোতেই কোকো ফ্যালকন দের কামরার ভেতর থাকা রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরের স্পিকারে ফিমেইল আর্টিফিশিয়াল ভয়েস প্রচন্ড জোরালো শব্দে বলে উঠলো,
“দ্যা কিং নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান! প্রিপেয়ার ইয়োরসেলভস!”
আর্টিফিশিয়াল ভয়েসটি কানে যাওয়া মাত্রই বাচ্চা গুলরো ঘুম উড়ে গেলো, তড়াক করে উঠে বসে গেলো যে যার বিছানার ওপর। একে ওপরের মুখের দিকে তাকালো ওরা বিস্মিত দৃষ্টিতে।
হিজ ম্যাজেস্টিতো ভুল করেও কখনো এদিকে আসেননা! হিজ ম্যাজেস্টি তো ওদেরকে পছন্দই করেন না বলতে গেলে। অপছন্দের চোটে ওদের কামরার ওপর লিখে দিয়েছেন দ্যা রয়্যাল জ্যু! মানে ওদেরকে চিড়িয়াখানার জানোয়ার ছাড়া অন্য কোনো চোখে তিনি কখনোই দেখেননা। তবে আজ হঠাৎ এদিকে! আশ্চর্য ঘটনা!
বাচ্চাগুলো একে অপরের দিকে তাকানো বাদ দিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে ছুটে ওয়াশরুমে গিয়ে কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে এসে পোশাক পরে নিলো দ্রুত হাতে। হিজ ম্যাজেস্টি যদি এসে দেখেন সব গুলো এখনো আরামে শুয়ে আছে তবে ধরে নিয়ে বারান্দা থেকে সবগুলোকে ছুড়ে ছুড়ে নিচে ফেলে দেবেন শিওর!
পোশাক পরে সবগুলো দাঁড়িয়ে গেলো পাশাপাশি, একদম স্ট্রেইট! নো নড়চড়। তার কিছুক্ষণ পরেই দ্যা রয়্যাল জ্যু এর দরজা ঠেলে বিরাট এক পাহাড়ের ন্যায় গুরুগম্ভীর পা ফেলে ভেতরে ঢুকলো মীর৷
মীর ঢুকতেই সবগুলো আনত নয়নে দাঁড়িয়ে গেলো স্ট্যাচু হয়ে৷ চোখে চোখ পড়লেই সর্বনাশ! তাঁর চোখে সারাক্ষণ এদের জন্য বিরক্তি ছাড়া অন্য কিছু দেখা যায় না!
মীর ঢুকেই তড়িতে একবার নিজের স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়া দিয়ে পরখ করে নিলো সবগুলো বাচ্চাকে।
সবার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে পাটখড়ির মতো পাতলা ফ্যালকন। ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি ওর, মাঝে মাঝেই ঘুমের ভারে সামনের দিকে ঝুকে পড়ছে, পাশে দাঁড়ানো আলফাদ পেছন থেকে খামচি দিয়ে ধরে আছে ওর গায়ের টি শার্ট, যেন ঘুমের ঘোরে ল্যাদা বাচ্চাটা দুড়ুম দিয়ে সামনে পড়ে না যায়!
মীর শেষ প্রান্তের ফ্যালকনকে এক বার পরখ করে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়ানো কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“রেডি হ, আর জানোয়ার গুলোকেও রেডি হতে বল। আমরা বেরোবো।”
কোকো তড়িৎ বেগে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো যে সে মিলি সেকেন্ডের ভেতরে রেডি হয়ে বসে থাকবে৷ কোকোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে এবার আবার ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে গমগমে গলায় ডেকে উঠলো,
“ফ্যালকন, রেডি হয়ে আমার কামরায় আসবি।”
বলেই কামরা ছেড়ে চলে গেলো মীর। ফ্যালকনের বুকের ভেতর ধুকপুক করতে শুরু করলো। ঘুম উড়ে গেছে ওর হিজ ম্যাজেস্টির মুখে নিজের নাম শুনে।
এতলোক থাকতে ওকেই কেন রেডি হয়ে কামরায় যেতে বলল? ওকে কি মেরে টেরে দিবে নাকি শেহজাদীর সাথে চিপকে থাকার অপরাধে!
কিন্তু মেরে দিতে চাইলে রেডি হতে বলবে কেন? মানে মেরে দেওয়ার আগে একটু সাজিয়ে গুজিয়ে না নিলে মারার রুচি হবেনা এমন কিছু নাকি?
ফ্যালকনকে এমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এক দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কোকো এপাশ থেকে বলে উঠলো,
“হোই হাঁস, রেডি হ সালা! তোর গা থেকে হাঁস হাঁস গন্ধ আসে, ভালো করে ডলে ডলে গোসল করবি, নইলে হিজ ম্যাজেস্টি তোকে সত্যি সত্যি হাঁস ভেবে বার্বিকিউ করে খেয়ে ফেলবেন শিওর।”
“শোনো কোকো ভাইয়া, একদম আমাকে হাঁস বলবানা! আমি বাজ পাখি, হাঁস না।”
তেজি গলায় বলে উঠলো ফ্যালকন। এই কোকো ভাইয়া সারাদিন ওকে হাঁস বলে ক্ষ্যাপায়। অথচ নিজে যে একটা হাতি, খায় মণকে মণ সেটা আর তার মনে থাকেনা! ফ্যালকনের তেজি গলা শুনে কোকো এপাশ থেকে হাতা গুটিয়ে ওর এগোতে এগোতে বলে উঠলো,
“হোই, তুই আমাকে মেজাজ দেখাচ্ছিস? আম্মা কিন্তু এখনো কামরায় ঘুমোচ্ছেন। তোকে এখান থেকে সটকে দেবো, কেউ কিচ্ছুটি টের পাবেনা। পুরো হাওয়া হয়ে যাবি!”
“হুউউ! লিও ভাইয়া, হাইনা ভাইয়া আছে এখানে, তুমি আমার কিছু করলে ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে ভেবেছো?
কোকো আশেপাশে সবার দিকে একবার তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“এই, তোরা কেউ কিছু জানিস এ ব্যাপারে?”
সবগুলা গোফের তলে হেসে তড়িতে মাথা নাড়ালো দুদিকে। ওরা কিছুই জানেনা, ওরা তো এখানে ছিলোই না! ফ্যালকন আবার কে? সেটা কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?
কোকো আবার ফ্যালকনের দিকে তাকালো। এদিকে নিজের ভাই বেরাদার দের এমন নিষ্ঠুর চেহারা দেখে ফ্যালকনের ঠোঁট ফুলে গেলো। এরা এমন বিট্রে করবে ওর সাথে! অথচ এদেরকে ও মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো ভেবে এসেছিলো এতদিন! ছিঃ!
লিও ও পাশ থেকে ওকে হাত ধরে টেনে ওয়াশরুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“শোক উদযাপন পরে করিস, এখন গিয়ে গোসল দিয়ে আয়। হাঁসের গন্ধে টেকা যাচ্ছেনা কামরায়!”
তারপর ওকে ওয়াশরুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা দিয়ে দিলো। ভেতর থেকে ফ্যালকনের ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো সাথে সাথেই। ও ছোট আর দুর্বল বলে সবাই ওর সাথে এরম করে! একমাত্র শেহজাদী ছাড়া ওকে আর কেউ ভালোবাসেনা!
কিমালেবের পানিপথের ভেতর দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলতে থাকা মীরের গাড়ির ভেতর ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে কাচুমাচু হয়ে চুপটি করে বসে আছে ফ্যালকন, চোখ জোড়া ওর সামনে থাকা স্ক্রিনের দিকে, সেখানে আনাবিয়ার অবস্থান নির্দেশ করছে একটা লাল রঙা ছোট্ট চিহ্ন, কিছুক্ষণ পর পর নেচে উঠে সেটা এগোচ্ছে সামনের দিকে।
ড্রাইভিং সিটে বসে রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখে একমনে ড্রাইভ করছে মীর। মাঝে মাঝে ফ্যালকনকে আনাবিয়ার অবস্থানের পরিবর্তন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, ফ্যালকন উত্তর দিচ্ছে আমতাআমতা করে।
কোকো হাইনা জোভি লিওরা অন্য গাড়িতে। মীরের গাড়ির পেছন পেছন এগোচ্ছে ওরা সমান তালে।
ফ্যালকন স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে অবশেষে সাহস নিয়ে কাচুমাচু স্বরে শুধালো,
“ই-ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী আমাদেরকে ছাড়াই অতো দূরে কেন গেছেন?”
মীর এক মনে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে চলেছিলো, ফ্যালকনের কথায় রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখেই ও গমগমে গলায় উত্তর দিলো,
“তিনি রাগ করে চলে গেছেন। ফিরতে চাচ্ছেননা এখন আর।”
মীরের কথা শুনে ফ্যালকনের ঠোঁট ফুলে গেলো, শেহজাদী ফিরতে চাচ্ছেননা মানে কি? উনি কি রাগ করে প্রাসাদ ছেড়েই চলে গেছেন একেবারের জন্য? তবে কি ওকে আদর যত্ন করার জন্য আর কেউই রইলোনা এই দুনিয়ায়! চোখ জোড়া ভরে উঠলো ওর পানিতে, ফুপিয়ে উঠে ও কাতর কন্ঠে শুধালো,
“উনি কি আর ফিরবেন না?”
ওর ফোপাঁনোর বিরক্তিকর শব্দে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে মীর ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“শাট আপ ফ্যালকন!”
মীরের ধমকে ফ্যালকন কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে ঠোঁট চেপে পড়ে রইলো, তবুও ফোপাঁনোর শব্দ বন্ধ হলোনা ওর! মীর বিরক্তির সাথে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“বউ চলে গেছে আমার আর কোথাকার কোন হাঁসের বাচ্চা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে, যত্তসব!”
ফ্যালকন তখনো স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে ছিলো, হঠাৎ করেই ফোপাঁনো থামিয়ে, নাক টেনে ও স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদী আর এগোচ্ছেন না। ওনারা হয়তো রাতে ওখানেই স্ট্যে করবেন।”
মীর রাস্তার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে স্ক্রিনের ওপর দৃষ্টি দিলো, জায়গাটা দেখে নিলো ভালোভাবে৷
কিমালেবের প্রতিটি স্থান ওর চেনা। যখন কাঁধে দায়িত্বের এত ভার ছিলোনা তখন সালিমের সাথে সমস্ত পঞ্চদ্বীপ চষে বেড়িয়েছে ও। এখন ওর হাতে সময় অনেক কম।
এইযে এখন প্রাসাদের কত কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে ওকে যেতে হচ্ছে ওর শিনজোর মান ভাঙাতে! শিনুটা তেজ না করলে এখন ও দিব্যি বসে বসে সমস্ত কাজগুলো শেষ করতে পারতো, এখন এই সময়টুকুর জন্য ওর কাজগুলো শেষ হতে আরও অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হবে। কিন্তু কিছুই করার নেই, বউ তো বউই!
মীর স্ক্রিনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রাস্তার দিকে রাখলো আবার, তারপর বাড়িয়ে দিলো গাড়ির গতি। পূর্বের থেকেও জোর বেগে চলতে শুরু করলো ওর স্বর্ণ বাধানো কালো রঙা গাড়িটা। আর তার কিছু মুহুর্ত বাদেই ওরা বেরিয়ে এলো কিমালেবের পানি পথের ভেতর থেকে।
ঘন জঙ্গলের ভেতর রাতের নিস্তব্ধতা জেঁকে বসেছে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল গাছগুলো যেন আকাশ ছুঁতে চায়। তাদের পত্রপল্লবের মাঝে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে নকশার ন্যায়।
গাঢ় কুয়াশা চারপাশে চাদরের মতো ভেসে আছে। দূর থেকে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছে মৃদু ঝিঁঝি পোকার ডাক আর নিশাচর পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ।
ভারডানশিয়ার ভেতরের একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় ক্যাম্প গেড়েছে আনাবিয়া আর ওর সাথের ছেলেমেয়ে গুলো। তাবু গুলোর মাঝখানে জ্বলছে একটি বড়সড় বনফায়ার। আগুনের সোনালি শিখা আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তার আলোতে ঝলমল করে উঠছে চারপাশ। শুকনো পাতা আর কাঠ পোড়ার গন্ধ বাতাসে মিশে এক অন্যরকম অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে ওরা সবাই। জিবরানের হাতে গিটার, গান ধরেছে ও মৃদু স্বরে। মেয়েগুলো সব হাসি-ঠাট্টায় মগ্ন। আর আনাবিয়া ওদের এই হাসি ঠাট্টার ভেতর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা নীরব তারার দিকে। আগুনের আলোয় ওর মুখের ওপর স্পষ্ট হয়ে আছে ক্লান্তি।
এমন সময়ে জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে এলো কোনো নাম না জানা বুনো প্রাণীর অদ্ভুত মৃদু গর্জন। শব্দ শুনে এলিজা চমকে তাকালো সেদিকে, আনাবিয়ার পাশেই বসে ছিলো ও, অদ্ভুত গর্জনটা শুনে আনাবিয়ার দিকে আরেকটু ঘেঁষে বসলো ও। ভারডানশিয়ার জঙ্গলে অনেক প্রাণিই থাকে, তবে ওরা মোটামুটি সেইফ জোনে আছে। এদিকে বন্যপ্রাণী তেমন একটা আসেনা, তবে কি হয় বলাও যায় না!
ইব্রাহিম আর ইথানের হাতে দোনলা বন্দুক। হঠাৎ যদি বন্যপ্রাণী আক্রমণ করে বসে তবে এটা দিয়েই তার খুলি উড়িয়ে দিবে ওরা, সেভাবেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করে নিয়ে বসে আছে ওরা দুজনে৷
আনাবিয়া কফির মাগে থেকে থেকে চুমুক দিচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট করে। কফি টা বিস্বাদ! প্রাসাদের কফির কাছে এ কফি নিতান্তই শিশু, কিন্তু এখন উপায় নেই, খেতেই হবে। সারাদিন কোনো রকমে খাবার খেয়েছে ও। এসব শুকনো খাবার খাওয়ার অভ্যাস ওর কোনো কালেই ছিলোনা৷
বনফায়ারের ওপর ঝলসাচ্ছে বুনোগরুর মাংস। দুপুর বেলা একটা গরু শিকার করে জবাই দিয়েছে ওরা সকলে মিলে। সেটার কিছু অংশ খেয়েছে আর বাকিটা নিজেদের ব্যাগে ভরে নিয়েছে। শীত প্রচুর, নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা নেই। এখনো পঞ্চদ্বীপে তুষার পড়তে শুরু করেনি, তবে খুব শীঘ্রই শুরু হবে৷ তখন পঞ্চদ্বীপের তাপমাত্রা চলে আসবে মাইনাসে৷
অলিভার বনফায়ারের পাশে বসে মাংস টুকরো গুলো উলটে পালটে দিচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর। ওদের সবার গায়ে ভারী ভারী শীতের পোশাক। শুধু আনাবিয়ার গায়ে একটা হুডি ছাড়া আর কিছুই নেই৷
জিবরান ছেলেটা গিটারের সুর থামিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“নূর, তোমার শীত লাগছেনা? এদিকে এসে বসো।”
“সমস্যা নাই জিবরান, আমি ঠিক আছি।”
জিবরান আর কিছু বললনা। দলের ভেতর ও সবচেয়ে বেশি চুপচাপ, ভদ্র। ওর পিঠাপিঠি একটা বোন ছিলো, কিছুটা আনাবিয়ার মুখের আদলের, কিন্তু বোনটা ছ বছর বয়সেই মারা গেছিলো। আনাবিয়াকে দেখার পর থেকে ওর সেই মৃত বোনটার কথাই মনে পড়ে বারবার। আনাবিয়াকে তাই ও খুব আগলে আগলে রাখতে চায়, কিন্তু ও যা মেয়ে তাতে ওর আনাবিয়াকে আগলে রাখা লাগে না, উলটো আনাবিয়াই ওকে আগলে রাখে।
জিবরান কিছুক্ষণ আবার বনফায়ারের হলুদ শিখার দিকে তাকিয়ে থেকে আনাবিয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে শুধালো,
“ক্ষিদে পেয়েছে তোমার নূর?”
আনাবিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। জিবরান ওর এমন অবস্থা দেখে হাসলো মিষ্টি করে, বলল,
“এইতো হয়ে এসেছে, আর অল্প কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো!”
জিবরানের কথা শেষ হতে না হতেই অদূরেই শোনা গেলো কোনো নেকড়ের দীর্ঘ, করুণ সুরে ভরা ডাক। রাতের নিস্তব্ধতার বুক চিরে সে শব্দ বাড়ি খেলো জঙ্গলের পরতে পরতে, একাকী নেকড়েটা যেন খুঁজে চলেছে তার হারানো সঙ্গী।
নেকড়ের সে ডাকে চমকে উঠলো ওরা সকলে, ইথান আর ইব্রাহিম দুজনে হাতের বন্দুক গুলো শক্ত করে ধরে সচকিত দৃষ্টি ফেললো চারদিকে৷ নেকড়েরা কোথায় অবস্থান করে সেটা ওরা ম্যাপে দেখেই এসেছে৷ জঙ্গলের অতটা গভীরে ওরা এখনো যেয়ে পারেনি। আর সেখানে ওরা যেতেও চায়না। সেখানে নেকড়েদের প্রায় ছ সাতটা প্যাক থাকে। সেখানে গেলে কোনো ভাবে ওদেরকে বিরক্ত করে ফেললে বেঁচে ফেরা কষ্টকর হয়ে যাবে৷
ইব্রাহিম আর ইথান এগিয়ে গিয়ে আশেপাশের এরিয়াগুলোকে ভালোভাবে পরখ করে সন্দেহজনক কিছু না দেখে আবার ফিরে এসে বসলো নিজেদের জায়গায়৷ এলিজা ততক্ষণে আনাবিয়ার আরও কাছে চলে এসেছে। ইসাবেলা গিয়ে বসেছে ইথানের কোলের ভেতর৷ ইথান ওকে জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে বুকের ভেতর৷ ইব্রাহিম চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে দিতে বলল,
“শিরো মিদোরির রেড জোনের কথা শুনেছিস তোরা কখনো?”
ওর প্রশ্নে সকলে ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শিরো মিদোরি সম্পর্কে জানার জন্য৷ এই একটা বিষয়ে কোনো কথা শুনতে ওদের কখনো বোরিং লাগেনা। শিরো মিদোরি সম্পর্কে সারাদিন কেউ গল্প বললেও ওরা কোনো বিরক্তি ছাড়াই শুনবে।
সবাইকে এমন উৎসুক, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইব্রাহিম আবার বলল,
“রেড জোনে সব রকমের প্রাণীই থাকে বলা যায়, হিংস্র মাংসাশী থেকে শুরু করে শাকাশী, সবই। তবে সেখানের প্রাণী গুলো আমাদের চোখে দেখা সাধারণ প্রাণীদের মতো নয়! সেগুলো আকারে সাধারণ প্রাণীদের থেকে অনেক অনেক বিশাল হয়। এত্ত বিশাল যে রেড জোনের একটা প্রাণী আর তারই সাধারণ ভার্সনকে একত্রে দাড়া করালে মনে হবে সাধারণ টা রেড জোনের টার বাচ্চা।
এবং ওরা সাধারণ প্রাণীদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি হিংস্র হয়ে থাকে। কখনো যদি রেড জোনের কোনো প্রাণীর সামনে পড়িস তবে জান নিয়ে ফিরতে পারবিনা।”
ওর কথা হা হয়ে শুনছিলো সকলে, ইসাবেলা কে কোলে নিয়ে বসা ইথান বলে উঠলো,
“এরকমটা আমিও শুনেছি, আরও শুনেছি রেড জোনে নাকি সাধারণ মানুষ যেতে পারেনা, দম আটকে আসে তাদের! সেখানের বাতাস নাকি প্রচন্ড ভারী! দম নিতে কষ্ট হয় অনেক, বাতাস এসে চেপে ধরে চারপাশ থেকে। আর সাধারণ মানুষ সেখানে গেলে নাকি মাটি থেকে কিসব লতাপাতা টাইপ বের হয়ে এসে সে মানুষ কে গিলে নেয়। মোটকথা পুরো পরিবেশটা এমন যে তুমি কোনো ভাবেই বেঁচে ফিরতে পারবেনা, হয় তোমাকে প্রাণীতে খাবে, নয়তো মাটিতে!”
ক্রমে ক্রমে শিরো মিদোরি নিয়ে অনেক কথাই হতে লাগলো ওদের ভেতর, যৌক্তিক অযৌক্তিক, সত্য অসত্য সব মিলিয়ে। আনাবিয়া চুপচাপ শুনতে লাগলো ওদের কথা আর একটু একটু করে চুমুক দিতে লাগলো কফিতে।
এমন সময় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো ওর চিরপরিচিত ব্যাক্তিটির উপস্থিতির বার্তা। দূরে সে, অনেক দূরে! কিন্তু ধীরে ধীরে আসছে এদিকেই, ওরই কাছে!
আর সেই মুহুর্তেই ইব্রাহিম ছেলেটা হঠাৎ করেই স্থীর হয়ে গিয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চাপা সুরে বলে উঠলো,
“শশশ, সবাই চুপ!”
ওর এমন স্বরে মুহুর্তেই থেমে গেলো ওদের হাসি তামাশা আর কথার ফুলঝুরি! সবাই আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলো ইব্রাহিমের দিকে।
ইথান ইব্রাহিমের সতর্ক দৃষ্টি খেয়াল করে নিজেও কান খাড়া করলো জঙ্গলের দিকে। হ্যাঁ, শোনা যাচ্ছে। কানে এসে লাগছে কোনো শিকারী প্রাণীর চাপা, হিংস্র গরগরে শব্দ! ওদেরকে নিশানা করে সে প্রস্তুতি নিচ্ছে শিকার ধরার!
চমকে উঠে দ্রুত গতিতে কোল থেলে ইসাবেলা কে নামিয়ে সে সবার উদ্দেশ্যে চাপা সুরে বলে উঠলো,
“কেউ কথা বলবিনা কোনো। আর হ্যাঁ, যা-ই হয়ে যাক কেউ ছুটে পালাবিনা! ছুটে পালালেই কিন্তু জঙ্গলের ভেতর যা লুকিয়ে আছে সেটা এসে ঝাপিয়ে পড়বে তোদের ওপর, তাই সাবধান! আবারও বলছি, কেউ ছুটবিনা!”
ইথানের কথা শুনে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো ওরা সকলে। ইথান এক হাতে ইসাবেলাকে উঠিয়ে আনাবিয়ার ওদিকে দিয়ে দিলো, আনাবিয়া ওকে একহাতে আগলে নিয়ে বসালো নিজের অন্য পাশে। এপাশটা এলিজা দখল করে নিয়ে বসে আছে আগে থেকেই, সে কোনোভাবেই এ জায়গা ছাড়বেনা!
ইব্রাহিম আর ইথান দুজনে মিলে দোনলা বন্দুক টা হাতে উঠিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগোলো জঙ্গলের সেদিকটায়। আর সেই মুহুর্তেই ওরা শুনতে পেলো ভেতর থেকে ধীর গতিতে, সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে আসছে কিছু একটা! শুকনো পাতার ওপর মরমর শব্দ তুলে তার জোড়ায় জোড়ায় পা ফেলানোর শব্দ এসে কানে বাজতে লাগলো ইব্রাহীম আর ইথানের।
দুজনেই দোনলা বন্দুক টা আরও শক্ত করে নিশানা করে ধরে রউলো, কিছু এগিয়ে এলেই বন্দুকের গুলিতে এফোড় ওফোড় করে দিবে সেটার মাথার খুলি!
জঙ্গলের অন্ধকার যেন এবার হঠাৎই গভীর হয়ে উঠল। বাতাস ভারী হয়ে এল এক অজানা আতঙ্কে। বনফায়ারের নেচে চলা শিখাগুলোও যেন থমকে গেলো শঙ্কায়! আর তখনই, গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখা দিল একটি হিংস্র ছায়া। জঙ্গলের তলার শুকনো পাতাগুলো এবার জোরালো মচমচ শব্দ তুলল, আর সেই সঙ্গে ওদের সবাইকে আতঙ্কের চরম সীমায় নিয়ে গিয়ে, হিংস্র গরগর শব্দ তুলে অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল এক সিংহ।
আগুনের মতো জ্বলজ্বলে এক জোড়া চোখ আর পেশিবহুল শরীর প্রতিমুহূর্তে ইঙ্গিত দিচ্ছে তার হিংস্র শক্তির! ঠোঁটের কোণজোড়া আলগা হয়ে বের হয়ে আছে ধারালো চকচকে ক্যানাইন দাঁত জোড়া, যেন শিকারকে ছিন্নভিন্ন করার জন্য প্রস্তুত।
সিংহটা থামল, মাথা উঁচু করে তাকাল একবার চারপাশে যেন সে এখানে ঘোষণা করতে এসেছে তার এলাকার সীমা, আর তারপর হঠাৎ করেই আকাশ বাতাশ কাপানো, বজ্রধ্বনির মতো এক গর্জন বের হলো তার গলা থেকে।
সিংহের সেই শক্তিশালী যেন গর্জন জঙ্গলের গভীরতম কোণেও প্রতিধ্বনি তুলল। এলিজারা সবাই জমে গেল নিজেদের জায়গাতেই! কেউ আর নড়তে পারছে না, নিঃশ্বাসই যেন আটকে গেছে।
ইথান আর ইব্রাহিম সেই স্থানেই জমে গেলো। এ সিংহ কোনো সাধারণ সিংহ নয়, সিংহটার উচ্চতা প্রায় ওর মাথা ছাড়িয়ে আরও ওপরে চলে গেছে! এটা কোথাকার সিংহ!
সিংহের এমন হুলিয়া দেখে ভড়কে গিয়ে ছুটে পিছিয়ে এলো ইব্রাহিম, আর ওকে ছুটতে দেখে সিংহটা ওকেই করে নিলো নিশানা! গর্জে উঠে তড়িৎ কদম ফেলে সে এগোলো ইব্রাহিমের পেছনে৷ আর সেই মুহুর্তেই দৃষ্টি গোচর হলো তার পুরো শরীর!
সিংহটার আকার পুরোপুরি দেখা মাত্রই বনফায়ারের পাশে এতক্ষণ স্তব্ধ গয়ে বসে থাকা জিবরান আর অলিভার চিৎকার দিয়ে উঠে ছুটে পালাতে নিলো। ওদের চিৎকারে সিংহটার লক্ষ্য এবার ইব্রাহিমের ওপর থেকে সরে গেলো ওদের দুজনের ওপর৷ ইব্রাহিম কে হাতের এক থাবায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে বিশালাকার সিংহটা ছুটলো জিবরান আর অলিভারের পেছনে। ছোটার আগে সিংহটা একবার তাকালো আনাবিয়ার দিকে, চোখে ওর খেলে গেলো আনুগত্য, সেই সাথে একটা নিরব বার্তা, তিনি আসছেন!
গা জ্বলে গেলো আনাবিয়ার! অসভ্যটা তবে বাচ্চাদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে এখানে। এদিকে এলিজা আর ইসাবেলা ভয়ে আতঙ্কে আনাবিয়াকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে বসে আছে, ওদেরকে ছাড়িয়ে ও যেতেও পারছেনা কোনোখানে!
এমন সময় এত হুলুস্থুলের ভেতর সেখানে এসে উপস্থিত হলো আর এক আতঙ্ক! জঙ্গলের ভেতর এতসময় ধরে দীর্ঘ, করুণ, তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে ঘুরে বেড়ানো নেকড়েটার হাঁক শোনা গেলো এবার ওদের খুব কাছেই! তার তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ কন্ঠে রাত যেন কেঁপে উঠলো!
ইথান ভড়কালো, এ নেকড়ে কি ওর সঙ্গীসাথী নেকড়েদেরও ডেকে আনতে এমন ডাক দিচ্ছে?
ইথান সাহস করে ওর দোনলা বন্দুক টা উঁচিয়ে ধরে রইলো শব্দের উৎপত্তির দিকে! আর ঠিক সেই মুহুর্তেই জঙ্গলের ভেতর থেকে হিংস্র ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শিকারীর ভঙ্গিমায় একপা একপা করে বেতিয়ে এলো বিশালদেহী এক নেকড়ে! নিচু করে রাখা মাথার সামনে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে চোখ জোড়া ইথানের দিকেই নিবদ্ধিত! গরগরে আওয়াজের কারণে ধারালো দাঁত গুলো বেরিয়ে আছে, আগুনের উজ্জ্বলতায় সেগুলো ঝকঝক করে উঠে আরও হিংস্র রূপ ধারণ করেছে!
আর তার পরমুহূর্তেই নেকড়েটা আবারও আকাশের দিকে মুখ করে এক বিশাল দীর্ঘ চিৎকার দিয়ে উঠলো! তার বিকট চিৎকারে এলিজা, ইসাবেলা, জারা আর গ্রেস আনাবিয়াকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো উচ্চস্বরে।
এদিকে নেকড়েটার এমন বিশালাকার দেখে ইথান সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, হাতের দোনলা বন্দুকটার কথা ভুলেই গেলো আতঙ্কে!
নেকড়ে টা নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে দাঁত বের করে শিকারী ভঙ্গিতে গর গর করতে করতে এগোলো ইথানের দিকে। ইথান আতঙ্কিত হয়ে উঠে পিছু হটতেও ভুলে গেলো যেন, নেকড়েটার জ্বলজ্বলে চোখের দিকে তাকিয়েই স্থীর হয়ে রইলো ও।
ইব্রাহিম দূর থেকেই নেকড়ের উপস্থিতি টের পেয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো! একদিকে ইথান অন্যদিকে জিবরান, অলিভার! ইব্রাহিম কাকে রেখে কাকে বাচাবে বুঝতে পারলোনা, সাথে আবার মেয়েও আছে কতকগুলো, আনাবিয়াকে আকড়ে ধরে আতঙ্কে চুপসে গিয়ে অসহায় চোখে ওর তাকাচ্ছে একবার ইথান তো আর একবার জিবিরান অলিভারের দিকে!
দিশেহারা হয়ে গেলো ইব্রাহিম! নেকড়ের ডাক, সিংহের গর্জন সবগুলো মিশে একাকার হয়ে গেছে এক ভয়ানক সিম্ফোনিতে। শ্বাস আটকে যেতে লাগলো ইব্রাহিমের! ভয়ে আতঙ্কে যেন ভারী হয়ে উঠতে লাগলো বাতাসও!
সেই মুহুর্তে হঠাৎ করেই কোনো এক দিক থেকে ভেসে এলো ধারালো তালওয়ার খাপমুক্ত করার ধাতব শব্দ! তারপরেই সেদিক থেকে ভেসে এলো ভারী জুতার পদক্ষেপের আওয়াজ; হালকা কিন্তু প্রচন্ড দৃঢ়।
সকলে ওরা তাকিয়ে রইলো সেই শব্দের উৎসের দিকে! শাখা-পত্রের ভাঁজ ভেঙে, গাছের ছায়া ছাড়িয়ে এক রাজকীয় উপস্থিতি ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে! আর তার কিছু মুহুর্ত বাদেই সারা শরীর ভারী কালো পোশাকে আবৃত কেউ তার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতি গতিতে এক রাজকীয় শক্তির উপস্থিতি নিয়ে আবির্ভূত হলো সেখানে!
পুরু কাপড়ে মোড়া মুখখানা দেখার উপায় নেই! উন্মুক্ত হয়ে আছে শুধু তীক্ষ্ণ, শাণিত কালো রঙা চোখ জোড়া; যেন সেজোড়া দিয়েই পুরো জঙ্গলের গভীরতা দেখে নিয়েছে সে তড়িতে!
সে এক আতঙ্ককের মতো এসে দাঁড়ালো ইথানের পাশ ঘেষে, বাতাসে যেন ছড়িয়ে গেলো তাঁর অদৃশ্য শক্তির ঘ্রাণ! হাতের সোর্ডখানা দক্ষতার সাথে ঘুরিয়ে তার হাতলটা ধরে ফেললো ও!
ইথানের ওপর তখনি হামলে পড়তে যাওয়া নেজড়েটা থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ! তালওয়ারের ধারে এক মুহুর্ত ভাবে সে, একবার তালওয়ার আর একবার সে লোকটির কাপড়ে ঢাকা মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে ধীর গতিতে পিছিয়ে যায় সে!
নেকড়েটা পিছিয়ে সরে যেতেই অজ্ঞাত লোকটা তড়িতে পেছন দিকে ফিরে জিবরান আর অলিভারকে আক্রমণ করতে থাকা সিংহটার দিকে ছুড়ে দেয় তার হাতের শক্ত মুষ্টিতে ধরে রাখা সোর্ডটা!
তড়িতে সরে যায় সিংহটা, সোর্ডটা এসে আছড়ে পড়ে মাটিতে। একবার তার দিকে ছুড়ে দেওয়া ধারালো তালওয়ার আর একবার অজ্ঞাত লোকটির দিকে তাকিয়ে একটা গর্জন তুলে মুহুর্তেই সিংহটি পেছন ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায় জঙ্গলের আঁধারের ভেতর!
বিপদ দূর হয়ে গেলে লোকটি ধীর, ভারী পায়ে এগিয়ে এসে মাটিতে পড়ে তার দিকেই স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা জিবরান আর অলিভারকে এক হাতে টেনে তুললো৷ লোকটির ইস্পাত-দৃঢ় হাতের টানে জিবরান আর অলিভার ছোট বাচ্চাদের ন্যায় উঠে এলো মুহুর্তেই।
ওদের দুজনকে উঠিয়ে লোকটি এবার এগিয়ে গিয়ে তুললো ইথানকে। লোকটির শক্ত হাতের মুঠিতে নিজের হাত গিয়ে ঠেকতেই চমকে উঠলো ইথান। হাত তো নয় যেন ধাতব কোনো যন্ত্রাংশ! সাড়াশির মতো করে খামচা দিয়ে তুলে ফেললো ওকে মাটি থেকে।
আর ইথানকে উঠিয়েই সে এগিয়ে গেলো আনাবিয়াকে জড়িয়ে ধরে রাখা লেইলা, এলিজা, জারা, ইসাবেলা আর গ্রেসের দিকে। নিজের দীর্ঘকায় শরীরটা এগিয়ে নিয়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মীর ওর শক্ত হাত খানা বাড়িয়ে দিলো সোজা আনাবিয়ার দিকে, বলে উঠলো,
“হাই বিয়্যুটিফুল, আ’ম মীর!”
বলে নিজের মোটা কাপড়ের আড়ালে পৈশাচিক হাসলো মীর৷ আনাবিয়া ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলল,
“চলে এসেছেন নাটকবাজ। হলিউডে ডাক পড়বে তার কিছুদিন পর!”
আনাবিয়া হাত মেলাচ্ছেনা দেখে মীর এবার ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে ওর হাতটার ডিরেকশন বদলে দিলো জারার দিকে। জারা একপ্রকার লুফে নিলো মীরের হাতটা, মীরের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে ও দাঁত কেলিয়ে বিগলিত হেসে বলে উঠলো,
“আ’মা জারা, নায়েস ট্যু মিট ইয়্যু!”
এই ভীষণ শক্তিশালী শরীরের দীর্ঘকায় পুরুষটি ওদেরকে কেবল মাত্র শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে বাচালো, সেটাও যে সে প্রাণী নয়, রীতিমতো নেকড়ে সিংহ! লোকটির এমন হিরোগিরিতে জারা ফিদা হয়ে গেলো যেন!
মীরের দিকে অপলকে তাকিয়ে আগের মতোই দাঁত কেলিয়ে মীরের হাত ধরে ওপর নিচে করতে থাকলো ও। মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
“জ্বি জারা, এবার ছাড়ুন।”
জারা অপ্রস্তুত হয়ে ছেড়ে দিলো ওর হাতটা সাথে সাথে। মীর এবার পেছন ফিরে তাকালো ছেলেগুলোর দিকে। সেগুলো এর ভেতরে এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। মীর ওদের দিকে তাকিয়ে ভারী, গমগমে কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
“জঙ্গলে এত গভীরে ক্যাম্পিং করতে আপনারা কেন এসেছেন? এখানে হিংস্র প্রাণীদের বিচরণ সেটা কি আপনারা জানতেন না? এসেছেন তো এসেছেন, সাথে এতগুলো মেয়ে নিয়ে এসেছেন! আপনাদের কি কোনো কমনসেন্স নেই?”
ইথান ইব্রাহিমেরা মাথা নিচু করে রইলো, আসলেই ওদের আরও ভেবে আসা উচিত ছিলো। ক্যাম্পিংটা এত গভীর জঙ্গলে করা উচিত হয়নি একদমই, আরও পাতলা এলাকার দিকে করা উচিত ছিলো। জিবরান মাথা তুলে অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে নরম গলায় বলে উঠলো,
“ভাইজান, আমরা আসলে বুঝতে পারিনি এই স্থানটা আমাদের জন্য এতটা হুমকির হবে! বুঝতে পারলে কখনোই এদিকে আসতাম না। আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি সঠিক সময়ে এখানে এসে না পৌছালে আমরা এতক্ষণে সিংহ আর নেকড়ের পেটে যেতাম।”
মীর ওর মুখে জড়ানো পোশাকের অংশটা আরও ভালোভাবে জড়াতে জড়াতে ক্যাম্পিং এর স্থানটা ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলে উঠলো,
“সাবধানে থাকবেন। রাত শেষ হতে এখনো অনেক সময় বাকি, এর ভেতরে ওরা যে দলে ভারী হয়ে এসে আপনাদেরকে আক্রমণ করবেনা তার কি গ্যারান্টি? সতর্ক থাকুন।”
মীরকে চলে যেতে দেখেই আনাবিয়ার পাশে বসা জারা আর এলিজা একে অপরের দিকে তাকিয়ে তড়িতে ছেলে গুলোর দিকে তাকিয়ে ভাব বিনিময় করে নিয়ে মীরের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“ভাইয়া শুনুন!”
মীর দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথে। পোশাকের আড়ালে থাকা ঠোটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো ওর আবারও। জারা এলিজাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে ও ভ্রু জোড়া কুচকে বিরক্তির গলায় বলে উঠলো,
“দ্রুত বলুন, আপনাদের জন্য এমনিতেই আমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। আর এক মিনিট সময়ও নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই, কুইক!”
ইথান আর ইব্রাহিম ওর দিকে এগিয়ে এসে ইতস্তত গলায় বলল,
“ভাইয়া, আমাদের কাছে মাত্র এই দুইটা বন্দুকই আছে, ওরা আবার এলে আমরা কোনোভাবেই ঠেকাতে পারবোনা। ওদের যে সাইজ তাতে আমাদের এই বন্দুক ওদের সামনে কিছুই না! আপনি যদি আমাদেরকে আজকের রাতের জন্য নিরাপত্তা দিতেন…”
বাকি কথা শেষ করতে পারলোনা ইব্রাহিম, তার আগেই মীর ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,
“আপনাদের কি মনে হচ্ছে আমি এখানে বডিগার্ডের কাজ করতে এসেছি? নিজেদের টা নিজেরা দেখে নেন।”
বলেই আবার যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো মীর। এদিকে মীরের এমন বাজখাঁই গলা শুনে ভড়কে গেলো জারা আর এলিজা। ওরা সকলে মিলে চাপা গলায় আনাবিয়াকে খোচাতে লাগলো,
“দোস্ত তুই বল প্লিজ, তোর কথা কেউ ফেলেনা, বলনা দোস্ত, একবার বলেই দ্যাখ না! তোর পায়ে ধরি!”
আনাবিয়া পড়লো ফ্যাসাদে, শালার কালাভুনা এরকম কাহিনী সাজাবে জানলে ও এদের সাথে আসতোই না! মীরকে পা বাড়াতে দেখে এলিজা ওকে এক প্রকার ঠেলে উঠিয়ে দিলো, জারা জোরে গলা খাকারি দিলো মীরের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য।
গলা খাকারি শুনে মীর পিছু ফিরে তাকিয়ে আনাবিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাতের তালওয়ারটা উঠিয়ে ঘাড়ের ওপর ঠেকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল,
“যা বলার দ্রুত বলুন, আমার সময় নেই।”
“আমাদেরকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন।”
কাঠকাঠ গলায় বলল আনাবিয়া। এলিজারা কপাল চাপড়ালো, এই মেয়েটার মুখে জন্মের সময় কি মধু দেওয়ার মতো কেউই ছিলোনা?
গেলো, ওদের সব গেলো! এবার নেকড়ের পেটে গিয়েই ক্যাম্পিং করতে হবে ওদের।
কিন্তু ওদেরকে অবাক করে দিয়ে একপা একপা করে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এলো মীর, আনাবিয়ার একেবারেই সামনে এসে দাঁড়িয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে মীর বলে উঠলো,
“অকারণে আমি কারো উপকার করিনা।”
“কি চান আপনি?”
ভ্রু জোড়া কুচকে বিরক্তির গলায় প্রশ্ন ছুড়লো আনাবিয়া। কিন্তু ওর প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন এলো,
“কি দিতে পারবেন আপনি আমাকে, মিস বিয়্যুটিফ্যুল? উত্তরের ওপর নির্ভর করবে আপনারা নিরাপত্তা পাবেন নাকি পাবননা।”
পেছন থেকে ইব্রাহিম বলে উঠলো,
“ভাইজান আমাদের কাছে দেবার মতো তেমন কিছুই নেই, আমরা সাথে করে কোনো টাকাপয়সা আনিনি বললেই চলে, আর আমাদের গাড়ি আছে পানি পথের ধারে থাকা পার্কিং লটে। এছাড়া আমাদের ব্যাগভর্তি সব ক্যাম্পিং এর জিনিসপত্র।”
“আমাকে কিছুই দিতে না পারলে আমিও নিরাপত্তা দিতে পারবোনা।”
মীরের কথা শুনে আনাবিয়া ওদেরকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
“প্রয়োজন নেই ওনার নিরাপত্তার, আমরা রাতে পালা করে করে পাহারা দিবো তাতেই হবে। নেকড়ে গুলো আর আসবে বলে মনে হয়না, তোরা নিশ্চিন্তে থাক। ”
মীর আনাবিয়ার এমন আত্মবিশ্বাসে ঠোঁট বেকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
“সাহসী নারী, আপনাকে একদমই বিচলিত লাগছেনা দেখি! অনেক আত্মবিশ্বাস। ঠিক আছে, আপনারা থাকুন এখানে৷ আমি চললাম।”
মীর ওদের দিক থেকে ঘুরে চলে যেতে নিলো আবারও, তখনি পেছন থেকে জারা বলে উঠলো,
“যাবেন না প্লিজ, আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে থাকতে পারি, আজকের রাতটা।”
মীরের পা থেমে গেলো সাথে সাথেই। ওকে থামতে দেখে ওরা বুঝলো হয়তো এবার কাজ হবে৷ আশার আলো দেখতে পেলো ওরা, চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠলো ওদের। আনাবিয়া অবাক চোখে তাকালো জারার দিকে। বলে কি এ মেয়ে?
মীর ঘুরে আবার তাকালো ওদের দিকে, আর তারপর ভারী কদমে ওর বিশাল দেহ নিয়ে এগোলো মেয়েগুলোর দিকে। ওর ভারিক্কি চলনে পেছন থেকে পিছিয়ে সরে গেলো ইসাবেলা, গিয়ে দাড়ালো ইথানের পাশে। নিজেকে এই সওদার ভেতর থেকে বের করে নিলো সে।
মীর জারার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো, জারা পড়লো ওর কোমরের কাছে। মীরের উপস্থিতিতে ভয় পেলে পিছিয়ে গেলো সেও। মীর ওর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ওকে পরখ করে নিয়ে বলে উঠলো,
“নট মা’ টাইপ!”
আর এরপর চোখ উঁচিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“এই সাহসী নারীকে পেলে বিবেচনা করে দেখবো।”
“কোনোভাবেই না! আমি কোনো বাজারের পণ্য নই যে আমাকে নিয়ে এখানে সওদা চলবে!”
আনাবিয়ার কথা শুনে মীর ঘুরে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে তবে… আপনারা নিরাপদে থাকুন।”
“দাড়ান, ও রাজি।”
পাশে দাঁড়ানো ইথান বলে উঠলো সাথে সাথেই। মীর ভ্রু কুচকে তাকালো ওর দিকে, ইসাবেলা কে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। আনাবিয়া অবিশ্বাস্য কন্ঠে ইথানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি বলছিস তুই ইথান!”
“নূর, এইটা আমাদের সবার জীবনের ব্যাপার, সাথে তোরও! আমাদের হাতে আর কোনো অপশন নাই। তুই স্যাক্রিফাইস না করলে আমরা কেউই এখান থেকে বেঁচে ফিরবোনা৷ এত রাতে অন্ধকারের ভেতর গাড়ির কাছে ফেরাও সম্ভব না! একটা রাতেরই তো ব্যাপার! রাজি হয়ে যা প্লিজ! নইলে আমাদের সবাইকে নেকড়ে আর সিংহর পেটে যেতে হবে! প্লিজ!”
ইথানের কথায় সকলেই সায় জানালো, কেউ সরবে কেউ নিরবে, কিন্তু কেউই প্রতিবাদ করলোনা। আনাবিয়া আশা নিয়ে তাকালো ওদের সবার দিকে, এলিজার দিকে, জিবরানের দিকে। সবাই চুপ!
জিবরান কিছু বলতে নিলেও ইব্রাহিমের হাতটানে থেমে গেলো সেও।
আনাবিয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে, এলিজার দিকে শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো ও, এলিজা চোখ নামিয়ে নিলো সাথে সাথেই!
দাঁতে দাঁত পিষে গেলো আনাবিয়ার! যাদেরকে ও এতদিন এত ভালো বন্ধুরূপে জেনে এসেছে তারা ভেতরে ভেতরে এতটা নিচু মানসিকতা আর স্বার্থ নিয়ে থাকে সেটা ও ঘূর্ণাক্ষরেও কখনো বুঝতে পারেনি!
মীর মৃদু হেসে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে ওর একেবারে কাছাকাছি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
“কাদেরকে বিশ্বাস করেছেন বেগম? যারা নিজেদের স্বার্থের জন্য আপনাকে নিয়ে বাজারে তুলতে দ্বিতীয়বার ভাবেনা তাদেরকে? অথচ আপনার স্বামীকে দেখুন, আপনার শরীরে কারো স্পর্শ থাকলে সেই সত্তাকে সে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেয়! এখন থেকে বুঝেশুনে পা বাড়াবেন, কেমন?”
আনাবিয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, মীর ওকে এক হাতে টেনে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে। দেখলো সকলে, কেউ কিছুই বললনা। মীর বাকা হেসে জঙ্গলের কুচকুচে আঁধারের দিকে নির্দেশ করে হাঁক ছাড়লো,
“কোকো!”
ডাক শুনতেই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কোকো, মীর ওকে দেখে বলে উঠলো,
“এদেরকে আমার বেগমের রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে সুন্দরমতো আপ্যায়ন করবে।”
কোকো মীরের কথায় মাথা নাড়িয়ে ভারিক্কি গলায় ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭+২৮
“আসুন!”
কোকোর আহবান শোনা মাত্রই আনাবিয়ার জন্য দ্বিতীয় চিন্তা না করে সকলে বিড়বিড় করে পা বাড়ালো কোকোর পেছন পেছন। আর মীর আনাবিয়ার কোমরটা ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর হতভম্ব চেহারার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই!
