বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯+৪০

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯+৪০
রানী আমিনা

মীরকে সেখানে দেখা মাত্রই উচ্ছসিত হলো আনাবিয়া, অভিমানও হলো খুব! কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়েছিলো যে ওকে বিছানায় রেখেই উঠে চলে যেতে হলো, একটাবার বলেও গেলোনা!
একটু আগের অসহ্য যন্ত্রণায় যদি ও আজ মরে যেতো তবে কি হতো? ও তো ওর মীরকে শেষ বারের জন্য একটু দেখতেও পেতোনা!

মীর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এখনো, দৃষ্টি ওর স্থীর হয়ে আছে আনাবিয়ার মুখের ওপর। জড়বৎ দাঁড়িয়ে ও তাকিয়ে আছে আনাবিয়ার উচ্ছসিত চেহারার দিকে।
কিন্তু ওর মুখে লেগে নেই কোনো হাসি, শুষ্ক হয়ে আছে মুখখানা। সব হাসি, আনন্দ যেন সেই বিশ্বাস ভেঙে ফেলা কামরাতেই রেখে চলে এসেছে সে!
আনাবিয়া এই হঠাৎ যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সেই সাথে মীরকেও চোখের সামনে পেয়ে খুশি হলো প্রচন্ড। ঝিলিক দিয়ে ওঠা মুখখানাতে মায়াভরা হাসি মাখিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেলো মীরের দিকে, আর গিয়েই ঝাপিয়ে পড়লো মীরের বুকের ওপর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মীর ওর বুকে আছড়ে পড়া আনাবিয়ার পাতলা শরীরটা জড়িয়ে নিলো, দ্বিধাভরা কম্পিত হাতে! যেন আনাবিয়ার পবিত্র শরীরটা নিজের এইমাত্র কলুষিত হয়ে যাওয়া হাত দ্বারা স্পর্শ করতে বিবেকে বাঁধছে ওর।
আনাবিয়া পরম আবেশে চোখ বুজে মুখ লুকিয়ে নিলো নিলো মীরের বুকের ভেতর, কিন্তু সেই মুহুর্তেই ওর নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকলো এক সম্পুর্ন অপরিচিত ঘ্রাণ, অন্য কারো ঘ্রাণ; অজ্ঞাত, অজানা ঘ্রাণ!
তাৎক্ষনিক সচকিত হয়ে গেলো আনাবিয়া, তড়িতে মীরের বুক থেকে মাথা তুলে ছিটকে দূরে সরে এলো মীরের থেকে, অতঃপর মীরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে মীরের মুখাবয়বের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও বোঝার চেষ্টা করলো কিছু!

ওর মীরের এই শক্তিশালী পুরুষালি দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাজ, প্রতিটি দৃঢ় পেশীর ভারত্ব ওর চেনা। মীরের শরীরের ওর অস্তিত্বের চেয়েও আপন, নিজের নিঃশ্বাসের ন্যায় পরিচিত!
খরস্রোতা পাথুরে নদীর পানি যেভাবে তার গতিপথকে পরতে পরতে চেনে ঠিক সেভাবেই ও চেনে মীরের শরীরের প্রতিটি খাজ, প্রতিটি কোণ, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি শ্বাসপ্রশ্বাসের গভীরতা!
তবে আজ ওর বুকে অন্য ঘ্রাণ কেন?
কিসের ঘ্রাণ, কার ঘ্রাণ ওই চিরচেনা বুকের মধ্যিখানে পেলো আনাবিয়া?
এক মুহুর্তের জন্য অবিশ্বাস্য, সংশয়ী, বিস্ফোরিত চোখে আনাবিয়া তাকালো মীরের দিকে, আর তার পরমুহূর্তেই সেই অবিশ্বাসের আলোড়নে বিস্ময়ে হতবাক চাহনি রূপ নিলো বিধ্বংসী দৃষ্টিতে। দৃঢ় গম্ভীর স্বরে সে মীরের দিকে ছুড়ে দিলো প্রশ্ন,

“কোথায় ছিলে তুমি?”
মীর এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। আনাবিয়ার ওই দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখা কষ্টসাধ্য! কি উত্তর দেবে ও? কোন উত্তরে সন্তুষ্ট হবে ওর শিনজোর আহত হৃদয়?
এক অদৃশ্য ভারী বোঝা বুকের ভেতর যেন আঁটকে রইলো ওর, হৃদয় ভর্তি হয়ে গেলো অবর্ণনীয় তীব্র যন্ত্রণায়!
যাকে ছাড়া ওর পৃথিবী একেবারে শূন্য, যে ওর সবচেয়ে বড় সহায়, যে ওর হৃদয়ের একমাত্র মালিক তাকে ও আজ ঠকিয়েছে। কিন্তু এ ছাড়া যে ওর কাছে আর কোনো উপায় বেঁচে ছিলোনা!
ওর শিনজোকে কি কিছু বলে দেওয়ার প্রয়োজন হয়? সে যে মীরের চোখে তাকালেই সমস্তটা পড়ে ফেলতে পারে! তবে আজ ওর চোখে চেয়ে সে কেন বুঝতে পারছেনা যে মীরের অস্তিত্বটাই ভেতরে ভেতরে দগ্ধ হতে হতে ধ্বংস হয়ে যেতে চলেছে!

সে আনাবিয়ার বিশ্বাস ভেঙেছে, অন্য কারো সংস্পর্শে গিয়েছে, অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হয়েছে— হোক সে মেয়ে অচেনা অজানা তুচ্ছ কেউ, তবুও হয়েছে তো! কিন্তু কি আর করার ছিলো ওর? কিছুইনা।
মীরের এই মুহুর্তে হঠাৎ করেই উপলব্ধি হলো কেন ওর পূর্বপুরুষেরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি।
এই তীব্র মনোকষ্ট, মানসিক অশান্তি নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকে মানুষ! কিভাবে পুরোপুরি দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারে? প্রাণের চেয়েও প্রিয় স্ত্রীকে কিভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারে?
ভুল করেছে ও চরম ভুল! ওর বিয়ে করাই উচিত হয়নি, একদমই উচিত হয়নি। ওর শিনজোকে তার মতো করেই বাঁচতে দেওয়া উচিত ছিলো। একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পেতো সে। মীরকেও কখনো কোনো মনস্তাত্ত্বিক সংঘর্ষে জড়াতে হতোনা, সেও একজন দায়িত্বশীল বাদশাহর ন্যায় এই সাম্রাজ্য শাসন করে চলতো! ভালোবাসা নামক কোনো বস্তুর অস্তিত্বই থাকতোনা ওর জীবনে।

কিন্তু এখন ওর কিছুই করার নেই। শিনজো ওর স্ত্রী, ওর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। এই জনসমাগমে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে ওর একমাত্র আপনজন! এই স্থান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব!
কি হবে যদি ওর আনাবিয়া এখন ওর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়? না, এটা সে চাইবেই বা কোন সাহসে? সে পঞ্চদ্বীপের একচ্ছত্র অধিপতি, দেমিয়ান বাদশাহ। তার নিকট থেকে সে পরিত্রাণ পাওয়ার কথা ভাববেই বা কোন স্পর্ধায়?
আনাবিয়া তার, শুধুমাত্র তার। আনাবিয়ার ভাগ্য তার সাথেই বাঁধা, ও ছাড়া আনাবিয়ার আর কোনো ঠিকানা নেই, আর না কখনো হবে।

ওর শিনজোর চোখে ও কখনোই নিজের জন্য কোনো ক্ষোভ দেখতে চায়নি, দেখতে চায়নি বিষাদ। কিন্তু আজ ও নিরুপায়, হয়তো এটাই নির্ধারিত ছিলো। আর এটাও শিনজোকে মেনে নিতে হবে, অন্য সবকিছুর মতোই।
সে একজন বাদশাহ, এই বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বময় শাসক, কাঁধে তার দায়িত্বের পাহাড়। এসব কিছুকে অন্যদিকে ফেলে আবেগকে প্রাধান্য দেওয়া তার কোনোভাবেই মানায় না। শিনজো তার জীবনে যতটা গুরুত্ব বহন করে, ঠিক ততটাই বা তার চাইতেও বেশি গুরুত্ব বহন করে তার সিংহাসন, তার সাম্রাজ্য৷
ভাবনা গুলোকে চেপে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মীর, আনাবিয়ার প্রশ্নটাকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে দুকদম এগিয়ে এসে মৃদু গলায় বলে উঠলো,
“তোমার শরীর খারাপ শিনজো, বাইরে ঠান্ডা বাতাস। বাইরে থেকোনা শরীর আরও খারাপ করবে। কামরায় চলো, ঘুমাবে৷”

বলে হাতটা বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলো আনাবিয়াকে, কিন্তু আনাবিয়া ক্ষিপ্র গতিতে পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। আর তারপর ক্রোধ, ক্ষোভ, আর্তনাদ, কান্না সবকিছুকে একত্রে মিশিয়ে ও আহত বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলল,
“ভুলেও স্পর্শ করবেনা আমাকে। কোথায় ছিলে তুমি? উত্তর দাও!”
মীর শান্ত, স্থীর, নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার নোনা জলে পরিপূর্ণ ক্রোধিত দৃষ্টির দিকে। আনাবিয়ার পেছনে তাকিয়ে বারান্দার অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো লিও কাঞ্জি কোকোর দিকে দৃষ্টি দিলো সে।
মীরের এই নিঃশব্দ আদেশ পাওয়া মাত্রই তিনজনেই বিরাট বারান্দা ছেড়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলো নিজেদের কামরায়। নির্জন হয়ে এলো রয়্যাল ফ্লোর, একটি ভারাক্রান্ত হৃদয় আর একটি ক্রোধে পরিপূর্ণ সত্তা ব্যাতিত কেউ রইলোনা সেখানে।

মীর এগিয়ে এলো আনাবিয়ার দিকে, সদ্য বাচ্চা হারানো সর্পিণীর ক্রোধিত, ব্যাথিত ফোসফোসানির ন্যায় প্রতিমুহূর্তে সশব্দ নিঃশ্বাস পড়ছে তার৷
মীর কিয়ৎক্ষণ চুপ রইলো, তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে। এই মেয়েকে ও কিভাবে সমস্তটা বোঝাবে? কিভাবে বললে সে বুঝবে ওর অসহায়ত্ব! ও কি আদৌ ওর শিনজোকে কিছু বোঝাতে পারবে? সে কি বুঝবে ওকে?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মীর এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, হাত জোড়া পেছনে বেধে, চোখের দৃষ্টি দৃঢ় করে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“আমাকে ক্ষমা করে দিও শিনজো। আমি তোমার ভালোবাসার উপযুক্ত শ্রদ্ধা, সম্মান, মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি জানি আমি যা করেছি তা তোমার জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি কখনোই।
তুমি আমার স্ত্রী, আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তুমি ছাড়া আমার এ জীবনের কোনো মানে নেই, সব কিছুই মূল্যহীন।

তাই, যদি কখনো দেখো আমি তোমার সাথে এমন কিছু করেছি যাতে তুমি কষ্ট পেতে পারো বা কষ্ট পেয়েছো, তখন তুমি জেনো আমি নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করিনি, করেছি কোনো দুর্দমনীয় কঠিন পরিস্থিতির কারণে, বাধ্য হয়ে।
আমি জানি, আমি আমার হয়ে সাফাই গাইছি।
কিন্তু আমি শুধু চাই তুমি বুঝো আমাকে, আমার পরিস্থিতিকে।
তুমি নিজেও জানো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, এবং যত্ন কোনোকিছুই কোনো সীমানায় বাঁধা নেই, অসীম; তোমাকে আমি সবকিছুই মাত্রাছাড়া দিয়েছি।
তোমার প্রতি আমার যে ভালোবাসা, সেটা আমার অস্তিত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সবচেয়ে গভীর সত্য। তুমি ছাড়া আমি অন্য কোনো কিছু বা কাউকে ভাবতে পারি না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা অব্যক্ত, অমলিন।”
এতটুকু বলে থামলো মীর, আনাবিয়ার দুচোখ ছাপিয়ে লোনা বারিধারা গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে৷ অবিশ্বাস্য নেত্রে তাকিয়ে আছে ও মীরের দিকে। এটা কি ওর মীর, সত্যিই ওর মীর! যেকিনা অকপটে স্বীকার করছে নিজের করা এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা!

ওর কি একটুও গলা কাঁপছেনা? একটুও অপরাধবোধ হচ্ছেনা? এতটুকুও কষ্ট হচ্ছেনা? এই অসহনীয় বার্তাটা জানার পর আনাবিয়ার কি অবস্থা হতে পারে সেটা কি সে জানতোনা? এত সহজে সে অন্য কারো হয়ে গেলো? এত সহজে?
মীর তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়ার মনের ভেতর বয়ে চলা ঝড়, প্রশ্নোত্তরের ঝাপটা এসে স্পর্শ করলো ওকে, আনাবিয়ার অগোচরেই শিউরে উঠলো ও। তারপর পূর্বের থেকেও শীতল গলায় বলে উঠলো,
“তুমি আমাকে এই মুহুর্তে ঠিক কেমন ভাবছো আমি জানিনা, তবে আমি কসম করে বলতে পারি আমার বুকে তুমি ব্যাতিত অন্য কারো জন্য সামান্যতম আকর্ষণ, অনুভূতির ছিটে ফোটাএ নেই। তুমিই আমার সব কিছু, আর আমার সমস্তটাই তোমার জন্য।

তুমি কখনো আঘাত পেলে, হোক সেটা শারীরিক বা মানসিক সেটা সৃষ্টিকর্তার পর এই আমিই অনুভব করি। তোমার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট আমি উপলব্ধি করি আমার প্রতিটি শ্বাসে।
শুধু এবং শুধুমাত্র তুমিই আমার হৃদয়ের একমাত্র অধিপত্রী, আমার স্ত্রী তুমি। তুমি ভিন্ন আর কোনো কিছুকেই আমি তোমার চেয়ে বেশি অনুভব করি না।
আমি শুধু একটা সন্তান চাই শিনজো, একটামাত্র সন্তান। যা আমি তোমার থেকে নিতে পারবোনা! তুমি আমার জীবনের সর্বোচ্চ অমূল্য সম্পদ। তোমাকে আমি কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দিবোনা, আর না হারাতে দিবো এই সাম্রাজ্যকে।

আমি যেদিন জানবো এ পৃথিবীতে আমার কোনো সন্তান আসতে চলেছে সেদিনের পর থেকে আমি কাউকে কখনোই স্পর্শ করবোনা। আমি তোমার এবং শুধু তোমারই থাকবো। আমি তোমাকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছি, তার হাজারগুণ বেশি ভালোবাসা দিয়ে তোমার মনকে নিজের করে নিয়ে আবার তোমার বিশ্বাস অর্জন করবো। কথা দিচ্ছি তোমাকে।”
আনাবিয়া স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে শুনে গেলো সবটা! অবিশ্বাসের মাত্রাটা আরও কয়েক কাঠি ওপরে উঠে গেলো; আশ্চর্যান্বিত, ব্যথিত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।

যে মীর ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতোনা সে অন্য কারোর বাহুডোরে গিয়েছে আজ! এটা কি সত্যি?
ও কি কোনো স্বপ্নের ভেতর আঁটকে গেছে? এটা কি কোনো দুঃস্বপ্ন? হবে হয়তো! এইতো একটু পরেই ঘুম ভাঙবে ওর, তারপর মীরকে ওর পাশেই শুয়ে থাকতে দেখবে। মীর চুমু এঁকে দিবে ওর কপালে।
এসব মিথ্যা, সব মিথ্যা, শুধুই স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন! এই স্বপ্নতে ও আর থাকতে চায়না, একদমই চায়না!
আনাবিয়ার চোখের দৃষ্টি এলোমেলো হলো, দুর্বল পায়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম, শ্বাস প্রশ্বাস হয়ে উঠলো অস্বাভাবিক। এই মীর ওর মীর নয়; এটা অন্য, অন্য কেউ। চারপাশে সবকিছু অস্বাভাবিক, সবাই অস্বাভাবিক। কেউ আর ওর নয়, ওর নিজের নয়! এখানের সবাই বিশ্বাসঘাতক!
কোথায় যাবে ও? কার কাছে যাবে?

বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যাচ্ছে, যেন চেপে ধরেছে কেউ ওর হৃৎপিণ্ড। যন্ত্রণা, অসহ্য যন্ত্রণা!
চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে উঠছে বার বার, পরক্ষণেই আবার হচ্ছে স্বচ্ছ!
আনাবিয়া পেছালো আরও। মীর লক্ষ্য করলো ওর গতিবিধি, বারান্দার রেলিঙের নিকট পৌঁছাতে চাইছে সে!
মীর এগিয়ে এলো জোর কদমে, কিন্তু ওকে এগিয়ে আসতে দেখেই আনাবিয়া ছুটলো রেলিঙের দিকে, মীর এগিয়ে আসার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বজ্রকঠিন গলায় বলে উঠলো,
“শিনজো ভুলেও ও কাজ করার চিন্তাও কোরোনা!”

কিন্তু আনাবিয়া শুনলোনা, মুহুর্তেই রেলিঙের কাছে গিয়ে রেলিঙের উপরি ভাগে হাতের ভর দিয়ে লাফিয়ে পড়লো অন্য পাশে, আর তারপরেই অভিকর্ষের টানে সবেগে পড়ে যেতে লাগলো সুউচ্চ প্রাসাদের একেবারে তলানিতে!
মীর আর এক মুহুর্তও দেরি করলো না, লাফিয়ে রেলিঙের ওপর থেকে নিচে ঝাপ দিলো সেও। তড়িতে সম্মুখে নিয়ে এলো নিজের পেশিবহুল হাত জোড়া, আর এরপর সর্বশক্তি দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করতেই কব্জির উপরিভাগে ক্ষোদাই করা ক্ষীণ দৃশ্যমান ডোরাকাটা কালো রঙা বাঘের অবয়বটা জ্বলে উঠলো দপ করে! আর মুহুর্তেই সে কালো রংটা স্বর্ণালি আভা ছড়িয়ে বজ্রগতিতে ছড়িয়ে পড়লো ওর সারা শরীরে, আর তার পরমুহূর্তেই সোনালি বর্ডারে কালো রঙা এক চকচকা মেটালের আর্মরে মুড়িয়ে গেলো ওর সমস্ত শরীর। দৃশ্যমান রইলো শুধু গনগনে আগুনের ন্যায় স্বর্ণালি আভা ছড়ানো চোখ জোড়া!

মুহুর্তেই গতি বেড়ে গেলো মীরের, নিজের সম্মুখে পৃথিবী পৃষ্ঠের দিকে সবেগে ধাবিত হওয়া আনাবিয়ার দিকে বিদ্যুৎ গতিতে এগোলো ও, আর এরপর আনাবিয়ার শরীরটা পৃথিবী পৃষ্ঠের সাথে সজোরে বাড়ি খাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ক্ষিপ্রবেগে নিজেই চলে গেলো আনাবিয়ার নিচে, মুহুর্তেই ঘুরে আনাবিয়ার জন্য বুক পেতে দিলো ও, সরে গেলো ওর শরীরের আর্মর, আনাবিয়ার দেহটা এসে তীব্রবেগে আছাড় খেলো ওর শক্তপোক্ত চওড়া বুকে। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে মীরের বুকেই লুটিয়ে পড়লো ও!

নিজের কামরায় বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে আনাবিয়া, লোনা পানি শুকিয়ে সাদা রঙা আস্তরণ পড়া চোখ জোড়া সামনের দেয়ালের দিকে নিবদ্ধিত, হাতে মীরের অনেক অনেক দিন আগে উপহার দেওয়া নকশাদার খঞ্জরটা৷
সেটার ধারালো অগ্রভাগ দিয়ে মেঝের কার্পেটের ওপর একের পর এক আঁচড় কেটে চলেছে ও। কার্পেটটা ফালাফালা হয়ে গেছে, তবুও থামছেনা আনাবিয়া।
কামরার ভেতর দরজার নিকট আনাবিয়ার দিকে সতর্কচিত্তে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমিন। আনাবিয়ার ওপর কড়া নজর রাখছে সে৷

আনাবিয়ার জ্ঞান ফিরেছে এক দিন পর, আর তারপর থেকেই নিজেকে হত্যার সব রকমের চেষ্টা সে করে ফেলেছে। প্রতিবারেই মীর কোনোনা কোনো ভাবে ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে ঠেকিয়েছে ওকে।
কিছু ঘন্টা আগেই মীরের দেওয়া খঞ্জরটা দিয়ে নিজের হাতের ধমনী, শিরা-উপশিরা গুলোতে ছেদ করতে চলেছিলো সে, কিন্তু মীর যথাসময়ে এসে পড়ায় সে কাজেও ব্যর্থ হয়েছে আনাবিয়া।
তাই ইয়াসমিনকে রাত দিন চব্বিশঘন্টার জন্য বেঁধে দিয়েছে আনাবিয়ার সাথে, যেন একটা মুহুর্তের জন্যেও চোখের আড়াল না করে ওকে।
ইয়াসমিন কিছুক্ষণ আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে ঢোক গিলে মৃদু গলায়, অনুরোধের সুরে বলল,

“শেহজাদী, দয়া করে খঞ্জরটা রেখে দিন এবার!”
ইয়াসমিনের কথার বিপরীতে ওর দিকে ঝড়োবেগে ঘাড় ঘুরিয়ে বজ্রকঠিন গলায় গর্জে আনাবিয়া বলে উঠলো,
“আমার সামনে থেকে সরে যাও ইয়াসমিন! তোমাদের কারো মুখ দেখতে চাইনা আমি!”
ইয়াসমিন আনাবিয়ার এমন ধমকে নুইয়ে গেলো। দ্বিতীয় কথাটি বলার সাহস করলোনা৷
আনাবিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারও একের পর ওক শক্তিশালী আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে লাগলো কার্পেটের বুক।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো একবার ওর আর মীরের কামরায় যাওয়া আসার দরজাটার দিকে, সেটাকে গাছের হৃষ্টপুষ্ট শেকড়ের সাহায্যে পুরোপুরি সীলগালা করে দিয়েছে ও। কাঁটাযুক্ত ডালপালা গুলো এঁকেবেঁকে জড়িয়ে নিয়েছে সমস্ত প্রবেশপথটুকু, যেন মীরের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রচেষ্টার এটি একটি অন্যতম পদক্ষেপ!
এমন সময় ইয়াসমিনের পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানো বাহির দরজায় শোনা গেলো কারো পদধ্বনি। ইয়াসমিন ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে নিলেও আনাবিয়া আগের মতো করেই উগ্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“ভুলেও দরজা খুলবেনা ইয়াসমিন! নইলে এই খঞ্জরের প্রথম শিকার আমার বদলে তুমি হবে!”
ইয়াসমিন অসহায় চোখে এক পলক আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে দিলো। খুলতেই কামরার ভেতর ঢুকে পড়লো মীর। ইয়াসমিন সাথে সাথেই বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
আনাবিয়া বসে রইলো ওভাবেই। মীর ধীরপায়ে এসে দাঁড়ালো ওর সামনে, তারপর হাটুগেড়ে বসে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো আনাবিয়ার আনত মুখাবয়বের দিকে।

শক্ত হাতে ধরা খঞ্জরটা এখন আর কার্পেটের বুক ফালাফালা করছেনা, স্থীর হয়ে বিঁধে আছে মেঝেতে৷
মীর কার্পেটের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আনাবিয়ার হাত থেকে খঞ্জর টা নিয়ে নিতে গেলো, কিন্তু মুহুর্তে আনাবিয়া সরিয়ে নিলো হাত। মীরের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই শক্ত, ক্রোধিত গলায় বলে উঠলো,
“আমার সামনে আসবেনা, আমি তোমার মুখ দেখতে চাইনা!”
“উপায় নেই আর কোনো, এই মুখটাকেই দেখতে হবে সারাজীবন।”
শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে আনাবিয়ার হাত থেকে আবারও খঞ্জর নিতে হাত বাড়ালো মীর, আনাবিয়া হাত সরিয়ে নিলো আবারও। মীর কিয়ৎক্ষণ জড়বৎ বসে থেকে বলে উঠলো,
“রেখে দাও ওটা। ওটা খুব শার্প, ভুলবশত হাতে লাগলে ব্যাথা পাবে।”
মীরের কথায় তাচ্ছিল্য হাসলো আনাবিয়া, মীরের চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“এত চিন্তা তোমার! কই, আমার বুকটাকে ক্ষতবিক্ষত করার সময়ে তো একবারও ভাবোনি?”
মীর প্রতিবাদ করলো সঙ্গে সঙ্গে, দৃঢ় গলায় বলল,

“আমি ভেবেছি কি ভাবিনি সেটা তুমি না জানলেও আমি জানি, আর জানেন আমার সৃষ্টিকর্তা! তোমার বুকে আমি যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছি সেটা কোনো শব্দ দিয়েই পূরণ করা সম্ভব নয়, আমি জানি।
কিন্তু তোমার পাওয়া কষ্ট যে আমাকেও ভেতর থেকে শেষ করে দেয় সেটা কি তুমি জানো? আমি কতখানি ভার বয়ে বেড়াই সেসবের কিচ্ছুটি তুমি জানোনা। তোমাকে কখনো সেসবের আঁচটুকুও আমি লাগতে দেইনি!
যা ঘটছে তা আমি চাইনি, কখনোই চাইনি! আমি যা করেছি স্বেচ্ছায় করিনি, বাধ্য হয়ে কর……”
বাকিটুকু শেষ করতে পারলোনা মীর, তার আগেই আনাবিয়া হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলল,
“কিসের বাধ্য হয়ে করেছো তুমি? কি স্বেচ্ছায় করোনি? তোমাকে কি কেউ জোর করে নিয়েছিলো ওই নিকৃষ্ট দাসীটির কাছে? তুমি নিজের পায়ে হেটে গেছিলে, নিজের ইচ্ছাতে গেছিলে, স্বীকার করো! সিচুয়েশনের দোষ দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জঘন্য চেষ্টা কোরোনা!”

মীর চুপ হয়ে গেলো, নির্বাক হয়ে চোখ ভর্তি কথা নিয়ে ও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। এক বুক ভর্তি অভিযোগ নিয়ে ঢোক গিললো ও, তারপর ধীর পায়ে মেঝে থেকে উঠে যেতে যেতে বলল,
“খঞ্জরটা রেখে দাও।”
পরমুহূর্তেই ইয়াসমিনকে ডেকে আবার ভেতরে আসতে বলে ক্ষিপ্র পায়ে মীর চলে গেলো কামরা ছেড়ে। আনাবিয়া একটি বারের জন্যও ফিরে তাকালোনা সেদিকে।
ইয়াসমিন আবার ফিরে এলো কামরায়, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ও দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।
এমন সময়ে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালো আনাবিয়া, তারপর হেটে গেলো নিজের কামরার ডান দিকের ওয়াল আলমিরার দিকে। সেখানের একটি নির্দিষ্ট কম্পার্টেমেন্ট খুলে সে বের করলো একটা ডায়েরি, বিশেষ ডায়েরি।
চামড়ার তৈরি মেরুণ রঙা মলাটের ডায়েরীটা ওকে মনে করিয়ে দেয় ওর বিয়ের দিনের স্মৃতি। এই চামড়াটা মীর খুব যত্ন করে ছাড়িয়েছিলো মেয়েটির গা থেকে, কোথাও এতটুকু ছেদ হয়নি তার। রক্তিম রঙে সেটাকে রাঙিয়ে বাধাই করে দিয়েছিলো এই অসাধারণ ডায়েরিটা।

এখনো পর্যন্ত তাতে কোনো লেখনীর আঁচড় কাটেনি আনাবিয়া। এটাকে রেখে দিয়েছিলো নিজের জীবনের দুর্বিষহ স্মৃতিকে বন্দি করে রাখার জন্য, আজ পর্যন্ত ওর জীবনে যতকিছু ঘটেছে কোনোকিছুকেই দুর্বিষহ মনে হয়নি ওর। কিন্তু আজ এই মেরুণ চামড়ায় মোড়া ডায়েরিটাতে প্রথম কালিমা লেপন হবে!
ডায়েরিটা হাতে করে নিয়ে মেঝেতে এসে আবার বসলো আনাবিয়া, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ইয়াসমিনের দিকে না তাকিয়েই হাক ছেড়ে ও নির্বিকার, শান্ত গলায় শুধালো,

“মেয়েটির নাম কি?”
“আ-আন্দ্রেয়া, শেহজাদী।”
আনাবিয়া নিজের ভাজ করে রাখা হাটুর ওপর মেলে ধরলো ডায়েরির প্রথম পাতা, তারপর তাতে গোটা গোটা করে লিখলো, ‘আন্দ্রেয়া’।
এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে সেখানে লিখলো এই দুটো দিনে ওর সাথে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা, সবিস্তারে বর্ণনা করলো নিজের মনের অনুভূতির মিশেল, লিখলো ওর প্রতি করা মীরের সমস্ত মানসিক অত্যাচার, ফুটিয়ে তুললো মীরের ভেতরে চলা কাল্পনিক ভাবনা গুলোকে।

লেখা শেষ করতে করতে ঘন্টা দুই পার করে ফেললো ও। পুরোটা সময় এতটুকু টু শব্দও করলোনা, লিখেই গেলো লিখেই গেলো৷ তারপর একসময় ক্লান্ত হয়ে হাত থেকে ছেড়ে দিলো কলম। ডায়েরিটা রেখে দিলো পাশে। কিয়ৎক্ষণ শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দেয়ালের দিকে, তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একসময় ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে এলো ওর চোখ, মুখ চোয়াল। আর তারপর হুট করেই খঞ্জরটা হাতে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেটে বেরিয়ে গেলো ও বাইরে।
পেছন থেকে ইয়াসমিনের হাজারটা ‘শেহজাদী’ ডাকেও ফিরে তাকালোনা৷

প্রাসাদের তৃতীয় স্তরে অবস্থিত বিরাট হলরুমের মেঝেতে লুকোচুরি খেলছে বিকেলের নরম আলো।
হলরুমের চারপাশে অবস্থিত সুসজ্জিত কামরা গুলোর বিশাল বিশাল জানালার রেশমি পর্দাগুলো দুলে উঠছে বাতাসের নরম স্পর্শে৷
বাতাসে ভেসে আসছে স্নিগ্ধ, নরম সুগন্ধি। স্ফটিকের ঝাড়বাতির আলোয় চিকচিক করে উঠছে মার্বেলের দেয়াল।
হেরেমের বিস্তীর্ণ কক্ষের এক কোনে থাকা সুসজ্জিত নরম বিছানার ওপর রত্নখচিত আরাম কুশনে হেলান দিয়ে বসে আছে এক ঝাঁক মেয়ে, তাদের উচ্চস্বরে খিলখিলে হাসিতে মেতে আছে আশপাশটা।
বাকিরা ব্যাস্ত আছে কাজে।

বসে থাকা মেয়েগুলোর চোখ উজ্জ্বল, কৌতূহলে টানটান। তাদের মধ্যমণি হয়ে বসে আছে একটি অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে, কেউ তাকে স্পর্শ করতে এলে সলজ্জ ভঙ্গিতে দূরে সরে যাচ্ছে সে, তার গায়ে যে এখনো বাদশাহর ছোঁয়ার আবেশ! এটাকে অন্য কারো ছোয়ায় নষ্ট করতে চায়না সে!
সলজ্জ মুখটা রেশমের ওড়নায় ঢেকে নেয়, কিন্তু বাকিরা তো ছাড়তে চাইছেনা তাকে, সে যে বাদশাহর সেবায় গিয়েছে গত দুরাতে সেটা জানার পর থেকেই এরা যেন পাগল হয়ে গেছে!
“বল না আন্দ্রেয়া, কেমন ছিলেন উনি? কেমন দেখতে? সুদর্শন অনেক তাইনা?”
অন্য একজন প্রথমজনকে থামিয়ে দিয়ে কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে খুব আদর করেছেন তাইনা? খুশি হয়েছিলেন তিনি? উপহার দিয়েছেন কোনো?
আন্দ্রেয়া চোখ জোড়ার ওপর থেকে আবরণটা সরালো কিঞ্চিৎ, তারপর লাজুক হেসে, সলজ্জ কাঁপা গলায় বলে উঠলো,

“আমি কিছুই বলতে পারবোনা!”
পরমুহুর্তেই চোখ জোড়া আবার বন্ধ করে নিলো।
“উফ, এমন করিস কেন? বল না! কিভাবে এসেছিলেন তিনি? তোর দিকে কিভাবে তাকিয়েছিলেন, কিভাবে কাছে ডেকেছিলেন?”
চাপা সুরে বলে বলে উঠলো কেউ একজন, তার কণ্ঠে ঈর্ষার স্পষ্ট আঁচ।
আন্দ্রেয়ার ঠোঁটে গর্বের হাসি খেলে যায়। সে জানে, এই মুহূর্তে তাকে ঘিরে ধরা সব দাসীর মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে ঈর্ষার আগুন, আগ্রহ আর মুগ্ধতায় ছেয়ে আছে তারা।
ওদের সে ইর্ষাকে আরও এক পারদ বৃদ্ধি করে দেওয়ার প্রয়াসে সে এবার সলজ্জ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে বলে উঠলো,
“উনি…উনি… অসম্ভব রকমের সুদর্শন! চোখ জোড়া তাঁর অসাধারণ সুন্দর, কল্পনাতীত! দীর্ঘ, প্রশস্ত, ভীষণ শক্তিশালী শরীর, দুহাতেও তাকে জড়িয়ে নেওয়া যায়না……”
আর কিছু বলতে পারলোনা আন্দ্রেয়া, লজ্জায় আবার মুখ লুকালো ওড়নার তলে।
“কিছু বলেননি তিনি তোকে?”

আন্দ্রেয়া আনত নয়নে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো, পরক্ষণেই সলজ্জ মুখে বলল,
“আমি শুধু তার নিঃশ্বাস শুনেছি; আমার কানের কাছে, তার দীর্ঘ, ভারী নিঃশ্বাস!”
আশপাশটা নিরব হয়ে এলো, কারও মুখে কথা রইলোনা। বাতাসে ভাসতে লাগলো এক অদৃশ্য স্পর্ধা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা।
কেউ একজন বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,
“আমার এমন রাত কবে আসবে!”
আন্দ্রেয়া সেই ফিসফিসে কথাটা শুনতে পেয়েই যেন ফুসে উঠলো, অজানা সেই মেয়ের উদ্দ্যেশ্যে সে বলে উঠলো,
“এখন থেকে আমিই হবো তার বেগম, আমার কোলে যে সন্তান আসবে সেই হবে এই সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকার। তাই আমার সামনে সাবধানে কথা বল……”
আন্দ্রেয়ার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বিরাট হেরেমের অন্য প্রান্তের প্রবেশ দ্বারে অবস্থিত রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরে একটি আর্টিফিশিয়াল ভয়েস বলে উঠলো,

“অ্যালার্ট, ব্যি প্রিপেয়ার্ড। অনারেবল শেহজাদী অ্যান্ড বেগাম ইজ অ্যাপ্রোচিং!”
আর্টিফিশিয়াল ভয়েসটি ধ্বনিত হলো বিশাল হলরুমের কোণায় কোণায়, আন্দ্রেয়া এবং তাকে ঘিরে ধরে রাখা তার সাথীরা সহ হলরুম জুড়ে বিচরণ করে বেড়ানো সমস্ত দাস দাসীগুলো সচকিত হয়ে উঠলো এই ঘোষণায়!
হতচকিত হয়ে কোত্থেকে ছুটে এলো দাসীদের প্রধান হুমায়রা তায়ির। এইখানে আসার পর থেকে এখনো পর্যন্ত কোনোদিন শেহজাদীকে দেখার সৌভাগ্য তাদের কারো হয়নি।
লোকমুখে শুনেছে বাচ্চা অবস্থায় শেষবার তিনি এসেছিলেন হেরেমে, কিন্তু দাসীদের অত্যাধিক আদরে অতিষ্ঠ হয়ে হিজ ম্যাজেস্টির আদেশে তিনি আর হেরেমে পা রাখেননি কখনো। তবে আজ কেন হঠাৎ?
হুমায়রা তায়ির মুহুর্তেই হাঁক ছেড়ে সকলকে সুশৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে নিয়মানুসারে দাঁড়া করিয়ে দিলো। নিজে গিয়ে দাঁড়ালো সকলের সামনে।

তার হৃদয়ে তৈরি হলো এক অদ্ভুত আলোড়ন। শুনেছে শেহজাদী নাকি অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর এক সৌন্দর্যের অধিকারী, তার দিকে একবার তাকালে চোখ রয়ে যায় স্থীর, ঘোরে পড়ে যায় সকলে! সত্যিই কি এমন কিছু হয়, নাকি সেটা নিছকই লোকমুখে প্রচলিত সেটাই দেখবে ও আজ৷
মুহুর্তেই শ্বেত পাথরের মেঝেতে উঠলো ঝংকার; মিষ্টি, রিনরিনে ঝুন ঝুন শব্দে ছেয়ে গেলো সমস্তটা। চোখ কেঁপে উঠলো সবার। এক গভীর শ্রদ্ধা, বিস্ময়, ভয়ে নুইয়ে গেলো তারা।
সত্যিই আজ শেহজাদী আসছেন তাদের হেরেমে! অবিশ্বাস্য!
হেরেমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা আন্দ্রেয়া বিস্মিত কৌতুহলী চোখে চেয়ে রইলো প্রবেশদ্বারের দিকে। শেহজাদী তাদের বেগম। ওই দীর্ঘদেহী, সুদর্শন পুরুষটার বিবাহিতা স্ত্রী!
কেমন সে? সত্যিই কি অসাধারণ সুন্দরী? তবে বাদশাহ ওকে কেন চাইলো? শেহজাদীর চাইতে কি তবে তার সৌন্দর্য বেশি?

খুশি হলো আন্দ্রেয়া, সে কি কম সুন্দরী? একদমই না। হেরেমের সকলের চাইতে সে বেশি সৌন্দর্যের অধিকারী, বেশি শক্তিশালী।
জায়ান সাদি এক দেখাতেই তাকে হিজ ম্যাজেস্টির জন্য পছন্দ করে নিয়েছেন৷ গর্বে মাথা উঁচু হয়ে গেলো আন্দ্রেয়ার। আনাবিয়ার সামনে নিজেকে জাহির করার জন্য তর সইলোনা তার।
সেই মুহুর্তেই হেরেমের প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকলো আনাবিয়া। তার পেছন পেছন দ্রুত, শঙ্কিত পায়ে ছুটে এলো ইয়াসমিন৷
আনাবিয়া হলরুমে প্রবেশ করা মাত্রই যেন থমকে গেলো সময়। প্রাসাদের সাদা রঙা দেয়াল, মখমলি বালিশ, সিল্কের পর্দা—সবকিছুই যেন ফিকে হয়ে গেলো তাঁর সৌন্দর্যের সামনে! জানালা দিয়ে ভেতরে ভেসে আসা মৃদু বাতাস খেলে গেলো তার সাদা রঙা সিল্কের পাতলা পোশাকের প্রান্তে!

হুমায়রা তায়ির হা হয়ে গেলো, অপলকে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। কোমরে ঢেউ তুলে প্রতি পদক্ষেপে রিনরিনে শব্দ তুলে হেটে চলেছে সে, শ্বেতশুভ্র রেশম কোমল মুখাবয়বের প্রতিটি রেখায় ফুটে আছে রাজকীয় সৌন্দর্য। হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে, অপার্থিব স্নিগ্ধ চোখ জোড়ার ভেতরকার আর্দ্র, শক্তিশালী দ্যুতি যেন সম্বোধন করে চলেছে ভিন্ন পৃথিবীর কাউকে।
টেরাকোটা রঙা ঠোঁটের মিষ্টি ভাঁজে ফুটে আছে ক্রোধ!

দীর্ঘ রেশমসম শুভ্র চুলে পড়ন্ত বিকেলের সোনালি আলো এসে প্রতিফলিত হয়ে ঝিকিমিকি করে উঠছে!
পৌরাণিক বইয়ের পাতায় লিখে রাখা কোনো মায়াবিনী, কুহকিনী, ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে মন্ডিত নারীটির মতোন যেন মুহুর্তেই থমকে দিয়েছে সে আশেপাশের সমস্ত কিছু!
ওর শ্বেতশুভ্র চেহারার দিকে দৃষ্টি দিয়ে যেন সেই পৌরাণিক কাহিনীর কুহকিনীর মায়াতেই পড়ে গেলো ওরা সকলে!
দাসীদের সমস্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আনাবিয়া ভারী কদমে এগিয়ে গেলো, কার শরীরে লেগে আছে ওর মীরের ঘ্রাণ সেটাকে শিকারী নেকড়ের মতো খুঁজে ফিরলো ও। পোশাকের ভাজে হাতের মুঠিতে ধরা ধারালো খঞ্জর!
পেছন থেকে শোনা গেলো ইয়াসমিনের কন্ঠস্বর, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনুনয়ের সুরে সে বলে ওঠে,

“শেহজাদী, শান্ত হোন! হিজ ম্যাজেস্টি জানলে একদমই ভালো হবে না৷ ফিরে চলুন শেহজাদী, পায়ে ধরি আপনার!”
ইয়াসমিনের কথাতে কর্ণপাত করলো না আনাবিয়া। ক্ষিপ্র পায়ে ও এগোলো সামনের দিকে।
আন্দ্রেয়ার শ্বাস আটকে এলো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে৷
হলরুমে এইমাত্র প্রবেশ করা নারীমূর্তির কাছে সে কিছুই নয়, তার এতটুকু যোগ্যতাও নেই ওই নারীর কাছে ঘেঁষার! তার অবচেতন মন ঘুরেফিরে শুধু একটাই প্রশ্ন করলো, ‘কীভাবে এমন অপার্থিব সৌন্দর্য ধারণ করা সম্ভব?’
আন্দ্রেয়ার পাশে দাঁড়ানো অন্য একটি মেয়ে আনাবিয়ার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে থেকে আন্দ্রেয়ার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

“কার সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে চাও তুমি? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছো কখনো? ওই অপরূপা শেহজাদী আমাদের বাদশাহর একমাত্র স্ত্রী, দেমিয়ান প্রাসাদের বেগম। বাদশাহর হৃদয়ে তিনি অদ্বিতীয় স্থান দখল করে আছেন, তিনি বাদশাহর জন্য কতখানি, বাদশাহ তাকে কতটা ভালোবাসে শোনোনি কখনো?
আর, বেগম হতে চাও তুমি? ইয়াসমিনকে বলতে শুনেছি, একটা সন্তান দেওয়ার পর তোমাকে কেটে ফেলে দেওয়া হবে সমুদ্রে! মাংসাশী জলজ প্রাণী গুলো ছিড়ে খাবে তোমাকে। তোমার সামান্যতম মূল্যও নেই বাদশাহর কাছে!”
বলে পৈশাচিক হাসলো মেয়েটি, আন্দ্রেয়া চমকে তাকালো মেয়েটির দিকে। মুখ ফিরিয়ে নিলো মেয়েটি, মুখে তখনো লেগে রইলো পৈশাচিক হাসি৷
ঠিক সেই মুহুর্তেই আনাবিয়া হাটতে হাটতে চলে এলো সেদিকটায়। ইয়াসমিন ভড়কে গিয়ে পেছন থেকে ত্রস্ত পায়ে ছুটে এসে আন্দ্রেয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আড়াল করে নিলো আন্দ্রেয়াকে আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে অনুরোধের সুরে সে বলে উঠলো,

“শেহজাদী, পায়ে পড়ি আপনার, ওকে কিছু করবেন না! হিজ ম্যাজেস্টি রেগে যাবেন প্রচন্ড!”
আনাবিয়া শুনতে পেলোনা ইয়াসমিনের কোনো কথা, ওর শাণিত, ক্রোধিত দৃষ্টি নিবদ্ধিত ইয়াসমিনের পেছনে ঝড়ের কবলে পড়া ভীত চড়ুই পাখিটির ন্যায় থরথর করে কাঁপতে থাকা আন্দ্রেয়ার দিকে৷
সেই মুহুর্তেই হলরুমের প্রবেশদ্বার দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে চলে এলো মুহসিন, লিও, ফ্যালকন, কোকো। হেরেমে পুরুষ নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও আনাবিয়ার হাত থেকে আন্দ্রেয়াকে রক্ষা করতে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ঢুকে পড়েছে ওরা৷

হিজ ম্যাজেস্টি নিজে দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন ওদের সবার ওপর। শেহজাদীকে তিনি রন্ধ্রে রন্ধ্রে চিনেন, শেহজাদীর পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে সেটা সম্পর্কে তিনি আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন ওদের।
লিও দ্রুতস্বরে কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“কোকো, তুই ছাড়া আমাদের অন্য কারো শেহজাদীকে স্পর্শ করার অনুমতি নেই। ইয়াসমিন কখনোই শেহজাদীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেনা!”

কোকোকে আর কিছুই বলতে হলোনা, নিজের বিশাল শরীর নিয়ে বড় বড় কদমে সে এগিয়ে এলো আনাবিয়ার দিকে। ওকে আসতে দেখেই আনাবিয়া পেছন ফিরে বজ্রকন্ঠে বলে উঠলো,
“আর এক পাও এগোলে ওর সাথে সাথে তোকেও শেষ করে দেবো!”
ওর এমন কঠোর, দৃঢ় স্বরে কেঁপে উঠলো সকলে। হলরুমে নেমে এলো নিস্তব্দতা।
আন্দ্রেয়া ভয়ে শঙ্কায় কেঁদে উঠলো শব্দ করে। ওর কান্নার শব্দে কোকোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার ওর দিকে ফিরে তাকালো আনাবিয়া।

কোকো পেছন থেকে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“এরকমটা করবেন না আম্মা! আপনি সবই জানেন, তাকে শেষ করে দিলে হিজ ম্যাজেস্টি রেগে যাবেন। দয়া করে চলে আসুন। আপনার শরীর ভালো নেই, কামরায় চলুন প্লিজ!”
কিন্তু আনাবিয়া শুনতে পেলোনা কোকোর কথা, আর তার পরমুহূর্তেই ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে ইয়াসমিনকে বা হাত দ্বারা এক ঝটকায় টেনে সরিয়ে দিলো আন্দ্রেয়ায় সামনে থেকে। আর তার পরেই নিজের ডান হাতের শক্ত মুষ্টিতে থাকা খঞ্জরটা সর্বশক্তি দিয়ে চোখের পলকে চালিয়ে দিলো আন্দ্রেয়ার গলার নলি বরাবর!
মুহুর্তেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে এলো আন্দ্রেয়ার গলার সরু, গভীর ক্ষত থেকে। ছিটকে আনাবিয়ার সাদা রঙা পোশাকে এসে লাগলো তার কিছু অংশ, শ্বেতশুভ্র চোয়ালে এসে পড়লো কিছু ছিটেফোঁটা!
আন্দ্রেয়া নিজের ফোয়ারার ন্যায় রক্ত বের হতে থাকা গলাটা এক হাতে চেপে ধরে অবিশ্বাস্য, বিস্ফোরিত, ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, ধীরেধীরে ঢলে পড়লো মেঝেতে! আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই তড়পালো কিছুক্ষণ, রক্তে ভেসে গেলো মেঝে।

আর তারপরেই বিস্ফোরিত নয়ন যুগল খোলা রেখেই হাপরের মতো বুক উঠিয়ে শেষ শ্বাসটুকু ছেড়ে দিলো বাতাসে, শান্ত হয়ে গেলো তার শ্বাস প্রশ্বাস, স্থীর হয়ে গেলো মৃত্যুযন্ত্রণায় তড়পানো শরীর!
সেই সাথে সাথে শান্ত হয়ে গেলো ইয়াসমিন, কোকো, লিও, কাঞ্জি। আসন্ন বিপদের শঙ্কায়, ভয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ওদের শিরদাঁড়া বেয়ে! অবিশ্বাস্য, হতাশ চোখে ওরা তাকিয়ে রইলো আনবাইয়ার এই বিধ্বংসী সত্তার পানে৷
আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ আন্দ্রেয়ার চোখ খোলা স্থীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর পায়ে প্রস্থান করলো হলরুম থেকে। আর হলরুম থেকে বেরিয়ে এসে রয়্যাল ফ্লোরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওর চোখে পড়লো মীরের দীর্ঘাবয়ব, স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে……

দাঁড়িয়ে গেলো আনাবিয়া, নিরুদ্দিপ হয়ে অনুভূতিহীন, শুষ্ক, কঠিন চোখে ও তাকিয়ে রইলো মীরের নির্বিকার নির্লিপ্ত নয়ন যুগলে।
মীর কিয়ৎক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। ওর প্রচন্ড ক্রোধে উন্মাদ হওয়ার কথা ছিলো হয়তো, আনাবিয়া তেমনই আশা করেছিলো। কিন্তু আনাবিয়াকে অবাক করে দিয়ে মীরের চেহারায় ক্রোধের পরিবর্তে দেখা গেলো মৃদু, নীরব হাসি।
ঠোঁট কামড়ে নিজের এমন ভুল সময়ের নির্লজ্জ হাসিটাকে আটকানোর চেষ্টা করলো মীর কিয়ৎক্ষণ!
আনাবিয়া ভ্রুকুটি করে দ্বিধাভরা চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, এর মাথায় ঠিক কি চলছে সেটা বোঝার জন্য। মীর নিজের হাসি সংবরণ করার চেষ্টা করতে করতে এগিয়ে এসে দাড়ালো আনাবিয়ার সম্মুখে, চপল হেসে বলল,
“শৈশবে তোমাকে ইম্পেরিয়ালে দিয়েছিলাম যেন তুমি সংযত হয়, নিজের ক্রোধ সংবরণ করতে সক্ষম হও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত তুমি সফল হতে পারোনি৷

হাজার হলেও বাপ কা বেটী, দেমিয়ান ব্লাড। নট অ্যা সাবজেক্ট ট্যু চেইঞ্জ।
জানো, তোমার ভেতর সর্বক্ষণ সালিমের ছায়া দেখি আমি, যাকে কোনোভাবেই থামানো যায় না। তাকে তার ক্রোধ মেটাতে দিতেই হবে!”
“তুমি বুঝি কম যাও? তুমি কার সাথে কি করছো সেটা কি আমি জানিনা? ফারিশের সাথে কি করেছো আমি কি ভুলে গেছি?”
এতক্ষণ মীরের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলা করলেও ফারিশের নাম শোনা মাত্রই মিলিয়ে গেলো, কাঠিন্যতা এসে ভর করলো সেখানে। উগ্র, তীক্ষ্ণ হলো চোখের দৃষ্টি। আনাবিয়ার দিকে আরও একটু এগিয়ে এসে আনাবিয়ার চোয়ালে লেগে থাকা আন্দ্রেয়ায় শরীর নিঃসৃত মেরুণ রঙা তরলের ছিটেফোঁটা গুলোকে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিতে দিতে নরম গলায় বলল,
“অন্যের ব্লাডে তোমার এলার্জি, কামরায় গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নাও৷
এভাবে তাকে হত্যা করা তোমার একদমই ঠিক হয়নি, আমার সন্তানের ব্যাপারটা চুকে গেলেই আর কোনো অশান্তি, জটিলতা থাকতোনা। কিন্তু তুমি তো অধৈর্য!
এমন অধৈর্য হলে যে এই দুর্ভোগ চলতেই থাকবে শিনজো!
আর… আমি তোমার স্বামী, তোমার জীবনসঙ্গী। স্বামীর সামনে প্রেমিকদের নাম নিতে হয়না, এটা এক ধরণের বেয়াদবি৷”

“স্বামীর সামনে প্রেমিকের নাম নিতে হয়না, কিন্তু স্ত্রীর সামনে যার তার সাথে শুয়ে পড়া যায়, তাইতো?”
চাপা হিসহিসে কন্ঠে বলল আনাবিয়া, মীর নিঃশব্দে হেসে আনাবিয়ার চোয়ালে দুবার নরম চাপড়ের ন্যায় হাত ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
“রেগো না। রাগলে তুমি লাল হয়ে যাও, তখন তোমাকে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
বলেই দু আঙুলে আনাবিয়ার গাল টিপে দিয়ে পেছন ফিরে ও এগোলো রয়্যাল ফ্লোরের দিকে। হলরুম থেকে লিও কাঞ্জি বেরিয়ে আনাবিয়াকে আনুগত্যের সাথে পাশ কাটিয়ে এগোলো মীরের পেছন পেছন। আনাবিয়া দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই, তাকিয়ে দেখলো মীরের চলে যাওয়া।

আনাবিয়া বসে আছে নিজের কামরার মেঝেতে, বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে৷ হাতে তার মেরুণ রঙা চামড়ার ডায়েরি। খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে সে, পড়ছে পুরাতন লেখা গুলো৷
গত তিন বছরে এই ডায়েরির ঝকঝকে নকশাদার পৃষ্ঠায় আরও তিন জনের নাম উঠে গেছে৷ নিরব অভিযোগে ভর্তি হয়েছে শতশত পৃষ্ঠা।
মীর যে বলেছিলো তাকে, সে অধৈর্য হলে এই দুর্ভোগ চলতেই থাকবে! সেই দুর্ভোগই চালিয়ে চলেছে সে। সে স্থীর নেই, একটা সন্তান তার চাই-ই চাই।

আনাবিয়া কি দিতে পারতোনা তাকে সন্তান? মীর কি একটাবার চেষ্টা করে দেখতে পারতোনা আসলেই সে মীরের সন্তান ধারণে সক্ষম কিনা? সে তো সম্পুর্ন ফার্টাইল, তার তো কোনো অসুবিধা নেই, তবে মীর কেন আগায় না? কেন বার বার ওসমস্ত নিকৃষ্ট দাসীগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ হয় সে? সে ব্যাতিত অন্য কেউ কেন মীরের সন্তানের মা হবে? কোন অধিকারে?
কোন অতীতে কোন শেহজাদীর তার কাজিনের সাথে বিয়ে হওয়ার কি দুর্ঘটনা ঘটেছে তার সাথে এখনের কি সম্পর্ক? ওরা তো এখন অনেক এগিয়ে, ওদের টেকনোলজি অতীতের তুলনায় অনেক অনেক উন্নত, তবে একটাবার চেষ্টা করলে কি হতোনা?

হতেও পারে সেই শেহজাদীর সাথে অন্য কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, অন্য কোনো ভাবে সে পৃথিবী ত্যাগ করেছিলো! হয়তো তখনের মানুষ আবেগে পড়ে রুলস করে দিয়েছিলো, যে একজন দেমিয়ান শেহজাদা অন্য কোনো দেমিয়ান শেহজাদীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেনা!
কিন্তু বর্তমানে এসে ওদের সামান্য পরীক্ষা করে দেখতে ক্ষতি কি ছিলো? কি হতো রিস্ক নিলে? রিস্ক নেওয়ার পর যদি তার ভেতরে কোনো কম্পলিকেশন্স দেখা যেতো তখন না হয় আনাবিয়া মেনে নিতো সব! কিন্তু আগেই কেন?
ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া। তাকালো একবার মীর আর তার কামরার সংযোগ স্থলের দরজার দিকে। সেটা আজও কণ্টকাকীর্ণ ডালপালাতে আবৃত। ওই দুয়ার সে আর খুলতে দেয়নি কখনোই, থাকুক ওভাবেই, রুদ্ধ, আবদ্ধ!

এখনো সেই অসহ্য যন্ত্রণার স্মৃতি স্মরণে এলে তড়পায় ও। লাইফট্রি মীরের সাথে কেন ওকে এতটা জুড়ে দিলো? কেন সে মীরের প্রতিটি অনুভূতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জুড়ে আছে? কেন সে প্রতিমুহূর্তে ওই হৃদয়হীন মানুষটির অনুভূতিতে যন্ত্রণা পায়? কোন কারণে?
যতবার মীর কারো সাথে সামান্যতম ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততবারই তড়পেছে ও, ঝাঝরা হওয়ার উপক্রম হয়েছে ওর বুক। কোনো কিছু না জেনেই, কোনো আগাম বার্তা না পেয়েই মীরের বিশ্বাসঘাতকতা গুলো জেনে গেছে ও৷ সবকিছু কেন ওর আড়ালে হলোনা?
বুকের ভেতর থেকে একটা ঝড়ো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আবারও। ওর ভাবনায় বাঁধা দিয়ে দরজায় কড়া নেড়ে খাবারের ট্রে হাতে ভেতরে এলো ইয়াসমিন। আনাবিয়ার কোনো হেলদোল দেখা গেলোনা, সেভাবেই মেঝেতে বসে রইলো।

ইয়াসমিন সন্তর্পণে খাবারের ট্রে টা আনাবিয়ার বিছানার সাইড টেবিলের ওপর রেখে আনাবিয়ার কাছে এসে মৃদুস্বরে অনুরোধের গলায় বলে উঠলো,
“শেহজাদী, খেয়ে নিন! সকাল থেকে আপনি কিছুই মুখে তোলেননি, হিজ ম্যাজেস্টি রেগে আছেন খুব। বের হওয়ার আগে তিনি বলে গেছেন আপনাকে খাইয়ে দিতে৷ আপনি না খেলে তিনি আমাকে প্রাসাদ থেকে বের কিরে দিবেন!”
“কোথায় গেছেন তিনি?”
ডায়েরির ওপর থেকে মুখ না তুলেই শুধালো আনাবিয়া। আন্দ্রেয়ার ঘটনার পর থেকেই মীরকে আর তুমি বলে সম্বোধন করেনি আনাবিয়া, মীরকে তার নাম ধরে ডাকার বদলে অন্যদের মতো সেও এখন তাকে হিজ ম্যাজেস্টি বলেই সম্বোধন করে। অভিমানের দুরত্ব টা সবদিক থেকেই হওয়া চাই, যেন কোনোদিক থেকেই মীর তার কাছাকাছি আসার সুযোগটুকু পর্যন্ত না পায়!

“উনি কিমালেবে গিয়েছেন, মিস্টার সাদির সাথে দেখা করতে।”
ডায়েরির ওপর থেকে মুখ তুললো এবার আনাবিয়া, তাকালো সম্মুখের দেয়ালের পানে, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“সেদিন না গেছিলেন? আজ আবার কেন? কোনো অসুবিধা হয়েছে কোথাও?”
জিজ্ঞেস করে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ানো ইয়াসমিনের দিকে তাকালো আনাবিয়া। আনাবিয়ার প্রশ্নে ভড়কালো ইয়াসমিন, কি বলবে বুঝতে পারলোনা ও, ঢোক গিললো একটা সশব্দে। তারপর কাঁপা গলায় কিছুটা জোর দিয়েই বলে উঠলো,

“আ-আমি জানিনা শেহজাদী!”
আনাবিয়া সুক্ষ্ম, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো ইয়াসমিনের দিকে। বোঝার চেষ্টা করলো কি চলছে এখানে। মীর হঠাৎ করেই ভালো হয়ে গিয়েছে। ওই অসহ্য যন্ত্রণাটা সে বহুদিন হলো আর অনুভব করেনি। শেষ বার যন্ত্রণাটা অনুভব করার পর চার নম্বর মেয়েটিকে প্রাসাদের ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিলো ও, পড়েছিলো গিয়ে প্রাসাদের চারপাশে থাকা তারকাটা যুক্ত প্রাচীরের ওপর, ধারালো লৌহদন্ডের ওপর পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে দুভাগ হয়েছিলো তার।
তারপর থেকে ওই অসহ্য যন্ত্রণাটা আর অনুভব করেনি আনাবিয়া। যন্ত্রণাটা ছিলো ওর মীরের অন্য কারো সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার একমাত্র সংকেত। কিন্তু এই সংকেত ও পায়নি অনেক অনেক দিন!
তবে কি ওকে স্বান্তনা দিয়ে ওর আড়ালেই কিছু হচ্ছে? ওরা কি ওর অজ্ঞাতে আবার ওকে কষ্ট দেওয়ার পায়তারা করে চলেছে?

ইয়াসমিন আনাবিয়ার ওই ভেতর পড়ে ফেলা দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারলোনা, মাথা ঘুরতে লাগলো ওর, মনে হলো ওই ঝকমকে দৃষ্টির আঘাতে ঘায়েল হয়ে এখানেই জ্ঞান হারাবে ও।
ইয়াসমিন নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে চলে যেতে নিলো সেখান থেকে, কিন্তু তার আগেই আনাবিয়ার প্রশ্নে থেমে গেলো ওর পা জোড়া,
“তাঁর সাথে আর কে কে আছে সেখানে? কোকো ফ্যালকন কোথায়?”
“কোকো ভাইয়া, ফ্যালকন ভাইয়া দুজনে প্রাসাদেই আছেন।”
“ওরা প্রাসাদে কি করছে? হিজ ম্যাজেস্টি কোনো দ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় তো অলওয়েজ কোকো ফ্যালকনকে সাথে নিয়েই যান, তবে আজ এর অন্যথা হলো কেন?
বিগত ছ সাত মাসে তিনি কিমালেবে তিন বার গিয়েছেন, কিন্তু কোনোবারই কোকো ফ্যালকনকে সাথে নেননি। কেন? উনি হঠাৎ এভাবে বার বার কিমালেবে যাচ্ছেনই বা কেন? সবসময় তো জায়ান চাচাজানই আসেন যে কোনো প্রয়োজনে, এখন কি হচ্ছে?”

আনাবিয়ার একের পর এক প্রশ্নে পাংশু বর্ণ ধারণ করলো ইয়াসমিনের চেহারা৷ ভয়ে আর উত্তেজনায় আনাবিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েও পারলোনা ও, তোতলাতে শুরু করলো,
“আ-আমি এস-সবের কিছুই জানিনা শ-শেহজাদী! হিজ ম-ম্যাজেস্টি চেয়েছেন ত-তাই কোকো ভাইয়ারা ত-থেকে গেছেন প্রাসাদে!”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ঢোক গিললো ইয়াসমিন, পালাতে চাইলো এই কামরা থেকে। কিন্তু আনাবিয়ার ঝলমলে দৃষ্টি পেরিয়ে হেটে বেরিয়ে যাওয়ার মতো সাহস ওর হলোনা। ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই, কাঁপা-কাঁপি লেগে গেলো ওর হঠাৎ! ভয়ে চোখের কোণে পানি জমলো মুহুর্তেই।
আনাবিয়া ওর দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই মেঝে থেকে উঠে দাড়ালো ধীর গতিতে। ওকে উঠতে দেখে ইয়াসমিনের গলা শুকিয়ে এলো, কথা বলতে গিয়েও আঁটকে গেলো গলায়, ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠতে লাগলো তিরতির করে৷।

আনাবিয়া একপা একপা করে ধীর গতিতে ইয়াসমিনের দিকে এগোতে এগোতে, নির্বিকার চোখে তাকিয়ে ধীর, শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
“আমাকে ভয় পাচ্ছিস কেন? ভয় পাওয়ার মতো কোনো কথা আমি বলেছি? নাকি আমি আঘাত করেছি তোকে? মেরেছি তোকে?”
ইয়াসমিন অসহায়, ভেজা চোখে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে এক পা এক পা করে পেছাতে পেছাতে তড়িতে মাথা নেড়ে না বোঝালো। আনাবিয়া এগোতে এগোতে চোখ মুখ শক্ত করে আগের মতোই স্থীর গলায় বলল,

“তবে তোতলাচ্ছিস কেন? কি লুকোচ্ছিস তোরা আমার থেকে? কাকে লুকোচ্ছিস? বল!
কাকে ধোঁকা দিতে চাস? যে তোদেরকে বুকে নিয়ে মায়ের মতো করে বড় করেছে তাকে?”
আনাবিয়ার এমন আচরণে ইয়াসমিন ভয়ে আতঙ্কে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তড়িতে মাথা নাড়ালো আবারও, পেছাতে পেছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো ওর পিঠ। আনাবিয়া চলে এলো ওর একদম কাছে, কঠিন দৃষ্টি ফেললো ইয়াসমিনের মুখের ওপর, দাঁতে দাঁত পিষে ধীর গতিতে হাত বাড়ালো ওর গলার উদ্দ্যেশ্যে!
কিন্তু ঠিক সেই মুহুর্তেই আনাবিয়ার কামরার দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো কোকো, ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে আনাবিয়াকে পেছন থেকে দুহাতে আকড়ে ধরে উত্তেজিত গলায় বলল,

“আম্মা! কি করতে চলেছেন আপনি?”
পরমুহূর্তেই ইয়াসমিনের উদ্দ্যেশ্যে দ্রুত স্বরে বলে উঠলো,
“ইয়াসমিন, এখনি বাইরে যাও!”
কোকোর বলতে দেরি ইয়াসমিনের যেতে দেরি হলোনা। আতঙ্কে ঢিপঢিপ করতে থাকা বুকের ওপর হাত চেপে ছুটে বেরিয়ে গেলো ও কামরা থেকে।
ইয়াসমিন ছুটে বেরিয়ে যেতেই ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ক্রোধে চিৎকার দিয়ে উঠে কোকোকে নিজের পেছন থেকে দুহাতের সাহায্যে এক ঝটকায় উঁচু করে তুলে ঘুরিয়ে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিলো আনাবিয়া। কোকো এক প্রকার উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়লো শক্ত মেঝেতে!
পিঠটা শব্দ করে মেঝেতে বাড়ি খেয়ে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো ওর, মাথার নিচটা কোনো রকমে দুহাতে আকড়ে নিয়ে আঘাত থেকে বাঁচালো ও।

পিঠের যন্ত্রণার তোপে কপাল কুচকে এলো কোকোর, শুয়ে শুয়েই বড় বড় দম ফেলতে লাগলো ও। মাথাটা ভীষণ ঘুরছে, শেহজাদী ওকে কিভাবে ঘুরিয়ে নিচে ফেলেছে ও জানেনা। কিন্তু ঘুর্ণিটা ভয়ানক! করোটির ভেতর থাকা মগজটাই যেন উল্টেপাল্টে গেছে৷
আনাবিয়া মেঝেতে পড়ে থাকা কোকোর দিকে জোর কদমে এগিয়ে গিয়ে রাগে, ক্ষোভে উন্মাদ হয়ে গিয়ে বজ্রকঠিন গলায় বলে উঠলো,
“আমার বলা প্রতিটি কথাই তো তিনি শুনেন, প্রতিটি পদক্ষেপই তাঁর জানা! আমার ওপর নজরদারি করার জন্যই তোদেরকে প্রাসাদে রেখে গেছেন তাইনা?
এত সতর্কতা আমাকে নিয়ে? এত গোপনীয়তা? আমার আড়ালে এত কিছু করছিস তোরা? আমাকে কি তোদের মানুষ মনে হয় না, হ্যাঁ?

আমার আড়ালে যদি সত্যিই আবার কিছু হয়ে থাকে তবে কাউকে ছেড়ে দেবোনা আমি, শেষ করে ফেলবো সবাইকে!”
বলে কোকো কে মেঝেতে রেখেই আনাবিয়া পরণের ঘরোয়া পোশাকেই বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। তারপর সোজা এগোলো প্রাসাদের এক্সিটের দিকে।

কিমালেবে যাওয়ার পানি পথ দিয়ে নিজের বাইকের ইঞ্জিনে দানবীয় গর্জন তুলে ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে আনাবিয়া। শরীরে নেই কোনো সেইফটি পোশাক, হেডগার্ডও পরেনি।
গায়ের পাতলা শার্টটার বুক খোলা, বাইকের গতির সাথে তাল মিলিয়ে বাতাসের তোপে শব্দ করে উড়ছে তার বুক খোলা শার্টের দুই প্রান্ত। ভেতরের ছাই রঙা স্লিভলেস ক্রপটপের সীমানা রেখায় উন্মুক্ত হয়ে আছে ওর মেদহীন সরু কোমরের কিয়দাংশ।
বেপরোয়া গতিতে বাতাসে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে ওর শ্বেতশুভ্র রেশমী চুল। টানেলের ভেতরের কৃত্রিম আলোর পরশে ঝিকিমিকি করছে ঘন কেশগুচ্ছ।
চোখে লেগে আছে ভয়ানক ক্রোধ, দাঁতে পিষে আছে দাঁত। চোয়াল দ্বয় শক্ত হয়ে জানান দিচ্ছে ওর ভেতরে বয়ে চলা দুর্দমনীয় ঝড়ের।

কিছুদূর যাওয়ার পরই হঠাৎ ক্ষিপ্রতার সাথে কমিয়ে ফেললো ও বাইকের গতি। চোখ জোড়া নিবদ্ধিত হলো সম্মুখে।
চিরচেনা কালো রঙা গাড়িটা রাস্তার মাঝে আনুভূমিক ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওর পথ আগলে, তারই গায়ে ঠেস দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ইস্পাত-দৃঢ় বলিষ্ঠ শরীরের অধিকারী দীর্ঘদেহী মীর।
গায়ের ফিনফিনা পাতলা শার্টটার বুকের বোতামগুলো খোলা, অনাবৃত হয়ে আছে পেশিবহুল বক্ষ আর উদর। হাত জোড়া বুকে বাধা। বাহুদ্বয় প্রশস্ত, মাংসপেশির চাপে স্ফিত, পাতলা শার্টের ওপর দিয়েই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে যেন ক্রমেই!
জ্বলন্ত অগ্নির লেলিহান শিখার ন্যায় উজ্জ্বল শাণিত চোখ জোড়ার শান্ত, নির্লিপ্ত চাহনি আঁটকে আছে আনাবিয়ার শুভ্র মুখের ওপর।

আনাবিয় ক্ষিপ্রবেগে ব্রেক কষলো বাইকে। ইঞ্জিন বন্ধ করে মীরের নির্লিপ্ত চাহনিতে সেও রাখলো নিজের ঝকমকে চোখের কঠিন দৃষ্টি। কিমালেবের পানিপথের টানেলের মাঝে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো দুজন, নিরবে!
দুজনের এই নিরব স্নায়বিক যুদ্ধে চারপাশের সব কিছু যেন থমকে গেলো আরও। পৃথিবী যেন এই মুহূর্তে ছোট্ট হয়ে গিয়ে এক করে ফেললো তাদেকে!

পাহাড়ের মতো ভারী ক্রোধের বহর নিয়ে আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো মীরের মুখপানে, হাত জোড়া তার মুষ্টিবদ্ধ, যেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে৷ যন্ত্রণা আর ক্ষোভ মিশ্রিত ঝলমলে চোখ জোড়া হয়ে আছে ভয়ানক। ভেতরে ভেতরে যেন কোনো ভীষণ উত্তাপে দগ্ধ হচ্ছে সে প্রতিনিয়ত!
মীরের নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শুধুই এক রাশ হতাশা, নিঃসঙ্গতা! কিছুই বলতে চায়না সে আর। এই মুহুর্তে তার মুখনিঃসৃত কোনো কথাই তার সম্মুখে দন্ডায়মান রোষে রক্তিম হওয়া নারীটিকে শান্ত করতে পারবেনা। উপরন্তু শব্দগুলো আরও গহীন করে ফেলবে তাদের দুরত্ব।

অদ্ভুত এক নীরবতায় ছেয়ে গেলো ওদের দুজনার ভেতরের স্বল্প দুরত্বটুকু, যেখানে হাজারো কথা চাপা পড়ে আছে, কিন্তু সামান্যতম শব্দও কেউ করছেনা! কিচ্ছুটি বলছে না কেউ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেজে চলেছে শব্দের ঝংকার।
দুঃসময়ের কিছু অংশ এসে দাঁড়িয়ে গেছে তাদের মাঝে। সেখানে আঁটকে আছে কিছু ভুল বোঝাবুঝি, কিছু অসমাপ্ত কথা, কিছু অভিযোগ, কিছু প্রেমময় বাক্য; যা হয়তো বলা হবেনা আর কখনো!
দু’জনের ভেতরকার এই অদৃশ্য কঠিন দেয়ালের আড়ালে অনবরত হয়ে চলেছে একটি দীর্ঘসময়ের দৃঢ়, পবিত্র সম্পর্কের অল্প-বিস্তর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, যার অস্ত্রের নিষ্ঠুর ঝনঝন শব্দ বেজে চলেছে তাদের হৃদয়ের গোপনতম স্থানে!
দীর্ঘক্ষণের এই নিরবতাকে ভেঙে গাড়ি থেকে পিঠ সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো মীর, তারপর বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে এলো বাইকের ওপর বসে থাকা আনবিয়ার দিকে।
বাইকের সুম্মুখে এসে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো সে, তারপর ভারী, গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

“এমন খোলামেলা হয়ে বাইরে বেরিয়েছো কোন সাহসে?”
প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে আনাবিয়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার বলল,
“গাড়িতে এসো, প্রাসাদে ফিরবে আমার সাথে৷”
“না।”
কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো আনাবিয়া। মীর কথা শেষ করে ঘুরে আবার চলে যেতে নিচ্ছিলো গাড়ির নিকট, আনাবিয়ার না’ শুনে থেমে গেলো আবার। ওকে থামতে দেখে আনাবিয়া কঠিন স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কিমালেবে বারবার আপনি কেন আসছেন? রোজ কি কাজ আপনার এখানে? দেখতে চাই আমি।”
মীর থমকে দাড়ালো, ঘাড় ঘুরিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে সে আনাবিয়ার প্রশ্নকে উপেক্ষা করে বলে উঠলো,
“বাইক থেকে নেমে গাড়িতে এসো।”
আনাবিয়া বাইক থেকে নামলো ঠিকই কিন্তু এগোলোনা সামনের দিকে। দু কদম বাড়িয়ে থেমে গিয়ে তার দিকে পেছন ফিরে গাড়ির দিকে এগোতে থাকা মীরকে প্রশ্ন করলো,
“কেন গিয়েছিলেন আপনি সেখানে? কার কাছে গেছিলেন?”
মীর যতটুকু গিয়েছিলো ততটুকু গিয়েই ঘুরে আবার ফিরে এলো আনাবিয়ার কাছে, সোজা হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শুধালো,

“সত্যি কথা শুনতে চাও?”
আনাবিয়া এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলোনা, দাঁতচেপে বড় বড় চোখজোড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া অশ্রুকণা গুলোকে থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে সে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে৷
মনে প্রাণে চাইলো ওর ধারণা যেন ভুল হয়, যেন মীর একবার বলে যে সে সাম্রাজ্যের কাজে গেছিলো, জায়ানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো তার! ওর চোখের পানি গুলো যেন গড়িয়ে আজ নিচে না পড়ে!
মীর অপেক্ষা করলোনা আনাবিয়ার উত্তরের, আরও এক কদম এগিয়ে এসে ছোটখাটো একটা শ্বাস ছেড়ে সে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,

“আমি বাবা হতে চলেছি, খুব দ্রুতই হয়তো আমার সন্তানটি পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করবে।”
মীরের কথাটা আনাবিয়ার কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্রই হৃৎপিণ্ডটা প্রচন্ড জোরে ধ্বক করে উঠলো একবার, পরক্ষণেই থমকে গেলো ওর পুরো পৃথিবী, ধীরে ধীরে এক আকাশ পরিমাণ শূন্যতা, নিঃস্তব্ধতা এসে গ্রাস করলো ওকে!
মীরের কথাটি বিশ্বাস করতে না চাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করলো ও। বুকের ভেতর কোথাও শুরু হলো একটা চাপা সুক্ষ্ম ব্যথা, মুহূর্তেই সেটা ছড়িয়ে পড়লো শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরায়!
কানে এখনও প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো মীরের মুখনিঃসৃত কথাটা —” আমি বাবা হতে চলেছি”— কিন্তু ওর মস্তিষ্ক যেন গ্রহণ করতেই চাইলোনা এই বার্তাটা, ফিরিয়ে দিতে চাইলো সমস্তটা দিয়ে!
এক অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও মীরের দিকে, হাসার চেষ্টা করলো একবার, যেন ভুল করে ভুল শুনে ফেলেছে ও। কিন্তু ওর হাসির চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই চোখ ভরে আসলো ওর, অধরজোড়া কেঁপে উঠলো তিরতির করে!

হাত-পা অবশ হয়ে এলো, যেন এই মুহুর্তে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাবে ওর, ও তলিয়ে যাবে গহীনে, অনেক অনেক গভীরে!
টানেলের অন্য প্রান্ত থেকে আসা এক দমকা বাতাস উড়িয়ে দিয়ে গেলো ওর চুল, কিন্তু কিচ্ছুটি অনুভব করলোনা আনাবিয়া। অনুভূতি শূন্য হয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে। বুকের ভেতরটা তীব্র আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে এক মুঠো ধুলির ন্যায় ছড়িয়ে গেলো যেন চারদিকে! বুক ভর্তি হলো অসাড়তা, হাহাকার আর তীব্র ব্যথাতে!
বলতে চাইলো কিছু, কিন্তু গলাটা আটকে আছে, এতটুকু শব্দও বের হতে চাইছে না— অথচ মনের মধ্যে ভীষণ ঝড়ে ধ্বংস হতে চলেছে সবকিছু!
তার এত বছরের জীবনে জন্মের পর থেকে মীরের বলা সমস্ত ভালোবাসা মেশানো কথা, সমস্ত প্রতিশ্রুতি, সমস্ত ঝড় তোলা আদর মুহুর্তেই ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে।

এই বিশ্বাসঘাতকতা, এই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতম বাস্তবতা একমুহূর্তে যেন গিলে খেতে চাইলো ওকে!
কিন্তু আনাবিয়ার চোখের সমস্ত শূন্যতা হঠাৎ করেই রূপ নিলো ভয়ানক ক্রোধে, জলছাপানো চোখে, দাঁতে দাঁত চেপে মীরের দিকে এগিয়ে এলো ও। ক্রোধে আগুন হওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে!
সে যার পৃথিবী ছিল, যার জন্য সে শ্বাস নিয়েছিল, যার প্রতিটা কথা ছিল তার বিশ্বাসের শেষ সীমানা— আজ সেই মানুষটাই তার সামনে অপরিচিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটে লেগে আছে ক্ষীণ অপরাধবোধের ছাপ, কিন্তু তবুও এক নির্লজ্জ নীরবতায় ছেয়ে আছে সে।

কিভাবে পারলো সে, কিভাবে আনাবিয়ার সাথে এমনটা করতে পারলো? কত অকপটেই না সে বলে দিলো যে সে বাবা হতে চলেছে! এত সহজ তার কাছে সবকিছু?
চোখ জ্বলে উঠলো আনাবিয়ার, অশ্রুভরা দৃষ্টিতে যন্ত্রণা, ঘৃণা, ক্ষোভ, ক্রোধ মিশিয়ে তাকালো ও মীরের দিকে।
আচমকাই ওর বুকের ভেতর জমে থাকা নিদারুণ কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতার দহন, সবকিছুই একত্রে এক ভয়ংকর বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়লো!
বুকের ভেতর ঘূর্ণিপাকানো যন্ত্রণা গুলো শব্দ হয়ে উঠতে না পারার ব্যার্থতায় অপ্রত্যাশিতভাবেই হাত হয়ে উঠে গেলো, আর তারপর… তারপর একটা তীব্র, ধারালো মুহূর্ত!
বাতাস কেটে ওর শক্ত হাতের থাবা গিয়ে আঘাত করলো মীরের বা গালে! এক শক্তিশালী, দুঃসহ শব্দ ছড়িয়ে পড়লো নিস্তব্ধ পরিবেশে—একটা চাবুকের ন্যায়, একটা বিদ্রোহের ন্যায়!

মীরের মুখখানা ওর সে শক্ত আঘাতে এক অণু পরিমাণও টললো না৷ কিন্তু মুহুর্তেই ওর চোখ জোড়ার এতক্ষণের শান্ত, নির্লিপ্ত দশা রূপ নিলো প্রলয়ঙ্কারী ক্রোধে।
আনাবিয়ার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে, হাতটা কাঁপছে থরথর করে। বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো ওর। এ সে কি করে ফেলেছে? কিভাবে করে ফেলেছে? কার গায়ে হাত তুলে ফেলেছে!
ক্রোধ, কান্না, যন্ত্রণা, ভয় সমস্ত মিলিয়ে ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপতে শুরু করলো ওর, কিন্তু পিছিয়ে এলোনা ও। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো!

মীর দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে চোখ বুজে নিলো মুহুর্তেই। ঠোঁট চেপে নিজের ভেতরের ভয়ঙ্করতম হিংস্র ক্রোধটাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করলো ও, আপ্রাণ চেষ্টা সত্বেও গলা থেকে বেরিয়ে এলো চাপা হিংস্র এক গর্জন!
ভড়কালো আনাবিয়া, ঢোক গিললো একটা। এক মনে বলল এই মুহুর্তেই এখান থেকে ছুটে পালাতে, অন্য জনে বলল যা হবে এখানে এই মুহুর্তেই হবে। মীরের হাতে যদি এই মুহুর্তে ওর মৃত্যুও হয় তবে তাই সই!
একটা ঝড়ো শ্বাস ফেলে চোখ মেলে তাকালো মীর, যেন শ্বাসটার মাধ্যমেই নিজের সমস্ত ক্রোধকে বাইরে বের করে দেওয়ার তীব্র চেষ্টা করলো ও।
কদম বাড়িয়ে আনাবিয়ার একেবারেই সম্মুখে চলে এলো ও, ওর ক্রোধে পরিপূর্ণ ঘন, ভারী নিঃশ্বাস এসে বাড়ি খেতে লাগলো আনাবিয়ার মুখের ওপর৷

কিছুক্ষণ কঠোর চোখে একদৃষ্টিতে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে ও বলে উঠলো,
“আজ যে দুঃসাহস দেখিয়েছো, দেখিয়েছো। দ্বিতীয়বার কখনো এমন দুঃসাহস দেখানোর পূর্বে হাজার বার ভেবে নিবে, নয়তো সেদিনটা তোমার একদমই ভালো যাবেনা আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান!”
কথা শেষ করেই আনাবিয়ার হাতের কব্জির ঊর্ধ্বাংশ ধরলো ও, তারপর টেনে নিয়ে চলল নিজের গাড়ির দিকে।
হাতে টান পড়ায় আনাবিয়া পিচঢালা রাস্তায় পা বাধিয়ে দিয়ে মীরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে তেজি গলায় বলে উঠলো,
“কোথাও যাবোনা আমি! যাবোনা আমি ওই প্রাসাদে, ওই জাহান্নামে আমি আর কখনোই ফিরবোনা!”
“তোমাকে যেতে হবে।”

আনাবিয়াকে টেনে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে শক্ত গলায় বলে উঠলো মীর। আনাবিয়া মীরের হাত থেকে নিজের হাতটা ঝটকা দিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ক্রোধিত গলায় বলল,
“আমি আর আপনার সাথে ফিরবোনা, আর না কখনো ওই প্রাসাদে যাবো! ডিভোর্স চাই আমার!
আপনি একটা কেন, হাজারটা দাসী নিয়ে থাকুন, আমার কিচ্ছু যাবে আসবেনা তখন! আমাকে মুক্তিদিন আপনি!”
“আমার থেকে তোমার কোনো মুক্তি নেই। আমি তোমার স্বামী, এই পঞ্চদ্বীপের বাদশাহ। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমাকে স্নেহ করি। তোমার গার্ডিয়ান আমি, আমার আদেশ মানতে তুমি বাধ্য। তোমার কথা মানতে আমি বাধ্য নই।”

এক হাতে আনাবিয়াকে ধরে রেখে অন্য হাতে গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে নির্বিকার, শক্ত গলায় বলে উঠলো মীর। মীরের কথায় ঝাঝিয়ে উঠলো আনাবিয়া, বলল,
“লজ্জা করেনা আপনার ‘ভালোবাসি’ বলতে? অন্য মেয়ের গর্ভে সন্তান রেখে এসে আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলছেন!
আমি আপনাকে স্বামী মানিনা, কেউ নন আপনি আমার, কেউ নেই আমার এই পৃথিবীতে!”
“সে সামান্য একজন দাসী, তার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। আমার সন্তানটাকে পেয়ে গেলে আর কখনো তার মুখদর্শন করবোনা আমি। সুতরাং শুধু শুধু এটা নিয়ে আমাকে চাপে ফেলে আমার মানসিক শান্তিটা নষ্ট কোরোনা! আমি যা করতে চাইছি করতে দাও, আমাকে কঠিন হতে বাধ্য কোরোনা।”

আনাবিয়াকে দুহাতে ধরে গাড়ির ভেতরের সিটে তুলে দিয়ে হাত বাড়িয়ে গাড়ির পেছনের সিটে ফেলে রাখা দীর্ঘ, মোটাসোটা লোহার শেকলটা নিয়ে আনাবিয়ার হাত জোড়া বেধে দিতে দিতে আগের মতো করেই বলল মীর।
আনাবিয়া বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলোনা আর, বুকফাটা আর্তনাদ ছাড়া ওর মুখে আর কিছুই এলোনা! উচ্চস্বরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ও। বেরিয়ে যেতে চাইলো গাড়ির ভেতর থেকে। মীর ওকে আবার ঠেলে ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে কঠিন স্বরে বলে উঠলো,

“শুধু হাত বেধেছি, বেশি লাফালাফি করলে হ্যোল বডি সুদ্ধ সিটের সাথে বেধে দেবো। চুপচাপ বসে থাকো।”
বলে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং দিটে এসে বসলো ও, তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়েই ঝড়ো গতিতে হাঁকিয়ে নিয়ে চলল প্রাসাদের দিকে।
ওদের গাড়িটা চোখের আড়াল হওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই পেছন পেছন অন্য একটা গাড়ি কিমালেবের রাস্তা হয়ে রওনা দিলো শিরো মিদোরির পথে!

প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের পাশে অবস্থিত প্রাসাদের গুরুত্বপূর্ণ এমপ্লয়িদের ফ্লোরের ইয়াসমিন আরমান দম্পতির কক্ষের ঠিক পাশেই একটা ছোটখাটো কামরায় কৃত্রিম আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
ইয়াসমিন এখন বিধবা, তার স্বামী আরমান কিছু বছর আগেই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন৷ এখন নিজের কামরায় সে একাই থাকে। কিন্তু আজ দুদিন হলো তার দায়িত্বের ফর্দে নতুন এক দায়িত্ব এসে জায়গা করে নিয়েছে। নিজের কামরার পাশের কামরায় আসা এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির দেখাশোনার ভার এসে পড়েছে তারই কাধে৷
শেহজাদীর কামরা থেকে ওইদিন বের হয়ে আসার পর থেকে সে আর যায়নি সেদিকে ভয়ে। সেদিন রাতেই অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে কিমালেব থেকে প্রাসাদে নিয়ে এসেছে লিও আর কাঞ্জি। এ খবর শেহজাদী জানেননা, জানানো কড়া বারণ!

মেয়েটিকে হিজ ম্যাজেস্টি দূরেই রেখেছিলেন, শেহজাদীর থেকে অনেক অনেক দূরে৷ তাকে শেহজাদীর অনুভূতির নাগালের বাইরে নিয়ে গেছিলেন যেন শেহজাদী কিচ্ছুটি টের না পান! কিন্তু তিনি কি টের পাননি? তাঁর যন্ত্রণা হয়েছে ঠিকই কিন্তু বুঝতে পারেননি তিনি! হিজ ম্যাজেস্টি কিমালেবে যাওয়ার রাতে ঘুম থেকে উঠে তিনি ইয়াসমিনকে বার বার করে বলছিলেন তার খুব পিপাসা লাগছে, গলা শুকিয়ে আসছে। অথচ পানিতেও তৃপ্তি পাচ্ছিলেননা তিনি। অথচ তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাননি যে তার আড়ালে, তার থেকে অনেক অনেক দূরে হয়ে চলেছে তার হৃদয় বিরুদ্ধ কাজ!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইতাসমিন। এই মেয়েটিকে দুদিন আগেই প্রাসাদে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রসবের সময় যতই এগিয়ে আসছে ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে মেয়েটা।

তাই দেমিয়ান প্রাসাদের উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হিজ ম্যাজেস্টির আদেশেই তাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। রোজ হেকিক এসে দেখে যাচ্ছেন তাকে, খুব গোপনে!
হিজ ম্যাজেস্টি বর্তমানে মেয়েটির সমস্ত দায়িত্ব ইয়াসমিনের কাধে তুলে দিয়েছেন, বলে গেছেন আপাতত শেহজাদীর সেবায় না যেতে, অন্য কাউকে ইয়াসমিনের স্থানে দিবেন তিনি।
ইয়াসমিনের মনটা ভালো নেই। এতগুলো বছর সে শুধু শেহজাদীর কাছেই পড়ে থেকেছে। কতইনা ভালোবাসতেন তিনি ওকে! কত আদর, কত যত্নই না করতেন!
একটা ঝড় মানুষের জীবনের কতখানিই না বদলে দেয়।

মেঝের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ইয়াসমিন।
ওকে এভাবে শ্বাস ছাড়তে দেখে স্ফিত উদর নিয়ে, কোমরে হাত বেধে ঘরময় হাটাহাটি করতে থাকা মেয়েটি থেমে দাঁড়ালো। গর্ভের অত্যন্ত শক্তিশালী সন্তানটির কারণে হাটাচলা খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে তার জন্য, অথচ প্রসবের এখনো দুমাস!
ইয়াসমিনের দিকে এগিয়ে এসে সে রিনরিনে কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়েছে তোমার ইয়াসমিন? কি এত ভাবছো?”
মেয়েটির প্রশ্নে মেঝে থেকে চোখ তুলে তাকালো ইয়াসমিন, বড়বড় নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে ইয়াসমিনের দিকে উত্তরের আশায়৷
ইয়াসমিন হতাশ হয়ে উত্তর করলো,
“আমাদের বেগমের কথা ভাবছি সিয়ারা, আমি ছাড়া অন্য কোনো দাসীর হাত থেকে তিনি খাবার খান না কখনো। সারাদিনে কি খেয়েছেন, কি করছেন এই চিন্তাই হচ্ছে শুধু!”
বেগম নামটি শুনতেই সিয়ারা মেয়েটার মুখের হাসি ক্ষীণ হয়ে এলো। যে শ্রদ্ধেয় মানুষটির সন্তান সে পেটে বয়ে বেড়াচ্ছে বেগম তাঁরই স্ত্রী, বিবাহিতা স্ত্রী!

সে বাদশাহর সন্তানের মা হওয়ার পর তার অবস্থানও কি বেগমের পর্যায়ে হবে না? সেও কি এমন সম্মান পাবেনা? তারও দাসী থাকবে, ইয়াসমিনের মতো। সেও পাবে একটি আভিজাত্যপূর্ণ বিলাসবহুল জীবন!
তার স্থানও কি রয়্যাল ফ্লোরে হবে? সেও কি হিজ ম্যাজেস্টির কামরার আশেপাশে থাকতে পারবে শেহজাদীর মতো?
কেন পারবেনা? সেও তো বেগম, বরং তার সম্মান শেহজাদীর থেকেও বেশি হবে, সে যে হবে ভবিষ্যৎ বাদশাহর জননী!
ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে এসবই ভেবে নিয়ে গর্বিত হলো সিয়ারা। ধীরে ধীরে এসে বসলো বিছানায় তারপর পাশেই মেঝেতে হাটুর ওপর থুতনি ঠেকিয়ে বসে থাকা ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে শুধালো,

“উনি কি সত্যিই অনেক সুন্দরী ইয়াসমিন?
ইয়াসমিন মুখ না তুলেই বলে উঠলো,
“যদি কখনো তোমার তাকে দেখার সৌভাগ্য হয় তবে তুমি বলতে বাধ্য হবে এমন সুন্দরী কাউকে তুমি এর আগে কখনোই দেখোনি!”
ইয়াসমিনের কথায় বুকে জ্বলন হলো সিয়ারার!

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৭+৩৮

হিজ ম্যাজেস্টিকে সে কাছে পেয়েছে, খুব কাছে। মুগ্ধ হয়েছে ও প্রতি ক্ষণে ক্ষণে! এমন সুদর্শন, ক্ষমতাবান, ব্যাক্তিত্ববান, ইস্পাত-দৃঢ় শরীরের প্রভাবশালী কাউকে ভালো না বেসে কিভাবে থাকা যায়? সে তো মনে প্রাণে চায় ওই পরম শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিকে, আরও হাজারটা রাত কাটাতে চায় তাঁর সাথে!
কিন্তু প্রতিপক্ষ এমন ঝলসানো সুন্দরী হলে সেটা কেমন করে হবে? কিভাবে জিতবে সে?
হতাশ চোখে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা……

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শেষ পর্ব 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here