আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১
নাবিলা ইষ্ক
বসার ঘরে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। রোযা বসেছিলো কাজল বেগম আর জয়নাল সাহেবের মাঝখানে। সোফার বিপরীত দিকে বসেছিলো জিহাদ। এবেলায় দাঁড়িয়ে পড়েছে রাগে। বড়ো করে শ্বাস টেনে নিলো রোযা। সবার সামনে শান্ত গলায় বললো –
‘আমি কাজটা ছাড়বো না।’
জিহাদ হিসহিসিয়ে উঠলো, ‘ছাড়বে না?’
রোযা মাথা নুইয়ে রেখেছিলো। এবারে সরাসরি তাকিয়ে বললো –
‘পারবো না।’
‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও।’
কাজল বেগম আঁতকে উঠলেন, ‘রাগের মাথায় কীসব বলছিস, বাবা? মাথা ঠিক আছে? দুজন একান্তে আলোচনা করে মিটিয়ে নে।’
জিহাদ রাগে চিৎকার করে ওঠে –
‘ওর কাছে আমার কথার, আমার কি কোনো দাম আছে, মা? নেই তো। আমি তো বলেছি ও অন্য যেকোনো চাকরি করুক আমার আপত্তি নেই। শুধু ওইখানে ও আর চাকরি করতে পারবে না। এতটুকু কি বেশি চেয়ে ফেলেছি?’
রোযা উঠে দাঁড়িয়েছে। নিপা বেগম দ্রুতো এগিয়ে এলেন। মেয়ের হাত ছুঁয়ে কিছু একটা বলতে চাইলেন। রোযা সেই সময়টুকু দেয় না। থমথমে মুখে প্রশ্ন করে –
‘আমি ওখানে কেনো চাকরি নিয়েছিলাম, জিহাদ? ওমন এক বাঘের গুহায় আমি কাঁপতে কাঁপতে কেনো যেতাম?’
জিহাদ মুহূর্তে নরম হয়ে এলো। আগেকার বিষন্ন দিনগুলোর কথা ভেবে রাগ নিভে গেলো। রোযার হাত দুটো ধরতে চেয়ে বললো –
‘প্রয়োজনে। তখন আংকেল ক্যান্সারের পেশেন্ট ছিলেন। অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন ছিলো। এখন তো আর প্রয়োজন নেই, তাই না? বাড়ি-গাড়ি সবই তো হয়েছে। আংকেলও দিব্যি সুস্থ। তাহলে এখনো কেনো ওখানে কাজ করতে হবে! এবারে রিজাইন করে নাও। বিয়ের পর তুমি যেখানে ইচ্ছে চাকরি নিও।’
রোযা দু-পা পেছনে চলে এসেছে। চোখমুখ অনুভূতি শূন্য প্রায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘হৃদি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’
জিহাদের হৃদয় যেন কেউ খামচে ধরলো। রাগ মাথায় চড়তে চাইলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখাই দুষ্কর হয়ে এলো। কোনোরকমে দাঁতে দাঁত পিষে প্রশ্ন করলো –
‘তুমি কি ওর মা?’
রোযার ঠোঁট কাঁপলো অপমানে। নাকের পাটা দুটো ফুলে উঠলো। আজিজুল সাহেব চুপচাপ বসেছিলেন। এযাত্রায় মিহি গলায় বললেন –
‘মা না হলেও মায়ের আদরেই তো পেলেছে? বাচ্চাটার বয়স ছিলো মাত্র তিন বছর। এখন প্রায় সাত। এতগুলো বছর ধরে নিজ দু-হাতে যত্ন করেছে। মায়া হয়ে গিয়েছে না? তুমি এভাবে কথা বলে কেনো কষ্ট দিচ্ছো আমার মেয়েটাকে? সুন্দর ভাবে যদি কথাই না বলতে পারো তবে আর তোমাকে আমি কোন সাহসে মেয়ে দেবো?’
জিহাদ ফিরে তাকালো আজিজুল সাহেবের দিকে। রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো –
‘আংকেল, আপনার আমার দিকটাও তো দেখা প্রয়োজন? আমি পছন্দ করছি না বিষয়টা। একসময় টাকার প্রয়োজন ছিলো তাই আমি কিছু বলিনি আমার পছন্দ না হলেও। কিন্তু এখন? এখনো কেনো? ওর তো দায়বদ্ধতা নেই। আজ বাদে কাল তো ছাড়তেই হবে। দিনশেষে আপনি যেভাবেই দেখুন না কেনো, ও ওই বাড়ির একজন কাজের লোক। ওর দায়িত্ব যা ছিলো তাই করেছে। ও না গেলে ওই বাচ্চার জীবনে বিন্দুমাত্র ডিফারেন্স আসবে না। রাজ্যের অনৈতিক, বে-আইনি কাজকর্ম করে টাকার পাহাড় বানিয়ে রেখেছে ওই লোক। মেয়ের জন্য চার-পাঁচেক কেনো দশ-পনেরো ন্যানি রাখার মতো অ্যাবিলিটি আছে।’
জিহাদের কণ্ঠ দৃঢ় হলো, ‘উল্টো ওদের সাথে আরও জড়ালে পুরো বংশের ভোগান্তি আছে। মানুষ না-হয় ভয়ে স্বীকার করে না। কিন্তু কে না জানে ওই লোক দেশের সবচেয়ে বড়ো সন্ত্রাস! কোন অপকর্ম করা বাদ রেখেছে? এখনো সময় আছে ওকে বলুন সরে আসতে।’
আজিজুল সাহেবও এবারে নিশ্চুপ হয়ে এলেন। তারও যে ভয় হয়। তাকালেন মেয়ের জেদি মুখের দিকে। রোযা তখনো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিহাদ নিজেকে শান্ত করতে চেয়ে দু-পা এগিয়ে বলতে নেয় –
‘রোযা, লিসেন টু…’
রোযা আর একমুহূর্ত দাঁড়ালো না। জিহাদকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে চলে এলো। সোজা নিজের ঘরে এসে দরজা লক করে রাখলো। তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। জিহাদের কথাগুলো তাকে বাজেভাবে কষ্ট দিয়েছে। কষ্টের চেয়েও বেশি তার ভয় হচ্ছে। হৃদিকে যে সে খুব ভালোবেসে। একদিন দেখতে না পারলে কী ভীষণ যন্ত্রণা হয়! সেখানে কীভাবে কাজ ছাড়ার কথা ভাববে সে? বিছানার সাইড টেবিলটার ওপরের ল্যাম্পশেডের পাশেই দুটো ছবির ফ্রেম রাখা। একটাতে বাবা-মা, রোযা আর তার ছোটো ভাই রাজু। আরেকটা ফ্রেমে রোযা আর ছোটো হৃদি। সুবিশাল উজ্জ্বল রুমের গোল বিছানায় বসে আছে রোযা। হৃদি ঠিক রোযার কোলে বসেছে। ওর বয়সটা তখন সবে পাঁচ। পুতুলের মতন দেখতে মেয়েটার হাতে আরেককটা গোলাপি রঙের পুতুল। কাঁধ সমান কোকড়া চুলে দুটো ঝুটি করে রাখা। মিষ্টি করে হাসছে রোযার দিকে চেয়ে। ছবিটা দেখে রোযার দমবন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। সে কল্পনাই করতে পারে না কাজটা ছাড়ার কথা। কাজ ছেড়ে দিলে তো আর কখনো হৃদিকে দেখতে পারবে না৷ সম্ভবই না। তাহলে কীভাবে সে পারবে? কেনো বুঝতে চাচ্ছে না জিহাদ?
‘রোযা, মা আমার! দরজাটা খোল।’
আজিজুল সাহেবের ডাকে দরজা খুলে দিলো রোযা। ফের এসে বসলো বিছানার ওপর। রুমে ঢুকতেই আজিজুল সাহেবের চোখ চলে গেলো সাইড টেবিলটার দিকে। মুহূর্তে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এসে বসলেন মেয়ের পাশে। মাথায় হাত রাখলেন। দীর্ঘসময় নীরব থেকে অবশেষে বললেন –
‘জিহাদ কিন্তু একেবারে ভুল বলছে না, মা। আর কতো?’
রোযার চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো অবশেষে। ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো –
‘কাজটা ছাড়তে পারবো না, বাবা৷ হৃদি এখনো ছোটো। আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আমি ছাড়া আর কারো কাছে যেতে চায় না। আরও অনেকেই তো আছে ওকে টেককেয়ার করার জন্য। কাউকে পছন্দ করে না। ওর সব আমি নিজ হাতে সামলাই। কীভাবে চলে আসবো বাবা? আর যদি কাজটা ছেড়ে চলে আসি —কখনোই ওকে আর দেখতে পারবো না। ওই বাড়িতে ঢোকার বা হৃদির আশেপাশে যাবার সুযোগ আর পাওয়া সম্ভব না।’
আজিজুল সাহেব নীরব হয়ে গেলেন। চব্বিশঘণ্টা বডিগার্ড দিয়ে হেফাজতে রাখা অমন বড়লোক বাড়ির মেয়েকে কাজ ছেড়ে দিলে কীভাবে দেখা সম্ভব? তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। কী বলবেন বুঝে পেলেন না! বাচ্চাটাকে তারা কখনো সামনাসামনি দেখেননি। রোযার মুখে শুনে আর ফোনে দেখেই কেমন মায়া করে বসে আছেন। সেখানে রোযা কতগুলো বছর ধরে মেয়েটাকে দু-হাতে যত্ন করে লালনপালন করেছে! একটু হলেও মেয়ের অনুভূতি তিনি বুঝতে পারছেন।
‘জিহাদকে আমি বোঝাবো। তবে তুমি তর্ক করে ওর সাথে আর ঝগড়া করো না, মা। বয়স তো কম হলো না। বিয়েশাদি তো করতে হবে তাই না?’
রোযা মাথা দোলালো। চিন্তিতও হলো। দেখতে দেখতে কেমন ঊনত্রিশে পা দিয়ে ফেললো। আর এক বছর মাত্র! এরপর ত্রিশ! এসময়ে দরজার কাছ থেকে রাজু চাপা গলায় আওড়ালো –
‘জানো না, কুড়িতেই বুড়ি? সেখানে তোমার ত্রিশ হবে আপু। ভাবো তুমি কোন পর্যায়ের বুড়ি হয়ে আছো। আস্তাগফিরুল্লাহ!’
রোযার মেজাজটা খারাপ হলো। মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো ছেলেটার পিঠে চারটা থাপ্পড় বসানোর জন্য। রাজু ওখানে মার খাওয়ার জন্য মোটেও দাঁড়িয়ে নেই। পাশের রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিয়েছে।
বারিধারার এই নিরিবিলি এরিয়া জুড়ে গড়ে ওঠা অট্টালিকার মতো বিলাসবহুল বাড়িটা, ভদ্রসমাজে শিল্পপতি আদিল মির্জার নামে পরিচিত হলেও আন্ডারওয়ার্ল্ডে টাইগার্স ডেন নামে পরিচিত। বডিগার্ড, সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে কড়া সুরক্ষায় রাখা এই বাড়িতে প্রবেশের পথেই বহু বাঁধা। রোযাদের গাড়িটা চারবার থেমেছে। চার ধাপে চেকিং করা হয়েছে। রোযা এতে অভ্যস্ত। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই সে সারা রাস্তা জুড়ে ঘুমিয়েছে। প্রত্যেকদিন তাকে নিতে এবং বাসায় পৌঁছে দিতে এই গাড়িটাই আসে। প্রত্যেকদিনের মতো ড্রাইভার চাচার পাশের সিটে ধ্রুব বসে আছে৷ হৃদির পার্সোনাল বডিগার্ড। যেমন শরীর, তেমন উচ্চতা। লোকটার মাথাটা মনে হচ্ছে গাড়ির সিলিং ছুঁবে আরেকটু হলেই। এতো লম্বা মানুষ হয়?
রোযার ঘুম ছুটেছে। সে হাতে গাল ঠেকিয়ে বাইরে তাকালো। সরু রাস্তার দু-পাশে ঘন করে গাছপালা উঠেছে। গাছ গুলো ভিন্নপ্রজাতির। কেমন ট্রিম করে একইরকম শেপে রাখা। প্রতিদিন দেখেও তার দেখবার সাধ মেটে না। সবকিছু একদম কল্পনার মতো সুন্দর। রোযা যখন গাড়ি থেকে নেমে বিশাল বাড়ির দুয়ার পেরুলো তখন লিভিং রুমের দেয়াল ঘড়িটা আওয়াজ করলো ঘড়ির কাঁটা ছটায় ঘুরছে বলে। মরিয়ম বেগম সহ বাকিরা মোছামুছির কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছেন। বেশ সাবধানে চকচকে কালো কাঁচের সিঁড়ি মুছছিলেন মরিয়ম বেগম। রোযা কাছাকাছি এসে আস্তে করে বললো –
‘গুডমর্নিং, আন্টি।’
মরিয়ম বেগমের জবাব আরও ধীর শোনালো। রোযা সোজা ওপরে চলে এলো। আশেপাশে কোথাও সে তাকালো না। এই বাড়িতে কয়েক বছর ধরে চাকরি করতে পেরেছে এমনি এমনি না! অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, যা খুব সুন্দরভাবে মান্য করে এসেছে রোযা। তাইতো আজ পর্যন্ত সে পুরো বাড়িটা পর্যন্ত দেখেনি৷ প্রয়োজনের তাগিদে যতটুকু পর্যন্ত যেতে হয়, ওতটুকুই। কথায় আছে, কিউরিওসিটি ক্যান ইট ইউ এলাইভ। রোযা তাই মানে। সে কোনো কিছুতেই আগ্রহ দেখায়নি, কিছু জানার চেষ্টাও করেনি হৃদি ব্যতীত। হৃদির রুমটা একেবারে শেষ মাথায়৷ ওর রুমে সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। রোযা যতটুকু জানে পুরো বাড়িতেই সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো। সেসব মনিটরিং করা হয়, তারও আলাদা রুম আছে। ওটাকে মনে হয় কন্ট্রোল রুম বলে!
হৃদির পুরো নাম, আমিরা মির্জা হৃদি। আদর করে, ছোটো করে রোযা হৃদও ডাকে। শুধু হৃদ নয় মাঝেমধ্যে প্রিন্সেসও ডাকে। মেয়েটা ডিজনিল্যান্ডের ওপর অবসেসড। পুরো রুম জুড়ে ডিজনিল্যান্ডের অধিপত্য। গতবছর ফ্রান্সের ডিজনিল্যান্ড – Marne-la-Vallée থেকেও ঘুরে এসেছে। এবছরও যাওয়ার জন্য বায়না শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। কাঁধ ব্যাগটা একপাশে রেখে রোযা বিছানার কাছে গেলো। বসলো ঘুমন্ত হৃদির পাশে। কী মিষ্টি একটা মুখ! কী সুন্দর দেখতে! রোযা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মাথাটা। রাতে বিনুনি করে দিয়ে গিয়েছিলো। মাথাটা নুইয়ে ছোটো করে ডাকলো –
‘মাই প্রিন্সেস, ইউ হ্যাভ টু ওয়েক আপ।’
হৃদি ভীষণ লাইট স্লিপার। এক ডাকেই বড়ো বড়ো চোখ দুটো মেলে তাকালো, গোঙাল। দু-হাত বাড়িয়ে দিলো মুহূর্তে। রোযা ওকে কোলে তুলে নিলো। তার কোলে বসাতেই মেয়েটা রোযার বুকে মিশে গেলো কেমন। দু-হাতে গলা জড়িয়ে আবারো চোখ বুজে নিলো। রোযা ওকে কোলে নিয়েই এগুলো ওয়াশরুমের দিকে। ওকে ফ্রেশ করিয়ে, ব্রেকফাস্ট করাতে হবে। এরপর রেডি করে বেরুতে হবে স্কুলের উদ্দেশ্যে।
মরিয়ম বেগম ব্রেকফাস্টের ট্রলি ঠেলে যখন ঢুকলেন ততক্ষণে হৃদিকে ফ্রেশ করিয়ে স্কুল ড্রেস পরিয়ে দিয়েছে রোযা৷ ওর স্কুলের ড্রেসকোড হচ্ছে, সাদা রঙের শর্ট স্কার্টের সাথে কালো রঙের শার্ট—সাদা রঙের টাই, সাদা মোজার সাথে কালো জুতো। কোকড়া চুলগুলোতে সুন্দর একটা হেয়ারস্টাইল করে দিয়েছে। হৃদির স্কুল ব্যাগটা গতকাল রাতেই গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলো রোযা৷ হৃদি এমুহূর্তে বেঁকে বসলো –
‘আই ডোন্ট ওয়ানা ইট।’
রোযা শান্ত। এক হাতে স্যুপের বাটিটা নিয়ে অন্য হাতে হৃদিকে জড়িয়ে নিয়ে প্রশ্ন করে –
‘কেনো না? কী হয়েছে? খারাপ লাগছে?’
‘স্নো হোয়াইট, ওন্ট ইউ গো উইদ মি টু সি ডিজনিল্যান্ড?’
রোযা অসহায়! গত বছরও মেয়েটা এমন করেছে মাসখানেক ধরে। রোযা যায়নি। এবছরও শুরু করেছে।
‘পরে ভাববো। আপাতত খেতে হবে। তুমি খেলে আমি ভেবে দেখবো।’
হৃদি দ্রুতো সরল গলায় বললো –
‘তাহলে আমি খাবো।’
‘মাই গুড গার্ল।’
রোযা সবসময়ই আপনমনে ভেবে এসেছে এতো বডিগার্ডের কী প্রয়োজন? এইযে সাধারণ একটা ব্যাপার — হৃদিকে স্কুল নিয়ে যাবে মাত্র, এখানেও এতো সিকিউরিটির কী প্রয়োজন? তিন তিনটা বডিগার্ডের কী কোনো দরকার আছে? কী দরকার এতো ঝামেলার? এতো লোকজনের? তার চার বছরের প্রশ্নের জবাব যেনো আজকে মিললো! ভয়ানক ভাবে। এই সিকিউরিটিও যে বেশ কম তা সে হারে হারে টের পেলো। জ্যাম মুক্ত মেইনরোড ছিলো। গাড়িটাড়ি রাস্তায় তেমন একটা ছিলো না। হঠাৎ করে নয়-দশটা ভিন্ন মডেলের গাড়ি একত্রে তাদের গাড়ি দুটোকে ঘেরাও করে ফেললো। দুর্দান্ত ফাস্ট। রোযা চোখের পলক ফেলতেই তাদের গাড়িটা ঝাকিয়ে উঠলো। গাড়িতে গাড়ি ঘর্ষণের তীব্র শব্দে ভয়ংকর ভাবে কাঁপিয়ে তুলল তার শরীর। মস্তিষ্ক কাজ করার আগেই রোযার শরীর কাজ করলো। সে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো পাশের তুলোর মতন নরম শরীরের হৃদিকে। মেয়েটা আতঙ্কে এইটুকুন হয়ে গেছে। থরথর করে কাঁপছে। এযাত্রায় শব্দ করে কেঁদে ফেললো। রোযা ওকে বুকে মিশিয়ে শান্ত করতে চাইলো।
তাদের গাড়িতে প্রতিদিনের মতন ধ্রুব ড্রাইভারের পাশেই বসাছিলো। এযাত্রায় বিদ্যুৎ বেগে ড্রাইভারকে সরিয়ে নিজে বসলো ড্রাইভ করতে। চলন্ত গাড়ি নিজ আয়ত্তে নিয়ে টানা সামনে এগুচ্ছে। হাইয়েস্ট স্পিড। কানের ব্লুটুথ দিয়ে সে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করে যাচ্ছে। গাড়িতে গাড়ি ঘর্ষণের শব্দ, ভাংচুরের মতন শোনাচ্ছে। তাদের এই গাড়িতে চতুর্দিক দিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে। একপর্যায়ে রোযার পাশের জানালার কাঁচে আঘাত করা হলো। কাঁচটা বোধহয় সামান্য ফাটলো। টানা অনেকবারের আঘাতে জানালার কাঁচ ভেঙে সিটে পড়লো। রোযা আরও গাঢ়ভাবে আগলে নিলো হৃদিকে। দ্রুতো বুকের ভেতর নিয়ে সিট ছেড়ে নিচে হামাগুড়ি দিয়ে বসলো। বাচ্চাটার মাথা শক্ত করে নিজের বুকে লুকিয়ে, দু-কান চেপে ধরে রাখলো। ধ্রুব একপলক পেছনটা দেখে নিয়ে এবারে দিকবিদিকশুন্য হয়ে একেকটা বাঁকা টার্ন নিতে লাগলো আক্রমণ থেকে বাঁচতে। ড্রাইভার চাচা ইতোমধ্যে কল করেছেন— আদিল মির্জাকে। আক্রমণের কথা এক্ষণ না জানালে বড্ড দেরি হয়ে যাবে যে!
সামনে দিয়েও একটা গাড়ি পালাক্রমে আক্রমণ করে যাচ্ছে। ধ্রুব এরপরও হাই স্পিডে গাড়ি টানছে। চোখমুখ শক্ত তবে শান্ত। অনড়ভাবে চতুর্দিকে নজর রেখেছিল। এযাত্রায় খুব সাবধানে এক হাতে হুইল কন্ট্রোলে রেখে, জানালার কাঁচ অল্প নামিয়ে অন্যহাতে পিস্তলটা বের করে মুহূর্তে গুলি করে। দু দুটো, সামনের গাড়ির দু টায়ারেই। সামনের গাড়িটা ব্রেইকফেইল করায়— ওটা পাশ কাটিয়ে ধ্রুব হাইস্পিডে এগোয়। রোযা দেখছিলো ড্রাইভার চাচা আর ধ্রুবের মিলেমিশে করা একেকটি কাণ্ড। কেমন চতুরতার সাথে এতোগুলো গাড়ির সাথে কীভাবে একা লড়ছিলো! হঠাৎ করে দুটো গাড়ি ধেয়ে এসে আক্রমণ চালালে তাদের গাড়িটা প্রায় উল্টে যেতে নেয়। ধ্রুব দ্রুততার সাথে পালানোর পথ খুঁজে চলেছে তখনো। কিন্তু কোনোভাবেই গাড়িগুলোর পিছু ছাড়ানো যাচ্ছে না। যেন তৈয়ারি হয়ে এসেছে! রোযা তাকালো তার বুকে মিশে থাকা ফুটফুটে মুখটার দিকে। এতটুকু মেয়েকে কোন পাষাণ মা রতে চায়? ওরা কি মানুষ?
গাড়ির টায়ারে টানা দু-তিনটে গুলি লাগতেই গাড়িটা ঝাকিয়ে সামনের বড়ো গাছটায় বাড়ি খেয়ে থমকে যায়। ধোয়ায় ভরে যায় ভেতরটা। ধ্রুবের মাথা গলিয়ে র ক্ত বেরুচ্ছে। সে দ্রুতো বলে –
‘রোযা, ভয় পাবেন না। গাড়িতেই থাকুন। নাামবেন না। বস চলে আসবে। প–প্রিন্সেসকে আগলে রাখুন।’
ধ্রুব দুর্বল ভাবে পিস্তল সহ বেরুলো। সম্ভবত জ্ঞান হা রাবে। রোযা ডাকতে চাইলো কিন্তু পারলো না। ভয়ে তার আত্মা সহ শরীর কাঁপছে। জানালার ভাঙা কাঁচ পুনরায় ভেঙে দরজা খোলার জন্য কেউ কসরত করে চলেছে। সমানে কিছু গু লির আওয়াজ শোনা গেলো। খুলে গেলো রোযার পাশের জানালা দরজা। রোযা আর দেরি করে না। হৃদির দিকের জানালার দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। সাত-আটজন লোক ঘিরে আছে সামনে। ধ্রুপ সামনেই পড়ে আছে। চোখমুখে র ক্ত। সম্ভবত পায়ে গু লি লেগেছে। ভরভর করে র ক্ত বেরুচ্ছে। ড্রাইভার চাচাকে মা রা হয়েছে। ভদ্রলোক ওঠার চেষ্টা করছে। রোযা হৃদিকে নিজের পেছনে লুকোয়। একজন চ্যাঁচায় –
‘প্রাণে বাঁচতে চাইলে সরে দাঁড়া। বাচ্চাকে দে।’
রোযার ভেতরটা ভয়ে কাঁপছিলো। তবে নিজের জন্য নয়। হৃদির জন্য। সে আড়চোখে তাকালো পাশে। ধ্রুবের পিস্তলটা পড়ে আছে। মুহূর্তে তুলে নিলো হাতে। একহাতে হৃদিকে নিজের পেছনে জড়িয়ে রেখে অন্যহাতে পিস্তল সামনে তাঁক করে রাখলো। মনেপ্রাণে শপথও করলো, কেউ এগিয়ে এসে হৃদিকে নিতে চাইলে রোযা গু লি করে ফেলবে। এতগুলো মানুষের সামনে সে কাঁপে না, ভয়ে সিঁটিয়ে যায় না। চোখে চোখ রেখে ট্রিগার প্রেস করে। ওভাবেই ধীরে ধীরে পেছনে যেতে থাকে হৃদিকে নিয়ে। বারবার করে বলে –
‘কাছে আসার চেষ্টাও নয়…ওর আই’ল স্যুট।’
তখন বাচ্চা চাওয়া ওই কালো লোকটাই হঠাৎ করে ছুটে আসতে চাইলোরোযার দিকে। রোযা সচেতন হয়। ঢোক গিলে চোখ বুজে ট্রিগার প্রেস করে ফেললো। এক গু লি যেন সাহস এনো দিলো। পরপর পায়ের কাছে টানা কিছু গু লি করলে একটা লেগে যায় লোকটার পায়ে। ককিয়ে উঠে লোকটা পা ভেঙে বসে পড়ে। রোযা সমানে পেছোয়। ওসময়ে সে দেখলো একসাথে অনেকগুলো কালো গাড়ি হাইস্পিডে ধেয়ে আসছে। কারা এরা? ওদের আরও লোক না তো? গাড়িগুলো এসে থামলে উপস্থিত সবগুলো লোক জড়সড় হয়ে যায়। রোযার ওদিকে নজর নেই, সে নির্ভীক হয়ে উচ্চস্বরে বললো –
‘ডোন্ট মুভ অর এলস আই’ল কিল ইউ অল।’
আদিল তখন গাড়ি থেকে ঝড়ের বেগে কেবলই নেমে দাঁড়িয়েছে। তার লোকেরা ইতোমধ্যে সবগুলো আক্রমণকারীকে আন্ডার কন্ট্রোল করতে নেমে পড়েছে। অথচ আদিল স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে অদূরের নারীর দিকে। যে দৃঢ়ভাবে, অনড় রূপে দাঁড়িয়ে আছে তার মেয়েকে আগলে নিয়ে। যার হাতে পিস্তল… তাঁক করা, যার চোখে, কণ্ঠে আগুন আর রূপেও…..
