আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ২

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ২
নাবিলা ইষ্ক

রক্তাক্ত ধ্রুবকে একজন বডিগার্ড কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার চাচা কোনোরকমে ভাঙা পা নিয়ে উঠতে উঠতে বললেন –
‘ম…মিস রোযা, দে আর উইদ আস। কাম ডাউন। কাম ডাউন, মাই চাইল্ড।’
রোযা কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছিল না। তাঁক করা পিস্তলটা নামাতেও তার সময়ের প্রয়োজন পড়ল। তার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। তার ডান পা-টা ছোটো দু-হাতে পেছন দিয়ে জড়িয়ে চোখদুটো শক্ত করে বুজে ছিল হৃদি। থরথর করে কাঁপছিল। ফোঁপাচ্ছিল নীরবে। হঠাৎ মিষ্টি এমন নিস্তব্ধতা উপলব্ধি করে তাকাল। অদূরে দাঁড়ানো স্তম্ভিত শরীরের মানুষটাকে দেখতে পেয়েই শব্দ করে কেঁদে উঠল –

‘ড্যাডি…ড্যাড।’
আদিল মির্জা! হৃদির বাবা! রোযার হাত কাঁপে সামান্য। হাত থেকে ফসকে পড়তে চায় পিস্তলটা। ভয়ে আত্মাটা যেমন এইটুকুন হয়েছিল, তেমনি শ্বাস গলায় আটকে ছিলো। এবারে বড়ো করে শ্বাস ফেলল। তারা এখন বিপদ মুক্ত এতটুকু ভাবনাই যথেষ্ট ছিল শান্ত হওয়ার জন্য। নিজেকে শান্ত করল। পরপর নজরে এলো ওই কালো পোশাক পরিহিত লোকটার পা। যাকে সে গু লি করেছিল। রোযা হতবাক হয়ে নিজের হাতের পিস্তলটা দেখে। ভালোভাবে দেখে নিজের হাত! পরমুহূর্তেই একঝটকায় পিস্তলটা ফেলে দেয়। সে বাকরুদ্ধ! জীবন্ত এক মানুষকে গু লি করেছে!! রোযা গু লি করেছে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেয়ের কান্না মিশ্রিত কণ্ঠের ডাকে আদিল মির্জার ঘোর কাটে। ঘোর! হ্যাঁ, ঘোরই ছিলো। দ্রুতো কয়েক কদম এগিয়ে গেলো। দু-পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসে দু-হাত মেলে দিতেই মেয়ে তার ছুটে এলো কোলে। ছোটো দুটো হাতে জড়িয়ে ধরল আদিলের গলা। ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফুপিয়েই গেলো। রীতিমতো বাচ্চা মেয়েটার শরীর কাঁপছে তখনো –
‘ড্যাডি….’
মেয়ের মাথায় সমানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আদিল আওড়ায় –
‘এইতো আমি, সোনা। শান্ত হও। ড্যাড ইজ হিয়ের ফর ইউ। দেখি— তাকাও।’
হৃদি বাবার ঘাড় থেকে মাথা উঠিয়ে তাকাল। চোখমুখ লাল। কেঁদেকেটে চোখের পানি, নাকের পানি এক করে রেখেছে। পেছনে দাঁড়িয়েছিল শান্ত। আদিলের ডান হাত। সে বেশ সাবলীলভাবে একটা পরিষ্কার রুমাল বের করে এগিয়ে ধরল। আদিল রুমালটা নিয়ে মেয়ের নাক, মুখ যত্মের সাথে মুছিয়ে দিতে নিয়ে প্রশ্ন করে –
‘এখনো ভয় লাগছে?’

হৃদি মাথা নাড়িয়ে বোঝাল — ভয় লাগছে না। আরও জোড়ালো ভাবে আদিলের গলা জড়িয়ে ধরতেই আদিল উঠে দাঁড়াল মেয়েকে কোলে নিয়ে। হৃদি ফিসফিস করে বলল –
‘কিন্তু.. কিন্তু আমার স্নো হোয়াইট ভীষণ ভয় পেয়েছে, ড্যাড। শি ওয়াজ সো স্কেয়ের্ড।’
আদিল ভ্রু তুলে তাকাল সামনে। রোযা ড্রাইভার চাচাকে সাহায্য করছিল গাড়িতে উঠে বসতে। বয়স বেশি তার, এরওপর আবার বৃদ্ধার কোমরে বেশ কয়েকটা বাড়ি মা রা হয়েছে। স্বাভাবিক যে সে নিজে নিজে উঠতেই পারছে না। রোযা তাকে উঠিয়ে আবারও পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকল গাড়ির সামনে। আড়চোখে দেখল কেমন সবগুলো আক্রমণকারীকে টু-শব্দ করা ব্যতীত ধরেবেঁধে গাড়িতে তোলা হচ্ছে! কিছুক্ষণের মাথায় রাস্তাঘাট পরিষ্কার! অথচ একটু আগেও পুরো রাস্তা ব্লকড ছিলো। সাধারণ মানুষের জন্য এই দৃশ্যটি আতঙ্কজনক।
শান্ত আদিলের নজর আড়চোখে দেখেই মাথাটা এগিয়ে এনে আস্তে করে বলল, ‘বস, দ্যাট ইজ মিস রোযা। প্রিন্সেসের ইলেভেনথ ন্যানি।’

আদিল আপদমস্তক দেখল কিছুক্ষণ। তখনকার তেজস্বিনী রূপটা নেই। মাথাটা নুইয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আদিল সবসময়ই কাজের লোকদের প্রতি উদাসীন। সেভাবে খেয়ালই করে না, সেধে এলেও। আদিল অনুমান করল, এই মেয়ে বুঝি তার সামনেই কখনো আসেনি বা পড়েনি। চার বছর ধরে এতো কো-ইন্সিডেন্স কীভাবে সম্ভব? এতো চমৎকার ভাবে ইনভিসিবল থাকাটাও একটা মারাত্মক গুণ, বলতেই হয়। শেষ একবার চেয়ে আদিল মেয়েকে নিয়ে হাঁটা ধরল গাড়ির দিকে। এলেন, আদিল মির্জার ডান হাত —গাড়ির দরজা মেলে ধরে আছে। গাড়িতে উঠে বসতে বসতে আদিল শান্তকে ইশারা করে গেলো। আদিলের কালো গাড়ির সাথে, একইরকম দেখতে আরও দুটো গাড়ি সারিবদ্ধ ভাবে চলে যাচ্ছে।

শান্ত আড়চোখে রোযাকে দেখল। সবসময় মাথাটা নুইয়ে রেখে চলেছে। অযথার্কিংবা প্রয়োজনে, কোনোভাবেই সামনে পড়েনি। তাই হয়তোবা তেমন খেয়ালও করা হয়নি এতো কাল। বেশ সুন্দরী! আগুন সুন্দরী বলা যেতেই পারে। তারওপর আবার বেশ ফিটনেস মেইনটেইন করে রেখেছে। ফর্সা মুখে টানা টানা চোখ, ফুল লিপস, চোখা নাক। স্কিন কেমন চকচক করছে। চুলের রংটা ব্রাউন। সম্ভবত কালার করা। চুলের রংটা কমপ্লিমেন্ট করছে লুকসকে। শান্তর চোখে ভাসল তার বসের স্তম্ভিত মুখটা। কিছু একটা ভেবে সে ভদ্রভাবে গাড়ির দরজা মেলে ধরল –
‘মিস, উঠে বসুন।’

রোযা চেয়েছিল চকচকে দাম্ভিক গাড়িগুলোর দিকে। নিমিষে চোখের সীমানার বাইরে চলে গিয়েছে। হৃদির জন্য তার চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। কোথাও ব্যথা পেলো কি-না? ভাবতে ভাবতে উঠে বসল। ড্রাইভার সিটে ভিন্ন একজন মানুষ বসে। রোযা ভুল না হলে এটাও একজন বডিগার্ড। তার পাশেই শান্ত। কালো একটা স্যুট গায়ে। কানে ব্লুটুথ। কাকে যেন ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে।
ড্রাইভ করছিল রাদিন। জিজ্ঞেস করল –
‘বস কী বললেন?’
‘টু ফাক দেম ওল….’

রোযা সামান্য কাশল। শান্ত মুহুর্তে ঘুরে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। গাম্ভীর্যের মুখশও যে কেউ এতো দ্রুত পাল্টাতে পারে তার জানা ছিলো না। শান্ত হেসে হেসে প্রশ্ন করল –
‘মিস রোযা রাইট? মিস তো? মিসেস না রাইট?’
রোযার অপ্রস্তুত হয়েও বলল, ‘মিস রোযা।’
‘সাচ আ নাইস নেইম। সো প্রিটিইইই। ফুল নেইম উড বি?’
রোযার দু-ভ্রুয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ল। বিড়বিড় করল, ‘হোয়াটস রং উইদ দিস গায়?’
জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলো –
‘আয়াত তালুকদার রোযা।’
রাদিন ভ্রু তুলল শান্তর দিকে আড়চোখে চেয়ে। সেদিকে ধ্যান নেই শান্তর। উৎসাহের সাথে একের পর এক প্রশ্ন করে গেলো –

‘আপনার বাবা কী করেন মিস রোযা? আর ডেটিং সামওয়ান রাইট নাও? হোয়াট কাইন্ড অব কার ডু ইউ ইউস? আর ইউ….’
দু-হাতে বুকে ভাঁজ করে বেশ সাবলীলভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল রোযা। শান্তর শ্যামবর্ণ মুখটা ভালোভাবে দেখে এযাত্রায় মিষ্টি করে হাসল। প্রশ্ন করল –
‘ওই লোকগুলো কারা ছিলো? মাস্টারমাইন্ড কে? তারা কেনো মা রতে চাচ্ছিলো হৃদিকে?’
শান্তর হাসি মুখ থেকে সরে গেলো। মুখ বন্ধ করে ঘুরে বসল আগের মতো। রোযা বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করল। বিড়বিড় করল –
‘শেইমল্যাস।’
নিজের মতন ফের তাকাল জানালার বাইরে। শান্তর কিচিরমিচির ব্যতীত এবারে একটু আরামবোধ হচ্ছে। মাথাটা ফেটে যাচ্ছিল। তার এখনো সবকিছু কেমন কল্পনা মনে হচ্ছে। রোযা — সে সাধারণ একজন মেয়ে। যার দুনিয়া সাধারণ। অথচ আজ যা সে করেছে…তা তো সাধারণ কিছু না। চোখ পড়ল তার হাতের চকচকে লাল নেইলপালিশের ওপর।

রোযার মনে আছে যখন নতুন সে হৃদির ন্যানি হিসেবে প্রবেশ করেছিল মির্জা বাড়ির এমন গম্ভীর পরিবেশে। সবসময়ের চঞ্চল, নিজেকে সুন্দর করে রাখতে চাওয়া সে একদম গুটিয়ে থাকতো। নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। সাজগোজ করা বাদ করে দিলো। যদি খারাপ কারো নজর পড়ে যায়? যদি কেউ তাকে বিরক্ত করে? তখন কী করবে অসহায় তারা? বাবার ব্যবসায় তখন লাল বাত্তি জ্বলছে। টাকার সমস্যা, বাবার অসুস্থতা..ভাইয়ের পড়াশোনা, সব মিলিয়ে সে তখন অসহায়ের চরম পর্যায়ে। বড়ো সন্তান হিসেবে সব দায়িত্ব এসে পড়ল রোযার কাঁধে। তার এতো ভালো একাডেমিক রেজাল্ট তখন বাচ্চাদের অপছন্দের খেলনায় রূপান্তরিত হলো। কোনো কাজেই এলো। যদিওবা এলো, সেসব কাজের বেতন সীমিত। ওতে রোযার পোষাতো না। তখুনি আল্লাহর অশেষ রহমতে সে এই কাজের সূত্র পায়। চড়া বেতন। তখুনি পঞ্চান্ন হাজার ছিলো তার মাসিক বেতন। আর এখন তা প্রায় লাখের ঘরে। রিস্ক বলেইতো এতো টাকা! সন্ত্রাসের বাড়িতে এসে কাজ করতে হয় বলেইতো একটা সাধারণ কাজে এতটা পারিশ্রমিক সে পেয়ে এসেছে! নিজের পরিবারকে দাড় করাতে পেরেছে। নিজে লিড করতে পারছে স্বপ্নের জীবন। রোযা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকাল সামনে। রাদিন তখন ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। রোযা ভ্রু তুলতেই সে আগ্রহী দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। আওড়াল –
‘ডেঞ্জারাস।’

বাড়ির সামনে গাড়ি থেমেছে। এলেন দ্রুতো বেরিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়েই নেমে এলো আদিল মির্জা। সূর্যের আলো সোজা এসে পড়ল কালো কুচকুচে মেসি আন্ডারকাট চুলে। রোদ পড়ায় কেমন লাল দেখাল চুলগুলো। এলেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারল বসের চওড়া মেজাজ। কাছে, কোলে মেয়ে দেখে এখনো ফেটে পড়েনি। নাহলে….! আদিল দুয়ারের কাছে গিয়ে থামল। শক্ত চোয়াল সামান্য ডান পাশ করে, কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল –
‘খোঁজ লাগা। আই ওয়ান্ট দিস দিস মাদার***।’

এলেন মাথা দোলাল। আদিল ভেতরে চলে গেলে বড়ো করে শ্বাস ফেলল। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। রীতিমতো ঝড় বয়ে গিয়েছিল তার ওপর। কীভাবে যে তারা এতো দ্রুতো পৌঁছেছে– তা সে নিজেই জানে। গাড়ি না যেন প্ল্যান চালিয়েছে! কোন শা লার ম রার শখ জাগল আবার? অবশ্য প্রতিনিয়তই কেউ না কেউ ম রতে চলেই আসে। আশেপাশে পৌঁছানোর আগেই এদের শ্মশান ঘাট পাঠিয়েও দেয়া হয়। এই শা লার পুত কীভাবে যেন তাদের নজরের বাইরে চলে গেছে। ব্যাপার না! একবার পেয়ে নেক খোঁজটা।

‘ধ্রুবের কী অবস্থা? এনিথিং সিরিয়াস?’
জাকির সহ আরও পনেরোজন দাঁড়িয়ে ছিলো পেছনে। জাকির উত্তর করল –
‘পায়ে গু লি লেগেছে। মাথায় চট পেয়েছে। মাসখানেক বেড রেস্ট তো করতেই হবে।’
এলেন আচমকা ফিরে তাকাল। কণ্ঠ নামিয়ে প্রশ্ন করল –
‘ওই টাকলার পায়ে গু লি কি সত্যিই মেয়েটা করেছে?’
‘হু। মিস রোযা। প্রিন্সেসের ন্যানি।’
এলেন আশ্চর্যই হলো। বিড়বিড় করল, ‘শি’জ সামথিং।’
রোযাদের গাড়িটা তখুনি এসে থামল। চকিতে ফিরে তাকাল এলেন। তখন ঝামেলায় এই মিস রোযাকে দেখা হয়ে ওঠেনি। রোযা গাড়ি থেকে নেমে এলো স্বাভাবিক ভাবেই। সঙ্গে সঙ্গে এতগুলো চোখের দৃষ্টিতে অপ্রস্তুত হলো। চোখমুখ কুঁচকাতেই সব রোবটের মতো নিজেদের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। শান্ত গাড়ি থেকে নেমে এসে বিনয়ের সাথে বলল –

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ১

‘মিস, কাম উইদ মি। বস আপনার সাথে কথা বলবেন।’
রোযা জানে, বুঝেছে… আজ সম্মুখীন হতেই হবে। এতো বড়ো ঝামেলা হলো যেহেতু। দেখা করে কথা তো বলবেনই। কিন্তু রোযার সত্য বলতে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার এখানকার কারো সাথে কথা বলতে, সামনাসামনি দাঁড়াতে ভালো লাগে না। এককথায় হৃদি বাদে কিচ্ছু ভালো লাগে না। সে যেমন লুকিয়ে ছিলো, ওমনই থাকতে চায়। তা কি আর সম্ভব? শান্ত পুনরায় ডাকতেই রোযা পা বাড়াল ভেতরে।

আদিল মির্জা’স বিলাভড পর্ব ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here