মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৮+৩৯

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৮+৩৯
ফাবিয়াহ্ মমো

চোখের সামনেই নতুন ফোনটা বাজতে-বাজতে কেটে গেলো। মেহনূর কান্না আঁটকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলে এদিকে আর ফোন ধরতে পারলো না। কল কেটে গেলে মূঢ় দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো মেহনূর, এবার সবকিছু ভেঙ্গেচুরে কান্না ঠেলে আসছে তার। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা এমনেই অভিমান-অপমান নিয়ে রেগে ছিলো, এখন যদি কল না ধরাকে একধাপ বেশি ভাবে তখন? মেহনূর আর ভাবতে পারলো না, ফোনটা কোলে ছেড়ে দিয়ে অশ্রুমাখা মুখটা দুহাতে ঢেকে ফেললো।

হাতের শুকনো তালু দুটো আবারও সিক্তজলে ভিজে উঠলো। এবার মাহতিম জীবনেও ওকে কল করবেনা। ও যে ভুলবশত কলটা ধরতে পারেনি, কলটা যে আপনা-আপনি কেটে গেছে সেটা না জেনেই মাহতিম তিনগুণ বেশি ক্ষেপবে। এই ঘটনার পর থেকে আদৌ সে কল করবে? মেহনূর অসহ্য চিন্তা-ভাবনার ভেতর অস্থির হয়ে উঠলে কোলের উপর আলো জ্বেলে পুনরায় বস্তুটা বাজতে লাগলো, টিকটিক করা ঘড়ির আওয়াজকে টেক্কা দিয়ে পুরো রুমে তখন ফোনের রিংটোনটা ছড়িয়ে পরলো। মেহনূর হতবাক হয়ে মুখ থেকে হাতদুটো নামাতে লাগলো, দৃষ্টিনত করে কোলের দিকে চোখ পরতেই এবার ডানেবামে তাকালো না। খপ করে ফোনটা হাতে তুলে রিসিভ অপশনে বৃদ্ধাঙ্গুল রেখে আলতো চাপ দিলো, এবার কলটা রিসিভ! মেহনূর ভেজা-ভেজা দৃষ্টিতে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা তখন কানে ঠেকালো, নির্বাক ভঙ্গিতে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হালকা সুরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– হ্যালো,
উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো মেহনূর, বুকটা প্রচুর ঢিপঢিপ করে শব্দ করছে। শুকিয়ে আসা গলাটা ছোট্ট ঢোক গিলে খানিকটা ভিজিয়ে নিলো, অপেক্ষায় থাকা উৎকন্ঠিত মনটা মাহতিমের কথা শোনার জন্য ছটফট করে চন্ঞ্চল হচ্ছে, আচঁলের নরম কাপড়টা বাঁহাতের তালুতে দলা পাকিয়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা মাহতিম কি প্রচুর রাগারাগী করবে? ধমক দিবে? কড়া কথা শোনাবে? অসংখ্য-অসংখ্য প্রশ্ন যখন মেহনূরের চিন্তাকে হুরহুর করে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো, তখনই কিলবিল করা প্রশ্নের মধ্যে দাঁড়ি বসিয়ে ওপাশ থেকে বলতে লাগলো মানুষটা। আজ তার কথার মধ্যে ঝাঁঝ ছিলো, তেজ ছিলো, প্রচণ্ড রাগের আভাস বোঝা যাচ্ছিলো।

– খুব খারাপ লাগছে? হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়ার কথা। সেদিন তোমার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, গাড়ি ব্যাক ঘুরিয়ে কত বড় রিষ্ক নিয়েছিলাম তোমার ধারণাও বাইরে। আমার পজিশনের পাওয়ারটা কোনোদিন খাটাইনি, সেদিন ফ্লাইট মিস করবো জেনে এ্যাজেন্সীর মালিককে শ্যাডিউল পিছাতে বলি। তোমার জন্য ওই ফ্লাইটের সত্তর জন যাত্রীর ভোগান্তি সহ্য করা লাগে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন ইচ্ছা করছিলো সৌভিককে বলে তোমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেই। পুরোটা রাস্তা তোমার ওইসব কথাগুলো কানে বিধেঁছে।

তোমার উপর কি পরিমাণ ক্ষোভ কাজ করছিলো, সেটা যদি এককোণা পরিমাণ প্রকাশ করি তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবেনা মেহনূর। আমাকে মনের খুশীমতো কথা শোনাবে, ইচ্ছামতো এটা-ওটা করে ফেলবে, এদিকে আমিও চুপচাপ শুনে তোমাকে আদর করতে আসবো, তোমার কথা ভুলে পিছনে-পিছনে ঘুরঘুর করবো, এই চিন্তা মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলো। আমাকে অন্যদের মতো ভাবতে যেও না। এই ভুলটা যদি না করো তাহলে তোমার জন্যই ভালো। তুমি আমার হাসিখুশি রূপ দেখে অভ্যস্ত মেহনূর, সেটা নিয়েই থাকার চেষ্টা করো। আমার আড়ালে থাকা রূপটা টেনে-হিঁচড়ে বের করার চেষ্টা করো না, জাস্ট এটুকুই সতর্ক করবো, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবে না।

কাট-কাট গলায় তেজালো সুর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মেহনূর। মুখের ভাষা হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো। মাহতিমের সহজাত রূপটা পলকে-পলকে যেনো অন্যরূপে বদলে যাচ্ছে। যাকে চেনা যায় না, বুঝা যায় না, জানাও যায়না এমনই স্থিতিতে গুলিয়ে যাচ্ছে। মেহনূর স্থির দৃষ্টিতে বুক ফুলিয়ে দম নিলো, নিশ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে আটদিন আগের ক্ষত হাতটা চোখের সামনে তুললো। এখনো ঘা-টা শুকোয়নি, চাপ লাগলে এখনো ভীষণ ব্যথা করে। ক্ষতটার দিকে নির্মল দৃষ্টি রেখে স্বচ্ছ গলায় বললো মেহনূর,

– আপনার হাত ভালো হয়েছে?
বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে মাহতিম। রুমের লাইট নেভানো বলে জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে চর্তুদিকে আবছা অন্ধকার করে দিচ্ছে। ঠান্ডা-ঠান্ডা বাতাস তখন খোলা জানালা দিয়ে পর্দা উড়িয়ে ঢুকছে। মাহতিম উড়ন্ত পর্দার দিকে দৃষ্টি রেখে তাচ্ছিল্যের হাসিতে বললো,
– মনের খোঁজ নেওয়াটা জরুরী। হাতের জন্য ডাক্তার আছে।

উত্তর শুনে ফিক করে হেসে দিলো মেহনূর। হাতটা চোখের সামনে থেকে নামিয়ে বাঁ-পাশ থেকে মাহতিমের বালিশটা টেনে নিলো। বিছানার হেডসাইডে সেও পিঠ ঠেকিয়ে কোলে বালিশ রেখে বসলো। এদিকে মাহতিমের মাথায় অতিথিদের নিয়ে টেনশন কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি টেনশন হচ্ছে মেহনূরকে নিয়ে। এই মূহুর্তে যদি ওর কিছু হয়ে যায় তাহলে কিভাবে সবকিছু সামাল দিবে? মাহদিকে একা পেয়ে গাল চেপে ধরেছে, যদি মেহনূরকে সুযোগ মতো কিছু করে ফেলে? কোনোকিছুই ঠিকঠাক মতো ভাবতে পারছেনা মাহতিম। বাড়ি ফিরার জন্য মন ও মস্তিষ্ক ব্যকুলভাবে আনচান করছে। বিছানার ডানপাশ থেকে চারকোণা বস্তুটা হাতে তুলে নিলো মাহতিম। আবছা অন্ধকারের ভেতর সেই বস্তুটার দিকে একাগ্রমনে তাকিয়ে রইলো। কালো রঙের ফটো-ফ্রেমটা আজ সকালেই ডেলিভারি ম্যান দিয়ে গেছে। গোলাপি শাড়ি পড়ুয়া মানবী হাতে উপন্যাস নিয়ে ডুবে আছে, তার দীর্ঘকেশগুলো পিঠ ছাড়িয়ে মাটিতে পরে আছে। আনমনে নিজের ভুবনে থাকা নারীমূর্তির ছবিটা রেসোর্টে থাকার সময় মাহদি তুলেছিলো। ভাগ্যিস ফোনটা মাহতিমের ছিলো বলে আজ একটুকরো ভালোবাসা নিজের কাছে রাখতে পেরেছে। মাহতিম ছবিটার দিকে দৃষ্টি রেখে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমার বইগুলো যেই ভাগ্য নিয়ে এসেছে, আমার নসিবে সেই ভাগ্যটুকু নেই। তোমার বইগুলো যখন-তখন তোমার কোমল-কোমল আঙ্গুলগুলোর ছোঁয়া পাচ্ছে, তোমার কোলটায় নিজেদের গুঁজে নিয়েছে, তোমার কাছে থাকার সুযোগ তারাই বেশি পায়। আমি ঠিক এতোটাই দূরে আছি যে, যদি তোমার কিছু হয়েও যায় তাও আমি আসতে পারবো না। নিজের দিকে খেয়াল রেখো মেহনূর। এবার ফিল্ড থেকে ফিরলে আমাকে একটু ……

চোখদুটো বন্ধ করে গভীরভাবে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। কান থেকে ফোন সরিয়ে কলটা কেটে দিলো। ফটোফ্রেমটা বিছানায় ফেলে ফ্লোরে পা রেখে দাঁড়ালো। খোলা জানালার দিকে উদাস দৃষ্টি রেখে ধীরপায়ে সেখানে গেলো। ট্রাউজারের দু’পকেটে হাত গুঁজে জানালা দিয়ে নিচে তাকালো মাহতিম। সুইমিংপুলের টলমল পানিতে আকাশের ছাপ পরে আছে এখন। বাতাসের জন্য পানির উপর মৃদ্যু স্রোত দেখা যাচ্ছে, স্রোতের প্রবাহে আকাশের প্রতিচ্ছবিটা নড়েচড়ে উঠছে। ডানপকেট থেকে হাত বের করলো মাহতিম। মুঠোবন্দি হাতটা কাছে এনে আঙ্গুলগুলো আলগা করে ফেললো, ওমনেই মুঠোয় থাকা পাসপোর্ট সাইজের ছোট্ট ছবিটার দিকে দৃষ্টি রাখলো। কিছু সময় নিরব থেকে একাকী রুমের ভেতর বলতে লাগলো মাহতিম,

– তোমার মিষ্টি মুখটায় অসংখ্য চুমু মেহনূর। যতো দূরেই থাকিনা কেনো তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। চাইলে এখুনি তোমার কাছে ফিরতে পারি, কিন্তু কাজ ফাঁকি দেওয়াটা আমার দ্বারা কোনোকালেই সম্ভব না।

আকস্মিকভাবে ফোন কেটে দেওয়াতে কিছুটা আশ্চর্য হয় মেহনূর। তাঁর রাগ কি এখনো কমেনি নাকি ক্ষোভটা এখনো দেখিয়ে যাচ্ছে? মেহনূর ফোন হাতে নিয়ে দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করলো, কিন্তু কল এলো না। এবার আর মন খারাপ হলো না, মনে-মনে ভেবে নিলো হয়তো কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। এখন আর রাতের সময়টুকু ঘুমায় না মেহনূর, গ্রামে যেভাবে বই নিয়ে সময় কাটাতো সেভাবেই বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। হাতে এখন ‘ সমুদ্রবিলাস ‘ নিয়ে মগ্ন হয়েছে, সময়ের প্রহর বাড়তে-বাড়তে রাতটা গভীরভাবে তলিয়ে যাচ্ছে। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহরের ঘন্টা বেজে উঠলো তার কিছু মিনিট পরপরই রুমের দরজায় ঠকঠক করে উঠলো। মেহনূর বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো, এতো রাতে এই রুমে কে নক করছে? মেহনূর বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রশ্নাত্মক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– কে?
‘ ক্যাচ ‘ করে শব্দ তুলে দরজা খুলতে লাগলো, দরজা একটু ফাঁক হয়ে গেলে রুমের ভেতরে পা রাখলো মাহদি। মেহনূরের দিকে চিলতেখানি হাসি দিয়ে দরজা চাপিয়ে কাছে এলো। বিছানার কাছে এসে পাশে বসতেই হাসি-হাসি গলায় বললো,
– আমার শত্রু ফোন দিয়েছিলো তাইনা? তোমাকে কাঁদালে আমার কাছে বিচার দিবে ঠিক আছে? আমি একেবারে ফাল্টি-ফাল্টি করে সাইজ করে দিবো।
মাহদির দুঃসাহসিক আচরণ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর। মাহদিকে কাছে কোলে বসিয়ে নিলো, গালদুটো দুহাতে ধরে কপালে ছোট্ট চুমু দিতেই হাসিসূচকে বললো,

– তোমার কিচ্ছু করতে হবে না পুচকে দেবর। তুমি যে এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে এসেছো, এটা কি ঠিক হলো? ঘুমাওনি কেনো? কিছু লাগবে?
মাহদি কোনোপ্রকার উত্তর না দিয়ে মেহনূরের গলা জড়িয়ে ধরলো। মেহনূরের কাধে গাল ঠেকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– আমি তোমার কাছে ঘুমাবো বউ। ভাইয়া তো এখন নেই, আমি তোমার কাছে একটু ঘুমাই?
মাহদির আকুতিসম্পণ্ণ কন্ঠ শুনে ‘ না ‘ করলো না মেহনূর। প্রসন্ন গলায় হাসি দিয়ে মাহদির পিঠ বুলিয়ে বললো,
– আমি কি কখনো না করেছি? করিনি তো। যখন ইচ্ছে তখন চলে এসো।

মাহদি দুপাটি দাঁত বের করে প্রফুল্ল হাসিতে মেতে উঠলো, মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে পাশে বালিশ টেনে শুলো। মেহনূর রুমের জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে কম্বল বের করলো। কম্বলের ভাঁজটা খুলে দিয়ে মাহদির গা ঢেকে দিতেই নিজেও কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। ঘুমানোর জন্য মাহদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলে অন্যদিকে পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহদি। মিচকি-মিচকি হাসিটা অনেক কষ্টে ভেতরে চেপে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ টাইপ করলো,
– তোমার বিছানায় আমার বউ নিয়ে ঘুমাচ্ছি ভাইয়া। আমার বউ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে, ইয়াহু, ইয়াহু।
ম্যাসেজটা পাঠিয়ে বিশ্বজয়ীর হাসি দিয়ে মেহনূরের দিকে একপলক তাকালো। মেহনূরের দৃষ্টি তখন দেয়ালে আটঁকে থাকা বন্দুকটার দিকে স্থির হয়ে আছে। মাহদি সেটা দেখতে পেয়ে মেহনূরকে কিছু বললো না, চুপচাপ ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললো।

রাতের আধার চিড়ে ধীরে-ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। পূবদিকটা অরুণপ্রভায় রাঙা হয়ে দিনের আর্বতনে পরিবর্তন হলো। ভোরের আলো পেয়ে জাগ্রত হলো পাখিরা, মসজিদে-মসজিদে আযানের সুর শেষ হয়ে জামাতের সালাত শুরু হলো। পাখিরা কিচিরমিচির করতে-করতে জাগিয়ে দিলো গাছের সতেজতা। মৃদ্যু হাওয়ায় পর্দা উড়ে স্থানচ্যূত হলো, তখনই পূবের সোনালী আলো এসে মেহনূরের চোখদুটোতে ভর দিলো। আলোর তীব্রতায় ঘুমের ঘোরেই চোখ কুঁচকালো মেহনূর, সাথে-সাথে একটা হাত এনে চোখের উপর আড়াল করে ধরলো।

চোখের পল্লবজোড়া আস্তে-আস্তে খুলে সকালের প্রথম প্রহরটা দেখতে পেলো, ওমনেই দেখতে পেলো মাহদি গুটিশুটি পাকিয়ে মাথা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে মুড়ে রেখেছে। মেহনূর ঈষৎ ভঙ্গিতে হেসে দিয়ে আস্তে করে মাহদির মাথা থেকে কম্বল সরিয়ে দিলো। যেটা ভেবেছিলো তাই দেখলো, মাথাটা ঘেমে উঠেছে। মেহনূর আচঁলটা টেনে মাহদির মাথা মুছে দিলো, এরপর শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহনূর। ঘুমের আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্য শরীরটা একটু টানা দিয়ে নিলো।

চোখটা ডলতে-ডলতে বালিশের তলা থেকে ফোন বের করলো, সেটা অন করে অভ্যেস মতো দেখলো, আজও কি মানুষটা স্মরণ করেছে কিনা। ফোনের স্ক্রিনটা আজও খালি, না স্মরণ করেনি। মেহনূর ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো, হাত-মুখ ধুয়ে এসে দরজা খুলে বাইরে বেরুলো। উদ্দেশ্য এখন ছাদের রুমটার দিকে খেয়াল রেখে আসা। মেহনূর সিড়ি ধরে উপরে উঠে নিজের আসল রুমটার দরজা ঠেলে দিলো, হাই তুলে ভেতরে ঢুকতেই হাইটা সেখানেই ওইভঙ্গিতে আটঁকে গেলো। আশ্চর্য হয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে আশে-পাশে তাকাতেই বুকটা নিংড়ে এলো মেহনূরের!

নিশ্বাসটা যেনো গলার মধ্যে আঁটকে গেছে, চোখদুটোর অবস্থা বিষ্ময়ে অভিভূত। মেহনূর বিধ্বস্ত রুমটার ভেতর একপা-একপা করে এগুচ্ছে, ওমনেই নিশ্বাসের প্রখর যেনো ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে বুকের পিষ্টনে আঘাত করছে। বিছানার চাদরটা অস্বাভাবিক আকারে দলা পাকিয়ে আছে, যেনো টেনেটুনে ছিঁড়তে চাওয়ার বাসনা ছিলো। ফ্লোরের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছেঁড়া বালিশের তুলা, টেবিলের উপর যে গ্লাস দুটো রেখেছিলো সেগুলো এখন চূর্ণবিচূর্ণ। স্বাভাবিক কায়দায় রেখে যাওয়া রুমটা একরাতের ভেতর লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কে করেছে, কেনো করেছে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা, কেনো এসব হলো? মেহনূর জড়সড় মন নিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো, ভীতশঙ্কিত চাহনি নিয়ে ধীরে-ধীরে ধ্বংসাত্মক অবস্থা দেখতে লাগলো।

দেখতে-দেখতে যেই ভীতিপ্রবণ চোখদুটো আলমারির দিকে আঁটকালো, তখনই বিস্ফোরণ চাহনিতে মুখের উপর হাত চাপা দিলো মেহনূর। উন্মাদের মতোই হোক, বা অস্থিরচিত্তের মতোই, মেহনূর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কাঁচকণাকে উপেক্ষা করে দৌড়ে সেদিকে পা বাড়ালো। পায়ের তলায় নরম চামড়া ভেদ করে ক্ষুদ্র ধারালো কাঁচ টুকরো ঢুকলো, ব্যথায় চোখ খিঁচে আসলেও নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে হজম করলো। হাতদুটো দিয়ে পাগলের মতো আলামারির ভেতরটা হাতাপিতা করতে লাগলো মেহনূর, প্রত্যেকটা হ্যাঙ্কার সরিয়ে-সরিয়ে বেঁচে যাওয়া শাড়ির খোঁজ করতে লাগলো। সতেরটা শাড়ির একটা শাড়িও অবশিষ্ট নেই, সবগুলো শাড়ি নৃশংসভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। তবুও উন্মাদের মতো বারবার দেখতে লাগলো মেহনূর, পায়ের তলায় যে কঠিন ব্যথা হচ্ছিলো সেটা কোনোভাবেই তোয়াক্কা করলো না।

গুণে-গুণে সতেরটা শাড়ি দিয়ে লাগেজভর্তি করে দিয়েছিলো মাহতিম। যাওয়ার আগে একটা কথাই বলেছিলো, বয়সটা যখন আঠারোয় এসে পৌছাবেতখন আঠারো নাম্বার শাড়িটা সে নিজে এসে কিনে দিবে। তদ্দিন পযর্ন্ত সতেরটা শাড়ির সঙ্গেই যেনো দিনগুলো কাটতে থাকুক, কিন্তু আজকের এই ঘটনা সমস্ত কিছু চুরমার করে দিয়েছে। মেহনূর নিরুপায় হয়ে নিস্তেজ ভঙ্গিতে থেমে যায়, নষ্ট করা শাড়িগুলো ওভাবেই রেখে আলামারি থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটা অবস্থা দেখে চিল্লিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যেদিন থেকে মাহতিম বিদায় হলো সেদিন থেকেই মনের ভেতর ভীতি ঢুকে গেছে। এই ভীতিটা দিনকে-দিন ভয়ানক আকারে বাড়ছে, শুধু বাড়ছে।

কমার অবস্থা একদম নেই। মেহনূর বিকারহীন ভঙ্গিতে থম মেরে ছিলো, আস্তে-আস্তে বাস্তবিক অবস্থায় ফিরে এলে পায়ের তলাটা যেনো বিষিয়ে উঠলো। ফ্লোরে ধপ করে বসতে পারলে শান্তি পেতো মেহনূর, কিন্তু কাঁচের টুকরো দিয়ে ঘরভর্তি ছড়িয়ে আছে তখন। শাড়ির কুচিগুলো ডানহাতে খাবলে একটু উঁচু করে তুললো শাড়িটা, অন্যহাত দিয়ে শাড়ির আচঁলটা মুঠো করে ধরে রইলো। ধীর কদমে এগুতে-এগুতে বহুকষ্টে ছাদের পরিখা পার করলো। এরপর সিড়ি ধরে নিচে নামতেই ব্যথাতুর কন্ঠে ‘ মা ‘ বলে ডেকে উঠলো মেহনূর। ডাকটা যে বেশিদূর যায়নি এবং কারোর কানেই পৌঁছনোর কথা না সেটা বুঝতে পারলো মেহনূর, কিন্তু গলা উঁচিয়ে যে কাউকে ডাকবে সেটাও তীব্র যন্ত্রণার কাছে পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে। রজনীর রুম থেকে পরিষ্কারের কাজ শেষ করে সাবু খালা পান চিবাতে-চিবাতে বের হচ্ছিলো, জিহবা দিয়ে উপরপাটির দাঁতগুলো বুলিয়ে নিতেই সিড়ির দিকে দৃষ্টি পরলো। ভ্রুঁ খানিকটা কুঁচকে অনেকটা কৌতুহলের সাথেই সেদিকে এগিয়ে গেলো, মেহনূরের যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে ওর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বললো,

– ও বউ, তোমার মুখ এমুন লাল হইয়া আছে ক্যা? কুনোহানে বিষ-ব্যাথা করতাছে নি? তোমার অবস্থা যে আমার কাছে ভালা ঠেকতাছে না।
মেহনূর খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটো পিটপিট করে খুললো, অনেক কষ্টে ঢোক গিলতেই আবারও চোখ খিঁচুনি দিয়ে মাথানত করে বললো,
– পায়ে কাঁচ ঢুকেছে খালা। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিনা, খুব জ্বলছে।
‘ হায়, হায় ‘ আর্তকন্ঠে চিল্লিয়ে উঠলো সাবু খালা। ঢলঢলে দেহটা নিয়ে দ্রুত সে মেহনূরের হাতটা শক্ত করে ধরলো। মেহনূরের একটা হাত নিজের কাধের উপর টেনে নিতেই চিন্তিত কন্ঠে বললো,
– বউ কামডা তুমি ঠিক করলা? এহন যদি আফায় আমারে ইচ্চামতু বকে তাইলে আমার কি হইবো কওতো দেহি? ইশশি রে, কাঁচ ঢুকলে যে কি ব্যথা! বউ একটু ধৈইর্য্য ধরো, আমি এহুনি তোমার ব্যথা কমায়া দিতাছি।
সাবু খালা কথায় যেমন চটপট, কাজের বেলাতেও পটুতা দেখিয়ে দিলো। মেহনূরের মতো পাতলা দেহী মানুষকে সে একাই ধরে-ধরে কোনো কষ্ট ছাড়া মাহতিমের নিয়ে গেলো। বিছানায় বসিয়ে দিতেই মাথায় রঙচটা আচঁলটা ঠিক করে ব্যান্ডেজের সরন্ঞ্জামাদি এনে মেহনূরের মুখোমুখি হয়ে বসলো। স্যাভলনের মুখটা তিন আঙ্গুলে ঘুরাতে-ঘুরাতেই বললো,

– পা দুইটা আস্তে কইরা কোলে তুলো বউ।
মেহনূর দাঁত-মুখ শক্ত করে পাদুটো সাবু খালার কোলের উপর তুললো। খুলে রাখা স্যাভলনের চ্যাপ্টা বোতলটা একপাশে রেখে ছিলো সাবু খালা, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পায়ের তালুটা দেখতেই ব্যথিত দৃষ্টিতে বলে উঠলো,
– বউ গো, যেই সর্বনাশ করছো এই সর্বনাশের কথা যুদি বড়বাবায় জানে, আমারে না ধুইয়া ফালাইবো! এইডা কি করলা কও দেহি? ক্যামনে তুমি সর্বনাশডা করলা?
মাহতিমের প্রসঙ্গ আসতেই খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটো খুলে তাকালো মেহনূর, এদিকে পাকা হাতে তুলো ছিঁড়ে ঘা পরিষ্কার করছে সাবু খালা। ব্যথায় যেনো বিদ্যুতের মতো টনটন করে বাজছে মেহনূরের,হাঁটুর উপর খামচে রাখা হাতটা আরো শক্তভাবে খামচে নিয়ে রুষ্ট গলায় বললো সে,

– খালা, আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি ভুলেও উনার কাছে কিছু বলবেন না। আমার কথাটুকু মান্য করুন, উনি শুনলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবেন।
কাঁচের ক্ষুদ্র কণাটা এইফাঁকে দু’আঙ্গুলের নখ দিয়ে টেনে বার করলো সাবু খালা, আচমকা ব্যথায় অস্ফুট সুরে শিউরে উঠলো মেহনূর। চোখদুটো বন্ধ করে ঠোঁট গোল করে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়তেই সাবু খালা সেখানে তুলা চেপে বললো,

– তোমার এই অবস্থার কথা আমার কওন লাগতো না। তোমার দুই নাম্বার জামাই গিয়া আসল জায়গায় পাচার কইরা দিবো।
চট করে চোখ খুলে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর। চিকন-চিকন ভ্রুঁদুটো কপালে ভাঁজ ফেলে দিলো। হাঁটুর উপর খামচে ধরা হাতটা ধীরে-ধীরে শিথিল হতে থাকলে সাবু খালা ওর দিকে দৃষ্টি তুলে বললো,
– ওই পাকনারে থামান যাইতো না বউ। বড়বাবার কাছে ঠিকই লাগায়া দিবো। তার চেয়ে তোমারে ভালা বুদ্ধি দেই শোনো, তুমি এহুনি বড়বাবারে ফুন দিয়া ঘটনাডা কইয়া দেও। তাইলে আর সমিস্যা হইবো না।

মেহনূর মুখ ফুটে কিছুই বললো না, ওইমূহুর্তে স্থির হয়ে চুপ থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমনেতেই রুমের অবস্থা দেখে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে, তার উপর দ্বিতীয় দুশ্চিন্তায় মগ্ন হলে সর্বনাশটা ঠিকই হবে। পাদুটো সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দিয়ে রক্তাক্ত তুলাগুলো ডাস্টবিনে ফেললো সাবুখালা, ফিরে এসে মেহনূরের সামনে বসতেই একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো। পড়নে বাটিকের সবুজ শাড়ি, সবুজের উপর কমলা রঙের গোল-গোল ছাপ, ব্লাউজটা বাহুদুটোর উপর টাইট ফিটিং হয়ে চিপসে আছে, পেটের ভূড়িটাও বেশ স্বচক্ষে বোঝা যায়। পানের রসে ঠোঁটদুটো টকটকে লাল, দাঁতও লালবর্ণে লেপ্টে আছে, ‘ আনসারী নিবাসে ‘ প্রায় পনেরো বছর যাবৎ বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করছে, চালচলন এবং দেহের স্থূলতা দেখে বয়সের কোঠা অনুমানের বাইরে।

মেহনূর অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ থেকেও সাবু খালা খোচাখুচির প্রশ্ন থেকে রেহাই পেলো না, ভীতিকর পরিস্থিতিটা যথাসম্ভব সংক্ষেপেই বলে দিলো মেহনূর। সাবু খালা এতো বড় ঘটনা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না, উলটো ঝিম মেরে কিছুক্ষণ অন্যমনষ্ক হয়ে বসে রইলো। মেহনূর ভেবেছিলো সাবু খালা এই ঘটনা শুনে এলাহীকাণ্ডের মতো বাড়ি মাতিয়ে তুলবে, নিজেই এদিক-ওদিক না তাকিয়ে মাহতিমকে ফোন করে বসবে। অথচ চরম আশ্চর্যের ব্যাপার, সে কিছুই করলো না। শান্ত-স্থির হাবভাব দেখে মেহনূরের মনটা খটমট করতে লাগলো, নিশ্চিতরূপে বলা যায় সাবু খালার নিঃশ্চুপের পেছনে বিরাট কোনো কারণ লুকিয়ে আছে।

মেহনূর মারজার জন্য খোঁজ করলো, এদিকেও সে জানতে পারলো মারজা খুব সকালের দিকে ডাক্তারের কাছে চেক-আপ করতে গিয়েছে। মেহনূরকে তিনি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু রজনীর জন্য নাকি নেননি। অন্যদিকে হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে বড়ভাইয়ের রুমে আসে মাহদি। সবসময়ের মতো আজও সে মাহতিমের রুমে মেহনূরকে পেয়ে যায়, কিন্তু পায়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই পুচকে দেবরের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয় মেহনূর। অনেকটা নিরুপায় হয়েই মাহদির কাছে সব কথা বলে দেয়, এতেও মাহদির গভীর কৌতুহলের জায়গাটা তৃপ্তি পায়নি। মেহনূরের সরল মস্তিষ্ক যেখানে গোলকধাঁধার নিয়ম ধরতে পারতোনা, সেখানে বড়ভাই মাহতিমের সাথে উঠ-বস করতে-করতে মাহদি এসব নিয়ে যথেষ্ট তৎপর হয়েছে।

আজও সে গোড়ার দিকটা ধরার জন্য মেহনূরকে নাস্তা খাওয়ার নাম করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়, ট্রাউজারের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনের অস্তিত্বটা দেখে নেয়, এরপর সোজা ছাদের রুমটায় চলে আসে মাহদি। দরজার পর্দাটা ডানহাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিলে চোখ ছানাবড়া অবস্থায় থমকে যায়, এক-এক করে সবক’টা জিনিসে চোখ বুলিয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে। আজ কোনোভাবেই অস্থির হলে চলবে না, যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টায় মাহদি অনুভব করলো তার পাদুটো কাঁপছে। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। তবুও মনের উপর সাংঘাতিক জোর খাটিয়ে কলটা ডায়ালে ফেললো মাহদি, কোমরে ডানহাত রেখে কানে ফোন ঠেকালো তখন। পরপর দুটো রিং যেতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো কলটা, মাহদি তৎক্ষণাৎ ত্রস্তভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,

– আপু, ভাইয়া সবাই শোনো, প্লিজ শোনো, আজ বাড়িতে মা নেই। মা সম্ভবত ইকবাল আঙ্কেলের কাছে গিয়েছে। আমার বউয়ের রুমটা একদম তছনছ করা, আমি মাত্র দেখেছি। ওর পায়ে দেখলাম সাবু খালা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আমি কি কর —
কথাটা বলতে যেয়ে আঁটকে গেলো মাহদি। ভয়টা যে ওকেও কঠিনভাবে কাবু করে ফেলেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মাহদি শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে লম্বা-লম্বা নিশ্বাস টানতে লাগলো, গলাটা ভেজানোর জন্য বরফ ঠান্ডা পানি দরকার। বরফ কুচি ছেড়ে দেওয়া পানি ঢকঢক করে গিললে হয়তো খরতপ্ত গলাটার তৃষ্ণা মিটবে। মাহদির কথা মাঝপথে থামার পর কলের ওপাশ থেকে একযোগে চিল্লিয়ে উঠলো আটজন,

– মাহদি তুই ঠিক আছিস?
আটটা গলা একসাথে চিল্লানোর জন্য চমকে উঠলো মাহদি, তাড়াতাড়ি কান থেকে ফোনটা একটু দূরে সরাতে বাধ্য হলো। কানটা আরেকটু হলে ঠিকই কালা বানিয়ে ছাড়তো ওরা, মাহদি সাথে-সাথে বিরক্তিতে মুখ ভার করে বললো,
– তোমাদের কতোবার বলবো এভাবে চিল্লাবে না? আমি ভয় পেয়ে যাই জানো না? আমি ঠিকই আছি, আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। সাবু খালাকে রুম পরিষ্কার করতে বলে এলাম। আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা, রজনী মামী অনাকে নিয়ে কালরাত থেকে ফুসুর-ফাসুর করছে। আমি দূর থেকে কিচ্ছু শুনতে পাইনা। আজ মা’ও নেই এখন কি করবো মাথায় ঢুকছেনা।

হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপ কলে একত্র হয়েছে সবাই। সৌভিক অফিসের মিটিং বাদ দিয়ে মাহদির কল ধরে আছে, তৌফ মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে কথা শুনছে, সিয়াম গাড়ি ড্রাইভ করতে-করতে কানে ফোন চেপে আছে, নীতি লেকচার এ্যাটেন্ড করা বাদ দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছে, প্রীতি ক্যান্টিনে বসে আধা খাওয়া চা রেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, সাবির শোয়া থেকে না উঠলেও সজাগ হয়ে গেছে, সামিক আপাতত কাজহীন তাই তার সমস্যা হয়নি, ফারিন ফোনের নেটওয়ার্কটা ঠিকঠাক পাওয়ার জন্য জানালার বাইরে ফোন ধরে আছে, ফোনের স্পিকারটা লাউডে দেওয়া। মাহদির বিরক্তি মেশানো কন্ঠ শুনে সবার আগে চেঁচিয়ে উঠলো তৌফ। ব্রাশটা মুখ থেকে বের করে চেঁচানো সুরেই বললো,

– তুই যে আমার বুকপিন্ডটা খত’ম করার তালে আছোস জানা আছে? তোর কল দেখলেই আমার কলিজা ভয়ে থপথপায়।
তৌফের কথা শুনে এবার ফারিন ভ্রুঁ কুঁচকালো। তৌফের অস্ফুট ভঙ্গির তোতলামি শুনে ফারিন স্পষ্ট গলায় বললো,
– তুমি এমন ‘ ওয়া ওয়া ‘ করে তোতলাচ্ছো কেনো? তোমার কি ভয়ের চোটে মৃগী ব্যারাম ধরলো? আর বুকপিন্ড কি শব্দ? কি আজেবাজে বকছো তুমি?
ফারিনের ত্যাড়ামো ধরনের প্রশ্ন শুনে ক্ষেপে উঠলো তৌফ। গলাটা হাই ভলিউমে উঁচু করে গজগজ সুরে বললো,
– মুখে ব্রাশ নিয়া তারপর কথা বলতাছি বুঝছোস? হাদা কোথাকার, মাথায় সামান্যতম বুদ্ধি নেই। সকালে মানুষ কি করে হ্যাঁ?
তৌফের ক্ষেপাটে ভঙ্গির সুর শুনে ওপাশ থেকে নিরব রইলো ফারিন। নিরব ছিলো সবাই, কারণ হঠাৎ ফোনের মধ্য থেকে ‘ গড়গড় ‘ জাতীয় শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফারিন-সহ সবাই তখন কপাল কুঁচকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে, তার আগেই ফারিন হামেশার মতো আগ বাড়িয়ে বললো,

– এই শব্দ কি ফ্লাশের না? ছিঃ ছিঃ তৌফ ভাই তুমি হাই কমোডে —
ফারিনের কথা শেষ না হতেই ছোঁ মেরে কথা টান দিলো সৌভিক। যথেষ্ট সংযত গলায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
– আমি জরুরী মিটিং ছেড়ে তোদের দুটোর বকবক শুনতে আসিনি। মাহদি চটপট বলতো আর কি কাহিনী হয়েছে? আমি কি ছুটি নিয়ে সেখানে আসবো? তোর কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? তুই কি আর দুটো দিন ম্যানেজ করতে পারবি না?

এবার সৌভিকের কথার প্রেক্ষিতে মুখ খুললো মাহদি। যেই কথা বলতে নিবে ছাদের খোলা দরজার দিকে সর্তক দৃষ্টি চলে গেলো ওর। কিছু একটা তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতেই তাড়াতাড়ি কল কেটে ফোন পকেটে ঢুকালো। আজ যেহেতু মা নেই, এই সুযোগটা কি হাতছাড়া করবে ওরা? আদৌ কি হাতছাড়া করার পরিকল্পনা করেছে? ছাদের দিকে কেউ যেনো এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসার জোরদার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এখন। খোলা ছাদের উপর তখনই বয়ে চললো দমকা হাওয়া। বাতাসে মাহদির কমলা টিশার্টটা হালকা মতোন উড়লো, মাথার ঝিলমিল করা চুলগুলো বাতাসের দোলায় কপালের উপর আছড়ে পরলো। দুটো কুন্ঞ্চিত ভ্রু’র নিচে একজোড়া সর্তক চাহনি এমন কিছু দেখলো, ওই চোখদুটো রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো আবার।

শীতের খোলসে ঢাকা পরেছে প্রকৃতির নান্দনিক রূপ। গ্রামের আনাচে-কানাচে শীতের ভরা মৌসুম। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা তেজ হারিয়ে পশ্চিমে হেলে পরেছে, অরুণশক্তি নিস্তেজ হয়ে শীতের প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামের মানুষরা গায়ে চাদর জড়িয়ে নিত্যকর্মে নেমেছে। কেউ-কেউ অলসতাকে সাঙ্গ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেকার। মোল্লাবাড়ির মুখরোচক ঘটনাটা এতোদিনে চাপা পরে গেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেছে অন্য বাড়ির সমালোচনা নিয়ে। কাঠের ইজিচেয়ারে ক্যাচ ক্যাচ করে শব্দ হচ্ছে এখন, শব্দটা নিস্তব্ধ রুমটায় ভূতুড়ে কায়দায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

রুমে একটি মাত্র জানালা খোলা আছে, সেই জানালা দিয়ে যতটুকু আলো প্রবেশ করছে তা অন্ধকার হ্রাসের জন্য যৎসামান্য। চাপিয়ে রাখা দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হলো, ইজিচেয়ারটা সহসা থমকে যেতেই ক্যাচক্যাচ শব্দটা আর হলো না। বাইরে থেকে আগত মানুষটা কান খাড়া রেখেছিলো, অবিরাম শব্দটা থেমে গেলে সে আধ-ভেজানো দরজা ঠেলে দিলো। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই আধো-আধো অন্ধকার ফুঁড়ে বাঁদিকে দৃষ্টি গেলো লোকটার, গলা খাকাড়ি দিয়ে ইঙ্গিত দিতেই গম্ভীর সুরে এবার ইজিচেয়ার থেকে উত্তর চলে এলো,

– ভেতরে আসো জহিরুল।
খুবই নিঃশব্দ কায়দা বজায় রেখে ভেতরে ঢুকলো জহিরুল। অনেকটা চোরের মতোই ভেতরে প্রবেশ করলো। কোনো বিশেষ আজ্ঞা না পেলেও নিজ দায়িত্বে দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি-বদ্ধ করে দিলো। ইজিচেয়ারে দুলতে থাকা মানুষটা ছিটকিনি লাগানোর আওয়াজ পেতেই চোখ কাঠিন্য করে তাকালো, ততক্ষণে জহিরুল সামনে এসে হাজির। ঘিয়ে রঙের পান্ঞ্জাবীটার ডানপকেটে হাত ঢুকালো সে, সঙ্গে-সঙ্গে দুটো খামে বদ্ধ চিঠি সামনে ধরলো হান্নান শেখের। কাঠিন্য দৃষ্টিদুটো বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে স্থির এখন। একবার খামদুটোর দিকে তাকালো হান্নান শেখ, আরেকবার দৃষ্টি তুলে জহিরুলের দিকে তাকালো। মার্জিত শব্দে কঠোর আভাসে জিজ্ঞেস করলো জহিরুলকে,

– চিঠি আসার কথা মাঝ রাতে। এখন এসেছে কেনো?
জহিরুল নতমুখে আমতা-আমতা করে বললো,
– চাচাহুজুর, এই ব্যাপারে আমিও কিছু কইতে পারিনা। শফিক্কা আমার হাতে দুইডা চিঠি গুইজা দিয়া কয়, তাত্তাড়ি আমনের হাতে দিতে।
প্রচণ্ড সংকীর্ণ মনে কপাল কুঁচকে গেলো হান্নান শেখের। তিনি নিজেই যেটা নিয়ে ভয়ে-ভয়ে ছিলেন সেটা সম্ভবত ফলতে শুরু করেছে। হান্নান শেখ খামদুটো হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে লাগলেন, ছোট্ট একটা প্রশ্ন জুড়ে জহিরুলকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন,
– তোকে কেউ আসতে দেখেছে?

জহিরুল ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে নিজের প্রস্তুত উত্তরটা জানিয়ে দিলো,

– না চাচাহুজুর, কেউ দেহে নাই। সুজলা ভাবী গোয়ালঘরে দুধ দুয়াইতাছে। বাকিরা যার যার রুমে কাম করতাছে। আমি চোখ ফাঁকি দিয়া ঢুইক্কা গেছি।
হান্নান শেখ জহিরুলকে বিদায় দিয়ে এবার খাম নিয়ে বসলেন। ইজিচেয়ারে পিঠ লাগিয়ে মৃদ্যুভঙ্গিতে দুলতে লাগলেন। একটা খামের উপর আরবী হরফে কিছু লিখা ছিলো, বিশেষ খামটা আগে ছিঁড়ে উপুড় করতেই ভেতর থেকে ফস করে কোলে পরলো চিঠিটা। চিঠিটার ভাঁজ খুলে চোখ বুলাতেই চোখের কোটর আশ্চর্যভাবে বড় বড় হয়ে গেলো, ইজিচেয়ারে দোল খাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেলো হান্নান শেখের। ঠোঁট নাড়িয়ে চিঠির শব্দগুলো নিঃশব্দে পড়তেই বুকের রক্তস্রোত যেন টালমাটাল হচ্ছিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভঙ্গিতে চিঠির পাতায় গোটা-গোটা শব্দগুলো আবার পড়তে লাগলেন, ফের পড়তে লাগলেন, বারবার পড়লেন, বহুবার পড়লেন। চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় চোখ বুজে ফেললে তিনি মনে-মনে আওড়াতে লাগলেন চিঠিটা,
‘ মাহতিম আনসারী পিছু ছাড়েনি কালাম সরদার। ও সবার চোখে বাজেভাবে ভেলকি মে’রেছে। জীবিত থাকলে গুরুতর সমস্যায় পড়বেন। দ্রুত মৃ’ত্যু-সংবাদ ধার্য করুন। ‘

পিসিটা বহুক্ষণ যাবৎ অন করা, সেটা বন্ধ করার প্রয়োজন হয়নি। রুমের ভেতরটা নীলাভ আলোয় স্বল্পোজ্জ্বল হয়ে আছে, থাইগ্লাসটা খুলে রাখা। জানালার দুপাশে জড়ো করে রাখা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে, সেই সঙ্গে অনুভব করিয়ে দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। কফি মেকার থেকে মোটা পেটের মগটায় ঢকঢক করে কফি ঢালছে নোমান, কফির অবস্থা দেখে মুখ কুঁচকে রেখেছে। কালো পানীয়টার মধ্যে চিলতেখানি চিনির কণা পরেনি, না পরেছে এক চামচ দুধ। মাঝারি সাইজের কফি মগটায় পাঁচ চামচ কফি পাউডার মেশানো হয়েছে, দ্রবণটা হয়েছে কুচকুচে কালো। গন্ধে এতো বেশি তিক্ততা ছড়াচ্ছিলো, না-জানি খেতে কেমন জ’ঘন্য হয়!

তবুও নাকি জঘন্য পানীয়টা বসের জন্য তৈরি করাই লাগবে, নইলে কি অবস্থা করে দিবে কে জানে। ছোট্ট একটা আয়তাকার ট্রের উপর সদ্য বানানো কফিটা রাখলো, ট্রে’টা দুহাতে ধরে উক্ত রুমটার দিকে যেতে লাগলো নোমান। রুমের দরজাটা যদিও পুরোপুরি খোলা, তবুও সে সৌজন্যতা কায়েম করে দরজায় নক করলো। নীলাভ বাতিতে আলোকিত রুমটা দেখে কেমন জানি গা ছমছম করলো নোমানের। বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি অদ্ভুত ভাবে উত্থাল করছে, রুমের দিকে তাকালে মনেহয় মৃত্যুপুরীর রাজ্য, পিসিটা কেমন নির্বিকার ভাবে জ্বলে আছে, মনে হচ্ছে রুমটার সমস্ত অন্ধকার দেখে খুশীতে মত্ত। নোমান এবার খুব সাবধানী গলায় ডাক দিলো,

– স্যা-স্যার,
গলাটা যেনো কেঁপে উঠলো নোমানের, কেনো কেঁপে উঠলো সে জানে না। সে যথেষ্ট সাহসী ব্যক্তি, প্রচুর দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড করার রের্কডও তার আছে। এতোকিছুর পরও এই একটা ব্যক্তির কাছে আসলে তার সকল সাহস কোণঠাসা হতে বাধ্য। পিসির সামনে মুখোমুখি অবস্থায় থাকা রকিং চেয়ারটা নড়েচড়ে উঠলো। একনিমিষেই সেটা পিসির দিক থেকে মুখ সরিয়ে নোমানের দিকে ঘুরে গেলো, নোমান অবশ্য চমকালো না। গতরাতে এরকম দৃশ্যের অভিজ্ঞতা আরো একবার হয়েছে, তাই আজ সে উদ্যোগী ভঙ্গিমায় সচেতন। নোমান অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বে আরেকদফায় ডেকে উঠলো,

– স্যার? স্যার, আপনার কি মাথাব্যথা করছে?
প্রশ্ন করার পর কয়েক মিনিট নিরব রইলো, এর পরপরই নিরবতা চ্ছিন্ন করে ভারী গলায় বললো মাহতিম,
– মগটা টেবিলে রেখে বিদায় হও। লাইট জ্বালাতে যাবে না।
নোমান যথা আজ্ঞাসূচকে ভেতরে ঢুকলো, রকিং চেয়ারের পাশে এসে টেবিলে রাখলো মগটা। ঘাড়টা ডানে ঘুরিয়ে একপলক চেয়ারে হেলান দেওয়া ব্যক্তিটার দিকে তাকালো, সে চোখ বন্ধ করে একটা হাত ভাবুক স্টাইলে হ্যান্ডেল রেখে ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল রেখে দিয়েছে। নোমান আবার প্রশ্ন করলো,
– স্যার রাগ না করলে একটা কথা বলি? আপনি একটু ঘুমোন স্যার। ছেঁচল্লিশ ঘন্টা ধরে আপনি কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন। আপনার চোখ খুব লাল হয়ে গেছে।

কথাটুকু শেষ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো নোমান। ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রেখে চাপা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে দিলো। ঠোঁটের কাছ থেকে আঙ্গুল সরিয়ে স্বাভাবিক হলো মাহতিম। মগের হ্যান্ডেলটা দু’আঙ্গুলে পেঁচিয়ে টেবিল থেকে তুলে নিলো সেটা, নিচের ঠোঁটটার কাছে মগ এনে গভীর করে এক চুমুক দিলো। তিক্তস্বাদের আভাস কোনোভাবেই মুখের উপর প্রকাশ পেলো না, চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ পর জবাব দিলো মাহতিম,

– বাহাত্তর ঘন্টা খাটতেও সমস্যা নেই নোমান। অসুস্থ হবো না। শুধু মাথাটা একটু ঝিমঝিম করবে এর বেশি কিছু হবেনা। তোমার কাজ না থাকলে একটু পিসির সামনে বসো। আমি কফিটা ততক্ষণে শেষ করে নেই।
বলতে-বলতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো মাহতিম। মাথাটা আসলেই যন্ত্রণা করছে। নির্ঘুম দশা যে কতটা অসহ্যকর সেটা ফিল্ডে ফিরলেই বুঝা যায়। মাহতিমের নির্দেশ মতো রকিংচেয়ারে বসলো নোমান। ইতিমধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছে, নির্ঘাত কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিউজের জন্য অপেক্ষা করছে তার বস। এতো খাটাখাটনির পেছনে যেই গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা কিছুক্ষণের মধ্যে বেঁফাস হতে বাকি নেই। মাহতিম ধীরগতিতে হাঁটতে-হাঁটতে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো, ট্রাউজারের লেফট পকেট থেকে ফোন বের করে কল বসালো, ধোয়া উঠা কফিতে চুমুক দিতেই বাঁকানে রিসিভ হওয়ার টিউন শুনতে পেলো। চুমুক শেষে মগ নামাতেই ঝারি লাগিয়ে বললো,

– কিরে ব্যাটা, রিসিভ করতে এতো টাইম লাগলো কেন? থাকিস কোথায়? তোর ভাবী আম্মার খবরটা চটপট দে। আবার যদি ‘ আমার বউ, আমার বউ ‘ করতে দেখি, থাপড়ে দাঁত তুলে আনবো।
ওপাশ থেকে গাঁইগুই করতে-করতে শেষে রাগ দেখিয়ে বললো,
– নিজে খেয়াল রাখতে জানো না? আমাকে শাষাচ্ছো কেনো? সারাদিন তো ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে সময় কাটাও আমার অবস্থা কি করে বুঝবে?
কফিতে চুমুক দিতে গেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো মাহতিম। হাসতে-হাসতে আকাশের দিকে অন্যমনষ্ক হয়ে বললো,

– হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। আমিতো ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে দিন কাটাই। খুব আরামে কাটছে।
মাহতিমের মুখটা না দেখেও কন্ঠের ধাত শুনে চুপসে গেলো মাহদি। কথাটা আসলেই এভাবে বলা ঠিক হয়নি। সে তো জানেই তার ভাই শুধু-শুধু দূরে গিয়ে থাকছেনা, বাধ্য না হলে কেউ দূরে থাকতে চায়? মাহদি গুমোট অবস্থার ভেতর সকালের ঘটনাটা ব্যক্ত করবে কিনা চিন্তায় পরে গেছে। ভাবতে-ভাবতে শেষে প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়ে বলতে শুরু করলে হঠাৎ বিকট উল্লাসে ‘ স্যার এক্ষুনি আসুন ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠলো নোমান। গরম কফিতে কেবল চুমুক দিতে নিয়েছিলো মাহতিম, ওমন ভড়কে দেওয়া চিৎকার শুনে কফির আগুনতুল্য তাপটা ঠোঁটে লেগে গেলো ওর। সাথে সাথে ঠোঁটটার জ্বলুনির কমানোর জন্য দুপাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো জায়গাটা। কলটা অজান্তেই কেটে দিলো মাহতিম। কি থেকে কি হলো সেটা বুঝার আগেই কঠিন মেজাজে পিছু ঘুরে তাকালো। নোমান এই প্রথম বসের রাগ উপেক্ষা করে আশ্চর্য কন্ঠে হড়বড় করে বলতে লাগলো,
– আপনার ইমেইল চলে এসেছে স্যার। জলদি এদিকে আসুন, এক্ষুনি এদিকে আসুন। দেখে যান আপনার ইমেইল কোত্থেকে এসেছে। স্যার আপনি প্রচণ্ড খুশী হয়ে যাবেন, আপনার এ্যাফ্রড ভেস্তে যায়নি।

নিরবে-নিভৃতে সতেরটা শাড়ির নিঃশেষ করার ঘটনা বাড়ির মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলো। সেই সঙ্গে চাহর হয়ে গেলো রুমটার ভেতর অজ্ঞাত কেউ তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখার পর মারজার অবস্থা বাকশূন্য। তিনি ডাক্তারের কাছ থেকে চেকআপ সেরে সদ্য বাড়িতে পা ফেলেছেন, পা ফেলতেই তিনি জঘন্য ঘটনার বিবরণ শুনে হতবাক। তিনি রীতিমতো ভেবেই পাচ্ছেন না, মেহনূরের ব্যক্তিগত জিনিসের প্রতি এতো ক্ষোভ কিসের? মেহনূর পুরো ব্যাপারটা বিশদ ভাবে জানালেও মারজা অদ্ভুতকাণ্ডের মতো নিরব রইলেন। কোনোপ্রকার বাক্য খরচ না করে ছাদের রুমটা দেখে এলেন, উপস্থিত সকলের পানে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শেষে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললেন,

– তুই আমার রুমে আয়। এক্ষুনি আসবি। রান্নাঘরের দিকে যাবি না, মাহতিমের রুমেও ঢুকবিনা। সোজা আমার রুমে এসে দেখা করবি।
কথার ধাঁচ দেখে চোখ ছোট করে তাকালো রজনী ইবনাত। মুখে কিছু না বললেও মনে-মনে ঠিকই মূখ্য ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে। সবাই যেখানে উপস্থিত ছিলো, অনামিকা সেখানে উপস্থিত ছিলো না। এটা নিয়ে কারোর মনে সন্দেহ না জাগলেও আসল ব্যক্তির মনে ঠিকই সন্দেহটা পাকাপাকি হয়েছে। মারজার প্রস্থানের পর রজনীও সেখানে মূহুর্তক্ষণ না দাঁড়িয়ে চলে যায়।

নিজের রুমের দিকে আসার আগে চলন্ত পাদুটো অনামিকার রুমের কাছে থেমে যায়। দু’কানে এয়ারপড গুঁজে বিছানার হেডসাইডে পিঠ হেলিয়ে বসে আছে অনামিকা। চোখদুটো শান্তভঙ্গিতে বন্ধ করা, ঠোঁটদুটো যেনো গানের তালে-তালে নড়ছে, নিঃশব্দে আলোড়িত হচ্ছে কম্বলের ভেতরে থাকা পাদুটো। রজনী এ দৃশ্য দেখে দরজায় নক করলো না, কঠিন মেজাজে রুমে ঢুকে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো। তীব্র শব্দে বিছানা কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো অনামিকা, হড়কে গিয়ে কান থেকে এয়ারপড দুটো খুলে এলো, হাতের ফোনটাও কোলে পরে গেলে চোখ-মুখ ক্রুদ্ধ করে দরজার দিকে তাকালো। নিমিষেই সমস্ত রাগ যেনো তরলে পরিণত হলো অনামিকার, ছোট্ট একটা ঢোক গিলে আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ব্যর্থতা চারিদিক থেকে আগলে ধরলে নিরুত্তেজ দৃষ্টিতে তাকালো সে। রজনীর দিকে আমতা-আমতা করে গলা ভিজাতেই সঙ্কোচ সুরে বললো,

– ফু-ফু-পি তুমি এসেছো? দরজাটা খুব জোরে লাগালে কেনো?
রজনী বিছানার কাছে এসে চট করে অনামিকার দিকে এগিয়ে এলেন। বিছানার হেডসাইডে একহাত রেখে অনামিকার মুখ বরাবর ঝুঁকলেন। রজনীর কঠিন দৃষ্টি দেখে অনামিকৃ ভীতপূর্ণ উদভ্রান্ত চাহনিতে গুটিয়ে গেলো, রজনী তার অন্যহাতটা এগিয়ে খপ করে অনামিকার চোয়াল চেপে ধরলেন। অনামিকাকে বিন্দুমাত্র গোঙানোর সুযোগ না দিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলতে লাগলেন,

– রাতের বেলা পাকনামো করতে কে বলেছিলো? ওখানে গিয়েছো কোন্ সাহসে? আমি হাজার বার বলেছি আমি কোনো ভুল চাই না। মারজা ভাবী ঠিকই তোমাকে সন্দেহ করে ফেলেছে। একমাত্র তুমিযে এমন বিকৃত মস্তিষ্কের মতো কর্মকাণ্ড করতে পারো, সেটা উনার অজানা নয়।

রজনীর বড় বড় নখগুলো গালের চামড়ায় দাগ বসে যাচ্ছিলো, নখের তীব্র জ্বালা-যন্ত্রনায় আকুতি দৃষ্টিতে তাকালো ফুপুর দিকে। আপন ফুপুর আচরণ যে কতটা কঠিন, কতটা পাশবিক হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই তার জন্য গোপন বিষয় নয়। রজনী সত্যিই মেহনূরের আশ-পাশ থেকে দূরে থাকতে বলেছিলো, সঙ্গে এটাও বলেছিলো সে যেনো কূটকৌশল না খাটাতে যায়। অনামিকা বুঝতেই পারছেনা, এবার মাহতিম নেই জেনেও কেনো তার ফুপি চেপে-চেপে চলছে। এমন পিছিয়ে-পিছিয়ে নিরব থাকার মানে কি?

এসবের মূল সারাংশ আসলে কোথায় গিয়ে ঠেকছে? অনামিকাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রজনী ইবনাত। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন, দরজার নব্ ঘুরিয়ে ফাঁক করে ফেললে একপলকের জন্য পিছু ফিরে তাকালেন। অনামিকা তখন বিপদমুক্ত হওয়ার আভাসে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ছিলো, স্বাভাবিক কায়দায় স্থির হতেই হঠাৎ একজোড়া ক্রুদ্ধদৃষ্টি দেখে আবার ভয়ে শুকিয়ে গেলো। নিজের শঙ্কিত অবস্থাকে আড়াল করার চেষ্টায় জোরপূর্বক হাসি দিলো অনামিকা। কিন্তু কোনো লাভ হলো না, অনিমেষ নেত্রে চেয়ে থাকা অগ্নিদৃষ্টিটা ততক্ষণে পা চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে।

নতশীর্ণ মুখে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো মেহনূর। শ্বাশুড়ির তলব-ধ্বনি শুনে মনটা ভয়ে আক্রান্ত। মাথায় ঘোমটা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও সেটা আপাতত শ্বাশুড়ির নির্দেশে পালিত হয়না। মেহনূর আচঁলখানা পিঠের উপর টেনে নিয়ে শ্বাশুড়ির মস্ত বিছানার দিকে এগুতে লাগলো। দৃষ্টিদুটো চকচকে টাইলসের উপর স্থির থাকলেও আড়চোখে মারজার কঠিনমূর্তিটা দেখে নিলো।

বিছানায় আসন করে বসে জানালার দিকে মুখ করে আছে মারজা, পিঠ দিয়ে আছে মেহনূরের দিকে। মেহনূর পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসে খাটটা অতিক্রম করে মারজার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। মারজা একপলক চাহনিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন, মেহনূরের সংকুচিত হৃদয়ের উদ্বেগ অবস্থা দেখে পাশে বসার নির্দেশ দিলেন। শ্বাশুড়ির আদেশে শির ঝুঁকানো অবস্থায় বিছানায় বসলো মেহনূর, ওমনেই তার মুখোমুখি হয়ে সুতীক্ষ্ম চাহনিতে আঁটসাঁট হয়ে বসলেন মারজা। অন্যসময় মেহনূরের হাতদুটো মাতৃতুল্য কোলের উপর দৃঢ়ভাবে টেনে নিতেন, সুকোমল হাতদুটো ধরে স্নেহের চুমু দিতেও দেরি করতেন না। আজ ব্যতিক্রম কাণ্ড ঘটানোর পাশাপাশি তিনি কন্ঠস্বর দৃঢ় করে বললেন,

– রুম থেকে আর কিছু খুইয়েছে? হারিয়েছে কিছু?
মেহনূর একটু সময় নিয়ে ভেবে নিলো, এরপর নতমুখেই মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে জবাব বুঝিয়ে দিলো। মারজা উত্তর পেয়েও স্বস্তিসূচকে ফিরলেন না। জেরার প্রসঙ্গটা বজায় রেখে মেহনূরকে আবার প্রশ্ন করে বললেন,
– তোর সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেছে? মন ঝেড়ে উত্তর দিবি। আমার কাছে কিচ্ছু লুকানোর চেষ্টা করবি না।
মেহনূর এবার মাথা তুলে শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো। শান্ত-নিবিড়ভাবে বললো,
– না মা, আমার সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করেনি। আমি মিথ্যা বলছি না।

মারজা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর মেহনূরের পেছনে থাকা দেয়ালঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে এবার মেহনূরের পায়ের দিকে তাকালেন। ভারী একটা নিশ্বাস ছাড়তেই রুমটার ভেতর নিশ্বাসের শব্দ ছড়িয়ে পরলো। তিনি মেহনূরকে আড় ভেঙ্গে কিছুই বললেন না, পায়ের অবস্থা দেখে নির্দেশ দিলেন বিছানা না উঠতে। কথাটুকু শেষ হওয়া মাত্র নিজেই বিছানা ত্যাগ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এমন অত্যাশ্চর্য আচরণ দেখে আস্ফালন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় ঠাহর করতে পারলো না মেহনূর। মারজা মন শক্ত করে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে পা বাড়িয়ে গেলেন, ওড়নাটা মাথার উপর ভালোমতো টেনে নিয়ে কাঙ্ক্ষিত রুমটার ভেতরে ঢুকলেন। কোনোপ্রকার সৌজন্যতা না দেখিয়ে একেবারে রজনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। রজনী ফোনে ব্যস্তভঙ্গিতে কথা বলছিলো, দরজা দিয়ে মারজাকে ঢুকতে দেখে সে আর কথা বলতে চালাতে পারলো না, ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চট করে কলটা কেটে দিলো। মারজার মুখের অবস্থা দেখে সন্দেহাতীত ঘটনা নিয়ে বিচলিত হলো রজনী, তবুও যতদূর সম্ভব সেটা আড়াল করে কৌতুহল গলায় বললো,

– কিছু হয়েছে মারজা আপা? আপনার মুখ এমন মলিন দেখাচ্ছে কেনো? আপনি কি মেহনূরের —
কথার মাঝপথে ছিদ্র বসিয়ে কঠোর আভাসে বললেন মারজা,
– অবশ্যই কিছু হয়েছে। আমার পিঠ-পেছনে এরকম ঘটনা আশা করা যায়নি ভাবী। আমি যখন বাড়ির বাইরে থাকি, তখন পুরো বাড়ির দায়ভার আপনার উপর দিয়ে যাই। আপনি আমার অনুপস্থিতিতে কেমন খেয়াল রেখেছেন? আমি নিতান্তই অসুস্থ মানুষ। ঔষুধের জোরে টিকে আছি। তাই বলে এমন দিন দেখতে হলো? আমারই বউয়ের রুমে ওসব তছনছ অবস্থা? আমিতো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
মারজার উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে কিছুটা স্বাভাবিক হয় রজনী। পুরো বিষয়টাকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে সামাল দেওয়ার জন্য মিথ্যা চিন্তার অভিনয় করে বিচলিত সুরে বললো,

– আমার ভুল হয়েছে আপা। অনামিকার জন্য লজ্জায় এখন মুখ দেখাতে পারছিনা। ও রাগের ঝোঁকে কাজটা করে ফেলে আপা। ওর বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। এদিকে ভাইজানেরও শেষমূর্হতে কাজের খবর এসে যায়, আপনিতো জানেন ভাইজান পলিটিক্সের মানুষ। দিনে কতলোকের সাথে উঠাবসা করা লাগে তার হিসেব নেই। তাই জন্য ভাইজান অনামিকাকে বাধ্য হয়ে না করে দেন। ও বুঝতে পারেনি, রাগের মাথায় কাজটা করার পর হুঁশ ফেরে। ততক্ষণে যা হওয়ার সব হয়ে গেছে। আমার কাছে রাতে এসেই কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। আপা আপনার হাতদুটো ধরি, আপনি মেয়েটাকে মাফ করে দিন। মেহনূরের শাড়ির ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি, বিকেলের মধ্যেই হোম ডেলিভারী করিয়ে দিবো।

রজনী এখানেই ক্ষান্ত হলো না, যতপ্রচার বশীভুত কথাবার্তা আছে সব একে-একে ফলানো করে মারজার মন সিক্ত করলো। মারজা ক্রুরহৃদয়ে এসেছিলেন ইচ্ছামতো কথা শোনাবেন বলে। পরক্ষণে ব্যাপারটা এমনভাবে উলটে যায়, মারজা তখন সমস্ত রাগ ঝেড়ে বিগলিত হৃদয়ে চলে যান। মারজাকে আজকের মতো জব্দ করতে পেরে বুকের উপর থেকে দশ টনের পাথর সরে গেলো রজনীর, ভারমুক্ত হয়ে হাঁফ ছাড়তে-ছাড়তে ধপ করে ডিভানে বসলো সে। মারজা যেমন সরল-সহজ মন নিয়ে চলাফেরা করে, তেমনি আকস্মিক রাগ নিয়ে আগমন হলে সেটা সামলা নেওয়া তেমন কঠিন কিছু না। সমস্যা হলো, অনামিকা যদি আবারও অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপারগুলো ঘটায় তাহলে সোজা মাহতিমের কান অবধি পৌঁছে যাবে। বাড়ির প্রতিটি কাজে মূখ্য কর্তা হিসেবে এখন মাহতিমই গণমান্য, তার একটা কথার উপর দ্বিতীয় কথার প্রলেপ পরার সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই সে স্বাভাবিক চিন্তাধারার ব্যক্তি, হাসিখুশী থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু রাগ যখন তুঙ্গস্পর্শী হয় তখন সেটা নিচে নামানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাকে থামানো, বুঝানো, শান্ত করার জন্য নিজেরই ধৈর্য্য যেনো অসহায় হয়ে যায়, অধৈর্য হয়ে বিগড়ে যায় মেজাজ। যার মুখটা হাসিতে ভরপুর, তার রাগটা ততই ভয়ংকর।

গ্রামের চিরপরিচিত পরিবেশ নিয়ে যদ্দূর বর্ণনা খাটে, তাতে হয়তো সরল-সহজ জীবনযাত্রার দৃশ্যপট ফুটে উঠে। চিত্রিত হয় সবুজে ঘেরা মেঠোপথের রাস্তা, মানসপটে ভেসে উঠে সরলভাবে রোজগার করা পুরুষ কর্তার শ্রম। দিনের শুরুটা সূর্যাদয়ের সঙ্গে আরম্ভ হয়েছিলো, জাগতিক কর্মকাণ্ডগুলো শুরু হয়েছিলো স্বাভাবিক নিয়মে। খাঁ খাঁ করা খরাক্রান্ত জমি, মাথার উপর জলন্ত সূর্যপিণ্ড দাপুটে রাঙা ছড়াচ্ছে। জমির একদিকে টিনের বাংলাবাড়ি বানানো, বাড়িটাও পুরোনো হয়ে টিনের উপর জংয়ের আস্তরণ পরেছে। আশেপাশে কোনো জনবর নেই, দূর-দূরান্ত শুধু ফসলি জমির জায়গা। যারা ফসলী জমিতে এতোক্ষণ কাজ করছিলো, তারাও দুপুরের আহার সারার জন্যে বাড়িমুখী হয়েছে।

নির্জন ধূ ধূ করা মাঠের সেই বাংলাবাড়িতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে এক লোক। যার বয়সটা চল্লিশ পেরিয়ে পয়তাল্লিশের কাছাকাছি এসেছে। পড়নে ময়লা লুঙ্গি, গায়ে পাতলা ধরনের গোল ছলার গেন্ঞ্জি। সাদা গেন্ঞ্জিটা এখন আর সাদা নেই, সাদা রঙকে ভিজিয়ে-ভিজিয়ে রক্তিম রঙে চুপচুপে হয়ে গেছে। চোখের ডানকোণা ফেটে র’ক্ত ঝরছে অনবরত, মুখ দিয়ে ঝরছে বিন্দু-বিন্দু র’ক্ত, হাতদুটো পিছমোড়া করে বাধঁলেও পাদুটো শক্ত শিকলে পেঁচিয়ে রেখেছে। নিশ্বাসের গতি এতোটাই ধীর ভাবে চলছে, লোকটা নিশ্বাস নিতেও যেনো ম’রণ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। বুকের ছাতি যেনো ফেটে যেতে চাইছে তার, গলা শুকিয়ে খরার মতোই রুক্ষ হয়ে গেছে, চক্ষুর লোলুপদৃষ্টি যেনো ঝাপসা-ঝাপসা।

হঠাৎ মাথার উপর কঠিন ব্যথা অনুভব করলে চিৎকার করতে গেলো লোকটা, কিন্তু আফসোস, গলা ভেদ করে শেষ শব্দগুলো যেনো কুন্ডলী পাকিয়ে আঁটকে যাচ্ছে। চিৎকার করতে যেয়ে ব্যর্থ হলে জোরে-জোরে কাশতে থাকে লোকটা, তখুনি ঝাপসা দৃষ্টির সামনে টিনের বদ্ধ দরজাটা দু’ধার বরাবর খুলে গেলো। উন্মুখ দুয়ার দিয়ে ঢুকলো কয়েক জোড়া পদযুগল। ঝাপসা দৃষ্টিতে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা লোকটা, গোঙানির মতো চেঁচাতে গেলে ঠোঁটের কিনারা দিয়ে তরল রক্ত পরতে লাগলো তার। মাথাটা নিচে নোয়ানো থাকলেও আকস্মিকভাবে আবারও চুলে টান খেয়ে মাথা তুলে তাকালো, বুজে আসা চোখ দিয়ে পিটপিট করে তাকাতেই অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলো সামনে এখন কে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা হলফমাত্র দেরি করলো না, ভয়ে-আতঙ্কে উপস্থিত সবার সামনেই হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। টিনের ঘরটার ভেতর লোকটার ক্রদনধ্বনি দফায়-দফায় বেজে উঠছিলো, পদযুগল এসে একদম কাছাকাছি থামলো। কেবল একজোড়া বৃদ্ধ পা এসে দু’কদম বেশি এগিয়ে এলো। লোকটা কান্না স্ফীত না করে হাউমাউ করেই বলতে লাগলো,

– আমারে ছাইড়া দেন হুজুর। ও হুজুর, আমি ভুল করছি আমারে মাই’রেন না। আমি আপনারে কিডনী বেইচা হইলেও টেকা পরিশোধ কইরা দিমু। আমারে এইবারের লিগা ছাইড়া দেন হুজুর, আমি কারুর কাছে কিচ্চু কইবার যাইতাম না। এই দেহেন কিরা কাইটা কইতাছি, আমি কালকাই আপনের টেকা দিয়া যামু। আমারে মাই’রেন নাগো হুজুর। আমার বউ পোলাপাইন ক্যামনে চলবো? আমি ছাড়া ওগোরে কেউ দেখতো না হুজুর।
বৃদ্ধ পদজোড়ার ব্যক্তিটা কথাগুলো নিরবে শুনলেন, শোনার কয়েক মূহুর্ত স্থির থেকে মাটিতে নতজানু হয়ে বসলেন। মাটিতে বসার দৃশ্য দেখে চেলারা সবাই হৈহৈ করে মাদুর-পাটি বিছিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু বৃদ্ধ লোকটার আঙ্গুলী নির্দেশ দেখে সবক’টা সেখানেই থেমে গেলো। ক্ষতবীক্ষত লোকটা অশ্রু টলটল চোখে বৃদ্ধর সহানুভূতির আভাস পেয়ে শান্ত হতে লাগলো, কান্নার হিড়িকে কাঁপতে-কাঁপতে বললো,

– হুজুর…
চোখের পলকে সবকিছু বীভৎস অন্ধকারে ছেয়ে গেলো, কানের ভেতর মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করতে-করতে মাথাটা ঝিমিয়ে এলো। ঝাপসা দৃষ্টিটা আরো সংকুচিত হতে-হতে ধপ করে মাটিতে লুটিয়ে নরলো। চোখের সামনে প্রহেলিকার অন্ধকারে ছেয়ে গেলো লোকটার, ফে’নকি দিয়ে তরতর র’ক্ত-বন্যা জায়গাটা সিক্ত করতে লাগলো। নতজানু অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ, মাটিগুলো ঝাড়া দিতে-দিতে চেলাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ওর বাড়ির কেউ জানে?
উক্ত চেলাটা ব্যস্তভঙ্গিতে উত্তর দিলো,

– না, মোল্লা হুজুর। ওর বাড়িতে কেউ জানে না। জানে ওয় আবার গান্ঞ্জা টানতে উধাও হইয়া গেছে। কেউ ওর খবর মালুম করতে পারবো না মোল্লা হুজুর। আমি আপনারে নিচ্চিন্ত দিতাছি। ওর আষ্টগুষ্ঠিও ওর খবর উদ্ধার করতে পারবো না। আপনে ঠান্ডা মাথায় বাড়িত যান। বাকিডা আমরাই দেখতাছি।
গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে হাতদুটো কোমরের কাছে বেঁধে নিলেন হান্নান শেখ। যেই ভঙ্গিতে তিনি এখানে এসেছিলেন, একই ভঙ্গিমা বজায় রেখে চুপচাপ সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। তিনজন চেলা আগে থেকেই পথঘাটের অবস্থা দেখে এসেছে, রাস্তায় মোসাদ্দেক চাষা ছাড়া আর কেউ ক্ষেতে ফিরেনি। তারা হান্নান শেখকে অন্য রাস্তার খবর দিয়ে সেদিক বরার বাড়ি ফিরতে বলে দিলেন, হান্নান শেখ আবারও ধূর্ততার সাথে সকল গ্রামবাসীর চক্ষু আড়ালে কাজ সেরে এলেন। নিজের বাড়িতে ফিরে কলপাড়ে গিয়ে সাদামাটা ভাবেই হাতমুখ ধুলেন, সুজলাকে একগ্লাস পানির চাহিদা প্রকাশ করে নিজের ঘরের দ্বার ঠেলে ঢুকলেন। ঘরের এককোণে থাকা আলনা থেকে শুকনো গামছা নিয়ে মুখ মুছতেই সুজলা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ‘ আব্বা, আপনার পানি ‘ বলতেই হান্নান শেখ প্রসন্ন হাসিতে বললেন,

– বাইরে দাঁড়ানোর দরকার নেই বড় বউ। ভেতরে এসে গ্লাসটা রাখো।
সুজলা ঘরে ঢুকে ছোট্ট কাঠের টেবিলে গ্লাস রাখতেই হান্নান শেখ কনুই পযর্ন্ত হাত মুছতেই বললেন,
– আমার নাতনীটার কোনো খবর আনছো বড় বউ? শানাজের সাথে যোগাযোগ হয়?
সুজলা উদাস মুখে চোখ নামিয়ে বললো,
– আব্বা, শানাজের ফোনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে। ওটা নাকি কাজ করেনা। সুরাইয়া রাগ দেখিয়ে ফোনটা যে আছাড় মারলো, ওটা আর ঠিক হয়না।

হান্নান শেখ ভাবুক ভঙ্গিতে গামছাটা সুজলার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। সুজলা শ্বশুড়ের ভেজা গামছাটা নেড়ে দেওয়ার জন্য চলে গেলে হান্নান শেখ তার ইজিচেয়ারে গিয়ে বসলেন। চোখদুটো শ্রান্তিতে ঢুলে আসছে, ইজিচেয়ারে দোল খেতে-খেতে তিনি জীবনের মস্ত বড় ভুলটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মারজাকে যখন বিয়ে দেওয়া হলো, তখন হয়তো জানাই ছিলো সে সেনাসদস্যের স্ত্রী হয়েছে। মারজার সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্নতার বিশেষ কারণ হয়তো এটাই ছিলো, মারজার স্বামীর পেশাগত জীবন।

হান্নান শেখ স্বেচ্ছায় মারজার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, কিন্তু মারজার সেই স্বামীই যখন দুনিয়ায় নেই, তখন এসব নিয়ে আর চিন্তায় পড়তে হয়নি। মারজা বহু বছর পর তার ভিটেবাড়িতে ঘুরতে এসেছিলো, স্বপরিবারে না এলেও যাদের নিয়ে এসেছিলো, বেশ ভালো করেই খাতির করেছে হান্নান শেখ। এখানেই তিনি বিশাল বড় ভুলটা করে ফেলেন। যেই ছেলেকে তিনি সহজচিত্তের সুপুরুষ ভেবেছিলেন, ওই ছেলে সহজের কাতারে কোনোদিন পরতোনা। মারজার ছেলেকে নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করার ইচ্ছা তার ছিলো না, ওরকম মনোবৃত্তিই তার উদয় হয়নি। মারজা যখন নিজ থেকেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন, তখন আশেপাশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে মেহনূরকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেন। আচ্ছা, মেহনূর কি আদৌ এ বিয়েতে মন থেকে রাজী ছিলো?

দেশের সর্বত্র নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। আকাশে সূর্যের দেখা নেই। ভারি-ভারি মেঘের আড়ালে ঢাকা পরেছে সূর্যটা। খুব যে একটা ঠান্ডানুভব হচ্ছে তাও অবশ্য না। মেঘগুলো যেনো বিষণ্ণতায় উত্তীর্ণ হয়ে সূর্যকে আড়াল করে দিয়েছে। তার উপর পৃথিবীর এ প্রান্তে আজ কড়া আলো পরেনি। সময়ের আবহকাল ছুটতে-ছুটতে দিনপন্ঞ্জিকার মাসগুলো পালটে দিচ্ছিলো। জাদুদণ্ডের কারসাজির মতোই পেরিয়ে যাচ্ছিলো ঋতুময় চক্রটা। মারজা দিনকে-দিন অসুস্থ হয়ে পরছিলেন, মাথার যন্ত্রণার জন্য নানাপদের ঔষুধ গিলতে হত। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি শয্যাশায়ী থাকতেন, প্রচণ্ড যন্ত্রনায় কাতরাতে-কাতরাতে একপর্যায়ে ঘুমে ডোজে ঘুমিয়ে পরতেন।

মেহনূর চারটা মাসের ভেতর পুরো আনসারী নিবাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। চুপচাপ-নিরবে কাজ সেরে যাওয়াই মেহনূরের আসল কর্ম ছিলো, নিজেকে সংসারের হালে মিলিয়ে নিলে আস্তে-আস্তে অনেক কিছুই বুঝতে শিখলো। জীবনের গম্ভীরতা আজও তাকে কঠিনভাবে ভুগাচ্ছে, সে এখনো কারোর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেনি। মারজার সাথে যতটুকু হৃদতাপূর্ণ মধুর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কেবল মাহদির সাথে একটু-আধটু। রজনী যে কিসের জন্য নিরব থাকতো, সেটা আস্তেধীরে বুঝতে লাগলো অনামিকা। চার-চারট মাস কচ্ছপের খোলসের মধ্যে মাথা গোঁজ করে আছে রজনী, কাঙ্ক্ষিত সময়টার জন্য যেনো বাঁকা হাসিতে অপেক্ষা করছে সে। পন্ঞ্চম মাসটার শুরুর দিকে ভিডিও বার্তায় যুক্ত হলো আটজন, আজ তাদের সম্মেলনে মাহদি যুক্ত নেই। সময়টা বাংলাদেশ টাইম রাত দুটোর দিকে চলছে, অন্যদিকে আমেরিকায় চলছে সকাল বারোটার মতো। দু’দেশের দু’প্রান্ত থেকে মোবাইল-পিসি-ল্যাপটপে একত্র হলো সবাই, প্রথমে হাসি-ঠাট্টায় কুশল চললো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে চিন্তিত বিষয়ধারা চলে এলে ফারিন প্রথম প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো,

– আচ্ছা তোমরা একটা কথার জবাব দিবে? আমি জাস্ট ফ্যাড আপ হয়ে গেছি, তবুও কোনো আন্সার বের করতে পারলাম না। রজনী মামীকে কেনো আমরা ভয় পাচ্ছি? কেনো আমরা ওই মহিলাকে ভয় পাচ্ছি? আমি নীতি আপুকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, বাট নো আন্সার। তৌফ ভাইয়াকে কোয়াশ্চ্যানটা করলাম, সে এ্যাজ-অলয়েজ আমাকে ঝারি মারলো। আমার প্রশ্নের উত্তর কেউ দিবে? প্লিজ আমি কোনোভাবেই তোমাদের ভীতু হওয়ার রিজ্যান ধরতে পারছিনা। তোমরা কেনো আমাকে ছোট-ছোট করে আন্সারটা দিচ্ছো না? আমিতো মুখচোরা না, পেট-পাতলাও না।
ভিডিও কলের আওতায় সবাই যেনো চুপ রইলো। চুপটি থাকার পর নীতির কাছেই বিষয়টা উদ্ভট ঠেকতে লাগলো। আসলেই তো, কেনো ফারিনকে এ বিষয়ে বলা হচ্ছে না? আর কতো চুপিচুপি? নীতি সব চিন্তা উপেক্ষা করে গলা পরিষ্কার করে নিলো, কানের এয়ারপডটা ঠিকঠাক করে শান্ত গলায় বললো,

– ফারিন শোন, রাগ করিস না। তোকে না বলার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, কিন্তু টেনশনে ছিলাম যদিনা আবার প্রবলেম ক্রিয়েট করে দিস। শোন তাহলে, রজনী মামীর ভা —–
কথাটা ভয়ংকর ভাবে ছিনিয়ে নিয়ে চট করে বলে উঠলো সিয়াম,

– তুই চুপ কর্। তোর ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে কান দিয়ে র’ক্ত বের হইবো। আমি বলি, রজনী বেডির ভাই একটা তুখোড় মাল। রাজনীতি করে, একনামে সবাই চিনে। তুইও দামী মালটারে চিনোস। নাম আর ভাঙ্গায়া বললাম না। আগুন-আগুন যুদ্ধ লাগলে কেমন অবস্থা হইবো চিন্তা করছোস? চিন্তা করোস নাই। মাহতিম যদি শান্ত থাকতো ওরে নিয়া টেনশন কাজ করতো না, ওর মেজাজের উপর বিশ্বাস নাই ফারিন। যদি একবার খারাপ হয় জানো’য়ারের মতো সবগুলারে ছিঁ’ড়া ধরবো। ওই বেডিরে আমরা ভয় পাই না ফারিন।

ভয় পাই ওই লোকটারে। ওই লোক খুবই পাওয়ারফুল। আমার নিজের বাবা পযর্ন্ত ওই লোকটার কাছে যাওয়ার আগে দশবার ভাবে। নাহলে অনামিকারে আমরা ছাড়তাম? ওরে না চুলের মু’ঠি ধইরা কাদার মধ্যে ডুবাতাম! সাহস আছে ঠিকই, কিন্তু ভয়টা কোনদিকে করতেছে এইটা একটু বুঝিস ফারিন। সবাই আমাদের বাইরের অবস্থা দেইখা ভাববো, আমরা এমন দাপট দেখাই, অথচ সামান্য দুইটা ডাই’নীর কাছে কুঁজো হয়ে আছি ক্যান। ভাই, আমরা যতোই তোপ দেখাইতে যাইনা ক্যান, এইসব মানুষ ক্যামনে যে বুকের উপর কলি’জা টাইনা ধরবো আন্দাজও করতে পারবিনা।
ফারিন কোনো কথাই বলতে পারলো না। আস্তে করে কলটা কেটে গিয়ে অফলাইন চলে গেলো।

ঋতুচক্রের সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া যেনো বিচিত্র রূপে পালটে গেছে। নীলচে আকাশ যেনো ভারী-ভারী মেঘের বেশভূষায় গা ঢেকে নিয়েছে। আকাশটাকে ধূসরবর্ণে মূর্ছিত করে নিভিয়ে দিয়েছে দিনের আলো। ঠান্ডা শীতল হাওয়া যেনো জেঁকে বসেছে শহরের বুকে। শহরের নগরীতে যেনো হিমেল হাওয়ার তোড়জোড় চলছে। ঘড়ির সময়সীমা হিসেবে বেলা তিনটে বাজে, অথচ প্রকৃতির অবস্থা দেখলে মনেহয় সান্ধ্যাহ্নিক প্রহর। মেহনূর নির্মলচিত্তে সমস্ত কাজ সেরে আবারও প্রাণ-প্রনয়ের শূন্য শয্যায় বসে আছে। বসে-বসে উবু হয়ে মাহদির দেওয়া নতুন ডায়েরীতে নিজের শব্দ-সম্ভাষণ লিখছে।

রুমের ভেতরকার অবস্থা আজও আবছা অন্ধকার, যদিও সবগুলো জানালা খুলে দেওয়া। উন্মুক্ত জানালার পর্দাগুলো উত্থাল হাওয়ায় উড়ছে, টালমাটাল প্রকৃতির রূপ যেনো সস্নিগ্ধ ধারায় প্রফুল্ল। গাঢ় রেগুনি রঙের জামদানীটা কি ভেবে যে বাঙালী কায়দায় পরেছে জানা নেই, তবে বেগুনী ব্লাউজটার হাতটা এবার যেনো খাটো। মাথায় আজ ভুলবশত ঘোমটা দিয়েছিলো মেহনূর, কিন্তু বাতাসের দাপটের কাছে হার মেনে একনিমিষেই মাথা থেকে সরে গেলো ঘোমটার কাপড়। এক ঝটকায় সরতে গিয়ে মেদহীন পিঠটার উপর থেকেও আচঁলখানা খসে পরলো, উন্মুক্ত হয়ে উঠলো ব্লাউজ ও শাড়ির মধ্যবর্তী কোমরের অংশটা।

লিখতে গিয়ে ভারী বিরক্ত হলো মেহনূর, কলমটা ডায়েরীর পাতায় ফেলে হাত উলটে আচঁলখানা টানতে গেলো, কিন্তু বৃথা হয়ে চেষ্টাটুকুতে হাল ছেড়ে দিলো মেহনূর। রাশি-রাশি চুলগুলো খোপায় মুড়ে কাধের কাছে জড়সড় করে বেঁধেছিলো, সেখান থেকে চুল ছুটতে-ছুটতে অনেক চুলই কানের দুইধার দিয়ে বেরিয়ে পরেছে। ডায়েরীর পাতায় আবার মনোযোগ দিলো মেহনূর, প্রতিটা শব্দ যেনো হৃদয়ের আদর মাখিয়ে লিখছে। অশান্ত হাওয়ায় মত্ত প্রকৃতিটা মেহনূরের সাথে যেনো লুকোচুরি করে খেলছে। হাওয়ার সেই চন্ঞ্চলতা-অস্থিরতা-উন্মত্ততা সশব্দ সমারোহে শোঁ শোঁ করতে থাকলে চারিদিক থেকে মুখর হতে লাগলো গাড়ির বিকট হর্ণের আওয়াজ।

বাতাসের শোঁ শোঁ হাসিটার সঙ্গে নিরব যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দাপুটে হর্ণটা, সূদূর থেকেই যেনো বাজাতে-বাজাতে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে জানান দিয়ে আসছে। আগমনী সূত্রে সংকেত যেনো বাতাসের শব্দ চিড়ে পৌঁছে দিতে চাচ্ছে। উৎকট আওয়াজের যন্ত্রণায় চিকন দুটো ভ্রুঁ তৎক্ষণাৎ কুঁচকে এলো, সুকোমল ওষ্ঠাধর কঠোরভঙ্গিতে শক্ত হয়ে উঠলো। কলমটা আবারও ছেড়ে দিয়ে খোলা জানালার থেকে তাকালো মেহনূর। বিরক্তিতে চূর্ণ হয়ে কঠিন কিছু কথা বলতে নিচ্ছিলো, ওই সময়ই খেয়াল করলো কলমের নিপটা অজান্তেই বেরিয়ে গেছে, এদিকে ভকভক করে কালি বেরিয়ে ডানহাতটা কালিঝুলিতে বিশ্রী অবস্থা হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে হর্ণের শব্দ একবিন্দু হ্রাস হয়নি। মেহনূর আবারও খোলা জানালা দিকে শব্দ উৎসের জন্য কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। ইচ্ছা করছিলো এখুনি জানালা দিয়ে দেখে আসতে, কিন্তু কালির দূর্দশা দেখে হাতটা ধোয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো মেহনূর। তখনই বাতাসের সোল্লাসে বাইরে থেকে চিল্লানো সুরে ছুটে এলো কন্ঠধ্বনি,
– মেহনূর আফরিন, আনসারী হেয়ার!

চিৎকারের কল্লোলধ্বনি চর্তুদিকে জানান দিলো সে এসেছে। বাতাসের সাথে বেজে উঠলো পরিচিত কন্ঠের তেজীভাব। আজ বহুদিন, বহুকাল পর নীড়ের মাঝে ফিরেছে। ফিরেছে হাতে গোণা চারটি মাসের ব্যস্তময় কর্মজীবন কাটিয়ে। বাতাসের উত্থাল-পাত্থাল বৈরি অবস্থা প্রকৃতিকে অশান্ত করে দিচ্ছে, আশেপাশের ধূলো উড়িয়ে অন্ধকারকে ডেকে আনছে, আকাশের সূর্যহীন নিষ্ক্রিয় অবস্থা বারিধারার প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন। দিনের অবশিষ্ট আলোটুকু এক লহমায় চোখের পলকে নিভে গেলো, অন্ধকারকে ডেকে এনে বৃষ্টির সোল্লাসকে বরণ করলো। বড় বড় ফোঁটায় ঝপ করে বৃষ্টি নামলো তখন। মেদিনী ভিজিয়ে সিক্ত করলো ধূলোর কারসাজিকে।

ওয়াশরুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে আকস্মিক বর্ষণের দিকে তাকিয়ে আছে মেহনূর। হাতদুটো বেসিনের ট্যাপের নিচে সাবানমুক্ত করার জন্য ধীরেসুস্থে ধুচ্ছে, হাতের মুঠোদুটো কচলে-কচলে ধুতেই মনের ভেতর আওড়াতে লাগলো, ‘ তুমি আজ কেনো এলে বৃষ্টি? তোমাকে দেখলে বারবার ওই মানুষটার কথা মনে পরে। জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে যখন তোমাকে ছুঁতে যাই, তখন প্রথম ছোঁয়ায় যে শিরশির অনুভূতিটা হয়, যেই আনন্দাপ্লুত সুখটা মনের উঠোনে দোল লাগিয়ে দেয়, যেই একটুকরো হাসিটা ঠোঁটের উপর চনমনিয়ে ফুটে উঠে, তাঁর স্পর্শ পেলে, হাসি দেখলে, কন্ঠ শুনলে আমার কেমন অনুভব হয় তাতো বোঝানো অসম্ভব। আমিতো তাঁকে কিছুই বলতে পারিনা।

আমার এই না-বলা ভাবটা কবে শেষ হবে জানি না। আমার না-বলা কঠিন অনুভূতির কথাগুলো যদি প্রকাশ হয়ে যেতো, যদি কখনো উনি জানতে পারতেন আমি উনার প্রতিটি স্পর্শ-গন্ধ-কথা মনের কোণে সযতনে রেখে দিয়েছি, তখন কি উনি আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাতেন? উনার ওই শূন্য বুকটার উপর একটুখানি টেনে নিতেন না? আমার এই অর্ন্তমুখী স্বভাবটা আমার অন্তরটাকে বিরোধী বানিয়ে দিয়েছে, পদেপদে বিমুখ বানিয়ে আজ কতখানি ক্ষতি করে দিয়েছে তাতো লোকের কাছে দেমাকী, অহংকারী উপাধি হিসেবে খোটা পেয়েছি। আর কি চাইবার আছে কিছু? ‘

নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করে জানালা থেকে দৃষ্টি সরালো মেহনূর। জোরে এক লম্বা নিশ্বাস ছাড়লো। হাতের কালিগুলো হালকা হয়েছে বটে, তবে পুরোপুরি মিটে যায়নি দেখে বিরক্তিতে হ্যান্ডওয়াশে আবার চাপ দিলো। ফোস করে একটুখানি লিকুইড হাতের তেলোয় আসতেই পুনরায় ফেনা তুলে কালির জায়গাটা ধুতে লাগলো। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে বাঁহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ডানহাতের তালুটা সমানতালে ঘষতে থাকলো মেহনূর, ওমনেই দরজায় টুকটুক করে শব্দ করে উঠলো। সহসা হাতদুটো থমকে বেসিনের আয়নার দিকে দৃষ্টি তুললো মেহনূর, আয়নার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে পেছনে থাকা বদ্ধ দরজার উদ্দেশ্যে একপলক ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। তখনই বাইরে থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,

– দরজা খোলো মেহনূর।
মেহনূর বিরক্তিতে সেদিকে আর বিশেষ ভাবে পাত্তাই দিলো না। উলটো আকস্মিকভাবে রাগ দেখিয়ে কাজে লিপ্ত হলে হাত ধুতে-ধুতে বললো,
– আমাকে বিরক্ত করবেন না। দরজায় শব্দ করা বন্ধ করুন, এখান থেকে চলে যান।
মেহনূর ভ্রুঁ কুঁচকে কঠিন ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে কাজ করতে থাকলে আবারও বাইরে থেকে বাক্যসুর ভেসে এলো,
– আমি তোমাকে বিরক্তি করছি? রুমটা তো আমার। তুমি কাকে চলে যেতে বলছো?
প্রচণ্ড বেখেয়ালি ছিলো মেহনূর। এমনেই কালির উটকো যন্ত্রনার জন্য রাগ লাগছে, তার উপর বাইরে থেকে এরকম উদ্ভট কথা শুনে বিরক্ত হয়েই জবাব দিলো,
– হ্যাঁ, আপনাকেই চলে যেতে —-

ট্যাপের নিচে কচলাতে থাকা হাতদুটো থেমে গেলো এবার। বুকটায় ধড়াস করে কড়াঘাত বাজতেই গলা শুকিয়ে এলো মেহনূরের। অত্যাশ্চর্য চাহনি নিয়ে ধীরে-ধীরে মাথা তুলে আয়নার দিকে তাকালো, শান্ত-স্থির-স্বাভাবিক নিশ্বাসগুলো ক্রমশ অশান্ত-অস্থির-অস্বাভাবিক হয়ে উঠলো। গলা শুকিয়ে যেনো ঠোঁটের বাষ্পটুকুও শুষে ফেলেছে, খরার মতো শুষ্ক ঠোঁটদুটো মুখের ভেতরে পুড়ে জিভ দিয়ে সিক্ত করলো মেহনূর। ছলছল করে ট্যাপের পানিটাও বন্ধ করার মতো হেলদোল নেই তার , থেমে-থেমে জোরে নিশ্বাস টানতেই বুকটা ক্রমাগত উঠা-নামা করছে। মেহনূর কাঁপা-কাঁপা গলনালিতে বহুকষ্টে ঢোক গিলে মাথা পিছনে ঘুরালো। ট্যাপটা ওভাবেই ছেড়ে মূঢ় ভঙ্গিতে নির্বাক দৃষ্টিতে দরজার দিকে পা বাড়াতে লাগলো। হাঁটতে গিয়ে যেনো ওয়াশরুমের ফ্লোর থেকে ভুলবশত শাড়ি না ভিজে না, সেজন্য বাঁহাতে কুচিগুলো ধরে ধীরগতিতে শাড়িটা উপরে তুললো।

দরজার মুখোমুখি এসে ডানহাত এগিয়ে খট করে ছিটকিনি খুললে দরজাটা তখন সরু মতোন ফাঁক হলো। মেহনূর আরেকবার নিজেকে আশ্বস্তরূপে স্বাভাবিক করার উছিলায় চোখ বুজে ঢোক গিললো, দরজার রূপালি হ্যান্ডেলটা ধরে হালকাভাবে টান দিয়ে নিচুদৃষ্টিতে রুমের ভেতরে পা ফেললো। মুঠোয় ধরা কুচিগুলো ছেড়ে দিয়ে নত দৃষ্টিটা উপরে তুলতে লাগলো মেহনূর, উপরে তুলতেই তৎক্ষণাৎ শূণ্য বিছানার দিকে নজর আঁটকে গেলো। দৃষ্টিজোড়া আর উপরে তুলতে পারলো না। শরীরের উপর তখনই বয়ে গেলো ঠান্ডাশীতল হাওয়া, ফুলানো বুকের নিশ্বাসটা ওই ছোট্ট বুকের মধ্যেই আঁটকে গেলো, হাতদুটো সাথে-সাথে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেলো মেহনূরের। যেই বিছানায় একটু আগে ডায়েরী-কলম-বই ছাড়া অন্য কোনো বস্তু ছিলো না, এখন সেখানে নেভি ব্লু শার্টটা খুলে রাখা আছে কোমরের কালো কুচকুচে বেল্টটা শার্টের একপাশে জায়গা নিয়েছে।

ব্রাউন রঙের ঘড়িটাও উলটো হয়ে নির্বিকারে ঠাঁই নিয়েছে যেনো। পুরো রুমের ভেতর কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে, নিশ্বাস টানলেই যেনো তিরতির করে মোহনীয় সুভাষটা ইন্দ্রীয়শক্তিকে পৌঁছে যাচ্ছে। মেহনূর অবলীলায় বিশ্বাস করতে বাধ্য, এই মূহুর্তে কি হতে যাচ্ছে। নিজের বেখেয়ালি ভুলের জন্য আবারও তার সাথে রুষ্ট আচরণ করেছে মেহনূর। দফায়-দফায় খারাপ ব্যবহার পেয়ে নিশ্চয়ই মানুষটা স্থির মেজাজে থাকবেনা। তাঁর রুক্ষ আচরণের কঠোরতা না দেখলেও চড়া মেজাজের শঠ ধ্বনি ঠিকই শুনেছে মেহনূর। বিছানায় যেভাবে শার্ট-বেল্ট-ঘড়ি ফেলে রেখেছে, তাতে মনেহচ্ছে রোষানলে দীপ্ত হয়েই ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেছে সেগুলো। মেহনূরের অবচেতন সুপ্ত মনটা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে, জানালার কাছেই হয়তো মানুষটা রক্তিম মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

রুমের ভেতরটা এখনো অন্ধকারে ডুবে আছে, জানালা দিয়ে বৃষ্টির উন্মত্ত বারিধারার ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে, ফ্লোরস্পর্শী লম্বা-লম্বা পর্দাগুলো এখনো হালকা হাওয়ায় উড়ছে। মনের উপর বল প্রয়োগ করে ভয়ের রেশটা কিন্ঞ্চিৎ কাটালো মেহনূর। তাঁকে একটুখানি দেখার জন্য চোখের ভয়যুক্ত চাহনিটা ধীরে-ধীরে বাঁদিকে ঘুরাতে লাগলো, জানালার অভিমুখে ঘুরাতেই এতোক্ষণ যেই অবস্থাটা মনের উপর হালকাভাবে উত্থাল করছিলো, সেটা তীব্রভাবে মনের কুটিরে হামলে পড়লো। জানালার কাছে নির্বিঘ্ন চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে মাহতিম। শোঁ শোঁ করে বৃষ্টির সঙ্গে আসা হিমেল হাওয়াটা তার উন্মুক্ত দেহটাকে প্রাণনাশক বানিয়ে দিয়েছে। সৌষ্ঠব্য দেহের পেশিগুলো শার্টহীনতার কারণে আরো তীব্রভাবে পরিদৃষ্ট। তাঁর হাতদুটো সে বুকের কাছটায় দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে, নয়তো ক্ষোভের রোষে ভাঁজ করে রেখেছে। জানালার দুদিকের পর্দাগুলো তাঁর উপস্থিতিতে কেমন চন্ঞ্চলীভূত হয়ে নাচছে।

মেহনূর ওই লম্বামূর্তি দেখে দুঠোঁট চেপে ডুকরে কেদেঁ উঠলো। মাথাটা নত করে ভেজা চোখে তার দিকে এগুতে লাগলো। নিঃশব্দ কদমে মানুষটার এগুলেও সেই রোষাক্রান্ত মানুষটা ঠিকই কানের কর্ণধারে পদধ্বনি টের পাচ্ছে। গূঢ় অভিমানের চেয়ে মনের মধ্যে রাগের উত্তাপটাই আজ বেশি। বেহায়ার মতো গাড়ি থেকে না বেরিয়েই মেহনূরকে চিৎকার করে ডাকলো, অথচ মেহনূর একবারও জানালা দিয়ে চুপি দিলো না। আনসারীর নিবাসের প্রতিটা জানালা দিয়ে বাড়ির চাকর-বাকর, মা, মাহদি, বিশেষ দুই অতিথি কৌতুহলের চাপে মুখ বাড়িয়ে দেখলো, কিন্তু নিজের প্রাণান্তিকা প্রণয়ী বউ তাকে একপলক দেখলো না। ইচ্ছা ছিলো, বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকার সময় এমন বদমাইশ ধরনের কাজটা করলে মেহনূর লজ্জায় রাঙা হয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে।

কিন্তু, বাস্তবে যেটা হলো সেটা অপমান ছাড়া কিছুই হলো না। জানালার ঠিক এই পর্দাগুলোই উড়লো, সেখানে কেউই এলো না। অবজ্ঞার রেশ যদি এখানেই শেষ হতো, তবে মাহতিম নিজের অশান্ত মনকে বুঝ্ দিতে পারতো। কিন্তু এখানে এসেও তার চেয়ে দ্বিগুণ অবহেলার স্বীকার হলো। চারটা মাসের ইতি টানার পর, মাহতিম আশায় ছিলো এবার হয়তো মেহনূর দূরত্বের গুরত্ব বুঝবে। যেই সুক্ষ্ম একফালি দূরত্ব তাদের প্রণয়পর্বে ফাঁক ছিলো, সেটা মেহনূর নিজেই ঘুচিয়ে আদর করবে। সেটার পরিবর্তে মেহনূর তাঁকে চলে যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করে বুঝালো। চারটা মাসের ভেতর কতরাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে, কতবার ঝিমুনি চোখ নিয়ে কাজ সেরেছে, নিজের আবেগের দুয়ার আবদ্ধ রেখে দুটো ইচ্ছের কথা পযর্ন্ত ফোনালাপে জানায়নি।

এতোকিছু কার জন্য করলো? মাহতিম বৃষ্টির প্রবলধারার দিকে আর তাকিয়ে রইলো না, চোখদুটো নিবিড়তায় আচ্ছন্ন করে বন্ধ করলো। কানে পায়ের আওয়াজটা তীব্র হতে-হতে কাছে এসে থেমেছে। কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য রুমটা শান্ত, স্তব্ধ হয়ে থাকলো, বৃষ্টির পতনধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না। মাহতিমের কাছাকাছি এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর, কথা বলার জন্যই মূলত এতোসময় যাবৎ সময় নিচ্ছিলো। কি কথা দিয়ে গা ঢাকা দিবে সেটা কোনোভাবেই হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছিলো না। শেষমেশ কিছু একটা বলার উদ্দেশ্যে গলাটা একটু সাফ করতেই আস্তে-আস্তে বলে উঠলো মেহনূর,

– হাতমুখ ধুয়ে নিন। আপনার খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিচ্ছি।
মাহতিম চোখ না খুলেই নিগ্রহের সাথে বললো,
– খাবো না। তুমি তোমার রুমে যাও।
কথাটা তীরের মতো বিঁধে উঠলো, সাথে-সাথে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। চারটা মাস ধরে নিজেকে এই রুমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভেবেছে, যদিও এই রুমের উত্তরোত্তর ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক তেমন অটুট হয়নি, তাই বলে সে কখনো নিজেকে অযোগ্য ভেবে কার্পণ্য করেনি। কন্ঠের আভাস ও কথার অবস্থা দেখে মন থেকে পরিস্কার হলো মাহতিম আসলেই শান্ত নয়। মেহনূরকে যেতে না দেখে এবার শঠতা বজায় রেখে ধমকে উঠলো মাহতিম,

– তুমি তোমার রুমে যাও মেহনূর আফরিন! আর অবহেলা দেখিয়ে আমার যন্ত্রণা বাড়াতে এসো না। প্লিজ আউট! যেতে বলেছি যাও!
ধমকের কঠোরতা দেখে ওই মূহুর্ত্তেই কয়েক পা পিছিয়ে গেলো মেহনূর। আশ্চর্য হয়ে হতে গিয়ে বাকশূন্য হয়ে গিয়েছে সে। আনমনে পিছাতে-পিছাতে চোখের পলকেই পা ঘুরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো মেহনূর। দরজাটা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ হতেই চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। মুখটা বাঁকাধের দিক এনে আবার জানালার বাইরে দৃষ্টিপাত দিলো।

মারজা এখনো আহাম্মক হয়ে আছেন। তাঁর ছেলে যে এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলো, কিভাবে ছুটির ব্যবস্থা করলো, আপাতত কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা। অনবরত পানি খেয়ে-খেয়ে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছেন, মাহতিম কি অনামিকার জন্য ফিরে এলো? নাকি মেহনূরের টানে বাড়িমুখী হলো? মাহতিমের কার্যকলাপ দেখে যেটাই অনুমান করতে যান, দিনশেষে দেখা যায় সেটার উলটোটটা করে দেখায়। এই ছেলে ঠিক তার বাবার আদল পেয়েছে। বাবাও যেমন ফট করে একটা কাজ করে বসতো, মাহতিমও চট করে কাজ করে দেখায়। মারজাকে চিন্তিত দেখে রুমের দরজার মুখে দাঁড়ালো রজনী, সে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাইনিং স্পেসের দিকে পা বাড়িয়েছিলো, কিন্তু মারজার রুমে এভাবেই চোখ ফেরতে গিয়ে তাকে চিন্তিত দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। রজনী কিছুকৈষণ আপনমনে ভেবে নিয়ে দরজায় এবার শব্দ করলো, মারজার চিন্তাগ্রস্থ দুনিয়াটা তার দিকে আর্কষণ হলে রজনী হাসি দিয়ে বললো,

– আপা, খাবেন না?
মারজা চিন্তার রেশটা এখনো কাটাতে পারেননি, তাই সদুপরি হাসিটা দিয়ে একটু বেগ পেতে হলো উনার। রজনীর দিকে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললেন,
– আমিতো খেয়েছি ভাবী। মেহনূর একটু আগে এসে খাইয়ে গেলো।
রজনী এটা ভালো করেই জানতো, মেহনূর এখন সংসারের দিকে তৎপর হয়েছে। মেয়েদের সুখের জন্য সর্বোপরি চাবিকাঠিটা তাদের শ্বাশুড়ির হাতে থাকে, মেহনূরের মতো গেঁয়ো ধুরন্ধরটা ঠিক এখানেই ঘাঁটি গেড়েছে। এরা সরল-সোজা সেজে থাকে ঠিকই, কিন্তু তলে-তলে ষোলকলা ঠিকই বুঝতে জানে। রজনী কথার হাওয়াটা পরোক্ষ করে একটু খোঁচা দিয়ে বললো,

– আপা, আপনি মনে কিছু না করলে একটা কথা বলতে চাই। আপনাকে নিজের মানুষ ভাবি বলেই কথাটা বলা। মাহতিম তো কমবয়সী মেয়েকে বিয়ে করলো এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপা আপনার কি মনেহয়না আপনারা ওকে নিয়ে একটু বেশি আহ্লাদ করছেন? মেয়েটা গ্রামের বলে বেশি সোহাগ দিবেন, পরে দেখা যাবে সবার মাথায় চড়ে চুল ছিঁড়তে শুরু করেছে। পুরুষ মানুষদের কোনো ভরসা নেই আপা। পুরুষ আর ছাগল সুযোগ পেলে মুখ দিতে ভুলবেনা। এদের বেঁধে রাখার টেকনিক —
রজনীর তির্যক ইঙ্গিতের কথাটা চট করে কেটে দিলেন মারজা। তিনি যথেষ্ট কৌশলী হয়ে ব্যাপারটা অনুকূল্য সূচকে বললেন,

– আপনি পুরুষকে ছাগলের সাথে তুলনা করলেন ভাবী। তারা যদি সুযোগ সন্ধানী হতো তাহলে তাদের জগতের নিয়মটা বিচিত্রই হতো। কোনো সভ্য পুরুষ সমাজে থাকতো বলে মনেহয় না, আর বিয়ে নামক বিশ্বাসটাও হয়তো পাশ্চাত্য দেশের মতো ছকি-নকি খেলার মতো দেখতো।
রজনী হাসি দিয়ে ব্যাপারটা আড়াল করার চেষ্টায় বললো,
– আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন আপা। কথাটা আমি বলিনি। কোনো এক বিশিষ্ট লেখক কথাটা বলেছিলো। আমি সেটাই এখানে —
আবারও নির্বিকারে কথা কাট করে নিজের মত পেশ করলেন মারজা,

– লেখকের উক্তি আর কথা খাপ-খাওয়ানো পরিবেশের জন্য বহাল ভাবী। সবখানে যে ওই কথাগুলো ব্যবহার হবে এমনটা তারা নিজেরাও বলেন নি। যেগুলো অসভ্য,কু’জাত ধরনের পুরুষ ওগুলোর স্বভাব ওই মুখ দেওয়ার মতোই। ভালো ঘরের সন্তানরা ওসব চিন্তার ভেতরও আনে না। আমি সন্তান পেটে ধরেছি তো, আমি জানি আমার সন্তানের স্বভাবটা কেমন। যেই বাড়িতে গিয়ে দিনের-পর-দিন থেকেছি, ওই বাড়িতে মুখ দেওয়ার মতো অবস্থা ভালোই ছিলো। আমার একটা সন্তানও ওরকম জঘন্য কাজ করেনি। ছেলে বিয়ে করতে চেয়েছে, বিয়ে করিয়ে দিয়ে বউ তুলে এনেছি।

মারজার কথা শুনে ভেতরে-ভেতরে জ্বলে উঠলো রজনী। ঠোঁটের উপর প্রাণবন্ত মিথ্যা হাসি ছাপিয়ে এমন ভান করলো যেনো সে মারজার কথায় সন্তুষ্ট। আজ রজনী চুপটি থেকেই কড়া কথাটা হজম করে নিলো। অপেক্ষায় আছে কবে মারজাকে চিকিৎসার ফ্যাসিলিটিসের জন্য এ্যাব্রড পাঠানো হবে। মারজার বিদেশ যাওয়ার সময়টা কিভাবে ঘনিয়ে এসেছে, সেটা হয়তো আর কেউ তেমন খেয়াল করেনি। এক-এক করে বাড়ি থেকে সব সদস্য কমিয়ে মূখ্য কাজটায় খুব সুন্দর করে হাতটান করবে রজনী। শুধু একবার এই মারজা ভিসার কাজটা শেষ করুক, দ্রুত হাট গুটিয়ে চিকিৎসার জন্য যাত্রা ধরুক, বাকিটা এভাবেই কন্ট্রোলে চলে আসবে।

অনেক তোষামোদের পর মারজার অবস্থা দেখে ডাইনিং টেবিলে বসলো মাহতিম। আসার পর থেকে সেইযে রুমে ঢুকেছে, এরপর আর বের হয়নি। খাওয়ার প্রতি মোটেই ইচ্ছাকর্ষণ নেই, তবুও মায়ের প্রত্যক্ষ জোড়াজুড়ি দেখে মায়ের হাতেই কয়েক লোকমা খেতে বসলো। অনামিকা কঠোর ডায়েট করছে দেখে রাতে সে খেতে আসেনি, কেবল এক গ্লাস দুধ খেয়ে মাহতিমের সাথে কুশলাদি করে চলে গিয়েছে। রজনী চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে, বিশেষ দৃষ্টিটা মাহতিম ও মেহনূরের উপর বর্তায়মান। অন্যদিকে ভ্রুঁ কুঁচকে মুখ ফুলিয়ে মা ও ভাইয়ের তামাশা দেখছে মাহদি। মাহদির পেছনেই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর। প্লেটে ভাত মেখে রাখলেও মায়ের আহ্লাদী অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছে মাহদি। জ্বলজ্বল করা রাগী দৃষ্টিদুটো একবার ভাইয়ের দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে ছুঁড়ছে। শেষমেষ জ্বালা সহ্য করতে না পেরে গজগজ করে উঠলো মাহদি,

– ভাইয়াকে উতুবুতু করে খাওয়াচ্ছো, আর আমাকে খাইয়ে দিতে বললে তখন, ‘ এখান থেকে যা, বড় হইছিস না ‘ বলে দূরদূর করে সরিয়ে দাও। তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না মা। একদম ভালোবাসো না। তুমিযে ভাইয়ার জন্য পাগল আবারও প্রমাণ হলো। আমিও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো। সেদিন তুমি কাঁদলেও আমি ফিরে আসবো না। এই কথা আমি বউকে ছুঁয়ে বলে দিলাম!
কথাটা রাগের মাথায় অকপটে বলেছিলো মাহদি, কোনোরূপ না ভেবেই ফটফট করে বলে দিচ্ছিলো। ওমন অশুভ কথায় মেহনূর চমকে উঠে তাড়াতাড়ি মাহদির মুখটা চেপে ধরলো, দারুণ রাগ দেখিয়ে চ’ড়ের ইঙ্গিত করে বললো,
– খুব লাগাবো কিন্তু। এগুলো কিসব কথা হ্যাঁ? আর যদি কখনো এরকম বলতে শুনি, যদি শুনেছি এরকম বিশ্রী কথা মুখে এনেছো, তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলবো না। আর কখনো বলবে এসব? বলো এসব বলবে?
মেহনূরের ঈষৎ ক্রোধ দেখে মাহদি মিটিমিটি হাসলো, কিন্তু মাহতিম যেনো ভ্রুক্ষেপই করলো না। শেষ লোকমা মুখে পুড়ে চট করে পানি খেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। খাবার চিবোতে-চিবোতে চেয়ার সরিয়ে পা বাড়াতেই মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

– ওই বদমাশটার মুখে দু’লোকমা ঢুকিয়ে দাও মা। নাহলে ওটা ফ্যাচফ্যাচ করতেই থাকবে।
মেহনূরের দিকে একবারও দৃষ্টি না দিয়ে এবার মাহদির দিকে গরম চোখে বললো,
– তুই আমার সামনে এসব বলা থেকে শতহাত দূরে থাকবি। পাদুটো ধরে এমন আছাড় মা’রবো, জন্মের শিক্ষা পেয়ে যাবি। তোকে সাবধান করে দিলাম। কাউকে ছুঁয়ে-ফুঁয়ে যা-তা কথা বকে যাবি, এক ঘুসি মেরে চাপার খুলে ফেলবো।

দাঁতে দাঁত চিবিয়ে স্বগোতক্তি করে সেখান থেকে প্রস্থান হলো মাহতিম। পুরো রাগটাই যে পরোক্ষভাবে মেহনূরকে দেখিয়ে গেলো সেটা মাহদি বুঝতে পারেনি। মারজা কিছুক্ষণ দু’ভাইয়ের অবস্থা দেখে নালিশী অবস্থা পালন করলেন, মাহদিকে পাশের চেয়ার ডেকে ঠিকই খাইয়ে দিলেন। রান্নাঘরের অবস্থা দেখার নাম করে সেদিকে গিয়ে চোখ ঢাকা দিলো মেহনূর। এতোক্ষণ চোখ-মুখের অবস্থা দেখে মারজা আপাতত সন্দেহ না করলেও মাহতিমের অযৌক্তিক রাগ দেখে কলহের গন্ধটা আঁচ করলো রজনী। নিজের মনে হাসতে গিয়ে হঠাৎ অনামিকার দিকে নজর পরলো। সে নিজের রুমের দরজার সাথে ডানহাতটা ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনামিকার সাথে দৃষ্টি বদল হতেই দুজনেই আপন মনে বাঁকা হাসিতে হেসে দিলো।

গভীর রাত্রির প্রথম প্রহর চলছে। শীতের আবহকালে বাইরের প্রকৃতিটা যেনো কুয়াশার ধুম্রজালে আবদ্ধ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই, চন্দ্রপ্রভার কিরণ নেই, মনের মধ্যে পুলকাভাবের কারণ নেই। চাঁদহীন আকাশটার উপর কতক্ষণ দৃষ্টিপাত করতেই হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা পকেট থেকে বের করে কলার নামটা পরোখ করলো, কানে ফোন ঠেকাতেই প্রথম উত্তরটা দিলো,
– হ্যালো,
ওপাশ থেকে সৌজন্য কন্ঠে নোমান বললো,
– আপনার জরুরী ফাইল আর লাগেজটা কি আজই পাঠাবো স্যার? আমি এয়ারপোর্টে বসে আছি। ইমার্জেন্সী টিকিট নাকি নেই। কি করবো এখন?
মাহতিম দ্বিরুক্তিভাব প্রকাশ না করলে বললো,

– আজ পাঠাতে পারলে আজই। আমার জন্য আজই দরকার। টিকিট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি এয়ারলেন্সে যোগাযোগ করছি, তারা টিকিটটা সময়মতোই দিবে। তুমি শুধু সবকিছু রেডি রাখো।
এদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছে মেহনূর। রুমে ঢুকবে নাকি ঢুকবেনা এ নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় পড়েছে সে। এর মধ্যে চারপাশ নিরব হওয়ায় মাহতিমের কথোপকথন সবই রুমের বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে। মেহনূর কান সজাগ না করলেও টিকিটের কথা শুনে অস্থির হয়ে উঠেছে। টিকিট কিসের জন্য দরকার? মাহতিম কি চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে? মেহনূর পাগলের মতো মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে নিজেকে বুঝিয়ে নিলো, মাহতিম নিশ্চয়ই যাচ্ছেনা। সে এগুলো ভুল বলছে, হয়তো অন্য কাউকে টিকিটের কথা বলছে। হ্যাঁ, এটাই হবে। ওদিকে কলের বিপরীত থেকে টিকিটের ঝামেলা সামলাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাসে বললো নোমান,

– থ্যাংকিউ স্যার। আমি কাল সকালের দিকেই আপনার ফাইল আর লাগেজ নিয়ে হাজির হচ্ছি। স্যার, আপনি কিভাবে বাড়িতে লাগেজটা তুলবেন?আমি কি সাহায্য করবো?
মাহতিমও দ্বিধাক্ষণ বিলম্ব না করে আশ্বস্ত সুরে উত্তর দিলো,
– ওটা তোমার দেখতে হবেনা। আমি সকালের দিকেই বের হচ্ছি। রেডি থাকো তাহলে। লাগেজটার বন্দোবস্ত নিয়ে ভেবে রেখেছি, তুমি জাস্ট টিকিট কনফার্ম দাও।

নোমানের কথা শেষ হতেই মাহতিম কল কেটে দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো দুটো বেজে পাঁচ মিনিট। ঠিক তিনটা বাজলে একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসতে হবে। তিনটার পর মনেহয়না জেগে থাকার কথা। আরো পন্ঞ্চান্ন মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, তিনটা না বাজলে ভুলেও সেখানে যাওয়া যাবেনা। মাহতিম জানালাটা আটঁকে দিয়ে পর্দা টেনে দিলো, রুমটার ভেতর অবস্থা অন্ধকারে ঘনিয়ে গেলো। বুকের চেইনটা একটান দিয়ে খুলে গা থেকে জ্যাকেট খুললো মাহতিম। পড়নের সাদা শার্টটা সেইযে হাতমুখ ধুয়ে পরেছিলো, সেটা খুলে গেন্ঞ্জি পরতে একদম ইচ্ছে করছেনা। শীতের জন্য মূলত ইচ্ছাটা নেই। বিছানায় বসে হেডসাইডের সাথে পিঠ ঠেকালো মাহতিম, পাদুটো লম্বা করতেই ক্রস করে রাখলো। হাতের ফোনটা নিয়ে পন্ঞ্চান্ন মিনিট কাটানোর জন্য মগ্ন হলে এদিকে ভেজানো দরজাটা ক্যাচ করে খুলে যেতে লাগলো। ফোন থেকে চোখ সরে দরজার দিকে তাকালো মাহতিম, ওমনেই চোখের কৌতুহল দৃষ্টি কঠোর হয়ে উঠলো। সেদিক থেকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় ফোনের সাদা স্ক্রিনে মনোযোগ দিলো, দরজাটা আস্তেধীরে বন্ধ করার আওয়াজ পেলো মাহতিম। শব্দটা পেতেই নিভিয়ে রাখা রাগটা আবার জ্বালিয়ে নিয়ে তিক্ততার সুরে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩৬+৩৭

– কোন্ তামাশা দেখাতে এসেছো? সকালে এক তামাশা দেখিয়ে শান্তি পাওনি, এখানে তু —
ঠোঁটের উপর চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলোর চাপ পেয়ে কথা থেমে গেলো মাহতিমের, আচমকা সমস্ত রাগের জোয়ার যেনো তলিয়ে গেলো তার। ফোলা ফোলা ওই লালবর্ণের চোখকে কেন্দ্র করে নিকষ মায়ায় ডুবতে বাধ্য হলো মাহতিম। নিজের সাথে কি হলো নিজেও তখন টের পেলো না।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪০+৪১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here