মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪৪+৪৫
ফাবিয়াহ্ মমো
মাহতিমের চোখের সামনে যা ঘটলো তা চিন্তার বাইরে ছিলো! গায়ের রক্ত যেনো হিম হয়ে গেছে তার! সে ভাবতে পারেনি, কল্পনাও করেনি, মেহনূর তার জন্য থেকে যাবে। এমনই একটি মূহুর্তে তার জুতাজোড়া নিয়ে ব্যস্ত হবে সেটা ভাবনার ভেতরেই আনা দুষ্কর ছিলো। হাতের ফোনটা থেকে অনেকক্ষণ ‘ হ্যালো, হ্যালো ‘ করে শব্দ ভেসে এলো ঠিকই, শেষে সাড়া না পেয়ে কেটে গেলো সেটা। মাহতিম তখনও আশ্চর্যের রেশ কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারেনি। তার মনেও পরেনা এতোটা আশ্চর্য তার কর্মজীবনে কোনো অপারেশন চলাকালীন হয়েছিলো কিনা। ভেতরের অস্বাভাবিক দূরাবস্থাটা চট করে সামলে নিয়ে খিটখিটে মেজাজে গলা তুললো মাহতিম,
– তুমি ওদের সাথে গেলে না কেনো? কি সমস্যা ছিলো ওদের সাথে যেতে? আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করছো, না? যাওনি কেনো?
মুখ তুলে সরল দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর, তাকিয়ে থাকতেই জুতার গিটটা দুহাতে টাইট দিয়ে স্থিরচোখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। স্মিত হাস্যে শান্ত গলায় বললো,
– আমিযে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিরশির করে কথাটা যেনো বেজে উঠলো কোথাও, তবুও সেটা ভাব-সাবে প্রকাশ করলো না মাহতিম। মুখের অবস্থা পূর্বের চেয়েও কাঠিন্য করে হনহন গতিতে মেহনূরের ডানসাইড কেটে সোজা বাইরে বেরুলো, প্যান্টের ডান পকেট থেকে চাবি বের করতেই চট করে জিপে উঠে বসলো। বসতেই শরীরটা যেনো চিনচিন করে উঠলো তার, আবারও গতরাতের ব্যথাটা শিরায়-শিরায় সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে, ব্যথাটা সাধারণ মানুষের জন্য তীব্র, তবে এটা আপাতদৃষ্টিতে তার জন্য কিছুই না। এক সেকেন্ডের মতো দাঁত শক্ত করে চোখদুটো বন্ধ রাখলো সে, জোরে একটা দৃঢ়ভঙ্গির নিশ্বাস ছাড়তেই স্টিয়ারিংয়ে দুহাত রাখলো মাহতিম, যেই স্টার্ট দিয়ে জিপের ব্রেকজনিত ব্যাপারটা চেক দিতে নেয়, তখনই দরজার দিকে দৃষ্টি থমকে স্টিয়ারিংয়ের হাতদুটো শক্ত হয়ে এলো।
দরজা দিয়ে পায়ে-পায়ে বেরিয়ে এলো নীলাভ ছায়ার মানবী, তার মুখটা করুণ লজ্জায় আবৃত হয়ে আছে, দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিদুটো ভূমিতে নিক্ষেপ করে পেটের কাছে হাতদুটো কচলাতে-কচলাতে জিপের কাছে চলে আসছে, একজোড়া তীক্ষ্ম-বিচক্ষণ চোখ তার আগমন দেখে অনিমেষ নয়নজোড়ায় তাকিয়ে আছে। নীল শাড়িটার দিকে পর্যবেক্ষণশীল দৃষ্টিদুটো একবার রাখতেই তার মেমোরি সেন্স জানান দিলো, শাড়িটা তারই কিনে দেওয়া। দূরত্বটুকু পায়ে হেঁটে ঘুচাতেই ড্রাইভিং সিটের পাশে এলো মেহনূর, আড়চোখে দেখতে পেলো, তার ব্যক্তিগত মানুষটা আজ আগের মতো হাসি-হাসি চোখে দেখলো না। সে একটুও যেনো গ্রাহ্য করলো না, একবারও চোখ তুলে তাকালো না। মেহনূর যে আজ ব্যতিক্রম করে সেজেছে তা কি চোখে পরেনি?
এইযে ব্লাউজের হাতাটা ছোট পরেছে, তারই কিনে দেওয়া শাড়িটা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়েছে, বাইরে বেরুলে কখনো পিঠ উন্মুক্ত ব্লাউজ না পরা সত্ত্বেও আজ পরেছে, এগুলো কি তার চোখে পরছেনা? মেহনূর মুখ তুলে দেখলো, মাহতিম তার দিকে একদম তাকিয়ে নেই, সে জিপ স্টার্টের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতিটা নিয়ে ফেলেছে। শাড়ি পরে জিপে উঠতে এবারও হিমশিম খেলো মেহনূর, মাটি থেকে বেশ উঁচু লেগস্ট্যান্ডটায় পা উঠাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো, তার পা’টা ফসকে যাচ্ছিলো বারবার। ব্যর্থতার অথৈ জলে হাবুডুবু খেলেও মনে শেষ আশাটুকু ছিলো যে, মাহতিম এখুনি হাত বাড়িয়ে তাকে উঠতে সাহায্য করবে, কিন্তু আফসোসের গলাধঃকরণ করে মাহতিম এসবের কিছুই করলো না, বরন্ঞ্চ ঝাঁঝালো গলায় ধমক লাগিয়ে এখানে ফেলে যাওয়ার হুঙ্কার দিয়ে বসলো।
দূর থেকে বাগানের ফুলে পানি দিতেই পুরো দৃশ্যটা দেখছিলো সিরাজ কাকা, তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি পানির পাইপ ফেলে গ্যারেজের দিকে ছুটে গেলেন, একই দৌড়ে তিনি বগলচাপা করে লাল বস্তুটা মেহনূরের কাছে এনে রাখলেন, মেহনূর কাঁদো-কাঁদো চেহারায় দৃষ্টি ফেলে দেখলো, তার পায়ের কাছে জিপে উঠার জন্য একটা টুল রাখা হয়েছে। মেহনূর টুল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ডানে তাকিয়ে সিরাজ কাকার দিকে তাকালো, বৃদ্ধ সিরাজ অভয় সূচকে মাথা নাড়িয়ে টুলে পা বাড়ানোর ইশারা করলেন। অদ্ভুত এক আনন্দে উদাসী মুখের মধ্যেই হাসিটুকু উঁকি দিলো মেহনূরের, টুলে পা ফেলে জিপে উঠে বসতেই দায়িত্বভার হিসেবে ঝুলন্ত আঁচলটুকু মেহনূরের কোলে তুলে দিলেন সিরাজ কাকা। মাহতিম এসবের দিকে ভ্রুক্ষেপ পযর্ন্ত করছিলো না, সে শুধু সিরাজ কাকার দিকে চোখ দিয়ে বাড়ির দিকে ইশারা করলো। শব্দহীন মুখে একবার ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়িয়ে অব্যক্ত আজ্ঞাটা বুঝিয়ে দিলেন সিরাজ। গোলাকার স্টিয়ারিংটা দুটি দক্ষ হাতের চালনা পেয়ে সমস্ত জড়তা ছেড়ে গতিশক্তি ধারণ করলো, জিপটা শোঁ শোঁ করে বাড়ির শূন্য ঠোকাঠা মাড়িয়ে বেজায় স্পিডে ছুটতে লাগলো।
হৃদয়ের কপাটগুলো ভয়ের আস্তরণে নড়বড়ে হয়ে আছে, অবচেতন মনটা মিনিটে-মিনিটে অদ্ভুত কিছুর আভাস দিচ্ছে। সেই আভাসে আরো সংকুচিত হয়ে লজ্জাবতী পাতার মতো কুঁকড়ে যাচ্ছেন মারজা। তার সরল মনের শান্ত আঙিনাটা এই যাত্রা নিয়ে কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকতে পারছেনা, তার মাতৃতুল্য অমূল্য স্নেহের মনটা অজানা-অচেনা ভয়ের কোটরে ঢুকে গেছে, মনে হচ্ছে এবার খুবই খারাপ কিছুর মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। ভেতর থেকে কোনোভাবেই ভালো কিছুর ‘ শুভসংকেত ‘ পাচ্ছেন না, হাজার চেষ্টা করেও শান্ত থাকার বদলে চাপা অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পরছেন তিনি।
একটু পরপর সবার আগমন নিয়ে খবর নিচ্ছেন, মাথা ঘুরিয়ে পেছন থেকে তাদের গাড়ি দেখা চেষ্টা করছেন, বোতল খুলে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছেন, আবার মাঝে-মাঝে পানিটা কুলি করে চলন্ত গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে ফেলছেন। পেছনের সিটে বসা অনামিকা মারজার কীর্তিকলাপ দেখে কৌতুহলী হওয়ার পরিবর্তে বিরক্ত হচ্ছে, এই মহিলা কিসের ঢং শুরু করেছে? ঢং করার কি জায়গা পেলো না? এমন ফালতু ভাবে কেউ হাইরোডে কুলি করে? ‘ মেন্টাল ‘ বলে মনে-মনে বিরক্তির বার্তা ছুঁড়লো অনামিকা। রজনী এমনভাবে ড্রাইভিং করছে যেনো সে ট্যূরের চূড়ান্ত স্ফূর্তিতে মেতে আছে। মোবাইল টেপা বাদ নিয়ে কানে সাদা-সাদা দুটো ইয়ারপড গুঁজলো অনামিকা, ফেসবুক স্ক্রল করতেই একটি লোমহর্ষক লাইভ টেলিকাস্ট দেখে আতঙ্কে তার মুখটা হা হতে লাগলো। নিষ্পলক দৃষ্টিতে লাইভের অবস্থাটা দেখতেই গলা শুকিয়ে খরা, বহু কষ্টে ভীতগ্রস্থ চাহনিদুটো ফোন থেকে সরাতে পারলো অনামিকা, কথা বলতে গেলো কিন্তু কন্ঠস্বর যেনো তোতলা সুরে বিকৃত হয়ে গেলো তার,
– ফু-ফু-ফু-ফুপ…ফুপি রাস্তায় স্ট্রাই— ,
বেপরোয়া স্পিডে শহরের হাইরোড মাড়িয়ে মাইক্রোবাসটা ছুটছে। সমুদ্র দেখার অভিলাষে তন-মন যেনো প্রফুল্লতায় মেতে উঠেছে, মাইক্রোর সেই বদ্ধ পরিকর চলন্ত পরিবেশে সুর উঠলো নীতির,
‘ দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘
নীতির হাসিতে গেয়ে উঠলো প্রীতির চন্ঞ্চল মন,
‘ এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘
দুবোনকে ছাড়িয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে বললো তৌফ,
– ‘ দুঃখ টাকে দিলাম ছুটি আসবেনা ফিরে, ‘
মুচকি হাসিতে নিজেও ঠোঁট নাড়ালো সৌভিক,
– ‘ এক পৃথিবী ভালবাসা রয়েছে ঘিরে, ‘
সবাইকে টেক্কা দিয়ে হাতদুটো পাখির ডানার মতো ঢেউয়ের ভঙ্গি করে গাইলো ফারিন,
– ‘ মনটা যেন আজ পাখির ডানা, ‘
পাশ থেকে কলি ছিনিয়ে গেয়ে উঠলো মাহদি,
– ‘ হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা, ‘
ঠোঁটের কাছে ফিসফিসিয়ে বলার মতো সুর তুললো সিয়াম,
– ‘ চুপি চুপি চুপি সপ্ন ডাকে হাত বারিয়ে, ‘
খিলখিল হাস্য ধ্বনিতে সবাই যেনো মিলে গেলো তখন। পুরো মাইক্রোতে যেনো হাসির কলরব ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছিলো, পেছনের সিট থেকে গিটারের টুংটাং আওয়াজে কাঙ্ক্ষিত গানের মিউজিক বাজতেই দারুণ উল্লাসে, দারুণ আমেজে একসাথে গলা মিলিয়ে গাইলো সবাই,
মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে
ওওও
মন চায় মন চায়,
যেখানে চোখ যায়,
সেখানে যাব হারিয়ে।
দুপুরের তৃতীয় প্রহর চলছে, অরুণের তেজী চাকাটা আজ ম্রিয়মাণ। গ্রীষ্মের মতো দাপট না দেখালেও শীতের হিমেলে উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। হাইরোডে এখন জ্যাম নেই, আজ যে কেনো এমন জ্যাম নেই তা ধরতে পারছেনা মাহতিম। বেকুবের দলটা ফোনই ধরছেনা, এদিকে মেহনূরকেও জিপে রাখা সম্ভব না। ধ্যাত! কেনো করলো এই কাজ? কেনো ওদের সাথে গেলো না? রাগটা সম্পূর্ণ নিজের মধ্যেই চেপে রাখলো মাহতিম। এই মূহুর্তে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই, একটু আগে কল এসেছে সামনের পরিস্থিতি খুবই খারাপ! সড়ক অবরোধ করে দলবল জুটিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করছে, যত্রতত্র আগুন জ্বালিয়ে হাহাকার অবস্থা! রাজনৈতিক অবস্থাটা ইতিবাচকের পাশাপাশির কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা আর বলার প্রয়োজন রাখেনা।
বাঁহাতের হাতঘড়িটায় একপলকের জন্য চোখ বুলিয়ে ফের সামনের দিকে তাকালো, খুব একটা সময় খুব। কখন-কিভাবে-কোনদিক দিয়ে বিপদ এসে হানা দেয় বুঝতে পারছেনা, ভয়টা নিজের জন্য না হলেও পাশে থাকা মানুষটার জন্য হচ্ছে। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে-ফাঁকে কালো সানগ্লাসের আড়ালে নজর রাখাটা থেমে নেই, পাংশুটে ছোট্ট মুখটা কেমন মিইয়ে গেছে। একরত্নি হাসি নেই সেখানে, উজ্জ্বলতার রেশ নেই, দৃষ্টিদুটোও বিষণ্ণ, ঠিক নুইয়ে পরা ছোট্ট চারাগাছের মতো। মুখটা বায়ে ফিরিয়ে চলন্ত জিপ থেকে ছুটে যাওয়া দৃশ্যগুলো চুপ করে দেখছিলো মেহনূর। মাথাটা সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুম-ঘুম অবস্থায় দেখছিলো। আজও গাধার মতো গায়ে গরম পোশাক নেই, আবার শাড়িটাও অতো মোটা পরেনি। কাঁপুনি ধরানো ঠান্ডা বাতাসে একটু পরপর বাহুতে হাত ঘষে উষ্ণসূচক করছিলো সে, আঁচলটা দিয়ে গা ঢাকা সত্ত্বেও কাঁপুনি কমছেনা।
পাশ থেকে আড়চোখে ড্রাইভ করা অবস্থায় ওসব কীর্তিকাণ্ড দেখে চোখ সামনের দিকে ঘুরালো মাহতিম, কিছু একটা চিন্তা করে স্পিড খানিকটা কমিয়ে আনতেই চিন্তার অঙ্কটা ক্ষণিকের ভেতর ফলে গেলো। মেহনূর ঘুমে বিভোর হয়ে যেই মাথাটা বাঁদিকে রাস্তা বরাবর ছেড়ে দিতে নিলো, সাথে-সাথে একসেকেন্ডও দেরি না করে ঘাড়ের পেছনে হাত গলিয়ে মেহনূরকে আগলে ধরলো মাহতিম। তন্দ্রাচ্ছন্ন মেহনূর নির্ঘুম রাত্রির ক্লেশে ঘুমাতে না পারলেও প্রশান্তিময় জিপের ভ্রমনে গভীর তন্দ্রায় ডুবে গেছে, মেহনূরকে বুঝতে না দিয়ে আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাধে রাখলো মাহতিম। গ্রীষ্মের তালুফাটা গরমে যখন তৃষ্ণার্ত গলাটা ঠান্ডা পানির স্বাদ পেয়ে অদ্ভুত শান্তিতে চোখ বুজে আসে, মাহতিমও যেনো কাধের উপর উষ্ণতার ভর পেয়ে চোখদুটো ক্ষণকালের জন্য বন্ধ করেছিলো।
আজ যদি জিপটা নিজে না চালাতো, তবে ওই ঘুম-ঘুম বিষণ্ণ কোমল মুখটায় অসংখ্য ছোঁয়া ছুঁইয়ে দিতো মাহতিম। উন্মাদের মতোই দুহাতে মুখটা তুলে কাজটা করতো সে, একটুও বাধা-নিষেধ মান্য করে নিজের প্রগাঢ় ইচ্ছাটা পাথর চাপা দিতো না। বুক হালকা করে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম, হঠাৎ প্যান্টের ডান পকেটটায় সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো। তার ভাইব্রেট ফোনটা কলের জন্য বাজছে, মাহতিম ফোনটা বের করে দেখলো সামিকের নাম্বার থেকে কল এসেছে। জিপটা সুযোগ মতো রাস্তার একপাশে থামিয়ে কলটা রিসিভ করলো মাহতিম, মেহনূরের ঘুমন্ত দেহটা একইভাবে ধরে রেখে ছোট্ট স্বরে ‘ হ্যালো, হ্যাঁ সামি– ‘ বলতে নেবে তখনই কথাটা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্থে চেঁচিয়ে উঠলো সামিক,
– মাহতিম ভাই, তুমি কোথায়? ভাই খবরদার তুমি আর এগিয়েও না। এখানে গাড়ি ভাঙচুর করছে! রাস্তায় স্ট্রাইক চলছে ভাই, তুমি জলদি জিপ ঘুরাও! তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে গাজীপুরের রাস্তা ধরো! আর এগিও না। আমি সবাইকে নিয়ে আমার বন্ধুর বাসায় উঠেছি। সামনের রাস্তা খুবই জঘন্য, ওরা গাড়িতে আগুন পযর্ন্ত দিয়ে ফেলছে! তোমাকে নেটওয়ার্কের জন্য কলও দিতে পারছিলাম না। ভাই প্লিজ তাড়াতাড়ি, প্লিজ তাড়াতাড়ি পালাও।
সামিকের অস্থির কন্ঠের চেঁচামেচি শুনে নিজেকে ধাতস্থ রাখলো মাহতিম। পরিস্থিতি যতোই নাগালের বাইরে যাক, নিজের ধূর্ত মস্তিষ্কটার উপর ভালোই ভরসা আছে। সামিককে শান্ত হতে বলে নিজেও কয়েক মিনিটের ভেতর যুৎসই প্ল্যান সাজিয়ে নিলো। এর জন্য কিছুক্ষণ গুগলে ঘাঁটাঘাটি করলো মাহতিম, বৃদ্ধাঙ্গুলে উপর-টু-নিচ স্ক্রিল করতেই হঠাৎ একটা কনটেন্ট দেখে বৃদ্ধাঙ্গুলটা থেমে গেলো তার। সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিদুটো সেই ইংরেজিতে লেখা কনটেন্টে বুলাতেই ঠোঁটে বিচক্ষণতার বাঁকা হাসিটা খেলে গেলো। এখন তাকে জরুরী দুটো কল করতে হবে, পাওয়ারটা আবারও খাটানোর সময় এসে পরেছে। কলটা ডায়ালে ফেলে কানে চাপতেই মেহনূরের দিকে মুখ করলো মাহতিম, সানগ্লাসের দৃষ্টিটা মেহনূরের মুখের উপর ফেলে চাপা হাসিতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
– ‘ এবার যদি বায় চান্স আউট অফ কন্ট্রোল হই, আংশিক মধুচন্দ্রিমা হয়েই যাবে। ‘
রাতের খোলসে ঝিমিয়ে আছে মহিনপুরের গ্রামটা। গ্রামের নামটা এতোদিন ধামাচাপা ছিলো অনিচ্ছুক কারণে, তবে এটা যেহেতু খোলাশা হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বলা উচিত এটা মেহেরপুরের কাছাকাছি। গ্রামটা মূলত মেহনূর আফরিনের শৈশবের স্মৃতিখানি, তার বেড়ে উঠার একমাত্র স্থল ছিলো। কিন্তু ‘ বিয়ে ‘ নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেই গ্রাম থেকে আজ বহুদূরে বসবাস করছে।’ স্বামী ‘ নামক পুরুষের সাথে তার বৈবাহিক সম্পর্ক এখন পন্ঞ্চম মাসে পর্দাপণ করেছে, এ নিয়ে ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে দিন হিসাব করলো হান্নান শেখ। হ্যাঁ, পন্ঞ্চম মাসটা শুরু হয়েছে বৈকি, কিন্তু সম্পর্কটা আদৌ স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হয়েছে কিনা সেটা জানাটা জরুরী।
তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা এখন জঘন্য নিয়মে শুধরাতে চাইছেন, হোক সেটা ভুল, সব ভুলেরই তো সমাধান আছে। যদি তার নাতনী ওই ধুরন্ধর লোকের সাথে এখনো সম্পর্ক স্থাপন না করে থাকে, তাহলে তিনিও ষোলআনা মিলিয়ে কাহিনী শেষ করে দিবেন। ওই বদমাইশের বাচ্চাটাকে সামনে পেলে সবার আগে ওর মাথাটা থেতলে দিতেন তিনি। কতো বড় চালাকি করেছে ওই শয়তান! তারই বাড়িতে ঢুকে, তারই নাকের নিচে থেকে-থেকে দাবার গুটি সাজিয়ে নিয়েছে, আবার সুযোগ মতো ছোঁক করে ছোবল মেরে গুটি সরিয়ে ফেলেছে। তিনি কি এতোদিন চোখে পট্টি মেরে ঘুমাচ্ছিলেন নাকি? ওই হারামির কর্মকাণ্ড কি করে তিনি দেখতে পেলেন না? নির্ঘাত ওই বদমাইশের বাচ্চা অনেক তথ্য হাতিয়ে ফেলেছে।
মেহনূরকে বিয়ে দেওয়ার সময় ছোট্ট একটা শর্ত রেখেছিলো হান্নান শেখ, তার ছোট নাতনীটা যেহেতু এখনো বয়সে পাকা হয়নি, তাই তাকে কাবিন করেই রাখা হোক, সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। এ কথায় মাহতিম তার সাথে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলো, বিয়েটা যেহেতু হয়েই গেছে সেক্ষেত্রে বাড়ির বউ বাড়িতে ফিরলেই যুগোপযোগী, বাপের বাড়িতে না থেকে আসল বাড়িতে থাকাটাই ঠিক হবে। মারজা যদি সেদিন ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ ‘ করে জোর না দিতো, তাহলে হান্নান শেখ খুব সহজেই তার সহজ-সরল নাতনীকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সরিয়ে আজ আনতে পারতেন। খুব সহজেই আরেক পাত্র খুঁজে তাদের ভুলভাল বুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতেন। নিজের কপালে গুণে-গুণে দশটা ঝাড়ুর বারি লাগাতে ইচ্ছে করছে, তিনি যে খাল কেটে নিজ বাড়িতেই কুমির চাষ করেছেন সেটা বুঝতে পেরে কঠিনভাবে আফসোস হচ্ছে। ওমন সুপুরুষের মাথায় চতুর বুদ্ধির ক্ষমতাটা আসলেই আশ্চর্যজনক! মাহতিম আনসারী খুবই বিপদজ্জনক মানুষ এ নিয়ে মনে আর সন্দেহ নেই হান্নান শেখের।
আজ সবকিছু বিপক্ষে চলে যাচ্ছে, বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে আকাশ চিঁড়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। চোখের সামনে প্রায় একহাত পযর্ন্ত বৃষ্টির জন্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা, নিগুঢ় অন্ধকারে তলিয়ে আছে আকাশের গুমোট চেহারা। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে তবুও জিপ ছুটাচ্ছে মাহতিম। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো অনেকাংশে নিষিদ্ধ হলেও মাহতিম উলটো স্পিড বাড়িয়ে চালাচ্ছে। বৃষ্টি ফোঁটা যেনো ঠান্ডার একেকটা গোলার মতো আকাশ থেকে ঝরছে, একদম দেহের পশম ছুঁয়ে অন্তঃস্থলে ছুড়ির মতো মারছে। এর চেয়েও ঠান্ডা পানিতে ট্রেনিং নেওয়ার কার্যকরী দক্ষতা তার আছে, অথচ আজ চিন্তার ঘড়িটা বারবার মেহনূরের জন্য টিকটিক করছে।
গ্রাম্য রাস্তাটায় পানি জমার কারণে জিপের বেদম গতিতে ‘ ছলাৎ ছলাৎ ‘ করে পানি ভাঙ্গার আওয়াজ উঠছে, সুনশান চারদিকে, কোনো ধরনের কোলাহল নেই, শহুরের হর্ণের ছিঁটেফোঁটা যন্ত্রনাও নেই এখানে। ঢাকা থেকে অদূরে যানবাহনের কালোধোঁয়া মুক্ত পরিবেশে গাজীপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর উপজেলার রাজাবাড়ি বাজার ইউনিয়নের চিনা শুখানিয়া গ্রামে সম্পূর্ণ গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে উঠেছে ‘ নক্ষত্র বাড়ি ‘ রিসোর্ট। রিসোর্টটি শ্রীপুরের কাছে অবস্থিত। দেশের জনপ্রিয় দম্পতি তথা চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির আহমেদ এবং অভিনেত্রী বিপাশা হায়াতের সুকৌশল চিন্তাধারায় নির্মিত বানিজ্যিক রেসোর্টির উদ্দেশ্যে যাত্রা ধরেছে মাহতিম। শীতে দাঁত কপাটি দিয়ে কাঁপতে থাকা মেহনূর কাঁপতে-কাঁপতে মাহতিমের দিকে বললো,
– এটা কি আমাদের গ্রাম?
মাহতিম তার দিকে না তাকিয়ে কপালের চুলগুলো আবার ব্যাকব্রাশ করে কাটকাট সুরে বললো,
– না।
মেহনূর আর প্রশ্ন করার অবস্থা পাচ্ছিলো না। ঠান্ডায় তার বুকের ভেতর ভারী হয়ে গেছে। নাক বন্ধ হওয়ার ফলে মুখ খুলে নিশ্বাস নিচ্ছে। প্রচণ্ড অসহ্য অনুভূতিতে ছটফট করছে মেহনূর। শৈশব থেকে এই ঠান্ডার জন্য করুণভাবে ভুগছে, নিশ্বাস আঁটকেও আসছে এখন। ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে বামে তাকালো মাহতিম। কাঁপতে থাকা উন্মুক্ত পিঠটায় বৃষ্টির বিধ্বংসী ফোঁটাগুলো হিংস্রভাবে পরছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে গরম গলায় বললো মাহতিম,
– পাকনামো করে পিঠ খোলা ব্লাউজ পরেছো কি জন্যে?
কাঁপতে-কাঁপতে লাল চোখ তুললো মেহনূর। ঠান্ডায় দাঁতকপাটি লাগার সুরে অত্যন্ত ধীরভাবে বললো,
– আপনার জন্য।
চকিত ভঙ্গিতে আবার বামে তাকালো মাহতিম। তাকানোটা অস্থায়ী রেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে ‘ নক্ষত্রবাড়ি ‘ রেসোর্টের সদর দরজা দিয়ে জিপ ঢুকিয়ে দিলো। বুকিংজনিত কাজটা কলেই সম্পণ্ণ করেছিলো বলে দ্রুততার সাথে নিজেদের কটেজ পেয়ে গেলো। কটেজ পযর্ন্ত যাওয়ার দূরত্বটুকু বৃষ্টির মধ্যেই একসঙ্গে হাঁটা দিলো। মাহতিম বড়-বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলেও তার সাথে তাল মেলাতে না পেরে পিছিয়ে পরলো মেহনূর। অসহন গলায় কাশতে-কাশতে বললো,
– শুনুন,
ঝুম বৃষ্টির জোরালোপূর্ণ আওয়াজে শুনতে পেলো না মাহতিম। সে নিজগতিতে পা চালিয়ে দ্রুত কটেজের ভেতরে ঢুকে গেলো। মেহনূরের জন্য শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করাটা এখন মূখ্য কর্ম! তার সাথে ওর কোনো পোশাকই নেই, যদি নিজের লাগেজটা খুলে কিছু পাওয়া যায় তা দিয়েই রাতটা চালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। লাগেজটা ফ্লোরে ফেলে তাড়াতাড়ি উপর্যুক্ত পোশাক খুঁজলো মাহতিম, ভাঁজ করা ইস্ত্রির শার্টগুলো মাহতিমের ভেজা হাতের পরশ পেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো, উলোটপালোট করে খুঁজতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো মাহতিম,
– তুমি কি আজ রাতটুকুর জন্য আমার শার্ট পরতে পারবে? ভেজা শাড়িতে থাকলে তোমার নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। কোনটা পরবে জলদি বলো?
প্রশ্ন করার প্রায় দুই মিনিট পেরিয়ে গেলো। চারপাশ থেকে কোনো উত্তরই এলো না। মাহতিম ভাবলো অভিমানে চুপটি মেরে আছে হয়তো, সে এবার মাথা পিছু ঘুরিয়ে ‘ মেহনূর জবাব দিচ্ছো না কেনো? ‘ বলেই ভ্রুঁ কুঁচকে ফেললো। ডানে-বামে-চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে চিৎকার দিলো,
– মেহনূর !
হাঁটু সোজা করে অগোছালো লাগেজ ফেলেই উঠে দাঁড়ালো মাহতিম! এই প্রথম অস্থিরতায়-উৎকন্ঠায়-উদ্বিগ্নে তার বক্ষস্থল পযর্ন্ত ধুকপুক-ধুকপুক করছে! এক দৌঁড়ে কটেজের রুম থেকে বেরিয়ে ডানে-বামে চোখ ঘুরাতেই কটেজের নিয়নবাতির ঝাপসা বর্ষণে নীল শাড়িটা নজর কাড়লো। কাঠের ও বাঁশের লম্বা লনটার শেষ মাথায় জবুথবু অবস্থায় হাঁটুতে মাথা রেখে হাঁপানো রোগীর মতো কাপছিলো মেহনূর। অপরাধী দৃষ্টিতে দাঁতে-দাঁত শক্ত করে ‘ ও আল্লাহ্, কি করলাম! ‘ বলতেই সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে দৌঁড়ে গেলো মাহতিম। মেহনূরের সামনে পা থামিয়ে ধপ করে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরলো সে। কানে অদ্ভুত শব্দটা বেজে উঠলে নতমাথা ধীরে-ধীরে উঠালো মেহনূর। লাল টকটকে চোখের পাতা টেনে খুলতেই সামনের দিকে তাকালো, ঘোলা-ঘোলা চাহনিতে দেখতে পেলো সাদা শার্টটা দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো পানিতে জেলহীন হয়ে কপালের কাছে ছড়িয়ে আছে, টুপ-টুপ করে চুল চুয়ে পানি পরছে তার। ঠোঁটদুটো গাছের কচিপাতার মতো দুলে-দুলে কাঁপছে। মেহনূর একদৃষ্টিতে আধবোজা চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে দুঃখী কন্ঠে বললো,
– সরি,
মেহনূরের অবস্থা যেনো ‘ নো নড়া, নো চড়া ‘ ভঙ্গিতে থমকে আছে। মাহতিম আরো নত হয়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে গেলো, ঠান্ডা গালদুটো ধরে মুখটার আরেক ধাপ কাছে এগুলো। ভারাক্রান্ত চাহনি দিয়ে অপরাধী গলায় বললো,
– পেছনে তাকাতে খেয়াল ছিলো না।
নির্যুত্তর মুখে ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। মাহতিম আবার নরম গলায় বললো,
– বসে আছো কেনো? যাবে না?
চোখ বন্ধ করলো মেহনূর, আবার চোখ খুলে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে মাথাটা ডানে-বামে নাড়িয়ে দিলো। আশ্চর্যে হতবাক হতেই মাহতিম তৎক্ষণাৎ অস্থির কন্ঠে ক্ষোভ দেখিয়ে বললো,
– যাবে না মানে? ফাজলামি? ফাজলামি করছো?
ক্ষেপাটে চোখদ্বয় জ্বলজ্বল করে উঠলে মেহনূরকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মাহতিম। মেহনূর তখন জুলজুল চোখে মাহতিমকে দেখছিলো। অনেকটা নির্বাকভাবে, অনেকটা ভাবশূন্য চাহনিতে। মাহতিম কোনোদিকে কোনোকিছু পরোয়া না করে মেহনূরের হাঁটুর নিচে ডানহাত এবং ঘাড়ের নিচে বাঁহাত ঢুকিয়ে শূন্যে তুলে ফেললো। পাজকোলে আষ্টেপৃষ্টে আবদ্ধ করতেই বুকের কাছে মেহনূরের একপাশটা লেগে গেলো। মেহনূর অনুভব করছে, মাহতিম তাকে কোলে তুলেই কটেজমুখো হয়েছে, সে চাপা জেদ হিসেবে দৃঢ় বাহুবলে মেহনূরকে চেপে রেখেছে। সিড়ির ধাপগুলো পদে-পদে অতিক্রম করে কটেজের রুমে প্রবেশ করলো মাহতিম, রুমের ঠিক মধ্যখানটায় সিলিং থেকে বিশাল আকারের ঝারবাতি জ্বলছে। সেই ঝারবাতির আলোতেই নান্দনিক শোভায় পরিপূর্ণ রুমটা মনোরম হয়ে আছে। পা দিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিলো মাহতিম, মেহনূরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে-আস্তে রুমের ডানদিকটায় চলে যাচ্ছিলো সে। কন্ঠটা কোমল করে হাসি দিয়ে বললো,
– আমার শার্ট পরতে হবে ম্যাডাম। কোন কালারটা পড়বেন আপনি?
মাহতিমের কথা ও হাসি দুটোই কৌতুহল করে দিলো মেহনূরকে। অনেকক্ষণ পর স্বচ্ছ চাহনিতে প্রশ্ন সূচকে জিজ্ঞেস বললো,
– কেনো?
মাহতিম শুধু হাসলো। মেহনূরের ঘাড়ের নিচে রাখা হাতটা একটুখানি এগিয়ে নিতেই মেহনূর সেদিকে তাকালো। তাকাতে দেরি, ‘ পটাশ ‘ করে শব্দ হয়ে লাইট নিভে গেলো রুমের। ঝারবাতির চোখ ধাঁধানো সোনালী আলোটা নিভে গেলেও রুমে ড্রিম লাইটের মতো মৃদ্যু আলো ছড়ালো। জানালা দিয়ে ঝুমঝুম বৃষ্টির ছন্দময় শব্দ ঘোর পরিবেশে নিয়ে গেলো। গ্রামের মাটি যেনো সিক্ত-অভিসিক্ত হয়ে সুমিষ্ট ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিলো। মেহনূর ওই স্বল্প আলোতে দেখতে পেলো, মাহতিমের মুখটা তার দিকে চলে আসছে। খুবই ধীরভাবে মুখটা নিচে নামিয়ে মেহনূরের কম্পন ওষ্ঠজোড়ায় নিশ্বাস ছাড়লো সে, মেহনূর খামচে ধরলো মাহতিমের সাদা কলারটা। আবারও হেসে দিয়ে মেহনূরের থুতনির উপর ঠোঁটদুটো রেখে মৃদ্যু চাপ দিলো মাহতিম, ফিসফিস করে নিজের ঠোঁটদুটো দ্বারা থুতনি ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে বললো,
– তোমাকে প্রথম চুমুটা কোলে তুলে দিবো বলেছিলাম। মনে আছে?
কুঁকড়ে থাকা মেহনূর চোখ খিঁচুনি দিয়ে জড়িয়ে যাওয়া গলায় বললো,
– ম-ম-মনে আছে।
মেহনূরের ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উপরে তুললো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে থুতনি থেকে অধরযুগল সরিয়ে কিন্ঞ্চিত উপরে তুললো। শীতলতার পরশকে উষ্ণতার কোমলতা দিয়ে ঢেকে দিলো সে। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত-আকন্ঠ-আকুল স্পর্শের কাছে নত হয়ে মেহনূরের
আদুরে অধরযুগল গাঢ় করে আঁকড়ে ধরলো মাহতিম। পিপাসিত মাটি যেমন বহুদিন-বহুকাল পর পানির সন্ঞ্চার পেয়ে সবটুকু পানিই শুষে নেয়, সেই আদুরে ঠোঁটদুটোয় তেমনিভাবে নিজের উন্মত্ততা প্রকাশ করছিলো সে।
মেহনূর অনবরত বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই হাতদুটো কলার থেকে সরিয়ে মাহতিমের ভেজা গলা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানগালে রাখলো, অপর হাতটা বাঁ-গাল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ভেজা চুলের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। হঠাৎ মেহনূর চমকে গিয়ে চোখ খুলে তাকালো, নিজের উন্মুক্ত পিঠটায় তরল কিছুর আভাস পেয়ে তৎক্ষণাৎ চুল থেকে হাত নামিয়ে ফেললো। হাতটা নিজের পিঠের দিকে উলটে নিয়ে সেখানে তরল স্পর্শ করলো, সারা শরীর অদ্ভুত ভয়ে কাটা দিয়ে উঠলো মেহনূরের। স্বাভাবিক হাতটা আচমকা কাঁপতে-কাঁপতে নিজের চোখের সামনে আনতেই বুঝলো, ওটা রক্ত! কাঁপা হাত থেকে চোখ সরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। ব্যান্ডেজ গলে রক্ত বেরুচ্ছে, রক্তে মেহনূরের পিঠ লেপ্টে যাচ্ছে, এই মানুষটা কি কাটাছেঁড়ার ব্যথা অনুভব করেনা? নির্বিকারে চোখের পল্লবজোড়া বন্ধ করলো মেহনূর। তার বন্ধ চোখজোড়ার দুইকোল ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পরলো নিশব্দে-নির্লিপ্তে-নিমিষে।
অনুরাগের সময়টুকু সাঙ্গ করে কোমল উষ্ণজোড়া মুক্ত করলো মাহতিম। চোখ খুলে ওই মুখখানিটা ড্রিম লাইটের মৃদ্যু আলোয় দেখার চেষ্টা করলো। আরো কাছ থেকে নিবিড় চাহনিতে মায়াবিদ্ধ হওয়ার জন্য ঘাড়ের নিচে থাকা হাতটা উর্ধ্বমুখী করলো। মুখটার বন্ধ চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি রাখলো মাহতিম। এবার যেনো চোখ সয়ানো চাহনিতে আবিষ্কার করলো, তার পাজকোলে আবদ্ধ থাকা প্রিয় মুখটার বন্ধ চোখদুটো থেকে নির্মল ধারায় অশ্রু ঝরছে, তার গালের উজ্জল চামড়াটা এমনই রাঙ্গা হয়ে ছিলো যে, প্রকৃতির সদ্য ফোঁটা লাল গোলাপের রসগুলো যেনো গালের চামড়ায় মাখিয়ে দিয়েছে কেউ।
মৃদ্যু ভঙ্গিতে হাসলো মাহতিম, রুমের লাইটটা না জ্বালিয়ে আবারও ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করলো। কানের রহস্যময় ছিদ্রপথে বৃষ্টির মুষলধারার শব্দ আসছে, মাটিগুলো ভিজে শ্যাওলার চাপা গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেই সাথে গন্ধে মিলেমিশে আছে কিছু নাম-না-জানা ফুলের প্রাণচাঞ্চল্যকর মধুর সুভাষ। মাহতিম ওই আরক্ত মুখের দিকে দৃষ্টি ফেলে তার হাতদুটো নিচে নামিয়ে সোফায় বসিয়ে দিলো। মেহনূরকে সোফায় বসিয়ে তার সামনেই ফ্লোরে হাঁটুগেড়ে বসলো মাহতিম, পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালো সে। বৃষ্টির স্বচ্ছ শীতল ধারায় সিক্ত হয়ে গায়ের ধবল রঙটা রক্তিম হয়ে উঠেছে মেহনূরের, মুখটা অদ্ভুত আবেশে অনুপম ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে আছে। মেহনূরের শান্ত চাহনিটুকুর সবটুকুই মাহতিমের হাসিমাখা চাহনির দিকে নিবদ্ধ, ঠান্ডা ভাবটা এখনো দেহের অঙ্গে-অঙ্গে শিউরে দিচ্ছে তার, দাঁত কপাটির ভাবটা এখন কম। মাহতিম নিজের ঘোর দৃষ্টিটা সংযত করে রুমের লাইট জ্বালিয়ে লাগেজের দিকে চলে গেলো, সেখান থেকে শার্ট বাছাই করতেই স্বাভাবিক গলায় বললো,
– তোমার গায়ে একটাও হবে না জানি। কিন্তু তোমাকে আজ রাতটুকুর জন্য পরতে হবে। সকালের ভেতর তোমার ভেজা কাপড়গুলোর ব্যবস্থা করে ফেলবো। তুমি কি একটু এ্যাডজাস্ট করতে পারবে? না ভেজা কাপড়েই থাকবে?
একটু আগের ওমন লজ্জা জনিত অবস্থায় পরার জন্য মেহনূর কোনো উত্তর দিবেনা তা ভেবেছিলো মাহতিম। তাই উত্তরের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের জন্য পোশাক নির্বাচনে উদ্যত হলো সে। বৃষ্টিমুখর বর্ষায় মৌনব্রত রুমটায় ছেদন করলো ঠান্ডা একফালি ইতস্তত সুর,
– আপনার, আপনার নেভি রঙের শার্টটা চাই।
চমকে উঠে দুই চোখ বড়-বড় করে তৎক্ষণাৎ ডানে তাকালো মাহতিম। চরম আশ্চর্য নিয়ে মেহনূরের দিকে তাকালে সাথে-সাথে দৃষ্টি নামাতে বাধ্য হলো মেহনূর। মাহতিম কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে আর বিব্রত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো না তখন। ধীরে-ধীরে মেহনূরের সহজ হওয়ার লক্ষণটা দেখে মন হালকা হলো, সে চুপচাপ মেহনূরের উদ্দেশ্যে তোয়ালে ও একসেট পোশাক বিছানায় রেখে নিজেও পোশাক বদলাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দরজা লাগানোর আগে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– তোমার চেন্ঞ্জ করা হলে দরজায় নক দিও।
মেহনূরকে একান্ত অবস্থায় পেয়েও ভেতরের ঝড়টা দামাল সামলালো মাহতিম। উজবুক মেহনূর এবার ঠিকই মাহতিমের ‘ পালাই পালাই ‘ অবস্থাটা বুঝে আপন মনে হেসে ফেললো। সোফা থেকে উঠে চটপট কাপড় ছেড়ে গায়ে শুকনো পোশাক জড়ালো মেহনূর, আয়নার সামনে যেতে-যেতে ভেজা বেণীটা আঙ্গুলে-আঙ্গুলে উন্মুক্ত করে ফেললো। ডানহাতের আঙ্গুলগুলো মাথায় চিড়ুনির মতো ঢুকিয়ে দিতেই আয়নায় নিজের ঢিলেঢালা পোশাকের প্রতিচ্ছবিটা দেখে থমকে গেলো। একমূহুর্ত যেনো নিরব রইলো মেহনূরের দৃষ্টি-নিশ্বাস-দেহ। এরপরেই খিলখিল করে জড়তাহীন মুখটা যেনো বহুদিন পর হেসে উঠলো, আয়নার সামনে হাতদুটো ‘ কাকতাড়ুয়া ‘ স্টাইলে দুপাশে উঠালো মেহনূর, তার চিকন দেহ থেকে নেভি কালারের শার্টটা কতো ঢিলা তা দেখে হাসিতে ফেটে পরলো।
পড়নের ট্রাউজারের মাপ দেখে মনে হচ্ছে, যেনো পেটমোটা মোমের ভেতর একরত্নি সরু সুতার পলতে। খুব কষ্টে ট্রাউজারের ফিতা বেঁধে কোমরের সাথে জড়িয়েছে মেহনূর, এতো ঢিলা-ঢিলা পোশাকে আসলেই অদ্ভুত লাগছে এখন। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পা টিপে-টিপে ওয়াশরুমের দরজায় আস্তে করে টুকটুক করলো, সেখান থেকে চুপটি করে সরে এসে লাগেজটা গুছিয়ে দিতে ফ্লোরে বসলো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলে কি ভেবে যে সেদিকে তাকালো, হাতের কবল থেকে ভাঁজকৃত শার্টটা অসহায়ের মতো লাগেজে ফসকে গেলো। ফ্লোর থেকে ধীরগতিতে উঠে দাঁড়াতেই অতি অসহন ভঙ্গিতে ঢোক গিললো মেহনূর, তার সামনে থাকা মানুষটা তরতাজা রক্তের খন্দ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখন। ভেজা শার্টটা ওয়াশরুম থেকে ধুয়ে আনলেও রক্তের দাগগুলো এখনো ছোপ-ছোপ করে সাদা কাপড়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে। বাঁ বাহুটার জন্য ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শার্ট বা গেন্ঞ্জি পরতে পারেনি মাহতিম, কালো ট্রাউজারটা পরেই বেরিয়ে পরেছে এখন। মাথাটা তোয়ালে দিয়ে ঘষতে-ঘষতে সোজা আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহুর উপর সাদা ড্রেসিংটা রক্তে ধুয়ে-ধুয়ে লাল-রক্তিম হয়ে উঠেছে, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ফোনটা প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে বের করে সৌভিককে কল করলো। কলটা লাউডে রেখে ভেজা চুল মুছতে-মুছতে ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হলো,
– হ্যাঁ, সৌভিক? মা ঠিক আছে? ঔষুধ দিয়েছিস?
প্রশ্নটা শুনে উত্তরের আশায় উৎসুক চোখে তাকালো মেহনূর। ওমনেই দেরি না করে আশ্বস্ত গলায় বললো সৌভিক,
– দোস্ত এখানে সব কন্ট্রোলে আছে। রজনী মামীকে যদি ঠিক সময় না ধরতে পারতাম তখন যে কি হতো! উহ্, ভাবতেই বুকটা শুকিয়ে আসে। মারজা আন্টিকে ঔষুধ খাইয়ে ঘুমাতে পাঠালাম। আমরা সবাই সামিকের বন্ধুর বাসায় উঠেছি। তুই আমাদের নিয়ে টেনশন করিস না। তোদের খবর বল, তুই কি রেসোর্টে উঠছিস?
তোয়ালেতে মুখ মুছতে-মুছতে জবাব দিলো মাহতিম,
– দশমিনিট হলো চেকিং দিয়ে রুমে আসলাম। বাইরে যে কি বৃষ্টি! ড্রাইভ করতে গিয়ে মেজাজটাই বিগড়ে গেছে।
কলের ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা গেলো, সেই হাসিতে আরো কথা সারছিলো দুই বন্ধু। পেছন থেকে নির্বিকার চাহনিতে চেয়ে থেকে লাগেজটা ঠিকমতো বন্ধ করে রাখলো মেহনূর। মাহতিমের ভেজা শার্টটা পানি চিপড়ে চেয়ারের উপর রাখা ছিলো, সেটাকে হাতে তুলে রক্তের দাগগুলো দেখলো মেহনূর। ওই লন এরিয়া থেকে রুম পযর্ন্ত দূরত্বটা চাট্টিখানি ব্যাপার না, তার উপর এই লোক সমস্ত রাস্তা এই ক্ষেপাটে বৃষ্টির মধ্যে নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে। সুখকর অনুভূতিটা স্বল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিলো।
তবুও স্বল্প সময়টুকু তার মনের অলিন্দ স্থানে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, এই মাহতিম আনসারী পুরুষটা ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষ স্বস্তির-শান্তির-নির্ভয়ের জায়গাটুকু কোনোদিন দিতে পারবেনা। শার্টটা নিয়ে চেয়ারের উপর টানটান করে মেলে দিলো মেহনূর। কথা বলা শেষ হতেই পিছু ঘুরলো মাহতিম, ওমনেই ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হয়ে গেলো দুজনের। মেহনূরের রাশি-রাশি লম্বা চুল থেকে বেশ পানি ঝরছে, মাথাটা ঠিক করে মুছেনি দেখে একটু রাগ লাগলো মাহতিমের। তোয়ালেটা কি সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছিলো? রাগটা দাঁতে চেপে ভেতরে দমিয়ে মেহনূরের দুবাহু ধরে বিছানায় বসালো মাহতিম, তোয়ালেটা নিয়ে তার ঠিক মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভেঙ্গে বসতেই বললো,
– আজ যদি তোমার কঠিন ঠান্ডা লাগে তাহলে আমার চেয়ে জঘন্য কেউ হবেনা মেহনূর। তুমি প্রচুর অবাধ্যতা করছো, আমি এসব মোটেও সহ্য করতে পারিনা।
কন্ঠের তেজ দেখে ঘাবড়ে গেলো মেহনূর। আজ তো নির্ঘাত জ্বর-ঠান্ডা-নিউমোনিয়া যা আছে, সব বেঁধে যাবে। কারণ, শীতের এমন করুণ মৌসুমে বরফের মতো বৃষ্টি তাকে গোগ্রাসে ছুঁয়ে ফেলেছে, নিউমোনিয়ার অসুখ থেকে একচুল নিস্তার পাওয়ার জো নেই। ইতিমধ্যে চুলের উপর মাহতিমের বলশালী হাতদুটোর কসরত চলছে যেনো, তোয়ালে দিয়ে চুলের শেষ পানিটুকু হরণ করার তীব্র চিন্তা। মেহনূর বিপাকে ফাঁসলেও আধো-আধো চাহনিতে হাসির ছলে বলে ফেললো,
– আমি কঠিন ঠান্ডায় যদি দম আঁটকে ম-রে যাই? তাহলে কি আপনি খুশী হবেন?
বেখাপ্পা প্রশ্ন দুটো ঠাট্টা করে বলেছিলো মেহনূর, এই ঠাট্টাটা কারো বুকের মধ্যে সাহসের দূর্গম প্রাচীরটা কেমন ভিত্তিসহ নাড়িয়ে দিবে সেটা চোখে দেখা যায়নি তখন। আগ্নেয়গিরির ভয়াবহ উদগীরণের ভয়ে মেহনূর দিশেহারা হয়ে পরলে মাহতিম বুকের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে ফের মাথা মুছতে থাকে। শান্ত ও সংযত গলায় যোগ্য জবাবদুটো ছুঁড়ে বলে,
– আমার সাথে যতখুশী ফাজলামি করো, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে বলার চেষ্টা করবে। আমি এমন কথাবার্তা পছন্দ করি না।
নিরব হুমকির বার্তা শুনে তটস্থ চোখে তাকালো মেহনূর, অনুতপ্ত সুরে গলা নামিয়ে বললো,
– বুঝতে পারিনি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
কথাটায় সায় দিয়ে চুল মোছা শেষ করে বললো মাহতিম,
– এবারের জন্য মাফ। পরবর্তীতে এমন ভুল করলে ক্ষমা থাকবেনা। কথাটা মনে থাকে যেনো।
মাথাটা উপর-নিচ নাড়িয়ে সম্মতির ইঙ্গিতটা বুঝালো মেহনূর। বসা থেকে কেবল উঠে দাঁড়াতে নিচ্ছিলো মাহতিম, এদিকে ব্যান্ডেজ পালটানোর তাগাদা কিভাবে দিবে সেটা নিয়ে উশখুশ করতেই হঠাৎ গলাটা মিহি করে সাবধানী কন্ঠে বললো,
– আপনার ব্যান্ডেজটা একটু দেখতে পারি?
অস্থিরতার জন্য নিশ্বাসটা কোনোভাবেই স্বাভাবিক হচ্ছেনা। বারবার এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমের লেশমাত্র ছোঁয়া নেই। বুকের ভেতর অদ্ভুত-উদ্ভট ভয় এসে দলা পাকিয়ে মনটাকে খেয়ে দিচ্ছে। দুঃস্বপ্নের ভেতর রাতগুলো পার করলেও আজ যেনো ভয়ের কারনে ঘুম নেই। মাহতিমকে তিনি বাড়ি ফেরার জন্য অনুরোধ করেছেন, স্পষ্ট করে বলেছেন তার মন কোনো অজানা ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছে। শরীর-মন যেভাবে ছটফট করে শুরু করেছে তাতে স্বস্তিতে বুকে নিশ্বাসও নিতে পারছেন না।
সত্যি-সত্যিই খারাপ কিছু হবে। মায়ের মন বিপদের গন্ধ যেনো দশ গজ আগে থেকে টের পায়, ধরতে পায় তার আশেপাশে অনিষ্ট কিছু হবে। এখনো মন যেনো চিৎকার করে বলছে, ‘ জঘন্য কিছু হবে, জঘন্য কিছু হবে। পালা। ‘ মারজা ভয়ে আবার শোয়া থেকে উঠে ঢকঢক করে দু’গ্লাস পানি খেলেন। কম্বল ফেলে, বালিশ উলটে তাড়াতাড়ি হাতের ফোনটা নিয়ে মাহতিমকে কল করলেন। এখান থেকে তিনি সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে ফিরতে চান, বাড়িটাই উনার আসল জায়গা, ভরসার জায়গা। বাড়ি থেকে বেরুলেই বিপদ! কলটা নেটওয়ার্কের জন্য কেটে গেলো, মাহতিমের কাছে পৌঁছলো না। তিনি ফোন ফেলে পাগলের মতো রুমে পায়চারি শুরু করলেন, পায়ের গিঁটগুলো অবশ হয়ে এলেও পায়চারী থামালেন না। থাই জানালার বাইরে গুমোট আকাশের বর্ষণ দেখে ভীত মুখটা সেদিকে তাক করলেন, থুতনিটা মৃদ্যু-মৃদ্যু কাঁপতেই চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে এলো, তিনি বিড়বিড় করে আকাশের দিকে ব্যর্থ অন্তরের ব্যকুল ভারে বলতে লাগলেন,
– আমি আর সহ্য করতে পারি না গো মাবুদ। এ কি যন্ত্রণায় পরেছি! কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবেনা, কেউ বুঝবে না আমি কেমন চিন্তায় ম-রে যাচ্ছি। এই প্রথম বাড়ি থেকে বের হয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না, কি ভয়াবহ বিপদের ঠাহর হচ্ছে সেটা যদি কাউকে বলতে পারতাম।
ফিরোজা রঙের সাদা পেড়ে ওড়নায় চোখ মুছলেন মারজা। ফোনটা নিয়ে আবার তিনি মাহতিমের ফোনে কল দিলেন। ইচ্ছা ছিলো মেহনূরের সাথে কথা বলে মন হালকা করবেন, তার বিশ্বাস মেহনূর তার কথা হাওয়ায় উড়াবে না, শুনবে। একে-একে নিরর্থক কলগুলো দিলেন ঠিকই, কিন্তু নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টের সীমানায় সেগুলোর একটাও পৌঁছালো না।
বৈরি আবহাওয়ার সোল্লাস ধ্বনিটা শাঁ শাঁ করে শোনা যাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টির ঝড়ো হাওয়া যেনো উদ্যমী হয়ে লম্বা-লম্বা গাছগুলোকে মাটিতে ঝুঁকাতে চাচ্ছে। এতোক্ষণ কেবল বৃষ্টির উত্তালটা বহাল ছিলো, এখন এর সঙ্গে দ্বিগুণ উৎসাহে যুক্ত হয়েছে ঝড়ো হাওয়াটা। মাহতিম চরম আশ্চর্য হয়ে মেহনূরের কথা মতোই বিছানায় উঠে বসলো, মুখোমুখি হয়ে বসতেই কোনোপ্রকার জড়তা ছাড়া মাহতিমের বাঁ হাতটা ধরলো মেহনূর, ফোলা পেশির শক্ত হাতটা ধরতেই নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। নিশ্বাসের অদম্য অবস্থাকে প্রকাশ না করে ভেজা গিঁটটা খুলে প্যাঁচানো কাপড় সরিয়ে আনলো মেহনূর , ক্ষতটা একপর্যায়ে দুচোখের সামনে উন্মুক্ত হলে তৎক্ষণাৎ চোখ খিঁচ মেরে আবার ধীরগতিতে চোখ খুললো। মাহতিম সবই চুপচাপ ভঙ্গিতে দেখে যাচ্ছিলো, ঠোঁটে সহজাত শান্ত হাসি ঝুলছে তার। রক্ত মাখা ভেজা তুলাগুলো তুলতে-তুলতেই বিহ্বল কন্ঠে বললো মেহনূর,
– খুব ব্যথা করছে?
মাহতিম মৃদ্যু হাসি দিয়ে মেহনূরকে একটু খোঁচা মেরে বললো,
– করলেও তো তোমার এতে যায় আসে না।
হাত থামতে গেলেও থামালো না মেহনূর, কিছু না শোনার ভঙ্গিতে কাজ সারতেই কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– যদি বলি যায় আসে?
চোখে বিষ্ময় ফুটিয়ে অবাক হলো মাহতিম, তৎক্ষণাৎ তর্জনী দিয়ে মেহনূরের থুতনি উঁচিয়ে ফেললো, সরল দৃষ্টির মাঝে তার অস্থির চাহনিটুকু মিলিয়ে দিয়ে চন্ঞ্চল সুরে বললো,
– কিসে যায় আসে তোমার? কিচ্ছুতে যায় আসে না! আমার শরীরের কাঁ’টাছেড়া দেখে কাঁদো-কাঁদো মুখে তাকাও, অথচ জায়গামতো ছুঁ’ড়ি তো তুমিই ঢুকিয়েছো।
থুতনিটা তাচ্ছিল্যের সাথে সরিয়ে দিয়ে কম্বল টেনে শুলো মাহতিম। বিছানার ডানদিকে ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে মেহনূরকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করলো। সমস্ত আয়োজন, সমস্ত চিন্তাভাবনা, সমস্ত জল্পনা নসাৎ করে দিলো ওর। হাতের মুঠোয় ভেজা ব্যান্ডেজের তুলোর দিকে দৃষ্টি দিলো মেহনূর, আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। আজ এতোটাই অবজ্ঞার দুয়ারে ঠেলে দিলো যে, মাহতিম ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছে। মেহনূর মুঠোভর্তি তুলাগুলো রুমের বিনে ফেলে লাইট নিভিয়ে বিছানায় ফিরলো। কম্বলটা গায়ে টানতেই মাহতিমের পিঠের দিকে মুখ করে শুলো। হাতটা একটু উর্ধ্ধে উঁচিয়ে জানালার একটা দ্বার কিন্ঞ্চিত ঠেলে দিলো, চাপ পেয়ে জানালাটা ক্যাচ করে খানিকটা খুলে গিয়ে সরু একফালি আলো ঢুকলো।
আলোটা দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্বের উপর তেরছা হয়ে পরেছে, ফাঁকা পেয়ে প্রকৃতির উদ্দাম হাওয়াও শান বাজিয়ে ঢুকছে। মেহনূর বালিশে গাল রেখে গালের নিচে বাঁহাতের তালু রেখে সুঠাম পিঠটার দিকে তাকালো, বিছানা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ডানহাতটা বাড়িয়ে দিতেই আবার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলো। সাহস হচ্ছে না বুকে, যদি মাহতিম ক্ষেপে উঠে? চোখ বন্ধ করে ডানহাতটা মুষ্টি করলো মেহনূর, ঘুমের জন্য বৃথা চেষ্টা সেরে ফের ডানহাতটা বাড়িয়ে দিলো। একবুক ভয়, একটু আশা, খানিকটা অনুশোচনা নিয়ে বিছানা থেকে শূন্য উঠিয়ে পিঠের উপর হাত রাখলো মেহনূর। আজ একটুও অস্বাভাবিক ভাবে হৃদকম্পন হচ্ছে না, দূর্বল লাগছেনা, কুণ্ঠা হচ্ছেনা, মেহনূর অদ্ভুত ভালো লাগায় পিঠ ছুঁয়ে হাতটা কাধে রাখলো। কম্বলটা সাথে-সাথে নড়েচড়ে উঠতেই অভিযোগী মুখটা কাধের কাছে এনে অপ্রসন্ন গলায় বললো,
– কি চাই?
মেহনূর ফিসফিস সুরে হাসি আঁটকাতে যেয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলো। এদিকে হাসির দশা দেখে মাহতিমের রাগ যেনো আরো তুঙ্গে! কাধ থেকে মেহনূরের হাতটা ঝটকা মেরে ওর দিকে ফিরলো সে, ভ্রুঁ কুঁচকে রাগ দেখিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
– পাগলের মতো হাসছো কেনো? কি চাই তোমার?
হাসিটা কোনোরকমে চেপে দুই বালিশের দূরত্বটুকু খতম করলো মেহনূর। নিজের বালিশটা বেখেয়ালে রেখে মাহতিমের দিকে এগুতেই বললো,
– ঘুমাতে চাই।
কথা শুনে ছোট-ছোট চোখে বাঁ ভ্রুটা উপরে তুললো মাহতিম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ক্ষীণ মেজাজে বললো,
– ওপাশ ফিরো,
‘ ওপাশ ফিরো ‘ মানেই তুমি ওপাশ ফিরে শোও, আমি আমার শক্ত-সৌম্য-সুগঠিত বুকটা দিয়ে তোমার সুকোমল দেহটা আগলে দিচ্ছি। তোমার দেহের ভেতর আমার উষ্ণতার সাহস, আমার শক্ত চেতনার দৃঢ়তা, আমার জীবিত নিশ্বাস ছেড়ে দফায়-দফায় কাছে থাকার মূলক বুঝাচ্ছি। মেহনূর অম্লানবদনে হাসি উৎসর্গ করে ওপাশ না ফিরে ওই বুকটার কাছে মুখ লুকিয়ে নিলো। প্রশ্নাত্মক চোখদুটো পরম উষ্ণতার নিবেদন পেয়ে তৎক্ষণাৎ বন্ধ হলো, দুপাটি দাঁতের করাত থেকে শান্তির দমটা সশব্দে বেড়িয়ে এলো। এই প্রথম মাহতিম আনসারীর নির্দেশটা কেউ অমান্য করলো, কেউ তার হৃদ দূর্গের বক্ষস্থলটা আত্মসাৎ করে সেখানে ছড়িয়ে দিলো আনন্দের সুখ। ঝুমঝুম বৃষ্টির হিংস্রতায় শীতল হওয়া বুকটার ভেতর থেকে উত্তর এলো,
– আপনি আমার উপর যতখুশী রাগ করুন, আপত্তি নেই। শুধু এসব ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলবেন। আমি এমন দূরত্ব পছন্দ করি না।
মুখটা আশ্চর্যে হা হতেই হোহো করে হেসে উঠলো মাহতিম। বাহুজোড়ায় আষ্টেপৃষ্টে ধরে হাসতে-হাসতে বললো,
– কি কাণ্ড! আমার ডায়লগ আমার উপরেই ছুঁড়ে দিলে?
বজ্রপাতের নোঙ্গর যেনো কাঁপিয়ে তুলছে ভূমি! একের-পর-এক বজ্রধ্বনি বুকের ভেতর শেঁল বিঁধিয়ে দিচ্ছে! মেঘে-মেঘে ছুটছে বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গ, প্রকৃতি যেনো ক্রুদ্ধ হয়ে বিকট চিৎকারে ফেটে পরেছে, এমনই একটি কালো অন্ধকারে ঢাকা পরেছে সময়ের সন্ধিক্ষণ। ঘড়িতে ভোর ছয়টা বাজতে পাঁচটা মিনিট বাকি আছে, কিন্তু বাইরে নেই এক চিলতে আলো। আলোহীন প্রকৃতিটা কেমন বীভৎস-ভয়াবহ-গা কাঁপানো লাগছে, তা জানালার সরু ফাঁকটা দিয়ে দেখছে মেহনূর। ঘুমটা বজ্রপাতের প্রথম দুটো বাজের সময় ভেঙ্গে যায়, পাতলা হওয়া ঘুমটা আর চোখের কোটের আসেনি। বাবার বাড়িতে থাকলে ঘুমের ভেতরেই এক চিৎকার দিয়ে উঠে পরতো মেহনূর, কিন্তু আজ সেটা মাহতিমের উষ্ণ বুক পেয়ে হলো না।
গুটিশুটি পাকিয়ে কচ্ছপের শক্ত খোলসের মতো উন্মুক্ত বুকটার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো তখন। মনের অস্থিরতা একটু স্বাভাবিক হলে হাতজোড়া আলগা করে মুখটা উপরে তুললো মেহনূর। না, মানুষটা এখনো ঘুমে মগ্ন। তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ঠোঁট প্রসার করে মুচকি হাসলো মেহনূর, ঘুমন্ত মুখটাকে আরো কাছ থেকে, আরো নিবিড়ভাবে দেখার জন্য বালিশে মাথা উঠিয়ে রাখলো। মাহতিমের ব্যান্ডেজ খোলা হাতটা আস্তে করে টেনে এনে নিজের গায়ে রাখলো মেহনূর, কম্বলটা টেনে দিয়ে মাহতিমের পিঠের দিকটা ঢেকে দিলো। ক্লিন শেভের পরিষ্কার গালটায় দাড়ি নেই, প্রতিদিন ক্লিন শেভ করাটা তার প্রোফেশনাল কর্মের বৈশিষ্ট্য।
ভোরবেলায় উঠাটা তার নিত্যদিনের শ্যাডিউল, আজই একটু চোখ বুজে শান্তির তন্দ্রায় ডুবে আছে। সেই পরিষ্কার গালটার প্রতি ক্ষুদ্র লোভ কাজ করলো মেহনূরের, এই বৃষ্টিমুখর নিরিবিলি মূহুর্তে লোভটা যেনো দেহ-মনে চন্ঞ্চলতা বাড়িয়ে দিলো। মাহতিমের তন্দ্রাচ্ছন্নের সুযোগ নিয়ে একটুখানি ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনায় ডানহাতের আঙ্গুলগুলো অগ্রসর করলো মেহনূর, ঈষৎ কাঁপা-কাঁপা আঙ্গুলগুলো গালের পরিখায় রাখতেই পায়ের নখ-থেকে-মাথার চুল পযর্ন্ত শিউরে উঠলো তার। চোখ বন্ধ করে অন্তঃস্থলের অস্বাভাবিকতা প্রশমন করতে গিয়ে ছোট্ট ঢোক গিললো।
– আমার ঘুম কিন্তু তোমার চেয়েও পাতলা মেহনূর।
চকিত ভঙ্গিতে চোখ খুলে লজ্জায় হাত সরাতে নিলো মেহনূর, গাল থেকে যখনই হাত উঠাতে নিলো তখনই মাহতিমের বলযুক্ত হাতের কঠিন থাবা এসে মেহনূরের হাতটা আগের জায়গায় চেপে রাখলো। এবার তন্দ্রাচ্ছন্ন অভিনয় ছেড়ে স্বাভাবিক এবং ঘুমহীন চোখে তাকালো মাহতিম, সরাসরি মেহনূরের দৃষ্টিতে-দৃষ্টি তাক করে বললো,
– তোমার সামনে এ্যালিট ইউনিটের মানুষ শুয়ে আছে। স্পেশাল ওয়ারফেয়ার ডাইভিং এ্যান্ড স্যালভেজ। তুমি আমার গায়ে হাত রাখবে আর আমি টের পাবো না?
অবাক হয়ে ঢোক গিললো মেহনূর, বিষ্মিত চাহনিটা স্থির রেখে ভয়ার্ত সুরে বললো,
– জ্বী।
মাহতিম চোখাচোখি দৃষ্টিটা অটল রাখা অবস্থায় মেহনূরের হাতটা এনে ঠোঁটের উপর রাখলো। হাতটায় গাঢ় করে ঠোঁটযুগলের অদৃশ্য সীলমোহর ছাপিয়ে দিতেই ধীরাজ কন্ঠে বললো,
– তুমি কি আমাকে এখন পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারো? আমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ বা শঙ্কা উঁকিঝুঁকি করে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাহতিমের হাতের বলয় থেকে ইচ্ছে করে হাত সরালো মেহনূর, মাহতিম অপ্রতিভ দৃষ্টিতে চোখ করতেই মেহনূর পুনরায় মাহতিমের গাল স্পর্শ করলো। চোখ দৃষ্টি অকুণ্ঠ রেখে মুখটা এগিয়ে নিলো। বুকের অকুল চিন্তার নিশ্বাসটা শব্দ করে ছাড়তেই মলিন হাসিতে বলতে লাগলো,
– আপনি কি জানেন, আমি যে নিজেকে পছন্দ করিনা? আমার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে এতো গালমন্দ শুনেছি যে এখন নিজের প্রতি এখন ধিক্কার আসে। কেউ যদি বলে ‘ তুমি এটা পারবেনা ‘, তখন আমিও মনে-মনে বিশ্বাস করে ফেলি ‘ আমি সত্যিই ওটা পারবো না ‘। কোনোদিন কারো কথার খেলাফ করিনি, প্রতিবাদ করা আমার ভালো লাগে না। আপন মানুষদের কথায় কিসের প্রতিবাদ করবো বলুন? তাদের প্রতিবাদ করলে যে নিজের কপালেই দুঃখ জুটে! তবুও সত্য হলো আমার জীবনটায় আঠারোটা বছর হলেও আমার জীবনে আঠারোটা মানুষ নেই। আমি লেখাপড়া শেখা এক মূর্খ, যে কিনা গুছিয়ে কথা বলতে জানেনা। সবাই আমাকে নিয়ে নাক ছিটকায়, কারো-কারো কাছে আমি বিরক্তির মানুষ। জানেন, আমি চুপ থাকলেও সব বুঝি। কোনো মেয়ে যদি বাচাল হয় তাহলেও সমস্যা, কম কথা বললেও সমস্যা, স্বাভাবিক থাকলেও কোনো-না-কোনো সমস্যা তাকে ধরবেই। দিনশেষে একটা মেয়ের বিরুদ্ধে আরেকটা মেয়েই আঙ্গুল তুলে কথা বলে। পুরুষের চোখ যদি ছুঁচালো হয়, তাহলে মহিলাদের ঠোঁট ছুঁড়ির মতো ধারালো। হয়তো আমার ঠোঁট ধারালো নেই বলে আমি সকলের কাছে অযোগ্য। আর আপনি একটা অযোগ্যকেই বিয়ে করেছেন, আমার মতো কুচ্ছা শোনা মেয়ের প্রতি তো —
তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেলো কন্ঠটার! ভূকম্পনের মতো পুরো শরীর কেঁপে উঠতেই নিশ্বাস যেনো কুণ্ডলী পাকিয়ে গলায় বিঁধলো! একফোঁটা নিশ্বাসের জন্য দুহাতের মুঠোতে চাদরটা মোচড়ে এলো, গলা-মাথা-কপাল যেনো ঘেমে উঠার মতো অবস্থা! দম বন্ধ হওয়ার অসহন যন্ত্রনায় শিউরে উঠতেই হঠাৎ গম্ভীর গমগমে সুরটা চাপা ক্ষোভের সঙ্গে ছিটকে এলো,
– ঠিক এভাবেই দম বন্ধ করে মেরে ফেলবো। একদম নিশ্বাস নিতে দেবো না। ঠিক তেঁতাল্লিশ মিনিটের ভেতর তোমার নিশ্বাস ফুরিয়ে যাবে। তুমি আমার সামনে কোন্ স্পর্ধায় এ ধরনের কথা বলার সাহস দেখাও? তুমি কি আমাকে ভয় পাও না? আমার অবস্থা কি হবে ভেবেছো?
অস্থির অবস্থায় উত্তেজিত হয়েছিলো মেহনূর, মাহতিমের কথা শুনে সেই অবস্থা থেকে একদম পরিশ্রান্ত হয়ে গেলো। নিশ্বাসের জন্য আরেকবার মুখ উঁচাতেই প্রশিক্ষণ সম্পণ্ণ হাতের থাবাটা ঢিলা করলো মাহতিম। ছাড়া পেয়ে মুখ হা করতেই চোখ খিঁচুনি দিয়ে লম্বা নির্মল শ্বাস টানলো, ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে চোখ খুলে তাকালো মেহনূর। বিশাল দেহের শক্তপোক্ত শরীরটা এখন তার দেহের উপর ঝুঁকে আছে। তার তীক্ষ্ণদৃষ্টির প্রতি একটুও ভয় না পেয়ে চোখে-চোখ রেখে কিন্ঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বললো,
– পেতাম। সেই ভয়টা আপনিই দূর করে দিয়েছেন। এর জন্য কেবল আপনি দায়ী।
মাহতিম এখনো গম্ভীর, মুখে ছোট্ট কথা অবধি নেই। একটু থেমে পুনরায় হেসে বললো মেহনূর,
– আপনি আমাকে কোনোদিন মারবেন না। যদি মেরেও ফেলেন তাতে আমার আফসোস — ,
মুখ থেকে কথা লোপাট করলো মাহতিম। তেজপূর্ণ কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে বললো,
– আমার অবস্থাই বেহাল হয়ে যাবে। আমি থাকতে পারবো না।
গুড়ুম-গুড়ুম করে আকাশ ডেকে উঠলো, বৃষ্টির সাথে একঝাঁক দমকা হাওয়া ঢুকে পরলো নিরব রুমে। ঠান্ডার প্রখরতাকে জানান দিয়ে ফর্সা হতে লাগলো ঘুটঘুটে কালো আকাশটা। মাহতিম ভারী নিশ্বাস ছেড়ে মুখটা নিচে নামাতে লাগলো তখন, একটা হাত দিয়ে আদর করে ধরলো মেহনূরের গালের আস্তরণ। স্বেচ্ছায় আঁখিপল্লব বন্ধ করলো মেহনূর। নিজের উৎসুক হৃদয়কে সমুখে বাড়িয়ে দিয়ে স্বল্প সময়ের উষ্ণতার জন্য উন্মুখ হলো। কিছুক্ষণ পরেই দুচোখের পাতায় উন্মাদের মতো অধরকার্যের প্রগাঢ় চাপ অনুভব করলো মেহনূর।
বন্ধুর বাড়িতে উঠে দারুণ যন্ত্রনার শিকার হয়েছে সামিক। এখানে হুট করেই পানির মটরটা নষ্ট হয়ে সবাইকে কঠিন ভোগান্তিতে ফেলেছে। শহরে বিদ্যূৎ-পানি-গ্যাস তিনটির জন্য হাহাকার অবস্থা থাকে, গ্রামে এসব না থাকলেও বিকল্প এবং আদিযুগের ঐতিহ্য রীতিতে দিব্যি কেটে চলে। নাওয়া নেই সেই গতকাল থেকে, হাতমুখ ধোয়ার জন্য প্লাস্টিক বালতিতে বৃষ্টির জমা করা পানি দিয়ে কাজ চালিয়েছে। সবচেয়ে বেশি গোমড়া হয়ে আছে রজনী। একটু পরপর কঠিন গলায় সামিককে এসপার-ওসপার করে ধুয়ে দিচ্ছে, গলার তেজ শুনে দুঠোঁট চেপে হাসছে মাহদি। রজনী যেই চোখ পাকিয়ে তাকায় ওমনেই নাদান বাচ্চার মতো ‘ আমি ফিডার খাবো ‘ ভঙ্গিতে মারজার দিকে তাকায়। মারজার অস্থির বিপন্ন মন আরো বিপর্যস্ত হয়ে কঠিন ধমক লাগায়।
মায়ের বকুনি খেয়ে এবার উদাস হয়ে যায় মাহদি। সবার বকাবকি ইচ্ছামতো শুনতে পারবে মাহদি, শুধু মা আর ভাইয়ের বকা শুনলে নেতিয়ে যায়। যেই বাসায় ওরা অতিথি হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে সেখানে খেলনা তো নেই, উলটো খেলার সঙ্গীও নেই। ফারিন যা একটু সঙ্গ দিতো, এখন সে দরজা আঁটকে প্রীতির সাথে চুটিয়ে ঘুম দিচ্ছে। ট্যূরের উছিলায় কেউ গেমসের খেলার জন্য মাহদিকে ফোন দিচ্ছে না, বারান্দায় গিয়ে গ্রিল ধরে বাইরে তাকালো মাহদি। থুতনিটা গ্রিলের উপর বসিয়ে ভাই আর ভাবীকে মিস করছিলো সে। তারা দুজন মানুষ যতোই তাকে বকা দিক, দিনশেষে কখনো তাকে একা ফেলে যায়নি। মাহতিম যতই ব্যস্ত ব্যক্তিসম্পন্ন কর্মকর্তা হোক, একবার বাড়ি ফিরলে সেই সব কষ্টের দিনগুলো একদম ভুলিয়ে দিয়ে যায়। মেহনূর কোনোদিন মাহদিকে না খাইয়ে নিজে খেয়েছে বলে এখনো মনে করতে পারে না মাহদি। মেহনূরকে যতখুশি তত ‘ বউ, বউ ‘ করে ডাকে, এতে একটুও বিরক্ত হয়না মেহনূর, উলটো হাসি দিয়ে পিঠ একটা আদুরে চাপড় মারে। হতাশার নিশ্বাস ফেলে ঘোলাটে আকাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললো সে,
– তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো ভাইয়া। আমার কিছুতেই মন টিকছে না। জলদি আসো, জলদি আসো।
চোখ বন্ধ করে দু’মিনিট শান্ত থাকলো মাহদি। ঝমঝম বৃষ্টির আওয়াজটা নিরবে অনুভব করলো। ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ভেজা টাইলসের উপর আনমনে এঁকেবেঁকে চিত্র কষতে লাগলো। চোখ খুলে ডান পা দিয়ে একই কাজ করতে-করতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালো মাহদি। হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে ডানপা থামিয়ে সেটা আরো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো। দারোয়ানের বাথরুম থেকে টিনের দরজাটা একটু ফাঁক করে উঁকি দিয়ে আছে সিয়াম। মাথাটা উঁকি দেওয়ার পাশাপাশি ডানহাতে সবুজ বদনাও দেখা যাচ্ছে। চাল ধোয়া পানিটা যেনো বদনায় না পরুক তার জন্য হাতটা টান-টান করে বাইরে এগিয়ে ধরেছে। বৃষ্টির পানি দিয়ে বদনা ভর্তি? হোহো করে গলা ফাটিয়ে হেসে দিলো মাহদি। তার হাসি এখন দেখে কে! বাথরুমে গিয়েও বেচারা আধা কাজ শেষ করে বদনা ভর্তি করতে নেমেছে। মাহদি হাসতে-হাসতে গ্রিল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ফ্লোরে ধপাস করে বসে পরলো। হাসির তোড়ে ফ্লোর থাপড়াতে-থাপড়াতে হাসতে লাগলো। একটু শান্ত হলে পেট চেপে আবার উঠে দাঁড়ালো মাহদি, আবার একই দৃশ্য দেখতে হোহো করে হেসে গ্রিলে কপিল ঠেকিয়ে দিলো।
থেমে-থেমে বৃষ্টি হচ্ছে আজ। শীতে মুড়িয়ে আছে সাদামাটা দিনটা। কম্বলের পশমতুল্য উষ্ণতার ভেতর নতুন বউ নিয়ে ঘুমিয়ে আছে নোমান ইকবাল। এবার বসের অজুহাতে সেও কিছুদিন ছুটি পেয়েছে। বাড়ি ফিরতেই নানা টেনশনের ভেতর দিয়ে পরিবারের চাপাচাপিতে বিয়েটা করতে নারাজ ছিলো। শেষমেশ হামেশার মতো তার বসের কাছে পরামর্শ চাইলো নোমান। তার বিশ্বাস, তার বস মাহতিম আনসারীর কাছে সব ধরনের সমাধান পাওয়া যায়। লোকটার মাথায় যেনো উপস্থিত বুদ্ধির মেশিন ফিট করা আছে, যখনই কোনো বিপদ দেখে জাস্ট কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করতেই এমন একটা পরিকল্পনা করে যা বর্ণনাতীত!
এবারও বসের পরামর্শ মোতাবেক বিয়েটা করেই ফেলেছে নোমান। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে বলে বড়সড় আয়োজন করে বিয়ে করেনি। কিন্তু এখন বিয়েটা করে মনেহচ্ছে, আহা স্বর্গীয় সুখ! তার বসকে এখন একশো-একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে। লোকটা কি জম্পেশ বুদ্ধিই না দিলো! তার মানে তার বস মানুষটা যতোই শুকনো মুখে গম্ভীরভাবে চুপ থাকুক, দিনশেষে তারও অভিজ্ঞতা আছে। বউকে জড়িয়ে ধরে আরো আয়েশ করে ঘুম দিলো নোমান, হঠাৎ বিপ্ বিপ্ করে তার ফোনটা ভাইব্রেট হয়ে উঠলো। আরামের শয্যা ছেড়ে ফোন ধরতে অলসতা কাজ করছিলো, একটানা পাঁচটা ভাইব্রেট কল কেটে যেতেই ষষ্ঠ নাম্বারের সময় বউয়ের ঠ্যালা খেয়ে উঠলো নোমান। কলটা ঘুম-ঘুম চোখে না দেখে রিসিভ করলো, মুখভর্তি গালি থেকে একপ্রস্থ গালি ছুঁড়ে বললো,
– ওই হা-লা, কে রে তুই? এমন বে-টাইমে কল দিলি কোন্ কলিজা দিয়ে?
ওপাশ থেকে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো কেউ,
– তোমার কলিজা আমি পারা দিয়ে ধরবো নোমান। স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে দেখো কে আমি।
চোখ কচলাতে গিয়ে হাত থেমে গেলো নোমানের। কথা শুনে বুকের ভেতর ধুকুর-পুকুর করছে। বড় করে ঢোক গিলে কান থেকে ফোন নামালো নোমান। স্ক্রিনে তাকিয়ে ‘ M.A.B. ‘ স্পষ্ট করে অক্ষর তিনটা দেখতে পেলো। মাহতিম আনসারী বস! ভয়ে-ভয়ে কানে ফোন ঠেকিয়ে ভীত কন্ঠে বললো,
– হ্যা-হ্যালো বস,
ওপাশ থেকে ক্ষেপে গিয়ে বললো মাহতিম,
– বউ হয়েছে বলে আমার সাথে গালাগালি? এগুলো কেমন ধরনের আচরণ নোমান? তোমার কি এখন লম্বা বিরতি দরকার? প্রয়োজন হলে জানাও, আমিও সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
নোমান তাড়াতাড়ি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে মাফ চাইলো। ভুলটা তার নিজের বলে অনেকবার ক্ষমার বাক্য খরচ করলো। মাহতিম এখন ঘ্যানঘ্যাননি শোনার মানসিকতায় নেই বলে সংক্ষেপে তার জন্য একটা গাড়ি পাঠানোর কথা বললো। নোমান যথা আজ্ঞার মতো নির্দিষ্ট ঠিকানায় গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে জিপটার তদারকির জন্য নিজে রওনা দিলো। সূত্র মোতাবেক নক্ষত্রবাড়ি রেসোর্টে পৌঁছলো একটা গাড়ি, জিপটা কর্তৃপক্ষের কাছে রেখে নোমানের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলো মাহতিম।
আগত গাড়িটায় চড়ে বৃষ্টির মধ্যেই সামিকের বন্ধুর বাসার দিকে রওনা দিলো সে। মেহনূর জানালার কাঁচ নামিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে, মুখের উপর বৃষ্টির ছাঁট খেয়ে থেমে-থেমে হাসছে। পলকে-পলকে নজর দিচ্ছে মাহতিমের বিচক্ষণ চোখ। এতোদিন পর ফ্যাকাশে বিষণ্ণ চেহারায় হাসির লালিমা ফুটেছে, হাসির উচ্ছলতায় প্রাণবন্ত সুমিষ্ট মুখটায় মায়া ছাপিয়ে দিয়েছে, ভেতরের গুমোট-শক্ত আবরণটা নিঃশেষ হয়ে গুছানো-নরম মনোচিত্তে ফিরিয়ে দিয়েছে। একদিকে যেমন মেহনূরের সাথে সম্পর্কটা সহজ করে এনেছে, তেমনি মেহনূরের অন্তর থেকে জানতে পেরেছে কঠিন সত্য। শোনার পর মাহতিম যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, পরের বাক্যগুলো কিচ্ছু শুনতে পায়নি সে। স্টিয়ারিং চেপে একপলকের জন্য বামে তাকালো মাহতিম, মুখটা ড্রাইভে ফিরিয়ে এনে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– মেহনূর, যদি তোমার দাদাভাই আমাকে বিয়ের ব্যাপারে ‘ না ‘ করে দিতো, তখন কি তুমি আমায় ফিরিয়ে দিতে?
এমন অদ্ভুত কথা শুনে ঠোঁট থেকে হাসি মিলিয়ে গেলো, জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে ডানে তাকাতেই মাহতিমের দিকে তাকালো। হতভম্ব দৃষ্টিতে বললো,
– আপনি কেমন প্রশ্ন করলেন?
মাহতিম তাড়া দিয়ে বললো,
– উত্তরটা শুনতে তো দোষ নেই। তাছাড়া এখন তুমি আমার বউ। তোমার দাদা হাজারবার মাথা ঠুকলেও তো তোমাকে ফিরিয়ে দেবো না।
মেহনূর এমন অপ্রস্তুত প্রশ্ন শুনে অনেক সময় যাবৎ কথা বললো না। জানালার কাঁচটাও উঠিয়ে দিলো সে, ভেজা হাতটা আঁচলে মুছতে-মুছতে তার ঠোঁটের হাসিটুকুও যেনো ছিনিয়ে ফেললো কেউ। মেহনূর দীর্ঘক্ষণ যাবৎ মৌন পালন করে নির্লিপ্ত সুরে বললো,
– আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম।
বিকট আওয়াজে চলন্ত গাড়িটা জোরালো ভাবে থেমে গেলো! হুট করে এরকম ব্রেক কষাতে পেছন থেকে অন্য একটা গাড়ি পাশ কেটে যেতে-যেতে ‘ খান* পোলা চোখ কি আকাশে তুইলা চালাস ‘ বলে জঘন্য একটা গালি দিলো। মাহতিম গালিটা শুনলো কিনা ঠাহর করা গেলো না, দু’হাত দিয়ে স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে আছে সে, চোখদুটো বন্ধ দৃষ্টি নিচের দিকে ঝুঁকানো তার। সীটবেল্ট বাঁধার সুবিধায় কোনোরকম ক্ষতি বা ব্যথা পায়নি পায়নি মেহনূর, কিন্তু ভয়ের যেই গোলাটা চোখের সমুখে দেহের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে টের পেলো সেটা বীভৎস! ফোন বাজার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহতিম, চোখদুটো তখনও নিদারুণ যন্ত্রনায় বন্ধ। কলটা আন্দাজমতো রিসিভ করে কানে চাপলো মাহতিম, ওপাশ থেকে অত্যন্ত চিন্তিত এবং অস্থির গলায় বললো,
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৪২+৪৩
– হ্যালো আনসারী স্যার, প্লিজ ক্লাইন্ডলি আমার কথাটা শুনুন! আপনাকে ওরা ট্রেক করার ফর্দ করে ফেলেছে। আপনি এলার্ট থাকুন, দ্যা আর ভেরি ডেন্ঞ্জারাস স্যার! ওরা সংখ্যায় কতজন আপনার পেছনে লেগেছে আমরা কেউই ইনফরমেশন পাচ্ছি না। আপনাকে যেখানেই পাবে সেখানেই ওরা মা-র্ডার করে ফেলবে স্যার!
