মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫৪+৫৫

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫৪+৫৫
ফাবিয়াহ্ মমো

দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রটা বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সব রকমের কলাকৌশল প্রস্তুত করা শেষ। এখন শুধু শিকারের জন্য অপেক্ষা। চারিদিক থেকে হানা দেওয়ার জন্য ওত পেতে আছে দলবল। একটা ইশারা পেলেই জানোয়ারের মতো কোপ চালাবে তারা। ঘড়িতে টিক-টিক করে দশটা বেজে যাচ্ছে, রাত্রিকালীন সময়। জঙ্গলের গোপন আস্তানায় তিনটা ছেলেপিলে নিয়ে বসে আছে কালাম। উঠোনের চৌকিতে চুপচাপ বসে আছে সে। তার সামনে এক পেয়ালা ধোয়া উঠা মালাই চা। পেয়ালার হাতলটা দু’আঙ্গুলে পেচিয়ে সোজা ঠোঁটের কাছে আনে, হালকা একটা ফু দিয়ে ছোট্ট চুমুক দেয়। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে কালাম। চতুর মস্তিষ্কটা প্রচণ্ড আরাম বোধ করে।

– চাছা?
চাচার বিকৃত সম্বোধনে একটু বিরক্ত হয় কালাম। চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নেড়ে সায়সূচকে ইশারা করলো, তা দেখে ছেলেটা একটু পুলকিত হলো। বাকি দুজনের দিকে একবার করে চেয়ে নিয়ে এবার মূখ্য কথায় ফিরলো। কন্ঠে একটু সতর্কতা মাখিয়ে একবুক ভয় নিয়ে বললো,
– বাইরেত্তে এট্টু ঘুইরা আহি? হেই কহনতে কামলা খাটতাছি চাছা, এট্টু বাইরে যাইতে চাইতাছি। এট্টু যাই?
সাথে-সাথেই দুপাশ থেকে কনুই গুঁতা খেলো ছেলেটা। তার দুপাশে থাকা দুজন ছেলে আরো কিছু বলার জন্য তাগাদা দিলো। ছেলেটা ইশারার গুঁতা খেয়ে আমতা-আমতা করে বললো,
– না মানে, হইছে কি চাছা, বিল্লাল আর মফিজও আমার লগে যাইতে চায়। আপনে যুদি —
একটানা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রাখলো কালাম। চোখদুটো বন্ধ করে যোগাসনের মতো বসে আছে সে। গলাটা গম্ভীর করে খড়খড়ে সুরে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– যেতে চাস যাবি। কিন্তু, গোসল ছাড়া এই আস্তানায় ঢুকবি না।
কথাটার গভীর অর্থটা অন্যকেউ না বুঝলেও ওরা তিনজন ঠিকই বুঝলো। রাতের এই নিরিবিলি সময়ে ফূর্তি করতে চাচ্ছে ওরা, এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ দেখায় না কালাম সরদার। একসময় সেও যৌবনকালে এসব নিয়ে মত্ত ছিলো, বিভিন্ন ভাবে সিনেমার টিকিট যোগাড় করে নানা অসাধু কাজ করতো, তাও সেটা লোকলজ্জার চক্ষু এড়িয়ে। তার সঙ্গী-সাথীরা নানাভাবে ধরা পরলেও সে নিজে কখনো ধরা পরেনি। ব্যাপারটা কাকতলীয় হলেও চরম সত্যি। ঠোঁটে ঝলমলে হাসিটা কায়েম রেখে বাবু, বিল্লাল, মফিজ উঠে গেলো। তিনজনই খুশীতে গদগদ হয়ে যেতে ধরলে পেছন থেকে গাম্ভীর্য সুরে বলে উঠলো,

– রমজানের ফার্মেসীতে যাবি না। ধরা পরবি। মকবুইল্লার দোকানে ওইসব পাওয়া যায়। আর শোন, যদি কেউ কেলেঙ্কারি করতে গিয়া ধরা পরোস! একেকটার ক’ল্লা আলাদা থাকবো, সাবধান। মাথা কোনদিকে, বডি কোনদিকে, হদিশও পাবি না।
ভয়ে-বিষ্ময়ে তিনজন একে-অন্যের দিকে তাকালো। একসঙ্গে ঢোক গিলে কালাম সরদারের কাছ থেকে বিদায় নিলো তারা। পুরো আস্তানায় শুধু জেগে আছে কালাম, বাকিসব গভীর ঘুমে।লুঙ্গি ও কোমরের চিপা থেকে ফোন বের করলো, বাটন ফোনটা টিপে কল করলো সে। পেয়ালাটা আবার উঠিয়ে চুমুক দিতে নিলে ওই মূহুর্ত্তেই রিসিভ হলো কলটা। বিপরীত পাশ থেকে মার্জিত ও সভ্য সূচকে বললো,
– হ্যালো,

উত্তর না দিয়ে বেশ জোরে চুমুক দিলো কালাম। ভাবভঙ্গি এমন, যেনো চা খাওয়াটাই প্রধান কাজ, বাকিসব পরের ব্যাপার। হঠাৎ সে খেয়াল করলো, একটা ‘ হ্যালো ‘ বলার পর আর কোনো শব্দ আসছেনা। চায়ে শেষ চুমুকটা দিতেই বিদঘুটে হাসি দিলো কালাম। হাসতে-হাসতে লুঙ্গির কোঁচে কপাল মুছে বললো,
– ভয়ে জবান বন্ধ হইলো নাকি?
এবার শক্ত গলায় জবাব এলো,
– জানো-য়ারের সাথে কথা বলতে ঘেন্না করে।
একটু থামলো কালাম, হঠাৎ নিরবতা চিঁড়ে হো-হো হাসির পৈশাচিকতা ফুটে উঠলো। কিছুক্ষণ পর হাসি থামতে-থামতে গম্ভীর হলো সে, কন্ঠ তীক্ষ্ম করে বললো,
– মুখ সামলে কথা বলবি। তোর চৌদ্দগোষ্ঠী শেষ করতে আমার এক মিনিটের ব্যাপার! বেশি পাওয়ার দেখাতে যাবি, ওমনেই মা’রা।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো মাহতিম। হাসিটা থামিয়ে ডিরেক্ট তুই-তোকারি করলো সে, পুরো বেপরোয়া ভঙ্গিতে গর্জে উঠলো তখন,

– আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর ভেতর তোর নাতনী বাদ নেই। মুখটা তুই সামলে কথা বলবি! তোর আলগা পাওয়ার আমাকে দেখাতে আসিস না।
থামলো না কালাম। ঝাঁঝের সাথে বলে ফেললো,
– তোর ওই পাওয়ার আমার বা* ছিঁড়বে। শা’লা জানো’য়ারের বাচ্চা! তুই এইবার খালি আমার সামনে আয়, তোর বুকের কলিজা আমি দুই হাতে কু’টিকু’টি করবো! তুই আমাকে ঢপ খাইয়েছিস না? আমার চোখে পট্টি মেরে এতোগুলো দিন চালাকি করেছিস, তোকে তো আমি বিনা সুদে ছাড়বো না। তুই একবার শুধু আসবি! তোর যে কেমন করুণ দশা করবো, রাস্তার শেয়াল-কুত্তাও তোকে শুঁকতে আসবেনা!
রাগটা একটু বেসামাল হয়ে যায়, ওমনেই ধাম-ধাম করে বিকট একটা আওয়াজ হলো। সেই আওয়াজে পুরোপুরি হকচকিয়ে যায় কালাম। ভ্রুঁ কুঁচকে বিষয়টা বুঝবার চেষ্টা করতেই তীব্র ও ক্ষিপ্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলো মাহতিম, তার ঝাঁঝপূর্ণ প্রতিটা শব্দ-বাক্য-কথা শুনে বাধ্য হয়ে ফোনটা কান থেকে দূরে সরালো সে। মাহতিমের তেজপূর্ণ কথা তখনো থামেনি,

– তুই আমার সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবি না শয়তান! তুই সেদিন আমার হাত থেকে বেঁচে গেলেও তোকে খোঁজা আমি বন্ধ করিনি। তোর জঘন্য কর্মকাণ্ডের ভেতর আমার বউকে ইনক্লুড করবি না, করলেই তুই শেষ! আমার নৃশংস রূপ তোকে খু’ন করে ছাড়বে! তোকে জ’বাই করতে কোনো আইন মানবো না, এই মাহতিম তোকে শেষবারের মতো শাষিয়ে দিচ্ছে! তুই আমার সাথে শ’ত্রুতা করতে চাস, করবি! আমি কোনো বাধা দেবো না। শুধু আমার মেহনূরের কাছ থেকে একশো হাত দূরে থাকবি, ওর কানের কাছে উলটাপালটা কিছু ঢুকালেই তোর জিহবা টেনে ছিঁড়’বো! আমি মাহতিম আনসারী তোর মতো জানো’য়ারকে ভয় পাইনা, তোর পুরো কাহিনী কোন্ স্টাইলে পণ্ড করি দেখিস!

এরপর আর কথা হয়নি মাহতিমের সাথে। মেহনূরকে গ্রামে পাঠানোর পরও মাহতিম কি করে নিশ্চিন্তে আছে, এটারই হিসাব মিলাতে পারছেনা কালাম। তার মনেহচ্ছে, মাহতিম এবার এসপার-ওসপার সংঘর্ষ করতে চাচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা ওই মাহতিমকে চুপ করে রাস্তা থেকে সরাতে হবে। মাহতিমকে আগেই যদি মে-রে ফেলা যায়, তাহলে এখানে চিন্তা নেই। দ্রুত সজিবকে জানাতে হবে, ওদের পাকাপোক্ত প্ল্যান এবার ফলাতে শুরু করুক।

আভিজাত্য কেবিনের শীতল এসিতে বসে আছে রজনী। পুরো কেবিনের চর্তুপাশটা কাঁচের দেয়ালে ঘেরা। চারপাশে নানা নান্দনিক জিনিস স্থান পেলেও শৌখিনতার ঘাটতি নেই। চারকোণা বাদামি রঙের ডেষ্কে বসে আছে সে, তার সামনে রকিং চেয়ারে ভাবুক ভঙ্গিতে বসে আছে তার ভাই। দুজনের ভেতর মধ্যকার আলোচনা একটু আগে শেষ হয়েছে, এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মূহুর্ত চলছে। সিদ্ধান্তটা নেবেন তার ভাই। গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে রজনী। তার দৃঢ় বিশ্বাস, তার ভাই কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়না। এমনকি ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ পর ইন্টারকম বাজিয়ে দু’কাপ কফির অর্ডার দিলো, কফিটা এসে পরতেই নিজের বোনকে সেটা খেতে বললো। যদি কফির জায়গায় বিষও খেতে বলতো, তাও নির্দ্বিধায় ‘ হু-হা ‘ না করে খেয়ে ফেলতো রজনী। ঠিক এমনই অটল বিশ্বাস কাজ করে তার ভাইয়ের প্রতি। কালো মগটা ডানহাতে তুলে চেয়ারে একটু পিঠ হেলে দিলো, বোনের দিকে সরল চাহনিতে দৃষ্টি দিয়ে কফিতে চুমুক দিলো ভদ্রলোক। শান্ত মেজাজের সাথে বললো,

– রিভেন্ঞ্জটা ভুলে যা রজু।
কফিতে চুমুক দিতে পারলো না রজনী। ভাইয়ের দিকে চমকানো দৃষ্টিতে তাকালে এক চুমুক দিয়ে মগটা ডেষ্কে রাখলো ভদ্রলোক। চেয়ারের হ্যান্ডেলদুটোয় কনুই লাগিয়ে দুহাতের আঙ্গুলগুলো আবদ্ধ করলো সে, গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বললো,
– সবসময় রিভেন্ঞ্জের জন্য মুখিয়ে থাকবি না। এটা খারাপ। এখন অনাকে এব্রডে পাঠিয়ে দে। ওর ব্যাপার নিয়ে এইসময় চিন্তা করলে তুই আমার ব্যাপারটা ঠিকঠাক মতো দেখতে পারবি না। কথা বুঝেছিস?
রজনী চোখ নিচু করে বললো,
– জ্বী ভাইজান।
রজনীর থমথমে মুখ দেখে নরম হলো ভদ্রলোক। একটু ঝুঁকে এসে বললো,

– অতিরিক্ত সফট্ হওয়াটা ঠিক না রজু।
তৎক্ষণাৎ চোখ তুললো রজনী ইবনাত। ভাইয়ের দিকে চোখাচোখি দৃষ্টি রেখে বললো,
– আমি আর আপনি দুজনই অনার উপর হাত তুলিনি ভাইজান। কোনোদিন না! শুধু একটা ভুলের জন্য ওকে পিটিয়ে জখম করে দিলো? ওর পিঠের দাগগুলো আজও মিশেনি ভাইজান! পায়ের একটা নখ এখনো নষ্ট হয়ে আছে, আপনি এখনো চুপ থাকবেন?

– দোষটা কি অনার ছিলো না?
– না, ছিলো না। ওর বয়সটাই ওরকম। মা ছাড়া বড় হয়েছে, আপনার আদরটাও ওর কপালে জুটেনি, আমিও আপনার বিজনেসের কাজে ব্যস্ত থাকতাম, সেখানে ওর এরকম হওয়াটা কি স্বাভাবিক না? তাছাড়া ভুল করেছে বলে এতো বড় শা’স্তি দিবে? একটা মেয়ের গায়ে সোজা হাত? তাকে মা’রপিট? আপনি আমাকে না থামালে এতোদিনে ল্যা’ঠা চুকিয়ে দিতাম ভাইজান। অন্তত লকআপের হাওয়া খাওয়াতাম।
– সবসময় বাড়াবাড়ি ভালো না রজু। একহাতে কখনো তালি বাজে না এটাও মাথায় রাখবি। প্লিজ, সিচুয়েশনটা বিগড়াতে যাস না, অনাকে রেডি করে পাসপোর্ট বুঝিয়ে দে।
– জ-জজ্বী, ভাইজান। কথাটা বলতে যেয়ে তোতলে ফেললো রজনী।

আজ গুণে-গুণে পন্ঞ্চম দিন। প্রায় পঁয়ত্রিশ ঘন্টা যাবৎ যোগাযোগহীন। পুরোপুরি চ্ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ঢলে আছে মেহনূর। একটা মানুষ কিভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়? কোনো সাড়া নেই, কোনো খবর নেই, কোনো খোঁজ নেই! মাহতিম যে ভেতরে-ভেতরে কিছু একটা নিয়ে খুব মশগুল থাকতো, সেটার জন্য কি খারাপ কিছু হয়েছে? তাড়াতাড়ি নিজেকে শান্ত করে মেহনূর। এসব কুলক্ষণ নিয়ে ভাবলে সে স্থির থাকতে পারেনা। অস্থির হলেই রুমের ভেতর পায়চারী থাকতে থাকে, পা দুটো ব্যথায় বিষিয়ে উঠলেও পায়চারী থামেনা। তার কাছে নোমানের নাম্বার ছাড়া আর কারোর নাম্বার নেই। নোমান ছেলেটাও ফোন বন্ধ করে রেখেছে। সৌভিককে একবার কল দিবে? না না, সৌভিককে কল দিলে নীতিরাও টেনশনে পরবে।

ওখানে মারজা চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছে। দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলে সুরাহা চাইবে? ধ্যাত্! তাও তো হয় না। দাদাভাইও একটা জরুরী কাজে শহরে গিয়েছে। কবে ফিরবে কেউ জানে না। মাথা খাটাতে পারছেনা মেহনূর। কিচ্ছুনা সহ্য হচ্ছেনা। পায়চারী করতে-করতে হঠাৎ তার খোপাটা আলগোছে খুলে গেলো। ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও দুটো নাম্বারে পরপর কল দিলো সে। মেয়েলী সুরে লাগাতার একই জবাব, ‘ আপনি যে নাম্বারটিতে কল করেছেন, তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। ‘ ঠোঁট শক্ত করে ফোনটা ঢিল মা’রতে নিলো, কিন্তু মা’রলো না। আস্তে করে ফোনটা বিছানার দিকে ছুঁড়ে দিলো।

সাংঘাতিক কিছু হয়েছে, নাহলে ফোনটা শুধু-শুধু বন্ধ থাকেনা। নোমানের ফোন যেখানে হরহামেশা খোলা থাকে, সেখানে অদ্ভুতকাণ্ডের মতো বন্ধ। আর কতোক্ষণ? পাঁচটা দিন যাবৎ নিজেকে পাগল-পাগল লাগছে। এলোচুলেই দক্ষিণ-টু-উত্তর দিকে পায়চারী করছে সে। এলোচুলগুলো হাঁটার জন্য কোমরের সাথে বারি খাচ্ছে।স ময়ের প্রতিটি কাটা তো এগুচ্ছে, কিন্তু কাটাগুলো সূইঁয়ের মতো ভয় খুঁচিয়ে আনছে। নাস্তার জন্য ডাকতে এসে পায়চারীর দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খায় সাবা, মেহনূরকে উদভ্রান্তের মতো অস্থির দেখে চটজলদি রুমে ঢুকে। সরাসরি মেহনূরের সামনে এসে দুই বাহু ধরে চিন্তার সুরে বলে,
– সমস্যা কি? তুই এভাবে দৌঁড়াচ্ছিস কেনো? তোকে যে নিচ থেকে ছোটমা ডেকেছে, তুই শুনেছিস? কি হয়েছে মেহনূর?

সাবার দিকে তাকিয়ে অনবরত হাত কচলাচ্ছে মেহনূর। কি বলবে, কিভাবে বলবে কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। মাথাটা ডানে ঘুরিয়ে বিছানায় থাকা কালো ফোনটার দিকে তাকালো। এদিকে সাবা উত্তর না পেয়ে মেহনূরের থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। স্বাভাবিক কন্ঠে আশ্বস্ত সুরে বললো,
– বলবি না কি হয়েছে? দেখে তো মনে হচ্ছে এখুনি কেঁদে দিবি। বুবুকে চাচ্ছিস?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে মেহনূর। বড় করে ঢোক গিলতেই চোখ বন্ধ করে সে, আজ চিকন-চিকন ভ্রূঁদুটো রাগে নয়, বরং হতবিহ্বল হয়ে কুঁচকে গেছে। ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপতেই চোখের পাপড়ি চুয়ে একফোঁটা পানি বেরুলো। তা দেখে দারুণ উদ্বেগে চন্ঞ্চল হলো সাবা, মেহনূরের বাহুজোড়া মৃদ্যু ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
– মেহনূর, কিচ্ছু লুকাস না! তাড়াতাড়ি বল কি হয়েছে? ভাইয়ার খোঁজ এখনো পাসনি? কিছু হয়েছে? কিছু তো বল্ গা’ধা!

ভেজা পাপড়ি খুলে সামনে তাকালো মেহনূর। কিছু গিয়েও স্থির হয়ে যায় সাবা। মূহুর্ত্তের ভেতর চোখের সাদা অংশটা লাল হয়ে গেছে মেহনূরের, নাকের ডগাটা লাল হতে শুরু করেছে। মেহনূর আগের মতো ফুপিয়ে কাঁদেনি , না সে হাউমাউ করে উঠেছে। তার চেহারায় ভয় ছেয়ে থাকলেও বাইরে থেকে পুরোপুরি শক্ত। থরথর ঠোঁটে, লালবর্ণ চোখ দিয়ে যেহারে ভয় নিংড়ে আসছে, তাতে সংবাদটা শুভ লাগছেনা। থুতনি ছেড়ে দিলো সাবা। কাধদুটোতে হাত রেখে সাহস জুগিয়ে বললো,
– তুই ভয় পাচ্ছিস?
মেহনূর পূর্ণদৃষ্টিতে সাবার দিকে তাকালো। মৃদ্যুস্বরে বললো,
– না।
কন্ঠের শঠতা দেখে প্রসন্ন হলো সাবা। শক্ত জমিনে থাবার মতো বাজিয়ে বললো সে,

– ভাবছিস ভাইয়া বাঁচবে কিনা? এটা নিয়েই তো ভয় পাচ্ছিস, ঠিক বলেছি কিনা বল্।
কথাটায় বুলেটের মতো ধাক্কা খেলো মেহনূর। ভয়ের দলাটা ঠেলেঠুলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
– হ্যাঁ, পাচ্ছি। খুব বাজে ভাবে পাচ্ছি। তোমাকে মিথ্যা বলে লাভ নেই। তুমি সবসময়ের মতো আজও মন পড়ে ফেলেছো। আমাকে চিন্তামুক্ত থাকতে বোলো না সাবা বুবু। উনাকে যেই পযর্ন্ত চোখের সামনে না দেখবো, না ছুঁবো, তোমার কোনো কথা আমি বিশ্বাস করতে পারবো না। তুমি আমাকে একা ছাড়ো বুবু, একা থাকতে চাই।
সাবা আর কিছু বললো না। কোনোপ্রকার সহমর্মিতার প্রয়োজন নেই। এই মূহুর্তে সহমর্মিতা দেখানোর চেয়ে মেহনূরের সাহসিকতা দেখতে ইচ্ছুক। এই মেহনূর একসময় চরম লেভেলের গা’ধা ছিলো, এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। গা’ধা বলাও ভুল হবে। তার গালে কঠিন ভাবে চ’ড় মা’রলেও উফ আওয়াজ করতো না। আড়ালে কাঁদতো, নয়তো নিরব হয়ে যেতো। সময়ের সাথে, পরিস্থিতির চাপে মানুষের কত কি পাল্টায়! স্বভাব-চরিত্র-আচার-আচরণ সবকিছু পালটে যায়। পালটে যায় পুরোনো খোলসের ব্যক্তিত্ব। নিজেকে শক্ত-সামর্থ-সাহসী বানাতে গিয়ে ধারণ করে নতুন অস্তিস্ত্ব। সেই খোলসের আড়ালে ঢাকা পরে গোবেচার ব্যক্তিত্বটা। দূর্বল ব্যক্তিত্বের মানুষরা সমাজের অনুপযোগী জীব, সেটা মানুষই তাদের ক্ষণেক্ষণে বুঝিয়ে ছাড়ে।

রুম থেকে নিঃশব্দে বেরুতে নেয় সাবা। ভেজা চোখ নিয়ে বিছানায় বসে মেহনূর, দৃষ্টিটা মেঝের দিকে নিক্ষেপ করা। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে যেতেই একটু থামলো সাবা, মাথা ঘুরিয়ে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– বাইরে বৃষ্টি পরছে। আম্মার কাছে শুনেছি, বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দুয়া করলে সেটা নাকি কবুল হয়।
চট করে দরজার দিকে তাকালো মেহনূর। দরজায় আর সাবা নেই, তার চলে যাওয়ার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো মেহনূর, তার পিছনে থাকা জানালাটা বন্ধ। বাইরে যে তুমুল আকারে বৃষ্টি পরছে সেটা বন্ধ জানালার জন্য খুব একটা বোঝেনি। বিছানায় পুরোপুরি উঠে সোজা জানালা খুলতে চলে গেলো। জানালাটা খুলে দুহাতে টান দিতেই কাঠের দ্বারদুটো খুলে গেলো।

ঝপ-ঝপ করে একঝাঁক বৃষ্টির ছাঁট তার শাড়িতে পরলো। লাল-নীল-গোলাপী রঙের মোটা পাড়টা বৃষ্টির ছোঁয়ায় ভিজে উঠলো, ডানহাত দিয়ে বাড়তি পানিটা ঝাঁট দিলো মেহনূর। জানালা দিয়ে মুষলধারার শীতল বর্ষণের দিকে তাকালো। গাছগুলো স্নান করে মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে, মাটির ভিজা গন্ধও মৃদ্যু-মৃদ্যু পাচ্ছে। খোলা জানালা গলে দুহাত বাড়িয়ে দিলো মেহনূর, ভারী-ভারী বৃষ্টিফোঁটা বরফের মতো তার হাতদুটো ভিজিয়ে দিচ্ছে। গভীর করে দম নিয়ে চোখ বুজলো সে, হাতদুটো মুঠো করতেই চোখ ভিজে উঠলো। ভেতরের সবকিছু উজাড় করলো ওই মুঠোর মধ্যে, প্রতিটা কথা আওড়াতে-আওড়াতে চোখ থেকে টপটপ অশ্রু ঝরছিলো তার, তবুও থামেনি মেহনূর, সবটুকু কথা ব্যক্ত করতে অস্থির হলো সে,

– আমার জীবনে এরকম পরিস্থিতি কখনো আসেনি। আমি নিজের জন্য কষ্ট পেলেও আজ ভেঙ্গে যাচ্ছি। আমি খুবই দূর্বল, খুব বেশিই দূর্বল। এই দূর্বলতা তাঁকে না দেখা পযর্ন্ত কাটবে না। আমি শুধু জানি, আমি তাঁকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। এই ভালোবাসার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আমার মধ্যে যেই ভয় ভর করেছে, তা দয়াকরে দূর হোক। আমার স্বামী, আমার অভিভাবক, আমার সবকিছু সুস্থ ভাবে ফিরে আসুক। সে আমাকে কোনোদিন কষ্ট দেয়নি, কোনোদিন আমাকে নিচু চোখে দেখেনি। আমার মধ্যে হাজারো খুঁত থাকলেও তাঁর কাছে অপদস্থ হইনি। আমাদের সাক্ষাৎ খুবই অল্পদিনের হতো, বারবার সে দূরে চলে যায়। আমি চাইলেও বাধা দিতে পারিনা। আজ সে কোথায় আছে আমি জানি না। যেই ফোন দিয়ে কিছুদিন আগেও কথা বলেছি, সেই ফোনটা পাঁচটা দিন ধরে বন্ধ। আগে কখনো ফোন বন্ধ হয়নি। আমি তাঁকে কোনোদিন অসভ্য বলবো না, সে একবার ফিরে আসুক।
মুঠো ভরে-ভরে নিচ দিয়ে লম্বাকারে পানি পরছে। বৃষ্টি যেনো মুঠোভর্তি করার মহাআনন্দে আছে। হঠাৎ পেছন থেকে রাগ দেখিয়ে বললো,

– এ্যাই মেহনূর! তুই বসে-বসে বৃষ্টির পানি হাতাচ্ছিস? আবার ঠান্ডা লাগতে চাস? তাড়াতাড়ি হাত ভেতরে আন।
কানে মায়ের ডাক শুনে চমকে গেলো মেহনূর। অতিদ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে হাত ভেতরে ঢুকালো। আঁচলে মুছতে-মুছতে মাথা না ঘুরিয়ে বললো,
– তুমি যাও, আমি আসছি। হাত বাইরে দেবো না।
মাহমুদা একপলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে নিরুত্তাপ কন্ঠে বললেন,
– মনে থাকে যেনো। খেতে আয়, তোর বড়মা কুমড়া পাতার বড়া বানিয়েছে। দেরি করিস না।

মাহমুদা চলে যেতেই মাথা ঘুরালো মেহনূর। মাহমুদার গমন দেখে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো, খেতে একদম ইচ্ছে না করলেও কথা রাখার জন্য খেতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুহাত মাথায় উঠালো মেহনূর, এলোচুলটা খোপা করতেই হঠাৎ ‘ টুট-টুট ‘ বিপ হলো। আয়নার ভেতর দৃষ্টি থমকে চোখের চাহনি বড়-বড় হতে লাগলো। মাথায় খোপা পাঁকানো হাতদুটো শক্ত হয়ে আছে, বুকের হৃদস্পন্দনটা একধাপ-একধাপ করে বাড়ছে। এটা কি ভ্রম না সত্যি? কল্পনা না বাস্তব?

অতীত না বর্তমান? কন্ঠনালী শুকিয়ে বক্ষতালু পযর্ন্ত শুকিয়ে উঠলো তার। আয়না থেকে চোখ সরিয়ে বামে তাকালো মেহনূর, বিছানার উপর কালো ফোনের স্ক্রিনটা জ্বলে আছে। এটাও ভ্রম না, কল্পনা না, অতীতও না। এটা চূড়ান্ত কোঠায় সত্য যে ফোন বেজেছে। নোটিফিকেশনের টোনটা স্পষ্ট কানে শুনেছে। মাথা থেকে দুহাত নামিয়ে ফেললো সে, বাঁদিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো, ডানহাত এগিয়ে ফোন হাতে নিতেই ঢোক গিলে নিলো। ফোনের উপর ‘ নিউ ম্যাসেজেস্ ‘ লিখা। সেখানে বৃদ্ধাঙ্গুল রাখলো মেহনূর, পুরো স্ক্রিনটা বদলে গিয়ে ম্যাসেজের ওয়ালটা ওপেন হলো। সেখানে একটা অপরিচিত, আন-সেভ নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। সম্পূর্ণ ইংরেজি কির্বোডের ইংরেজি বর্ণমালায় ক্যাপিটাল অক্ষরে লিখা,
NICHE ASHO. KAWKE BOLTE JEYONA. ANTICEPTIC LIQUID NIYE DRUTO ASHO PLEASE.
DON’T PANIC.
NEW SIM.
M. ANSARI

গোয়ালঘরের কাছে আসতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো! চোখদুটো বিস্ফোরণের মতো স্থির হয়ে গেলো, বুকের ভেতরটা তুফানের মতো উত্থাল। দরজার দোরগোড়ায় ছোপ-ছোপ রক্ত দেখা যাচ্ছে, টিনের চাল ধুয়ে ঝর্নার মতো বৃষ্টির পানি পরছে। কাঠের বন্ধ দরজাটা এই মূহুর্তে একটুখানি ফাঁক হয়ে আছে। বড় করে ঢোক গিললো মেহনূর, আঁচলের নিচে এন্টিসেপটিক বোতল লুকানো, ডানহাতে দাদাভাইয়ের পুরোনো আমলের ছাতা ধরে আছে। ম্যাসেজটা যদি সত্যি হয়, তাহলে ভয়াবহ অঘটন ঘটেছে। মাহতিম অক্ষতশরীরে ফিরেনি, তাঁর নির্ঘাত কিছু একটা হয়েছে। রক্তের নিদর্শন বতর্মানে সেটাই জানান দিচ্ছে। মনে-মনে প্রচুর ভয় পেলেও নিজেকে শান্ত রাখলো সে। বৃষ্টির পানিতে থপ-থপ শব্দ তরঙ্গ তুলে এগিয়ে গেলো মেহনূর। দরজার কাছে এসে ছাতাটা বন্ধ করে দরজাটা ঠেলে দিলো, আস্তে করে দরজাটা খুলে যেতেই ভীতু চাহনিতে ভেতরে তাকালো। ডানপা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকতেই ডানে তাকালো মেহনূর, তৎক্ষণাৎ চোখদুটো চুম্বকের মতো আঁটকে গেলো তার। সমস্ত শরীর-সহ প্রতিটি ইন্দ্রীয় যেনো কাঁটার মতো ফুটে উঠলো! একটা জোরালো আর্তনাদ করতে গিয়েও শেষ মূহুর্তে সামলে নিলো। চিৎকার করলো না মেহনূর, চোখদুটো বড় করে লম্বা-লম্বা প্রলম্বিত নিশ্বাস নিতে লাগলো। বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিতেই অজান্তেই হাতের বন্ধন থেকে ফসকে গেলো ছাতাটা।

কিছু পরার মতো বিদঘুটে আওয়াজ শুনে সেদিকে তাকালো মাহতিম। পিঠের বাঁদিকের শার্টটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরে আছে। ব্যথায় কাতর, তবুও কন্ঠে শীতলতা মাখিয়ে আস্তে করে ডাকতে নিলো। চিনচিনে ব্যথার কারনে কিচ্ছু বলতে পারলো না সে। চোখ খিঁচুনি দিয়ে ব্যথায় জব্দ হলো মাহতিম। মুখটা নত করে শক্ত হয়ে থাকলে হঠাৎ মাথায় আলতো স্পর্শ টের পেলো। চোখ খুলে মুখ তুলে উপরে তাকালো সে, তার মুখের দিকে সরাসরি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। স্থিরচোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে ঠিকই, কিন্তু নরম ঠোঁটদুটো আজ একটুও কাঁপেনি, নিজেকে যেনো অনড় রাখতে বাধ্য।

মেহনূরের শান্ত-স্বাভাবিক রূপ দেখে মাহতিম মারাত্মক আশ্চর্য হলো, পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেলো সে। অন্যদিন হলে মেহনূর বুঝি হাউমাউ করে ফুপিয়ে উঠতো, এমন করুণ দশা দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারতো না, কিন্তু আজ সবকিছু পালটে দিয়ে মেহনূর তাকিয়ে-তাকিয়ে শুধু দেখছে! কি দেখছে? ওমন লাল-লাল চোখ দিয়ে মাহতিমের আহত অবস্থা দেখছে? দেখছে মাহতিম কতটা ক্ষতবীক্ষত হয়ে এসেছে? নাকি মনের উচাটন অবস্থাটা ঠেলেঠুলে সহ্য করে আছে? মাহতিমকে ফের চমকে দিয়ে তার পিঠ খামচানো ডানহাতটা ধরলো মেহনূর, হাতটা পিঠ থেকে টেনে টলমল চোখে হালকা গলায় বললো,

– হাতটা সরান, আমি দেখছি। ব্যথাটা আরেকটু সহ্য করুন, আমি ঔষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
মাহতিম বিনা বাক্য ব্যয়ে শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। চুপচাপ তাকিয়ে রইলো মেহনূরের দিকে। মেহনূর কোনো সঙ্কোচ ছাড়াই তার সাদা শার্টে হাত দিলো, দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে শার্টের প্রতিটি বোতাম দুহাতে খুলতে লাগলো। ধীরে-ধীরে চোখের সামনে বৃষ্টিস্নাত বুকটা উন্মুক্ত হতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ থামলো তার, এরপর দৃষ্টি নামিয়ে শেষ বোতামটা খুলে ফেললো মেহনূর। শার্টের দুই প্রান্ত ধরে কাধ ছাড়িয়ে খুলতে নিলে পিঠের ক্ষত জায়গাটায় চোখ পরলো। পিঠের ডানদিকটায় তেরছা ভাবে গভীর জখম হয়ে আছে, মেহনূর সেখানে থমথমে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে মাহতিম আশ্বস্ত গলায় বললো,

– ভয় পেও না। সেরে যাবে।
চোখ ঘুরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর, ঢোক গিলে নিচু গলায় বললো,
– সারবে?
মাহতিম চোখ বন্ধ করে আশ্বস্ত করলো, আস্তে করে বললো,
– সারবে।

উত্তর পেয়ে নির্বিঘ্নে শার্ট খুলে আনলো মেহনূর। ক্ষতের দিকে তাকালেই গা শিরশির করছে তার, তবুও মুখের উপর ভয়ানাশনের মুখোশ এঁটে ক্ষত পরিষ্কার করলো। বুদ্ধি করে সঙ্গে লম্বা একফালি সাদা কাপড় এনেছিলো, সেটা দিয়ে মাহতিমের নির্দেশ মতো বুকে-পিঠে ড্রেসিং করে করলো মেহনূর। মাহতিমের রক্ত মাখা হাতদুটো গামছা ভিজিয়ে পরিষ্কার করে দিলো। বাইরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছে, উঠোনে জমেছে জলাবদ্ধ পানি। নাছোড়বান্দা মাহতিম কড়া গলায় বলে দিলো সে এই মূহুর্তে বাড়িতে ঢুকবেনা, এমন শরীর নিয়ে সকলের সামনে যাওয়া মানে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। মেহনূরকে আপাতত বাড়ি ফিরতে বলে স্বাভাবিক আচরণ করতে বললো, সকলের কাছে তার আগমনের খবরটা চাপা রাখতে বুঝিয়ে দিলো।

মেহনূর সবটা শোনার পর অন্যদিকে ভিড়লো না। কেনো মাহতিম লুকোচুরি খেলতে চাইছে আজ জেনেই ছাড়বে। সমস্ত কথা কাটায়-কাটায় জানা পযর্ন্ত হাল ছাড়বে না মেহনূর। মাহতিমকে একা ফেলে ভুলেও বাড়িতে যাবেনা, দরকার পরলে এখানেই আস্তানা গাড়তে প্রস্তুত। গোয়ালঘরটা বতর্মানে পরিত্যক্ত, সবকটা গরু-গাভীকে অন্যদিকে অন্য ঘরে রাখা হয়েছে। অবসর ও একাকী সময় কাটানোর জন্য এখনো এটাকে ব্যবহার করে মেহনূর, কাজেই ঘরের মেটো মেঝেটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে। মাহতিম যেই কঙ্কালসার চৌকির উপর শুয়ে পরতে নিবে ওমনেই বাধ সাধলো মেহনূর, তাকে চৌকি থেকে নামতে বলে ঘরের অন্যপাশ থেকে তোশক-বালিশ টেনে আনলো। চৌকিতে তোশক পাতার দৃশ্য দেখে বিষ্ময়ে প্রশ্ন করলো মাহতিম,

– এটা গোয়ালঘর না?
প্রশ্নের আসল মর্মটা বুঝলো মেহনূর, ভালো একটা চাদর বিছাতে-বিছাতে বললো,
– আগে ছিলো, এখন নেই। এখন গরুগুলোকে বাড়ির আমগাছের ওখানে রাখা হয়। ওখানেই নতুন গোয়ালঘর বানানো হয়েছে।
– এটা কি তাহলে গেষ্টরুম? তোশক কিসের জন্যে?
প্রশ্ন শুনে হাসলো মেহনূর। মাথাটা ‘ না ‘ সূচকে নাড়িয়ে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললো,
– আগে এ ঘরেই থাকতাম। এমনও হয়েছে রাতে আমি বাড়িতে না থেকে এখানে থেকেছি। এখানে আমি বই পড়তে-পড়তে ঘুমিয়ে যেতাম। আমার বদঅভ্যাস বলতে পারেন। এজন্য তোশক-বালিশ আম্মা রেখে দিয়েছে।
নিজের বাঁ কাধটা ধরে হাসলো মাহতিম। প্রসন্ন গলায় বললো,
– সাহস তো কম না। ক’দিনের জন্য একা ছেড়েছি দেখে সাহস একেবারে তুঙ্গে উঠেছে। একা-একা থাকতে ভয় করতো না?

মাথার কাছে তুলতুলে নরম বালিশটা রাখতে গিয়ে থমকালো মেহনূর। স্থির হয়ে কয়েক সেকেন্ড কি যেনো ভাবলো, বিছানা গুছানো বাদ দিয়ে মলিন দৃষ্টি তুলে বললো,
– আপনিতো সবসময় আমার কাছে থাকবেন না।আমার একা থাকার অভ্যাস তো করতেই হতো।
ডানহাতে মাথাটা ঝাড়ছিলো মাহতিম, হঠাৎ কথাটা শুনে হোঁচট খেলো সে। দৃষ্টি তুলে চৌকির দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো তাদের। টিনের চালে বৃষ্টির ঝুনঝুন শব্দ আবার বেড়েছে, টিনের ফাঁকফোঁকর দিয়ে ঢুকছে আলো। মাহতিম প্রসঙ্গ পালটে অন্য দিকে ঘুরলো, চৌকির কাছে আসতে-আসতে ফাজলামি করে বললো,
– যদি কোনো চোর তোমাকে একা পেয়ে চুরি করে ফেলতো?

চোখে-চোখ রেখে আলতো ঠোঁটে প্রশ্নটা করলো মাহতিম। চৌকির আরামপূর্ণ শয়নে উঠে আসলো সে। প্রশ্নটা শুনেও কিছুক্ষণ চুপ রইলো মেহনূর। অনেকক্ষণ কোনো কারণ ছাড়াই নিরব রইলো সে। মাহতিম কিছুটা উজবুক চোখে সরু দৃষ্টিতে তাকালে অদ্ভুত আত্মগর্বের মতো নিশ্বাস ছাড়লো মেহনূর। চাপা তেজের সাথে সম্মোহন চাহনিতে বললো,
– এই তল্লাটে ওমন সাহস কারোর হবে না। শুধু —

কথাটা বলেই থামলো মেহনূর। অসম্পূর্ণ কথাটা কথাটা শোনার জন্য প্রচণ্ড উদগ্রীব হয়ে আছে মাহতিম। আনচান মনটা অস্থির হয়ে বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। মাহতিম ওমন উন্মুখ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে শেষমেশ কিন্ঞ্চিৎ হাসি দিলো মেহনূর, ‘ শুধু ‘ শব্দটার পরের বাক্য আর সম্পূর্ণ করলো না। মাহতিম প্রচণ্ড অধৈর্য হলেও তাকে ইচ্ছে করেই অগ্রাহ্য করলো মেহনূর। সম্পূর্ণ উল্টো ঘুরে বন্ধ জানালা খুলতে গেলো, কাঠের মোটা ডাসাটা ডানে টান দিতেই খট করে শব্দ হলো। জানালার দুই দ্বার ধরে যেই দুদিকে টান দিবে, সাথে-সাথে দুচোখ বন্ধ করে ঠান্ডা স্পর্শে শিউরে উঠলো মেহনূর। মাথা থেকে পায়ের নখ পযর্ন্ত শিরশির করে উঠলো।

বুকের পিষ্টনে ধড়াস করে এক ঘা লাগতেই ধুকধুকনি বেড়ে গেলো। দাঁতে-দাঁত পিষে আড়ষ্ট হলো একটু, জানালাটা থেকে হাতদুটো আপনা-আপনি নেমে গেলো। চোখ খুলে মাথাটা নুইয়ে দেখলো পেটের উপর মাহতিমের ডানহাতের অস্তিত্ব। পাঁচটা আঙ্গুল যেনো খাপে-খাপ ফর্সা চামড়ার উপর ডেবে আছে। শক্ত করে পেছন থেকে ডানহাতেই জড়িয়ে ধরেছে। মেহনূর গলাটা ভিজিয়ে বড়-বড় নিশ্বাস নিতেই পিছু ঘুরতে চাইলো, তাকে বাধা দিয়ে খামচে ধরলো হাতটা। সামান্য ব্যথায় চোখ খিঁচে ফেললো মেহনূর, আস্তে করে সেই হাতের উপর হাত রাখলো সে। খোপাটা ইতিমধ্যে আলগা করে শেষ। এলোচুলগুলো পিঠের উপর থেকে সরিয়ে বামে ঠেলে দিলো, মেহনূরের ডান কাধটায় ঠোঁট ছুঁয়ে গাঢ় চাপ বসালো। চোখ বন্ধ রেখেই কাধে থুতনি রাখলো মাহতিম, তার ক্লিনশেভ গালটা আলতো করে নরম গালের গায়ে ঠেকিয়ে দিলো। নিচু গলায় প্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– আমিতো জানিই আমার ফেলে আসা দামী মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। দিন হোক, রাত হোক সে আমার কথা একটা মূহুর্ত্তের জন্য ভোলেনি। মাসের-পর-মাস দূরে থাকছি, তার অসুস্থতা, তার অসুবিধা, তার হাসির নিচে দুঃখগুলো আমি ভুলবো? এতোগুলো দিন পাগলের মতো অপেক্ষা করেছো, আমি কি সেকথা জানি না? অপেক্ষা করার মতো অসহ্য কষ্ট মানুষের ভেতরটা কিভাবে কুড়েকুড়ে খায়, আমি কি ভুলে গিয়েছি? ওই সৌভিকের মুখে যখন তোমার অবস্থার কথা শুনতাম, আমি কি ঠিক থাকতাম?

সবকিছু ফেলে চলে আসতে ইচ্ছে করতো মেহনূর, আমি পারতাম না। আমার জীবনের প্রতি কোনো মায়া নেই। যেদিন নিজের হাতে আমার সন্তানের মতো ভাইটাকে দাফন করে আসলাম, সেদিন থেকে মায়া চলে গেছে। আমি ফিরলে আমাকে নিয়ে এখন কেউ মাতামাতি করবে না মেহনূর। ওই বাড়িটার আসল আত্মা চলে গেছে। প্রথমে বাবা গেলো, একদম মানতে পারিনি। বিশ্বাসই করতে কষ্ট হচ্ছিলো। বাবার শোকটা কাটাতে গিয়ে জীবনের আসল বাস্তবতা চিনতে শুরু করলাম। ওই বাস্তবতা খুবই জঘন্য ছিলো মেহনূর, বাবার মতো অভিভাবক ছাড়া দুনিয়ায় টেকা যায় না। একসময় যার আঙ্গুল ধরে হাটিহাটি পা-পা করে বড় হয়েছি, আজ তার অনুপস্থিতিতে ভেতরটা ছিঁড়ে আসে মেহনূর। এর চেয়ে অসহ্য যন্ত্রনা আমি ট্রেনিংয়ের সময়ও পাইনি।

টালমাটাল বৃষ্টির ঝুমুঝুম আওয়াজ টিনের ঘরে মুখর। মাটি ভিজে শ্যাওলার সতেজ গন্ধ ছড়িয়ে পরেছে। গাছের পাতা ধুয়ে কচিপাতার মতো রঙ নিয়েছে, ঠান্ডা বাতাসে পুরো প্রকৃতি যেনো নৃত্যের ভঙ্গিমায় অটল। চোখের গরম পল্লবটা খুলে নাক টানলো মেহনূর, জানালাটা খুলতেই ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকলো। পর্দাটা টেনে দিলো সে, ঘরটার ভেতর ঠান্ডা হাওয়ার সাথে ফালিফালি আলো আসুক। পেটের উপর থেকে থাবার মতো হাতটা সরালো মেহনূর। পুরোপুরি পিছনে ঘুরতেই মানুষটার কাছ ঘেঁষে মুখোমুখি হলো।

কখনো যে দৃশ্য মানসপটে চিন্তা করেনি, ভাবতেও পারেনি দেখতে পাবে, আজ অকল্পনীয় দৃশ্যটা দেখে বুক নিংড়ে ব্যথা হলো মেহনূরের। তীক্ষ্মদৃষ্টির চোখজোড়া ঈষৎ লালে পরিণত, পাপড়ি গুলো ভেজার কারনে চকচক দেখাচ্ছে, গলার মাঝামাঝি উঁচু হাড়টা বারবার ঢোকের জন্য উঠা-নামা করছে, আজ মাহতিম আনসারী করুণভাবে অশ্রুসিক্ত। পরাজিত সৈন্যের মতো মাথা নত হয়ে আছে। আজ মেহনূরের পরিবর্তে তার লাল হয়ে আসা ঠোঁটদুটো কাঁপছে। নত মুখটা দুহাতে ধরে উপরে তুললো মেহনূর। মুখটা কাছে টেনে কপালে-গালে-নাকে চুমু খেলো। ভেজা পাপড়ির উপর ওষ্ঠযুগল ঠেকিয়ে নির্বাধ অশ্রুটা বাধা দিলো। গভীর করে দম নিলো মাহতিম, নিশ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে ধাতস্থ হতে লাগলো। মেহনূর গাল ছেড়ে সরল গলায় বললো,

– আমার সাধ্য হয়তো এটুকুই। আমি কোনোভাবেই আপনার দুঃখ ঘুচাতে পারবো না। আপনি যেভাবে আমার সমস্যা বুঝতেন, সমাধান করতেন, আমার মধ্যে ওভাবে কিছু করার গুণ নেই। আমার বাবা থাকাও না থাকার সমান, দাদার কাছেই বড় হয়েছি। আপনি যেভাবে দুঃখ পেয়েছেন, আমি আজ পযর্ন্ত ওমন স্বজন হারানোর দুঃখ পাইনি। শুধু এটুকু জানি, মাহদিকে হারানোর শোক আজও আমি কাটাতে পারিনি। ও আমার চোখের সামনে ভাসে, আমি ওর মুখে ভাত তুলে খাইয়েছি।

দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, নিজের অবাধ অশ্রুকে শান্ত করতে পারছিলো না মাহতিম। যে ট্রেনিংয়ের ভূমিতে আবেগ নিয়ন্ত্রণের মন্ত্র মন্ঞ্চস্থ করা হয়েছিলো, আজ তা ভেস্তে যাচ্ছে। আঁচলের কোণাটা টেনে চোখ মুছলো মেহনূর, পায়ের কাছ থেকে পাতলা কাঁথাটা নিয়ে পুরোপুরি মেলে দিলো। জানালার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পরলো মেহনূর। দুহাত দুদিকে মেলে কাছে আসার ইশারা দিয়ে বললো,
– জান্তব নি-ষ্ঠুরটাকে বুকে আসার ঘোর আহ্বান জানাচ্ছি। তাকে দুহাতের ভেতর জড়িয়ে ধরার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আসুন,
থমথমে শীর্ণ মূহুর্তে ফিক করে হেসে ফেললো মাহতিম। হাসতে-হাসতে বললো,
– তোমার মনে আছে?
মেহনূর ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো। মুচকি হাসিতে বললো,
– আমি আবদারের কথা ভুলি না।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫২+৫৩

বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দের সাথে আরেকদফা হাসলো মাহতিম। চোখে শ্রান্ত মায়া, ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলো সে, মেহনূরের বাড়িয়ে দেওয়া হাতযুগলে নিজেকে ছেড়ে দিলো। দেহের সমস্ত ভর, মনের সমস্ত ক্লান্তিগুলো মেহনূরের শয্যায় সমর্পণ করলো। চোখ বন্ধ করে পরম মায়ায় শান্তির নিশ্বাস নিলো মাহতিম, পিঠের ব্যথাটা ভুলে গিয়ে আতিশয্য কোমল উষ্ণতায় মন-প্রাণ ছেঁকে বিষণ্ণতা বেরিয়ে গেলো। মাহতিমের উদ্যম পিঠটা কাঁথার ছায়াতলে ঢেকে দিলো মেহনূর, ঠান্ডা পিঠের ক্ষতস্থান বাদে সর্বত্র ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দিলো। ভেজা ঝলমলে চুলগুলোতে বাঁহাত রাখলো সে, শক্ত করে মাথাটা বুকে চেপে ফিসফিস করে বললো,
– ঘুমিয়ে পরুন, লম্বা একটা ঘুম দিন। আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না, এভাবেই আমার কাছে রেখে দিবো, এই বৃষ্টির মধ্যেই ওয়াদা করলাম।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৫৬+৫৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here