মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৬৪+৬৫

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৬৪+৬৫
ফাবিয়াহ্ মমো

সারারাত ঝুম বৃষ্টি শেষে দিনের আলো ফুটলো। পূব আকাশে আস্তে-আস্তে সূর্যের চাকা উঠলো। ভেজা মাঠ-ঘাট সূর্য-কিরণে চিকচিক করছে। কচু পাতায় শিশির জমে মুক্তোর মতো জ্বলছে। পাখির মিষ্টি-মধুর কিচির স্বরে প্রকৃতি জেগে উঠছে। বাতাসের দোল খেয়ে গাছের পাতাগুলো মর্মর ধ্বনি তুলছে। একফালি সোনা রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলে ঢুকলো। পর্দাদুটোর মাঝ দিয়ে সেই আলোটা মুখে এসে পরলো। দিনের আলোটা চোখে পরতেই ঘুম ভাঙলো মেহনূরের। চোখের পল্লবজোড়া বেশ ভারী-ভারী লাগছে। সম্ভবত রাতে কান্নার জন্য চোখদুটোর এই দশা।

কিন্তু আজ মন খারাপের রেশটুকু কেটে গেছে। সকালের নির্মল হাওয়াটা বুক ভরে-ভরে কিছুক্ষণ টানলো মেহনূর, মনটা একদম ঝরঝরে হয়ে গেছে। এতো শান্তি, এতো প্রফুল্ল মন, আগে কোনোদিন টের পায়নি। গাছের নতুন পাতার মতো সবকিছু সতেজ লাগছে। শোয়া থেকে উঠে বসতেই ব্যকুল চোখে একজনকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সেই মানুষটা এতো সকাল-সকাল কোথায় হারিয়ে গেলো? লম্বা হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে পরলো মেহনূর, শোয়ার জন্য বিগড়ে যাওয়া চুলগুলো নতুন খোপা করে বাইরে পা দিলো। সকালের নরম রোদটা মেহনূরের গায়ে মোলায়েম ভাবে ছুঁয়ে দিলো, আদুরে উষ্ণতায় শরীর চনমন করে উঠলো তার।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এখনো কটেজের দরজাগুলো খুলেনি, তার মানে ঘুমের আরামটা কারোরই ভাঙেনি। সিড়ির ধাপ পেরিয়ে একটু সামনে এগোলো মেহনূর, পায়ের নিচে নরম সবুজ ঘাসগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছে। হাত-মুখ ধুয়ে শাড়ির আঁচলে ভেজা মুখটা মুছতে-মুছতে নিরিবিলি রেসোর্টের পুকুরপাড়ে গেলো সে। বৃষ্টির কারণে পুকুরপাড়ের রাস্তাটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। এমনেতেই জায়গাটা গাছ-গাছালির জন্য ভয়াবহ অন্ধকার। তার উপর সূর্যের আলো পড়ে না। কাদা বাঁচিয়ে পা ফেলতেই দুহাত এগিয়ে ঝোঁপের কুন্ঞ্জটা সরিয়ে দিলো, তখনই চোখ ধাঁধিয়ে এক পশলা আলো মেহনূরের চোখ বুজিয়ে দিলো। ঝোঁপটা পেরিয়ে চোখ খুললো মেহনূর, পুকুরপাড়ের দিকে স্পষ্টভাবে তাকাতেই দূর থেকে সবুজ টিশার্টটা নজর কাড়লো।

শান বাঁধানো পাকা জায়গায় একা বসে আছে মাহতিম। সাতসকালে একা বসে থাকাটা বিলক্ষণ মনে হচ্ছে না। ঘুম থেকে উঠেই এখানে চলে আসলো? কিছু কি হয়েছে? কালরাতেও মাহতিম কোনো কথা বলেনি। মাহতিমের মধ্যে এরকম নিঃশ্চুপ আচরণ বোধগম্য হচ্ছে না। মেহনূর চুপচাপ পা বাড়িয়ে মাহতিমের পেছন গিয়ে দাঁড়ালো। পেছন থেকে মাহতিমের চোখদুটো ধরার জন্য যেই হাত বাড়ালো, তখনই খপ করে হাতদুটো ধরলো মাহতিম। একবারও পিছু না তাকিয়ে ওইভাবেই মেহনূরের হাত ধরে বললো,
– এমন ছোটোখাটো চালাকি আমার বেলায় খাটে না।

হাত ছেড়ে দিলো মাহতিম। আবারও নির্জনতায় ডুবে গেলো চারপাশ। মাহতিমের দৃষ্টিজোড়া পুকুরের মৃদ্যু দোলায়মান স্রোতের উপর অটল। বিশেষ ভাবনায় মত্ত মাহতিমকে বিরক্ত করলো না মেহনূর। মাহতিমের বাঁ-পাশটায় স্থান গেড়ে শান্তভাবে বসলো। মাহতিমের চওড়া-প্রশস্ত কাধটায় মাথা রেখে তার হাতটা পেঁচিয়ে ধরলো। মেহনূরের কাণ্ডকারখানায় কোনো ভাবাবেগ দেখালো না মাহতিম। অনতিকাল পেরুতেই মেহনূর অর্ধৈয্যের গলায় বলে ফেললো,
– স্বাভাবিক আচরণটা করছেন না কেনো? আমিতো আপনাকে ভুল বুঝিনি। যেটা সত্য, যেটা ঘটতো, সেটা নিয়ে আপোস করার কোনো কারণ ছিলো না। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। আপনি আমার উপর কেনো রেগে আছেন?
ঘাড়টা বামে ঘুরালো মাহতিম। বোধহয় মেহনূরের মুখটা দেখার একটুখানি প্রয়াস ছিলো। আবার মুখ ঘুরিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে শান্ত ভাবে বললো,

– আমি চুপ থাকলেই ‘ রেগে আছি ‘ ভাবো কেনো?
কাধ থেকে মাথা তুললো মেহনূর। মাহতিমের মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,
– আপনি স্বাভাবিক আচরণ করছেন না।
এবার একসেকেন্ডও দেরি করলো না মাহতিম। কথার তোড়ে সঙ্গে-সঙ্গে মেহনূরের দিকে তাকালো। সত্যিই মাহতিমের হাব-ভাব স্বাভাবিক নেই। রাতেও এই ব্যক্তি এরকম হালে ফিরেনি। রাত পেরুতেই কি এমন হলো? কেনো সকাল-সকাল কাউকে না জানিয়ে একা বসে আছে? চোখের দৃষ্টি জ্বালাময় দেখাচ্ছে। কোনো ব্যাপার নিয়ে ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ফুঁসছে। ঢোক গিলে একটু কাছে গেলো মেহনূর। ক্লিন শেভ বাঁগালটায় হাত রেখে আলতো গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন না?
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাহতিম ছোট্ট সুরে বললো,
– কোনোদিন অবিশ্বাস করিনি।
আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো মেহনূর,
– তাহলে কেনো কথাটা লুকাচ্ছেন?
মাহতিমের পালটা উত্তর,
– তুমি এভাবে জিজ্ঞেস করোনি।
মেহনূর থামলো না। নিজেও উত্তাপের সাথে বললো,
– আজ জিজ্ঞেস করছি, এখন জিজ্ঞেস করছি, বলুন।
মাহতিম পুরোপুরি মেহনূরের দিকে ঘুরলো। মুখোমুখি হয়ে মেহনূরের অন্যহাতটাও নিজের ডান গালে রাখলো। ছটফট দৃষ্টির মাঝে নিজের শান্ত দৃষ্টিটুকু রেখে দিলো। মেহনূর অপেক্ষায় অধীর, মনের ভেতর উচাটন অবস্থা ধেয়ে-ধেয়ে বাড়ছে। ওই শান্ত চোখদুটো তাকে গভীরে টেনে নিচ্ছে। জিভে ঠোঁট বুলালো মাহতিম, একটু ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করলো,

– যা বলবো সব মন দিয়ে শুনবে। শুধু শর্ত একটাই, যা বলবো, আজকের পর সবকিছু ভুলে যাবে। ওই ছোট্ট বুকটায় এসব মনে রাখার দরকার নেই। ঠিক আছে?
মাথা নাড়ালো মেহনূর। উত্তর পেয়ে বলতে থাকলো মাহতিম,
– তোমার বয়সটা চার, তখন তোমার বাবা মা:রা যান। একটা স্বাভাবিক মানুষের মতো নেচারাল ডে:থ হয়েছে। কেউ উনাকে মা:র্ডার করেননি বা, এই জাতীয় প্ল্যান-প্রোগ্রামও ছিলো না। হয়তো তোমার কানে এসেছে, তোমার দাদাভাই তোমার বাবাকে খু:ন করেছেন। এটা ভুয়া খবর। তোমার বাবা একজন সৎ মানুষ ছিলেন। কিন্তু উনার একটা বাজে অভ্যাস ছিলো, বলতে গেলে সেটার জন্যই উনার মৃ:ত্যু। উনি প্রচুর ধূমপান করতেন, যেটাকে এক্সট্রিম লেভেলের স্মোক করা বলে। প্রায়ই এটা নিয়ে তোমার মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি হতো। তোমার মা রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেতেন।

কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে একদিন সেটা মানিয়ে যায়। তোমার মাও চুপচাপ সেটা সহ্য করতে শিখে গেলেন। বিদেশ যাওয়ার জন্য যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন, হুট করে সেটার খবর আসে। তোমার বাবা কোনোভাবেই বিদেশ যেতে রাজি ছিলেন না। অনেককিছুর পর যখন বিদেশের মাটিতে পাড়ি দিলেন, তখন তোমাদের বিলাসিতা আসতে শুরু হয়। সবই ঠিকঠাক মতো চলছিলো, কিন্তু একদিন চিঠির পাতায় খবর আসে তোমার বাবার লাংগ ইনফেকশন ধরা পরেছে। তখনই তোমার দাদা ছেলেকে দেশে আনার জন্য বন্দোবস্ত করেন। আটমাসের ভেতর তোমার দাদা সবকিছু ঠিক করেন ঠিকই, কিন্তু তোমার বাবা আর ফিরেন না। সেখানেই হার্ট স্ট্রোক করে মা:রা যান। সবচেয়ে বেশি তোমার মা ভেঙ্গে পরেন।

তোমার দাদা হয়তো অবশ্য তোমার বাবাকে দুচোখে সহ্য করতে পারতেন না। উপর্যুক্ত কারণও ছিলো। তোমার দাদাভাই মেয়েমানুষ নিয়ে ফূর্তি করতেই হাতে-নাতে একদিন ধরা পরেছিলেন। সেটার ক্ষোভ তোমার বাবা ভালোমতোই ঝেড়েছিলো। তোমার দাদাটা তোমাদের সবগুলো বোনকে আদর করেছেন, এ বিষয়ে কোনো ডাউট নেই মেহনূর। আজ শুধু এটুকুই বলবো, তোমার দাদার জন্যই তোমাকে পেয়েছি। তাকদির কিভাবে আমাদের দুজনকে মিলিয়েছে সেটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলাম না। আমি তোমাকে চিনতাম না, তুমিও আমাকে চিনতে না। তোমার পরিবার আমাদের চিনতো, আমার পরিবার তোমাদের আত্মীয় বলে ভাবতো। তোমাদের বাড়িতে তোমাকেই আমার পছন্দ হলো, তাও আবার বয়সে তুমি ছোটো। বিয়েটাও করে ফেললাম, ওমনেই পুরোনো কেস রি-ওপেন হয়ে কাজে চলে গেলাম। লাইফ কিভাবে ঘুরছে দেখেছো? আমি তোমার উপর রাগ করিনি। লাইফের ইউনিক স্ট্র‍্যাটেজিটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম।

চোখ বন্ধ করে বড় একটা দম নিলো মেহনূর। বুক থেকে ধীরেসুস্থে নিশ্বাসটা ঝেঁটিয়ে বের করলো। চোখ খুলে গলা ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। বাতাসের ঠান্ডা মোহটা চর্তুদিকে ছড়িয়ে পরেছে। মেহনূর স্বচ্ছ গলায় বললো,
– আমি জীবনেও এই অধ্যায় ঘাঁটতে চাই না। আজকের মতো এখানেই বন্ধ হোক। একটা খারাপ মানুষের বিনিময়ে আপনাকে পেয়েছি, আমার কি এতে খুশি হওয়া উচিত না?

বিষণ্ণতায় চূর্ণ হলেও ম্লান হাসি দিলো মেহনূর। ধীরে-ধীরে হাতদুটো গাল থেকে নামালো। মাহতিম মূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ তীব্র বেগে এক টান মারলো! মাথার পেছনে চাপ দিয়ে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিলো। আচমকা কাণ্ডে প্রচণ্ড বিস্মিত হয় মেহনূর, বুকটা যেনো ধড়াস করে কেঁপে উঠতেই দুরু-দুরু করে ছুটছে। দুচোখ বন্ধ করতেই অতলস্পর্শী বাহুখানা তাকে দখলিস্বত্ব করলো। মেহনূরের পুরো অস্তিত্বটা বুকের সাথে মিশে রইলো। খুবই স্পষ্টভাবে ওপাশের দেয়াল থেকে হৃদ-স্পন্দনের শব্দ শুনছে। ঘড়ির কাঁটার মতো ধুকপুক-ধুকপুক করে বাজছে। আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে সবুজ টিশার্টটা শক্ত করে ধরলো, দুহাতের বলয়ের মাঝে খামচে ধরে রইলো। টের পেলো, মাহতিমের একটা হাত সারা পিঠ জুড়ে ছুটছে।

অন্য হাতটা চুলের চামড়ায় নরম স্পর্শ ছড়াতে ব্যকুল। দূরের কোনো গাছে বসে পাখি ডেকে উঠলো। ছন্দ কাটতে-কাটতে প্রকৃতি যেনো গরম করে তুললো। পাখির ডানা ঝাঁপটানির আওয়াজগুলো দুজনের কানেই যাচ্ছে। বাতাসের শীতল পরশগুলো হেলেদুলে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। প্রকৃতির সরলতায় দুজন মানুষ যেনো অনুভূতির নির্যাস করছে। বাতাসের নিষ্ঠুর দোলায় খোপাটা আলগা হয়ে গেলো, পরপর জোরে ঝাঁপটা মেরে গোছাটা পুরোপুরি খুলেই দিলো। মেহনূরের পিঠ ডেঙিয়ে মাহতিমের হাত ঢেকে ছিটকে নিচে পরলো, মেহনূর সবটা টের পেলেও নড়চড় করলো না। বুকের মধ্যে শান্তির সুখটুকু নিতে-নিতে খুবই আস্তে করে বললো,

– নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে,
হৃদয়ে রয়েছো গোপনে।
মেহনূরের কথাগুলো ওপাশের কর্ণধারে পৌঁছে গেছে। প্রতিটি শব্দের অর্থ বুঝে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনেছে। মেহনূর কি তার বাবার মতোই কাব্যপ্রেমি? কথাটা খাঁটি সত্য। চরণযুগলের গূঢ়ার্থ বুঝতে পেরে বদ্ধ চোখে শুধিয়ে উঠলো,
– অনেক কাছে রেখেছি মেহনূর। যতটুকু কাছে রাখলে মানুষ নিজেকেই দেখতে পায় না।
এবার একটুখানি নড়েচড়ে উঠলো মেহনূর। শক্ত বুকটার সাথে থুতনি ঠেকিয়ে মুখ তুলে চাইলো। মাহতিম চোখ খুলে মুখ নিচু করতেই ভ্রুঁ নাচিয়ে ইশারা করলো, ‘ কি হয়েছে? ‘। মেহনূর হ্যাঁ-না কিছুই বললো না। কালোমনির সুন্দর চোখদুটোর কাছে অজান্তেই দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। মাহতিমের চোরাদৃষ্টি বারবার সুকোমল অধরজোড়ায় নিক্ষেপ হচ্ছে। মাথার পেছনটায় চাপ দিয়ে মেহনূরের কপালটা নিজের কাছে আনলো মাহতিম, কপালের মধ্যখানটায় সবটুকু উষ্ণতা কয়েক মূহুর্তের জন্য চেপে দিলো। ছেড়ে দিয়ে বললো,

– আমি আজই রওনা হবো মেহনূর। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও? যদি আরো কিছুদিন থাকতে —
চোরের মতো কথা ছিনিয়ে তাড়াহুড়ো গলায় বললো,
– না, না ফিরতে চাই। সুরাইয়া বুবুর যন্ত্রণায় থাকা যায় না। আমিও আপনার সঙ্গে ফিরবো।
মাহতিম হাসি দিয়ে বললো,
– চালাকি মনে করেছো বুঝিনা, না? বেচারি আমার ভয়ে তোমার কাছেই যায় না, এখন যত দোষ, নন্দ ঘোসের করছো।

মেহনূর সাথে-সাথে মাথা নিচু করে জিভ কামড় ফেললো। মিথ্যা বলাটা আজও পটুতার সাথে করতে পারে না। কি বলতে যেয়ে কি বললো, ছিঃ! মেহনূরের ধরা খাওয়া মুখ দেখে পাটাতন থেকে উঠলো মাহতিম। পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। কিছু একটা ডায়ালে বসাতে-বসাতে বললো,
– যদি কিছু করতো, চুলের গোড়া পযর্ন্ত ছিঁড়ে আনতাম। তাছাড়া ওই দুটো মাল-মালতী আমাকে বাঘের মতো ভয় পায়। এমনেতেও কিছু করার সাহস দেখাতো না।
পা চালিয়ে ফোনটা কানে ধরলো মাহতিম।
– হ্যালো, আনসারী বলছি। আমার দুপুর বারোটার ভেতর মাইক্রো দরকার।
– ………………………….. .
– সিকিউরিটি লাগবে না। নোমানকে সঙ্গে পাঠান।
– ………………………….. .

– না, কোনো প্রবলেম নেই। ডানদিকে লেগেছে। না, স্টিচ লাগেনি। মাথায় আহামরি কিছু পাইনি। আপাতত —-
ঝোঁপটার দিকে যেতে-যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলো মাহতিম। কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে পিছু তাকালো সে। দ্রুত ডানহাতে দু’দফা তুড়ি বাজাতেই মেহনূর চোখ তুলে তাকালো। মাহতিম তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে চলে আসার ইশারা করলো। মুখে কিছু না বললেও আকারে-ইঙ্গিতে বুঝালো,
– উঠে এসো। গরম বাড়ছে। ওখানে বসার দরকার নেই।
মেহনূর উঠলো। মনে-মনে ভাবলো, এটা কি দায়িত্ববোধ, নাকি অধিকারযুক্ত ভালোবাসা?

মোল্লাবিহীন গ্রাম অনেকটা মেরুদন্ডহীন প্রাণীর মতো। হান্নান শেখের সবকিছু যতোই বর্বর হোক, গ্রামটার মধ্যে একটু হলেও শৃংখলা ছিলো। যেসব মুরুব্বিরা তাঁর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতো, তারাই গ্রাম চালানোর জন্য হাতাহাতি শুরু করবে। গ্রামের পুলিশরা ঘুষের জোরে, টাকার গন্ধে ন্যায়নিষ্ঠতা শূঁলে চড়াবে। ক্ষুদ্ধ-বিক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী সকলের মুখোশ চিনতে-চিনতে একদিন ঠিকই হাপিয়ে উঠবে, তখন কিভাবে ওই অবস্থা থেকে ব্যবস্থা নেওয়া নিবে? সেটাই যেনো মাথায় ঢুকছেনা মাহতিমের। সকালের নাস্তাটা খেতে-খেতেই হতদরিদ্র মানুষের কথা মনে হয়। না-জানি হান্নান শেখ কতগুলো মানুষের রুজি-রুটি খেয়েছেন। সেইসব অগণিত মানুষ হায়-অভিশাপ বড় নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানবে। এই অভিশম্পাতের মুখ থেকে বাঁচতে হলে যোগ্য বিচারের প্রয়োজন। কিন্তু, সেটা এখন দেখবেই কে? নীতির নামে যারা আদর্শ বেঁচে চলে, সেই গ্রামের মুরুব্বিদের ধরবে? মাথাটা ঠান্ডা করে আরো কিছুসময় ভাবলো মাহতিম। লেবুর ঠান্ডা শরবতটা গিলে সুজলার দিকে তাকালো। সুজলার সাথে তার সম্পর্কটা বেশ মজবুত হয়েছে। এখন আর আগের মতো রাখ-ঢাক রেখে কথা বলার প্রয়োজন পরে না। মাহতিম তাই শরবতটা খেয়ে খালি গ্লাসটা রেখে বললো,

– বড় মা, গ্রামের মানুষগুলোর কথা ভেবেছেন? যেই ছিদ্রগুলো আপনার শ্বশুর করে গেছেন, সেগুলো সময় থাকতে ভরে ফেলুন।
সুজলা উজবুক চাহনিতে মাহতিমের দিকে তাকালো,
– শ্বশুরের দোষ কি আমরা সহ্য করবো?
মাহতিম ভণিতা না কে বললো,
– অপশনই তো রাখেনি। আপনার ছেলে যদি এ দেশে থাকতো, তাহলে মেবি সুবিধা করা যেতো।
সুজলা কাঠ-কাঠ গলায় বলে দেয়,
– শাওন কোনোদিনও এ দেশে আসবে না। ও আমার কাছে ওয়াদা করে গেছে।
মাহতিম কথাটা শুধরে দিয়ে বললো,
– ভুল বললেন বড় মা। ও আপনার কাছে ওয়াদা করতে বাধ্য হয়েছে। আপনিই ওকে বিদেশ যেতে বাধ্য করেছেন। তবে, সেটা ওর মঙ্গলের জন্যই করেছেন।
সুজলা এবার না বলে পারলো না,
– এতোসব খবর কি করে পাচ্ছো? তোমার জন্য দেখি কিছুই গোপন করা যাবে না।
মাহতিম দাম্ভিকতার হাসি দিয়ে বললো,

– ভুল বুঝবেন না বড় মা। আমি লোক লাগালে পাতাল থেকেও ভুসভুস করে তথ্য বেরোতে থাকে। আমি শুধু ওইটুকুই শুনি, যেটুকু আমার প্রয়োজন। আমি বর্তমানে গ্রামবাসীর কথা চিন্তা করছি। এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে বুঝলাম, আপনিই এখন মোল্লাবাড়ির গুরুজন। আপনার চেয়ে বয়সে আর কেউ নেই।
সুজলা মর্মার্থ বুঝে ভীত চোখে তাকালো। তাড়াতাড়ি বলে ফেললো,
– অসম্ভব! এমন আকাশ-পাতাল চিন্তা কোরো না মাহতিম। তুমি শহরে থাকো, তাই গ্রামের রীতিনীতি বোঝো না। ভুলেও ওকাজ করতে যেও না বলছি। আমি ওসবে অভ্যস্ত নই, কোনোদিন পারবো না।
মাহতিম কথাটা হেলা-ফেলা না করে জোর দিয়ে বললো,
– আপনি পারবেন। আপনার সুবুদ্ধির পরিমাপ কতখানি পযর্ন্ত হতে পারে, সেটা অলরেডি বুঝে গিয়েছি। আগে শুধু নিজের বাড়ি দেখতেন, এখন আপনি সবার বাড়িতে নজর দিবেন। পার্থক্য এটুকুই, আপনি মানুষগুলোর সেবা করবেন, আপনার শ্বশুরের মতো শোষণ করবেন না।
সুজলা কথা শুনে শান্ত হলো না। অশান্ত কন্ঠে বললো,

– আমি দ্বারা সম্ভব হলে আজ রাজি হতাম। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না মাহতিম। কথাটা যতো ছোট শোনাচ্ছে, দায়িত্বের ভারটা কিন্তু অনেক। এটা একটা পুরুষের কর্ম, সেখানে তুমি আমাকে কেনো টেনে আনছো?
মাহতিম বিজ্ঞের মতো বলে উঠলো,
– পুরুষের কর্ম পুরুষই করবে। আপনি তো নিজের চৌকাঠ ডিঙোবেন না। আপনার নিজের লোকবল থাকবে, উঠাবসার মানুষ থাকবে, তাদের ইশারা করে কাজ করাবেন।

সুজলা অনেকক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে তর্কবিতর্ক চালালো। কিন্তু খাঁটি যুক্তির কাছে সুজলাও টিকলো না। মাহতিমের সোজাসাপ্টা কথা, আপাতত হাতের চাবি নিজের কাছেই রাখুন। শুধু চাবি চালানোর পন্থাটা বদলে ফেলুন। দীর্ঘসময়ের তর্কযুদ্ধটা শেষমেশ মাহতিমের জয়ে ইতি টানলো। মাহতিম বিষয়টা নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে-করতে সবাইকে মোল্লাবাড়িতে পৌঁছে দিলো। সেই একই মাইক্রোতে বসে থেকে সে এবং মেহনূর সদর দরজা থেকে বিদায় নিলো। যাওয়ার আগ পযর্ন্ত সুজলার মাথায় সবকিছু ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দিলো। এবার যেনো মহিমপুর গ্রামটা অন্য চেহারার জন্য অপেক্ষা করছে। শাষক-শোষণ মুক্ত গ্রাম হয়ে ভিন্ন আদলের চিন্তা করছে। সুজলা ঠিকই গূঢ়ভাবে সবকিছু চিন্তা করে নিলো, দীর্ঘদিনের নীল-নকশাকে নসাৎ করে নতুন চিত্র বানালো। সেই চিত্রে সাদা-কালো রঙ হটিয়ে রঙিন তুলি চালালো, মনের ভেতর যত ভেতর কলাকৌশল, পরিকল্পনা, চিন্তাভাবনা আসলো, আস্তে-আস্তে বাস্তবায়ন শুরু করলো সে। প্রথম দফায় বিরাট ধাক্কা খেলো সুজলা। কিন্তু সময় বাড়তে-বাড়তে সত্যি-সত্যিই সবকিছু পালটে যেতে থাকলো। যেই অরাজকতা ছোট্ট একটা গ্রামের ভেতর চলছিলো, সেখান থেকে সবকিছু ধূলিসাৎ হতে লাগলো।

সময়ের গণ্ডি প্রায় মাসখানেক পেরুলো। আনসারী-নিবাসে চিকিৎসা শেষে মারজা ফিরে এলো। কয়েক মাসের ছুটি পেয়ে পরিবারিক মূহুর্তে যুক্ত হলো মাহতিম। এই উছিলায় সৌভিকের ব্যাপারটা পাকাপাকি করতে সবকিছু বন্দোবস্ত করতে লাগলো। বাড়িতে একটা ধুম উঠলো শীঘ্রই সৌভিকের বিয়ে হচ্ছে। বিয়েটা বিরাট ধুমধামে মহাসমারোহে ঘটবে। নিজের বিয়ে নিয়ে যতটুকু ঘাটতি ছিলো, তার চেয়ে অনেকখানি সৌভিকের বিয়েতে করবে। বেচারা সৌভিক লজ্জায় এখন অফিসের কাজে ব্যস্ততা দেখায়, বিয়ের হাট-পাট নিয়ে কথা তুললেই চাটুকারের মতো ছিটকে যায়। সবকিছু বিবেচনায় রেখে দুপক্ষের শর্ত-সম্মতিতে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শানাজের বিয়েটা আনসারী-নিবাস থেকে উঠবে, এ নিয়ে ব্যাপারটা ঠিকঠাক করা হয়। সেই অনুযায়ী বিয়ের তিন সপ্তাহ আগে গ্রাম থেকে সবাইকে আনায় মাহতিম।বিয়ে উপলক্ষ্যে রমরমা পরিবেশে কেউই বাদ যায়নি। শেফালি যেনো মুখরোচক হয়ে সবার সঙ্গে মিলে গিয়েছে। মাহতিমকে বাঘের মতো ভয় পেয়েই হোক, বা সৎ বুদ্ধির জন্যই হোক, সুরাইয়া এখন আগের মতো নিকৃষ্ট সুলভ দেখায় না। নিজেকে মার্জিত রূপে দেখানোর জন্য বেশ মাপযোগ করে কথা আগায়। বাড়িটা হৈ-হৈ কল্লোলে মুখরিত হলেও কোথায় যেনো শূন্যতা কাজ করে। প্রায়ই মনে হয় কি যেনো নেই। আজও তৌফের ছাদে এসে পূর্ণিমা চাঁদ দেখে শূন্য-শূন্য লাগলো। চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,

– তোকে মিস করছি রে মাহদি। খালি তোর কথা মনে পরে।
কোথায় যেনো গভীরভাবে ব্যথা লাগে। তৌফ খুব শক্ত থাকার চেষ্টা করে, পারে না। চোখ নিংড়ে দু-এক ফোঁটা পানি বেরিয়ে আসে। কখনো সেই পানিটুকু ভেতরে আঁটকানোর চেষ্টা করে। আজ কেমন অবাধ নয়নে পানি পরতে লাগলো, চাঁদের আলোয় তৌফের চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। নিরবে পেছন থেকে চলে এলো ফারিন, তৌফের ডান কাধে হাত রেখে সেও চাঁদের দিকে তাকালো। বির্মষ সুরে বলতে-বলতেই কেঁদে উঠলো,
– তৌফ ভাই, একা থাকলেই ওর কথা মনে পরে। খাওয়ার টেবিলে কতো ফাজলামি করেছি, কত কি বলেছি। আজ ভালো লাগে না ভাই, সৌভিক ভাইয়ের বিয়েতে মাহদিই মিসিং।
তৌফ অশ্রুচোখে ঢোক গিলে নিজেকে দ্রুত সামলে নিলো। ফারিনকে কাঁদতে দেখে মাথায় জোরে এক গাট্টা মারলো। ব্যথার চোটে কান্না চোখে ভ্রুঁ কুঁচকালো ফারিন। বিস্ময় নিয়ে বললো,
– তুমি আমাকে এতো জোরে মা:রলে?
ফারিনকে হাবার মতো তাকিয়ে থাকতে তৌফ নিজের হাসি আঁটকালো। মুখের উপর রাগী অভাস টেনে তেজালো সুরে বললো,

– খাচ্চরের মতো নাক দিয়ে যে পানি বের করলি, তোর কি একটুও শরম করেনা?
ফারিন রেগে গিয়ে বললো,
– কাঁদলে শরম করবে কেন?
তৌফ ইচ্ছে করে ফাজলামি জুড়ে দিলো,
– ছিঃ ছিঃ, তুই এইটাও জানোস না? মানুষ হাসতে-হাসতে যে ভেদভাদায়া বায়ু ছাড়ে, ওই গন্ধের ঠ্যালায় চারপাশের মানুষ টিকবো?

ফারিন হা করে তাকাতেই ভয়ংকর রেগে গেলো। তৌফকে ইচ্ছামতো এলোপাথাড়ি মারতে থাকলে নিরুপায় তৌফ তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে পালিয়ে গেলো। পিছু-পিছু ছুট দিলো ফারিন, একটুও ছাড় দিবে না ব:দমাশটাকে। দৌড়ে দুজন সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে যেই করিডোরে আসলো, তখনই প্রচণ্ড কিছু আছাড় মারার শব্দ হলো! শব্দ শুনে তড়াক করে থেমে গেলো দুজন, যেখান থেকে শব্দটা পেলো, দুজনই চুপিচুপি সেদিক বরাবর এগিয়ে গেলো। সরু ফাঁক থাকা দরজার দিকে তাকাতেই চমকে দুজন নিজেদের তাকালো। ফারিন অবাক হয়ে কিছু বলতে নিলে তৌফ ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ থাকতে বললো। দুজনই দরজার ফাঁক গলে ভেতরে চাইলে সাথে-সাথে চোখ বড় করে ফেললো! মাহতিম মোবাইলটা আছাড় মেরে প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছে, একজোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফ্লোরের উপর আঁটকে আছে। মোবাইলটা তিন পার্টে হয়ে কোথায় ছিঁটকে পরলো, তার কোনো হদিশ নেই। দুজন বুঝতেই পারছেনা, মাহতিম এভাবে ফুঁসছে কেনো? মোবাইলটা আছাড় দেওয়ার কারণ কি?

ফ্লোরের উপর আছাড় দেওয়া ফোনটা পরে আছে! প্রচণ্ড রাগে মুখের চামড়া লাল দেখাচ্ছে। কপালের ক্ষত জায়গার কাছে নীল রগগুলো ফুলে উঠেছে। রাগের এমন ভয়াবহ আক্রোশ আগে দেখেনি কেউ। শান্তভাবে বিছানায় বসে থাকলেও মুখটা কাঠ-কাঠ ভাবে গম্ভীর। দরজার সরু ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটুকু দেখতেই অজান্তে ঢোক গিললো ফারিন। অবাকে চোখদুটো বড়-বড় করে পাশে থাকা তৌফের দিকে তাকালো। তৌফও দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফারিনের দিকে তাকালে ফিসফিস করে বললো ফারিন,

– এটা রেড সাইরেন তৌফ ভাই! আমার ভয় লাগছে! আমি শিওর খারাপ কিছু হয়েছে। ভাইয়ার এমন চুপ মানেই বিপদ। সবাইকে ডাকো, প্লিজ সবাইকে ডাকো।
তৌফ ভেতরে-ভেতর ভয় পেলেও বাইরে প্রকাশ করলো না। বাড়িতে বিয়ের আমেজটা পণ্ড হোক, এমন মূর্খতা করা যাবে না। দ্রুত কিছু বুদ্ধি এঁটে গলা নামিয়ে বললো,
– তুই এখুনি নিচে যাবি। যেয়ে চুপচাপ সিয়ামকে ডেকে আনবি। আগেভাগে কিচ্ছু বলতে যাবি না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নীতির রুমে দেখা কর। তাড়াতাড়ি যা! দৌঁড় দে!
দেরি করলো না ফারিন। দু’হাতে লেহেঙ্গা ধরে একদৌঁড়ে সিয়ামের উদ্দেশ্যে ছুটলো। তৌফ সেখান থেকে দ্রুততার সাথে নীতির রুমে ঢুকে পরলো। আয়নার সামনে রঙিন বুরুশে ব্লাশার দিচ্ছিলো নীতি, তৌফকে চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় ঢুকতে দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। আয়নায় দৃষ্টি রেখে বললো,

– ব্যাপারটা কি? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?তৌফ ভাই, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?
চিন্তায় বিভোর তৌফ হঠাৎ সৎবিৎ ফিরে পেলো। চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাতেই নীতির উদ্দেশ্যে বললো,
– মেবি ঝামেলা হইছে। মাহতিমের এক্সপ্রেশান নরমাল ছিলো না। তুই ভাবতে পারোস, ও নিজের ফোন আছাড় দিছে! আমি সিয়ামরে ডাকার জন্য ফারিনরে নিচে পাঠাইছি। গণ্ডগোল হইছে নীতি, পিঠ-পিছে বিরাট গণ্ডগোল হইছে!
বুকটা ধ্বক করে উঠলো নীতির। ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরলো সে, হাতের বুরুশটা ফসকে ফেস প্যালেটের উপর শব্দ করে পরলো। নীতি চাপা মুখে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,

– তুমি খুব ভয় দেখাচ্ছো তৌফ ভাই। এমন ভয় দেখিও না।
তৌফ হঠাৎ তেঁতে উঠলো। মারমুখি আচরণের মতো চিৎকার দিয়ে বললো,
– তোর কি আমার কন্ঠ রিল্যাক্স মনে হইতাছে? টেনশনে শা:লা শেষ হইয়া যাইতাছি, এইদিকে তুই মশকারি লাগাইছোস!
নীতি অপ্রতিভ অবস্থায় নিভলো। কথা বাড়িয়ে কুরুক্ষেত্র ডাকার দরকার নেই। ততক্ষণে সিয়ামকে নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকলো ফারিন। দরজাটা লাগিয়ে চার মাথা একত্র হলো। গোল করে বিছানায় বসতেই সিয়াম প্রথম বললো,
– ঘটনা কি? ফারিন তো কুত্তার মতো আমারে টানতে-টানতে আনলো। কাহিনী জিগাই, কিছুই বললো না।
সিয়ামকে থামিয়ে দিয়ে তৌফ বলে উঠলো,

– সৌভিকরা আসছে?
সিয়াম যেই উত্তর দিবে, তখনই পাশ থেকে ফারিন বলে উঠলো,
– না, রাস্তায়। জ্যামে আঁটকে গেছে।
বুকভরা নিশ্বাস নিলো তৌফ। একে-একে সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বললো,
– মাহতিম একটু আগে মোবাইল আছাড় দিছে। কি কারণে দিছে জানি না।
সিয়াম উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– কি বলোস? হুর, বিশ্বাস হয়না! সকালেই ভাবীর সাথে বান্দরামি করতে দেখছি। সেকেন্ডের মধ্যে আরেক চেহারা দেখাইবো ক্যান?
তৌফের ইচ্ছে করলো কষে একটা চড় লাগাতে! এমন বোকার মতো কথা শুনে প্রচণ্ড খ্যাঁকিয়ে উঠলো তৌফ,

– ওরে আবা:ল! মানুষ কি সেকেন্ডে-সেকেন্ডে চেন্ঞ্জ হয় না? এমন হাবলার মতো কথা বলতাছোস ক্যান? তুই নিজেও জানোস মাহতিম হুদাই রাগ দেখাইতে যাইবো না। আমার তো মনে হইতাছে —
কথার মাঝখানে দাঁড়ি বসিয়ে চমক কাটলো নীতি,
– অনামিকার জন্য?
বিরক্তি নিয়ে নীতির দিকে তাকালো তৌফ। ডানহাত উঠিয়ে নীতির মাথায় জোরে এক ঘা মারলো। ব্যথায় নীতি আর্তনাদ করে উঠলে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো তৌফ,
– গালে মাখ্খন লাগাইছোস দেইখা থাপ্পড়টা দিলাম না। আমার পুরা কথা শেষ হইতে দিস। ওই জাউরার কথা স্মরণ না কইরা আমার কথা চুপচাপ শোন্!
তৌফের দিকে গরম চোখে তাকালো নীতি। তন্মধ্যে নীতির পক্ষে সাড়া দিয়ে ঝাড়ি মারলো ফারিন,
– তুমি আপুকে শুধু শুধু মারলে কেনো? তোমার হাতটা অযথা কারণে কেনো উঠাও? কারোর মাথায় যে হিট করা নিষেধ এই কমনসেন্স নেই?
সিয়াম পরিস্থিতিটা সামাল দিলো। আড়ালে তৌফের দিকে কনুই গুঁতা দিয়ে ঠান্ডা থাকার ইশারা করলো, ফারিনের উদ্দেশ্য স্বাভাবিক ভাবে বললো,

– প্লিজ, নিজেদের মধ্যে এরকম করিস না। সিচুয়েশনটা কোন্ ফেজে আছে ওইটা বুঝতে দে। তৌফ তুই শুরু কর্।
তৌফ ক্রুদ্ধ ভারি নিশ্বাস ছেড়ে হালকা হয়ে বললো,
– আমি শিওর মাহতিম ফোনে কথা বলছে। ফোনে এমন কিছু শুনছে যেটার জন্য রাগ সামলাইতে পারেনাই। ভোরে ওর নামে কুরিয়ার আসছে। পাক্কা একটা ছোটখাট বক্সের মতোন প্যাকেট। ওই প্যাকেটে কি আসছে আমি জগিংয়ের সময় জিগাইছিলাম। মাহতিম এদিকেও লজিক্যালি টপিকটা স্কিপ করছে। বলছে ভাবীর জন্য নাকি সারপ্রাইজ অর্ডার দিছিলো, ওটা কুরিয়ারে আসছে। অথচ তোরা বিশ্বাস করবি কিনা জানিনা, আমি কিচেনে যখন হুদাই ভাবীরে মশকারির জন্য জিগাইলাম, ভাবী বললো মাহতিম নাকি রুমে কোনো পার্সেলই আনে নাই। এখন প্রশ্ন হইলো, মাহতিম আসলে কি লুকাইতেছে?
সবাই মন দিয়ে পুরো কথাটা শুনলো। তৌফের কথায় গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য আছে। কিন্তু সামান্য একটু খটকা লাগলে প্রশ্ন করলো সিয়াম,

– কিন্তু দোস্ত এদিকে আরেকটা ব্যাপার আছে। যদি ওই পার্সেলটা ভাবীর জন্যই হয়, তাহলে তো চিন্তার কিছু নাই। হয়তো ভাবীরে অন্য বাবে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মাহতিম ওটা রুমে আনেনি।
সিয়ামের কথা যুক্তি পেয়ে সম্মতি দিলো নীতি,
– কথাটা ভুল বলোনি সিয়াম ভাই। ভাবীকে ইউনিক স্টাইলে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য অন্য কিছুও প্ল্যান থাকতে পারে। কি পারে না?
তৌফ দুজনের কথাকেই সমর্থন করলো। কিন্তু সুক্ষ্ম ফাঁকটা সবার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে, সেটাই তৌফ ভালোভাবে বুঝিয়ে বললো,

– তোদের দুজনের কথাই ঠিক। দুইটার কথাই আমি মানলাম। কিন্তু একটা জিনিস চিন্তা কর্, যেই মানুষটা সকালেও ঠিক ছিলো, দুপুরেও ঠিক ছিলো, ওই মানুষ সন্ধ্যার টাইমে রাগের চোটে চুপ হইবো ক্যান? কোনো উত্তর আছে? জানি আমার কথা শুইনা আগা-মাথা কিছু বুঝতাছোস না। কিন্তু আমি বুঝতে পারতাছি। আমি জানি ওই পার্সেলটা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধছে। সবকিছুর পিছে ওই পার্সেলটাই আছে, সময়মতো আমার কথাটা মিলায়া নিস।
দুটো মিনিট পুরো নিঃশব্দ অবস্থা চললো। কারো মুখে শব্দ নেই। চারজনের নজর বিছানার ফ্লোরাল ডিজাইনে আঁটকে আছে। একটা সময় ছিলো, যখন নয় মাথা একত্র হয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ করতো। যেকোনো মুশকিল মূহুর্তে উপায় খুঁজে ফেলতো। আজ সেই সংখ্যাটা কমে এসে চারে দাঁড়িয়েছে। দলের সবচেয়ে চন্ঞ্চল সদস্যটা পাকা-পাকা বুদ্ধি মিলানোর জন্য আর নেই। সবার বুকের ভেতরটা যেনো একইসঙ্গে হাহাকার করে উঠলো। একসাথে ভারি নিশ্বাসটা চারটা বুক থেকে বেরুলো। অনেকক্ষণ পর নিচে থেকে হৈচৈ শুরু হলো। ওরা চারজন বুঝতে পারলো নিশ্চয়ই সৌভিকরা এসেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দুপক্ষের আংটি বদল হবে। ঠিক পন্ঞ্চম দিনে ঢাক-ঢোলের সাথে সৌভিকের বিয়ে হচ্ছে। নিরবতার রুদ্ধ অবস্থা ছিঁড়ে ফারিন কথা বললো,

– আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। মাহতিম ভাইয়া যদি নিজে থেকে যেচে বলে, তাহলে হয়তো সম্পূর্ণ ব্যাপারটা জানা সম্ভব। কিন্তু আমরা যদি পাকনামি করে জানার আগ্রহ দেখাই, তাহলে বিয়েতে নেগেটিভ ভাইব পরবে।
তিনজনই চোখ তুলে ফারিনের দিকে তাকালো। মুখে কিছু না বললেও ফারিনের কথাকে সবাঈ মেনে নিয়েছে। অপেক্ষা নামক শব্দের কাছে স্থির থেকে রুম ত্যাগ করলো সবাই। কেউ যেন সন্দেহ না করুক, তাই নিচে নামার আগে দলভঙ্গ করে আলাদা হলো প্রথমে নীতি ও ফারিন একসাথে নামলে শেষে বাকি দুজন নামলো।

সাদা সিল্কের শাড়ি পরেছে মেহনূর। মোটা পাড়টা রক্তজবার মতো লাল। গায়ের ব্লাউজটা লাল পরলেও স্লিভটা কনুই সমান। আজ মারজার জোর-জবরদস্তিতে বেশ সেজেছে মেহনূর। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। মারজার কথা মতোন ফিটফাট হলেও মেহনূরের কাছে ভালো লাগছে না। পার্লারের মেয়েগুলো রাক্ষু:সের মতো মারজা কথাই শুনেছে। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা পাকিয়ে ঘাড়ের কাছে সেঁটে দিয়েছে। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি তুলে খোঁপার গোল স্তুবকটা গাজরা দিয়ে পেঁচিয়েছে। আচ্ছা ঠোঁটের মেরুন লিপস্টিকটা খরার মতো শুকালো কেনো? এটাকেই তাহলে নীতি আপু ‘ ম্যাট ‘ বলে পরিচয় দেয়? মেহনূর একবুক অস্বস্তি নিয়ে মেহমান দেখাশোনা করছে। চোখদুটো চুম্বকের মতো সিঁড়ির কাছে চলে যাচ্ছে। ফাঁকা সিঁড়িটা দিয়ে কখন মাহতিম নিচে নামবে, কখন সবার আড়ালে ডেকে মেহনূরের দিকে তাকাবে, আজকের সম্পূর্ণ সাজটা একজনের জন্যই উৎসর্গ। অন্তত সেই মানুষটা একটাবার দেখুক, হাসি-হাসি ঠোঁটে অবাক চাহনিতে আপাদমস্তক দেখতে থাকুক। ওই মূহুর্তে কিযে লজ্জার পরিস্থিতি হবে, সেটা ভেবেই আনমনে মিচকি-মিচকি হাসছে মেহনূর।

– একা-একা বেকুবের হাসছিস কেন?
পাশ থেকে কন্ঠ শুনতেই চমকে উঠলো মেহনূর। কল্পনার চিন্তাটা কেটে যেতেই বাম দিকে তাকালো। গোলাপী রঙের জামদানী শাড়িতে সাবা দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ভেতর প্রশ্ন নিয়ে মেহনূরের কাণ্ডকারখানা দেখছে। সাবার দিকে জোরপূর্বক হাসি দিলো মেহনূর, অপ্রস্তুত গলায় আমতা-আমতা করে বললো,
– এই যা, হাসবো কেনো? হাসির তো কিছুই নেই। ভুল দেখেছো বুবু।
সাবা চোখদুটো ছোট-ছোট করে গোয়েন্দার মতো তাকালো। ভ্রঁ-টা বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো উঁচু করে ভাবুক কন্ঠে বললো,
– আমি দশ মাইল দূর থেকে তোর তামাশা দেখছি। কাঁটাচামচ দিয়ে মিষ্টি গুঁতিয়ে কি করলি হ্যাঁ?
সাবার কথামতো পিরিচে তাকালো মেহনূর। সাথে-সাথে জিহবায় কামড় দিয়ে চোখ খিচুঁনি দিলো। কি সর্বনাশ! মহাজনের কথা ভাবতে-ভাবতে মিষ্টি খুঁচিয়ে শেষ! মেহনূরকে হা-হুতাশ করতে দেখে হো-হো করে হেসে উঠলো সাবা। টিটকারিটা জায়গামতো ছুঁড়ে বললো,

– যার ধ্যানে এতোক্ষন ডুবেছিলি, ওই ব্যক্তি একটু আগে বাইরে চলে গেছে। এখন এদিক-সেদিক না তাকিয়ে অপেক্ষা কর।
সাবার অকপটে কথায় আজ লজ্জা পেলো না মেহনূর। উলটো একরাশ মনক্ষুণ্ণতা ভর করলো তাকে। মাহতিম না বলে বাইরে গিয়েছে? দুপুরের পর থেকে বড্ড অদ্ভুত আচরণ করছে। খুবই অদ্ভুত! প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে নিচে নামলো শানাজ। সোনালী রঙের তাঁতের শাড়িতে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো তাকে। মেহনূর দূর থেকে শানাজের মুখটা দেখে তৃপ্তির হাসি দিলো। কতগুলো দিন শেষে শানাজের মুখটা হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শানাজকে এনে সোফায় বসালো সুজলা। দু’পক্ষের আংটি বদলটা প্রায় শুরু হলো। সৌভিক যখন হাতে আংটি নিলো, তখনই কিছু একটা মনে পরায় আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলো। সৌভিকের হন্য হয়ে খুঁজাটা দৃষ্টি এড়ালো না প্রীতির। সৌভিকের কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো সে,

– কাকে খুঁজো ভাইয়া?
সৌভিক উৎসুক গলায় বললো,
– মাহতিম কোথায়? ওকে ডেকে আন্। ও ছাড়া আংটি বদল করবো, এটা হয় না।
সৌভিকের কথায় চেতন ফিরলো সবার। ঠিকই তো, মাহতিম কোথায়? ও কি বাইরে থেকে ফিরেনি? সবাই একযোগে খুঁজতে লাগলো মাহতিমকে। নীতি নিজ দায়িত্বে রুমে গিয়ে ফেরত আসলো। মাহতিমের ফোন কল দিয়ে কেউই তাকে পেলো না। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি সুরে বলতে লাগলো,

– যে নাম্বারটিতে কল করেছেন, তা এই মূহুর্তে বন্ধ আছে। অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ।
মাহতিম তো ফোনটা আছাড় মেরেছিলো, তাহলে কি ফোনটা ওভাবেই আছে? কথাটা মনে-মনে আওড়ালো সিয়াম। ভাবনাটা মাথায় খেলতেই দ্রুত তৌফকে আড়ালে নিয়ে বললো। তৌফ আর দেরি না করে সৌভিককে মিথ্যা বুঝ দিয়ে শুভ কাজ সারতে বললো। সৌভিক প্রথম-প্রথম অমত করলেও শেষে সবার জোড়াজুড়িতে আংটি বদল করলো। মাহতিমের উদ্ভট আচরণ দেখে ভীষণ খটকায় আছে মেহনূর। না, এবার শান্ত হচ্ছে না। কাউকে না বললেও অন্তত মেহনূরকে জানিয়ে যায়। যেখানেই কাজ থাকুক, মেহনূরকে আশ্বস্ত করে বাসা থেকে বেরোয়। অপেক্ষা করতে লাগলো মেহনূর। যে পযর্ন্ত না আসবে, ওই পযর্ন্ত একটা খাবারও টাচ করবে না সে।

বাড়ির ভেতরটা কোলাহলে ভরপুর। সৌভিকদের পরিবারের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে বড়রা। মারজার তোষামোদে সৌভিকের কাকা-কাকিমা রাতটুকু এখানেই কাটাবে। বিয়ের পরিবেশটা জমানোর জন্য আজ ভালোই আয়োজন হয়েছে। অন্যদিকে নীতিরা ছাদে আঁড়ি গেঁথেছে। খোলা আকাশের নিচে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে এলাহি কারবার। সবাই নিজেদের ব্যক্তি জীবনের নানা গাল-গল্প নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে মেহনূর। রাগে ভেতরটা দাউদাউ করছে মাহতিমের জন্য। অসভ্য লোকটা এখনো দোরগোড়ায় হাজির হয়নি। গেছে কই? কোন্ চুলায় আগুন ধরাতে গিয়েছে? মেহনূরকে অন্য চিন্তায় বিভোর দেখে জোরে কাশলো সৌভিক। কাশির ইঙ্গিতপূর্ণ ব্যাপারটা কানে যেতেই স্বাভাবিক হলো মেহনূর। সৌভিক একগাল হাসি দিয়ে ফাজলামির সুরে বললো,

– আপনার অভদ্র লোকটা কাজে গেছে ভাবী-শ্যালিকা। চিন্তা ঝেড়ে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোন।
সৌভিকের মুখে ডাবল সম্বোধন শুনে হো-হো হাসছে সবাই। সামিক হাসতে-হাসতে দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
– ভাই জানলে টুট টুট খাবা ব্রো। ভাবীই ডাকো।
সামিকের ইঙ্গিত শুনে কপট রাগ দেখালো সৌভিক। পিঠে জোরে চাপড় মেরে হাসি দিয়ে বললো,
– আমার কাছে বোনই ভালো। এর ঊর্ধ্বে কিছু ভাবা লাগবে না।
কোকাকোলার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলো ফারিন। হঠাৎ গ্লাসটা ঝটকা মেরে ছিনিয়ে নিলো তৌফ। সুন্দর করে চুমুক দিলে হা হয়ে গেলো ফারিন। একবার গ্লাসের দিকে তাকালো, আরেকবার তৌফের দিকে দৃষ্টি ঘুরালো সে। রাগে গজগজ করে চেঁচিয়ে বললো,

– অসহ্য তৌফ ভাই! অসহ্য! তোমার জ্বালায় কি শান্তি মতো কোকও খেতে পারবো না? তুমি কি আমাকে বিরক্ত করা অফ করবে?
তৌফ নির্বিকার ভঙ্গিতে পুরো গ্লাস খালি করে করলো। বড় একটা ঢেঁকুর তুলে বললো,
– ওই সিয়াম, শোনতো ব্যাটা, ফটাফট একটা রুম স্প্রের ব্যবস্থা কর। নাইলে একটু পরে যেই কেলেঙ্কারিটা হইবো, ওইটার জ্বালায় টিকতে পারবি না।
ফারিন বাদে সবাই তখন অবুঝের চোখে তাকালো। সিয়াম নিজেই ব্যাপারটা বুঝার জন্য বললো,
– তোর দেখি ভালোই কারেন্ট। রুম স্প্রে চাস ক্যান? কোন্ জায়গায় লাগাবি?
তৌফ রাগী মুখে তাকালো। নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে থাবড়া মা:রার ভঙ্গি ধরে বললো,

– দূর ব্যাটা! আলগা কথা কস ক্যান? পরিবেশে মাইয়া মানুষ আছে দেখোস না? ফারিন পারদ মারবো বুঝছোস? এজন্য আনতে বলতেছি।
সিয়াম আবার জিজ্ঞেস করলো,
– আরে ব্যাটা পারদ মানে কি?
তৌফ বিরক্ত ভরে বললো,
– মূর্খ! অশিক্ষিত! আই-কিউ দিয়াও বুঝোস না? পারদ মানে বুঝোস না? মাঝখানের শব্দ আউট কর, এরপর দ্যাখ কি দাঁড়ায়।

একমিনিট পুরো পরিবেশটা ঠান্ডা হয়ে থাকলো। সবাই একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাইয়ি করলো। যেই সবগুলো চোখ ফারিনের দিকে আঁটকে গেলো, তখনই দুম করে তীব্র হাসির ঝড় উঠলো। পুরো ছাদটা তখন হাসির শব্দে গমগম করে উঠলো। ফারিন লজ্জায় নত হয়ে গেলেও শেষে সবার হাসিতে যুক্ত হলো। ছাদের শুকনো কাপড় তুলতে অন্যপ্রান্তে ছিলো মেহনূর। সেখানে আলো জ্বালায়নি বলে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাতাসে উড়তে থাকা কাপড়গুলো তুলতেই হঠাৎ গা ছমছম করলো মেহনূরের। ক্লিপের উপর হাত রেখে স্থির হলো সে। শোঁ শোঁ বাতাস, থেমে-থেমে হাসির শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ছন্দপূর্ণ ডাকটা স্পষ্ট কানে শুনতে পাচ্ছে। বুকের স্পন্দনটা একটু-একটু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ওটা কিসের আলো?

মেহনূর ধীরপায়ে রেলিংয়ের কাছটায় এগিয়ে গেলো। বাড়ির সদর দরজার বাইরে ‘ হাইজ ‘ গাড়ি থামানো। আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই লম্বা গড়নটা দেখতে পেলো মেহনূর। গেটের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সাদা পান্ঞ্জাবিটা দেখতে পাচ্ছে। তাকে তিনজন ব্যক্তি কি কথা যেনো বললো। ওমনেই মাহতিম রণমূর্তি ধারণ করে তাদের শাষাতে লাগলো। এটুকুতেই ক্ষান্ত হলো না মাহতিম, সোজা তর্জনী তুলে রাগের তেজ ছেড়ে দিলো। ধুক-ধুক তালটা যেনো কানের পর্দায় আঘাত দিচ্ছে। শরীরটা ঠান্ডা মৌসুমের মতো ভয়ে শিউরে উঠছে। মাহতিম এখন পযর্ন্ত কোনোকিছু লুকায়নি! যা জানতে চেয়েছে, যখন জানতে চেয়েছে, সব নির্দ্বিধায় মেহনূরকে বলার জন্য প্রস্তুত থাকতো। হঠাৎ চোখের পলকে প্রথম লোকটার কলার চেপে ধরলো মাহতিম, দু’হাতে কলার খামচে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। দৃশ্যটা দেখার সাথেই মুখে হাত চাপা দিলো মেহনূর। মাথাটা এলোমেলো লাগছে!

কি হচ্ছে বাইরে? মাহতিম কেনো ঝগড়া করছে? লোকগুলো কারা? মাহতিমের কবল হতে কোনোভাবেই কলার ছাড়াতে পারছেনা। দুজন লোক অবিরামভাবে কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ব্যর্থ! মাহতিমকে ওরকম অবস্থায় দেখতে পেয়ে বাড়ির দারোয়ান গিয়ে তাড়াতাড়ি আঁটকালো। দারোয়ান-সহ তিনজন মিলে ওই কলার ছাড়িয়ে দিলো। মাহতিম তবুও ওদের শাষাতে থাকলে দারোয়ান লোকটা ভেতর টেনে আনলো। মাহতিমকে শান্ত থাকার কথাটা দূর থেকে বুঝলো মেহনূর, দৃশ্যটা দেখতে-দেখতে আরো একবার ঢোক গিললো। হাতভর্তি কাপড় ফেলে দৌঁড় লাগালো মেহনূর। মেহনূরের দৌঁড় দেখে সবাই একটু প্রশ্নসূচকে তাকালেও মাহতিমকে দেখে হয়তো ছুটে গিয়েছে।

মেহনূর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির বাইরে গেলো, হাঁপাতে-হাঁপাতে ডান-থেকে-বামে তাকালে লন এরিয়ায় দৃষ্টি পরলো। পাকা ছাউনি দেওয়া বসার জায়গাটায় বসে আছে মাহতিম। আবার দৌড় লাগিয়ে একেবারে সামনে থামলো মেহনূর। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই মাহতিমের কাছে গেলো। বসার পাকা জায়গায় মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে সে। নিচু করা মাথাটায় হাত রাখলো মেহনূর। চুলগুলো আঙ্গুলে নাড়াতেই মাথা তুললো মাহতিম, সামনে আগত মানুষটার দিকে থমথমে দৃষ্টিতে তাকালো। মুষ্টিবদ্ধ করা হাতদুটো আলগা করে একটা হাত উপরে তুললো, মাথা থেকে কোমল হাতটা পাঁচ আঙ্গুলে খামচে ধরলো সে। প্রচন্ড রাগে-ক্ষোভে-আক্রোশে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো। সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো মেহনূরের, তুমুল আশ্চর্যে চূর্ণ হলো সে। অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে একবুক ভয় নিয়ে প্রশ্ন করলো মাহতিমকে,

– বাইরের লোকগুলো কারা?
কোনো জবাব দিলো না মাহতিম। নির্বাকভাবে মেহনূরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহনূর একটু ঢোক গিলে আবার জিজ্ঞেস করলো,
– ওই তিনটে লোক কারা ছিলো? আপনি ওদের সাথে ঝগড়া করছিলেন। একজনের কলারও চেপে ধরেছেন, ওরা কারা ছিলো?
বুকটা ধড়ফড়-ধড়ফড় করছে। মাহতিম কোনো কথাই বলছে না। বেচইন মেহনূর এবার কাট-কাট ভঙ্গিতে সংযত সুরে বললো,
– আপনি আমার কাছে কোনো কথাই লুকান না আনসারী সাহেব। আজ যদি কথাটা গোপন করেন, তাহলে আপনার ওয়াদাটা ঠিকই ভেঙ্গে যাবে।
চট করে দুই চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। জোরে এক নিশ্বাস নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। অদ্ভুত কঠোরতায়, ভিন্ন শঠতায়, আলাদা গাম্ভীর্য স্বরে বলে উঠলো সে,
– তোমাকে বিয়ে করাই হয়তো আমার জীবনের মস্ত বড় ভুল! নয়তো এই মাহতিমকে পাওয়াটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশা:প!

মুখের উপর কেউ যেনো ঠাস করে চড় মারলো। কথার আঘাতটা মূহুর্তের ভেতর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পরলো। অকল্পনীয় চিন্তায় স্থির হলো মেহনূর। মুখে কোনো শব্দ নেই, তার শ্রীযুক্ত নমন চোখদুটো বরফের মতো জমে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় সাদা পাণ্ঞ্জাবীর মানুষটাকে শীতল চোখে দেখছে। বিষণ্ণ মুখ, চিন্তিত চাহনি, চোয়ালজোড়া থরথর করে কাঁপছে, এমন দৃশ্যপট মেহনূরের মধ্যে ঝড় তুলে দিয়েছে। একটু আগের বিষাক্ত কথাটা রি-রি করে কানে বাজছে, রক্তের দামাল স্রোতে ভেতরটা যেনো লন্ডভন্ড অবস্থা! মাথা নিচু করে দীর্ঘক্ষণ চুপ থাকার পর মৌনতা ভাঙ্গলো মেহনূর, পাষাণের মতো ব্যক্তির দিকে একপা এগিয়ে এলো। গরমের উৎকট যন্ত্রণায় সাদা পাণ্ঞ্জাবীর পিঠটা ভিজে দেহের খাপে-খাপে সিঁটিয়ে আছে, ঘাড়ের উপর বিন্দু-বিন্দু ঘাম কণাও দৃশ্যমান। ছাঁটা চুলগুলো ক’দিনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে ঝলমল করে উঠেছে, সেই চুলগুলো এখন ঘামে ভিজে জবজবে অবস্থা। চুলের ভেতর আঙ্গুল চালিয়ে ভেজা গোড়াটা স্পর্শ করলো মেহনূর। বুকের ভেতর নিম্নচাপের ঝড়টা ঢিপঢিপ করে টের পাচ্ছে ও। হঠাৎ নতমুখটা অবসাদ দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তুললো, মেহনূরের শান্ত চোখের ভেতর ম্লান দৃষ্টি মিলিয়ে চুপ করে রইলো। মেহনূর এসময় ভণিতা করলো না, কপালের সামনে বেপরোয়া চুলগুলো আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে পিছনে ঠেলে দিলো। শান্ত অবস্থা ছিঁড়ে নমনশীল কন্ঠে বললো,

– আপনার তো অনেক ক্ষমতা। আমার মতো ভুলকে শুধু-শুধু জিইয়ে রাখবেন কেন? একেবারে মাটি শুদ্ধো উপড়ে ফেলুন। গ্রামের জঙ্গলি আগাছা কেটে ফেলাই ভালো।
থমথমে দৃষ্টিটা চট করে তীক্ষ্ম হলো। চেহারায় গম্ভীর ছাপ ফেলে শক্ত গলায় বললো,
– তোমাকে ওই ক্ষমতা দেখাতে চাই না। সহ্য করতে পারবে না।
ঠোঁট শক্ত করলো মেহনূর। ও যে খুবই দূর্বল, মাহতিম সেটা কৌশলের সাথে বুঝিয়ে দিলো। এমন বাঁকা কথার খোঁচাটা সহ্য করলো সে। মনে-মনে নিজেকে বললো, মাথাটা ঠান্ডা রাখতে হবে, মুখে-মুখে তর্ক করা যাবে না, পরিস্থিতি বেসামাল হলে বিশ্রী অবস্থা হতে পারে। লম্বা-লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ভেতরের ক্রুদ্ধ আগুনটাকে নিভিয়ে ফেললো মেহনূর, জিভের উপর ঠোঁট বুলিয়ে যথাসম্ভব বিনীতা হয়ে বললো,

– যদি সহ্য করতে না পারি, তাহলে এতো আদর দিয়ে যত্ন করছেন কেন? আপনার সবকিছু আমার সাথে কেন জড়িয়ে দিলেন?
মাহতিম দ্বিধাগ্রস্ত মুখটা অন্যদিকে ঘুরালো। অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে! নিজেকেই অশ্রাব্য-অকথ্য ভাষায় অপদস্থ করছে। দাঁত শক্ত করে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম, ভেতরের দপদপানি অবস্থাটা কন্ট্রোল করতেই মেহনূর ফের বলে উঠলো,
– আপনি যদি তাড়িয়েও দেন, তাও আমি এখান থেকে একচুল নড়বো না। তার চেয়ে ভালো, আপনি আমাকে মে:রে ফেলুন, আমার লা:শটাকে গুম করে দিন।

বজ্রাহতের মতো চমকে উঠলো মাহতিম। শিরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোতটা যেনো কোষাগারে গিয়ে পৌঁছলো। অবচেতন মনটা ইতিমধ্যে দুঃসহ কল্পনাটা করে ফেলেছে। কি ভয়াবহ সেই চিন্তা! কি জঘন্য, কি নিকৃষ্ট ধরনের! ঠাস করে চড় লাগানোর জন্য হাত উঠালো মাহতিম, প্রচণ্ড রাগটা শরীরময় ছড়িয়ে গেলেও চূড়ান্ত মূহুর্তে হাত থামিয়ে ফেললো! মেহনূরের মুখটার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো। নিচের ঠোঁট কামড়ালো মেহনূর, অশান্ত মাহতিমের দিকে ভারি নিশ্বাস ছেড়ে তার কোলে এসে বসলো। দু’হাতে মাহতিমের মুখটা ধরে এক ঝটকায় নিজের মুখের কাছে আনলো। দু’হাতের তালুর নিচে শেভড্ গালদুটো গরম হয়ে আছে, ভ্রুঁর নিচে সুদৃঢ় চোখদুটো তপ্ত ক্ষোভে অটল। রাগের কারনে ঠোঁটদুটোর উপর দাঁতের দংশন চলেছে, যার সুবাদে ঠোঁটদুটো এখন টকটকে লাল। যদি সুছাঁদের ঠোঁটদুটোয় স্পর্শ মিলিয়ে দেয়, তাহলে রাগটুকু কি নিভিয়ে দেওয়া যাবে? এই মানুষটা কি একটু আগের বিষদিগ্ধ কথাগুলো তুলে নেবে? ঠোঁটের উপর থেকে চোখ সরিয়ে সুগভীর চোখদুটোয় দৃষ্টি বসালো মেহনূর। মাহতিমের ডান গালটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,

– ঠান্ডা হয়ে যান। আমি শুধু যন্ত্রণা বুঝানোর জন্য ওই কথাটা বলেছি। কিচ্ছু হয়নি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকুন। বলুন কি নিয়ে ভয় পাচ্ছেন? আপনি অস্বীকার করবেন না। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আপনি ওই লোকগুলোর কথা শুনে টেনশনে আছেন। বলুন, চুপ করে থাকবেন না, আমাকে বলুন।
ডান গাল থেকে হাত নামিয়ে আঁচল টানলো মেহনূর। আঁচলের শেষ অংশ টেনে মাহতিমের ঘামার্ক্ত গলাটা মুছে দিলো। কপালের ডানদিকে কানের কাছটায় চুয়ে-চুয়ে ঘাম ঝরছিলো, সেই ঘামটুকু আঁচলে মুছে দিতেই হঠাৎ জীর্ণ গলায় বললো মাহতিম,

– ভয়টা তোমাকে নিয়ে পাচ্ছি।
কথা থেমে গেলো মাহতিমের। ওর ঘামে ভেজা চুলগুলোয় আঙ্গুল রাখলো মেহনূর। অসম্পূর্ণ উত্তর শুনে মাহতিমের দিকে একপলক তাকালো, পরক্ষণে চোখ সরিয়ে এমনভাবে চুল ঝাড়তে লাগলো, যেনো বাকি কথার মর্মও সে শুনেছে। অনেকটা দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে হাস্যমুখে বললো,
– আমার চারদিকে যেই অদৃশ্য বেড়িবাঁধ গেড়ে আছে, ওটাতো আনসারী সাহেবের অনুমতি ছাড়া খোলে না। উনার বিশেষ অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকলে কি জঘন্য আপ্যয়ন করেন, সেটার নমুনা আমি তরুণ ভাইয়ার কাহিনি থেকে বহু আগেই বুঝেছি।

গম্ভীরভাবে তাকিয়ে থাকা মাহতিম আচমকা হেসে ফেললো। তরুণকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে-পিটিয়ে কিভাবে শায়েস্তা করেছিলো, সেটা এমন মূহুর্তে মনে পড়ায় সত্যিই হাসি পাচ্ছে। মাহতিমের মুখে হাসির ছোঁয়া দেখে স্বস্তি পেলো মেহনূর, হলদে আলোয় উজ্জ্বল মুখটা দেখতেই হঠাৎ বাতি নিভে গেলো। পুরো পরিবেশটা একমূহুর্ত্তের ভেতর অন্ধকারে ডুব দিলো। চর্তুদিকে মূর্ছার মতো অন্ধকার দেখে বিচলিত হলো মেহনূর, ডানে-বামে তাকিয়ে কিছুটা অস্থির হলে ব্যাপারটা বুঝলো মাহতিম। মেহনূরের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– লোডশেডিং।

উত্তরে মাহতিমের দিকে তাকালো মেহনূর। মুখটা এখন দেখা যাচ্ছে না। একজোড়া চোখ যে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পেরেছে ও। ঝুপ করে অন্ধকার নামা পরিবেশটা চারধারে রহস্য করে দিয়েছে। বাড়ির বাইরে খোলা লনে অদ্ভুত এক নির্জনতা। দখিনের মন-মাতানো বাতাস যেনো সবটুকু গ্লানি টেনে নিচ্ছে, ভ্যাপসা গরমের তপ্তশ্বাসটা একটু যেনো কমলো। মাহতিমের কোল থেকে উঠতে নিলো মেহনূর, চট করে বাঁ-কাধে টান লাগতেই পিছু তাকালো ও। সাদা আঁচলটা কয়েক পাক পেঁচিয়ে ধরেছে মাহতিম। অন্ধকারে থেমে-থেমে দু’দফা তুড়ি বাজালো। ‘ আমার কাছে এসে চুপচাপ বসো ‘ কথাটার ইঙ্গিত দিলো সে। মেহনূর বাঁ-কাধে হাত রেখে আঁচলের পিনটা সামাল দিলো। চুপচাপ আগের মতো মাহতিমের কোলে এসে বসলো।

মেহনূর টের পেলো, তার আঁচলটা ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, খুবই সন্তর্পণে নিরবে-নিভৃতে কোমরের দুপাশে হাত রাখছে। একটু-একটু সংকুচিত হচ্ছে মেহনূর। আজও সেই স্পর্শের কাছে ছোট্ট মনটা রাঙা হয়ে যায়, তার মুখখানাটা প্রথমদিনের মতো লজ্জার ভূষণে ঢাকা পরে। মাহতিমের আদর-স্পর্শ-সুখদ মায়ায় সম্মোহিত হয়। গভীর রাতে যখন সহসা তন্দ্রা ভাঙ্গে, তখন ওই মানুষটার বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে। একজোড়া সুঠাম হাতে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে, যেনো বুকের মধ্যে মুক্তো লুকিয়ে রেখেছে, তাকে দেখতে দেওয়া পুরোপুরি নিষেধ। পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে মেহনূর, অনেক সময় ধরে ঘুমন্ত মুখটা নিরীক্ষণ করে। কখনো-কখনো মুচকি হাসিতে মাহতিমের চুলে হাত বুলায়, কখনো-কখনো গালে টুপ করে চুমু খায়। এই টুকরো-টুকরো মূহুর্তগুলো জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করছে। যখন মাহতিম চলে যায়, তখন অদ্ভুত ঝিম ধরানো রাতগুলোয় স্মৃতিগুলো স্মরণ করে মেহনূর। একেকটা মূহুর্ত নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই কখনো হাসে, কখনো আরো বেশি উদাসীনতা ভর করে। নিরবতা চিঁড়ে হালকা গলায় বললো মাহতিম,

– আমার ভাইটাকে মনে পরছে মেহনূর। কতদিন ওকে দেখি না। আমার চোখের সামনে বড় হলো, ওকে আমি বড় করলাম, অথচ আমারই চোখের সামনে চলে গেলো। কোন্ পাপের যে প্রায়শ্চিত্ত করলাম, নিজেই জানি না। ওর কথা মনে হলেই ভেতরটা ছিঁড়ে যায়। এতো কাছে ছিলো, তবুও কি ভাগ্য আমার, ওইটুকু কাছ থেকেও বাঁচাতে পারলাম না। আমার বাবা, আমার ভাই চলে গেলো, সেই যন্ত্রণা এখনো ধুকে-ধুকে সহ্য করছি। তোমার কিছু হলে আমি ম:রেই যাবো মেহনূর।
সাথে-সাথে মুখে ‘ স ‘ জাতীয় শব্দ করলো মেহনূর,
– সসস, এভাবে বলবেন না। নিয়তিচালিত ব্যাপারে কারোর হাত নেই। আপনি যে বুকে কষ্ট পুষে, মুখে হাসি রেখে চলছেন, সেটা কাছ থেকে না দেখলে কেউ বুঝবে না। আমার কিচ্ছু হবে না, ভরসা রাখুন। আমি জানি, আপনি কিছুই হতে দিবেন না।
হাস্য কন্ঠে বললো মাহতিম,

– এতো বিশ্বাস?
মৃদ্যু হাসলো মেহনূর। কোমর জড়ানো হাতদুটোর উপর নিজের হাতদুটো রাখলো, স্বগোতক্তির মতো বলে উঠলো,
– যতক্ষণ এই হাতদুটোর আশ্রয় আছে, ততক্ষণ কোনো ভয় নেই। সেদিন একা-একাই যে ব্যক্তি তিনটা গাড়ি সটকে দিয়েছে, আপনি তাঁর যোগ্যতার কি জানেন?

যোগ্যতার বিচার শুধাতে গিয়ে ঢোক গিললো মেহনূর। বেশ ফটফট করতে গিয়ে ভুলভাল কথা বলে ফেলেছে। কার সাথে বাচালের মতো আচরণ করছে, সেটা মিনিট খানেকের জন্য ভুলে গেছিলো। কোমর থেকে নিজের হাতদুটো উঠালো মেহনূর, ভয়ে-ভয়ে সামনের দিকে তাকাতেই হঠাৎ আলো জ্বলে উঠলো। আবারও ল্যাম্পপোস্টের চিলতে আলোয় উজ্জ্বল মুখটা দেখতে পেলে অপরাধী চোখে তাকালো। কখন যে কোমর থেকে একটা হাত ঘাড়ে এসে পৌঁছলো, টের পায়নি মেহনূর। ঘাড়টায় মৃদ্যু চাপ খেয়ে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হলে মুখ নিচু করলো মাহতিম। মাথাটা বাঁদিকে কিন্ঞ্চি কাত করে গালে অনুরাগের ছোঁয়াটা চেপে দিলো। চোখদুটো নিমিষের ভেতর বন্ধ করলো মেহনূর, ভেজা পান্ঞ্জাবীর পিঠে হাতদুটো রেখে দিলো। থেমে-থেমে গলার কাছটায়, কাধের উঁচু হাড়টায় আদরটুকু ছুঁয়ে দিলো মাহতিম। আবারও দেহে শীতল উচ্ছাস লাগিয়ে দখিনা হাওয়া এলো। দূরের আকাশে মিটিমিটি তারার দিকে মুচকি হাসলো মেহনূর। মনে-মনে সাধুবাদ জানাতেই পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললো।
– উনাকে পাওয়া যদি আমার অভিশাপ হয়, আমি বারবার অভিশপ্ত হতে প্রস্তুত।

আনসারী নিবাসটা ঘুমে কাবু। প্রতিটি ঘরের লাইট নিভে আছে। সবাই আমেজের ক্লান্তি শেষে গভীর নিদ্রায় ডুবেছে। আশেপাশে কোনো সাড় নেই, সব যেনো নিঃসাড়-নির্জীব হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটাটা টিক-টিক করে সেকেন্ডের হিসাবে ঘুরছে। রাত গভীর, সময় এখন তিনটা বেজে ত্রিশ। রাস্তার কুকুরগুলো দূর থেকে ঘেউ-ঘেউ করছে, আর্ত স্বরে ডাকছে দু-একটা কুকুর। গাছের ডালপালা নাড়ার আওয়াজ হয়, যেনো ডালে বসে কোনো অশরীরী জিনিস ওৎ পেতে আছে। মাটির গুল্ম পোকাগুলো তাক লাগিয়ে চেঁচাচ্ছে। গায়ে ‘ adidas ‘ ব্রান্ডের কালো টিশার্ট এবং সাদা ট্রাউজার পরে বেরিয়েছে। বাঁহাতে মোবাইল নিয়ে বিশেষ কলের জন্য অপেক্ষা করছে।

মোবাইলের স্ক্রিনটা আছাড় মারার জন্য কোণাকুণি ভাবে ফেটেছে, আপাতত ফোনটা কোনোরকমে জোড়াতাপ্পি দিয়ে কলের অপেক্ষায় সময় গুণছে। মুখ ঘুরিয়ে সোজা দোতলায় তাকালো। দৃঢ়তাপূর্ণ চোখদুটো ক্ষণিকের জন্য সতর্ক হলো। দোতলার বদ্ধ জানালায় সন্দেহজনক কিছু আছে কিনা, স্র বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু না, সন্দেহজনক কিছু নেই। সব নরমাল আছে, সব একদম ঠিকঠাক। কিছুক্ষণের ভেতর মোবাইলটার ডিসপ্লে জ্বলে উঠলো, স্ক্রিনের উপর স্পষ্ট অক্ষরে ‘ Incoming call ‘ লেখাটা পরে ফেললো। রিসিভে সোয়াইপ করে কলটা কানে রাখলো, ওপাশ থেকে আসল কন্ঠটা পাওয়ার জন্য চুপ রইলো সে। বাড়তি সতর্কতার জন্য নিজ থেকে কথা টানলো না। হঠাৎ ওপাশ থেকে শক্ত গলায় বললো,

– আমি কি মাহতিম আনসারীর সাথে কথা বলছি?
কন্ঠটা চিনতে পেরে ধীরস্থির ভাবে উত্তর দিলো মাহতিম,
– জ্বী,
চোখটা আবার ঘুরালো মাহতিম। দোতলার সেই বদ্ধ জানালার দিকে একপলক তাকালো। মেহনূর তাহলে টের পায়নি। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটি বুঝদার ব্যক্তির মতো বললো,
– আপনার মতো পাওয়ারফুল পার্সন আমার হেল্প চাইছে, ম্যাটারটা ধরতে পারছি না আনসারী সাহেব।
দোতলা থেকে চোখ নামালো মাহতিম। উত্তর দিতে গিয়ে বাঁকা হাসলো, কন্ঠে সৌজন্যতা রেখে বললো,
– প্রত্যেকটা পাওয়ারফুল পার্সনের উইক পয়েন্ট থাকে, এটা জানেন তো? যখন শকুনের চোখ ওই উইক পয়েন্টে পরে, তখন কোনো পাওয়ারই কাজে লাগে না। আমার সিচুয়েশনটা কোন স্টেজে আছে, আশাকরি ইন্ট্রোডাকশান-নোট ছাড়াই বুঝেছেন।
ওপাশ থেকে স্বল্প হাসির শব্দ এলো। সম্মতি জানিয়ে বললো,

– আপনি এখন ডেসপ্যারেট সিচুয়েশনে আছেন। এমন দিনগুলো আমিও পাস্টে কাটিয়ে এসেছি। বাট আপনি যেটার হেল্প চাচ্ছেন, সেটা কোয়াইট ইম্পসিব্যাল। বলতে গেলে, আপনি ডেন্ঞ্জারাস ঝামেলায় পরেছেন। আমি এটার জন্যই আমার ওয়াইফকে পাবলিক্যালি ফেস করাতাম না। ইভেন, এখনো কিছু-কিছু জায়গায় রেসট্রিকশান রেখেছি।
মাথাটা কাজ করছেনা মাহতিমের। হুট করে চুপ হয়ে গেলে ওপাশের মানুষটা এবার স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৬২+৬৩

– কাম ডাউন আনসারী সাহেব। আপনার ওয়াইফ যদি বুদ্ধিমতি হয়, উনি আপনার অবস্থা অবশ্যই বুঝতে পারবেন। তাছাড়া প্রবলেমটা যেহেতু একসেস লেভেলে চলে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে গোড়া থেকে ছিঁড়ে ফেলুন। আপনি তো এসবে যথেষ্ট এক্সপার্ট।
স্মিত হাসিতে মাহতিম হাসলো। ফোনটা বাঁ-কান থেকে ডান কানে পাস করে বললো,
– দ্যান আই হেভ টু কি:ল সাম পিপল্স। এটা ছাড়া অলটারনেটিভ নেই।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৬৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here