মন বাড়িয়ে ছুঁই শেষ পর্ব
ফাবিয়াহ্ মমো
বিয়েবাড়ির চেহারাটা এক লহমায় বিধ্বস্ত হলো! কেউ আন্দাজও করতে পারলো না এই মূহুর্তে কি হচ্ছে! সবার মূখের অবস্থা পাণ্ডুর হয়ে গেছে। চেহারার সবটুকু আনন্দ গ্লানিতে পরিণত হয়েছে। কেউ স্বাভাবিক হতে পারছে না! মারজা থমকানো দৃষ্টিতে চুপ হয়ে গেছে, মাহমুদার অবস্থা বোবা। সুজলা ভয়কাতুরে দৃষ্টি দিয়ে মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে, মাহতিমের মুখ থেকে সঠিক তথ্য জানার ইচ্ছা পোষণ করছে। মাহতিম কিছু বলছে না। শানাজ ভয়-ভয় চাহনি দিয়ে বারবার ঢোক গিলছে, থুতনিটা থরথরিয়ে কাঁপছে, মাথা কাজ করছে না।
হঠাৎ কাধের উপর স্পর্শ পেলে বামে তাকায় শানাজ। চোখ একবার বন্ধ করে শান্ত থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে মেহনূর। মেহনূরের অভয় চেতনা দেখে চোখ ঝাপসা হয় শানাজের। সাথে-সাথে ঠোঁট কামড়ায় সে। তা দেখে ‘ না ‘ সূচকে মাথা নাড়ায় মেহনূর, ঠোঁট নাড়িয়ে বিনা শব্দে বলে, ‘ ঠান্ডা হও বুবু ‘। শানাজ একটু শক্ত হয়, বড় একটা ঢোক গিলে নিজেকে আঁটকায়। তখনই পরিস্থিত মহলের সামনে নিরবতা ভাঙে মাহতিম। কান থেকে ফোন নামিয়ে একে-একে সবার দিকে তাকায়। কয়েক জোড়া তার দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। উৎসুক চাহনিতে আসল ঘটনা জানার আকাঙ্ক্ষায় আছে। ফোনটা পকেটে রাখতে-রাখতে স্বাভাবিক গলায় বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– মাইনর ইন্ঞ্জুরি। টেনশনের কোনো কারণ নেই। বামহাতের এ্যালবোতে সামান্য ব্যথা পেয়েছে। স্টিচের আশঙ্কা নেই। ওনারা আসছে। আপনারা রেডি থাকুন।
একসঙ্গে সবাই চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো। বুকের উপর থেকে কয়েক টনের পাথর যেনো নেমে গেলো। অনেকক্ষণ পর শান্ত হলো সবাই। একটু আগে সৌভিকের কাকা এক্সিডেন্টের খবর পাঠিয়েছে। সৌভিকের গাড়িটা বায়পাস রোডের কাছে প্রাইভেট কারের সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছে। খবরটা শোনার পর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। তৌফ-সামিক খবর শোনার সাথে-সাথেই সৌভিকের কাছে চলে গেছে।
এখন সৌভিকের কাছ থেকে সবটুকু তথ্য জানার পর শান্ত হয়েছে মাহতিম। বাড়ির সবাইকে তখন যার-যার কাজে ব্যস্ত হতে বললো। শানাজ, মেহনূর, নীতি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সব শুনতে পাচ্ছিলো। বিয়ের ভারী সাজে পরিপূর্ণ শানাজকে নিয়ে রুমে ফিরলো তারা। বিউটিশিয়ান মেয়েরা বাকিদের সাজিয়ে দিচ্ছে তখন। নীতি ও মেহনূর শুধু রেডি হতে বাকি ছিলো। এবার সবকিছু ঠিকঠাক শুনে ননদ-ভাবী রেডি হতে লাগলো। মেহনূর যখন শাড়ি ও ব্লাউজ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলো, তখন পেছন থেকে টিটকারি মারলো নীতি। হাসি দিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– সাবধান ভাবী। আজকে কিন্তু সাবধানে থেকো।তোমাকে এই স্টাইলে দেখলে কিন্তু সর্বনাশ! ভাইয়া ডেফিনেটলি কন্ট্রোল হারাবে।
নীতির কথা শুনে লজ্জায় অবাক হলো মেহনূর। কপট রাগ দেখিয়ে নীতির মাথায় আলতো একটা চাপড় মা:রলো। নীতি মৃদ্যু ব্যথায় ঠোঁট গোল করলে ওয়াশরুমে ঢুকলো মেহনূর। দরজা লাগাতে-লাগাতে মেহনূর বললো,
– খুব পাঁজি হয়েছো। যেমন ভাই, তেমনই বোন। দুটোই এক নাম্বার ফাজিল!
মেহনূর ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিলে হাসতে লাগলো নীতি। কাল হলুদ পর্ব শেষ হওয়ার পর মেহনূরকে ডেকে পাঠিয়েছিলো মাহতিম। মনে-মনে বিষয়টা নিয়ে বড় ভাইকে জ্বালাবে বলে নীতি আর মেহনূরকে বলেনি। নীতি জানতো না, ভাই-ভাবীর মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছে। নীতির মজা করার উছিলায় মাহতিমের ক্ষোভ যেনো একধাপ বেড়েছে। মেহনূরকে ডাকা সত্ত্বেও মেহনূর যখন আসলো না, সেই জিদে খাবারটা পযর্ন্ত ছোঁয়নি। অপেক্ষা করতে-করতে রাত দুটো বাজলো, তিনটা বাজলো, একসময় চারটা পেরিয়ে ফজরের আযান দিলো। তাও মেহনূর আসলো না। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সারারাত অপেক্ষা করেছে মাহতিম।
তবুও একটা সেকেন্ডের জন্য মেহনূর আসলো না। অন্ধকার রুমে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিলো সে। এই বুঝি মেহনূর চুপিচুপি আসছে, গুটি-গুটি পায়ে টুপ করে রুমে ঢুকছে। কিন্তু মেহনূর সত্যিই আসেনি। তার সবটুকু চিন্তাকে জলান্ঞ্জলি দিয়ে মেহনূর তাকে কুৎসিত ভাবে অবজ্ঞা করলো। এই অবজ্ঞা পেয়ে নিরবে চুপ হয় মাহতিম। এই অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ, শক্ত অভিমান, তুমুল জেদ দেখে মুখের কথা হারিয়ে ফেললো। এ কি সেই মেহনূর? যে একটা ডাক শুনলেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে মাহতিমের কাছে ছুটে চলে আসতো! সেই মেহনূর কি তাকে বাজে ভাবে উপেক্ষা করলো? ফজরের আযানটা দেওয়ার পর চোখ বুজলো মাহতিম।
কি এমন দোষ করেছিলো? কেনো ডাকার পরও এলোনা? পাগলের মতো জিপ ছুটিয়ে বেরুলো, গরমে অস্থির হয়ে শাড়ি কিনে আনলো, শেষপর্যন্ত শাড়িটাও গায়ে দিলো না। আর কতো? চোখ খুললো মাহতিম। ডানে মুখ ফিরালো সে, খোলা জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে দিলো। রাতের সবটুকু অন্ধকার শুষে উদীয়মান সূর্যটা পূব আকাশে উঠছে। দারুণ তেজ, প্রখর লালিমা নিয়ে পৃথিবীর বুকে উদয় হচ্ছে। সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা শান্ত মনে ব্যথিত হৃদয়ে চুপচাপ দেখলো মাহতিম। মনের ভেতর থেকে ধরা গলায় সুর এলো, আমি কি তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলাম? আমার সাথে কি করলে মেহনূর? আমাকে একবারও মানুষ মনে হলো না? অপেক্ষার যন্ত্রণা তবুও সহ্য করতাম, তবুও সবকিছু ভুলে যেতাম, কিন্তু এতো অপেক্ষার পরও তুমি এলে না।
বরযাত্রীর আসতে এখনো বিশ মিনিটের মতো লাগবে। এই ফাঁকে মুখে একটা পান পুড়লেন সুজলা। পানটা চিবোতে-চিবোতে মাহমুদার উদ্দেশ্যে বললেন,
– বুঝলি ছোটবউ, ওরা আমাদের সাথে কাজটা ভালো করলো না। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে বল? বসে-বসে সবার কাজ দেখবো, এটা কি হলো?
মাহমুদা ফিচেল হেসে বললো,
– জামাইর কথা অমান্য করার উপায় আছে? জামাইর তো এক কথাই সই। এইযে বুঝালাম, বললাম, বাবা আমার হাতেও কিছু একটা দেও। সবার দেখাদেখি আমিও কিছু করি। কে শোনে কার কথা। পাত্তাই দিলো না। মারজা আপাও আমাদের সাথে দূর্নীতিটা করলো। এখন কাকে ধরে-ধরে বোঝাবো?
কথা শুনে একগাল হাসলেন সুজলা। টকটকে লাল ঠোঁটে বললেন,
– আল্লাহর রহমতে মেয়েগুলা ভালো থাকলেই শান্তি। আমার কিচ্ছু চাই না ছোটবউ। সুরাইয়া, সাবা যতদিন ইচ্ছা আমাদের সাথে থাকুক। আমি ওই দুইটাকে এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাই না। বাড়িটা খালি হয়ে গেলে কিভাবে দিন চলবে? মেহনূরকে বিদায় দেওয়ার পর যেই খারাপ লাগতো, এখন শানাজও ….। ভাবলেই বুকটা ছ্যাৎ করে জ্বলে। মেয়ে বিদায় দেওয়া কতো যে কষ্টের! এটা যদি মানুষকে বুঝাতে পারতাম। আহারে, জীবন। বুকের মানিককে আরেক বাড়িতে তুলে দেওয়া লাগে। পাললাম, বড় করলাম, এখন ওরা আরেক বাড়ির সম্পদ।
চাপা নিশ্বাস ছেড়ে আঁচলে চোখ মুছলেন সুজলা। পাশ থেকে মাহমুদা মাথা নুইয়ে আছে। অশ্রু ভারাক্রান্ত সজল নয়নজোড়া ঢেকে রেখেছে। আজ সন্ধ্যার দিকে বাড়ির আরেক টুকরোকে বিদায় করে দিবেন। বাড়িটা আরো শূন্য হয়ে যাবে। চারবোনের যেই হৈহৈ সমাগম ছিলো, আস্তে-আস্তে অন্যবাড়ির জৌলুস বাড়াবে। কি নিষ্ঠুর নিয়ম!
– আপনেরা দুইজন এহনি কান্দিতাছেন? এই অবস্থা যদি মাইয়াটায় দেখে ওয় টিকতে পারবো?
কথা শুনে দুজনই মুখ তুলে তাকালো। সামনে শেফালি দাঁড়িয়ে আছে। সুজলা চোখ মুছে ফিকে হাসি দিয়ে শেফালির হাত ধরে বসালো। মুখে বললো,
– বসো। আমরা কাঁদছি, তুমি বাদ যাবে কেন? কাঁদলে একসাথেই কাঁদি। মেয়ে তো এখনো বিদায় দেওয়া বাকি।
মূহুর্তের মধ্যে শেফালির হাসিমাখা মুখটা বিষণ্ণ হয়ে গেলো। চোখদুটো ছলছল করে উঠতেই ভেজা গলায় বললো,
– আমি থাকবার পারুম না। আমি আপনেগো মতোন থাকবার পারুম না। আমি কাউরে বিয়া দিতাম না ভাবী। বাড়িডা খালি হই যাবো। আমি ক্যামনে থাকুম? আমার তো পুলাও নাই।
সুজলা ও মাহমুদা একে-অপরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। শেফালির জীবনটা দুঃসহ। স্বামীর ভালোবাসা বলতে কোনোদিনই ওইটুকু সুখ পায়নি। যার হাত ধরে এ বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়েছিলো, লোকটা দিনশেষে এক নম্বরের ফাপড়বাজ। কোথায়-কোথায় আছে, ম:রে গেছে না পচে গেছে, কেউ জানে না। ওই বদমা:শের জন্য এখন দুঃখ করে না শেফালি। ওই লোক কোনোদিন শান্তি দেয়নি। আজ শেফালি নিঃস্ব। নিজের কৃতকর্মের জন্য প্রায়ই বিলাপের শোকে কাঁদে। শেফালির তো কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই, আত্মীয় বলতে তেমন কেউই নেই। যার হাতে মানুষ হয়েছিলো, ওই খালাও ছিলো বা:টপার।
ধুকে-ধুকে জীবনের এটুকু পর্যায়ে এসে একদম নেতিয়ে গেছে সে। একমাত্র ছেলেটার জন্য গালমন্দ শুনেও কতকিছু করলো, বিদেশের মাটিতে পাঠালো, নিজের সব সম্বল বেচে দিলো, আজ সেই ছেলেরও খোঁজ নেই। নিজ থেকেই মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। মূর্খ মায়ের সাথে কিসের যোগাযোগ? গ্রামের গেঁয়োভূতের সাথে কথা বলার ইচ্ছা নেই। ফটর-ফটর ইংলিশ বলা ছেলেটা এখন বাংলা বলতে বিব্রত হয়। শেফালি জানে, তার জীবনের সমস্ত কৃতকর্মের ফল পাই-পাই করে পাচ্ছে। স্বামীর সুখ ও ছেলের ভালোবাসা থেকে আজ কঠিনভাবে বন্ঞ্চিত। এ কি তার প্রাপ্য না? অন্যকে জ্বালিয়ে-মা:রিয়ে যে হক আদায় করতো, সেই হক আজ তাকেই পুড়িয়ে মা:রছে, এ কি বিচার না? সুরাইয়া-সুজলা-মাহমুদা ছাড়া তার এখন আপন বলতে আজ কেউ নেই। শেফালি সেটা কড়ায়-গণ্ডায় ভালোভাবেই বুঝে গেছে। যা আপন, যত আপন, এখন শুধু তারাই। শুধু তাদের ঘিরে, তাদের নিয়ে।
খয়েরী রঙটা ঐশ্বর্যের মতো ফুটে আছে। যেনো ঝলমলে আলোর মাঝে মনোরম কোনো অপ্সরী। শাড়িটা চমৎকার ভাবে পরেছে মেহনূর, আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ রকম সেজেছে। চোখের কোলদুটো গাঢ় কাজলের ছোঁয়ায় রহস্যময়ী লাগছে। নরম ঠোঁটদুটোর উপর খয়েরী রঙের ছোঁয়া। হালকা বুরুজের স্পর্শে গালদুটো অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে। মাথার মধ্যভাগে সিঁথি তুলে চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে। দুপাশ থেকে কিছু চুল পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে মাথার পেছনে আঁটকে দিয়েছে। অসংখ্য বড়-বড় লাল গোলাপ দিয়ে মাথার পেছনটা সারিবদ্ধ ভাবে এঁটে দিয়েছে। কানে ঝুলছে খয়েরী রঙের দুল। কাঁচ-কাটা রেশমি চুড়িতে দুহাত পরিপূর্ণ। মেহনূরের সাজ-রূপ-লাবণ্য দেখে বিমোহিত হয়ে গেছে নীতি। চোখে আশ্চর্যজনক চাহনি রেখে তাকিয়ে আছে। নিজের সোনালি লেহেঙ্গাটা দুহাতে ধরে মেহনূরের সামনে আসলো সে। মেহনূরকে আপাদমস্তক দেখতে-দেখতে মুগ্ধ গলায় বললো,
– তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো, তোমাকে সবচাইতে সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবী। আমি নিজে মেয়ে হয়েও তোমার উপর ইম্প্রেসড্। তুমি বেয়ার ফেসে যতটা সুন্দরী, তোমাকে মেক-ওভারের পর আরো মারাত্মক লাগছে। একটা কথাও মিথ্যে বলছি না।
লজ্জায় চোখ নামালো মেহনূর। তাকে আসলেই সুন্দর লাগছে? একবার কি মাহতিমের কাছে যাবে? বুবুর যেদিন আংটি বদল হলো, সেদিন রাতে অন্ধকার মূহুর্তে মাহতিম গলায় চুমু খেয়েছিলো। মাদক কন্ঠে অদ্ভুত নেশার মতো বলেছিলো, ‘ তোমাকে রাণীনগরের রাণী লাগছে। তোমার পাশে আমাকে মানাচ্ছে না। নিজেকে ক্ষুদ্র প্রজার মতো লাগছে। এই সামান্য প্রজা তোমাকে চুমু খাচ্ছে। ইশ! এটাতো ঠিক হলো না। ‘ হঠাৎ চিন্তার দুনিয়া থেকে বাস্তবে ফিরলো মেহনূর। নীতি তার ডানহাত ধরে ‘ ভাবী, ভাবী ‘ বলে ডাকছে। সংবিৎ ফিরে পেতেই একটু অপ্রস্তুত হলো মেহনূর। পরক্ষণে শান্ত গলায় বললো,
– ঠিক আছি, ঠিক আছি। আমি হাতের কাজটা শেষ করে এখুনি নিচে আসছি। ঠিক আছে?
নীতি হাসি দিয়ে বললো,
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আসো।
নীতি রুম থেকে চলে যেতেই মেহনূর রুম থেকে বেরুলো। বুকভর্তি নিশ্বাস নিয়ে ডানে-বামে তাকালো। নীতি বা ফারিন কেউ নেই। বুকে সাহস জুগিয়ে পায়ে-পায়ে সাদা দরজার কাছে আসলো। দরজাটা আজ বন্ধ। নব্ মোচড় দিতে গিয়ে আচমকা থামলো মেহনূর। কানে জোরে-জোরে সেই কথাগুলো বেজে উঠলো, ‘ কোথাও গুরুত্বপূর্ণ কথা চললে সবসময় নক করে ঢুকতে হয়। কথাটা মাথায় রাখবে, দ্বিতীয় বার রিপিট করবো না ‘। নব্ থেকে হাত সরালো। নিজের রুম হওয়া সত্ত্বেও আজ বাইরের মানুষের মতো দরজায় নক করলো। টুকটুক শব্দ করার পর যখন ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না, তখন নব্ মোচড়ে দরজা খুললো মেহনূর। ভেতরে দৃষ্টি ফেলে দেখলো, রুম খালি। মাহতিম নেই।
তিন কবুলে আবদ্ধ হয়ে বিদায় হলো শানাজ। সবটুকু স্মৃতি মায়ের কাছে, পরিবারের কাছে, নিজের ছোট্ট গ্রামের কাছে ফেলে গেলো। চিরদিনের জন্য অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিলো সে। বুক উজাড় করা অশ্রু নিয়ে নতুন সংসারের দিকে ভিড়লো। শাফায়াত ইসলাম সৌভিকের হাত ধরে নতুন জীবনের দিকে পাড়ি দিলো। পুরোনো জীবনকে ফেলে নতুনত্বকে হাত বাড়িয়ে ছুঁলো। বিদায়ের পর অতিথির গমগমে ভাবটা কেটে যেতে লাগলো, একপর্যায়ে বাড়ির মানুষ ছাড়া আর কেউ অবশিষ্ট রইলো না। শানাজের বিদায়ের পর সাবার মনটা নুয়ে গেছে। এবার গ্রামে ফিরলে আর শানাজ পাশে থাকবে না। দু’বোন একসাথে কলেজে যাবে না।
সাবার কাঁদো-কাঁদো চেহারা দেখে সুরাইয়াও মুখ ভার করে আছে। বিদায়ের সময় সব বোনেরা হাউমাউ করে কেঁদেছে। একসাথে বড় হলো, সবকিছুই একসাথে করলো, কিন্তু বড় হবার সাথে-সাথে সব বন্ধন কেটে গেলো। শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যেতে মন চায়। যেই স্মৃতিতে শুধু অবুঝপনার দিন ছিলো, আনন্দদায়ক মূহুর্ত ছিলো। এরকম বিচ্ছেদের অধ্যায় ছিলো না। গুমোটপূর্ণ পরিবেশটা অনুকূল করার জন্য সিয়াম একটু আয়োজন করলো। বাড়ির লন সাইডে কাঠ-লাকড়ি এনে আগুনের ব্যবস্থা করে ফেললো। সবুজ-সবুজ ঘাসের উপর মাদুর পেড়ে সবাইকে উপস্থিত করলো। ঘোষণা দিলো, আজ রাতটা একটু আড্ডায় কাটুক।
সব মন খারাপের কারণগুলো ভষ্ম হোক। এমন চমৎকার সিদ্ধান্ত শুনে সবাই আগুনের চারপাশে গোল করে বসলো। সাবিরের পাশে প্রীতি, প্রীতির পাশে সাবা, সাবার পাশে ফারিন, ফারিনের পাশে সুরাইয়া, সুরাইয়ার পাশে তৌফ, তৌফের পর সামিক, সামিকের পাশে সিয়াম। সিয়াম যেয়ে মাহতিমকে খুঁজে না পেয়ে মেহনূরকে ধরে-বেঁধে বসিয়েছে। নীতির প্রচন্ড মাইগ্রেনের সমস্যা হচ্ছে বলে আসতে পারেনি। ঔষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। এদিকে আলোচনার প্রথম বার্তাটা আজ সামিক শুরু করলো,
– আজকে জোৎস্না রাত দেখছো সবাই? কি বিউটিফুল লাগছে! আচ্ছা, একটু মিউজিক হলে কেমন হয়? আমি বাজাই?
সামিকের কথায় মেয়েরা কেউ সাড়া দিলো না। তাদের গম্ভীর ভাব দেখে তৌফ ফট করে বললো,
– একেকটার চেহারা দেখলে মনটা চায় ঝাড়ু আইনা পিটাই! ওই তোদের কি হইছে রে? ওইদিকে সৌভিক হালায় তো বউ পাইয়া ফূর্তি করতেছে। তোরা ক্যান কচুর মতো থপথপ করতাছোস?
তৌফের অবস্থা দেখে ফারিন চোখ গরম করলো। তীব্র রাগে খেঁকিয়ে উঠলো,
– তোমার মুখে কি লাগাম লাগাতে পারো না? এখানে যে ভাবী বসে আছে, সেটা কি চিল্লিয়ে বোঝাতে হবে?
ব্যাপারটা খেয়াল করতেই জিহবায় কামড় দিলো তৌফ। ডান কানটা ধরে আফসোসের সুরে বললো,
– তওবা, তওবা। এহেহেহে, ছিঃ, আমি খেয়াল করিনাই। ভাবী কিছু মনে করছেন নাকি?
মেহনূর অন্যমনষ্ক হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। তৌফ ওকে কি বলছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মেহনূরকে খামোশ দেখে তৌফ সিয়ামের দিকে তাকালো। ইশারা করলো,
– কি হইছে?
ইশারার উত্তরটা সিয়াম ঠোঁট উল্টে বুঝালো,
– জানি না মামা।
এবার সিয়াম ও তৌফ দুজনই বাকিদের দিকে তাকালো। এখন মেহনূর বাদে সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করছে। নীতি মাথা নাড়িয়ে বুঝালো, সে কিছু জানে না। সাবা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বললো, সেও কিছু জানে না। একে-একে সবার উত্তর যখন একই হয়ে দাঁড়ালো, তখন তৌফ কন্ঠ নামিয়ে ভদ্রভাবে ডাকলো,
– ভাবী? ভাবী শুনেন, ভাবী?
কিন্ঞ্চিৎ কেঁপে উঠে তৌফের দিকে তাকালো মেহনূর। দেখতে পেলো সবার দৃষ্টি এখন তার দিকে। মেহনূর বিব্রত হয়ে কোনোমতে হাসি দিয়ে বললো,
– জ্বী ভাইয়া,
তৌফ গলা ভিজিয়ে বললো,
– মাহতিম আপনারে কিছু বলছে?
এক মিনিটের মতো নিরব রইলো মেহনূর। কি উত্তর দিবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় পরলে শেষে আমতা-আমতা করে বললো,
– নাতো, কিছু বলেননি। কিছু কি বলার ছিলো?
তৌফ বহুদিনের কথাটা আজ সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
– মাইন্ড না করলে একটা কথা বলবো। এই প্রশ্নটা অনেকদিন থেকেই মাথায় ঘুরঘুর করতাছিলো, বাট আমি আপনারে জিজ্ঞাসা করিনাই। বিয়ের সময় মাহতিমের প্রোফেশনটা আমরা সিক্রেট রাখছিলাম। বলতে পারেন, আমরা আপনারে ইচ্ছা করে জানাই নাই। আপনি কি এই ম্যাটার নিয়া মাহতিমের উপর ফ্যাড-আপ?
কথাটা পুরোপুরি বুঝলো না মেহনূর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বলে দিলো,
– আপনার কথাটা বুঝলাম না তৌফ ভাইয়া। যদি বুঝিয়ে বলতেন..
গলা খাঁকাড়ি দিলো তৌফ। যতটুকু নম্র হওয়া যায়, ততটুকু নম্রভাবে বললো,
– দেখেন ভাবী, কথাটা আপনারে ছোট করে বলতাছি না। কিন্তু কথাটার হেতু একটু বুঝিয়েন। হাজবেন্ড নিয়ে প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনে আলাদা-আলাদা চিন্তা থাকে। সবাই চায় তার পার্টনার একটু মন মতো হোক। এখন কথা হলো গিয়ে, মাহতিমের ব্যাপারটা আপনি অন্যভাবে নিতাছেন। যেটা আপনাদের সম্পর্কে ফাটল আনতাছে। আপনি রাগ করিয়েন না। কথাগুলো সবার সামনে বলতাছি কারণ, এখানে সব আমরা-আমরাই আছি। যদি কোনো প্রবলেম হয়, আমরা সল্যুশন দিতে পারবো।
তৌফের কথা শেষ হতেই ফারিন বলে উঠলো,
– প্লিজ ভাবী, তোমার সমস্যাটা আমাদের বলো। আমরাতো বাইরের লোক না। তুমি আমাদের সবাইকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো, আমরা কখনো কথা পাচার করবো না। ভাইয়াকে অনেক জিজ্ঞেস করেছি, অনেক বলেছি কেনো সে তোমাকে ইগনোর করে। ভাইয়া বলেনি। প্লিজ তুমি বলো, চুপ করে থাকলে সবকিছু নষ্ট হয় ভাবী। সামান্য এ্যাপ্রোচের জন্য বিরাট ক্ল্যাশ হয়ে যায়।
ফারিনকে থামিয়ে পাশ থেকে সুরাইয়া কথা টেনে বললো,
– তুই একটা মূর্খের মতো কাজ করছিস। আজীবন তো হাবলা-ক্যাবলার মতো থাকলি, এখনতো একটু চালাক হ। ছাগলের মতো বুদ্ধি নিয়ে থাকলে চলতে পারবি? ভাইয়ার কার্ডটা যেভাবে ফিরিয়ে দিলি, মন চাইতেছিলো হাত ঘুরিয়ে এক চড় লাগাই।
জনে-জনে সবার কথা শোনার পর চুপ থাকলো মেহনূর। নিজের আসল কথাটা সাজিয়ে-গুছিয়ে স্পষ্ট আকারে বললো,
– রাত তিনটা বাজে। ভয়ে আমি অস্থির। ইদানিং উনাকে কি নিয়ে যেনো খালি টেনশন করতে দেখি। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না। কথা ঘুরান। ওই রাতের বেলা যখন একা-একা উনাকে খুঁজতে বের হলাম, আমার অবস্থা তখন কেমন ছিলো আমিই জানি। ভয় নিয়েই ছাদে গেলাম। উনি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে বলছেন, উনি আমাকে বিয়ে করে বড় ভুল করে ফেলেছেন। আমাকে যদি বিয়ে না করতেন, তাহলে আমি অভিশাপ টুকিয়ে আনতাম না। আমার মন্দ কপালের জন্য মাহদি মারা গেছে। উনি চাইলে শহরের একজন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। করেননি। অনামিকার মতো চরিত্রহীনাও আমার চেয়ে বহুগুণে যোগ্য। আমি তোমাদের মাহতিম ভাইয়ের ঘাড়ে বোঝা হয়ে গেছি। যেই বোঝার জন্য উনি টেনশনে বাঁচেন না। উনাকে আমাদের গ্রামে এনেছেন দেখে মা’কে সম্পূর্ণ দোষী বানিয়ে দিলেন। উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন আমি একটা গাধা! আমি শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজন মিটাতে পারি। আমি যদি সুন্দরী না হতাম, যদি উনাকে বশ না করতাম, তাহলে উনি ভুলেও তাকাতেন না। উনার মতো নেভির স্পেশাল ফোর্সের মানুষ গণ্ডদেশের মেয়েকে বিয়ে করে আফসোস করছেন।
এটুকু বলতেই সুরাইয়ার দিকে তাকালো মেহনূর। সংযত গলায় বলে উঠলো,
– সুরাইয়া বুবু, আমি আসলেই একটা মূর্খ। পড়াশোনাই বা কতদূর করেছি? মানুষ শুনলে হাসতে-হাসতে মরেই যাবে। এখনো মেট্রিক পাশ করিনি, অথচ বড় পদের মানুষকে পটিয়ে একেবারে বিয়ে ফেলেছি।
দীর্ঘদিন পর এক অদেখা সত্যের মুখোমুখি হলো সবাই। লজ্জায়-আক্রোশে-কাঁচুমাচু করে মুখ নামিয়ে ফেললো। মেহনূরের একেকটা কথা, বাক্য, শব্দ সঠিক। কোনো অংশেই অযৌক্তিকতা নেই। মাহতিমকে বিয়ের পর মেহনূর সবকিছু বদলে ফেলেছে। নিজের পড়াশোনাটা নিয়ে ভুলেও মাহতিমের আবদার করেনি। তার বয়স অল্প ছিলো, নানা বিষয় নিয়ে সমস্যায় পড়তো, তখনও মাহতিম পাশে ছিলো না। গ্রাম থেকে শহরে ফেরার পর স্বাভাবিক ছিলো মেহনূর। সে যে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর যুদ্ধ করছিলো, এগুলো কেউ বুঝেনি। একটা ভিন্ন পরিবেশ থেকে আসার পর সহজভাবে নিজেকে জড়ানো যায় না। তবুও নিজেকে গুটিয়ে-মুড়িয়ে-ভাঙচুর করে, যেভাবে সবকিছুর সাথে মানানো যায়, একদম খাপে-খাপ মিলিয়েছে মেহনূর। যেই মোবাইল ফোনের সংস্পর্শে সে ছিলো না, সেই ফোনকে সে টুকে-টুকে আয়ত্ত করেছে। শিখেছে নানা কিছু। মেহনূরের কথা শোনার পর সবাই যেনো মুখ থুবড়ে পরেছে। সেখান থেকে মুখ তুলার ক্ষমতা তাদের নেই। মেহনূর সবাইকে নিরব দেখে নিজেই বলে উঠলো,
– আপনাদের ভাই স্বভাবে-গুণে-কাজে সবকিছুতে পটু। তার মধ্যে কোনো ত্রুটি নেই। আমি এটাও বলবো সে যথেষ্ট অমায়িক। তার বুদ্ধি, কাজ দারুণ চৌকশ। কিন্তু এই বুদ্ধিমান মানুষটা আমার মতো মূর্খকে বিয়ে করে বড্ড পস্তাচ্ছে। সম্ভবত আমাকে নিয়ে তার সাময়িক মোহ ছিলো, সেই মোহ আর নেই। নইলে এমন ধরনের কথা তিনি বলতেন না। আমি কখনোই উনার জন্য পাগল ছিলাম না। আমার দাদা যদি ওইদিনই বিয়েতে অমত করতো, আমি সেটাই মাথা পেতে মেনে নিতাম। আমি আমার দাদাকে আমার অভিভাবকের মতো সম্মান করতাম। আজ সে নেই, তা নিয়েও আমার কষ্ট নেই। আমার দাদা আমাকে কোনোদিন কষ্ট দেননি। বিয়ের পর তোমাদের ভাইকে চিনলাম। উনাকে আমার দাদার চাইতেও বেশি সম্মান করতাম। সম্মানটা আপনা-আপনি উনার প্রতি চলে আসতো। উনি আমাকে অযত্ন করেননি। বটগাছের ছায়ার মতো আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, পরিস্থিতির জন্য আমাকে শক্ত হতে বলেছেন। আমি চেষ্টা করেছি। সেই চেষ্টা এখনো করে যাচ্ছি। আমি থামিনি। কিন্তু উনার কাছ থেকে ওই কথাগুলো ধারালো ছুঁড়ির মতো লেগেছে। বাইরের আঘাতটা সবাই দেখতে পায়, ভেতরের ক্ষতটা কজন বুঝে? আমাকে শান্ত দেখাচ্ছে না? আমি শান্ত নই! সোজা ভাষায় বলে দিলাম, আমি শান্ত নই!
সবাইকে মুখের উপর কথা শুনিয়ে উঠে পরলো মেহনূর। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে সেখান থেকে হনহন করে চলে গেলো। আগুনের পাশ থেকে সবাই ওর যাওয়াটা দেখলো। যেতে-যেতে হাত উঠিয়ে চোখ ডলার দৃশ্যটা সবার নজরেই পরলো। সিঁড়ি পেরিয়ে দরজা ডিঙিয়ে মিলিয়ে গেলো মেহনূর। নিস্তব্ধ পরিবেশের ভেতর হঠাৎ সাবা মুখ খুললো। বহুদিন পুরোনো কথাটা চোখ নিচু করে বলতে থাকলো,
– যাদের হাতে পিস্তুল-বন্দুক থাকে, মেহনূর ওদের ছোট থেকেই দেখতে পারতো না। ও ভাবতো, যারা মানুষ মা:রতে জানে, তাদের ভেতরে মন নেই। ওরা ভালোবাসতে জানে না। ওরা আজীবন পাষাণ থাকে। মানুষের মূল্য দিতে জানে না। হয়তো এই কারণে মাহতিম ভাইয়ার প্রতি প্রথম-প্রথম ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু, এখন যা শুনলাম, তাতে আমার বোনের কোনো দোষ নেই। দোষ তোমাদের ভা…
মুখ ফসকে বেফাঁস কথাটা আঁটকালো সাবা। গরম মূহুর্তে অপ্রীতিকর কথা বলা উচিত না।
দেখতেই-দেখতে পুরো আটচল্লিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। দুই দিন ও দুই রাত শেষে গ্রামের ফেরার উদ্যোগ চললো। সুজলা এবার গ্রামে ফিরবেন, আগামীকাল বিকেল চারটার দিকে রওনা দিবেন। একটু-একটু সব পাট গুছিয়ে নিচ্ছেন তিনি। সাবা ও সুরাইয়াও নিজ-নিজ জিনিসপত্র গোছ-গাছ করে নিচ্ছে। মারজা শত বাধা দিয়ে থাকার জন্য মিনতি করলেন। সুজলা রাজী হলেন না। মারজা অনেক জোরাজুরি করে বললেন,
– আর কটা দিন থেকে যান ভাবী। গ্রামে তো কেউ নেই। একা-একা সময় কাটবে? থাকুন ভাবী। পরে যান।
সুজলা পুরোপুরি নারাজ। নাছোড়বান্দার মতো বললেন,
– আবার আসবো আপা। এবার তো অনেকদিন থেকে গেলাম। বাড়িটার কথা খুব মনে পরছে। এভাবে তো বেশিদিন বাইরে কাটাইনি। গেরস্থবাড়ি ফেলে আসাটা চিন্তার বিষয়। এখানে এসেও রাতভর ওখানকার চিন্তায় থাকতাম। এভাবে থাকা যায় বলুন? এবার যাই। ইনশাআল্লাহ্ আবার আসবো। মেয়ে তো আপনার কাছেই রেখে গেলাম। আবার আসবো আপা।
মারজার কোনো কথাই শেষমেশ টিকলো না। সকালে নাস্তার টেবিলে উপস্থিত হলো সবাই। সবাই যার যার আসন নিয়ে খেতে বসে পরলো। কেবল আসলো না শুধু মাহতিম। মেহনূর বিষয়টা লক্ষ করার পর প্রীতির কাছে আড়ালে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার ভাই কি খেতে আসবেন না? উনার খাবার কি রুমে পাঠিয়ে দেবো?
প্রীতি চটপট গলায় বললো,
– ভাইয়া তো এখনো ঘুম থেকে উঠেনি ভাবী। সেতো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারারাত কম্পিউটারের সামনে বসে-বসে কি যেনো করেছে। রাতে একফোঁটা ঘুমায়নি।
প্রীতির কথায় উদ্বিগ্ন হলো মেহনূর। কথাটা কৌশলের সাথে জিজ্ঞেস করলো,
– সারারাত গেমস্ খেললে ওই কি মানুষ তাড়াতাড়ি উঠবে? ঘুমাক। আমি তাহলে যাচ্ছি না।
পানির গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলো প্রীতি। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বললো,
– উহু, ভাইয়া গেমস্ খেলেনি। নিজের চোখে দেখেছি অফিশিয়াল কিছু নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। আমিতো আড্ডা দিতে গিয়ে ফেরত এসেছি। ভাইয়া তো দুই দিন ধরে ঘুমায় না ভাবী। মাহদির রুমে বসে-বসে পিসি চালায়।
বিগত দুই রাত ধরে মাহতিম রুমে আসে না। বিয়ের রাতে সবাইকে যখন শক্ত কথা বলে এলো, তখন রুমে ফিরেছিলো মেহনূর। রাত তখন দশটা বাজছিলো। খাবার না খেয়ে অপেক্ষা করতে-করতে কখন ঘুমিয়ে পরে টের পায়নি। যখন ঘুম ভাঙে, তখন দেখে মাহতিম রুমে নেই। নিচে গিয়ে জানতে পারে মাহতিম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নোমানকে নিয়ে বাইরে গেছে। নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কখন আসবে বলে যায়নি। প্রীতির সম্পূর্ণ কথা শোনার পর নাস্তার প্লেট সাজালো মেহনূর। যেহেতু এখনো সে ঘুমে আছে, তাই নিজেই এই ফাঁকে প্লেট নিয়ে চলে গেলো। খুব সকালে ঘুম উঠে যায় মাহতিম, আজই প্রথম ব্যতিক্রম দেখলো।
মাহতিম যেনো আগের মাহতিমটার মতো নেই। ভাবলেই বড্ড হাসি পায়। সম্পর্ক বুঝি ধীরে-ধীরে ঠান্ডা হয়ে যায়। আগের মতো সময় থাকে না, না-থাকে মূহুর্ত। মেহনূরের মাঝে-মাঝে মনেহয়, সে বুঝি পুরোনো হয়ে গেছে। দৈনন্দিন জীবনের অভ্যস্ত পোশাকের মতো ময়লা হয়ে শেষ। তার গুরুত্ব এখন কোথাও নেই। ব্যাপারটা এমন, ব্যবহার শেষ, এবার ডাস্টবিনে থাকো। নাস্তার প্লেট নিয়ে দরজার কাছে আসলো। ডানহাতে প্লেট ধরে বাঁহাত দিয়ে নব্ মোচড়ে ঢুকলো। রুমে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে করলো মেহনূর। প্লেট-সহ সামনে তাকাতেই বিছানার দিকে নজর পরলো। লম্বা হয়ে ঘুমিয়ে আছে মাহতিম আনসারী। দেখেই বুঝা যাচ্ছে গণমান্য ব্যক্তিটা গভীর ঘুমে বিভোর। এই ঘুমে আপাতত হুঁশ-জ্ঞান থাকা একদম ভুল চিন্তা।
মেহনূর নাস্তার প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে রুমের জানালার কাছে গেলো। দুহাতে পর্দাটা দুদিকে সরিয়ে দিতেই একফালি সোনালি আলো বিছানার উপর পরলো। সাদা বিছানার উপর আলোর তীর্যক রেখাটা তেরছা হয়ে পরেছে। মেহনূর জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় বসে পরলো। হাতদুটো বুকের উপর আড়াআড়ি ভঙ্গিতে রেখেছে। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গায়ে কোনো শার্ট বা টিশার্ট নেই। পড়নে স্রেফ ব্রাউন ট্রাউজার।উন্মুক্ত বুকটা নিশ্বাসের জন্য ফুলে-ফুলে উঠছে। বুকের খাপে-খাপে ছয়টি ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। যখন ওই বুকটার ভেতর মাথা লুকিয়ে ঘুমাতো, চর্তুদিকে বাউন্ডারি দেয়ালের মতো অদৃশ্য নিরাপত্তা অনুভব হতো।
আজও ইচ্ছে করছে ঘুমন্ত মানুষটার বুকে মাথা রাখতে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে। সকালের মিষ্টি রোদকে সাঙ্গ করে কপালে চুমু এঁকে দিতে। মাহতিমকে দেখতে-দেখতে মুখ নিচু করলো মেহনূর, ডানহাতটা বালিশের উপর ভর ফেলে মাহতিমের দিকে ঝুঁকলো। বাঁহাত এগিয়ে শেভড গালটা স্পর্শ করলো। নরম হাতের নরম চামড়ায় ধারালো শেভের খোঁচা লাগছে। অদ্ভুত ভালোলাগায় শিউরে উঠলো মেহনূর। ঘুমন্তাবস্থার সুযোগ লুফার জন্য মনটা আনচান করছিলো। একটু ছুঁয়ে দিলে কি জেগে যাবে? ঘুম-ঘুম চোখ মেলে আধো-আধো চাহনিতে তাকিয়ে থাকবে? চোখটা বন্ধ করলো মেহনূর। কপালের ঠিক মধ্যখানটা সবটুকু ভর ছেড়ে দিয়ে প্রগাঢ়ভাবে চুমু খেলো। মাহতিম ঘুমের ভেতর নড়েচড়ে চোখ খুলতে চাইলো, কিন্তু ঘুমের চোটে চোখের পাতা টেনেও যেনো খুলতে পারছে না। মেহনূর চোখ বন্ধ করে কপালের মধ্যখানটায় চুমু খেলো। ব্যকুলরূপে পাগলের মতোই হোক, বা উন্মাদের মতো মাহতিমের মুখটা দুহাতে ধরলো। একটা-দুটো অসংখ্য চুমু সারা মুখ জুড়ে খেলো। চোখের পাতায়, নাকের ডগায়, দুটো গাল ভরিয়ে আদর করলো। মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকে ছোট-ছোট চোখে তাকালো, আধো-আধো গলায় ঘুম জড়িয়ে বললো,
– ঘুমাবো..
ছোট্ট শিশুর মতো নাদান লাগলো। যার ঘুমটা ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচুর বিরক্ত হয়ে গেছে সে। ঘুমন্ত মাহতিমের মুখটা যেনো সবটুকু শুদ্ধ জড়িয়ে রেখেছে। মিশ্র অনুভূতির স্বীকার হয়ে মেহনূর হাসি-হাসি চোখে তাকালো। গালদুটো শক্ত করে ধরে ঘাড়টা কিন্ঞ্চিৎ কাত করলো মেহনূর। দুটো সুআকৃতির ঠোঁটদুটোর মাঝে নিজের কোমল ঠোঁটজোড়া গভীর থেকে গভীরতম পর্যায়ে মিলিয়ে দিলো। আধো-আধো ঘুমের ভেতর কিছু আঁকড়ে ধরার মতো অধরদুটো নিজের করে নিলো। নিশ্বাস আঁটকে আসার মতো বুক ফুলালো মাহতিম। নিশ্বাসটা তৎক্ষণাৎ স্বাভাবিক হতেই আস্তে-আস্তে শান্ত হয়ে গেলো। চিকন পিঠের উপর দুহাত রেখে সুকোমল দেহটা বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ সকালের হাওয়া ঢুকছে। মেহনূরের আলগোছে পাকানো খোপা থেকে ছোট-ছোট চুল কানের পাশ বেয়ে মাহতিমের গালে লাগছে। পিঠ থেকে দুহাত সরিয়ে মেহনূরের মুখটা ধরলো মাহতিম। ধরেই আলতো করে ওষ্ঠজোড়া মুক্ত করে দিলো। চোখদুটো খুললো মেহনূর, সরাসরি মাহতিমের দিকে নরম দৃষ্টি পরলো। ঘুম-ঘুম চোখে জড়ানো গলায় বললো মাহতিম,
– আমার উপর রেগে আছো কেন?
মেহনূর ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চুপ করে থাকলো। তা দেখতে পেয়ে বালিশ থেকে মাথা তুললো মাহতিম, সোজা মেহনূরের ডানগালে, বাম গালে পরপর চুমু খেলো। ফের বালিশে মাথা রেখে ভ্রুঁ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– বলো না? রেগে আছো কেন?
মেহনূর স্থিরদৃষ্টিতে শুধু ঢোক গিললো। কোনো জবাবদিহি করলো না। মাহতিমের বাঁ-গালের ক্ষতটা নিবিড়ভাবে দেখতে লাগলো। গালটা চোয়ালটার কাছে অনেকখানি কেটে গিয়েছে। জায়গাটা শুকিয়ে গেলেও এখনো চতুর্দিকের চামড়াটা লাল। মেহনূরের চুপটি দেখে আবার বললো মাহতিম,
– কাল বিকেলেই চলে যাব। সব ছুটি কেটে দিয়েছি। আমার মুখ দেখলে তোমার বিরক্ত লাগে, এবার স্বস্তি দিলাম মেহনূর আফরিন।
এক ধাক্কায় বুক থেকে উঠলো মেহনূর। বিছানার পাশে থাকা গ্লাস ও জগটা দেখে এক আছাড় মারলো! বিকট গর্জনে চুরমার হলো ফ্লোরে! মাহতিম বালিশ থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো, চরম বিরক্ত নিয়ে ভ্রুঁদুটো কুঁচকে ফেললো সে। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দেখলো চূর্ণবিচূর্ণ টুকরো পরে আছে। ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায় মেহনূরের দিকে তাকালো, পাদুটো বিছানা থেকে ফ্লোরে রেখে বললো,
– সমস্যা কি? রুমের জিনিসগুলো বেহুদা কেন ভাঙ্গছো? কিছু বলিনা দেখে খুব উড়ছো, তাই না?বুকে ভয় বলতে ভয় নেই?
মেহনূর গর্জনের সাথে চেঁচাতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করলো। ডানহাতের উলটোপিঠে ঠোঁটজোড়া এমন ভাবে ডলতে লাগলো, যেনো সে অপরাধজনক কিছু করে ফেলেছে। রাগ দেখিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো মেহনূর,
– প্রত্যেকটাবার আমি আপনার কাছে ফিরবো? কেন, আপনি কি আমার কাছে আসতে জানেন না? একবারও আমাকে ডেকেছেন? কাউকে বলে পাঠিয়েছেন, যা মেহনূরকে আসতে বল? বলেছেন এমন? এখন আপনি মধু মিশিয়ে বলছেন, কাল বিকেলেই বিদায় হবেন! কেন, কি বুঝাচ্ছেন আপনি? আমি আপনাকে খুব অমূল্য করেছি? মানে এটা বোঝাতে চাচ্ছেন, আমার জন্য আপনি এ বাড়িতেও শান্তি পাচ্ছেন না? এজন্যই ছুটি বাতিল করে চলে যাচ্ছেন? ঠিক আছে। বেশ। আমি খুশি হলাম। আমি প্রচণ্ড খুশি হয়েছি বিশেষ মাননীয় জনাব মাহতিম আনসারী, আমি আসলেই খুশি হয়েছি। আপনি এবার বিদায় হোন। আপনার এইসব নাটক না আমার সহ্য হচ্ছে না। আসেন, আবার ঢঙ দেখিয়ে চলে যান। আবার তামাশা করে আসেন, আবার কাজের তালবাহানা দেখিয়ে বিদায় হোন। এগুলাই তো চলছে ঠিকনা? চমৎকার নাটকটা এবার শেষ হোক, কি বলেন?
মাহতিম বড্ড উগ্র মেজাজে গম্ভীর হলো। মেহনূরকে ভয়ংকর কিছু বলতে যাবে, তখনই দরজার নব্ মোচড়ানোর শব্দ এলো। দরজাটা খুলে যেতেই সবাই বিষ্ময় নিয়ে রুমে ঢুকলো। মাহতিম কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছিলো না। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে নিজেকে চ্ছিন্ন করে বেরিয়ে গেলো মেহনূর। ছেলের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালেন মারজা। এরপর পিছু-পিছু চলে গেলেন মেহনূরের দিকে। সুজলা মূর্তির মতো অবাক হয়ে আছে। যাদের নিয়ে এতোদিন যাবৎ বুক ফুলিয়ে গর্ব করতো, তাদের একি নমুনা? মারজা পিছু-পিছু গিয়ে ছাদের রুমে উপস্থিত হলে মেহনূর কাঁদতে-কাঁদতে বলে উঠে,
– আমি এ বাড়িতে থাকবো না। এক মূহুর্ত্তের জন্যও থাকবো না। আপনার ছেলেকে নিয়ে পক্ষ গাইতে আসবেন না মা। আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। কিচ্ছু শুনবো না। আমি চলে যাবো। আমি আম্মার সাথে চলে যাবো।
মারজা ছুটে এসে দুহাতে মেহনূরকে ধরে ঠান্ডা হতে বললেন। টেনে এনে বিছানায় বসালেন। মিনিটের ভেতর মাহমুদা এসে হাজির। তিনি এসেই সোজা মেয়ের গালে চড় বসাতে নিচ্ছিলেন, তড়িঘড়ি করে হাত আঁটকায় মারজা। নিষেধের সুরে বলেন,
– আসতাগফিরুল্লাহ্ ভাবী, এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলবেন না। এটা পাপ। ওর কথা শুনুন, মাথা ঠান্ডা করুন। রাগারাগী করলে লাভ নেই ভাবী। বসুন, এদিকে বসুন।
মাহমুদা ভয়ংকর চাহনিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কোনোদিন এই শান্ত-শিষ্ট মেয়ের কাছ থেকে অভদ্র আচরণ দেখবেন, মোটেই আশা করেননি তিনি। দুই গাল লাল করে মারতে মন চাইছে। কতো বড় বেয়াদব! স্বামীর রাগ দেখায়! জিনিস ভাঙচুর করে। মাহমুদা নিজের শান্ত রূপ ছেড়ে জোর গলায় বলেন,
– তুই হলি মেয়ে মানুষ! তোর মেজাজ থাকবে পানির মতো। তুই কোন্ সাহসে জামাইর সাথে অভদ্রতা করবি? তোর এতো বড় সাহস কবে জন্মালো? কার উপর বাড়াবাড়ি দেখাস তুই? তোর শিয়ানীগিরি দেখে থাপ্পরে সোজা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফাজিল! শয়তান! তুই আবার ভাবীর উপর গলাবাজি করছিস! তোকে তো…
তীব্র ক্ষোভে আবার এগুতে নেন মাহমুদা, ওমনেই মারজা জাপটে ধরে দূরে সরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য মাথা ঠান্ডা করতে বলেন। আকস্মিকভাবে এমন ঘটনা দেখে বাকরুদ্ধ সবাই! সবার অবস্থা স্তব্ধ হয়ে গেছে। কেউ কোনো কূলকিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। অন্ধকার হাতড়ে অবলম্বন খোঁজার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট-ছোট ভুল বোঝাবুঝি থেকে আজ বিশাল সমস্যায় পা বাড়িয়েছে। মাহতিম মুখ ধুতে নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে পরলো, জিপ ছুটিয়ে কাউকে না বলে চলে গেলো। সারাদিনের মধ্যে আর ফিরলো না সে। মেহনূর ততক্ষণে শান্ত হলেও জেদের জন্য দাউদাউ করে জ্বলছিলো। দোষ কি মাহতিমের না? প্রথমে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে জোরেসোরে ধাপ্পা মারলো! ভুল বোঝাবুঝি বাড়লো, এরপর সোজাসাপ্টা বুঝিয়ে দিলো ছুটি কেটে দিচ্ছে! কেনো কাটছে? মেহনূরের জন্যই না? মেহনূরই তো অশান্তির গোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার এখান থেকে চলে যাবে। মুখ ফিরিয়ে জীবনেও তাকাবে না।
চোখ মুছে স্লাইডিং ডোরের লক খুলে বাইরে বেরুলো মেহনূর। একদৌঁড়ে ছুটে গিয়ে সুজলার রূমে ঢুকলো। সুজলা ঘুমাননি। হাতে তসবী নিয়ে একমনে জপছিলেন। মেহনূরকে ঢুকতে দেখে তিনি চোখ খুলে তাকালেন। অবাক হয়ে শুধালেন,
– এতো রাতে আসলি? জামাই ফিরেছে?
মেহনূর সেগুলো উপেক্ষা করে নিজের কথা পাড়লো,
– আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন বড়মা। আমি এখান থেকে যেতে চাই। আপনি কি আমার খরচটা বহন করতে পারবেন?
সুজলা বিষ্ময়সূচকে বললেন,
– খরচ মানে? তুই এদিকে থাকবি না? এগুলো বলিস না মেহনূর। তোর মা শুনলে…
মেহনূর বাধা দিয়ে ফেললো,
– আপনি বলুন, আপনি কি আমার আবদার শুনবেন না? আমাকে রেখে যাবেন? আমাকে নিয়ে চলুন বড়মা। আমি থাকবো না।
গোটা রাত পেরিয়ে দিনের আলো ফুটলো। মাহতিম ফিরলো না। বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠলেও নাস্তাটা গলা দিয়ে নামলো না। মেহনূরের সাথে কেউই কথা বলতে পারছেনা, মেহনূর নিজেকে রুমবন্দি করে আলাদা রেখেছে। নীতি সেই রাত থেকে কিছু বলার জন্য হাঁশফাঁশ করছে। সুজলা একটু আগে মাহমুদাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। মেহনূরও তাদের সঙ্গে মহিমপুর গ্রামে যাচ্ছে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে সবকিছু বন্দোবস্ত করতেই আসরের আযান দিলো। সিয়াম মারজার আদেশে মাইক্রো নিয়ে হাজির হয়েছে। লাগেজ সিস্টেমে সব ব্যাগপত্র তুলে দিচ্ছে তৌফ ও সামিক। চোখের সামনে যেনো দুঃস্বপ্নের মূহুর্ত চলছে, এইতো ঘুম ভাঙলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না, এমনটা হলো না। সকাল থেকে পাগলের মতো মাহতিমের খোঁজ করে যাচ্ছে। ওর সঙ্গী নোমানকেও রীতিমতো কল দিয়েছে। নোমানও কিছু জানেনা। তৌফ বিমর্ষ মুখ তুলে বললো,
– কি থেকে কি হইলো দোস্ত? ভাবী যে চইলা যাইতাছে, ওই শা:লা তো এখনো জানে না। ক্যামনে খবরটা পাঠাই? ফোনটাও সাথে না নিয়া রুমে ফালায় গেছে।
সিয়াম শান্ত করে বললো,
– থাম, চেঁচিয়ে লাভ নেই। আজকে যদি ভাবী বিদায় হয়, শুধু বুঝে রাখ, মাহতিম এখনই শেষ। ওর দোষের জন্য ভাবী চেতছে। এমনে-এমনেই একটা মানুষ এতো চেতবো না।
হাতে ছোট্ট একটা সাইড ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসলো মেহনূর। সবার আগে মেহনূর চলে এসেছে। বাকিরা আস্তে-ধীরে নামছে। সিয়াম ডোর টেনে দিতেই মেহনূর চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলো। জানালার ধারের সীটটা দখল করতেই মেইন গেইট দিয়ে শব্দ হলো। সিয়াম আর তৌফ মেইন গেটের দিকে তাকাতেই কালোজীপটার আগমন দেখতে পেলো। মেহনূর তখন কোলের উপর বই খুলে রাখছিলো, যেনো কিছুই শোনেনি এমন একটা ভাব ধরে শান্ত রইলো। জীপটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে মাইক্রোর দিকে বেখেয়ালে তাকালো মাহতিম। মাইক্রোতে কে বসে আছে সেটা ভালোভাবে লক্ষ করেনি। বাড়ির দিকে যেতে নিলে তৌফ চেঁচিয়ে ডাকলো,
– মাহতিম! এ্যাই মাহতিম?
মাহতিম পা থামিয়ে কপালের ঘাম ঝেড়ে বললো,
– বল,
তৌফ সাথে-সাথে উত্তর দিলো,
– ভাবী চলে যাচ্ছে।
ক্লান্ত-নির্ঘুম-অন্যমনষ্ক ছিলো মাহতিম। তাই কথা শুনতে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে ফের যেতে নিলো। বড়-বড় পা ফেলে এগুতে নিলে তাড়াহুড়ো কন্ঠে তৌফ চেঁচিয়ে উঠলো,
– ওই শা:লা! তোর বউ চলে যাচ্ছে!
বজ্রাহতের মতো চোখ বড় করে থামলো। সিঁড়ির ধাপে পা ফেলার জন্য পা উঁচিয়েছিলো, সেটা নামিয়ে পিছু তাকালো মাহতিম। এবার তার তীক্ষ্মদৃষ্টি সরাসরি গাড়ির দিকে। মাহতিম রোবটের মতো প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে তাকিয়ে আছে। কানে কি স্পষ্ট শুনেছে? ‘ বউ চলে যাচ্ছে ‘ ? মাহতিমকে আসতে দেখে সিয়াম ও তৌফ সেখান থেকে কেটে পরলো। মাহতিম ধীরপায়ে এগুতে-এগুতে মাইক্রোর কাছে এসে পৌঁছলো। মাইক্রোর ভেতরে খুব মনোযোগের সহিত ‘ শেষ বিকেলের মেয়ে ‘ পড়ছে। বইটা কোলের উপর নমনীয় ভঙ্গিতে রাখা। মাহতিম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই ছোট্ট গলায় বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
পুরো একপাতা পড়ার পর বইটা বন্ধ করলো মেহনূর। না পড়া পযর্ন্ত ততক্ষণ চুপ ছিলো সে। বইটার ফাঁকে বুকমার্ক ঢুকিয়ে সেটা পাশে রেখে দিলো। জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে বললো,
– আপনার মুখটা একটু ভেতরে আনুন।
রোবটের মতো কমান্ড মেনে মাথাটা নিচু করলো মাহতিম। জানালার কাছে মুখটা আনলে মেহনূর জানালার গা ঘেঁষে বসলো। মাহতিমের মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ম্লান হেসে বললো,
– দোষটা কি আমার ছিলো? কেনো আমাকে বুঝতে পারলেন না আনসারী সাহেব? আপনাকে তো নিজের সবটুকুই দিয়েছিলাম। যে আদর-যত্ন-ভালোবাসা আমাকে শিখিয়েছিলেন, আমিতো সবই আপনার কাছে সপে দিয়েছি। নিজের কাছে কিচ্ছু জমা রাখিনি। তবুও দিনশেষে এই দিন দেখতে হলো? ছেড়ে যাওয়াই যদি কপালে লিখা থাকতো, তাহলে কেনো আপনার সাথে দেখা হলো? আমি কোনোদিন ভাবতেও পারিনি আমার কপাল যে এতো খারাপ! বাবা না থাকলে বুঝি কোনো মেয়ের মূল্য নেই। আপনি ভালো করে জানতেন, আজও আপনার যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনা। সে-ই আপনি আমাকে কাল সকালে যাওয়ার কথা শোনালেন? একসময় দুটো দিন থাকার জন্য প্রচণ্ড আফসোস করতেন, আজ আপনি ছুটি বাতিল করে দিলেন? কার জন্য করলেন? আমার জন্য? আমার জন্য না ছুটি বাড়িয়ে ফেলতেন? কই গেলো ওইদিন? আর কোনোদিন অভিযোগ করবো না। আপনি ডাকলেও ফিরবো না। যেখান থেকে এই নোংরাকে টুকিয়ে এনেছিলেন, আজ সেই নোংরা আসল জায়গায় ফিরে যাচ্ছে। এখানে অনামিকার মতো স্মার্ট মেয়ে আর আনসারীর মতো ব্যস্ত মানুষের বড্ড হাহাকার। নোংরা গেঁয়ো জন্ঞ্জালদের কোনো জায়গা নেই। একদম নেই।
ম্লান হাসিতে অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে আছে মেহনূর। বিষাদের হাসিতে ভেতরের সমস্ত যন্ত্রণা-উৎকন্ঠা শক্তভাবে চেপে রেখেছে। গালের উপর মোটা প্রস্থের অশ্রু পরছে। বাধ ভাঙার মতো চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কোলের উপর টপটপ অশ্রু বর্ষণ হতেই ভাঙচুর গলায় বললো,
– আপনি চাইলে কাগজ পাঠিয়ে দিয়েন। আমি সই…
দাঁত শক্ত করে চোখ কুঁচকালো মেহনূর। বীভৎস শব্দগুলো ঠোঁট বেরিয়ে আসছে না। কেউ গলাটা যেনো চেপে ধরেছে। ঢোক গিলেও শুষ্ক গলাটা ভিজছে না, কন্ঠনালী রুক্ষ হয়ে গেছে। মাথা নিচু করে নাক টানলো মেহনূর, দুচোখের উপর তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল চেপে অশ্রু নিংড়ে ফেললো। কয়েক মিনিট পর নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা তুললো। জানালার কাছে মাহতিমের মুখটা এখনো শান্ত-স্বাভাবিক। পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশূন্য, নির্বিকার। মেহনূর হালকা একটা ঢোক গিলে মাহতিমের মুখটা আদর করে ধরলো, মুখটা দুহাতে টেনে আর্দ্র চোখে বললো,
– এই শেষবার হ্যাঁ? আর আপনাকে চুমু খাব না।
শেষ বাক্যটা বলতে গিয়ে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মেহনূর। মুখ এগিয়ে ঘনিষ্ঠ হতেই মাহতিম চোখ বন্ধ করলো। উষ্ণ জোড়ায় তীব্র আকুলের ছোঁয়া পেতেই সবটুকু আদর মিলিয়ে দিলো মেহনূর। উন্মত্তের মতো ওষ্ঠযুগলের উপর অধিকার ফলালো সে। শেষবারের মতো মাহতিমের মায়াটুকু কাঙ্গালের মতো টেনে নিলো। শুষ্ক খরার মাঠ যখন অশ্রান্ত বারিধারায় সতেজ হয়ে উঠে, মাটি তখন বৃষ্টির পানি শুষে-শুষে সরস নবীনে পৌঁছায়। তেমনি ব্যকুল আকাঙ্ক্ষায় মাহতিমের অতলস্পর্শী ছোঁয়ায় অধীর হলো মেহনূর। ওষ্ঠজোড়া মুক্ত করে মাহতিমের দিকে চোখ খুলে তাকালো। লাল হওয়া টকটকে ঠোঁটদুটোর দিকে একঝলক তাকালো মেহনূর। মাহতিম চোখ খুলে বোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর আবার একটুখানি হেসে দিলো।
হাসতেই দু’চোখের কোণা থেকে টপ করে অশ্রু পরলো। মাহতিমের কাটা গালটার দিকে দৃষ্টি রাখলো সে। নরম চোখে তাকিয়ে থাকতেই বৃদ্ধাঙ্গুলে ক্ষতটা আলতো ছুঁয়ে দিলো। মাঝের দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে শেভহীন গালটায় নিজের গাল রাখলো মেহনূর। ধারালো বাঁ-গালটায় নিজের গাল মিলিয়ে চোখ বন্ধ করলো। পারফিউমের ঘ্রাণটা নিশ্বাসের তালে-তালে পাচ্ছে। পরিচিত ঘ্রাণ, গায়ের মিঠে সুভাসটা মেহনূর শেষবারের মতো অনুভব করছে। ঠোঁট এগিয়ে গালটায় চুমু খেলো মেহনূর। খোঁচা-খোঁচা ধারযুক্ত দাড়িগুলো সূচের মতো মেহনূরের ঠোঁটে ঢুকে গেলো। ঠোঁট নামিয়ে সেই ক্ষতটার কাছে মুখ আনলো মেহনূর। কাঁটা জায়গাটার উপর নিঃসঙ্কোচে ঠোঁট চেপে গাঢ় চুমু খেলো। ক্ষতটায় আকস্মিক ব্যথা লাগতেই মাহতিম চোখ খিঁচুনি দিলো। চোয়াল শক্ত করে ব্যথাটা ভেতরেই চেপে রাখলো। তখনই কানের কানে ফিসফিস সুরে শুনতে পেলো,
– একদিন আপনার জন্য আমার কোমরে ক্ষ’ত হয়েছিলো। আপনি সেই জায়গায় ঠোঁট ছুঁয়ে প্রথম চুমু খেয়েছিলেন। আজ আমার ভুলের জন্য আপনার গালে ক্ষত হলো। আমিও সেই জায়গাটা ছুঁয়ে দিলাম আনসারী সাহেব। আপনার চুমুটা ফিরিয়ে দিলাম। পারলে সবকিছু আপনার কাছে ছুঁড়ে দিয়ে যেতাম। আমি পারলাম না। আপনি ভালো থাকবেন। অনেক বেশি ভালো থাকবেন। আপনাকে আমি শান্তি দিলাম। আজ থেকে শান্তি দিলাম। আপনার যাত্রা শুভ হোক।
গাল ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো মেহনূর। অঝোরে চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পরছে। নিঃশব্দে অন্তঃস্থলের দহন বেড়ে যাচ্ছে। মাহতিম ভালো থাকুক। হাতের তেলোয় চোখ চাপতেই মারজা গলাটা শোনা গেলো। মায়ের কন্ঠ শুনেই বোধহয় মাহতিম জানালা থেকে সরলো। চুপচাপ সবাইকে অগ্রাহ্য করে বাড়িতে ঢুকে গেলো। সুজলা কিছু বলতে যেয়ে মাহতিমের অবস্থা দেখে বললেন না। সুরাইয়া, সুজলা, শেফালি, সাবা, মাহমুদা সবাই মাইক্রোতে বসলো। মেহনূর সবার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য মাথা নুইয়ে রাখলো। সিয়াম স্লাইডিং ডোরটা এক টান দিয়ে বন্ধ করে দিলো। ড্রাইভিং সিটে উঠে মাইক্রো স্টার্ট দিলো সে। মাইক্রোটা যখন মৃদ্যু ঝাঁকুনি খেয়ে চলতে শুরু করলো, তখন দূর থেকে একাকী ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিলো মাহতিম।
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৬৬
মুখটা গম্ভীর আকারে শক্ত হয়ে আছে। গাড়িটা যখন মেইন গেইট পেরিয়ে চলে যাচ্ছিলো, তখন বুকের ভেতর মোচড়ে উঠার মতো অসহ্য ব্যথা লাগলো। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। তার পাপড়ি চুয়ে-চুয়ে দু’চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পরলো। বিকেলের হাওয়াটা সবটুকু নিরবতাকে চ্ছিন্নভিন্ন করে দিলো। মাহতিম ধীরগতিতে মাথা নুইয়ে ফেললো। তীব্র হাহাকারের সাথে ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় হলো তার। ডান পকেট থেকে সাদা কাগজের খামটা কাঁপা-কাঁপা হাতে বের করলো, দূর্বল হাতে সাদা খামটা রেলিংয়ের উপর রাখলো। খামটার দিকে একপলক তাকাতেই ভেতরটা যেনো দুমড়ে-মুচড়ে নিংড়ে এলো তার। আর পারলো না মাহতিম, তৎক্ষণাৎ চোখদুটো কুঁচকে ফেললো। দুচোখ থেকে অবাধ্য অশ্রু টপটপ করে সাদা খামটার উপর পরছিলো। খামের উপর নীল রঙের লেখাটা নোনাজলের জন্য নষ্ট হয়ে গেলো। মাহতিম চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের মতো বিধ্বস্ত হয়ে থেমে-থেমে বলতে লাগলো,
– যতটা যত্ন দিয়ে তাকে ভালোবাসলাম…। ততটা অযত্ন করে আমাকে ফেলে গেলো।
