The Silent Manor part 31
Dayna Imrose lucky
জেবুন্নেছা ঠোঁটের ফাঁকে নিঃশব্দে বিস্ময় প্রকাশ করল। থতমত খেয়ে বলল “তোমাকে এসব কে বলল?আর এগুলো মোটেই সত্য নয়।সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মা’রা গেছে।”
সুফিয়ান বলল “মিথ্যা বলে লাভ নেই।আমি সত্যটা আগেই জানতে পেরেছি।এখন বলুন আপনি কি সংবাদ দিতে এসেছেন?
জেবুন্নেছা ঘেমে গেল।শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলল।অথচ এখন তীব্র শীত।সে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। সুফিয়ান জেবুন্নেছার দিকে ঝুঁকে বলল “কি হল,চুপ কেন?
“আমি আসছি।কাজ আছে।”
“সংবাদটা তো দিয়ে যান।”
“তুমি ছেলে ভীষণ চালাক।”
“একটু চালাক না হলে দুনিয়াতে টিকে থাকা বড় মুশকিল।”
“তোমার সাথে কথা বলাই আমার ভুল হয়েছে।”
“আমারও সেটাই মনে হচ্ছে।” সুফিয়ান আড়ালে হাসল।রাঙা তির্যক আওয়াজে হ্রেষাধ্বনি তুলল।ও যেন বলছে হ্যাঁ বন্ধু তোঁর ওনার সাথে কথা বলাই ভুল হয়েছে।”সুফিয়ান রাঙার কাছে এগিয়ে বলল “তুই ঠিকই বলেছিস,নারী মানুষ মানেই যন্ত্রণা।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জেবুন্নেছা কাঁধ উঁচু করে শরীর টানটান করে চলে যায়। সুফিয়ান পেছন থেকে বলল “ঐ বুড়ি সংবাদ টা দিয়ে যান।” জেবুন্নেছা থ’হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন ঘুরল। লম্বা সুরে ছুঁড়ে দিল একটি বাক্য “তোমার তেজ আমি শিগগিরই শেষ করব।” এরপর চলে যায় জেবুন্নেছা। সুফিয়ান রাঙার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল “এমন কেউ নেই যে আমার ক্ষতি করবে। সে-ই সাহস আমি কাউকে দেইনি।বুঝলি” রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলল।যেন ও বুঝেছে।
রাতটা আপছা অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে।সুফিয়ান সিগার টানছে বারান্দায় বসে।আজ ফারদিনা দেখা করতে আসেনি। বিষয়টি তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে।ফারদিনার কিছু হয়েছে? তাঁর ভাইয়েরা কিছু জানতে পেরেছে? তাঁরা কিছু জানতে পারলে অবশ্যই ফারদিনা গোপনে কোনভাবে সংবাদ পাঠাত। সুফিয়ান আবার ভাবছে,হয়ত কিছু জেনেছে, সে চিন্তা করবে বলে ফারদিনা জানায়নি। সুফিয়ান আর ভাবতে পারছে না। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাঁর।
সোলেমান,বদরু, হাবলু লাল মিয়া একসাথে সুফিয়ান এর বাড়িতে রাতের আঁধারে উপস্থিত হয়। সুফিয়ান ওদের দেখে বলল “তোরা এই সময়ে এখানে?
সোলেমান একবার লাল মিয়ার দিকে দেখল। এরপর জবাব দিল “বাজারে গেছিলাম। আপনার বাড়ির সামনে থেকেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম দেখা করে যাই।” সোলেমান বলে ঢোক গিলল। অকারণে ঘেমে যাচ্ছে।চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে গেছে। সুফিয়ান সিগার টানা রেখে বলল “তোদের হাবভাব আজকাল ডা’কাত ডাকা’তই লাগছে। আবার এসব শুরু করেছিস নাকি?”
“না..না।যে কাজ একবার ছেড়ে দিয়েছি,সে কাজ আর দ্বিতীয় বার করব কি, পাপের কাজ। পাপের কাজে শান্তি নাই।” বলল লাল মিয়া।বদরু সুফিয়ান এর সিগার এর দিকে চেয়ে বলল “আপনি সিগার টানছেন,সিগার এর তো অনেক মূল্য। আপনি এত টাকা কোথায় পেলেন।..?” হাবলু বদরুর রেশ টেনে বলল “ঠিকই তো,এত টাকা কোথায় পেলেন?
সুফিয়ান শান্ত ভঙ্গিতে দৃঢ় কন্ঠে বলল “আজিবন যে কৃষিকাজ করে টাকা কামিয়েছি,তা দিয়ে এরকম শতশত সিগার ক্রয় করা যায়।সিগার আমি সখের বসে টানছি। কখনো চিন্তিত হলেও সিগার দরকার হয়।এখন বল,তোরা শুধুই কি আমার সাথে দেখা করতে এসেছিস নাকি অন্য কোন কারণ,টাকা পয়সার দরকার হলে বলতে পারিস”
লাল মিয়া নিঃশব্দে জবাব দিল “তুই আর কি টাকা দিবি,চু’রি ডাকা’তি করে যা আয় করতে পারতাম তাঁর চার ভাগের অর্ধেকও দিতে পারবি না। আমাদের ব্যবহার করছিস। বিনিময়ে এখন তোর জানটাই কেড়ে নেব।’ লাল মিয়া শুধু রাগে আক্রোশে ফুঁসছে। সুফিয়ান এর সামনে রাগটা দেখাতে পারল না। ওঁরা চারজন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুফিয়ান ওঁদের নীরবতা দেখে বলল “এভাবে কি দেখছিস, কিছু বলার থাকলে বলে ফেল।” সোলেমান বলল “না। কিছু বলার নাই।আমরা তাহলে আজ আসি।’ পাশ থেকে লাল মিয়া সোলেমান কে খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল “আসি মানে,এটাই সুযোগ ওকে মেরে ফেলার।এখন রাত। আশেপাশে কেউ নাই।চল, কাজটা সেরে ফেলি।”
সোলেমান চোখে অসহায় ভাব এনে লাল মিয়ার দিকে তাকাল।ও রাজি নয়,এমন কাজ করতে।ওর হাত পা কাঁপছে। মানুষ হ’ত্যা করা কখনোই পূণ্যের কাজ নয়।মহা পাপ। সোলেমান জীবনে অনেক পাপ করেছে।অন্যর হক ছিনিয়ে খাওয়া বড় পাপ।তাঁর থেকেও বড় পাপ মানুষ হ’ত্যা করা।
সুফিয়ান বারান্দা থেকে বাইরে এসে ওঁদের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়াল।ওঁদের চার জনের দিকে তাকিয়ে বলল “কি ভাবছিস তোরা? কোথাও কিছু হয়নি তো?”
“না।কি হবে।আমরা আসি।” সোলেমান আমতা আমতা করে বলল।ওর মুখে এক ধরনের ভয়। সুফিয়ান লক্ষ্য করে বলল “কখন থেকেই বলছিস আসি, এরপর নিজেদের মধ্যে কানা ফিস ফিস করছিস!আজ রাতে ডাকা’তি করবি, এমনটি ভাবছিস নয়তো,দ্যাখ,এসব একদম উচিত না। দ্বিতীয়বার যদি কোনদিন শুনি এসব করেছিস,সেদিন আমিই জমিদার এর কাছে তোদের নামে নালিশ করব। এরপর তাঁর ছেলেরা তোদের বাঘের খাবার বানাবে।” লাল মিয়া চোখ আধখোলা করে ক্রোধের আ’গুনে তাকিয়ে রইল সুফিয়ান এর দিকে। ওদের রাগ আরো বেড়ে গেল।ওদের ভয় দেখাচ্ছে। সোলেমান লাল মিয়ার হাত ধরে নিয়ে যায়।যেতে যেতে লাল মিয়া কয়েকবার সুফিয়ান এর দিকে দেখল।
সুফিয়ান ওঁদের নিয়ে কিছু ভাবতে চাইল না।
তাঁর ভাবনার শহরে ইতিমধ্যে ফারদিনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তালুকদার বাড়ির দিকে যাবে বলে মনস্থির করল।বাড়ির ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয়। বাড়ির পুব দিক এবং পেছনের দিক থেকে ফারদিনার ঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। তাঁর সাথে হয়ত কথা হবে না। কিন্তু দূর থেকে তাঁর ছায়াটা অন্তত দেখা যাবে।
সে বেরিয়ে পড়ে তালুকদার বাড়ির পথে।হাতে সিগার নেই।দু হাত পেছনে বাঁধা।হালকা বাতাসে শালটা দুলছে।শো শো শব্দে বাতাস বইছে।বাতাসে ধানের চিরিচিরি শব্দ গুলো যেন দোল খাচ্ছে। সুফিয়ান হাঁটছে ধীর পায়ে।তাঁর মনে কু গাইছে। ক্রমাগত পায়ের শক্তি যেন লোপ পাচ্ছে। তাঁর মা ফারহিনা বেগম বলেছিলেন ‘কোন বিপদ ঘনিয়ে আসার আগে বুকের ভেতর অজানা ব্যথা শুরু হয়।কোন কাজে স্বস্তি পাওয়া যায় না।মনে হয় এই বুঝি সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’এই ধরনের কথাবার্তা,অনূভুতি বেশিরভাগ মহিলাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায়।তাঁরা এসব বিশ্বাস করে। পুরুষেরা খুব কমই করে।করলেও প্রকাশ করে না।আজ সুফিয়ান এর মনে অজানা ব্যথা সাড়া দিচ্ছে।না চাইতেই নানান-ভাবনা মনে আসছে। তাঁর ভাবনার মূল কারণ ফারদিনা।
সুফিয়ান তাঁর বাড়ি থেকে তালুকদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছে।দুই বাড়ির মাঝ বরাবর পথে সে।এমন সময় মনে হল তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে। সুফিয়ান স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ব্যথিত দৃষ্টিতে পেছন ঘুরল।একটা লন্ঠন এর আপছা আলো বট গাছের আড়ালে চলে গেল। চোখের ভুল না, বাস্তব ভাবছে।মানুষ চেতনার পাতায় জড়িয়ে থাকলে তখন ভুলভাল দেখে।সে ভুল দেখছে বলে সামনে হাঁটা শুরু করল।
ঠিক দু মিনিট হাঁটার পর আবারো মনে হল তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে।এবার আর সে দাড়িয়ে পড়ল না।তবে সে দাঁড়াবে। হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে ঘূর্ণনের গতিতে পেছন ঘুরবে।যাতে অনুসরণ করা ব্যক্তিটি তাঁর চোখের আড়ালে যেতে সুযোগ না পায়।
সুফিয়ান তাই করল। হঠাৎ পেছন ঘুরল।সে সফল। অবশেষে অনুসরণ করা ব্যক্তি কে দেখল।তামার লন্ঠন হাতে একচোখা ব্যক্তি চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান তাকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হল।ওনার দিকে এগিয়ে গেল। এখচোখা ব্যক্তি সুফিয়ান কে দেখছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।যেন এর আগে কোনদিন সুফিয়ান এর মত কাউকে দেখেনি।
সুফিয়ান একচোখার সামনে এসে বলল “আপনার সমস্যা কি,কখন থেকে আমাকে অনুসরণ করছেন! কিসের জন্য?
“আমি তোমারে অনুসরণ করছি কই?আমিতো এই পথ দিয়াই যাইতে ছিলাম।”
“মিথ্যা বলছেন,আমি আপনার দিকে তাকানোর পর গাছের আড়ালে চলে গেছেন।কি চাই আপনার?
“তোমারে।” বলে একচোখা হেসে উঠল বিকৃত কন্ঠে। সুফিয়ান কপাল ভাঁজ করে বলল “আমায় পাওয়া এত সহজ না।”
“তোমারে পাইতে হইলে কি খাজনা দিতে হইবো!” বলে আবার হাসলো একচোখা ব্যক্তি। সুফিয়ান বেশ বিরক্ত হল।চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ইচ্ছে করছে লোকটাকে এখানেই পুঁতে ফেলতে।পারছে না।র’ক্তশোষীর খাবারের জন্য গ্রামে গ্রামে নিখুঁত একমাত্র ব্যক্তিদের খুঁজে বেড়ায়।সুফিয়ান জেনে বুঝেই সেদিন নিজেকে একমাত্র সন্তান হিসেবে দাবি করেছে। “আমি দরকারি কাজে যাচ্ছি।পেছন নিবেন না।”
“যাও,মানা করছে কেডা।”
সুফিয়ান বলতে চাইছে, আপনারা গ্রামের নিরীহ মানুষের ওপর অমানবিক অত্যা’চার করেন, ওদের প্রাণ কেড়ে নেন। এগুলো অন্যায়। সুফিয়ান বলছে তবে শব্দ ছাড়া।এখচোখা ব্যক্তির পেছনে ফারদিনার ভাইদের হাত। তাঁদের নির্দেশনায় একচোখা কাজ করছে।আজ তাকে কিছু বললে ফারদিনার ভাইদের সাথে ঝামেলা হবে। দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে।সুফিয়ান এসব চায়না।শুধুমাত্র ফারদিনার জন্য।যাতে তাকে নিজের করে পেতে কোন বাঁধা সৃষ্টি না হয়।
এখচোখা সুফিয়ান কে ভালো ভাবে দেখল। এরপর বলল “আমি যাই,যাও,যাও তোমার কাজে যাও।” একচোখা ব্যক্তিটি লন্ঠন হাতে চলে যায় উত্তর দিকে।
সুফিয়ান হাঁফ ছেড়ে তালুকদার বাড়ির পেছনের দিকে চলে যায়।
রাত বাড়ার সাথে সাথে চাঁদের আলোর দেখা মিলেছে।খোলা ক্ষেতের মাঝে সুফিয়ান দাড়িয়ে আছে। শুকনো ক্ষেত। দীর্ঘদিন এই ক্ষেতে ফসল চাষ করা হয় না। শীতের সময় বলে ক্ষেতের মাঝে দাঁড়ানো যাচ্ছে। বর্ষাকালে জলে ভরপুর থাকে এই ক্ষেত।তখন আর বৃষ্টির জলের মধ্যে ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।সুফিয়ান নিজের কাছে নিজেই প্রতিশ্রুতি দিল ‘বর্ষাকাল আসার আগেই সে ফারদিনাকে নিজের করে নিবে।আজ দূর থেকে ফারদিনার ঘরটা দেখতে পারছে। বর্ষাকালে দেখতে পারবে না।এমন ভাবনাকে কি বলে? অতিরিক্ত ভাবনা। সুফিয়ান আজকাল ফারদিনাকে নিয়ে অতিরিক্ত ভাবছে। মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছুই ভালো নয়। কিন্তু সুফিয়ান খারাপ কিছু দেখছে না।তাঁর ভাবতে ভালো লাগে ফারদিনাকে নিয়ে।
ফারদিনার ঘরে আলো জ্বলছে। সোনালী আলো। অন্যদিন এর তুলনায় আজকের আলো আপছা এবং ধোঁয়াশা।দু তিনটে লন্ঠন জ্বলছে হয়ত।ফারদিনাকে দেখা যাচ্ছে না। সুফিয়ান এর চাপা কষ্ট হচ্ছে।ফারদিনা কোনভাবে সুযোগ করে তাঁর সাথে যদি দেখা করত।চাইছে,খুব করে চাইছে আজ তাঁকে দেখতে। ইচ্ছে করছে এখুনি তালুকদার বাড়ি যেতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই যেন।গেলেই রশীদ তালুকদার জিজ্ঞেস করবে ‘কি জন্য এসেছো?
‘আপনার ছেলের সাথে দেখা করতে।’ ঠাসা মিথ্যা কথা। রশীদ বুঝে যাবে।এক দিনে দুবার কারো সাথে দেখা করার দরকার পড়ে না। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ নেই,যা রশীদ কে দেখাবে বা বলবে। তাঁর অসহায় লাগছে নিজেকে বড্ড।
ক্ষেতের মধ্যে পায়চারি করছে সুফিয়ান। কখনো আকাশের দিকে কখনো মাটির কখনো ঘাড় ঘুরিয়ে ফারদিনার ঘরের দিকে দেখছে।ফারদিনাকে দেখা যায়নি একবারও।
ফারদিনা ঘরে থাকলে তো দেখা যেত।সে ছাদের উপরে। সেখান থেকে দেখছে সুফিয়ান কে। ঘন্টাখানেক হয় ঝিলমিল কে নিয়ে ছাদে এসেছে।আজ সারাদিন ঘর থেকে বের হতে পারেনি।বের হওয়ার জন্য মিথ্যা বলেছিল কিন্তু তাঁর মিথ্যা কাজে আসেনি।বলেছিল আজমাত দু’দিন পর চলে যাবে।সে গ্রামটা শেষ বারের মত ঘুরে ঘুরে দেখতে চাইছে।আমি তাকে শেষ বারের মত ঘুরিয়ে আনি।’ কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে রাজি হল না রশীদ।সে গভীর গলায় পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে ‘বাড়িতে অনেক লোক আছে আজমাত কে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানোর।তোর যেতে হবে না।’ ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। এরপর ফারদিনা রায়ান এর কাছে গিয়েছিল সেও একই কথা বলেছে। এরপর আরিব,সায়েম।বাকি ছিল আদিব।ফারদিনা তখন অনেক আশা নিয়ে আদিব এর কাছে গিয়েছিল। আদিব সিগার টানতে টানতে পায়চারি করছিল।বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে চুপ ছিল। এরপর বলেছিল ‘মেয়েদের এত ঘরের বাইরে বের হতে নেই। অমঙ্গল হয়। অসম্মান হয়। গ্রামের লোকেরা নানান ধরণের মন্তব্য করবে।’ এই প্রথমবার ফারদিনা এরকম কথা শুনেছি।বেশ অবাকও হয়েছিল। ঝিলমিল অনেক চেষ্টা করেছে ফারদিনাকে ঘরের বাইরে বের হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু এই প্রথম ঝিলমিলও ব্যর্থ হয়।
সন্ধ্যা থেকে ফারদিনার মন বেশ উতালা। সুফিয়ান এর সাথে আর দেখা হয়নি। ঝিলমিল চুলের বেনুনি টা নাচাতে নাচাতে ফারদিনার গা ঘেঁষে বলল ‘খোলা মাঠে তোর বাঁশিওয়ালা বইসা আছে।তোর অপেক্ষায়।যা দেখা করে আয়। চাইলে আরো অনেক কিছুই করতে পারোছ।”
“কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছিস!আমি তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ছটফট করছি,আর তুই!পারলে আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ করে দে।”
“আহ মরি যা,আজ সারাদিন কম চেষ্টা করলাম।হইলো না তোর জল্লাদ ভাই গুলার লইগা।তোরে সন্দেহ করতেছে। নজরদারি রাখছে।খাস লোক। কিন্তু কেডায় তা জানি না।জানলে ভালোই হইতো।”
ফারদিনা চাদের আলোয় দূর থেকে সুফিয়ান কে দেখতে দেখতে বলল “ছাদ থেকে লাফ দেব?
ঝিলমিল স্বশব্দে হেসে উঠল।ওর হাসির শব্দ সুফিয়ান এর কানে গেল। সুফিয়ান দৃষ্টি সরিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। অবশেষে ফারদিনাকে দেখছে।
ঝিলমিল হাঁসি থামায়।বলল “দে লাফ, সোজা আসমানে চইলা যাবি।ভালোই হইবো।এরপর তোর পেছনে পেছনে সুফিয়ানও যাইবো।”
“তুই আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতিস। আমার ভেতরে কি চলছে।চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকা অনেক কষ্টের।কোন স্বাধীনতা নাই।”
“এতদিন স্বাধীন ভাবে ঘুরছোছ,অহন না হয় একটু বন্দিই থাক।”
“তারমানে আমি আর কোনদিন সুফিয়ান এর সাথে দেখা করতে পারব না?” ব্যথিত কন্ঠে বলল ফারদিনা। তাঁর চোখে অজস্র জল জমে গেছে ইতিমধ্যে।
“ভাগ্যে থাকলে দেখা হইবো।”
“আমার ভাগ্যে সুফিয়ান আছে তো?” বলে ফারদিনা রেলিঙ এর ঈট ঘেঁষে বসে পড়ে।পা দুটো ভাঁজ করা।
ঝিলমিল ফারদিনার সামনে বসে বলল “কাদিস না।যদি সুফিয়ান তোর ভাগ্যে থাকে তাইলে তারে ঠিকই পাবি।”
ফারদিনা নির্বিকার কন্ঠে বলল “তুই আমাকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার শেষ সুযোগ করে দে।আমি সুফিয়ান কে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।আর কোনদিন ফিরব না। নিকৃষ্ট পরিবারের সাথে আমি আর থাকতে চাই না”
“হঠাৎ কইরা কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। আগে একবার সুফিয়ান এর লগে আলাপ কর। তারপর সিদ্ধান্ত নে।”
“কিন্তু কিভাবে দেখা করব?
“দেখতাছি কি করা যায়।কাদিস না।”
ফারদিনা নিজেকে সামলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সুফিয়ান এর দিকে দেখল। ঝিলমিল পাশ থেকে ফারদিনার দিকে দেখছে।বড্ড মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সুফিয়ান এর দিকে। এতটুকু কান্নায় চোখ দুটো ছলছল করছে।নাকটা লাল হয়ে গেছে।মনে হচ্ছে এখুনি র’ক্ত বেরিয়ে আসবে।
রশীদ বৈঠকখানায় বসে বসে বই পড়ছে। বইয়ের নাম The Pilgrim’s Progress অর্থাৎ তীর্থযাত্রীর অগ্রগতি।লেখক জন বানিয়ান।বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৬৭৮ সালে।এটি এক আধ্যাত্মিক উপন্যাস, যেখানে একজন মানুষ ‘ক্রিস্টিয়ান’মুক্তির পথে কঠিন যাত্রা করত।বইটি ধর্মীয় কিন্তু প্রতীকী “জীবন হলো এক কঠিন যাত্রা, গন্তব্য হলো মুক্তি।”সেই সময়ে বইটি ভদ্রলোক ও ধর্মভীরু পাঠকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল।
বইটি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রশীদ রান্নাঘরের দিকে উঁকি মারছে। কুদ্দুস গুনগুন করতে করতে চা করছে। রশীদ লম্বা সুরে ডাকল। “কালু,তোর চা কতদূর?
কুদ্দুসও একই সুরে জবাব দিল। “চা পথে আসছে। মাঝপথে এসে আটকে গেছে। অপেক্ষা করুন।”
“ভালো কথা শিখেছিস।”
“আপনার থেকেই শিখেছি।”
“জলদি চা নিয়ে আয়।”
কুদ্দুস চা হাতে এগিয়ে আসল। রশীদ কে দিল। রশীদ বইটা পাশে রেখে কুদ্দুস এর দিকে তাকাল।ওর চোখ মুখে হতাশার ছাপ। জিজ্ঞেস করল “তোর কোন কারণে মন খারাপ?
“জ্বী, আমার মনটা বড় কুদাস।”
“কুদাস মানে কি? রশীদ চায়ে চুমুক দিল।
“কুদাস হল উদাস এর বিপরীত শব্দ। শব্দটি আমিই তৈরি করেছি।আজ সত্যিই আমার মনটা কুদাস।”
রশীদ চা মুখে খিলখিল শব্দে হেসে উঠল।
কুদ্দুস বলল “আপনি হাসলেন কেন?
“তোর মনটা আজ কুদাস।আমি এই শব্দ বাপের জন্মেও শুনি নাই।এখন বল তোর মনটা ভালো করার উপায় কি?
কুদ্দুস মেঝেতে বসে বলল “আপনার বয়স বাড়ছে তাই না’
“হুঁ তো?
“আপনার সেবা করার জন্য লোক দরকার কি-না?
“লোক দরকার মানে,তুই আছিস কি করতে”
“আমি আছি, কিন্তু আমি যখন অসুস্থ হব তখন আপনার সেবা কে করবে?
“হতচ্ছাড়া,কথা ঘোরাচ্ছিস কেন? সরাসরি বল,যা বলতে চাইছিস।”
“আমি সরাসরি বিয়ে করতে চাই।”
“তাহলে এই হল তোর উদাস মন কুদাস হওয়ার পেছনের ইতিহাস।”
“জ্বী। আমি বিয়ে করলে আমার বউ আপনার সেবা করতে পারবে।”
“তুই ভুলে যাচ্ছিস, আমার নিজের মেয়ে ব্যতীত অন্য কোন মেয়ের সাথে ঠিক মত কথাই বলি না,আর ওদের থেকে সেবা নেব ভাবছিস?
“আমিও ওটাই বলতে চাইছিলাম।”
“ওটাই মানে?
কুদ্দুস এবার একটু জবাব দিতে সময় নিল। সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল “আপনার মেয়েই যদি আমার বউ হয় তাহলে তাঁর যত্ন নিতে সমস্যা কোথায়?”
রশীদ এবার কটমট চোখে কুদ্দুস এর দিকে তাকাল।এক ভ্র উঁচিয়ে বলল “তাহলে এই ব্যাপার।যা তোর কথা আমি মেনে নিলাম।তুই যদি ওর মন জয় করতে পারিস তবেই আমরা এই বিষয়ে এগোবো।”
কুদ্দুস খুশি মনে উঠে দাঁড়ালো। রশীদ এর পা ধরে সালাম করল।বলল “দোয়া করবেন যাতে আমি আপনার মেয়ের মন জয় করতে পারি।”
রশীদ বলল “এমন দিন চলে আসছে,এখন আমার মেয়ের মন গলানোর দোয়া করতে হবে।”
“দিন কত উন্নত হয়েছে দেখছেন।”
রশীদ এখন কি বলবে বুঝতে পারল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল “ফারদিনা কোথায়?
“ছাদে”
“আমার পু্ত্রেরা?
“ওনাদের খবর কে জানে। সারাদিন ধরে-ফরে খায় লয়।”
“ধরে-ফরে খায় লয় এর মানে কি?
“এটা আমার উক্তি। আপনার ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য।”
রশীদ কিছু বলতে চাইল। কিন্তু তাৎক্ষণিক একজন অনুচারী এসে হাজির হয়। রশীদ এর সামনে এসে মাথা নিচু করে সম্মান জানিয়ে বলল “সরদার একজন ডাকপিয়ন এসেছে। আপনাকে চিঠি দিতে।আমি বলেছিলাম আমার কাছে দিতে।উনি বলতেছে আপনারেই দেব।”
রশীদ বিস্ফারিত চোখে তাকাল।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল “ডাকপিয়ন দিনে চিঠি পৌঁছে দেয়।রাতে দেয়া কবে থেকে শুরু হল!” রশীদ কিছুটা অবাক হয়ে ঘরের বাইরে বের হল।বাড়ির মূল ফটকের সামনে উপস্থিত হয়।খঞ্জর হাতে ক’জন অনুচারী একজনকে ঘেরাও করে রেখেছে।মনে হচ্ছে শ’ত্রু কে অবশেষে ধরতে সক্ষম হয়েছে। রশীদ বলল “কে চিঠি নিয়ে এসেছে?
“সরদার আমি।” ডাকপিয়ন বলল। গ্রামের পরিচিত ডাকপিয়ন। সবাই চিনে তাঁকে।যুবক বয়সী লোকটি। চিঠিটা রশীদ এর দিকে এগিয়ে দিল। রশীদ হাতে নিয়ে বলল “রাতে কে চিঠি পাঠিয়েছে? অদ্ভুত।”
ডাকপিয়ন বলল “যিনি পাঠিয়েছেন তিনিও অদ্ভুত ছিলেন।বুড়ো লোক।কত করে বললাম আগামীকাল পৌঁছে দেব। উনি জোর করে এখুনি পাঠাল।”
The Silent Manor part 30
রশীদ আগ্রহ নিয়ে চিঠিটা খুলল। একজন অনুচারী লন্ঠন এগিয়ে ধরল। লন্ঠন এর আলোয় লেখাগুলো স্পষ্ট দেখা গেল।অক্ষর গুলো এলোমেলো। নিশ্চয়ই কাঁপা হাতের লেখা। চিঠিতে লেখা
‘আপনি যাকে বিশ্বাস করছেন সে-ই আপনাদের ধ্বং’স এর মূল কারণ হবে।’
