কাজলরেখা পর্ব ৩১

কাজলরেখা পর্ব ৩১
তানজিনা ইসলাম

আকিব শিকদার রাতে চাদনীর রুমে থাকলেন। পুরো ফ্ল্যাটে শুধু দু’টো বেডরুম আছে। আকিব শিকদার জানলেন না চাদনী আর আঁধার এতোদিন আলাদা রুমে থেকে এসেছে। এদিক দিয়ে আঁধার বড় বাঁচা বেচেছে। মাত্র কয়েকদিনই তো হলো চাদনী আর ও বাংলাদেশ, ইন্ডিয়ার বর্ডার দিয়ে একরুমে থাকছে। ভাগ্যেস আকিব শিকদার আগে আসেননি। নয়তো ভেবেই নিতো আঁধার চাঁদনী কে মানতে পারেনি। তারপর চাদনী কে গ্রামে নিয়ে চলে যেতো, আর কখনো আসতেও দিতো না।

পরেরদিন সকালে চাদনী আধারের কক্ষের বেলকনিতে বসেছিলো। আকিব শিকদার এখনো ঘুম থেকে উঠেননি। লং জার্নিতে হয়তো বেশিই ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন। ওনি না উঠায় আঁধার আর চাদনীরও ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। আঁধার ঘুম থেকে উঠেই কোথায় যেন বেরিয়েছে। চাদনী অন্যমনষ্ক হয়ে বসেছিলো। একটু পর আঁধার গলা ফেড়ে ডাকতে ডাকতে কক্ষে এলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“চাঁদ, এই চাঁদ!”
চাদনী হকচকিয়ে উঠে দাড়ালো। উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-“কী?”
আধারের হাতে একটা কালো রঙের খাঁচা। ভেতরে দু’টো পাখি ভদ্র হয়ে বসে আছে। একটার রঙ হলুদ, আর একটি অফ হোয়াইট আর ধূসরের মিশেল। আঁধার বেলকনিতে এলো। চাদনী এগিয়ে গেলো ওর দিকে। খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
-“দেখ, তোর জন্য পাখি নিয়ে এসেছি!একদম তোর মতো।
ইট’স ইউর বার্থডে গিফট।সুন্দর না?”
-“খুববব সুন্দর। এগুলো কী পাখি?”
-“ওরা লাভ বার্ড! কাঁপল। বাজরিগার পাখি!”
চাদনী খাঁচায় হাত রাখে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
-“পাখিদের আকাশে উড়তে দেখেই সুন্দর লাগে। খাঁচায় মানায় না। ওঁদের মুক্ত করে দাও।”
আঁধার উদ্বিগ্ন স্বরে বললো

-“তোর পছন্দ হয়নি চাঁদ? কেন উড়িয়ে দেব ওদের?”
-“ওঁদের আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আর তাই ওঁদের বন্দীত্ব আমার ভালো লাগছে না। খাঁচায় ওঁদের কষ্ট হচ্ছে, আমার মতো!”
-“আমি তো তোকে মুক্তি দেবো না চাঁদ। আমার থেকে তোর মুক্তি নেই। ওঁদের উড়িয়ে দিলে তোর মনে হবে, তুইও আমার খাঁচা থেকে উড়ে যেতে পারবি। আমার খাঁচা খুব শক্ত রে চাদনী, সেটার শিকল ভেঙে উড়ে যাওয়ার সাধ্য তোর বা পাখিদের নেই।”

পাখিদের জায়গা হলো বেলকনিতে। চাদনী মুখে বলেছে ঠিকই ওঁদের উড়িয়ে দিতে, অথচ বেলকনিতে রাখার পর চাদনী খুব ব্যস্ত হয়ে পরলো ওঁদের নিয়ে। কী খাওয়াবে, কীভাবে রাখবে ওঁদের, কী করলে ওরা পোষ মানবে সেসব জানার জন্য খুব তোড়জোড় শুরু করলো ও। আঁধার মুখ লটকে দেখলো সবকিছু। এমনিতেই ওর সাথে এক অক্ষর শব্দ নিজ থেকে বলে না চাদনী, এখন তো ওকে আর পাত্তাই দিবে না, টোটালি চোখেই দেখবে না। এভাবে খাল কেটে কেও কুমির আনে। উহু কুমির না, সতিন। আঁধারের তো এখন ওঁদের সতিনই মনে হচ্ছে।

আকিব শিকদার ড্রইংরুমে বসে আছেন।ওনার হাতে কফির মগ। একটু আগেই ব্রেকফাস্ট সেরেছে সবাই। চাদনী ওর কক্ষে বসে ফোন দেখছে। মেয়েটা আল্লাহর দুনিয়ায় এই একটা কাজ ছাড়া আর কিচ্ছু পারে না। আঁধার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ গালে হাত দিয়ে আকিব শিকদারের দিকে তাকিয়ে থাকলো। একটু পর ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো
-“তাহলে তুমি চাঁদ কে নিতে এসেছো!”
-“হুম। অর্পিতা ফিরে এসেছে। শুধু একা আসেনি ওর স্বামী কেও নিয়ে এসেছে। জানো বড় ভাইয়া প্রথমে ওদের থাকায় অসম্মতি জানালেও, পরে মেঝো ভাইয়ার অনুরোধে মেনে নিয়েছে ওঁদের। মেঝো ভাবি কান্নাকাটি করে বাড়ির সবাইকে মানিয়ে নিয়েছেন। অথচ ওই মেয়েটার জন্য আমার মেয়ের জীবনটা উলোটপালোট হয়ে গেলো আঁধার। অর্পিতা ফিরে না এলে তো জানতামই না, বাবা হিসেবে কতটা জঘন্য আমি!অন্যের দোষের শাস্তি নিজের মেয়ের মাথার উপর গছিয়ে দিয়েছি। তুমি বলো আঁধার, অর্পিতা কে বাড়িতে থাকতে দেওয়া চাঁদের উপর অন্যায় না?”
আঁধার মাথা ঝাঁকিয়ে বললো

-“হ্যাঁ, অন্যায়।কিন্তু তুমি এটা আমাকে বললেই পারতে,
আমিই নিয়ে যেতাম। তোমার কষ্ট করে আসার দরকার ছিলো না।”
আকিব শিকদার ভ্রু কুঁচকে বললেন
-“আমি আসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?”
-“নাহ কি সমস্যা হবে!”
-“মনে হচ্ছে খুশি হওনি।”
-“সত্যি বলতে, তুমি যদি পরে আসতে তবে আমি অবশ্যই অনেক বেশি খুশি হতাম। কিন্তু এখন আমার এক্সাম চলছে চাচ্চু। আমি গ্রামে যেতে পারবো না।”

-“তুমি না-হয় পরে এসো আঁধার।এক্সাম শেষ হলে।আমি চাঁদ কে নিয়ে যাই।খুব মনে পরছিলো ওর কথা। জানো তো ওঁকে ছাড়া কোনোদিন থাকিনি। সুযোগই হচ্ছিলো না আসার। এরচেয়ে বড়ো কথা ভয় হচ্ছিলো। কিভাবে ওর সাথে নজর মেলাবো!সবাই তোমার কথা ভাবছে আঁধার। কিন্তু আমার মেয়ের কথা ভাবার জন্য শুধু আমিই আছি!”
আঁধার কী বলবে বুঝতে পারলো না। আকিব শিকদার আবার বললেন

-“তোমরা দু’জনই এখনো ছোট।সংসার করা তো মুখের কথা না। আমার মেয়েটা তো আমাকে ছাড়া একপাও এগোতে পারে না। সেখানে ধরে বেঁধে বিয়ে নামক একটা সম্পর্কে জড়িয়ে দিয়েছি তোমাদেরকে। ভুল করেছি।কতো অপমান করেছো তুমি আমার ছোট মেয়েটাকে। আমি ওঁকে নিয়ে যাবো আঁধার!”
-“শাস্তি দিবা? আমি কী ইচ্ছে করে অপমান করেছি ওঁকে! বাবার উপর খুব রাগ হয়েছিলো।”
-“সে রাগ তো তুমি চাঁদনীর উপর ঝারতে পারো না। ওর তো কোনো দোষ ছিলো না। ও কেন সাফার করবে বলো! তুমি এখনো ওঁকে মেনে নিতে পারোনি আমি জানি!”
আঁধার নিষ্প্রাণ দৃষ্টি তে তাকালো আকিব শিকদারের দিকে।

-“তুমি ওঁকে নিয়ে যেতে পারবে না!”
-“তুমি তো ওঁকে চাও না! পছন্দ না তোমার ওঁকে।”
-“সেটা তো প্রথম দিনই বলেছিলাম। দাম দিয়েছিলে আমার কথার। ঠিকই তো বিয়েতে তিন ভাই মিলে সাক্ষী দিয়েছো। এখন কেন মেয়ের কথা মনে পরছে!”
-“মানুষ মাত্রই ভুল হয় আধার!”
-“এক্সেক্টলি।দ্যাটস দা পয়েন্ট। মানুষই তো ভুল করবে।ভুল না করলে তো আমরা ফেরেশতাই হতাম!তোমরা এই শেষ বয়সে এসে ভুল করতে পারো। আর, বয়সের দোষে
সেইম ভুল আমি করতে পারি না?”

-“শেষ বয়স কী বলছো? মনে প্রাণে আমি এখনো ইয়াং! শুনো এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই। আজ রাতে, দু’জনের জন্য ট্রেনের টিকেট বুক করেছি আমি। চাদনীর খুব শখ ট্রেনে চড়ার। প্রথমবার আমাকে ছেড়ে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলো, ট্রেনে চড়ার অনুভূতি নিতে পারেনি। তাই রিকুয়েষ্ট করেছে আমাকে ট্রেনে করে যাবে।”
-“নো, আমি যেতেপারমিশন দেব না!”
-“আমি ওর বাবা আঁধার। বাবা হয়ে তোমার পারমিশন লাগবে আমার?”

কাজলরেখা পর্ব ৩০

-“লাগবে। ওর যখন বিয়ে হয়ে গেছে তখন আমার অধিকার তোমার চেয়েও বেশি।”
আকিব শিকদার কিছু না বলে উঠে দাড়ালেন। সিড়ি বেয়ে যেতে যেতে বললেন
-“যা ইচ্ছা করো। ওঁকে তো আমি নিয়ে যাবোই।”
-“চাদনী যাবে না, দেখো তুমি!”
-“দেখা যাবে!”

কাজলরেখা পর্ব ৩২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here