নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৩+৪
আহমেদ হৃদ
রুদ্র নিজেকে সামলে নিলো। তার জানতে বড্ড ইচ্ছা করছে কে সেই ছেলেটি? যাকে সরাসরি স্বামী বলে দিলো আরু! আচ্ছা, তারা কি দু’জন দু’জনকে খুব বেশি ভালোবাসে? আরুকে না পেলে মরে-টরে যাবে না তো ছেলেটা? না না! এসব কি ভাবছে রুদ্র। এই পিচ্চি মেয়েটার যে বয়ফ্রেন্ড আছে, এটাই তো রুদ্র বিশ্বাস করতে পারছে না। ডপ মারছে না তো মেয়েটা? মার-তেই পারে! মেয়েটার দ্বারা সব সম্ভব! বুকে দু’হাত গুজে শক্তপোক্ত ভাবে দাড়ালো রুদ্র। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কত দিনের রিলেশন তোমাদের?’
আরু বিরক্ত হলো। মনেমনে বললো, এগুলো জেনে তুই কি করবি ব্যাটা? এসেছিস মেয়ে দেখতে। নিষ্চয়ই এখন আরুকে খারাপ মনে হচ্ছে? যদি হয়ে থাকে তো চলে যা। অন্য কেউ হলে একদন্ড এখানে দাঁড়াতো না। এখনি চলে যেত। তুলকালাম বাঁধাতো! বিয়ে তো ভাঙতোই, সাথে গোটা পাড়ায় মিষ্টি বিলি করে বলতো,’মেয়েটা এক্কেবারে খারাপ! দশ-বারোটা নগর আছে।’ অথচ এই লোক? বয়ফ্রেন্ড কে স্বামী বলার পরেও কোন ছেলে এভাবে রসিয়ে রসিয়ে জিজ্ঞেস করে এসব? যত্তসব! আরু মিথ্যে বললো না। কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো,
‘একমাস।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রুদ্র বিষম খেলো। আকাশ থেকে পড়লো যেন। মুহুর্তেই মুখের গম্ভীর ভাব উধাও হয়ে গেল। মাত্র ত্রিশ দিনের প্রেম! তাতেই হাজবেন্ড বানিয়ে ফেলেছে মেয়েটা? কি ডেঞ্জারাস! হয়তো, ছেলে-মেয়েদের নামও ঠিক করে ফেলেছে? এ-তো পুরাই নিব্বা-নিব্বির প্রেম! তবে, মনে মনে সে খুশি। চান্স আছে এখনো।
আরু বড়োবড়ো চোখে রুদ্রকে দেখছে। কি এতো ভাবছে লোকটা? মাথায় কি প্যাঁচ কষছে আল্লাহ মালুম। দেখে তো মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। আরু ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,’কি হলো?’
‘এ্যাহ্? না আসলে, মাত্র পনেরো দিনের প্রেম! তা-ও কত গভীর! এটাই ভাবছি।’
রুদ্র’র কথাটা মনে ধরলো আরুর। আহা! বাইরের লোকটাও এতটুকু শুনে বললো তার আর আশিকের ‘গভীর প্রেম’। এই এতোক্ষণে ভালো কোন কথা বললো লোকটা। আরুর কন্ঠ গদগদ,
‘হ্যা। এটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনাকে অতো ভাবতে হবে না। আপনি যা করার করুন গিয়ে।’
রুদ্র অবাক হওয়ার ভান ধরে বললো,’কিছু করার কথা আমার?’
আরু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বিরক্ত হয়ে বললো,’কি করার মানে? এখন আপনার উচিত নিচে গিয়ে বলা, এ বিয়ে আপনি করবে না। এটাও বলতে পারেন, মেয়েটা এক্কেবারে খারাপ! দশ-বারোটা প্রেম করে।’
‘সরি টু সে,এসব কিছুই আমি বলছি না মিস অরোনিতা। বরং নিচে যাবো; আর গিয়ে বলবো, মেয়েকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। আর আপনার যে কোন বয়ফ্রেন্ড আছে, এটার’ই বা প্রমাণ কি?’
আরুর মন চাইছে ছাঁদের সবকটা ফুলের টব মাথায় ভাঙতে লোকটার। কি বে`য়াদব ছেলেরে বাবা! নিজেকে সামলালো আরু। বিয়েটা ভাঙতে তেমন কিছুই করতে হবে না। তার বয়ফ্রেন্ড যে আছে, এটা প্রমান করতে পারলেই হবে।
‘কি প্রমাণ লাগবে আপনার?’ আরু বললো।
‘বয়ফ্রেন্ডের পিক দেখান।’
আরুর হাতেই ফোন ছিলো। ফোনটা এক সেকেন্ড হাতছাড়া করছে না আরু। যদি আশিক অনলাইনে আসে? আরু ঝটপট গ্যালারিতে গেলো। একটা ছবি বের করে রুদ্র’র মুখের সামনে ধরলো আরু। রুদ্র দেখে অবাক! পুরাই ফিল্মের হিরোর মতো দেখতে ছেলেটা। লম্বা, স্ট্রেইট করা চুলগুলো মুঠো করে সেইরকম পোজ দিয়ে ছবিটা তুলেছে। রুদ্র প্রথমে অবাক হলেও নিজেকে আবারো সান্তনা দিতে লাগলো। আরু নিশ্চয়ই অন্যকারো ছবি দেখাচ্ছে। এমন সুন্দর ছেলে বাংলাদেশে আদেও আছে? সব ঠিকঠাক করেই মেয়েটা মাঠে নেমেছে হয়তো আরু। আরুর বুদ্ধির তারিফ করলো মনেমনে রুদ্র। এরপর হেঁসে উঠলো।
রুদ্র’র হাসি দেখে জ্বলে উঠলো আরুর শরীর। ঝাঁঝালো গলায় বললো আরু,
‘আজব তো! হাসছেন কেন এভাবে? না হওয়া বউয়ের শোকে পাগল-টাগল হলেন নাকি?’
‘ছেলের নাম্বার দাওতো,কথা বলি।’
আরুর মুখ চুপসে গেলো। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। আশিকের সাথে যতবার কথা হয়েছে, সব অনলাইনেই হয়েছে! তাহলে নাম্বার কই পাবে আরু? আশিকের থেকে চেয়েওছিলো আরু। ছেলেটা মারাত্নক পাজি! দিলোই না। এখন কি হবে ভাবলেই তো আরুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। থমথমে কন্ঠে উত্তর দিলো আরু,’নাম্বার নেই।’
‘তাহলে তো আমি বিয়েটা ভাঙতে পারবো না মিস। আসছি…’
আরু বুকে ছুরির মতো আ*ঘাত করলো কথাটা। রুদ্র অলরেডি হাঁটতে আরম্ভ করেছে। এইবার? কি হবে? আরু শুকনো ডোগ গিললো। শেষ চেষ্টা! চেঁচিয়ে উঠলো,
‘কি করলে বিশ্বাস করবেন তাহলে?’
রুদ্র থামলো। না ঘুরেই জিজ্ঞেস করলো,’দেখা করেছো কখনো?’
‘না।’
রুদ্র আড়ালে হাঁসলো। ঘার ঘুড়িয়ে তাকালো।বললো,’আগে দেখা করাও। তাহলে বিশ্বাস করতে পারি।’
‘কাল তেরো তারিখ না? চলে আসবেন। আশিকের ঠিকানা আমি জানি। নিয়ে যাবো আপনাকে।’
‘কথা বলো কিভাবে তোমরা?’
উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো না আরুর। কিন্তু সে নিরুপায়। ‘ওয়াটস্এ্যাপ আর মেসেঞ্জারে।’
রুদ্র সামনে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ‘পুরাই নিব্বা-নিব্বি।’ বলে নিচে চলে গেলো। ফেলে গেলো আরুর রক্তচক্ষু চাহনি!
রুমে এলোমেলো ভাবে বসে আছে চারজন। রাহিল আরুর বেডে চিৎ হয়ে শুয়ে। আরু পড়ার টেবিলে পানশে মুখ করে বসে। তানিয়া আর সোনিয়া মেঝেতে বসেছে বাবু হয়ে। কারো মুখে রা নেই। সবাই অপেক্ষা করছে, কেউ কিছু বলুক। কথা শুরু হোক। অথচ, কারোই হেলদোল নেই। তানিয়া বরাবরই শান্ত, কম কথা বলে। আজ যেন মাথাটাও তুলছে না। আরু খেয়াল করেছে কয়েকবার তানিয়াকে। আজ একটু বেশিই শান্ত লাগছে না মেয়েটাকে? এই মেয়েটা এতো ভদ্র, শান্ত আর পড়ুয়া দেখেই আরু দিনরাত মায়ের গা/লি খায়। ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল তানিয়া। আরুর মা তো ভেবেই পায় না, এই মেয়ে(তানিয়া) কি দেখে আরুর সাথে বন্ধত্ব করেছে।
কথা শুরু করলো রাহিল। উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
‘তাহলে আমাদের আরুর হিল্লে হয়েই গেলো! এখন শুধু মজা,মজা আর মজা।’
সোনিয়া এটারই অপেক্ষায় ছিলো। সবার আগে কথা তোলার স্পর্ধা সোনিয়ার হয়নি। আরু যেরকম, দেখা যাবে তাদের ঠেলেঠুলে বাড়ি থেকে বের দিলো। এইযে আন্টি বিরিয়ানি রান্না করছে, এগুলো কি মিস করা যাবে? যাবেনা তো! তাই তো কথা বলেনি সোনিয়া। কিন্তু এখন তার দল ভারি। সে-ও রাশভারি গলায় আওড়ালো,
‘যা বলেছিস রাহিল! স্কুল লাইফ থেকে শুনে আসছি আরুর বিয়ের কথা। হচ্ছেই না! অবশেষে সব ঠিকঠাক। একেই বলে ধৈর্যের ফল মিষ্টি।’
‘আর আরুর জামাইটাকেও দেখ। যেমন স্টাইলিশ তেমন টাকাওয়ালা। বিয়ের আগে বেশ বড়সড় ট্রিট নেওয়া যাবে।’
আরু শুধু শুনছে। মূলত সে রাগ দমাবার চেষ্টা করছে। রুদ্র নিচে এসেই পাল্টি খেয়েছে। ব্যাটা খচ্চ`র! বেয়া-দব! অসভ্য! এরকম ছেলে জীবনে দুটো দেখেনি আরু। এক্কেবারে এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করে গেছে ব্যাটা। যদিও বলেছে, দেখা করাতে পারলে সে বিয়ে ভেঙে দেবে। কিন্তু আরু মোটেই তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। ওনারা আজকেই আংটি পড়িয়ে যেত, শুধুমাত্র আহমেদ সাহেব নেই বলেই দেড়ি। আরু তখন থেকে গালি দিচ্ছে লোকটাকে। আরু তো বলেছে নিয়ে যাবে। তিনদিন পর এনগেজমেন্ট! একটিবার না আটকালো না লোকটা। কি মিথ্যুক!
‘দোস্ত, আমি প্রেমে পড়েছি।’
আকস্মিক তানিয়ার মুখে এমন কথা শুনে পিলে চমকে উঠলো সকলের। উৎসুক চোখে তাকালো সবাই। সকলের চোখে প্রশ্ন। সবথেকে অবাক হলো আরু। পড়ার বাইরে এই মেয়ে-ও এতোকিছু বোঝে? তাও নিজে বলছে! আরু জিজ্ঞেস করলো,
‘কার প্রেমে পড়েছিস?’
তানিয়ার মুখ লাল হয়ে উঠলো লজ্জায়। মাথা তখনো নিচু করা তানিয়ার। নতজানু গলায় বললো,
‘তোর দেবরের।’
রাহিল সিনা টানটান করে উঠে বসলো। আরু নির্বাক! সোনিয়া শুকনো ডোগ গিলে জিজ্ঞেস করলো,’কখন? আর কিভাবে?’
তানিয়ার কন্ঠ নিচু,’যখন প্রথম দেখলাম, তখনি ভালো লেগেছে। আর কি গম্ভীর, চুপচাপ! এসেছে অব্ধি একটা কথাও বলেনি। আমি এতেই ফিদা হয়ে গেছি। দেখতেও তো মাশাল্লাহ।’
তানিয়া এটুকু বলেই থেমে গেলো। আরু চেয়ার ছেড়েছে কথার মাঝেই। তানিয়া যে এতো কথা বলেছে এটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এই মেয়ে এতোকিছু বোঝে? আরু জানতো, তানিয়ার কাছে ‘ক্রাশ’ এর মিনিং ‘বিদ্ধস্ত’ পর্যন্তই। কিন্তু..! আরু তানিয়ার সবকথা হজম করলো। এই মেয়েও তলেতলে সব বোঝে। শুধু সবাইকে দেখায় শান্ত, ভদ্র, পড়ুয়া, পরিপাটি সে। তলেতলে করলেই সে মহান, আর আরু দেখিয়ে করলেই খারাপ!
পরেরদিন। আরু আজ ভোর বেলা উঠেছে। সারারাত তো ঘুমোতেই পারেনি আনন্দে। আজ তার একপ্রকার ইদের দিন। ভোরে উঠেই পুরো বাড়ি গুটিগুটি পায়ে চক্কর কে-টেছে কয়েকবার। মহুয়া বেগম রান্নাঘরে তখন। আরু একবার উঁকি দিলো আহমেদ সাহেবের রুমে। তখন পাঁচটা বাজে। ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আহমেদ সাহেব। আরুকে বেরোতে হবে সাতটায়। নাহলে আহমেদ সাহেবের সামনে পড়লে আর যাওয়া হবে না।
আর যাওয়ার প্রস্তুতি তাকে শুরু করে দিতে হবে এখনি। আরু নিজের রুমে চলে গেলো। আজ সে কুর্তি পড়বে। শাড়ি পড়তে ইচ্ছে করছিলো আরুর। আরু আর শাড়ি! তাই শাড়ির চিন্তা ঝেড়ে ফেললো আরু। সাথে লিপস্টিক, কাজল, সানগ্লাস, নেকলেস, সুন্দর একটা কালো টিপ, মেকাপ সব করবে! নিজের সবটা দিয়ে সেজে সামনে গিয়ে দাড়াবে আশিকের। আশিক নিশ্চিত হার্টফেল করবে আজ। ভাবলেই মন নেঁচে নেঁচে উঠছে আরুর। কথামতো সেজে নিলো আরু। ছয়টা চল্লিশে তার সাজগোজ শেষ। কিন্তু আরুর মোটেই এখন ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে কাঁধে তার প্রিয় ব্যাগটা ঝুলিয়ে নিলো। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে মহুয়াকে বললো,
‘আম্মু, আমি আসছি।’
আরু উত্তরের অপেক্ষাও করলো না। বাইরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে রুদ্র।
বাড়ি থেকে বেরোতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আরুর। লোকটা শুধু অসহ্যকর’ই নয়; বরং আনরোমান্টিক ও বটে। একটা মেয়ে তার সাথে কোথাও যাবে, আর সে গাড়ি নিয়ে এসেছে? কাল তো ঠিকিই বাইক নিয়ে এসেছিলো। আরু নিজে ছাঁদ থেকে দেখেছে একটা বাইক। আরু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। লোকটাকে বিয়ে করলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই জীবন শেষ হয়ে যাবে।
আরু রুদ্র’র সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়িতে হেলান দিয়ে তার’ই দিকে তাকিয়ে রুদ্র। রুদ্র’র মোটা মোটা ভ্রুদুটিতে চরম বিরক্তি! কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ। একজন পাগলকেও আরুর থেকে সুন্দর লাগবে। সাজ বিষয়ে এতটুকু জ্ঞান নেই মেয়েটার। শুধু মেকাম করলেই ভালো লাগে? মেয়েদের ন্যাচারালি কত সুন্দর লাগে,তা কি মেয়েরা জানে? জানেনা! আরু’ই তার স্পষ্ট প্রমান।
‘কি দেখছেন এভাবে?’
রুদ্র উত্তর দিলো না। ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। তার অবশ্য একটু রাগও লাগছে। মন খারাপ হলো কি? হলো মনে হয় একটু। কই, তার সাথে দেখা করার সময় তো এমন সাজেনি আরু। আর আজ? বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করার কি সখ! মন চাইছে ঠাটিয়ে একটা চড় বসিয়ে বলতে, ‘এই মেয়ে এই, পরপুরুষের সাথে দেখা করার জন্য এতো সেজেছো কেন হ্যা? খুব সখ অন্যকাউকে দেখানোর তুমি সুন্দরী?’ কিন্তু মুখে রা কাটলো না রুদ্র। হোক না একবার বিয়ে! আরুকে সারাজীবন বুকে আগলে রাখবে। এই সৌন্দর্য শুধুই রুদ্র’র। শুধু এবং শুধু তার!
আরু লোকটাকে খুব খুঁটিয়ে দেখলো কিয়ৎক্ষন। এরপর রুদ্র’র পাশে বসলো। লুকিং গ্লাসটা তার দিকে করে গাঢ় করে লিপস্টিক দিলো আবারো। তারপর সেটি ধীরেসুস্থে ব্যাগে রেখে বললো,’চলুন।’
‘উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে?’
আরু চমকালো। ধীর গতিতে তাকালো রুদ্র’র দিকে। রুদ্র নরম চোখে তাকিয়ে। তার চোখের ভাষা কি আরু বুঝছে না? তার চোখ যে বরংবার বলছে যেওনা প্রিয়, আমার খারাপ লাগছে। কোথাও চিনচিন করছে। আমার হয়ে গেলে সমস্যা কই? একটা অসুন্দর মানুষকে কি ভালোবাসা যায়না?
‘মানে?’ জিজ্ঞেস করলো আরু।
রুদ্র’র ঘোর কাটলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে জবাব দিলো,’জায়গার নাম না বললে তো এটাই হলো।’
‘ওহ্ হ্যা। রাজকন্যা পার্লারের সামনে চলুন। তারপর বামে গিয়ে মোড় নিয়ে সোজা গেলে পড়বে মেইন রোড। ওইখান থেকে সোজা গিয়ে ডানের বা পার্শ ঘেষে যে রোডটা রয়েছে; তার এক্সাক্টলি সামনে নামবো আমরা। কারন হেঁটে যেতে হবে তারপর। আর…’
‘ব্যাস ব্যাস। এতটুকু আগে যাই। গুগল ম্যাপও এমন রাস্তা বলতে পারবে না।’
আরু চুপ করলো। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। গ্লাস নামিয়ে দিলো আরু। সাথেসাথে হু হু করে বাতাস আসতে শুরু করেছে। আরু একপলক রুদ্র’র দিকে তাকিয়ে বাইরে তাকালো। লোকটা চোখে সানগ্লাস পড়ে মনোযোগ সহকারে গাড়ি চালাচ্ছে। আজ একটু চুপচাপ লাগছে না?
‘কি করে তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
এইতো, ব্যাটা ফর্মে ফিরেছে। আরুর মুড বেশ ভালো। তাই মিষ্টি হেঁসে জবাব দিলো আরু,
‘এমনিতে ওনার বাবার অনেক বড়ো ব্যাবসা আছে। কিন্তু নিজে কিছু করতে চায়। এখন তেমন কিছু করেনা।’
‘ওহ্।’ ছোট করে বললো রুদ্র। এখনি ‘উনি উনি’ করছে। যেন বিয়ে হয়ে গেছে। অসহ্যকর!
গাড়ির স্পিড বাড়ছে। সাঁ করে ছুটে চলেছে মেইনরোড ধরে। আরু আর একবার-ও তাকালো না রুদ্র’র দিকে। গাড়ি থামলো ‘ইরহাম এন্টারপ্রাইজ’ এর সামনে।
দু’হাতে দু’টুকরো ইট নিয়ে দাড়িয়ে আছে সোনিয়া। তার লক্ষ্য সামনের গাড়িটায় ইটগুলো ছুঁড়ে মারা। সাথে তানিয়া ভীত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে। সে নিষেধ করলো কয়েকবার। সোনিয়া শুনলো না। কি সাহস! ইচ্ছে করে গাড়িটা তাদের গা ঘেঁষে নিয়েছে। ড্রেনের নোংরা পানিগুলোয় আধভেজা হয়ে দাড়িয়ে দুজন। মেজাজ এমনিতেই আগুন সোনিয়ার। আর তাতে ঘি ঢালবার কাজ হলো এতেই। সোনিয়া সাতপাঁচ ভাবলো না। ছুঁড়ে মারলো ইটটা গাড়িতে। সোনিয়ার তিক্ন নিশানা সোজা গাড়ির গ্লাসে লাগলো। ভেঙে ছিটকে পড়লো কাঁচের কিয়দাংশ টুকরো। গাড়ি থেমে গেলো। সোনিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। সে-ও তো দেখবে; কোন লাটসাহেব গাড়িতে বসে। যে গোটা রাস্তা ছেড়ে তাদের পাশ দিয়ে গেলো! আর এতোটাই অসভ্য যে, একবার থেমে সরিটুকুও বললো না।
গাড়ির পেছন থেকে নামলো অভ্র। হাতের ঘরির দিকে তাকাতেই দেখলো দশটা বেজে গেছে অলরেডি। এরপর দৃষ্টি তুলে কাঁচের দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে এলো অভ্র’র। এমনিতেই তারা লেট! তারউপর উটকো ঝামেলা। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালো একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা মেয়ে দুটোর দিকে। গাড়ি থেকে নামলো রাফি, সিফাত আর শুভ।
দূর থেকে তিনটে ছেলেকে নামতে দেখে গলা শুকিয়ে আসছে সোনিয়ার। আবার হনহনিয়ে এদিকেই আসছে ছেলেগুলো। কি দা’মড়া দা’মড়া ছেলে! এবার কি হবে? পুরো রাস্তা ফাঁকা। যদি তুলে নিয়ে যায় তাদের? সোনিয়া আকস্মিক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো। আরেকহাতের ইটটা তানিয়ার হাতে ধরিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো সোনিয়া। তানিয়া চমকালো, থমকে গেলো। অস্থিরচিত্তে কিছু বলার আগেই কেউ খপ করে ধরে ফেললো তানিয়ার হাত। তানিয়া না দেখেই চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো। অভ্র চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
‘হাউ ডেয়ার ইউ। আপনার সাহস কি করে হলো ইট মারার?’
তানিয়া আরও কুঁচকে গেলো। জড়সড় হয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো। কি হিংস্র গলা! লোমহর্ষক! বক্ষস্থলের ওঠানামার গতি ট্রেনের গতিকে হাড় মানায়।
অভ্রের বিরক্তির মাত্রা তিব্র হলো। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেনা। অথচ, এই মেয়ে’ই ইটটা ছুঁড়েছে। মারার সময় সাহসে কুলিয়েছে?
‘এই মেয়ে, অভ্র কি বলছে উত্তর দিচ্ছো না কেন?’ বললো শুভ।
তানিয়া পিটপিট করে তাকালো। সাদা শার্ট ইন করে তার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে অভ্র। হয়তো কোট-ও পড়েছিলো। কিন্তু তানিয়া চোখ ফেরাতে পারলো না। সে কি ঠিক দেখছে? এ’তো তার জীবনের ফার্স্ট ক্রাশ। রুদ্র’র ভাই দাড়িয়ে তার সানে। তানিয়া ঠিক হয়ে দাড়ালো। ইশশ! এতোক্ষণ না জানে কেমন লাগছিলো তাকে! অভ্র কি তাকে খারাপ ভাবলো? ভাববেই তো! ইট ছুঁড়ে কাঁচ ভেঙেছে। খারাপ ভাববে না তো কি নিষ্পাপ শিশু ভাববে? সব দোষ সোনিয়ার। শান্ত মনটাও আজ অশান্ত হয়ে মা*রতে চাইছে সোনিয়াকে।
‘দেখে রাখলাম। আরেকদিন দেখা হলে শোধ তুলে নেব সেদিন। আজ একটু ব্যাস্ত বলে..’
অভ্র চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সিফাত বলে উঠলো,
‘এভাবে ছেড়ে দিবি অভ্র? কাঁচটা একবার দেখ কতোটা ..’
‘সাট আপ সিফাত। গাড়ি তোকে চালাতে দেয়াই উচিত হয়নি আমার। দোষ তো তোরও রয়েছে। কি দরকার ছিলো ওদের দিক দিয়ে গাড়ি নেওয়ার?’ বলে তানিয়ার দিকে তাকালো অভ্র। বললো,’তবুও দেখে রাখলাম। জঙ্গি মহিলা!’
তানিয়া বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো। সিফাত একবার ক্রুদ্ধ চোখে তাকালো তাদের দিকে। তারপর সবাই চলে গেলো। পেছন থেকে মৃদু ধাক্কা দিলো তানিয়াকে সোনিয়া। তেতে বললো, ‘কিছু বললি না কেন তুই?’
‘কি বলবো?’
তানিয়া চোখ তুলে তাকালো। এখনো সূদুরে একধ্যানে তাকিয়ে মেয়েটা। কি হলো হঠাৎ? সোনিয়ার মনে পড়লো সেদিনের কথাগুলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথায় টোকা দিয়ে বললো,’অন্ধ প্রেম ভালো নয় তনু।’
ব্রীজের ধারে আরু-রুদ্র দাড়িয়ে। সূর্য ডুবছে। অন্তরিক্ষে লাল আভা ছড়িয়ে। সেই মনোরম দৃশ্য দুজনে দেখছে। কিন্তু সবাই কি সব আনন্দ উপভোগ করতে পারে? পারেনা! এই সূর্যান্তের দৃশ্য যেমন অনেকের’ই আনন্দের, তেমনি অনেকের বিভীষিকাময়। প্রণয় বিরহ এতো বিরহের? আরুর দু’চোখ ভর্তি নোনাজল। থেকেথেকে ফুঁপিয়ে উঠছে সে। আশিক তাকে ঠকিয়েছে। শুধু কি ঠকিয়েছে? সে-ই লোকটাই তো আদতে দুনিয়ায় নেই হয়তো। যে নিজের পরিচয়ে মিথ্যে বলে, তার আর কি সঠিক হবে? সব মিথ্যা! পুরোটাই ফেইক!
পাশেই রুদ্র দাড়িয়ে। তার চোখদুটি অকপটে আরুর দিকে স্থির। মুখে বাঁকা হাসির ছাপ। ক্রন্দনরত আরুকে ভীষন মায়াবি লাগছে রুদ্র’র কাছে। বিশিষ্ট বিজনেসম্যান ইরহামের দ্বিতীয় সন্তান নাকি আরুর প্রেমিক। ভাবলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে ইচ্ছা করছে রুদ্র’র। মেয়েটা এতোটাই বোকা? যে যা বলে তাতেই বিশ্বাস করে নেয়। যার বাপের বিশাল সম্পত্তি রয়েছে, সে বসে আছে চাকরীর আশায়? হাস্যকর! খুবই হাস্যকর! রুদ্র তো অবাক তখন হয়েছিলো আরু যখন চকচকে হাসি নিয়ে বলেছিলো ‘ইরহাম এন্টারপ্রাইজ’ এর সামনে দাড়াতে। এটা তো রুদ্রদের অফিস। শহরের দ্বিতীয় ব্রাঞ্চ। আরুর এখানে কি প্রয়োজন? আরও অবাক হয়েছিলো, যখন আরু বললো তার প্রেমিক এই কম্পানির মালিকের ছোট ছেলে।
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১+২
চোখের কাজল পানির সাথে গলে পড়েছে গাল বেয়ে আরুর। তা বারবার মুছে আরও ঘেঁটে দিচ্ছে আরু। স্বেচ্ছায়। তার পাশেই পড়ে আছে ফোনের টুকরো অংশগুলো। ভেঙেছে আরু নিজেই। সে এতো বোকা কেন! আহমেদ সাহেব ভুল কথা বলেননা কিছুই। তার মাথায় আসলেই গোবরে ভরা। ছেলেটার আইডির নামটাও ফেইক ছিলো; তবুও নির্বোধ আরু বোঝেনি।
