নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ১১+১২
আহমেদ হৃদ
রাত নয়টা। রুম অন্ধকার করে ইজি চেয়ারে বসে আছে রুদ্র। কপালে সূক্ষ্ম তিনটি ভাজ তার। বেলকনি দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। ঠান্ডা বাতাসে শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যাচ্ছে; তবুও ভ্রুক্ষেপহীন রুদ্র। যদি এই বাতাস পারতো রুদ্র’র বুকের জ্বালাগুলো থামিয়ে দিতে? ঠান্ডা করে দিতে বিভৎস যন্ত্রণাগুলো! খুব ভালো হতো। রুদ্র’র মাঝেমধ্যে মনে হয়, যদি দেখা না হতো আরুর সাথে।
খুব ভালো হতো। সেদিন আরুর পিছু’ই বা নিয়েছিলো কেন সে! এটা নিয়েও চিন্তায় বিদগ্ধ হচ্ছে রুদ্র। সেদিন অতো মহৎ সাজতে কে বলেছিলো মেয়েটাকে? খাবারগুলো বস্তিতে না নিয়ে, পারতো তো নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে। তাহলে রুদ্র মুগ্ধ হতো না, জীবনসঙ্গী হিসেবে উড়নচণ্ডীকে চাইতো না। আর মুখ-ও দেখতো না! এমন অবুঝ, বোকাসোকা মেয়েকে কিভাবে ভালোবাসে ফেললো রুদ্র? মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে রুদ্র’র। এই ভুলভাল ভাবনাগুলো; ভেবেও যন্ত্রনা বাড়ছে। দিকসারা লাগছে নিজেকে। রুদ্র নিজের চুলগুলো মুঠো করে নিলো। কপালের রগগুলো জেগে উঠলো আবারো। জ্বলছে! অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘রুদ্র!’
কারো ডাকে তাকালো রুদ্র। দরজায় ইলিমা দাড়িয়া। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাড়ালো রুদ্র। এগিয়ে এসে বললো,’বাইরে কেন? ভেতরে এসো।’
ইলিমা রুমে প্রবেশ করলেন। ঘর অন্ধকার দেখে ফিচেল হাঁসলেন। হাসি বজায় রেখেই বললেন,
‘আজ এতো খুশির দিনে তোর মন খারাপ?’
রুদ্র চমকালো। তার মা জানলো কিভাবে তার মন খারাপ? অন্যদিকে ফিরলো রুদ্র। ইলিমা এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। আস্বস্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি হয়েছে?’
রুদ্র’র ভেতর হাহাকার করে উঠলো মায়ের কথায়। ইলিমা রুদ্রকে বিছানায় এনে বসালেন। ফের জিজ্ঞেস করলেন,
‘আরুর সাথে কিছু হয়েছে?’
রুদ্র ঘোলাটে চোখে তাকায় মায়ের দিকে। ভার গলায় বলে,
‘মেয়েটা আমায় জ্বালাচ্ছে মা। খুব কষ্ট দিচ্ছে।’
ইলিমা চোখ বুজে সহ্য করলেন কথাটা। এতোদিন রুম অন্ধকারের কারন ছিলো অভ্র। সারাদিন মাথায় ঘুরতো কবে ঘুচবে এই অভিমান? শেষ হবে কথা না হওয়ার পালা! যেদিন থেকে আরু এলো রুদ্র’র জীবনে, সেদিন থেকে রুদ্র অন্ধকারে ডোবেনি। একাকিত্বে ভোগেনি। আজ আবারো? ইলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন,
‘কি হয়েছে?’
রুদ্র চোখ বুজলো। সেদিনের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতেই রাগে লাল হয়ে উঠলো রুদ্র’র চোখদুটি..
টেবিল থেকে পরপর কয়েকটি ফাইল পড়তেই রুদ্র বিরক্তিতে ‘চ’ জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করলো। একেই আজ রুদ্র লেট। তারউপর উটকো ঝামেলা যেন আজ লেগেই আছে। এইতো আজ রাস্তায় গাড়িটা নষ্ট হলো। আরও ত্রিশ মিনিট নষ্ট হলো এতে। আর এখন? করিম সাহেব দিনদিন অমনোযোগী হয়ে যাচ্ছে। এতো কোনায় ফাইল রাখলে তো পড়বেই! ফাইল তোলার অবধি সময় রুদ্র’র নেই। প্রয়োজনীয় মেইল পাঠাতে হবে ক্লাইন্টকে।
দরজায় নক্ করলো কেউ। বলে উঠলো,
‘মে আই কামিং স্যার?’
ল্যাপটপে চোখ নিবদ্ধ রুদ্র’র। সেভাবেই বললো,’কামিং।’
অথৈ প্রবেশ করলো কেবিনে। এই কেবিনে দু’সপ্তাহ পর প্রবেশ করছে সে। অথৈর হাতে ধোয়া ওঠা গরম কফি। রুদ্র’র থেকে কয়েক হাত দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো অথৈ। কোন ভুল করা চলবে না আজ। না চাইতেও অনেক ভূল করে বসে অথৈ; শুধুমাত্র রুদ্র’র চাহনিতে! এই কেবিনটায় যতবার অথৈর আগমন হয়েছে, ততবার’ই কোন না কোন ভূল অথৈর দ্বারা হয়েছে। অথৈ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্র’র পাণে। চোখদুটি ছোটছোট। অথৈর যদি সামর্থ্য, শক্তি থাকতো; তুলে নিতো ওই চোখ। এই চোখদুটি’তে এতো রাগ, তেজ আসে কোত্থেকে? অথৈ বোঝেনা! কই, অভ্র স্যার তো এমন নয়! তিনি তো বেশ সাবলীল, সুন্দর ভাবে কথা বলে, বুঝিয়ে দেয়। এককথায় অভ্র অথৈর ক্রাশ। কাজের ছুতোয়, এমনি, অথৈ ছুটবে ঔ কেবিনে। কফি, চা এগুলো কিছুতেই করিম’কে অথৈ দিতে দেবেনা। আর এদিকে, এই মহাশয়ের রাগ যেন উঠেই থাকে সবসময়। শুধু ছুতো পাওয়ার অপেক্ষা, পেলেই উগ্রে দেয়।
রুদ্র একপলক তাকালো অথৈর দিকে। বিরক্তি কাটিয়ে রাগে রুপ নিলো এবারে। করিম সাহেব শুধু অমনোযোগী-ই নয়, দিনদিন ফাঁকিবাজ ও হচ্ছে! নিজে কফি দিতে পারবে না; তাই বলে কোন মেয়েকে পাঠিয়ে দেবে? তার উপর এসে থেকে দাড়িয়ে রয়েছে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘কফি কি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছেন?’
অথৈ নড়েচড়ে দাঁড়ালো। ইচ্ছে হচ্ছে মাটি ফাঁক করে ডুকে যেতে। প্রতিটা কথাতেই যেন রাগের ছাপ। নিশ্চিত জন্মের পর ব্যাটাকে কেউ একফোঁটা খাটি মধু দেয়নি। খুব সন্তোর্পণে এগোলো অথৈ। কিন্তু অথৈর সাবধানতা অবলম্বন কোন কাজে এলো না। নিচে পড়ে থাকা ফাইলগুলোয় উষ্টা খেয়ে সম্পূর্ণ গরম কফি ফেলে দিলো রুদ্র’র শুভ্র শার্টের উপর। আকস্মিক ঘটনায় ধুপ করে পড়ে গেলো অথৈ।
শরীর ছিলকে উঠলো রুদ্র’র। সাদা শার্টে মানচিত্রের মতো সেঁটে গেলো কফির রঙ। চেয়াল শক্ত করে তাকালো রুদ্র। অথৈ তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়ালো। ভয়ে পিছিয়ে গেলো দু’কদম। বুক ভয়ে দুরুদুরু করছে। এটাই বাকি ছিলো। ষোলকলা পূর্ণ হলো এবারে! আর কে বাঁচায় তাকে? আজ নির্ঘাত চাকরি নট হবে অথৈর।
‘স্টুপিড গার্ল! কি করলেন এটা?’ দাঁতে দাঁত চেপে বললো রুদ্র।
এই একটি কথায় কেঁপে উঠলো অথৈ। চারপাশ মরুভূমি মনে হচ্ছে অথৈর। যেখানে সে ছোট্ট একটি হরিণ আর রুদ্র সয়ং সিংহ! এখনি খেয়ে ফেলবে তাকে। চোখ ছোটছোট করে তাকালো অথৈ। এহ্ হে! না জানে কত দামী কোর্ট, শার্টের সাথে ওটাও ভিজে গেছে। অথৈ হিতাহিত জ্ঞান হাড়ালো। কি করবে, কি করবে ভাবতে ভাবতে গলার ওড়নার দিকে চোখ পড়লো। ওটা নিয়েই ছুটলো মুছে দিতে। রাগের সর্বস্ব সীমা পেরিয়ে গেলো রুদ্র’র। হাত মুঠো করে কিছু বলার আগেই দরজা খোলার শব্দ। আগমন আরুর…
তড়িৎ গতিতে চোখ খুললো রুদ্র। চারপাশ অন্ধকার। এরপর আরুর অবহেলাগুলো মনে পড়তেই কপালের শিরাগুলো জ্বলে উঠলো। অথৈকে সেদিন’ই বের করে দিতে চেয়েছিলো রুদ্র। পরে যখন শুনলো পরিবারের একমাত্র ভরসা অথৈ, রুদ্র আর কিছু করেনি।
‘আরুর কোন দোষ আমি দেখছি না রুদ্র।’
ইলিমার কথায় রুদ্র ভেজা চোখে তাকালো। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে,
‘মা তুমিও? তুমি ও যদি আমায় এভাবে ভূল বোঝো, আমি কার কাছে যাবো বলতে পারো?’
ইলিমা ঠোঁট বিস্তৃত করে হাঁসলেন। ছেলেটা উপরে উপরে শক্ত হলেও, ভেতরটা ভীষণ নরম। একবার কেউ আপন করে নিলেই মনের সব কষ্ট, অভিমান বাচ্চাদের মতো বলে দেয়।
‘কোন মেয়ে কাছের মানুষকে অন্য মেয়ের সাথে দেখলে সহ্য করতে পারে? কোন মেয়েই পারবে না! যে পারবে, মনে করবি সে তোকে ভালোবাসে না। আরু রাগ করেছে, অভিমান করেছে; এটাই তোর অভিযোগ। তাইতো? তোর তো এতে খুশি হওয়া উচিত রুদ্র। তোর প্রতি আরুর অনুভূতি না থাকলে সে রেগে যেত না। অন্য কারো সাথে দেখে কথা বলা বন্ধ করতো না।’
বলে থামলেন ইলিমা। রুদ্র’র চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। এতক্ষণে শান্ত হলো একটু রুদ্র’র মন। ইলিমা আবারো বললেন,
‘এখন বলতো,তোর কি করনীয়?’
রুদ্র গভীর চিন্তায় ডুবলো। এখন আবার কি করনীয়? ছেলেকে ভাবুক হতে দেখে ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে এলো ইলিমার। তিনি হাই তুলতে তুলতে বললেন,
‘তোরা ছেলেরা কোনদিন ও মেয়েদের রাগ ভাঙাতে পারবি না। মন বুঝতে পারবি না। আমি বলে দিচ্ছি বোকা ছেলে, আরুর রাগ ভাঙা। মুখে সরি বল।’
রুদ্র কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে হাঁসলো। দু’বার ‘থ্যাংক ইউ’ বলে উঠে প্রানভরে শ্বাস টানলো। ইলিমা উঠে দাড়ালেন যাওয়ার জন্য। কি যেন ভেবে আবারো বললেন, ‘রুদ্র শোন।’
রুদ্র তাকালো। হেঁসে বললো,’হুম, বলো।’
‘না, তোকে বলবো না। আমি অভ্রকে বলছি। তুই বরং রাগ ভাঙা আমার বউমার।’
রুদ্র হাঁসলো। ইলিমা বেড়িয়ে গেলেন বলে। রুদ্র বেলকনিতে গিয়ে আকাশপাণে তাকালো। চোখ বুজতেই আরুর মুখশ্রী মনে পড়লো। চিৎকার দিয়ে উঠলো রুদ্র,’আসছি আমি মিস অরোনিতা..আসছি..’
আরু ফোন নিয়ে বসে আছে এক ঘন্টা যাবৎ। ঘড়ির কাটা প্রায় বারোটার কাছাকাছি। লোকটা আর একটাও মেসেজ দেয়নি। আরুর কেন জানি খারাপ লাগছে। কেনো দেবে না মেসেজ? পরমুহূর্তেই ভাবলো, দেবে কেন মেসেজ? না দিক! দূরে যাক। কিন্তু, আরু অপেক্ষা কেন করছে? এই প্যাচের মাঝে আরুর চোখে একফোঁটা ঘুম নেই চোখে।
পাশেই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তোফা, ইরু। নিশ্চিন্তে, নির্বিগ্নে! আরুর হিংসে হলো। ঘুম আসে কই থেকে এগুলোর? না না, এবার আরুকে ঘুমোতেই হবে! কেন অপেক্ষা করবে ওই অসভ্য লোকটার ম্যাসেজের? আরু করবে না। আরু ফোন সুইচ স্টপ করে দিলো। পাশ ফিরে চোখ বুজলো। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর চোখে ঘুম এলো আরুর।
হুট করে সজোরে কিছু ভেঙার শব্দ হতেই সদ্য আসা ঘুম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আরুর। আরু বিছানা ছাড়ে উঠলো। শব্দটি এসেছে বেলকনিতে থেকে। আরু উঠে মনেমনে দোয়া পড়ে নিলো। গুটিগুটি পায়ে বেলকনির দিকে এগোলো। বেলকনিতে কারো অবময় দেখতেই হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলে আরুর। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেলো আরুর শ্বাস। চোর এলো নাকি? চোর ছাড়া এতো রাতে কে আসবে? আরু চারদিকে কড়া চোখ বোলায়। একটু দূরে ফুলদানিটার দিকে চোখ পড়তেই আরু তুলে নিলো ওটা। উদ্দেশ্য, ব্যাটার মাথা ফাটানো!
বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো রুদ্র। শরীর ঘেমে একাকার। যদিও বাইরে বাতাসের তীব্রতা বেশি। তবুও, এই বয়সে দো’তলায় ওঠা কি চারটি খানি কথা? রুদ্র গরম শ্বাস ফেলে আবারো নিচে উঁকি দিলো। তাকাতেই ভেতর আঁতকে উঠলো রুদ্র’র। ভাবতেই অবাক লাগে, রুদ্র একটা মেয়ের জন্য এতো রাতে চোরের মতো দেয়াল বেয়ে উঠেছে। এতে কতো রিস্ক ছিলো, মেয়েটা বুঝবে? দেখলেই নিশ্চয়ই চেঁচিয়ে উঠবে। বাড়ি মাথায় ও তুলতে পারে। উড়নচণ্ডী’র দ্বারা কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আর আরুর চেঁচামেচিতে, যদি একবার তার শশুর দেখে ফেলে; যাচ্ছেতাই কান্ড হবে। একদিন বলেছে ‘চরিত্রহীন’ আজ বললে ‘খাঁটি লুচ্চা’। ভাবলেই রুদ্র’র গা শিউরে উঠছে। রুদ্র আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। পিছু ফিরে ভালো করে দেখে নিলো চারপাশ। দরজা খোলা। একদিক দিয়ে ভালো হলেও, আবার রাগ-ও হলো খানিকটা। এভাবে দরজা খুলে ঘুমায় কেউ?
আরু দরজার চিপায় সেঁটে গেলো ভালোমতো। কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবে না বাড়ির লোক জেগে আছে। একটু টের পেলেই দেয়াল টপকে পালাবে ব্যাটা। টিকি’টাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তখন। আরুর খুশিতে চোখ-মুখ উজ্জ্বল। তার বাবা বলে, আরুর দ্বারা কিছু হবে না! এতোকাল আত্নীয়’রাও এই একই কথা বলে এসেছে। আজ আরু দেখিয়ে দেবে। ভালোমতো বুঝিয়ে দেবে আরু কি জিনিস! এমনিতেও বাড়িতে আজ সব আত্মীয়রা রয়েছে। সবার মুখে আজ সিলি টেপ লাগিয়ে দেবে একদম। রাতে খাওয়ার আগে আড়াল থেকে ফুপির কথা শুনেছে আরু। তিনি কাউকে রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন,’আরে ফেলঠুস মেয়ে তো। ভাবীও যেমন তার মেয়েটাও ঠিক তেমন হয়েছে। বিয়ে দেবে না তো কি করবে? তবে যা-ই বলো, বেশ ভালো বাড়ির ছেলেকে হাত করেছে। টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি কোন কিছুর কমতি নেই।’
কথাগুলো শুনে আরুর রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিলো। বয়সে ছোট না হলে আরু তখনি গিয়ে কড়াকড়া কথা শুনিয়ে দিতো। শুধুমাত্র বয়স বেশি বলেই আরু কিছু বলেনি। আজ, এখন ওই অপমানের জবাব দেবে আরু। এই চোর’কে নিয়ে যখন ছুড়ে ফেলবে ড্রয়িংরুমে; তখনি দেয়া হবে যোগ্য জবাব। আরু নিজের বুদ্ধির তারিফ করলো। এরপর তক্কেতক্কে রইলো চোরের রুমে প্রবেশ করার।
রুদ্র উঁকি-ঝুঁকি দিতে দিতে এগোলো। আরু শক্ত করে ধরে নিলো হাতের ফুলদানি। রুদ্র পা টিপেটিপে দরজার সামনে আসতেই আরু নিজের সব শক্তি দিয়ে দিলো এক ঘাত। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো আরু। বিকট শব্দে ভেঙে গুড়িয়ে গেলো ফুলদানি। নির্ঘাত ব্যাটার মাথা তরমুজের মতো দু’ফালা হয়ে গেছে। আরু ধীরেধীরে চোখ খুললো। চোখ খুলে যখন সামনে সয়ং রুদ্র’কে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো আরু, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো সে। বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো আরু। ভাবলেশহীন হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রুদ্র। সবথেকে বড় কথা, রুদ্র’র কিছুই হয়নি। মেঝেতে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে আছে ফুলদানি। আরু কি দেয়ালে মারলো তবে নাহলে কিছু হলো না কেন রুদ্র’র? ধ্যাত! একটা কাজ যদি আরুর দ্বারা হয়। নিজেকে নিজেই গালি দিলো আরু৷ এরপর তাকালো রুদ্র’র দিকে। ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
‘আপনি?’
নিজেকে স্বাভাবিক করলো রুদ্র। রুদ্র কল্পনাও করেনি এভাবে আরু ওত পেতে থাকবে। হয়তো ভূল বুঝে করেছে।
রুদ্র হাঁসে বললো,
‘কেনো? আসতে পারি না?’
‘সেটাই তো বলছি, আমাদের বাড়িতে কি চুরি করতে এসেছেন আপনি?’
রুদ্র আরুর কথায় বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো। এতো খেটেখুটে, কষ্ট করে পাইপ বেয়ে উঠলো যার জন্য; সে কি-না তাকে বলছে চোর? রুদ্র মস্তিষ্ক যেন ঝেড়ে বলে উঠলো,’রুদ্ররে, তোর জীবনটাই লস!’ রুদ্র শুকনো ডোগ গিলে চোখ বুজে হজম করে নিলো আরুর কথাটা। এখনো যেন রুদ্র’র কানে বাজছে,’কি চুরি করতে এসেছেন আমাদের বাড়িতে?’
‘চলুন।’ নিরুদ্বেগ কন্ঠ আরুর।
রুদ্র চোখ খুললো আরুর কথায়। কোথায় যেতে বলছে এই মেয়ে? রুদ্র’র প্লান কি ধরে ফেললো? আরুকে তার থেকেও একধাপ এগিয়ে ভেবে বসলো রুদ্র। আগের কথাটা সম্পূর্ণ তোয়াক্কা করে, রুদ্র ফিচেল হেঁসে বললো,
‘আপনি তো ভীষণ দুষ্টু। আমি এতো জলদি বেডরুমে যেতে চাই না মিস অরোনিতা।’
রুদ্র বাঁকা হাঁসলো। অথচ, আরুর মাঝে কোন হেলদোল নেই। আরু আগের মতোই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। বিরক্ত গলায় বললো,
‘আপনাকে যেতেই হবে বেডরুমে৷ আপনি বেডরুমে যাবেন, এবং বেডরুম দিয়েই ড্রইংরুমে যাবেন।’
রুদ্র সন্দিহান চোখে তাকালো আরুর দিকে। জিজ্ঞেস করলো,’ড্রয়িংরুমে কেন?’
‘ওমা! আপনি চুরি করতে এসেছেন, আর আমি আপনাকে ধরে ফেলেছি। তো এখন সবার সামনে যাবেন না? আর আপনাকে ধরিয়ে আমি আমার বুদ্ধি’র পরিচয় দেব।’
রুদ্র’র এবারে মন চাইছে নিজের গলায় ছুড়ি বসাতে। কোন শোকে আসতে গিয়েছিলো রুদ্র? সৃষ্টিকর্তা কি সত্যি’ই এই মেয়ের মাথায় ঘিলু দেয়নি? রুদ্র কপোট রাগান্বিত চোখে তাকালো আরুর দিকে। ড্রয়িংরুমে নিয়ে যাবে, সবাইকে বলবে, বেঁধে পিটুনি খাইয়ে ছাড়বে; কি বুদ্ধি! নিজের হবু স্বামীকে মার খাওয়ানোর কি সুন্দর পরিকল্পনা এই মেয়ের। আর এই বুদ্ধি’র সে আবার প্রসংসা চায়! রুদ্র আরুর হাত ধরে নিলো। রুমের ভেতরে ডুকে দেখলো তোফা, ইরু এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আরুকে টেনে বাইরে আনলো রুদ্র। দো’তলা থেকে সচেতন দৃষ্টিতে পুরো নিচটা পর্যবেক্ষন করে নিচে নিয়ে এলো আরুকে। আরু সবটা সেচ্ছায় করলো। এই চোরটাকে আরুর ভালো লেগেছে। নিজে থেকে ধরা দিচ্ছে বলেই হয়তো।
কিন্তু আরুর ভালোলাগা বেশিক্ষণ স্থানী হলো না। রুদ্র টেনে সদর দরজার সামনে এনে দাঁড় করালো। নিঃশব্দে দরজা খুলতেই আরু তেতে এগিয়ে এসে রুদ্র’র হাত ধরলো। ভ্রুক্ষেপ করে বললো,
‘কি করছেন?’
‘তোমায় নিয়ে পালাচ্ছি।’
‘কিহ্..?’ অবাক কন্ঠ আরুর। চিৎকার দেয়ার আগেই আরুকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো রুদ্র। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে, কোন কথা না বলেই টেনে এনে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসালো আরুকে। রুদ্র নিজে বসে কাঁচ উঠিয়ে দিলো। এরপর হাঁসলো। এ হাসি জয়ের হাঁসি। প্রথমবার এই কাজ করলেও, রুদ্র সফল! গর্ব হচ্ছে তার। এই সাফল্য রুদ্র জিবনেও ভুলবে না। গাড়িতে ওঠাতেই,আরু চিৎকার জুড়েছে। বোকা আরু কি জানে? গাড়িতে বাতাস ডোকার অব্ধি ফাঁক নেই। তার আওয়াজ কেউ শুনবে না। চিল্লাতে চিল্লাতে গলা ফাটালেও না!
গাড়ি স্টার্ট দিলো রুদ্র। সুনসান রাস্তায় দ্রুত বেগে ছুটতে লাগলো রুদ্র’র গাড়িটি। আরু থেমেছে। পাড়ার দুলা চাচার দোকান পেরোতেই আরু চুপসে গেছে। এখন চিৎকার করেও আর কোন লাভ নেই। এখন যদি লোকটা নামিয়ে দেয়? আরু ভয়ে মরে পড়ে থাকবে। তাই চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ মেনে আরু চুপ রইলো।
গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। আরু মুখ ফিরিয়ে বসে রয়েছে। এভাবে বন্ধ গাড়িতে থাকতে কারো ভালো লাগে? গরম গরম ও লাগছে। কে জানে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে লোকটা। আরু জিজ্ঞেস ও করলো না। কিন্তু এভাবে বসে থাকতে খারাপ লাগছে বিধায় ছোট করে বললো,
‘কাঁচটা নামিয়ে দিন।’
রুদ্র’র নাকচ উত্তর,’না, এতো রাতে কাঁচ নামানো যাবে না।’
আরু বিরক্ত হলো। পুরোপুরি ফিরে ঘুরে তাকালো রুদ্র’র দিকে। বিরক্তিঝড়া কন্ঠে বললো,’কেন? যাবে না কেন?’
‘চুপচাপ বসো।’
আরু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো। গাঁট হয়ে বসে রইলো। লোকটা নিজেকে ভাবে কি? একেই তুলে নিয়ে এসেছে। আরু তো জানেও না, তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তারউপর যা ভাব! বলি, ওই ভাবের ধার ধারে কে হে? যত্তসব!
আরুর ভাবনার মাঝেই গাড়িটা থেমে গেলো। আরু বাইরে উঁকি দিতে চাইলো; কিন্তু তা হয়ে উঠলো না। ভেতর থেকে বাইরে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কাঁচ ধুলোয় মাখামাখি। রুদ্র গাড়ি থেকে নামলো। এপাশে এসে দরজা খুলে দিতেই আরু তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এলো গাড়ি থেকে। বাইরে অতিরিক্ত বাতাস। আরুর খোলা চুল তিরতির করে উড়তে লাগলো বাতাসে। রুদ্র এগিয়ে গেলো। দূরের একটি বেঞ্চে ইসারা করে বললো,’চলো, বসি।’
আরু রুদ্রকে ফেলেই দ্রুত গিয়ে বসে পড়লো। রুদ্র কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আনমনে হেঁসে ফেললো আরুর কান্ডে। কত বয়স হবে মেয়েটার? আঠারো-উনিশ? তবুও কি ছেলেমানুষী! রুদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলো আরুর পাশে। ম্যাডাম বুকে হাত গুঁজে গম্ভীর হয়ে বসে আছেন। রুদ্র খেয়াল করলো, রাতের এই অন্ধকারে আরুর ফরসা গাল চিকচিক করছে। বড্ড টানছে রুদ্র’কে। রুদ্র দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। দূরে তাকিয়ে চাপা গলায় ডাকলো,
‘আরু!’
আরু তাকালো না। ছোট করে জবাব দিলো,’হু।’
‘এখনো রেগে আছো?’
‘কিসের জন্য?’
রুদ্র তাকালো আরুর দিকে। এখনো দূরে আরুর চোখ। রুদ্র ডোগ গিললো। মলিন কন্ঠে বললো,
‘সেদিন অফিসে আমাকে আর অথৈকে ওভাবে দেখে!’
কপালের রগ দপদপ করে উঠলো আরুর। বুকটা হঠাৎ ভার হয়ে গেলো। আরু জবাব দিলো,
‘না, রাগ কেনো করবো?’
রুদ্র হাঁসলো। সে হাসিতে মিশ্রিত চাঁপা কষ্ট। ভেজা গলায় বললো,’আমি জানি তুমি রেগে আছো।’
আরু জবাব দিলো না। রুদ্র এগিয়ে এসে গা ঘেঁষে বসলো আরুর। তবুও ভ্রুক্ষেপহীন আরু। দূরে কি যেন মনোযোগ সহিত দেখছে সে।
‘সরি।’
এটুকু বলেই থেমে গেলো রুদ্র। মনটা খচখচ করছে। আরু তবুও তাকালো না। রুদ্র সূদুরে তাকালো। নিরব-নিস্তব্ধ চারপাশ। পাশে কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। একটু দূরে পার্ক করা গাড়ির মৃদু আলোয় কি মহোনীয় চারপাশ। দু’একটা জোনাকির টিমটিমে আলো দূরে অবলোকন। রুদ্র বলতে লাগলো। অথৈ আর তার সেদিনের পুরো ঘটনা বিস্তারিত বলে রুদ্র থামলো। চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানলো। পাশাপাশি বসা দুটি মানব-মানবীর মনের মধ্যে ঘটে যাওয়ার ঝড়, পিপাসায় কাতর করে তোলা অন্তস্তল; একটু কাছে, শুধু একটু কাছে পাওয়ার কি বিদীর্ণ প্রত্যাশা! বিষাদে মেতে উঠলো রুদ্র’র বুক। আরুর নিশ্চুপ’তা বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। হুট করে ফুপিয়ে উঠলো আরু। রুদ্র চমকালো; তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে ফেরালো আরুকে। আরুর ক্রন্দনরত মুখখানায় হাত রেখে উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ৯+১০
‘কি হয়েছে আরু?’
আরু হেঁচকি তুলে কাঁদছে। এই কান্নায় মিশ্রিত অগাধ অভিমান, কষ্ট। আটকানো গলায় অভিযোগ তুললো আরু,
‘আমার কত কষ্ট হয়েছে জানেন? যতবার সেই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আমার শ্বাস আঁটকে যায়। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। গলায় দলা পাকিয়ে যায়। মনে হয় আমি মরে যাচ্ছি।’
রুদ্র’র চোখ ভিজে উঠলো। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো আরুকে বুকে। ঠোঁটে দাঁত চেপে নিঃশব্দে ফেললো চোখের দু’ফোটা পানি। কি করে বোঝাবে রুদ্র আরুকে, এই কষ্টের সমান ভাগিদার যে সে-ও!
