নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৫+২৬
আহমেদ হৃদ
‘আপনার সাহস কি করে হয় অন্য মেয়েদের সাথে ড্যান্স করার? লজ্জা করে না? আপনি শুধু আমার। আই লাভ ইউ! বুঝেছেন আপনি? ভালোবাসি আপনাকে!’
থমকে গেলো অভ্র। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেলো। শক্ত, কঠোর চোখদ্বয় ধপ করে নিভে গেলো সাথেসাথে। ছুড়ির মতো হৃদয়ে হানলো তানিয়ার কথাগুলো। কি বললো মেয়েটা? ভালোবাসে? কাকে, অভ্র’কে? অভ্র কি ঠিক শুনলো? অভ্র এখনো অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে তানিয়ার দিকে। শ্বাস আঁটকে আসছে অভ্র’র। আশেপাশে চলা ফুল ভলিউমে মিউজিক কানে আসছে না। অভ্র কিছু বলতে গিয়ে বুঝলো, সে কথা বলতে পারছে না৷ গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। অভ্র কি এই কয়েকবাক্যে বাকরুদ্ধ হলো? মন মস্তিষ্কের রোষানলে পড়লো অভ্র। এটা তো সম্ভব নয়! তানিয়া তো ভালোবাসে তুর্যকে। তাহলে?
তানিয়া টলটলে চোখে তাকিয়ে অভ্র’র পাণে। পা দুটো অবস হয়ে আসছে তানিয়ার। দেহ ভর ছেড়ে দিচ্ছে। দিন-দুনিয়া ভূলে চৈতন্য হারালো তানিয়া। দেহ ছেড়ে দিলো নিজের ভর। ঢুলে পড়লো তানিয়া। মেঝেতে পড়ার আগেই শক্ত বাহুর বাঁধন ধরে নিলো তাকে। তানিয়া বোজা চোখদুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক করে তাকালো তাকে ধরা লোকটার দিকে। অভ্র! ঠোঁটে হাঁসি ফুটলো তানিয়ার। মদকতা মেশানো চোখে তাকিয়ে রইলো অভ্র’র পাণে। হুডি নেমে গেছে মাথা থেকে। এলোমেলো চুলগুলোর বিচরণ কপাল জুড়ে অভ্র’র। হাতটা তুলে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল এলোমেলো চুলগুলো। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারলো না তানিয়া।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিদঘুটে একটা গন্ধ নাকে এলো অভ্র’র। কপাল কুঁচকে ফেললো সে। তানিয়া ড্রিংক করেছে? চোখদুটি জ্বলে উঠলো অভ্র’র। চেয়াল শক্ত হয়ে এলো। কাপালের রগগুলো জেগে উঠলো।
অথৈ বিস্ফোরিত নয়নে দেখছিলো তানিয়ার কান্ড। তবে এভাবে গায়ে এসে পড়া অথৈ মোটেও সহ্য করতে পারলো না। একেই এই মেয়ে সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করে অভ্র’র পিছেপিছে। চোখে-মুখে একরাশ রাগ নিয়ে এগিয়ে এলো অথৈ। যারপরনাই চেঁচিয়ে উঠলো,
‘এই মেয়ে এই? সাহস কি হয় স্যারকে এসব বলার তোমার? লজ্জা করেনা এভাবে স্যারের গায়ে..’
অথৈর কথা শেষ হওয়ার আগেই রাগত চোখে অথৈর দিকে তাকালো অভ্র৷ অথৈ দমে যায়। শান্ত, তবে কঠোর শোনালো অভ্র’র কন্ঠ,
‘সি ইজ ইন্টকসিকেটেড।’
‘কিন্তু স্যার..’
জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই থেমে গেলো অথৈ। মাথা নিচু করে নিলো সে। রাগ হচ্ছে খুব অথৈর। এইতো শুরু হতে যাচ্ছিলো তাদের কাছে আসা। এভাবেই হয়তো অভ্র অথৈর কাছে আসত। অথৈকে এখনো একটু আগের ঘটনা ভাবাচ্ছে। যে অভ্র নিজের কাছে কোন মেয়েকে ঘেষতে দেয় না, সেই অভ্র যে সত্যিই ড্যান্সের জন্য রাজি হয়ে যাবে; কল্পনাও করেনি অথৈ। বেশ তো চলছিলো! তার মাঝে চলে এলো মেয়েটা। রাগে গজগজ করতে করতে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় অথৈ। তানিয়ার প্রতি ক্ষোভটা দ্বিগুন হলো এবারে!
সবাই তখনো আমোদে মেতে। কারো চোখে আটকালো ছোট কাহিনিটুকু। অভ্র তপ্তশ্বাস ফেললো। ধীর গতিতে চোখ সরিয়ে তানিয়ার দিকে তাকালো। নেশায় বুদ হয়ে থাকা তানিয়াকে দেখতেই রাগটা চড়া হলো অভ্র’র। কে করিয়েছে তানিয়াকে ড্রিংক? শেষবার তুর্য’কে তানিয়ার সাথে দেখেছিলো অভ্র। তবে কি তুর্য? অভ্র বুঝে উঠতে পারলো না। তুর্য বয়ফ্রেন্ড হয়ে নিশ্চয়ই চাইবে না তানিয়া মদ্যপান করুক। অতশত না ভেবে পাজকোলা করে নিলো তানিয়াকে অভ্র। বেড়িয়ে এলো বার থেকে। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই কতগুলো চোখ এসে পড়লো তাদের উপর। উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রাস্তায় থাকা মানুষগুলো। সেসবে অবশ্য অভ্র পাত্তা দিলো না। এখান খুব বেশি দূরে নয় তাদের হোটেল। অভ্র তবুও এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে যানবাহন খোঁজে। এভাবে হেঁটে নিয়ে গেলে যে কেউ যা কিছু ভাবতে পারে। কিছুদূরে রিকশা দেখতেই অভ্র ডাকলো রিকশাওয়ালাকে। রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসে। রিকশা থামাতেই অভ্র তানিয়াকে বসিয়ে নিজে বসলো। রিকশাওয়ালা তাকিয়ে আছে দু’জনের দিকে। দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
‘স্যার কই যাবেন?’
‘সি ক্রাউন হোটেল।’
বললো অভ্র। রিকশা চলতে শুরু করেছে। বাতাসের তিব্র দাপট। নিজ বাহুতে আগলে নিলো তানিয়াকে অভ্র। এখনো ভাবাচ্ছে তানিয়ার কথাগুলো অভ্র’কে। কি শান্তির প্রয়াসে চোখ বুজে তানিয়া! ঘোর লেগে যায় ঘুমন্ত তানিয়াকে দেখলে অভ্র’র। তানিয়ার সান্নিধ্যে এলেই মায়ায় আঁটকে যায় চোখদুটি। চেয়েও নিজের দৃষ্টি সামলাতে পারে না অভ্র। আজ বাসেও তো! কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলো সে। হুট করে চোখ খুললো তানিয়া। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয় অভ্র। তবে হাত সরালো না। মেয়েটা জেগে? দম নিতে ভুলে বসলো অভ্র।
তানিয়া মুচকি হাঁসলো। ঢলুঢলু চোখে অভ্র’কে দেখতে লাগলো। খোঁচাখোঁচা দাঁড়িগুলো, মাথার এলোমেলো চুলগুলোয় হাত দিতে ইচ্ছে করছে তানিয়ার। এতোটা কাছ থেকে তানিয়া ভীষণভাবে উপলব্ধি করলো, অভ্র সুন্দর! তানিয়ার চোখে দেখা সবথেকে সুদর্শন যুবক এই লোক। আনমনে হেঁসে ওঠে তানিয়া। আটকানো গলায় জিজ্ঞেস করলো অভ্র’কে,
‘ক্ কি দেখছিলেন?’
শুনেও যেন শুনলো না অভ্র। অন্যদিকে দৃষ্টি রেখেই ছোট করে বললো,’কিছুনা।’
‘তাহলে দেখছিলেন কেন এভাবে?’
অভ্র উত্তর দিলো না। তানিয়া কষ্ট পেলো। ক্ষুন্ন হলো হৃদয়। কেন ভালোবাসে না তানিয়াকে লোকটা? কবে বলবে ভালোবাসি? কবে প্রেম হবে তাদের? আদেও কি হবে? অভ্র কি তাকে ভালোবাসবে কোনদিন? উত্তরে চারিদিকে শূন্য দেখে তানিয়া।
রিকশা থামলো হোটেলের সামনে। রিকশায় বসেই ভারা মিটিয়ে সন্তর্পণে তানিয়াকে নামালো অভ্র। ছেড়ে দিলেই যে ধুপ করে পড়বে, বেশ বুঝতে পারছে সে। প্রথম নেশা করায় এমন অবস্থা তানিয়ার। অভ্র তানিয়ার কাধে হাত রেখে হাঁটতে লাগলো। ধীরেধীরে হেঁটে হোটেলে প্রবেশ করলো দু’জনে। কয়েকজন সার্ভেন্ট এগিয়ে এলো সাহায্যের জন্য। অভ্র সাহায্য নিলো না। লিফট নিয়ে উঠে এলো তিন তলায়। তানিয়াকে নিজ রুমে নিয়ে গেলো অভ্র। বিছানায় শুইয়ে দিলো তানিয়াকে। এগুলো মোটোও অভ্র’র ভালো লাগছে না। বারবার স্পর্শ করতে হচ্ছে তানিয়াকে। এতে অস্বস্তি হচ্ছে অভ্র’র। মন বলছে পাপ হচ্ছে। অভ্র তানিয়াকে শুইয়ে, উঠতে নিলেই হাত টেনে ধরলো তানিয়া। তখনো বুজে আসা ছোট ছোট চোখদুটি স্থির অভ্র’তে। ক্ষিণ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘বললেন না যে?’
অভ্র আস্তে করে হাত ছাড়িয়ে নেয়। তানিয়া উন্মাদের মতো হেঁসে ওঠে। অভ্র পাশের টি-টেবিলে থাকা টেলিফোন তুলে কল দিলো ওয়েটারকে। লেবু আর পানি মিশিয়ে আনতো বললো। এবং অবশ্যই যেন মেয়ে স্টাফ আসে ভালো করে বলে দিলো। ফোন কাটে অভ্র দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। সে জানে, তানিয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। না চাইতেও অভ্র’র সেই দৃশ্যটি মনে পড়ছে বরংবার। যেগুলো মানুষ মনে করতে চায় না, ওগুলোই বারবার মনে পড়ে, খোঁচায়, কষ্ট দেয়; প্রমান হলো আবারো! মন বলছে তানিয়া মন থেকে বলেছে কথাগুলো। কেন মনে হচ্ছে এমন? সাথেসাথে মস্তিষ্ক বিদ্রুপ তুলে হেঁসে ওঠে। অভ্র’র সিক্ত মনটাকে ছিন্নভিন্ন করতে বিকৃত গলায় বলে ওঠে,
‘তুই কি ভূলে যাচ্ছিস তুর্য’র কথা অভ্র? তানিয়া মনেপ্রাণে ভালোবাসে তুর্যকে। তুই মূর্খ অভ্র! তোর প্রতি সামান্য ভালোলাগাও নেই তানিয়ার মনে। তুই বড্ড বোকা!’
সারা শরীরে আগুন ধরে অভ্র’র। জ্বলতে লাগলো চোখদুটো। মন যেন এতটুকু খুশি হলো না এই কথাগুলোয়। প্রতিবাদ তুলে নিজেকে বোঝায়,
‘আজকের কথাগুলো মিথ্যে নয়! আমি ওই চোখে সত্যতা দেখেছি।’
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে অভ্র’র মস্তিষ্ক। আগের তুলনায় তেজি গলায় বলে,
‘ওহ্ তাই? কখনো ওই চোখে তোর প্রতি ভালোবাসা দেখেছিস?’
মন নত হয়। শরীর কেঁপে ওঠে প্রশ্নে। কি জবাব দেবে অভ্র? মন থেকে উঠে আসে একটি উত্তর,আর তা হলো ‘না!’
‘দেখিনি কখনো।’
‘তবে? কিসের জন্য ভাবিস ওর মনে তোর প্রতি ভালোলাগা আছে?’
অভ্র দিশেহারা হয়ে উঠলো। মাথায় তিব্র যন্ত্রণা শুরু হলো। কোন দহনে পুড়ছে সে? কেন এতো কষ্ট, যন্ত্রনা পোহাতে হচ্ছে তাকে? ভেতরটা তবুও বিরোধিতা করে উঠলো,
‘তুমি ভুল বলছো। আজ নাহয় চৈতন্য হারিয়ে বলেছে, একদিন ঠিক মুখ ফুটে বলবে।’
‘কি বলবে?’
দমে গেলো অভ্র। আসলেই তো! কি বলবে? ভালোবাসা তো দূর, ভালোলাগে এটাও কোনদিন বলবে না তানিয়া। কেন বলবে? কে হয় এই মেয়ে অভ্র’র? কেউনা! ঠিক’ই তো বলেছে। আজ সম্পূর্ণ নেশার ঘোরে ছিলো তানিয়া। নেশার বসে মানুষ তো কত কি করে, বলে! ওগুলো ধরলে চলে না! এবার অভ্র ও যেন বিদ্রুপ হাঁসলো। নিজের প্রতি তিব্র ঘৃনা জন্মালো অভ্র’র। রগগুলো ভেসে উঠলো আবারো। দপদপ করতে লাগলো কপালের শিরা-উপশিরা। আর কোনদিন অভ্র এই মেয়েকে নিয়ে ভাববে না। কোনদিন না! যাকে খুশি ভালোবাসুক, তাতে অভ্র’র আজ থেকে কিছু যাবে আসবে না। না, কিছুতেই না! চোখ বুজে ফেললো অভ্র। শ্বাস টানলো কয়েকবার। মাথাটা ব্যামোটা বড্ড জালাচ্ছে আজকাল!
দরজায় কেউ নক্ করতেই সম্বিত ফিরলো অভ্র’র। ডোগ গিলে কপালের ঘাম মুছে নিলো। নিচু কন্ঠে বললো,
‘আসুন।’
ঘরে প্রবেশ করলো একজন মেয়ে সার্ভেন্ট। হাতে একগ্লাস লেবু মেশানো পানি। মেয়েটি এসেই সৌজন্য হাঁসলো। অভ্র একপলক শক্ত চাহনি নিয়ে তানিয়ার দিকে তাকায়। সেদিকে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় বলে,
‘ওনাকে পানিটুকু খাইয়ে চেইঞ্জ করে দেবেন। ব্যাগে কাপর রাখা আছে।’
আর একসেকেন্ড এখানে দাড়ালো না অভ্র। দ্রুতপায়ে ত্যাগ করলো তানিয়ার রুম।
ড্রইংরুমে বসে আছে জেবা। মুখে হাঁসি নেই তার। বিষন্ন, নিচু মুখে বসে আছে সোফায়। দুনিয়ার সব কষ্ট যেন তাকে ধরেছে এমন একটা ভাব মুখে। পাশেই বসে জুঁই। সে জানে জেবার মন খারাপের কারণ। রাফিদের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে। রাফিদ সে-কথা জানিয়েছে জেবাকে। সেই থেকেই মন খারাপ জেবার। কিভাবে বলবে রাফিদের কথা জেবা? এখনো দু’ভাইয়ের বিয়ে বাকি! চোখে জল জমলো জেবার। বরাবরের মতো এবারেও আড়ালে মুছে নিলো তা। জুঁই সান্ত্বনা দিচ্ছে, তবুও জেবা বুঝছে না।
ইরহাম আজাদ এসে বসলেন সামনে। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে তাকালেন মেয়েদের দিকে। কখনো দুই মেয়েকে এভাবে চুপচাপ একসাথে দেখা যায় না। জেবাকে তো নয়ই। মরার মতো ঘুমোয় এখ। আজ কোনদিকে সূর্য উঠলো? ইরহাম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন মেয়েদের,
‘সকাল সকাল কি হয়েছে আমার ছানাদের?’
জুঁই বলতে চাইলো জেবার কথা। প্লান করেই এসেছে সে। সারাদিন ঝগড়া করলেও বোনের এই কষ্ট জুঁইয়ের সহ্য হয় না। এভাবে দেখলে নড়ে ওঠে ভেতরটা। রাফিদ আর জেবার কতবার মিল করিয়ে দিয়েছে সে! কত সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী জুঁই। রাতে দেখা পর্যন্ত করানোর ব্যাবস্থা করিয়ে দিয়েছে। সেই রাফিদকে অন্য কারো কিছুতেই হতে দেবে না জুঁই। জুঁই বলতে নিলেই,জেবা পাশ থেকে হাত ধরে সতর্ক করলো জুঁইকে। সে চায় না এখুনি জানাতে। আগে বড় ভাইয়ের বিয়ে হোক, তারপর দেখা যাবে। যদি আর এই ক’টা দিন রাফিদ অপেক্ষা না করতে পারে; তাহলে জেবা বুঝে নিবে রাফিদ তার ভাগ্যে নেই। ভাবলেই চোখে জল জমে জেবার। জুঁই বিরক্ত হলো। মরাকান্না কাঁদতে কি খুব ভালো লাগছে মেয়েটার? আরে বাবা এতো কাঁদার সখ তো দূরে গিয়ে কাঁদ! জুঁইকে রাতেও মারাত্নক বিরক্ত হয়েছে জেবা। একপর্যায়ে তো উঠে এসে বলতে চেয়েছিলো সবকথা ইরহামকে। জেবা তখনো থামিয়েছে। নিজে কেঁদেছে, জুঁইকেও ঘুমাতে দেয়নি। গল্প জুড়েছিলো তাদের প্রেম-প্রকৃতির! ঘুমুঘুমু চোখ সব শুনতে হয়েছে জুঁইকে। অভ্র থাকলে সে বলেই দিতো! চুপচাপ বিরক্ত মুখে বসে রইলো জুঁই। জেবা নিজেকে সামলায়। জিজ্ঞেস করলো ইরহামকে,
‘আব্বু, ভাইয়ার বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে না?’
সজল হাঁসলেন ইরহাম। খবরের পাতায় চোখ রেখেই বললেন,
‘ঠিক হয়নি এখনো। কথা বলা দরকার।’
জেবার চোখ ছলছল করে ওঠে। এখনো ঠিক হয়নি? আর কবে ঠিক হবে? ততদিন কি থাকবে তার জন্য রাফিদ? থাকবে না! এইতো বললো তার মা কতগুলো মেয়ের ছবি তাকে দিয়েছে। দেখতে বলেছে কাকে পছন্দ! জেবা হুট করে রেগে উঠলো। চোখের সাদা অংশ লালচে আভায় ছেঁয়ে গেলো। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো জেবা। ক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠলো,
‘একজনের বিয়ে দিতেই বছর পার করিয়ে দাও! আমরা তো বড় হচ্ছি না! আমাদের তো বিয়ে দিতে হবে না! চলুক এভাবেই!’
বলেই দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলো জেবা। কথাগুলো বলতে বলতে সে কেঁদে ফেলেছে। প্রণয় বিরহ কত কষ্টের কেউ বুঝবে? একটা মানুষকে ভালোবাসার পর তার পাশে অন্য কাউকে ইমাজিন করলেও বুকের পাজর মুঁচড়ে ওঠে। কষ্ট হয়! তার কষ্ট কে বুঝবে?
ইরহান যেন থমকে গেলেন মেয়ের আচরণে। বরাবরই জেবা শান্ত; সেই ছোট থেকে। দুই মেয়ের মাঝে জুঁই হলো ছটফটে। এমন শান্ত মেয়ের আকম্মিক এই আচরণে তিনি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
মেয়ের গলা শুনে ছুটে এলেন ইলিমা। তিনি সবটাই শুনেছেন। তার বুঝতে বাকি নেই, মেয়ের এমন আচরনেট কারণ!
বেলা বারোটা। কাঠফাটা রোদ বাইরে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো তানিয়া। শরীর এখনো দূর্বল। একটু আগে তুর্য এসেছিলো। ওরা ইনানী সি বিচ যাচ্ছে। তানিয়া যাবে নাকি জিজ্ঞেস করতে এসেছিলো। তানিয়া না করে দেয়। ওরা বেড়িয়ে গেছে আরও ঘন্টা তিনেক আগে। আচ্ছা, অভ্র ও কি গিয়েছে? কাল রাতের ঘটনা আবছা মনে পড়ে তানিয়ার। ভাবলেই ব্যাথায় বিষিয়ে উঠলো মাথাটা। কি হয়েছিলো? সে তো বারে ছিলো। এখানে এলো কি করে? কাপড় কে বদলে দিয়েছে ওকে? সব ঝাপসা! তানিয়া এ বিষয়ে ভাবলো না। একপলক পাশে অভ্র’র বেলকনির দিকে তাকালো তানিয়া।
অভ্র হয়তো ওদের সাথে গেছে। নাহলে একবার দেখা করতে আসবে না? অভ্র এতোটাও কঠিন নয়! তানিয়া দূরে তাকালো। সমুদ্র ঢেউ খেলায় মেতেছে। মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। তপ্ত দুপুর; এটাই তো পার্ফেক্ট সময় বিচে ঘোরার। তানিয়া একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে দূরে। এরপর রুমে আসে তানিয়া। দমবন্ধ লাগছে রুমটাতে। একটু নিজেকে দেখে নিলো আয়নায়। এরপর বেড়িয়ে এলো রুম থেকে। হোটেল থেকে বের হয়ে তানিয়া সমুদ্রের দিকে এগোয়। নীল-সাদা বিরাট আমব্রেলা কতগুলো পরপর সারি করে সাজানো। সেগুলোর নিচে চেয়ার পাতা। তানিয়া গিয়ে বসলো সেখানে।
মিনিট কয়েক পড়ে তানিয়া উপলব্ধি করলো, এখানে ভালে লাগছে না তার। উঠে দাড়ালো তানিয়া। ভেবেছিলো এতো মানুষের ভীরে থাকলে ভালো লাগবে। কিন্তু তার ভাবনা সম্পূর্ণ ভূল! কোলাহলে মাথার যন্ত্রণা বাড়ছে আরও। তানিয়া হোটেল মুখো হতেই চোখ পড়লো তাদের বেলকনির দিকে। তানিয়াকে দেখে ছায়ামূর্তি সরে গেলো বেলকনি থেকে। তবে কি অভ্র যায়নি?
আধারে ঢাকা চারপাশ। সোডিয়ামের নিয়ন আলো থেকে বেশ দূরে দাড়িয়ে রুদ্র। দু’হাত পকেটে গুঁজে দৃষ্টি সামনে তার। রাতের নিস্তব্ধতার সাথে ঢেউয়ের শব্দ রোমাঞ্চকর করে তুলছে চারপাশ। হিমেল ঠান্ডা হাওয়ায় স্লিকি চুলগুলো উড়ছে রুদ্র’র। কয়টা বাজতে চললো? একটা? হয়তো! নয়তে তারও বেশি। রুদ্র ফোন কিংবা ওয়াচ আনেনি। রুম থেকে যখন বেরিয়েছিলো তখন সারে এগারোটা বাজে। এখানে দাড়িয়ে আছে ঘন্টাখানেকের বেশি হবে। এখনো এই মেয়ের আসার নাম আছে? নাকি ঘুমিয়ে পড়লো আবার? আজ আরু ঘুমিয়ে পড়লে কিছু কঠিন কথা শোনাবে আরুকে রুদ্র। এই মেয়ের এতো ঘুম আসে কিভাবে? আজকের দিনটাও কেমন অসহ্যকর। অফিসের স্টাফদের সামনে না পারছিলো আরুর সাথে কথা বলতে, আর না পারছিলো একটু সময় কাটাতে। রুদ্র এবার বিরক্ত হলো খানিক। ফরফর করে মাথার উপরের আমব্রেলাটা উড়ছে। রুদ্র পাতা ইজি চেয়ারটায় বসলো। দৃষ্টি তখনো সামনে।
কাঁপা কাঁপা পায়ে এসে দাঁড়ালো আরু। গায়ে ওড়না জড়ানো। ঠান্ডা হওয়ায় শরীর কাঁপছে। না, শীত পড়েনি। এই রাতে একলা বেড়িয়েছে বলেই ভয়ে শীতটা একটু বেশিই লাগছে। আরু রুদ্র’র পেছনে। রুদ্র গভীর ভাবনায় ডুবে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। মৃদু গলায় ডাকলো আরু,
‘শুনছেন?’
রুদ্র’র বুকে তিরের মতো বিধলো কথাটা। সাথেসাথে পিছনে তাকালো রুদ্র। জীর্ণশীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে আরু। মরুভূমির বুকে একপশলা বৃষ্টি নামলো যেন। মনের উত্তাপ ফিকে পড়ে গেলো রুদ্র’র। রুদ্র হাঁসলো। এই পিচ্চি মেয়েটা মাত্র কয়েকদিনেই মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে রুদ্র’কে। প্রথম যেদিন দেখেছিলো আরুকে, অসভ্য ভেবেছিলো আরুকে রুদ্র। আবার আগ্রহও ছিলো। একজন পুলিশ কনস্টেবল এর মেয়ে নিশ্চয়ই এমন নয়! এমন হওয়ার কথাও নয়। ওরা ভীষন অহংকারী টাইপ হয়! দম্ভী আগ্রহ রুদ্র এড়াতে পাড়লো না। বাইরে এসে নিজ গাড়িতে বসে অপেক্ষায় রইলো আরুর। আরু বেরোতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো রুদ্র। রেস্টুরেন্টের গাইয়া, এয়ো মেয়েটা আর গাইয়া নেই। স্বাভাবিক, স্বচ্ছল সাজে বেড়িয়েছে। এভাবে ভোল পাল্টে এসেছিলো কেন এই মেয়ে? আগ্রহ যেন তরতর করে বাড়লো রুদ্র’র।
খুবই সন্তোর্পণে পিছু নিয়েছিলো আরুর। বোকা আরু বোঝেনি। বস্তিতে খাবারগুলো দিতে দেখে, রুদ্র’র মনে প্রথম কোন মেয়ের প্রতি ভালোলাগা কাজ করলো। কিন্তু তার সামনে এমন করছিলো কেন মেয়েটা? রুদ্র’কে কি পছন্দ হয়নি? রুদ্র আগের সিদ্ধান্তে ফিরে গেলো আবারো। সে এই বিয়ে করবে না। মেয়েটা তো তাকে পছন্দ করেনি! তাহলে এই সম্পর্ক আগানোর কোন মানে হয় না! রুদ্র বাড়ি ফিরে গেলো। বাড়ি ফিরতেই ইলিমা আরুর কথা জিজ্ঞেস করলেন। না চাইতেও প্রশংসা করে বসলো রুদ্র। কোন কাজে মন দিতে পারলো না সেদিন। আরুর ব্যবহারগুলো ক্ষনে ক্ষনে ভাবাতে লাগলো রুদ্র’কে। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে কোনদিন রুদ্র নড়েনি। সেদিন নড়েছিলো। তার মাকে বলেছিলো মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। সেদিনই দেখতে যাওয়া হলো আরুকে। আরেকবারের মতো বুকে বিধলো আরুর টলমলে দু’টি চোখ। ওই চোখে সবসময় সমুদ্রের জোয়াড় দেখে রুদ্র। প্রথম দেখায় ভেবেছিলো আরু কাঁদছে। তারপর বুঝলো না, এই টলমলে গভীর দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আরুকে অপরুপ করে বানিয়ে পাঠিয়েছেন ধরনীতে। রুদ্র চোখে হাঁসলো। সেই টলমলে আঁখি জোড়ার মালিক এখন তার। নিজের, একান্ত আপন। চাঁদের ম্লান আলো মুখে পড়েছে আরুর। এখনো দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। নরম গলায় ডাকলো রুদ্র,
‘এদিকে এসো।’
আরু গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালো রুদ্র’র সামনে। আগের মতো সে এখন রুদ্র’র সামনে এলে ছটফটে মেয়ে হয়ে থাকতে পারে না। চেয়েও পারে না। ভেবেচিন্তে কথা বলে। বুকটা টিপটিপ করে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। রুদ্র যখন তীক্ষ্ণ নজরে আরুর মুখপাণে চেয়ে থাকে, মাথা তুলতে লজ্জা পায় আরু। মাথা নামিয়ে স্যাতস্যাতে বালির দিকে তাকালো আরু।
‘এখানে বসো।’
চেয়ারে হাত রেখে বললো রুদ্র। বিরাট ইজি চেয়ার। আরু পাশে বসলো। আবারো মাথা নিচু করে নিলো। অন্যদিনের তুলনায় আজকের লজ্জার পরিমাণটা দুইগুন বেশি। কেন? নিজেকে ঘাটিয়েও আরু জবাব পেলো না।
রুদ্র অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আরুর দিকে। তৃষ্ণা জাগে টলমলে চোখদুটো দেখতে। কিন্তু মেয়েটা এসেছে থেকে মাথা নিচু করে আছে। এতো লজ্জাবতি কবে থেকে হলো আরু? রুদ্র ফের ক্ষীণ গলায় ডাকলো,
‘অরোনিতা!’
‘হু?’ জবাব দিলো আরু। রুদ্র’র মুখে ‘অরোনিতা’ নাম শুনে বরাবরের মতোই শ্বাস আঁটকে এলো আরুর।
‘এদিকে তাকাও।’
আরু তাকালো না। যেন শুনতে পায়নি রুদ্র’র কথা সে। বরং-চ আরেকটু নিচু হলো আরও। রুদ্র আরুর থুতনিতে হাত রেখে মাথা তোলে। আরু তাকায় রুদ্র’র দিকে। টলমলে চোখদুটো চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। তৃপ্ত চোখে চেয়ে রইলো রুদ্র। এই তৃষ্ণা কি কোনদিন মিটবে রুদ্র’র? রুদ্র চাইছে সময়টা থেমে যাক। অপলকভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকুক আরুর দিকে। আরুকে দেখার তৃষ্ণা ইহজনমে না মিটুক! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেয়ে থাকতে চায় এই চোখে রুদ্র। শেষ নিশ্বাস ফেলার আগ পর্যন্ত পাশে চায় উড়নচণ্ডী মেয়েটাকে!
‘কি দেখছেন?’
নতজানু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আরু। রুদ্র’র ঘোর কাটে। ওই চোখে চেয়ে থাকলে সম্মোহিত হয়ে যায় রুদ্র। আরুর দিকে দৃষ্টি অনড়ভাবে তাকিয়ে ফিচেল গলায় বললো,
‘বউকে দেখছি।’
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো আরু। কান গরম হয়ে উঠলো রুদ্র’র কথায়। আসলেই লোকটার লাজলজ্জা নেই। কোন কথা মুখে বাঁধে না। চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো আরু।
‘কি হলো?’
আরু তাকায়। জিজ্ঞেস করে,’কই কি হলো?’
‘তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো, বউ?’
রুদ্র’র ইচ্ছে করে টিটকারি করা কথাটাতেও মইয়ে গেলো আরু। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো আরুর মুখ। রুদ্র একটানে কাছে আনে আরুকে। ঘেঁষে বসায় নিজের পাশে। লজ্জায় রাঙা মুখের দিকে তাকিয়ে আনমনে হাঁসে ওঠে রুদ্র। এই টুকটুকে লাল বউটা নাকি রুদ্র’র! ভাবা যায়? রুদ্র দূরে তাকালো। নির্মল গলায় বললো,
‘কাল আমরা চলে যাব অরোনিতা।’
রুদ্র’র কথায় হাহাকার করে ওঠে আরুর বুক। চলে যাব! তারমানেই তো রুদ্র’র থেকে দূরে চলে যেতে হবে। দেখা হবে দিন-তারিখ ঠিক করে। এই ঘোরাঘুরির পর আহমেদ সাহেব কি রাজি হবেন আর দেখা করতে দিতে? চোখ ছলছল করে উঠলো আরুর। ম্লান আলোয় তা স্পষ্ট দেখতে পেলো রুদ্র। মন যে তারও খারাপ! কিন্তু করার-ই বা কি আছে?
আরু ভীরু গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কালকেই?’
মাথা নাড়ে রুদ্র। আরু আরও ঘেঁষে বসে রুদ্র’র পাশে। দু’বাহুতে আগলে কাছে টেনে নিলো রুদ্র। দু’জনে নিরব! অথচ ভেতরে ঝড় উঠেছে। দগ্ধ হয়ে উঠছে হৃদয়। কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? কয়েকদিন পরই তো তারা এক হবে। তবুও এই কয়েকদিনের দূরুত্ব ক্ষনে ক্ষনে পোড়াবে আরুকে, রুদ্র’কে। আরু চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলো না৷ জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘আরেকদিন থাকা যায় না, রুদ্র?’
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ যে সম্ভব নয়! আরুকে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো রুদ্র। উষ্ণ বুকে মাথা গুঁজে চোখ বোজে আরু। এই শান্তিটুকু আরু প্রতিদিন চায়। রুদ্র আরুর মাথায় হাত রাখে। নিবিড় কন্ঠে বলে,
‘আমরা তো নিয়মিত দেখা করবো। কথা হবে প্রতিদিন। আর কয়েকদিন পর তো আমরা এক হচ্ছি’ই। দুঃখ পেয়ো না অরোনিতা। এখনো একসাথে কত পথ চলা বাকি আমাদের!’
‘সারাজীবন আপনি এভাবে ভালোবাসবেন তো আমায়, রুদ্র?’
রুদ্র যেন থমকায়। নিজেকে সামলে চুমু খায় আরুর চুলে। শিতল গলার বলে,
‘আমার সবটাই যে তুমি অরোনিতা!’
আরু মাথা তোলে। ছলছল চোখে তাকায় রুদ্র’র দিকে। আরু কাঁদো কাঁদো গলায় প্রশ্ন ছোড়ে,’সত্যিই?’
আরুর চোখে পানি দেখে ভেতর কেঁপে ওঠে রুদ্র’র। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বুজে নিবিড় গলায় বলে,
‘সন্দেহ হয়?’
আরু ঝটপট মাথা নাড়ে। যার অর্থ না। কপালে গাঢ় চুম্বন করলো রুদ্র। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যায় আরুর। আবারো রুদ্র’র বুকে মাথা গোজে। এই মানুষটার সাথে অনেকদূর যেতে চায় আরু। সুন্দর সুন্দর মুহুর্তের সাক্ষী হয়ে থাকতে চায়। একসাথে বৃদ্ধ হতে চায়। মরার আগ অব্ধি রুদ্র’র গলায় শুনতে চায়,’ভালোবাসি!’
সকাল সাতটায় বাস এসে থামলো হোটেলের সামনে। আজকে চলে যাবে সবাই। নিজের ব্যাগ গোছগাছ করে সবাই দাঁড়িয়ে। আরু আজ বেশ স্বাভাবিক সাজে। আরু বুঝেছে, রুদ্র ওমন সাজগোজ মোটেও পছন্দ করে না। তাইতো সেদিন আরুকে ‘কেমন লাগছে’ এর উত্তর রুদ্র দেয়নি। আজ ঠোঁটে লিপস্টিক ও দেয়নি আরু। অফিসের সবার সাথেই কালকে বেশ সখ্যতা হয়ে উঠেছে আরুর। রুদ্র ট্রিট ও দিয়েছে কাল। তাছাড়া, এমন ছটফটে মেয়েকে কার না ভালো লাগে? আরু আঁড়চোখে একবার রুদ্র’কে দেখলো। করিম সাহেবের সাথে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা করছে রুদ্র। লোকটা মাস্ক পড়ে না কেন? কত মেয়ে আশেপাশে!
তানিয়া সবার শেষে এসে দাঁড়ালো। চোখেমুখে বিষন্নতা। কালকে গোটা দিনটা অভ্র তার সামনে আসেনি। কথাও বলেনি। তানিয়া আশ্চর্যন্বিত হয়েছে। তানিয়াকে তো সহ্য করতে পারে না অভ্র। কত রাগ! হঠাৎ কি ভালো মানুষ হয়ে গেলো অভ্র? তানিয়া ভেবেছিলো, ইচ্ছে করেই বাধ্যতামূলক বলেছিলো এই ট্রিপ অভ্র। যাতে এখানে এসেও অপদস্ত করতে পারে। তাহলে এতো ভালোমানুষ কবে থেকে হলো অভ্র? একবার চারিদিকে দেখে নেয় তানিয়া। না! অভ্র নেই।
তুর্য এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তানিয়ার পাশে। মুখে অপরাধী অপরাধী ভাব। তানিয়া তুর্য’কে দেখতেই চোখমুখ শক্ত করে অন্যদিকে ফিরলো। কালকে তুর্য’র বলা মিথ্যে বুঝে ফেলেছে তানিয়া। আর দেখো, এসে কেমন চুপ করে আছে! কিছু বলে না কেন এই ছেলে? তানিয়াই গম্ভীর গলায় শুরু করলো,
‘স্পেশাল ওয়ান এর মানে আপেল তাইনা?’
তুর্য একপলক তাকালো তানিয়ার দিকে। আবারো মাথা নামিয়ে নিলো। তানিয়ার তুর্য’র এহেম কান্ডে হাঁসি পেলো। কষ্টে চেপে নিলো তানিয়া। আগের মতো গম্ভীর হওয়ার ভান ধরলো। এই ড্রিংক এর জন্যই কাল কিছু একটা ঘটেছে। এমন কিছু, যা ঘটা উচিত ছিলো না। তানিয়া গম্ভীর গলায় বললো তুর্য’কে,
‘কালকের ওই আপেল আর লেবুর বিদঘুটে শরবতটা হুইস্কি ছিলো তাই না?’
‘হু।’ ছোট করে জবাব দিলো তুর্য। মাথা তখনো পিচঢালা রাস্তার দিকে স্থির।
‘কালকে কি হয়েছিলো? আমি ঘরে কি করে গেলাম?’
তুর্য মাথা তুলে তাকালো। তানিয়ার প্রশ্ন উপেক্ষা করে নতজানু গলায় বলে উঠলো,’সরি, আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ওটা খাওয়াতে চাইনি।’
‘এটা আমার প্রশ্ন ছিলো না। কি করেছি কাল আমি?’
সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করলো তানিয়া। তাকালো তুর্য’র দিকে। না শোনা পর্যন্ত ভালো লাগছে না তানিয়ার। একদিনে অভ্র এমন চুপ হয়ে যাবে কেন? সেই কারনটাই তানিয়া জানতে চায়। তুর্য চারপাশে চোখ বুলিয়ে কারো উপস্থিতি দেখে নিলো। নিচু গলায় বললো,
‘কাল আপনি নেশার ঘোরে স্যারকে আই লাভ ইউ বলেছেন। স্যারকে দেখে মনে হয়েছিলো বেজায়..’
‘ওয়েট ওয়েট!’ শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠ তানিয়ার। একটু দম নিলো সে। আবারো জিজ্ঞেস করলো,’কি বলেছিলাম?’
‘আই লাভ ইউ!’
চমকে উঠলো তানিয়া। গলা শুকিয়ে এলো এবারে। কি বললো তুর্য? সত্যি নাকি কথাটা? মিথ্যেই বা কেন হতে যাবে? চারপাশ ঘোলা হয়ে আসতে লাগলো তানিয়ার। হৃদপিণ্ড লাফাতে লাগলো তিব্র গতিতে। এবার? কোনমুখে সামনে যাবে তানিয়া অভ্র’র?
নিষিদ্ধ অনুভূতি পর্ব ২৩+২৪
‘সবাই উঠে বসুন।’ করিম সাহেবের গলায় ভাবনার সুতো ছিড়লো তানিয়ার। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে অভ্র’কে খুঁজলো। ওইতো লোকটা! চোখ সরিয়ে দ্রুত গিয়ে বসে পড়লো তানিয়া। তুর্য বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো কিয়ৎপরিমাণ সময়। এরপর সে-ও উঠে গিয়ে বসলো তানিয়ার পাশে।
তানিয়া রীতিমতো কাঁপছে। শ্বাস ঘন হয়ে আসছে। যে করেই হোক অভ্র’কে সে সরি বলবে। অফিসে গিয়েই বলবে! তানিয়া উত্তেজনা, ভয়ের কারনে পাশে বসা তুর্য’কে তানিয়া খেয়াল করলো না। তবে তানিয়া না করুক, করেছে অন্য একজোড়া চোখ!
