মোহশৃঙ্খল পর্ব ৩
মাহা আয়মাত
দরজায় একের পর এক ধাক্কা…ঘুমচোখে চমকে ওঠে মেহজা। চোখমুখ কুঁচকে ওঠে তার অজান্তেই। বিরক্তি আর একটা চাপা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে চেহারাজুড়ে।আবার ধাক্কা। এবার সে চোখ মেলে দেখে—দিনের আলো ঘরে ঢুকে পড়েছে। রাত কেটে গেছে। হঠাৎ ঘরের চারপাশটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের সামনে ছায়া ছায়া ভাবে ফুটে ওঠে রাতের সেই স্মৃতি। এক মুহূর্তে শরীরটা কেঁপে ওঠে—ব্যথায়, ঘৃণায়… আর এক ভয়ংকর বোধে।
সে তড়াক করে উঠে বসে, কিন্তু শরীরটা যেন বিদ্রোহ করে ওঠে। তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ বেরিয়ে যায় ঠোঁট ফুঁড়ে। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে বসে মেহজা। সারা শরীর যেন একটা কুৎসিত ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে। ওয়াশরুমের ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ—বুঝতে আর বাকি থাকে না, আরভিদ ভেতরে আছে। আশপাশে কেউ নেই, যেন এই ঘরটাও কোনো কারাগার, আর সে এখানে বন্দি। শরীরটা ঢেকে একটা কম্বল জরিয়ে দরজার দিকে এগোয় সে। কণ্ঠটা কাঁপে না, কিন্তু শব্দে একটা অবজ্ঞা মিশে থাকে।
— কে?
ওপাশ থেকে ভেসে আসে নারীকণ্ঠ। ঠাণ্ডা, অভিজাত ও কর্তৃত্বপূর্ণ—তাহিয়া কারদার।
— মেহু, আমি তোমার মামানি। তুমি আর আরভিদ রেডি হয়ে নিচে এসো। সবাই তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর আবার মেকআপ আর্টিস্ট আসবে, তোমাকে রেডি করাতে।
মেহজার ঠোঁটে ঝাঁজালো বিরক্তি। তবুও গলা নরম করে নেয়,
— মামানি, আমি রেডি হয়ে আসছি।
— আচ্ছা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যায় করিডোরের দিকটায়।মেহজা কাভার্ডের দিকে পা বাড়াতে যাবে ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা খুলে যায়। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো আরভিদ—শুধু কালো ট্রাউজার পরা। ওলফ ছাঁট ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে, জিমে গড়া লোমহীন বুকের ওপর ঝলমল করছে জলবিন্দু।
অনেকের কাছে এই দৃশ্য আকর্ষণীয় হতো—কামনাবিধুর। কিন্তু মেহজার চোখে আরভিদ এখন ঘৃণার এক জীবন্ত প্রতিমা। চোখে বিষ ঢেলে তাকিয়ে থাকে সে, কিন্তু আরভিদ নির্বিকার। হালকাভাবে চুল মোছে, কাভার্ড খুলে একটা সবুজ জরজেট শাড়ি বের করে। স্টোনের কাজ করা ঝলমলে কাপড়টা বাড়িয়ে দেয় মেহজার দিকে।
— শাওয়ার নিয়ে এটা পরে নিস।
মেহজার চোখে এবার আগুন জ্বলে ওঠে। তবুও রাগটাকে গিলে ফেলে সে। কোনো মতে শাড়িটা হাত থেকে নিয়ে হাঁটতে থাকে ওয়াশরুমের দিকে। ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে আসে আরভিদ কালোর টি-শার্ট পড়তে পড়তে বলে,
— ব্ল্যাংকেট নিয়ে যাচ্ছিস কেন ওয়াশরুমে?
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে, বিষমাখা গলায় বলে ওঠে,
— আপনার রাতের লুচ্চামির জন্য!
আরভিদ হেসে ফেলে,
— তাড়াতাড়ি বের হোস।
ওয়াশরুমে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে থেমে যায় মেহজা। হঠাৎই ফিরে তাকায়, রাগে গর্জে ওঠে,
— কেন? তাড়াতাড়ি বের হয়ে আপনাকে দাফন দিতে যাবো?
বলেই দরজাটা ধপ করে লাগিয়ে দেয়। আরভিদ ঠোঁটে মুচকি হাসি রেখে নিজে রেডি হতে থাকে। সময় গড়ায়। মিনিট কুড়ি, তিরিশ… পঁইচাল্লিশ। ওয়াশরুম থেকে মেহজা বের হয় না। বিরক্ত হয়ে এবার আরভিদ ধাক্কা দেবে দরজায়, ঠিক তখনই মেহজা বেরিয়ে আসে।
আরভিদের নিঃশ্বাস আটকে যায় এক মুহূর্তের জন্য।
দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে আছে মেহজা—সবুজ জরজেটের শাড়িতে মোড়া, যেন কোনো বিষণ্ন জলপরি। শরীরটা আধভেজা, ভেজা চুল থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে ঘাড় বেয়ে। চোখের পাপড়ি স্নিগ্ধ জলে ভেজা, ঠোঁটের হালকা ঘোলাটে হয়ে গেছে। গলায়, বুকের কাছজুড়ে জমেছে কুয়াশার মতো জলবিন্দু।
আরভিদ তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে—পলকহীনভাবে।হঠাৎই মেহজা থেমে যায়। আরভিদকে সামনে দেখে এক মুহূর্তের ভয় খেলে যায় শরীরে। কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। মুখ ঘুরিয়ে বলে,
— সরুন। এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আরভিদ সরে না। বরং এগিয়ে এসে তাকে হেঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনে। মেহজা ভারসাম্য হারিয়ে তার বুকে এসে পড়ে। আরভিদ নিঃশব্দে দেখতে থাকে মেহজাকে। হঠাৎ তার চোখ পড়ে মেহজার গলায় আর বুকে—সেখানে তারই আঁকা চিহ্ন। লালচে, বেগুনি, কিছুটা ফুলে থাকা। কামনার দাগ।
সেই চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে আরভিদের চোখ জ্বলে ওঠে। তার ইচ্ছে হয়—সেগুলোকে আবার রক্তাক্ত করে দিতে। আরও গভীর দাগ, আরও গভীর শ্বাস। তিনে দুইয়ে আর দ্বিধা রাখে না সে। নিজেকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে আসে, মেহজার বুকে থাকা দাগে ঠোঁট চেপে ধরে। এক চুম্বন, তারপর হঠাৎ কামড় বসিয়ে দেয়।
মেহজার মুখ বিকৃত হয়ে যায় ব্যথায়। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। আরভিদ মেহজার চোখে চোখ রেখে নরম, গভীর স্বরে জিজ্ঞেস করে,
— ব্যথা পেয়েছিস, রেডলিপ?
মেহজা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দে। তার দৃষ্টিতে জমে থাকে হাহাকার, অথচ মুখে একফোঁটাও শব্দ নেই। আরভিদ আবার বলে,
— পেলেও কিছু করার নেই, অভ্যাস বানিয়ে নে। আমার আদরও আমার মতোই টক্সিক—নরম করে আসে না, বরং পুরো শরীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিঃশ্বাস আটকে দেয়, রক্ত গরম করে তোলে।
এক মুহূর্ত নীরবতা ভেদ করে মেহজা আরভিদের চোখের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে,
— আপনি মানুষ না… আপনি এক ধরণের অসুখ।
আরভিদ হালকা হেসে মাথা ঝাঁকায়।
— হ্যাঁ, আমি অসুখ। এমন এক বিষ, যা তোর শিরা-উপশিরায় ঢুকে গেছে। এমন এক যন্ত্রণা, যা তুই নিজে চাইলেও ছুঁড়ে ফেলতে পারবি না। আমি হিংস্র, আমি পাগল। আমি তোর সমস্তটাকে ভেঙে ফেলতে চাই—আর সেই ভাঙা প্রতিটি টুকরোতেই নিজেকে খুঁজে নিতে চাই।
মেহজা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরভিদের দিকে। তার মনে প্রশ্ন জাগে—এই মানুষটা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে কীভাবে? কী অপরাধ ছিল তার? কী এমন ভুল করেছিল, যে তাকে এমন জীবন, এমন সঙ্গী তার জন্য নির্ধারিত—যে ভালোবাসার নামে শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, কষ্ট দেয়, বোঝার চেষ্টাটুকুও করে না?
আরভিদও মেহজার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে গভীর দৃষ্টিতে। এক অদ্ভুত নীরবতা ছেয়ে যায় তাদের মাঝখানে। ঠিক তখনই দরজায় ধীরে ধাক্কা পড়ে। নরম কণ্ঠে মেইড বলে ওঠে,
— স্যার, আপনাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
মেহজা ধীরে চোখ ফিরিয়ে নেয় আরভিদের দিক থেকে। আরভিদও তার দৃষ্টি সরিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলে,
— আসছি।
মেইড নিঃশব্দে সরে যায় দরজা থেকে। আরভিদ আবার মেহজার দিকে তাকায়। তার ঠোঁটে খেলে যায় এক ক্ষীণ মুচকি হাসি। তারপর ধীরে বলে ওঠে,
— বাই দ্য ওয়ে, মিসেস আরভিদ কারদার… ইউ’আর রিডিফাইনিং এলিগ্যান্স টুডে।
মেহজা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নেয়। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আবার চোখ মেলে বলে,
— আমি নিচে যাচ্ছি। মামানি অনেকক্ষণ আগেই এসে ডেকে গেছে।
একথা বলে মেহজা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। আরভিদও তার পিছু নেয়। সিঁড়ির ধারে এসে হঠাৎ আরভিদ মেহজার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয়। মেহজা হতবাক—না কিছু বলতে পারে, না হাত ছাড়িয়ে নিতে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওদের দেখে তাহিয়া কারদার বলে ওঠেন,
— এই যে, ওরা দুজন এসেছে।
সবাই তাকায় তাদের দিকে। ওরা এসে লিভিং রুমে দাঁড়ায়। আভীর কারদার হেসে বলেন,
— দুজনকে বেশ মানিয়েছে।
তখনই আফির কারদারের স্ত্রী—নাজনীন কারদার তির্যক হাসি দিয়ে বলে,
— কী যে বলেন ভাইয়া! আরভিদের পাশে মেহজাকে দেখে মনে হচ্ছে, ডায়মন্ডের পাশে কাচ। কোথায় আমাদের আরভিদ, আর কোথায় এই মেহজা!
— নো, মম। দ্যাট ওয়াজ আনকোল্ড ফোর।
সবাই অবাক হয়ে তাকায় সিঁড়ির ওপরে। কাচের ব্যালাস্ট্রেডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সুদর্শন পুরুষ। তার চেহারা নিখুঁত ভারসাম্যের মিশেল-শীতল, গভীর এবং স্থির। ছয় ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতা, জিমে গড়া দৃঢ় দেহ। চোখগুলো গভীর নীল, হালকা টানানো আলমন্ড আকৃতির, রহস্যময়। ঘন, বাঁকা ভ্রু চোখের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। নাক সোজা, তীক্ষ্ণ, কিন্তু কোমল রেখায় গড়া। ঠোঁট পাতলা নয়, না খুব মোটা-একটু গোল এবং হালকা বাঁকা, যা মিলিয়ে নিখুঁত ভারসাম্য তৈরি করে।
গালের নিচের হাড়ের রেখাটি অত্যন্ত শার্প, ধারালো এবং স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। চোয়ালটি চওড়া নয়, বরং নিচের দিকে সরু হয়ে গিয়ে একটি পরিপাটি V-আকৃতি ধারণ করেছে—যাকে বলে একটি নিখুঁত টেইপার্ড জ-লাইন। তীক্ষ্ণ চোয়ালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চাপ দাঁড়ি তার ব্যক্তিত্বকে করেছিল আরও দৃঢ়। ঢেউ খেলানো, মাঝারি দৈর্ঘ্যের কালো এলোমেলো চুল তার আকর্ষণ বাড়িয়েছে। ফর্সা ত্বকে টিশার্ট আর টাউজারে তার উপস্থিতি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ঠোঁটে লেগে থাকা সেই রহস্যময়, মোহময় হাসিটি যেন চোখকে আটকে রাখে। একবার চোখ পড়লে সেই হাসির উপর সহজে আর চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।
আফির কারদার ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— আদ্রিক, তুমি না বলেছিলে আরও দু’দিন পর আসবে?
আদ্রিক সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,
— বলেছিলাম ড্যাড। কিন্তু নিজের বন্ধুর মতো ভাইয়ের বিয়েতে থাকতে না পারলেও রিসেপশনটা তো মিস করা যায় না।
তাহিয়া কারদার হেসে বলেন,
— একদম ঠিক করেছো।
আদ্রিক এসে মেহজার দিকে তাকিয়ে মজা করে বলে,
— অবশেষে তুমি মিস মেহজা তালুকদার থেকে মিসেস মেহজা আরভিদ কারদার হয়েই গেলে?
মেহজা একবার আরভিদের দিকে, তারপর আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে হেসে দাতে দাত চেপে বলে,
— আপনার বন্ধুর মেহেরবানিতে।
আদ্রিক হেসে ওঠে। আরভিদ প্রশ্ন করে,
— কখন এসেছিস?
— রাতেই।
আভীর কারদার চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলে ওঠেন,
— আমার প্রিন্সেস কোথায়? সে কি এখনো ঘুমিয়ে?
তাহিয়া কারদার বলেন,
— আপনার মেয়ে হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছে।
আভীর কারদার হাসতে হাসতে বলেন,
— থাক ঘুমাক, আমার মা’টাকে একদম জ্বালাবে না।
তাহিয়া কারদার বলেন,
— ঠিক আছে, এখন সবাই চল খেতে।
সবাই ডাইনিং রুমে যায়। হঠাৎ অর্তিহা এসে হাজির হয়। চোখের দৃষ্টিতে আটকে যায় আদ্রিক—সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে।
আভীর কারদার মৃদু হেসে বলেন,
— প্রিন্সেস, ঘুম কেমন হলো?
অর্তিহা এক ঝলক আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,
— ভালো, ড্যাড।
— আদ্রিকের পাশের চেয়ারটা খালি। ওটাতেই বসে পড়ো।
অর্তিহা চুপচাপ গিয়ে বসে পড়ে। খাওয়া শেষে মেহজা একা রুমে ফিরে আসে। একা বসে ভাবে—এই লড়াই সে কিভাবে লড়বে, কারণ মেহজা মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার মেয়ে নয়।
ঠিক তখনই দরজায় নক হয়। বিরক্ত হয়ে বলে,
— ভেতরে আসুন।
ভেতরে ঢোকেন নাজনীন কারদার, সঙ্গে দুজন মেকআপ আর্টিস্ট। চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
— আরভিদ নেই?
মেহজা বিরক্ত হলেও নিজেকে সংযত করে বলে,
— না।
নাজনীন একটু ভাব নিয়ে বলেন,
— আমি তো ভেবেছিলাম আরভিদ আছে রুমে, তাই নক করেই ঢুকলাম। নাহলে তুমি কে? যে তোমার কাছ থেকে পারমিশন নেবে, কারদার ম্যানরের ছোট বউ নাজনীন কারদার?
মেহজা এবার আর চুপ থাকতে পারে না। দাঁড়িয়ে বলে,
— আমি আপনার থেকে বেশি আপন এই বাড়ির। এটা আগে আমার নানাবাড়ি ছিলো, এখন তো শ্বশুরবাড়ি। সুতরাং এমন ছাগল মার্কা প্রশ্ন আর করবেন না, ছোট মামানি।
নাজনীন কারদার রেগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন,
— অসভ্য মেয়েমানুষ! বড়দের সঙ্গে এমন ব্যবহার?
মেহজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,
— আমি সামনে থেকে যা পাই, সেটাই ফিরিয়ে দেই।
নাজনীন কারদার গজগজ করতে করতে মেকআপ আর্টিস্টদের উদ্দেশে বলেন,
— এই মেয়েটাকেই রেডি করিয়ে দাও।
বলেই বেড়িয়ে যান রুম থেকে। একজন মেকআপ আর্টিস্ট পিচ কালারের গাউন বের করে মেহজার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
— ম্যাম, এটা পরে আসুন। এরপর মেকআপ শুরু করবো।
গাউনটা রাজকীয়—সাদা স্টোন আর সূতার কাজ করা। মেহজা ইচ্ছে না থাকলেও গাউনটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। তিন মিনিট পর বের হয় গাউন পরে—যেন কোনো রাজকন্যা। ভারে দাঁড়ানো দায়, তবু নিজেকে সামলে নেয়। একজন মেকআপ আর্টিস্ট তাকে ধরে এনে ড্রেসিং টুলে বসায়। সাজানোর প্রস্তুতির মাঝেই মেহজা বলে,
— আমাকে ফাউন্ডেশন দেবেন না। ভালো লাগে না।
একজন মেকআপ আর্টিস্ট হেসে বলে,
— ম্যাম, ফাউন্ডেশন না দিলে গলা ও বুকে লাভ বাইটগুলো দেখা যাবে।
মেহজা লজ্জা ও রাগে গলে যায়। মনে মনে আরভিদকে গালি দেয়,
— লুচ্চা কোথাকার!
একঘণ্টা পর সাজগোজ শেষে মেহজা আয়নায় তাকায়। গলায় ভারী হীরে, কানে দুল, মাথায় দোপাট্টা। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই হতবাক—অসাধারণ লাগছে। তবে এটা সবই সাজানো, কৃত্রিম সৌন্দর্য। ঠিক তখনই রুমে ঢোকেন তাহিয়া কারদার। মুগ্ধ হয়ে বলেন,
— মাশাল্লাহ!
মেহজা মুচকি হাসে।
— সবাই রিসেপশনের ভেন্যুতে চলে গেছে। এখন শুধু তুমি, আমি আর অর্তি আছি। চল।
তিনজন একসাথে নিচে নামে। অর্তিহা তখনও আসেনি। তাহিয়া নিচ থেকে ডাকেন। কিছুক্ষণ পর সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখা যায় অর্তিহাকে।
মেহজার চোখ আটকে গেল অর্তিহার দিকে—ফন রঙার গাউনে মোড়া সে যেন স্বপ্নের মতো এক দেবী। তার ধবধবে ফর্সা ত্বক মণির মতো ঝলমল, চোখ দু’টি গভীর জ্যোৎস্নার খনি, আর নিখুঁত সাজে এমন এক মোহ, যা একবার দেখলেই মন হারিয়ে ফেলে। অর্তিহা শুধু সুন্দরী নয়, সে এক অপরূপ মায়াবী রূপ। মেহজা নিজেকে যেন ম্লান মনে করে এই রূপবতীর পাশে।
অর্তিহা কাছে এসে কোমল কণ্ঠে বলে,
— দেরি হয়ে গেল, সরি।
তাহিয়া তার কানের নিচে চোখের কাজল ছুঁয়ে দেন।
— কারো নজর না লাগে আমার মেয়ের।
তিনজন বেরিয়ে পড়ে ভেন্যুর উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে এক ঘণ্টা লাগে। তাহিয়া কারদার ও অর্তিহা মিলে মেহজাকে স্টেজের দিকে নিয়ে যায়। মাঝপথে আভীর কারদার ডাক দেওয়ায় তাহিয়া কারদার সেদিকে চলে যায়। তারপর অর্তিহা একা নিয়ে যায় মেহজাকে স্টেজের দিকে। সবাই তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে, বিশেষ করে অর্তিহার দিকে কারণ তার সৌন্দর্য তার রূপ।
স্টেজের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুরুষ—আরভিদ ও আদ্রিক। আরভিদের পরনে হোয়াইট শার্ট আর ব্ল্যাক স্যুট, হাতে রূপালি ঘড়ির মোলায়েম ঝলক। আদ্রিক ব্ল্যাক শার্ট ইন করে পরেছে কালো প্যান্টের সঙ্গে, হাতে কালো ঘড়ির নিঃশব্দ অথচ তীক্ষ্ণ আভিজাত্য।
এই ভেন্যুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দুই পুরুষ। চারপাশে শত শত চোখ, বিশেষ করে মেয়েদের দৃষ্টির কেন্দ্রে শুধুই ওরা। যেন পুরো পরিবেশটাই থমকে আছে ওদের উপস্থিতিতে—সময় যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়ে কেবল তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। কিন্তু দুজনেরই দৃষ্টি থেমে গেছে সামনে—আদ্রিকের চোখ একটানা অর্তিহার দিকে, আর আরভিদের দৃষ্টি যেন মেহজার উপর হারিয়ে গেছে।
মেহজা ও অর্তিহা স্টেজের কাছে আসতেই আরভিদ হাত বাড়ায় মেহজাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য। মেহজা একবার তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে নিজেই উঠে যায়, আরভিদের হাত না ধরেই। আরভিদ মুচকি হেসে রাগ চাপা দিয়ে হাত নামিয়ে নেয় এবং মেহজার পাশে গিয়ে বসে। মুখে হাসি রেখেই মেহজার কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
— এখন হাত ধরিসনি তো কী হয়েছে? রাতে তোর পুরো শরীরে আমার স্পর্শের সুনামি বইবে।
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— এই বয়সেই এতো কুড়কুড়ানি? কলকাতার হারবাল খান-টান নাকি?
আরভিদ হেসে ফেলে।
— না আমি খাই না, তবে তোকে খাওয়ানো দরকার খুব! তোর শরীরের যত্ন এখন আমার দায়িত্ব। সারারাত… মুখে, ঘাড়ে, গন্ধে… উফফ… এ যেন ঈদের খুশিরও বেশি কিছু।
মেহজা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— খুশি না, ক্ষুধা বলেন।
আরভিদ চোখ টিপে বলে,
— “ক্ষুধা, খুশি, কামের ক্যামোফ্লাজ—সে তুই যাই বলিস, আমার কাছে তুইই সেরা ডেসার্ট।
মেহজা দাত চেপে বলে, স্বর তার কাঁপছে রাগে,
— লজ্জা করে না এসব বলতে?
আরভিদ ভান করে চোখ কপালে তুলে অবাক হলো, যেন তার এই প্রশ্নই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস,
— লজ্জা? সে আবার কী? প্রথম শুনলাম।
মেহজা ঘৃণা-রাগ মিশিয়ে তাকিয়ে বলে,
— জালেম একটা!
আরভিদ মেকি হেসে বলে,
— আমার জালেমা।
মেহজা রাগে ফুসে উঠেছিল, কিছু বলতে যাবার মুখ খুলবে ঠিক মুহূর্তেই আদ্রিক এসে উপস্থিত হয়। তার উপস্থিতিতে মেহজা নিজেকে কোনোরকমে সামলে নেয়, রাগটাকে গিলে ফেলতে বাধ্য হয়। আদ্রিকের হাতে একটি কালো স্যাটিন মোড়ানো বাক্স। একপাশে ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসে সে।
— কংগ্র্যাচুলেশনস, মি. এন্ড মিসেস কারদার।
সে বাক্সটা বাড়িয়ে দেয় মেহজার দিকে। মেহজা একটু দ্বিধায় পড়ে, তারপর স্বভাবজাত ভদ্রতা থেকে মুচকি হেসে গিফটটা হাতে নেয়। আদ্রিক তখন হালকা ভঙ্গিতে বলে,
— খুলে দেখো তো, পছন্দ হয় কিনা।
মেহজা একবার আরভিদের দিকে তাকায়। আরভিদ চুপচাপ—চোখে প্রশান্ত, গভীর দৃষ্টি। তারপর আবার গিফটের দিকে ফিরে আসে। ইচ্ছে না থাকলেও সৌজন্যের খাতিরে ধীরে ধীরে রিবনটা খোলে। বাক্সটা খুলতেই মেহজার মুখে এক ধরণের নিরুত্তাপ বিস্ময়। চোখের পাতা হালকা কেঁপে ওঠে।
ভেতরে রাখা—একটা অনন্য শিল্পকর্ম।“Volcano in Glass”—এর লিমিটেড এডিশন। স্বচ্ছ গ্লাসের ভেতর লাল-কমলা রঙের বিমূর্ত লাভা, যেন ক্ষুদ্র একটা বিস্ফোরণ থেমে গিয়েও থামে না। স্পার্কিং পাথরের কণা,কাচের স্বচ্ছতায়, ফিনিশিংয়ের নিখুঁততায় সেটা যেন একধরনের নির্বাক বিস্ফোরণ।
মেহজা আস্তে বলে,
— এটা…এটা কী?
আদ্রিক হেসে বলে,
— ভলকানো ইন গ্লাস। আমার মনে হয়েছে, এটা পারফেক্ট গিফট তোমাদের জন্য।
একটু থেমে আবার বলে,
— “তোমরা দুজনেই আগুন—তীব্র, বিশুদ্ধ, নিজস্ব। আলাদা থাকলে ভয়ংকর, কিন্তু একসাথে থাকলে চারপাশ আলো করে তোলে। এই গিফটটাও ঠিক তেমন—আগুনের রূপ, কিন্তু গ্লাসে বাঁধা—কন্ট্রোলড বিউটি। পারফেক্ট ম্যারেজ।”
মেহজা অপলক তাকিয়ে থাকে জিনিসটার দিকে। চোখেমুখে বিস্ময়ের ছাপ, মুগ্ধতায় ভরে ওঠে পুরো মুখ। প্রফুল্ল হাসিতে বলে,
— থ্যাংক ইউ, আদ্রিক ভাই।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরভিদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহজার মুখের দিকে। মেহজার ঠোঁটে তখনো ঝুলে আছে এক অনাবিল হাসির রেখা। কোনো কারণ ছাড়াই বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে আরভিদের। ঈর্ষা এসে জমা হয় চোখে-মুখে। আদ্রিক সেটা বুঝে যায় সহজেই। আদ্রিক ঠোঁটের কোণে একপাশে বাঁকানো হাসি নিয়ে বলে,
— রিলাক্স, আরভিদ। গিফট আমি দিলেও, ব্যবহার করার পারমিশন শুধু তোর।
তারপর একটু ঝুঁকে গলা নামিয়ে বলে,
— “দো অনেস্টলি… ভলকানো ইন গ্লাস–এর চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস তুই কিনে ফেলেছিস। বেস্ট অফ লাক, ব্রো।“
বলেই হেসে সে চলে গেল। আদ্রিক চলে যাওয়ার পর মেহজা সকলের অগোচরে আরভিদকে ভেংচি কাটতে থাকে। এই ছোট্ট ভেংচি টাই তার মনকে কিছুটা শান্তি দেয়। আরভিদ কিছুই বলে না, তার চেহারা যেন আগের মতোই স্বাভাবিক। তবু তার চোখে ও ভাবভঙ্গিতে কিছু একটা অদ্ভুত ছাপ থাকে—বুঝতে পারা কঠিন, সে রেগে আছে নাকি চুপচাপ শান্ত।
অর্তিহা দাঁড়িয়ে ছিল নির্জন এক কোণে, রিসেপশন ভেন্যু থেকে কিছুটা দূরে। আলো-ঝলমলে ভেতরটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে-কারণ সেখানে উপস্থিত প্রতিটি চোখ যেন তাকিয়ে ছিল শুধু তার দিকেই।এতগুলো দৃষ্টির ভার সইতে পারে না অর্তিহা। কারও চোখে মুগ্ধতা দেখলেই তার ভেতরে অজানা ভয় জেগে ওঠে। নিজের রূপ নিয়েই যেন তার অস্বস্তি। এই সৌন্দর্য এখন তার কাছে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়।
একসময় এমন ছিল না। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে সে কখনো ভয় পায়নি। সবকিছু বদলে গেছে আদ্রিকের পর থেকে। তাই আজ রূপের প্রশংসা শুনলেও তার হৃদয়ে একরাশ বিষাদ নামে।
— আমার কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্যই এখানে এসে লুকিয়েছিস?
অর্তিহা ধীরে পেছনে ঘুরে তাকায়। তার দৃষ্টি স্থির হয় আদ্রিকের উপর—সে গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, বুকের দুই হাত গুঁজে রেখেছে। ঠোঁটে তার সেই
চিরচেনা, রহস্যময় হাসি। আদ্রিক ধীরে এগিয়ে আসে। অর্তিহার থুতনিতে আলতো স্পর্শ করে তার মুখটা উপরের দিকে তোলে—কারণ, ছোট্ট গড়নের অর্তিহার দৃষ্টি তখনও আদ্রিকের বুক পর্যন্তই পৌঁছেছিল।
আদ্রিক চোখে চোখ রেখে বলে,
— বৃথা চেষ্টা মিস্ট্রি মারমেইড। আদ্রিক কারদার পাতাল থেকেও তোকে খুঁজে বের করবে। আমার থেকে নিজেকে আড়াল করতে পারবি না।
অর্তিহা চোখ নামিয়ে ফেলে। গলার স্বর কেঁপে ওঠে সামান্য,
— লুকিয়ে ছিলাম না। ভেতরের কোলাহলটা সহ্য হচ্ছিল না… তাই এখানে এসেছি।
আদ্রিক হাসে। ঠোঁটের কোণে একটুখানি বাঁকা টান,
— কোলাহল যদি তোর ভালো না লাগে, তবে বাকিদের চুপ করাতে আমি তো আছিই।
তারপর খুব ধীরে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
— দরকার হলে আমি পুরো পৃথিবীটাই নীরব করে দেব, শুধুমাত্র তোর জন্য।
অর্তিহা অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে আদ্রিকের দিকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, বুকের ভিতরটা হাহাকার করছে ভেতর থেকে। কিন্তু তার কষ্ট প্রকাশের বারণ। তাই চোখের জল আটকে রাখে, নিজেকে সামলায়। এক ফাঁকে চোখ নামিয়ে নরম গলায় বলে,
— তার প্রয়োজন নেই। অনেকক্ষণ ধরে বাইরে… ভেতরে হয়তো সবাই চিন্তা করছে।
আদ্রিক ধীরে তার কোমর জড়িয়ে ধরে, শরীরটা নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে নেয়। গভীর, হাস্কি স্বরে বলে,
— শুধু আমার থেকে দূরে দূরে থাকার চিন্তা… কিন্তু অর্তি জান, সেটা তো হচ্ছে না।
অর্তিহা তার কথায় কোনো জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে, মাথা নামিয়ে রাখে আদ্রিকের বুকে। আদ্রিকের চোখে তখন একরকম উন্মাদ ও বেপরোয়া দৃষ্টি— যে দৃষ্টিতে শুধু মুগ্ধতা, আর অর্তিহার সৌন্দর্যের প্রতি নেশালো টান।
সে মৃদু স্বরে বলে,
— লিটলহার্ট, তোর এত সুন্দর হওয়া আমার উপর অত্যাচার।
অর্তিহার ঠোঁটে তিক্ত হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ক্ষীণ স্বরে উত্তর দেয়,
— আর আমার উপর অভিশাপ।
আদ্রিক মাথা নিচু করে কপাল ঠেকায় অর্তিহার কপালে, চোখ বুজে নেয়। নাক ছুঁয়ে যায় নাকে। নিঃশ্বাসের গতি জটিল হয়। আবেশে ভেজা স্বরে বলে,
— তোর এই অভিশাপে আমি ভীষণ উন্মাদ, লিটলহার্ট।
বলেই ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় অর্তিহার ঠোঁটে। চোখ বুজে গভীর এক আবেশে চুমু খেতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে হাত ডুবে যায় অর্তিহার চুলে। সেই নরম চুলে আঙুল চালিয়ে দিয়ে, তাকে আরও নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে খুবই নরমভাবে, যত্নে, একান্ত আবেগে চুমু খেতে থাকে।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর আদ্রিক ধীরে ধীরে তার ঠোঁট সরিয়ে নেয় অর্তিহার ঠোঁট থেকে। তার চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া। তারপর হেসে জিজ্ঞেস করে,
— আমার ঠোঁটে লিপস্টিক লেগেছে?
অর্তিহা ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের দিকে তাকায়।আদ্রিকের ঠোঁটে তার লিপস্টিকের হালকা ছাপ স্পষ্ট। মাথা নিচু করে হালকা ভাবে সম্মতি জানায় সে।
আদ্রিক হেসে বলে,
— মুছে দে।
অর্তিহা কাপা-কাপা হাতে, কিছুটা ইতস্তত করে আদ্রিকের ঠোঁট থেকে লিপস্টিকের ছাপ মুছে দেয়।
আদ্রিক এক পলক চেয়ে নরম স্বরে বলে,
— চল।
দুজন একসাথে ভেতরে প্রবেশ করে। মেহজা একা বসে রয়েছে সোফায়। আরভিদের একটি ফোন আসায় সে কথা বলার জন্য নির্জন এক কোনায় চলে গেছে। আরভিদ ফোনে কথা শেষ করে আবার স্টেজে ফিরে আসে। দূর থেকে অর্তিহা ও আদ্রিককে দেখে ডাকে। ওরা কাছে যেতেই কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে,
আদ্রিক একবার অর্তিহার দিকে তাকায় তারপর উত্তর দেয়,
— অর্তির শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো। তাই ওকে একটু ফ্রেশ এয়ারে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আরভিদ উদ্বিগ্ন হয়ে অর্তিহার কাছে এসে বলে,
— শরীর খারাপ লাগলে আমাকে বলিসনি কেন? ডাক্তারের কাছে…
অর্তিহা তার হাত চেপে ধরে হালকা হাসে। মৃদু কণ্ঠে বলে,
— ভাইয়া, আমি এখন ঠিক আছি। চিন্তা করো না।
মেহজা দূর থেকে সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আদ্রিক আর অর্তিহার দিকে। সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও আদ্রিক ঠিক বুঝে যায়, সেই দৃষ্টিতে রয়েছে প্রশ্ন। ঠিক তখনই প্রবেশ করে তালুকদার পরিবার। মাশরিফ তালুকদার মেয়েকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই জরিয়ে ধরেন। মেহজা বাবার বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে।
মাশরিফ মেয়ের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করেন,
— কেমন আছো আম্মু?
মেহজা নাক টেনে জবাব দেয়,
— ভালো, আব্বু। তুমি কেমন আছো?
— ভালো নেই। আমার রাজকন্যাকে ছাড়া আমার ঘরটা যে ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
মেহজা মাথা তোলে, বাবার চোখে চোখ রাখে। সেই চোখে জল আর ব্যথা মেশানো গলা,
— কিন্তু তোমরাই তো আমাকে রাখতে চাওনি। আমি চাইনি তোমাদের ছেড়ে আসতে।
আস্মিতা তালুকদার মেয়ের গালে হাত রেখে চোখে জল নিয়ে বলে ওঠেন,
— মেয়েরা তো বাবার বাড়িতে চিরকাল থাকতে পারে না মা। স্বামীর বাড়িই তো তাদের ঠিকানা হয়।
মেহজা মুখ শক্ত করে আস্মিতা তালুকদারের হাতটা সরিয়ে দেয়। কণ্ঠে তীব্র অভিমানের স্পষ্ট আভাস,
— স্বামীর বাড়ি যেতে হয়, ঠিক। কিন্তু তুমি তোমার ভাতিজার জন্য আমাকে বলি দিয়েছো, আম্মু!
সবাই হতভম্ব, শুধু দু’জন ছাড়া—আরভিদ ও আদ্রিক। আরভিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। আদ্রিকের চোখে স্থির দৃষ্টি।
আস্মিতা তালুকদার আবার এক পা এগিয়ে এসে বলেন,
— মেহু, আম্মু তোমার সুখের জন্যই তো এই বিয়েটা দিয়েছি।
— “আমার থেকে চৌদ্দ বছরের বড় তোমার ভাতিজার সঙ্গে আমাকে বিয়ের বলিতে চড়িয়ে, তুমি বলছো—এই বিয়েটা আমার সুখের জন্য? যার সঙ্গে না বয়সের মিল, না মননের সাযুজ্য!”
আস্মিতা তালুকদার নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। চোখ দু’টি ভিজে কষ্টের জলে। কথার ভারে নুয়ে পড়া সেই দৃষ্টি দেখে মাশরিফ তালুকদার ধীরে মেয়েকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শান্ত কন্ঠে বলেন,
— আম্মু, এসব কী বলছো তুমি? তোমাকে কেউ বলি দেয়নি। হ্যাঁ, সত্যি… আরভিদের সঙ্গে তোমার বয়সের ব্যবধান অনেক। কিন্তু আরভি…
মেহজা কোনো জবাব দেয় না। জানে, আরভিদের প্রশংসায় সকলেই চোখ বেঁধে রেখেছে। সে যদি এখন চিৎকার করেও কিছু বোঝাতে চায়, কেউ বিশ্বাস করবে না। আস্মিতা তালুকদার স্বামীর হাত চেপে চুপ করায়। ইশারা করেন— এখন এসব বলার সময় না।
মিশান পরিস্থিতি হালকা করতে মেহজাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আপু, জানো আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি!
মেহজা তাকায়, চোখে হালকা জল আর ঠোঁটে একটুখানি হাসি। মিশান আবার বলে,
— আপু, তোমাকে আজ একদম পরির মতো লাগছে।
মেহজা নরম স্বরে বলে,
— তোকেও অনেক সুন্দর লাগছে।
দু’বোন কথা বলতে থাকে। এদিকে আস্মিতা তালুকদার মন খারাপ করে ধীরে ধীরে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে চলে যান। মেহজা একবার তার দিকে তাকায়, কিন্তু আবার মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে কষ্ট আছে, কিন্তু ক্ষমা নেই। অর্তিহার মুখে চিন্তার ছাপ। আরভিদ নিরবে সরে যায় ভিড় থেকে। আস্মিতা তালুকদার এক কোণে গিয়ে দাঁড়ান। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে অবিরাম। ঠিক তখনই পেছনে কারো উপস্থিতি অনুভব করেন। একটি হাত তার কাঁধে পড়ে।
— আমি ঠিক আছি, মাশরিফ।
চোখ মুছতে মুছতে তিনি ঘুরে দাঁড়ান, কিন্তু অবাক হয়ে দেখেন মাসরিফ নয়—আরভিদ।
— আরভিদ! তুমি?
আরভিদ হালকা হেসে বলে,
— ফুজি কাঁদছে, তো আমি আসবো না?
আস্মিতা কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠেন,
— আরভিদ, আমার মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার দিক থেকে…
পুরো কথা শেষ করার আগেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। আরভিদ এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
— কেঁদো না ফুজি। মেহু, রেগে আছে এখন। রাগ কমলে আবার তোমার কাছেই ফিরবে। আমি নিজে ওকে নিয়ে আসবো, কথা দিচ্ছি।
সে নিজের হাতেই মুছে দেয় আস্মিতার চোখের জল। আহিরা তার হাত আঁকড়ে ধরে শুধু বলে ওঠেন,
— হুম…
— এখন চল। আর একদম কান্না করবে না। আজ তোমার মেয়ের রিসেপশন, ইনজয় করো—একজন মায়ের মতো।
আস্মিতা তালুকদার চোখ মুছে মাথা নাড়েন। আরভিদের সঙ্গে ধীরে ধীরে পা বাড়ান মূল হলের দিকে।
রিসেপশনের আলোর ঝলক ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়। হাসি, কোলাহল, উচ্ছ্বাস—সব মিশে যায় সন্ধ্যার নরম ছায়ায়। সময় গড়িয়ে যায় নিঃশব্দে। সন্ধ্যা নামে। অনুষ্ঠান শেষে সকলে ধীরে ধীরে ফিরে আসে কারদার ম্যানরে। মেহজা এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। দরজা বন্ধ করে নিঃশব্দে বিছানায় ধপ করে পড়ে যায়। সারাদিন একভাবে বসে থাকতে হয়েছে তাকে—একেবারে যেন নিথর কোনো মূর্তি। তার ওপর যখন ওর পরিবার চলে যাচ্ছিল, তখন কেঁদে ছিলো অনেক। এই শারীরিক ও মানসিক ধকল মিলিয়ে শরীর ও মন দুই-ই যেন ক্লান্তিতে নুয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে এখন তার শরীর কেবল একটাই দাবি করছে—আরাম। শরীরটা যেন ধীরে ধীরে ভারহীন হয়ে আসছে। ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ দরজা খুলে ঢোকে আরভিদ। এক দৃষ্টিতে তাকায় বিছানায় অলসভাবে শুয়ে থাকা মেহজার দিকে। তারপর কোনো কথা না বলে সোজা আলমারির দিকে যায়, কাপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে—শাওয়ার নিতে।
সময় গড়িয়ে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা পর, শাওয়ার শেষে ভেজা চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হয় আরভিদ। ঘরে ফিরে দেখে, মেহজা ঠিক আগের মতোই বিছানায় পড়ে আছে—নড়চড় করেনি একটুও। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আয়নার প্রতিবিম্বে চোখ পড়ে মেহজার ওপর। চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে হাস্কি স্বরে বলে,,
— এভাবে শুয়ে না থেকে চেঞ্জ করে আস, তাহলে বেটার ফিল করবি।
মেহজা একটু চোখ খুলে তাকায়, মুখে ভেংচি মেরে জবাব দেয়,
— আপনি মন্ত্রী, অন্তরগামী না।
আরভিদের ঠোঁট বাঁকা হয়ে ওঠে,
— অন্তরগামী না ঠিকই তবে তোর শরীরগামী। কিভাবে তোর শরীর বেটার ও কম্ফোর্ট ফিল করবে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।
কথাটা যেন কানের ভেতর ছুরি চালালো। মেহজা এক ঝটকায় উঠে বসে পড়ে। চোখে আগুন, কণ্ঠে বিষ।
— ইচ্ছে করছে রিন ওয়াশিং পাউডার দিয়ে আপনার নোংরা দৃষ্টি টা ধুয়ে দিতে।
আরভিদ হেসে ফেলে। একেবারে গলায় ঝুলে থাকা সেই স্বরে,
— দৃষ্টি কিন্তু তোর উপরই থাকবে।
মেহজা দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকে। ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কাভার্ড থেকে আরভিদের একটা টি-শার্ট বের করে।
— কাভার্ডে শুধু শাড়ি। রাতে আমি শাড়ি পরে ঘুমাতে পারবো না… তাই আপনার টি-শার্টটা নিচ্ছি।
আরভিদ ঠোঁট কামড়ে বলে,
— রাতে তোর গায়ে আমি শাড়ি রাখবোও না, রেডলিপ।
মেহজা চোখমুখ কুচকে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
— আল্লাহ এই জালেমের দৃষ্টিতে তুমি পর্দা ফালাও।
আরভিদ পেছন থেকে হেসে বলে উঠে,
— স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো পর্দা নেই, জালেমা।
মেহজা রাগে ফুসতে ফুসতে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
আরভিদ হালকা হেসে একহাতে মোবাইল নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। এরই মাঝে তাহিয়া কারদার মেইডকে দিয়ে ওদের খাবার রুমে পাঠায়। প্রায় পনেরো মিনিট শাওয়ার শেষে মেহজা বেরিয়ে আসে। পরনে আরভিদের সাদা টি-শার্ট, যা হাটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে, আর পেটিকোট। আরভিদ তাকিয়ে দেখে মেহজাকে, তার এই সাধারণ অথচ কোমল অবস্থা তাকে আরও বেশি আদুরে মনে হচ্ছে।
সে উঠে দাঁড়িয়ে পাশে রাখা সাইড টেবিল থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে মেহজার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে বলে,
— খেয়ে নে।
মেহজা আরভিদের হাত থেকে প্লেটটা ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত খেতে শুরু করে। তার প্রচণ্ড ক্ষিদে লাগায় বড় বড় লোকমা নিয়ে একটুখানি না থেমে খাচ্ছে। আরভিদ ভ্রু কুঁচকে মেহজাকে দেখল। তারপর নিজের প্লেট নিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল স্পোন দিয়ে। মেহজা খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আসে। তারপর সোফা থেকে কুশনগুলো এনে বিছানার মাঝখানে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে বর্ডার বানাল। আরভিদ তা দেখেও চুপচাপ খাওয়া চালিয়ে গেল। বর্ডার শেষ করেই মেহজা বিছানায় শুয়ে পড়ে—এখন একটা কড়া ঘুম দরকার।
আরভিদ খাওয়া শেষ করে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
— দু’মিনিট সময় দিলাম, নিজেকে তৈরি করে নে।
মেহজা ধীরে চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। ভ্রু কুঁচকে বলে,
— এখন আমি কোথাও যাবো না।
আরভিদ শান্ত গলায় বলে,
— আমি কি কোথাও যেতে বলেছি নাকি?
মেহজা এবার স্পষ্ট বিরক্তিতে গলা চড়িয়ে বলে,
— তাহলে এখন কেন বললেন রেডি হতে?
আরভিদ বাকা হেসে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল।
— রোমান্সের জন্য, রেডলিপ! মনে নেই, ঐ সময় কি বলেছিলাম?
তার কন্ঠস্বর নরম, কিন্তু তাতে একটা অদ্ভুত শীতলতা।মেহজা একটু কেঁপে উঠল। ঢোক গিলে ধীরে ধীরে পিছু হটতে হটতে বলে,
— একদম আমার কাছে আসবেন না। প্রথম দিন কিছু বলিনি, কিন্তু আজ যদি আবার কাছে আসেন, আমি চিৎকার করবো। পুরো বাড়ির মানুষকে জড়ো করে ফেলবো!
কথাগুলো শেষ হতেই আরভিদ এক হাঁটু বেডে ভর দিয়ে মেহজার পা টেনে এনে এক টানে নিজের একেবারে কাছে নিয়ে এল। দূরত্বটা মুছে গেল মুহূর্তেই। মেহজার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
আরভিদ কানে ঠাণ্ডা ফিসফিসে গলায় বলে,
— “চিৎকার কর, সমস্যা নেই। কিন্তু কেউ আসবে না। কারণ, বিয়ের প্রথম প্রথম মেয়েরা চিৎকারই করে—প্রাচীন নিয়ম, রেডলিপ।”
মেহজার সারা শরীর যেন হঠাৎ করে বিদ্যুতের শিরশিরে ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে। এক মুহূর্তেই গা হিম হয়ে আসে, ঠোঁট শুকিয়ে যায়, নিঃশ্বাস আটকে যায় তার।
আরভিদ আলতো করে মেহজার গলার কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে মজা করে বলে,
— আমাকে ইনডিরেক্টলি বুড়ো বলেছিলি তাই না? এখন এই বুড়োর সামান্য ছোঁয়াতেই কাপছিস?
মেহজা কাঁপতে কাঁপতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কণ্ঠটা যেন গলার গভীরে আটকে আছে। তবু চোখ খুলে কোনোমতে বলে,
— আ… আমার… ব… বয়সটাই বা কি? মাত্র উনিশ… সেই তুলনায় আপনি তো…বু….
কথা শেষ করতে পারে না, আরভিদ মৃদু হেসে তার গালে একটা কোমল চুমু একেঁ দেয়। কণ্ঠে মিশে থাকে একরাশ মাদকতা,
— ঠিক আছে, বুড়োই যখন বলেছিস… তাহলে এখন এই বুড়োকে সামলা, আমার কচি বউ।
মেহজা চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশ্বাসে যেন ভারী কিছু জমে আছে। কিছু বলার চেষ্টা করে না, কেবল চুপচাপ বসে থাকে। আরভিদ তার গালে ধীরে ধীরে নাক ঘষে দেয়। তার স্পর্শে যেন একরাশ অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে মেহজার ভেতরটায়। মেহজা চাদরের কোণা শক্ত করে মুঠো করে ধরে রাখে— কয়েক সেকেন্ড, শুধু কয়েক সেকেন্ড… সহ্য করে যায় সেই ঘনত্ব।
তারপর ধীরে চোখ মেলে, গভীর ক্লান্ত কণ্ঠে বলে,
— আজ… আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, আরভিদ ভাই…
আরভিদ তাকাল মেহজার ক্লান্ত চোখের দিকে। দিনভর যে চাপ আর ব্যস্ততা তার শরীরে মিশে আছে, সে চোখগুলোই বলে দিচ্ছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে একটু সরে গিয়ে পাশেই শুয়ে পড়ল। নরম কণ্ঠে বলে,
— আজকে ছাড়লাম, কিন্তু কাল থেকে রেহাই নেই, রেডলিপ।
মেহজা হালকা এক নিঃশ্বাস ফেলে। বুকের ভার যেন একটু হালকা হয়। এতক্ষণ ধরে যেন তার নিঃশ্বাসই আটকে ছিল, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এখন যেন একটু আলো আসছে ভেতরে, একটু প্রশান্তি। সে আরভিদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভেংচি কাটে,
— হুহ্! কালকে আমাকে পেলে তো!
আরভিদ যেন মেহজার মনের কথা পড়ে ফেলে। হঠাৎই মেহজাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয়, গভীর হাস্কি টোনে বলে,
—ঝেড়ে ফেল মাথা থেকে এসব চিন্তা। শুধু কালকে নয়, তুই কোনো দিনই আমার থেকে পালাতে পারবি না, রেডলিপ।
মেহজা ছটফট করে উঠে, আরভিদের বুক থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টায়। কিন্তু আরভিদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। গলায় চাপা এক গম্ভীর সুরে বলে,
— আর একবার নড়লে কিন্তু আদর করা শুরু করব।
মোহশৃঙ্খল পর্ব ২
মেহজা থেমে গেল। সে জানে, আরভিদের চোখেমুখে যে বেপরোয়া রঙ খেলে যাচ্ছে, সেটা নিছক কথা নয়—ছেলেটা এমন করেই বসবে। অগত্যা নিঃশব্দে মাথা রেখে দিল আরভিদের বুকের ওপর। সারাদিনের ক্লান্তি যেন মেহজার চোখে ঘুম হয়ে নেমে এলো—কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই নিঃশব্দে তলিয়ে গেল গভীর নিদ্রায়। আরভিদ মেহজারের চুলে চুমু দেয়, সেও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
