নীল চিরকুট পর্ব ১৩+১৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
নম্রতা পাঁচ-দশ মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল,
‘ আসলে, সকালে খুব ডিস্টার্ব ছিলাম। কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম খুব। তাই অন্যমনস্কভাবে হঠাৎই দুটো উইয়ার্ড শব্দ বেরিয়ে গিয়েছিল মুখ থেকে। ট্রাস্ট মি! আমি ইচ্ছে করে বলিনি। আর না আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছি। কসম!’
বেশ কিছুক্ষণ পর আরফান উত্তর দিল,
‘ তাই নাকি? তো, কি বলেছিলেন? আই মিন, হঠাৎ বেরিয়ে আসা উইয়ার্ড শব্দদুটো কী ছিল? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’
রাগে নম্রতার ফর্সা নাক লাল রঙ ধারন করল। বাঘিনীর মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ঢকঢক করে বোতলের পুরো পানি সাবাড় করল। ডানহাতের পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে চেয়ার পা গুটিয়ে বসল। প্রচন্ড রাগে গায়ে ঘাম দিচ্ছে তার। পিঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোকে হাত খোঁপা করে আবারও ফোনের দিকে তাকাল নম্রতা। মাথার উপর ক্যাট ক্যাটে শব্দ তুলে ঘুরে চলেছে পাখা । নম্রতার মনে হচ্ছে, এই পাখায় বাতাসের থেকে শব্দই পাওয়া যাচ্ছে বেশি। ‘খালি কলসি বাজে বেশি’ টাইপ অবস্থা। কিছুতেই ঘাম বন্ধ হচ্ছে না। নম্রতা চোখ বোজে জোরে জোরে দম নিল। ওই অসভ্য লোকটা শুধু অসভ্য নয়, ভয়ানক থেকে ভয়ানক ফাজিলও। ইচ্ছে করে ছ্যাচলামো করছে। বেয়াদব।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এইসব বেয়াদব দিয়ে হাসপাতাল ভরে থাকলে রুগীরা সুষ্ঠু চিকিৎসা পাবে কোথায়? দেখা যাবে, অপারেশন থিয়াটারে দাঁড়িয়েও এদের ছ্যাচলামো, ফাজলামো শুরু হয়ে গিয়েছে। নম্রতাকে যেমন সব জেনেশুনেও জিগ্যেস করছে, ‘ওই হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়া উইয়ার্ড শব্দ দুটো কী?’ ঠিক তেমনই অপারেশন বাদ দিয়ে রুগীকে জিগ্যেস করবে, ‘ আপনার এই উইয়ার্ড রুগের পেছনে কারণ কী? বিশ্লেষণ করুন তো শুনি।’ নম্রতা বিপন্ন দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল। এখন কী উত্তর দিবে সে? উফ্ ভাল্লাগে না। নম্রতা বার কয়েক ঘন ঘন দম নিয়ে লিখল,
‘ নেতিবাচক বিষয়গুলো মনে না থাকায় ভালো। সেগুলো মনে না করিয়ে দেওয়া আরও ভালো। আপনার মনে নেই শুনে স্বস্তি পেলাম। আপনি প্লিজ সরিটা একসেপ্ট করে নিন। ক্ষমা করা মহৎ গুণ।’
‘ তাই নাকি? কে বলেছে?’
‘ সবাই বলে। তাছাড়া আল্লাহ ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে পছন্দ করেন। আজকাল, মানুষ নিজের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিচ্ছে আর আপনি ওই ছোট্ট দুটো শব্দের জন্য আস্ত একটা সরি একসেপ্ট করতে পারবেন না?’
বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর এলো,
‘ আপনি খুবই হিপোক্রিট মহিলা। নিজের কথার প্রতি নিজেরই ভরসা নেই ঠিকঠিক।’
‘হিপোক্রিট’ শব্দটা শুনেই নম্রতার মিইয়ে থাকা আগুনটা দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এতো বড় সাহস! এই লোক নম্রতাকে হিপোক্রিট বলে। নম্রতাকে? রাগে হাত-পা কাঁপছে নম্রতার। মাথা ধরে যাচ্ছে। এই লোকটা আস্ত শয়তান, অসভ্য। যে কুক্ষণে এই লোকটাকে নক করতে গিয়েছিল, সেই কুক্ষণটাকে কেঁটে টুকরো টুকরো করে ফেলতে ইচ্ছে করছে নম্রতার। ইনবক্স ভর্তি গালি দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ব্যাটা তুই হিপোক্রিট, ম্যানারলেস। নাও গো টু হেল। কিন্তু বলা যাচ্ছে না। এহেন অপমান সহ্যও করা যাচ্ছে না। রাগে-দুঃখে-বাধ্যবাধকতায় কান্না পেয়ে যাচ্ছে নম্রতার। কিছুক্ষণ চোখ বোজে বসে থেকে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিল নম্রতা। তারপর আরফানের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে উত্তর দিল,
‘ এসাইনমেন্টে আপনার সাইন লাগবে। ইট’স ইমারজেন্সি। প্লিজ।’
‘ আমাদের মতো ফালতু ডাক্তার থেকেও সাইন লাগে নাকি আজকাল?’
‘ লাগছে তো।’
‘ কখন চাই?’
‘ দশটায়।’
‘ দশটায় আমার ক্লাস আছে।’
‘ প্লিজ স্যার। প্লিজ। কৃতজ্ঞ থাকব।’
নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে আবারও লিখল,
‘ কালকেই জমা দিতে হবে। নয়তো ঝামেলা হয়ে যাবে। প্লিজ, স্যার। ‘
‘ সাড়ে দশটায় চলবে?’
‘ চলবে চলবে।’
‘ বেশ! আসবেন সাড়ে দশটায়।’
নম্রতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। ফোনটা রেখে বিছানায় যেতে যেতে মাথায় একটা চিন্তায় খেলে গেল। এই বেয়াদব লোকটিকে শুকনো কথায় ছেড়ে দিলে তো চলবে না। ভয়ানক কিছু ভাবতে হবে। এই লোককে হাই লেভেলের অপমান না করতে পারলে ঠিকঠাক ঘুমও হবে না নম্রতার। বিশাল যন্ত্রণা।
ভার্সিটির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই ঘাটছিল নীরা। তার পাশের সেল্ফ থেকেই সাইকোলোজির উপর কোনো একটা বই খুঁজছিল অন্তু। অন্তুর চোখ-মুখ আজ গম্ভীর, থমথমে। কাল থেকে নীরার সাথে হা-হু ছাড়া কথা বলছে না সে। নীরা খেয়াল করেছে। নম্রতা, ছোঁয়াদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে নীরার সাথে এমন নিষ্ঠুরতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অন্তু বই হাতে কোণার একটা টেবিলে চেয়ার টেনে বসল। নীরা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তুর পাশের চেয়ারটাতে বসল। অন্তুর গায়ে কালো রঙের পাতলা টি-শার্ট। ছিমছিমে কালো গায়ে কালো রঙটা বেশ মানিয়েছে। পরিপাটি চুল আর শক্ত চিবুকে আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে। নীরা গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল। অন্তু ফিরেও তাকাল না। গভীর মনোযোগে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচু কন্ঠে জিগ্যেস করল,
‘ তুই ঠিক আছিস?’
অন্তু চোখ তুলে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,
‘ আমাকে বলছিস?’
‘ এখানে আর কেউ আছে?’
অন্তু তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
‘ ঠিক থাকব না কেন? আমার কী বেঠিক থাকার কথা ছিল নাকি?’
নীরা আহত কন্ঠে বলল,
‘ এভাবে কথা বলছিস কেন?’
অন্তু বই থেকে মুখ উঠিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। ভারি অবাক হয়ে বলল,
‘ কিভাবে কথা বলছি?’
‘ কেমন ঠেস মারা কন্ঠে কথা বলছিস। শুনতে খারাপ লাগছে।’
অন্তুর সহজ উত্তর,
‘ খারাপ লাগলে যেচে পড়ে কথা বলতে আসছিস কেন?’
‘ তুই দু’দিন যাবৎ খুব রুড বিহেভ করছিস আমার সাথে। কি করেছি আমি?’
অন্তুর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। টেবিলের নিচে থাকা নীরার বাম হাতের কনুইয়ের নিচে শক্ত করে চেপে ধরল। হেঁচকা টানে নীরাকে নিজের দিকে এনে রক্তলাল চোখে তাকাল। তপ্ত কিন্তু ধীর কন্ঠে বলল,
‘ তোর সাথে সবসময় আদর আদর কন্ঠে কথা বলতে হবে এমন কোনো চুক্তি ছিল নাকি আমার?’
নীরা চাপা স্বরে বলল,
‘ অন্তু হাত ছাঁড়। লাগছে।’
অন্তুর হাতের থাবা আরও খানিকটা শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ লাগুক। আমারও লাগছে। তিন বছর ধরে কন্টিনিউয়াসলি লাগছে। কই? আমি তো অভিযোগ করি না। তাহলে তোর এতো হাসফাস কেন?’
‘ ছাঁড় অন্তু।’
‘ আমাকে ভালোবাসিস না কেন?’
‘ অন্তু এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’
‘ হোক বাড়াবাড়ি। বল, কেন ভালোবাসিস না আমায়? কেন? কি করলে ভালোবাসবি?’
বিরক্তি আর রাগে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো নীরার। জারি দিয়ে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
‘ জোরজবরদস্তি নাকি? ভালোলাগে না তাই ভালোবাসি না। এখন কি জোর করে ভালোবাসাবি আমায়? এতোটা নীচে নেমেছিস তুই।’
অন্তু এবার রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল। ইচ্ছে করেই হাতের বাঁধনটা শক্ত করল সে। রাগান্বিত মস্তিষ্ক নীরাকে কষ্ট দিতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত কোমল মনের সাথে পেরে উঠল না। হাতটা ঝাঁকি দিয়ে ছেড়ে দিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে হিসহিসিয়ে বলল,
‘ ভালোবাসিস না অথচ সস্তা মেয়েদের মতো আগেপিছে ঘুরিস কেন? খবরদার আশেপাশে আসবি না আমার।’
নীরা হতভম্ব চোখে অন্তুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ থেকে টসটসে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। অন্তু সত্যিই কথাটা বলল? তাকে সস্তা, নোংরা মেয়েদের সাথে তুলনা করতে পারল? কন্ঠে আটকাল না? নীরা কী সত্যিই এতো সস্তা? নীরার বুকের ভেতর উথলে উঠল কান্না। বইটা টেবিলের ওপর রেখে সেল্ফের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়াল। এতো কষ্ট হচ্ছে কেন তার? অন্তুর কথাগুলো ঘুরেফিরে কানে এসে বাজছে। নীরা দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে উঠে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। ওড়নার আঁচল কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন করে। মনে মনে খুব করে কামনা করে, এই সস্তা আমিটার যেন খুব জলদিই মরণ হয়। খুব খুব জলদি মরণ হয়। এই সাংসারিক টানাপোড়েন। পরিবার আর মান-সম্মানের চিন্তায় অস্থির থাকার চেয়ে মরণটা কি সহজ নয়?
সুন্দর ঝকঝকে সকাল। আকাশে ছড়ানো ছিটানো শুভ্র মেঘমালা। উজ্জ্বল সোনালি রোদে ঝলমল করছে পুরো শহর। নম্রতা ব্যাগ কাঁধে চেম্বারের সামনে পায়চারী করছে। হাতে এসাইনমেন্ট। সাদা-নীল সালোয়ার-কামিজ আর ঘন খোলা চুলে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। নম্রতা পায়চারী থামিয়ে ঘড়ি দেখল, দশটা ঊনত্রিশ। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দরজার দিকে উঁকি দিল নম্রতা। ঠিক তখনই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো আরফানের এসিস্ট্যান্ট। হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ নম্রতা মাহমুদ কে?’
নম্রতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘ আমি।’
‘ স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বললেন। ভেতরে যান।’
নম্রতা মাথা হেলিয়ে আবারও ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘড়িতে ঠিকঠাক দশটা ত্রিশ। দুই হাতে এসাইনমেন্টের ফাইলটা চেপে ধরে ঠোঁট উল্টাল নম্রতা। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিরবির করল, ‘ ব্যাটা দেখি বহুত পান্চুয়াল।’ দরজার সামনে দাঁড়িয়েই জোরেসোরে শ্বাস ছাড়ল নম্রতা। মন থেকে সব রকম ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে মন ও মস্তিষ্ককে শান্ত করল। তারপর ধীর হাতে দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল।
‘ আসতে পারি?’
আরফান গভীর মনোযোগে সামনে রাখা ফাইল ঘাটছিল। দুই ভ্রুর মাঝখানে হালকা কুঁচকানো। গায়ে গাঢ় নীল শার্ট। কব্জির ওপর সাদা চকচকে ব্র্যান্ডেড ঘড়ি। নম্রতার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাল আরফান। কুঁচকে থাকা ভ্রু’জোড়া সোজা করে গমগমে কন্ঠে বলল,
‘ আসুন।’
নম্রতা দরজাটা সাবধানে লাগিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। আরফানের টেবিলের কাছাকাছি এগিয়ে যেতেই বিচলিত হয়ে পড়ল নম্রতা। আরফান প্রথম থেকেই ঠান্ডা দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে তাকে। আরফানের ঠান্ডা, গম্ভীর দৃষ্টি নম্রতাকে ক্রমেই বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। ছেলেটা কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকায়। ঠান্ডা, মায়াভরা চোখদুটো বুকের কোথাও তীরের মতো আটকে যায়। চোখ ফেরাতে দেয় না, ভাবতে দেয় না। চিন্তাগুলোকে করে দেয় এলোমেলো। ভারী টেবিলটির ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর পর নম্রতা উপলব্ধি করল ,উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের এই অসভ্য পুরুষটিকে আজ ভালো দেখাচ্ছে। নাকের ডগায় ঝুলে থাকা গাম্ভীর্যটাই যেন তাকে পরিপূর্ণ পুরুষ করে তুলেছে। নম্রতা টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই গমগমে কন্ঠে বলল আরফান,
‘ বসুন।’
নম্রতা জানে না কেন আরফানের এই ছোট্ট কথাতে চমকে উঠল । গলা শুকিয়ে এলো। সন্তপর্ণে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার টেনে বসল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ বসে রইল। আকাশ-পাতাল চিন্তাভাবনা করে হঠাৎই নিজেকে শক্ত, স্বাভাবিক করে তুলল সে। মাথা তুলে সরাসরি আরফানের চোখের দিকে তাকাল। আরফান চেয়ারে ঠেস দিয়ে নম্রতার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ঘাড়টা হালকা কাত। দৃষ্টি গভীর ও শান্ত। নম্রতা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
‘ হ্যালো স্যার।’
আরফানের ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখা গেল না। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘ আপনার এসাইনমেন্ট?’
অপমানে নম্রতার ফর্সা মুখটা কালো হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁতের এসাইনমেন্টটা এগিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে রইল। আরফান আজ ঝামেলাহীনভাবেই সাক্ষর করল। সাক্ষর শেষে ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ কমপ্লিট। আর কিছু?’
নম্রতা মাথা নেড়ে ‘না’ জানাল। এসাইনমেন্টটা উল্টেপাল্টে দেখে নিতেই গম্ভীর কন্ঠে বলল আরফান,
‘ তাহলে আসুন। আমার এখন ব্রেকফাস্টের সময়। একটু পর রাউন্ডে যেতে হবে।’
নম্রতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে নিয়েও হঠাৎই থমকে গেল। কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিমা করে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে সামনের দেয়ালটির দিকে তাকিয়ে রইল। কপালের ওপর পড়ল চিন্তার ভাঁজ। আরফান ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ কোনো সমস্যা?’
নম্রতা জিহ্বা দিয়ে উপরের ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে আরফানের দিকে তাকাল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
‘ একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
আরফান একই ভঙ্গিমায় উত্তর দিল,
‘ বলুন।’
নম্রতার অস্বস্তি আরও বাড়ল। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। আরফান পুরোটা সময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল নম্রতাকে। মেয়েটা একটু কেমন যেন। অদ্ভুত, ক্ষ্যাপা আবার পাগলাটে। আরফান কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে বলল,
‘ কি হলো? বললেন না?’
নম্রতা আমতা আমতা করে বলল,
‘ আপনার বন্ধু নিষাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করার ছিল।’
আরফানের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। খানিকটা বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে বলল,
‘ নিষাদ সম্পর্কে কি প্রশ্ন আপনার? আপনি নিষাদকে চিনেন?’
নম্রতার হৃদপিন্ড কাঁপছে। পরের প্রশ্নটা করতে গিয়ে জিহ্বা ভারী ভারী লাগছে। আচ্ছা? সত্যিই কি নিষাদই নম্রতার সে? আরফান কি তাকে পৌঁছে দিতে পারবে তার গন্তব্যে? নম্রতা অনেক কষ্টে প্রশ্ন করল,
‘ হয়ত চিনি। আচ্ছা? উনি কি খুব পড়াকু? ঘন ঘন লাইব্রেরিতে যাওয়ার অভ্যাস আছে উনার?’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ। কিন্তু কেন?’
নম্রতা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ উনি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারেন, তাই না?’
আরফান সরু চোখে তাকাল। পরমুহূর্তেই ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি। ঠেস মারা কন্ঠে বলল,
‘ ওয়েট! ওয়েট! প্রেমে টেমে পড়েছেন নাকি নিষাদের? ওহহো, গ্রেট! আপনার জন্য অসম্ভব কিছুই না।’
আরফানের কথায় অনুভূতি নামক প্রজাপতিরা যেন প্রমোদ গুনল। মুহূর্তেই রঙিন প্রজাপতিগুলো মিলিয়ে গিয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠল চারপাশ। ধেবে থাকা রাগটা ফুঁস করে উঠল। চেয়ার থেকে তড়িৎ বেগে উঠে দাঁড়িয়ে তপ্ত কন্ঠে বলল নম্রতা,
‘ যে যেমন তার কাছে পৃথিবীর সবার চরিত্রও তেমন। কথায় আছে না? সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। আসছি ডক্টর আরফান আলম স্যারররর। আল্লাহ হাফেজ।’
কথাগুলো বলে এক মুহূর্তও দাঁড়াল না নম্রতা। এই লোক নিজেকে ভাবেটা কি? প্রিন্স চার্মিং? নাকি এই বিশ্ব-ভ্রহ্মান্ডের মালিক? সামান্য ডাক্তারের ডিগ্রি অর্জন করেই এতো অহংকার! কিন্তু এ-কি! নম্রতার রাগে ফুঁসতে থাকা মস্তিষ্ক হঠাৎই কেমন শান্ত হয়ে গেল। পেশীগুলো বেয়ে নেমে গেল অদ্ভূত এক শীতলতা। সচেতন মস্তিষ্কে বাজতে লাগল একটাই প্রশ্ন। একটাই চিন্তা। নিষাদ ঘন ঘন লাইব্রেরি যেত! পড়াকু ছিল। গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতাও তার স্পষ্ট। তবে কি এই সেই পুরুষ? নম্রতার কল্পনার কল্প পুরুষ? কিন্তু তার সন্ধান কি করে পাবে নম্রতা? কোথায় থাকে সে? নম্রতার কথা কি আদৌ মনে পড়ে তার?
বারোটায় এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসল নম্রতা। সাথে নীরা আর ছোঁয়া। নীরার চোখ-মুখ থমথমে। ফর্সা নাকের ডগা লাল। চোখদুটোও খানিক ফোলা। ছোঁয়া-নম্রতার আড্ডার আসরে তার মনোযোগটাও আজ নিতান্তই আলগা। নম্রতাও খানিকটা চিন্তিত, অবিশ্রান্ত। ক্যান্টিনের সুস্বাদু চা আজ তেঁতো, বিশ্রী। আড্ডাও জমছে না। চারদিকে কেমন বিষণ্ন, উদাস ভাব। অন্তু ক্যাম্পাসেই ছিল। কিন্তু নানা টালবাহানায় ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছে এই ঘন্টা দুই হলো। রঞ্জন পূজাকে নিয়ে ব্যস্ত আর নাদিম ব্যস্ত টিউশনিতে। নম্রতা বিষণ্ন মুখ নিয়ে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে রইল। মনটা খুব পোড়াচ্ছে তার। পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে।
হারিয়ে যাওয়া মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার আকুতিতে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে এই স্বপ্নময় সুন্দর পৃথিবী। তার যে ওই লোকটাকে চাই-ই চাই। বছরের পর বছর জমিয়ে রাখা প্রশ্নের উত্তরগুলোর জন্য হলেও তাকে চাই। এমন বিষণ্ন, মৃদুল পরিবেশে দমকা হাওয়ার মতো উড়ে এলো নাদিম। গিটার আর ব্যাগটা ধুম করে টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে গা এলিয়ে হাঁপাতে লাগল। গরমে দরদর করে ঘামছে তার শরীর। হলুদ শার্টটা ঘামে ভিজে ল্যাপ্টে আছে গায়ে। একদম সাদা ফর্সা মুখটা সূর্যের তাপে রক্তের মতো লাল রঙ ধারণ করেছে। নাদিমের হঠাৎ আগমনে চমকে উঠল নম্রতারা। ছোঁয়া কোল্ড ড্রিংকের ক্যান হাতে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল। নাদিম বিদ্যুৎবেগে উঠে গিয়ে ছিনিয়ে নিল কোল্ড ড্রিংকের ক্যান। এক চুমুক সবটা শেষ করে ভারি আয়েশী কন্ঠে বলল,
‘ বালের লোকাল বাস। জীবনডারে মেইনহল বানাইয়া ছাইড়া দিছে একদম। শালার যেদিকে তাকাই শুধু দূর্গন্ধ। এই গরমের দিন এতো ঘষাঘষি কইরা বাসে উঠতে মন চায়? শালার বুইড়া আংকেলগুলোও আরেক সার্কাস। এমনভাবে শরীরের ওপর পড়ে মনে হয় নয়া নয়া পিরিতি জাগছে, রিডিকিউলাস। মনডায় চায় বা..’
নাদিমকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফুঁসে উঠল ছোঁয়া। রণচণ্ডী রূপ নিয়ে বলল,
‘ তুই আমার কোল্ড ড্রিংক খেলি কেন? আমি মাত্রই কিনে আনলাম বোতলটা। ফাজিল একটা। অসভ্য। আর এইসব কি ভাষায় কথা বলিস তুই? ন্যূনতম ব্যক্তিত্ববোধ নেই তোর? ছিঃ। আমার জাস্ট ঘেন্না লাগে।’
নাদিম ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
‘ আরেকটায় ব্যক্তিত্ব মারাইতে আসছে। তোর ওই প্রফেসর বাপরে গিয়া ব্যক্তিত্ব জ্ঞান দে গা বাল। আমার সামনে আজাইরা ঢং মারাইতে আসবি না।’
এমন সময় ক্যান্টিনে এসে ঢুকল রঞ্জন। নাদিমের পাশের চেয়ারটা টেনে দু’দিকে পা দিয়ে উল্টো করে বসল। শার্টের উপরের দুই বোতাম খুলে দিয়ে কলার ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ প্রচন্ড গরম আজ। আমি বোধহয় লেইট। পূজাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলাম। মেয়েটা অসুস্থ।’
তারপর আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে কপাল কুঁচকাল। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ এই অন্তু কই রে?’
নাদিম ততক্ষণে গিটার তুলে নিয়েছে হাতে। দক্ষহাতে টুংটাং সুর তুলে চলেছে একের পর এক। রঞ্জন খাওয়ার জন্য কিছু অর্ডার করে বন্ধুদের দিকে তাকাল। নম্রতা হেসে বলল,
‘ দোস্ত? তোরে তো গরমের দিনেও হেব্বি হ্যান্ডসাম লাগে রে। তুই আমার বন্ধু না হলে আমি তোর প্রেমে পড়ে যেতাম।’
রঞ্জন সামনে রাখা ম্যাগাজিন দিয়ে বাতাস করতে করতে হাসল। চোখ টিপে বলল,
‘ আর তুই আমার বান্ধবী না হলে আমি তোরে বিয়ে করে ফেলতাম। আহা! সুন্দরী বউ।’
রঞ্জনের কথায় সামনে থাকা খাতাটা ছুঁড়ে মারল নম্রতা। নাদিম গিটার বাজানো থামিয়ে দাঁত বের করে হাসল। ডান পা দিয়ে রঞ্জনের কোমর বরাবর লাথি মেরে বলল,
‘ আর তোমার পূজা তোমারে এই এঙ্গেলে পূজা করত মামা।’
নাদিমের কথায় হেসে ফেলল সবাই। হঠাৎই হাসি থামিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল রঞ্জন,
‘ তুই ঠিক আছিস নীরু? চোখ-মুখ এমন লাগছে কেন?’
নীরা হাসার চেষ্টা করল। দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ আমার কি হবে? ঠিক আছি।’
সবার চোখ এবার নীরার দিকে আটকে গেল। নাদিম টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বেশ খেয়াল করে দেখল। চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল,
‘ জামাই মইরা গেছি নাকি রে? কান্দিছস মনে হইতাছে। চোখ-নাক লাল ক্যান? জামাই মরলে কান্দোন লাগব? আমরা আছি না? দরকার পড়লে আরেকটা জামাই ধইরা আইনা দিমু্। প্যারা নাই।’
নাদিমের কথায় হেসে ফেলল নীরা। চোখ নামিয়ে বলল,
‘ শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।’
নম্রতা তাড়াহুড়ো করে নীরার কপালে হাত রাখল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ জ্বর টর তো নেই। কি হয়েছে বল তো? কেঁদেছিস কেন?’
নম্রতার কথার মাঝেই বন্ধুদের আড্ডায় এসে পৌঁছাল অন্তু। মুখ ভার করে পাশের টেবিল থেকে চেয়ার টেনে রঞ্জনের পাশে বসল। নীরা অন্যদিকে তাকিয়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ কাঁদিনি তো।’
কথাটা শুনে চোখ তুলে তাকাল অন্তু। টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ আর ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
‘ কেঁদে কেটে মরে যাওয়ার মতো কি হয়েছে? আশেপাশের মানুষ কেঁদে কেটে অমাবস্যা নামায় ফেলছে দেখি।’
নাদিম গিটারে দ্রুততর টুন বাজিয়ে বলল,
‘ উক্ত মহিলার জামাই ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। তাহাকে অতিশীঘ্রই একটা জামাই গিফটাইতে হইবে। এই মহান কাজের জন্য তোমরা তৈরি সেনা?’
সবাই টেবিলে হাত বাজিয়ে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ ইয়েসসস!’
নীরা সামনে থাকা বইটা নাদিমের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে হেসে ফেলল। মুখে বলল,
‘ চুপ থাক হারামি।’
নাদিম বইটা ক্যাচ ধরে বিগলিত হাসল। ধীরে ধীরে কাঁটতে লাগল উত্তপ্ত দুপুরের বিষণ্নতা। জমে উঠল আড্ডা। মেতে উঠল প্রতিটি প্রাণ।
কর্ম ব্যস্তময় দীর্ঘ দিনটা পাড় করার পর রাতে যখন ফোনটা হাতে নিল নম্রতা ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল আরফান নামক অসভ্য লোকটির কথা। আরফানকে অনলাইনে দেখেই সকালের অপমানগুলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাজতে লাগল। আরফানের প্রোফাইলের দিকে কিছুক্ষণ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ইনবক্সে ঢুকল। নির্ভুল বাংলায় লিখল,
‘ আপনার মতো অসভ্য, অভদ্র আর ইতর মানুষ আমি আমার জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। একটা মেয়েকে কতটা বাজেভাবে হেনস্তা করেছেন আপনি। কাল আমাকে হিপোক্রেট বললেন। হিপোক্রেট মানে বুঝেন আপনি?
নীল চিরকুট পর্ব ১১+১২
দেখে তো মনে হয় নকল টকল করে, প্রফেসরকে টাকা খাইয়ে নয়তো নকল সার্টিফিকেট দিয়ে ডাক্তার হয়ে গিয়েছেন।’
এভাবে শুরু করে মাথায় যা এলো তাই তাই লিখে ইনবক্স ভরিয়ে ফেলল নম্রতা। আরফান অনলাইনেই ছিল। নম্রতার লেখা প্রত্যেকটা ম্যাসেজ আরফান সীন করছে দেখে নম্রতার বুকে এক আকাশ স্বস্তি মিলল। মনের সব ঝাঁঝ ইনবক্সে মিটিয়ে দিয়ে অসভ্য লোকটাকে ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিল নম্রতা। আহ্ শান্তি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই….
