নীল চিরকুট পর্ব ২৯+৩০
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ক্যান্টিনে এতোগুলো মানুষের সামনে নীরার ক্রোধের এমন নগ্ন প্রকাশ ঘটবে তা কখনো চিন্তাই করতে পারেনি অন্তু। বন্ধুরাও নীরার এমন রূপে স্তব্ধ, বিস্মিত। একটু আগেই ক্যান্টিনের যে টেবিলটিতে চলছিল আড্ডার বহর সেখানে এখন ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। আড্ডার মাঝেই হঠাৎ ফোন বাজল নীরার। ফোন কানে নিয়ে বাইরে গেল ঠিক। কিন্তু ফিরে এলো ভয়াবহ রূপে। কথা নেই বার্তা নেই অন্তুর গালে কষে এক চড় বসাল। এমন কিছুর জন্য বন্ধুমহলের কেউই প্রস্তুত ছিল না। সবার চোখেই আতঙ্ক আর প্রশ্ন। রঞ্জনের মতো শান্ত ছেলেও আজ বিভ্রান্ত।
‘ আমার তোর প্রতি ঘেন্না হচ্ছে অন্তু। অতটা নীচ তুই কি করে? বারবার বলেছিলাম বন্ধুত্বটা রাখতে দে। বন্ধু হিসেবে বাঁচতে দে কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম নিমকহারামরা কখনও বন্ধু হতে পারে না। যে কুক্ষণে তুই আমার বন্ধুর তালিকায় যুক্ত হয়েছিলি সেই কুক্ষণকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি আমি। ওইদিনটি আমার জীবনে না এলেই পৃথিবীর সবথেকে সুখী মেয়ে হতাম আমি।’
রাগে শরীর কাঁপছে নীরার। চোখদুটোতে জল টলমল করছে। ফর্সা মুখটা হয়ে উঠেছে লাল। নম্রতা থতমত খেয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ কি বলছিস এসব? এটা পাব্লিক প্লেস। আমরা পরে আলোচনা…’
নম্রতাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল নীরা,
‘ তুই চুপ কর নমু। দয়া করে আমার ব্যাপারে আর মাথা ঘামাতে আসিস না। আমার অন্তুর কাছে শুধু একটা প্রশ্নেরই উত্তর চাই। কেন ভেঙে দিলি বিয়েটা? বিয়ের ডেইট ফিক্সড হয়ে গিয়েছিল অন্তু। সবাইকে দাওয়াতও দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমার চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে তোর কি লাভ হলো? আমার একটা ছোট বোন আছে অন্তু। ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভাঙার মানে কী আদৌ জানিস তুই? আমার জীবন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে তোর?
অন্তু জবাব দিল না। রাগে দুঃখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য নীরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ পাগলামো! পাগলামো! সত্যি করে বল তো, এই পাগলামো কিসের জন্য? আমার জন্য নাকি আমার সুন্দর শরীরের জন্য? তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমার ঘেন্না লাগছে এখন।’
অন্তু এবার চোখ তুলে তাকাল। নীরার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রাখল। দুই জনের চোখেই সীমাহীন রাগ। অন্তু নীরার ডান হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে কটমটে কন্ঠে বলল,
‘ যা করেছি বেশ করেছি। ভালোবাসি বলে দাম নেই, না? খুব তো বিয়ের জন্য নাচছিলি। যা কর এখন বিয়ে।’
নীরার এখন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় বলে বোধ হচ্ছে। নীরা খুব জলদিই নিজেকে সামলে নিল। অন্তুর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,
‘ তুই মরে যাচ্ছিস না কেন, বল তো? আই উইশ, এক্সিডেন্টের দিনটাই তোর শেষ দিন হতো।’
অন্তু দূর্বোধ্য হাসল। প্রচন্ড রাগে আবারও কষে চড় বসাল নীরা। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ তোর হাসি আমার সহ্য হচ্ছে না।’
‘ আর তোর সুখ আমার সহ্য হচ্ছিল না।’
নম্রতা দুই হাতে মুখ চেপে বসে আছে। নীরা যথেষ্ট বাস্তববাদী মেয়ে। নিজেকে সংযত করার শক্তি তার প্রচন্ড। সেই নীরার এমন দশায় বুক বেয়ে কান্না আসছে নম্রতার। ক্যান্টিনের সবাই ‘হা’ করে মজা গিলছে। অবস্থা বেগতিক দেখে উঠে দাঁড়াল রঞ্জন। অন্তুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে নম্রতাকে ইশারা করল। নাদিম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। কাকে ধমক দিবে, কাকে সান্ত্বনা দিবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। প্রেম, ভালোবাসার মতো ঠুনকো বিষয়গুলো এই প্রগাঢ় বন্ধুত্বেও এতোবড় সংকট তৈরি করতে পারে? নম্রতা নিজেকে সামলে নিয়ে নীরার কাঁধে হাত রাখল। অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ দোস্ত! সবাই দেখছে।’
নীরা উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ অন্তুর দিকে তাকিয়ে থেকে শান্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। কারো সাথে কথা বলল না। কারো দিকে এক পলক তাকাল না পর্যন্ত। অন্তুও রঞ্জনকে ধাক্কা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে। তারপর বাইক নিয়ে নিরুদ্দেশ। বাকি চারজন দিশেহারা পথিকের মতো চেয়ে রইল। কাকে বুঝাবে? কাকে শাস্তি দেবে? দুই জনেই যে প্রাণ। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে হলের উদ্দেশ্য রওনা দিল নম্রতা। নীরাকে কোনোভাবেই একা ছাড়া চলবে না। কিছুতেই না। ছোঁয়া গাড়ির চাবিটা টেবিলের ওপর রেখে রঞ্জন আর নাদিমের দিকে তাকাল। শান্ত ও শীতল তাদের দৃষ্টি।
বিছানার পাশে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে আছে নীরা। হল ফাঁকা। প্রায় সময়টাতে প্রায় সবাইই হলের বাইরে থাকে। নীরা এই প্রথম হাউমাউ করে কাঁদছে। মুখে ওড়না গুঁজে কান্না নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। মায়ের বলা কথাগুলো ঘুরেফিরে বুকে কাঁটার মতো বিঁধছে,
‘ তোকে আমি পেটে ধরেছি এই দুঃখেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। হারামজাদী, তুই কী মরে যেতে পারিস না? এক বোতল বিষ খেয়ে মরে যা না। এক বছর ধরে পাত্র খুঁজতে খুঁজতে যাই একটা জুটলো সেটাতেও বাগরা। ঢাকায় তুই প্রেম করে বেড়াস? নাগর জুটাইছিস? আর কি কি করিস সেখানে? বিয়ে কেন ভেঙে দিল তারা? তোর কাকারা তো পারলে ঢোল পেটাচ্ছে পাড়ায়। আমি নাকি পড়ার নামে মেয়েকে ঢাকায় বে….’
নীরা আর ভাবতে পারে না। ওর সত্যিই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অন্তু এতো পাগল কেন? এতো বড় সর্বনাশটা কেন করল ও? এমন সর্বনাশা ভালোবাসা তো নীরার চাই না। অন্তু ওকে এতটা অসম্মান কি করে করল? পাড়ায় এখন নীরার জয়জয়কার। নীরা ঢাকায় প্রেম করে। প্রেমিকের সাথে তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে বলেই বিয়ে ভেঙেছে। গ্রামের মানুষ নিশ্চয় আরও বিশ্রী বিশ্রী কথায় জর্জরিত করছে মাকে? এবার কী আরও পাত্র আসবে ঘরে? নীরা নিজের কথা ভাবছে না। তার ছোট একটা বোন আছে। যার বড় বোনের চরিত্রে এতো বড় দাগ তাকে বিয়ে দেওয়াটা কী অতো সহজ হবে? কি পোড়াকপালি নীরা। কেন এসেছিল সে ঢাকায়? কেন ভর্তি হয়েছিল এই অভাগা বিশ্ববিদ্যালয়ে? তার থেকে কোনো মধ্যবয়স্ক লোকের বউ হয়ে নির্যাতন সহ্য করাটাও কি ঢের ভালো ছিল না? নীরা রাগে-দুঃখে হাতের কাছে থাকা কাঁচের মগটা ছুঁড়ে মারল দূরে। প্রচন্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল কাঁচের মগ।
অসচেতনতায় বিছানার নিচে থাকা অপ্রয়োজনীয় লোহার শিকরা ঢুকে গেল হাতে। নীরা শিক বের করা নিয়ে তেমন কোনো ব্যস্ততা দেখাল না। উদাসী ভঙ্গিতে বসে রইল। ভেসে যাক সব রক্ত। সে মরে গেলেই শান্ত হবে পৃথিবী। মায়ের লজ্জা, অন্তুর পাগলাটে ভালোবাসা সব ফুরাবে। নীরার মৃত্যুটাই তো চাই। কিন্তু এই মৃত্যুও বড় বিশ্বাসঘাতক। নিমোকহারাম। এমন সময়ে হন্তদন্ত করে ছুঁটে এলো নম্রতা। নীরাকে এমন অগোছালো হয়ে বসে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল সে। ফ্লোরে রক্ত গড়াতে দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো তার। তাড়াহুড়ো করে নীরার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। ডানহাতটা তুলে নিয়ে চোখ-মুখ খিঁচে শিক টেনে বের করল। হাতটা ওড়না দিয়ে বেঁধে দিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ এসব কী নীরুপাখি? এতো কেন ভাবছিস তুই? দুনিয়া ভেসে যাক, আমি তোর সাথে আছি। যে তোর দিকে আঙ্গুল তুলবে তার আঙ্গুল কেটে রেখে দেব। কাঁদিস না সোনা। তুই কাঁদলে আমিও কেঁদে দেব। পরে কিন্তু থামাতে পারবি না।’
নীরা এবারে নম্রতার ওপর হামলে পড়ল। দুই হাতে জাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এই এক আশ্রয় তার। এই মেয়েটা তাকে একটু হলেও বুঝে। অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। নীরার এমন কান্নায় ভেতরটা ফেঁটে গেলেও নিজেকে সামলে নিল নম্রতা। নীরাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে হসপিটালে যেতে রাজি করাল। লোহার শিক ঢুকে গিয়েছে ইনজেকশন দিতে হবে নয়তো ইনফেকশন হতে পারে। নীরা বুঝদার বাচ্চাদের মতো বুঝল। নম্রতার কথামতোই চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে শান্ত হলো।
নীরার হাতে ইনজেকশন আর ব্যান্ডেজের কাজ শেষ হয়েছে সেই অনেকক্ষণ আগে। এখন নীরার ব্রেইন ওয়াশের জন্য খাবারের নামে তাকে নিয়ে হাসপাতালের আশেপাশেই কোনো রেস্টুরেন্টে বসেছে রঞ্জন। নম্রতা ইচ্ছে করেই সাথে যায়নি। রঞ্জন খুব ভালো বুঝাতে পারে। নীরার এই ম্যান্টাল প্রেশার কমিয়ে আনার ক্ষমতা রঞ্জনের আছে। এই সময়ে রঞ্জন আর নীরাকে একা ছেড়ে দেওয়ায় উত্তম। তাছাড়া নম্রতারও বেশকিছু কাজ বাকি। মেডিক্যালে এসে ডাক্তারের খোঁজ না নিয়ে চলে যাবে তা তো হয় না। এই লোক আসলে করছেটা কী? এই দুনিয়ায় আছে? নাকি বিয়ে-শাদী করে সাজেক ভ্যালির মেঘে হাবুডুবু খাচ্ছে? নম্রতাকে তো জানতে হবে। নম্রতা আরফানের চেম্বারের সামনে এসে উঁকি দিল। চেম্বারের সামনে এসিস্ট্যান্টকে দেখা যাচ্ছে না। ভেতরে আরফান আছে কি নেই সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। নম্রতা কপাল কুঁচকে আবারও উঁকি দিল। সাথে সাথেই পেছন থেকে কেঁশে উঠল কেউ। নম্রতা বিদ্যুৎ বেগে পেছনে ফিরে তাকাল। আরফান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে শ্লেষাত্মক হাসি,
‘ কি অবস্থা? কাউকে খুঁজছেন?’
আরফানের কথায় হেঁচকি উঠে গেল নম্রতার। বুকে হাত দিয়ে বার দুই হেঁচকি তুলে মাথা নাড়ল। আরফানও নম্রতাকে অনুসরণ করে মাথা নাড়ল। বলল,
‘ খুঁজছেন না?’
নম্রতা মিনমিন করে বলল,
‘ আমি কাকে খুঁজব?’
আরফান পকেটে হাত মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘ সেটা তো আপনিই ভালো জানেন।’
‘ আমি কাউকে খুঁজছি না।’
কথাটা বলে আবারও হেঁচকি তুলল নম্রতা। আরফান বেশ গম্ভীর কন্ঠেই বলল,
‘ তাহলে নিশ্চয় চুরি করতে এসেছিলেন।’
নম্রতা চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ হসপিটালে কেউ চুরি করতে আসে?’
আরফান আলগা কন্ঠে বলল,
‘ আসতেই পারে। চুরের কি আর ধর্মজ্ঞান আছে?’
নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ কি এমন আছে আপনার চেম্বারে যে আমায় চুরি করতে হবে? আমাকে কি ভিখারি মনে হয়?’
আরফান হেসে বলল,
‘ না তা মনে হয় না। তবে…’
আরফানের কথার মাঝেই কয়েকবার হেঁচকি তুলল নম্রতা। আরফান ঠেস মারা কন্ঠে বলল,
‘ চেম্বারে বসুন, পানি খাওয়াই। হাজার হলেও আমাদের হসপিটালে চুরি করতে এসেছেন।’
নম্রতা চোখ রাঙাতেই কথা পাল্টাল আরফান,
‘ না মানে বেড়াতে এসেছেন। আপ্যায়ন তো করতেই হয়। চলুন ম্যাম।’
কথাটা বলেই চেম্বারের দরজার দিকে এগিয়ে গেল আরফান। দরজাটা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। নম্রতা ‘না’ করবে করবে করেও আর ‘না’ করতে পারল না। নম্রতা চেম্বারে ঢুকে চেয়ার টেনে বসল। আরফান স্টেথোস্কোপটা টেবিলে রেখে শার্টের হাতা গোটাল। চেয়ার টেনে ধীরে স্থিরে নম্রতার মুখোমুখি বসল। টেবিল ওয়েটটা দুই আঙ্গুল দিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে গভীর চোখে নম্রতার দিকে তাকাল। আরফানের এমন চাহনীর সামনে অসহায় হয়ে পড়ল নম্রতা। অস্বস্তিতে হাসফাস করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে প্রশ্ন করল আরফান,
‘ কি খাবেন?’
‘ হঠাৎ এতো আপ্যায়ন?’
আরফান জবাব না দিয়ে বলল,
‘ কফি খেতে হলে বাইরে কোথাও বসতে হবে। যেতে চান?’
আরফানের চোখদুটো আটকে আছে নম্রতার ঠোঁটে। নিচের ঠোঁটের মাঝ বরাবর কালো, ছোট্ট তিলটিতে। গোলাপী রঙে ছোট্ট কালো তিলটা কি সুন্দর মানিয়েছে। এই একবিন্দু কালো রঙেই যেন পৃথিবীর সব নেশা ধ্বংস আজ। নম্রতা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল। সাথে সাথেই ভিজে উঠল সেই অদ্ভুত সুন্দর তিল। কৃত্রিম আলোয় চিকচিক করে উঠল কালো রং। আরফান চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। তারপর আবারও আড়চোখে তাকাল নম্রতার ঠোঁটে। নম্রতা স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আমি কফি খাই না।’
‘ তাহলে কি খান?’
কথাটা বলে রহস্যময় হাসি হাসল আরফান। নম্রতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘ হাসছেন কেন?’
আরফান এবারও উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘ আপনার বিয়ের কী হলো?’
নম্রতা ফট করেই বলল,
‘ বিয়ের আবার কি হবে? বিয়ে হবে।’
‘ কবে হবে?’
‘ খুব শীঘ্রই।’
আরফান অদ্ভুত ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ ও।’
কথাটা বলে উঠে দাঁড়াল আরফান। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে নম্রতার পাশে এসে দাঁড়াল। আরফানকে এতো কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখেই ধুকপুক করে উঠল বুক। গলা শুকিয়ে এলো। ভাবনাগুলো হয়ে পড়ল এলোমেলো। আরফানের কাটা কাটা আকর্ষণীয় চোয়ালের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল নম্রতা। ভারী জিহ্বা নেড়ে বলল,
‘ কি হয়েছে?’
আরফান চোখের ইশারায় পানির গ্লাসটা দেখিয়ে বলল,
‘ পানি খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলাম। পানি খাবেন না?’
নম্রতা বিভ্রান্ত চোখে আরফানের দিকে তাকাল। কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা নিয়ে আড়চোখে আরফানকে পর্যবেক্ষণ করল। আরফান একবিন্দুও নড়ল না। আগের জায়গাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটো আটকে রইল নম্রতার মুখে, ঠোঁটে। নম্রতা অস্বস্তি নিয়ে পানি খেলো। পানি খেতে খেতেই আড়চোখে আরফানের দিকে তাকাল সে। আরফান তাকিয়েই ছিলো। চোখে চোখ পড়ল। কিছুটা সময় এভাবেই, অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়েই কেটে গেল তাদের। নম্রতা গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই দুই হাত ভাজ করে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল আরফান। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
‘ বিয়ের শপিং শেষ? একমাসে শেষ তো হওয়ার কথা, তাই না?’
নম্রতা হালকা কেশে বলল,
‘ বিয়ের শপিং কী অতো সহজে শেষ হয়? বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত চলতে থাকে।’
‘ তা হোক। কাল আপনি আমার সাথে লাঞ্চ করছেন। ঠিক একটায়।’
কথাটা বলে চঞ্চল চোখে নম্রতার ঠোঁটের দিকে চেয়ে রইল আরফান। নম্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ লাঞ্চ?’
‘ আপনি চাইলে ডিনারের দাওয়াতও দিতে পারি।’
আরফানের কথায় তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল নম্রতা। আরফানের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি দেখে বলল,
‘ আপনি মানুষটা খুব খারাপ।’
আরফান হেসে বলল,
‘ আপনার বিয়েটা সাকসেসফুল হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
‘ হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া মানুষ থেকে কোনোরূপ দাওয়াত আমি একসেপ্ট করি না।’
‘ কেউ একজন আমার কল রিসিভ করেনি।’
নম্রতা চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ বেশ করেছে। আমার পানি খাওয়া শেষ। এখন হলে ফিরব। পানির জন্য ধন্যবাদ।’
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ চলুন পৌঁছে দিই।’
নম্রতা সরু চোখে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ আপনি কেন পৌঁছে দিবেন? হসপিটালে আসা সব পেশেন্টদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আছে নাকি আপনার?’
আরফান ফোনটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
‘ পেশেন্টদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেই। তবে হসপিটালে যারা চৌর্যবৃত্তি আর উঁকিঝুঁকি দিতে আসে তাদের পৌঁছে দেওয়া যায়। এদের বিশ্বাস নেই। অন্যকারো চেম্বারে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ফেলতে পারে। আমি রিস্ক নিতে রাজি নই।’
নম্রতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আমি একা যেতে পারি।’
আরফান হেসে বলল,
‘ আমিও পৌঁছে দিতে পারি।’
রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে নম্রতা আর আরফান। কারো মুখে কথা নেই। তবুও মনের সাথে মনের চলছে বিস্তর কথা দেওয়া নেওয়ার খেলা। রিক্সার ঝাঁকিতে অনিচ্ছায় ছুঁয়ে যাওয়া দুটো হাত। একটু স্পর্শেই শরীরময় শিহরণ। রাজ্যের অস্বস্তি আর ভাবনাতীত ভালো লাগা। মনজুড়ে কতই না অনুভূতির খেলা। পুরোটা রাস্তা অসহনীয় এক ঘোরের মাঝেই কাটিয়ে দিল নম্রতা। আরফানের ঠোঁটেও কথা ফুটলো না। হলের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎই নম্রতার হাতের উপর হাত রাখল আরফান। ডানহাতের মুঠোতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দ্রুতই সরিয়ে নিল হাত। নম্রতা চমকে তাকাল। আরফানের ভাবলেশহীন মুখ তখন অন্যদিকে ফেরানো। আরফানের মনের ভাব বুঝা গেল না। নম্রতা হলের সামনে নেমে যেতেই প্রথম কথা বলল আরফান। কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বলল,
‘ কাল তবে দেখা হচ্ছে। ভালো থাকবেন।’
আরফানের ফিরতি রিক্সাটির দিকে মোহাচ্ছন্নের মতো চেয়ে রইল নম্রতা। রিক্সাটা মোড়ের বাঁকে হারিয়ে যেতেই হাতের মুঠোয় থাকা কাগজটির দিকে তাকাল সে, ‘ নীল চিরকুট!’
ঘন্টা দুই আগে সন্ধ্যা মিলিয়েছে। হলের প্রতিটি রুমে রুমে জ্বলে উঠেছে টিমটিমে আলো। নির্জন পথগুলোতেও ভূতগ্রস্তের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ল্যাম্পপোস্ট। অন্ধকারের দুষ্টুমিতে তারা প্রায় ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত। হলের পাশের ঝোপঝাড়গুলোর মাথায় তখন জমাট বাঁধা অন্ধকার। ইট-পাথরের শহরেও সানন্দে আলো ছড়াচ্ছে দুই একটা ঝিঁঝি পোকার দল। দুই তলার বারান্দা থেকে সেসবই লক্ষ্য করছিল নম্রতা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল গাছের প্রতিটি পাতার হেলদোল। গায়ে তার বাইরের পোশাক। এখনও পাল্টানো হয়নি। পাল্টানো হবে বলেও মনে হচ্ছে না। বুকের ভেতর ধুপধাপ হাতুড়ি পেটানো হৃদপিণ্ডটা একটা বারের জন্যও নিষেধ শুনছে না।
শরতের শিরশিরে বাতাসের সাথে ভেসে আসছে বেলীফুলের সুগন্ধ। পাশের রুমের কেউ একজন দিন কতক আগে বেলীফুলের চারা লাগিয়েছে বারান্দায়। সেই গাছে দু-দিন হলো ফুল এসেছে। সেই গন্ধেই ম ম করছে চারপাশ। বেলীফুলের সুগন্ধটা নাকে আসতেই হৃৎস্পন্দনটা থেমে গেল নম্রতার। হাতে ধরে রাখা নীল চিরকুটটা শক্ত করে চেপে ধরে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে সরে এলো জানালার কাছে। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা আলোয় চিঠিটা আবারও মেলে ধরল নম্রতা। ওই এক টুকরো চিঠিটাই দশম বারের মতো পড়তে আরম্ভ করল। এই তো পরিচিত সেই অক্ষর। পরিচিত সেই স্বাদ। পরিচিত সুগন্ধ। নম্রতা বুক ভরে শ্বাস টেনে টলমলে চোখে চেয়ে রইল নীলাভ কাগজের পাতায়,
‘ চিঠিতে সম্বোধন লেখার অভ্যাস আমার কোনো কালেই নেই। চিঠির সম্বোধনে কিছু লিখতে গেলেই মোটা মোটা চোখের অভিমানী একটা মেয়ে চোখে ভাসে। ভ্রু কুঁচকে বলে, তুমি কখনও সম্বোধনে কিছু লিখ না। সম্বোধনে কিছু না লিখলে কী চিঠি হয়? চিঠি হয় কিনা জানি না। কিন্তু ওই অভিমানী চোখদুটো বড় দেখতে ইচ্ছে হয়। বুকে শিশির বিন্দুর মতো শুভ্র অনুভূতির বর্ষন হয়। সেই অভিমানীকে অভিমান করার অসংখ্য সুযোগ দিতে ইচ্ছে হয়। অবসরে ভাবতে ইচ্ছে করে তার সেই অভিমানী মুখের নিখুঁত অবয়ব। কিন্তু পারি না। প্রত্যেকবারই মনে হয়, সে এমন নয়। অন্যরকম। সবচেয়ে অন্যরকম তার চোখ। সে কল্পনা থেকেও কল্পনাময়। রূপকথার থেকেও স্নিগ্ধ, সরল। আমি তাকে যত ভাবি সে আমায় তত ভাবায়। এসাইনমেন্টের খাতায় ভুল করে তার নাম লিখে ফেলি। পাতার পর পাতা লিখে যাই একটাই নাম। নতুন করে এসাইনমেন্ট করি সেখানেও সেই একই ভুল। আহ্ কি যন্ত্রণা! আজকাল প্রেসক্রিপশনের পাতাতেও লেখা হয়ে যায় তার নাম। কাটি। আবার লিখি। আবার কাটি। শেষমেশ নতুন কাগজ টেনে প্রেসক্রিপশন লিখি। আশেপাশে কারো পায়ে নুপুরের শব্দ হলেই চমকে তাকাই। কারো পায়ে তিল দেখলে চমকে উঠি। কিন্তু সবার পায়ের তিল তো তার মতো নেশাতুর নয়। ওমন মিষ্টি আর পবিত্রও নয়।
আমি জানি না, তুমি কে। তবে তোমার পা’জুড়ো আমার ভাবনার খুব কাছে। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না ঠিক। তবে, তোমার চোখদুটো আমায় টানছে। সেই চোখজোড়ায় উপচে পড়া অভিমানগুলো বারবার আমার অভিমানীর সাথে মিলে যাচ্ছে। আমার কল্পনায় তুমি ছিলে অন্যরকম। তাই বাস্তবের হঠাৎ সাক্ষাতের জটিলতাটা আমি ধরতে পারছি না। তবে কী আমি প্রেমিক হিসেবে ব্যর্থ? শুনো বিষব্যথা। নির্ঘুম রাত্রির নীলব্যথা, আমি আবারও একবার দুঃখ পেতে চাই। মিষ্টি দুঃখ, মিষ্টি ব্যথা পেয়ে স্বার্থক এক প্রেমিক হতে চাই। আমি খুব চেষ্টা করেও নম্রতা নামের মেয়েটির প্রেমে পড়তে পারছি না। তার চোখদুটো আমায় টানলেও সেই চোখ আমায় আকৃষ্ট করতে পারছে না। আমি এক জনম, হাজার জনম শুধু শ্যামলতাকেই চাই। তার প্রেমে আকন্ঠ ডুবে ব্যথায় ব্যথায় মরে যেতে চাই।প্রতিটি মুহূর্তে আমি শুধু তার প্রেমেই পড়তে চাই। আগামীকালের সেই দুপুরবেলায়, ঘেমে-নেয়ে ক্লান্ত হয়ে আমি আমার পরিচিত শ্যামলতাকেই দেখতে চাই। আমার অভিমানীকে কাল ফিরিয়ে দিও প্লিজ!
[ বিঃদ্রঃ শ্যামলতাকে বলবে আমার শেষ চিঠির উত্তর সে দেয়নি। সেই উত্তরটা আমার চাই।] ‘
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোঁটা টসটসে জল। ঠোঁটের কোনো ফুটল প্রাপ্তির হাসি। সেই কতদিন পর ফিরে পেলো সেই দমবন্ধ করা অনুভূতি। কিশোরী বয়সের অনুভূতিগুলো যৌবনেও কত তাজা! কত মিষ্টি! কত সুন্দর। প্রগাঢ় অনুভূতি নিয়ে বারান্দা পা মুড়ে বসে পড়ল নম্রতা। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বোজল। বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধটা নাকে আসতেই নম্রতার মনে পড়ল পুরনো এক চিঠির লাইন,
‘ তোমার আঙিনা বেলীফুলের গাছে গাছে ভরিয়ে দেব শ্যামলতা। রোজ সকালে মুগ্ধ চোখে সাদা ফুলের রাজ্য দেখবে তুমি আর আমি দেখব তোমাকে। তোমার সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে ল্যাপ্টে থাকবে কাজল। ঠোঁটে থাকবে নিষ্পাপ হাসি। সেই হাসিটা দেখার জন্য হলেও তোমার জন্য বেলীফুলের রাজ্য বানাব আমি। সেই রাজ্যের রাণী হবে তুমি। শুধুই তুমি। আর….’
‘ কাঁদছিস?’
নম্রতা চমকে চোখ মেলল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ কখন এলি? বুঝতেই পারিনি।’
নীরা ফোড়ন কেটে বলল,
‘ স্বপ্নে প্রেমিকের বাহুডোরে আঁটকে থাকলে আশেপাশের খেয়াল কি আর থাকে সোনা?’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘ বাজে কথা।’
নীরা নিঃশব্দে হাসে। তারপর হঠাৎই গম্ভীর মুখভঙ্গি নিয়ে চুপ হয়ে যায়। নীরাকে নীরব হয়ে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নম্রতা। বেশ রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,
‘ মন খারাপ?’
নীরা অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
‘ মন খারাপ কেন হবে?’
নম্রতা কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ ভাই তুই এতো স্বাভাবিক থাকিস কিভাবে? রোবট তো নস। তবুও অনুভূতিশূন্যের মতো ব্যবহার।’
নীরা হাসল। দেয়ালে ঠেস দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘ বাড়িতে খুব ঝামেলা হচ্ছে। কাকারা খুব বাজে বাজে কথা শুনাচ্ছে ভাইয়া আর মাকে। পুরো পাড়া জুড়ে বিশ্রী একটা খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। মা আমাকে খুব দ্রুত মরে যেতে বলেছে। ভাইয়া কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কাছের মানুষ, কাছের বন্ধুটি থেকে অপ্রত্যাশিত একটা ধাক্কা জুটেছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমার কাছে দুটো পথ খোলা আছে নমু। এক. নিজের কপাল চাপড়ে কান্নাকাটি করা নয়তো সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়া। দুই. নিজেকে এতোটা শক্ত করা যাতে এই বিষবাক্যগুলো প্রতিবেলার খাবারের সাথে খুব সহজেই হজম হয়ে যায়। সমাজের নীতিবাক্যগুলো ছুঁড়ির মতো ঢুকতে চাইলেও শরীরের প্রতিরোধে বারবারই ব্যর্থ হয়। আমি দ্বিতীয় অপশনটা চুজ করেছি। এই ব্যথাগুলো হজম করার চেষ্টা করছি। আমি যে পরিবার থেকে বিলং করি সেখানে এতো ইমোশন থাকা উচিত নয়।’
কথাটুকু বলে থামল নীরা। নম্রতার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল,
‘ আমাদের পৃথিবীতে খুব অন্যায় একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের সাথেই বেঁধে গিয়েছে আমাদের ভাগ্য। এখানে কারো কারো জীবন থাকে সুখের ফুলে মোড়ানো। এরা কখনো সত্যিকারে দুঃখ সওয়ার সুযোগ পায় না। আবার কারো কারো জীবন থাকে দুঃখ ফুলে মোড়ানো। এরা কখনো সত্যিকারের সুখ ফুলের সন্ধান পায় না। কল্পনায় সুখ ফুলের অবয়ব এঁকেই পাড় করে দেয় গোটা জীবন।’
নম্রতা চুপ করে রইল। নীরাও আর কথা বাড়াল না। হঠাৎ করেই নিজস্ব ভাবনায় ডুব দিল। নম্রতা মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ অন্তুকে তুই ঘৃণা করিস না নীরু। ছেলেটা তোকে খুব ভালোবাসে বলেই…’
নীরা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
‘ অন্তু আমায় ভালো না বাসলেই হয়তো সুখ ফুলের অবয়ব আঁকাটা একটু সহজ হতো। সে জানে, ভালোবাসা অর্থ পাওয়া। আর আমি জানি, ভালোবাসা অর্থ দেওয়া। আফসোস, অন্তু আমায় ন্যূনতম সম্মানটুকুই দিতে পারল না।’
নম্রতা ব্যস্ত হয়ে বলল,
‘ তুই যেমনটা ভাবছিস তেমনটা কিন্তু নয়। আমি মানছি, ও ভুল করেছে। কিন্তু অপরাধটা যতটা ঘৃণ্যভাবে তোর সামনে এসেছে ততটা ঘৃণ্য কিন্তু নয়। অন্তু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছিল। মেনে নেওয়ার চেষ্টাও করেছিল সবটা কিন্তু সেদিন যখন তোর বিয়ের কার্ডের ছবি দেখালি তখন ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আমি ওকে শান্ত করার জন্যই সত্যটা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, তুইও ওকে ভালোবাসিস কিন্তু পরিস্থিতির চাপে সেই ভালোবাসাটা তোয়াক্কা করছিস না। কষ্ট তুইও পাচ্ছিস। তাই ওর উচিত নিজেকে সামলে নেওয়া যেমনটা তুই সামলে নিচ্ছিস। অন্তু আমার কথা বুঝেছিল। শান্তও হয়েছিল। কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করিনি যে ও এমন একটা কাজ করবে। আমি সরি দোস্ত।’
নীরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘ তোকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম নমু।’
নম্রতা অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ ভুল বুঝিস না প্লিজ। আমি তোকে হার্ট করতে চাইনি। আর না অন্তু চেয়েছিল। অন্তু তোর হবু বরের অফিসে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে ভদ্রলোককে খুবই নম্রভাবে বুঝিয়েছে, সে তোকে ভালোবাসে। আর তুইও ওকে ভালোবাসিস। পরিবারের চাপে বিয়েটা তোকে বাধ্য হয়েই মেনে নিতে হচ্ছে। প্রমাণ হিসেবে আমাদের একটা গ্রুপ ছবি দেখিয়েছে যেখানে তুই আর অন্তু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছিস। আরেকটা ছবি দেখিয়েছে, যেখানে অন্তুর কাঁধে হাত রেখে হাস্যোজ্জল মুখে দাঁড়িয়ে আছিস তুই। দুটোই গ্রুপ ফটো ছিল। তোর নামে বাজে কিছু বলা তো দূর, তোর এক্সট্রা কোনো ছবি পর্যন্ত দেখায়নি ও। অন্তু আমাদের বন্ধু নীরু। তুই একটাবার চিন্তা করে দেখ, অন্তু, নাদিম, রঞ্জন এমন কিছু করতে পারে যার জন্য আমাদের সাফার করতে হবে? কখনও করেছিল এমন কিছু? ওই হারামি ব্যাটা তার আর তোর ফ্যামিলিকে কি আলতু ফালতু বুঝিয়েছে আল্লাহ জানে। আজকালকার যুগেও যে এমন থার্ড গ্রেড মানসিকতার মানুষ থাকতে পারে তা ভেবেই অবাক হচ্ছি আমি।’
নীরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ এতো ভালোবাসা দেখাতে কে বলেছিল তোদের? বিয়েটা আমি নিজের ইচ্ছেই করছিলাম নমু। অন্তু কাজটা যেভাবেই করুক ফলাফল তো একই তাই না?’
নম্রতা হতাশ চোখে তাকাল। ব্যর্থ নিঃশ্বাস ফেলে ঘাড়টা হালকা কাত করল। বলল,
‘ নিজের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য শেষ চেষ্টা করার অধিকার তো সবার আছে নীরু। অন্তু তোর বন্ধু বলে তার থেকে তুই হাই লেভেলের কিছু এক্সপেক্ট করতে পারিস না। যে ছেলেটা চার চারটা বছর থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছে তার কাছে সব কিছু মুখবুজে সহ্য করে নেওয়ার ক্ষমতা আশা করলে তো চলবে না। তুইও জানিস, অন্তুর রাগ বরাবরই বেশি। ও যে রাগের মাথায় কিছু….’
নীরা ফুঁসে উঠে বলল,
‘ তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস? অন্তু আমার সাথে যা করেছে তা কম হয়ে গিয়েছে? তুলে নিয়ে ধর্ষণ করলে পার্ফেক্ট কিছু হতো? অথবা এসিডে ঝলসে দেওয়াটাই এক্সপেক্ট করছিলি তুই?’
নম্রতা প্রতুত্তরে কিছু বলার আগেই উঠে চলে গেল নীরা। নম্রতা হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নীরার ক্ষতি সে উপলব্ধি করতে পারছে। তাই বলে, অন্ধভাবে অন্তুকে ঘৃণা করাটাও তো ঠিক হচ্ছে না নীরার। ছেলেটা ওকে ভালোবাসে বলেই তো….. কথাগুলো ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নম্রতা।
রাত গড়িয়ে সকাল হতেই অস্থিরতা বেড়ে গেল নম্রতার। ভার্সিটি যাওয়ার সময়টুকু বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিল। ক্লাস, আড্ডা সবই যেন উবে গেল আজ। টলমলে আবেগ নিয়ে চিঠি লিখল। পছন্দ না হওয়ায় অসংখ্যবার কেটে-কুটে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। আবার লিখল। ফ্লোরটা নীল কাগজে ভরিয়ে ফেলে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়। আকাশে সূর্যের তেজ বাড়তেই বিছানার নিচে থাকা লাগেজ ঘেঁটে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি খুঁজে বের করল নম্রতা। তারপর, অনেকদিন আগে চিঠিতে যেমনটা লিখেছিল দু’জনে। যেভাবে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার কথা ছিল ঠিক সেভাবেই তৈরি হয়ে নিল সে। শাড়িটা সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মতো খুব যত্ন করে পড়ল। চোখে গাঢ় করে কাজল টানল। পাতলা ঠোঁটদুটো লাল রঙে রাঙাল।
ঘন চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে হাতে পরল কাঁচের চুড়ি। লাগেজের জিনিস, কাপড়ের র্যাক সব উল্টেপাল্টে ছোট্ট একটা আলতার শিশিও উদ্ধার করল সে। তারপর খুব যত্ন করে ফর্সা পায়ে আলতা লাগাল। কপালে পরল ছোট্ট লাল টিপ। কানে ঝুমকো পরতে পরতেই ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘরে এসে ঠেকল। সাথে সাথেই নম্রতার ফোনে ম্যাসেজ টুন বাজল। আরফানের দেওয়া ছোট্ট একটি বার্তা, ‘ অপেক্ষা করছি।’ এতোক্ষণ শান্ত থাকলেও শেষ মুহূর্তে এসে নার্ভাস হয়ে পড়ল নম্রতা। হাত-পা কাঁপতে লাগল। অস্বস্তি আর লজ্জায় ঢিপঢিপ করতে লাগল বুক। নম্রতা কিছুক্ষণ ঘরময় পায়চারী করল। দাঁত দিয়ে নখ কাটল। বারান্দা থেকে নিচের রাস্তায় উঁকিঝুঁকি দিল। ঠিক তখনই দ্বিতীয় বার্তাটি এলো, ‘ বারোটা বিশ বাজে মিস.নম্রতা।’ নম্রতা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। দুই তলা থেকে গেইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে অসংখ্যবার একটা চিন্তায় মাথায় খেলে গেল তার,
‘ বেশি সেজে ফেললাম না তো? আরফান কি ভাববে তাকে?’
পরমুহূর্তেই ভাবল,
‘ কি ভাববে? সে মোটেও ডাক্তার আরফানের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে না। সে যাচ্ছে একান্তই নিজের মানুষটির সাথে দেখা করতে। তার বহু আকাঙ্ক্ষিত সে এর সাথে দেখা করতে। এতো অস্বস্তি তাকে মানাবে কেন?’
গেইটের কাছেই রিকশায় বসে অপেক্ষা করছিল আরফান। গায়ে তার নীল পাঞ্জাবি। ডান হাতের কব্জিতে কালো রঙের ঘড়ি। একহাতের মুঠোয় কালো ফ্রেমের চশমা। সূর্যের তেজে অনেকক্ষণ আগেই ঘাম ছুঁটেছে তার শরীরে। আরফান দুই হাতে মুখ ঢেকে জোড়াল শ্বাস ফেলল।
মুখ থেকে হাত সরিয়ে ঘড়িতে সময় দেখল। তারপর বেখেয়ালি দৃষ্টিতে একবার গেইটের দিকে তাকাল। গেইট থেকে দৃষ্টি ফিরিয়েই কপাল কুঁচকে ফেলল সে। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও গেইটের দিকে তাকাল। গেইটে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীকে দেখেই কপালের ভাঁজটা সরে গিয়ে মসৃণ হয়ে গেল মুখ। ধবধবে ফর্সা নম্রতার গায়ে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি। মায়াবী চোখগুলোতে ঘন কাজল। আরফান ঢোক গিলল। পাঞ্জাবির কলার টেনে ঠিক করতে করতে চোখ ফেরাল সামনে। তারপর আবারও তাকাল নম্রতার চোখে। ঘোর লাগা মুগ্ধ দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে পায়ের কাছে এসে ঠেকলো। সুন্দর পা-জুড়ো আজ আলতায় রাঙা। হাতে রিনিঝিনি কাঁচের চুড়ির শব্দ। আরফানের মুখটা ধীরে ধীরে উজ্জল হয়ে উঠল। চোখে পর্দায় থাকা দ্বিধাটা সরে গেল মুহূর্তেই। রিকশার এক পাশে সরে বসে নির্বিকার কন্ঠে বলল,
‘ উঠে আসুন। এতো রোদ, গরমে মারা যাচ্ছি।’
আরফানের নির্বিকার কন্ঠে চোখ তুলে তাকাল নম্রতা। দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়ে রিকশায় উঠে বসল। রিকশায় উঠতে গিয়েই বাহুতে বাহুতে স্পর্শ লাগল দু’জনার। আরফান এবার আর আগের মতো সরে বসল না। দীর্ঘক্ষণ নীরব থেকে বলল,
‘ ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করালেন আমায়।’
নম্রতার কাট কাট জবাব,
‘ ত্রিশ মিনিটেই ক্লান্ত? মেয়েরা চাইলে চার বছরও অপেক্ষা করতে পারে। অপেক্ষা করতে পারে অনন্ত জীবন। আচ্ছা? চার বছরে কত মিনিট হয় জানেন? চার বছরে হয়, বিশ লক্ষ তিয়াত্তর হাজার ছয়শ মিনিট। সেই হিসেবে ত্রিশ মিনিট খুবই অল্প। তাই নয় কি?’
আরফান জবাব দিল না। চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নম্রতার চোখে চোখ রাখল। গাঢ় কন্ঠে বলল,
‘ অপেক্ষা কী সবসময় একপাক্ষিকই হয়?’
নম্রতা ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল,
‘ হয় না?’
আরফান নিশ্চুপ চেয়ে রইল নম্রতার চোখে। খুবই সাধারণ মুখটিতে জ্বলজ্বল করা অভিমানী চোখদুটোতে আকন্ঠ ডুবে গিয়ে হঠাৎই বলল,
‘ আপনাকে দুটো বিষয় জানিয়ে রাখা আমার কর্তব্য। প্রথমত, আপনার “অতি শীঘ্রই হয়ে যাওয়া” বিয়েটা কখনোই হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, সন্ধ্যার আগে আপনার হলে ফেরাটাও হচ্ছে না।’
আরফানের কথায় প্রগাঢ় অধিকারবোধের ছাপ পেয়ে ভীষণ অবাক হলো নম্রতা। মনের সুপ্ত কোনো গহ্বরে বয়ে গেলো ভালো লাগার হাওয়া। আনন্দে নাকি বিস্মিয়ে হতভম্ব হয়ে জানা নেই নম্রতা ক্ষণকাল নিশ্চুপ চেয়ে থেকে বলল,
‘ ডক্টর আরফান আপনি…’
আরফান তাকিয়েই ছিল। চোখে তার চঞ্চল দৃষ্টি। নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে একদম অন্যরকম কন্ঠে বলল,
‘ নিষ্প্রভ।’
নম্রতা একদম ক্ষীণ কন্ঠে আওড়াল,
নীল চিরকুট পর্ব ২৭+২৮
‘ নিষ্প্রভ?’
আরফানের চোখে খেলে গেল তৃপ্তির হাসি। খোশমেজাজী কন্ঠে বলল,
‘ কিছু কিছু মানুষের কন্ঠে আমার নামটা একটু বেশিই মিষ্টি লাগে। এক্ষেত্রে ক্রেডিটটা আমার নামের নাকি বিশেষ কারো কন্ঠের, ঠিক বুঝতে পারছি না।’
তারপর বাচ্চাদের মতো খুব ছেলেমানুষী কন্ঠে জানতে চাইল,
‘ আপনি বুঝতে পারছেন?’
