নীল চিরকুট পর্ব ৪১+৪২
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
খাওয়া শেষে দীর্ঘ এক ভাত ঘুমের পর বড় মামার সাথে দেখা করল নাদিম। বড় মামা মাত্রই পরিষদ থেকে ফিরেছেন। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বৈঠক ঘরের বারান্দায় বসে আছেন। চোখে-মুখে আগের সেই জৌলুশ নেই। বার্ধক্য হানা দিয়েছে শরীরে। শক্তপোক্ত শরীরটা ঢিলেঢালা, থলথলে হয়ে গিয়েছে। মামার সামনে বেতের মোড়ায় বসে কৌতূহলী চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করল নাদিম।
‘ আপনার শরীরটা বোধহয় খুব একটা ভালো যাচ্ছে না মামা।’
বড় মামা চোখ মেলে তাকালেন। ম্লান হেসে বললেন,
‘ বয়স হচ্ছে।’
‘ ততটাও বয়স হয়নি। ডাক্তার দেখান।’
বড় মামা মাথা নেড়ে চুপ করে রইলেন। বড় বড় দম নিয়ে গ্লাসের বাকি শরবতটুকু এক চুমুকে শেষ করলেন। নাদিম উৎসুক কন্ঠে বলল,
‘ মিষ্টিকে নিয়ে কী বলছিলেন ফোনে?’
বড় মামা জবাব না দিয়ে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ তোমার চেহারার দশা দেখে তো আমাদের বংশের ছেলে বলে মনে হচ্ছে না বাবা। মাথায় পাখির বাসা। গালেও দাঁড়ি-গোঁফের জঙ্গল। ঢাকা শহরে গুন্ডামী করে বেড়াও নাকি হে?’
নাদিম হাসল। বড় মামা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন নাদিমের পুরু ঠোঁট জোড়ার দিকে। পরিচিত! খুব পরিচিত সেই হাসি। নাদিম হেসে বলল,
‘ আমি তো আপনাদের বংশের ছেলে নই বড় মামা। আমার বংশ ভিন্ন।’
বড় মামা কিছুক্ষণ চুপ করে নাদিমকে লক্ষ্য করলেন। তারপর মৃদু কন্ঠে বললেন,
‘ মায়ের বংশ কী নিজের বংশ নয়?’
‘ হওয়ার তো কথা নয়।’
বড় মামা বিড়বিড় করে বললেন,
‘ আমি মতিনকে বলে দিচ্ছি। বাড়ি এসে চুল,দাড়ি ছেঁটে দিয়ে যাবে তোমার। ভদ্রলোকদের এভাবে থাকতে নেই।’
নাদিম মাথার ঘন চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ সে দেখা যাবে। আপনি বরং মিষ্টির কথা বলুন। ওর জন্যই তো এতো জরুরি তলব। কেন ডেকেছেন?’
বড় মামা চওড়া চেয়ারটাতে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজলেন।
‘ অতো তাড়া কীসের? আজই এলে, বিশ্রাম নাও। কাল সকালে নাহয় কথা হবে।’
‘ কাল সকাল পর্যন্ত তো থাকতে পারছি না মামা। আসার সময় ফেরার টিকেট করেই এসেছি। সন্ধ্যায় ট্রেন। রাতের মধ্যে ঢাকা পৌঁছাতে হবে।’
বড় মামা অবাক হয়ে বললেন,
‘ সে কি! এতোদিন পর এসে আজই ফিরে যাবে? কিছুদিন থাকো। টিকেটের ব্যবস্থা আমি করে দেব।’
‘ টিকেটটা কোনো ব্যাপার না বড় মামা। ব্যাপারটা আমার ঢাকা ফেরা নিয়ে। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।’
নাদিমের উত্তরটা বড় মামার ঠিক পছন্দ হলো না। বিস্বাদ মুখে বললেন,
‘ বন্ধু অপেক্ষা করলেই ছুটতে হবে নাকি? থাকো ক’দিন। গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াও। তোমার মামিও বোধহয় এতো তাড়াতাড়ি ছাড়বে না। ভেতর বাড়িতে রান্নার বিশাল আয়োজন চলছে।’
নাদিম জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। ধীর কন্ঠে বলল,
‘ মিষ্টির কি হয়েছে? কেন ডেকেছেন?’
বড় মামা এবার যেন হঠাৎই আগের রূপে ফিরে এলেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খেলে গেল চোখে মুখে। মুখের ভঙ্গিমা পাল্টে বললেন,
‘ তোমার বোন যে এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে জানো?’
কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা করলেন তিনি। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
‘ জানো না, জানি। জানার প্রয়োজনও বিশেষ ছিল না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভিন্ন। মিষ্টি বড় হয়েছে। ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।’
নাদিম ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল। মিষ্টির বিয়ে? ওই ছোট্ট পুচকো মেয়েটার বিয়ে? ওর কী আদৌ বিয়ের বয়স হয়েছে? এই সেদিনও না লাল ফ্রক পরে বোকা বোকা চোখে চেয়ে থাকত মেয়েটা? নাদিম মিষ্টির মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। শেষ কবে দেখেছিল সেটাও মনে পড়ছে না। নাদিম চিন্তিত চোখদুটো বড় মামার মুখের উপর স্থির করল। বড় মামা উত্তরের অপেক্ষায় বসে থাকায় খানিক নড়ে চড়ে উঠল নাদিম। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কোন ক্লাসে পড়ে মিষ্টি? এখনই বিয়ে কেন? পড়াশোনা করুক।’
বড় মামা অসন্তুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ রক্ত কথা বলে বাবা। ওই মেয়ের বিশ্বাস আছে? কখন কী কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারলে আপদ বিদেয় হয়।’
নাদিমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, সে রেগে যাচ্ছে। বড় মামাকে ধরে বেধরাম পেটাতে ইচ্ছে করছে। শালা, পিশাচ! নাদিমকে বিরক্ত মুখে বসে থাকতে দেখে মৃদু হাসলেন বড় মামা। ভারি বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকালেন।সেই কুটিল চোখ দুটোর দিকে চেয়ে নাদিমের কী ঘেন্না হলো? হওয়ার কথা না। নাদিম মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে মজা পায়। প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে গালি দেয়। বেধরাম পেটায়ও। কিন্তু ঘেন্না করে না। নাদিম সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে বড় মামার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। বড় মামা চাকর শ্রেণীর কাউকে ডেকে কিছু একটা আনতে বললেন। তারপর চিন্তিত হওয়ার ভান করে বললেন,
‘ আজকাল বিয়ের বাজার খুব সোজা নয় বাবা। তারওপর মেয়ে হলো জারজ। জেনে-শুনে জারজ মেয়েকে ঘরের বউ কে করবে শুনি? টাকা-পয়সা দিয়ে পাড় করা ছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখি না বাপ।’
নাদিমকে বিরক্ত মুখে বসে থাকতে দেখে বড় মামা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
‘ তোমায় ওসব ঝামেলায় জড়াতে হবে না বাবা। যেমন আছো তেমনই থাকো। ব্যবস্থা যা করার সব আমিই করব। কিন্তু টাকা-পয়সার ব্যাপারটা তো তোমাকেই দেখতে হবে বাবা। মেয়ের ভাই যেহেতু তুমি সে হিসেবে দায়িত্ব তো তোমারই বলো?এই মেয়ের সাত-পাঁচে না থেকেও বহুত টেনেছি আমি। আর কত? আমারও দু-দুটো মেয়ে আছে। অত টাকা-পয়সায় আমিই বা কোথায় পাব বাবা?’
বড় মামার উদ্দেশ্য এবার স্পষ্ট বুঝল নাদিম। চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ চেয়ে রইল বড় মামার থলথলে মুখটার দিকে। চাকরটা এসে একটা কালো চামড়ার ব্যাগ দিয়ে যেতেই ব্যাগ থেকে কিছু কাগজ বের করে নাদিমের দিকে এগিয়ে দিলেন। নাদিম ভ্রু কুঁচকে কাগজটা হাতে নিতেই বড় মামা বিগলিত কন্ঠে বললেন,
‘ তুমি তো বাবা বছরেও এদিকে মাড়াও না। কোথায়, কী করো আল্লাহ মালুম। তাই বলছিলাম কী? তোমার নামে বাবা যে চার একর জমি রেখে গিয়েছেন। সেই জমিটা বরং ছেড়ে দাও। অযথা পড়ে আছে। ওগুলো বিক্রি করে মিষ্টির বিয়েটা….’
বলতে বলতে থেমে গেলেন বড় মামা। সামনে বসে থাকা ছেলেটির শক্ত চোয়াল। অকপট চাহনি দেখে হঠাৎই চমকে উঠলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য আদিবকে বিভ্রম হলো তার। নাদিম কাগজটা বড় মামার কোলের উপর ছুঁড়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ মিষ্টির বিয়ের কথা ভুলে যান মামা। ওর বিয়ের বয়স হয়নি।’
নাদিমের কন্ঠে আদিবের সেই অকপট, ভয়হীন কন্ঠের আভাস পেয়ে কিছুক্ষণ কথা খুঁজে পেল না বড় মামা। সম্মোহনের মতো নাদিমের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ বয়স হয়নি, বিয়ের পর বয়স হয়ে যাবে। তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। তবুও অযথা বোঝা বইতে যাব কেন? তোমারই বা কী প্রয়োজন? তুমি টাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাও৷ বাকিটা আমি দেখব।’
নাদিম দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ মিষ্টির বিয়ে নিয়ে আর কোনো আলোচনা না হওয়ায় ভালো বড় মামা। ওর বিয়ের বয়স হয়নি।’
বড় মামা চাপা রাগ নিয়ে বললেন,
‘ ওর বিয়ের বয়স হয়েছে কিনা তা তুমি শেখাবে আমায়? কখনও খোঁজ নিয়েছ ওর? আজ হঠাৎ বোনের প্রতি এত দরদ, হ্যাঁ?’
নাদিম শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ আপনি ক’দিন খোঁজ নিয়েছেন ওর? আপনার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো বলে মনে হচ্ছে না। খুব বেশিদিন বাঁচবেন বলেও মনে হয় না। শেষ বয়সে এসে আপাতত হিসেবী চিন্তা-ভাবনা বাদ দিন। বিশ্রী কুটিলতা থেকে বেরিয়ে একটু মানুষ হোন।’
বড় মামা হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার গ্রাম, তার বাড়িতে বসে কেমন অকপট কথা বলছে ছেলেটা। অপমান করছে। ভয় নেই? আদিবেরও ছিল না। বড় মামা চাপা গর্জন করে বললেন,
‘ কি বলতে চাইছ তুমি? আমি অমানুষ? আমি অমানুষ হলে তোমার ওই জারজ বোনকে এতোদিন দেখেছে কে?’
‘ সেটা তো আমারও প্রশ্ন। কে দেখেছে ওকে? আপনি তো দেখেননি।’
এটুকু বলে থামল নাদিম। হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ মিষ্টি কোনো চাইল্ড হাউজে থাকে না, তাই না মামা? আপনি ওকে সরিয়ে দিয়েছেন। কোথায় থাকে ও?’
বড় মামা থতমত খেয়ে গেলেন। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেল মুখ। অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, এই দুইদিনের বাচ্চা ছেলেটাকে খানিক সমীহ করছে তার মন। নাদিম শক্ত চোখে চেয়ে রইল। বোনের প্রতি প্রগাঢ় কোনো টান কোনো কালেই উপলব্ধি করেনি সে। সংগত কারণেই তার সুখ-দুঃখের কথাও কখনও চিন্তা করা হয়নি। তবুও আজ হঠাৎ ভীষণ রাগ লাগছে তার। সামনে বসে থাকা লোকটিকে রড দিয়ে পিটিয়ে চমড়া ফাটিয়ে দেওয়ার এক দূর্দমনীয় ইচ্ছে জাগছে।
বিষণ্ন সন্ধ্যা মিলিয়ে রাত নেমেছে শহরে। শরতের ঝিরিঝিরি বাতাসে উড়ছে পূজার খয়েরী শাড়ির আঁচল। গোছালো চুলগুলো ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছে ক্লান্ত, সুন্দর মুখটিতে। চাঁদের আলোয় মোমের পুতুলের মতোই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তার নিখুঁত মুখশ্রী। তার থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে, তার দিকেই মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপুরুষ এক যুবক। প্রিয়তমার মুখের প্রতিটি ভাঁজ যেন গুণে গুণে মুখস্থ করছে সে। পূজা কৌতূহলী দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিল। বেখেয়ালি হাতে অগোছালো চুলগুলো গোছাতে গোছাতে বলল,
‘ অন্তদাদের ছাঁদটা বেশ খোলামেলা। বাতাস হয় খুব। আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
রঞ্জন রেলিঙে ঠেস দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়াল,
‘ আমারও খুব পছন্দ হয়েছে।’
পূজা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকাল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ কী?’
‘ তোমাকে।’
রঞ্জনের ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি। পূজা হেসে অন্যদিকে তাকাল। রঞ্জন বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে পূজার সামনে এসে দাঁড়াল। রঞ্জনকে কাছাকাছি দাঁড়াতে দেখে চোখ তুলে তাকাল পূজা। চোখে তার হাজারখানেক প্রশ্ন। দমকা বাতাসে এক গাছি চুল আছড়ে পড়ল পূজার কপালে। আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে সম্মোহিত,মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল রঞ্জন। হাত বাড়িয়ে রঞ্জনের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে কপাল কুঁচকাল পূজা। আদুরে কন্ঠে বলল,
‘ কি দেখছ? কি হয়েছে?’
রঞ্জন জবাব দিল না। আগের মতোই নির্নিমেষ চেয়ে থেকে হঠাৎ এক অদ্ভুত কাজ করে বসল। পকেট থেকে সিঁদুর কৌটা বের করে পূজার সিঁথি রাঙাল গাঢ় সিঁদুরের রেখায়। মোমের মতো ফর্সা খাড়া নাকে উজ্জল হয়ে উঠল সিঁদুরের লাল রঙ। মুখটিতে ভর করল গাঢ় মায়া। কপালে সিঁদুর ল্যাপ্টানো প্রিয়তমাকে হঠাৎই প্রতিমা বলে বোধ হলো তার। লুকায়িত সৌন্দর্যটুকু ডানা মেলে ঝলসে দিতে চাইল তার গাঢ় দৃষ্টি, সম্মোহিত মন। পূজার হতভম্ব দৃষ্টি উপেক্ষা করে পূজার ডানহাতটা নিজের হাতে তুলে নিল রঞ্জন। খুব মনোযোগ দিয়ে হাতের চুড়িগুলো গুণার চেষ্টা করল। প্রতিটা চুড়ি আলাদা করতে করতে নিরবিচ্ছিন্নভাবে বলতে লাগল,
‘ ভালোবাসি। ভালোবাসি। ভালোবাসি।’
রঞ্জনের দিকে চেয়ে থাকা পূজার দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগল। হতভম্বভাব শেষে ফুটল গাঢ় কোমলতা। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছেদের অসহনীয় সুর। এতোদিন কঠোর নিয়মে সামলে রাখা পূজা এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। রঞ্জনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠল। রঞ্জন আলতো হাতে সামলে নিল তাকে। ভালোবাসার প্রতিমাটিকে বুকের সাথে ল্যাপ্টে নিয়ে ঘন চুলে ঠোঁট ছোঁয়াল। ভীষণ আবেগ নিয়ে বলল,
‘ ভালোবাসি!’
পূজার কান্নার আওয়াজ দৃঢ় হলো। দুইহাতে খামচে ধরল রঞ্জনের পাঞ্জাবি। যেন ছেঁড়ে দিলেই ফুরিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে অনেক দূর দেশে। রঞ্জনের ভারী পাপড়ি খানিকটা ভিজে উঠল কী? হয়তো। সিক্ত কন্ঠে বলল,
‘ তোমাকে বুক পকেটে ক্যারি করার ক্ষমতা থাকলে দূর্দান্ত হতো পূজা। বিশ্বাস করো, বুক পকেটে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতাম তোমায়। হঠাৎ হঠাৎ বের করে মন ভরে দেখতাম। অল্প একটু দুষ্টু আদর করতাম। ইচ্ছেমতো ভালোবাসতাম। তারপর আবারও লুকিয়ে রাখতাম বুক পকেটের এক কোণায়। তোমার ঠাকুর নাকি সব পারে? দিতে বলো তো আমায় এমন ক্ষমতা। আমার খুব দরকার তোমায়। খুব বেশিই দরকার।’
পূজা মাথা তুলে তাকাল। ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ভ্রু কুঁচকাল।
‘ ঠাকুর শুধু আমার? তোমার নয়?’
‘ উহু। আমার নয়। আমার ওসবে বিশ্বাস নেই।’
‘ তাহলে সিঁদুরে বিশ্বাস কী করে এলো?’
রঞ্জন হেসে বলল,
‘ সিঁদুরটা তো তোমার বাবার জন্য। সুন্দরী বউ রেখে দেশ ছাড়ছি। সিকিউরিটির প্রয়োজন আছে না? সিঁদুর পরিয়ে সীল গালা করলাম। ছবি তুলে দলিল করব। সেই দলিল তোমার বাবাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে ট্যাগ মার্কে লিখব, “রঞ্জনের ব্যক্তিগত জিনিস”। ‘
পূজা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘ সব সময় ফাজলামো না?’
রঞ্জন হেসে ফেলল। পূজাকে কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আরে, আমি সিরিয়াস!’
পূজা প্রত্যুত্তর না করে চুপ করে পড়ে রইল বুকে। রঞ্জন জোড়াল শ্বাস নিয়ে কৌতুকমাখা কন্ঠে বলল,
‘ এখন একটু কেঁদে নাও তো। কাল এয়ারপোর্টে কিন্তু কান্নাকাটি চলবে না। কান্নাকাটি চলবে না আগামী পাঁচ বছর। আমি ফিরলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বাকি কান্না কাঁদবে। আজ ফার্স্ট রাউন্ড। স্টার্ট, স্টার্ট।’
পূজা হেসে ফেলল। পরমুহূর্তে, বাস্তবিকই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে দিল রঞ্জনের বুক। সারাদিন যে থমথমে কান্না নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তা যেন বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো এবার। রঞ্জনের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। ঠোঁটদুটো নিবদ্ধ হলো প্রেয়সীর কপালে। ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি তো আমায় সীল গালা করলে না, পূজা।’ ঠিক সেই সময় বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটি লম্বাকৃতি ছায়া। ল্যাম্পপোস্টের ফিকে আলোয় ক্লান্ত দেখাল তার মুখ। রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা নেড়ি কুকুর দুটো ঘেউঘেউ করে এলাকা মাথায় তুলল। রূপালী চাঁদটা কারো ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে লাজুক মুখ লুকাল শরতের শুভ্র মেঘের ছায়ায়। কালো পাঞ্জাবি গায়ে ক্লান্ত যুবকটি বাড়িতে প্রবেশ করতেই ঝিমিয়ে থাকা আড্ডাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এগারোর ঘরে পৌঁছে যাওয়া ঘড়ির কাটাটা যেন নিমিষেই সন্ধ্যেতে নেমে এলো। উচ্ছ্বসিত, কলোরবে মুখরিত হল বন্ধুমহল।
মেয়েটা যখন মারা গেল তখন ঘড়িতে বারোটা কি একটা বাজে। এক্সিডেন্ট কেইস। দশদিন হাসপাতালে ভর্তি থেকে এগারো দিনের মাথায় মৃত্যু। আরফান যখন শেষবার চেকআপ করল তখন মেয়েটি বেঁচে ছিল। লাইফ সাপোর্টে নিঃশ্বাস চলছে, ক্লিনিক্যালই ব্রেইন ডেথ। বাঁচার সম্ভবনা ক্ষীণ। আরফান মৃত্যু দেখে অভ্যস্ত। নিজের পেশার খাতিরেই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে সে। এই সকল মৃত্যু খুব একটা স্পর্শ করে না তাকে। মানসিক পীড়া দেয় না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম কিছু ঘটল। চেকআপ শেষে, মেয়েটির স্বামীকে যখন চেম্বার ডেকে বলল,
‘ রোগীর বাঁচার আশঙ্কা কম। আপনারা ম্যান্টালি প্রিপেয়ার থাকার চেষ্টা করুন। এক দুই ঘন্টার মাঝেই খারাপ কোনো সংবাদ শুনতে হতে পারে। আপনারা চাইলে এখনও লাইফ সাপোর্টে রাখতে পারেন। তবে, লাভ বিশেষ হবে বলে মনে হয় না।’
আরফান কথাগুলো খুব প্রফেশনালি বলেছিল। সবসময় যেমন বলে, ঠিক সেভাবেই। কিন্তু সামনে বসা ছেলেটির হতভম্ব, অসহায় দৃষ্টি যেন তার মনের কপাটে শক্ত এক আঘাত হানল। পুরোটা সময় ছেলেটি দিশেহারা চোখে আরফানের মুখের দিকে চেয়ে রইল। একটা কথাও বলল না। একসময় আরফানের সন্দেহ হলো, ছেলেটি তার কথা শুনছে তো? আরফান এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন?’
ছেলেটি একদৃষ্টে চেয়ে রইল ঝকঝকে পরিষ্কার গ্লাসটির দিকে, জবাব দিল না। আদৌ কিছু বুঝতে পারছে বলেও মনে হলো না। ছেলেটির চোখ-মুখের অসহায়ত্ব, দিশেহারা ভাব দেখে জানে না কেন হঠাৎ নম্রতার মুখটা ভেসে উঠল আরফানের চোখে। বুকে স্পষ্ট এক ব্যথা তরতর করে বাড়তে লাগল। ছেলেটি উদভ্রান্তের মতো চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও সেই ব্যথাটা রয়ে গেল। মাংস খামচে বসে রইল আরফানের বুকে। শুরু হলো অস্থিরতা। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, গোটা ডাক্তারি জীবনে এই প্রথম কোনো রোগীর মৃত্যুতে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার নয়। হয়নি কখনও। তবে আজ কেন? আরফান অস্থিরতায় হাসফাস করে । কাজে মন বসে না। ঘুরেফিরে মনে পড়ে যায় মৃত মেয়েটির মুখ। সেই মুখটা যদি নম্রতার হতো তবে? আরফান কেঁপে উঠে। নম্রতার প্রতি তার প্রগাঢ় দুর্বলতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে।
অন্তুদের বাসা থেকে ফিরে মাত্রই বিছানায় গা এলিয়েছে নম্রতা। সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ। ঢাকায় ফিরে বাসর ঘর সাজানো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা সব মিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে গা। দুই চোখ ভার করে আসতে চাইছে রাজ্যের ঘুম। কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিল নম্রতা। ভাসা ভাসা কিছু স্বপ্নও বোধহয় দেখছিল। ঠিক তখনই ফোনের ঘন্টি বাজল। নম্রতা ঘুমের মাঝেই চমকে উঠল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ‘ডাক্তার’ নামটা দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল নম্রতা। তাড়াতাড়ি ঘড়ি দেখল, একটা বিশ। আরফান যেখানে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিনের বেশি ফোন দেয় না সেখানে এতো রাতে তার ফোন পেয়ে বোকা বনে গেল নম্রতা। ফোন রিসিভ করে সন্দিহান কন্ঠে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ল আরফান,
‘ কেমন আছেন আপনি?’
বিষয়টা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল নম্রতার। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বলল,
‘ হঠাৎ এতো রাতে?’
‘ উচিত হয়নি? রেখে দেব?’
নম্রতা ব্যস্ত হয়ে বললাম,
‘ না। তা কেন? এখনও রেগে আছেন?’
‘ না।’
‘ তাহলে কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?’
আরফান লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ আমি হয়তো আপনাকে মিস করছি নম্রমিতা। আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। এই মুহূর্তে দেখতে ইচ্ছে করছে। এই অদ্ভুত ইচ্ছে কেন হচ্ছে আমার?’
আরফানের কন্ঠে কি ছিল জানা নেই। কিন্তু সেই কন্ঠে বলা বাক্যগুলো হঠাৎ-ই বড় সুমধুর ঠেকল নম্রতার কানে। আরফানের অকপট প্রকাশে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সে। আরফানের করা প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া গেল না। খুঁজার চেষ্টায় হয়ত করল না নম্রতা। কানের মাঝে বৃষ্টির শব্দের মতো ছন্দ তুলে বাজতে লাগল আরফানের কন্ঠস্বর। বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ থাকার পর মৃদু কন্ঠে প্রশ্ন করল আরফান,
‘ কালকের দাওয়াতটা নিচ্ছেন?’
‘ দাওয়াত?’
অবাক হয়ে প্রশ্ন করল নম্রতা।
‘ নিদ্রার পক্ষ থেকে লাঞ্চের দাওয়াত। আজ তো পারলেন না। কাল হবে?’
নম্রতাকে চুপ থাকতে দেখে কাতর স্বরে অনুরোধ করে বসল আরফান,
‘ প্লিজ!’
আরফানের কথার ধরনে বারবার অবাক হচ্ছে নম্রতা। আরফান কখনোই এতোটা দুর্বল ছিল না। তাদের সম্পর্কের শুরু থেকেই আরফানের চেয়ে নম্রতার দূর্বলতাটাই ছিল বেশি। নম্রতাই কাছে আসার চেষ্টা করত, ভালোবাসার চেষ্টা করত। পাগলামো, বাচ্চামো সবটাই ছিল নম্রতার। তবে আজ হঠাৎ এই অস্থিরতা কেন?
বেলী আর গোলাপে ঢাকা বিছানায় শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে নীরা। অপরিচিত এই ঘরটা বেলী ফুলের তীব্র গন্ধে মৌ মৌ করছে। বেলী ফুলের ঝাঁঝাল গন্ধে দমবন্ধ লাগছে নীরার। খুব পরিচিত একজনের অপেক্ষায় হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। বুকের ভেতর দামামা বাজাচ্ছে হৃদপিন্ড। বন্ধু থেকে স্বামী হয়ে উঠা মানুষটি তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে ভাবতেই অস্থির লাগছে। চিরায়ত স্বামী-স্ত্রীর মতই কি কাটবে তাদের রাত? অন্তু কিভাবে নিবে তাকে?
বেলী আর গোলাপের শোভামন্ডিত ঘরটিতে হালকা নীল আলো জ্বলছে। দরজার পাশে ছোট্ট টেবিলটিতে ভিন্ন রঙের মোমও জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। নিশুতি রাত দ্বিতীয় প্রহরে গা ভাসাতেই রাতের শান্ত ঝিমঝিম শব্দে ধরফর করে উঠছে বুক। চারদিকে অস্বস্তিকর নীরবতা। সেই নীরবতাকে আরও বেশি গা ছমছমে করে দেওয়ার জন্যই হয়ত ঘরজুড়ে বেলীফুলের তীব্র সুগন্ধ। হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসছে বেশ কিছু উৎসুক মানুষের আনন্দিত কন্ঠস্বর। ক্ষীণ হাসির শব্দ। ওগুলো কী তবে নাদিম-রঞ্জন? হতে পারে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্লান্তিতে চোখদুটো বোজে আসছে তার। ভারী শাড়ি আর অনেকক্ষণ টানা বসে থাকার জন্য ঝিমঝিম করছে পা। ভ্যাপসা গরমে চুলকাচ্ছে শরীর। নীরা অসহায় চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল, একটা বিশ। অন্তু কি তবে ঘরে আসবে না? একটি চিন্তার রেশ ধরে ধীরে ধীরে অসংখ্য চিন্তা উঁকি দিয়ে গেল মস্তিষ্কে। অন্তুর মনোভাব জানার ইচ্ছেয় ছটফট করে উঠল ভেতরটা। চিরায়ত স্বামীদের মতো অন্তুও কী খুব ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে আজ? নাকি দূর্ব্যবহার করবে তার সাথে? বন্ধু অন্তুকে নীরা চিনে। বন্ধু অন্তুর আগাগোড়া পড়ে ফেলার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু স্বামী হিসেবে অন্তু কী রকম হতে পারে তার বিন্দু বিসর্গও ধারণা করা যাচ্ছে না। ক্ষণে ক্ষণে ভয় আর অনিশ্চয়তায় গলা শুকিয়ে আসছে। এক চুমুক জলের জন্য হাপিত্যেশ করে মরছে হৃদপিণ্ড।
নীরার হাজারও জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঘরে এলো অন্তু। ঘড়ির কাটা তখন দেড়টা ছুঁই ছুঁই। অন্তু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ফ্যানের সুইচ চাপল। কয়েক সেকেন্ড বিলম্ব করে ভো ভো শব্দ তুলে ঘুরতে লাগল বৈদুত্যিক পাখা। অন্তু শেরওয়ানির বোতাম খুলতে খুলতে ফ্যানের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। টি-টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলা ভেজাল। প্রতিটি কাজই সে করল অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। নীরার দিকে তাকাল না। অন্তুকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অস্বস্তিতে জড়োসড়ো হয়ে পড়েছিল নীরা। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে অন্তুর দিকে এক পলক তাকাতেই দৃষ্টি থমকে গেল তার। চোখের পলকে বিশ্বাস করে নিল, সাদা শেরওয়ানি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি পৃথিবীর সবথেকে সুপুরুষদের একজন।
অন্তুর শ্যাম কালো মুখের বিগলিত মায়ায় নারী অহংকারের সবটায় যেন ভেসে গেল নীরার। বুকের ভেতর শিরশির করে উঠল গুচ্ছ গুচ্ছ অনুভূতির বহর। বন্ধু থেকে স্বামীত্ব বরণ করা মানুষটির দিকে অপলক চোখে চেয়ে থেকে হঠাৎই উপলব্ধি করল, এই মানুষটিকে প্রচন্ড ভালোবাসে নীরা। তাকে দেখা মাত্রই তীব্র অনুভূতিতে ঝাপসা হয়ে আসে সব। অন্তু শেরওয়ানিটা খুলে রেখে আলমারি থেকে টি-শার্ট, টাউজার বের করল। নীরার সামনে বিছানায় একটি সুতি শাড়ি রেখে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। পুরোটা সময় অন্তুকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করল নীরা। অন্তুর বেখেয়ালি চাহনী। প্রশস্ত কাঁধ। অনাবৃত রোমশ বুক। কপালের কুঞ্চন থেকে শুরু করে হাঁটা-চলা সব। পনেরো মিনিটের মাথায় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো অন্তু। সারামুখে বিন্দু বিন্দু পানির ছঁটা।
চুলগুলো ভেজা, অগোছালো। নীরা আবারও অপলক চোখে চেয়ে রইল অন্তুর চোখে-মুখে। তবে, অন্তুর মাঝে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। তার হাবভাব দেখে মনে হল, তার নিজস্ব বিছানায় নীরা নামক মেয়েটার বসে থাকা। তার দিকে অহর্নিশ চেয়ে থাকা খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। অতীতে ঘটেছে। নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটছে। ভবিষ্যতেও এমনটাই ঘটবে। অন্তু হাতের তোয়ালেটা চেয়ারের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। নীরার দিকে পিঠ ফিরিয়ে চুপচাপ বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। একটা বারের জন্যও নীরার দিকে চোখ তুলে তাকাল না। নীরার উদ্দেশ্যে একটা কথাও বলল না। নীরাও আগ বাড়িয়ে কথা বলার সাহস পেল না। শুকনো মুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে অন্তুর দেওয়া শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। দরজা লাগানোর আগমুহূর্তেও অসহায় চোখে চেয়ে রইল সাদা টি-শার্ট গায়ে অন্তুর পিঠে।
মুখের সাজগোজ তুলে গোসল করে বেরুতে বেরুতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেল নীরার। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই দেখল অন্তু ঘুমাচ্ছে। বিছানায় ফুলের অংশবিশেষও অবিশিষ্ট নেই। ধবধবে সাদা চাদরে, সাদা টি-শার্ট গায়ে ঘুমিয়ে আছে শ্যাম কালো এক যুবক। নীরা ধীর পায়ে বিছানার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। বামপাশে একজনের শোয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা রেখে ডানপাশ ঘেঁষে শুয়েছে অন্তু। বামহাতটা মাথার নিচে দিয়ে ডানহাতটাকে কপালের উপড় আড়াআড়িভাবে স্থান দিয়েছে সে। কপালটা হালকা কুঁচকে আছে। নীরা বুঝল, তার এই বিছানায়, অন্তুর পাশে ঘুমানোর অনুমতি আছে। নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসল। অভিমান ভরা চোখে অন্তুর মুখের দিকে চেয়ে রইল অল্প কিছুক্ষণ। বালিশ টেনে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়তেই টপাটপ চোখের জলে বালিশ ভিজল। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের বিছানায় এসে মনের একটা অংশ অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেলেও অপর একটি অংশ খুব করে চাইতে লাগল, অন্তু তাকে জড়িয়ে ধরুক। বুকের খুব কাছে নিয়ে খুব যত্ন করে ঘুম পড়াক। কতদিন ঘুমায় না নীরা! অন্তু নাহয় এবার একটু ঘুম পাড়ানী ঔষধ হোক।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্তুকে বিছানায় পেল না নীরা। ঘড়ির কাটা তখন সাড়ে আটের ঘরে। নীরা দরফর করে উঠে বসল। হাতে-মুখে পানি দিয়ে বিছানা গোছাল। ঘড়িতে নয়টা বাজতে চললেও কেউ ডাকতে এলো না তাকে। নতুন বউ হয়ে নিজ উদ্যোগে বাইরে যাওয়া উচিত হবে কিনা বুঝে উঠতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অন্তুর দূর সম্পর্কের বোন দরজা থেকেই বাইরে আসার জন্য ডেকে গেল। নীরা অস্বস্তি আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘর থেকে বেরুতেই মহিলাদের ফিসফাস কানে এলো। রান্নাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল অন্তুর দুই ফুপু আর খালা। নীরাকে বেরুতে দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ নতুন বউয়ের কী এতো ঘুমালে চলে নাকি? আমাদের সময় ফজরের ওয়াক্ত উঠে মশলা বাটতে হয়েছে। একশো মানুষের রান্না করতে হয়েছে। নতুন বউ মশলা বাটতে পারো?’
নীরা মাথার কাপড় ঠিক করে নিয়ে মাথা নাড়ল। অন্তুর বড় ফুপু এক গামলা পেঁয়াজ, রসুন আর কাঁচা মরিচ ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ এগুলো বেঁটে ফেলো তো। তোমাদের তো বৌভাত হচ্ছে না। আমরা আজই পত্রপাঠ বিধেয় হচ্ছি সব। যাওয়ার আগে অন্তুর বউয়ের হাতে রান্না খেয়ে যাই।হাঁসের মাংসটা মরিচ বাটা দিয়ে রাঁধবা। বড় ভাবি? দুপুরে অন্তুর বউ রাঁধব। আপনার ছুটি।’
কড়াইয়ে খুন্তি চালাতে চালাতেই মুখ ফিরিয়ে তাকালেন জাহানারা। থমথমে মুখে নীরাকে একবার পর্যবেক্ষণ করে আবারও নিজের কাজে মন দিলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নীরাকে শীল-নোড়া ধরিয়ে দেওয়া হলো। নীরা টু শব্দ না করে মশলা বাটতে বসল। কাল নম্রতা-ছোঁয়া ফিরে যাওয়ার আগে জোরপূর্বক কয়েক লোকমা খাইয়ে রেখে গিয়েছিল তাকে। তখন মানসিক চাপ আর চিন্তায় খেতে পারেনি নীরা। গা গুলাচ্ছিল। মাথা ঘুরছিল। এখন ক্ষুধায় পেট জ্বালা করছে অথচ খাবার মুখে দেওয়ার উপায় নেই। অতোগুলো পেঁয়াজ,রসুন ছিলে বাটতে বাটতেই চোখ-মুখে জ্বালা ধরে গেল নীরার। এক পর্যায়ে হাতের মাংস পেশিগুলোতেও চিনচিনে ব্যথা করে উঠল। হাতদুটো বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে আবারও নিজের কাজে মন দিল নীরা। কাঁচা মরিচ বাটতে গিয়ে কচি হাতদুটোতে যেন আগুন ধরে গেল। সেই সাথে ফুপু-খালা শাশুড়ীদের ঝাঁঝাল কথার তোড়ে চোখ ফেঁটে জল গড়াতে চাইল নীরার। ফুপু শাশুড়ী হৈ হৈ করে বললেন,
‘ এভাবে কেউ মশলা বাটে? সারা পাটায় ছড়িয়ে ফেলছে দেখি। কাজের মিল-মিছিল জানো না। আমাদের সময় হলে শাশুড়ী একদম মুখে গুঁজে দিত। আমাদের স্বর্ণা কি সুন্দর মশলা বাটে!’
এমন হাজারও কথায় বুকটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল নীরার। হঠাৎ করেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখে। বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ করেই অভাব-অনটনে পড়ে গিয়েছিল তারা। কত টানাপোড়েনে জীবন কাটাতে হয়েছে। খেয়ে-না-খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এতোকিছুর পরও মেয়ে দুটোকে বুকে আগলে বড় করেছেন মা। সময়ে-অসময়ে ঝাঁঝাল, ভারী কথাও শুনিয়েছেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই পরম মমতায় আগলে নিয়েছেন বুকে। হাত জ্বলার ভয়ে মরিচ কাটতে না দেওয়া তার মেয়েটি আজ মরিচ বাটতে বসেছে দেখলে কি মা আঁতকে আঁতকে উঠত না? মেয়ের জ্বালায়, মেয়ের আগেই কি তার চোখে জল টলমল করত না? নীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করে অসহ্য জ্বালা আর ব্যথা সহ্য করতে করতেই বুঝল, বাড়ির বউ আসলে বাড়ির কেউ নয়। তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো এই সমাজের সবচেয়ে বড় অন্যায়। পরিষ্কার, ঝকঝকে পবিত্র সমাজটা কী অতোবড় অন্যায় করতে পারে? কক্ষনও নয়।
চোখের উপর কড়া রোদের ঝাপটায় ঘুম ভাঙল নাদিমের। পায়ের দুই আঙ্গুল দিয়ে জানালার পাল্লাটা ঠেলে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উল্টো হয়ে শুল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ পড়ে থেকেও ঘুমের দেখা পাওয়া গেল না। মাথা ঝিমঝিম করছে। একটু আগে খুব ফালতু একটা স্বপ্ন দেখায় মেজাজটা চটে গিয়েছে। স্বপ্নে বড় মামা হাসতে হাসতে রক্ত বমি করে পৃথিবী ভরিয়ে ফেলছেন। মানুষ কখনও হেসে হেসে রক্ত বমি করে কি-না জানা নেই নাদিমের। রক্তবমি কখনোই আনন্দের কোনো ব্যাপার নয়। বমি করাও যথেষ্ট পরিশ্রমের ব্যাপার। কাঁদতে কাঁদতে বমি করলেও ঠিক ছিল। কেউ হাসতে হাসতে বমি করবে কেন? আর বমি করলেও, বমিতে বমিতে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলতে হবে কেন? নাদিম বড় মামাকে বিশ্রী কিছু গালি দিয়ে উঠে বসল। স্বপ্ন নিয়ে থিওরিটা আজ মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে তার। মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বেখেয়ালে পাশের বিছানায় তাকাতেই চমকে উঠল নাদিম। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বুকে থুতু ছিটাল। বিশাল একটা হাই তুলে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল,
‘ ডর দেখাই দিছিলি, শালা।’
অন্তুর জবাব না দিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল। পায়ের জুতোটা নাদিমের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,
‘ তোর ভাষা ভয়ানক বাজে হচ্ছে দিন দিন। এতো অশ্লীল গালি আমি মনেও আনতে পারিনি কোনোদিন।’
নাদিম দাঁত বের করে হাসল। জুতোটা লাথি দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে বলল,
‘ আরে মামা! আমি সিঙ্গেল মানুষ হয়ে ঘুম থেকে উঠতে পারলাম না৷ আর তুই বাসর-টাসর সেড়ে ধানমন্ডি থেকে শাহাবাগ চলে এলি? বাহ্! রাতে কী ঘটল?’
কথাটা বলে ভ্রু নাচিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল নাদিম।
‘ ঘড়ি দ্যাখ বলদ। অলমোস্ট দেড়টা বাজে। তুই উঠিস নাই বলে যে সূর্য উঠে নাই এমন নয়। এতোক্ষণে দশবার বাসর করে ফেলা যাবে।’
অন্তুর কথায় শব্দ করে হেসে উঠল নাদিম। অন্তু চোখ পাকিয়ে বলল,
‘ হাসছিস কেন?’
নাদিম হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। কোনরূপ হাসি চেপে বলল,
‘ রাতে তাহলে এই ঘটল? দশবার! আমাদের নীরু তোর বউ বইলা কিছু কইতেও পারতেছি না। মনোভাবটা বুইঝা নে প্লিজ।’
কথাটা বলে আবারও দৈত্যর মতো হাসতে লাগল নাদিম। অন্তু পাশ থেকে বালিশ ছুঁড়ে মেরে বাজে একটা গালি দিল। নাদিমের হাসি যেন আরও বিস্তৃত হলো। ঠিক সেই সময় রুমের ভেতরে এলো রঞ্জন। হাতে খাবারের ব্যাগ। ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানার উপর বসল। নিচু হয়ে জুতো খুলতে খুলতে বলল,
‘ এভাবে হাসছিস কেন? কি হয়েছে?’
নাদিম হাসি চেপে উঠে বসল। অন্তু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আবারও হেসে ফেলল। রঞ্জনকে পুরো ঘটনাটা রসিয়ে রসিয়ে শুনাতেই নিঃশব্দে হাসতে লাগল রঞ্জন। নাদিম বিছানা থেকে টুপ করে নেমে গিয়ে খাবারের ব্যাগটা তুলে নিল। ব্যাগের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল,
‘ কাহিনি কী?’
রঞ্জন সোজা হয়ে বসল। হেসে বলল,
‘ পূজা পাঠিয়েছে। আবার মাও প্যাক করে দিল। সব মিলিয়ে এতো খাবার হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট, ভাবলাম আজকের লাঞ্চটা আপাতত একসাথেই খাই। নমু-নীরা খায় না বলে মাংস আনিনি। রোস্ট, মাংসের ঝুল রেস্টুরেন্ট থেকে নিলেই হবে।’
নাদিম ততক্ষণে ঢাকনা খুলে ফেলেছে। আলুর একটা টুকরোও তুলে নিয়েছে হাতে। অন্তু বালিশে ঠেস দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসল। উচ্ছল হেসে বলল,
‘ ছোঁয়া থাকলে বলত, এই তুই হাত ধুয়েছিস? দাঁতও ব্রাশ করিসনি। ছিঃ কি জঘন্য! আমার তো ভাবতেই বমি পাচ্ছে।’
অন্তুর কথা বলার ঢং-এ হেসে ফেলল রঞ্জন। ফোন বের করতে করতে বলল,
‘ নমুকে ফোন লাগাই। হলে তো ঢুকতে পারবে না। ছোঁয়াকে নিয়ে লেকের পাড়ে চলে আসতে বলি। ছোটখাটো একটা পিকনিক হয়ে যাবে। খোলা আকাশের নিচে বসে খাওয়ার মজাই আলাদা।’
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল রঞ্জন। অন্তুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ কিন্তু নীরু?’
অন্তুর মুখটা চুপসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল,
‘ ফোন দিয়ে জিগ্যেস কর। আসতে চাইলে আমি গিয়ে নিয়ে আসব।’
নাদিম আলুর টুকরোটা চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ আসতে চাইলে মানে? অবশ্যই আসবে। আর ফোন দে মানে কী? তোর বউ তুই ফোন দিবি। রঞ্জনরে কস ক্যান?’
অন্তু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বউ টানোস ক্যান? বউ বাড়িতে, এখানে তো নয়। এই মুহূর্তে তোদেরও যা, আমারও তাই। আর দাওয়াত তো রঞ্জনের। আমার হলে নাহয় আমি ফোন দিতাম। রঞ্জনের দাওয়াত রঞ্জন দিব। তাছাড়া আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।’
নাদিম কিছু বলতে গিয়েও বলল না। রঞ্জন দুই তিনবার ফোন দেওয়ার পরও নীরাকে ফোনে পাওয়া গেল না। নাদিম-রঞ্জন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অন্তুর দিকে তাকাতেই অস্বস্তিতে পড়ে গেল অন্তু। ঠোঁট দিয়ে জিহ্বা ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন? বাড়ি ভর্তি মেহমান। নতুন বউকে এভাবে বের হতে দেবে বলে মনে হয় না। বড় ফুপু তো কেয়ামত করে ফেলবে। আমাকে কেউ কিছুই বলবে না, ঘুরেফিরে প্রশ্নের মুখোমুখি ওকেই হতে হবে।’
রঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাদিম রক্তিম চোখে চেয়ে রইল, কিছু বলল না।
দুপুরের খা খা রোদে, রিকশায় বসে অপেক্ষা করছে আরফান। গায়ে ঘর্মাক্ত সাদা শার্ট। আজ নম্রতা তাদের বাসায় যাবে বলে হাসপাতাল থেকে সোজা নম্রতাকে রিসিভ করতে এসেছে সে। শরীরে এক টন ক্লান্তি। নম্রতাকে সময় দিতে আজও দুপুরের দিকটায় ছুটি নিয়েছে সে। কয়েকদিন যাবৎ ঘন ঘন ছুটি নেওয়ায় হালকা ঝাঁঝাল কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। মেজাজটা খানিক চটে আছে। ব্যাপারটা তার ব্যক্তিত্বে তীব্রভাবে আঘাত হেনেছে। গরমের মাঝে অপেক্ষা করতে করতে সেই রাগ, ক্ষোভ যেন তরতর করে বাড়ছে। আরফান কপাল কুঁচকে ঘড়ি দেখল। প্রায় সাথে সাথেই গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো নম্রতা। গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ। ফর্সা গায়ে রঙটা ফুটে উঠেছে। নম্রতাকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতে দেখেই বিরক্তিটা উবে গেল তার। নম্রতার শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটা দেখে সমস্ত রাগ, মন খারাপ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। নম্রতা রিক্সার পাশে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আরফান একটু হেসে বলল,
‘ কী হলো? উঠুন।’
নম্রতা অপরাধী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আরফান কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কোনো সমস্যা?’
নম্রতা আমতা-আমতা করে বলল,
‘ আজ না যাই?’
আরফান অবাক হয়ে বলল,
‘ মানে? কাল তো আপনি নিজেই রাজি হলেন। তাহলে আজ কেন?’
নম্রতা প্রচন্ড অপরাধবোধ নিয়ে বলল,
‘ আসলে আজ রঞ্জন চলে যাচ্ছে। আবার কবে দেখা হবে, কে জানে? আজকের দুপুরটা ও…’
নম্রতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আরফান শীতল কন্ঠে বলল,
‘ ফাইন।’
নম্রতা বুঝল আরফান রেগে গিয়েছে। নম্রতা মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ সরি! আপনি কী রাগ করলেন?’
আরফান অত্যধিক শীতল কন্ঠে বলল,
‘ না।’
নম্রতা কি বলবে বুঝতে না পেরে অসহায় চোখে চেয়ে রইল। আরফানের থমথমে, রক্তিম মুখ দেখে বুঝল আরফান প্রচন্ড রেগে আছে। সেদিনের থেকেও বেশি। নম্রতা কথা গুছিয়ে নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই রিকশা চালককে তাড়া দিয়ে জায়গাটা ছেড়ে গেল আরফান। ভদ্রতাস্বরূপ একবার বিদায়টা পর্যন্ত নিল না। নম্রতা মুখ কালো করে চেয়ে রইল। সাথে সাথেই বেজে উঠল ফোন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল সে। বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।
নীল চিরকুট পর্ব ৩৯+৪০
একই আকাশে চড়ে বেড়ানো ছয় রঙা উচ্ছল ঘুড়ি আজ সময়ের তালগোলে ক্লান্ত। আজও তারা একই সুতোয় গাঁথা। ভিন্ন স্বাদের ঘুড়িগুলো আজও একই টানে মত্ত। তবুও কোথাও একটা ছন্নছাড়া ঢঙ্কা। প্রাণপণে কাছে টানলেও দূরত্ব বাড়ার শঙ্কা। নতুন সম্পর্ক, নতুন সময়, নতুন স্বপ্নে তাদের আকাশটা আজ ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। কারো আকাশে পরাধীনতার ছোঁয়া, কেউবা সম্পর্কের টানাপোড়েনে ক্লান্ত। কারো আকাশে স্বপ্নের ছোঁয়া তো কেউ সমাজের যুদ্ধে পরিশ্রান্ত। কেউবা অতীতের ঘ্যাঁড়াক্যাচে বন্ধী। আবার কারো আকাশে নতুন ভালোবাসার সূর্যোদয়।
