নীল চিরকুট পর্ব ৬১+৬২

নীল চিরকুট পর্ব ৬১+৬২
নৌশিন আহমেদ রোদেলা

চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। কানের পাশে শো শো বাতাস। জায়গাটা কোনো ব্রিজের কাছে। নিচে টলমলে কালো জল। আকাশে ভীষণ মেঘ। অন্ধকার আকাশে আঁধার করে আসা বিষণ্নতা। থেকে থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি। নম্রতার গা ছমছম করছে৷ কানদুটো তালা লেগে যাচ্ছে নিশাচরদের ঝিমঝিম শব্দে। নম্রতা ভয়ে ভয়ে চারপাশটা দেখল, কেউ নেই। এমন একটা নিস্তব্ধ জায়গায় কেন নিয়ে এলো নিষ্প্রভ? নিষ্প্রভ কী জানে না, নম্রতা অন্ধকার ভয় পায়? নম্রতা থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে আরফান। গায়ে তার ধূসর রঙের শার্ট। অন্ধকারে চেহারা অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়েও নম্রতা বুঝে ফেলল, আরফানের মনটা ভীষণ খারাপ। চোখ-মুখ শুকনো। নম্রতা উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ আমরা কোথায় আছি ডক্টর? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে। ফিরে চলুন।’
আরফান নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘ এখান থেকে ফেরার উপায় নেই নম্রতা।’
নম্রতা চমকে উঠল। শরীর বেয়ে বয়ে গেল শীতল রক্তস্রোত। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
‘ উপায় নেই! কেন? এখানে এতো অন্ধকার কেন? এতো অন্ধকার আমার সহ্য হচ্ছে না ডক্টর। আমি আপনাকে দেখতে পারছি না। কাছে আসুন।’
আরফান ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘ সম্ভব নয়।’
নম্রতা উম্মাদের মতো বলতে লাগল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ আমি অন্ধকার সহ্য করে পারছি না। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। এখানে খুব অন্ধকার। আলো জ্বালুন।’
‘ আমার কাছে আলো নেই নম্রতা।’
‘ এটা কোথায়? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না কেন?’
‘ আপনি চিনতে পারছেন। খেয়াল করে দেখুন। এটা আপনার আর আমার খুব পরিচিত জায়গা। খুব।’
আরফানের শেষ কথাটা কেমন ফিসফিসের মতো শোনাল নম্রতার কানে। হালকা বাতাসে ধাক্কা দিয়ে উড়ে গেল অনেক দূরে। নম্রতা চোখ মেলে দেখতে চেষ্টা করল। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, জায়গাটা তার পরিচিত। এইতো চির পরিচিত সেই সিঁড়ি। শাহবাগ গ্রন্থাগার। নম্রতা আশেপাশে কোনো ব্রিজ বা নদী দেখতে পেল না। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ আমরা এখানে কেন এসেছি ডক্টর?’
‘ বিদায় জানাতে।’
‘ বিদায়?’
‘ হ্যাঁ, বিদায় নম্রতা। এখান থেকে শুরু হওয়া গল্পটির বিদায় ঘন্টি বেজে গিয়েছে নম্রতা। এখানে তৈরি হওয়া শ্যামলতা এখানেই নিঃশেষ। আপনার আর আমার পথ ভিন্ন। আমাদের আর এগোনোর পথ নেই।’
নম্রতার ভেতরটা ভয়াবহ শঙ্কায় কেঁপে উঠল। ছলছল চোখে চেয়ে বলল,
‘ কি বলছেন?’

‘ আপনাকে আমি চাই না নম্রতা। আমি যাকে চাই সে আপনি নন। আপনাকে হারিয়ে যেতে হবে নম্রতা। সময়ের কাল গর্ভে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শ্যামলতার মতোই হারিয়ে যেতে হবে আপনাকে। তবেই না আমি এগোতে পারব।’
নম্রতার চারপাশটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ হাহাকার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মুখ অস্পষ্ট হয়ে উঠে আরও। তবুও নম্রতা দেখতে পায়, মানুষটির চোখে তীব্র বিরক্তি, ভয়াবহ বিতৃষ্ণা। তীক্ষ্ণ হয়ে বাজে একটাই কন্ঠ,
‘ আপনি হারিয়ে যান নম্রতা। আপনি হারিয়ে যান। আপনাকে আমি চাই না। হারিয়ে যান।’

নম্রতা ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে উঠল তার কন্ঠনালী। বুকের ভেতরটা দ্বগ্ধ হল। নিঃশ্বাস আটকে এলো। নম্রতার হঠাৎ মনে হলো, সে বাঁচতে পারছে না। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অসাড় শরীর নেড়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। নম্রতা মারা যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎই বহুদূর থেকে ভেসে এলো অসংখ্য কন্ঠস্বর। ওগুলো কে? নাদিম, রঞ্জন? না। ওরা নয়। বাবা। হ্যাঁ, নম্রতার প্রিয় বাবা। নম্রতা বাবার কাছে ছুটতে চেষ্টা করল। ভীষণ চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, বাবা! আমার বাবা। বাবা শুনেছে। কেউ না শুনলেও তার ডাক শুনেছে বাবা। উম্মাদের মতো ছুটে আসছে। নম্রতাকে বুকে আগলে নিতে ছুটে আসছে।

‘ মা? নমু মা? কি হয়েছে আম্মু? এইতো বাবা। এমন ছটফট করছিস কেন মা?’
নম্রতা বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে চোখ মেলে তাকাল। নন্দিতা রুদ্ধ কন্ঠে ডাকল,
‘ আপু?এই আপু? কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? বাবা? কি হচ্ছে আপুর?’
নম্রতার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শরীর। মেহরুমা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বললেন,
‘ আম্মু? কি হয়েছে আম্মু? নমুর বাবা? আমার মেয়ে এমন করছে কেন? আমার কলিজা, আম্মু? নমু মা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সোনা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা?’
নুরুল সাহেব ধমকে উঠে বললেন,

‘ আহ! এখন চিৎকার চেঁচামেচি করার সময় নয় মেহরুমা। মেয়েটাকে ইজি হতে দাও। দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। এভাবে চিৎকার করে তাকে ভরকে দিও না।’
মেহরুমা থামলেন না। গুনগুনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন পানি আনতে। নন্দিতা দৌঁড়ে গিয়ে বসল বোনের পাশে। ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে তার। বোনের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্রমাগত মালিশ করে চলেছে। নুরুল সাহেব নম্রতার গালে হাত দিয়ে আলতো কন্ঠে ডাকলেন,
‘ নমু মা? বাবা পাশে আছে। ভয় কী? ভয় নেই। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? কী হয়েছে? বাবাকে বল। এই দেখ বাবা পাশে। ভয় নেই তো মা।’

নম্রতার শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে কমে এলো। চোখ ঘুরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের প্রাত্যহিক বিছানায়। পাশেই বসা বাবা আর বোন। নম্রতার শরীরটা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ওটা স্বপ্ন ছিল? এতো বাস্তব স্বপ্ন! ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে চট করে উঠে বসল নম্রতা। ঘরে তীক্ষ্ণ কোনো আলো নেই, ঢিম লাইট জ্বলছে। খোলা জানালার পাশে গাঢ় অন্ধকার। নম্রতার শ্বাস আটকে এলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। উম্মাদের মতে চিৎকার করতে লাগল হঠাৎ,
‘ অন্ধকার কেন? আমার অন্ধকার সহ্য হচ্ছে না। আলো জ্বালাও। আলো জ্বালাও। বাবা! বাবা! বাবা আলো জ্বালাও। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না।’

নুরুল সাহেব মেয়েকে ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। নন্দিতা ছুটে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল। নম্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। নুরুল সাহেব এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইলেন। দোয়া পড়ে মেয়ের গায়ে বার কয়েক ফু দিয়ে মেয়েকে পানি খাওয়ালেন। তারপর আবারও আগের মতোই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন চুপচাপ। সেই রাতে ছোট্ট নন্দিতা পর্যন্ত ঘুমোতে গেল না। বোনের একহাত ধরে চুপ করে বসে রইল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ধুম করে জ্বর হলো নম্রতার। মেয়ের ভয়ানক জ্বরে দিশেহারা হয়ে পড়লেন মেহরুমা। মেয়েকে বাবার কাছে রেখে ওযু করে জায়নামাজে বসলেন। কলিজার মেয়েটার জন্য ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। বেশ তো বন্ধুর বিয়ে থেকে এলো। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায়, খারাপ কিছুর নজর পড়েনি তো আবার?

তখন মধ্যরাত। বারোটা কি একটা বাজে। ছোঁয়ার বিয়ে থেকে ফিরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নীরা। বিছানার এক কোণায় বসে তার দিকেই অপলক চেয়ে আছে অন্তু। ভীষণ অস্বস্তিতে কাটা হয়ে আছে নীরা। কাল রাতের ওমন ঘটনার পর লজ্জায় মাথা তুলে তাকানো যাচ্ছে না। অথচ অন্তুর চোখে যেন আজ রাজ্যের অবসর। নীরা আড়চোখে তাকাল। সাথে সাথেই চোখে চোখ পড়ল দুজনের। নীরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্তুর দিকে পিঠ করে বিছানায় বসল। চুলগুলো হাত খোপা করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল এক কোণায়। কাঁথা দিয়ে টুপ করে মুখ ঢেকে নিয়ে চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়। পুরো ব্যাপারটা সূক্ষ্ম চোখে নিরক্ষণ করে বেশ মজা পেয়ে গেল অন্তু। নীরার দিকে কিছুটা সরে বসে নীরার মাথার কাছাকাছি ঝুঁকে এসে হুট করেই টেনে সরিয়ে দিল কাঁথা। নীরা বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই হাসল অন্তু। চোখ টিপে বলল,

‘ হ্যালো।’
নীরা ভরকে গেল। কাঁথা নিয়ে আবার মুখ ঢাকল। অন্তু আবারও একই কাজ করতেই দুই হাতে মুখ ঢেকে অসহায় কন্ঠে বলল নীরা,
‘ উফ! আমি লজ্জা পাচ্ছি।’
নীরার কথায় হুহা করে হেসে উঠল অন্তু। জোরজবরদস্তি করে নীরার হাতদুটো সরিয়ে দিয়ে, নীরাকে অনুকরণ করে বলল,
‘ উফ! এত লজ্জা কেন পাচ্ছেন?’
নীরা হেসে ফেলল। অন্তু টুপ করে চুমু খেয়ে নিল নীরার কপালে। সেই প্রথমদিনের মতোই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল অন্তু। নীরার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলো নেভাল। কিন্তু সরে গেল না। জহরি চোখে চেয়ে রইল নীরার চোখে, ঠোঁটে, লতানো দেহে। নীরার গায়ে আজও পাতলা শাড়ি। মৃদু সবুজ আলোতে মোমের মতো জ্বলজ্বল করছে ফর্সা উদর। নারী দেহের আকর্ষণীয় বাঁক। অন্তুর চোখের সুপ্ত মুগ্ধতা এবার জ্বলজ্বল করে উঠল চোখে। মাথা নুইয়ে ঠোঁট রাখল ঠিক সেখানেই যেখানে একবার আকস্মিক কাঁপন ধরিয়েছিল নীরা। গলদেশের পাশটায় আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের গাঢ় ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল নীরা। ছোঁয়ার প্রখরতা বেড়ে ঠোঁটের কাছে পৌঁছেতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এক অভাবনীয় আনন্দ বার্তা। প্রতীক্ষার সম্ভাব্য অবসান!

আকাশের কোণে প্রত্যুষের দেখা মিলতেই জ্বর নেমে এলো নম্রতার। দুর্বল হয়ে পড়ল শরীর। ঠিক আজই, বাদ জোহরে আরফানের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার দিন। অন্য কোনো দাওয়াত হলে চোখ বন্ধ করে নাকজ করতেন নুরুল সাহেব। কিন্তু এবার তা করলেন না। মেয়ের এই নাজুক অবস্থায় আরফানের সাথে দেখা হলে ভালো লাগবে ভেবে দাওয়াত রক্ষার প্রস্তুতি নিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েই ঘটল আরেক দূর্ঘটনা।

আরফানদের বাড়িতে চাপা উচ্ছ্বাস। চারদিকে নতুন অতিথি আপ্যায়নের ব্যস্ততা। হাসি-আড্ডায় মাতোয়ারা হয়ে আছে চারপাশ। এমন একটা আনন্দঘন পরিবেশে চুপচাপ বসে আছে নম্রতা। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। দৃষ্টি অস্থির। মস্তিষ্কে চলছে ভয়ানক দ্বন্দ্ব, আরফান কেন বাড়ি নেই আজ? নিদ্রা বলেছিল, দুপুরের খাবারটা আজ বাড়িতেই খাবে আরফান। ফিরবে জলদি। কিন্তু ফিরল না তো। নম্রতা অস্থির চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল। এক সময় ঘড়ির কাটা এসে ঠেকল দুটোয়। তারপর তিনটা। আরফান ফিরল না। নম্রতার হঠাৎ করেই মনে হল, নম্রতার উপস্থিতি, একমাত্র নম্রতার উপস্থিতিই আরফানের না ফেরার কারণ। নম্রতা আছে বলেই কি বাড়ি ফিরল না আরফান?

নম্রতাকে এড়িয়ে চলার জন্য, নম্রতার মুখোমুখি হওয়ার ভয়েই কী আরফানের এই আত্মগোপন? নম্রতার গলা শুকিয়ে এল। অচেনা এক ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। গায়ের জ্বরটা আবারও তরতর করে বেড়ে গেল। শরীরটা দুর্বলতায় অসাড়। ঘড়ির কাঁটা তিনটায় গড়াতেই খাবারের জন্য তাড়া দিলেন আরফানের মা। আরফান কোনো কাজে আটকে গিয়েছে ভেবে অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী না করে খাবার টেবিলে বসল সবাই। কিন্তু নম্রতার মস্তিষ্ক ঘটনাটা সহজভাবে নিতে পারল না। বারবার মনে হতে লাগল, কোনো কাজ নয়, বাড়ি না ফেরাটা আরফানের ইচ্ছেকৃত। নম্রতার উপস্থিতিই তার না ফেরার কারণ। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, শারিরীক দুর্বলতা আর জ্বরের প্রখরতায় দুই লোকমা খাবারও মুখে তুলতে পারল না নম্রতা। সবই কেমন বিস্বাদ, তেঁতো। তার থেকেও বড় কথা খাবারটা যে গলা দিয়ে নামছে না! নম্রতা পানি দিয়ে খাবারটুকু গিলে নিতেই নম্রতার মুখোমুখি চেয়ারটিতে এসে বসল নিদ্রা। খাবারের প্লেট তুলে নিতে নিতে বলল,

‘ নিষ্প্রভ ভাইয়া তো হসপিটালে নেই মা। হসপিটাল থেকে জানাল, ভাইয়া প্রায় তিন চার ঘন্টা আগে বেরিয়ে গিয়েছে।’
আরফানের মা ভ্রু কুঁচকালেন। ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
‘ হসপিটালে নেই? তবে গিয়েছে কোথায়? ওকে ফোন দাও।’
নিদ্রা ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ ভাইয়ার ফোন একবার সুইচড অফ। একবার নেটওয়ার্ক বিজি। ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।’
নম্রতা চমকে উঠল। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল রাতে দেখা স্বপ্নের কথা। আরফানের বলা বিষাক্ত সেই বাক্য, ‘আপনি হারিয়ে যান নম্রতা। হারিয়ে যান।’ তবে কী আরফানই হারিয়ে যাচ্ছে দূরে? নম্রতা থেকে বহুদূরে? নম্রতা তপ্ত শ্বাস ফেলল। আশপাশটা ঝাপসা লাগছে। সেই স্বপ্নের মতোই অস্পষ্ট লাগছে সব। নম্রতা হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ছলকে উঠল গ্লাসভর্তি জল। দুই ঢোক পানি গলায় ঢালতেই মুখ ভর্তি বমিতে ভাসিয়ে দিল শরীর। নিস্তেজ শরীরে দ্বিতীয় বার বমি করে, তৃতীয়বারে জ্ঞান হারাল নম্রতা। নম্রতার হঠাৎ এই অবস্থায় ভরকে গেল সবাই। আতঙ্কিত হয়ে উঠল। খাবার-দাবার সব সেভাবেই পড়ে রইল, কারো পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছাল না। নুরুল সাহেব মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে চাইলেও বাঁধা দিলেন আরফানের মা। নম্রতাকে খোলামেলা একটি ঘরে শুইয়ে দিয়ে পরিচিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলেন। নম্রতার কাপড় পাল্টে নিদ্রার কাপড় পরানো হলো। হাতে-পায়ে তেল মালিশ করতে করতে অপরাধী কন্ঠে বললেন,

‘ মেয়েটা আমাদের বাড়িতে এসে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভীষণ লজ্জিতবোধ করছি ভাইসাহেব। মেয়েটাকে অসুস্থ অবস্থায় যেতে দিতে বিবেকে বাঁধছে। আমাদের বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়েছে, আমাদের সেবায় সুস্থ হোক। নিজ পায়ে হেঁটে এসেছে, নিজ পায়ে হেঁটে ফেরার সামর্থ্য হোক। এটুকু সুযোগ আমাদের দিন। নয়তো নিজের বিবেকের কাছেই বড্ড খচখচ করবে।’
নুরুল সাহেব ভদ্রমহিলার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। আরফানেরই এক ডাক্তার বন্ধু বাড়ি বয়ে এসে নম্রতাকে দেখে গেলেন। কিছু এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইভ করলেন। স্ট্রেস কমানোর ঔষধ আর পরপর দুটো স্যালাইন পুশ করলেন। নুরুল সাহেবকে বলে গেলেন,

‘ রাতে আবারও বমি হলে বা শরীর খুব দূর্বল মনে হলে আরও একটা স্যালাইন দিতে হতে পারে। আপনারা আরেকটা স্যালাইন ম্যানেজ করে রাখবেন। আর উনাকে স্ট্রেজ থেকে দূরে রাখুন আপাতত। দুই একদিন যাবৎ হয়ত কোনো কারণে খুব দুশ্চিতা করছেন। প্রেশারের অবস্থা ভয়াবহ।’
নম্রতার জ্ঞান ফিরল প্রায় দুই তিনঘন্টা পর। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। জানালার কার্ণিশে এসে বসেছে ক্লান্ত শালিক। নম্রতার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তার। জ্ঞান ফিরতেই দ্রুত একটা ইনজেকশন পুশ করলেন। নম্রতা ঝাপসা চোখে বাবা-বোনের মুখের দিকে তাকাল। ঘোলা মস্তিষ্কে বার দুয়েক কি আরফানকে খুঁজল? হয়তো খুঁজল, হয়তো নয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল অতল অন্ধকার ঘুমের রাজ্যে। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে খুব মৃদু কিছু শব্দ ভেসে এলো কানে। নম্রতার মনে হলো, এ যেন অন্য কোনো পৃথিবীর শব্দ। বহুদূরের পথ অতিক্রম করে শব্দরা বুঝি ক্লান্ত। অবিশ্রান্ত। নম্রতার মতোই নিদ্রাগত।

‘ ভাবীকে তো বেশ কয়েকবার হসপিটালে দেখেছি। খুব মিশুক আর হাসিখুশিই মনে হয়েছিল তখন। হঠাৎ এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে? আরফান কোথায় আন্টি?’
আরফানের মা ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন। কপাল কুঁচকে এলো। দুশ্চিন্তায় থমথমে হয়ে গেল তাঁর সুন্দর মুখ। এক ছেলেকে হারানোর পর ছেলেকে নিয়ে বড় ভয়। ঠিক এই বয়সে এসেই হারিয়ে গেল বড় ছেলেটা। বাড়িতে সেদিনও আত্মীয়-স্বজনের মেলা। স্নিগ্ধার বাড়ি থেকে আত্মীয় এসেছে বিয়ের তারিখ ঠিক করার উদ্দেশ্যে। এমন সময় আইসক্রিমের জন্য বায়না ধরল নিদ্রা। সেই সাথে বিশাল এক টেডিবিয়ার। বোনকে শান্ত করতে হাসিমুখেই বেরিয়ে গেল নেহাল। সেই যে গেল আর ফিরল না। সেই হাসিমুখটা আর হাসল না। ভদ্রমহিলার ভেতরটা হু হু করে উঠল। ভয়ার্ত চোখে নম্রতার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকালেন। সেদিনও ঠিক এভাবেই, এই বিছানাতেই অচেতন হয়ে পড়ে ছিল স্নিগ্ধা। একই দৃশ্য। একই উৎকন্ঠা। ছেলে তার ঘরে ফিরছে না। ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলার ভেতরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। পুরাতন স্মৃতি, পুরাতন ইতিহাসগুলো ভেসে উঠল একের পর এক। রক্তাক্ত হলো বুক। দলা পাকাল এক সমুদ্র কান্না!

সূর্যের আলো যখন নরম হয়ে এলো। গোধূলি হানা দিল দরজায়। কনে দেখা আলোয় উচ্ছ্বসিত হল চারপাশ ঠিক তখনই সিরাজগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাল আরফান। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিন কী চারটা বাজে। আরফান ক্লান্ত চোখে চারপাশটা দেখল। বাসস্ট্যান্ডের পাশের এক চায়ের স্টল থেকে এক চা খেয়ে আবারও রাস্তায় নামল। বাসস্ট্যান্ডের এক লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাই এখান থেকে কামারখন্দ কতদূর?’
লোকটি আরফানকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল,
‘ কামারখন্দ কই যাইবেন?’
‘ কামারখন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাব। এখান থেকে যাওয়ার উপায় কী?’
লোকটি বোধহয় বাসের কন্ট্রাক্টর। আরফানের সাথে কথা বলতে বলতেই একটা চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ এইখান থাইকা পঁয়ত্রিশ চল্লিশ মিনিট লাগব কামারখন্দ যাইতে। সিএনজি বা অটো ধইরা চইলা যান। মোড়েই সিএনজি পাইবেন।’

আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মোড়ে গিয়ে সিএনজি ধরে, সিএনজিতে উঠে বসতেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠল ক্ষুধা। হুট করেই মনে পড়ে গেল, সারাদিন খাওয়া হয়নি তার। হাসপাতাল থেকে এগারোটার দিকে বেরিয়ে শাহাবাগ গ্রন্থাগারে গিয়েছিল আরফান। দুই ঘন্টা সময় নিয়ে, দুই তলার সেই পরিচিত তাকের প্রতিটি বইই নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়েই সিরাজগঞ্জের বাস ধরেছে আরফান। এই দীর্ঘ দিনটিতে খাওয়ার কথা একবারও মনে পড়েনি তার। আরফান সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মাথাটা ধপধপ করছে। চোখ ব্যথা করছে। এই মুহূর্তে চশমাটা খুব প্রয়োজন। আরফানের মনে পড়ল, চশমাটা চেম্বারেই ফেলে এসেছে সে। সেই সাথে ফেলে এসেছে মোবাইল ফোন। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মাথায় কামারখন্দ গিয়ে পৌঁছাল আরফান। সেখান থেকে অটোরিকশায় কামারখন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আরফান যখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয়ে হয়ে এসেছে প্রায়। চারদিকে শেষ বিকেলের বিষণ্ন আলো। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় সুন্দর মতোন এই ছেলেটা ডাক্তার মুহিব নামে একজনের খোঁজ করতেই কৌতূহল নিয়ে তাকাল সবাই। গায়ে-গতরে পুরোদস্তুর শহুরে মানবটিকে পরখ করে নিতেই যেন এগিয়ে এলো একজন। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ ডাক্তার মুহিবকে দিয়ে কী কাজ? ডাক্তার দেখাবেন।’
আরফান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ না। মুহিব আমার পরিচিত। ওকে গিয়ে বলুন ডক্টর আরফান দেখা করতে এসেছে। আমাকে চিনবে।’
লোকটির দৃষ্টি এবার সরু হলো। আরফান যে সাধারণ কেউ নই বুঝতে পেরে তাকে বসতে দিয়ে মুহিবকে ডাকতে পাঠাল। আরফানের নাম শুনে ঠিক চিনতে না পারলেও আরফানকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মুহিব। ভীষণ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল গোলাকার মুখ। হতভম্ব ভাব কেটে যেতেই দৌঁড়ে গিয়ে জাপটে ধরল তাকে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

‘ আরফান ভাই! আপনি এখানে? দেশে ফিরেছেন কবে?’
আরফান উঠে দাঁড়াল। শুকনো হেসে বলল,
‘ সে অনেকদিন। প্রায় এক বছর হয়ে যাচ্ছে। রাদিনের কাছে শুনলাম তুই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছিস।’
মুহিব হন্তদন্ত করে চা বিস্কুটের ব্যবস্থা করল। আরফানকে নিজের কেবিনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ হ ভাই। কিন্তু আয় রোজগার তেমন নাই। সরকার ডাক্তারদের জীবনটা একদম খেয়ে দিল। কষ্ট করে বিসিএস পাশ করেই বা কী লাভ হইল? এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টিং দিল যে জীবন শ্যাষ। কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে কী মনে করে?’
আরফান চেয়ার টেনে বসল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সরাসরি প্রসঙ্গ টেনে বলল,

‘ তোর সাথেই দেখা করতে এসেছি। বিষয়টা সেনসেটিভ। ভেবে জবাব দিবি।’
মুহিব খানিক ভরকে গেল এবার। ব্যাপারটা গুরুগম্ভীর বুঝতে পেরে সোজা হয়ে বসল। ভীত কন্ঠে শুধাল,
‘ কোনো সমস্যা ভাই?’
‘ হ্যাঁ। সমস্যা। ইউএস যাওয়ার আগে একটা চিঠি দিয়েছিলাম তোকে। চিঠিটা গ্রন্থাগারে নির্দিষ্ট একটি বইয়ের মলাটের তলায় রাখতে বলেছিলাম, মনে আছে?’
মুহিব থতমত খেয়ে গেল। এই সামান্য একটা বিষয় জানতে আরফান এতোটা ছুটে এসেছে ভাবতেই অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ জি ভাই। মনে আছে।’
আরফান এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মুহিবের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,
‘ চিঠিটা যার জন্য ছিল সে পায়নি। চিঠিটা বইয়েও নেই। পুরো তাকের কোনো বইয়েই নেই। তারমানে চিঠির জায়গা অদলবদল করা হয়নি। কিন্তু হাত আদলবদল হয়েছে। কোনোভাবে সেটা অন্য কারো হাতে পৌঁছেছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে কাকতালীয়ভাবে চিঠিটা অন্যকারো হাতে পড়ে যেতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয়টা হলো, এতো খোঁজাখুঁজির পরও না পাওয়া চিঠিটা প্রায় পাঁচ বছর পর হঠাৎই একজনের হাতে পড়ে গেল। যে নিজেকে সেই চিঠির মালিক বলে দাবী করতে লাগল।

আমি যদি কিছুক্ষণের জন্য মেনেও নিই যে সে-ই চিঠির মালিক তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, সে এতোদিন পর আত্মপ্রকাশ ঘটাল কেন? আর যদি সে চিঠির মালিক না হয়, তাহলে তার কাছে চিঠিটা পৌঁছাল কীভাবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সে আমায় বলেছে, সে নাকি ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছিল তাই তাৎক্ষনাৎ যোগাযোগ করতে পারেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে মিথ্যা বলছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যদি বলি,কাকতালীভাবে চিঠিটা কারো হাতে লেগে গিয়েছে তবুও খুব লেইম একটা যুক্তি হবে। কাকতালীয়ভাবে চিঠিটা কারো হাতে লাগার পর কেউ নিশ্চয় চিঠিটা সযত্নে রেখে দেবে না। কনফিউশান ক্রিয়েটের চেষ্টা করতে চাইলে তখনই করতে পারত, পাঁচবছর যাবৎ অপেক্ষা করে বসে থাকত না। তারমানে স্পষ্ট, চিঠিটা পাঁচবছর আগে কেউ পায়নি। পেয়েছে আজকালের মধ্যে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব?’

মুহিব অবাক চোখে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তুই বোধহয় আমাকে সাহায্য করতে পারিস মুহিব। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো, চিঠিটা কী সত্যিই সঠিক বইটাতে রাখা হয়েছিল? সত্যিই?’
মুহিব থতমত খেয়ে গেল। অসহায় চোখে চেয়ে রইল আরফানের চোখে।

কাকের কর্কশ ডাকে ঘুম ভেঙে গেল নম্রতার। দক্ষিণের জানালায় বসে থাকা কাকটা কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে। ঘরভর্তি প্রথম ভোরের আলো। নম্রতা চোখ মেলে চারপাশটা দেখল, অপরিচিত ঘর, অপরিচিত বিছানা। সদ্য ভোরের ঝাপসা আলোয় অপরিচিত ঘরটা আরও বেশি অপরিচিত ঠেকল নম্রতার। শরীরটা দূর্বল লাগছে। হাতে-পায়ে বল পাওয়া যাচ্ছে না। নম্রতা ধীরেসুস্থে বিছানা থেকে নামল। গায়ে তার নিদ্রার টি-শার্ট আর টাওজার। গায়ের পোশাকের দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। মিনিট খানেক ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই গুটি গুটি পায়ে ঘর ছাড়ল নম্রতা। আশপাশটা দেখতে দেখতে উঠে গেল ছাদে।

চাল-চলনে তার অস্বাভাবিকতার ছোঁয়া। যেন ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি কোনো রাজ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। ছাদের দরজায় পৌঁছেই স্তম্ভিত হয়ে গেল নম্রতা। ছাদটাকে হঠাৎ করেই রূপকথার রাজ্য বলে বোধ হলো। বিশাল ছাদটা ভোরের ফ্যাকাশে আলো আর কুয়াশায় ঝাপসা দেখাচ্ছে চোখে। সেই ঝাপসা আলোতেই টানা বারান্দা দেওয়া ছনের ঘরটা চোখে পড়ল নম্রতার। বারান্দার বাঁশগুলো বাহারি লতা-পাতায় ঢাকা। ঘরের পাশে, মাঝারি আকারের শিউলি গাছে, ফুটন্ত কিছু শিউলি। কুয়াশায় ডুবে থাকা ঘরটা যেন দরদী শিল্পীর ভীষণ দরদ দিয়ে আঁকা প্রকৃতির গল্প। ফুল গাছে ভরে থাকা চারপাশটা কী স্নিগ্ধ। এ যেন এক রূপকথার বেলীফুলের রাজ্য!

নম্রতা বিস্ময় নিয়ে সামনে এগলো। ঘরের সামনের দুই তিন হাতের রাস্তাটা শিউলির চাদরে ঢাকা। নম্রতা কৌতূহল নিয়ে বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার এক কোণায় ছোট্ট একটা দোলনা। দরজার পাশের দেয়ালটিতে ঝুলছে ভীষণ পুরোনো এক হারিকেন। পশ্চিমের দেয়ালটিতে নকশা করা বেতের বাক্স। তাতে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা ‘ডাকপিয়ন’। নম্রতার ঠোঁটে হাসি ফুটল। চোখে ফুটল রাজ্যের বিস্ময়। ঢাকা শহরে এমন একটা ঘর? অবিশ্বাস্য! নম্রতা ডাকপিয়নের দিকে পা বাড়াতেই অদ্ভুত তীক্ষ্ম কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল কেউ,
‘ শ্যামলতা! শ্যামলতা! চিঠি! চিঠি! আমার নাম ডাকপাখি। আমার নাম ডাকপাখি।’
নম্রতা চমকে দুই পা পিছিয়ে দাঁড়াল। ভীষণ ভীত চোখে আশেপাশে তাকাল। কই?কেউ তো নেই। নম্রতার ভাবনার মাঝেই আবারও চেঁচিয়ে উঠল সেই কন্ঠ,

” শ্যামলতা! শ্যামলতা! চিঠি! চিঠি!’
নম্রতা এবার ভয়ে ভয়ে বারান্দার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করল, বারান্দার এক কোণায় ঝুলছে খাঁচায় বন্দী হৃষ্টপুষ্ট টিয়া পাখি। নম্রতা বোকা বোকা চোখে চেয়ে রইল। টিয়া পাখিটা তার নামই তো ডাকছে। কি আশ্চর্য! পাখিটা তাকে চেনে? নম্রতার ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো দীর্ঘকায় এক মানব। নম্রতা চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। মানুষটির গায়ে অফ হোয়াট টি-শার্ট। মাথা ভর্তি ভেজা চুল। চোখদুটোতে এক রাজ্য বিস্ময়। নম্রতা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল। ফিরে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিতেই হেসে এগিয়ে এলো মানুষটি।

‘ এতো সকালে উঠে পড়েছেন যে?’
পরমুহূর্তেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘ জ্বর কমেছে? দেখি।’
নম্রতা দুই পা পিছিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। উত্তর দিল না। আরফান বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা গুটিয়ে নিয়ে বলল,
‘ কী হলো?’
নম্রতা চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইল, উত্তর দিল না। আরফান কপাল কুঁচকে তাকাল। নম্রতাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে বলল,
‘ জ্বর নিয়ে এই পাতলা কাপড়ে ছাদে আসার কী প্রয়োজন ছিল? কমন সেন্স নেই? কত ঠান্ডা পড়ে গিয়েছে দেখেছেন?’
এটুকু বলেই ঘরে ঢুকে গেল আরফান। কয়েক মিনিটের মাঝেই চাদর হাতে বেরিয়ে এলো আবার। চাদরটা নিয়ে নম্রতার দিকে এগিয়ে আসতেই ছিটকে সরে গেল নম্রতা। ধমক দিয়ে বলল,

‘ খবরদার আমার দাঁড়ে কাছে আসবেন না। বেয়াদব পুরুষ মানুষ। আপনার মনের খবর আমি খুব ভালো করেই জানি।’
আরফান থমকে দাঁড়াল। অবাক চোখে চেয়ে রইল। নিজেকে ধাতস্থ করে মৃদু হাসল,
‘ আচ্ছা? তো কী জানেন?’
‘ আপনি যে আমায় পটিয়ে ফটিয়ে নিজের জীবন থেকে আউট করতে চান তা খুব ভালো করে জানি আমি। দেখুন ডক্টর? এতো নাটক ফাটকের দরকার নেই। আমার প্রতি এতো মায়া দেখানোরও প্রয়োজন নেই। আমি এমনিতেও আপনাকে বিয়ে করব না। আপনার যাকে ইচ্ছে আপনি বিয়ে করতে পারেন, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি বাবাকে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিব। আপনি চাইলে আপনার মাকেও জানিয়ে দিতে পারি। নাও চয়েজ ইজ ইউরস।’
নম্রতার কথায় যেন আকাশ থেকে পড়ল আরফান। আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বলল,

‘ কী বলছেন? কেন বলছেন?দুপুরে আসিনি বলে এত রাগ?’
নম্রতা চোখ রাঙিয়ে তাকাল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আপনি দুপুরে আসুন বা বিকেলে আসুন বা মধ্যরাতে কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত থাকুন কোনো কিছুতেই আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। আমি আপনাকে বিয়ে করব না, মানে করব না।’
আরফান হাসল। নম্রতাকে জোর করে টেনে নিল কাছে। নম্রতা হাত ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও লাভ বিশেষ হলো না। আরফান নম্রতাকে শক্ত করে চেপে ধরে চাদর জড়াল গায়ে। নম্রতাকে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখে হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,

‘ আহ! লাফাচ্ছেন কেন? বিয়ে করবেন না বললেন, শুনেছি তো। বিয়ে না করলে জড়িয়ে ধরা যাবে না? আপনার যদি বিয়ে করতে ইচ্ছে না হয় তাহলে করব না। জোরাজুরি করেছে কে? বিয়ে তো সবাই করে। আমরা বরং লিভ ইন রিলেশনশিপ কন্টিনিউ করব। বাইরের দেশগুলোতে এসব কমন। ব্যাপার না।’
নম্রতা ধাক্কাধাক্কি থামিয়ে অবাক চোখে তাকাল। পরমুহূর্তেই রাগে ফুঁসে উঠল। আরফান থেকে দূরে সরার চেষ্টা করে বলল,

‘ আপনি খুবই জঘন্য একটা মানুষ। কী মনে করেন আমাকে? খুব সস্তা? মাঝরাতে অন্যের ফোনালাপে ব্যস্ত থাকবেন অথচ আমার বেলায় ব্যস্ততা। আমি বেঁচে আছি না মরে গিয়েছি তাতে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই আপনার। নিজ থেকে ফোনটা পর্যন্ত দেন না। আর আমি ফোন দিলে বিরক্তিতে ফোন বন্ধ। এতোই যদি বিরক্তি তাহলে এতো নাটকের প্রয়োজন কী? আপনার জীবনে আমার অস্তিত্ব ব্যস্ততা আর খেয়াল হওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নিষ্প্রভ। আমি বোধহয় অতটাও সস্তা নয়। এতোটা অবহেলা আমি ডিজার্ভ করি না। আর আপনি ডিজার্ভ করেন না আমাকে। কখনও ডিজার্ভ করেন না। ছাড়ুন!’
কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেলল নম্রতা। আরফান আহত চোখে তাকাল। রাগারাগি না করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ আপনাকে অবহেলা করা আমার পক্ষে সম্ভব বলে আপনার বিশ্বাস হয় নম্রতা?’
নম্রতা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে অন্য দিকে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আমি যে এমনই তা তো আপনি জানতেন নম্রতা। বার বার ফোনে কথা বলার চেয়ে আপনাকে অনুভব করতেই বেশি পছন্দ করি আমি। যখন আমাদের মাঝে চিঠি দেওয়া নেওয়া হতো তখনও কী আমি এমনই ছিলাম না?’
নম্রতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

‘ তাই বলে কখনও অবহেলা করতেন না। এক সপ্তাহ পরও যখন চিঠি লিখতেন, আমার মনে হতো আপনার সবটা জুড়ে শুধু আমিই আছি। কিন্তু এখন তেমনটা হচ্ছে না। আমার বারবার মনে হচ্ছে আপনি অন্যকারো মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন ডক্টর। এমন যদি হয় তবে আমায় সরাসরি বলুন। আমি আপনার পথে বাঁধা হব না।’
আরফানের মেজাজ বিগড়ে গেল। নম্রতাকে ছেড়ে দিয়ে বারান্দার দরজায় গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে চোখ তোলে তাকাল। নম্রতার হাতটা জোরপূর্বক টেনে নিয়ে পাশে বসাল। নম্রতার হাতের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

‘ কেন আমায় অবিশ্বাস করছেন নম্রতা? আমি কী এমন কিছু করেছি যা আপনার পছন্দ হয়নি? আমি মাঝরাতে কারো সাথে কথা বলি, এটা আপনার ভুল ধারণা। আপনার আমাকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল যেমনটা আমি আপনাকে করি। কিছুদিন যাবৎ একটা মেয়ে ভীষণ বিরক্ত করছিল আমায়। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছিল। তারপর হঠাৎ একদিন নিজেকে শ্যামলতা বলে দাবী করে বসল।’
নম্রতা অবাক চোখে তাকাল। আরফান অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ আপনি চাইলে আমার কল লিস্ট চেইক করতে পারেন। আমি কখনও ফোন দিইনি তাকে। সে নিজে আমাকে ফোন দিয়েছে প্রতিবার। সে যখন নিজেকে শ্যামলতা বলে দাবী করল তখন ভীষণ ডিস্টার্বড হয়ে পড়েছিলাম আমি।’
নম্রতা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

‘ মেয়েটার কথায় আমাকে অবিশ্বাস করেছিলেন আপনি? এজন্যই এবোয়েড করছিলেন আমায়?’
আরফান হেসে ফেলল। নম্রতাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আলতো চুমু খেল কপালে। ভীষণ তৃপ্তি নিয়ে বলল,
‘ এক সেকেন্ডের জন্যও নয়।’
‘ তাহলে ম্যান্টালি ডিস্টার্বড হয়ে পড়েছিলেন কেন? মেয়েটার ফোন নাম্বারটা ব্লক করে দিলেই হতো।’
আরফান নম্রতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

‘ আপনি নিজেও জানেন না শ্যামলতা নামক মানুষটা আমার অনুভূতির কতটা জুড়ে আছে নম্রতা। এই অনুভূতিটা কতটা তীক্ষ্ণ, কতটা জোড়াল। আমার জীবনের সবচেয়ে সেনসেটিভ দিকগুলোর একটি আপনি নিজে শ্যামলতা। মেয়েটা যখন ফোন দিয়ে নিজেকে শ্যামলতা বলে দাবী করছিল। তখন আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার এই অনুভূতিটাকে অপমান করছে। আপনাকে অপমান করছে। আমাদের এই অনুভূতি নিয়ে বিশ্রী একটা খেলা খেলছে। হাসাহাসি করছে। বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়ত, মেয়েটা কে হতে পারে, তার উদ্দেশ্য কী এসবও মাথায় ঘুরছিল খুব। তারওপর হসপিটালে কাজের চাপ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা অসহ্য লাগছিল খুব। আপনার ধারণা তার নাম্বার আমি ব্লক করিনি? এই নিয়ে দশটা নাম্বার ব্লক করেছি কিন্তু কোনো লাভ নেই। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে ফেলে রাখতাম। যখন দেখলাম তাতেও কাজ হচ্ছে না তখন ফোনই বন্ধ করে রাখতে লাগলাম। সেদিন রাতেও এমন কিছুই ঘটেছিল। ফোন রিসিভ করে ফেলে রেখেছিলাম বলেই আপনার কলের হদিশ পাইনি। আপনার সাথে কথা বলার সময়টুকুতেও চার থেকে পাঁচবার কল দিয়েছে সেই মেয়ে। এতো বিরক্ত লাগছিল। ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে আমি খুন করে ফেলি।’

নম্রতা স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল। আরফান একটু থেমে আবার বলতে লাগল,
‘ রাতে মেজাজ খারাপ থাকায় ঘুম ভালো হয়নি। ডিউটিতেও ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারিনি। হসপিটালেও সেদিন ঝামেলা চলছিল। রোগীর চাপও ছিল বেশি। এতো কিছুর মধ্যে সীম অন করার ব্যাপারটা মাথায় আসেনি। আপনাকে ফোন করার সুযোগও হয়নি৷ আপনি বলার পর মনে হয়েছে। আমার খেয়াল রাখার উচিত ছিল। আমি সরি নম্রা।’
নম্রতা অভিমান নিয়ে বলল,
‘ আমি তো ভেবেছিলাম, আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ রেখেছেন আপনি। আপনার অন্য নাম্বারটাও দেননি আমায়। আমি ফোন দেওয়ার পরও রুড বিহেভ করেছেন, আমি কষ্ট পেয়েছি।’
আরফান অবাক হয়ে বলল,

‘ ওই ফোন নাম্বারটা যে আপনার কাছে নেই তাই-ই তো খেয়াল ছিল না আমার। আর তখন সামনে সত্যিই প্যাশেন্ট ছিল। বৃদ্ধা ভদ্রলোক ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে আছে, বিষয়টা অস্বস্তির না? আপনি বুঝতেই চাইছিলেন না। প্যাশেন্টের সামনে কী করে বুঝায় বলুন? আর রাগ তো আমারও করার কথা ছিল। আমি কী রাগ করেছি? নিদ্রার থেকে আপনার অসুস্থতার খবর শুনে কত অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম জানেন? হাজারবার কল দিয়েছি, রিসিভ করলেন না। শেষমেশ লজ্জার মাথা খেয়ে আপনার বন্ধু নাদিমকে ফোন করতে হয়েছে আমায়।’
নম্রতা চোখ বড় বড় করে তাকাল। অবিশ্বাস নিয়ে বলল,
‘ নাদিমকে ফোন করেছিলেন আপনি? ও বলেনি তো।’

‘ বলার প্রয়োজন মনে করেনি বলেই হয়ত বলেনি। তাছাড়া সেদিন রাত একটা পর্যন্ত ফোন ট্রাই করেছি আমি। বারোটা পর্যন্ত ফোনই রিসিভ করলেন না। তারপর থেকে ফোন বন্ধ। সকালে হসপিটালে যাওয়ার আগে এবং হসপিটালে গিয়েও কল করেছিলাম সেই-ই যে ফোন বন্ধ আর খুললেনই না। কতটা অস্থির লাগছিল জানেন?’
নম্রতার হঠাৎ করেই মনে পড়ল, আরফানের সাথে রাগ করে ফোনটা সাইলেন্ট করে আলমারিতে তুলে রেখেছিল নম্রতা। ছোঁয়ার বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হওয়ায় আর বের করা হয়নি। নম্রতা অপরাধী চোখে তাকাল। পরমুহূর্তেই তেজ নিয়ে বলল,

‘ তা নাহয় বুঝলাম কিন্তু কাল দুপুরে কোথায় হাওয়া হয়েছিলেন আপনি? এতোই যদি খারাপ লাগত তাহলে আমি আসব জেনেও হাওয়া হতেন না নিশ্চয়।’
কথাটা বলে ভ্রু নাচাল নম্রতা। আরফান ভেজা চুলগুলো গোছাতে গোছাতে বলল,
‘ হসপিটালে যাওয়ার দুই তিন ঘন্টা পর আবারও সেই মেয়ের ফোন পেয়েছিলাম আমি। মেয়েটি কথা শুরু করার আগে পাশে কোথাও হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। মেয়েটির কথার মাঝেও পাশে থেকে সূক্ষ্ম হাসির আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল কয়েকজন মিলে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। তৎক্ষনাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। ওরা যে দলবেঁধে ব্যাপারটা নিয়ে ফাজলামো করছে তা তখন ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঠিক ওই মুহূর্তে আসল কালপ্রিটকে না ধরতে পেরে। তাকে দুটো থাপ্পড় না মেরে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই রহস্য উদঘাটনে বেরিয়েছিলাম। মেজাজ খারাপ ছিল বলে বোকামো করে ফোন ফেলে গিয়েছিলাম চেম্বারে। তাই আর কল করে ইনফর্ম করতে পারিনি।’

নম্রতা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আপনি মেয়েটিকে সত্যিই থাপ্পড় মেরেছেন?’
‘ না। মারিনি। তখন হাতের কাছে পেলে হয়ত মারতাম। যদিও মেয়েদের গায়ে হাত তোলার অভ্যাস আমার নেই। নিদ্রাকেও কখনও মারিনি। বকিওনি। রেগে গেলেও না। আমি না মারলেও আপনি কিন্তু মারতেই পারেন। লঞ্চে আমাকে যেভাবে খামচে ধরেছিলেন, সেভাবে। নিজেকে আপনার বরের বউ হিসেবে দাবী করছিল। আপনার তো ভয়ানক রেগে যাওয়া উচিত।’
শেষের কথাগুলো দুষ্টুমি করে বলল আরফান। নম্রতা সেসব খেয়াল না করে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘ মেয়েটা কে? খুঁজে পেয়েছেন তাকে?’
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ পাইনি তবে শীঘ্রই পাব। কাল সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম আমি। রাতে ফিরেছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল চিঠিটা সঠিক জায়গায় রাখা হয়নি। এখনও অবশ্য তাই মনে হচ্ছে। মুহিবের ভাষ্যমতে, চিঠিটা সে গ্রন্থাগারে না রেখে তার এক বন্ধুকে রাখতে দিয়েছিল। আর পড়াশোনার চাপে চিঠিটা সঠিক জায়গায় রাখা হয়েছিল কী-না তার খোঁজ নিতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। আমি আপনার ফোন না পেয়ে প্রায় তিনদিন পর মুহিবের সাথে যোগাযোগ করি। মুহিব যোগাযোগ করে তার বন্ধুর সাথে। তার বন্ধু তাকে জানায় চিঠিটা সঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে। মুহিবও আমায় সেরকমটাই বলে। আপনি যখন দুই সপ্তাহের মাথাতেও কল করলেন না। তখন মুহিবকে গ্রন্থাগারে গিয়ে চিঠি আছে কী নেই তা সিওর হয়ে জানাতে বলি। সেদিনই মুহিব গ্রন্থাগারে গিয়ে বইয়ের ছবি তুলে পাঠায়। চিঠি নেই। তারমানে চিঠিটা আপনি পেয়েছেন। এমনটা ধারণা করেই অপেক্ষা করতে লাগি। এখন প্রশ্ন হলো, তার বন্ধু কী চিঠিটা সত্যিই রেখেছিল বইয়ে?’

নম্রতা স্তম্ভিত চোখে চেয়ে থেকে আর্তনাদ করে বলল,
‘ ইয়া মাবুদ! এই একটা চিঠি নিয়ে এত কাহিনী? আমার মাথা ঘুরছে। মুহিব ভাইয়ের বন্ধু আবার আরেকজনকে রাখতে দিলেই হলো। চিঠি এভাবে সার্কেলের মতো ঘুরতেই থাকবে। রহস্যও ঘুরতেই থাকবে ভন ভন ভন। ভয়াবহ।’
আরফান হাসল না। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ মুহিব আমার সাথে ঢাকা এসেছে। আজ বিকেলে তার সেই বন্ধুকে একটা কফিশপে দেখা করতে বলা হয়েছে। আমার মনে হয় এবার উত্তর মিলবে।’
নম্রতা আরফানের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এতো কাহিনী! আমি তো শুনতে শুনতেই টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি ভাই।’
আরফান হেসে বলল,

‘ এতো অল্পতেই ক্লান্ত? তাহলে চারবছর ধরে অপেক্ষা করলেন কীভাবে? ক্লান্ত হয়ে পড়েননি? আমাকে খুঁজে পাওয়াটাও মুশকিল ছিল।’
নম্রতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তখন আপনি পাশে ছিলেন না বলে পেরেছি। এখন আছেন, এখন আমার বিশ্রাম।’
আরফান হেসে নম্রতাকে সামনে টেনে নিয়ে বলল,
‘ রাগ-অভিমান কমলে কাছে আসুন তো, জ্বর কমেছে কিনা দেখি। কাল এসেই আপনার অসুস্থতার কথা শুনে কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানেন? মা আমাকে দুই দুটো থাপ্পড় মেরেছে গালে। আপনি বসুন, আমি আমার ব্যাগ নিয়ে আসি। প্রেশার মাপতে হবে।’
আরফান উঠতে নিতেই বিরক্ত চোখে তাকাল নম্রতা,
‘ এসব ডাক্তারি ফাক্তারি বন্ধ করুন তো। আমি এখন একদম সুস্থ। প্রেশার ট্রেশার মাফতে হবে না। তার থেকে পাশে বসুন, সকাল দেখি।’

আরফান আগের জায়গাতেই বসে পড়ল। নম্রতার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা। এবার বলুন, মহারাণী কী তার বেলীফুলের রাজ্য দেখে সন্তুষ্ট হয়েছে? এই রাজ্যে শুধু শ্যামলতার অধিকার।’
নম্রতা এবার আশেপাশে তাকাল। ভীষণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,
‘ ভীষণ সন্তুষ্ট। ঢাকা শহরে ছনের ঘর। ভাবতেই পারছি না। ডেকরেশনটাও কী মারাত্মক!’
আরফান হুহা করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ এটা ছনের মতো দেখতে হলেও ছনের ঘর নয় নম্রতা। ইটের দেয়ালে ছনের মতো পেইন্ট করা হয়েছে।’
নম্রতা যেন আকাশ থেকে পড়ল। বোকা বোকা চোখে চেয়ে বলল,
‘ এটা ইটের দেয়াল! একদম বোঝা যায় না। সত্যি বলছি…তাহলে এই বাঁশগুলোও কী?’
বিস্মিত চোখে চাইল নম্রতা। আরফান হেসে বলল,

‘ স্পেশাল পেইন্টার এপয়েন্ট করেছিলাম পেইন্ট করার জন্য। যেন আপনি যেমন চান ঠিক তেমই হয়। আর এগুলোও বাঁশ নয়। স্বাভাবিক লোহার গ্রিল। বাঁশের মতো রং করা হয়েছে।’
নম্রতা অবিশ্বাস নিয়ে বাঁশের উপর হাত রাখল। নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কপাল কুঁচকাল। বাঁশটা টিপে টিপে পরীক্ষা করার চেষ্টা করল। নম্রতার পাগলামোতে শব্দ করে হেসে ফেলল আরফান।
‘ এখন তো অনেক সকাল, কুয়াশাও পড়েছে তাই একদম বুঝতে পারেননি। কুয়াশা কেটে গেলে খেয়াল করলেই বুঝা যাবে। আমি তো ভেবেছিলাম একদম বিয়ের রাতে সারপ্রাইজ দিব আপনাকে। কিন্তু আপনি তো সব প্ল্যানই মাটি করে দিলেন।’

নম্রতা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠোঁট ভর্তি অকৃত্রিম হাসি নিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বলল,
‘ বিয়ের পর আমরা এখানে থাকব?’
‘ অবশ্যই। আপনিই না বলেছিলেন? আমরা ছোট্ট একটা ঘর বাঁধব। ছনের ছাওয়া চাল থাকবে। ফাঁক গলে জ্যোৎস্না আসবে। একটা পোষা টিয়া থাকবে। দেখুন তো সব ঠিকঠাক আছে না? আপনি বারান্দার দোলনাটাতে বসলেই এক ঝাঁক জ্যোৎস্না এসে ঘিরে ধরবে। পোষা টিয়া আপনার সাথে কথাও বলবে। ওকে আমি কথা শেখাচ্ছি আজকাল। এতো গাছ পেয়ে ঝিঁঝি পোকাদেরও দেখা মিলে মাঝে মাঝে। রাতে যখন আমি ফিরব তখন সারা ছাদের আলো নিভিয়ে হারিকেন জ্বালাব। জ্যোৎস্নার আর হারিকেনের আলো মিলেমিশে স্বর্গীয় এক আলো ছড়াবে। সেই আলোয় বসে একের পর এক গল্প করবেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনব। চারপাশে থাকবে বেলী ফুলের তীব্র সুবাস।’
আরফানের কথাগুলো শুনেই আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়ল নম্রতা। সুন্দর একটা রাতের ছবি ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠল দুঃখ দুঃখ সুখ। নম্রতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। ডাকপিয়ন বাক্সটির কাছে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে বলল,

‘ এটা কী?’
আরফান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
‘ এটা চিঠি বাক্স। আপনার খুব ইচ্ছে ছিল না? বিয়ের পরও আমরা চিঠি প্রেম করব? সেজন্যই এই ব্যবস্থা। আমাদের সাংসারিক জীবনে নানা বাঁধা সৃষ্টি হবে, রাগ হবে, অভিমান হবে, ভুল বোঝাবুঝিও হবে। সেই রাগ,অভিমান, অভিযোগ সবকিছু এই বাক্সটিতেই চালান করব আমরা। যখনই মন খারাপ হবে তখনই চিঠি লিখতে বসে যাবেন আপনার প্রেমিকের ঠিকানায়। ডাকবক্সের বাইরে আমাদের সম্পর্কটা আপনিময় হলেও। ডাকবক্সের ভেতরের জীবনটা হবে তুমিময়। চিঠিতে আপনার স্বামী নয় প্রেমিক থাকবে। চির প্রেমিক।’

আরফানের দিকে চেয়ে, তার কথা শুনতে শুনতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল নম্রতার। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, আমার এত সুখ কেন? আমার মানুষটা এমন পাগল কেন? এমন ভয়াবহ প্রেমিক কেন? নম্রতাকে কাঁদতে দেখে হাসল আরফান। ধীর পায়ে নম্রতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নম্রতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ এখনই কাঁদছেন? আপনাকে আরও অনেক অনেক কাঁদানো বাকি শ্যামলতা। আমি আপনাকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়েই ভালোবাসব। এবার ডাকপিয়নটা খুলুন। কিছু আছে নিশ্চয়।’
আনন্দ, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগল নম্রতা। কাঁপা হাতে চিঠি বাক্সের দিকে হাত বাড়াতেই তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠল ডাকপাখি,

‘ শ্যামলতা! শ্যামলতা! চিঠি! চিঠি!’
আরফান হেসে ফেলে বলল,
‘ ওর নাম ডাকপাখি। আপনাকে চিঠির কথা মনে করে দেওয়ার দায়িত্ব ওর।’
নম্রতার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। নম্রতা নাক টেনে টেনে চিঠি বাক্স থেকে নীল খামে মোড়ানো এক চিঠি উদ্ধার করল। চিঠিটা মেলে ধরতেই দুইহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে খোলা কাঁধে মুখ ডুবাল আরফান। নম্রতা কেঁপে উঠল। ধুরু ধুরু বুক নিয়ে দেখল দীর্ঘ এক চিঠি। গুটি গুটি অক্ষরে লেখা,
” এইযে,
শ্যামলতা! আমার প্রিয়তমা! আমার মিষ্টি কিছু অনুভূতি। আমার শূন্য ঘরের যতি!

কোনো এক কাক ডাকা ভোরে হঠাৎ উপলব্ধি করেছিলাম, তার প্রতি আমার জীবন মরণ ব্যধি। তাকে ছাড়া শ্বাসকষ্ট। তাকে নিয়ে শ্বাসকষ্ট। তার প্রতিটি ভাবনায় আমার ভয়ানক শ্বাসকষ্ট। তখন ছোট্ট একটা মেয়ে ছিল সে। বুলবুলির বাচ্চাটির মত চঞ্চল, আদুরে। কত অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি তার! কত অদ্ভূত তার স্বপ্ন! আমি তখন টগবগে যুবক। ভীষণ পড়াকু ছাত্র। হাসপাতালের ইন্টার্নি ডাক্তার। ক্যারেয়ারের প্রতি ভীষণ ফোকাসড্। প্রেম- ভালোবাসা দু-চোখের বিষ। এমন একটা ধরা-বাঁধা, নিয়মমাফিক জীবনে কেমন দুষ্টুমি করেই ঢুকে পড়ল সে। আমি তাকে আটকাতে গেলাম, সে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি তাকে অবহেলা করতে গেলাম, সে টলমল অভিমানী চোখে চাইল। ব্যস! আমার আজন্ম শ্বাসকষ্ট হয়ে গেল।

আমি হেরে গেলাম। আমার এই ধরা বাঁধা জীবনটা সেই ছোট্ট মেয়েটার তরে মেলে ধরলাম। একটু স্বস্তি, একটু আরামের আশায়। কিন্তু সে-ই চঞ্চলা আমায় স্বস্তি দিল না। ছোট্ট শ্যামলতার চিঠির ভাঁজে, কথার তোড়ে স্বস্তি নামক পাখিটা শ্বাসরোধ হয়ে মরেই গেল শেষ পর্যন্ত। আহা, কী অকাল মৃত্যু তার! ডাক্তারের ডাক্তারী উবে গেল। প্রেসক্রিপশনের পাতায় ঔষধের নাম মিলিয়ে গিয়ে গুটি গুটি অক্ষরে ভেসে উঠতে লাগল আবেগময় চিঠি, তার টানা টানা অভিমানী চোখ। আমি এলোমেলো হয়ে গেলাম। মরে গেলাম। বিশ্বাস করো, সে-ই ছিল আমার প্রথম মৃত্যু। শ্যামলতার বিষে আকন্ঠ ডুবে বিস্ময়কর সেচ্ছা মৃত্যু।

তারপর একদিন হঠাৎ হারিয়ে ফেললাম তাকে। আমার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেল। পাগল হয়ে উঠলাম। ছটফট করে উঠল বুক। তারপর যেদিন ফিরে পেলাম। তার টলমল অভিমানী চাহনীতে স্তম্ভিত হলাম। ক্লান্ত হলাম। আমার শ্বাসকষ্টের মাত্রা সেদিন সহ্য ছাড়াল। আমি ভেসে গেলাম। তাকে কাছে পেলে বুক শুকিয়ে আসতে লাগল। দূরে গেলে শুরু হতে লাগল তীক্ষ্ণ বুক ব্যথা। তাকে আমি কী করে বুঝাই, এই ক্ষণিকের বুক ব্যথায় কত সুখ, বেদনাময় স্বস্তি! দিনের পর দিন দূরত্ব রেখে হঠাৎ তাকে কাছে পাওয়া, তার অভিমানী চোখ নেড়ে নেড়ে এক আকাশ অভিমান ঝাড়া যে আমার কত প্রিয়!

আজ বলতে দ্বিধা নেই, আমি তার পাগল প্রেমিক। তবে তার রূপ নয়, তার অভিমানী চোখ দুটোরই ভয়ানক প্রেমিক। আমি তার শরীরের মসৃন বাঁক নয় তার বাম পায়ের স্বর্গীয় তিলের প্রেমিক। তার ঠোঁটের রঙ হওয়ার থেকে কপালের টিপ হতে পারাটাই আমার প্রিয়। তাকে খুব কাছে টানার চেয়ে বুকের ভেতর স্থাপন করে, প্রতিটি মুহূর্তে পাওয়া চিনচিনে সুখটাই আমার প্রিয়। তার নেশা ধরা যৌবন থেকে তার নেশা ধরা হাসিই আমার বেশি প্রিয়।

নীল চিরকুট পর্ব ৫৯+৬০

তাকে প্রকাশ্যে শতবার ভালোবাসি বলার চেয়ে চুপিচুপি নিরন্তর, নিরবিচ্ছিন্ন, বিশ্রামহীন ভালোবেসে যাওয়াটাই আমার প্রিয়। শুনো মেয়ে? সেই সর্বগ্রাসীকে বলে দিও, তার কাজল রাঙা চোখদুটোতে আমার মৃত্যুও প্রিয়।
শুনো, শুনছ শ্যামলতা? আমার তোমাকে নয়, তোমার অভিমানী চোখদুটো খুব প্রিয়। তোমাকে এক সমুদ্র কাঁদিয়ে, এক পাহাড় অপেক্ষা করিয়ে, এক আকাশ সুখ দেওয়াটাই আমার ভীষণ প্রিয়।’
ইতি
তোমার সে ”

নীল চিরকুট পর্ব ৬৩+৬৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here