নীল চিরকুট শেষ পর্ব
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ভরা বর্ষা। আকাশটা ছেয়ে আছে কালো মেঘে। পাহাড়ি গা’জুড়ে ভয়াবহ ঝুম বৃষ্টি। সরু আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলোর পাশ বেয়ে ছুটে যাচ্ছে ফুলে-ফেঁপে থাকা ঝিরি। আষাঢ়ে কান্নায় ধুয়েমুছে আরও খানিকটা পবিত্র হয়ে উঠেছে রূপসী পাহাড়ের অঙ্গ। সেই সরু,পিচ্ছিল লাল মাটির রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে মধ্যবয়স্ক এক উপজাতি। মাথায় তার কালো ছাতা। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ছাতাটা বুঝি ঠেকে গিয়েছে কালো,অন্ধকার মেঘরাজ্যে। পা জোড়া খালি, জুতো নেই। হাঁটু সমান লুঙ্গি আর ঢিলেঢালা ফতুয়ার অধিকাংশই ভেজা।
পিঠে মাঝারি আকারের ঝুড়ি। লোকটি নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হেঁটে চলেছেন। ভীষণ পরিচিত পাহাড়ি জঙ্গলা ভেঙে উঠে যাচ্ছেন পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ছোট্ট, ছিমছাম বাড়িটির দিকে। বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িটি চোখে পড়ছে না। কালো মেঘ আর পাহাড়ি গাছে ঢেকে আছে তার অস্তিত্ব। লোকটি চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যে নামল। বৃষ্টি বাড়ছে। বাইরের চটানে রাখা বালতি থেকে পা ধুয়ে ভেতরে ঢুকল বাহাদুর। দরজা খোলা। ভেতর থেকে অদ্ভুত সুরেলা শব্দ আসছে। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে অসাধারণ শোনাচ্ছে কানে। ঝুড়িটা বাইরের ঘরে রাখতেই ভেতর থেকে কোমল কন্ঠ শুনতে পেল বাহাদুর। বাবু গাইছে। আজও নিশ্চয় সেই অদ্ভুত যন্ত্রটা নিয়ে বসেছে বাবু? বাহাদুর ভেতরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ
বেদনাকে সাথী করে
পাখা মেলে দিয়েছো তুমি
কত দূরে যাবে বলো
কত দূরে যাবে বলো
তোমার পথের সাথী হবো আমি…’
গানটা থেমে গেল হঠাৎ। জানালার পাশে বসে থাকা নাদিম ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল,
‘ কী অবস্থা বাহাদুর? ভিজে গিয়েছ দেখছি। বৃষ্টি সারলেই আসতে পারতে।’
বাহাদুর মুখ কাঁচুমাচু করে নিজের দিকে তাকাল। তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে ভয়াবহ অপরাধ করে ফেলেছে। নাদিম গিটারে সুর তুললো। টুংটাং শব্দ তুলে বলল,
‘ বেশি করে চিনি দিয়ে এক কাপ চা বানিয়ে ফেলো তো বাহাদুর। ফটাফট বানাবে। পারবে না?’
বাহাদুর মাথা নাড়ল। তারপর কী ভেবে বলল,
‘ ঘরত দুধ নেই বাবু।’
‘ দুধ না থাকলে রং চা বানাবে। চিনিটা একটু বেশি দিবে। দুধ থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।’
বাহাদুর মাথা নাড়ল। ফিরে যেতে নিয়েও থেমে গেল হঠাৎ। নাদিম গিটার থেকে হাত সরিয়ে তার দিকে চাইল। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ কিছু বলতে চাও বাহাদুর?’
বাহাদুর মাথা নাড়ল। নাদিম গিটারটা পাশে রেখে সোজা হয়ে বসল,
‘ বলে ফেলো।’
‘ ত নামে চিঠি ইজজি।’
নাদিম জবাব না দিয়ে চেয়ে রইল। বাহাদুর নাদিমের বছর বাঁধা ভৃত্য। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাজারঘাট সবই করে সে পুরোদমে। শক্তসমর্থ শরীরে পরিশ্রম করার অসাধারণ স্পৃহা। কিন্তু সমস্যা হলো, বাহাদুর খুব একটা বাংলা বলতে পারে না। নাদিমের ধারণা, বাহাদুর বাংলাটা ইচ্ছে করেই বলে না। বাংলা বুঝা সত্যেও বাংলা বলতে না-পারাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নাদিম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নিষ্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘ আমার নামে চিঠি? আমাকে কে চিঠি পাঠাবে বাহাদুর? তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। চিঠিটা অবশ্যই আমার নামে নয়।’
বাহাদুর কিছু বলার আগেই গিটার তুলে নিল নাদিম। গিটারের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ বাংলায় কথা বলো বাহাদুর। তোমার অধিকাংশ শব্দ আমি বুঝি না।’
বাহাদুর এবার বাংলায় কথা বলল। ভাঙা বাংলা আর তার নিজস্ব ভাষায় যতটুকু বলল তাতে, চিঠিতে নাদিমের নামই লেখা আছে। সিভিল সার্জন অফিসে এসেছিল। বড় বাবু শহর থেকে কেউ একজনকে দিয়ে থানচি পাঠিয়েছে। বাহাদুর সেই চিঠি নিতেই শহরে গিয়েছিল আজ। নাদিমের কপাল কুঁচকে এলো। উদ্বিগ্ন চোখে চেয়ে বলল,
‘ চিঠিটা কোথায়?’
বাহাদুর ফতুয়ার পকেট থেকে পলিথিন কাগজে মোড়ানো একটা খাম বের করল। খামটা নাদিমের দিকে এগিয়ে দিতেই চোখ দিয়ে টেবিলের উপর রাখতে ইশারা করল নাদিম। বাহাদুর চিঠিটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,
‘ হি হেবে? হি রানিম, বাবু?’
নাদিম চিঠিটির দিকে চেয়ে থেকে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
‘ কিছু রান্না করতে হবে না। দুটো ডিম ভেজে ফেলো তাতেই হবে।’
‘ ঘরত বডা নাই, বাবু।’
নাদিম বিরক্ত চোখে চাইল,
‘ ডিম না থাকলে যা আছে তাই রান্না করো। আমার মেজাজ ভালো নেই। আমাকে বিরক্ত করবে না।’
সহজ-সরল বাহাদুর ভীতমুখে মাথা নাড়ল। বাহাদুর চলে যেতেই চিঠিটা হাতে নিল নাদিম। দীর্ঘক্ষণ চিঠির দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল সে। খামের গায়ে প্রেরকের নাম ঠিকানা নেই। তবে এসেছে ঢাকা থেকে। নাদিম খামটা উল্টেপাল্টে দেখল। চিঠিটা যে পাঠিয়েছে সে নিশ্চয় খুব বুদ্ধিমান। নয়তো নাদিমকে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। নাদিম নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টা যেমন করেনি। তেমনই কারো ধরা-ছোঁয়ার মাঝেও নিজেকে রাখেনি। ঢাকা শহরটা একঘেয়ে, অসহ্য লাগছিল বলেই হঠাৎ এক গন্তব্যহীন রাতের ট্রেনে উঠে পড়েছিল নাদিম। সেই ট্রেনে করেই এসে পৌঁছাল রাজশাহী। প্রথম দুই-তিনমাস রাজশাহীর আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াল নাদিম।
তারপর ঢাকা থেকে কাগজপত্র জোগাড় করে মাস্টার্সটা শেষ করল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীর হাওয়া অসহ্য ঠেকতেই পিছুটানহীন নাদিম পাড়ি জমাল চট্টগ্রামের পথে। চট্রগ্রামের সিভিল সার্জন অফিসে হেল্থ প্রোগ্রাম প্রজেক্টে অস্থায়ী সাইকোলিক্যাল কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত সে। দুই বছরের ধরা বাঁধা চাকরি। এরপর আবারও অন্য কোনো শহরে গা ভাসানোর তাড়া। নাদিমের মতো উড়ো পাখির জন্য এ এক অসাধারণ কাজ। নাদিম কৌতূহল নিয়ে খাম খুলল। খামের ভেতর থেকে নীল চিরকুট লেখা খামটা বেরিয়ে আসতেই চট করে বুঝে ফেলল, এটা অবশ্যই আরফানের কাজ। নম্রতা অত বুদ্ধিমতী নয়। কিন্তু আরফান হঠাৎ তাকে চিঠি পাঠাবে কেন? হাজারও প্রশ্ন নিয়ে নীল খামটা ছিঁড়ে ভেতরের ছবিটা বের করতেই কপালের কুঞ্চন গাঢ় হলো তার। সাথে থাকা চিরকুটটা বার কয়েক পড়ে টেবিলের উপর রেখে দিল। গিটারটা হাতে নিয়ে এক মনে সুর তুললো তাতে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে গেয়ে উঠল তার কন্ঠ,
‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ…’
গান বেশিদূর এগোল না। গিটারের শব্দও থেমে গেল হঠাৎ। নাদিম হঠাৎ উপলব্ধি করল, এই সুন্দর পাহাড়ী বৃষ্টি, মুক্ত জীবন তার ভালো লাগছে না। বুক ভার লাগছে। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। নাদিম গিটার নামিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ভরাট কন্ঠে বাহাদুরকে ডাকল। বাহাদুর ভীত চোখে দরজার কাছে উঁকি দিতেই হাতের ইশারায় ভেতরে ডাকল নাদিম। চেয়ার টেনে বসতে বলে বলল,
‘ তোমার ছেলে মেয়ে ক’জন বাহাদুর?’
অবাঞ্ছিত প্রশ্ন। নাদিম জানে বহাদুরের দুই মেয়ে এক ছেলে। জানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার মানে হয় না। তবুও কেন জিজ্ঞেস করল জানা নেই। শুধু জানে, কথা বলতে হবে। এইযে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কিছু একটা পেয়ে যাওয়ার আনন্দে হাত-পা কাঁপছে। এই কম্পন থামাতে হবে। বাহাদুর বিরস কন্ঠে বলল,
‘ মর দিবি জি আর দিবি পো।’
নাদিম বুক ভরে শ্বাস নিল। মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ তোমাদের ভাষায় বন্ধুদের কী বলে বাহাদুর?’
‘ সোমাজসি, বাবু।’
নাদিম হাসল। জানালার বাইরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বিরবিরিয়ে বলল,
‘ সোমাজসি! বাহ! সুন্দর তো।’.
একটু থেমে আবারও বলল,
‘ আমাকে ঢাকা যেতে হবে বাহাদুর। কালকেই যেতে হবে। তুমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করো।’
বাহাদুর অবাক হয়ে বলল,
‘বারে বেজ ঝড় দেড়। পদট পুট উটটি। গাড়ি ন পেব।’ [ বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে রাস্তা কাদা। গাড়ি পাওয়া যাবে না।]
নাদিম আনমনা কন্ঠে বলল,
‘ তবুও যেতে হবে। যেতেই হবে বাহাদুর।’
বাহাদুর কী বুঝে বলল,
‘ আচ্চা বাবু।’
নাদিম হঠাৎ সুর তুলল। ভীষণ করুণ কন্ঠে গাইল,
‘ আমার ধূলাবালি জমা বই
আমার বন্ধুরা সব কই
আমার ভাল্লাগেনা এই মিথ্যে শহর
রাতের আড়ালে রই।’
বাহাদুরের হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। নাদিমের কন্ঠে ভেসে আসা কাতরতা যেন আকাশের কান্না হয়ে বৃষ্টির শব্দে কন্ঠ মেলাল। নাদিম গান থামিয়ে হঠাৎ প্রশ্ন করল,
‘ ভালোবাসাকে তোমরা কী বল বাহাদুর?’
‘ হোজপানা।’
নাদিম উঠে বসল। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখা জ্যাকেটটা পরতে পরতে মৃদু হাসল। বাহাদুরকে অবাক করে দিয়ে বলল,
‘ তর তেই হোজপানা বাহাদুর।’ [ তোমার জন্য ভালোবাসা বাহাদুর। ]
বাহাদুরের সহজ-সরল গাল লজ্জায় রাঙা হলো। পরমুহূর্তেই বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ কোতায় যাচ্চেন বাবু?’
‘ ঢাকা যাচ্ছি বাহাদুর। এখনই যেতে হবে। আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।’
‘বারে বেজ ঝড় দেড়, বাবু।’
নাদিম অমায়িক হেসে বলল,
‘ ঝড়ে কিছু ক্ষতি হবে না বাহাদুর। ঝড়ের ভয়ে এখানে বসে থাকলেই বরং ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাবে আমার। উত্তেজনায় ঘুম হবে না। নিঃশ্বাস নিতে পারব না।’
বাহাদুর আকাশসম বিস্ময় নিয়ে দেখল, একা এক সুদর্শন যুবক রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ ঝড়ের মুখে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেল। পিঠে তার ঝুলন্ত গিটার আর কালো ব্যাগ। বুক ভরা সাহস। গন্তব্য বহুদূর। এতো সাহস কোথায় পায় সে? কোথায় পায় এতো তেজ!
অস্ট্রেলিয়ায় হাড় কাঁপানো শীত। আবহাওয়ার তাপমাত্রা -৪ এর কাছাকাছি। পথঘাট শুভ্র বরফে আচ্ছন্ন। ছোঁয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে তার খয়েরী রঙের হুডি। হাতে-পায়ে মোজা তবুও তিরতির করে কাঁপছে শরীর। সাইমের গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বরফে ডুবে থাকা ছোঁয়ার টয়েটোর পাশেই পার্ক করা হলো গাড়ি। খুব ভোরে গাড়ির হিটার অন করে, বোতল থেকে পানি ঢেলে, ওয়াইপার চালিয়ে সামনের বরফ পরিষ্কার করেছিল ছোঁয়া। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। আবারও বরফ কুঁচিতে ভরে গিয়েছে গাড়ির গ্লাস। সাইম গাড়ি থেকে নেমেই হাত নাড়ল। ছোঁয়া উত্তরে মুচকি হাসল। ঘরে ঢুকে গায়ের মোটা জ্যাকেট আর হাত মোজা খুলতে খুলতে সোফায় বসল সাইম। একটা খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ উড ইউ লাইক টু ইট গ্রিলড চিকেন, চিপস এবং গারলিক সস নাউ?’
ছোঁয়া হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে হাসি হাসি চোখে চাইল। প্যাকেটটা পাশে রেখে বলল,
‘ আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি সাইম। উড ইউ লাইক টু গো উইদ মি?’
সাইম অবাক চোখে তাকাল,
‘ বাংলাদেশ মানে? হঠাৎ বাংলাদেশে কেন? নো প্ল্যানস্, নো রিজনস্, হোয়াই ডিড ইউ মেইক দিস ডিসিশন? আমার ছুটি নেই ছোঁয়া। ইভেন তোমারও ছুটি থাকার কথা নয়।’
ছোঁয়া ভ্রু কুঁচকে চাইল। সাইমের সামনের টেবিলটাতে বসে পড়ে তার কলার ধরে কাছে টেনে আনল আচমকা। সাইম বিস্ময়ে হতবাক চোখে চেয়ে রইল। সাইমের বিস্ময় আরও কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েই মুখ খুলল ছোঁয়া,
‘ এইযে লায়ক শাকিব খান? সারাদিন অস্ট্রেলিয়ান গরুদের মতো প্ল্যানিং, রিজনস্ ক্যান খুঁজো? তুমি বাঙালী না? বাঙালীদের কোনো পরিকল্পনা ফরিকল্পনা থাকে না। তাদের কর্মকান্ড হবে হুটহাট, এটাই নিয়ম।’
সাইম বিস্ময়ে কথা খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড চোখ বড় বড় করে চেয়ে থেকে বলল,
‘ এভাবে কথা বলছ কেন তুমি? আর ইউ ওকে?’
‘ অবশ্যই ঠিক আছে? ক্যান? আমারে দেইখা রোগী রোগী মনে হইতাছে তোমার? তুমি কইতে চাও আমি রোগী?’
সাইম স্তব্ধ। সাইমের হতভম্ব চোখের দিকে চেয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল ছোঁয়া। সাইমের বিস্ময় এবার আকাশ ছুঁলো। ছোঁয়া সাধারণত শব্দ করে হাসে না। এমন উদ্ভট কথা তো কখনোই বলে না। ছোঁয়া কথা বলে মেপে মেপে। মার্জিত ভঙ্গিতে। আজ হঠাৎ কী হলো তার? সাইম উদ্বিগ্ন চোখে ডানহাতটা বাড়িয়ে ছোঁয়ার কপালের উপর রাখল। কপাল কুঁচকে বলল,
‘ তোমার কী জ্বর হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?’
ছোঁয়া সাইমের হাতটা সরিয়ে নিজের হাতে নিল। ঠোঁটভরা হাসি নিয়ে বলল,
‘ আমি ঠিক আছি। আই ওয়াজ ইঞ্জয়েনিং দিজ ল্যাঙ্গুয়েজ সাইম। আমার ফ্রেন্ডদের চিনো? ওরা এভাবে কথা বলত। ওরা আমার মতো ভিতু নয়। আমার মতো গোছালোও নয়। তবুও তারা পার্ফেক্ট? একবার নাদিম কী করেছিল জানো? হঠাৎ স্যারের সামনে পরীক্ষার খাতা ছিঁড়ে ফেলে বলে ফেলল, ধূর বাল! সময় শেষ হওয়ার আগেই খাতা টানাটানি। পরীক্ষায় দিতাম না। ফেইল দিলে ফেইল। এইসব ছাতার পাশ মার্ক আমার লাগতো না। বালের পরীক্ষা!’
এটুকু বলে আবারও খিলখিল করে হেসে ফেলল ছোঁয়া। তারপর হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনা হয়ে গেল। সাইম কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে চুপ করে বসে রইল। ছোঁয়া উঠে গিয়ে সাইমের পাশ ঘেঁষে বসল। হয়তো এই প্রথম বারের মতো ভীষণ অনুভূতি নিয়ে বাহু চেপে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। বিরবির করে বলল,
‘ আমি বাংলাদেশে যাব সাইম। আমাকে যেতেই হবে। ওরা আমার অপেক্ষায় আছে। আই উইল ম্যানেজ আনাদার জব। বাট আই কান্ট গেইট আনাদার অপরচুনিটি। আমার জীবনের সব থেকে কনফিডেন্ট ডিসিশন এটা। এই ডিসিশন নিয়ে আমার কোনো কনফিউশান নেই। একটুও না…’
সাইম অবাক চোখে চেয়ে রইল। ছোঁয়ার পূর্ণ আত্মবিশ্বাস দেখেই হয়ত ছোট্ট একটা চুমু খেল ডানহাতের পিঠে। মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ ওকে। গো এন্ড ইঞ্জয়।’
বাইরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। নম্রতা রান্নার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ তার ঝাল ঝাল খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। শাশুড়ী মা ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়েটাও ভাত ঘুমে। নম্রতার প্রেগনেন্সির পর থেকে হুটহাট বাড়ি চলে আসে আরফান। আজও এলো। নিজের ঘরে নম্রতার খোঁজ না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরে এসে উঁকি দিল। বউকে কোমরে ওড়না বেঁধে রান্না করতে দেখে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সে। হালকা একটু কেশে বলল,
‘ হ্যালো মিসেস নিম পাতা। কী চলছে?’
হঠাৎ আরফানের ডাকে চমকে তাকাল নম্রতা। ভীত মুখে বলল,
‘ দেখুন! আপনি এখন মানা করবেন না। মানা করলেও আমি শুনব না। রান্না প্রায় হয়ে গিয়েছে। সারাদিন বসে থাকতে ভালো লাগে না।’
আরফান হাসল। কেবিনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বলল,
‘ মানা কেন করব? যা মন চাই তাই করবেন। শুধু ভারী কিছু না করলেই হলো। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকলে এমনিই শরীর খারাপ করবে। মুড সুয়িংও করবে বেশি বেশি। তার থেকে একটু আধটু কাজ করুন। তবে কাজ করার সময় আশেপাশে কাউকে রাখবেন। একা একা পন্ডিতি করতে যাবেন না।’
নম্রতা মুখ কালো করে চুলোর আঁচ কমাল। আড়চোখে আরফানকে দেখে নিয়ে বলল,
‘ আম্মু ফোন দিয়েছিল। বলেছে এক দুই মাসের মধ্যে আমায় নিয়ে যাবে। ডেলিভারি হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানে….’
নম্রতার কথা শেষ না হতেই বাঁধ সাধল আরফান,
‘ অসম্ভব। আমি অনুমতি দেব না।’
‘ অনুমতি দিবেন না মানে? আমি বাবা-মার সাথে দেখা করতে যাব না?’
‘ দেখা করবেন না, তা তো বলিনি। তবে ওখানে গিয়েও থাকতে পারবেন না। এ বাড়িতে আমার সামনেই থাকতে হবে। এ ব্যাপারে আর একটা কথাও নয়।’
নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ আমি যাবই। কেন শুনব আপনার কথা? আমার উপহার কই? দুই সপ্তাহ হয়ে যাচ্ছে অথচ উপহারের খোঁজ নেই। নিশ্চয় ভুলে বসে আছেন?’
আরফান কেবিনেট থেকে নেমে ফ্রিজ খুলল। পানির বোতল বের করতে করতে বলল,
‘ ভুলিনি। আর চারদিন পর পাবেন। আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকির সকাল বেলায়।’
নম্রতা চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ এক উপহারে তিন অকেশন পাড় করে দিতে চাইছেন? এতো কিপ্টা আপনি? এইজন্য ডাক্তার বিয়ে করতে চাইনি। আম্মু ঠিকই বলেছিল। ডাক্তাররা এতো কিপ্টা!’
আরফান হাসল। পানির বোতলটা পাশে রেখে নম্রতার পেছনে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। খাবারের ঢাকনা খুলতে খুলতে ফিসফিস করে বলল,
‘ বিয়ের রাতের উপহার বিয়ের দিন ছাড়া তো দেওয়া যায় না নম্রতা। আর আফসোস করেই বা কী হবে? ডাক্তার বিয়ে করে জুনিয়র ডাক্তারের ঘন্টীও তো বাজিয়ে ফেলেছেন। এখন এসব আফসোস টাফসোস বাদ দিয়ে কাজ করুন। স্বামীকে খাইয়ে দিয়ে স্বামীসেবা করুন। খাবারটা লোভনীয় দেখাচ্ছে।’
নম্রতা মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘ যে পুরুষ একটা চিরকুট লিখতে তিন সপ্তাহ লাগায় তাকে আমি খাইয়ে দিই না।’
আরফান হাসছে। হাসিমুখেই বলল,
‘ দিবেন না মানে? দিতে বাধ্য। আমি জোর করে পেতে জানি, মহারাণী নিম পাতা।’
তখন মাঝরাত। অভিমানী কিশোরীর মতোই মুখ ভার করে রেখেছে আষাঢ়ে আকাশ। চাঁদ তারাহীন আকাশের নিচে শীতলপাটিতে শুয়ে আছে একজোড়া মানব-মানবী।ঝিরিঝিরি ঠান্ডা বাতাসে উড়ছে মানবীর এলো চুল। ছড়িয়ে রাখা শাড়ির আঁচল। ছাদের পাটাতনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভেজা বেলী ফুল। বারান্দায় জ্বালিয়ে রাখা হারিকেনের আলো এসে পড়ছে শীতলপাটির একাংশে। মৃদু হলদে আলোয় কী ভীষণ মায়াবী দেখাচ্ছে প্রিয়তমার মুখ। আরফান এক হাতে ভর করে নির্ণিমেষ চেয়ে আছে নম্রতার চোখে। নিকষ অন্ধকারেও খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রিয়তমার অপ্রকাশিত, সুপ্ত সৌন্দর্য। নম্রতা আকাশের কী চেয়ে ছিল। আরফানকে স্থির চেয়ে থাকতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। আকাশে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। নম্রতা চমকে গিয়ে চোখ কুঁচকে বন্ধ করে আবারও পিটপিট করে তাকাল। ঠোঁট ভর্তি হাসি নিয়ে বলল,
‘ কী দেখছেন?’
আরফান উত্তর দেওয়ার আগেই ঝুম বৃষ্টি নামল ছাদে। নম্রতার হাসি বিস্তৃত হলো। দুই বাহু দু’পাশে মেলে দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। তাকানো যাচ্ছে না। বৃষ্টির তোড়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে চোখের পাতা। শীতলপাটিটা ডুবে যাচ্ছে ঠান্ডা শীতল জলে। ভাসমান বেলীগুলো তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে আষাঢ়ে হাওয়ায়। কিছুক্ষণের মাঝেই পানি জমল ছাদে। নম্রতার ছড়িয়ে রাখা লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে সাঁতারে নামল। আরফান নম্রতার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ডানহাত বাড়িয়ে হাতটা রাখল নম্রতার চোখের ওপর। নম্রতা এবার চোখ পিটপিট করে তাকাল। শীতে কাঁপতে কাঁপতেই খিলখিল করে হাসল। আরফান কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আজকের এই দিনটিতেই প্রথম চিঠি পেয়েছিলাম আমি। আজকের এই দিনটিতেই হাত ভর্তি খুশি নিয়ে আমার নামে বধূ সেজেছিলে তুমি। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় খুশি হওয়ার জন্য ধন্যবাদ মহারাণী। মহারাণীকে বিবাহ বার্ষিকির প্রথম প্রহরের শুভেচ্ছা।’
নম্রতা থমকে গেল। চোখ ফিরিয়ে অন্ধকারে ঢাকা আবছা চেহারাটির দিকে তাকাল। আজকেই প্রথম চিঠি পেয়েছিল আরফান? তার এখনও মনে আছে? কই? নম্রতার তো চিঠি দেওয়ার দিনক্ষণ খেয়াল নেই। আরফান কী করে খেয়াল রাখল?ঠিক ঠিক সেই দিনে গিয়েই বিয়ের তারিখ ঠিক করাল। বিয়েও হলো সেই একই দিনে। এই অসাধারণ কথাটা এতোদিন কেন প্রকাশ করেনি আরফান? আজ বলে চমকে দিবে বলে? নম্রতার ধারণা আরফানের কাছে চমক ঝুলি আছে। হঠাৎ হঠাৎ অপ্রত্যাশিত কিছু করে চমকে দেওয়ার অসাধারণ এক ক্ষমতা আছে তার সারা শরীরজুড়ে। নম্রতার বৃষ্টিস্নান মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল আরফান। ঝুম বৃষ্টির রাত্রিবেলা ভীষণ আবেশে দীর্ঘ এক চুমু খেল নম্রতার বৃষ্টিভেজা ওষ্ঠে। আষাঢ়ে আকাশ বুঝি লজ্জা পেল? নাকি আকাশ জুড়ে তীক্ষ্ণ আলো আর বিকট শব্দ ছড়িয়ে ফ্রেমবন্দী করল সেই আষাঢ়ে চুমু?
ঘুমের মাঝেই কানে সুড়সুড়ি টের পেলো নম্রতা। প্রথম দফায় চোখ বোজেই কান চুলকাল সে। দ্বিতীয়বারও একই কান্ড ঘটায় চোখ পিটপিট করে তাকাল। মুখের উপর ফর্মাল পোশাক পরা আরফানকে ঝুঁকে থাকতে দেখে পাশ ফিরতে ফিরতে বিরক্ত কন্ঠে বলল,
‘ জ্বালাচ্ছেন কেন ডক্টর?’
আরফান মৃদু হেসে বলল,
‘ ডাক্তার যে তাই। অনেক ঘুমিয়েছেন এখন উঠুন। আমি হসপিটালে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে প্রেশার চেইক করব। খাওয়া দাওয়া শেষে আদা চা খাবেন। টেবিলের উপর পানির জার রাখা আছে। আধ ঘন্টা পর পর পানি খাবেন। আজ গোসলের প্রয়োজন নেই। কাল বৃষ্টিতে ভিজেছেন। জ্বর হতে পারে। আপনার কিন্তু মেডিসিন নেওয়া এলাউ নয়। জ্বর জ্বর ফিল হলে আমায় জানাবেন।’
নম্রতা কম্বলে চোখমুখ ডেকে বলল,
‘ উফ! ডাক্তার বর হলে এই এক সমস্যা। সব সময় ডাক্তারি শুরু করে দেন। বাসায় এসব ডাক্তারী ফাক্তারী চলবে না ডক্টর। আমাকে ঘুমুতে দিন। আমি ঘুমোব।’
আরফান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ আচ্ছা। আপনি তবে ঘুমুতেই থাকুন। আপনার উপহারটা তাহলে ক্যান্সেল।’
নম্রতা লাফিয়ে উঠে বসল। আরফান হাত ভাঁজ করে ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে। নম্রতা চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে বলল,
‘ আমার উপহার কোথায়?’
আরফান চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ উপহার ক্যান্সেল।’
নম্রতা আর্তনাদ করে বলল,
‘ মানে কী?’
আরফান হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে বলল,
‘ বাচ্চাদের মতো জেদ ধরার পানিশমেন্ট।’
নম্রতার মন খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে বসে থেকে ব্যাপারটা যাচাই করার জন্য দৌঁড়ে গেল বারান্দায়। ডাকবাক্স তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো চিঠি পাওয়া গেল না। বারান্দায় থাকা ফুলের টব। ডাকবাক্সে পেছন সব জায়গায় খুঁজে নিয়ে হতাশ হয়ে বসে পড়ল দোলনায়। আরফান তবে সত্যিই উপহারটা রেখে যায়নি? নম্রতার মন খারাপ ভাব তরতর করে বাড়তে লাগল। ঠিক সেই সময় বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়াল যুবতী কাজের মেয়েটা। নম্রতার দিকে বাদামী এক খাম এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ছোট ভাবী? আপনার নামে চিঠি আসছে।’
নম্রতা ভ্রু কুঁচকে চিঠির দিকে তাকাল। এই বাড়িতে শুরু থেকেই কনিষ্ঠ পুত্রবধূর দৃষ্টিতে দেখা হয় তাকে। কোনো অনুষ্ঠান বা উৎসবে পুত্রবধূর উপহার হিসেবে বরাবরই একই রকম দুটো উপহার কেনা হয়। একটি নম্রতাকে দিয়ে অপরটি পাঠানো হয় যশোরে থাকা স্নিগ্ধার কাছে। প্রথমে ব্যাপারটি বুঝতে না পারলেও পরে বুঝেছে। নেহালের মৃত্যুর পর জোর করেও বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যায়নি স্নিগ্ধাকে। নিজেকে নেহালের নামের সাথে জড়িয়ে রাখতেই সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে স্নিগ্ধা। ছোট্ট একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে যশোরের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে একা এক সংসার গড়ে তুলেছে সে। যশোর কলেজে অধ্যাপনা আর ছোট্ট বাচ্চার ব্যস্ততা নিয়েই পাড় করে দিচ্ছে অসহনীয় রাত-দিন, চব্বিশ ঘন্টা। নম্রতা হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ এটা কী তোমার নিষ্প্রভ ভাইয়া দিয়েছে?’
যুবতী মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল,
‘ না ছোটভাবী। চিঠি তো পিয়নে দিয়া গেল সকালে।’
নম্রতা অবাক হলো। সত্যি সত্যি পিয়ন দিয়ে গেল চিঠি? কী আশ্চর্য! নম্রতাকে কে পাঠাবে চিঠি? নম্রতা যুবতী মেয়েটিকে যেতে বলে কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রইল খামে। রেজিস্ট্রি করা চিঠি। প্রেরকের নাম ঠিকানা নেই। নম্রতা দম আটকে খাম খুলল। ভেতর থেকে নীল চিরকুট নামে খামটা বেরিয়ে আসতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল নম্রতার। মনটা খুশিতে নেচে উঠল হঠাৎ। নিশ্চয় সেই উপহারটাই পাঠিয়েছে আরফান? কিন্তু ডাকবাক্সে না রেখে এভাবে পাঠাল কেন? হাজারও প্রশ্ন নিয়ে নীল রঙা খামটা খুলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল নম্রতা। ছয় বন্ধুর ফ্রেমেবন্ধী ঝলমলে ছবি আর ছোট্ট চিরকুট দেখে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল নম্রতার। কী করবে, কী হচ্ছে কিছু বুঝতে না পেরে চিঠি কোলে স্থির বসে রইল কিছুক্ষণ। ছবির পিঠে গামে আটকানো আরেকটি চিঠি পেয়ে ভ্রু বাঁকাল নম্রতা। নীল কাগজের মাঝ বরাবর মাঝারি আকারের চিঠি।
‘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে একটি হলো আনন্দাশ্রু। আপনি কী চিঠিটা পেয়ে আনন্দে হাউমাউ করে কাঁদবেন নম্রতা? যখন জানবেন আপনার খুব প্রিয় মানুষগুলো টিএসসির পুরনো সেই চা স্টলটাতেই দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে। অপেক্ষার প্রহরগুলোতে আপনাকেই খুঁজছে, আপনাকেই ভাবছে তবে কী ভীষণ আনন্দে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বেন আপনি? এই চিরকুটটাকে হাসি-আনন্দের চিরকুট বলে স্বীকৃতি দিবেন?’
নম্রতা শক্ত হয়ে বসে রইল। এসবের মানে কী? বন্ধুরা টিএসসিতে অপেক্ষা করছে মানে? নাদিম,রঞ্জন, নীরা ওরা সত্যিই এসেছে? এসব আদৌ সম্ভব? নম্রতার মস্তিষ্ক বিশ্বাস করতে না চাইলেও কোমল মনটা যেন থরথর করে কাঁপছে। সেই সাথে কাঁপছে গোটা শরীর। নম্রতা এক ছুটে নিজের ঘরে গেল। আরফানের নাম্বারে ডায়াল করতেই উত্তেজনায় ধুকপুক করতে লাগল বুক। আরফান ফোন ধরেই বলল,
‘ বাসার বাইরে রিকশা অপেক্ষা করছে নম্রতা। আর টিএসসিতে বন্ধুরা। জলদি করুন নাকি উপহারটা পছন্দ হচ্ছে না?’
নম্রতা বিস্ময়ে এক হাতে মুখ চেপে ধরল। টলমলে জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। উত্তেজনায় আটকে গেল কথা। বহু কসরত করে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ ওরা ওরা সত্যি?’
আরফান হেসে ফেলল এবার। স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল,
‘ ভালোবাসি নম্রতা। আগে কখনও বলা হয়নি বোধহয়। আজ বলছি, ভালোবাসি ভালোবাসি।’
নম্রতা ডুকরে কেঁদে উঠল এবার। আরফান হাসছে। নম্রতা হাউমাউ কান্নায় ভেঙে পড়ে রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আমি আপনাকে একদম ভালোবাসি না ডক্টর। একদম না।’
নম্রতার হাউমাউ কান্নায় দু’তলা থেকে ছুটে এলেন শাশুড়ী মা। বিস্ময় আর উদ্বেগ নিয়ে বললেন,
‘ কাঁদছ কেন মা? মুড সুয়িং হচ্ছে? শরীর খারাপ লাগছে? বাবাকে মনে পড়ছে আম্মু?’
নম্রতা ফোনটা বিছানায় ফেলে দুই হাতে মুখ ডেকে ফুপিয়ে উঠল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ তোমার ছেলেকে আমি একদম ভালোবাসি না মা।’
ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা ধরতে না পেরে অবাক হয়ে চাইলেন। বিছানা থেকে ফোনটা তুলে নিয়ে লাউডস্পিকার দিতেই ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো কানে। আরফান হাসছে। ভদ্রমহিলা গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ কী ব্যাপার নিষ্প্রভ?’
‘ তোমার বউমাকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি মা।’
ছেলের কথায় হেসে ফেললেন ভদ্রমহিলা। ফোনটা নম্রতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওপাশ থেকে উচ্ছল ভরাট কন্ঠে বলে উঠল,
‘ ভালোবাসি। ভালোবাসি নিম পাতা। নীল চিরকুটের থেকে বেশি, শ্যামলতার থেকে একটু কম।’
ভরা দুপুর। সূর্যের উত্তাপ নেই। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় এখানে সেখানে কাঁদামাখা জল। নাদিম চিরপরিচিত চায়ের স্টলে বসে আছে। গায়ে চেইক শার্ট। কোলের উপর রাখা গিটার। নাদিম আগ্রহ নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আজ তিন বছর পর ঢাকায় ফিরেছে সে। চিরপরিচিত জায়গাটা আজও একই রকম। কোনো পরিবর্তন নেই। পরিবর্তন থাকলেও সেই সূক্ষ্ম পরিবর্তনটা নাদিম ধরতে পারছে না। নাদিম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই রাস্তার বাঁকে চিরচেনা একজনকে চোখে পড়ল হঠাৎ। নাদিম চায়ে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেল। চায়ের কাপ মুখের কাছে নিয়েই স্থির চেয়ে রইল রাস্তার বাঁকে। চেহারাটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো। সামনের মানুষটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে পড়ল নাদিমও। দু’জনের ঠোঁটই বিস্তৃত হলো ধীরে ধীরে। তারপর…. তারপর ছুটন্ত ঘোড়ার মতোই ছুটে এলো দুজনে। কয়েক সেকেন্ডের সেই আলিঙ্গনেই গুচে গেল বছর তিনেকের দূরত্ব। প্রতিদিনই দেখা হচ্ছে এমন ভাব নিয়ে মুখ ছুটল তাদের,
‘ এক ঘন্টা ধইরা অপেক্ষা করতাছি বাল। এতো দেরী করলি ক্যান? রাস্তায় কোনো সুন্দরী মাইয়া দেইখ্যা আটকায় পড়ছিলি নাকি মামা?এখনও ভালো হইতে পারলি না? আফসোস!’
রঞ্জন হেসে ফেলল। নাদিমের পিঠে শক্ত কিল বসিয়ে বলল,
‘ নিজের গুণ আমার উপর ঝাড়ছিস? এক ঘন্টা যাবৎ এখানে এমনি বসে বসে মশা মারতেছিলা তুমি? বললি আর বিশ্বাস করলাম? তোকে আমি খুব ভালো করে চিনি। গত এক ঘন্টায় এই রাস্তা দিয়ে কয়টা মেয়ে গিয়েছে তা সিসিটিভি ফুটেজ থেকেও ভালো বলতে পারবি তুই। কোনোটা পছন্দ হয়েছে মামা?’
নাদিম উত্তর দেওয়ার আগেই অন্তুর বাইক এসে থামল পাশে। বাইক থামিয়ে এক রকম লাফিয়ে নেমে পড়ল অন্তু। নাদিম রঞ্জনও যেন একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সবার মুখেই উপচে পড়া হাসি। অযথায় হাসছে তার। সবার শরীরেই কম্পীয়মান উত্তেজনা। অন্তুকে ছেড়ে নীরার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল নাদিম। নীরার বেণী করে রাখা চুল টেনে দিয়ে বলল,
‘ কয় প্যাকেট আটা ময়দা লাগাইছিস সত্যি কইরা ক তো ভতী। ময়দার যন্ত্রণায় তোরে তো দেখা যাইতাছে না রে।’
নীরা চোখ গরম করে তাকাল। অন্তু নীরার মাথায় একটা চাটি মেরে বলল,
‘ কমপক্ষে তিন-চার ব্যাগ তো লাগাইছেই। জামাইয়ের টাকা ধ্বংস করে ফেললি ফাজিল মাইয়া।’
অন্তুর কথায় হুহা করে হেসে উঠল সবাই। নীরা কোমরে হাত রেখে চোখ-নাক ফুলিয়ে তাকাল। রঞ্জন নীরাকে এক হাতে আলতো জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ বেচারীকে সহজ-সরল পেয়ে এভাবে জ্বালাচ্ছিস কেন তোরা? নাহয় দুই তিন ব্যাগ লাগিয়েছেই। দশ, পনেরো তো আর ক্রস করেনি? নীরু তুই এদের কথায় কান দিস না তো। নিশ্চিন্তে আটা ময়দা লাগিয়ে যা। সমস্যা নেই।’
নীরা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘ রঞ্জন তুইও?’
অন্তু, নাদিম হাসিতে গড়াগড়ি খেলো এবার। নীরা একে একে তিনজনের দিকেই রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। কিন্তু লাভ বিশেষ হচ্ছে না। বন্ধুরা তার রাগকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। বন্ধুদের হাসি মজার মাঝেই নম্রতা এসে পৌঁছাল। বন্ধুদের একসাথে দেখে রিকশা থেকে নেমেই এক হাতে মুখ চেপে চেঁচিয়ে উঠল সে। নম্রতাকে দেখেই চোখ টলমল করে উঠল নীরার। নম্রতা সেখানেই মুখ চেপে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। নীরা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই দু’জনেই ডুকরে কেঁদে উঠল একই তালে। এতো আনন্দ! এতো আনন্দ! এতো আনন্দ কান্না ছাড়া আর কী করে প্রকাশ করা যায়? নম্রতা রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ হারামি! তুই এখনও আমারে সরি বলছ নাই। বেয়াইন হওয়ার চিন্তা বাদ দে। আমি তোরে মেয়ে টেয়ে দিব না।’
নীরা কাঁদতে কাঁদতেই হেসে ফেলল। রঞ্জন, নাদিম, অন্তুও এগিয়ে এলো এবার। রঞ্জন মন খারাপ ভাব নিয়ে বলল,
‘ কলিজা? তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে এই মহিলার জন্য কেঁদে ভাসিয়ে ফেলছ। এটা তো ঠিক না। আমি কষ্ট পেয়েছি।’
তৎক্ষনাৎ হেসে ফেলল নম্রতা। রঞ্জনের পেটে শক্ত ঘুষি দিয়ে বলল,
‘ এ্যাহ! এখন কলিজা? যাহ্ ফুট!’
রঞ্জন পেট চেপে ধরে বলল,
‘ আরফান ভাই কী তোরে লোহা টোহা খাওয়ায় নাকি নমু? এক ঘুষিতে কলিজা বের করে ফেলেছিস অত্যাচারী মহিলা।’
এবার দৃশ্যপটে এলো নীল রঙা অত্যাধুনিক এক টয়েটো গাড়ি। আশেপাশে কাঁদা ছিটিয়ে রাস্তা ঘেঁষে দাঁড়াল। ড্রাইভার ছুটে এসে দরজাটা খুলে দিতেই বেরিয়ে এলো ছোঁয়া। গায়ে তার জিন্স আর নীল রঙা কূর্তি। গাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের দিকে চেয়ে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়াল সে। বন্ধুরা ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে আছে। সবার ঠোঁটেই হাসি। ছোঁয়া ধীরেস্থিরে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বিস্তৃত হাসল নাদিম। ঘাড় কাঁধ করে বলল,
‘ চেনা চেনা লাগে। এটা আমাদের ইংরেজ বলদ না?’
ছোঁয়া হাসল। নাদিম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ আয়, আয়।’
ছোঁয়া নাদিমের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আচমকাই ফুঁপিয়ে উঠল। তারপর ঢলে পড়ল নাদিমের বুকে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
‘ আই মিসড ইউ সো মাচ।’
হতবাক নাদিম চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ মিস করছিস ভালা কথা। কিন্তু কাইন্দা কাইট্টা আমার শার্ট নষ্ট করার মানে কী? বিয়ার দিনও তুই আমার পাঞ্জাবি নষ্ট করছিস হারামি। এই দূরে যাইয়া খাড়া। হাড় মাংস দলা পাকায় গেল ইংরেজের বাচ্চা।’
ছোঁয়া রাগান্বিত চোখে চেয়ে সরে দাঁড়াল। রাগ নিয়ে বলল,
‘ মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ। তোর কথার প্যাটার্ন শুনলে যে কারো বমি পেয়ে যাবে।’
নাদিম ডোন্ট কেয়ার নিয়ে বলল,
‘ তো তুই হুনছ কেন? কান বন্ধ কইরা রাখ। ইংরেজ বলদ গো কানের প্রয়োজন নাই। এরা কান থাকলেও বলদ, না থাকলেও বলদ।’
তখন বিকেল। সারাদিন ভার্সিটিজুড়ে হৈ-হুল্লোড় করে আগের মতো সিএনজি ধরে রমনা পার্কে গিয়ে বসল তারা। লেকের পারে শান বাঁধানো বেঞ্চে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে নাদিম। আজও বেঞ্চ ভেজা। অন্তু আর রঞ্জন কাগজ জোগাড় করে তার উপর বসে আছে। বাকিরা এখানে ওখানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। সবার হাতেই বাদামের ঠোঙা। অন্তু ভীষণ আয়েশ করে বাদাম চিবোতে চিবোতে বলল,
‘ মৌশির কোনো খবর জানিস নাদিম?’
নাদিম খোসাসহ বাদাম হাওয়ায় ছুঁড়ে মেরে মুখ দিয়ে লুফে নিতে নিতে বলল,
‘ আমার জানার কথা নাকি?’
অন্তু অবাক হয়ে বলল,
‘ একসময় তোর হাফ প্রেমিকা ছিল। তো জানার কথা না? তুই চাইলে আমি খবর নিয়ে দিতে পারি। কী খাওয়াবি বল?’
‘ আমার টেহা বেশি হয় নাই। সুখে থাকতে ভূতে কিলাই? ওরে দিয়া আমি করমুডা কী?’
‘ কী করবি মানে? বিয়ে করবি। বিয়ে না করলে প্রেম করবি। তারপর যা করা লাগে তাই করবি। মেয়েটা ভীষণ পছন্দ করত তোকে। আমি ড্যাম শিওর এখনও প্রচন্ড পছন্দ করে তোকে।
নাদিম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল,
‘ গুড। আমাকে প্রচন্ড পছন্দ করার জন্য তাকে ধন্যবাদ। এখন এসব আজাইরা পেঁচাল বন্ধ কর।’
অন্তু হতাশ কন্ঠে বলল,
‘ অন্যের অনুভূতির গুরুত্ব দিতে শিখলি না। মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী ছিল।’
নাদিম বাদাম খাওয়ায় মনোযোগী হয়ে বলল,
‘ তোর এতো রঙ লাগলে তুই নে গা। আমার রঙ লাগে নাই। আমার ওরে দরকারও নাই।’
অন্তু দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলল,
‘ রঙ তো লেগেছিলোই বন্ধু। কিন্তু তুমি তো পাত্তা দিলা না। আমার একমাত্র প্রেমটা নির্দয়ের মতো বানচাল করে দিছিস তুই। তোর বোন….’
এটুকু বলতেই শক্ত এক কিল পড়ল অন্তুর পিঠে। নাদিম দ্বিতীয় লাথিটা দিয়ে বলল,
‘ শালা তুই আসলেই চরিত্রহীন। বউ রাইখা অন্য মাইয়া গো দিকে নজর দিস।’
নীরা কুটিল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
‘ আরও একটা দে। বেয়াদব পুরুষ মানুষ।’
অন্তু পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘ নীরুর বাচ্চা! তোরে যদি আমি আছাড় না মারছি তবে আমার নাম অন্তু না।’
নাদিম বাদামের ঠোঙাটা ছুড়ে ফেলে গিটার তুলল হাতে। টুংটাং সুর বাজল গিটারের তারে তারে। বন্ধুদের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল স্মৃতিময় বিকেল। কন্ঠে কন্ঠে গেয়ে উঠল বহু পুরোনো এক গান,
‘ আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে
মনে পড়লো তোমায়
অশ্রু ভরা দুটি চোখ
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ….’
[ পুনশ্চঃ রাউন্ড শেষ করে সন্ধ্যার কিছু আগে চেম্বারে ফিরল আরফান। পাঁচটা থেকে রোগী দেখার সময়। প্রথম রোগী চেম্বার ঢুকার পাঁচ মিনিট পরই দরজায় টোকা দিল সাঈদ। ভীষণ বিনয়ী কন্ঠে বলল,
‘ আপনার নামে একটা পার্সেল আসছে স্যার।’
আরফান অবাক হয়ে তাকাল। পার্সেল মানে? তার কাছে তো কোনো পার্সেল আসার কথা না। আর আসলেই বা হাসপাতালের ঠিকানায় কে পাঠাবে পার্সেল? আরফান ইশারায় পার্সেলটা টেবিলের উপর রাখতে বলল। সাইজ দেখে বুঝা যাচ্ছে বেশ ভারী একটি পার্সেল। আরফান রোগীর কথায় মনোযোগী হতে পারছে না। চোখ দুটো বারবার পার্সেলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। মাথায় ঘুরছে একটায় প্রশ্ন , কী আছে পার্সেলে? কে পাঠাল? রোগীকে প্রেসক্রাইভ করেই প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে পার্সেল খুলল আরফান। পার্সেল খুলেই প্রচন্ড ধাক্কায় হতভম্ব হয়ে গেল সে। পার্সেলের ভিতর একটা বই। যেনতেন কোনো বই নয়। গ্রন্থাগারের সেই স্মৃতিজড়িত দর্শনের বই। আরফান বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল দর্শনের সেই বইয়ে। অভ্যাস বশত বইয়ের মলাটের নিচে হাত দিতেই বেরিয়ে এলো ছোট্ট এক নীল চিরকুট।
” কিশোরী বয়সে প্রথম চিরকুটের সাক্ষী হয়েছিল এই বই। নিজ দায়িত্বে মুড়িয়ে নিয়েছিল নীল চিরকুটের শত গোপন, নির্লজ্জ কথা। আজ বইটিকে আবারও সেই দায়িত্ব ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমার জীবন্ত চিরকুটটাকে আমার নির্লজ্জা আবদারে মুড়িয়ে নিয়ে পুরো পৃথিবী থেকে ঢেকে রাখার দায়িত্ব দিচ্ছি।
নীল চিরকুট পর্ব ৬৯+৭০
আমার জীবন্ত নীল চিরকুট হওয়ার জন্য ধন্যবাদ ডাক্তার সাহেব। কিশোরী বয়সে আমার হয়েছিলন, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত নীল চিরকুট হয়েই থাকবেন প্লিজ। আমি কিন্তু আপনাকে ভালো টালো বাসি না। একটুও না। শুধুমাত্র জীবন্ত নীল চিরকুটটাকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারি না। দমবন্ধ লাগে। মৃত্যু অবধারিত মনে হয়, এই যা!
ইতি
নীল চিরকুটের শ্যামলতা ”
