স্নিগ্ধবিষ পর্ব ২০
সানজিদা আক্তার মুন্নী
শিকদার বাড়ির বিবিজানের ঘরে সোফায় বসে আছে ধ্রুব। তার অপজিটে বসে আছেন তার বড় ফুফু আর উনার মেয়ে। উনাদের সাথে বসে আছেন বিবিজান। এখানে ধ্রুবর বিয়ের কথা চলতেছে। হঠাৎ বিবিজান ঠিক করছেন, ধ্রুবর সাথে বিয়ে দিবেন উনার বড় মেয়ে, মানে তৌসিরের বড় ফুফু সুলতানার একমাত্র মেয়ে ইকরার। গতকালই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর আজ ইকরা আর তার মাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইকরা আর তার মা এসেছেন। এখন উনাদের আর ধ্রুবকে নিয়েই বিয়ের মত নেওয়ার পালা চলছে। পরে বাড়ির সবাইকে নিয়ে বসবেন। ইকরার মা ওত বেশি আসা-যাওয়া করেন না প্রয়োজন ব্যতীত।
ইকরা, পুরো নাম ইকরা মারজান। বাবা সাজাদ মারজান। ইকরার বয়স একুশ, ভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু তার প্রফেশন হলো বাবার বিজনেস সামলানো। বাবা অসুস্থ হওয়ায় আর একমাত্র সন্তান হওয়ায়, নিজের বাবার সবকিছু লোভী আত্মীয়দের হাত থেকে বাঁচাতে নিজেই এই এতটুকু বয়সে বিগত ছ’মাস ধরে পড়ে আছে বিজনেস নিয়ে। অবশ্য এ নিয়ে তার আগ্রহও আছে বটে। তো যাই হোক, বর্তমানে আসি।
ধ্রুবর বয়স ছাব্বিশ। ইকরা ধ্রুবর ছোট, তাই বিবিজান সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ধ্রুব আর ইকরাকে বিয়ে পড়িয়ে দিবেন। ধ্রুবর বিয়েটা হয়ে গেলেই রুদ্র, নাযেম চাচা আর মিনহাজ মামাকে ধরে বেঁধে বিয়ে করাবেন। ধ্রুব বসে আছে দাঁতে দাঁত চেপে ফ্লোরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সে জানত না, তাকে বিয়ের কথাবার্তা বলার জন্য বিবিজান এখানে এনেছেন। সে বিয়ে করবে না। ইকরাকে জীবনেও বিয়ে করবে না।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে তাকে বিবিজান জিজ্ঞেস করেন, “তুই কি বিয়াতে রাজি?”
ধ্রুব বিবিজানের কথায় কিড়মিড় খেয়ে রাগ কন্ট্রোল করে চোখ তুলে ইকরার দিকে তাকায়। তারপর সোজা উঠে দাঁড়িয়ে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় উত্তর দেয়, “আমি রাজি মানে? তুমি কি ফাইজলামি করতেছো, বিবিজান? এটা আমার জীবন, ছেলেখেলা নয়। আমি ওর মতো একটা উগ্র, কিলার টাইপ মেয়েকে কোন দুঃখে বিয়ে করতে যাব?”
বিবিজান ধ্রুবের কথার জবাবে কিছু বলবেন, তার আগেই সবার মাঝখান থেকে ইকরা সোফা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলে, “হোয়াট দ্য ফাকিং কথাবার্তা! আবে শালা সাণ্ডা, তোর যখন এই কিলারকে বিয়ে করার ইচ্ছে নাই, তো আগে বলবি না? এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে রাখছিলি ক্যান? সুদানি**র নাতি, আমার এতটা টাইম খাইলি।”
ইকরার কথা শুনে ধ্রুবের রাগ চরমমাত্রায় পৌঁছায়। ঠিক এ কারণেই ধ্রুব রাজি নয় বিয়েতে। এমন বেয়াদবকে কেই বা বিয়ে করে ঠেকতে যাবে? ধ্রুব বিবিজানকে দেখিয়ে বলে, “দেখো, দেখো, ও আমাকে তুই করে বলতেছে। প্লাস কী অসভ্যের মতো কথা বলতেছে! ওকে বিয়ে করব আমি? এ কাকে বিয়ে করব আমি?”
বিবিজান এবার ধমকে ওঠেন, “এই, চুপ কর তোরা দুইটা। বস নিজ নিজ জায়গায়।”
বিবিজানের ধমক খেয়ে দুজনেই আবার বসে যায় নিজ নিজ জায়গায়। বিবিজান সুলতানাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোর মাইয়ারে ক একটু মাইয়াগো মতো আচরণ করতে। এই ব্যাটাদের মতো কথা কয় ক্যান?”
সুলতানা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে হালকা কঠিন গলায় বলেন, “ওকে বুঝাতে বুঝাতে ওর বয়স আজ কুড়ির ঊর্ধ্বে। তারপরও বুঝে না। আর বিয়েটা তো স্বার্থেই দিচ্ছো, যাতে আমাদের কোম্পানির সাথে কোলাবোরেশন করতে পারো। তাহলে এত ফর্মালিটির কী, আম্মা?”
ইকরা বিবিজানের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে, “দেখো নানিজান, তোমার এই আছুদা বাইনচুদ নাতিরে বিয়া করার শখ আমার নাই। আমি এখানে আইছি শুধু তোমার কথা রাখার জন্য। এখন বলো কী সিদ্ধান্ত।”
বিবিজান উত্তরে কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে বলে ওঠেন, “এই বিয়ে হবে। আমি ধ্রুবের বাপের লগে কথা কইয়া বিকালে ডেট ফাইনাল করতাছি।”
ইকরা এতে উচ্চ স্বরে বলে ওঠে, “আলহামদুলিল্লাহ! যাক, ডিল বৃথা গেল না।”
ধ্রুব স্থবির হয়ে বসে থাকে। বিবিজান ওর জীবনে এমন বিপদ ঢুকিয়ে দিবেন, তা কোনোদিন স্বপ্নেও কল্পনা করেনি ধ্রুব। ধ্রুব চিৎকার করে বলে ওঠে, “এই বিয়ে আমি করব না! আমি এই অসভ্য, বেতমিজকে নিজের বউ মানব না!”
বিবিজান ধ্রুবকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন, তার আগেই ইকরা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “আবে ছালা সাণ্ডা, চুপ কর! আসার পর থেকে তোর এই প্যানপ্যান শুনতেছি। আমার মতো এমন চারদিক দিয়া সুন্দরী পাইবা? দুইটা? ম্যায় হুঁ হুস্ন কি রানী, ভুলে যাইস না।”
ধ্রুব প্রত্যুত্তরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোর মতো বেহায়া, বেয়াদব মহিলা বিয়ে করার চেয়ে সারাজীবন কুমার থাকাই উত্তম!”
বিবিজান ধ্রুবকে ঠান্ডা গলায় বলেন, “তোদের বিয়ে হচ্ছে, এটাই ফাইনাল। এবার তোরা যা বুঝার, একান্তে বুঝ। সুলতানা, আয় আমার লগে।”
বিবিজান এ বলে সুলতানাকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় রুমের দরজাটা বন্ধ করে যান। ধ্রুব ইকরার অপজিট সোফায় বসা। ধ্রুব ইকরার দিকে কটমট চোখে চেয়ে বলে, “ইকরা, প্লিজ তুই আমারে ছাইড়া দে, বইন। মাফ চাই তোর কাছে। আমি গরিব মানুষ। আমি টাকা-পয়সা ইনকাম করি না। ছোট একটা জব করে নিজের খরচ চালাই।”
ইকরা এ শুনে মুচকি হেসে চারপাশে তাকায়, তারপর বলে, “আরে ধ্রুব ভাই, চিন্তা কিসের? তোমার বউয়ের টাকার অভাব আছে নাকি? আমি সমাজের চিত্র পাল্টে দিমু। এতদিন বউকে মানুষ আর্ন করে খাওয়াত, কিন্তু এখন আমি তোমায় আর্ন করে খাওয়াব। হবে? আর আমার একটা কোম্পানির ওনার তো তোমায় দিতেই পারি। তা পারবে সিইও হয়ে তা সামলাতে?”
ধ্রুব উঠে এসে ইকরার সামনে হাত জোড় করে ওর পাশে সোফায় বসতে বসতে মিনতি করে, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বইন রে, আমার কিচ্ছু লাগব না। তুই শুধু আমার ঘাড়ে উঠিস না।”
ইকরা উঠে দাঁড়ায়। সোফার মাঝখানে কাচের টেবিলে রাখা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কালো গ্লাসটা চোখে পরতে পরতে ধ্রুবকে টাশ করে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, “হালা ষণ্ডা, এমনে কান্দিস না। আমি তোর ঘাড়েই উঠমু।”
এ বলে ইকরা বেরিয়ে যায় রুম থেকে। আর ধ্রুব হতবাক হয়ে বসে থাকে। কী হলো? ওকে মারলো? তারমানে বিয়ের পর ওকে বউয়ের হাতে মার খেতে হবে! না, না, এটা হতে পারে না! ধ্রুব কষ্টে মাটিতে পড়ে বাচ্চাদের মতো গড়াগড়ি খেতে থাকে আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি বিয়ে করব না! এই জিনিসকে ঘরে তুললে ঘর সহ ডুইবা মরতে হইবো !”
নাজহা আলতো পায়ে রুমে প্রবেশ করে হাতে এক কাপ লাল চা। চা ‘টা তৌসিরের জন্য। তৌসিরদের বাড়ির সবাই প্রায় লাল চা খান আর তৌসির তো খাবেই, সে যে হাড়কিপটে! দুধ চা জীবনে তৌসির চেকে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে নাজহার। নাজহা দুধ চা খায়। বিয়ের পরের দিনই বাড়ির মহিলাদের এক কথার কথায় জানিয়ে দিয়েছে সে দুধ চা-প্রেমী মানুষ। তার শ্বশুর-আম্মা বলেছেন, “তোমার যখন যা ইচ্ছে হয়, তা তুমি বানিয়ে খেয়ো মা।” নাজহাও সকালে উঠে আগে নিজের জন্য এক কাপ কড়া লিকারের দুধ চা জ্বাল দিয়ে খায় আর আসরের পর এক কাপ খায়। কড়া লিকারের দুধ চা না খেলে মাথা নষ্ট হয়ে যায় তার। ভাত দু’বেলা না খেয়ে থাকতে পারলেও চা সে না খেয়ে থাকতে পারবে না। চা যে মারাত্মক এক নেশার মতো। নাজহা নিজের এক জীবনে দুটি জিনিসের প্রতি বেশ আসক্ত হয়েছে এক তালহা ভাই আর দুই কড়া লিকারের দুধ চা।
যাই হোক, নাজহা রুমে ঢুকে তো ভীমড়ি খায়! যেখানে প্রতিদিন তৌসিরের সাথে গ্যাগ্যান করতে করতে তৌসিরকে তুলে তার মুখে চা তুলে দেয়, সেখানে আজ তৌসির উঠে বিছানা গুছিয়ে, পুরো রুম গুছিয়ে নিয়েছে। পুরো রুম অবশ্য প্রতিদিন তৌসিরই গোছায়। নাজহা এসবে হাত লাগায় না। কেন লাগাবে? অগোছালো তো সে করে না, করে তৌসির তাই গোছানোর দায়িত্বটাও তার। তৌসির শুধু রুমই গোছায়নি, সাথে নিজে গোসল করে আয়নার সামনে রেডি হচ্ছে। নাজহা ধীর পায়ে আয়নার সামনে তৌসিরের পিছনে দাঁড়ায়। তৌসির আজ সাদা পাঞ্জাবি আর সেই সেদিনের নতুন কালো লুঙ্গিটা পরেছে। তৌসির মানুষ জাউরা হলেও দেখতে কিন্তু মাশাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ! এটা নাজহা নিজেও স্বীকার করে। নাজহা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তৌসিরকে একবার পরখ করে নেয়। আয়নার মধ্যে নাজহাকে দেখে তৌসির এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করে, “কিতা লো, আমারে সুন্দর লাগেরনি?”
নাজহা ভুরু কোঁচকে তৌসিরের দিকে এগিয়ে এসে চায়ের কাপটা ড্রেসিং টেবিলের স্টেজের উপর রেখে তৌসিরকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি এত সকালে উঠে গেলেন, আবার রেডি হচ্ছেন কোথাও যাবেন নাকি?”
তৌসির হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে এক চুমুক দিতে দিতে বলে, “হ, যামু। তুমিই তো কইলা আইজ যেন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি, তো তাড়াতাড়ি ফিরতে হইলে তাড়াতাড়ি যাইতে হইবো না।”
নাজহা কারণ শুনে বুঝতে পারে, এই লোকের আর তস সইছে না। নাজহা নরম গলায় অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে তৌসিরকে খুঁচা মেরে বলে, “উম, লুইচ্চা বেটা! রাত পোহাতে না পোহাতেই শুরু করে দিছেন প্রস্তুতি!”
তৌসির নাজহার কথা শুনে ওর দিকে আড়চোখে কিছু সময় চেয়ে থাকে। তারপর রঙ্গিলা গলায় বলে, “ধূর ব্যাটি, সাউয়া! লুইচ্চামির দেখছো কি!”
নাজহা সেই আগের মতো অন্যদিকে তাকাতে তাকাতে বলে ওঠে, “আচ্ছা হয়েছে, যান গিয়ে বসে চা’টা খান।”
তৌসির চা’টা এক টানে খেয়ে চায়ের কাপটা আগের জায়গায় রাখতে রাখতে বলে, “কি বইসা খামু? চা তো পুরাই ঠান্ডা।”
নাজহা কিছু বলে না। চুপচাপ চায়ের কাপটা নিতে যায়, উদ্দেশ্য কিচেনে নিয়ে রেখে আসা কিন্তু তা আর হয় না। তৌসির ওর হাত টেনে ধরে নিজের নিকট নিয়ে আসে। নাজহার কোমরে হাত দুটো রেখে চঞ্চল ছোঁয়া ছড়িয়ে দেয় তার শরীর জুড়ে। নাজহা লজ্জায় গুটিয়ে যায়। লাজে লাল হয়ে আসে ওর মুখোবয়ব। নতজানু দৃষ্টিতে হালকা হালকা হাসতে হাসতে বলে, “উহু, তৌসির! কী করছেন! যান এখন কাজে যান, সব রাতে।”
নাজহার এই লজ্জা দেখে তৌসিরের হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। ওর সবুজ বাঘিনী এভাবে লজ্জাও পায়! বাহ, কি সুন্দর দিন তার দেখতে হচ্ছে! তৌসির নাজহার থুতনিতে মৃদু স্পর্শে ধরে ওর লজ্জায় টুকটুকে হয়ে ওঠা মুখশ্রী তুলে নিজের দিকে তাক করায়। নাজহাও এবার তৌসিরের মুখপানে তাকায়। তৌসির প্রেমে ডোবা চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নাজহার লালচে আভায় ফুটে ওঠা স্নিগ্ধ মুখপানে। নাজহার লজ্জার উষ্ণতায় গাল দুটো গোলাপের পাপড়ির মতো টুকটুকে হয়ে গেছে। মুখটা দেখে মনে হচ্ছে লজ্জার রঙে রাঙানো সাদা গোলাপ। তৌসির নাজহার এই রূপ দেখে বড়ই অবাক আর মুগ্ধ ভীষণ মুগ্ধ। শুধুই মুগ্ধ নয়, মোহগ্রস্ত সাথে বিস্ময়সিক্ত। তৌসির ধীরে ধীরে নাজহার ডান গালে নিজের বাঁ হাত রাখে আর মুখ এগিয়ে নিয়ে টুপ করে একটা চুমু এঁকে দেয় নাজহার লাজে লাল হয়ে ওঠা বাম গালে। তারপর ঠোঁট তুলে আবারো ঠোঁট ঠেসে ধরে নাজহার ঠোঁটের কিনারায়। নাজহা চোখ বুঁজে নেয়। তৌসিরের এই স্পর্শে নাজহার চামড়ার নিচে স্নায়ুগুলো কেঁপে উঠছে বারংবার । তার স্পর্শে শিরশিরে অনুভূতি জাগছে দেহে। তৌসিরের স্পর্শটুকু মনে হলো রেশমের মতো গলে পড়ছে ওর ত্বকে। নাজহার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তৌসিরের ঠোঁটের ছোঁয়ায় মৃদু বিদ্যুৎ নেমে আসছে শরীরে। নিজেকে সামলাতে না পেরে নাজহা তৌসিরের বুকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বলে, “সরুন! যেখানে যাচ্ছিলেন, ওখানে যান তো। এসব সবসময় ভালো লাগে না।”
তৌসির এ শুনে নাজহার থেকে মুখ সরিয়ে এনে রঙ্গ করে বলে, “আরে, নয়া নয়া বিয়া করলাম, উত্তেজনা তো আমার একটু থাকবই। একটু তো সহ্য তোমারে করতেই হইবো, কৈতরি!”
নাজহা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এই লোকটা সবসময় উল্টোপাল্টা ভাষায় কথা বলে যা ইচ্ছে তাই। নাজহার মনে কিছু একটা আসে, তাই গুনগুনিয়ে তৌসিরের বুকের হাত রেখে পাঞ্জাবির বোতামগুলোর উপর হাত বুলাতে বুলাতে নিজের মারাত্মক সুন্দর সবুজ নয়না একটু সরু করে নরম হাসি নিয়ে তৌসিরের দিকে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে বলে, “আমি তো আপনায় স্বামী হিসেবে মেনে নিলাম। তাই আপনায় কিন্তু এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন গিফট দিতে হবে।”
তৌসির স্পষ্ট বুঝে যায়, নাজহা ওর সাথে ফ্লার্ট করতেছে। তৌসিরও হাত বাড়িয়ে নাজহার কপালে পড়া বেবি হেয়ারগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিতে দিতে হালকা তিক্ত সুরে বলে, “পয়সা বাচাইতে দুই বছর ধইরা আন্ডারওয়্যার কিনি না, তিন বছর ধইরা নয়া লুঙ্গি কিনি না, আর তুমি সাপ্তায় সাপ্তায় গিফট মারাইও না।”
তৌসিরের কথা শুনে নাজহা স্তব্ধ হয়ে যায়। কী একটা অবস্থা! এত সুন্দর করে বললো, তারপরও এই লোক এভাবে উত্তর দিলো! তিতা-মিঠার কোনো মূল্য এই মানবের কাছে নাই। তারপরও নাজহা তৌসিরকে কড়া কিছু বলে না। আজ থেকে পণ করেছে সব সহ্য করে নিবে। নিজেও নাহয় একটু কিপটেমি শিখে নিবে, একটু আয় করে নিবে, মানিয়ে নিবে। বিগত জীবনে তো অনেক বিলাসিতাই করলো, এখন নাহয় একটু কম বিলাসিতা করবে। ধীরস্থিরে তৌসিরকে ঠিক করে নিবে। বউয়ের কথা তো শুনতেই হবে। সে তৌসির যত বড় সণ্ডা হোক, ওর সণ্ডামি-গুণ্ডামি নাজহা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে নিবে। সংসার জীবনের তো এখনো শুরুই হলো না। সব ভুলে নাজহা সুন্দর একটা জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখছে এই মন্দ লোকের সাথে। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, সে এই মন্দ লোকের নিন্দার সংসারেই করবে। নাজহা তৌসিরের পাঞ্জাবির কলার টেনে ধরে গোড়ালিতে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে তৌসিরের মুখের সামনে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “আপনি আমায় টুনির মা ডাকেন না? আপনি যদি আপনার এই আখেরী কিপটেমি না ছাড়েন, তাহলে সাফ সাফ স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি আপনার টুনি বা টুনার মা হবো না আমি।”
তৌসির নাজহার কোমর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” কিপ্টামি তো আমি করি, তাহলে আমার না-হওয়া টুনা বা টুনির দোষ কী? কেন আনবেন তাদের পৃথিবীতে?”
“এত কিপটেমি করে সন্তান পালা যায় না, তৌসির! আমি ম্যানেজ করলাম বা করেই নিলাম, কিন্তু যখন আমাদের একটা সন্তান হবে, তখন তার সাথে এমন করবেন আপনি?”
তৌসির নাজহার কথায় মুচকি হেসে বলে, “এই! এত টাকা-পয়সা কাদের জন্য? ওগো লাইগাই তো। ভাবতেছি, এই বছরই একটা নিমু, এরপর দু’বছর পর আরেকটা। বয়স তো কম হইলো না। ওদের কোনো অভাব রাখমু না। তারপর কও আমার টুনা-টুনির মা হইবা?”
নাজহা তৌসিরের কথায় ভুরু কোঁচকে একটু ভাবে, তারপরও হেসে দিয়ে বলে, “এমন যদি হয়, তাহলে হওয়াও যায় টুনির মা। কী বলেন, আপনাকে বানানোই যায় টুনির বাপ।”
তৌসির নাজহার কথায় এক গাল হেসে সাহস করে নাজহার ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে গাঢ়ভাবে চুমু খেয়ে নেয়। নাজহাও বাঁধা দেয় না। উল্টো দু’হাতে তৌসিরের গলা জড়িয়ে ধরে। তৌসির নাজহাকে চুমু খেতে সিক্ত এমনই মুহূর্তে পিছন থেকে বিবিজানের গলা ভেসে ওঠে, “বউয়ের লগে ঘষাঘষি পরে করবা নে। এখন নিচে আও। পাছা দিয়া তো আইক্কালা বাঁশ ঢুইক্কা গেছে।”
তৌসির বিবিজানের গলা শুনে নাজহাকে ছাড়তে চায়, কিন্তু নাজহা ছাড়ে না। তৌসিরের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। এ ভেবে ধরে বিবিজান এসেছেন তো কী হয়েছে, উনি কেন আপত্তিকর মুহূর্তে চলে আসেন! তৌসির অনেক কষ্টে নাজহাকে নিজের থেকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে বিবিজানের দিকে তাকায় আর বলে, “কী হইছে?”
বিবিজান গায়ের চাদর ঠিক করতে করতে দাঁত চেপে বলেন, “নিচে পুলিশ আইছে, নতুন ওসি ঐটা আইছে। তাড়াতাড়ি আয়।”
তৌসির বিবিজানের গলায় আতঙ্ক দেখে তাড়াতাড়ি বিবিজানের সামনে দাঁড়ায় আর বলে, “চলো।”
বিবিজান কটমট চোখে নাজহার দিকে এক নজর তাকিয়ে ফের তৌসিরের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ঠোঁট মোছ। রক্ত পড়তাছে।”
তৌসির হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে বলে, “চলো।”
এ বলে সামনে পা বাড়ায় নিচে যাওয়ার জন্য। নিচে এসে দেখে বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত। ওর বাপ-চাচা চারজনের চারজন এখানে। দাদাজানও সাথে। ওর মা, চাচী, চাচাতো ভাই-বোনরা—সবাই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ কয়েকজন এসেছে বাড়িতে। তৌসির নিচে নেমে সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে বিস্ময় নিয়ে নিজের বাবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী হইছে এখানে?”
তার বাবা কিছু বলার আগে ওসি ফারদিন এগিয়ে এসে হাতের লাঠিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলেন, “কী হওয়ার বাকি আছে মিস্টার তৌসির? ওহ, সরি সরি, মেয়র সাহেব।”
তৌসির ফারদিনের কথায় বুঝে যায় উল্টোপাল্টা কেস তো খেয়েছে, এরজন্য এই পুলিশ। তৌসির তাও ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
ফারদিন তৌসিরের কথায় হেসে ওঠে বলে, “মানে বুঝতে পারলেন না, নেতা সাহেব? তাহলে স্পষ্ট শুনুন!”
এতটুকু বলে ফারদিন তৌসিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রুক্ষ চোখে তৌসিরের চোখে চোখ রেখে কঠিন গলায় বলে, “আপনার নামে গুরুতর মামলা আছে অর্গান ট্রান্সফারের, ড্রাগস ডিলের, খুনের। আর কত কত ক্রাইমের প্রুফও আছে!”
তৌসিরের ভেতর কেঁপে উঠে সামান্য পুলিশ কীভাবে এসব জানলো! তৌসির ভয় না পেয়ে ফারদিনের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “প্রমাণ দেখান।”
ফারদিন তৌসিরের মুখের সামনে ফোন ধরেন। ফোনের স্ক্রিনে ঝুলছে তৌসিরের সেই পতিতা মেয়েটিকে খুন করার দৃশ্য, অর্গান বের করে নেওয়ার দৃশ্য, ড্রাগস ডিলের সময়কার দৃশ্য। তৌসির স্তব্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখে কথা নেই, একদম চুপ। উপস্থিত সবাই যেমন এতক্ষণ নীরবতা পালন করছিলেন, তৌসিরও তেমন নীরবতা পালন করতে থাকে। ফারদিন ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিতে নিতে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, “অবাক হলেন? আমিও অবাক হয়েছি। এই প্রুফ কেউ একজন আমাদের দিয়েছে। এগুলো এআই ভাববেন না, এগুলো রিয়্যাল কিন্তু। আপনাকে এইসব অপরাধে অ্যারেস্ট করা হলো। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।”
নাজহা তৌসিরদের পিছনে পিছনে এসেছিল, সিঁড়ির কাছে এক কোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছে ও। তৌসির এসব দেখে নিরুত্তর। নিজের সব পাপ ধরা পড়ে যাওয়ায় ও নিরুত্তর।
নাজহার চোখ দুটি টলমল করছে এগুলো দেখে, কিন্তু অশ্রু বাইরে আসার শক্তি পাচ্ছিল না। বুক থেকে গলা পর্যন্ত একটা দলা পাকানো কষ্ট উঠে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে স্তব্ধ। বাইরের নাজহা এখনও দাঁড়িয়ে, কিন্তু ভেতরে যে নাজহা, যে তৌসিরের সাথে সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণে সিঁড়ির কোণেই মৃত্যুবরণ করেছে। বাইরের শরীরটা শুধু তার মৃত্যু-পরবর্তী যান্ত্রিক খোসা মাত্র।
সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে নাজহার, কিন্তু এ কোনো ভূমিকম্পের ধাক্কা নয়, এ হলো ভূমিকম্পের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কম্পন। যে দেয়াল ধরে নাজহা জীবনে একটু নিরাপত্তা, একটু ভালোবাসা আশা করেছিল, সেই দেয়ালই যে আসলে ছেঁড়া কাগজের আবরণ ছিল, তা এখন নির্মমভাবে প্রমাণিত হলো। নাজহা তো শুধু একটুখানি শান্তি ভিক্ষা করেছিল ভাগ্যের কাছে। চেয়েছিল অতীতের ক্ষতগুলোয় একটু মলম লাগাতে, নতুন করে বাঁচতে। একটা সাধারণ, সুন্দর, নিষ্পাপ সকাল দেখতে চেয়েছিল এই মন্দ লোকের সাথে। কিন্তু সেই সকালের প্রথম রোদ ওঠার আগেই সব আলো কেড়ে নেওয়া হলো। সবটা সরাইয়ে এক ভয়াবহ, অন্তহীন সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে গেল।
“শুরুর আগেই শেষ!” নাজহার মস্তিষ্কে এই সত্যটা তিরের মতো নয়, তপ্ত লোহার শিকের মতো বিঁধছে গিয়ে।
তার স্বপ্নগুলো ছিল ফুলের পাপড়ির মতো নরম, কিন্তু এই এক মুহূর্তের আঘাতে তা শুধু ধুলোয় মেশেনি, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মিশে গেল সেই বিষে, যা তৌসিরের জীবন। এখন শুধু রইল এক কবর-সমান গভীর শূন্যতা আর এক আশাহীনতার তীক্ষ্ণ বেদনা, যা শিরায় শিরায় বইছে। নাজহা বুঝতে পারে, তার আর নিজের বলতে কিছু রইলো না। যা রইলো, তা শুধু তার নিজেরই ভেঙে যাওয়া অন্তরের অন্ধকার গহ্বর।
তৌসির বুঝে যায়, আজ তাকে হাজতে যেতেই হবে। ঘুষ টুষ দিয়েও কাজ হবে না। সব শেষ হয়ে গেছে। এই অফিসার নাছোড়বান্দা। তৌসির ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। দেখতে পায় নাজহাকে দেখতে পায় নাজহার অসহায় চোখের চাহনি, দেখতে পায় ঠোঁট শুকিয়ে গেছে তার সবুজ বাঘিনীর। যে নয়নায় সবসময় তৌসিরের জন্য রাগ বরাদ্দ থাকতো, আজ সেই নয়নায় অসহায় চাহনি। তৌসিরের এতক্ষণ একটুও ভয় করেনি, খারাপ লাগেনি কিন্তু নাজহার অবস্থা দেখে শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে ঘা মেরে ধরছে এক তীক্ষ্ণ ব্যাথায়। তৌসিরকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে নাজহা ঠোঁট ভেঙে চোখে জমা পানিটুকু ছেড়ে দিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে ওঠে, “তৌসির, আপনি সত্যি চলে যাবেন?”
এ বলে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে থাকে। নাজহার এই চোখের পানি তৌসিরের শরীরের শিরায় শিরায় দুঃখের রেস বাঁধিয়ে দেয়। তৌসিরের মনে হয়, এই বুঝি কেউ বক্ষপিঞ্জর হতে কলিজাটা জোর করে খাবলিয়ে টেনে টেনে বের করে নিচ্ছে। তৌসিরের গলায় এসে কথা আটকে যায়। ও ঢোক গিলে ফারদিনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি আপনার লগে যাব। পাঁচটা মিনিট আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে দিন।”
ফারদিন তৌসিরের মুখে ‘স্ত্রী’ শুনে থতমত খায়। মনে করেছিল, বোন হবে। ফারদিন প্রথমেই নাজহাকে দেখে টাশকি খেয়েছে। ফারদিন ভেবেছিল, এ হয়তো বিদেশী কেউ তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এখন দেখে, সে বাংলাতে কথা বলতে পারে, তারওপর তৌসিরের স্ত্রী! ফারদিন তৌসিরকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার স্ত্রী?”
তৌসির পিছনে ঘুরে নাজহার দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ, আমার অর্ধাঙ্গিনী।”
ফারদিন কিছু বলবে, তার আগে তৌসিরের বাবা বলেন, “ওসি সাহেব, নতুন বিয়ে করেছে। কিছু বুঝাপড়া করে নিক যাওয়ার আগে, একটু সময় দিন একান্তে।”
ফারদিন এটা শুনে একজন মহিলা অফিসারকে বলেন, “আপনি তাদের সাথে যান। তারা যে ঘরে কথা বলবেন, তার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন।”
এ আদেশ দিয়ে অন্য অফিসারদের দিকে তাকিয়ে বলে, “এ বাড়ির প্রত্যেকের ঘর সার্চ দাও। সাথে সবার ফোন। একজন যখন ক্রাইমের সাথে জড়িত, তাহলে পরিবারের কেউ থাকতে পারে।”
এই আদেশের বিরুদ্ধে বিবিজান কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন, তার আগেই ফারদিন বলে ওঠে, “ম্যাডাম, ওয়ারেন্ট আছে।”
ব্যাস! বিবিজান চুপ করে যান। আর কী বলবেন! বাঁশ তো খেয়ে নিয়েছেন।
তৌসির আর নাজহাকে নিচে একটা রুমে পাঁচ মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। দরজা আগলিয়ে দরজার বাইরে মহিলা অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন। তৌসির নাজহার গালে হাত রেখে চোখের নিচের পানি বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, “তুমি কান্দো কিসের লাইগ্যা? এই খারাপের জন্য চোখের পানি ফেইল্যো না তো। আমি সারাজীবন থাকমু নাকি? দু’-এক মাস থাকা লাগতে পারে।”
নাজহা দুই হাতে তৌসিরের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে, “ওদেরকে ঘুষ দিয়ে দিন! কিছু ঘুষ দিয়ে দিলে নিবে না? আপনাকে ছেড়ে দিবে!”
তৌসির নাজহার কথায় মুচকি হেসে বলে, “আরেএ! তালুকদারের মাইয়া! তুমি দেখি আমার থেকেও বড় বদমাশ! ঘুষের কথা কও! ঘুষ দিলে মানব না।”
নাজহা তৌসিরের চোখের দিকে তাকিয়ে আহত গলায় বলে, “আমি কী করে থাকব একা? আমার রাতে ভয় লাগে, তৌসির! আপনার বুকে ঘুমিয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনার দেওয়া যন্ত্রণাগুলো আমার বড্ড প্রিয়! আপনিহীন কীভাবে থাকবো? আমার একটুখানি ভালো থাকার হলেও আপনার প্রয়োজন। কেন এমন হয়? আমি আপনার সাথে থাকব তো, তাহলে কেন আপনি চলে যাবেন? আমি খুব খারাপ? আমার সাথে সংসার না করার জন্য পালাচ্ছেন? পালিয়ে যাচ্ছেন দায়িত্ব থেকে?”
নাজহার এই আর্তনাদ তৌসিরের শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে সরাসরি তার বিবেকদংশনের কেন্দ্রে আঘাত হানছে। নাজহার কথাগুলো শুনে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। তবে তা বাতাসের অভাব নয়, বরং নিজেরই শ্বাসরোধকারী অপরাধবোধের ভার। তৌসির নাজহাকে বুকে টেনে ধরে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ওর চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “আরে ব্যাটি ব্যাঙ! কান্দিস ক্যান? শোন, আমি চলে আসমু কিছুদিন পর। আর যদি না আসি, তাইলে তুই চইল্যা যাইস। ডিভোর্স দিয়া দিমুনে।”
নাজহা হু হু করে কেঁদে উঠে বলে, “আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আমি দ্বিতীয় পুরুষের নাম নিজের সাথে কোনোদিনও জুড়বো না।”
তৌসির নাজহাকে আর কিছু বলতে যাবে, এমনি সময় ফারদিন ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে আর বলে, “তৌসির সাব, সময় শেষ।”
তৌসির নাজহাকে নিজের থেকে ছাড়াতে চেয়ে বলে, “আমারে যাইতে হইবো।”
কিন্তু নাজহা ছাড়ে না। উল্টো দুই হাতে শক্ত করে তৌসিরের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলে, “আমি যেতে দেব না আপনায়! কেন যাবেন আপনি? আমি আপনাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি না। আপনি জানেন তো, আমি একরোখা মানুষ। আমার সাথে কেউ অত কথা বলে না। আপনিই শুধু বকবক করেন। আপনার বকবক না শুনলে আমার শান্তি মেলে না। আপনি গালি দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন না? যা ইচ্ছে গালি দিয়েন, আমি রাগ করব না। তারপরও থেকে যান, তৌসির! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার কলিজাটা কেউ ছিঁড়ে নিচ্ছে।”
এই আহাজারি শুনে তৌসিরের মনে হচ্ছে, বুকের বাম পাশটায় কেউ যেন তপ্ত শলাকা গেঁথে দিয়েছে। প্রতিটি হৃদস্পন্দন এখন কষ্টের দলিল হয়ে গেছে । তৌসির অনেক কষ্টে নাজহাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ওর চোখ মুছি দিতে দিতে বলে ওঠে, “এ ব্যাটি সাউয়া! এমনে কান্দিস না। আমি চলে আসমু তো, আসমু কয়েকদিন পর। তোরে কানলে মায়া লাগে না।”
ফারদিন এটা দেখে মনে মনে বলে, “একজন পরী কাঁদতেছে একজন সরোয়ারের জন্য! কি বিশ্রী ব্যাপার।”
ফারদিন হাতকড়া নিয়ে তৌসিরের দিকে এগিয়ে আসে। এ দেখে তৌসির নাজহার কাছ থেকে এক পা সরে আসে। সে মাথা নিচু করে হাত বাড়িয়ে দেয়। ফারদিন তৌসিরের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়।
নাজহা অসহায়, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রয় তৌসিরের দিকে। ওর প্রাণবন্ত সবুজ চোখ দুটো আজ শুকনো, ভেতরের সব জলীয় অংশ শুকিয়ে পাথরের গুঁড়োয় পরিণত হয়েছে। নাজহার মনে হলো ওর ফুসফুস চিরে বেরিয়ে আসতে চাওয়া গলা-ফাটানো চিৎকারটা তার কণ্ঠনালীতে এসে আটকে গেছে। নাজহার ইচ্ছে হচ্ছে উন্মাদিনীর মতো কাঁদতে, পৃথিবীকে তার যন্ত্রণার কথা জানাতে কিন্তু নিয়তি তাকে নির্বাক, অসহায় পুতুলে পরিণত করে দিয়েছে।
নাজহার এই অসহায়, নীরব চাহনি তৌসিরের ভেতরের সব প্রাচীর ভেঙে দিচ্ছে। তৌসিরের কাছে হাতকড়া এখন আর কেবল গ্রেপ্তারের প্রতীক নয় এটি নাজহার অন্ধকার হয়ে যাওয়া ভবিষ্যতের প্রতীক, যার জন্য সে নিজেই দায়ী।
ফারদিন শান্ত অথচ কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, “চলুন সাহেব।”
তৌসির এলোমেলো পায়ে সামনে পা বাড়ায়। তার শরীরটা বাধ্য হয়ে সামনে যাচ্ছে, কিন্তু তার বিবেক, তার ভালোবাসা এবং তার সমস্ত অনুশোচনা সবকিছুই তীব্রভাবে পেছনের নাজহার দিকে ছুটে যেতে চাইছে। নিজের সবুজ বাঘিনীর সবুজ নয়নে নিজের জন্য নিঃশব্দে ঝরে যাওয়া চোখের পানি তৌসিরের কাছে নিজের মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও যে ভয়ংকর মনে হচ্ছে।
ফারদিন যখন তৌসিরের বাহু ধরে তাকে নিয়ে যেতে লাগে, তৌসির তখন বারংবার পিছনে ফিরছিল। প্রতিবার তাকানোর কারণ ছিল নাজহার কাছে তার শেষবারের মতো আজীবন ক্ষমা প্রার্থনার ব্যর্থ চেষ্টা। তার চোখ যেন নাজহাকে আকুলভাবে বলছে “বিশ্বাস করো, তোমার ইচ্ছেকে ধ্বংস করার জন্য আমি দায়ী নই, আমি শুধু নিয়তির কাছে হেরে গেলাম।”
নাজহাও তাদের পিছনে এলোমেলো, ভারসাম্যহীন পায়ে হাঁটতে শুরু করে। সে হাঁটছিল না, বরং তার ভেঙে যাওয়া শরীরটা যান্ত্রিকভাবে এগিয়ে চলছিল, গন্তব্যহীন। তাদের মাঝের দূরত্ব বাড়ছে, তৌসিরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সামনে দিয়ে, কিন্তু তাদের যুগ্ম যন্ত্রণা এক অদৃশ্য, টানটান সুতোয় বাঁধা পড়ে গেছে। তৌসিরের প্রতিটি পিছন ফেরা নাজহার পায়ে শক্তি যোগাচ্ছে। নাজহা সামনে পা বাড়াচ্ছে আর দেখছে তার অতি অপ্রিয় মন্দ লোকরা চলে যাচ্ছে, এবং এই দৃশ্যই তার শেষ আশ্রয়।তৌসির যাচ্ছে এক লোহার তৈরি কারাগারের দিকে, আর নাজহা যাচ্ছে এক শূন্য ভবিষ্যতের দিকে। তাদের এই পথচলা ছিল দুটি আত্মার পতন, যার শেষ নেই। নাজহার পায়ের এলোমেলো পদক্ষেপ তার জীবনের দিকভ্রান্তির প্রতীক, আর তৌসিরের প্রতিটি পিছন ফিরে তাকানো তার আজীবনের অনুশোচনার দলিল।
তৌসির সদর দরজায় গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। পিছন ফিরে চেয়ে মায়ের দিকে তাকায়। মা যে কাঁদবেন তা সে জানে, তাই মাকে আওয়াজ দিয়ে বলে, “আম্মাহ, তুমি খবরদার কাঁদবা না। আমি চইল্লা আইমু। কাপুরুষ পেটে ধরোনি, মনে রাইখো।”
এ বলে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে বলে, “বিবিজান, ভালো থাকিও। আমার নাজহার খেয়াল রাখিও। আমার নাজহা বড্ড অবুঝ।”
এ বলে তৌসির সামনে ঘুরে যায়। পিছনে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। শিকদার বাড়ির প্রাণ বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে। যে চিল্লিয়ে মাতিয়ে রাখতো বাড়ি, সে চলে যাচ্ছে।
তৌসিরকে নিয়ে যেতেই হালিমা, মানে তৌসিরের মা, জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। একমাত্র সন্তান উনার। তার এই পরিণতি মেনে নিতে পারলেন না। উনার বুকের ধন, উনার খোকা আজ উনার বক্ষ হতে হাজতে কী করে এই যন্ত্রণা সহ্য করবেন মা তো উনি! মায়েরা যে সন্তানের দুঃখ সইতে পারে না।
পুলিশ সারা বাড়ি তল্লাশি করে আর কিছু পায়নি। সবার ফোনও চেক দিয়েছে, তবে তেমন কিছু পায়নি।
সবকিছুর শেষে নাজহা রুমে আসে। এখন রুমে আসাটাও অর্থহীন, কারণ এখন তাকে জ্বালানোর যে তৌসির আর এখানে নেই। নাজহার চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু টলটলিয়ে গড়ায়। রুমে পা রেখে চারপাশের স্তব্ধতার দিকে চোখ বোলায়। তৌসীরের বদলে রাখা লুঙ্গি, স্যান্ডো গেঞ্জি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রাখা। মাথা আঁচড়ে চিরুনি বিছানার মাঝখানে হয়তো ছুড়ে মেরেছিল; সেই ছুড়ে মারা অবস্থাতেই রয়েছে। নাজহা ধীরে ধীরে দরজা আগলে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। চারদিকে চোখ বোলায় একটু আগেও তো এখানে তৌসির ওর সাথে খুনসুটি করছিল, আর এখন তৌসির এক প্রান্তে আর ও এক প্রান্তে। মনটা বিষাদে ভরে যায়।
নাজহা ধীরে ধীরে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকায়। নিজের চোখে চোখ রেখে চেয়ে থাকে। চোখের পাতা ভিজে গেছে মন্দ লোকটার এক মুহূর্তের অভাবে। নাজহা আয়নায় নিজের ভেজা চোখের দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে কিছু মুহূর্ত। অতঃপর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, চোখে আগুন, ঠোঁটে তৃপ্তি নিয়ে রক্তচোষা এক হাসি দেয় । চোখের পানি মুছতে মুছতে নিজেকেই নিজে বলে, “ওয়াও, তুমি এত ভালো অ্যাক্টিং করো? তুমি তো ভালো অ্যাক্টর হয়ে গেছো, ডার্লিং নাজহা।”
এ বলে আবারো বিষমাখানো হাসি পৈশাচিক তৃপ্তির হাসি হেসে ওঠে ” তৌসির আমায় ঠিকই বলে আমি গাদ্দার। নো নো, আই অ্যাম নট আ গাদ্দার, আই অ্যাম আ মহা গাদ্দার তৌসির শিকদারের নোবেল প্রাপ্ত গাদ্দারিনী।”
”নাজহা, নাজহা, তুমি এত সুন্দর অ্যাক্টিং করো! তোমায় তো মিস ওয়ার্ল্ড বানিয়ে দেওয়া উচিত।”
এ বলে নিজের চেহারায় হাত বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, “এই চেহারা, এই নিষ্পাপ চেহারার মায়ায় পড়েছে তৌসির শিকদার। আর এই চেহারার মায়ায় পড়লে কী হয়? ক্ষণে ক্ষণে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয়। তো তৌসির, আপনাকেও মরতে হবে।”
নাজহা হাসতে হাসতে ফ্যান অন করে, দু’পা বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে, জোরে জোরে শান্তির শ্বাস নেয়। তৌসিরকে নিজের মায়ায় জড়িয়ে পোড়াতে পাঠিয়েছে এর চেয়ে বড় জয় আর কী হয়? নিজের জাত শত্রুকে কেউ ভালোবাসতে পারে না। তাহলে নাজহা কীভাবে ওকে মেনে নিয়ে সংসার পাতবে? এইসব এভিডেন্স নাজহা এতদিন ধরে কালেক্ট করেছে। তারপর ফারদিনের নাম্বার ম্যানেজ করে নিজেই দিয়েছে। নিচে যা যা বলেছে, সবই ছিল নাটক। নাজহা এই বাড়িতে এসেছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে, কিন্তু তৌসীরের জন্য তা সফল হচ্ছে না। সেই কারণে তৌসিরকে দু’এক মাসের জন্য হাজতে পাঠানো। এক মাসের ভেতর নাজহা নিজের লক্ষ্য পূরণ করবে আর পরের মাসেই ডিভোর্স নেবে। যা করার দু’মাসের ভেতরেই করতে হবে। তৌসির আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসবেই। ও আসার আগেই কিস্সা খতম করতে হবে। এ ভেবে নাজহা উঠে দাঁড়ায়। ভাবে, বাড়িতে কল দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়ে বলে, “নাহ, এখন না।”
এ বলে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা সাদা কুর্তি হাতে নেয়। নিয়ে কুর্তিটার দিকে তাকিয়ে আফসোসসূচক ‘চ’ শব্দ বের করে বলে, “আমার স্বামী তো হাজতে, তাই আমার এখন বিধবার বেশে থাকা উচিত।”
এ বলে কুর্তিটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে নিজেকে বলে, “পবিত্র হই!ঐ খবিস চুমু-টুমু খেয়েছে।”
কিছুক্ষণ পর…
স্নিগ্ধবিষ পর্ব ১৯
নাজহা গোসল দিয়ে ওযু করে সালাতুত তাসবির নামাজে দাঁড়িয়েছে। আজ মনে শান্তি আছে, সেই উপলক্ষে নামাজ পড়ে উদযাপন করছে। নামাজ শেষে নাজহা সালাম ফেরায়। সালাম ফিরিয়ে পিছনে তাকাতেই নাজহা তাশকি খেয়ে ওঠে। ওর পিছনে কাঠের চেয়ারে ডান পায়ের উপর বা পা তুলে তৌসির বসে আছে। নাজহাকে চমকাতে দেখে তৌসির মুচকি হেসে হাত দিয়ে ইশারা করে সালাম দেয়, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ ম্যাডাম গাদ্দারিনী।”
