ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৫
জান্নাত চৌধুরী
বেলা দুইটা নাগাদ
বাড়িতে পুলিশ এসেছে চেয়ারম্যান ব্যস্ত হয়ে কথা বলছেন। রুনুর মা এসে দুকাপ চা দিয়ে যায় । চেয়ারম্যান টেবিল হতে এক কাপ চা কাব্যের দিকে এগিয়ে দিয়ে অপর কাপ তুলে নিলেন নিজের হাতে। আরাধ্য বেরিয়েছে , বেরিয়েছে বলতে তাকে জোর করে জুম্মার নামাজের পাঠানো হয়েছে । যেতে চাইছিল না তার ভাষ্যমতে সপ্তাহের ৬ দিন আকাম করে , একদিন মসজিদে গেলে নাকি মসজিদ তাকে নিয়ে খিল্লি ওড়ারে।
ইফরাহ শুনে না এসব জ্ঞান। একটু জেদ ধরলো, আরাধ্য মানলো। ভুল জায়গায় জেদ খাটবে না তার। বেজায় ক্ষিপ্ত হবে তার ঘরণী। এই মেয়েদের হুটহাট রেগে যাওয়ার একটা ব্যারাম আছে। কাব্য চা তে এক লম্বা চুমুক দিয়ে বলল-
-আপনার খাস লোকের ছেলে খালাস হয়ে গেল, তবে আপনারা ছায়ার দেখাও মেলে নি কাহিনী কি চেয়ারম্যান সাহেব ??
চেয়ারম্যান হতে চায়ের কাপ ঘুরিয়ে বলল –
“প্রায় ছয় চল্লিশ জন লোক আমার কাজে খাটে। তাই বলে কি সবার খোঁজ নেওয়া আমার কাম্য অফিসার?
-“আসলে তা ঠিক নয় তবে কর্মচারীর কর্মের সাথে খানিক খোঁজখবর রাখাটাও আপনার দায়িত্ব নয় কি ?”
-“তাহলে ঘরে বউ আর পর নারী দুটোই সামাল দিতে বলছেন ?”
-মানে ?
কাব্য চমকিত হলো ,চেয়ারম্যান তার দিকে একটু ঝুঁকে এলো -“ আমি মালিক আমার কাজ দরকার, কারো ঘরের খবর নয় !
দুজনের মাঝে নীরবতা চলছে ,আরাধ্য সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে সাথে রেজা। আরাধ্য রেজার কাঁধে হাত রেখে দুলে দুলে গান গাইছে-
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্যান্টে তালি বা’ড়া পকেট খালি
চুল কি দিলে শালা মুখে গালি
আরাধ্য থেমে যায় পরের লাইন রেজা ধরে-
এই জীবন যতই হোক এদো গলি
মনের ঝোপে ফুটে প্রেমের কলি…
হঠাৎ অন্দরমহলে চোখ পড়তেই শুষ্ক ঢক গিলে রেজা। গান থেমে যায় , মিইয়ে যাওয়া মুখে তাকায় আরাধ্যের দিকে। এই শালা পুলিশ দেখলেই বুক ধরফর করে তার। এই মালগুলো খুব একটা সুবিধার নয়, বলা যায় না কখন কিসে ফাসায়। কাব্য বসা ছেড়ে এগিয়ে আসে , চরকির মত একখান পাক দিয়ে তাকিয়ে থাকে আরাধ্যের দিকে।
এতে ভ্রু কুচকায় আরাধ্য! এই স্বভাবটা তার স্কুল জীবনের, স্কুলের হেডমাস্টার মশাইয়ের এই স্বভাব ছিলেন। তিনি ক্লাসে ঢুকে কোন ঝামেলা দেখলে ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিতেন। প্রায় অনেকটা সময় লেগে যেত তা ঠিক হতে। এই স্বভাব রপ্ত করেছিল আরাধ্য। খুব একটা ভালো স্বভাব নয়। কাব্যের চাহুনি স্থির- আরাধ্য বলল-
-কি লো অফিসার? নজরে গিলে নিচ্ছো দেখি। ছ্যাহ আমার আবার ছেলেদের প্রতি চাহিদা নেই। ছেলে ছেলে ওসব কেমন ইয়ো।
থামে আরাধ্য ! ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ভাবুক হয়ে বলে –
-“তুমি মাল আবার ওটা নাকি? কি জানি বলে …
-“সমকামী ছোট নবাব !”
রেজা কথায় ঘাড় কাত করে তাকালো আরাধ্য। রেজা বেক্কল হাসলো!
আরাধ্য তার কাধ থেকে হাত নামিয়ে বলল-
-সমকামী কি? ‘গ্রে’ বল বেটা , বাংলা মাড়ালে অশ্লীল হয়ে যাবে! ইংলিশ ছাড়বি বুঝলি?
কাব্য এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল- ছোট নবাব , নামটা বেশ টুইস্ট কিন্তু ১৭৫৬ থেকে ১৭৫৭ সম্ভাব্য সময় ছিল সিরাজউদ্দৌলার। বর্তমান সময় আপনার ছোট নবাব-
আরাধ্য শুনলো! পাশ কাটিয়ে সোফায় গিয়ে বসে ডানে বামে কাধ নাড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল –
-“আমি ময় টুইস্ট! যেমন বিরিয়ানির আলু।”
কাব্য হাসলো – বিরিয়ানিতে যে মাংসের পিছ টাও থাকে ভুলে যাচ্ছেন ? আলু তো কেবল অপশনাল।
-“আদার ব্যাপারে , মাংসের খোঁজে কি কাজ বলুন?”
রেজা বারবার শুষ্ক ঢোক গিলছে ,পিলে দম নিচ্ছে। ভয়ে মুখটা শুকনো। কাব্য গিয়ে এসে দাঁড়ালো এই বাড়িটা পুরোটাই যেন কোন এক রহস্য লাগছে। খানি চোখ বুলিয়ে বলল –
-তো মীর বাড়ির বংশ পরম্পরায় নিশ্চয়ই মাংসের ব্যবসা চলে কি বলেন ঠিক বলেছি কিনা?
-“ও হবে একটা বংশের ধাঁচ !
কাব্য ডান কাধ কিছুটা কাত করে বলল –
-“তাহলে কি ধরে নিব আপনিও এই ব্যবসায় আছেন?”
-ঝেড়ে কাশি দেন মিয়া ! এত রসে ডুবলে আবার ডায়াবেটিস হবে –
-“খুনে ব্যাপারে আপনি নেই তো সাহেব ?”
-“প্রমাণ পেয়েছেন?”
কাব্য মাথা নাড়লো- “ এখনো নেই ”
আরাধ্য কপাল চুলকে বলল- “শুনেন অফিসার পুরান পাগল! সহজে চেতি না।, তাই বলে চেতবেন না। আমি মাল ভীষণ জাউড়া এসব কিন্তু বালের আগালেও গুনবো না।”
-আহা রাগেন কেন ? রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন ! মির্জাফরের কিন্তু অভাব নেই।
আরাধ্যের ক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক। এত ঠান্ডা কোনকালেই ছিল না কোনমতে দাঁতে দাঁত চেপে সংবরণ করল নিজেকে ।কাব্য বাঁকা হেসে বলল
-“চেয়ারম্যান সাহেব খানিকটা ত্রাণ দিয়ে সাহায্য ছেড়ে দিবেন আশা করছি। সবে ছেলে মরেছে শোক কাটাতে সময় লাগবে তাই নয় ?
চেয়ারম্যান কিছু সময় তাকিয়ে দেখে কাব্যের মুখটা! চেয়ারম্যানের বাম ভ্রুর উপরে বেশ বড় এক কালো তিল রয়েছে। এটা তার দাদার ছিল সে সূত্রেই তার রয়েছে। তবে কাব্যের সাথে তিলের মিল ব্যাপার টা ভাবুক। তিনি কিছুটা সময় স্তব্ধ থাকেন-
-আজ তাহলে আসি !
-“হ্যা- হ্যাঁ আচ্ছা ”
কাব্যে কথায় চমকিত হয় চেয়ারম্যান-টেবিল হতে ফাইল তুলে বেরিয়ে যায় কাব্য। তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন তিনি । আরাধ্য চোখ বুঝে গায় এলিয়ে দিতেই তিনি বললেন-
-ঘটনার সূত্রপাত নিশ্চয়ই তুমি?
আরাধ্য দুচোখ বন্ধ রেখেই বলল – “জ্বি কোন ঘটনা?”
-“সত্যি বুঝে উঠছো না , নাকি বুঝতে চাইছো না !”
-যদি বলি দুটোই।
চেয়ারম্যান বিরক্ত নিজের উপর। দিন দিন এই ছেলের উগ্রতা সীমা ছাড়িয়ে চলেছে –
-নিজেকে নিয়ে ভয় নেই?
-কি বলেন আব্বাজান আমি ডরাইছি, ভীষণ ভয় পেয়েছি। জলদি লোহা পরা পানি খাইতে হবে। আমি পানি খাইয়া আসি;
কথা শেষ করে এক ঝটকা উঠে দাঁড়ায় আরাধ্য। চেয়ারম্যানকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে কিছুটা এগিয়ে ডাকে রেজাকে
-শামসির পুত !
রেজা এগিয়ে আসে। আরাধ্য তার দিকে ঝুঁকে কানে কানে কিছু একটা বলে- কথা শেষে রেজা মুচকি হেসে বলল-
-আপনি মহান সাহেব!
কথা বলেই দুই হাত এক জোর করে মাথা ঝোঁকায় রেজা! আরাধ্য ডান হাত উঁচিয়ে বলল-
-”বেঁচে থাকো বৎস ! দিলাম দোয়া করে খাও ভিক্ষা করে।”
রেজার খুশি মুখ পানসে হয়ে যায়। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল –
-আচ্ছা আপনার মহত্বের গুণ কী ছোট নবাব?
-এই যে কেউ হাঁটু পানিতে নামতে চাইলে তাকে গলা অব্দি ডাবিয়ে দেওয়া !
রেজার মনে হচ্ছে সে ধর্ষিত। আরাধ্যের কথায় ধর্ষণ হয়েছে তার। এ লোক সব পারে, মুখটা হা করে জড় বস্তুর মত ঘুরে চলে যায় সে। আরাধ্য একটু হাসলো চুলগুলো বেক ব্রাশ করতে করতে এগিয়ে গেল ঘরের দিকে
ইফরাহ নকশী বুনছে? বিছানার উপর রুমালের ফুল তুলছে, অরুনিমার ঘর হতে সব সরঞ্জাম এনে রেখেছিল। আরাধ্য বেরিয়ে যেতে কাজে লেগে গিয়েছে
-এই মেয়ে কাজ নেই -এসব কি করছো?
ইফরাহ চমকে ওঠে ,দ্রুত সহিত হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ালো। মুখটা কাচুমাচু হয়েছে, আরাধ্য এগিয়ে আসে। একধ্যানে তাকিয়ে থাকে টান টানা চোখের পানে। ধীরে ধীরে আরো কাছে এসে দাঁড়ায়। ইফরাহর দৃষ্টি তখনো আরাধ্যের মনির চোখ জোড়ায় । আরাধ্য দৃষ্টি স্থির রেখে পাঞ্জাবি পকেট হাতরে একমুঠো খুরমা বের করে ইফরাহর হাতে ধরিয়ে দিল।
ইফরাহ , তাকালো তাজ্জব বুনে গিয়েছে, মুখটা ফাঁকা করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকলো। আরাধ্য ঠাওড়ে নিল না। কিছুটা সরে গিয়ে পাঞ্জাবি খুলে শরীর উদাম করলো
-এসব কি !
-“মালপোয়া চাটন দাও!”
“মশকরা করছেন?”
আরাধ্য হাসে , বিছানার দিকে ঝুঁকে বালিশ হাতরে সিগারেট বের করে। ইফরাহ আবার বলল
-মসজিদে খুরমা দিয়েছিল ?
-“দিয়েছো হয়তো ”
-আপনি হাত পেতে নিয়েছেন !
আরাধ্য ঠোঁটে সিগারেট চাপলো, টেবিলের উপর হতে লাইটার নিয়ে আগুন দিয়ে লম্বা টানে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছুড়ে বলল
“পলিথিন নেই নি তাই টুপি পেতে ছিলাম। শালার খুরমা দিবে জানলে বাড়ি হতে পলিথিন নিয়ে যেতাম ।”
-আমায় দিলেন যে?
-ঠেলে ঠুলে মসজিদে পাঠালে, এখন খুরমা এনে না দিলে যদি সওয়াব ফসকে যায়। তাই নিজের সাথে শামসির পুতের খুরমাও দখল করে এনেছি। সওয়াব মিস দেওয়া যাবে না-
ইফরাহ হা করে তাকিয়ে রইল! এই লোকের কথা উত্তর করার কিছু পেল না। শুধু অবাক হলো , আরাধ্য কাছে এলো তার। হাতে থেকে একটা খুরমা তুলে ইফরাহর মুখে দিয়ে বলল-
-খেয়ে তোমার অনুভূতি বলো?
ইফরাহ এবার অবাকের সপ্তম আকাশে। আরাধ্য এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে। রেলিংয়ে গা ঠেকিয়ে সিগারেট ফুকতে থাকে। ইফরাহও তার পিছু পিছু এসে দাঁড়ায় সেখানে
-আপনার মন মেজাজ ঠিক আছে?
-কাহিনী কি ?
এই লোককে ভালো কথাও বলতে নেই ,ইফরাহ নিঃশ্বাস ছাড়ে – “ কিছু নয় ? এমনি বলেছি !
আরাধ্য বাকা চাহনি তে ইফরাহ কে দেখে নিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে নিজে কাছে নিয়ে বলে –
-এভাবে কথা বলো নি কখনো ?
-দোষ করেছি নিশ্চয়ই !
আরাধ্য থমকালো সিগারেটেরের শেষ অংশে টান দিয়ে রেলিংয়ের বাহিরে ছুড়ে বললো –
-বড্ড প্রশ্ন প্যাঁচাও তুমি?
ইফরাহ নড়ে , ছাড়াতে চায় নিজেকে – আরাধ্যের শরীর হতে সিগারেটের গন্ধ আসছে , নিঃশ্বাসে মিশছে তা । ছটফট করছে মেয়েটা! আরাধ্য বলল-
ঘৃণা লাগছে ?
-বলেনি ! তবে নিজেই নিজেকে ঘৃণিত প্রমাণ করতে চাইছেন!
ঘৃণা করো না তবে কি ভালোবাসা ?
– আপনি বুঝি ভালোবাসার মতো মানুষ ?
আরাধ্য হাসলো ইফরাহ কে পাক দিয়ে নাক ঘোষলো কাঁধে ” -ভালোবাসো না ঘৃণা করো না তবে করো টা কি ?
ইফরাহ নিশ্চুপ থাকে! আরাধ্য তার কোমরে হাত দিতে কোমড় বন্ধনী হাতে পরে। আলগোছে একবার হাত বুলিয়ে হাস্কি টোনে বলে –
ছায়াস্পর্শ পর্ব ২৪
“ভালো না বাসো – আমাকে তোমার কোমড় বন্ধনীতে আটকে রেখো ! রক্তকমলিনী।
রাত্রির ছায়ায় ঢেকে দিও আমার সমস্ত উচ্চারণ—যেন তোমার নীরবতার গভীরে বিলীন হয়ে যাই আমি।এই নীরবতায় লুকিয়ে আছে এক প্রাচীন মন্ত্র,যেখানে অচিরেই শুনতে পাবে তুমি—আমার হৃদয়ের গোপন স্পন্দন।
