তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১২
প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
এয়ারপোর্টে শেষ বিদায়ের মুহূর্তে তাজদার তাসনুভাকে বলে গেল শাইনার প্রতিটি খবর তাকে জানাতে। তার শারীরিক অবস্থা কেমন, ডাক্তার কী বলেছেন, আর শাইনা ঠিকমতো সব নিয়ম-কানুন মেনে চলছে কিনা এসবের খোঁজ রাখতে।
বিদায়ের আগে সে আনিসের সঙ্গেও অনেক কথা বলল। শেষের দিকে বলল,”তোর বিয়ে খেতে পারিনি। শাওনেরটা এসে খাব।”
আনিস পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,”বিয়েশাদির কথা অনেকদূর। ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস। ওখানে কিন্তু আমরা কেউ নেই।”
তাজদার তার সাথে কথা বলা শেষে রায়হানের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল।
ভাইকে শেষবার দেখে তাসনুভার চোখে কোণা খানিকটা ভিজে ভিজে উঠেছিল সেই মুহূর্তে আনিসকে দেখে তার মেজাজ সপ্তমে চড়লো। সে এগিয়ে এসে আনিসকে বলল,”আনিস ভাই আপনি আমাকে আসার সময় খোঁচা মেরেছেন কেন?”
আনিস ফোনের স্ক্রীন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো। কপাল কুঁচকে বলল,”আমি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আপনি নয়তো কে? জরুরি কয়েকজন মানুষজন থাকলেই হয়ে যায়। এত কষ্ট করে এতজনকে এয়ারপোর্ট অব্দি আসতে হয় না। কথাটা কেন বলেছেন আপনি? নিশ্চয়ই আমাকেই মিন করে বলেছেন?”
আনিস একটু অবাকই হলো। সব কথা গায়ে টানা কি মেয়েমানুষের স্বভাব নাকি শুধু এই মেয়েটার? কখন সে কি বলেছে সেটা নিয়ে এখন ঝগড়া করতে এসেছে। আজব!
তাসনুভা বলল,”শুনুন আপনি কথাটা আমাকে গাড়িতে দেখামাত্রই বলেছেন। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলবো আপনি আমাকেই মিন করে কথাটা বলেছেন। পুরুষ মানুষকে এত খোঁচাখুঁচি করা মানায় না। এইসব ছেড়ে দিন। নইলে ভালো হবে না। আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলিনা আমাকে খোঁচা মারলে।”
আনিস বিরক্ত হয়ে সরে পড়লো। মেয়েটা ঝগরুটে এটা প্রতিটা পদে পদে প্রমাণ করে। নিজের মানসম্মান নিজেকেই বাঁচাতে হবে। তাই তর্ক না বাড়িয়ে সরে পড়াই ভালো।
ফেরার পথে রায়হান একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামলো। সবাই মিলে নাশতা করে তারপর বাড়ি ফিরে এল। বাড়ির সবাই দেখলো গাড়ি থেকে সবাই নামলেও সেই একজন নামলো না। সবার মন ভার হয়ে এল।
এয়ারপোর্ট থেকে এসেই ড্রয়িং রুমে সবার গল্পের আসর জমে উঠলো। সবাই তাজদার সিদ্দিকীর কথা বলাবলি করে হাসাহাসি করছে। গোরু কেনা নিয়ে বাচ্চাদের মতো সে কি রাগারাগি! আবার বউ রেখে চলে যেতে হচ্ছে বলে ইনিয়েবিনিয়ে সবার উপরেই ক্ষোভ প্রকাশ!
শাইনা আড়ালে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনলো। এতদিন তার মনে হয়েছে শুধু সেই বুঝতে পেরেছে বিষয়টা। অথচ সবাই-ই ধরতে পেরেছে রাগারাগির কারণটা। মনে হচ্ছে এতদিন পর সবাই যেন মনপ্রাণ খুলে কথা বলতে পারছে। এতদিন তাজদার সিদ্দিকী রেগে বসবে ভেবে সবাই আড়ালেই ফিসফাস করেছে।
কি আশ্চর্য! নিজেদের ছেলেকে তারা নিজেরাই এত ভয় পায় এমন আশ্চর্যের কথা শাইনা কোথাও দেখেনি। ভাই তো তারও আছে। মা বাবা ভাই বোনের সাথে তার ভাইদের এমন অদ্ভুত দূরত্ব, এমন লুকোচুরি সম্পর্ক তাদের পরিবারে ছিল না। তাহলে এই বাড়িতে এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন?
আফসার সাহেবও তখন বসেছিলেন সবার সঙ্গে। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“শানুকে আমি যদি এখন নিয়ে যাই বাড়িতে? জামাই চলে গেল। এখন যদি ও একটু বাড়িতে গিয়ে থেকে আসে তাহলে ভালো হবে বোধহয়। ওর মাও বলছিল যে…..
কথা শেষ হবার আগেই তাসনুভা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
“ইম্পসিবল কাকা! ভাইয়া আমাকে বলে গেছে শাইনাকে চোখে চোখে রাখতে। ওর কিছু হলে ভাইয়া আমাকে রেহাই দেবে না!”
আফসার সাহেব হালকা হেসে বললেন,
“জামাইকে আমি বলব মা। সমস্যা কী? প্রথম বাচ্চা তো এমনিতেই মেয়ের বাবার বাড়িতেই হয়।”
তাসনুভা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এইসব নিয়ম মানুষ বানিয়েছে। প্রথম বাচ্চা বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি কোথাও হবে না । হসপিটালেই হবে।”
রায়হান শান্তভাবে বলল,,
“তাজ পৌঁছাক আগে। তারপর ওর সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
আফসার সাহেব বললেন,
“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করা উচিত। শুনলাম ওর নাকি সামনে কোনো পরীক্ষা-টরীক্ষাও আছে?”
তাসনুভা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“হ্যাঁ, ইনকোর্স পরীক্ষা। ওটা এখনো দেরি আছে। কোনো সমস্যা হবে না। ফাইনাল পরীক্ষা হবে বেবি আসার পর।”
আফসার সাহেব মাথা নেড়ে বললেন,
“মেয়েটা এত ঝক্কি সামলাতে পারবে কিনা সেই চিন্তায় আছি।”
তাসনুভা মুখ শক্ত করে বলল,
“ওসব ভাবা উচিত ছিল বিয়ে দেওয়ার আগে। এখন ভেবে লাভ নেই। সব সামলে পরীক্ষা দিতেই হবে। ভাইয়া ওকে রেখে গিয়েছে পড়াশোনার জন্য। যাই, চা নিয়ে আসি। চা না খেয়ে যাবেন না কাকা!”
আফসার সাহেব নরম হাসিতে বললেন,
“আছি মা, এখানেই আছি।”
তাসনুভা ভেতরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর আনিস দরজার কাছে এসে উঁকি দিল। রায়হান বলল,”ভেতরে আয়।”
আনিস একটু ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আব্বাকে ডাকছে একজন। দেখা করতে এসেছে। একটু পাঠাও তো।”
আফসার সাহেব চমকে তাকালেন,”কে এসেছে?”
“চিনিনা। তবে তোমাকে খুঁজছে।”
“আবার কে এল?” বলে কৌতূহল নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আনিসের পিছু পিছু বাইরে চলে গেলেন।
ঠিক তখনই তাসনুভা চা নিয়ে ফিরে এলো। চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কাকা কোথায়?”
রায়হান বলল,
“ওই তো… আনিস এসে ডেকে নিয়ে গেল। কে যেন দেখা করতে এসেছে।”
তাসনুভা দাঁত কটমট করে ট্রেটা টেবিলে রাখল, তারপর কিছু না বলেই সেখান থেকে সোজা চলে গেল।
পথে শাইনার সাথে দেখা হলো। শাইনাকে আগাগোড়া পরখ করে সে বলল,
“তোমার এখন হাসিখুশি থাকা উচিত। আমি জানিনা তোমার সমস্যা কি? সারাক্ষণ এমন গোমড়া মুখে থাকো কেন? তোমার প্রত্যেকটা আপডেট ভাইয়ার কাছে পৌঁছে যাবে। বি কেয়ারফুল! বেবিটা তোমার একার না। খাও, দাও, আর হাসিখুশি থাকো। এই সময়টা খুব রিস্কি। আর হ্যাঁ পাশাপাশি বইপত্র খুলে পড়তে বসো। সামনেই তোমার ইনকোর্স পরীক্ষার ডেট আসবে হয়তো।”
শাইনা চুপ করে তার কথা শুনলো। তারপর বলল,”আমি কিছুদিন বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই।”
“ওকে ফাইন! ভাইয়াকে বলবো।”
“আপনার ভাইয়া যেতে না দিলেও আমি যাব। আমার এখানে ভালো লাগছে না এখন।”
ঝিমলি এসে বলল,”ননদিনী ওকে ছেড়ে দিন। ঘরে গেলে বরের কথা মনে পড়ছে তাই বাপের বাড়ি চলে যেতে চাইছে। যেতে দিন।”
তাসনুভা বলল,”আমি যেতে দেয়ার না দেয়ার কে? সে তার হাজবেন্ডের সাথে কথা বলে নিক। ব্যস!”
বলেই চলে গেল সেখান থেকে। ঝিমলি শাইনার পিঠ চাপড়ে বলল,”যাও যাও বেড়িয়ে এসো। আমার দেওর কিন্তু এমনিএমনি নিয়ে যেতে চায়নি।”
তিতলি হঠাৎ এসে বলল,
“এই শাইনা থুক্কু ভাবি! তুমি তোমার গায়ে হলুদের শাড়িটা আমাকে দেবে প্লিজ। আমি একটা বিয়েতে যাব, ওইটা পরেই যাব!”
শাইনা হালকা হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“নিও।”
কথাটা শেষ হতেই তাসনুভার কণ্ঠ ভেসে এল পিছন দিক থেকে,”হোয়াট?”
তিতলি চমকে পেছন ফিরে তাকাল। তাসনুভা সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে বলল,
“তুমি কোথাও যাচ্ছ না বিচ্ছু মেয়ে। তোমাকে নিয়ে আমি বিয়েতে যাব সেটা তুমি ভাবলে কী করে?”
তিতলি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল,
“মুক্তা আপুর বিয়েতে আমি যাব না?”
তাসনুভা ঠান্ডা গলায় বলল,”নো। অনলি মি।”
তিতলি গজগজ করে উঠল,
“তুমি একদম বেশি করো! আমি এখনই আম্মুকে গিয়ে বলে আসব। সবসময় আমার সঙ্গে এমন করো! আমি বিয়েতে না গেলে তুমিও যাবে না। আমাকে কোথাও নিয়ে যায় না কেউ। আমি যেতে না পারলে সব উলটপালট করে দেব এবার। আম্মু… আম্মুউ!”
চিৎকার করতে করতে সে দৌড়ে গেল মায়ের ঘরের দিকে।
ঝিমলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই দুটোকে কখন যে বিয়ে দেব। সারাক্ষণ একে-অপরের পেছনে লেগে থাকে।”
তাসনুভা তিরিক্ষি গলায় বলল,
“তুমিও এখন এইসব কথা বলছো?”
ঝিমলি জবাব দিল।
“আচ্ছা বাদ দিন। যান নিজের কাজে যান!”
তাসনুভা যেতে যেতে আবার থেমে ফিরে বলল,
“তুমি একটু ঘরে এসো তো, কিছু কথা আছে।”
“আচ্ছা, তুমি যাও। আমি আসছি।’
তাসনুভা চলে গেল।
ঝিমলি তখন শাইনার দিকে ফিরে নরম গলায় বলল,
“যাও খেয়ে এসো। মন খারাপ কোরো না। খেয়েদেয়ে রেডি থাকো। বর কিছুক্ষণ পর ফোন করবে।”
বলেই সে চলে গেল।
তাজমহল দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ১১
তাসনুভার সঙ্গে ঝিমলির দারুণ বোঝাপড়া। কিন্তু শাইনার সঙ্গে সম্পর্কটা এখনো একদম জমেনি।
হয়তো কোনোদিনও হবে না। তাসনুভা শাইনাকে পছন্দ করে না। শাইনাও তাকে না।
শাইনা খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঘরে এসে বসে রইলো কখন তাজদার সিদ্দিকী ফোন করবে। কিন্তু তাজদার সিদ্দিকী ফোন করলো না।
