তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৭+৮
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
ডান হাতটা আমার কাঁধের উপর দিয়ে সেল্ফের উপর রেখে বাম হাতটা পকেটে গুঁজে আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাইয়া।।চোখে রাগ স্পষ্ট।সাহস আমার অনেক আছে কিন্তু কোনো ছেলে এতেটা কাছে দাঁড়িয়ে থাকলে সাহসরাও হতাশ হতে বাধ্য ।কোন রকম ঢোক গিলে বলে উঠলাম….
আআপনি?
শুভ্র ভাইয়া ডেবিল মার্কা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকালেন।।উনার এই হাসিতেই আমার কাঁপা কাপি অবস্থা।শুভ্র ভাইয়ার কাঁধের উপর দিয়ে চোখ যেতেই দেখি উনার পুরো গ্যাং পেছনে দাঁড়িয়ে।। উনি বাঁকা হাসি দিয়ে আমার সামনের একটা টেবিলে বসে চেয়ারে পা রাখলেন।সিল্ক চুলগুলোতে আঙ্গুল চালিয়ে ঠিক করে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন…
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তোমার সাহস দেখে আমি হতবাক।আমার গাড়ি নষ্ট করার মতো দুঃসাহস তোমার হলো কি করে??
উনার কথায় কেঁপে উঠলাম,,এই যাহ!! বুঝে গেলো?কিন্তু কিভাবে বুঝলো??এরা কি এখন আমায় দুলাই দেবে নাকি?কাঁপা কাঁপা হাতে ওড়না ঠিক করতে করতে এদিক ওদিক তাকালাম..একটা ঢোক গিলে নিয়ে উনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম…
আপনার গাড়ি আমি কেনো নষ্ট করতে যাবো.?আর আমি করেছি তার কোনো প্রমান আছে আপনার কাছে??
আমার কথায় হুহা করে হেসে উঠলেন উনি।আবারও আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন…
তোমার কি মনে হয়?আমি পলিটিক্যাল লিডার হয়েছি এমনি এমনি?তোমার এই ছোট খাটো কূটনীতি আমার জন্য দুধ ভাত।।গেইটের পাশে যে একটা সিসি টিভি ক্যামেরা আছে খেয়াল করেছো??(ভ্রু নাচিয়ে,শয়তানী হাসি দিয়ে)
উনার কথার কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।।আমি যে এভাবে ফেঁসে যাবো ভাবতেও পারি নি।তবুও জোড় গলায় বলার চেষ্টা করলাম….
দদদেখুন…
উনি হঠাৎ আরো একটু এগিয়ে এসে মুখের সামনে মুখ এনে বলে উঠলেন, “হোয়াট?” উনার এভাবে কাছে আসায় ভয় পেয়ে গেলেও একটা বিষয়ে বেশ অবাক হলাম আমি। উনি আমার এতোটা কাছে দাঁড়িয়ে থেকেও একটাবারও আমায় টাচ করেন নি।।উনার হাতের একটু স্পর্শও আমার গায়ে লাগছে না।।উনি ফু দিয়ে আমার সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে আবারও চেয়ারে বসে পড়লেন।।ঠোঁটে ভয়ংকর হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলেন…
তোমাকে খুব কঠিন শাস্তি পেতে হবে রোদেলা।আমার সাথে পাঙ্গা নিতে আসলে বাঁচাটা যে খুব কঠিন হয়ে যায় জানো এটা??
উনার কথার কি উত্তর দিবো ভেবে পাচ্ছি না।।উনার লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই সাহেল ভাইয়া বলে উঠলেন…
ছেড়ে দে না শুভ্র।বাচ্চা মেয়ে না বুঝে করে ফেলেছে একটা ভুল।লেট হার গো।।তোর কার সার্ভিসিং এ যত টাকা লাগছে আমি দিয়ে দিচ্ছি তবু ওকে যেতে দে।
আমি অবাক চোখে সাহেল ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।এর আবার কি হলো হঠাৎ?? শুভ্র ভাইয়া রাগী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন…
এতো দরদ ওর জন্য তোর?তুই আমাকে টাকা দেখাচ্ছিস সাহেল??মনে রাখিস টাকা তোর থেকে আমার কম নেই।।টাকা আমার যথেষ্টই আছে যা নেই তা হলো মনের শান্তি।।আর এই মেয়েকে শাস্তি দিলেই সেই শান্তিটা পাবো।। সো গাইস??ওকে কি শাস্তি দেওয়া যায় বল তো??
শুভ্র প্লিজ ছেড়ে দে।।ছোট্ট একটা মেয়ে,,ওর সাথেও তোর জেদ করতে হবে??শাস্তি দিবি তো? ওকে তাহলে একটা কাজ কর…আমাদের এসাইনমেন্ট গুলো ওকে করতে দিয়ে দে।।ওর জন্য ওটাই সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে।।ট্রাস্ট মি!!
কিহ?আমি কি মুর্খ যে আমার এসাইনমেন্ট অন্যকেউ করবে?(রাগী গলায়)
আচ্ছা তোরটা তুইই কর। তুই তো আবার মহাঞ্জানী সানশাইনকে বরং আমাদের ছয়জনেরটা দিয়ে দে। ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টের জন্য মাস্টার্সের ছয় ছয়টা এসাইনমেন্ট করা অসম্ভব তাও আবার একরাতে।।তোর কি মনে হয়? এর থেকে কঠিন শাস্তি আর কিছু হতে পারে??
শুভ্রর মুখ দেখে মনে হচ্ছে সাহেল ভাইয়ার বুদ্ধিটা তার তেমন একটা মনে ধরে নি।।তবুও সবার কথায় মেনে নিলো সে।।আমাকে শেষ বারের মতো ওয়ার্নিং দিয়ে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আবারও ফিরে তাকিয়ে গলায় থাকা কামড়ের দাগটাকে লক্ষ করে বলে উঠলেন…
রোমান্স কিছু কমিয়ে করো।এভাবে স্ট্যাম্প লাগিয়ে ঘুরলে মানুষ পতিতালয়ের বাসিন্দা ভাববে(তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)নাকি তুমি ওই জায়গারই?হতেও পারো।
কথাটা বলেই উনি হনহন করে বেরিয়ে গেলেন লাইব্রেরি থেকে।।এতো সুন্দর একটা ছেলের কথাগুলো এতোটা তিক্ততাপূর্ণ কি করে হতে পারে?দিনে তিনবেলা করলার জুস খায় নাকি??তিতা করলা কোথাকার।।উনার কথাটা শুনে কান্না পাচ্ছে আমার।শুধু শুধু কান্না নয় ফ্লোরে পা ছড়িয়ে মরাকান্নার মতো কান্না করতে ইচ্ছে করছে।।এই ছেলেটা কতো সহজে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলে গেলো?? মেনার্সহীন বুইড়া।শুধু গলায় কেন দরকার পড়লে সারা শরীরে স্ট্যাম্প লাগিয়ে ঘুরবো তাতে তোর বাপের কি??ইডিয়ট।লাইব্রেরিতে মাস্টার্সের বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি আর উনার বলা কথাগুলো ভেবে চোখের পানি ঝরাচ্ছি।মানুষ কতোটা খারাপ হতে পারলে এভাবে বলতে পারে,সেটাই ভাবছি।।উনার কথা শুনে মাঝেমাঝে মনে হয়,আমাকে অপমান করার জন্যই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছেন উনি।।একঘন্টা যাবৎ পাতা উল্টিয়েও এদের বইয়ের আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না ।।
মাথাটা পুরাই হ্যাং মেরেছে বলে মনে হচ্ছে।।এটা যে আমার পক্ষে সম্ভব না তা এতোক্ষণে বেশ বুঝা হয়ে গেছে।।ইনোসেন্ট মার্কা অসহায় ফেস নিয়ে বইয়ের উপর মাথা রেখে আকাশ পাতাল চিন্তা করছি।।এভাবে টেবিলে মাথা রেখেই যে কখন ঘুমের সাগরে পাড়ি জমিয়েছি খেয়ালই ছিলো না….কতোক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না তবে কোনো পরিচিত ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙলো আমার।।চোখ মেলে দেখলাম চারপাশে কেউ নেই।।আমি একা বসে আছি পুরো লাইব্রেরিতে।।হাই তুলতে তুলতে সামনের দিকে তাকাতেই একটা খাতার দিকে চোখ পড়লো।।সামনে রাখা একটা খাতার মাঝ বরাবর আটকানো একটা লাল রঙের কাগজ।কাগজটা নিতে গিয়ে খাতাটা খুলেই অবাক হলাম আমি।।খাতাটায় এসাইনমেন্টটা করা!!!কিভাবে সম্ভব?হাতের লাল কাগজটাই চোখ বুলালাম…সেখানে গুঁটি গুঁটি অক্ষরে লেখা-“আমার ঘুমন্ত পরী,,এইযে প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে তোমার নেশায় জড়াচ্ছো আমায়।।পরে সামলাতে পারবে তো???” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাকি খাতাগুলো চেক করলাম।নাহ্,, শুধু একটাই করা।।
বাকিগুলো একদম ফাঁকা।। তবুও আমার খুশি দেখে কে।।এই এসাইনমেন্ট টা কপি মারলেই তো হয়ে গেলো থেংক গড যে আমায় এই মোটা মোটা বইগুলো পড়তে হবে না।।তবু সবশেষে একটা চিন্তা থেকেই যায়,,কে সে ব্যাক্তি??কালকের লোকটা আর আজকের লোকটা যে সেইম তা বেশ বুঝতে পারছি আমি।।কিন্তু কে হতে পারে তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না।।উফফ কালকে যাকে গালি দিয়েছি আজকে তাকে এতোটাও খারাপ মনে হচ্ছে না একটা থেংক্স দিলেও দেওয়া যেতে পারে।।।চিত্রাকে ইমোশনাল ব্লেকমেইল করে,,ভাইয়াকে ঘুষটুস দিয়ে,, তিনজনে মিলে পাঁচটা খাতার এসাইমেন্ট শেষ করলাম রাত ৪ টায়।।লিখতে লিখতে হাতের অবস্থা শেষ।ব্যাটা খাটাস!!তোর বউ ভেগে যাবে দেখে নিস।।মাসুম বাচ্চার উপর এতো টর্চার আল্লাহর সহ্য হবে না হুহ।।দেরিতে ঘুমাতে যাওয়ায় ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ৯ টা।যার ফলাফল, আজকেও প্রথম ক্লাসটা মিস।
তাড়াহুড়ো করে ভার্সিটি গেলাম আমি আর চিত্রা।।গেইটের সামনের পার্কিং এর পাশে বটতলায় আড্ডা দিচ্ছে শুভ্র ভাইয়ার গ্যাং।।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে।।আমাদের দেখেই একটু নড়ে চড়ে বসলো শুভ্র ভাইয়া।।বাইকের উপর বসে ছিলেন উনি এবার নেমে এসে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন।।উনাকে দেখে মনটা আপনা আপনিই বলে উঠলো,, বাহ!!লোকটি কি সুন্দর করে দাঁড়াতে পারে।।উনি আজ কফি কালার একটা শার্ট পড়েছেন।।শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটানো।।পরনে হোয়াইট জিন্স।হালকা ব্রাউন সিল্কি চুলগুলো খুব গুছিয়েই পড়ে আছে উনার কপালে।।ডান হাতে ব্রেন্ডেট ঘড়ি,, বাম হাতে ব্ল্যাক ব্রেসলেট টাইপ কিছু একটা পড়ে আছেন।।দুধসাদা শরীরে কফি কালার রঙটাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রং বলে মনে হচ্ছে আমার।।চিত্রার খোঁচা আর ফিসফিস কথায় এসব কল্প কাহিনী বাদ দিয়ে মাথা নিচু করে ওর দিকে আড়চোখে তাকালাম….
দোস্ত…শুভ্র ভাইয়াকে পুরো চকলেট বয় লাগছে রে।।ইচ্ছে তো করছে…(ফিসফিস করে)
তোর ইচ্ছে কে পুটলিতে বন্ধ করে রেখে দে।অন্যের বরের দিকে খারাপ নজরে তাকাস বদ মাইয়া।(দ্বিগুন ফিসফিসিয়ে)
আরে…অন্যের বর আগেই কেমনে বলিস?আমারও তো হতে পারে।।
আমি কিছু বললাম না শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম,, হ্যা হতেও পারে।।চিত্রার মতো সুন্দরী মেয়ের জন্য এটা অবিশ্বাস্যকর কিছু না।।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক তখনি শুভ্র ভাইয়া শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন..
তোমাদের ফিসফাস শেষ?এবার ওদের এসাইনমেন্ট টা দিয়ে বিদেয় হও।
আমি ব্যাগ থেকে খাতাগুলো বের করে এগিয়ে দিতেই পাশ থেকে একটা ছেলে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো।।সেখান থেকে একটা খাতা এগিয়ে দিলো শুভ্রর দিকে।।শুভ্র খাতাটা নিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে লেগে গেলো।।আর আমার চোখ খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখতে লেগে গেলো।।উনার ডার্ক পিংক ঠোঁট দুটো একটা আরেকটার সাথে চেপে ধরে খাতার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি।।গভীর শান্ত চোখগুলোর ঘন পাপড়ি একটু পড় পড় কেঁপে কেঁপে উঠছে।।আমি উনার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উনি খাতা থেকে একবার চোখ তুলে আমাকে দেখে নিয়ে আবারও খাতায় মুখ ডুবালেন।।উনার চাহনী টা কি স্বচ্ছ।।আচ্ছা মানুষ এতোটা পার্ফেক্ট কি করে হতে পারে?হাউ??হঠাৎই থুতনির কাছের তিলটা নাড়িয়ে কথা বলে উঠলেন উনি,,,
সাহেল?হেল্প যখন করেছিসই লুকিয়ে করার দরকার ছিলো না।।সামনাসামনিই করতে পারতি।।
মানে কি?(অবাক হয়ে)
মানেটা খুবই পরিষ্কার সাহেল।ফাস্ট ইয়ারের কোনো স্টুডেন্টের পক্ষে মাস্টার্সের এসাইনমেন্ট করা যে সম্ভব নয় তাও আবার একরাতে তা তুই এবং আমরা সবাই বেশ ভালো করেই জানি।।তবু এই মেয়ে করেছে।বলতে গেলে বেশ গুছিয়েই করেছে।এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে করেছে?উত্তরটা হলো সাহেল তুই ওকে হেল্প করেছিস।।ওর প্রতি তোর প্রেম, দরদ সব আমাদের আগে থেকেই জানা সাহেল।। সো ড্রামা কমিয়ে কর।
আরে আমি কেন করতে যাবো হেল্প? ও আমার বউ না গার্লফ্রেন্ড?
তোর বেডরুমের খবর তো আমার জানার কথা না সাহেল…
কথাটা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে।ছিহ্…মানুষের মনমানসিকতা কতোটা নিচু স্তরের হতে পারে তার উজ্জল দৃষ্টান্ত উনি।চিত্রাও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।।সাহেল ভাইয়াও বেশ অপ্রস্তুত ফিল করছেন বলেই মনে হচ্ছে।শুভ্র ভাইয়া এমন কিছু বলবে ভাবতে পারেন নি উনি।।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগী গলায় বলে উঠলেন উনি…
শুভ্র?এবার লিমিট ক্রস করছিস তুই?
এখন কি এই মেয়ের জন্য আমার সাথে ঝগড়া করবি?নাকি আমার সাথে যাবি? অনেক কাজ আছে।
কথাটা বলে হাতের খাতাটা সাহেল ভাইয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়েই সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে হাঁটা দিলেন উনি।একটু পর তার পিছু নিলেন সবাই।সাহেল ভাইয়াও আমার দিকে একটা নীরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেলেন নিজের গন্তব্যে।। আমি জাস্ট দাঁড়িয়ে আছি।।মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।।এখানে ভর্তি হওয়ার পর যেসকল কথা আমায় শুনতে হচ্ছে তা হয়তো এই ১৮ টা বছরে আর কখনো শুনতে হয় নি।।
আজ ভার্সিটিতে অরিনটেশন।।সবাইকে বড় আপুরা শাড়ি পড়ে যেতে বলেছেন।।আমি আর চিত্রা নীল শাড়ি পড়বো।।আমার রেডি হওয়া শেষ, তেমন কিছুই করিনি।।শাড়ি পড়ে, চুলগুলো খোলে দিয়ে চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়েছি ব্যস!!মেকাপ জিনিসটা আমার জন্য আস্ত একটা বিরক্তির বিষয়।।সবকিছু কমপ্লিট করে যেই না বের হবো তখনই চিত্রা মুখ ফুলিয়ে আমার বাসায় এসে হাজির।।শাড়িটাও পড়ে নি সে…দেখেই মেজাজটা গরম হয়ে গেলো আমার।৯ঃ৩০ বেজে গেছে প্রায় আর সে এখনও তৈরিই না।।এই হারামির জন্য আজ আবারও রেগ খেতে হবে আমাদের।।ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে উঠলাম….
কি সমস্যা তোর??শাড়ি পড়িস নি কেনো??
আমি যে শাড়ি পড়তে পারি না জানিস না তুই?বকবি না একদম। অনেক চেষ্টা করেছি বাট হচ্ছেই না(চশমা ঠিক করতে করতে)
বকবো না ঠাডায় চড় লাগাবো।। ফাজিল মেয়ে।।এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।
আমি ওকে শাড়ি পড়াচ্ছি আর ও বকবক করছে।। ওর একমাত্র চিন্তার বিষয় হলো সে শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারে না যদি স্টেজে গান গাইতে উঠার পর সবার সামনে শাড়ি খুলে পড়ে যায় তখন কি হবে??ওর এসব ফাউল পেচালে বিরক্ত হয়ে শান্ত গলায় বলে উঠলাম….
কি আর হবে?সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে সিটি বাজাবে।
তুই মজা করছিস?
না করছি না।।যা সত্য তাই বলছি।
ও আমার দিকে কাঁদো কাঁদো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমি ওকে পাত্তা দিলাম না।।এই মুহূর্তে আমি ওর উপর চরম বিরক্ত।এক তো লেইট করেছে দ্বিতীয়ত ওকে শাড়ি পড়াতে গিয়ে আমার শাড়ির অবস্থা বেকাহিল।।অবশেষে ভার্সিটি পৌঁছালাম।অনেক লেইট হয়ে গেছে বুঝতেই পারছি।তাড়াতাড়ি যে পা চালাবো তার উপায়ও নেই।।চিত্রা এতো আস্তে আস্তে হাঁটছে যেন সে নয় মাসের প্রেগন্যান্ট।যত্তসব।।এই মাইয়াকে এই মুহূর্তে তোলে আছাড় মারতে ইচ্ছে করছে আমার।।হঠাৎ কি মনে করে দাঁড়িয়ে পড়লাম।কপাল কুচঁকে গেলো অটোমেটিকলি।।আমার সিক্সসেন্স বলছে কেউ আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমায় দেখছে।।কিন্তু কে সে??
চিত্রাকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে চারপাশে তাকিয়ে সেই চোখে দুটোর সন্ধান করছি।কিন্ত কোথাও কেউ নেই।তবু কেনো যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না মনে হচ্ছে কেউ একজন তো আছে যে,, গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখে চলেছে আমায়।।একহাতে শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে ডানপাশের রাস্তাটির দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো কেউ। পেছনে তাকিয়ে দেখি সাহেল ভাইয়া উনিও নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়েছেন।বেশ সুন্দর লাগছে।।উনাকে দেখা হালকা হাসলাম।উনিও হালকা হেসে বলে উঠলেন…
কেমন আছো সানশাইন?
জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো,আপনি?
এইতো বেশ আছি।শাড়িতে তোমাকে বেশ মানিয়েছে আজ আর বাচ্চা লাগছে না তোমায়।(মুচকি হেসে)
উনার কথায় হাসলাম কিছু বললাম না।।আমারও জানতে ইচ্ছে করছে সেই গোপন ছেলেটা আসলে কে?? উনি??আমি উনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আমার চোখে হাজারও প্রশ্ন থাকলেও উনার চোখে কোনো উত্তর খুঁজে পেলাম না একদম শান্ত এক জোড়া চোখ।।আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবারও বলে উঠলেন উনি….
চলো হাটঁতে হাটঁতে কথা বলি?
জি চলুন…
কথাটা বলেই হাঁটা দিলাম উনার পাশাপাশি।। এখনও সেই একই অনুভূতি!! কেউ দেখছে আমায়!!হঠাৎই উনি বলে উঠলেন…
শুভ্রর কথায় কিছু মনে করো না সানশাইন।ওর যে কি হয়েছে আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।।ও আমার ছোট্ট বেলার ফ্রেন্ড,,ওকে কখনো মজা করেও মেয়েদেরকে হার্ট করতে দেখি নি।।ও খুবই ভদ্র একটা ছেলে বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি।।তুমিই একমাত্র মেয়ে যার সাথে ও এতোটা বাজে বিহেভ করে।সেদিন যে কথাগুলো ইউজ করলো সেগুলো সে কোনো বাজে মেয়েকেও কোনোদিন বলতে পারবে না বলে আমার ধারনা ছিলো।।কিন্তু আমি হতাশ।।তোমার প্রতি ওর ব্যবহার খুবই অগোছালো।আমরা রেগিং করি বাট মেয়েদের রেসপেক্টটা রেখেই করি বাট ও….
এসাইনমেন্টটা কি আপনি করে দিয়েছিলেন?
আমার হঠাৎ এমন কথায় অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন উনি।।তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন…
এসাইনমেন্টটা সত্যি তোমায় কেউ করে দিয়েছিলো??
আপনি করেন নি??
আমি উত্তরের বদলে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম উনাকে।।উনি সাবলিলভাবেই বলে উঠলেন…
না।আমি কেনো করতে যাবো বলো তো?শুভ্রও আমায় সন্দেহ করছে।আমার হেল্প যতটুকু করার সবার সামনেই করার চেষ্টা করেছি।।আমি শুভ্রর মতো এতো ব্রিলিয়ান্ট নই আর তাছাড়া আমার যদি এসাইনমেন্ট দেওয়ারই হতো তাহলে সরাসরিই দিতাম এতো লুকুচুরির তো কিছু নেই।।শুভ্রর বিহেভিয়ারটা তোমার প্রতি বেশি বাজে হয়ে যাচ্ছিলো তাই ওকে কন্ট্রোল করার জন্য এমন একটা শাস্তি দিতে বলি বাট দেখো ব্যাপারটা আরো উল্টো হলো।।তোমার প্রতি ওর বিহেভ খারাপ হয়েই চলেছে দিন দিন।।
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি কিছু বলছি না।।কি বলবো বুঝতেও পারছি না।।বারবার হতাশ হতে হচ্ছে আমায়।।কে সে?সাহেল ভাইয়া কি মিথ্যা বলছে আমায়?মিথ্যা বলে লাভই বা কি উনার।।উফফ…চিন্তায় করতে পারছি না আর।।সাহেল ভাইয়া আবারও বলে উঠলো…
কিছু বলছো না যে?
না এমনি(মুচকি হেসে)
একটা জিনিস খেয়াল করেছো??কাকতালীয় ভাবে হলেও আমাদের ড্রেসের কালারটা কিন্তু বেশ ম্যাচিং হয়ে গেছে।।তোমার বান্ধবীকেও দেখলাম সেইম কালার শাড়ি পড়েছে।।
হুম দুজন প্ল্যানিং করেই পড়েছি।
আমি আর শুভ্রও প্ল্যান করে পড়েছি।।ও হ্যা আজ শুভ্রও নীল পাঞ্জাবী পড়েছে।
ওহ
শুভ্রর নামটা শোনার সাথে সাথে বিতৃষ্ণায় ভরে গেলো মন।এই একটা মানুষকে আমার অসহ্য লাগে।।আমি কাউকে ঘৃনা করতে পারি না যদি পারতাম তাহলে উনিই সেই লিস্টে প্রথম হতেন।।সাহেল ভাইয়া আমাকে বাই বলে নিজের কাজে চলে গেলেন।।সামনে বেশ ভীর। চিত্রা স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওখান থেকেই হাতের ইশারায় ডেকে চলেছে আমায়।তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমি ওর কাছে না গেলে সে মরেও যেতে পারে।।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে ভীরের মধ্যেই হাঁটা দিলাম সেদিকে।।কিছুটা ভেতরের দিকে যেতেই কারো হাতের স্পর্শ পেলাম আমার পেটে সাথে আঁচড় লাগার মতো ব্যাথা।।আশেপাশে প্রচুর মানুষ,, কে এমনটা করতে পারে বুঝতে পারছি না,,তবে স্পর্শটা চেনা।।তাড়াতাড়ি ভীর থেকে বেরিয়ে এসে পেটে হাত দিয়ে দেখলাম রক্ত বেরিয়ে গেছে।।কেউ নখ দিয়ে খুব শক্ত করে আচঁড় কেটে দিয়েছে।।জায়গাটা প্রচুর জ্বলছে।।হঠাৎই একটা পিচ্চি ছেলে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।। ছেলেটাকে আমি এর আগেও দেখেছি ভার্সিটির পাশের চায়ের দোকানটাতে।।আমি ছেলেটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সে আমার দিকে এগিয়ে দিলো মলম, টিস্যু আর একটা কাগজ।আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম এসব কে দিয়েছে তোমায়??ছেলেটা গম্ভীর মুখে উত্তর দিলো…”নীল পাঞ্জাবী পড়া ভাইজান” “নীল পাঞ্জাবী” কথাটা শুনেই সাহেল ভাইয়ার কথা মাথায় এলো।।তারপর আবার মনে হলো শুভ্র ভাইয়ার কথা।।আশেপাশে তাকিয়ে দেখি অনেক ছেলেই নীল পাঞ্জাবী পড়েছে।।কার কথা বুঝবো আমি,??তাই আবারও ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম-
নাম কি তোমার ওই নীল পাঞ্জাবী ওয়ালা ভাইজানের?
নাম কইতে মানা করছে।।
কথাটা বলেই ওগুলো আমার হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো সে।।আমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়িটা উঁচু করে দেখলাম তিনটা নখের আচড়।।টিস্যু দিয়ে রক্তটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে দিলাম।।এই ভূতের মতো কাঁধে নেচে বেড়ানো মানুষটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে।। এর সাহস কি করে হয় আমার শরীরে হাত দাওয়ার??হাউ ডেয়ার হিম।।হাতের কাগজের দিকে নজর যাওয়ায় কাগজের ভাজটা মেলে ধরলাম।।সেখানে লেখা-
“” শাড়ি পড়েছো ঠিক আছে। তোমার ফর্সা পেটটা কি সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে?শাড়ি ঠিক না রাখতে পারলে পড়ো কেন??নাকি দেখাতে চাও সবাইকে যে তুমি কতো সুন্দর?ছেলেরা কিভাবে তাকাচ্ছিলো সে খেয়াল আছে??কেনো দেখবে তোমায় অন্যকেউ??খবরদার আবার এমন হলে খুন করে ফেলবো তোমায়।।রাগ লাগছিলো খুব তাই এমনটা করেছি বেশি ব্যাথা লাগলে সরি।।তোমার মন খারাপের জন্য আমি দায়ী সেটাও আমি জানি তাই আবারও একটা সরি।। শাড়িটা ঠিক করে নিও প্লিজ “””
চিঠিটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।।এই চিঠি পড়ার পড় ইচ্ছে হচ্ছে সম্পূর্ণ শাড়ি খুলে তারপর বাইরে বের হই।।এরা আমাকে পেয়েছেটা কি??নিজের প্রোপার্টি নাকি??সরি?হোয়াট সরি?তোর সরি দিয়ে কি আমি জুস বানিয়ে খাবো নাকি? ডাফার।।রাগ আর বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে এলাম ওয়াশ রুম থেকে।।অনুষ্ঠান যেদিকে হচ্ছে সেদিকে যেতেই দেখি শুভ্র ভাইয়া আর চিত্রা কথা বলছে।।।দুজনেই যেনো হেসে গড়িয়ে পড়ছে।।শুভ্রকে দেখেই রাগ উঠে গেছে মাথায়।।আর চিত্রার এমন দাঁত কেলানো দেখে ইচ্ছে হচ্ছে ওর কানের নিচে কয়েকটা লাগায়।।ডাফার কোথাকার।।আমাকে যে এতো অপমান করে তার সাথে এতো দাঁত কেলানোর কি আছে বুঝলাম না।।মনটাই খারাপ হয়ে গেলো।।এই মুহূর্তে সব কিছু বিষাক্ত লাগছে আমার কাছে।।আর কিছু না ভেবে ঘুরে দাঁড়ালাম বাসায় ফিরবো বলে।।পেছনে তাকাতেই দেখি অভ্র ভাইয়া।।আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে উঠলেন…
বাহ,, আজ আমাদের বীরবালিকাকে তো খুব মিষ্টি লাগছে কিন্তু মুখটা পেঁচার মতো হয়ে আছে কেন?
এমনি।
ওহ্।মন খারাপ বুঝতে পেরেছি।তো কোথায় যাওয়া হচ্ছিলো??(ভ্রু নাচিয়ে)
বাসায় যাবো ভালো লাগছে না।।কিন্তু আপনি এখানে?
বাবার সাথে আসছি।বাবা তো এই ভার্সিটিরই স্টুডেন্ট ছিলেন।।দুই তিন বছর অধ্যাপনাও করেছেন।।সেই সুবাদে উনাকে ইনভাইট করা হয়েছে।।বাবা সাথে করে এসিস্ট্যান্ট হিসেবে আমাকেও নিয়ে এলেন হাহাহাহা।।।আচ্ছা,, এসব ছাড়ো অনুষ্ঠান তো শুরুই হয় নি তো এখনই বাসায় যাচ্ছো কেন?
ভালো লাগছে না।।চলে যাবো।দম বন্ধ লাগছে এখানে।
আচ্ছা তাহলে এট লিস্ট বাবার সাথে দেখা করে যাও।তোমার ভালো লাগবে।।ওই তো বাবা…
তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৫+৬
আমার পেছনের দিকে ইশারা করে বলে উঠলেন কথাটা।।আমি পেছন ফিরে মামুকে দেখতে পেলাম।উনি আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শুভ্রর সাথে গল্প করছেন।শুভ্রও বত্রিশ দাঁত বের করে বেশ ভদ্রভাবে কথা বলে চলেছে।।শুভ্রকে দেখে মামুর সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাই চলে গেলো।।তাই অভ্র ভাইয়াকে কোনোরকম বুঝিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে।।একা একা হাঁটছি রাস্তা ধরে।।পেটের কাঁটায় হালকা পুড়াচ্ছে।।চুলগুলো ছাড়া থাকায় গরমও করছে হালকা।।সেই সাথে চেপে ধরছে হাজারও বিরক্তি।।আজ মনটাকেই আমার বড্ড বিরক্তিকর লাগছে।।ইচ্ছে হচ্ছে মনটাকে বের করে ঘষে মেজে আবার বসিয়ে দিতে পারলে মন খারাপ ভাবটা একটু কমে যেতো হয়তো।।আকাশ-পাতাল কল্পনায় ভর করে আগোছালো পায়ে হেঁটে চলেছে ব্যস্ত রাস্তায়।আজ রিক্সার অভাব নেই।।চারদিকে কতো টুংটাং শব্দ!!!কিন্তু আফসোস আজ এই রিক্সার আমার কোনো প্রয়োজনই নেই….
