বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২
রানী আমিনা
দেমিয়ান প্রাসাদের অদূরে, রেড জোনের ভেতরের বিশাল এরিয়ে জুড়ে তৈরি হচ্ছে একটা বিরাট ফার্ম হাউজ। ইটের ওপর ইট বসিয়ে সেটাকে গড়ে তোলা হচ্ছে ক্রমে ক্রমে। এক ঝাক অস্ত্রধারী গার্ড দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, পাহারা দিচ্ছে সেখানে কর্মরত কর্মীদের, যেন কেউ পালিয়ে যেতে না পারে।
ফার্ম হাউজ তৈরির কাজে নিয়োজিত আছে কয়েক ঝাঁক বন্দি। সকলের হাতেই পুরু মেটালের রিং, গলায় মেটালের বকলস। লম্বা শেকল দিয়ে দুহাতের রিংদ্বয় একত্রে বেধে দেওয়া, যেন কাজে অসুবিধা না হয়।
বন্দিদের এক দল থরে থরে সাজিয়ে রাখা ইটের বহর থেকে ইট নিয়ে পৌছে দিচ্ছে সাইটে, একদল ইটের ওপর ইট সাজিয়ে সিমেন্ট বালু দিয়ে ফার্ম হাউজটাকে দাড়া করানোর কাজে ব্যাস্ত, আর অন্যরা সাইটের এক পাশে তৈরি করছে বালু ও সিমেন্টের মিশ্রণ। ঘর্মাক্ত শরীরে ধুলোবালি আর মাটি মিশে চিকচিক করছে তাদের৷
পাহারা দিতে থাকা গার্ডগুলোর চোখে তীক্ষ্ণ নজর। সুচারু রূপে পর্যবেক্ষন করে চলেছে তারা শ্রমিকদের কাজ। হাতে শক্ত করে ধরা ভারী অস্ত্র, কাজে ভুল হলেই অস্ত্রের আঘাত গিয়ে পড়বে শ্রমিকদের ওপর।
বেতের তৈরি লম্বাটে ঝুড়ি গুলোর ভেতর একের পর এক ইট সাজিয়ে দিচ্ছে কয়েকটা ছোকরা গোছের ছেলে। ঝুড়ি গুলো ভর্তি হলে সেগুলোর লম্বা নরম হাতল গুলোকে চা বাগানের শ্রমিকদের মতো করেই কপালের সাথে লাগিয়ে পিঠের ওপর নিয়ে এগোচ্ছে ফ্যালকন, আলফাদ এবং অন্য কজন বন্দি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সকাল থেকে একনাগাড়ে কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে গেছে ফ্যালকন। ওর দুর্বল শরীরটা আর পেরে দিচ্ছেনা। একদিন পর পর এক বেলা করে খাবার দেওয়া হয় ওদের। কোকো লিও কাঞ্জি মিলে নিজেদের ভাগ থেকে অল্প অল্প করে দেয় ফ্যালকনকে, নইলে যে শরীরটা ওর চলতে চায়না!
অন্যদিন ভারী কাজ গুলো কোকো লিও কাঞ্জিরা মিলে করতো। ফ্যালকন সহ অন্য ছেলে গুলোকে তুলনামূলক স্বল্প পরিশ্রমের কাজ গুলো করতে দিতো ওরা। কিন্তু আজ তদারকিতে থাকা গার্ডদের কজন জোর জবরদস্তি করে সবাইকে কাজ বদলে ফেলতে বাধ্য করেছে।
কোকো লিও কাঞ্জি আর হাইনা কে আজ ইট বসানোর কাজে লাগিয়ে দিয়েছে ওরা। ফ্যালকন আর আলফাদকে দিয়েছে ইটের স্তুপ বইতে। ওকামি আর জোভি মিলে সিমেন্ট বালু মেশাচ্ছে এক স্থানে৷
এত ভারী ইটের ঝুড়ি বইতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ফ্যালকনের, মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যেতে চাইছে। হাফাচ্ছে ও রীতিমতো!
বেতের ঝুড়ির হাতলটা মাথায় বেধে পা টেনে টেনে হেটে কোকোদের নিকট আসার মাঝ পথে হঠাৎই মাটিতে পড়ে থাকা পাথরের টুকরোর সাথে হোচট খেয়ে ঝুড়ি ভর্তি ইট সহ মাটিতে শব্দ করে আছড়ে পড়লো ফ্যালকন। বাচ্চা গুলো সবাই চমকে তাকালো সেদিকে।
আলফাদ তাড়াতাড়ি ছুটে এসে ফ্যালকনকে উঠিয়ে দিতে চাইলে পাশ থেকে একজন গার্ড কড়া গলায় বলে উঠলো,
“তুমি তোমার কাজ করো। ওকে ওর মতো ছেড়ে দাও।”
আলফাদ মাথা তুলে চোখ মুখ শক্ত করে তাকালো গার্ডটির দিকে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে গার্ডটি ঝাঝিয়ে উঠে বলল,
“আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছো? চোখ নামাও! নইলে এখনি তোমার চোখ তুলে নিয়ে আসবো!”
আলফাদ কথা বললো না কোনো, চকিতে একবার তাকালো কোকোর দিকে। কোকো ইশারায় বোঝালো ঝামেলায় না জড়াতে। আলফাদ মাটিতে পড়ে থাকা ফ্যালকনের প্রাণপণে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখতে দেখতে ইট ভর্তি ঝুড়ি নিয়ে এগোলো কোকোদের দিকে৷
ফ্যালকন মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালো একবার, চোখে ওর ফুটে উঠলো অসহায়ত্ব! চোখ জোড়া গেলো অদূরেই ফার্ম হাউজের কাছে দাঁড়ানো কোকোর দিকে। বার বার ফ্যালকনের দিকে তাকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করছে ফ্যালকন আসলেই নিজে নিজে উঠে দাড়াতে পারবে কিনা৷
মাথা নামিয়ে নিলো ফ্যালকন। শরীরে ওর ক্লান্তি, মুখ থেকে আর একটা শব্দ বের করারও শক্তি নেই! চোখের সামনে অন্ধকার, দেহটা যেন আর সহ্য করতে পারছে না।
একটু সময় নিলো ফ্যালকন, জোরে দম ছেড়ে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে একটু সোজা করার চেষ্টা করলো।
ইটের বেশিরভাগ এসে পড়েছে ওর পিঠ আর মাথা জুড়ে, আঘাতের ফলে কেটেও গেছে বেশ কয়েক স্থানে। চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে সেসব ক্ষতস্থান থেকে!
কিছুক্ষণ এভাবেই মাটির ওপর পড়ে থেকে অবশেষে দুহাত মাটির ওপর ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো ও, এক হাতে পিঠের ওপর থেকে সরিয়ে দিলো ইটের বোঝা। বেতের ঝুড়ি টা শব্দ করে আছড়ে পড়লো মাটিতে।
উঠে বসলো ফ্যালকন। হাপাচ্ছে ও, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে! হাজার খুজেও গলা ভেজানোর মতো মুখের ভেতর সামান্য লালাটুকুও পেলোনা ফ্যালকন।
কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা, ক্ষতস্থান গুলো যন্ত্রণায় কাতর! দম ছাড়লো ও, তারপর বেতের ঝুড়িটা সোজা করে নিয়ে আবারও তাতে সময় নিয়ে ইট গুলো সাজালো। ঝুড়ির নরম হাতলটা উঁচু করে কপালে এটে পায়ে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আবার। বুক ভরে দম নিয়ে পা বাড়ালো কোকোদের দিকে।
ওকে উঠে দাড়াতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো কোকো। তারপর আবার মন দিলো নিজের কাজে৷ ফ্যালকন চোখের দৃষ্টিতে দৃঢ়তা ফুটিয়ে পিঠের বিশাল ঝুড়িটা বয়ে নিয়ে গিয়ে শব্দ করে রাখলো কোকোর পাশে। তারপর সেখানে বসেই জোরে জোরে দম ফেলতে লাগলো।
ওকে বসে থাকতে দেখে আগের গার্ডটিই আবার বলে উঠলো,
“বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই, এখনি কাজে হাত লাগাও।”
কোকো ইটের সারির ওপর সিমেন্ট বালুর মিশ্রণ লাগিয়ে আর একটা ইট রাখতে যাচ্ছিলো, গার্ডের কথা শুনে ইটটা আবার পূর্বের স্থানে ছুড়ে দিয়ে গার্ডের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে গমগমে গলায় বলে উঠলো,
“ফ্যালকন এখন বিশ্রাম নিবে, ও আর একটা কাজও করবেনা।”
“কে কাজ করবে আর কে করবেনা সেটা আমি ডিসাইড করবো, তুমি নও। চুপচাপ নিজের কাজ করো।
এখন আর শেহজাদা নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান বেঁচে নেই যে তোমাদের মতো জন্তু জানোয়ারকে মানুষের কাতারে ফেলবে। জানোয়ার জানোয়ারের মতো থাকবে!”
তাচ্ছিল্যের সুরে বলল লিডার গার্ডটি।
চোয়াল শক্ত হয়ে এলো কোকোর। কয়েক পা এগিয়ে এসে এক লাফে ও মাটিতে নেমে এলো কনস্ট্রাকশনের ওপর থেকে। ঝনঝন শব্দ হলো ওর শরীরে বাধা শেকলে। তারপর ফ্যালকনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গার্ডটির দিকে ফিরে ও শক্ত গলায় বলে উঠলো,
“আর একটাবার হিজ ম্যাজেস্টিকে কটাক্ষ করে কথা বললে আমি তোমার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো!
ফ্যালকন এখন বিশ্রাম নিবে, এবং যতদিন পর্যন্ত ও পুরোপুরি সুস্থ না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কোনো কাজে হাত লাগাবে না৷”
“যে মরে গেছে তাকে নিয়ে এত আদিক্ষেতা করিসনা, শিরো মিদোরি এখন বাদশাহ জাজীব ইলহান দেমিয়ান শাসন করছেন, তোদেরকে যে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন এটাই তোদের কপাল।
তাই এসব হিরোগিরি বাদ দিয়ে কাজে হাত লাগা, নইলে শেহজাদা নামীর আসওয়াদকে হিজ ম্যাজেস্টি যেভাবে মাটির তলে পুতে ফেলেছেন তোকেও সেভাবেই পুতে ফেলবো, তারপর মাটির নিচে গিয়ে দুজনে মিলে তোদের শেহজাদীর জন্য শোক করিস।
যে দরদ দেখি তোদের, তাতে তো মনে হয় সে আমলে দাসীতে না পোষানোয় অ্যানিম্যাল টাউনে গিয়ে শেহজাদা নামীর আসওয়াদ তোদেরকে জন্ম দিয়ে এসেছিলেন, নইলে এত আহ্লাদ আসবে কোথা থেকে?”
গার্ডের কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই হাতের মুঠি শক্ত হয়ে গেলো কোকোর। দাঁতে দাঁত পিষে, ভারী পা ফেলে তড়িৎ গতিতে ছুটে গিয়ে নিজের বজ্রকঠিন হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ করে ঝড়ো বেগে এক বিশাল ভারী আঘাত বসিয়ে দিলো গার্ডের মুখের ওপর!
কোকোর বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে নিজের জায়গা থেকে ছিটকে ডানদিকে গিয়ে আছড়ে পড়লো গার্ডটা। চোখের সামনে ঝিরিঝিরি দেখার কারণে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলো সেখানেই।
কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাড়ালো। ঠোঁটের কোণ বেয়ে চুইয়ে পড়া রক্তকে নিজের কনিষ্ঠাঙ্গুলি দিয়ে মুছে কোকোর দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“শালা জানোয়ারের বাচ্চা! এত বড় সাহস তোর তুই আমার গায়ে হাত তুলিস!”
এরপর বাকি গার্ডদের উদ্দ্যেশ্যে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো,
“এই এটাকে এক্ষুনি বেধে ফ্যাল। বেধে এখানেই ফেলে রেখে যাবি, আগামী সাত দিনের ভেতরে ওকে কোনো খাবার পানি কিচ্ছু দিবিনা, কুত্তায় মুখে মুতলে তাই খেয়ে বেঁচে থাকবে৷”
এরপর ফ্যালকনের দিকে নির্দেশ করে বলল,
“সাথে ওই হাড্ডীসারকেও। ওটাকে গাছে ঝুলাবি, উলটো করে। খুব বাড় বেড়েছে সবগুলোর, হ্যাঁ? আমাকে মারতে আসে, আমার কথার অবাধ্য হয়! সবগুলোকে আজ দেখে ছাড়বো আমি!”
লিডারের কথা শুনে কাজে লেগে পড়লো সবাই। এগিয়ে এসে, লিডারের দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে স্থীর দন্ডায়মান কোকোকে সকলে মিলে ধরে ওর দুহাতে বাধা মেটালের পুরুষ্টু বেড়ীর মধ্যকার শেকলের দুরত্ব কমিয়ে একত্রে বেধে দিলো ওর দুই হাত। অন্য একজন এক জোড়া পুরু ধাতব বেড়ী পরিয়ে দিতে নিলো ওর পায়ে।
লিডারের আদেশ অনুযায়ী ফ্যালকনের পায়ে বাধা হলো দড়ি। ফ্যালকনকে টেনে পাশের মোটাসোটা গাছটির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো ওরা উলটো করে ঝুলিয়ে রাখার জন্য।
বাচ্চারা সকলে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ, কিচ্ছু করার নেই ওদের। গলায় ওদের সকলেরই মেটালের পুরু বেড়ী পরানো, ঢোক গিলতে গেলেও ধাতব বন্ধনীর সাথে বেধে যাচ্ছে কণ্ঠমণি। গলার এই বেড়ী ভেঙে ফেলা ওদের কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, আর তাই এই অবস্থায় নিজেদের অ্যানিম্যাল ফর্মে এলে ওদের গলা কাটা পড়বে সম্পুর্ন!
এখন চুপচাপ দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই ওদের হাতে।
গার্ডগুলো ফ্যালকনকে টেনে গাছের নিকট নিয়ে যেতেই ঝাঝিয়ে উঠলো কোকো। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত গলায় লিডারের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“ফ্যালকনের যদি আজ কিচ্ছুটি হয় তবে আমি তোদের একটাকেও ছেড়ে দেবোনা, সবগুলোকে এখানেই গেড়ে রেখে দেবো মনে রাখিস!”
কোকোর এমন হুমকিতে লিডার গার্ডটি শব্দ করে বাকা হাসলো। ফ্যালকনকে বাঁধতে গিয়েও থেমে যাওয়া গার্ড গুলোর দিকে চেয়ে ইশারা দিলো ফ্যালকনকে ঝুলানোর কাজ শুরু করতে। সাথে সাথেই ফ্যালকনের পায়ে বাধা দড়িটা নিয়ে একজন তরতর করে উঠে গেলো গাছে, এরপর দড়ি টেনে টেনে ফ্যালকনকে শূন্যে উঠিয়ে ঝুলিয়ে দড়ির মধ্যাংশ শক্ত করে বেধে দিলো গাছের মোটাসোটা শক্তপোক্ত ডালে। কোকো নিজের স্থানে স্থীর দাঁড়িয়ে শক্ত চোখে চেয়ে রইলো উলটো হয়ে ঝুলে থাকা ফ্যালকনের দিকে। ভেতরে ভেতরে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইলো ও।
লিডার কোকোর দিকে এগিয়ে এসে বলল,
“খুব দরদ না?”
কিন্ত কোকো কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই লিডার পাশে থাকা একটা গার্ডকে ইশারা করলো কিছু, তখনি গার্ডটি পাশ থেকে একটা শক্তপোক্ত গাছের ডাল তুলে নিয়ে ঝুলে থাকা ফ্যাককনের কাছে এগিয়ে গিয়ে সজোরে আঘাত করলো ফ্যালকনের পিঠে!
দুর্বল ফ্যালকন ইটের আঘাত পেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়ার আগেই পিঠের ওপর দ্বিগুণ জোর আঘাত পেয়ে দিশেহারা হয়ে উঠলো যেন। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে কোকোর দিকে অসহায় চোখে চেয়ে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, যন্ত্রণায় কয়েকবার বড় বড় দম ফেলে চোখ উলটে জ্ঞান হারালো মুহুর্তেই। তৎক্ষনাৎ নিস্তেজ হয়ে এলো ওর শরীর, হাত জোড়া অভিকর্ষের টানে শব্দ করে ঝুলে গেলো মাটির দিকে, ঝনঝন করে উঠলো হাতে বাধা শেকল।
আর ফ্যালকন জ্ঞান হারানো মাত্রই রাগে ক্ষোভে চিৎকার দিয়ে উঠলো কোকো! হাতে বাধা ধাতব বেড়ি থেকে নিজের হাত জোড়া ছাড়ানোর জন্য সজোরে টানা হ্যাচড়া করতে লাগলো ও, ধাতবে ধাতবে ঘষা খেয়ে বিকট শব্দে ছেয়ে গেলো সম্পুর্ন এরিয়াটা৷
লিডার গার্ডটি অবস্থা বেশি ভালোনা দেখে দ্রুত একজনকে আদেশ দিলো আরও মোটা শেকল নিয়ে আসতে। লোকটা ছুটে গিয়ে কোথা থেকে আরও বিশাল একটা শেকল কাঁধে তুলে মাটি দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে এলো।
লিডার গার্ড আর তার সাথে আরও কজন মিলে শেকলসুদ্ধ এগিয়ে গেলো ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকা কোকোর দিকে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোকোকে কিয়ৎক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো সে, কোকোর এই ছটফটানি ভীষণ উপভোগ করলো যেন!
এরপর কোকোর হাতে মাত্র আনা মেটালের শেকলের চওড়া বেড়ী দুটো পরাতে যাওয়া মাত্রই কোকো গর্জে উঠে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের মাথা দ্বারা আঘাত করলো লিডার গার্ডের মুখ বরাবর।
মুহুর্তেই যন্ত্রণায় চিৎকার দিয়ে উঠে পেছন দিকে ছিটকে পড়লো লিডার গার্ডটি, নাক দিয়ে গল গল করে পড়তে লাগলো রক্ত। আঘাতের তোপে এই মুহুর্তে চোখে তার সবকিছু অন্ধকার!
বাকি গার্ডগুলো লিডারকে মাটিতে এভাবে যন্ত্রণায় মোচড়ামুচড়ি করতে দেখে দ্রুত ছুটে গিয়ে তুললো তাকে। শেকলটি পড়ে রইলো মাটিতে।
কোকো তখনো লিডারের দিকে তাকিয়ে ক্ষেপে যাওয়া ষাড়ের মতো ফুসতে লাগলো ক্রোধে, দম পড়তে লাগলো ওর ঘন ঘন!
লিডার গার্ডটি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে উঠে বসলো। শকুনি চোখে কোকোর দিকে তাকিয়ে তর্জনী তাক করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“আজ… আজ আমার হাত থেকে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা!”
তার পরেই হাত দিয়ে নিজের আঘাতপ্রাপ্ত নাক চেপে ধরে পাশে থাকা গার্ড গুলোকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“এই সবগুলো মিলে ওকে চেপে ধর!”
লিডারের কথা মতো সবগুলো এসে জাপটে ধরে ফেললো কোকোর হাত পা। হাটুর পেছনে লাথি মেরে ওকে বসিয়ে দিলো মাটিতে, জাপটে ধরলো সজোরে।
শক্তিশালী মাথাখানা দিয়ে যেন আবার কাউকে আঘাত করতে না পারে তার জন্য চেপে ধরা হলো ওর মাথাও।
ধস্তাধস্তি আর লোহার বেড়ীর ঠন ঠন শব্দে একাকার হয়ে উঠলো রেড জোনের একাংশ। কোকো ওদেরকে নিজের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে রাখতে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“শুয়ো**রের বাচ্চারা, এক বাপের সন্তান হোস তো বাধন খুলে দিয়ে লাগতে আয়!”
লিডার টি দূরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে নিলো নিজের নাক থেকে বের হওয়া রক্তের ফোয়ারা। তারপর এগিয়ে এসে কোকোর পাশে দাঁড়িয়ে সজোরে একটা লাথি মেরে দিলো কোকোর মুখে।
শক্ত বুটের লাথি খেয়ে কোকোর ঠোঁটের কোণা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলো রক্ত, কেটে গেলো চোয়ালের কিয়দংশ।
লাথির চোটে হাঠাৎ করেই খেই হারিয়ে ফেললো ও৷ আর ওকে দুর্বল করতে পারা মাত্রই সকলে মিলে মাটিতে ফেলে সজোরে ঠেসে ধরলো ওকে!
মরিয়া হয়ে ছটফট করতে লাগলো কোকো, মুখ থেকে হিংস্র গর্জন বেরিয়ে এলো ওর। সমস্ত শরীর শক্ত করে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো সবাইকে, যেন কোনোভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে।
কিন্তু দু’জন গার্ড ততক্ষণে মুচড়ে ধরে রেখেছে ওর হাত, একজন চেপে বসেছে ওর বিশাল বিশাল পায়ের ওপর, আরেকজন সরাসরি কোকোর কাঁধের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে মাটিতে ঠেসে ধরেছে ওকে।
লিডার গার্ডটি মাটি থেকে বিশালাকার ভারী ধাতব শেকলটা তুলে এগিয়ে এলো কোকর দিকে, সতর্ক হয়ে এগোলো যেন এবারও কোকো তাকে আঘাত না করে বসে!
কপালে ভাজ ফেলে চোখ তুলে চেয়ে লিডারকে একবার দেখে নিলো কোকো। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য টানা হ্যাচড়া করতে করতে ওকে চেপে ধরে রাখা গার্ডের হাত থেকে হঠাৎ করেই ছাড়িয়ে ফেললো নিজের ডান হাত, তারপর হাত উঁচিয়ে এক ঝটকায় গার্ডটির পরিহিত আর্মরের বুকের কাছ টা ধরে হ্যাচকা টেনে সজোরে আছড়ে ফেললো মাটিতে।
লোকটা আছাড় খেয়ে সেখানেই জমে গেলো, জ্ঞান থাকা সত্বেও এতটুকু নড়তে পারলোনা।
কোকোর এমন কাজ দেখে পাশ থেকে আরেকজন গার্ড ছুটে এসে কোকোর মুখ বরাবর বসিয়ে দিলো আরও একটা শক্ত লাথি!
মুহুর্তেই ঝিমঝিম করে উঠলো কোকোর মাথা, চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এলো ওর, তবুও দমে গেলোনা। আরও একবার গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠে নিজের পিঠের ওপর চেপে রাখা সবগুলোকে সরিয়ে উঠে আসতে চাইলো।
কিন্তু ততক্ষণে লিডার গার্ডটি ঘুরে পৌঁছে গেছে কোকোর পিঠের নিকট, পেছন থেকে দ্রুত হাতে ধাতব শেকলে আটকানো বড়সড় পুরু রিস্ট্রেইন্ট কলার পরিয়ে দিলো সে কোকোর গলায়, পরানো মাত্রই ক্লিক শব্দ করে সেটা সাথে সাথে লক হয়ে গেলো কোকোর গলা চেপে।
পরপর ক্লিক ক্লিক শব্দে একে একে ছটফট করতে থাকা কোকোর পা, কব্জি, কোমরে আটকানো হলো ভারী লোহার রিস্ট্রেইন্ট। কোকো প্রবলভাবে আছড়ে পিছড়ে চেষ্টা করতে লাগলো নিজেকে ছাড়ানোর, মুখ থেকে চাপা হিংস্র শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগলো ওর ক্ষণে ক্ষণে, কিন্তু শক্তিশালী লৌহশেকল গুলোর শক্ত বন্ধনীর চাপে ব্যাথায় কেঁপে উঠলো ওর শরীরের প্রতিটি পেশী!
নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এখন ওর, গলায় বাধা মেটালের কলারটা যেন চামড়ার গভীরে বসে যেতে চাইছে!
হাপরের মতো করে একবার নিঃশ্বাস নিলো কোকো, আর তারপর দাঁতে দাঁত পিষে গজরাতে গজরাতে আবারও দুহাতে ধাতব শেকল ধরে টানা হ্যাচড়া করে করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো একটানা! কিন্তু তাতে আর কোনো কাজ হলোনা!
দম নিলো আবার, তারপর হঠাৎই সমস্ত শক্তি দিয়ে টানতে শুরু করলো শেকল। যেন খুলেই ফেলবে সমস্ত বাধন! দাঁত চেপে, লাথি দিয়ে, কতশত ভাবে ছাড়ানোর চেষ্টা করে চলল পায়ে বাধা বেড়ী গুলো, কিন্তু শেকল টলল না, শুধু গর্জন করে উঠলো ধাতব শব্দে।
কখনো শরীর বাঁকিয়ে, কখনো মাটিতে শুয়ে হাতের শেকল টেনে ধরে, কখনো পায়ের শেকলে চাপ দিয়ে গোড়ালি বের করার চেষ্টা করে ও ছাড়াতে চাইলো নিজেকে।
কিন্তু যতই টানাটানি করলো বন্ধনীগুলো ততই আরও আঁটসাঁট হয়ে দাগ কেটে দিতে লাগলো ওর চামড়ায়।
লিডার গার্ডটি সন্তুষ্ট চিত্তে তাকিয়ে রইলো কোকোর দিকে। তার চোখে দেখা গেলোনা কোনো করুণা; বরং কোকোর এমন ছটফটানি তার কাছে খুব উপভোগ্যই লাগলো।
কোকোকে এত চেষ্টার পর এবার কব্জি বাঁকিয়ে রিং থেকে হাত বের করার চেষ্টা করতে দেখে হাসলো লিডার গার্ডটি। হেসে হেসেই বলল,
“তুই নিজেও জানিস এর থেকে তুই ছাড়া পাবিনা। তোদের জাহান্নামে থাকা বাদশাহই এই আলট্রা স্ট্রং মেটালিক চেইন তৈরি করেছিলো আসামী দের জন্য। আর আজ ভাগ্যের কি পরিহাস, তারই অনুগত জানোয়ারের শরীরে শোভা পাচ্ছে তারই তৈরিকৃত আয়রণ চেইন। একেই বলে আয়রণি!”
বলে শব্দ করে হাসলো লিডার গার্ডটি। তার দেখাদেখি হাসলো সেখানে উপস্থিত অন্যান্য গার্ডগুলো। কোকো হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে, রাগে ক্ষোভে দাঁতে দাঁত পিষে ফেললো ও, বেরিয়ে এলো ওর ধারালো হিংস্র দাঁতের পাটি!
চাইলেও এখন ও নিজের অ্যানিম্যাল ফর্মে যেতে পারবেনা। এই ধাতব শেকল ওর সমস্ত ট্রানসফর্মেশন আটকে রেখে দিয়েছে। চাইলেও আর এখান থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারবেনা। এই মেটালিক চেইনের শক্তি ওর জানা। স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টির যেখানে এই শেকলের একটা ভেঙে ফেলতে মিনিট পাঁচেক লেগেছিলো সেখানে কোকো তো কিছুই না!
ক্রমে শ্বাস ভারী হয়ে আসলো কোকোর, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা! এতক্ষণ টানা হ্যাচড়ার ফলে হাতে, গলায়, কোমরে, পায়ে থাকা লোহার বেড়ীর ঘষায় ছিলে লাল হয়ে গেছে সে সমস্ত স্থান, আর কয়েকবার ঘষা লাগলেই রক্ত বের হতে শুরু করবে ক্ষতস্থান গুলো থেকে!
ক্লান্ত হয়ে তাই অবশেষে শরীরের ভর ছেড়ে দিলো কোকো মাটিতে, ঘন ঘন দম নিয়ে শান্ত করার চেষ্টায় সঁপে দিলো নিজেকে।
সে দৃশ্য দেখা মাত্র শব্দ করে হেসে উঠলো লিডার গার্ডটি। তারপর পাশে থাকা গার্ড গুলোকে উদ্দেশ্য করে আদেশের সুরে বলে উঠলো,
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১
“এই, একে নিয়ে সোজা লাইফট্রির দিকে এগো। আমি আসছি।”
আদেশ পাওয়া মাত্রই কয়েকজন গার্ড এসে শেকল সুদ্ধ কোকোকে মাটিতে টেনে হিচড়ে নিয়ে যেতে লাগলো লাইফ ট্রির দিকে। লিডার অন্য গার্ডদের সহায়তায় বাকি বাচ্চাদেরও ধরে বেধে নিয়ে গেলো কোকোর পেছন পেছন। শাস্তিটা ওদেরও দেখার প্রয়োজন, যেন পরবর্তীতে এমন বেয়াদবি করার আগে শ’বার ভেবে নেয়!
শুধুমাত্র ফ্যালকন একা একা ঝুলে রইলো ওভাবেই, জ্ঞানহীন। রেড জোনের ভারী, ঝড়ো বাতাসে পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগলো ওর পাতলা শরীরটা!
