বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪
রানী আমিনা

কোকো নিভু নিভু চোখে চমকে তাকালো সেদিকে, মনের ভুল ভাবলো। তবুও কিয়ৎক্ষণ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে রইলো সম্মুখে গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে দন্ডায়মান বৃক্ষটির দিকে।
শাখাগুলো উঠে গেছে আকাশ চিরে, পাতারা ঘন হয়ে ঝুলে আছে। প্রতিটি শাখায়, প্রতিটি প্রশাখায় পেঁচিয়ে আছে অসংখ্য পুরনো লতা!
কিন্তু এরপর কোকোকে চমকে দিয়ে, ওর মনের ভুলকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে হঠাৎ করেই রুমঝুম শব্দ তুলে বৃক্ষটির বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক সুক্ষ্ম সোনালি আলোর ছটা! একটু একটু করে সুক্ষ্ম আলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রেখা গুলো নকশিকাঁথার নকশার ন্যায় এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে পড়লো বৃক্ষটির সমস্ত শরীরে! পাতাগুলো ঝলমলিয়ে উঠলো, যেন সেগুলোর মাঝে গেঁথে দেওয়া হয়েছে তারার সোনালী আলো।

আলোর তীব্রতা বাড়তে বাফতে বৃক্ষের বুক চিরে বের হওয়া আলোক রশ্মির উৎপত্তিস্থলে ক্রমে ক্রমে দেখা দিলো একটি সুক্ষ্ম ফাটল, ফাটলের আলো ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে মুহুর্তেই।
ধীরে ধীরে আরও প্রসারিত হতে হতে ফাটলটি একসময় রূপ নিলো একটি বিশাল খোলা দরজায়।
কোকো স্বপ্নাভ দৃষ্টিতে তখনো তাকিয়ে সেদিকে, বাস্তব আর কল্পনার মাঝে ঠাহর করতে অপারগ! সে বুঝতে পারলোনা কেন তার বেদনাবিধুর কল্পনা গুলো হঠাৎই আলো ঝলমলে হয়ে উঠলো!
কোকোর চোখের সামনে এবার সেই বিরাট দরজার মধ্য থেকে হঠাৎই উদ্ভাসিত হলো এক মোহময় সিঁড়ি—স্বচ্ছ, স্ফটিকের ন্যায় চকচকে, যেন আকাশের সমস্ত নক্ষত্ররাজী এতে গলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছে কেউ!
সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ একে একে এসে জড়ো হলো একটির পর একটি, হয়ে উঠলো ঠিক চাঁদের ন্যায় আলোকিত!
কোকো অবাক চোখে দেখতে রইলো দৃশ্য, চোখের পলক ফেলাতেই যেন ভুলে গেলো সে৷ বৃষ্টির বড়ো বড় শক্ত ফোটাও ব্যর্থ হলো ওর মনোযোগ টলাতে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অদূরেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড দুটো বিস্ময়ে হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝলমলে সিঁড়িটির দিকে। হাতের সিগারেট কখন মাটিতে পড়ে গেছে বলতে পারেনা৷ ডার্ক প্যালেসে থাকাকালীন সময়ে ওরা সারাজীবন শুনে এসেছে লাইফ ট্রি নামক বিস্ময়কর গাছটির কথা, কিন্তু আজ স্বচক্ষে দেখার পর ওদের নিজেদের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না!
কিন্তু তার পরেই কোকো সহ গার্ড দুটোকে অবাকের চরম সীমায় নিয়ে গিয়ে সিঁড়িটির সূচনা স্থলে দৃষ্টি গোচর হলো স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো, নরম, শ্বেতশুভ্র একটি পা, সিড়ির পরের ধাপেই এই অনিন্দ্য সুন্দর পায়ের মালকিন রাখলো তার অন্য পা টি।

ধীরে ধীরে একটা একটা করে পা ফেলে সুরের তালের ন্যায় সে নেমে আসতে থাকলো স্বচ্ছ সিঁড়ি বেয়ে।
পিঠময় তার ছড়ানো ঢেউ খেলানো সফেদ চুল, যেন চাঁদের আলো দিয়ে গড়া! নেমে গেছে তা নিতম্বদেশ ছেড়ে আরও নিচে। প্রতি পদক্ষেপে মৃদু আলো ছলকে উঠছে তার পায়ের নিচ থেকে, বেজে উঠছে মৃদু ঝংকার ধ্বনি!
পরণের রক্তিম, পাতলা পোশাক ঝড়ো বাতাসের তোপে উড়ে যেতে নিলো, ঝুম বৃষ্টি এসে জলদস্যুর ন্যায় ঝাপিয়ে পড়লো তার চোখে মুখে!

গভীর, হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখ জোড়া মুহুর্তেই খিচে বিন্ধ করে নিলো সে। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো এক চিলতে স্নিগ্ধ হাসি, বৃষ্টির শীতলতায় মুগ্ধ হওয়া হাসি!
হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে দিলো বৃষ্টির ফোটাকে নিজের সাথে আরও মিশিয়ে নিতে। ভিজে যাওয়া কেশগুচ্ছে বিদ্যুৎ চমকের আলো পড়ে ঝিকিমিকি করতে থাকলো ক্ষণে ক্ষণে!
আপনমনে বৃষ্টির সিক্ত ভালোবাসা উপভোগ করতে থাকা শুভ্র কেশবতীর মনোযোগ নষ্ট হলো একটি বিস্মিত, উৎকন্ঠিত, ব্যাকুল ডাকে,

“আম্মা……!”
আকাশের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে চকিতে তাকালো সে সম্মুখে। ঝলমলে দৃষ্টি এসে পড়লো কোকোর মুখের ওপর। চেনা অচেনার টানাপোড়েনে কিছুক্ষণ দ্বিধাভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সে কোকোর দিকে।
কোকোর বুক কাঁপলো শঙ্কায়, ওর আম্মা কি ওকে চিনতে পারছেনা? আর কি চিনতে পারবেনা? দ্বিতীয়বার আকুল গলায় ও ডেকে উঠলো আবারও,
“আম্মা…!”
শুভ্র রমণীর দ্বিধান্বিত দৃষ্টি খোলশা হলো যেন এবার, নির্বিকার চেহারাটা ভরে উঠলো স্নিগ্ধ, মায়াভরা হাসিতে। রিনরিনে কন্ঠে সে উচ্চারণ করলো,
“কোকো!”

শুভ্র রমনীটিকে কোকো তখনো নিজের ভ্রম বলে ধরে নিলো, ওর আম্মা তো নেই! সে তো অভিমান ভরে চলে গেছে ওদের ছেড়ে! কি করে আবার ফিরে আসবে সে?
ভ্রম ভেবেও হাসলো কোকো। ভ্রমে যদি ওর ঝাঝরা হওয়া বুকটা একটু জুড়ায় তবে ভ্রমই সই!
ভ্রম মনে করেই কোকো নিভু নিভু গলায় তার আম্মাকে জানান দিলো তার এই মুহুর্তের যাতনা,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা, সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে আম্মা আমার! খুব ক্ষিদে পেয়েছে, আমাকে মাছ ভাজা খাইয়ে দেবেন একটু?”
ঝুম বৃষ্টির তোপ কমে এলো সাথে সাথে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি জারি রইলো তখনো! আনাবিয়ার মনোযোগী দৃষ্টি পড়লো কোকোর শরীরের ওপর!

চোখ জোড়া ভয়ানক রকম লাল, রক্তনালি গুলো যেন ফেটে পড়তে চাইছে। মুখের ভেতর থেকে বইছে রক্তের ক্ষীণ স্রোত! শরীরে স্থানে স্থানে ঝলসে গেছে চামড়া, বুকটা ওঠানামা করছে অস্বাভাবিক গতিতে!
সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নেমে ছুটে এলো আনাবিয়া, চেয়ারটির কাছে এসে দুহাতের সাহায্যে সর্বশক্তি দিয়ে টেনে ভেঙে দুখন্ড করে ফেললো কোকোকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখা পুরু লোহার শেকল! দ্রুত হাতে কোকোর শরীর থেকে একে একে সেগুলো ছাড়িয়ে ফেলে দিলো মাটিতে।
কোকোর নিস্তেজ শরীরটা লোহার শেকলের অবলম্বন হারিয়ে ঢলে পড়ে যেতে নিলো একপাশে, আনাবিয়া তড়িতে দুহাতে আকড়ে নিলো কোকোর শরীর, অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠলো,

“কোকো!”
কোকোর নিস্তেজ দেহটাকে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো আনাবিয়া, কোকো এবার জ্ঞানলোপ করলো সম্পুর্ন, বিশাল দেহটা ভার ছাড়ে দিলো আনাবিয়ার কোলে।
আনাবিয়া নিজের কোলের ভেতরে পড়ে যাওয়া কোকোর শক্তিহীন, অবসন্ন দেহটার পানে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ফেরালো অদূরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ওরই দিকে বিস্মিত, স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা গার্ড দুটোর দিকে৷
সামান্য ঘাড় কাত করে আনাবিয়া দেখলো ওদের, এরা ওর অচেনা। মীরের গার্ডদের কে ও ভালোভাবেই চিনে। কিন্তু এরা ওর সম্পুর্ন অচেনা।

গার্ড দুটো এতক্ষণ হতভম্ব চোখে আনাবিয়াকে দেখলেও এই মুহুর্তে আনাবিয়ার এফোড় ওফোড় করে দেওয়া দৃষ্টির সামনে আচমকাই হুশে এলো, কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজনেই, কি করা উচিত এদের এখন সেই সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ হলো।
আনাবিয়া কোকোকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে শক্ত মুখে, ভারী পায়ে এগোলো ওদের দিকে। এরা কারা, কোকোর সাথে এদের কি সমস্যা সেটা ওর শুনতে হবে।
কিন্তু ওকে এভাবে এগোতে দেখা মাত্রই পিলে চমকে গেলো গার্ড দুটোর। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে, হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো হৃৎযন্ত্র!

ভয়ে আতঙ্কে কোনো কিছু না ভেবেই ছুটে পালাতে নিলো ওরা সেখানে থেকে৷ কিন্তু কদম বাড়ানোর আগেই আনাবিয়া নিজের হাত জোড়ার তড়িৎ ইশারাতে মাটি থেকে বের করে নিয়ে এলো এক গুচ্ছ লম্বা, ধারালো, সরু শেকড়!
পরমুহূর্তেই হাতের ইশারায় শেকড়ের গুচ্ছ গুলো ঝড়ের গতিতে এগিয়ে গেলো গার্ড গুলোর দিকে, মুহুর্তেই নিজেদের ধারালো কান্ডগুলো দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে শূণ্যে উঠিয়ে ফেললো তাদেরকে। গার্ড দুটো ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার জুড়ে দিলো।
হাত উচিয়ে ইশারা দিয়ে আনাবিয়া ওদেরকে ঘুরিয়ে ধরলো নিজের দিকে। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলো গার্ড দুটোর দিকে।

সে দুজন তখন ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে ব্যাস্ত। সম্মুখে দন্ডায়মান এই ভীষণ উচ্চতার মেয়েটি যে এই মুহুর্তে ভয়ানক রেগে আছে সেটা তার ঝকঝকে দৃষ্টির ধার দেখেই বুঝতে পারছে ওরা৷
আনাবিয়া ওদের একেবারেই সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বজ্রকন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি করেছো তোমরা আমার কোকোর সাথে?”
বৃষ্টির ছাট কমে গেছে, কিন্তু ঝড়ো বাতাস বইছে তখনো। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। সেই বিদ্যুত চমিকানির ঝলকানো আলো এসে ক্ষণে ক্ষণে পড়ছে আনাবিয়ার কঠিন মুখশ্রীর ওপর।
এই মুহুর্তে তাকে দেখাচ্ছে এক ভয়ানক, ক্ষুব্ধ অপ্সরার ন্যায়— না চোখ ফেরানো যাচ্ছে তার ওই অলৌকিক সুন্দরতম চেহারা থেকে, আর না চোখ রাখা যাচ্ছে তার ক্রোধে পরিপূর্ণ চোখে!
গার্ড দুটো উত্তর দিতে পারলোনা কোনো, মাটি ফুড়ে বের হওয়া শেকড়ের চাপে তাদের দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো! তাদের নিশ্চুপতার ওপর বাণস্বরূপ এসে আঘাত হানলো আবারও একই প্রশ্ন,

“কি করেছো তোমরা আমার কোকোর সাথে?”
পূর্বের থেকেও ক্রোধিত সে স্বর! আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো ওদের। একজন গার্ড কোনো রকমে বলে উঠলো,
“ক-কোকোকে ইল-লেকট্রিক শ-শক দেওয়া হ-হয়েছে…!”
ওদের মুখনিঃসৃত বাক্যটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই মাটিতে পড়ে থাকা কোকোর দিকে ফিরে তাকালো আনাবিয়া, পিঠ জুড়ে থাকা পোড়া ক্ষত গুলো চোখে বাধলো মুহুর্তেই।
দাঁতে দাঁত চেপে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে সামনে তাকালো ও, দ্বিতীয় কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলো না কারো সাথে৷

নিজের শুণ্যে তুলে ধরা ডানহাত টা মুঠি করে ধরলো ক্ষিপ্র বেগে, আর মুহুর্তেই ওর হাতের কমান্ড ফলো করে শেকড়ের গুচ্ছ প্রচন্ড জোর চাপ দিয়ে ধরলো গার্ডদুটোকে।
ভয়ঙ্করতম চাপে চোখ, নাক, মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মুহুর্তেই কটিদেশ থেকে দুভাগ হয়ে মাটির ওপর ঝুপঝাপ শব্দ করে পড়েগেলো তাদের দেহাবশেষ! রক্তে ভেসে গেলো সে স্থানটা।
হাত নামিয়ে নিলো আনাবিয়া, সাথে সাথে শান্ত হয়ে এলো শেকড়ের গুচ্ছ, এরপর ঠিক যেভাবে মাটির ভেতর থেকে উঠে এসেছিলো সেভাবেই আবার ঢুকে গেলো সন্তর্পণে, রইলো না তার পূর্ব উপস্থিতির কোনো চিহ্ন!
ঘুরে আবার কোকোর কাছে এলো আনাবিয়া, মাটির ওপর পা ভাজ করে বসে কোলে তুলে নিলো কোকোর নিস্তেজ মাথাটা। শ্বাস চলছে কোকোর, খুব ধীরে! শরীরের পোড়া জায়গা গুলো বৃষ্টির পানিতে সামান্য প্রশান্তি পেয়েছে হয়তো। সর্বদা ফুলে থাকা পেটটা যেন লেগে গেছে পিঠের সাথে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনাবিয়া হাত বুলিয়ে দিলো কোকোর চুলের ভেতর দিয়ে। শুরু করতে চাইলো ওর হিল্যিং সং। কিন্তু সেই মুহুর্তেই দূরে কারো চিৎকারের আওয়াজ কানে এলো ওর, মেয়েলি চিৎকার।
ঝটিতে শব্দের উৎসের দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো আনাবিয়া। পরমুহূর্তেই আবারও কানে এলো আরও একটা কন্ঠস্বরের আর্তনাদ৷ কোলের ওপর থেকে কোকোর মাথাটা সন্তর্পণে নামিয়ে রেখে উঠে দাড়ালো ও, তারপর বড়বড় পা ফেলে তড়িতে এগোলো সেদিকে।

হাতে থাকা লাঠিটা নিয়ে শার্লট আর ফাতমাকে আগলে রেখে সতর্ক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে ব্রায়ান, চোখে ওর আতঙ্ক। যে নেকড়ে আর হায়েনা গুলো খানিকক্ষণ আগেও দূরে ছিলো তারা এখন ওদের খুব কাছে।
ওদের থেকে কয়েক গজ দূরেই গাছ আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে থাকা কয়েক ঝাক লালচে চোখের ঝলক জানান দিচ্ছে শিকারী গুলোর উপস্থিতি! তারা শুধু আছে অপেক্ষায়, হিসেব করছে ঝাঁপিয়ে পড়ার মোক্ষম সময়ের।
কিছু মুহূর্ত বাদেই হঠাৎ বদলে গেলো বাতাসের প্রবাহ! হিংস্র হেসে কয়েকটা হায়েনা হঠাৎ লাফিয়ে বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে! চকচক করছে তাদের ধবধবে ক্যানাইন দাঁতদ্বয়, বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় যেন ঝলক দিচ্ছে সেগুলো!

নেকড়েগুলোও আড়াল থেকে নড়েচড়ে উঠলো একইসাথে, চোখগুলো ওদের জ্বলছে দপদপ করে। যেন দুদলে পূর্ব পরিকল্পনা করেই এসেছে কিভাবে এই তিন মনুষ্য সন্তানের শরীরের টুকরো দিয়ে আজ পেট ভরানো যায়!
একটা নেকড়ে লাফিয়ে ব্রায়ানকে ডিঙিয়ে তড়িতে এগিয়ে এলো শার্লটের দিকে।
বিশাল জন্তুটাকে দেখে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো শার্লট! বাধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলো কিয়ৎক্ষণ, কিন্তু ওর চেষ্টায় সামান্যতম লাভটুকুও হলোনা!
ওকে এভাবে ছটফট করতে দেখে মজা পেলো যেন নেকড়েটা, শিকারীর নিকট শিকারের থেকে শিকারের ভয় বেশি উপভোগ্য।

শার্লটের চিৎকারে ফাতমা চকিতে ফিরে তাকালো সেদিকে, আর তাকিয়েই সেখানে একটা বিশালাকৃতির নেকড়ে দেখা মাত্রই ভয়ে কেঁদে উঠে চিৎকার করে উঠলো সেও। শার্লটের মতোই হাত পা ছুড়ে চেষ্টা করতে থাকলো নিজেকে বন্দি দশা থেকে মুক্ত করার। কিন্তু এই শক্ত বন্ধনী থেকে মুক্ত হওয়ার মতো জোর খুজে পেলোনা কোথাও!
নেকড়ে গুলো যেন জানে ওদের দুর্বলতা, হায়েনা গুলো আগের মতো করেই হি হি শব্দে হিংস্র হাসি তুললো। দাঁড়িয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ, যেন দেখতে চাইলো তাদের শিকারেরা ছাড়া পাওয়ার জন্য কতক্ষণ কসরত করতে পারে!
অবস্থা বেগতিক দেখে ব্রায়ান ছুটে এগিয়ে এসে শার্লটকে আগলে দাঁড়িয়ে হাতের লাঠিটার সাহায্যে নেকড়ে টাকে আঘাত করার চেষ্টা করলো একবার, কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে লাফিয়ে ছুটে এসে ওকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে ওর পিঠের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে গেলো অন্য একটি নেকড়ে।
আর রক্ষাকর্তাকে ধরাশায়ী করার পরমুহূর্তেই ওদেরকে ঘিরে দাঁড়ানো হায়েনা গুলোর একটি শার্লটের দিকে মাথা নিচু করে তীর্যক লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, হিংস্র ভঙ্গিতে ধারালো দাঁত গুলো বের করে গরগরে গর্জন তুলতে তুলতে এগিয়ে এলো, আর তার পরমুহূর্তেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো শার্লটের ওপর……

কিন্তু ঠিক তখনই, বিদ্যুতের মতো দ্রুত বেগে কেউ একজন এসে শার্লটকে আগলে নিতে আছড়ে পড়লো হায়েনাটির সম্মুখে, আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার হাতের শক্ত থাবায় হায়েনাটা ছিটকে গিয়ে দূরের একটি গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে শব্দ করে আছড়ে পড়ে মাটিতে। আঘাতের ফলে মুহুর্তেই নিস্তেজ হয়ে গেলো তার শরীর!
ঝাঁকের অন্যরা চমকে তাকালো গাছের গোড়ায় পড়ে থেকে হাপরের ন্যায় দম নিতে থাকা হায়েনাটার দিকে। ঠিক কি হলো সেটা বুঝে উঠতে সময় নিলো কিয়ৎক্ষণ।

নিজেদের শিকার উপভোগে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় মুহুর্তেই ক্রোধ এসে ভর করলো তাদের চোখে মুখে, তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিলো হামলাকারীর দিকে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার। মৌন সিদ্ধান্ত, কিন্তু সকলেই একই সিদ্ধান্তে উপনিত।
আহত সঙ্গীর দিক থেকে তড়িতে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আবারও হিংস্র গরগরে শব্দ তুলে ওরা চারপায়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে গেলো হামলাকারীরর দিকে। কিন্তু কয়েকপা সামনে এগোনোর পরমুহূর্তেই হামলাকারীর মুখদর্শন করা মাত্রই আচমকা ব্রেক কষলো ওরা, পায়ের থাবা থেকে মুহুর্তে বেরিয়ে এলো ধারালো নখ, আকড়ে ধরলো মাটি।
ব্রেক কষার পরও গতি জড়তার কারণে বেশ কিছুটা সামনের দিকে স্লিপ করে সরে গেলো তারা, আর তারপরেই সামলে নিলো নিজেদেরকে৷

মাটি আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকালো ওরা হামলাকারীর মুখপানে, হামলাকারী নয় হামলাকারিনী! ওদের দৃষ্টি গোচর হলো হামলাকারিনীর অনিন্দ্য সুন্দর শ্বেতশুভ্র মুখখানা। এই অনাকাঙ্ক্ষিত নারী অবয়বকে চোখে দেখা মাত্রই অবাকতার চরম সীমায় গিয়ে অস্ফুটস্বরে গোঙানির মতো করে ওরা ডেকে উঠলো,
“শেহজাদী…!”
দীর্ঘ তিনটি বছর পর “শেহজাদী” শব্দটা এই লতাপাতায় পরিপূর্ণ জংলি রেড জোনে উচ্চারিত হওয়া মাত্রই যেন কেঁপে উঠলো সমস্তটা। চমকে উঠলো রেড জোনের সমস্ত প্রাণীকূল। ‘শেহজাদী’ শব্দটা ধ্বনিত হতে থাকলো সমস্ত জঙ্গল জুড়ে……

এক মুখ থেকে আর এক মুখ, এক কান থেকে আর এক কানে ফিসফিসানির মতো করে বাতাসের সাথে ভেসে মুহুর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ‘শেহজাদী, শেহজাদী, শেহজাদী’!
মুহুর্তেই যেন উত্তাল হয়ে উঠলো শিরো মিদোরির রেড জোন। সমুদ্রের বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়লো তটে, ভিজিয়ে দিলো শিরো মিদোরির শুকনো বালুকাময় চর!
ঘুমন্ত মধ্যরজনী হঠাৎ করেই হয়ে উঠলো জাগ্রত। চারদিকে শেহজাদীর আগমনের খবরে মুখোরিত হয়ে উঠলো তৎক্ষনাৎ! ঘুমিয়ে পড়া পাখিরা জঙ্গলের পশুদের ফিসফিসানিতে জেগে উঠলো, তারপর ঘুম ঝেড়ে উড়ে চলে গেলো আকাশের দিকে, সমস্ত রেড জোনের ওপরে উড়ে উড়ে জানান দিতে থাকলো তাদের হারানো শেহজাদীর আগমণের সংবাদ!

আনাবিয়া দাঁড়িয়ে আছে শার্লটকে আগলে, সম্মুখে ওর থমকে দাঁড়িয়ে আছে হায়েনা আর নেকড়ের দুই ঝাঁক, চোখে ওদের অবিশ্বাস আর বিস্ময়!
আনাবিয়া এগিয়ে এলো দুকদম, ভ্রু সোজা করে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বজ্র কঠিন গলায় বলে উঠলো,
“বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের তৈরিকৃত কানুনের তোয়াক্কা না করে, অনুমতি ব্যাতিত কোনো নিরপরাধ মানুষের ওপর হামলা করার দুঃসাহস তোমাদের কিভাবে হয়েছে?”
প্রাণীগুলো নিরুত্তর রইলো, ধীর ভঙ্গিমায় মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওরা শান্ত হয়ে।
বাদশাহ……!

তিনি যে আর নেই! তার সাথে সাথে তার কানুনও যে হারিয়ে গেছে গত তিন বছরে। এখন তার নাম উচ্চারণ করাও যে অপরাধের কাতারে ফেলে দিয়েছেন দেমিয়ান প্রাসাদে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে ব্যাস্ত থাকা জাজীব ইলহান দেমিয়ান!
ওদেরকে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাশে ফিরে ব্রায়ানের দিকে তাকালো আনাবিয়া,
“তোমরা ঠিক আছো?”
দৃঢ়, শান্ত কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া।
ব্রায়ান এতক্ষণ থমকানো দৃষ্টিতে ওকেই দেখছিলো। হাঁপাচ্ছে ও এখনো, বুঝে উঠতে পারছে না ওর হারিয়ে ফেলা শুভ্র মেয়েটি হঠাৎ কোথা থেকে এলো, কিভাবে এলো?

স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকা ব্রায়ানের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ফোস করে শ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে এগোলো মাটিতে পড়ে থাকা শার্লট আর ফাতমার নিকট।
শার্লটের কাছে গিয়ে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে ডান হাতের তর্জনি বাড়িয়ে শার্লটের শরীরে বাধা দড়ির ওপর দিয়ে একটা টান দিতেই কট কট শব্দ করে ছিড়ে এলো সেটা। দুহাতে শার্লটের শরীর থেকে সমস্ত দড়ি ছিড়ে ফেলে দিয়ে মুক্ত করলো ওকে।
শার্লট হতবাক, মুখে কথা নেই ওর! বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আনাবিয়ার মুখপানে। আনাবিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে শার্লটের পাশ থেকে উঠে গিয়ে খুলে দিলো ফাতমার বাধন।
উঠে দাড়ালো আনাবিয়া, তারপর ব্রায়ানের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,

“তোমরা এখানে কি করছো? ওদেরকে এভাবে বেধে রেখেছে কে?”
“থ-থিয়োডর ওদেরকে শাস্তি দিয়েছে শেহজাদী, ফল চুরির অপরাধে।”
নত মুখে বলে উঠলো ব্রায়ান। আনাবিয়া কপাল কুচকে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা, পরক্ষণে কোকোর কথা মনে পড়তেই লাইফ ট্রির রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে আদেশের সুরে বলে উঠলো,
“মাঞ্জারে ফিরে যাও, আমাকে ফিরতে হবে৷”
“আগামী আঠারো ঘন্টার ভেতরে আমরা সেইফ জোনে প্রবেশ করতে পারবোনা শেহজাদী, দেখা মাত্রই থিয়োডরের ফলোয়ার্সরা শার্লট আর ফাতমা কে মেরে ফেলবে। রেড জোনে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে!”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩

বলল ব্রায়ান, অসহায় ঠেকলো ওর কন্ঠস্বর। আনাবিয়া ফিরে তাকালো ওর কথা শুনে, থিয়োডর কেন শার্লট ফাতমাকে মেরে দিবে সেটা বুঝলোনা। কিন্তু এখন বোঝার মতো সময়ও ওর হাতে নেই, কোকোটা পড়ে আছে ওদিকে কাঁদা মাটির ভেতর।
কিয়ৎক্ষণ ব্রায়ানকে পরখ করে নিয়ে আবার লাইফট্রির রাস্তার দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলো,
“এসো আমার সাথে।”

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here