প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৬
নওরিন কবির তিশা
মিষ্টি রোদ্দুর মোড়ানো কোলাহলপূর্ণ-প্রাণবন্ত এক উজ্জ্বল সকাল। ঘড়ির কাঁটায় সকাল নয়টা বেজে পনেরো মিনিট। সকলে ঠিক করেছে আজ নিকটবর্তী পাহাড়ে যাবে। চূড়ায় না যেতে পারলেও যথাসাধ্য সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করবে তারা।
সকাল সকাল খাওয়া দেওয়া শেষে সকলে নিজ রুমে অবস্থান করছে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতির জন্য। নীল সবে ওয়াশরুমে ঢুকেছে, একটা শাওয়ার শেষে তৈরি হবে সে। তিহু বসে বসে কি পরা যায় সেটা নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে ভেসে আসলো নীলের ভরাট কণ্ঠস্বর,,
—’নুর?
ভাবনায় ছেদ ঘটামাত্র দ্রুত উঠে দাঁড়ালো তিহু। তড়িঘড়ি কন্ঠে বলল,,,
—’জ্বী?
—’আমার টাওয়ালটা ভুল করে রেখে এসেছি একটু এনে দিতে পারবে প্লিজ।
তিহু তাকিয়ে দেখে হ্যাঙ্গারে এখনো ঝুলছে শুভ্র রঙা টাওয়ালটা। সে সেদিকে তাকিয়েই বলে,,—’ আনছি একটু ওয়েট করুন।
বলেই চটজলদি টাওয়ালটা পেরে, দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে চলল ওয়াশরুমের দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য ধাক্কে বলল,,
—’শুনছেন? আপনার টাওয়ালটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘হুম দাও!’——মৃদু কন্ঠে কথাটা বলে আড়াল থেকে হাত বাড়ালো নীল।তিহুও টাওয়ালটা দিতে যেইনা হাত বাড়ালো সঙ্গে সঙ্গে সে টা খপ করে ধরল নীল।তাকে অবাক হওয়ার জন্য সামান্যতম সময়টি না দিয়ে নিজের দিকে টান দিলো তাকে। আকস্মিক স্পর্শের দৃঢ় টানে ভারসাম্য হারিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল তিহু। মুহুর্তের মাঝেই অনুভব করল কারো প্রশস্ত বক্ষ দেশে নিজ অবস্থান।
ওয়ারুমের দরজা ততক্ষণে বদ্ধ হয়েছে। তিহু মুখ তুলে একঝলক নীলের দিকে তাকালো। ক্রোধিত কন্ঠে কিছু বলতে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে নীলের জলস্নাত সুদর্শন মুখাবয়ব নজর কাড়লো তার। উপরের শাওয়ার থেকে এখনো শ্রাবণের ভারী বর্ষণের ন্যায় জলকনারা গড়িয়ে পড়ছে। সিক্ত করছে তাকে।
পানির তীব্রতায় ভিজে যাচ্ছে তিহু নিজেও তবে সেদিকে কোনো হেলদোল নেই তার। সমস্ত মনোযোগ ,আকুল-নিবিড়-মুগ্ধ দৃষ্টি তখনো নীলেতে স্থির। এদিকে রাগের পরিবর্তে তাকে এমন তাকিয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো নীল।সামান্য ঝুঁকে তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,,
—’কি দেখছেন,মিসেস খান সাহেবা?
মিসেস খান সাহেবা কথাটা একটু বেশিই গভীর কন্ঠে বলল সে। সর্বাঙ্গে মৃদু প্রেম-পরশের অদ্ভুত স্পর্শ অনুভব করলো তিহু, মৃদু ঝাকুনি দিয়ে শিরশির অনুভূতি জাগ্রত হলো তার দেশজুড়ে। নিজেকে ছাড়ানোর প্রয়াসে ছটফট করতেই নীল শক্ত হাতে সামলালো তাকে।
~’কি করছেন?ছাড়ুন আমায়। ছাড়ুন বলছি।ভিজে যাচ্ছি আমি,শীত করছে আমার।
~’এই গরমেও শীত? ইন্টারেস্টিং।
~’হ্যাঁ শীত।এখন ছাড়ুন।
~’যদি না ছাড়ি?
~’তাহলে আমি চিৎকার করব।
তার এমন কথায় সামান্য শব্দ করে হাসলো নীল।তিহুর নাকে সামান্য চাপ দিয়ে বলল,,
~’স্টুপিড গার্ল,কি বলে চিৎকার করবা?
তিহু থামলো। সত্যিই তো কি বলে চিৎকার করবে সে? নিজের বোকামিতে নিজের উপরই রাগ হলো।সে বোঝেনা সবসময় এত যুক্তিযুক্ত কথা বলা তার এই লোকটার সামনে আসলে হয়টা কি?এমন বোকা-বোকা কথাই বা কেন বলে বারংবার?
~’ইউ আর টু মাচ স্টুপিড ইউ নো?তোমার মতো স্টুপিড আমি দুইটা দেখি নাই ।
তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অর্থ সে আবার কি বোকামি করল?নীল যেনো বুঝল তার দৃষ্টির মানে। অদ্ভুততর দৃষ্টিতে চেয়ে গভীর-ভরাট কন্ঠে বলল,,
~’তুমি শুধু বোকামই নও অনেক ভীতুও।নয়তো না চাইতেই হৃদগহীনে যাকে স্থান দিতে পেরেছো।মুখে তাকে স্বীকার করতে এতো দ্বিধা কেন?
কথাটা বলেই শক্ত বাঁধন শিথিল করে তাকে মুক্ত করল নীল। ছেড়ে দিয়েই বলল,,
~’আউট।
মূহুর্তেই তাকে এমন পাল্টে যেতে দেখে তিহু ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কিছু একটা বলতে গিয়েও থামলো বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। বের হবামাত্র টের পেলো সমগ্র শরীর ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। দ্রুত পরিবর্তন করা দরকার সেটা, আলমারি থেকে একটা নীল রঙা পাকিস্তানি ড্রেস বের করে ঝটপট কমন ওয়াশরুমে প্রবেশ করল রেডি হতে।
আজকে সকলে ঠিক করেছে দুইটা গাড়ি নিবে, একটাতে সব মেয়েরা অন্য টাতে ছেলেগুলো। তবে রাওফিন থাকতে সেই সিদ্ধান্ত ঠিক হওয়ার যো কোথায়? সবশেষে ঠিক হলো চারটি জিপ নিবে তারা, তবে সেখানেও বাধলো আরেক বিপত্তি, মাহা তিহুদের জিপ ব্যতীত অন্য কোনো জিপে যেতে নারাজ। আর এদিকে তিহুর জিপ নীলের দখলে। অন্যটা সৌভিক আর তারপরেরটা তার। বাকিটাতে সামির ড্রাইভ করবে । যে করেই হোক মাহাকে তার জিপেই তুলতে হবে।
বহু ফন্দিফিকির করে সে, তিহু আর রিশাদ মিলে মাহাকে তার গাড়িতে তুলতে সফল হলো। বর্তমানে পরপর ছাড়া হচ্ছে চার খানা জিপ। ছাদ খোলা জিপ গাড়িগুলোতে উচ্ছ্বাসের কলরব ছড়িয়ে পড়েছে।
নীলের পাশের সিটে তিহু। পেছনে রিশাদ, নিহিত-নীরা আর রাফা। রাওফিনের পাশের সিটে মাহা পেছনে ফাহাদ-ফারিসা। মুন্নি আর নাহা। সৌভিকের গাড়িতে কুহেলিকা, জুনাইয়া-আদিত্য আর তাদের রাজকন্যা আয়রাত। সামিরের গাড়িতে আইয়াজ, রুদ্র আর জুনাইদ।
জিপ চলছে উঁচু-নিঁচু কখনো বা সমান্তরাল পথ দিয়ে। হঠাৎ রাওফিন বলল,,
—’কি ব্যাপার আমরা ঘুরতে যাচ্ছি না মরা বাড়ি? গান-ঠান কি কিছু হবে না?
কুহেলিকা:’এদের দ্বারা হবে না ভাইয়া।আপনিই শুরু করুন।
সৌভিক আড়চোখে তাকালো কুহেলিকার দিকে,,—’তুমি কি আমাকে ইনসার্ট করলে?
কুহেলিকা জিভ কেটে বলল,,—’না তো! অপমান করলাম।
তাদের কান্ডে হেসে উঠল সকলে। সৌভিক প্রথমে রাওফিন, পরক্ষণে নীলের দিকে ফিরে বলল,,—’সংসারে আগুন লাগাতে রাওফিন সেরা রেহ! তুই কিছু বল ব্রাদার।
নীলের কথা কেড়ে নিয়ে তিহু মুখ বাঁকিয়ে বলল,,—’উনি শাট আপ ভিন্ন অন্য কিছু বলতে পারেন নাকি?
নীল সানগ্লাসের আবরণে ঢাকা চক্ষু এক ঝলক ঘোরালো তিহুর দিকে। পাশ থেকে সৌভিক বলল,,—’দেখ দেখ তোর এখানেও লাগিয়েছে আগুন। কিছু কর ভাই।
রাওফিন:’তোরা এতো সাহস থাকে তুই করনা। নীলকে কেন উস্কাচ্ছিস?
সৌভিক:’এ তো আর মানা গেল না। বউয়ের সামনে অপমান! নীল ভাই আমি শুরু করলাম তুই শুধু আমার সাথে থাকিস।
পরমুহূর্তেই কুহেলিকার দিকে ঘুরে সে বলল,,—’ওকে। এমনিতেও বিয়ের আগে তুমি আমাকে বহুৎ জ্বালিয়েছো। তোমার কথা মেনে নিচ্ছি, তবে তোমাকেও গাইতে হবে। শুধু তোমাকে নয়।
সে গলা চড়িয়ে তিহুর উদ্দেশ্যে বলল,,—’আওয়ার লিটল সিস্টার। আমাদের গুরুগম্ভীর নেতা সাহেব যদি গান গায় তোমাকেও কিন্তু তার রিপ্লাই দিতে হবে।
তিহু কিছু না ভেবেই বললো,,—’আরে ভাইয়া আগে গাইতে তো বলুন।যদি গায় আ’ম প্রমিস রিপ্লাই দিব।
তার কথায় নীল ফের তার দিকে তাকালো। সামান্য উঁচালো বাম ভ্রু খানা। তাতেই যেন সম্বিৎ ফিরলো তিহুর। মনে পড়লো জাফলং এ আসার দিনের ঘটনা। তবে পরক্ষণে নিজেকে সাহস যোগাতে মনে মনে বলল,,—’তুই একটু বেশিই ভাবিস তিহু। ঐদিন তো শুধু ব্রো ছিল। আজ সকলে আছে। আর এই গুরগম্ভীর লোক কি কোনোদিন এদের সামনে গান করবে নাকি?
তার ভাবনায় ছেদ ঘঁটিয়ে রাওফিন বলল,,~’আরে ডোন্ট ওয়ারি সৌভো এমনিতেও আমরা ছেলেরাই গাইবো।কারন সেই সৎসাহস শুধু আমাদেরই আছে।তাই জিতবোও আমরাই।
কুহেলিকা:’আপনি কি আমাদের আন্ডারএস্টিমেট করলেন ভাইয়া?
তিহু:’দেখো ব্রাদার সাবধানে,আমার বড় মানে বেস্টি কিন্তু….!
তাকে কথা শেষ করতে দিলো না রাওফিন।মাহার দিকে তাকিয়েই বলল,,~’শুধু গান জানলেই হয় না সিস্টার।সকলের সামনে সেটা গাইতে সৎসাহসও লাগে।
তার কথার মর্ম বুঝে তিহু চাপা হাসলো। মাহা আড়দৃষ্টি নিক্ষেপ করল রাওফিনের দিকে। তিহু পিছনে একবার রিশাদের দিকে তাকালো অতঃপর মাহার দিকে ফিরে বলল,,
~’এটা আমাদের মান সম্মানের প্রশ্ন দোস্ত, পূরণ করাই লাগবে কিন্তু। কি বলো কুহুপু?
পাশের গাড়ি থেকে কুহেলিকাও চিৎকার করে বলল,,~’হ্যাঁ হ্যাঁ,মাহু, এদেরকে দেখিয়ে দিতে হবে কিন্তু।
মাহা কিছু বলতে গিয়েও থামল, বুঝলো রাওফিনের চাল। আর এখন এমন একটা অবস্থান না পারছে সরে আসতে না তো পারছে অন্য কিছু বলতে, যদি এখানে শুধু তিহু একা বলতো তাহলেও মানা করা যেত তবে এখানে কুহেলিকাও অনুরোধ করছে তাকে। শেষমেষ সে সামান্য সম্মতির সরে বলল,,~’আচ্ছা আপু।
কুহেলিকা সৌভিকের দিকে ফিরে বলল,,~’নাও, এবার আমরা তিনজন, দেখা যাবে।
সৌভিক ড্রাইভ করতে করতে বলল,,~’হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।। অতঃপর একঝলক কুহেলিকার দিকে তাকালো সে দক্ষ হাত স্টিয়ারিং এ রেখে পরক্ষণে গলা খাঁকারি দিয়ে গেয়ে উঠলো,,
🎶 প্রেমেরই নীল ইশারাতে এলোমেলো হাওয়া….
মনেরই মাঝে জাগালো আরো আরো চাওয়া…..
পরবর্তী কলিটা যেন লুফে নিল কুহেলিকা সে কি হেরে যাওয়ার পাত্রী নাকি?,,
🎶 প্রেমেরই নীল ইশারাতে এলোমেলো হাওয়া….
মনেরই মাঝে জাগালো আরো আরো চাওয়া…..
পেছনের গাড়ি থেকে রাওফিন গেয়ে উঠলো,,
🎶আগুন আগুন ভালোবাসা….
নেভালে যে নেভে না……
অতঃপর রাওফিন আর সৌভিক একত্রে গেয়ে উঠল,,
ওওওওও….
মন মানে না মানে না….
মন মানে না মানে না….
মন মানে না মানে না….
মওওন মা-নে না মানে না….
দেবের অত্যন্ত জনপ্রিয় গানটি একত্রে গিয়ে উঠল প্রত্যেকটা ছেলে।সামিরদের গাড়ি যেন কেঁপে উঠল রুদ্রের চিৎকারে। নিঃসন্দেহে গানটা সবার খুব প্রিয়, জুনাইদরা তো রীতিমতো বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আছে ছাদখোলা জিপটায়। এদিকে এত এত কন্ঠের ভিড়েও নীলকে নিশ্চুপ দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো তিহু। আর গান গাওয়া লাগবেনা তাকে। তবে পরমুহূর্তেই তাকে অবাক করে দিয়ে নীল গেয়ে উঠলো,,
🎶 স্বপ্ন আসে চোখে ভাসে…..
কত আশা মনে জাগে…..
হচকিত নয়নে তাকালো তিহু। পরক্ষণে গেয়ে উঠল,,
🎶ও…. চেনা জীবন বদলে গেল….
আরো যে রঙিন লাগে…..
নীল: নেশা নেশা ভালোবাসায়…..
ধরা কি আজ দেবে না….?
নীলের গান শুনে যেন লাই পেয়ে গেল সবাই,, নিহিত এতক্ষন বসে থাকলেও এক লহমায় উঠে দাঁড়ালো, সব কয়জন একত্রে গেয়ে উঠলো,,
মন মানে না মানে না….
মন মানে না মানে না….
মন মানে না মানে না….
মওওন মা-নে না মানে না….
কি ভেবে এবার যেন মাহা গেয়ে উঠলো,
🎶 ঘুম আসে না দুটি চোখে…..
জ্বলে নেভে দুটি তাঁরা…
বহুদিন পর মাহার কন্ঠে গান শুনে থমকালো রাওফিন, পরমুহূর্তে গেয়ে উঠলো,,
🎶 মনের পথে চলি তবু……
একা লাগে তোমায় ছাড়া……
হঠাৎ নিহিত গাইলো,,🎶 কিছু আশায় চোখের ভাষায়…..
সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে রিশাদ,,🎶 থমকে থাকে কামনা…..
একে অপরের দিকে তাকিয়ে, সামান্য হাসলো তারা। গাড়ি এগিয়ে চলল বহুদূর। গন্তব্য এগিয়ে আসছে, গানের সুরগুলো বাতাসে ভাসছে।
জিপগুলো এসে থেমেছে জাফলং এর অন্যতম সুন্দর এক সবুজ মন্ডিত পাহাড়ের সম্মুখে।একে একে নামছে নবীন প্রাণ গুলো। জায়গাটা বেশ জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায়, লোকজনের আনাগোনা বেশ। স্থানটার সবচেয়ে সুন্দরতম দিকটা হচ্ছে পাহাড়টি চূড়ায় ওঠার জন্য ব্যবস্থাকৃত পাহাড়ি সর্পিল রাস্তাটা।মানব মস্তিষ্ক থেকে প্রসূত এক সুনিপুণ সৃষ্টি সেটি,একবার ডানে ঘুরে কিছুটা উপরে উঠে যায়, আবার পরক্ষণেই বাঁয়ে মোচড় নিয়ে আরও কিছুটা চড়াই ভাঙে।
তিহু মুগ্ধ নয়নে তাকালো সেদিকে। পাশ থেকে কুহেলিকা বলল,,
~’কি ব্যাপারে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?সবাই তো উঠছে চলো।
তিহু তাকিয়ে দেখল একে একে সকলে পথটি বেয়ে উঠতে শুরু করেছে। কুহেলিকাও সৌভিকের হাত ধরে উঠছে উপরের দিকে। মাহার পিছন পিছন আর রাওফিনকে দেখে খানিক মুচকি হাসলো তিহু। তবে পরবর্তীতেই তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো নীরাকে রিশাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
~’এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার পণ করে এসেছ নাকি?
নীলের কন্ঠে তার দিকে ঘুরলো তিহু। মুখ কুঁচকে বলল,,~’ত্যাড়া ত্যাড়া কথা ছাড়া বলতে পারেন না?
~’আরো অনেকভাবে কথা বলতে পারি। তুমি আমাকে আপন বানাও, দেখবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট কথাগুলো তুমি আমার মুখ থেকেই শুনবে।
শেষ কথাটা কিঞ্চিৎ আস্তে বলল নীল। যার দরুন এই কলরবের মাঝে কথাগুলো কর্ণগোচর হলো তিহুর। নীল একে একে উঠতে লাগলো পথগুলো বেয়ে। তিহু দৌড়ে পাশ কাটিয়ে উঠে গেল তাকে।
চূড়ার বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। সকলের হাতে পাহাড়ি কাঠের দন্ড। ক্লান্ততা রোধ করতে এটির উপর সমস্ত ভার ছেড়ে একে একে উঠছে তারা। সকলের হাতে দন্ড থাকলেও ফাঁকা হাত তিহুর। উচ্ছ্বাসে-আনন্দে এক প্রকার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে সে। হঠাৎ পাশ থেকে মাহা বললো,,
~’চিৎ হয়ে পড়বি হাবলি, ধর এই লাঠিটা নে। নইলে উপরে উঠতে উঠতে তুই এক্কেবারে উপরে চলে যাবি।
~’তুই কি আমাকে নিজের মতো মনে করিস নাকি। আ’ম অলওয়েজ ফিট এন্ড ফাইন। কিচ্ছু হবে না আমার।
তার কথায় রিশাদ পাশ থেকে বলল,~’টেনশন করিস না বান্ধবী, শয়তান অত সহজে মরে না।
তিহু কটমটিয়ে তাকালো তার দিকে। এদিকে কথাটা বলেই বোকা বনে গিয়েছে রিশাদ। সকলে তাকিয়ে আছে তার পানে, রাস্তাটা সরু হওয়ায় ওপর-নিচ অবস্থান করছে সকলে। তিহু রিশাদকে কিছু জবাব দিতে যাবে তার আগেই ঘটলো মহাঅঘটন। রিশাদের দিকে তেড়ে আসতে গিয়ে রাস্তার বাঁকে পড়ে পা মোচকে গেল তিহুর।‘ও মাগো!’
মৃদু শব্দ হতেই সকলে তার দিকে তাকালো। কোত্থেকে জানি দৌড়ে এলো নীল, উপস্থিত সকলকে একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো তিহুর সম্মুখে। দ্রুতগতিতে তার পা টা নিজের হাতের তালুতে নিয়ে ধীরে-যত্নে অপর হাতের আঙুল সেথায় অতি যত্নে বোলাতে বোলাতে শুধালো,,
“খুব বেশি লেগেছে? কোথায় লেগেছে দেখি? এখনো ব্যথা করছে? কি যে করো না!”——বড্ড উদ্বিগ্ন শোনালো নীলের কণ্ঠস্বর। তার এমন কন্ঠ আর এমন কাণ্ডে তিহু ব্যথা ভুলে তার দিকে চেয়ে রইল। আশপাশ থেকে সকলে শুধাচ্ছে, তার পায়ের কথা। তবে সেদিকে একটুকুও মনোযোগ নেই তিহুর। সমস্ত মনোনিবেশ যেন নীলেতে বদ্ধ হয়েছে।
অন্যদিকে তাকে এমন চুপ করে থাকতে দেখে আরো রেগে গেল নীল উদ্বিগ্নতা প্রগাঢ় হলো,,~’কি হলো কথা কানে যাচ্ছে না? খুব বেশি ব্যথা করছে?
তিহু প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে টের পায়, সে আর নিচে বসে নেই। কারো শক্ত হাতের বাঁধনে মুক্ত বাতাসে ভাসছে সে। খেয়াল করে বুঝল বর্তমানে মাটি থেকে বেশ কিছুটা উচ্চতায় নীলের বক্ষের নিচ বরাবর অবস্থান করছে সে। খেয়াল হতেই সম্বিৎ ফেরার ন্যায় সে বলল,,
~’ক-ক-কি করছেন?
নীল তার হাত দুটো নিজের কাঁধে রেখে সম্মুখে এগোতে এগোতে বলল,,~’কি করছি সেটা তোমার না ভাবলেও চলবে। আপাতত চুপচাপ এভাবেই থাকো।
নীলের কথায় এক ঝলক তার পানে চাইল তিহু। বড্ড অস্থির দেখাচ্ছে নীলের মুখশ্রী। চিন্তার ছাপ স্পষ্ট তাতে।তিহু কিছু বলতে গিয়েও থমকালো। মস্তিষ্ক জানান দিলো এখানে শুধু তারা একা নয়, বাকিরাও উপস্থিত। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করল সে। নীল তাকে নিয়ে এগিয়ে চলল উপরের দিকে।
তাদের এমন অবস্থায় দেখে সকলে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলেও নাকের পাঁটা ফুলে উঠেছে মুন্নির। রাগে রি রি করে কাঁপছে শরীর। মাথা দপ দপ করছে। ইচ্ছা করছে তিহু ধাক্কা মেরে এই পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দিতে। নিজের প্রিয় মানুষটার সাথে অন্য একটা মেয়েকে এতটা অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ইচ্ছা করছে সব কিছু উল্টাপাল্টা করে দিতে। হঠাৎ দৌড়ে নিচে নেমে গেল সে। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়া নোনা জল কণাগুলোকে মুছে ফেলল অপর হাতের পৃষ্ঠ দ্বারা।
এদিকে সকলের মনযোগ যেন নীল আর তিহুতে স্থির। কেউ খেয়ালই করেনি মন্নিকে।রাফা দুচোয়ালে হাত রেখে আমুদে কন্ঠে বলল,,~’হাউ রোমান্টিক!
নিহিত:অত ঢং করার কিছু নেই।তোর বর তোকে ওভাবে কক্ষনো কোলে তুলবে না।তোর যে ওজন!
তার কথায় রেগে গিয়ে রাফা তার পিছু করতে করতে বলল,,~’আমি মোটা?বদদোয়া দিলাম তোমার বউ, তোমার বউ পুরো হাতির মত হবে।
তারা চলে যেতেই কুহেলিকা সৌভিকের দিকে তাকিয়ে বলল,,~’দেখো দেখো দেখে কিছু শেখো। নীল ভাইয়া কেমন তিহুকে যত্ন করছে দেখো। আর তুমি?
তার এমন মৃদু রাগে সৌভিক তার পানে চেয়ে বলল,,~’তুমিও কি সবার সামনে এমন কোলে উঠতে চাচ্ছ মাই লাভ?
~’গাধার মত প্রশ্ন না করে সরো তো আমার সামনে থেকে।
কুহেলিকা সত্যি সত্যি রেগে গেলো সৌভিকের এমন হেঁয়ালিতে। আর তৎক্ষণাৎ তার রাগের আগুনে ঘি ঢালতে আপদের মতো উদয় হলো রাওফিন। কুহেলিকার পক্ষ নিয়ে বলল,,
~’ঠিক বলেছো কুহু সিস।এটা আসলেও মস্ত গাধা।এভাবে কেউ প্রশ্ন করে? আমি হলে তো ডিরেক্ট কোলে তুলে নিতাম। কিন্তু আফসোস আমার বউ নাই।
কথাটা বলার সময় নিচ সিঁড়িতে থাকা মাহার দিকে একঝলক তাকালো সে।এদিকে তার কথায় সৌভিককে ঝামটি মেরে উপরে চলে গেল কুহেলিকা।বেচারা সৌভিক তার পিছু নিতে নিতে একপলক রাওফিনের দিকে ফিরে ক্রোধিত কন্ঠে বললো ,,
~’শা*লা আমার সংসারে আগুন লাগানো।বদদোয়া দিলাম তোর জীবনে বিয়ে হবে না। আর বিয়ে হলেও বাসর করতে পারবি না শা*লা।বাসর রাতে তোর বউ তোকে পঁচা পুকুরে ডুবিয়ে মারবে।
বলেই কুহেলিকার পিছু পিছু দৌড়ে যেতে যেতে সৌভিক বলল,,~’ও মাই লাভ । একবার দাঁড়াও প্লিজ।
সৌভিক যেতেই পিছন থেকে রাওফিন বলল,,~’আরে যা যা শকুনের দোয়ায় গরু থুক্কু মানুষ মরে না।
অতঃপর সে এক ঝলক পিছনে মাহার পানে তাকালো। সকালে উঠে গেলেও এখনো দাঁড়িয়ে আছে মাহা।
~’তুমিও কি কোলে উঠতে চাচ্ছ লাভলাইন? চাইলে বলতে পারো আমি আবার এসব ব্যাপারে মাইন্ড খাই না।
‘তোমার মত হাঁদার কোলে আমি উঠতে চাই না। নিজের কোলে নিজেই উঠে বসে থাকো।’——বলেও তাকে পাশ কাটিয়ে উঠে চলে গেল মাহা। এদিকে মাহার কথার মাথা মুন্ডু কিছু না বুঝে রাওফিন মাথার পেছনে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বলল,,
~’নিজের কোলে নিজে কিভাবে ওঠে?
~’এই মেয়ে আস্তে উঠো পড়ে যাবে তো।
রিশাদের কন্ঠে পিছন ঘুরে তাকালো নীরা। নীরাকে দেখে রিশাদ বললো,,~’আরে তুমি? তোমাকে তো দেখাই যায় না। সাবধানে উঠো।
নীরা চেয়ে আছে রিশাদের দিকে। রিশাদ তার পাশ কাটিয়ে উঠে যেতে যেতে ফের আরেকবার পিছন ঘুরল,,
~’ বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নামটা কি?
~’নীরা,ওয়ারিশা খান নীরা।
~’ওহ নাইচ নেম।
নীরা লাজুক হেসে বলল,,~’থ্যাঙ্ক ইউ।
~’মোস্ট ওয়েলকাম। আচ্ছা আমি যাই হ্যাঁ। দেখি তোমাদের বউমনির কি অবস্থা। নইলে আমার আরেক গুন্ডি বান্ধবী (মাহা) আমার গর্দান নিবে। যাইহোক সাবধানে উঠো তুমি।
বলেই উঠে গেল সে।নীরা তখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে। রিশাদ কে বড্ড অদ্ভুত লাগছে তার, সে সম্পূর্ণ নীরার থেকে ভিন্ন ধর্মী। ভিন্ন ব্যক্তিত্বের। তবুও তাকে ভালো লাগছে। কথায় আছে না মানুষ সমধর্মীর চেয়ে বিপরীত ধর্মীতে আকর্ষণ করে বেশি। তবে কি সেও! নিজের এমন অদ্ভুত চিন্তায় জিভ কেটে মাথায় গাট্টা মারলো নীরা। মুখ কুঁচকে মনে মনে বলল,,~’তোরও নিশ্চিত রাফার বাতাস লেগেছে নীরা। না হলে তুই আর এসব চিন্তা!
সবুজে মন্ডিত চূড়ার একটা নির্জন প্রকৃতি নিবিষ্ট স্থানে এসে তিহুকে নামালো নীল। আইয়াজ আগে থেকেই একটা মোড়ার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সেটাতে অতি সন্তর্পণে তিহুকে বসালো নীল। অতঃপর নিজে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সবুজ ঘাসের ওপর, তিহুর সম্মুখে।তিহুর ব্যথাপ্রাপ্ত পা টা অতি যত্নে তুলে নিল নিজের অপর হাঁটুর ওপর। তার এমন কাণ্ডে তিহু তড়িৎ বেগে পা সরাতে গিয়ে বলল,,
~’কি করছেন টা কি? এভাবে পায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?
নীল একদমই সরাতে দিল না তার পা টা। বরং শক্ত বন্ধনে সেটিকে ধরে ফের যথাযথ স্থানে রেখে হাত বোলাতে বোলাতে বলল,,, ~’ডোন্ট মুভ।
প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ২৫
অতঃপর সে আইয়াজকে ইশারা করতেই ,সে আয়োডেক্সের অ্যারোসল ক্যানটি নীলের হাতে দিয়ে দ্রুতপ্রস্থান করল সেখান থেকে। নীল ক্যানটা হাতে নিয়ে তিহুর পায়ে স্প্রে করতে করতে অতি যত্নশীল কন্ঠে বলল,,~’খুব বেশি ব্যথা করছে তাই না?আর একটুখানি সহ্য করো এক্ষুনি ব্যথা কমে যাবে।
তিহু বলতে চাইলো যে,তার তো বেশি ব্যথা লাগেইনি যতটা নীল উদ্বিগ্নতা দেখাচ্ছে। তবে কে শোনে কার কথা, নীল ঠিক আগের মতই স্প্রে করে অতি যত্নে হাত বোলাতে বোলাতে লাগলো।
