প্রেমতৃষা পর্ব ৪৪

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৪
ইশরাত জাহান জেরিন

তৃষার জ্ঞান ফিরতেই মাথায় ব্যথা অনুভব করল সে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ অন্ধকারের ভিতর থেকে কেউ তাকে টেনে তুলছে। মাথার ভেতরটা ভারী লাগছে, কপালের পাশ দিয়ে ঠাণ্ডা কিছু বেয়ে পড়ছে। ঘাম না রক্ত, বোঝা দায়। চোখ খুলতেই এক ঝলক আধো আলো তার দৃষ্টি ছুঁয়ে যায়, তারপর আবার গাঢ় ছায়ার ঘূর্ণিতে ডুবে যায় সবকিছু। চারপাশটা নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই এক বিকট শব্দ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাংস কাটার শব্দ। একেবারে ধীর গতিতে , যন্ত্রণাদায়ক ছন্দে ধাতব ঘর্ষণ চলছে। তারপর আবার এক চাপা ‘চটাং’ আওয়াজ।

তৃষার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে শীতল স্রোত বইতে থাকে। তৃষা নড়তে চায়, কিন্তু শরীর যে নিজেরই কারাগারে বন্দি। হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, মুখে মোটা কাপড় গোঁজা, চোখও কোনো কিছু দিয়ে বেঁধে রাখা। সে কেবল অনুভব করতে পারছে। অনুভব করতে পারছে, পায়ের নিচে ঠাণ্ডা সিমেন্টের মেঝে, বাতাসে গন্ধের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সবচেয়ে বেশি যেই গন্ধটা নাকে লাগছে তা হচ্ছে রক্তের কটু গন্ধ। তৃষার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। শব্দটা এখন আরও কাছে। ছ্যাঁক… ছ্যাঁক করে মাংস কাটার শব্দ। তৃষা চেষ্টা করে মনে করতে—শেষ কী ঘটেছিল? সে প্রেমকে খুঁজছিল… হোটেলের করিডোরের মোড়ে আলো নিভে গিয়েছিল… তারপর—
একটা অন্ধকার, একটা চাপা গন্ধ, আর এখন এই ঘর।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার বুকের ভেতর দমবন্ধ চিৎকার জমে, কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় কোনো শব্দ বের হয় না। তবুও তার নিঃশ্বাসে আতঙ্কের কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে। কান পেতে সে বুঝতে চেষ্টা করল, কতজন মানুষ আছে ঘরে? একটিমাত্র ছায়া? নাকি একাধিক? ঠিক তখনই, দূরে কোনো দরজা আস্তে কিঞ্চিৎ খোলে। এক ফালি আলো ভিতরে ঢোকে, আলোতে ধরা পড়ে ঝুলে থাকা একটা অচেনা ছায়া। যা মানুষও হতে পারে, আবার নিছক মাংসের অবশিষ্ট টুকরোও হতে পারে। ঘরের হাওয়া গা-হিমশীতল করার মতো। হঠাৎ একটা গানের শব্দ ভেসে এলো,

~তুমি ছাড়া আজ একা এ মন স্বপ্নের লাশ ঘর
ভেঙ্গে যাওয়া এই বুকের পাঁজর ধুধু মরু প্রান্তর
তুমি ছাড়া আজ একা এ মন স্বপ্নের লাশ ঘর
ভেঙ্গে যাওয়া এই বুকের পাঁজর ধুধু মরু প্রান্তর
তবু প্রেম এসে ভালো বেসে
আজ দেখা দিয়ে যায়
যেই ছুঁতে যাই আমি হাত বাড়াই
কেন দূরে সরে যায়
প্রেম আমার
ওহ.. প্রেম আমার~

দমবন্ধ করা অপেক্ষার শেষে, সেই বিকট শব্দ আর রক্ত-মাংসের কটু গন্ধে যখন তৃষার মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে আসছে, ঠিক তখনই তার কানে ভেসে এল এক ধীর, সতর্ক পদশব্দ। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন সিমেন্টের মেঝেতে নয়, তৃষার হৃৎপিণ্ডের তন্ত্রীতে আঘাত হানছে। শব্দটা কাছে এল, এসে থেমে গেল ঠিক তার শিয়রের কাছে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়েও তৃষা অনুভব করতে পারল সেই ছায়ামূর্তির উপস্থিতি। তার নিশ্বাসের অদ্ভুত ছন্দ, এক প্রকার অস্বাস্থ্যকর উত্তাপ, যা গা গুলিয়ে দিচ্ছে। পরের মুহূর্তেই, তৃষার চোখের বাঁধনে আলতো করে টান পড়ল। সেই টানটা যতোটা না শারীরিকভাবে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি ছিল মানসিক। বাঁধন খোলার সঙ্গে সঙ্গেই, দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত অন্ধকারের উপর হঠাৎ যেন এক ঝলক হলুদ, রোগাটে আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল তৃষার, পলক ফেলতে কষ্ট হল, কিন্তু আতঙ্কের বশে সে চোখ বন্ধ করতে পারল না। আধো-খোলা চোখ দিয়ে সে দেখতে পেল, ঘরের এক কোণে, পুরোনো একটি কলের গান ধুঁকছে। আর সেই যন্ত্রটি থেকেই ভেসে আসছে এক অতি পরিচিত, অথচ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর সুর, কুনাল গঞ্জাওয়ালা কণ্ঠে, “প্রেম আমার, আমি তোমার…”

আলোটা তখনও যথেষ্ট নয়। তৃষার সামনে দাঁড়ানো মূর্তিটির দিকে চোখ পড়তেই সে কেঁপে উঠল। লম্বা কালো একটি হুডি এবং মুখে কালো একটি মাস্ক। শুধু দুটো চোখের অংশ ফাঁকা, যেখানে দুটি ঠাণ্ডা, দীপ্তিহীন চোখ তাকে নিরীক্ষণ করছে। সেই দৃষ্টিতে নেই কোনো আবেগ, নেই কোনো ঘৃণা আছে শুধু এক হিংস্র, শীতল কৌতূহল। মাস্ক পরিহিত সেই লোকটা নিচু হয়ে তৃষার মুখের বাঁধনটা আলতো করে খুলে দিল। তীব্র কষ্টে ফোলা ঠোঁট দুটো ফাঁক হতেই, তৃষা টেনে একটা অসহায় গোঙানি বার করল, কিন্তু আতঙ্কে আর ভয়ে স্বর বের হলো না। “আহ্, তুমি জেগে আছো?” হুডির আড়াল থেকে ভেসে এল একটি শান্ত, কিন্তু অত্যন্ত বিকৃত কণ্ঠস্বর। “কেমন লাগছে তোমার? অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা?” তৃষা চোখ দিয়ে আকুতি জানাল, কিন্তু লোকটা তখনও অদ্ভুত খেলায় মত্ত। সে টেবিল থেকে একটি ছোট, ছুরি তুলে নিল, আর সেই ছুরিটা তৃষার কপালের ঠিক উপরে আলতো করে স্পর্শ করল। হিমশীতল ধাতুর স্পর্শে তৃষার শরীর কেঁপে উঠল।

“খুঁজছিলে তাকে, তাই না? প্রেমকে? এখন দেখো, প্রেম কী দিতে পারে তোমাকে..” হুডি-পরা লোকটা তৃষার হাত ও পায়ের বাঁধন সামান্য আলগা করল, ঠিক ততোটুকুই, যাতে তৃষা সামান্য নড়তে পারে, কিন্তু পালাতে না পারে। এরপর, সে তার হাতের সেই ধারালো ছুরি দিয়ে তৃষার গায়ের জামার ওপর অত্যন্ত ধীর গতিতে চালালো। প্রতিটা টানে তৃষার চামড়ার উপর দিয়ে ছুঁচালো ইস্পাত এমন ভাবে চলে যাচ্ছিল, যাতে রক্ত না বেরিয়ে আসে, কিন্তু স্নায়ুগুলো আর্তনাদ করে ওঠে। চামড়ার কাছাকাছি যখন ছুরি পৌঁছায়, তখন তৃষা যন্ত্রণায় গোঙাতে থাকে। তার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে যায়। লোকটা এক হাতে তৃষার চুলে মুঠো ধরে টেনে রাখে, যাতে সে নড়তে না পারে।
“এই যে স্পন্দন, এই যে কম্পন,” লোকটা ফিসফিস করে বলল, “এটাই জীবন! এই তীব্র যন্ত্রণাই তো প্রমাণ করে যে তুমি এখনো বেঁচে আছো। ভয় পাচ্ছো? ভালো, ভয় পাও। ভয় পেলে রক্ত গরম হয়, আর গরম রক্তের স্বাদ অনেক বেশি…”

এই বীভৎস খেলার মধ্যেই, লোকটি আচমকা তার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিল ঘরের অন্য প্রান্তের দিকে। সেইখানে, মেঝেতে একটি রক্তে ভেজা কম্বল পড়ে ছিল, যা তৃষা প্রথমবার খেয়াল করেনি। সে আলস্যের ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে কম্বলটি সরাল। তৃষার বুক ধ্বক করে উঠল।
কম্বলের নীচে রয়েছে একটি যুবতীর অর্ধ-নগ্ন, রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত শরীর। মেয়েটি তখনও পুরোপুরি মারা যায়নি। তার বুক ধুঁকছে, আর সেই শরীর থেকে রক্তের স্রোত মেঝেতে হাতরে বেড়াচ্ছে। তৈরি করছে আঠালো স্রোত।
“এই নাও, তোমার সঙ্গিনী।” লোকটি হাসল।

সে মেয়েটিকে নির্মমভাবে উল্টে দিল। তার পিঠে আগে থেকেই গভীর ক্ষত তৈরি করা ছিল। লোকটা দেরি না করে এগিয়ে গিয়ে একটি কাঠের বাটাম তুলে নিল। তৃষার অসহায় দৃষ্টির সামনে, সে মেয়েটিকে অমানুষিক শক্তিতে আঘাত করতে শুরু করল। প্রথমে পিঠে, তারপর হাতে, এরপর মেয়েটির মাথায় সশব্দে আঘাত করতেই তার গোঙানি বন্ধ হয়ে গেল। “চটাং” “চটাং” শব্দে মেয়েটি নিথর হয়ে গেল। তৃষা কখনো কল্পনাও করেনি তাকে চোখের সামনে এসব দেখতে হবে। জীবন্ত মেয়েটি কেবল তার চোখের সামনে ছটফট করেই গেল। তৃষা তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারল না। ভয় করছে। পুরো জীবনে যেই ভয় পায়নি, যতটুকু ভয় পাওয়া বাদ ছিল আজ সব পাচ্ছে। লোকটি আবার তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল, “বিরিয়ানি খাবে? মাংসের বিরিয়ানি? আমার প্রাক্তনের না খুব পছন্দ এই মাংসের বিরিয়ানি। আজকে আবার সে আবদার করেছে। কি করে ফেলি বলো? আচ্ছা তুমি দেখতে থাকো আমি রান্না করি কি করে।” লোকটি হেসে তৃষাকে পুনরায় উপর নিচ পরখ করে বলল, “আচ্ছা তোমার শরীরের কোন অংশের মাংস বেশি সুস্বাদু? আগে ভাগে ভেবে চিন্তে রাখতে হবে তো? কারণ এরপর তো তোমায় জবাই দেব।”
‘প্র..প্রেম আ…”

“একদম চুপ। গলার সাউন্ড আমার কান অবধি যেন ভুলেও না আসে। ভেবে না টুকরো হয়ে কুকুরের পাতে যাবে, ওইযে রান্নার হাঁড়ি দেখছো? ওটা তোমার অপেক্ষায়। তুমি প্রস্তুত তো?”
কথা শেষে সে পুনরায় মেয়েটির শরীরের ছুড়ি চালালো। চাঁছা হাতে মেয়েটির নিথর দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হিংস্র, বন্য উল্লাসে সে মাংস কাটার সেই শব্দ তৈরি করতে শুরু কর। “ছ্যাঁক… ছ্যাঁক… শব্দ। ইশ! ধাতব ঘর্ষণ, হাড় ভেঙে মাংস আলাদা হওয়ার সেই বীভৎস আওয়াজটা কি ভয়ানক। রক্ত আর মাংসের টুকরোগুলো চারপাশে ছিটকে পড়ছে। কাজ শেষে সে ঘরের এক কোণ থেকে একটি বড় ডেকচি আর একটি গ্যাস স্টোভ টেনে এনে স্টোভ জ্বালাল। ডেকচির মধ্যে জল আর মশলা ঢেলে ফুটতে দিলো। সে মেয়েটির দেহ থেকে মাংসের টুকরোগুলো অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আলাদা করে, সেই ফুটন্ত ডেকচির মধ্যে ছুড়ে মারতে থাকে।

মাংসগুলো গরম জলে পড়তেই “ছ্যাশ” করে এক তীব্র শব্দ হয়, আর তার সাথে মেশে হলুদ মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ। তৃষার মাথা ঘুরতে শুরু করে। রক্তমাখা মাংস গুলো চুলায় দিয়ে দিলো? তাও মানুষের মাংস? বুকের কাছ থেকে মাংস আলাদা করে রান্না করা হচ্ছে! মেয়েটির রহু বোধহয় পাশেই বসে আর্তনাদ করছে, নিজের অপরাধ কি জানার আগেই হয়তো মরণ হয়েছে। লাশের চোখ খোলা। তৃষা সেই চোখে চোখ রাখতেই হঠাৎ লোকটি পেছন ঘুরে বলল, “আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা, তৃষা। সুঘ্রাণে তোমার চেতনা ফিরে আসবে। তুমিও প্রস্তুত হও। তোমার পালাও খুব শীঘ্রই আসছে।”

তৃষা সেই বিকট দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে পারল না। তার মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরায় রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। তার মুখে তখনো কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ছে, যা ভয়ের চরম অভিব্যক্তি।
রক্তের তীব্র কটু গন্ধ, ফুটন্ত মশলা আর মাংস সেদ্ধ হওয়ার ঝাঁঝালো বাষ্পে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। ডেকচি থেকে ভেসে আসা সেই “ছ্যাশ… ছ্যাশ…” আওয়াজ এক বীভৎস নৈবেদ্যের মতো কানে বাজছে। লোকটা সন্তুষ্টচিত্তে ডেকচির ঢাকনা দিল, আঁচটা একদম কমিয়ে দিল, যাতে মাংসটা মৃদু তাপে সেদ্ধ হতে থাকে। তারপর আলস্যের ভঙ্গিতে, হাঁড়ি থেকে হাত সরিয়ে ধীরে ধীরে তৃষার দিকে এগিয়ে এলো। তার হাতে লেগে থাকা রক্ত তখনও টাটকা। সেই রক্তমাখা হাত দিয়েই সে তৃষার কপালের ঘাম আর চোখের জল আলতো করে মুছে দিল। সেই স্পর্শে তৃষার সমস্ত শরীর যেন বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল, কিন্তু সে আর এক বিন্দু শক্তি পেল না নড়তে বা গোঙাতে। তার সমস্ত স্নায়ু হিমশীতল আতঙ্কে নিথর হয়ে গেছে।

“কেমন লাগছে, তৃষা?” লোকটা ফিসফিস করে বলল। সেই কণ্ঠস্বর শান্ত, স্বাভাবিক—যা এই পরিবেশের সাথে বিন্দুমাত্র মানানসই নয়। সে হাঁটু গেড়ে বসল তৃষার ঠিক মুখোমুখি। ঘরের অন্ধকারেও তার দীপ্তিহীন চোখ দুটি তৃষার চোখ অনুসরণ করছে। “আমার প্রাক্তনের জন্য বিরিয়ানি রান্না করছি। সে খুব খুশি হবে।”
তৃষা পাথরের মতো পড়ে রইল, কেবল তার চোখ দুটি জীবন্ত। সেই চোখে জমে থাকা তীব্র ভয়, ঘৃণা আর অসহায়তা। তৃষা এখনো লোকটার মুখশের আড়ালে লুকায়িত চেহারা দেখতে পায়নি। কে এই লোক? এত চেনা লাগছে কেন? এই চোখ, এই ভঙ্গিমা? লোকটা তৃষার দিকে ঝুঁকে, ফিসফিস করে বলল, “শোনো, আজ আমি তোমাকে একটা গল্প বলব। আমার আর তার গল্প। গল্পের নাম দিতে পারো, নামহীন গল্প।

জীবনের প্রথম দেখায় যাকে মন আকৃষ্ট করেছিল তার নাম ছিলো তিথি মায়ানা। সাত বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের। সাত বছরে সে আমায় কত স্বপ্ন দেখিয়েছে জানো? কতবার বললাম চলো বিয়ে করে ফেলি। সে আমার বেকারত্ব আমায় ছাড়ার কারণ বানালো। আমি সময় চেয়েছিলাম। ছাত্র হিসেবে বরাবরের মতো মেধাবী ছিলাম। দেখো আমার সবই আছে। তবে সে চেয়েছিল সব যেন আমার একার থাকুক। তিথিকে বুঝাতে পারিনি, তুমি আমার পাশে থাকলে একদিন আমার নিজের কামাই করা টাকায় সিদ্দিক নেওয়াজের বাড়ির মতো বাড়ি হবে। সে বুঝেনি, সে একটুও বুঝেনি। কতবার বললাম বিয়ে করতে, সে সময় চাইলো, অযুহাত দেখালো। আচ্ছা তৃষা, আমার হাত দেখো। এই হাতের স্পর্শ তিথির সর্বাঙ্গে এখনো মিশে আছে। এই স্পর্শ সে কেমন করে ভুলে গেল?

কেমন করে সাত বছরকে পেছনে ফেলে, এত স্বপ্নকে খাটিয়ায় চাপিয়ে বউ সেজে অন্যের ঘরে চলে গেল? কেমন করে পারল অন্যের বউ হতে? অন্য পুরুষের স্পর্শে কাতর হতে? বলো তৃষা। সে চলে যাওয়ার পর আমার কি অবস্থা হয়েছিল তা কি সে জানে? জানতে চেয়েছে? সে চলে যাওয়ার পর মানসিক ভাবে ঠিক থাকতে পারিনি। কি করলে মানসিক শান্তি পাবো বুঝতে পারছিলাম না। আজও মনে আছে ঘটনাটা বেশি দিনের না। আবার কমও নয়। রাতের বেলা নেশা করে গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। সামনে একটা বিয়ে বাড়ি চোখে পড়ল। বউকে গাড়িতে তুলে বিদায় দেওয়ার পর্ব চলছিল। সবার কি কান্না কাটি। হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা ছেলে ভিড় থেকে চিৎকার করে এগিয়ে এলো। আমি চলেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ সেই চিৎকারে থেমে যাই। ভাবলাম কি না কি হলো। একটু সামনে এগুতেই হাহাকার শোনা গেল। তিথির বিয়ের দিনও আমি এভাবেই হাহাকার করেছিলাম। একমুহূর্তে নিজেকে ওই ছেলের মধ্যে দেখতে পেলাম। পরিস্থিতি বুঝতে আমার সময় লাগেনি। মেয়েটির ওই ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।

ছেলেকে শেষ মুহূর্তে এসে ধোঁকা দিয়ে মেয়েটি অন্যের হয়ে যায়। সেদিন সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। কত কি ভাবি। পরদিন ওই ছেলের খোঁজ নিয়ে তার বাড়ি যাই দেখা করতে। জানতে পারি রাতেই নাকি সে আত্মহত্যা করেছে। সে লড়াই করতে পারেনি। হেরে গেছে ভালোবাসার কাছে। আর সেই থেকেই ঠিক করলাম মেয়েটিরও অধিকার নেই বেঁচে থাকার৷ বিশ্বাসঘাতকদের বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না। এভাবেই শুরু হয় আমার ওই বিশ্বাসঘাতকদের নাম মুছে ফেলার কার্যত্রুম।যারা ছলনাময়ী, যারা অযুহাত দিয়ে সম্পর্ক নষ্ট করে, যারা এক পুরুষের জীবন নষ্ট করে অন্য পুরুষদের সঙ্গে সুখ খুঁজতে যায়, তারা সুখের যোগ্যতা রাখে না। তৃষা মনে আছে তুমি কি করেছিলে? যুবরাজের বউ হওয়ার কথা ছিল তোমার? তাকে ধোঁকা দিয়ে পুরান ঢাকা আসোনি?

প্রত্যুষ দেওয়ানকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে নেওয়াজ বাড়ির বউ হওনি? ধোঁকা দিয়েছো তো? তোমার শাস্তি যে মৃত্যু হবে না তুমি ভাবছো কি করে? একজনকে নয় দু’জনকে ধোঁকা দিয়েছো। এই যে বদ্ধ ঘরটা দেখছো? এখান থেকে পালানোর পথ নেই। এখানে মরবে তুমি। কঠর মৃত্যু হবে তোমার। আচ্ছা ভেবে দেখো তো এটা কেমন মৃত্যু হতে পারে? যেখানে তোমার দাফন হবে না, কাফন পাবে না, পরিশেষে মাটির দেহ মিশে যাবে না মাটিতে?” লোকটা হাসল। হেসে তৃষার মুখে পুনরায় টেপ লাগিয়ে নিজের মুখ থেকে মাক্স খুলে ফেলল এবার। তৃষার চোখ দু’টো বিস্ময়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে মুখ দিয়ে কথা বের হওয়ার যে পথ নেই। হঠাৎ লোকটা পেছনে তাকায়। ওপাশে আরেকটা রুম। রুমের দরজা খোলার শব্দ হয়। তৃষাও সেই শব্দ অনুসরণ করে দৃষ্টি ফেলে সেদিকে।

লোকটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘ঘুম ভাঙ্গল তবে? ক্ষুধা পেয়েছে নিশ্চয়ই? এখানে এসে বসো। আমি খাবার দিচ্ছি।’ মেয়েটি তৃষার দিকে তাকালো। তারপর লোকটিকে বলল,’ ওর মাংসের বিরিয়ানি ছাড়া খাবো না। তুমি খাও।’ মুহূর্তেই কেমন যেন চোখ-মুখ আঁধার হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে মুহূর্তেই ধারালো ছুড়িটা হাতে নিয়ে বলল, “এক্ষুনি আবার রান্না করে দিচ্ছি। তুমি মন খারাপ করো না। তুমি রাগ করে চলে যেও না। যেও না কোথায়। একটু অপেক্ষা করো।” সে তৎক্ষনাৎ তৃষার সামনে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। বলল, ” ওই দেখো? ওটা আমার তিথি। সুন্দরী না?” সে তৃষার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তোমার চুল অনেক সুন্দর। আমার তিথির সঙ্গে আমার প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল। সেদিন আমি তাকে আমায় একজোড়া পুতুল উপহার দেই। একটা বর, একটা বউ। কিন্তু জানো, তিথির যেদিন বিয়ে হয়ে যাবে।

তার আগের দিন সে আমায় ওই পুতুল ফেরত দেয়। আমাদের মাঝে অনেক রাগারাগি হয়। এক পর্যায়ে সে পুতুল গুলোকে ছুঁড়ে ফেলে, প্যান্সিল কম্পাস দিয়ে মুখ ছিঁড়ে ফেলে, চুল কেটে ছিঁড়ে ফেলে। আমি কতবার বললাম এসব করো না, আমি সবসময় ওই পুতুলের জায়গায় নিজেদের কে কল্পনা করেছি। তুমি বউ সাজবে, তবে কেবল আমার জন্য ঠিক তেমন একটা দিন কল্পনা করেছি। কিন্তু সে শুনলো না, বলল অনেক শখ ছিল এই পুতুলের মতো সুন্দর সংসারের? দেখো নষ্ট করে ফেলেছি পুতুল। আর কোনো সংসার হবে না আমাদের।” লোকটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি এখনো পুতুল কিনি।

তিথি ঠিক যেইভাবে পুতুলদের রূপ বদলে দিয়েছিল আমিও মনের আনন্দে সেইভাবে দেই। আবার সেই পুতুলকে ছলনাময়ীদের চুল কেটে নতুন রূপ দেই। আচ্ছ তিথিকে মারিনি কেন, মাথায় অনেক প্রশ্ন আসছে তাই না? কারণ প্রতারণা তো সেই আগে শুরু করেছে। জানা নেই আমার, কেন মারতে পারিনি। আজও তা জানি না। হয়তো অনেক বেশি ভালোবাসি বলে। জানো তিথি আমাকে বলেছিল যদি তাকে আমি বিশ্বাসঘাতক নারী, ঠিক তারই মতো নারীদের মাংস এনে বিরিয়ানি রান্না করে দেই তাহলে সে বার বার আমার কাছে ফিরে আসবে। নইলে সে রাগ করে চলে যাবে আর আসবে না। তার আর মাঝে মানুষের মাংসের বিরিয়ানির চুক্তি হয়েছে। আমি চুক্তিবদ্ধ। চুক্তি ভাঙলেই তিথি আর আসবে না। আর তাকে ছাড়া আমি কি করে বাঁচবো বলো? কি করে?’ লোকটি তৃষার চোখের সামনে ছুরি ধরতেই বাঁচার শেষ হচ্ছেটাও বিলুপ্ত হয়ে যায়। চোখের সামনে প্রেমের সঙ্গে কাটানো ভালো মুহূর্ত গুলো ভেসে উঠে। চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে আসে। দু’ধার গড়িয়ে পড়ে জল। মস্তিষ্কে কেবল একটা গানই ঘূর্ণিপাক খায়,

~তবু প্রেম এসে ভালো বেসে
আজ দেখা দিয়ে যায়
যেই ছুঁতে যাই আমি হাত বাড়াই
কেন দূরে সরে যায়
প্রেম আমার
ওহ.. প্রেম আমার~

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৩

লোকটি ছুরির আগা চোখে ছোঁয়াতে যাবে তার আগেই দরজা খুলে যায় রুমের। পরপর কিছু লোকজন রুমে ঢুকতেই লোকটি সেদিকে তাকায়। আতঙ্কিত তৃষার চোখ দু’টোও ততক্ষণে বাঁচার শেষ আশা খুঁজে বেড়াচ্ছে। লোকগুলো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই কালো হুডি পরহিত লোকটি তাঁদের দিকে তাকায়। বাঁকা হেসে বলে, ‘ এই অবধি তাহলে চলেই এসেছো ইন্টেলিজেন্স অফিসার? এবার খেলা জমবে।’

প্রেমতৃষা পর্ব ৪৫

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here