ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৫

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৫
অবন্তিকা তৃপ্তি

কাব্য কোমরের দিকে ছুয়ে দিতে দিতে নিচে নামবে তার আগেই কুহু সাথেসাথেই চমকে উঠে খামচে ধরলো ওর সেই বেহায়া-চঞ্চল হাতটা,রীতিমত ভয়ে হাপাচ্ছে কুহু।কুহুর থামিয়ে দেওয়াতে কাব্যও থেমে গেল ভদ্র ছেলের ন্যায়। তারপর আবার লেগে গেল কুহুর কানের দুল খোলে দেওয়াতে। কুহুর ঠোঁট কাপছে, কাব্যের ছুয়ে দেওয়া কানটাও হরম হয়ে যাচ্ছে। কাব্য ওদিকে ভীষণ মনোযোগ দিয়ে ওপর কানের দুল খুলে দিচ্ছে। কুহু কাব্যের মনোযোগী চোখের দিকে চেয়ে ভীষণ কষ্টে থেমে থেমে বলল—— ‘কি… কি করছেন?’

কাব্যও কুহুর কানের দুল খুলে বিছানার একপাশে ফেলে দিল। তারপর আবার বাম হাতটা কুহুর উন্মুক্ত কোমরে রেখে সেখানটায় ছুয়ে দিতে দিতে ডান হাতে গলার চেইন খোলায় মনোযোগী হয়ে ভীষণ ধৈর্য‍্য নিয়ে শান্ত স্বরে জবাব দিল—— ‘বাসর করছি, সিম্পল। গুরুত্বপূর্ণ কাজে গয়নাগাটি ডিস্টার্ব করলে প্রবলেম হবে।’
ব্যাস, কুহুর বেচে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাস এইবার বোধহয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কুহু একপ্রকার জমে আছে, দুহাতে দুর্বল ভঙ্গিতে কাব্যকে ঠেলে সরাতে চাইলে- কাব্য যেন ইচ্ছে করেই নিজের বাকি ভারটুকু কুহুর শরীরের উপর দিয়ে দিল। কুহু টলমকে চোখে তাকালো একবার, কাব্যের ঠোঁটের থেকে চোখ সরিয়ে তাকাল ধীরে ধীরে কাব্যের দুই বাদামি চোখে। কাব্যও তাকালো তখন। দুজনের চোখে চোখ মিললো।
উপন্যাসে, কুহু হয়তবা অনেক জেদি-রাগী এম-বদমেজাজি। তবে সেটা শুধুই কুহুর নিছক এক অভিনয়। চরম সত্য তো হচ্ছে— কুহু আজও তার কাব্য ভাইকে অসম্ভব ভালোবাসে। এখনো কাব্য ভাই ওর সামনে এলে; কুহু মুগ্ধ হয়ে তাকাতে মন চায়। তবে কিসের এত জেদ সিদ্দিক বাড়ির এই নারীর?

কারণ— নিজের আত্মসম্মান। ভালোবাসার চেয়ে বেশি মুল্যবান এই একটা শব্দ; ভীষন ভারিও বটে। কাব্য সামনে এলে এখনও হুশ-জ্ঞান খোয়ানো কুহু অভিনয় করে, বোঝায়- কাব্য ভাই ওর মনের আনাচে-কানাচে কোথাও নেই; থাকতেই পারেননা।
ভুল, ভুল, ভুল! কুহুলিকা সিদ্দিক কুহু স্রেফ অভিনয় করছে। কাব্যের কাছে একটা নির্দোষ প্রমাণের পেছনে মরিয়া হয়ে উঠে অযথা নিজেই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে।
এমনটা নয় যে— স্বয়ং কাব্য সেটা বুঝেই না। সে বুঝে, বুঝে বলেই কুহুর এত রাগ; এত অপমান কোনও কিছুই গায়ে মাখাই না কাব্য।

কুহুর ওই টলমলে চোখে তাকানো হয়তবা তাই কাব্য বুঝে গেল। হয়তবা আজ রাতে এক হতে কুহু বাধা দিবে না; ও হারিয়েই বসবে নিজেকে। কিন্তু কাব্য সেটা চায়না। ও চায় – যেদিন কাব্য কুহুজে গভীরে ছুঁবে, সেদিন যেন কুহুর এতবছরের মাতলামো-পাগলামো-অস্থিরতা সবটা অনুভব করে। রাতের উত্তাল-পাত্তাল আদর-ভালোবাসাবাসির পরেও কুহু যেন পাগলের মতো ওর কাছে আরো আদর চায়, আরো লেপটে যায় কাব্যের গায়ের সঙ্গে।
তবেই না প্রকৃত শারীরিক সুখ এবং মানসিক তৃপ্তি, দুটোই মিলে। জোর-জবরদস্তি তো কাপুরুষরা করে; আর কাব্য হচ্ছে উপন্যাসের সুপুরুষ নায়ক।
কাব্য থামলো। নিজের একটুখানি স্পর্শে কুহুকে এতটা বরফ-শীতল হয়ে যেতে দেখে ঠোঁট টিপে হাসলোও হয়তো। পরপর আলগোছে, নিতান্তই ভদ্র পুরুষের ন্যায় কুহুর কোমরের শাড়ি থেকে খুলে ফেলা সেফটিপিন নিজে থেকেই লাগিয়ে দিতে লাগল।

আচমকা কাব্যের থেমে যাওয়ায় অবাক হয়ে খিছে রাখা চোখটা খুকে ফেললো কুহু, বিস্ময়ে চেয়ে দেখল কাব্যের মনোযোগী দৃষ্টি— যে চোখ-দুটো কুহুর কোমরের শাড়িতে ভীষণ আলগোছে পিন আটকে দিচ্ছে, যেন পিনের খোচা কুহুর ওই নাজুক শরীরে না লাগে।
কুহু চেয়েই রইল, কাব্যের বা গালটা ঠিক ওর ঠোঁট বরাবর। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো কুহু এখন ওই গালটায় চুমু খেত, চুমু খেতে খেতে নির্লজ্জের মতো আবদার করত— একটা আদুরে, স্পর্শময় রাতের। নিজে থেকেই কাব্যের শেরওয়ানির বোতাম খুলে মুখ ডুবাতো কাব্যের গলার নিচে বুকের বা পাশটায়, তারপর? তারপর ওদের কাছে একটা রাত হাতছানি দিত, যে রাতটা কুহুর ভীষণ শখের ছিল এতকাল যাবত, আর আজ? ভেতর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কুহুর।

কাব্য পিন লাগিয়ে আলগোছে কুহুর শরীরের উপর থেকে উঠে বিছানায় বসল। নিজে চোখ বুজে বড়বড় শ্বাস ফেলে সামলাচ্ছে, ঠিক তখনও কুহু তাকিয়ে রইলো কাব্যের পেটানো, বলিষ্ঠ মাসকুলার পিঠের দিকে। কাব্য স্বাভাবিক হয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে থাকা কুহুর দিকে তাকাল। কুহুর ওইভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে এবার কেন যেন কাব্য নিজেই দুষ্টু হাসল; ডান চোখটা টিপে বলল——‘কি? এত অবাক হয়ে কি দেখছিস? চাই নাকি কিছু? চাইলে বলে ফেল, আমরা চাইলে কালকে থেকে আবার আমাদের ঝগড়া শুরু করব।’
কুহু যেন আবার হুশে এলো। শাড়ির আঁচল সামলে উঠে বসে তিরিক্ষি ভঙ্গিতে বলল——‘না! যদি এমন আজকে কিছু করতেন, জীবনে হয়তো আমার করা অপমান আর ভুলতেও পারতেন না। ভালো করেছেন; হুঁশে এসে।’
কাব্যের মুখটা ছোট হয়ে গেল কেন যেন, ছোট গলায় বলল——‘তোর কি মনে হচ্ছিল আমি টাচ করতাম আজকের রাতে তোকে?”

কুহু মুখ বাঁকাল, বলল——‘মনে না হওয়ার কি কোনো কারণ আছে?’
কাব্য মিছে হাসলো; কুহু চোখ ফিরিয়ে নিলো সেটা দেখে। কাব্য নিজের মতো ওসব ভুলে গিয়ে পরপর উঠে গেল বিছানা থেকে। কাবার্ড থেকে তিনটা টাকার মোটা ব্যান্ডেল এনে কুহুর সামনে ধরল। কুহু ভ্রু কুঁচকে তাকালো টাকার দিকে; পরপর কাব্যের দিকে। কাব্য স্বাভাবিক স্বরেই বলল——‘তোর দেনমোহর।’

কুহু তাকিয়ে রইলো, টাকার দিকে আর একবারের জন্যে চোখ গেল না। ও দেখল— কাব্যের মুখ-চোখ! কাব্য কুহুজে চুপ থাকতে দেখে, জোর করে হাত টেনে হাতে ব্যান্ডেল ধরিয়া দিয়ে বলল———‘দেনমোহর দিলেই নিজের ওয়াইফকে নাকি ছোঁয়া যায়— হুজুর বললেন। তবে টেনশন নিস না, আমি তোকে ছুঁবো না। যতদিন অব্দি না তুই আমার সাথে আগের মতো হচ্ছিস, নিজে থেকে আমার আদর উন্মাদের মতো চাইছিস- আমি কাব্য তোকে ছুঁবো না!’
কুহু ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে পরপর মুখ ফিরিয়ে নিলো। কাব্য ওই মুখ ফেরানোটাতেই জ্বলে গেল, পরপর গম্ভীর হয়ে বলল——‘তবে নিজের বউকে বিছানায় রেখে বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকার মতো কাপুরুষ তো নই আমি। তাই এসব টুকটাক স্পর্শ— পাবি আমার থেকে। বাধা দিলেও আমি শুনবো না এসব ব্যাপারে।’

বলেই কাব্য গম্ভীর মুখেই রেগে-রেগেই সেভাবেইই কুহুর কপালে টুপ করে করে একটা চুমু খেয়ে হনহনিয়ে ঘরের টি-শার্ট–প্যান্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।
ওদিকে কুহু আহাম্মক! ফ্যালফ্যাল চোখে টাকার বান্ডেলটার দিকে চেয়ে থেকে থেকে আবার ওয়াশরুমের দিকে তাকাল। লোকটা তো দারুণ ধুরন্ধর! বজ্জাতের হাড্ডি একটা।স্পর্শ করবে না বলেই— চুমু খেয়ে গেল।
কুহু যখন কাব্যের গুষ্টি উদ্ধার করছে, তখন কুহুর ফোনে মেসেজ এলো। শার্লিনের মেসেজ; পাঠিয়েছে—‘Are you there, my girl?’

কুহু ভ্রু কুঁচকে শার্লিনকে ফোনই দিয়ে দিল সরাসরি। শার্লিন কলটা রিসিভ করেই কোনরকমে হ্যালো বলতে বলতে কাশলো।কুহু বিরক্ত ভঙ্গিতে কাশি শুনে কিছু বলতে যাবে, তার আগে শার্লিন আবার কেশে উঠে বলল——‘না. . মানে রাত তো ১টা বাজে। এইসময় ওসব করা ছেড়ে আমাকে কল দিলি? তোরা এখনো মানে, আরকি…’
শার্লিন বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে-বাকিটা বলবেও বা কি করে। ওদিকে কুহু ওকে থামিয়ে দিয়ে একদম সোজাসাপটাই বলে উঠল——‘না, আমরা এখনও একজন আরেকজনকে নিয়ে ঘুমাইনি। ঝগড়া করেছি এতক্ষণ, আর এখন আমার বজ্জাত ধুরন্ধর বর শাওয়ার নিচ্ছে। অবশ্যই এটা স্বাভাবিক ব্যাচেলর শাওয়ার, ওকে? শোনা হয়ে গেছে? জানবি আর কিছু?’

শার্লিন থতমত খেয়ে গেল। কুহু যে এভাবে সোজাসাপটা সব গড়গড় করে বলে দেবে— এটা সলভবত আশা করেনি শার্লিন। ও লজ্জা পেয়ে বিষম খেয়ে বলল——‘আরে… আমি এত কিছু কখন জানতে চাইলাম? বিয়ের রাতে যদি ব্যাচেলর শাওয়ার না নিয়ে কাব্য ভাই ম্যারেড শাওয়ারও নিতেন- I have no problem!’
কুহু চিবিয়ে পালটা প্রশ্ন ছুড়লো—‘‘তাহলে অযথা খোচাচ্ছিলি কেন কল দিয়ে? ফাজিল কোথাকার।’
শার্লিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কুহুর এই নির্লজ্জ আচরণে শার্লিন বেচারি ভালোই হতাশ হয়েছে। এই কুহু গড়গড় করে যে কথাগুলো শার্লিনকে বলল- শার্লিনের নিজেরই লজ্জা লাগা শুরু হয়েছে।

শার্লিন লজ্জা লুকিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে বুঝদারের ন্যায় বলল—-‘বউদের এই রাতে লজ্জা পাওয়া আমার কাছে স্বাভাবিক লাগে বলেই খোচাচ্ছিলাম। তুই যে নির্লজ্জের মতো রাতের সবটা সিন বলে দিবি জানতাম না। এখন ফোন রেখে তুই আর তোর বর মিলে ঝগড়া করে দুনিয়াটাই ভস্ম করে দে।’
বলেই ঠাস করে শার্লিন কলটা কেটে দিল। বেচারি আজ বড় শখ করে কুহুকে কল দিয়েছিল— একটু পঁচানোর জন্য। উল্টো কুহু বেচারি নির্লজ্জ আচরণ করে ওর রোমান্টিক, অশ্লীল মুডটাই নষ্ট করে দিল।
কুহু এইবার ডাইরেক্ট অফ করে দিল ফোন। তারপর নিজে একটা টাওয়াল নিয়ে বসে থাকলো কাব্যের বেরোনোর অপেক্ষায়।

দশ মিনিট পর কাব্য বেশ সময় নিয়ে স্রেফ একটা টাওয়েল কোমরের নিচের অংশে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো।
ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে কুহু হেলায় আনমনে তাকালো ওদিকে। পরপর বেচারি কুহুর সারা শরীরটাই ধক করে উঠলো। কাব্য খালি গায়ে, স্রেফ টাওয়াল জড়ানো। বুকের অংশে টুপটাপ পানি জমে আছে, ভিজে চুল এলোমেলো হয়ে কপালে ছড়িয়ে আছে, চোখের বেশ অনেকটা অংশ ঢেকে ফেলেছে চুলের কারণে।
কুহুর বুকটা ধুকপুক করছে যেন। এমন নয় যে- এর আগে কাব্যকে খালি গায়ে দেখেনি— দেখেছে কুহু। কিন্তু এভাবে ভেজা শরীরে, বিয়ের রাতের অনুভূতি হয়তো অন্যরকমই। মেয়েরা এই বিয়ের রাতে ছেলেদের এসব সাদা জাদু থেকে কিভাবে মুগ্ধ হয়না? কুহুর এই মুহূর্তে মনে হলো—
‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের বৌরা হয়তো ঠিক এইভাবেই, এই একটা মুহূর্তেই তাদের নিজ নিজ স্বামীর প্রেমে পড়ে! প্রেমের শুরুটা সম্ভবত এখান থেকেই শুরু হয়।’

বুকের কাপুনি লুকিয়ে কুহু আলগোছে চোখটা নামিয়ে নিয়ে; কাব্যকে এড়িয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কাব্যও নিজের মতো ততক্ষণে টি-শার্ট–প্যান্ট পরে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে নিজের চুল শুকিয়ে নিচ্ছে।
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। কাব্য আয়নাতেই তাকাল ওদিকে।
ওয়াশরুমের দরজা পুরোপুরি তখন খুললো না, বরং হালকা খুলে কুহুর চোখটা নামিয়ে দরজায় টোকা দিল একটা— অর্থাৎ কুহুর মনোযোগ চাই এইবার। কাব্য ফিরল না, বরং আগের মতো ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে আয়নায় তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল——‘কি চাই?’

কুহু চোখটা নামিয়ে রেখেছে, ভেজা কাঁধের উন্মুক্ত একাংশ কাব্য একবারের জন্যে স্রেফ দেখতে পেল; সাথেসাথেই আরেকটু চেপে দাঁড়াল কুহু, গা লুকিয়ে। কাব্য এখন শুধু মুখটুকুই দেখতে পাচ্ছে। ভেজা স্নিগ্ধ একটা পান-পাতার ন্যায় মুখটা, কাব্য আয়নাতে চোখ দিয়ে কুহুকে দেখছে। ভেজা চুল টপটপ করে পানি পড়ছে।
কুহু সেভাবেই চোখটা নামিয়ে বলল——‘একটা হেল্প করুন। আমার ড্রেস… ওই ড্রয়ারে… না, লাগেজে আছে, দিন ওটা।’

বলতে গিয়েও দেখা গেল কুহুর মুখ লাল। কাব্যের সাথে এতক্ষণ ঝগড়া করলেও কেন যেন এভাবে, ভেজা গায়ে শরীর লুকিয়ে কাব্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেই কুহুর ভেতর থেকে লজ্জা, অস্বস্তি উপচে আসছে—লজ্জায় কান্নাও আসছে বলা চলে।
ওদিকে কুহুর এমন একটা নাজুক মুহূর্তেও কাব্য জবাবে সেভাবেই আবার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে শুকাতে দায়সারা ভঙ্গিতে বলল——‘নিজে এসে নিয়ে যা।”
এমন একটা ছোটলোকি কথাতে কুহুর লজ্জা পালিয়ে গেল সঙ্গেসঙ্গে। ও চোখ তুলে তাকাল, পরপর বলল—-‘আমি কিভাবে আসব?’
জবাব দিল কাব্য——‘টাওয়াল নিলি না? সেটা পরে এসে নিয়ে যা। যে মেয়েলোক আমার সাথে রুড বিহেভ করে, চিল্লায়, তার এসব কাজ আমি করে দেই না।’

কুহুর মনে হলো, কাব্যের মাথায় আস্ত একটা ডাব ভাঙলে বোধহয় শান্তি মিলত এখন। একটা মানুষ কি পরিমাণ ফাজিল হলে— এই ধরনের ছোটলোকি কথা বলতে পারে! কুহু এবার রাগে মেজাজ হারিয়ে বলল——‘লাগবে না! সারারাত তাহলে আমিও বাথরুমে বসেই কাটিয়ে দিব। তারপর ঠান্ডা লাগলে আব্বুর কাছে গিয়ে বলে আসব— তার আদরের ভাইয়ের ছেলে বিয়ের রাতেই আমাকে ঠান্ডায় রেখে টর্চার করেছে।যত্তসব!’
বলেই রেগেমেগে আগুন হয়ে ঠাস করে দরজাটা আটকে দিল কুহু। দরজা বন্ধের শব্দ যেন কাব্যের কানে বেসুরে তবলা বাজাল একপ্রকার। কাব্য মিটমিট হেসে স্রেফ তাকিয়ে রইল আয়নায় দরজার দিকে।
অতঃপর কুহু বাথরুমে বসে রাগে বিড়বিড় করে কাব্যের চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছিল, যখন কাব্য তখন দরজায় টোকা দিল, বাইরে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল——‘সেকেন্ডের মধ্যে দরজা না খুললে, সত্যি বলছি, বাথরুমেই সারারাত কাটাবি।’

কুহু রাগ নিয়ন্ত্রণে আনলো, কোনরকমে নিয়ন্ত্রণ করে দরজা খুলতেই কাব্য আর তেমন কিছু বললো না, লজ্জাও দিল না। একটা থ্রি-পিস এগিয়ে দিল কুহুর দিকে। কুহু রাগী চোখে কাব্যের দিকে তাকিয়ে থ্রি-পিস কেড়ে নিয়ে আবার দরজা আটকে দিল।

বাহ, জনাব থ্রি-পিস দিয়েছেন নিজের টিশার্টের কালারের সাথে ম্যাচ করে! পরপর মনে হলো— থ্রি-পিসের সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাপড় দিয়েছে কিনা ভাবতেই দেখা গেল— কাব্য ওই ছোট একটা বিষয় অব্দি লক্ষ্য করে থ্রি-পিসের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। সরাসরি দিলে হয়তো কুহু লজ্জা পেত, তাই বোধহয় এতটা লুকিয়ে-চুরিয়ে দেওয়া।
কুহুর ঠোঁটে অজান্তেই একটা হাসি এলো, পরক্ষণেই আগের কথা মনে করে হাসিটা দমন করে মুখ–চোখ আবার গম্ভীর করে বাকি জামাকাপড়গুলো স্ট্যান্ডে রেখে দিল।
অনেকক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখে কাব্য বিছানা ঝেড়ে ফুল ফেলে দিচ্ছে সব। কুহু ভ্রু কুঁচকে দেখল, তবু কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাল না। চুপচাপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ক্রিম দিয়ে, ভেজা চুল ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিল।

আদিকর কাব্য বিছানা সুন্দর করে পরিপাটি করে গুছিয়ে নিল। মেঝেতে কুহুর দোপাট্টা পড়ে ছিল, সেটা তুলে সাবধানে ভাঁজ করে আলমারিতে রেখে দিল। কুহুর শাড়িটা বাথরুমে ছিল, সেটা এনে বালিশের পাশে রাখল—
বেনারসি শাড়ি ভালো নিয়ম মেনে ধুতে হবে— সেটাও কুহুকে শুনিয়ে রাখল।
কুহু চুপচাপ শুনলো এসব, উত্তর দিল না। কাব্য সব কাজ শেষ করে বিছানার একপাশে বসল। কুহু এসে বসল ওপাশে। কাব্য বাতি নিভিয়ে দিতে দিতে বলল——‘ঘুমিয়ে পড়। সকালে মাছ কাটার রেওয়াজ হবে সম্ভবত। আমাকে বাজারে যেতে হবে।”

কুহু চোখ-মুখ গম্বীর করেই রাখলো তখনও, তারপর কাব্যের কথর সাথেসাথেই কয়েকটা বালিশ এনে ওদের দুজনের মাঝে বিছানায় বর্ডারের মতো করে রাখল। কাব্য ভ্রু কুঁচকে দেখল স্রেফ। পরপর ছোট একটা শ্বাস ফেলে কুহুর এই নিছক ন্যাকামিটা উপেক্ষা করে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।
অথচ বালিশ বালিশের জায়গায় থাকলোই না। রাত যখন গভীর, তখন কুহু নিজেই এসব বালিশ ফেলে দিয়ে ঠিকই কাব্যের বুকে মাথা রেখে আরাম করে ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাচ্ছে মুখ হা করে। কাব্য নিজের বুকের উপর কুহুকে টের পেয়ে সাথেসাথে সেটার একটা ছবি তুলে রাখল। সকালে উঠে কুহুকে অপবাদ দিতে গেলে, প্রুফ হিসেবে এই ছবিগুলো দেখিয়ে দেবে।

সিদ্দিক বাড়ি, ফ্লোর নং ১ (কাব্যদের ফ্ল্যাট)
ছোটখাটো বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে- বলার পরেও দেখা গেল পাড়ার বেশ কজন মহিলা; শামিমার কিছু অত্যন্ত ক্লোজ আত্মীয় এরা এসেছেন বিয়েতে। মেহমানদের রেওয়াজ প্রথা দেখানোর জন্যে হলে আজ মাছ কাটার আয়োজন করতেই হলো। তাই দেখা গেল/- সকাল হতেই কাব্য, স্নিগ্ধ আর আনোয়ার সিদ্দিক বাজারে দৌড়ে গেলেন। আজ কুহুর ঘরোয়া রান্নাঘরের প্রথম হাতেখড়ি হবে মাছ কাটার মাধ্যমে। এটা সিদ্দিক বাড়ির বহু বছরের পুরোনো ঐতিহ্য। ওদিকে কাব্য টেনশন করছে— খুঁজে খুঁজে মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছে, কোন মাছ কাটা সহজ; আনাড়ি হাতে কাটতে কষ্ট হবে না।

প্রতিটা মাছওয়ালাকে খুঁজে খুঁজে একই প্রশ্ন করাতে আনোয়ার সিদ্দিক বাকা চোখে একবার তাকালেন। কাব্য ঠিক তখনো আরেক মাছের দোকানিকে জিজ্ঞেস করছে——‘ছোট সাইজ দেন এটার: এটা তো ধরতেই পারবে না। হাতগুলো ওর নরম, ছোট অনেক। ছোট সাইজ দেন মামা।’
মাছওয়ালা বিপাকে পড়েছে হয়তো। কোনমতে বলল——‘এটাই ছোট সাইজ মামা। আফনারা কি দশ বছরের মাইয়া দিয়া মাছ কাটাইবেন নাকি?’

স্নিগ্ধ হাসতে হাসতে শেষ, মাছওয়ালাকে বললো——‘নতুন নতুন বিয়া মামা, বুঝেন নাই ব্যাপারটা?’
কাব্য এটা শুনে বিরক্ত চোখে স্নিগ্ধের দিকে তাকাতেই ওর হাসি থেমে গেল। মাছওয়ালা-কাব্যের দন্ধ দেখা গেল আনোয়ার সিদ্দিক এটা রেখে বড় সাইজের রুই দাম মিটিয়ে নিয়ে নিলেন; কাব্যের ছোট শুকনো মুখ দেখে গম্বীর কণ্ঠে বললেন——‘তোমার বউ শুধু বটিতে মাছের শরীর লাগাবে; দু ফোঁটা রক্ত পড়বে মাছ থেকে। বাকি কাটাকুটি তোমার আম্মু আর মহিলারাই করবে। এত টেনশন নিও না বাবা; হু?’
কাব্য লজ্জা পেয়ে গেল,মুখটা ছোট হয়ে আসতেই চোখ নামিয়ে কেশে উঠে অন্যদিকে তাকিয়ে ফেলল। স্নিগ্ধ ওদিকে হাসছে; কোনরকমে হাসি চেপে রাখছে বেচারা।

ওদিকে কুহুকে একটু আগে শামিমা এসে একটা শাড়ি দিয়ে গেছেন— পেস্টেল গ্রিন রঙের কারুকাজ করা মসলিন শাড়ি। সাথে কিছু মিনিমাম সোনার গয়না। আজ মাছ কাটার সময় কাব্য-কুহুর ছোটখাটো ফটোসেশনও হবে সেজন্যে। পরিপাটি হয়ে থাকতে বলেছেন; কাব্য এলেই শুরু হয়ে রেওয়াজ।
অথচ সময় পেরিয়ে গেলেও, এতক্ষণ ধরে কুহু শাড়িটা নিয়ে থমকে বসে আছে বিছানায়। কায়াকে কল করছে; এই ফাজিল কলটাও ধরছে না। ওকে শাড়ি পরাতে হবে কারোর, বেচারি কুহু এতটাই আদুরে-আহ্লাদে বড় হয়েছে বলে, আজ অবধি শাড়ি কিভাবে পরে— জানে না। অথচ এটা শেখা উচিত ছিলো—ব্যাসিক জিনিসটাই ও পারেনা।
অবেকবার কল দিতে দিতে; এইসময় কায়া কল রিসিভ করতেই কুহু শুরুতেই একটা ধমক দিল——‘ফাজিল, কই ছিলি?’

কায়া ভীষণ ব্যস্ত; সেভাবেই জবাব দিল——‘মামা ওই নীলটা দেখান; হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই। কুহুপু, শপিংয়ে আছি ফুপুর সঙ্গে। কেন? কিছু লাগবে?’
কুহু ভ্রু কুঁচকাল——‘কিসের শপিং?’
আশপাশে অনেক হইচই; কায়া কোনমতে সবটা সামলে একটু একপাশে গিয়ে উত্তর দিল——‘তোমার আর ভাইয়ার জন্যে কাপড় কিনবে ফুপু। তোমার শশুরবাড়ি ওরফে বড় চাচ্চুদের সবাইকেই গিফট দেবে আজ।’
কুহু কি করবে! বেচারি মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেল যে এইবার। ও আলগোছে কলটা কেটে দিল। অথচ বাইরে থেকে শামিমা বারবার বলে গেছেন— কাব্য আসার আগেই তৈরি হয়ে বসতে। কাব্য এলেই মাছ কাটার অনুষ্ঠান শুরু করা হবে। ঘরের বাইরে পাড়ার মহিলা আর শামিমার বাপের বাড়ির কয়েকজন এসেছে। ওরা না থাকলে এখনই বাইরে বের হয়ে বড়আম্মুকে ডাকলেই;উনি এসে দু মিনিট শাড়িটা পরিয়ে দিতেন।

বিরক্তিতে কুহুর সবকিছু তেতো লাগছে। ঠিক তখন মুশকিল আসান হবার মতো কাব্য দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, বেচারার পুরো শরীর ঘেমে একাকার। সাদা পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা, সেভাবেই কুহুর দিকে একপলক তাকিয়ে ব্যস্ত গলায় টাওয়েল নিতে নিতে বলল——‘এসি-টা ছেড়ে রাখ দ্রুত, আমি ৫ মিনিটে আসছি।’
বলেই কাব্য দ্রুত গোসল করতে গেল। কুহু চুপচাপ এসি চালাল, এখন এটার জন্যে আরেক দফা ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। কাব্য এমনিতেই গরম সহ্য করতে পারে না, থাক, এটুকু স্বস্তি দিক ওকে।
কাব্য বেরোল ৫ মিনিটের মাথাতেই। এসে মাথা মুছতে মুছতে এসির ঠিক নিচে বিছানায় বসে কুহুর দিকে চেয়ে বলল——‘রুই চলবে? কাটতে পারবি? আব্বু ইলিশ ধরেছিলেন, আমি আনিনি— কাঁটা বেশি, তুই পারবি না। রুই চিনিস তো? ওই যে বড় একটা মাছ, আলু দিয়ে রান্না ক—!’

কাব্য থেমে গেল, কুহুকে ওমন করে চুপ থাকতে দেখে ভ্রু বাঁকাল, হালকা গলায় বলল——‘কি ব্যাপার? আমার ঝাঁসির রানি আজ এত চুপচাপ? আমি তো কিছু করিনি; তাহলে? অন্য কেউ কিছু বলেছে তোকে?’
কুহু তাকাল কাব্যের দিকে, একনাগারে; একস্বাসে বলে গেল—-‘কি হয়েছে? বিয়ে করে তো উদ্ধার করেছেন আমাকে, রাইট? শাড়ি কে পরাবে এখন? বাড়ি ভর্তি মানুষ, যদি জানে বউ মানুষ শাড়ি পরতে জানে না— কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে! ফুর্তি তো সব আপনার, ঝামেলা তো সব আমার ঘাড়েই।’
কাব্য শুনল, তারপর সিরিয়াস গলায় বলল——‘শাড়িটা দেখি তো, কি মেটেরিয়াল।’
কুহু শাড়িটা ফেললো বিছানার উপর। কাব্য শাড়িতে হাত বুলিয়ে একবার দেখল, পরপর মাথা দুলিয়ে বিড়বিড় করল

——‘চলবে।’
কুহু কিছু না বুঝে তাকাল ওর দিকে। কাব্য উঠে দাঁড়াল, টাওয়াল বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে কুহুর দিকে চেয়ে বলল——‘উঠ, পরিয়ে দিচ্ছি শাড়ি।’
এবার যেন কুহুর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ও চূড়ান্ত বিস্ম নিয়ে য়েবলল——‘মানে? শাড়ি এটা, লুঙ্গি না কিন্তু।’
কাব্য বিরক্ত হলো যেমন; ‘চ’ সূচক শব্দ তুলে বলল——‘চোখ আছে আমার; আমি দেখতে পাচ্ছি এটা কি। উঠ এখন, দ্রুত পরিয়ে দেব, সময় নাই একদম- কুইক, কুইক!’

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৪

কুহু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে আছে তখনও। কাব্যের এত দেরি, এত সাসপেন্স ঠিক সহ্য হলো না। ও একটানে কুহুকে উঠিয়ে ফেলল। আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে না পেরে কুহু ঠিক আছড়ে পড়ল কাব্যের বুকের উপর। দু’হাত ঠেকল কাব্যের বুকের দু’পাশে। কাব্য কুহুকে একহাতে জড়িয়ে, অন্যহাতে ওর ওড়নাটা গলা থেকে টেনে আলগোছে ফেলে দিল মেঝেতে।

ডেনিম জ্যাকেট পর্ব ৩৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here