তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ১৩+১৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
রাত ৮ টা বেজে ১০ মিনিট। ফাঁকা রাস্তায় হেঁটে চলেছি।চিত্রা সকাল থেকে অনশন শুরু করেছে। আমরণ অনশন নয় আবিয়েভাঙন অনশন। অর্থাৎ বিয়ে ভাঙার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার এই অনশন চলবে। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না এই দাবিকে সামনে রেখে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে রুমে দরজা দিয়েছে। আন্টি আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার ধারনা উনার মিষ্টি কথার চেয়ে দরজার এপাশ থেকে আমার দেওয়া গালিগুলো বেশি কাজে দিবে। একদম পেটে যাওয়ার আগেই কাজ। অনেকটা হোমিওপ্যাথির মতো। বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা! আমিও গেলাম। গিয়েই উচ্চ মাপের কিছু গালি ছাড়লাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সুড়সুড় করে দরজাও খুলে গেল।
ব্যাপারটায় আন্টি আমার উপর ব্যাপক ইম্প্রেস।এই মুহূর্তে চিত্রাদের বাড়ি থেকেই ফিরছি। আমাদের বাসার এক নিয়ম সারাদিন ঘুরোফিরো নো প্রবলেম। বাট সন্ধ্যার আগে বাসায় থাকা চাই। এ বিষয়ে নো হাংকিপাংকি। এই নিয়মটা আপাতত আপু আর আমার উপরই জারি আছে। ভাইয়া যখন ভার্সিটিতে পড়তো তখন তারউপরও জারি ছিল এই নিয়ম। কিন্তু তারসময় সীমা ছিল রাত ৮ টা পর্যন্ত। এখন জব করায় তার উপর থেকে এই নিয়ম উইথড্র করা হয়েছে। মাত্র রাত ৮ টা। ভেবেছিলাম একাই চলে যেতে পারবো। তাই আর ভাইয়াকে ফোন দিই নি। কিন্তু এই সময়েই যে রাস্তা এতোটা ফাঁকা হয়ে যাবে ভাবি নি। একদম অস্বস্তিকর নীরবতা চারপাশে। তারউপর একটা রিকশাও পায় নি।এ আর নতুন কি!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমার বিপদে কুকুর এগিয়ে আসলেও এই রিক্সাওয়ালা জাতি কখনো এগিয়ে আসে না। এদের সাথে আমার শত্রুতাটা যে কি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। হঠাৎ সামনে কিছু ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আরেকটু কাছে গিয়েই আত্মা শুকিয়ে গেল আমার। এই ছেলেগুলোই তো সেদিন ভার্সিটিতে মাতলামো করছিল। হায় আল্লাহ! এবার কি হবে? কোনো রকম মুখ লুকিয়ে পা বাড়াতেই পথ আটকে দাঁড়ালো তারা। আজকে কাউকে দেখেই মাতাল মনে হচ্ছে না। সবাই একদম ফিট। আর এদের এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি ফিট আই মিন অজ্ঞান। কাঁপা কাঁপা চাহনীতে চারদিকে তাকাচ্ছি একটা আশার আলোর অপেক্ষায়। কিন্তু আশেপাশে কাউকেই চোখে পড়লো না। দু একজন পথচারী আসছে যাচ্ছে কিন্তু তাদের কাছে আমি দেখেও না দেখা। গলাটা শুকিয়ে আসছে রীতিমতো।বারবার ঢোক গিলে চলেছি ঠিক তখনই একজন বলে উঠলেন,
মাম্মা? পাখি তো নিজেই ধরা দিয়েছে রে। শুভ্রর জানেমান। ইশশ বাচ্চা মেয়েটা! সেদিন তো তোমার এই নরম হাতটা ধরার জন্য আমাদের বেদরম কেলিয়েছে সে। মনজুর তো হাতটায় ভেঙে দিছে। কতো প্রেম তাই না? কিন্তু এখন কে বাঁচাবে শুনি? (দাঁত কেলিয়ে)
দে দেখুনন আআমি শুভ্র ভাইয়ার প্রে প্রেমিকা নই। আ আমাকে যেতে দিন বলছি। নয়তো
নয়তো কি সোনা? শুভ্রকে বলবা? হা হা হা। তোমাকে বলার মতো অবস্থায় রাখলে তো বলবা। এমন অবস্থা করবো যে শুভ্র চোখ তুলে তাকাতেও কেঁপে উঠবে। সেদিন ওর এলাকায় ছিলাম তাই কিছু করতে পারি নি। কিন্তু আজ? এই সোহান, শুভ্র কি বলেছিল জানি সেদিন?
ছেলেটির কথায় পেছনে থেকে তেলসিটে চেহারার একটা ছেলে বলে উঠলো, “ভাই শুভ্র ভাই বলছিলো যে”
ওই হারামজাদা চুপ। শুভ্রকে আবার ভাই কস কেন? বল শুভ্র হারামজাদা। বল (ধমক দিয়ে)
না আসলে ভাই উনি বড়ই ভদ্র কিসেমের মানুষ। বিনা কারনে তো কিছু করে না। তাই উনার প্রতি আমার একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে আরকি। হারামজাদা বলতে পারুম না। এমনি বলি?
শুভ্রর চামচা কোথাকার (গালে থাপ্পর বসিয়ে) হ্যাঁ এখন বল
থাপ্পড়টা খেয়েও ছেলেটার মধ্যে তেমন কোনো ভাবাবেগ হলো না। সে গালে হাত ঘষতে ঘষতে বলে উঠলো,
উনি কইছিলেন, “শালা আমার ভার্সিটিতে এসে আমারই কলিজায় হাত দেওয়ার সাহস কেমনে হয় তোদের? এই ভার্সিটির একটা মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালে মাটিতে পুঁতে ফেলবো। আর এই যে একটু আগে মেয়েটার হাত ধরেছিলি এর জন্য তোর হাতটা কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ওর হাতের কব্জিতে লাল জখম হয়ে যাওয়াটা ঠিক (বুকে হাত দিয়ে) এইখানে লাগছে।আর শুভ্রর বুকে আঘাত লাগে মানে অনেক কিছু।” ভাই, এরপর কি কইছিল ঠিক মনে নাই। তখন আমি চড় খাইয়া বেহুশ হইয়া গেছিলাম।
তোরে দিয়া কিচ্ছু হবে না হারামজাদা। (বিরক্তি নিয়ে) তো ময়নাপাখি? তোমার হাত ধরায় ওর বুকে কাটা লাগছে আর যদি সারা শরীরে হাত রাখি তাহলে ওর কোথায় কোথায় লাগবে ভাবতে পারছো?
ভয়ে আমার কলিজা ঠান্ডা হওয়ার উপক্রম। শুভ্র ভাইয়ার কি দরকার ছিল এসব করার। এখন ফেঁসে গেলাম তো। চোখ ফেটে কান্না আসছে। কেন যে ভাইয়াকে ফোন করে আসতে বললাম না? এখন কি হবে? কালকের খবরের কাগজে নিশ্চয় হেড লাইন বের হবে, “গণধর্ষনের স্বীকার হয়ে এক বালিকার মৃত্যু না না বালিকা হবে না যুবতি হবে। গণধর্ষনের স্বীকার হয়ে এক যুবতীর ভয়াবহ মৃত্যু।” হ্যাঁ এবার পারফেক্ট। ছেলেগুলো এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি স্থির দাঁড়িয়ে আছি। পা নাড়ানোর ক্ষমতায় যেন পাচ্ছি না।হঠাৎই পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো, “ভাবি?”
কথাটা শুনে কৌতূহলী দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকালো সবাই। গোল চশমা চোখে, ঘেমে যাওয়া চিপকানো শার্ট গায়ে বোকা বোকা চেহারার একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একটু খেয়াল করতেই ছেলেটিকে চিনতে পারলাম। সেইদিন এই ছেলেটায় দৌঁড়ে এসে বার্গার দিয়ে গিয়েছিলো গাড়িতে। সাকিব! আমাকে দেখে দ্রুত পায়ে আমার কাছে এসে বলে উঠলো,
ভাই আপনারা উনাকে এভাবে আটকে রেখেছেন কেন? যেতে দিন
ওই তুই কে রে? এখান থেকে ফুট নয়তো বাড়ি ফেরার অবস্থায় থাকবি না আর (ধাক্কা দিয়ে)
আশ্চর্য ধাক্কা দিচ্ছেন কেন? ভাবি আপনি চলুন তো।এদের সুবিধার মনে হচ্ছে না।
ওলে ওলে এই চিকনা এরে বাঁচাইতে আসছে। ভাবি?তোর ভাইয়ের বউ নাকি? তোর ভাইরে যাইয়া বলে দে তার বউ আজ আমার বিছানায়। হা হা হা হা
মুখ সামলে কথা বলবেন। উনাকে টাচ করলেও খবর হয়ে যাবে আপনাদের বলে রাখলাম।
তাই নাকি? তুই খবর করবি? করে দেখা
কথাটা বলেই একটা ছেলে উড়না টেনে নিলো আমার।সাথে সাথেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো সাকিব। সে হয়তো নিজেও জানতো এই ছয় সাতজনের সাথে একা পেড়ে উঠবে না সে। তবু ছেলেটা শেষ চেষ্টায় ত্রুটি রাখছে না মোটেও। আমাকে চিৎকার করে বলে উঠলো, “ভাবি পালান। আমি ওদের বেশিক্ষণ আটকাতে পারবো না। দয়া করে দৌঁড়ান। দৌঁড়ান ভাবি। ওরা আপনাকে শেষ করে দিবে। যান” আমি তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছি। এই ছেলেটাকে একা ফেলে কি করে চলে যাবো আমি?আমাকে বাঁচাতে নিজে মার খাচ্ছে আর আমি কি না ভেগে যাবো? আর কতটুকুই বা যেতে পারবো?এইরাতে কে সাহায্য করবে আমায়? হঠাৎই কারো চিৎকারে চমকে উঠে সামনে তাকালাম আমি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো কয়েকফোঁটা। সাকিবের মাথা থেকে রক্ত পড়ছে ক্রমাগত। চোখের চশমাটাও ছিটকে পড়ছে রাস্তার মাঝখানে।।ল তবুও খুব কষ্টে বলে উঠলো ছেলেটি, “প্লিজ ভাবি যান।
ভার্সিটির দিকে যান। শুভ্র ভাই আছে ওখানে। প্লিজজ” ছেলেটার কথাটা বুকে গিয়ে বিঁধলো। এই ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। আমায় দৌঁড়াতে হবে। কারো কাছে সাহায্য চাইতে হবে। কি মনে করে নিজের সবটুকু দিয়ে দৌঁড়াতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। চোখে শুধু ভাসছে সাকিবের মাথা নিয়ে গড়িয়ে পড়া টাটকা রক্ত। কি ভয়ানক দৃশ্য! কিছুক্ষণ দৌঁড়ানোর পরই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। চোখ মেলে কোনোরকম দেখতে পেলাম সেই পরিচিত মুখ, সেই উদ্ধিগ্ন চোখ। শুভ্র! দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটা আর নেই। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না কিছুতেই। মনে হচ্ছে কেউ একজন শক্ত করে চেপে ধরেছে গলা। শরীরের ভরটা ছেড়ে দিতেই আমায় নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো শুভ্র।উদ্ধিগ্ন কন্ঠে কতো কিছুই বলে চলেছে সে,
রোদ? হোয়াট হ্যাপেন্ট? তুমি এই সময় এখানে কেন?কথা বলো? কি হয়েছে তোমার?
অনেক কিছুই বলতে চাইছি আমি কিন্তু শক্তিটা পাচ্ছি না মোটেও। তবু আমায় বলতে হবে ছেলেটাকে বাঁচাতে হবে। নিজের সবটুকু দিয়ে বলে উঠলাম,
স স সাকিব। ও ও ওরা ওকে মমারছে।
এটুকু বলেই চোখ বন্ধ করে নিলাম। ভয় আর উত্তেজনায় শরীরের ন্যূনতম শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছি।চোখ খুলে রাখারও শক্তি নেই আমার। শুধু শুনে যাচ্ছি চারপাশের কথাগুলো। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। শুভ্র আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলে উঠলেন,
সাহেল, সাব্বির ওদিকে গিয়ে দেখ তো কি হয়েছে? গো ফাস্ট। রোদ? এই রোদ? ওপেন ইউর আইস। বলো কে কি করেছে বলো? এই রোদ? একবার বলো খুন করে ফেলবো তাকে। এভাবে কাঁপছো কেন? আমি তো আছি।
উনি আমায় ক্রমাগত ডেকে চলেছেন। সেসব শুনতে পেলেও উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম উনি আমায় কোলে তোলে নিয়েছেন। আমি যেন শূন্য ভাসছি। নরম কোনো জায়গায় শুইয়ে দিলেন আমায়। ঠিক তখনই কানে এলো কারো কথা,
দোস্ত? সাকিব ছেলেটাকে ব্যাপক মেরেছে ফারুকেরা।ওকে হসপিটালে পাঠিয়েছি। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আল্লাহ জানে কি হবে!
কেন মেরেছে? সাকিব বাচ্চা একটা ছেলে। ও তো কোনোরকম বেয়াদবি করার ছেলে নয়। তাহলে?
আসলে ওরা রোদেলার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করতে চেয়েছিল। ওকে বাঁচাতে গিয়েই
শুভ্রর আর কোনো কথা শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পর হালকা করে বলে উঠলো, “ওকে”
প্রায় আধাঘন্টা হাতে পায়ে মালিশ করার পর শরীরে শক্তি পাচ্ছি আমি। মিটমিট করে চোখ মেলে তাকাতেই শুভ্রর মুখটা ভেসে উঠলো সামনে। শুকনো মুখে রক্তরাঙা দু’টি চোখ। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই উজ্জল হয়ে গেল উনার মুখ। আমাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন উনি।কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থেমে গেল। আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সরাসরি ঢুকে গেলেন ডক্টরের চেম্বারে। আমার মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুরছে, “সাকিব ছেলেটা ঠিক আছে তো?” ডক্টর আমায় ঘুমের ঔষধ দিয়েছেন। কিন্তু চোখ বুজতে ইচ্ছে করছে না। শুভ্র ভাইয়াকে সাকিবের কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে খুব।
কিন্তু পারছি না। কোনোরকম ঘুমে ঢুলুঢুলু প্রশ্নমাখা চোখে শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি কি বুঝতে পারবেন আমার প্রশ্ন? আমার মন পড়ার ক্ষমতা কি তার আছে? আমাকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র ভাইয়া আমার ডানহাতে হালকা চাপ দিয়ে বলে উঠলেন, “সাকিব আইসিইউতে আছে। ঠিক হয়ে যাবে ও। চিন্তা করো না।তুমি একটু ঘুমাও। ইউ নিড রেস্ট” উনার কথায় কোনো আশা খুঁজে পেলাম না আমি। কিন্তু কিছু বলতেও পারলাম না। তার আগেই গহীন ঘুমে তলিয়ে গেলাম।জানি না কতক্ষণ ঘুমিয়েছি। চোখ মেলে দেখি বাবা মা, ভাইয়া, মামু, মামানি, অভ্র ভাইয়া সবাই দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ওদের মুখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল। চারপাশে কোথাও শুভ্র ভাইয়াকে দেখতে পেলাম না। সাকিব ছেলেটার কিছু হলো না তো?
আমি কথা বলতে পারছি না ব্যাপারটা খেয়াল করা মাত্রই একধরনের অস্থিরতা শুরু হয়ে গেল আমার মাঝে। মাকে কাছে ডাকার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।কারণ শরীরের কোনো অঙ্গ নড়ানোর শক্তিই আমার নেই। অনেক চেষ্টা করেও পারছি না। ছটফট করছি, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। কি হচ্ছে আমার সাথে?কেন হচ্ছে? এক সময় ডক্টর এলেন। আমার পাশে এসে বলে উঠলেন,
রিলেক্স মামনি! রিলেক্স। আই নো তুমি কথা বলতে পারছো না, শরীর নাড়াতে পারছো না।।একটু শান্ত হও। আমি তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলছি। ইউ আর আ ইন্টেলিজেন্ট গার্ল। সবারই একধরনের ফোবিয়া থাকে।কেউ অন্ধকারে ভয় পায়, কেউ পানিতে, কেউ কোনো জীবজন্তুতে। তোমার ফোবিয়াটা হলো রক্তে। তুমি রক্তে ভয় পাও। প্রচন্ড রকম ভয় পাও। তুমি যে পরিস্থিতিতে ছিলে তাতে যেকোনো মেয়েই ভয় পেয়ে যাবে এটা স্বাভাবিক। বাট তোমার সামনে ঘটা ঘটনাগুলো, তোমার দেখা রক্ত এসব তোমার ব্রেন মেনে নিতে পারে নি। যার প্রভাব তোমার শরীরে পড়েছে। তুমি তোমার শরীরের কার্যক্ষম হারিয়েছো।
সাথে কথা বলার শক্তি। কিন্তু ব্রেন সচল এবং সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু রোদ তোমার সমস্যাগুলো সাময়িক। ২৪ ঘন্টার মধ্যে তোমার শারীরিক কার্যাবলি আবারও শুরু হবে। নো টেনশন। কিন্তু কথা কবে থেকে বলতে পারবে তা বলতে পারছি না। তবে খুব শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। অতিরিক্ত ভয়ের কারনে তোমার ব্রেনের রক্ত সঞ্চালন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাই এমনটা হয়েছে। তবু কনফিডেন্স রাখো। হাইপার হলে এর থেকেও বড় সমস্যায় পড়তে পারো। আমি তোমায় ঘুমের ইনজেকশন দিচ্ছি। আশা রাখছি তুমি ট্রামাটা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আর শারীরিক কার্যক্ষমতা ফিরে পাবে। তোমাকে মেন্টালি স্ট্রং থাকতে হবে। ইউ ক্যান ডু ইট রোদ। ট্রাই ওকে?
ডক্টর একটানা বলে গেলেন। আমিও শুনে যাচ্ছি। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মায়ের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি। আমি কি কখনোই সুস্থ হতে পারবো না? কথা বলতে পারবো না? আচ্ছা, সাকিব নামের ছেলেটা সুস্থ আছে তো? এমন ছেলে এখন পাওয়া যায় না। আমাদের সমাজের ছেলেরা দুই শ্রেনীতে ভাগ হয়ে গেছে এখন।এক পশু শ্রেণি, দুই কাপুরুষ শ্রেণি। কিন্তু সাকিব এই দুই শ্রেনীর কোনোটারই আওতায় পড়ে না। ওকে আমাদের এই নষ্ট সমাজে বড্ড প্রয়োজন। ভাবতে ভাবতেই চোখ ভার হয়ে এলো ঘুম। এই ঘুম থেকে আর উঠতে পারবো তো? শুভ্র ভাইয়া কোথায়? উনি কি এই ছেলেগুলোকে এমনি ছেড়ে দিবে?
গভীর ঘুমেও কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পাচ্ছি। কেউ কপালে বারবার ঠোঁট ছুঁইয়ে চলেছে। কপালে টপাটপ পানি পড়ছে। আচ্ছা আমার কেবিনের ছাদ কি ফুঁটো করা? বৃষ্টির পানি পড়ছে? না কেউ কাঁদছে? কে মা?নাকি আপু? নাকি অন্যকেউ। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকলাম। ঘাড়টা আস্তে করে ঘুরিয়ে দেখলাম কেউ নেই। দরজা নড়ছে মাত্রই কেউ বেরিয়ে গেল। কে ছিল ওটা? কপালে হাত রেখে পানির অস্তিত্বও পেলাম।তারমানে হ্যালোসিনেশন ছিল না। সত্যিই কেউ ছিল এখানে। কিন্তু কে? হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমি হাত নাড়াতে পারছি। কিন্তু পা টা এখনো ভারি। কথাও বলতে পারছি না। নিজেকে অসহায় লাগছে। এভাবে শুয়ে থাকার কোনো মানে হয়? একটু পরই ডাক্তার এলো। আমাকে খাবার খাওয়াতে বলে বেরিয়ে গেলেন।কিছুক্ষণের মধ্যেই দুনিয়ার সব খাবার এনে আমার সামনে রাখলো মামু। এইসব এক্সপেন্সিভ বিশ্রী খাবার দেখেই চোখ মুখ কুঁচকে গেল আমার। আমাকে ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অনবরত এটা ওটা খাবার জন্য জোড় করে চলেছে মা। কিন্তু আমিও প্রতীজ্ঞাবদ্ধ এসব কিছুতেই খাবো না। আমি কথা বলতে পারছি না বলে এরা আমার পছন্দের গুরুত্ব দেবে না? এটা কেমন কথা? একঘন্টা যাবৎ চেষ্টা করে আম্মু তুমুল বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলেন,
না খেলে এভাবেই মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে হবে, বুঝতে পারছিস? মা রে খেয়ে নে না। জেদ করে না সোনা। তুই কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?
আমি চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে বসে আছি। তখনই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই বলে উঠলো কেউ।
ফুপ্পি? তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও। আমি ওকে খাওয়াচ্ছি।
মা ঘাড় ঘুরিয়ে শুভ্রকে দেখতে পেয়েই বলে উঠলেন,
তুই পারবি? আমি একঘন্টায় মুখটা খুলাতে পারলাম না। এতো ফাজিল হয়েছে মেয়েটা! অসুস্থ অবস্থায় ফাজলামো যাবে না।
পারবো ফুপ্পি তুমি যাও তো। (মিষ্টি হেসে)
সিউর?
হান্ডেট পার্সেন্ট!
আচ্ছা তাহলে তুই চেষ্টা করে দেখ। আমি আসছি।
মা চলে যেতেই উনি বেডের সামনে রাখা চেয়ারে বসে পড়লেন। হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে হাত-পা টান টান করে মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে করে বসলেন। উনার গলার একটা অংশ উঁচু হয়ে আছে। বারবার উঠানামা করছে। অন্যরকম সুন্দর লাগছে উনাকে। পড়নে সাদা-কালো চ্যাক শার্ট, ব্রাউন কালার জিন্স। হাতাটা কনুই পর্যন্ত গোটানো। বাম হাতে ব্যান্ডেজ। ডান হাতে ঘড়ি। চোখ দু’টো লাল হয়ে ফুলে আছে। মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমোন নি উনি। সিল্কি চুলগুলো আজ প্রথম অগোছালো। কেমন পাগল পাগল ভাব চোখে মুখে। এই পাগল চেহারাটায় অন্য কাউকে পাগল করার জন্য যথেষ্ট। আমি চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি এবার সোজা হয়ে বসলেন। ডানহাতে চুলগুলোতো হাত চালিয়ে বললেন,
খাচ্ছো না কেন? ক্ষুধা পাই নি?
আমি মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ বসে গোলগোল চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই মাথা নিচু করে মুচকি হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। আমি উনার হাসি দেখে ভ্রু কুচঁকে তাকালাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসি কন্ট্রোল করে বলে উঠলেন,
রোদ ইউ নো হোয়াট? তুমি সবসময় এমন মুখ ফুলিয়ে চুপ করে বসে থাকলেও ব্যাপারটা খারাপ হবে না। ইউ আর লুকিং সো কিউট। গুলুমুলু গাল (গাল টেনে)
উনার এমন বিহেভ আমার জন্য অপরিচিত। আমি ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে আছি। উনি আবারও বলে উঠলেন,
ভ্রু কুঁচকাবে না। এখন বলো খাবে না? খেতে ইচ্ছে করছে না?
আমি চুপচাপ উনার দিকে তাকিয়ে আছি। বাচ্চাদের মতো কুটুরকুটুর চোখে তাকিয়ে আমার অসহায়ত্ব বুঝানোর চেষ্টা করছি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হালকা গলায় বললেন, ‘ওকে! নার্স? নার্স?’
তৎক্ষনাৎ দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো একটা অল্প বয়সী নার্স। সে ও টুকুরটুকুর চোখে তাকিয়ে আছে শুভ্রর দিকে। শুভ্র মুচকি হেসে বললো, “এক্সকিউজ মি? এই খাবারগুলো নিয়ে যান।” নার্সটা এখনও দাঁড়িয়েই আছে। মেয়েটাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে রাগী চোখে তাকিয়েই বলে উঠলেন, “আপনি কি যাবেন?” এবার নার্সটা নড়েচড়ে উঠলো। খাবারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমি আগের মতোই শান্ত হয়ে বসে আছি। ক্ষুধা লেগেছে ব্যাপক। এই খাটাসটা যে খাবার পাঠিয়ে দিলো তো আমি খাবো কি? এই সাদা বিলাই কি সুযোগের সৎ ব্যবহার করে আমাকে শাস্তি দেওয়ার পায়তারা করছে নাকি? এবার উনি পাশের ব্যাগ থেকে খাবারের বাটি বের করে প্লেটে সাজাতে লাগলেন। আমি চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি। একদম নরমাল খাবার এনেছেন উনি। বেগুন ভাজি, ছোট মাছের চচ্চড়ি, শাক পাতা, ডালের বড়া। খাবারগুলো দেখেই মুখে পানি এসে গেল আমার। উনি হাত ধুয়ে প্লেটটা সফ্টলি হাতে নিলেন। আমার মুখের সামনে খাবার ধরে বললেন “হা” করো। আমিও তাড়াতাড়ি মুখে নিয়ে নিলাম। কথায় আছে না! পেট ঠান্ডা তো সব ঠান্ডা। এই মুহূর্তে উনাকে একটা কিসসি দিয়ে দাওয়া উচিত। উনি কিভাবে জানলেন এসব আমার ভালো লাগবে? হঠাৎই উনার ফোন বেজে উঠলো। বামহাতে ফোনটা ধরে লাউডে দিয়ে বেডে রাখলেন,
হ্যালো?
হ্যাঁ সাহেল বল।
দোস্ত সাকিবের তো এখনও জ্ঞান ফিরলো না। আর দুই ঘন্টা আছে অবজারভেশনের। এইবার আমার ভয় লাগছে। ছেলেটা বাঁচবে তো?
উনি আমার দিকে একবার তাকিয়েই বলে উঠলেন, “টেনশন নিস না। ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক ওকে হতেই হবে।”
হুম। আল্লাহ ভরসা। আর শোন তোর কথা মতো বেশ কিছু মসজিদে সাকিব আর সানশাইনের জন্য জুমার নামাযের পর দোয়া আর কুরআন খতমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আচ্ছা পিচ্চি মেয়েটা কেমন আছে?
হুম ভালো। বকবকানিটা নেই। তেজ আগের মতোই আছে।
হা হা হা হা। তুই ও না! আচ্ছা আর একটা কথা। ফারুককে কি এখন হসপিটালে পাঠাবো? যে পরিমান রক্ত গড়িয়েছে। আরো পড়লে তো ব্যাটা মরে যাবে।
এ নিয়ে তোর সাথে পরে কথা বলছি। বাই
কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিলেন উনি। আমি বিস্ময়মাখা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। মাথায় চলছে সাকিবের কথা। ছেলেটা বাঁচবে তো? ওর কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা কিভাবে করবো আমি? চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। উনি পাশের টেবিল থেকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“চোখ মুছে। খবরদার চোখের পানি পড়েছে তো খুন করে ফেলবো। সারাটা রাত টেনশনে রেখে এখন কাঁদছো। আরেকটা ফোঁটা পড়লে এখনি খিঁচে দিবো এক চড়।”
তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ১১+১২
আমি কাঁদো কাঁদো চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।দেখো কেমন ফাজিল ছেলে! আমার এই অবস্থায়ই ও আমায় চড় মারতে চাইছে। খাটাস একটা। আজ কথা বলতে পারছি না বলে যা ইচ্ছে তাই বলবে নাকি?

