মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৬

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৬
মাহা আয়মাত

অর্তিহা আর মাওলিদের প্রেমের সম্পর্কের চার মাস কেটে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু তারপর এলো তাদের জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার দিন। ২৬শে জুলাই। সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই একসাথে নাস্তা করছে। অর্তিহার পরনে আকাশি কালারের কলেজ ড্রেস, আর আদ্রিকের পরনে নীল শার্ট আর সাদা প্যান্ট। খাওয়া শেষে আদ্রিক চেয়ারে থেকে উঠতে উঠতে বলে,
— তোর আর কতক্ষণ লাগবে?
অর্তিহা উত্তর দেয়,

— এই তো শেষ, আদ্রিক ভাইয়া!
— আচ্ছা, আমি গাড়ি বের করছি, তুই শেষ করে আয়।
আভীর কারদার খাওয়া থামিয়ে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— মাঝরাতে এসেছো এতোটা পথ জার্নি করে। এতো সকালে উঠার কি প্রয়োজন ছিলো! প্রিন্সেস কে নাহয় আরভিদ দিয়ে আসতো কলেজে!
আদ্রিক – আমি ঠিক আছি চাচ্চু। অর্তি তুই আয়।
বলে আদ্রিক বাইরে বেরিয়ে যায়। অর্তিহা খাওয়া শেষ করে বাইরে এসে দেখে, আদ্রিক গাড়ির পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, তার জন্য অপেক্ষা করছে। অর্তিহাকে দেখেই গাড়ির দরজাটা খুলে দেয়। অর্তিহা চুপচাপ উঠে বসে, তারপর আদ্রিকও গাড়িতে ওঠে। গাড়ি চলতে শুরু করে।
অর্তিহা ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে চার্জে লাগাতে লাগাতে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— কালকে রাতে এতোটা পথ জার্নি করে এসেছেন, তার উপর রাতে না ঘুমিয়েই সকাল সকাল উঠে পড়েছেন শুধুমাত্র আমাকে কলেজে দিয়ে আসার জন্য! কি দরকার ছিল? আমি তো ভাইয়ার সাথেও যেতে পারতাম!
— আমার কোম্পানি ভালো লাগছে না?
— না আমি এটা বলিনি। আসলে না ঘুমানোর ফলে যদি আপনার মাথা ব্যাথা করে?
আদ্রিক হাসে, চোখে তার অন্যরকম আবেগ,
— এমন কত সময় এসেছে তোর কথা ভেবে পুরো রাত কেটে গেছে। ঘুম আসার সাহসও পায়নি চোখে। তারপরের দিনই রুটে যেতে হয়েছে! একদম না ঘুমিয়েই!
অর্তিহা অবাক হয়ে বলে,
— বুঝিনি? আমার কথা ভেবে মানে?
আদ্রিক অর্তিহার চোখে চোখ রেখে বলে,
— মাথা ব্যাথা করলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিস, ব্যাথা কমে যাবে!
অর্তিহা কিছুই বুঝতে পারে না। সে একটার কথা বললে আদ্রিক আরেকটার উত্তর দিচ্ছে। পরক্ষণেই ভাবে, হয়ত রাতে ঘুম হয়নি বলে আবোল-তাবোল বলছে।
অর্তিহার ভাবনার মাঝেই আদ্রিক ডাকে,

— অর্তি?
— হুম?
আদ্রিক নরম কন্ঠে বলে,
— আমি যখন দুবাই থাকি তখন আমাকে মিস করিস?
অর্তিহা এই প্রশ্নের উত্তর বুঝে উঠতে পারে না। সে তো কখনো আদ্রিককে মিস করে না। আর করবে কেন? কিন্তু সেটা আদ্রিককে বলবে কীভাবে?
তাই সে পাল্টা প্রশ্ন করে,
— এটা কেমন প্রশ্ন ছিলো আদ্রিক ভাইয়া?
আদ্রিক হেসে বলে,
— জানতে ইচ্ছে হলো! তুই বল না, আমাকে মিস করিস আমি না থাকলে? আমি না থাকলে কি মনে হয়, ইচ্ছে হয় আমার উপস্থিতির?
অর্তিহা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। আগে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি সে। কিন্তু এখন মুখের উপর না বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। তাই চুপ থাকা-টাই শ্রেয় মনে করে। আদ্রিক অর্তিহার এই নীরবতা দেখেই তার উত্তর বুঝে ফেলে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আদ্রিকের গাড়ি থামে অর্তিহার কলেজের সামনে।
অর্তিহা দরজা খুলে নামতে যায়, তখন আদ্রিক বলে,

— সাবধানে যাবি, আর আমি ছুটির পর এসে নিয়ে যাবো।
অর্তিহা আস্তে বলে,
— আচ্ছা।
আদ্রিকের মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
— বাই?
অর্তিহা নরমস্বরে, মিষ্টি হেসে বলে,
— বাই ভাইয়া।
বলেই সে চলে যায়। আদ্রিকও গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যায়। অর্তিহা ক্লাসে ঢুকেই প্রথমে তাকায় লাস্ট বেঞ্চের দিকে। ঠিক তিন নাম্বার বেঞ্চে, যেখানে প্রতিদিন মাওলিদ বসে। বহুদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখে অর্তিহার মুখে এক চিলতে হাসি ফোটে।
মাওলিদও তাকে দেখে উঠে আসে। এসে প্রশ্ন করে,

— এতোদিন কলেজে আসোনি কেন?
অর্তিহা আস্তে বলে,
— অসুস্থ ছিলাম। জ্বর ছিলো।
— এখন সুস্থ হয়েছো?
— হুম।
— চলো, ক্যাম্পাসে যায়।
— কেন? এক্ষুনি তো ক্লাস শুরু হয়ে যাবে!
— আজকে ক্লাস করবো না। ক্যাম্পাসে চল, কথা বলবো আর ঘুরবো।
— আচ্ছা।
দুজনেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে দাঁড়ায় এক গাছের নিচে। সেই গাছটার নিচে, যেখানে মাওলিদ অর্তিহাকে প্রপোজ করেছিলো। তারা গাছের নিচে থাকা বেঞ্চে বসে, মাঝখানে একহাত দূরত্ব রেখে। অর্তিহা কথা বলছে, আর মাওলিদ একদৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ অর্তিহা অনুভব করে কারও ছায়া তার উপর পড়েছে। কথা বলতে বলতে মাথা তুলে তাকাতেই সে থমকে যায়। মুহূর্তের জন্য যেন তার প্রাণটা কেঁপে ওঠে। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিক, হাতে অর্তিহার ফোন। বুঝতে পারে, আদ্রিক হয়তো ফোনটা ফেরত দিতেই এসেছে! কিন্তু এখন কী হবে? আদ্রিকের চোখে প্রশ্ন, মুখে শান্ত ভাব। কিন্তু সেই চোখের গভীরে এমন কিছুই ছিলো, যা দেখে অর্তিহার বুক কেঁপে ওঠে।
মাওলিদ খেয়াল করে আদ্রিক অর্তিহার দিকে তাকিয়ে আছে। সে রেগে উঠে বলে,

— আপনি কে? ওর থেকে চোখ সরান!
আদ্রিক এবার তাকায় মাওলিদের দিকে, ভালো করে দেখে নেয় তাকে।
অর্তিহা ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
— আদ্রিক ভাইয়া আপনি? এখানে?
আদ্রিক নামটা শুনেই মাওলিদ অবাক হয়ে যায়। বুঝে ফেলে, এ তো অর্তিহার কাজিন আদ্রিক!
আদ্রিক এবার ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,
— ছেলেটা কে?
অর্তিহা তোতলাতে থাকে,
— ও… ও… ও…
আদ্রিক আবার জিজ্ঞেস করে,
— কে?
অর্তিহা ভাবে, মিথ্যে বলবে হয়তো। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে, আদ্রিক তো পরিবারের সবচেয়ে শান্ত, নরম স্বভাবের মানুষ। হয়তো সত্যিটা জানলে সাহায্যই করবে। কিন্তু বোকা অর্তিহা তো জানে না, আদ্রিক কেবল তার কাছেই নরম থাকে।

অর্তিহা কিছুটা সাহস পায় এসব ভেবে, যদিও ভয় এখনো রয়ে গেছে। অসহায় কণ্ঠে বলে,
— আদ্রিক ভাইয়া, ও হচ্ছে মাওলিদ। ভাইয়া, ওকে আমি ভালোবাসি। অনেক অনেক ভালোবাসি।
এই কথাটা শুনে আদ্রিকের চোখের প্রশ্ন মুছে যায়। চোখদুটি শান্ত, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা। অর্তিহার মুখে ভালোবাসি শব্দটা অন্য কারও জন্য শুনে মনে হয় বুকের বাঁ পাশে কেউ তীর মেরেছে। ভিতরে রক্ত ঝরছে, ব্যাথা করছে কিন্তু সে অনুভূতিহীন হয়ে আছে।
অর্তিহা বলতেই থাকে,
— মাওলিদ ও আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমরা দুজন দুজনকে অনেক অনেক ভালোবাসি। একে অপরকে ছাড়া বাঁচবো না।
মাওলিদ এগিয়ে এসে বলে,

— হ্যা ভাইয়া, আমি অর্তিহাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না!
আদ্রিক এবার মাওলিদের দিকে তাকায়। ছেলেটির চোখে আকুতি। অর্তিহা চেয়ে থাকে উত্তর পাওয়ার আশায়।
আদ্রিক ধীর কন্ঠে বলে,
— চল।
অর্তিহা বলে,
— কিন্তু ভাইয়া…
আদ্রিক তার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। অর্তিহা পেছনে ফিরে মাওলিদকে চোখের ইশারায় বোঝায়। ভয় না পেতে, কিছু হবে না। আদ্রিক অর্তিহাকে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে মোবাইল বের করে কাউকে একটা মেসেজ পাঠায়। তারপর নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। অর্তিহা আদ্রিকের শান্ত চেহারা দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। ভাবে, হয়তো আদ্রিক তাদের সাহায্য করবে।
আদ্রিক গাড়ি চালাচ্ছে, চোখ স্থির সামনে। বুকটা ব্যথায় ভারী হয়ে আছে। হবে নাই বা কেন? সদ্য তার মনটা ভেঙে গেছে। মুখে কঠোরতা, কিন্তু চোখের গভীরে সেই হৃদয়ভাঙা কষ্ট লুকিয়ে আছে, যা নিষ্ঠুর অর্তিহা দেখতে পাচ্ছে না। নিজেকে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখে যে ছেলেটা, সে আজ পারছে না নিজের কষ্ট সামলাতে। জীবনে প্রথমবার এমন আঘাত পেয়েছে, তাও তার কাছ থেকেই যাকে সে কল্পনায়, চোখে, স্বপ্নে রেখে সুখ পেত।
অর্তিহা কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আস্তে বলে,

— থ্যাংক্স।
আদ্রিক চোখ ফেরায় তার দিকে, কিন্তু কোনো অভিব্যক্তি নেই। অর্তিহা বলে,
— আমাদের সাহায্য করার জন্য। আপনি সত্যিই অনেক ভালো আদ্রিক ভাইয়া।
আদ্রিক উত্তর দেয় না। সে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালিয়ে যায়। প্রায় ২৫–৩০ মিনিট পর গাড়ি থামে।
অর্তিহা অবাক চোখে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— এখানে কেন গাড়ি থামিয়েছেন? এটা তো বাসা না। কোথায় এটা?
আদ্রিক শান্ত স্বরে উত্তর দেয়,
— কাজি অফিস।
অর্তিহা আরও বেশি অবাক হয়। কাজি অফিসে কেন এনেছে? আদ্রিক গাড়ি থেকে নেমে অর্তিহার দিকের দরজাটা খুলে দেয়।
নামতে নামতে অর্তিহা আবার প্রশ্ন করে,

— কিন্তু কাজি অফিসে এসেছি কেন?
আদ্রিক অর্তিহার হাত ধরে কাজি অফিসের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
— তোর বিয়ে হবে তাই।
এই কথা শুনে অর্তিহার পা থেমে যায়। এবং চোখ পড়ে সামনে দাঁড়ানো মাওলিদের দিকে। মাওলিদের দুপাশে দুজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অর্তিহা তাদের চেনে না। তারা মাওলিদকে ধরে রেখেছে।
মাওলিদ অর্তিহাকে দেখে হতবাক হয়ে বলে,
— অর্তিহা তুমি এখানে? উনারা কারা? আমাকেই বা এখানে ধরে এনেছে কেন?
অর্তিহা হাসিমুখে মাওলিদকে বলে,
— আরে বোকা ভাইয়া আমাদের বিয়ের দিবে তাই কাজি অফিসে এনেছে আমাদের।
তারপর আদ্রিককে বলে,

— তাই না ভাইয়া?
আদ্রিক কোনো উত্তর দেয় না, শান্ত চোখে অর্তিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাওলিদ এবার তাকে ধরে রাখা দুজনকে বলে,
— এখন আমাকে ছাড়েন? আমি তো রাজি বিয়েতে!
কিন্তু তারা ছেড়ে দেয় না। তারা শুধু আদ্রিকের দিকে চেয়ে থাকে।
অর্তিহা সেই দুজনকে সামান্য ধমকের স্বরে বলে,
— এই আপনারা ছাড়েন ওকে। ধরে কেন রেখেছেন? ও পালাবে না! বরং ও তো চাই আমাকে বিয়ে করতে!
আদ্রিক কাজির দিকে তাকিয়ে বলে,

— কাগজপত্র সব রেডি?
কাজি উত্তর দেন,
— জ্বি।
অর্তিহা কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বলে,
— কিন্তু আদ্রিক ভাইয়া আমাদের তো এখনো ১৮ বছর হয়নি। বিয়েটা কি স্বীকৃতি পাবে আইনের দৃষ্টিতে?
কাজি বলেন,
— ছেলের বয়স তো ৩২ বছর হয়েছে।
অর্তিহা হেসে ফেলে,
— ৩২ বছর? আচ্ছা আপনার কি ঐ ছেলেটাকে ৩২ বছরের লাগে দেখতে?
কাজি বিরক্ত কন্ঠে বলেন,
— ঐ ছেলে বর কেন হতে যাবে?
তারপর কাজি আদ্রিককে দেখিয়ে বলেন,

— বর তো উনি। আর কনে আপনি!
অর্তিহা অবাক হয়ে বলে,
— কিসব বলছেন আপনি?
মাওলিদ বলে,
— কাজি সাহেব আপনার কোথায় ভুল হচ্ছে!
আদ্রিক বলে,
— কোনো ভুল হচ্ছে না। কাজি ঠিকই বলেছে।
আদ্রিক অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই মুহুর্তে তোর আর আমার বিয়ে হবে।
অর্তিহার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। সে আদ্রিকের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে বলে,
— কিসব বলছেন আপনি আদ্রিক ভাইয়া। আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আমি কেন আপনাকে বিয়ে করবো! আমি মাওলিদকে ভালোবাসি! আর মাওলিদকেই…..

কথাটা শেষ করবার আগেই অদ্রিক পিছন থেকে কোমরে গুঁজে রাখা বন্দুক বের করে এবং মাওলিদের দিকে তাক করায়। অর্তিহা স্তম্ভিত হয়ে যায়। হাত বাড়িয়ে বন্দুকটা নামাতে বলে,
— আদ্রিক ভাইয়া ওর দিকে বন্দুক কেন তাক করেছেন! নামান বন্ধুক!
আদ্রিক গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
— আর একবার তোর মুখে ভালোবাসি শব্দ টা শুনবো ডিরেক্ট কপালের মাঝ বরাবর এই বন্ধুকের ১৩ টা গুলি গেঁথে যাবে।
কথাটা শুনে ভয়ে অর্তিহার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়।
— আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না বন্ধুক নামান। বলবো না আমি!
কাজি এসব দেখে রেগে বলেন,

— আরে আপনারা এসব কি করছেন? এটা কাজি অফিস! আপনি বন্ধুক নামান নাহলে পুলিশকে কল করবো!
কথাটা শুনে আদ্রিক কাজির দিকে তাকিয়ে অর্তিহার হাত ছেড়ে কাজির দিকে এগিয়ে যায়। কাজির চোয়াল চেপে ধরে মুখ খুলিয়ে বন্দুকটি কাজির মুখের ভিতরে ঠেসে ঠান্ডা গলায় বলে,
— আর একটা শব্দ বের হবে তোর মুখ থেকে তাহলে ১৩ গুলি থেকে ৩ টা তোর নামে দলিল করে দিবো! বুঝেছিস?
কাজি ভয় পেয়ে মাথা নেড়ে থাকে। আদ্রিক কাজিকে ছেড়ে বললো,
— বিয়ে পড়ানো শুরু করো কাজি!
কাজি হাঁ সূচক মাথা নেড়ে নেয়।
অর্তিহা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলে,
— আমি জীবনেও আপনাকে বিয়ে করবো না! আমাদের ছেড়ে দিন!
আদ্রিক এক ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
— বিয়ে করবি না?
অর্তিহা জোরে বলে,
— না!

আদ্রিক মাওলিদের কাছে এগিয়ে যায়। সে মাওলিদকে ধরে রাখার সৌরভের দিকে তাকায় এবং হাত বাড়ায়। সৌরভ শার্টের নিচ থেকে একটা ছুড়ি বের করে আদ্রিকের হাতে দেয়। আদ্রিক ছুড়িটা নিয়ে হঠাৎ মাওলিদের বাম হাতের পেশিতে ঢুকিয়ে দেয়। মাওলিদ জোরে চিৎকার করে উঠে। অর্তিহাও চিৎকার করে উঠে ও দৌড়ে মাওলিদের কাছে গিয়ে তাকে ধরতে গেল। কিন্তু পারল না। আদ্রিক থামিয়ে দিল। অর্তিহা থেমে গিয়ে আদ্রিকের ঠাণ্ডা দৃষ্টি দেখল। আদ্রিক অর্তিহার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে পাশে রাখা হকিস্টিক তুলে মাওলিদের বাম পায়ে জোরে মারে।
সঙ্গে সঙ্গেই মাওলিদ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। আর আঘাত ছিল এতটাই শক্ত যে মাওলিদের পা ভেঙে যায়। তবু আদ্রিক থামে না। সৌরভ ও মিরাজ মাওলিদকে ধরে দাঁড় করায়। মাওলিদ ব্যথায় দাঁড়াতে পারছে না। আদ্রিক আবার ডান পায়ের হাটুতে বাড়ি মারে।
অর্তিহা ছুটে এসে আদ্রিকের পা ধরে মাটিতে বসে কেঁদে কেঁদে বলে,

— রাজি রাজি! আমি রাজি বিয়েতে! তাও আপনি ওকে ছেড়ে দেন। আমি আপনার পায়ে পড়ি। ওর জানের বদলে আপনি আমার জানটা নিয়ে নেন তাও ওকে ছেড়ে দেন। দয়া করেন! ওর কোনো দোষ নেই!
আদ্রিক হকিস্টিক ফেলে অর্তিহাকে ধরে দাঁড় করায়। অর্তিহার কাঁদতে কাঁদতে চেহারা লাল হয়ে গেছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। তবু আদ্রিকের মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। সে অর্তিহার হাত ধরেই তাকে কাজির সামনে থাকা চেয়ারে বসায়। তারপর নিজেও বসে পড়ে।
মাওলিদের হাত ও পায়ের যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও সে অর্তিহাকে বলে,
— অর্তিহা প্লিজ বিয়েটা করো না!
আদ্রিক ঘাড় ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অর্তিহা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতেই আদ্রিক কে বলে,
— বিয়ে তো করছি! ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেন!
আদ্রিক কোনো উত্তর দিল না। কাজি ভয়ে ভয়ে আদ্রিককে কি যেন একটা ইশারা করছে। আদ্রিক তীক্ষ্ণ চোখে কাজির দিকে তাকিয়ে গানটা পিছন থেকে বের করে কাজিকে দেখিয়ে টেবিলের উপর রাখে। কাজি ভয়ে ইশারা করা বন্ধ করে দেয়।
তিনি কাপতে কাপতে বলেন,

— আপনিই তো বললেন মুখ থেকে শব্দ যেন বের না হয়!
আদ্রিক আগের মতোই ঠান্ডা দৃষ্টি রেখে বলে,
— তুই দেখি মরনের পায়তারা করছিস কাজি!
কাজি দ্রুত বলে উঠে,
— না না! আমি বিয়ে পড়াচ্ছি! আপনি বলুন দেনমোহর কত নির্ধারণ করবো?
আদ্রিক স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
— ওর ঐ আশিকের কলিজা!
কাজি চমকে উঠে,
— কি…কি…কি….
আদ্রিক ঠান্ডা গলায় বলে,
— সৌরভ কাজির মাথায় হকিস্টিক দিয়ে একটা মারো তো! ওর মেশিনে কথা আটকে গেছে।
সাব্বির বলে,
— ওকে বস।
বলেই মাওলিদকে ছেড়ে হকিস্টিক নিতে গেলে কাজি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে,

— না না না! মারতে হবে না মারতে হবে না মারতে হবে না!
আদ্রিক বলে,
— তোর কি কাজি মুখে সমস্যা? কোনো কথা একবার বলতে পারিস না? এক কথা বারবার রিপিট করিস!
কাজি কাঁপতে কাঁপতেই বলে,
— পারি পারি পারি!
আদ্রিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তার তাকানোটা এমন ছিল যেন সে কাজিকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে।
কাজি আবার বলেন,
— হয়েছে টা কি বাবা?
আদ্রিক বলে,
— আমাকে কি তোর ৭০ বছরের বুড়ো মনে হচ্ছে? নাহলে তুই নিজে ৫০+ হয়ে আমাকে বাবা ডাকছিস! বাপ হতে হলেও তো কম পক্ষে ২০ বছর লাগবে?
কাজি লজ্জায় বলে,

— ভুল হয়ে গেছে! হয়েছে টা কি….
আদ্রিক কাজিকে থামিয়ে বলে,
— তারপর কি হয়েছে সেটা বল! মাথা খাওয়ার চেষ্টা করিস না আমার! নাহলে তোর বডি রাস্তার কুকুর রা খাবে!
কাজি দ্রুত বলে,
— বলছিলাম দেনমোহর হিসেবে কারো কলিজা রাখা যায় না! এটা হালাল না! আর বিয়েটা হালাল ভাবে না হলে এই মেয়েকে ছোঁয়াও তোমার হালাল হবে না!
আদ্রিক ঠোঁটভঙ্গি করে বলে,
— ঠিক আছে, দেনমোহর ৫ লাখ রাখো! এমনিতেও আমার সবকিছুই ওর থাকবে!
কাজি দেনমোহর লিখতে শুরু করে। আদ্রিক পাশে দিকে তাকিয়ে দেখে অর্তিহা এখনো কাঁদছে। তবু আদ্রিকের কোনো কষ্ট নেই। অন্য সময়ে অর্তিহার চোখের পানি মুছে ফেলতে সে পৃথিবী উল্টে দিত, কিন্তু আজ সে এত কষ্ট পেয়েছে যে সবকিছু তুচ্ছ মনে হচ্ছে।
কাজি দেনমোহর লেখা শেষ করে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন,

— আপনি আভীর কারদারের একমাত্র মেয়ে অর্তিহা কারদারের সাথে বিবাহের জন্য রাজি আছেন?
আদ্রিক টেবিল থেকে বন্দুক লোড করে শান্ত গলায় বলে,
— না তোর বাল ফালাতে এসেছি এখানে!
কাজি বলেন,
— এটা বিবাহের নিয়ম। আমি বাড়তি কিছু করছি না। বিবাহের সম্মতির জন্য এভাবেই জিজ্ঞেস করতে হয়।
এবার মিরাজ ধমক দিয়ে বলে,
— এই কাজি চুপ কর তো! বাড়তি কথা বসের পছন্দ না!
মিরাজের ধমকে কাজি দমে গিয়ে আদ্রিকের দিকে বলে,
— আপনি যদি রাজি থাকেন তবে বলুন কবুল!
আদ্রিক অর্তিহার দিকে তাকায়। অর্তিহা কাঁদছে, তার চোখে অসহায়ত্ব ফুটে আছে। আদ্রিক এবার কাজির দিকে বলে,
— কবুল কবুল কবুল।
কাজি বিয়ে রেজিস্ট্রেশন পেপারটি এগিয়ে দিয়ে বলেন,

— সাক্ষর করুন।
আদ্রিক দ্রুত সাক্ষর করে দেয়। কাজি এবার অর্তিহাকে বলেন,
— আপনি যদি আফির কারদারের একমাত্র ছেলে আদ্রিক কারদারের সাথে বিবাহে রাজি থাকেন তাহলে বলুন কবুল।
ঠিক তখনই মাওলিদ কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— না অর্তিহা কবুল বলো না তোমাকে ছাড়া আমি বাচতে পারবো না!
অর্তিহা মাওলিদের দিকে তাকায়। মাওলিদ দাঁড়াতে পারছে না। সৌরভ ও মিরাজ ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। মাওলিদের হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে অনেক কষ্টে কাতরাচ্ছে।
কাজি আবার বলেন,
— কবুল বলুন মা?

অর্তিহা মাওলিদের থেকে চোখ ঘুরিয়ে আদ্রিকের দিকে তাকায়। আদ্রিক একেবারেই শান্ত, চোখ আরও ঠাণ্ডা। অর্তিহা আবার মাওলিদের দিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠে। আদ্রিক ঠাণ্ডা গলায় বলে,
— কবুল বল দ্রুত অর্তি।
অর্তিহা হঠাৎই রেগে চিল্লিয়ে উঠে,
— কবর, কবর, আদ্রিক কারদারের কবর!
আদ্রিক ছাড়া উপস্থিত সবাই হতভম্ভ হয়ে গেল। মেয়েটা বলেছে কি? কবুল বলার বদলে সে কবর বলেছে। আদ্রিকের চেহারায় কোনো পরিবর্তন নেই।
কাজি অনুরোধ করে বলেন,
— মা এসব কি বলছেন! আপনাকে কবুল বলতে বলা হয়েছে। আপনি কবুল বলেন!
অর্তিহা বলে,
— বলেছি!
কাজি বলেন,
— কই আপনি তো কবুল বলার বদলে কবর বলেছেন! তাও হবু স্বামীর!
অর্তিহা স্থির কণ্ঠে বলে,
— আমি যেটা চাই সেটাই বলেছি!

আদ্রিক সৌরভের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে। সৌরভ তা বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাওলিদের পেটে জোরে ঘুসি মারে! এবং অনবরত ঘুষি মারতে থাকে। মাওলিদ ব্যথায় চিৎকার করে উঠছে। অর্তিহা সেটা দেখে উঠে যেতে চাইলে আদ্রিক তার হাত ধরে ফেলে। অর্তিহা তাকালেই আদ্রিক মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো না। অর্তিহা আবার বসে পড়ে, কিন্তু চোখের জল থামছে না।
অর্তিহা কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে,
— ওকে মারছে! বন্ধ করতে বলেন! ওর কষ্ট হচ্ছে!
আদ্রিক আগের মতো করেই বলে,
— কবুল বল!
অর্তিহা কণ্ঠ কেঁপে বলে,

— কবুল কবুল কবুল। এখন ওকে মারা বন্ধ করতে বলেন!
অর্তিহাকে কবুল বলতে শুনে মাওলিদ কেঁদে উঠে। আদ্রিক সৌরভকে চোখে ইশারা করলে সৌরভ থেমে যায়। মাওলিদ কে ঘুসি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কাজি রেজিস্ট্রেশন পেপারটা এগিয়ে দেয় অর্তিহাকে সাক্ষর করার জন্য। অর্তিহা বাধ্য মেয়ের মতো সাক্ষর করে দেয়।
কাজি বলেন,
— এখন মেয়ে পক্ষের দুজন সাক্ষী লাগবে ছেলে পক্ষের দুজন। কে কে হবে সাক্ষী?
আদ্রিক মিরাজ ও সৌরভকে লক্ষ্য করে বলে,
— একে এখানে নিয়ে আসো!
তারা মাওলিদকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে এলো
কারণ মাওলিদের দুটো পা-ই ভেঙে গেছে, সে হাঁটতে পারবে না।
আদ্রিক বলে,

— বসাও ঐ চেয়ারটাতে।
তারা আদ্রিকের কথা মতো একটি চেয়ার টেনে এনে বসায় মাওলিদকে। এরপর আদ্রিক কাজিকে বলে,
— মেয়ের পক্ষ থেকে ও সাক্ষী দেবে!
কাজি আপত্তি করেন,
— কিন্তু ও সাক্ষী দিলে তো হবে না! ওর তো আঠারো……
আদ্রিক টেবিল থেকে বন্ধুক টা তুলে দেখাতেই কাজির স্বর পাল্টে গেল। কাজি জোরপূর্বক হেসে বলে,
— আঠারো না হলে কি হয়েছে? হবে আলবাত হবে!
মাওলিদ কণ্ঠ কেঁপে বলে,
— আমি আমার ভালোবাসা মানুষের বিয়ের সাক্ষী হবো না!
আদ্রিক অর্তিহার দিকে তাকিয়ে বলে,
— অর্তি বোঝা তোর প্রেমিককে!
অর্তিহা কণ্ঠে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলে,
— আপনি এতোটা পাষাণ কিভাবে হতে পারেন? এতো নোংরা মনের আপনি!
আদ্রিক আগের মতোই বলে,

— এর থেকে অনেক পাষাণ আমি! সেটা সময়ের সাথে দেখবি! এখন সাক্ষী হতে বল দ্রুত!
অর্তিহা কাঁদতে কাঁদতে মাওলিদকে বলে,
— মাওলিদ প্লিজ সাক্ষী হয়ে যাও নয়ত এই মানুষ টা তোমাকে মেরে ফেলবে!
মাওলিদ চোখে জল নিয়ে অসহায় গলায় বলে,
— অর্তিহা আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমি পারবো না এটা করতে!
অর্তিহা বলে,

— তোমাকে আমার কসম! প্লিজ সাক্ষী হয়ে যাও।
মাওলিদ চুপ হয়ে যায়। আদ্রিক বিয়ে রেজিষ্ট্রেশন পেপারটা তার সামনে রাখে এবং কলমটাও দেয়। ঠোঁটের তার হাসি। যা দেখে অর্তিহার ঘৃণায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠে। মাওলিদ একবার ক্ষোভভরা দৃষ্টিতে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে, কাজির দেখানো স্থানে সাক্ষর করে। সাক্ষর শেষ করেই মাওলিদ চেয়ারটিতে মাথা ভরিয়ে দেয়। শরীর ও মন দুটোর ব্যথায় ক্লান্ত হয়ে গেছে। সে টিকতে পারছে না।
অর্তিহা এগিয়ে গিয়ে মাওলিদকে ধরতে চাইলে, আদ্রিক তাকে ধরে ফেলে,
— স্বামীর পায়ের নিচেই স্ত্রীর জান্নাত জানিস না? স্বামীর পারমিশন ছাড়া শ্বাস নেওয়াটাও গুনাহ! সেখানে তুই আমাকে না জিজ্ঞেস করে পর ছেলেকে ধরার জন্য উঠে যাচ্ছিলি!
অর্তিহা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
— আপনি জাহান্নাম! আপনার পায়ের নিচে জান্নাত কিভাবে থাকবে?
আদ্রিক হেসে উত্তর দেয়,
— তাই? পুরোপুরি জাহান্নাম দেখায়, বেবিডল?
— আর কি জাহান্নাম দেখাবেন আপনি আমাকে?
আদ্রিক ঠাট্টা করে বলে,

— বাকি আছে আরও অর্তিজান! তুই আমাকে যা দেখিয়েছিস এটার সামনে এইগুলো ক্ষুদ্র কণা!
অর্তিহা ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আদ্রিক কাজির দিকে তাকিয়ে বলে,
— তাকিয়ে আছো কেন? ওদের সাক্ষর নিয়ে দ্রুত বিয়ের কাজ শেষ করো!
কাজি মাথা নেড়ে দ্রুত মিরাজকে অর্তিহার পক্ষ থেকে সাক্ষী রাখে এবং সৌরভকে আদ্রিকের পক্ষ থেকে। সাথে কাজির এক লোককে আদ্রিকের পক্ষের সাক্ষী রেখে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। বিয়ে শেষ হলে আদ্রিক উঠে দাঁড়ায়, মাওলিদের বসে থাকা চেয়ারে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চেয়ারের দুই হাতে ভর দিয়ে মাওলিদের দিকে ঝুঁকে বলে,
— কি বলছিলি? আমার অর্তিজানকে ছাড়া বাচতে পারবি না? ঠিক আছে তোকে কষ্ট করে বাচতে হবে না! আমি তোর হেল্প করে দিচ্ছি!

অর্তিহা দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে পেছন থেকে আদ্রিকের শার্ট টেনে খামচে মাওলিদকে দূরে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। মাওলিদ নিভৃতে, ভ্রু কুঞ্চিত করে আদ্রিকের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দেহের শক্তি সব হ্রাস পেয়েছে। সে তাকিয়ে থাকার শক্তিও পাচ্ছে না, ক্লান্তি আর ক্ষমতাহীনতায়। আদ্রিক আচমকা মাওলিদের হাতে গেঁথে রাখা ছুড়ি বের করে ফেলে। মাওলিদ ব্যথায় জোরে চিৎকার করে ওঠে।
আদ্রিক ছুড়িটা ধরেই সরাসরি মাওলিদের বুকে ঢুকিয়ে দেয়, জোরে। মাওলিদের চোখ বড় হয়ে যায়। অর্তিহা চিৎকার করে মাওলিদকে ধরতে যায়। কিন্তু আদ্রিক বাম হাত দিয়ে বাধা দিয়ে রাখে। ধীরে ধীরে মাওলিদের চোখ স্বাভাবিক হয়ে আসে। দেহ থেকে প্রাণটা বেরিয়ে যায়। কাজি ও তার সহকারী ভয়ভীতিতে স্থির হয়ে থাকে।
আদ্রিক সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,

— দ্যাটস্ মাই রিজাইন।
অর্তিহা মাটিতে বসে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে।
— আদ্রিক ভাইয়া সরেন! আমাকে যেতে দিন মাওলিদের কাছে! ওর কিছু হতে পারে না! প্লিজ আমাকে মাওলিদের কাছে যেতে দিন!
আদ্রিক অর্তিহার কথায় কান দেয় না। সে পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতে লেগে থাকা রক্ত মুছে, অর্তিহাকে পাজকোলা করে তুলে কোলে নেয়। তারপর মিরাজ ও সৌরভের উদ্দেশ্যে বলে,
— এর লাশের খবরটাও যেন কাকপক্ষী না পায়!
তারপর কাজির দিকে তাকিয়ে বলে,
— কিছু দেখছো তোমরা?
কাজি আর তার সহকারী ভয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,
— না!
আদ্রিক টেবিল থেকে নিজের বন্দুক নিয়ে অর্তিহাকে কোলে করে কাজি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। অর্তিহা কোলে ছটফট করে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,

— নামান আমাকে! যেতে দিন আমাকে আমার মাওলিদের কাছে!
আদ্রিক গাড়ির দরজা খুলে অর্তিহাকে বসায়। অর্তিহা বাইরে চলে যেতে চাইলে আদ্রিক দরজাটা লক করে দেয়। এরপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে পানির বোতল থেকে পানি নিয়ে হাতে লাগা রক্ত পরিষ্কার করতে থাকে। পরে টিস্যু দিয়ে হাত মুছে অর্তিহার দিকে দেখায়। অর্তিহা কাঁদছে, প্রলাপ করছে। মাওলিদের কাছে যেতে বলছে।
অর্তিহা রাগ করে বলে,
— আমি ড্যাড, ভাইয়া সবাইকে বলে দিবো আপনি একটা জানোয়ার! আমার ভাইয়া আপনাকে মেরে ফেলবে!
আদ্রিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
— বলে দে! তারপর আমি ওদেরকেও মেরে ফেলবো! ফিনিস!
অর্তিহা বলে,
— লজ্জা করছে অমানুষ? নিকৃষ্ট একটা মানুষ! ভালো মানুষির মুখোশ পরে ঘুরেন! দোয়া করি মরে যান আপনি! আপনি যেদিন মরবেন সেদিন আমার থেকে খুশি কেউ হবে না! আমি মিষ্টি বিলাবো রাস্তায় রাস্তায়!
আদ্রিক অভ্যাসগত হাসিটা টেনে বলে,
— তাহলে আজকে আমি মিষ্টি বিলায়? আমার বউয়ের আশিক মরেছে?
অর্তিহা ঘৃণা কণ্ঠে বলে,
— আপনার মুখে থুতু দিতে ইচ্ছে করছে! নোংরা, নিকৃষ্ট…
আর বলতে পারে না, আদ্রিক অর্তিহার চোয়াল চেপে ধরে। অর্তিহার মুখের একদম কাছে নিজের মুখটা তুলেই হিমশীতল চোখে তাকিয়ে বলে,

— বেশি বলছিস! আর আমি যা করেছি বেশ করেছি! আমার জিনিসের দিকে চোখ দিয়েছে কোন সাহসে? তাই মেরে ফেলেছিস! আর তুই? তোকে আমি ছেড়ে দিবো? তুই আমাকে হার্ট করেছিস! আর আমাকে যে হার্ট করে আমি তাকে হার্ট করি! তোর থেকে কষ্ট টা আমি বেশি পেয়েছি! আনএক্সপেক্টেড ছিলো তোর দেওয়া কষ্ট টা! এর শাস্তি তুই পাবি! আর যদি তোর মুখ থেকে একটা শব্দ বের হয় তাহলে পরবর্তীতে আরো কতগুলো লাশ পরবে নাই বললাম! শুধু তুই শব্দ কর আর আমি তোকে দেখাবো!
অর্তিহা ভয়ে নিজেকে চেপে ধরে, কোনো শব্দ না বেরোয়ার জন্য মুখ আটকায়। আদ্রিক গাড়ি স্টার্ট করে। গাড়ি চলতে থাকে, অর্তিহা একটুও শব্দ করে না, মুখ চেপে বসে থাকে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে গাড়ি কারদার ম্যানরের সামনে থামে। অর্তিহা দ্রুত মুখ মুছে, নিজেকে সামলে নেয় যেন কেউ বোঝে না কিছুই।
সোজা বাড়িতে ঢুকে সিঁড়ি ওঠার জন্য পা বাড়াতেই নাজনীন বলেন,

— অর্তি আজকে এতো দেরী হলো যে? আর তোমার চোখ-মুখ এমন ফুলে আছে কেন?
অর্তিহা কিছু বলার আগেই আদ্রিক মেইন ডোর দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলে,
— অর্তি আইসক্রিমের বায়না করছিলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাবে। আমি নিষেধ করায় কেদে দিয়েছিলো। তারপর রাস্তায় রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাওয়াতেই দেরী হয়েছে আর অর্তির চেহারা একদম লাল হয়ে আছে।
নাজনীন কাছে এসে অর্তিহাকে আদর করে বলে,
— ইশশ আইসক্রিমের জন্য কান্না করে চেহারার কি হাল করে ফেলেছে! আমার ছেলেটা অনেক পাজি! নয়ত আইসক্রিমের জন্য অনেক কান্না করিয়েছে এতো সুন্দর মেয়েটাকে?
আদ্রিক অর্তিহার দিকে একটা ভ্রু উচিয়ে তাকিয়ে বলে,
— অর্তি আমি সত্যিই পাজি?
অর্তিহা চোখ সরিয়ে নেয়। আদ্রিককে দেখার ইচ্ছে নেই, ঘৃণায় তাকাতে চায় না। নাজনীন বলে,

— দেখেছো আবার জিজ্ঞেস করছে!
অর্তিহা আস্তে করে বলে,
— মিমি আমি রুমে যাচ্ছি মাথাটা আমার অনেক ধরেছে!
নাজনীন বলে,
— আচ্ছা আমি সায়মাকে পাঠাচ্ছি তোমার মাথাটা একটু টিপে দিবে?
অর্তিহা বলে,
— না মিমি তার প্রয়োজন নেই! আমি শুধু একটু একা থাকতে চাই। ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।
নাজনীন বলে,
— আচ্ছা।
অর্তিহা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে গিয়ে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে মাটিতে বসে ডুকে কেঁদে ওঠে। চুল ধরে কাঁদতে থাকে।

— ইশ আজকের যা যা হয়েছে সবকিছু স্বপ্ন হতো! আমার ঘুম ভেঙে যেতো আর আমি দেখতাম এসব কিছু স্বপ্ন ছিলো। তুমি বেচে আছো! বিশ্বাস করো আমি আর তোমার কাছে যেতাম না! তুমি দূরে থাকো তাও বেচে থাকতে! আল্লাহ তোমার কাছে দোয়া লাগি এইসব কিছু যেন স্বপ্ন হয়। আমার মাওলিদ যেন বেঁচে থাকে!
কোনোক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে এই আশায় থাকে যে সে জেগে উঠবে এবং সব কিছু মিথ্যে হয়ে যাবে, কিন্তু পরে চোখ খুলে জোরে কাঁদতে উঠে বলে,

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৫

— আল্লাহ তুমি আছো! তুমি তোমার বান্দার ডাক ফিরিয়ে দাও না! আমার টাও ফিরিয়ে দিও না! আজকে আমার মাওলিদ যতটা যন্ত্রণা সহ্য করে মৃত্যুবরণ করেছে তুমি তার থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি কষ্ট দিয়ে ঐ আদ্রিক কারদারের মৃত্যু দিবে! আল্লাহ আমি যদি জীবনে কখনো কোনো ভালো কাজ করে থাকি তাহলে আজকে তুমি আমার দোয়া কবুল করবে! ঐ আদ্রিক কারদারের নির্মম মৃত্যু দেবে তুমি আল্লাহ! আজকে আমার মাওলিদ আমার ভালোবাসা যতটা কষ্ট পেয়েছে সেই কষ্ট তুমি ঐ আদ্রিক কারদার কে দিবে। তুমি ধ্বংস করে দিবে নরপিশাচটাকে!

মোহশৃঙ্খল পর্ব ১৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here