বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৪
রানী আমিনা
থমকে গেলো আনাবিয়া, কিয়ৎক্ষণের জন্য থেমে গেলো ওর হাত। নাক টেনে ঘ্রাণ নিলো আবারও। এই ঘ্রাণ ওর চেনা, প্রচন্ড চেনা!
বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠলো যেন। অবিশ্বাসী চেহারায় হুট করেই উঠে দাড়ালো ও, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রইলো ক্ষণকালের জন্য। কিন্তু ঘ্রাণটা যেভাবে ঝাপটে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই আবার উধাও হয়ে গেলো মুহুর্তেই!
ঘ্রাণটুকুর এই হঠাৎ পলায়নে দিশেহারা হয়ে উঠলো আনাবিয়া, বুক ভরে দম নিয়ে আবার চেষ্টা করলো ঘ্রাণ টা পাওয়ার, কিন্তু নেই, আর নেই…….! তবে এ ঘ্রাণ কোথা থেকে এলো? কিভাবে এলো? এই ঘ্রাণ ছুটে এসে ওকে কেন ছুঁয়ে দিয়ে গেলো?
বুকের গভীর থেকে এক তীব্র শ্বাস টেনে নিলো আনাবিয়া, ওই চিরপরিচিত ঘ্রাণটিকে আরেকবার অনুভব করার তীব্র চেষ্টা করলো! চোখ বন্ধ করে নিলো, নাক টেনে দম নিয়ে আবারও খুঁজে চলল সে ঘ্রাণ!
কিভাবে….. কিভাবে? এটা সত্যি নয়, এসব সত্যি নয়! এসব অসম্ভব; এসব নিছকই ওর মনের কল্পনা!
কিন্তু আনাবিয়ার মস্তিষ্ক এই কথাটি ওর মনকে বিশ্বাস করাতে ব্যর্থ হলো সম্পুর্ন! ওর মন ওকে জানান দিলো, আশেপাশে সে যা দেখছে তা সত্যি নয়, ওকে যা দেখানো হচ্ছে তা সত্যি নয়! কোথাও কিছু লুকোনো হচ্ছে ওর থেকে, লুকোনো হচ্ছে কাউকে!
সত্যিই কি লুকোনো হচ্ছে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘ্রাণটাকে হাতড়েও খুঁজে না পেয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে তাকালো আনাবিয়া, বেতের ঝুড়িটা সেখানেই ফেলে ছুটলো ও অজানার উদ্দ্যেশ্যে! ব্যাকুল হয়ে উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে ছুটতে ছুটতে গহীন জঙ্গলের চতুর্দিকে উদভ্রান্তের ন্যায় দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে ও খুঁজে চললো কাউকে, চিরপরিচিত কাউকে!
বাতাসের প্রতিটি তরঙ্গ ধরে ও দিশেহারার ন্যায় হাতড়ে চলল বহুল আকাঙ্ক্ষিত ঘ্রাণটির খোঁজে!
এক অদৃশ্য ছায়া, কোনো মায়াবী হাতছানির পেছনে ছুটে চলার মতো দৌড়ে চলল, যদি আর একটিবার….. শুধু একটিবার ওর আত্মার ন্যায় সুপরিচিত ঘ্রাণটির অস্তিত্বের ছোঁয়া পায়! যদি আরেকটিবার অনুভব করা যায় সেই দৃঢ়চেতা ব্যাক্তিটিকে!
কিন্তু পেলোনা আনাবিয়া, কিছুই পেলোনা! ওই শেষ, ওই এক ঝলকেই শেষ ওর মীরের ঘ্রাণটুকু!
আর একটু আগে যদি জানতো তবে ওই ঘ্রাণটুকুকে ও এই প্রকৃতি থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পুরে ফেলতো নিজের বক্ষে, কিন্তু আর তা পাবেনা, আর কোনোদিনও পাবেনা, সম্ভব নয়!
তবুও প্রাণপণে বাতাস ধরে ছুটলো আনাবিয়া, মাথা থেকে পড়ে গেলো ওর হুডির হুডখানা, বাতাসে মেলে গেলো দীর্ঘ সফেদ চুল! সেগুলো সাগরের বুকে ছুটে চলা পালতোলা নৌকার ছিড়ে যাওয়া পালের মতো উড়ে চলল বাতাসে।
নেই, কোথাও নেই! কোথাও নেই ওর মীরের ঘ্রাণ, তবে এটুকু প্রকৃতি ওকে কেন দিলো? কি কারণে দিলো? ওর প্রাণপণে শুকোতে চাওয়া ক্ষতগুলোকে আবার জীবন্ত করে দিতে?
ছুটতে ছুটতে আচমকাই ফুপিয়ে উঠলো আনাবিয়া, দুচোখ ছাপিয়ে বিষাদের ধারা নামলো অঝোরে, রাতের রেড জোন হঠাৎ বৃষ্টিতে খেই হারিয়ে ফেললো যেন!
কিন্তু এই ঝুম বৃষ্টির দাপটে চাপা পড়ে গেলো রেড জোনের সমস্ত ঘ্রাণ। আনাবিয়া সেই হারিয়ে যাওয়া ঘ্রাণটুকু আরেকটিবার পাওয়ার জন্য চোখ মোছার চেষ্টা করলো বারংবার কিন্তু কাজ হলোনা, চোখ ছাপিয়ে দ্বিগুণ গতিতে ঝরতে লাগলো অশ্রু, বেড়ে গেলো বৃষ্টির গতি!
প্রচন্ড অসহায় ঠেকলো ওর নিজেকে, আকুল হয়ে কান্নাজড়ানো অস্ফুটস্বরে একবার ও ডেকে উঠলো,
“মীরি…!”
সম্বোধন খানা হাহাকার হয়ে বেরিয়ে এলো আনাবিয়ার বুক চিরে, কিন্তু কেউ শুনলোনা সে ডাক, বৃষ্টির তুমুল বর্ষণের শব্দে চাপা পড়ে গেলো ওর কণ্ঠনিঃসৃত তীব্র যন্ত্রণার ধ্বনি!
হিচকি দিয়ে কেঁদে উঠলো আনাবিয়া, পা জোড়ার গতি ধীমে এলো, ধীরে ধীরে থেমে গেলো ওর ছোটা। ক্লান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো ও ঘন জঙ্গলের মধ্যিখানে, আর তারপর হাটু গেড়ে ধপ বসে পড়লো মাটিতে! কেউ নেই কোথাও, কেউ না…
এই নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা নিঃস্তব্ধ জঙ্গলে ও একা, একেবারেই একা…..
মধ্যরাত, আকাশ সম্পুর্ন পরিষ্কার। চাঁদের আলো এসে পড়ছে জঙ্গলের ভেতর। সরু পথগুলো চাঁদের আলোয় আবছা দৃশ্যমান হয়ে আছে। তারই ভেতর দিয়ে হাতে মশলার বাস্কেট টা ঝুলিয়ে ধীর পায়ে এগোচ্ছে আনাবিয়া।
ফোনটা ডেড হয়ে আছে। চার্জ যেটুকু ছিলো সেটুকুও শেষ। রাত বেড়ে যাওয়ার কারণে ফিরতি রাস্তা চিনতে একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে আনাবিয়ার, তবুও নিজের হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে দৃষ্টি দিয়ে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে হেটে চলেছে ও।
রাতটিকে হঠাৎ করেই দারুণ উপভোগ করছে। এভাবে কতদিন জঙ্গলে রাত কাটানো হয়না! মীর থাকতে যখন তখন মীরকে টেনে নিয়ে জঙ্গলে চলে আসতো ও, দুজনে মিলে কত ঘোরাঘুরিই না করতো! সেসব এখন শুধুই স্মৃতি!
শব্দ করে দম ছাড়লো আনাবিয়া, একটু আগের পাগলামির জন্য হাসলো মনে মনে। ওর মীরের ঘ্রাণ এখানে কোথা থেকে আসবে? এই জঙ্গলে, এই গভীর জঙ্গলে কিভাবে আসবে? দিনে দিনে পাগল হওয়ার রাস্তায় হাটছে ও।
হাজার চেষ্টা করেও মানুষটিকে এতটুকু সময়ের জন্য ভুলতে সক্ষম হয়নি, আর না সক্ষম হয়েছে তার প্রতি এক বিন্দু ভালোবাসা কমাতে, এতটুকু ঘৃণা করতে! পাগল তো হওয়ারই ছিলো।
ঘুমটুকুই যা ভরসা। কিন্তু ঘুমিয়েও যে শান্তি নেই, প্রায় প্রতি রাতেই মীর হানা দেয় ওর স্বপ্নে, স্বপ্নেই মীরের সাথে কাটে ওর হাজার হাজার ঘন্টা। সেখানেও রাগ অভিমানের পালা চলে ওর মীরের সাথে।
হাটতে হাটতে এমন সময় আচমকাই থমকে গেলো আনাবিয়া, ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অবিলম্বে জানান দিলো কোনো দ্বিতীয় পক্ষের উপস্থিতির। দাঁড়িয়ে গেলো ও মুহুর্তেই।
চুপচাপ স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো ঠিক কে আছে এদিকে, এই জনমানবহীন এলাকায়!
কিছু মুহূর্ত স্থীর অপেক্ষার পরেই ওর চোখে পড়লো এক তরুণ দম্পতিকে, আনাবিয়ার অবস্থান থেকে বেশ কিছুটা দূরের অন্য একটি সরু পথ দিয়ে নিজেদের ভেতর চুপিসারে কথা বলতে বলতে খুব সন্তর্পণে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে ওরা, আশপাশটা নজর রাখছে সতর্ক চোখে।
ভ্রু কুচকালো আনাবিয়া, এই জনমানবহীন স্থানে এই এক জোড়া নারী পুরুষ কি করছে ওর মাথায় এলোনা। চিন্তা ঝেড়ে নিজের রাস্তা থেকে বেরিয়ে এসে ও এগিয়ে গেলো দম্পতিটির দিকে।
চিন্তিত মুখে হেটে জঙ্গল থেকে বের হওয়ার চেষ্টারত দম্পতিটি নিজেদের ভেতর কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যাস্ত ছিলো, হঠাৎ করেই নিজেদের সামনে এত রাতে অন্য কাউকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে চিৎকার দিলো ওরা, ওদের চিৎকারে আশেপাশের প্রাণীগুলোর একাংশ ভয়ে চেচিয়ে উঠলো।
আনাবিয়া ওদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো এখানে ঠিক কি হচ্ছে, খেয়াল করে দেখলো ও দম্পতিটিকে৷ মেয়েটি ভয় পেয়ে এক হাত বুকের ওপর দিয়ে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় ব্যাস্ত, পুরুষটি ওকে দেখে থমকে গিয়ে কাঁপা-কাঁপি লাগিয়ে দিয়েছে, হাতে তার একটি বড়সড় থলে।
আনাবিয়া তাকালো থলেটের দিকে, তাকাতেই চোখে পড়লো ছেলেটার হাতে একটি বিশাল কামড়ের দাগ দগদগ করছে, কোনো হিংস্র প্রাণী সদ্যই কামড়ে দিয়েছে তাকে। রক্ত ঝরছে এখনো৷ হয়তো হাতটাই ছিড়ে নিয়ে যেতো, কামড়টা দেখে তেমনই মনে হচ্ছে।
থলেটি ভেজা, তা থেকে ক্ষণে ক্ষণে টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে কোনো তরল। নাক টেনে গন্ধ নিলো আনাবিয়া, নাকে এসে ওর ঠেকলো রক্তের ঘ্রাণ।
“শেহ-শেহজাদী…!”
আনাবিয়ার ঝলমলে চোখজোড়া দেখে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো মেয়েটি, পরমুহূর্তেই বিস্ময় কাটিয়ে তড়িঘড়ি করে মাথা নুইয়ে আনুগত্য জানালো সে, পাশে অথর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকা পুরুষটিকে আনাবিয়ার অলক্ষ্যে একটা চাটি মেরে মনে করিয়ে দিলো আনুগত্য প্রদর্শনের কথা। ছেলেটি আঘাত পেয়ে পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে নিলো, তারপর মাথা নুইয়ে আনুগত্য প্রদর্শন করলো সেও৷
“তোমরা এত রাতে এখানে কি করছো?”
সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধোলো আনাবিয়া। দম্পতিটি মুহুর্তেই একে অপরের সাথে চোখাচোখি করলো একবার, মেয়েটি বলে উঠলো,
“আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি শেহজাদী! ওষধি লতা সংগ্রহ করতে এদিকে এসেছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় আর ফিরতে পারিনি, আর এখন রাস্তা চিনতে পারছিনা।”
“কোথায় থাকো তোমরা?”
“অ্যা-অ্যানিম্যাল টাউনে শেহজাদী!”
উত্তরদিলো পুরুষটি। আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ তীর্যক চোখে পর্যবেক্ষণ করলো ওদের দুজনকে। পুরুষটির হাতের দিকে নির্দেশ করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিসে কামড়েছে তোমার হাতে?”
“নেন-নেকড়ে শহেজাদী! খরগোশ শিকার করতে গিয়ে নেকড়ের হামলার শিকার হতে চলেছিলাম। আরেকটু হলে জান বাঁচানো মুশকিল ছিলো।”
“তোমাদের অ্যানিম্যাল ফর্ম কি?”
“আমরা পাইথন শেহজাদী!”
বলল মেয়েটি। আনাবিয়া তবুও সন্দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে, ক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর বলে উঠলো,
“এসো আমার সাথে।”
ছেলেটির হাতে সামান্য প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দম্পতিটিকে অ্যানিম্যাল টাউনের কাছাকাছি ছেড়ে কিছুক্ষণ আগেই মহলে ফিরেছে আনাবিয়া। কিন্তু মনের ভেতর ওর কেমন জানি অশান্তি কাজ করছে।
দম্পতিটি ভীষণ অদ্ভুত! ওরা ওষধি লতা সংগ্রহ করতে যে যায়নি সে সম্পর্কে আনাবিয়া নিশ্চিত, ওদের ভেতরের পুরুষটির হাতের থলেতে আনাবিয়া স্পষ্ট রক্তের গন্ধ পেয়েছে, এবং সেটা খরগোসের নয়, হরিণের। তবে ছেলেটি মিথ্যে কেন বলল?
আনাবিয়ার ধারণা ওরা অ্যানিম্যাল টাউনেই ঢোকেনি। অ্যানিম্যাল টাউনের নারী পুরুষদের সাথে ওদের পোশাক এবং আচার আচরণের কোনো মিলই নেই, পুরোটাই অন্যরকম। তবে?
ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়লো ও, এসব ছাইপাঁশ ব্যাপার স্যাপার ভেবে নিজের মাথাটা আর খারাপ করতে চাইলোনা। কামরায় ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বাস্কেটটা কোনো রকমে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।
ধুমধাম ফ্রেশ হয়ে কামরায় ফিরে গা এলিয়ে দিলো বিছানায়, দেহ আর চলছে না।
বালিশে মাথা রাখার কিছু মুহুর্ত পরেই নিজের মস্তিষ্কের ভেতর ঘুর্ণিঝড়ের ন্যায় পাক খেতে থাকা ভাবনা গুলো শান্ত হয়ে ঝুম বৃষ্টির মতোন ঘুম ঝরে পড়লো ওর চোখে৷
“আপনার মনে আছে আম্মা, একদিন হিজ ম্যাজেস্টি মিস্টার সাদির ওপর কি ক্ষ্যাপাটাই না ক্ষেপেছিলেন?”
সকাল বেলা মহলের কিছুটা দূরে হাতে লাগানো কিছু চারাগাছে পানি দিতে দিতে কোকো আর ফ্যালকনের সাথে গল্প করছিলো আনাবিয়া।
সকালের খাওয়া শেষ করে মাত্রই উঠেছে সবাই, বাচ্চারা যে যার কাজে চলে গেছে, শার্লট আর ফাতমা মিলে দুপুরে কি রান্না হবে সেটা নিয়ে ঝগড়া করতে ব্যাস্ত, ব্রায়ান ওদের ভেতরে আপাতত রেফারি হিসেবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
লিন্ডা আর লিও দুজনে মিলে মহলের অদূরে থাকা মোটা অশ্বত্থ গাছটার নিচে বসে গল্প করতে করতে এখন হাতাহাতি র পর্যায়ে চলে গেছে। এবং কোকো ফ্যালকন এসে পড়েছে আনাবিয়ার পেছনে, গল্পের শেষ নেই তাদের।
তখনি কোকোর করা প্রশ্নে পানি দেওয়ার কাজে কিঞ্চিৎ বাধা পড়লো আনাবিয়ার।
কোকো আবারও বলল,
“সেদিন হিজ ম্যাজেস্টি যা রেগে ছিলেন তাতে আপনি যদি সঠিক সময়ে এসে না পৌছাতেন তবে মিস্টার সাদির কুলখানি খেতে হতো আমাদের।”
কোকো ফ্যালকনকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো, আর আনাবিয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিনের সমস্ত ঘটনা!
দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার, পরদিন সাপ্তাহিক ছুটি। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছিলো সেদিন মিটিংরুমে, সবগুলো দ্বীপের কন্ট্রোলারগণ সেদিন সমবেত হয়েছিলেন, রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন সেদিন।
বাচ্চারা তখন সবাই ছোট ছোট, কোকো তখন প্রায় পঁচিশে পড়েছে। আনাবিয়া ছিলো নিজের কামরায়, দুপুরের খাবারটা মীরের সাথে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো।
হঠাৎই কোকো আর নোমান ছুটে আসে রয়্যাল ফ্লোরের বারান্দায়, দুমদাম কড়া নাড়ার শব্দে আনাবিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে খুলে দেয় দরজা, খুলতেই ভয়ে আতঙ্কে পাংশু হয়ে যাওয়া কোকো বলে ওঠে,
“আম্মা, হিজ ম্যাজেস্টি ভয়ানক রেগে আছেন, জায়ান সাদিকে আজ হয়তো মেরেই ফেলবেন, আপনি তাড়াতাড়ি চলুন!”
আনাবিয়া জানতোনা কি হয়েছে, জানতোনা জায়ান চাচাজান ঠিক কি অপরাধ করেছেন যার জন্য মীর তার ওপর এতটা রেগে গেছে যে সে জায়ানকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেনা!
ছুটে গেছিলো সেদিন মিটিং রুমের দিকে, কিন্তু ও মিটিং রুমে ঢোকার আগেই সেখানের দরজা ভয়নাক শব্দে ঠেলে দুর্বার ঝড়ের ন্যায় পা ফেলে বেরিয়ে আসছিলো মীর।
প্রচন্ড ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষে গেছিলো তার, ভ্রু জোড়া কুচকে ছিলো ভয়ানক আক্রোশে, স্বর্ণাভ চোখজোড়ায় জ্বলছিলো আগুনের লেলিহান শিখা!
জায়ান সাদি আকড়ে ধরেছিলেন মীরের ডান পা, আর মীর ঝড়ের বেগে জায়ানকে সুদ্ধ টেনে হিচড়ে নিয়ে এগোতে এগোতে নিজের বজ্রকন্ঠে বলছিলো,
“এই মুহুর্তে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও নইলে আজ এখানেই আমি তোমাকে দাফন করে ফেলবো!”
কিন্তু জায়ান পা ছাড়েনি, ক্ষমা পাওয়ার জন্য সে আকুল হয়ে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বার বার অনুনয় করে চলেছিলো মীরের কাছে!
সাম্রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিরা সব তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, কারো মুখে সামান্য টু শব্দ টুকু ছিলোনা, সম্পুর্ন ফ্লোরটাতে শুধুমাত্র মীরের বজ্রকন্ঠ আর জায়ানের আকুতি পূর্ণ স্বর ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিলোনা!
মীর বার বার বলার পরও জায়ান যখন পা ছাড়লোনা তখন মীরের ক্রোধ সম্পুর্ন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছিলো! তড়িতে ঘুরে এক ঝটকায় জায়ানের পোশাকের বুকের কাছটা ধরে হ্যাচকা টানে উচু করে তুলে ধরেছিলো শুণ্যে! আর এরপর যখন তীব্র বেগে জায়ানকে পাশের পাথুরে দেয়ালে ছুড়ে মারতে যাবে তখনি পেছন থেকে এক জোড়া মাখন সম হাত এসে জড়িয়ে নেয় মীরের উদর, মীরের পিঠে এসে স্পর্শ করে তার কোমল পেট, বক্ষ!
আর মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায় মীর, ওর ক্রোধে পরিপূর্ণ চেহারাটা ধীরে ধীরে হয়ে আসে স্বাভাবিক,
হাতের বজ্রমুষ্ঠিতে ধরে রাখা জায়ানের পোশাকের বুকের কাছটা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এসে এক সময় ছেড়ে যায় সম্পুর্ন।
জায়ান শব্দ করে আছড়ে পড়ে মেঝেতে, ভয়ে হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকে তার বুক।
সেদিন একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি আনাবিয়া, শুধুমাত্র নিজের স্পর্শ দিয়েই কাবু করে ফেলছিলো সে মীরকে। মীর সেদিন জায়ানকে ছেড়ে দিয়েই ঘুরে দাড়িয়েছিলো, এরপর কোলে তুলে নিয়েছিলো আনাবিয়াকে।
সেদিন দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পুরোটা সময় আনাবিয়াকে মীরের সাথে বিছানাতেই কাটাতে হয়েছে, যতক্ষণ না সে মানুষটা ক্রোধ ছেড়ে শান্ত হয়ে একটু ঘুমিয়েছে!
মৃদু হাসলো আনাবিয়া, কি দিনই না গেছে ওদের! স্মৃতিপটে ভেসে উঠলে সে সবকিছুই এখন অবাস্তব মনে হয়, এত ভালোবাসাও কি সম্ভব ছিলো?
যদি ছিলোই তবে শেষ মুহুর্তে এসে কি হলো ওদের? সব এমন এলোমেলো কেন হয়ে গেলো? কার কুনজর পড়েছিলো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার কাজে মন দিলো আনাবিয়া, তখনি ওর মনে পড়লো গতরাতে মীরের শরীরের ঘ্রাণ পাওয়ার কথা।
বুকের ভেতরটা মুহুর্তেই ধ্বক করে উঠলো ওর, ঢোক গিললো একটা শব্দ করে। মস্তিষ্ক বার বার বলতে চাইছে এটা ওর মনের ভুল, কিন্তু মনের ভুল এতটা বাস্তব কিভাবে হতে পারে!
ওই ঘ্রাণটা স্পষ্টই মীরের শরীরের ঘ্রাণ ছিলো, মীরের ঘ্রাণ ওর চেনা; প্রচন্ড চেনা, এতে ওর ভুল হতেই পারেনা, কোনো মতেই না। তবে?
আনাবিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়লো মহলের অদূরে অশ্বত্থের নিচে লিও আর লিন্ডার হুটোপুটির শব্দে। ফিরে তাকালো আনাবিয়া, লিও দাড়িয়ে আছে গাছের নিচে, লিন্ডা লিওর প্রশস্ত কাঁধের ওপর উঠে বসে অশ্বত্থের একটা ডাল ভাঙার চেষ্টায় ব্যাস্ত। মুচড়ে মুচড়ে সরু ডালটিকে গাছের শরীর থেকে আলাদা করে ফেলার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে৷
আনাবিয়ার মনে পড়ে গেলো ওদের নিজেদের কথা, প্রাসাদের জিমে যখন মীরের পেছন পেছন সেও টকুর টুকুর করতে করতে যেত তখন মীর ওকে তুলে নিতো ওর শক্ত বাহুডোরে, আনাবিয়াকে কোলে নিয়েই মীর স্কোয়াট করতো।
পুশআপ দেওয়ার সময়ে আনাবিয়া উঠে পড়তো মীরের পিঠে, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকতো ও মীরের প্রসস্ত পিঠের ওপর। আর মীর পুশআপ দিতো যতক্ষণ না আনাবিয়া ওকে থামতে বলতো!
ট্রেডমিলের ওপর ওকে বসিয়ে দিয়ে দৌড়াতো মীর, আনাবিয়া যখন বন্ধ করবে তখন বন্ধ হবে, যখন যে স্পিড দিবে তখন সেই স্পিডে মীরকে দৌড়াতে হবে!
মাঝে মাঝেই নিজের সম্মুখে বসা আনাবিয়ার দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতো ওর চোয়াল, গাল, গলা!
আনাবিয়া হাসতো ভীষণ। মজা পেতো মীরকে নাকানিচুাবানী খাইয়ে, কিন্তু মীর কখনোই থেমে যেতো না, আনাবিয়ার সব খায়েশ পুরণ করে তবেই সে স্থীর হতো!
লিও লিন্ডার থেকে চোখ সরিয়ে নিলো আনাবিয়া। চারাগাছ গুলোতে পানি দেওয়া শেষ, এখন কামরায় ফেরার পালা। কোকো ফ্যালকন এখনো গল্পতে মজে আছে।
আনাবিয়া হাতের জলসিঞ্চনী টা নিয়ে এগোলো মহলের দিকে, আর সেই মুহুর্তেই মাথার ভেতর চক্কর দিয়ে উঠলো ওর। থমকে দাঁড়িয়ে গেলো সাথে সাথে, সূর্যের আলো ক্রমস ঝাপসা হয়ে এলো ওর চোখে।
শব্দগুলো যেন দূরে সরে যাচ্ছে, কানে ভেসে আসছে ফিসফিসে ঝিরঝির শব্দ, যেন ওকে পানির ভেতর ঠেলে ফেলে দিয়েছে কেউ, ডুবে যাচ্ছে ও অতলে! পায়ের নিচে মাটি নরম হয়ে উঠছে যেন ক্রমেই!
ভারসাম্য হারিয়ে এবার হঠাৎ করেই দুলে উঠলো আনাবিয়ার শরীরটা, চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো, যেন এখনি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে যাবে!
জলসিঞ্চনী টি হাত থেকে পড়ে ঝন ঝন শব্দ তুলে গড়িয়ে চলে গেলো অন্য দিকে। আর এরপর অপ্রত্যাশিতভাবে শরীরটা ঢলে পড়লো ওর, শব্দ করে আছড়ে পড়ে আলিঙ্গন করলো মাটি, সফেদ কেশগুচ্ছ ছড়িয়ে পড়লো গালের উপর!
শব্দ পেতেই চমকে তাকালো কোকো, আর তাকিয়ে আনাবিয়াকে এভাবে দেখা মাত্রই মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো যেন ওর!
ছুটে এসে ও লুটিয়ে পড়লো আনাবিয়ার পাশে, দুহাতে আনাবিয়াকে টেনে কোলের ওপর তুলে নিলো, মুখের ওপর এসে পড়া চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত কন্ঠে ডেকে উঠলো,
“আম্মা, আম্মা! শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা, আম্মা…… চোখ খুলুন আম্মা!”
প্রচন্ড ভড়কালো কোকো, বুকের মধ্যে ধুকধুক করতে থাকা ভয়কে সামলে নিয়ে, কাঁপা হাতে আনাবিয়ার কপাল ছুঁয়ে দেখলো, ঠান্ডা হয়ে আছে একদম!
শার্লট ফাতমা মহলের কিচেনে ছিলো, শব্দ পেয়ে ছুটে এলো ওরাও। আনাবিয়াকে এভাবে নিস্তেজ পড়ে থাকতে দেখে ভয় পেলো ওরা, ডুকরে কেঁদে উঠলো শার্লট। ফাতমার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু করলো আতঙ্কে, পাংশু মুখে সে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে।
ব্রায়ান তাড়া দিয়ে বলল,
“ফাতমা, তুমি সেইফজোনে আমাদের হেকিম ছিলে, তুমি একটু দেখো শেহজাদীকে!”
হিম হয়ে যাওয়া শঙ্কা নিয়ে ফাতমা তাকিয়ে ছিলো আনাবিয়ার দিকে, ব্রায়ানের কথায় হুশ ফিরলো ওর। দ্রুত স্বরে কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“ভাইজান, শেহজাদীর মাথা নিচের দিকে রাখুন। মস্তিষ্কে রক্তচলাচল ভালো হবে এতে।”
এরপর শার্লটকে আনাবিয়ার পাজোড়া ধরে সামান্য উঁচু করতে বলে লিন্ডাকে বাতাস করার দায়িত্ব দিয়ে ফাতমা ছুটলো মহলের ভেতর৷
দ্রুত বেগে ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এলো সে, সাথে একটা রুমাল। ঠান্ডা পানিতে রুমাল ভিজিয়ে দ্রুত হাতে রাখলো আনাবিয়ার কপালে, হাতের আঁজলায় নিয়ে অল্প অল্প করে ছিটিয়ে দিলো আনাবিয়ার মুখের ওপর।
সম্পুর্ন অচেতন আনাবিয়া, কোকো সমানে ডেকে যাচ্ছে ওকে কিন্তু কোনো সাড়া নেই তার! শার্লট সমানে কেঁদে যাচ্ছে, ব্রায়ান না পেরে ওকে সরিয়ে নিলো অন্যত্র। ফাতমা বোতল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ছোয়ালো আনাবিয়ার ঠোঁটে।
“আম্মা, চোখ খুলুন আম্মা! একটাবার তাকান আমার দিকে…!”
ভাঙা ভাঙা কম্পিত স্বরে বলে উঠলো কোকো। দুহাতে আনাবিয়াকে আগলে নিলো ছোট বাচ্চাটির মতো করে, যেন
হৃদয়ের যত যত্ন, যত ভালোবাসা, সব ঢেলে দিতো চাইলো এই আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে!
সেই মুহুর্তেই তিরতির করে কেঁপে উঠলো আনাবিয়ার চোখের পাতা, কোকো ডাকলো আরও কয়েকবার। কিয়ৎক্ষণ বাদেই ধীরে ধীরে চোখ খুললো আনাবিয়া।
চোখ খুলেই সবাইকে এভাবে চিন্তিত মুখে ওর ওপর ঝুঁকে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত হলো ও। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতে নিতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো কোকোর কোলের ভেতর। পিটপিট করে তাকালো ও কোকোর দিকে, দুর্বল গলায় শুধালো,
“কি হয়েছিলো আমার?”
“জ্ঞান হারিয়েছিলেন আপনি আম্মা, মিনিট পাঁচেক হচ্ছে!”
চোখ জোড়া আরও কবার পিটপিট করলো আনাবিয়া, মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ করেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর! উঠে বসার চেষ্টা করলো ও, কোকো সাহায্য করলো ওকে বসতে, মাথাটা তুলে ঠেকালো নিজের বুকের ওপর।
পানিকাঁদায় মাখামাখি হয়ে গেছে শরীরের পোশাক আর চুল, চিটচিট করছে শরীর, গোসল না দিল্ব হবেই না। কিন্তু শরীরটা দুর্বল লাগছে ভীষণ!
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৩
ফাতমার দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে ও যন্ত্রের মতো করে বলে উঠলো,
“আমি গোসল দিবো।”
ফাতমা তৎক্ষনাৎ লিন্ডাকে চোখের ইশারায় আনাবিয়ার গোসলের ব্যাবস্থা করতে বললো, লিন্ডা ছুটলো আনাবিয়ার কামরায়। ফাতমা আর শার্লট মিলে ধরে উঠিয়ে দিলো আনাবিয়াকে, এরপর ধরে ধরেই নিয়ে গেলো আনাবিয়ার কামরার ভেতর।
