বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৭
রানী আমিনা
কোকোর ডাক শুনে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে এলো আনাবিয়া। গায়ের কালো রঙা ঝমঝমে গাউনের সাথে পিঠময় ছড়িয়ে থাকা সফেদ চুলগুলো ঝলমলিয়ে উঠলো ওর প্রতি পদক্ষেপে।
মহলের বারান্দা চত্বরে এসে দাঁড়িয়ে ও তাকালো সম্মুখে, কোকো, লিও, লিন্ডা তিনজনে মিলে ছুটছে এদিকেই। কোকোর কোলে কেউ, কোনো মেয়ে, জ্ঞানহীন। খোলা চুল রক্ত মাখা।
চমকালো আনাবিয়া, শার্লট ফাতমা ঠিক আছে তো? মনে পড়লো ওরা তো কামরাতেই ছিলো! ঘুমিয়েও পড়েছে এতক্ষণে, বাইরে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা। তবে এই মেয়ে কে?
উদ্বিগ্ন চিত্তে কয়েক পা এগিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে এলো আনাবিয়া, কোকো দ্রুত পায়ে হেটে এসে বলে উঠলো,
“আম্মা, একে জঙ্গলের ভেতর পেয়েছি। এর হাতখানা কোনো কিছুতে কামড়ে নিয়েছে, হাত টা আর একটু হলেই ছিড়ে যেতো! শরীরেও অনেক আচঁড়ের চিহ্ন, রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। অবস্থা বেশি ভালো নয়, লিও না দেখতে পেলে মরে পড়ে থাকতো জঙ্গলে। দেখুন কি করা যায়!”
“ওকে গেস্ট রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দে, আর ফাতমা কে ডেকে বল ওকে ফার্স্ট এইড দিতে। আমি এখনি আসছি।”
বলেই দ্রুত পায়ে আবার কামরায় চলে গেলো আনাবিয়া। কোকো তৎক্ষনাৎ মেয়েটিকে নিয়ে ছুটলো গেস্ট রুমের দিকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কামরায় গিয়ে হাতের চিরুনীটা রেখে ভারী সফেদ চুলগুলো হাতখোপা করে নিলো আনাবিয়া, একটা ক্লাচার দিয়ে আটকে নিলো যেন আবার খুলে না যায়, তারপর এগোলো গেস্ট রুমের দিকে।
ফাতমা ততক্ষণে একটা রুমাল ভিজিয়ে মেয়েটির ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে শুরু করেছে। হাতের মাঝবরাবর একটা ভীষণ শক্তিশালী কামড়, কবজির সীমানা থেকে শুরু করে হাতের কনিষ্ঠ আঙুল পর্যন্ত অর্ধচন্দ্র আকৃতির কামড়ের দাগ। কামড় দাতার ক্যানাইন দাঁতদ্বয় যে খুব জোর বিধেছে, আর তার আঘাতেই যে হাতটা আর একটু হলে খুলে চলে আসতো সেটা দেখা মাত্রই বোঝা যাচ্ছে। ক্যানাইন দাঁতের কামড়ের স্থান দুটো এফোড় ওফোড় হয়ে গেছে।
আনাবিয়া কামরায় ঢুকে দাড়ালো বিছানার পাশে। মেয়েটিকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, সে সম্পুর্ন অচেতন। ছেলে গুলো বাইরে। শার্লট মেয়েটির গায়ের পোশাক খুলে দিলো, কাঁদা মাটি আর রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে তার শরীর৷ ধারালো নখের ভারী ক্ষত তার শরীরের যেখানে সেখানে, সেগুলো থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে এখনো, ক্ষতের চারপাশ শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে।
আনাবিয়া মেয়েটিকে দেখলো ভালোভাবে, কোথায় যেন দেখেছে মনে হলো। ভ্রু কুচকে মনে করার চেষ্টা করলো, তখনই ওর মস্তিষ্ক হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করলো মেয়েটির স্মৃতি।
এই মেয়েটিকেই বেশ কয়েক মাস পূর্বে আনাবিয়া দেখেছিলো জঙ্গলের ভেতর, তার সাথে একজন পুরুষও ছিলো। সেদিন ওই পুরুষটির হাতেও এমনই এক কামড় দেখেছিলো ও।
দ্রুতপদে জ্ঞানহীন মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলো আনাবিয়া, মেয়েটির মুখখানা পরখ করে নিলো আরও একবার। মুখের ওপর একটা বিশাল থাবার চিহ্ন, তিনটা নখের গভীর আচড় কপাল থেকে শুরু হয়ে থুতনি পর্যন্ত নেমে গেছে। কপালের ওপর লেপ্টে আছে কিছু চুল। শার্লট একে একে মুছে দিচ্ছে তার সারা শরীর।
মেয়েটির ক্ষত বিক্ষত হাতখানা তুলে নিলো আনাবিয়া কোলের ওপর। নিবিড়ভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো কামড়ের দাগ গুলো। কামড় প্রাণীটা মাত্র একবারই দিয়েছে, তার ধারালো দাঁত থেকে হাত ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় টানাহেঁচড়া করতে গিয়ে হাতখানা আরও বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। আরেকটু হলেই হাতখানা হারাতো মেয়েটি।
ভীষণ ভারী কামড়! কিন্তু কামড়টা ঠিক কোন প্রাণীর সেটা বুঝতে পারলোনা আনাবিয়া। এমন শক্তিশালী ফোর্স কোন প্রাণীর দাঁতে থাকতে পারে সেটাই মনে মনে ভেবে চললো ও৷
মেয়েটির শরীর পরিষ্কার করা শেষ, শার্লট কামরা থেকে নিজের একটা পোশাক এনে পরিয়ে দিলো ওকে। তারপর ফাতমাকে সাথে নিয়ে চলে গেলো নিজের কামরায়।
আনাবিয়া এখন ওর হ্যিলিং সং শুরু করবে, তাই আগেভাগে বিছানায় গেলো ওরা। ঘুমটা জমবে ভালো।
ওরা বিছানায় যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই গেস্ট রুম থেকে ভেসে এলো মন মাতানো সুরের এক মৃদু ঝংকার। ঠিক কোনো সেতারের তারে আঙুল বুলিয়ে ক্ষীণ সুর তোলার মতো শুরু হলো কন্ঠটি, অতঃপর একটু একটু করে বাড়তে থাকলো সেই সুর।
কখনো তা গাঢ় হলো, কখনো হালকা, কখনো মৃদু। রুগ্ন কারো তপ্ত কপালে রাখা হাতের মতোন শান্ত স্নিগ্ধ; এক নরম, মোহময় সুর। না কোনো বাদ্যযন্ত্র, না তাতে কোনো কথা শুধু নিঃশ্বাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা এক মন মাতানো শব্দ!
আনাবিয়ার মুখনিঃসৃত মোহনীয় সুরেলা কন্ঠ বাতাসে মিশে একে একে ঢেকে ফেললো সম্পুর্ন রেড জোন, আর এ সুরের মূর্চ্ছনায় ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো সকলে।
শুধু রেড জোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভয়ানক শব্দে গর্জে উঠে আকাশ ভারী করে ফেললো কোনো হিংস্র প্রাণী……
“শেহজাদী, মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।”
কোকো লিও আর কাঞ্জিকে বাজারের ফর্দ ঝুলিয়ে দিচ্ছিলো আনাবিয়া। ওরা এখন কুরো আহমারে যাবে, সেখান থেকে আগামী এক মাসের বাজার নিয়ে ফিরবে। ফেরার পথে ফারিশ আর ওর মেয়েদের সাথে নিয়ে আসবে।
মেয়ে দুটোকে নিয়ে ফারিশ এসেছিলো সেদিন, কিন্তু আনাবিয়ার শরীর একটু খারাপ থাকায় ওদের সাথে তেমন কথা বলা হয়নি। তাই আজ আবার ওদেরকে সাথে করে নিয়ে আসতে বলেছে। মেয়ে দুটো সেদিন যেতেই চাইছিলোনা বাসায়, ফারিশ কোনো রকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে গেছিলো। বাড়ি গিয়ে নাকি সে কি কান্না!
এমন সময় শার্লটের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ও, ইশারায় বুঝিয়ে দিলো কাজ শেষ করেই আসছে। তারপর আবার কোকোর দিকে ফিরে বলল,
“সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে নিয়ে আসবি, গতবার কিন্তু তেজপাতা আনতে গিয়ে ঘাসের পাতা নিয়ে এসেছিলি। এবার যদি ভুল করিস তবে সব ঘাস পাতা তোকে খাওয়াবো।”
“আমার কি দোষ? দোকানদার বলল এক নম্বরের তেজপাতা! আমি কি করে জানবো ওটা তেজপাতা না? দেখতে তো একই রকম!”
গাল ফুলিয়ে বলল কোকো। পাশ থেকে লিও বলে উঠলো,
“ভাই তুই বুড়ো হয়ে গেছিস, গাল ফুলানোর বয়স এখন তোর আছে নাকি? লুনা গাল ফুলোলে মানায়, তুই কেন ফুলোবি?”
“কথায় কথায় তোর ম্যাও কে টানবি না তো! আমার আম্মার কাছে আমি চব্বিশ ঘণ্টা গাল ফুলোবো তাতে তোর কি?”
আনাবিয়া চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে কপট ধমকে বলে উঠলো,
“অ্যাই তোরা থামবি? বুড়ো হয়ে গেছে সব তবুও এখনো বাচ্চা ছেলেদের মতো ঝগড়া করবে! যাহ্, বাজার নিয়ে আয়।”
কোকো লিওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঠোঁট বেকিয়ে ভেঙচি কেটে উঠে পড়লো, লিও-ও দুষ্টু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে এগোলো ওর পেছন পেছন। কাঞ্জি খালি গায়ে ছিলো, ছুটে কামরায় গিয়ে হাতে একটা শার্ট নিয়ে ছুটলো ওদের পেছনে৷
বাইক নিয়ে যাবে ওরা।
হিজ ম্যাজেস্টির গাড়িখানা পড়ে আছে মহলের বেইজমেন্টে, কিন্তু ওদের আম্মা কাউকে তা ছুতেও দেয়না। কয়েক দিন পর পর গিয়ে পরিষ্কার করে রেখে আসে, অন্য কেউ পরিষ্কার করলেও হবে না। তারই পরিষ্কার করা লাগবে৷
নিজেদের বাইকগুলো নিয়ে ওরা তিনজনে ছুটলো কুরো আহমারের উদ্দ্যেশ্যে, আর আনাবিয়া এগোলো গেস্ট রুমের দিকে।
মেয়েটিকে এক কাপ চা আর কিছু কুকিজ দিয়ে গেছে ফাতমা মেয়েটি সেগুলোই চায়ের কাপে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে ব্যাস্ত। আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে দাড়াতে গেলো সে, কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর চক্করে গরম চা ছলকে কিছুটা পড়ে গেলো মেয়েটির গায়ের ওপর। চিৎকার দিয়ে উঠলো সে!
আনাবিয়া এগিয়ে এসে নরম সুরে বলে উঠলো,
“সাবধানে, এত অস্থির হয়োনা৷”
মেয়েটি স্থীর হয়ে নত মুখে দাড়ালো, চোখে মুখে ফুটে উঠলো নিদারুণ যন্ত্রণা৷ আনাবিয়া ঘাড় কাত করে দরজার দিকে ফিরে ডাকলো,
“ফাতমা!”
ফাতমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সেখানে।
“আমার কামরা থেকে বার্ন ক্রিমটা নিয়ে আয় তো, ডান দিকের ওয়াল আলমিরার চার নম্বর কম্পার্টমেন্টে খুজলেই পেয়ে যাবি।”
ফাতমা ছুটে গিয়ে তখুনি বার্ন ক্রিম নিয়ে হাজির হলো। আনাবিয়া তা থেকে অল্প একটু আঙুলের মাথায় নিয়ে আলতো হাতে প্রলেপ বুলিয়ে দিলো মেয়েটির ক্ষতস্থানে, দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি নাম?”
“র্-রাইজেল”
“কিসে কামড়েছিলো তোমাকে?”
“হা-হায়েনা শেহজাদী!”
কিঞ্চিৎ কম্পিত কন্ঠে বলল রাইজেল মেয়েটি৷ আনাবিয়া মুখ তুলে চাইলো মেয়েটির পানে, যেন পড়ে নিতে চাইলো ভেতরটা। মেয়েটা ভড়কালো সামান্য।
“অতো রাতে জঙ্গলে কি করছিলে?”
“শ-শিকার ধরতে বেরিয়েছিলাম শেহজাদী।”
শুকনো একটা ঢোক গিলে উত্তর করলো সে। আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো তখনো সেভাবেই। মেয়েটি চোখ নামিয়ে নিয়ে চুপসে গিয়ে বসে রইলো।
আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে আবারও বার্ন ক্রিমের দিকে নজর দিলো। মেয়েটি জড়সড় হয়ে চুপচাপ বসে রইলো নত মুখে, অজানা এক ভীতিতে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করলো না।
সন্ধ্যার কিছু আগে কোকো লিও কাঞ্জির সাথে সাথে রেড জোনে এসে পৌছালো ফারিশ আর তার দুই জমজ মেয়ে ফেরিশা আর ফালাক।
এরা ফারিশের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। প্রথম স্ত্রীর থেকে ওর তিনজন ছেলে। প্রথম স্ত্রীর সাথে কোনো অনিবার্য কারণবসত ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর বিগত দশ বছর আগে ফারিশ আবারও বিয়ে করে, সেই স্ত্রীর সাথেই ওর এই দুই মেয়ে। মেয়েদুটো এবার ছ বছরে পড়েছে।
আনাবিয়া বারান্দা চত্বরেই ছিলো, ফারিশের গাড়ি মহলের সম্মুখে এসে দাড়ালে মেয়েদুটো হুটোপুটি করতে করতে দরজা খুলে নেমে এক ছুটে উঠে এলো বারান্দায়, তারপর ফুপ্পি বলে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো আনাবিয়ার কোলে।
আনাবিয়া দুজনকে দুহাতে আকড়ে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে, মেয়েদুটো প্রচন্ড খুশিতে আত্মহারা হয়ে চেচামেচি করতে শুরু করলো।
তখনি ফারিশ বাইরে বেরিয়ে গাড়ির দরজা দিতে দিতে বলে উঠলো,
“ফুপ্পিকে বেশি বিরক্ত কোরোনা মামানিরা।”
ফালাক আর ফেরিশা বাবার দিকে তাকিয়ে জিভ বের করে ভেঙচি কেটে বুঝিয়ে দিলো তারা বাবার কথার কোনো পাত্তাই দিবেনা৷
ওদের ভেঙচি কাটার ভঙ্গিমায় আনাবিয়া হেসে দিলো। ফারিশ মেয়েদের দেখে হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে চলে গেলো কোকো ফ্যালকনদের উদ্দ্যেশ্যে। আনাবিয়া বাচ্চা দুটোকে নিজের কোলের ওপর উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো তোমরা ফালাক ফেরিশা?”
“অন্নেএএক ভালো!”
দু হাত দুদিকে প্রসারিত করে ভালো থাকার পরিমাণ্টা দেখিয়ে দিলো ফেরিশা। দেখতে পুরোটাই বাবার মতো হয়েছে দুজন, মাথা ভর্তি কুচকুচে কালো ঝাকড়া চুল ঝুটি করে বাধা। পুতুলের মতো লাগছে দুজনকে।
আনাবিয়া ফেরিশার গাল টিপে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমাদের আম্মা কেমন আছে?”
“আম্মাও ভালো আছে।”
মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলো ফালাক, কিন্তু ফেরিশা আনাবিয়ার দিকে মুখ বাকিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“ফালাক জানেনা ফুপ্পি, আম্মা না ভালো নেই।”
“কেন কি হয়েছে?”
ফালাকের মতো করেই ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো আনাবিয়া, চোখে ওর দুষ্টি হাসি৷
“পাপা আম্মাকে খুব বকেছে, তাই আম্মা কাঁদছিলো। তাই আম্মা ভালো নেই।”
ফালাকের থেকে লুকিয়ে ফিসফিস করে বলল ফেরিশা আবারো। আনাবিয়া সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন? পাপা আম্মাকে বকেছে কেন?”
“পাপা তো আম্মার সাথে কথা বলে না, না? তো আম্মা পাপার সাথে কথা বলতে এসেছিলো যে, তাই পাপা আম্মাকে বকেছে। আমি লুকিয়ে দেখে ফেলেছি। বকা খেয়ে আম্মা খুব কাঁদছিলো।”
আনাবিয়ার চোখ থেকে দুষ্টু হাসিটা সরে গেলো মুহুর্তেই। আনাবিয়া আগেই আন্দাজ করেছিলো ফারিশের সাথে ওর স্ত্রীর সম্পর্ক খুব বেশি ভালো নয়। কিন্তু এ ব্যাপার গুলো বাচ্চাদের সম্মুখে এভাবে প্রকট হয়ে উঠলে সেটা ওদের দাম্পত্যজীবন এবং এই বাচ্চাদুটোর ভবিষ্যতের জন্য একদমই ভালো হবে না।
আনাবিয়া কথার মোড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে নিয়ে গেলো দ্রুতই, বাচ্চাদুটোকে হাসি তামাশায় ভরিয়ে দিতে দিতে এগোলো কামরার দিকে।
রাত তখন গভীর, আনাবিয়ার ঘুম আসছে না। ফালাক ফেরিশা দুজনে দুপাশ থেকে জড়িয়ে রেখেছে ওকে, আনাবিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে প্রচন্ড।
বাচ্চাদের স্পর্শে ওর খুব বেশি অসুবিধা হয়না, কিন্তু আজ হচ্ছে। হয়তো খুব বেশিক্ষণ স্পর্শ করে থাকায় এখন আর সহ্য হচ্ছে না! কেমন যেন দম আটকানো অনুভূতি হচ্ছে। মনে চাইছে সব কিছু ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে যেতে এ স্থান থেকে।
বড় করে দম নিলো আনাবিয়া, ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে বাচ্চাদুটোর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো ও৷ দুটোকে আলাদা কামরায় ঘুমোতে দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু সেদুটো নাছোড়বান্দার মতো আনাবিয়ার সাথে ঘুমোবে বলে বায়না ধরে পড়ে রইলো, উঠবেই না। ফারিশ কত করে বোঝালো অন্য কোথাও ঘুমোতে, কিন্তু জেদ ধরে পড়ে রইলো দুজন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ওদেরকে নিজের সাথে ঘুমোতে নিলো আনাবিয়া।
ওদেরকে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে গায়ের ওপর চাদর টেনে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো আনাবিয়া। বাইরে জোরেসোরে বাতাস বইছে। আকাশ পরিষ্কার, পুরো জোছনা, কিন্তু বাতাস প্রচন্ড।
কাবার্ড থেকে একটা পাতলা চাদর বের করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো ও। বারান্দা চত্বরে এসে দাড়ালো কিছুক্ষণ। দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইলো ওর সফেদ চুল, গায়ের রেশমের রাতের পোশাক খানা।
আরও কয়েককদম এগিয়ে মহলের কাঠের তৈরি চওড়া সিড়ির ওপর এসে বসলো। আকাশে পূর্ণ চাঁদ, তার নরম আলো গাছের পাতার ওপর পড়ে লেপে দিয়েছে রুপোলী প্রলেপ।
খোলা প্রান্তরের কিনারা ঘেঁষে একটি নিশাচর সাপ একিয়ে বেকিয়ে এগিয়ে চলেছে কোথাও, ভেজা মাটির মধ্যে তার শরীরের ওপর মহলের বারান্দার কৃত্রিম আলোর প্রলেপ পড়ে চকচক করছে।
বাদুড়গুলো নীরবে এদিক ওদিক উড়ে চলেছে বারংবার, অশ্বত্থ গাছের কোনো এক কোণে ছোট্ট একটি পেঁচা ডেকে উঠছে থেকে থেকে। একটি ডাহুক পাখি গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে ডেকে চলেছে একটানা৷ চারদিকে ঝাঝালো কন্ঠে ডেকে চলেছে ঝিঝিপোকার দল।
আনাবিয়া তাকালো আকাশের দিকে, চাঁদের নরম আলো এসে পড়লো ওর মুখের ওপর, ওর মখমলি শরীরে। অপ্সরার ন্যায় পাগল করা সৌন্দর্য নিয়ে ও বসে রইলো একাকি।
তখনি ওর কানে এলো একটা ক্ষীণ ম্যাও ধ্বনি, চকিতে নিজের বাদিকের জঙ্গলের ভেতর তাকালো আনাবিয়া। শব্দটা সেদিক থেকেই এসেছে।
কিয়ৎক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকার পর আবারও ম্যাও ধ্বনিটা শুনলো ও।
দ্বিধান্বিত চোখে উঠে দাড়ালো আনাবিয়া, বাদিকের জঙ্গলে ম্যাও ধ্বনির মালিককে খুজতে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনি পেছন থেকে ভেসে এলো কারো কন্ঠস্বর,
“এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন শেহজাদী?”
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে ফারিশকে একবার দেখলো আনাবিয়া, তারপর সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বলে উঠলো,
“ওদিকে কিছু একটা ডাকছে, হয়তো কোনো বাচ্চা প্রাণী বিপদে পড়েছে।”
ফারিশ নিজেও নামতে নামতে বলল,
“আপনি একা যাবেন? আমিও যাই?”
“শহরের অট্টালিকায় থেকে আপনি অভ্যস্ত, এত রাতে জঙ্গলে গেলে ভয় পাবেন।”
বলে আনাবিয়া পা বাড়ালো সামনের দিকে। ফারিশের পৌরুষে লাগলো কথা টা, মনোক্ষুণ্ণ হলো সামান্য। পরক্ষণেই আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর দিয়ে বলে উঠলো,
“একদমই না, আমি মোটেও ভয় পাইনা। কত গেলাম এমন জঙ্গলে! এ আর এমন কি?”
আনাবিয়া ঠোঁট টিপে হেসে উত্তর করলো,
“ঠিক আছে, আসুন দেখি।”
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নির্দ্বিধায় একের পর এক জোর কদম ফেলে হাটছে আনাবিয়া, ওর পেছন পেছন ফারিশ। কাছে কোনো আলোর উৎস নেই, চাঁদের আলোই ভরসা। আনাবিয়ার ঝকঝকে চোখ দিয়ে রাতে দেখতে অসুবিধা না হলেও ফারিশ ভীষণ বিপদে পড়েছে। অন্ধকারে কিসের ওপর পা দিচ্ছে নিজেও জানে না।
বেচারার এমন ভরা জঙ্গলে হাটাচলা করার অভ্যাস নেই, তার ওপর আবার রাতের বেলা! রেড জোন নিয়ে এমনিতেও সকলের মনেই ভয়, না জানি কি কি আছে এখানে! গা ছমছম করছে ওর, গলা শুকিয়ে আসছে। বার বার শুধু পেছন দিকে দেখছে, মনে হচ্ছে কেউ পিছু নিচ্ছে ওর।
আনাবিয়া ওর মুভমেন্ট টের পেয়ে ওর দিকে না ফিরেই জিজ্ঞেস করলো,
“ভয় লাগছে?”
“ন্-না! ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগার প্রশ্নই আসে না!”
আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল ফারিশ। আনাবিয়া আবারও হাসলো, নিঃশব্দে যেন ফারিশ বুঝতে না পারে। নইলে এবার তার পৌরুষ খন্ড খন্ড হয়ে যাবে৷
ক্ষীণ ম্যাও ধ্বনিটা ক্রমশ গাঢ় হয়ে চলেছে। আনাবিয়া ধ্বনিটাকে লক্ষ্য করে পা চালিয়ে এগোলো সেদিকে। হাটতে হাটতেই ফারিশ প্রশ্ন করলো,
“আপনার চোখের নিচে কালি জমেছে শেহজাদী, আপনি ঠিক ঠাক ঘুমান না নিশ্চয়। আপনি যদি এখনো নিজেকে গুছিয়ে না নিতে পারেন তবে কিভাবে চলবে বলুন! আপনি একজন শেহজাদী, আপনার ওপর কত বড় বড় দায়িত্ব ন্যাস্ত। আপনি যদি এভাবে নিজের অযত্ন করেন তবে সেটা কি কখনো ভালো কিছু বয়ে নিয়ে আসবে?”
“আমি আমার দায়িত্বে কখনো গাফিলতি করিনা ফারিশ ভাইজান, তাই যদি করতাম তবে এই শিরো মিদোরি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে যেতো। আমার ব্যাক্তিগত জীবন একদিকে দায়িত্ব অন্যদিকে। আমি দেমিয়ান সন্তান, দায়িত্বের সাথে আপোশ করা আমাকে শোভা পায় না। তাই চিন্তা করবেন না।”
শান্ত কন্ঠে বলল আনাবিয়া। তারপর কিছুক্ষণ নিরবতা। কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে ফারিশ বলল,
“আমি আপনাকে ভীষণ রকম শ্রদ্ধা করি শেহজাদী, শ্রদ্ধা থেকেই হয়তো অনেক সময় আমার দ্বারা অনেক ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট কাজ হয়ে গেছে বা ফিউচারে হয়ে যেতে পারে। আমার এই শ্রদ্ধাকে দয়া করে আপনি অন্যভাবে নিবেন না। আমি শুধু আপনার পাশে একটুখানি ঠাই চাই, এছাড়া কিছুই নয়।”
“আমি নিজের খেয়াল রাখার মতো বড় হয়ে গেছি ফারিশ ভাইজান, আমার কাউকে প্রয়োজন নেই। আমি অনেক ভালো আছি, সেটা আপনি নিজেও জানেন।
কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো কোনো ভালো মানুষের কাজ নয় তবুও বলছি, আপনার সংসার আছে, স্ত্রী আছে, দুটো অপূর্ব মেয়ে আছে। আপনার উচিত অন্যান্য দিকে মনোযোগ না দিয়ে তাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া। তাদের জন্য হলেও আপনার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।”
কিঞ্চিৎ কড়া গলায় বলল আনাবিয়া। ফারিশ একটা ছোট খাটো দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বলল,
“স্ত্রী……”
তারপর আবার বলল,
“একটি ঘর টিকে থাকে ছাদে, আর একটি সম্পর্ক টিকে হৃদয়ে। আমার চোখে আমার স্ত্রীকে আমি স্ত্রী রূপে কখনোই দেখিনা, সত্যি বলতে আমি তার ছায়াও চাই না। শুধু দায়িত্বের খাতিরেই এখনো আমরা এক ছাদের তলে বসবাস করছি।”
আনাবিয়া প্রতিউত্তরে বললনা কিছুই, প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো ওর। ব্যাপারটা ভালো দিকে এগোচ্ছে না, এই ফারিশটাকে সাথে নিয়েই আসতে হতোনা৷
ফারিশ কিছুক্ষণ ওর পেছন পেছন হাটতে হাটতে হঠাৎই প্রচন্ড নরম, কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, আপনি জানেন না আমার দিনগুলো কিভাবে কাটে… আমি….”
আনাবিয়া তৎক্ষনাৎ পেছনে ফিরে তাকিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠলো,
“আপনার মেয়েদুটো আপনাকে কতোটা ভালোবাসে জানেন? আপনি তাদের বাবা। আপনি একজন স্বামীও। কেবল দায়িত্ব পালন করলেই স্বামী হওয়া যায়না ফারিশ ভাইজান, তার জন্য ভালোবাসারও প্রয়োজন হয়।
আপনার মেয়েদুটো বড় হচ্ছে, তাই এমন কিছু করবেন বা বলবেন না যার কারণে তাদের পবিত্র মনের ওপর প্রভাব পড়ে এবং আপনাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। তখন আফসোস করেও কূল পাবেন না।
আর হ্যাঁ, আপনি যদি এ ধরণের কথা বলা কন্টিনিউ করেন তবে আমি এই শিরো মিদোরিতে প্রবেশই আপনার জন্য নিষিদ্ধ করে দিবো। তাই সাবধান।”
বলে আবারও সামনের দিকে ফিরে দ্রুত পায়ে এগোলো আনাবিয়া। আর কিছুদূর এগোতেই ওর চোখে পড়লো দূরের ঝোপ ঝাড়ের ভেতর বেধে পড়ে থাকা একটি ছোট্ট চিতার বাচ্চাকে, কিছুক্ষণ পর পর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে সর্বশক্তি দিয়ে ম্যাও স্বরে ডেকে উঠছে সে, শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে পড়ছে তার।
পায়ের গতি বাড়িয়ে সেখানে ছুটলো আনাবিয়া, বাচ্চাটির কাছে পৌছে মাটিতে বসে একবার হাত বোলালো বাচ্চাটির গায়ে, ওর স্পর্শ পেয়ে বাচ্চাটি স্বস্তি পেলো যেন, থামিয়ে দিলো নিজের ডাক। আস্বস্ত ভঙ্গিতে এলিয়ে দিলো নিজের শরীর, হেলে পড়ে মাথা উঁচু করে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আনাবিয়ার চেহারাটা।
আনাবিয়া একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো বাচ্চাটির বাবা মা কে দেখা যায় কিনা। কিন্তু এদিকে আর কোনো প্রাণিকেই দেখা গেলো না৷
আনাবিয়া উলটে পালটে দেখলো বাচ্চাটিকে, পেছনের পায়ের একটির থেকে রক্ত পড়ে মাটি ভিজে গেছে। খেয়াল করে দেখতেই বাচ্চাটির ঊরুর নিকট একটা মস্ত ক্ষত দেখতে পেলো আনাবিয়া, ছোট্ট পা খানা খসে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়তো দলছুট হয়ে অন্য কোনো শিকারী প্রাণীর খপ্পরে পড়ে গেছিলো। তারাই ওর এই অবস্থা করেছে।
আনাবিয়া দুহাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল,
“আর কোনো চিন্তা নেই ছোট্ট সোনা, আমি এসে গেছি।”
টুপ করে একটা চুমু খেলো বাচ্চাটির মাথায়, বাচ্চাটি আদর পেয়ে পরম নিশ্চিন্তে মাথাটা এলিয়ে দিলো আনাবিয়ার বাহুডোরে। আর তারপর মহলের দিকে ফিরতে ফিরতে আনাবিয়া শুরু করলো নিজের হ্যিলিং সং। ফারিশকে জঙ্গলের ভেতর থেকে একটা বিশেষ গাছের পাতা মুখে দিয়ে চিবোতে বলে দিলো যেন ঘুমে সে পড়ে না যায়।
ধীর পায়ে হাটতে হাটতে নিজের কণ্ঠনিঃসৃত মোহনীয় সুরের মূর্চ্ছনায় দুলতে দুলতে এগোলো আনাবিয়া, ওর ঊরুসন্ধি ছোয়া খোলা চুল সাপের মতোন এঁকিয়ে বেঁকিয়ে যেতে রইলো পিঠের ওপর। কোলে থাকা চিতার বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়লো সাথে সাথেই। ফারিশ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চলল আনাবিয়ার পেছন পেছন।
হ্যিলিং সং শেষ হতেই আনাবিয়া মুখ নামিয়ে ছোট করে আবার একটা চুমু খেলো চিতাটির মাথায়। ফারিশের ঘুমের ঘোর কেটে গেলো ক্রমে ক্রমে। পেছন থেকে আনাবিয়ার অপার্থিব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মাথা ঘুরিয়ে এলো ওর, নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ও নেশালো কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“আপনি আমায় কেন দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন শেহজাদী?”
“আমি আপনাকে কাছেই ঘেঁষতে দেইনি কোনোদিন ফারিশ ভাইজান, দূরে সরানোর প্রশ্ন আসে কোথা থেকে?
মীর ছাড়া আমার কাছাকাছি আসার স্পর্ধা কখনো কারো হয়নি, আমি কাউকে সে স্পর্ধা দেইনি, আর না কখনো দিবো। আমি বর্তমানে একা থাকতে প্রচন্ডরকম অভ্যস্ত, এতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই। এই বিশাল পৃথিবীতে আমি সম্পুর্ন একা হয়ে গেলেও আমার তাতে কিছুই যায় আসেনা, বরং তাতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করবো। তাই আমাকে এ ধরণের প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবেন৷”
“আমি খুব বেশি কিছু চাইনি শেহজাদী, আমি শুধু আপনার পাশে থাকতে চেয়েছি, এ ছাড়া কিছুই নয়!”
“যে পাশে থাকা ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসে সেই পাশে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ফারিশ ভাইজান। আপনি প্রথম সাক্ষাতে আমাকে বলেছিলেন আপনি বদলে গেছেন, কিন্তু আদতে আপনি বদলাননি, আপনি বদলানোর ভান ধরেছিলেন। এবং এটি অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ।
আমি আপনাকে কিছুই বলতে চাইনা, আপনি ছোট ছেলেটি নন যে আপনাকে হাতে কলমে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে হবে৷
আপনি যদি আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে আমার পাশে থাকতে পারেন তবে আমি আপনাকে সাদরে গ্রহণ করবো। আর যদি সেটা না পারেন তবে আমার দরজা আপনার জন্য চিরতরে বিন্ধ হয়ে যাবে, আপনি কোনটা চ্যুজ করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যাপার৷”
আনাবিয়ার কথাতে চমকালো ফারিশ, বুকের ভেতর বেজে উঠলো কিছু। তৎক্ষনাৎ আনাবিয়ার কথার বিরোধিতা করে দ্রুতস্বরে বলে উঠলো,
“না না শেহজাদী, আপনি যেভাবে চাইবেন আমি সেভাবেই আপনার পাশে থাকবো। আপনি যদি বলেন তবে আমি কেবল এক কোণায় বসে থাকবো, আপনার মহলের দরজার ধারে। তবুও আমি আপনার পাশে থাকতে চাই! এই সুযোগটুকু আমাকে দিন শুধু!
আমি আমার মনের ওপর কব্জা করে ফেলবো কথা দিচ্ছি! আমাকে সময়দিন কিছু, আমি আপনাকে হতাশ করবো না।”
ওদের কথার মাঝেই কোনো দূর অজানা থেকে রাতের নিরবতাকে ছুরির ফলার ন্যায় ভেদ করে ভেসে এলো কোনো হিংস্র জানোয়ারের ভীষণ ক্রোধিত গর্জনের ক্ষীণ শব্দ! এক গর্জনেই দূরের জঙ্গল সম্পুর্নটাই যেন কেঁপে উঠলো!
বজ্রের শব্দের ন্যায় ভীষণ গুরুগম্ভীর ও গর্জন শোনা মাত্রই থমকে দাড়ালো আনাবিয়া, সাথে দাড়ালো ফারিশও। গলা শুকিয়ে এলো ফারিশের, এই রেড জোনের ভেতর কি কি থাকতে পারে সে সম্পর্কে একটু হলেও বইতে পড়েছে ও। না জানি ওটা কিসের গর্জন! এই জঙ্গল থেকে যত দ্রুত সম্ভব ওদের নিরাপদ স্থানে যাওয়া উচিত।
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৬
আনাবিয়াকে তাগাদা দিয়ে ও বলে উঠলো,
“মহলে ফিরে চলুন শেহজাদী, এখানে থাকা আমাদের জন্য একদমই নিরাপদ নয়।”
আনাবিয়া পা চালালো ফারিশের কথায়, কিন্তু মন মস্তিষ্ক ওর ঘুরে ফিরে চলল সেই হিংস্র গর্জনটির পিছে।
