বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯
রানী আমিনা

রাতের শেষ প্রহরের মধ্যভাগ। মহলের বিরাট হল রুমের সারি সারি বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে বাচ্চারা। শুধু এক কোণার বিছানায় তখনও টিমটিম করে জ্বলছে একটা টেবিল ল্যাম্প, ল্যাম্পের মৃদু আলোতে একটা বই নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে কোকো।

বইটির প্রতি ওর বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই, শুধুমাত্র জেগে থাকার জন্য বইটা নিয়ে বসে আছে৷
পাশের কামরাটা আনাবিয়ার, আনাবিয়া নেই সেখানে, সেই যে বেরিয়েছে এখনো ফিরেনি। সেখানে লায়রা নামক বাচ্চা চিতাটা ঘুমোচ্ছে, মাঝে মাঝেই ঘুমের ভেতর পুরুর পুরুর শব্দ করছে, শব্দটা দেয়াল পেরিয়ে চলে আসছে এই কামরায়। কোকোর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে ধরে সেটাকে বাইরে ছুড়ে দিয়ে আসতে৷
বইয়েও মন বসছেনা, শেষ মেশ বিরক্ত হয়ে বইটা শব্দ করে বন্ধ করে ও রেখে দিলো টেবিলের ওপর। ওর বই বন্ধের শব্দে লাফিয়ে উঠে বসলো লিও, সবেই একটু চোখ লেগে এসেছিলো ওর, আর তার ভেতরেই এমন দুমদাম শব্দে মেজাজ টাই গরম হয়ে গেলো ওর। পাশের বিছানায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলে উঠলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“একটু তো ঘুমোতে দিবি ভাই! নিজে তো ঘুমোচ্ছিস না, আমাকে একটু ঘুমোতে দে, দয়া কর ভাই!”
“রাখ তোর ঘুম! আম্মা বেরিয়েছেন সেই কখন, এখনো ফেরেননি। আর তুই তোর ঘুম নিয়ে পড়ে আছিস!”
“ভাই, শেহজাদী একজন শেহজাদী, শেহজাদী! আজীবন জঙ্গলে পড়ে থাকলেও তাকে কেউ একটা আঙুলও ছোয়াতে পারবে না। এই জঙ্গল তার পায়ের তলায়!
ঘুমা ভাই ঘুমা, আর আমাকেও ঘুমাতে দে। একটু পরেই চলে আসবেন শেহজাদী, চিন্তা করিস না৷”
বলে লিও আবার আয়েস করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে ব্যাস্ত হয়ে গেলো, তখনি ব্রুম ব্রুম শব্দ করে ভাইব্রেট হলো কোকোর ফোনটা৷ বিরক্তি নিয়ে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতড়ে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই সমস্ত বিরক্তি উবে গেলো ওর, চমকে উঠে দ্রুত ফোন রিসিভ করে বলে উঠলো,

“জ্বি আম্মা, আপনি ঠিক আছেন তো? ফিরবেন কখন?”
“এসে গেছি প্রায়, সবাই কি ঘুমিয়েছে?”
“জ্বি আম্মা, আমি আর লিও জেগে আছি।”
লিও শুয়ে পড়েছিলো আবার, নিজের নাম শুনে কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুলে তাকালো কোকোর দিকে। ফোনের ওপাশ থেকে আনাবিয়া আবার বলে উঠলো,
“দুজন দুটো কোদাল নিয়ে রয়্যাল গ্রেভ ইয়ার্ডের দিকে এগো, আমি আসছি।”

ভোর হবে খুব শিগগিরই, আকাশের রং এখন ধূসর নীল, চারপাশটা কুয়াশায় ভেজা। রেড জোনের ভেতর বড় বড় গাছ গুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের প্রথম কিরণকে স্পর্শ করার আশায়। তাদের সুবিস্তৃত শিকড় ছড়ানো মাটিতে জেগে উঠতে শুরু করেছে কীটেরা।
পাখিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে, এখনি হয়তো উড়াল দিবে খাবারের খোজে৷ পশুগুলো এখনো ঘুমে, তাদের জাগার সময় এখনো আসেনি। দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়ালের হুক্কাহুয়া ধ্বনি।
নিঃসাড় বনের সবুজ ঘাসের ভেতরে তৈরি হওয়া সরু পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে লিও আর কোকো। কোকোর পরণে গাঢ় সবুজ ফ্ল্যাক জ্যাকেট, লিওর পরণে কালো রঙা হুডি। ওদের লম্বা, পেশিবহুল শরীরের নিঃশব্দ চলাফেরায় প্রখর দক্ষতার ছাপ।
কাঁধে ধরা কোদালের ধাতব ফলা ওদের চলার ভঙ্গিমার সাথে তাল মিলিয়ে একটি ঠান্ডা ধাতব ধ্বনি থেকে থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে।

“শেহজাদী হঠাৎ আমাদেরকে রয়্যাল গ্রেভইয়ার্ডে যেতে বলল কেন ভাই?”
“তুইও যেখানে আমিও সেখানে, অতিরিক্ত তথ্য আমি কিভাবে জানবো? আম্মা যখন যেতে বলেছেন তখন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই হবে।”
“কিন্তু কোদাল নিয়ে কেন? উনি কি কবর খুড়ে দেখতে চান?শেহজাদীর কি হিজ ম্যাজেস্টির মৃত্যু নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে?”
“থাকতে পারে। আম্মা এখনো বিশ্বাস করেননি হিজ ম্যাজেস্টি মারা গেছেন। সেদিনও বলছিলেন যে তাঁর এখনো বিশ্বাস হয়না, তাঁর মনে হয় হিজ ম্যাজেস্টি হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছেন, বা হয়তো কিমালেব বা কুরো আহমারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়ে আটকে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে কিছুদিন!
কোকোর কথায় শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো লিও। পেছন পেছন হাটতে হাটতে বলে উঠলো,
“আমরা আমাদের চোখের সামনে হিজ ম্যাজেস্টির দাফন হতে দেখেছি, তাঁকে কবরে নামাতে দেখেছি, মাটি দিতে দেখেছি। প্রাসাদের প্রায় সকলেই দেখেছে। এতকিছুর পরেও আমাদের শেহজাদী বিশ্বাস করেন হিজ ম্যাজেস্টি বেঁচে আছেন!

হিজ ম্যাজেস্টির মৃত্যুর আঘাতটা তাঁর বেশ জোরে সোরেই লেগেছে, প্রায় তিন বছর হতে চলল তবুও তিনি বিশ্বাস করলেন না!”
“এ ব্যাপারে আমি হেকিমের সাথে কথা বলেছি, উনি বলেছেন শেহজাদী শকে আছেন, শক কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। হঠাৎ করে হিজ ম্যাজেস্টির মৃত্যু সংবাদ তিনি মেনে নিতে পারেননি।
উনি বলেছিলেন শেহিজাদীকে চোখে চোখে রাখতে নইলে উনি এই মানসিক অশান্তির জের ধরে অনেক বড় ক্ষতির মুখে পড়ে যেতে পারেন, এই যেমন ধর সিজোফ্রেনিয়া!
উনি তাঁর কল্পনায় অনেক কিছু ভেবে নিতে পারেন, আর ক্রমে ক্রমে সেটাকেই সত্যি ভাবতে শুরু করতে পারেন। এই কারণে আম্মাকে আমি একা ছাড়তে চাইনা কখনোই। কিন্তু উনি তো নাছোড়বান্দা, একা তিনি যাবেনই!”
গল্প করতে করতে কবরস্থানে পৌছে গেলো ওরা দুজন, আনাবিয়া আগের থেকেই বসে আছে মীরের কবরের পাশে। কোকো লিও ওকে দেখতে পাওয়া মাত্রই দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকলো সেখানে।
ওরা কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই আনাবিয়া বলে উঠলো,

“কবরটা খুড়ে লাশ বের কর।”
কোকো লিও একে অপরের দিকে তাকালো একবার। আনাবিয়ার আদেশ ঠোকরানোর স্পর্ধা ওদের কারো নেই, তাই বিনা বাক্যব্যয়ে কাজে লেগে পড়লো মুহুর্তেই। আজ ওরা প্রমাণ করেই দিবে ওদের শেহজাদীর ধারণা ভুল ছিলো। তাতে অন্তত তিনি একটু আস্বস্ত হয়ে ঘুমোতে পারবেন৷
গম্ভীর মুখে, অন্ধকার মাটিতে একটার পর একটা কোপ দিলো ওরা। পরিশ্রমের কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্বাস ভারি হয়ে এলো ওদের, ঘাম ঝরতে শুরু করলো তরতরিয়ে।
আনাবিয়া দম ধরে বসে রইলো, এই তাড়া করে বেড়ানো অশান্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্থীর হতে পারবেনা ও কোনোভাবেই।

কোকো লিওর একের পর এক জোরালো কোপে মাটি আলগা হতে লাগলো ধীরে ধীরে, আলগা হতে হতে ক্রমেই প্রকট হতে শুরু করলো পুরনো, পঁচা কাফনের গন্ধ।
আরেকটু খুড়তেই মাটি সরে গিয়ে দৃশ্যমান হলো কাফনের ভেতর মোড়ানো একটি কঙ্কালসার দীর্ঘ মানবদেহ। কাপড় বিবর্ণ, কালচে, কিছু কিছু জায়গা ছেঁড়া। হাড়ের রেখা আঁচ করা যায় তাতে।
এতক্ষণ যাবৎ প্রাণপণে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকা আনাবিয়ার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো, কবরস্থানের হীম শীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে গেলো ওর শরীরের পশম, শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো ঠান্ডা এক স্রোত!
ও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলো এই কবরের ভেতর কোনো লাশ থাকবেনা। কিন্তু ওর সমস্ত বিশ্বাস মুহুর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে গেলো যেন!

কোকো কাফনের কাপড়ের মুখের দিকটা আলগা করেছে সামান্য, সেখানে ফাকা কোটরের ভেতর এক জোড়া স্বর্ণাভ চোখ কল্পনায় এঁকে গেলো আনাবিয়ার।
মাংস চামড়া খসে পড়া হাড় সর্বস্ব মুখখানা ওর চির পরিচিত মানুষের! ওই পড়ে থাকা হাড়কখানাই যেন এখনো বলে চলেছে দীর্ঘকায় মানুষটির ভেতরের সমস্ত কথা!
আনাবিয়ার চারপাশের হাওয়া ভারী হয়ে উঠলো হঠাৎই, নিস্তব্ধতা জেঁকে বসলো ভীষণভাবে, হাত কেঁপে উঠলো নিঃশব্দে! অবিলম্বে জল এসে জমলো চোখে।

সেই মানুষটার স্মৃতি, হাসি, দৃষ্টি, চলন, বলন, স্পর্শ, আদর সবই যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো মুহুর্তেই! মানস্পটে ভেসে উঠলো প্রতিটি পূঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি! পঁচে যাওয়া শরীরটায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তার অঙ্গসজ্জা হারিয়ে গেছে চিরতরে। হারিয়ে গেছে সেই অত্যন্ত পরিচিত কন্ঠস্বর!
“এটা আমার মীর হতে পারে না। কখনোই না! আমার মীর এত সহজে কারো কাছে কিভাবে হেরে যাবে? নেভার!”
বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করলো ও, কোকো লিও শুনতে পেলোনা ওর মুখনিঃসৃত বাক্য! শুধু বুঝলো এক অস্পষ্ট দুঃখ, এক সুস্পষ্ট অস্বীকারের মাঝে ডুবে যাচ্ছে ওদের আম্মা! তাকে এই শোকের ভেতরে ডুবতে দেওয়া যাবেনা, কোনোভাবেই না!

রেড জোনে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। লাশটিকে এখনি আবার মাটিচাপা না দিতে পারলে একটুপর কাঁদা পানিতে সয়লাব হয়ে পড়বে। কোকো লিও আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো আদেশের অপেক্ষায়, লাশটিকে ওদের কি করা উচিত সেই আদেশ।
আনাবিয়া বসে রইলো কিয়ৎক্ষণ, তারপর চোয়াল শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো হঠাৎ করেই। ধীর পায়ে হেটে কবস্থান থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো,
“মাটি চাপা দিয়ে দে আবার৷”

কোকো লিও ওর যাওয়ার পানে একবার তাকিয়ে কাজে নেমে পড়লো আবারও। ওদের শেহজাদীর যে বিশ্বাস হয়েছে এটাই অনেক। এবার হয়তো নিজেকে একটু সামলে নিবেন, বুঝ দিবেন নিজের মনকে। কাজের ফাঁকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরব ভাব বিনিময় করে দ্রুত হাত চালালো দুজন।
আনাবিয়া এগিয়ে গেলো কবরস্থানের গেটের নিকট, গেট ঠেলে বাইরে পা দেওয়ার আগে কিছু একটা মনে পড়তেই কিঞ্চিৎ চমকালো ও, তড়িতে পেছন দিকে ফিরে দ্রুত পায়ে আবার কবরের দিকে এগোতে এগোতে বলে উঠলো,
“কোকো, স্কেলিটন টার হাইট চেইক কর দ্রুত!”
কোকো লিও কোদাল ফেলে ততক্ষণে খানিকটা ভরাট করে ফেলেছে, আনাবিয়ার হঠাৎ আদেশে তড়িতে আবারও দৃষ্টি মেলালো দুজন। কোকো আনাবিয়ার দিকে ফিরে বলে উঠলো,

“আপনি যা বলবেন শেহজাদী।”
দ্রুত হাতে মাটি গুলো আবার উঠিয়ে ফেললো ওরা, কোকো ওর ফোরআর্ম দিয়ে মেপে দেখলো কঙ্কালটাকে। আনাবিয়া প্রচণ্ড উৎসুক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে৷
হাইট হিসেব করার পরই কোকো চমকে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, কিঞ্চিৎ হতভম্ব গলায় বলে উঠলো,
“সিক্স ফিট সিক্স আম্মা!”

তড়িতে হিসেব করে নিলো আনাবিয়া, শরীর থেকে সমস্ত মাংস, পেশী, কার্টিলেজ, চর্বি, উপাস্থি সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও হাইট সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন ইঞ্চি কমতে পারে, তার বেশি কোনো ভাবেই নয়! পাঁচ ইঞ্চি কমে যাওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব নয়! এটা মীরের কঙ্কাল হতেই পারেনা!
কঙ্কালটির দিকে তাকিয়ে আলতো করে হাসলো আনাবিয়া, মুহুর্তেই এক অনন্য শীতলতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেলো ওর বুক। কবরস্থানের শীতল বাতাস বুক ভরে টেনে নিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো, অতঃপর স্নিগ্ধ মুখশ্রী নিয়ে আবারও কবিস্থানের গেইটের নিকট যেতে যেতে বলে উঠলো,
“আমার মীর এত সহজে মরতেই পারে না!”

জঙ্গলের গভীরে, সভ্যতার শেষ নিঃশ্বাস পেরিয়ে যেখানে কেবলই প্রকৃতি আর নিগুঢ় নীরবতার রাজত্ব ঠিক সেখানের ঘন গাছপালার আড়ালে, অন্ধকারের গহ্বরে বন্দি এক অজানা সত্তা।
আবছা আলোর ভিড়ে হাটু মুড়িয়ে মাটিতে বসিয়ে রাখা হয়েছে একটি অবয়বকে, নির্জীব জংলা মাথাটা ঝুঁকে আছে মাটির দিকে। জ্ঞান আছে কিনা বোঝার উপায় নেই।
হাজার খানা ভীষণ মোটা, প্রকাণ্ড ধাতব শেকল আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তার কালো শরীর। তার হাত, পা, গলা, কোমর, এমনকি আঙুলের গাঁট পর্যন্ত আটকে রাখা পুরু ধাতব বেড়িতে। পুরোনো হতে হতে ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে তা।

হাত দুটো দুদিকে টেনে বাধা শেকলে, স্পষ্ট হয়ে আছে তার পাথরের মতোন দৃঢ় পেশিবহুল বাহু। প্রতিটি শেকলের প্রান্ত গিয়ে ঠেকেছে অবয়বটি হতে মাইল খানেক দুরত্বে, চতুর্দিক ঘিরে রাখা উঁচু উঁচু পাথরের বিশাল স্তম্ভগুলোতে; যেন একটা দুর্দমনীয় তাণ্ডবকে ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। শেকল গুলো একই স্থানে থাকতে থাকতে চামড়ার নিচে ঢুকে যাওয়ার উপক্রম।
হাতের নখগুলো তার জংলী পশুদের মতোন ধারালো। পিঠ ছাড়ানো ধুসর চুলগুলোতে জট পাকিয়ে আছে, দাড়ি গুলো হয়ে আছে জঙ্গল, অগোছালো। চুল দাড়ির ভারে দেখার উপায় নেই তার মুখখানা। খাবারের অভাবে পেট খানা প্রায় পিঠের সাথে লেগে যাওয়ার উপক্রম!

গায়ে তার ভয়নক রকম দুর্গন্ধ, বৃষ্টির পানি ব্যাতিত যে গোসল হয়না তার। দেখাশোনার লোকগুলো কিছুদিন ধরে মিসিং হওয়ায় আশপাশটা হয়ে আছে প্রচন্ড নোংরা।
থেকে থেকে বুকের ভেতর থেকে সে তুলছে হাড় হীম করা এক গরগরে শব্দ, যেন কোনো ক্ষ্যাপা বাঘের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে কোনো পুরোনো শত্রু! প্রতিবারে তার গুমরে গুমরে ওঠা শব্দ যেন কাঁপিয়ে দিচ্ছে মাটির গভীর স্তর পর্যন্ত।

এই শুনশান নিরবতার ভেতর হঠাৎই শোনা গেলো পদশব্দ। কেউ বেশ দ্রুত, ভারী পায়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। মাটিতে পড়ে থাকা গত রাতের ভেজা পাতায় ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে আগন্তুকের পদক্ষেপে। কিন্তু কোনো শব্দেই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা শেকলে বাধা অবয়বটি।
কিছুক্ষণ পরেই আগন্তুক এসে দাড়ালো অবয়বটির সম্মুখে, বেশ কিছুটা দুরত্ব নিয়ে। হাতে তার একটা ময়লা থলে। চারপাশ টা একবার নজর বোলালো সে, ভেসে এলো তার বিরক্তিপূর্ণ কন্ঠস্বর,
“কি অবস্থা করেছিস এটা? ছেলেটাকে তো খেয়ে দিয়েছিস, মেয়েটাকেও আমারই শেষ করা লাগলো। এখন তোর এসব উচ্ছিষ্ট কে পরিষ্কার করবে? নতুন করে আমি লোকজন কোথায় পাবো? কে তোর মতো জংলির সেবা করতে রাজি হবে শুনি?”

তার কন্ঠস্বর শুনতেই ধীর গতিতে ঝুকিয়ে রাখা মাথাটা উঁচু করলো কালো রঙা পাহাড়সম শরীরের মালিক, অমনিই দৃষ্টি গোচর হলো তার আগুনসম চোখ জোড়া, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতোন সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার তীব্র মনোবাসনা তাতে।
চোয়ালদ্বয় প্রচন্ড দৃঢ়, দানবিক মুখে ছড়িয়ে আছে আদিম বন্যতা, বুনো মুখে এক হীম শীতল ভাব; এক ঠান্ডা সন্ত্রাস ছড়িয়ে আছে তার সমস্ত দেহ জুড়ে!
আগন্তুক ধীর পায়ে এগিয়ে এলো আরও নিকটে, কৌতুক পূর্ণ কন্ঠে হাফ ছেড়ে বলল,

“উফফ, বহু কষ্টে আজ জঙ্গলের ভেতর ঢুকতে পেরেছি, নাইলে তোর বউ যে সিকিউরিটি লাগিয়েছে তাতে এর ভেতরে ঢুকতে গেলে আমার প্রাণ টা আরেকটু হলেই যেতো। কোনো রকমে একটা শর্ট সার্কিট করে ঢুকে পড়েছি তোর বউয়ের ডেরায়। দেখেছিস তোর জন্য কত স্যাক্রিফাইস করে তোর দু মিনিটের বড় ভাই?”
যাকে উদ্দ্যশ্য করে প্রশ্ন করা হলো তার মুখ থেকে কোনো উত্তর বের হলোনা। তীক্ষ্ণ, ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে ইলহানের মুখপানে, গলা থেকে বেরিয়ে এলো একটি হিংস্র গরগর ধ্বনি!
কিচ্ছু চিনেনা সে, কাউকে চিনেনা। এই পৃথিবী তার কাছে অচেনা। একটি জংলী পশুর ন্যায় তার জীবন, যেখানে খাওয়া সেখানেই ঘুম, সেখানেই বাকি সমস্ত কাজ। সে শুধু জানে তার সামনে দন্ডায়মান এই দুপেয়ে প্রাণী টি তার শত্রু, চরম শত্রু! তাই শত্রুর মোকাবেলার উদ্দ্যেশ্যে নিজের গরগরে ধ্বনি জারি রাখলো সে। নাক কুচকে এলো, বেরিয়ে এলো তার ধারালো ঝকঝকে ক্যানাইন দাঁত দ্বয়।

সম্পুর্ন নিশ্চুপে সে তাকিয়ে রইলো ইলহানের দিকে, মাটিতে ঠেকিয়ে রাখা হাটুদ্বয়ের একটি নড়লো সামান্য, আর এরপর ইলহানকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে সে হঠাৎ উঠে সমস্ত শেকলে ঝন ঝন শব্দ তুলে ঝড়ের বেগে ছুটে আক্রমণ করতে নিলো ইলহানকে, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ভয়ানক রকম গর্জন!
হঠাৎ প্রবল বেগে ছুটে যাওয়ায় হাতের শেকল টেনে বেধে রাখা পাথর দুটো তার প্রচন্ড শক্তিতে মুহুর্তেই উঠে গেলো শুণ্যে।

ঘটনার আকস্মিকতায় ইলহান হতভম্ব হয়ে গেলো, হুশ আসতেই তড়িতে ছুটে সরে গেলো তার দুই মিনিটের ছোট ভাইয়ের নাগাল থেকে। নিরাপদ দুরত্বে গিয়ে জোরে হাফ ছেড়ে বুকের ওপর হাত চাপা দিয়ে শান্ত করলো ধুকপুকানি, স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললো,
“ওফফফ! আরেকটু হলেই গেছিলাম। শালা জানোয়ার কোথাকার!”
শেষোক্ত বাক্যটা মীরের দিকে ফিরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ইলহান। শেকল বাধা ভারী পাথরের টানে পরমুহূর্তেই মীর সবেগে আবার ফিরে গেলো নিজের পূর্বের স্থানে। দৃষ্টিতে তখনো হিংস্রতা, তীব্র জ্বালাময়ী ধার, যেন পেলেই চিবিয়ে খেয়ে ফালবে তার সম্মুখে দন্ডায়মান এই প্রাণীটিকে।
ইলহান আরও কয়েকবার দম ছেড়ে হাতের থলিটা উঁচু করে মীরকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“বলতো এতে কি আছে?”
উত্তরে গরগর ধ্বনি ছাড়া আর কোনো শব্দই এলোনা। ইলহান ভ্রু নাচিয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“আচ্ছা, এত কষ্ট করতে হবে না। এতে কাঁচা মাংস আছে, তোর জন্য। ইয়াম্মি!”
“গারররররর…..”
“ভাগ্যিস আমি এসেছিলাম, নইলে তো তুই না খেয়ে মরতি। এত সহজে তুই মরলে কি করে চলবে? তুই আরও সাফার করিবি, আরও সাফার করবি!”
“গারররররর……”

“যদিও সেদিন মাটি চাপা দিতে আরেকটু দেরি না হলে তুই আজ জাহান্নামে থাকতি। সেদিন কত কষ্ট করে আমার আরেকটা লাশ জোগাড় করতে হলো! একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে অকারণে ধরে এনে মেরে দিলাম।
কি করতাম? তুই ওই সময়ে পালিয়ে না গেলে আর ছেলেটাকে এভাবে মরতে হতোনা। শালা, এত শক্তিশালী বিষ দিলাম তবুও মরলিনা! কি কই মাছের প্রাণ বাপরে বাপ!”
পাশেরই একটি ছোট পাথর খন্ডের ওপর বসতে বসতে বললো ইলহান। ওর মনে পড়ে গেলো সেদিনের ঘটনা, যেদিন মীরের বুকে বিধেছিলো ওর নিক্ষেপ করা বিষ মাখানো তীরের ফলা। কোকো ছেলেটা মীরকে সরিয়ে নিতে গিয়েও নিতে পারেনি, তার ভেতরেই ইলহানের সৈন্যরা ওদেরকে বেদম মার মেরে মীরকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো ওদের হাত থেকে।

বিষের প্রভাবে নীল বর্ণ ধারণ করা মীরকে ওরা মৃতই ভেবে নিয়েছিলো, তাই সত্যিই মরেছে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়ার আর প্রয়োজন মনে করেনি ইলহান।
কিন্তু বিপত্তি বাধে লাশকে গোসল দেওয়ার সময়ে, গোসল দিতে গিয়ে লোকজন দেখতে পায় গোসলের স্থান ফাঁকা, লাশ পালিয়ে গেছে। কখন পালিয়েছে কিভাবে পালিয়েছে কেউ জানেনা, ভোজ বাজির মতোন লাশ উধাও!
কিন্তু ইলহান বদ্ধ পরিকর! এই মুহুর্তে এসে যদি জনগণ জানতে পারে ওদের বর্তমান বাদশাহ বেঁচে আছে তবে ক্ষমতায় টিকে থাকা ওর জন্য সর্বোচ্চ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সতর্ক হয়ে গেলো সে, নিজের ক্লোজ লোকজন গুলোকে আদেশ দিলো যেখান থেকে পারে এমন লম্বা একটা ছেলে কে জোগাড় করতে, তাকেই গোসল দিয়ে তাকেই কবরে নেওয়া হবে।

স্মৃতিচারণ করে মৃদু হাসলো ইলহান, বেচারা পালালো ঠিকই কিন্তু সেই ধরা পড়েই গেলো। বিষাক্ত শরীর নিয়ে আর কতদূরই বা যাবে! ইলহান লোক লাগিয়ে রেড জোনের ভেতর থেকে ঠিকই খুজে বের করলো ওকে, আর তারপর মত বদলে ফেললো মীরলে মেরে ফেলার।
মীরের যে অনেক কষ্ট পাওয়া বাকি! ইলহান যা যা আঘাত পেয়েছে সেগুলোর এক্সাক্ট প্রতিশোধ নেওয়া এখন আর সম্ভব নয়, তবে তাকে আঘাত দেওয়ার আরও শত শত পন্থা যে খোলা আছে সামনে!
“তোর বউয়ের কথায় মনে পড়লো, তোর বউ একখান জিনিস মাইরি! আমি ভেবেছিলাম সে বোধ হয় অনেক দয়ালু, কারো ক্ষতি করার কথা সে ভাববেও না! হাজার হলেও শেহজাদী তো, নরম হৃদয়।

কিন্তু আমার ধারণা সম্পুর্ন ভুল। সে কি করেছে জানিস? শুধু মাত্র আমার নাম খারাপ করার জন্য সে কিমালেবের গুদামে আগুন ধরিয়েছে, আমার ওয়েবসাইট হ্যাক করে আমার সাম্রাজ্যের সব গোপন ইনফো হাতিয়ে নিয়েছে, শুধু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি! এমন এক বাগ ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আমি সেখানে ঢুকতেও পারছিনা, আমার ইনফো গুলো আর কালেক্ট করতে পারছিনা!
আরও কি কি আকাম কুকাম করেছে আমার অগোচরে সেটা আমি জানতেও পারছিনা। আমারই ভুল আসলে, আমিই ভুলে গেছিলাম যে ওটা দেমিয়ান শেহজাদী, তার শিরায় শিরায় দেমিয়ান ব্লাড। এই রক্ত নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে যা কিছু করতে পারে!”

“গাররররররর……”
“তুই শুধু গাররররর গাররররই কর, এ ছাড়া আর কি করবি?”
বলে ইলহান থলে থেকে এক টুকরো কাঁচা মাংস তুলে নিয়ে ছুড়ে মারলো মীরের দিকে, কিন্তু মীরের হেলদোল হলোনা কোনো, সে তখনো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। নিজের ক্যানাইন দাঁত দ্বয় হিংস্র ভাবে মেলে গরগরে শব্দ করতে করতে ভয়ানক দৃষ্টি ফেললো সে ইলহানের দিকে। মাংসের দলাটা পড়ে গেলো মাটিতে। ইলহান সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“উপায় নেই, আমার হাতেই খেতে হবে। তোকে যারা যত্ন করে খাওয়াতো তারা দুজনেই টিকিট কেটেছে। এখন এত গোস্যা করলে না খেতে পেয়ে মরেবি।”
বলে আর এক তাল মাংস ছুড়ে দিলো, সেটাও শব্দ করে পড়লো মাটিতে, মীর তাকিয়ে দেখলোনা পর্যন্ত। আগের মতোই চাপা গরগরে আওয়াজ বের হলো ওর গলা থেকে, শেকল গুলোর ধাতব শব্দ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর সামান্য নড়াচড়াতেও।
ইলহান হাসলো শব্দ করে, বিড়বিড়য়ে বলল, ‘বদলালোনা শালা!’ ফুটিয়ে বলল,

“যদিও তুই মরলে আমারই লাভ, তোর বউটাকে জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করা যেতো। কিন্তু মরছিস না বলে পারছিনা। এত সুন্দর একটা সুযোগ থাকা সত্বেও আমি তোকে কত যত্ন করে খাওয়াচ্ছি, আমার মতো ভালো বিগ ব্রাদার তুই আর কোথাও পাবিনা রে আসওয়াদ!”
মীর তাকিয়ে রইলো, ভীষণ ক্রোধে বুক টা ওঠানামা করতে লাগলো দ্রুত গতিতে। ইলহান আর এক টুকরো মাংস ছুড়ে দিলেও খেলোনা মীর। যাকে দুচোখে সহ্য করতে পারছেনা তার হাত থেকে খাবার খাওয়া যে ওর নিকট বিষের সমান!
ইলহান এবার হাল ছেড়ে দিয়ে থলে টা ছুড়ে দিলো মীরের সম্মুখে, বিরক্তি নিয়ে বলল,

“এত ঢং করার সময় নেই আমার, খাইলে খা না খাইলে নাই। ফিরতে হবে আমাকে, নইলে তোর বউ দেখে ফেললে আমার আম ছালা দুইটাই যাবে।”
দু সেকেন্ড বিরতি দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে ইলহান ভ্রু তুলে বলল,
“কার কথা বলছি বলতো? তোর বউয়ের কথা, বওওওউ। কি যেন ডাকতি তুই ওকে? অ হ্যাঁ, মনে পড়েছে, শিন-জো!”
শিনজো নামটা শোনা মাত্রই মীরের অচল মস্তিষ্কের ভেতর কিসের যেন বাড়ি খেলো, নামটা যেন বজ্রনিনাদ হয়ে আছড়ে পড়লো তার ঘোলাটে, উন্মাদ মস্তিষ্কে।

আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা, বিলুপ্তপ্রায় স্মৃতির ভেতর হঠাৎ জ্বলে উঠলো একটি নাম, ‘শিনজো’……!
আচমকাই স্থীর হয়ে গেলো মীর, স্তব্ধ হয়ে গেলো সে, থেমে গেলো তার এতক্ষণের তর্জন গর্জন। তার কুঞ্চিত ভ্রু দ্বয়, শক্ত চোয়াল, গলিত লাভার ন্যায় তীব্র ঝলসানো চোখ সমস্তই থমকে গেলো কয়েক মুহুর্তের জন্য।
ওর চোখের রক্তরাগ বেদ করে হঠাৎ জ্বলে উঠলো একটা ক্ষীণ আলো, গুঁড়িয়ে যাওয়া স্মৃতির ধ্বংসস্তূপের ভেতর কাঁপা কাঁপা হাতে খুঁজে চললো কিছু! হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ মানস্পটে এসে ধরা দিলো একটা অস্পষ্ট স্পর্শ….. অতঃপর একটা অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর…. এক জোড়া ঝলমলানো চোখ…. এক জোড়া নরম ঠোঁট….. তাতে এক টুকরো মিষ্টি হাসি আর তারপর…… তারপর একটি নাম,

‘শিনজো……!
হৃদপিণ্ড আচমকা ধড়াস করে উঠলো মীরের, বিদ্যুৎ বেগে শিহরণ বয়ে গেলো সমস্ত শরীরে! চারদিকে মুহূর্তেই নেমে এলো এক ভয়াল নিস্তব্ধতা, ঠিক ঝড়ের আগের নিস্তব্ধ গুমোট আবহাওয়ার মতোন!
শিনজো শব্দটা হঠাৎই যেন বিস্ফোরণ ঘটালো ওর মস্তিষ্কের ভেতর, স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে রক্তাভ হয়ে এলো ওর চোখ! ঘাড়টা ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরালো ও ইলহানের দিকে, গলা থেকে অদ্ভুত রকমের ভয়ঙ্কর এক গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ।

ভড়কালো ইলহান, নিরাপদ দুরত্বে সরে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে ও দেখতে রইলো মীরকে। শিনজো নাম শুনে একেবারেই জানোয়ারে রুপান্তর হলো কিনা সেটাই ভেবে চললো সে৷
কিন্তু এরপর ইলহানের ভীতিকে দ্বিগুণ করে দিয়ে, সমস্ত জঙ্গলকে কাঁপিয়ে মীরের বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক বুনো হিংস্র গর্জন! পেশিগুলো ফুলে উঠলো টানটান হয়ে, কপালের শিরা গুলো ভেসে উঠলো মুহুর্তেই! ওর ভীষণ শক্তিশালী টানে শেকলগুলো কাঁপতে শুরু করলো ধাতব আওয়াজে।

ইলহান পিছিয়ে গেলো আরও, পাগল হয়ে এবার শেকল গুলোই ভেঙে ফেলে কিনা সেই চিন্তায় মাথা হ্যাং হওয়ার জোগাড় হলো ওর। একবার এই জংলীটা শেকল ছিড়ে বেরিয়ে এলে এই পঞ্চদ্বীপ আর আস্ত থাকবে না!
একটা ঢোক গিলে দ্রুত পায়ে পেছন দিকে তাকাতে তাকাতে সে স্থান ত্যাগ করলো ইলহান। মীর তখনো শিনজো নামটার আঘাতে এক অসহনীয়, অব্যাক্ত যন্ত্রণায় গুমরে গুমরে ডেকে চলল…..

“তুই অ্যানাকে এখনো ভালোবাসিস, না ভাইয়া?”
শার্লটের প্রশ্নে চমকে সেদিকে তাকালো ব্রায়ান, অধীর আগ্রহে শার্লট অপেক্ষা করছে ব্রায়ানের উত্তর শোনার জন্য।
সকাল সকাল উঠেই তিনজনে মিলে রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। তৈজসপত্রের টুংটাং শব্দ আর রান্নার পাতিলে মশলা ভাজার চিড়চিড়ে শব্দে মুখোরিত হয়ে আছে চারপাশ, কিচেন ছাপিয়ে বাইরেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শব্দ৷
ফারিশ আর ওর মেয়েরা চলে যাবে আজ, তাই নানা পদের খাবারের আয়োজনে ব্যাস্ত ওরা কজন। সেখানেই হঠাৎ শার্লটের এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো ব্রায়ান।

ফাতমা রুটি বেলছিলো, শার্লটের এমন প্রশ্ন চমকে তাকালো সেও।
শার্লট বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো এদের দুজনের দিকে। ব্রায়ান চুপ রইলো, কিন্তু ওর চোখে নিদারুণ এক অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো নিমিষেই, সেটা সকলের থেকে আড়াল করে নিতে চোখ নামিয়ে ফেললো ও সাথে সাথেই, মনোযোগ দিলো সবজি কাটায়।
এই অদ্ভুত নিরাবতাকে ভাঙার জন্য ফাতমা এবার বেশ জোরেই বলে উঠলো,
“কতবার বলেছি তোকে শেহজাদী বলে ডাকবি, অ্যানা নয়! উনি এখন আর আমাদের অ্যানা নন, উনি একজন শেহজাদী। কোকো, লিও ভাইজান দের কেউ শুনলে কি হবে ভাবতে পারছিস তুই? আর যেন কখনো তোকে অ্যানা শব্দটা উচ্চারণ করতে না শুনি আমি!”

শার্লটের চোখজোড়া টলমল করে উঠলো, অভিমান ভরা মুখে ও লেগে গেলো আবার কাজে। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পেছন থেকে হঠাৎই ব্রায়ান বলে উঠলো,
“ভালোবাসি, ভীষণ রকম ভালোবাসি! কিন্তু তিনি আমার ধরাছোঁয়ারও বাইরে, ধরাছোঁয়া কেন বলছি; চিন্তারও বাইরে! উনি একজন শেহজাদী, আর আমি একজন নগন্য…… দাস বলা যায়!
উনি বিবাহিতা, স্বয়ং পঞ্চদ্বীপের বাদশাহর স্ত্রী! তার দিকে চোখ তুলে তাকানোও অপরাধ। তিনি বিরাট এক সাম্রাজ্যের একমাত্র কন্যা সন্তান। আমার মতো কেউ কিভাবে তাকে পাবে? আমি যে তাকে গোপনে ভালোবেসে চলেছি এই স্পর্ধাই বা কম কি!”

শার্লট ফাতমা নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো ব্রায়ানের নতমুখের দিকে। একহাতে সবজি কাটছে সে ধীর গতিতে, মাথা তুলছে না ভুলেও। তবুও শার্লট বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের চোখে তরল জমা হয়েছে!
ফাতমার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে ও ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার মনোযোগ দিলো কাজে, ভাইকে যেন অস্বস্তিতে পড়তে না হয় তার জন্য ফাতমাকেও ইশারায় বলল ওদিক থেকে ঘুরে এদিকে তাকাতে।
ফাতমা আবার রুটি বেলায় মনোনিবেশ করে শার্লটের উদ্দ্যেশ্যে ধীর, চাপা গলায় বলল,
“ব্রায়ানকে এসব আর বলবি না, ও এখনো শেহজাদীকে ভালোবাসে কিনা সেটা তুই ওর চোখে দেখেই টের পাবি, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই।”

শার্লট নত মুখে দুবার ওপর নিচে মাথা নাড়িয়ে আবার লেগে গেলো কাজে। দ্রুত নাস্তা তৈরি করতে উদ্যত হলো। কোকো বলে গেছে শেহজাদীর ক্ষিদে পেয়েছে, ঘুম থেকে উঠেই তিনি খাবেন। রাতে তিনি ছিলেননা মহলে, ভোরে ফিরেছেন, সারারাত না খাওয়া। সকলে তাই হাত চালালো দ্রুত।
ফাতমার এমনিতেই মেজাজ খারাপ। লিন্ডাকে ডেকে এসেছে, কিন্তু লাটসাহেবা ঘুমোচ্ছে এখনো, সময় নেই অসময় নেই মেয়েটা শুধু ঘুমোবে। এউ বেড়াল জাতির কাজই শুধু ঘুমানো! ফাতমা শার্লট বেরিয়ে যাওয়ার পর লিও ওদের কামরায় গিয়ে এখন লিন্ডাকে জড়িয়ে আয়েস করে ঘুমিয়ে আছে। অন্য বাচ্চারা এখনো কেউ ওঠেনি ঘুম থেকে।
আনাবিয়া ঘুমিয়ে আছে নিজের কামরায়, কয়েক ঘন্টা আগেই এসে পৌছেছে ও মহলে। অতিরিক্ত ক্লান্তিতে শরীর আর পেরে না দেওয়ায় ওভাবেই চলে গেছে বিছানায়। পরণের প্যান্টের নিচের দিকটাতে ছিটে ছিটে কাঁদা লেগে আছে, কাঁদা মাখা হাইকিং শু আর ব্যাকপ্যাক টা পড়ে আছে মেঝেতে এক কোণায়।

লায়রা ঘুমিয়ে ছিলো বিছানার পায়ের দিকে, ঘুম ভেঙে নিভু নিভু চোখে একবার তাকিয়ে আনাবিয়াকে দেখতে পেয়েই ঘুমের ঘোরে পা টেনে টেনে এগিয়ে গেলো আনাবিয়ার নিকট, তারপর আনাবিয়ার বুকের কাছে গিয়ে বসে বুকে মাথা ঘষে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়লো আবার। সারারাত এই ওম ওম বুকের খুব অভাব বোধ করেছে সে, তাই এখন সেই অভাব পূরণের চেষ্টা।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৮

বাইরের নানাবিধ শব্দে অবশেষে ঘুম ভাংলো আনাবিয়ার, বুকের ওপর থেকে লায়রা কে সরিয়ে ওর গায়ে চাদর তুলে দিয়ে চোখ কচলে উঠে বসলো ও।
মুহুর্তেই ওর মনে পড়ে গেলো গত রাতের কথা, তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে ও ছুটলো বাইরে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here