মায়াকুমারী পর্ব ৬৪+৬৫

মায়াকুমারী পর্ব ৬৪+৬৫
মেহেরিন আনজারা

অনেকক্ষণ শুভ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে; মুখে কোনো কথা নেই,কেবল চোখে একটা অনিদ্রাহীন বিষাদ। দ্যুতির ধৈর্যের ফোঁটা ছেঁকে পড়ল।
“আশ্চর্য,আমাকে ডেকে আনলেন কেন?”
শুভ্র নড়েচড়ে দাঁড়াল।
“কী বলবেন বলুন!”
আমতা-আমতা করল শুভ্র। ভ্রু কুঁচকে তাকায় দ্যুতি। মেজাজ খারাপ হলো তার।
“ইয়ে মানে..”
“আপনি ইয়ে মানে করুন,আমি যাচ্ছি। আমার ভাইয়া দেখলে রাগ করবে।”
“প্লিজ.. শুনুন।”
“সময় নেই।”
এতক্ষণ পুরো ঘটনাটি দেখছিল সিফাত। পকেট হাতড়ে ফোন তুলে ডায়াল করল আদনীন ফেরদৌসকে। দু’বার রিং হতেই পিক করলেন তিনি।

“হ্যালো!”
“আন্টি,আমার দোস্ত কই?”
“কেন?”
“আরে একটু দেন তো!”
“না।”
“দেন না.. প্লিজ।”
“তোমার ভরসা নেই।”
“আমি আবার কী করলাম?”
“তুমি আজেবাজে কথা বলে আমার অসুস্থ ছেলেটাকে উত্তেজিত করবে।”
আকস্মিক ফোন কেঁড়ে নিলো অনিক।
“কী হইছে?”
“হ্লার ঘরের হ্লা- তুই গোয়ালঘরে ঘুমাইয়া থাক।”
“কীরে হ্লা হাড্ডি আম্বানি কী হইছে?”
“দোস্ত,তোর ওয়ার্ল্ডকে দেখলাম অন্য গ্রহের কক্ষপথে ঘুরপাক খাইতেছে।”
“কস কী!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“বিশ্বাস না হইলে তাত্তাড়ি গোয়ালঘর থেইকা বাইর হো।”
“ওরে তোরা কেউ একটু আমার হবু বউটাকে পাহারা দিস.. হবু স্বামী রেখে কারো সঙ্গে আবার প্রেম-ট্রেম করে নাকি!”
আকস্মিক ফোন কেঁড়ে নিলেন ইফতেখার মির্জা।
“ফোন নিলেন ক্যান?”
“কার সঙ্গে কথা বলছো?”
“জানি না কোন হ্লায় আমার বউয়ের লগে প্রেম করতাছে,তাই টেনশন হইতাছে। যত্নে রাখিস ভাই,তোর ভাবী লাগে।”
“কী বললি?”
“ডমিনটিং করতাছেন ক্যান?”
“জুতা চেনো?”

ধ্রুবকে দেখতেই দ্যুতির গলা শুকিয়ে গেল। সে দ্রুত এগিয়ে এলো।
“কীরে তুই না বললি দ্যুতি এদিকে,এখন ও কই?”
“নিশ্চয়ই আশেপাশে রয়েছে।”
ভয়ে নিশুর ছোট্ট হৃদয়টা তিরতির করে কাঁপে।
“মিথ্যা কথা বলবি না।”
“ভাইয়া কী করছো?”
পিছু ঘুরে তাকায়।
“কোথায় ছিলি?”
স্বস্তির শ্বাস ফেলল নিশু। এই যাত্রায় বেঁচে গেল দু’জন।
“বাসার জন্য রজনীগন্ধা নিবো ভাবছিলাম,তাই দেখছিলাম।”
“নিয়েছিস?”
“না,তোমাকে দেখে এগিয়ে এলাম। কিনে দাও তো।”
নিশুর বুকটা একধাক্কায় হালকা হলো; সে প্রায় কেঁদে ফেলতে বসেছিল। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা কিনে তুলে দিলো দ্যুতির হাতে। আর নিশুকেও একগুচ্ছ লাল গোলাপ কিনে দিলো। মুহূর্তটা মিষ্টি কিন্তু বাইরে থেকে অশান্তির একটা ছায়া নেমে আসে।

“হাই ধ্রুব,কেমন আছো?”
পিছে ঘুরে তিনজন। নীলিকে দেখতেই মেজাজ খারাপ হলো নিশুর। বড় বড় চোখ করে তাকাল।
“তুমি এখানে কী করছো?”
“অনেক দিন ধরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই।”
“মনে হয় আগে কত ছিল!”
“এভাবে বলছো কেন!”
দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে রইল নিশু। মনের ভিতর আগুন জ্বলছে। ধ্রুব বাইকের দিকে এগিয়ে গেল,ওরাও পিছু পিছু গেল। হঠাৎ নীলি কয়েক ধাপ এগিয়ে ধ্রুবর হাত আঁকড়ে ধরতেই অপ্রস্তুত হলো সে।

“কী হয়েছে?”
“শোনো.. প্লিজ।”
“হাত ছাড়ো!”
“একটু তো শোনো!”
ধ্রুব নিজেই হাত ছাড়িয়ে নিলো।
“তোমার সাথে কথা ছিল।”
“বিরক্ত করো না,নীলি।”
অকস্মাৎ নীলিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো নিশু। পিচঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়তেই কোমরে ব্যথা পেতেই কুঁকড়ে উঠল সে।

“কী করলে এটা?”
“অসভ্য মেয়ে কোথাকার,লজ্জা করে না তোর?”
“বাজে কথা বলছো কেন?”
“আমার স্বামীকে স্পর্শ করলি কোন সাহসে?”
“হাত ধরলাম শুধু!”
“আমার স্বামীর হাত!”
“এটার জন্য রাগ হওয়ার কী আছে?”
আকস্মিক ছুটে গিয়ে রাস্তার পাশ থেকে একটি ইট নিয়ে এলো নিশু।
“মাথা ফাটিয়ে মগজ বের করে ফেলব যদি আর কখনও আমার স্বামীকে বিরক্ত করিস ছোঁয়া তো দূরের কথা!”
শব্দগুলো কাঁচের মতো ভাঙল।
“তোদের মতো নষ্টা মেয়েদের জন্যই আমাদের মতো সরল মেয়েরা স্বামীকে আঁটকে রাখতে পারে না। তোরা ছলনার জাল বিছিয়ে স্বামীকে বশ করে ফেলিস।”
ধ্রুব এগিয়ে এসে নিশুকে আঁটকাল।

“ছাড়ো! মেয়েটাকে শেষ করে ফেলব আজ! কত বড় সাহস তোমার হাত ধরে!”
“নিশু,থাম। চল,বলছি।”
“আর একদিন যদি ওকে বিরক্ত করিস সেদিনই হবে তোর শেষ দিন। তোর সবগুলো চুল ছিঁড়ে শাকের মতো ভাজি করব। লম্পট মেয়ে কোথাকার! নির্লজ্জ! চড়িয়ে গালের সবগুলো দাঁত ফেলে ফোকলা করে ফেলব! ঘুষিয়ে ঘুষিয়ে চেহারার নকশা বদলে ফেলব! প্লাস্টিকের বদনার মতো বানিয়ে ফেলব চেহারা! প্রেত্নী,শাঁকচুন্নি,ডাইনি,কটকটি,রাক্ষসী!”
সবসময় শান্তশিষ্ট,নীরব হয়ে থাকা নিশুর রণরুদ্র রূপ দেখে থমকাল ধ্রুব। ভিতরে ভিতরে এই মেয়ের মধ্যে এত জিদের পাহাড় রয়েছে তা কখনোই উপলব্ধি করতে পারেনি সে।
“নিশু,থাম।”

ইটটা কেঁড়ে ফেলে দিলো ধ্রুব।
“তোমার এত দরদ কেন মেয়েটার জন্য?”
“কোনো দরদ নেই। বাসায় চল,লেট হয়ে গিয়েছে।”
ওরা দু’জন ধ্রুবর পেছনে বাইকে চড়ে বসল। খানিকটা দূর থেকে এতক্ষণ ধূসর আর বুশরা সব দেখল। রাস্তায় ধূলি উড়ছে,বাতাসে রজনীগন্ধা ও লাল গোলাপের গন্ধ মিলেমিশে আছে। ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে নিশু।
“রাগ কমেনি তোর?”
“এটা রাগ কমার বিষয়?”
“বাদ দে।”
“কীভাবে এটা বাদ দিই?”
“ওকে পাত্তা দেয় কে!”
“শোনো,হিজাবের বাইরে চুল আসলে ছিঁড়ে ফেলি,আর তুমি যদি লিমিটের বাইরে যাও তাহলে মনে রেখ তোমার কী অবস্থা করি!”
“ওরে বাবা ভয় পেলাম!”
রাগে গজগজ করতে লাগল নিশু।
“ব্যাপারটা মনে রেখ।”

“তুই যে এই রকম হুটহাট রেগে যাস,আচ্ছা যদি প্রেম করতি আর তোর সাথে তোর বয়ফ্রেন্ডের ঝগড়া হত তাহলে রাগ ভাঙাতি কীভাবে?”
“আমার দ্বারা এই সব আদিখ্যেতা জীবনেও হবে না।”
“কেন?”
“আমি খুব কঠিন মানুষ।”
“সেটা তোকে দেখলেই বুঝা যায়। ছিদকাঁদুনে একটা।”
আকস্মিক পেছন থেকে মাথার চুলগুলো মুঠ করে টেনে ধরল নিশু।
“আহ কী করছিস!”
“কী বলেছ?”
“যা সত্যি তাই।”
“আমি মোটেও ছিদকাঁদুনে মেয়ে না বুঝলে!”
“বুঝলাম,ছাড়! পাগল কোথাকার,এক্সিডেন্ট হবি।”
তাদের টকমিষ্টি খুনসুটির নীরব সাক্ষী হয়ে রইল দ্যুতি। দ্যুতির তো বেশ লাগে দু’জনের এই রকম খুনসুটি। নীরবে সে উপভোগও করে। দীর্ঘ সময় পর বাসায় পৌঁছাল ওরা। আজও লিভিং স্পেসে বসে কথা বলছেন সুফিয়া বেগম এবং সাদিকা খাতুন। বাসায় ওদের একসঙ্গে ঢুকতে দেখে চোখ কপালে তুললেন। ওরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ওদের পেছন পেছন ঢুকল ধূসর ও বুশরাও। চোখ এবার মাথায় উঠে গেল। ভাবা যায় এই সব!

“আমার ভোলাভালা নাতিগুলার মাথা খাইছে এই মাইয়া দুইটা।”
“ছেলেগুলা হাতছাড়া হয়ে গেল,আম্মা। ভেবেছিলাম ভাইয়ের সাথে আত্মীয়তা করব তা আর হলো না।”
“ছোট থেকে পাইলাপুইসা বড় করছি কি এমন দিন দেখার জন্য নাকি!”
“কে জানত এমন হবে। কালসাপে গিলে ফেলবে সংসারটাকে!”
“আমার ছেলের সোনার সংসারটা শেষ করে দিলো! আহ আফসোস!”
“ভাবির কানে বিষ ঢালতে হবে,আম্মা। কিছুতেই সুখে সংসার করতে দিবো না এদের।”
“হুম। জায়গামতো চাল চালতে হবে।”
আড়াল থেকে সবই শুনল দ্যুতি।
“দিলরুবা,কই গো? পান দিয়ে যাও।”
দিলরুবা খাতুন পানের বাটা নিয়ে উনাদের পাশে এসে বসলেন।
“বউদের অতিরিক্ত ছাড় দিতে নেই,দিলরুবা।”
পান বানানোয় মনোযোগ দিলেন তিনি।
“এত ছাড় দিলে বউরা বেশি বাড় বেড়ে যাবে। মাথায় লবণ রেখে বড়ই খাবে।”
নীরব রইলেন তিনি। বউদের সম্পর্কে এই সব নেগেটিভ কথাবার্তা শুনতে ভালো লাগে না উনার। তিনিও এককালে বউ ছিলেন,এখন আল্লাহর ইচ্ছেয় শ্বাশুড়ি হয়েছেন। এটাও একটা নিয়ামত,ভাগ্য,কপাল। মানুষের নেগেটিভ কথাবার্তা শুনে তিনি কোনো নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে চান না।

“কী বলছি কানে গেছে তোমার?”
“জি।”
“শাসন করবা। এত উড়তে দিও না। নাগাল পাইবা না পরে। দিন-দুনিয়া ভালো না।”
“আম্মা,আমার এক মেয়ে। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে অন‍্যের ঘরে পাঠাব আর তিন মেয়েকে বিয়ে করিয়ে নিজের ঘরে আনব। আল্লাহর ইচ্ছেয় দু’জন এসেছে,নিয়ামত হয়েছে। অন্তরে কালি রাখা ভালো না,আম্মা।”
“শোনো,তোমার কপালে শেষমেষ অনেক দুঃখ আছে,দিলরুবা। বউদের টাইট দিতে হয়। শ্বাশুড়ি হয়েছ ভালো কথা এবার বউ কীভাবে চালাতে হয় সেটাও শিখো আমার থেকে।”
“তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দেন না,আম্মা। অশান্তি করে কী লাভ! আমরা আর বাঁচব কয়দিন!”
“তুমি অযোগ্য বউমা,অযোগ্য শ্বাশুড়ি। তোমার দ্বারা কিছুই হবে না।”
নীরব রইলেন তিনি।

“বিয়ের পর ছেলেরা পর হয়ে যায়,বউয়ের কারণে বদলে যায়.. বুঝছো,দিলরুবা?”
“এইসব আপনার ভুল ধারণা,আম্মা।”
“তুমি এখন আমারে শেখাবা?”
চায়ের কাপে টুং করে চামচ বাজল। গলায় রাগের সুর,চোখে পুরনো দিনের তেজ।
“না,শেখানো নয়- বোঝানোর চেষ্টা করছি মাত্র।”
উনার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত ধৈর্য ও মমতার মিশ্রণ।
“সন্তান যখন একা থাকে,তখন তার জীবনযাপন,অভ্যাস,মানসিকতা- সব একরকম থাকে। কিন্তু বিয়ের পর তার জীবনে আসে আরেকজন মানুষ,যে শুধু সঙ্গী নয়- দায়িত্ব,ভালোবাসা আর যত্নের নতুন কেন্দ্রবিন্দু। তখন অনেক কিছুই বদলায় কিন্তু সেটাই তো জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ,আম্মা।”
মুখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। ঠোঁট চেপে রইলেন অনিচ্ছার কঠিন রেখায়।
“একজন ছেলে যদি তার স্ত্রীকে ভালোবাসে,তার প্রতি যত্নশীল হয়,তাহলে মা-বাবা হিসেবে সেটা গর্বের বিষয় হওয়া উচিত। পৃথিবীর কোনো মা-বাবা তো চান না,তাঁদের সন্তান সংসারে অসুখী থাকুক। আর অন্যের মেয়েকে ভালোবাসলেই কি ছেলে পর হয়ে যায়? না,সে কেবল জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা রাখে- যেখানে সে আরেকটা হৃদয়ের যত্ন নিতে শেখে।”

তীর্যক চোখে তাকালেন তিনি। তাঁর নিঃশ্বাসে জমে থাকা কথা যেন বুকের ভিতর ধোঁয়ার মতো ঘুরপাক খাচ্ছে।
“আম্মা,একজন মা-বাবা কখনোই চান না,তাঁদের মেয়ের জামাই মেয়েকে কষ্ট দিক। তাহলে নিজের ছেলের ক্ষেত্রেও একই মনোভাব থাকা উচিত,তাই না?যে মেয়েটি আমাদের ঘরে এসেছে,সে যেন ভালোবাসা,যত্ন আর সম্মানের পরশ পায়- সেটাই তো প্রত্যাশা হওয়া উচিত। যে সংসারে শাশুড়ি ছেলের বউয়ের সঙ্গে হিংসা করে,সেই সংসার কখনো শান্ত হয় না,আম্মা। একসময় আপনিও ছিলেন একজন বউ- তখন আপনিও চেয়েছিলেন স্বামীর মনোযোগ,ভালোবাসা আর ভরসা। তাহলে এখন কেন সেই একই চাওয়া বুঝে উঠতে এত কষ্ট হয়?”
দিলরুবা খাতুনের গলায় মৃদু অনুযোগের সুর।
“ছেলে বদলে গিয়েছে,পর হয়ে গিয়েছে- এই ভাবনা সংসারের শান্তি নষ্ট করে দেয়। এতে ছেলে অপরাধবোধে ভোগে,স্ত্রী অবমূল্যায়িত হয়,আর সংসারে শুরু হয় অবিশ্বাসের আগুন। বরং ভাবুন,আপনার নাতিরা একটু বউপাগল হয়েছে,এতে ক্ষতি কী! এটা তো সুখের লক্ষণ,আম্মা!”
মৃদু হাসলেন দিলরুবা খাতুন।

“দাদী হিসেবে যদি আপনি নাতবউদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন,দেখবেন নাতিরা আরও বেশি শান্ত,সংযত আর আপন মনে সংসার করবে। সব ছেলে নিখুঁত নয় কিন্তু যে ছেলে তার মা-বাবাকে শ্রদ্ধা করে,দায়িত্ব পালন করে- তাকে ‘বদলে গিয়েছে’ বলা অন্যায়।”
জানালার বাইরে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সোনালি আলো এসে পড়েছে ঘরে।
“যদি আপনার নাতি তার স্ত্রীর কাছ থেকে মানসিক শান্তি পায়,তবে সেই সংসার স্বর্গের মতো হবে। কিন্তু যদি হিংসা,অভিযোগ আর তুলনা ঢুকে পড়ে,তবে সেটাই একদিন নরকে পরিণত হবে। তাই,আম্মা.. ওদের সংসারটাকে ওদের মতো করে গড়ে উঠতে দিন। সমালোচনা নয়,দিন ভালো পরামর্শ,মমতার পরশ। তাহলেই ঘরে ফিরে আসবে শান্তি।”

পুরো ঘর নীরব শুধু দেয়ালঘড়ির টিকটিক শব্দ। গ্যারেজে বাইক রেখে বাসায় ঢুকল ধ্রুব। সোফায় বসে স্নিকার্স খুলতে খুলতে বলল,”কী সমস্যা,দাদীমা?”
মুখ ভার করে তাকালেন তিনি।
“বিয়া কইরা তোরা সবডি পর হইয়া গেছোস। দাদীমার কথা এখন আর মনে থাকে না। সারাদিন বউগোরো লইয়াই ফূর্তি করোস। দাদীমার খবর নেওয়ার সময় কই!”
“দাদীমা,তুমি মনে হয় সংসার জীবনে অসুখী ছিলে,তাই না?”
“কী বললি?”
“তা না হলে অশান্তি করার মানে কী?”
“কই অশান্তি করলাম আমি?”

“দাদাজান মনে হয় তোমাকে সুখে রাখেননি,তাই কারো সুখ-শান্তি সহ্য হয় না তোমার। তা না হলে এই বয়সেও তোমার চোখে এত হিংসা কেন?”
“আগতাগফিরুল্লাহ! কীসব কইতাছোস?”
“শুনেছি,যারা সংসার জীবনে অসুখী ছিল,তারাই অন্যের সংসারে অশান্তি করে বেড়ায়। সুখী মানুষ অন্যের সুখ দেখে হাসে,হিংসে করে না।”
“নাউজুবিল্লাহ! আমি হিংসা করি?”
“তুমি না,তোমার মাথায় থাকা পুরনো দাদীমাটাই করে!”
“ধুরু! ধুরু!”

“খাবে-দাবে,নামাজ পড়বে,ঘুমাবে- এই বয়সে এত রাজনীতি করার কী দরকার বলো তো?”
“আমি কী এমন করলাম রে?”
“তোমার মতো কিছু কিছু শাশুড়িদের এই স্বভাবটা আমার ভালো লাগে না। তারা নিজের ছেলের বউকে সতীনের মতো হিংসা করে। হিংসা করে নাতবউদেরকেও।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ এই সব কী কস?”
“দিন তিনবার ঘুমের ওষুধ খেও,দাদীমা।”
“কেন?”
“জেগে থাকলে তোমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি ভর করে।”
“শুনছো কথা!”
থম মেরে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

“তুমি যদি সত্যি দাদাজানকে ভালোবাসতে,তাহলে আজও তোমার মুখে মিষ্টি হাসি লেগে থাকত,তেঁতো না। ভালোবাসা মানুষকে নরম করে,কঠিন নয়। বউদের নিয়ে ফূর্তি না করলে সংসার টেকে না.. বুঝচ্ছ,দাদীমা!”
নিজের ঘরের দিকে চলে গেল ধ্রুব। হঠাৎ সোফায় এসে বসল দ্যুতি। মায়ের হাত থেকে পান নিয়ে বলল,”আমি বানিয়ে দিচ্ছি,আম্মু। তুমি যাও,আব্বু ডাকছে।”
মৃদু হেসে উঠে গেলেন তিনি। মনোযোগ দিয়ে পান বানাতে লাগল দ্যুতি। মশলা,জর্দা,চুন- সব নিখুঁত পরিমাণে নিয়ে সাজাতে লাগল।

“নাও,দাদীমা।”
পানের পাতা গুটিয়ে এগিয়ে দিলো দ্যুতি।
“জর্দা দিছোস?”
“হুম,খেয়েই দেখো কী মজা!”
দাদীমা পানটা মুখে পুরে চিবুতে লাগলেন। মুখভর্তি পানের রঙ ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁটে। হঠাৎই মুখ কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি-
“এই কী করেছিস,পুড়ে গেল আমার মুখ! এত চুন কেন দিছিস?”
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল দ্যুতি।
“না তো,দাদীমা। আমি তো অল্পই দিয়েছি।”
“অল্প! জ্বলছে মুখটা আমার! আহ্,পানি দে কেউ!”
“বেসিনে যাও।”

দ্রুত উঠে বেসিনে গিয়ে কল ছেড়ে কুলকুচি করতে লাগলেন তিনি। চোখ রাগে লাল।
“এই মেয়ে পানের জায়গায় আগুন বানাইছে!”
“আমি তো ভালোই বানিয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ,কত ভালো দেখলাম তো! আমার মুখ পুড়িয়ে ফেলেছিস।”
“যে আগুনে তুমি অন্যকে পুড়াও,সেই আগুন একদিন নিজের মুখেই লাগে। এখন সামান্য চুন সহ্য করতে পারছো না!”

“কী বললি?”
“কই না তো!”
“এ মেয়ের হাতেই আগুন! মুখ পুড়ে গেল আমার!”
“ওফস সরি,দাদীমা!”
“নাটক করিস না।”
ধ্রুব রুমে ঢুকতেই নিশুও ঢুকে পড়ল।
“কীরে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”
“গোসল করো এখুনি!”
“দুপুরে করেছি।”
“এখন আবার করবে।”

“কেন?”
“পরনারী স্পর্শ করেছে তোমাকে।”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় নেত্রে তাকায় ধ্রুব।
“এটার জন্য গোসল করতে হবে?”
“হ্যাঁ,অবশ্যই।”
টেনে নিয়ে গেল ওয়াশরুমে। মাজুনিতে সাবান দিয়ে ফ্যানা করে হাতের মধ্যে ঘষতে লাগল সমানে।
“তুই তো দেখি চামড়া উঠিয়ে ফেলবি।”
“ওই মেয়ে তোমাকে ছুঁয়েছে.. সাহস কত!”

‘নিশুর বাচ্চা,ছাড়! কী করছিস! আমার হাতের ছাল-চামড়া সব তুলে ফেলছিস.. ওফ!’
শুনলে তো নিশু,একদম নয়। সে আরও জোরে হাতের চামড়া ঘষতেই আছে।
‘আল্লাহর ওয়াস্তে এবার তো ছাড়! কেন করছিস এমন পাগলামি?’
‘তুমি আমার একান্তই ব্যক্তিগত,তোমাকে আমি কাউকে দিবো না! ছুঁতেও দিবো না। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া বুঝচ্ছ! তোমাকে আরেক মেয়ে ছুঁবে কেন! কোন সাহসে! ওই মেয়েটার সবগুলো চুল তুলে শাক ভাজি করব আমি।’

নিশুর দিকে তাকায় ধ্রুব। মেয়েটা সত্যি একটা পাগল,তা না হলে এমন করে কেউ!
‘যে-কোন ব্যক্তি যতই মহৎ হোক না কেন- জায়গা,সম্পদ,টাকা সব দিয়ে দিতে পারে কিন্তু নিজ স্বামীর পাশে অন্য নারীকে দেখতে পারে না। নারীরা তার শখের পুরুষের পাশে জান্নাতি হুরের কথাও চিন্তা করতে পারে না। আর ওই মেয়ে কিনা তোমাকে ছোঁয় সাহস কত!’
‘তোর এত ভালোবাসা আমি কোথায় রাখব বল তো?’
‘হৃদয়ে।’
‘তাহলে এবার ছাড়,সত্যি চামড়া জ্বলছে।’
‘উহুম!’
শোনার নামই নেই। ধ্রুব আরেক হাতে এক মগ পানি নিয়ে নিশুর মাথায় ঢেলে দিতেই থমকাল।
‘কী করলে এটা?’

‘চল একসঙ্গে গোসল করি,ফাজিল কোথাকার!’
কিছুক্ষণের মধ্যে গোসল সেরে বেরোল দু’জন। নিশু ভেজা জামাকাপড়গুলো ব্যালকনিতে মেলে দিতে লাগল। চুলগুলো থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। টি-শার্ট পরে এগিয়ে এলো ধ্রুব।
‘চুলগুলো ভালো করে মুছিসনি কেন,ঠাণ্ডা লাগবে।’
‘লাগুক!’
টাওয়াল নিয়ে আলতো হাতে নিশুর চুলগুলো মুছে দিতে লাগল ধ্রুব। পাশের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল ধূসর। দু’জনের দিকে দৃষ্টি পড়তেই তাকিয়ে রইল।
‘এত বড় চুল রেখেছিস কেন?’
‘জামাইর হাতে বেণি করার জন্য।’
‘তুই তো দেখি জাতে মাতাল তালে ঠিক!’
‘হু,তোমার জন্য।’
আকস্মিক নিশুর ভেজা চুলগুলো একসাথ করে মুখ গুঁজতেই চোয়াল শক্ত করে দৃষ্টি সরিয়ে রুমে ঢুকে গেল ধূসর।
‘কী করছো?’

‘মেয়েদের ভেজা চুলের ঘ্রাণ পৃথিবীর সকল পারফিউমকে হার মানায়।’
‘জানো কীভাবে,প্রাকটিস আছে নাকি!’
‘হুম আছে তো! তোকে দিয়ে প্রাকটিস করছিস দেখছিস না!’
‘ছাড়ো! খাবার খেতে আসো।’
‘খেয়েছি,তোরা খা।’
বেরিয়ে গেল নিশু। দ্যুতিও গোসল সেরে জামাকাপড় নেড়ে দিয়ে জায়নামাজ বিছিয়ে সবে নামাজের জন্য দাঁড়াল। নিশুর মুখ মলিন হয়ে গেল। তাকে একটু ডাকলও না। সেও দ্যুতির পাশে না দাঁড়িয়ে আরেকটা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। সালাম ফিরিয়ে বাঁকা চোখে তাকাল দ্যুতি। সেও মুখ ফিরিয়ে নিলো নিশুর থেকে। নামাজ আদায় করে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখল নিশু।
‘কারো ইচ্ছে হলে খাবার খেতে আসে যেন।’

দ্যুতি তাকাল না শুয়ে পড়ল। মেজাজ খারাপ হলো নিশুর। দুপদাপ পা ফেলে ডাইনিংয়ে গেল। দুটো প্লেটে খাবার বেড়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু দ্যুতি এলো না। ধৈর্য ধরল নিশু। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও দ্যুতি এলো না। কান্না পায় নিশুর। একসময় পরিবারের সবাই তার দুঃখে ছিল। কিন্তু এখন যখন সে তার প্রিয় মানুষটার সঙ্গে সুখী এখন আর কেউ তার সুখের সঙ্গে ভাগিদার হয় না। বারবার তাকাল তবুও দ্যুতি এলো না।উঠে আবারও রুমে ঢুকল।
‘এই খাবি না?’
দ্যুতি কিছু বলল না।

‘ঢং করছে কেন বুঝলাম না!’
দ্যুতি তাকাল না। চুল টেনে দিলো নিশু। ব্যথা পেতেই আগুন চোখে তাকাল।
‘কী বলছি শুনিস না?’
‘যার ইচ্ছা সে খাক!’
‘ঠিক আছে,কাউকে খেতে হবে না। রোজা থাক। একদম কিছু খাবি না,খেলেই আজ তোর মুখ ভেঙে দিবো।’
বেরিয়ে গেল নিশু। এদিকে বুশরা তো তাদের চেনেই না দ্যুতি।এখন সেই জিদ দেখাচ্ছে তাকে। ধুপধাপ পা ফেলে চেয়ারে বসল। দাঁতে দাঁত চেপে ভাত মাখাতে লাগল।

‘কারো খেতে হবে না সব আমি খাব। থাক তুই রোজা।’
‘কী হয়েছে,আপু?’
‘কিছু না।’
‘এমনভাবে ভাত মাখাচ্ছ,ভাতের তো নাড়িভুঁড়ি সব ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।’
‘যাক!’
‘আরে আস্তে! ভাত ব্যথা পাচ্ছে তো!’
‘যা তো তুই!’
বেরিয়ে গেল ধীরাজ। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো তাসফিয়ার। হকচকালেও স্থির হয়ে উপরে উঠতে লাগল সে। সেদিকে একপলক তাকিয়ে শিস বাজিয়ে নামতে লাগল ধীরাজ। উপর থেকে অপ্রসন্ন চোখে তাকায় তাসফিয়া। গাল পুড়িয়ে মা-মেয়ে দু’জন সোফায় বসে আছে। দ্যুতিকে ইচ্ছেমত তুলোধুনো করছে। সেদিকে খেয়াল করল না নিশু। ধ্রুব তার ভুল বুঝতে পেরেছে,তাদের সম্পর্কটা একদম স্বাভাবিক কিন্তু ধূসর আর দ্যুতি বেঁকে বসেছে। আসাদ সাহেবেরও মতিগতি বুঝা যাচ্ছে না। বুশরাও কেমন জানি করছে। আর বাকিরা সবাই ঠিকঠাক আছে। এদিকে যোগ হলো দাদী আর ফুপি শ্বাশুড়ির যন্ত্রণা। নিশুর কেমন পাগল পাগল লাগে। রুমে ঢুকে হাসফাস করতে লাগল ধূসর। বিছানায় শুয়ে রয়েছিল বুশরা। ধূসরকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে চমকে উঠে বসল।

‘কী হয়েছে আপনার?’
‘কিছু না।’
‘সারাদিন তো ভালো ছিলেন হঠাৎ এমন করছেন কেন?’
‘প্রশ্ন করো না!’
চেঁচিয়ে উঠতেই কেঁপে উঠল বুশরা। চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে গেল।
‘এক মগ ব্ল্যাক কফি দাও।’
চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়াল বুশরা। নিশুকে দেখলেও কিছু বলল না। কিচেনে ঢুকে চুলায় কফির পানি বসাল। নিশু সেদিকে তাকাতেই মলিন হাসল বুশরা।

‘খাওয়া-দাওয়া করবি না তোরা?’
‘আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।’
‘ওহ.. ভালো।’
নিশু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
‘এই ছেরি এদিকে আসো।’
হকচকাল বুশরা।
‘তোমারেই বলছি।’
এগিয়ে গেল সে।
‘জি,কিছু বলবেন?’
‘পা ব্যথা করতেছে একটু টিপে দাও।’
বুশরা দাঁড়িয়ে রইল।
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘একটু পরে দিই,কফিটা..’

‘এত বাহানা করো কেন? সারাদিন তো ঘুরাঘুরি।করলে। স্বামীর কোলের মধ্যে চিপকে বসে থাকতে ভালো লাগে বুঝি তোমার?’
মলিন মুখে পা টিপতে লাগল বুশরা। দ্যুতির উপর জিদ করে কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে গেল নিশু। প্লেট ধুয়ে,হাত টাওয়ালে মুছে এগিয়ে গেল।
‘তুই যা আমি টিপে দিচ্ছি।’
‘এই যে মাদার তেরেসা এদিকে আসুন।’
চমকে তাকাল ওরা দু’জন। সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্যুতি। চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে যেন।

‘কী হয়েছে?’
‘এদিকে আসেন,আপনার কাজ পড়েছে।’
নিশু এগিয়ে গেল। রুমে ঢুকল দ্যুতি।
‘কী হয়েছে?’
ভ্রু কুঁচকায় নিশু।
‘মাদার তেরেসাগিরি কম দেখাবি।’
‘কী করেছি?’
‘তোকে কেউ বলছে সেধে সেধে আরেকজনের কাজ করতে?’
‘ওর অভ্যাস নেই এসবের।’
‘তোকে তো পণ্ডিতি করতে বলেনি কেউ। তুই ও বউ,সেও বউ। তোর কাজ তুই করবি,ওরটা ওকে করতে দে। মাদার তেরেসাগিরি একদম করবি না। আসছে আমাদের দিল-দরদী মাদার তেরেসা।’
সব মাথার উপর দিয়ে গেল নিশুর।

‘এমন করছিস কেন?’
‘নিজের দাম বুঝতে শিখ কারণ সস্তা জিনিসের কদর কেউ করে না।’
মলিন মুখে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। বেশ কিছুক্ষণ পর রুম থেকে বেরিয়ে এলো ধূসর। বুশরা পা টিপছে দাদীমার।
‘তোমাকে কী বলেছিলাম?’
হকচকায় বুশরা।
‘এই তো আসছি।’
‘প্রয়োজন নেই।’
বাঁকা হাসে দাদীমা।
‘ওই ছেরি তোমার হাতে জোর নাই কী টিপো!’
মলিন মুখে টিপতে লাগল বুশরা। কিচেনে ঢুকে একটি ছুরি নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল ধূসর। তার ব্যালকনিজুড়ে ফুলগাছের সমাহার। সবগুলো নিশু লাগিয়েছে। প্রতিটি ব্যালকনি নিশু আর দ্যুতি ফুলগাছ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। অবশ্য এতে আপত্তি নেই কারো। নিশুর সবচেয়ে প্রিয় হাসনাহেনা গাছটি ধূসরের ব্যালকনির এককোণে। ঝোপ হয়ে নিচের দিকে নেতিয়ে পড়েছে। ফুল ফুটলে সুগন্ধে থাকা যায় না বাড়িতে। তবে ধূসরেরও ভীষণ ভালো লাগে। ছু’রি দিয়ে গাছটি কেটে টুকরো টুকরো করে ব্যালকনির বাইরে দিয়ে ফেলে দিতে লাগল। হঠাৎ নিচের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আঁতকে উঠল নিশু। টুকরো টুকরো ডালগুলো দেখতেই কেঁপে উঠল।
‘আমার হাসনাহেনা! আমার হাসনাহেনা!’

দিকবিদিকশুন্য হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ধূসরের রুমের দিকে ছুটল। জামাকাপড় ভাঁজ করছিল দ্যুতি। নিশুকে ওমন করতে দেখতেই রুম থেকে বেরোল সেও। ধূসরের রুমে ঢুকে সোজা ব্যালকনিতে পা বাড়াল। ধূসর বাকি গাছগুলোও কেটে ফেলতে লাগল।
‘এটা কী করলে তুমি? আমার গাছগুলো কেন কাটলে?’
‘তোর ফুলগাছের জন্য রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।’
‘আগে তো ঘুমাতে পারতে!’
‘এখন পারি না,এখন তোর মতো বিষাক্ত লাগে!’
বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় নিশু।
‘কেন কাটলে আমার গাছ,আমাকে বলতে পারতে!’
হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আকস্মিক ধূসরের চুলগুলো চেপে ধরে পিঠের মধ্যে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিতেই হতভম্ব হলো সে সহ দ্যুতি ও বুশরাও।

‘কেন করলে! কেন!’
চিৎকার করে কাঁদতে লাগল নিশু। মলিন মুখে তাকিয়ে রইল দ্যুতি। বুঝতে পারল না এমনটা কেন করল!
‘কেন করলে এমনটা? কী দোষ করেছে আমার গাছগুলো?’
বুকের মধ্যে হাত দিয়ে কয়েকটি ধাক্কা দিলো। পড়তে নিয়েও নিজেকে সামলাল ধূসর। চিৎকার চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ধ্রুব ও দিলরুবা খাতুন। নিশু তখনও ধাক্কাচ্ছে ধূসরকে। ধূসর নীরব।
‘কী হয়েছে এখানে?’
‘আমার সব গাছ কেটে ফেলেছে!’
‘কীরে এমনটা করলি কেন?’

কিছু বলল না ধূসর। আসলেই তার মাথা ঠিক ছিল না।
‘পাগল হয়ে যাচ্ছিস মনে হচ্ছে! পাবনায় তোর জন্য একটা সিট বুকিং করব নাকি! এই বাড়িতে দেখছি সব পাগলের বসবাস! সবগুলোর মাথার তাঁর ছেঁড়া! একেকবার একেকটার মাথার তাঁর ছিঁড়ে যায় কয়দিন পর পর। সব পাগলের কারখানা। মাঝেমধ্যে মনে হয় যে একটা পাগলাগারদে আছি।’
শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইল ধূসর। ডালের টুকরোগুলো নিয়ে নিশু কাঁদছে।
‘আমার সব গাছ শেষ করে দিলো। পাষাণ,হৃদয়হীন!’
ধূসর তাকায়।
‘বাদ দে.. চল।’

নিশুর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো। নিশু তাদের রুমে ঢুকে স্লিপিং পিল নিলো। সেখানে মাত্র দু’টি পিল। দু’টিই খেয়ে শুয়ে পড়ল! দ্যুতির মনের ভিতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। এই যুগের চারপাশের মেয়েদের মতো নয় তারা। আজকালকার মেয়েরা সকাল-বিকেল পার্টি থেকে পার্টিতে ঘুরে বেড়ায়,বন্ধুদের সঙ্গে দেশ-বিদেশ চষে ফেলে। সেখানে ওদের দু’জনের পৃথিবী সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা দু’জন বাসার মধ্যেই খুনসুটি করে। কীভাবে তাদের জীবন,ক্যারিয়ার,সংসার,সম্পর্ক ইত্যাদি সুন্দর হবে সেইসব নিয়ে ভাবে। আউল-ফাউল আড্ডা না দিয়ে গাছ রোপন করে,পায়রা পুষে,রান্নাবান্না শিখে,আর্ট করে,সুই-সুতোয় নানান রকম হাতের কাজ করে,গল্প-উপন্যাস,একাডেমিক কিংবা ধর্মীয় বই পড়ে সময় কাটায়। অর্থাৎ ওদের জীবনটা খুবই সহজ-সরল। কারণ ওরা জানে,ভদ্র লাইফ স্টাইলে থেকেও অনেক মেয়ে উপরে উঠতে পারে। সে যাইহোক,এখন আজ এক নিমিষেই তাদের এত সুন্দর গাছগুলো কেটে ফেলল ধূসর,অথচ বুশরা কিছুই বলল না। তার তো স্বামী; সে-তো চাইলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে থামাতে পারত। আর তার ভাইয়ের অসহ্য লাগলে তাদের ডেকে বলতে পারত,তারা সরিয়ে নিতো গাছগুলো; তা না করে এমনটা করার কোনো কারণই খুঁজে পেল না দ্যুতি। অগ্নি চোখে তাকাল বুশরার দিকে। থমকায় সে।

‘এতগুলো গাছ কেটে নষ্ট করে ফেলল,আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছিস!’
থমকে গেল বুশরা। গলা শুকিয়ে এলো তার।
‘আ.. আমি..’
‘তুই তো চাইলে থামাতে পারতি! নিষেধ করতে পারতি! তা না করে মজা করে দেখছিস! শান্তি পেয়েছিস তো!’
বুশরা কিছু বলার পূর্বেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল দ্যুতি। তার পায়ের শব্দ গমগম করে বাজল করিডোরে। বুশরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যেন সময় থেমে গিয়েছে। ধূসর,নিশু,দ্যুতি- কাউকেই বুঝতে পারছে না সে। সবাই যেন কেমন ধোঁয়াশার মধ্যে ঢেকে গিয়েছে। প্রতিটি মুখে রহস্য,প্রতিটি কথায় অজানা ক্লান্তি। রুমে ঢুকে দেখল,নিশু শুয়ে আছে। পাশে মেডিসিনের পাতাটা পড়ে আছে। পুরো রুমটা কেমন ভারি,নিঃশব্দ,বাতাসেও একরকম বিষণ্ণতা। দ্যুতির মন আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কিছুই ভালো লাগছে না তার। সবকিছু কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। বেডের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসল। দিলরুবা খাতুন রুমে ফিরে গেলেন।

‘এত চিৎকার চেঁচামেচি কীসের,দিলরুবা?’
‘আপনার ছেলে ওদের গাছগুলো কেটে ফেলেছে।’
‘মুডওয়ালা ঘাড়ত্যাঁড়াটা নাকি?’
‘না,মেজটা।’
‘মন্ত্রীর মেয়েকে বিয়ে করে ওর পাখনা গজিয়েছে বুঝি!’
গর্জে উঠলেন তিনি।
‘আপনি আবার কী থেকে কী বলা শুরু করেছেন?চেঁচাচ্ছেন কেন?’
‘তো ভীমরতি ধরেছে কেন?’
‘চুপ থাকুন,বিশ্রাম নিন।’

বিষয়টি বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে মিটমিট করে বাঁকা হাসতে লাগলেন সুফিয়া বেগম এবং সাদিকা খাতুন। যাক সংসারে আগুন লাগানো গেল যেভাবেই হোক! এখন সেই আগুনে শুধু ঘি ঢালতে হবে। মা-মেয়ে দু’জন ধূসরের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
‘কী ছেরি বিয়া কইরা আনল আমার নাতি! ছেরি তো অলক্ষুণে! শুক্রুরে শুক্রুরে আটদিন না হইতেই সংসারে আগুন লাগাইয়া দিলো।’
অপ্রস্তুত হয় বুশরা।

‘এই ছেরি একটা অলক্ষী,অপয়া। আমার পুতের এত সুন্দর সোনার সংসারটা দিলো নষ্ট কইরা। আরেকটা ফকিন্নির ঝি লইয়া আসছে সেইটারে নিয়াও কত গীতি-কিচ্ছা। আমার নাতিগুলার কপালে শান্তি নাই রে! শান্তি নাই!’
মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুশরা। অঝরে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখ বেয়ে।
‘এই দিলরুবা কালনাগিনীরে বিয়া করাইয়া আইনা আমার পুতের জীবন তো শেষ। এখন আবার আমার নাতিগুলার জীবনও শেষ।’
বকতে বকতে বেরিয়ে গেলেন উনারা।

‘কামকাজ কিচ্ছু পারে না ছেরিগুলা,আর দিলরুবা ছেরিগুলারে আরো তেলাইয়া মাথায় তোলে। এখন দেখ কী আগুন লাগাইলো এই ছেরিডা। আসতে না আসতেই বড় জায়ের গাছগুলা সব নষ্ট করাইয়া ফেলছে। সব দোষ এই ছেরির। আমার নাতিরে আঁচলে বাইন্ধা এখন নাচাইতাছে। দিলরুবারে কত বলছি,এত লাই দিও না। দিলরুবা শোনে না আমার কথা। নীতি কথা শোনায় আমারে মা-ছেলে মিলে। এখন বুঝুক!’
চোখের জল মুছে কয়েক কদম এগিয়ে গেল বুশরা।

‘এমনটা কেন করলেন?’
নীরব রইল ধূসর।
‘সবাই এখন ভাবছে আমিই শিখিয়ে দিয়েছি আপনাকে। সমস্যা হলে আপনি ওদের ডেকে বলে দিলেই পারতেন। এই গাছগুলো নষ্ট করে আপনি কী বুঝাতে চাইলেন? এমন নয়ত সবার সামনে আমাকে খারাপ করার জন্য এমনটা করেছেন!’
ছু’রিটা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর।

‘আম্মা,আমার পাসপোর্ট কই?’
‘কেন?’
‘দাও।’
‘আমার কাছে নেই।’
‘মানে মানে দিয়ে দাও,আম্মা।’
‘তোমার ট্রিটমেন্ট এখনও শেষ হয়নি।’
আকস্মিক উনার হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যাগটা কেঁড়ে নিয়ে পাসপোর্ট আর ব্যাংক কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল অনিক। নার্সরা থামানোর চেষ্টা করলেও পারল না। কান থেকে ফোন নামিয়ে ছুটে এলেন ইফতেখার মির্জা।
‘আমার ছেলে কই?’
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তাকালেন।
‘কথা কানে যায় না তোমার?’
‘চলে গিয়েছে।’
‘কোথায়?’

চিন্তায় ঘামাতে লাগলেন আদনীন ফেরদৌস।
‘তোমার মুখের ভেতর কি আলু?’
‘পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।’
যেন বিনা মেঘে মাথায় বজ্রপাত হলো।
‘কী!’
ভীত চোখে তাকালেন তিনি। আকস্মিক ধাক্কা মারতেই পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি।
‘তোমাকে আমি.. তোমাকে আমি..’
হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চাপলেন।
‘না ছেলেকে আর না মেয়েকে কাউকেই মানুষ করতে পারলে না তুমি। তোমার কারণেই আজ আমার ছেলেমেয়ের এই অবস্থা! তোমাকে আমি পিষে ফেলব!’
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে দ্রুত এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। ততক্ষণে বিমানে চড়ে বসল অনিক।

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা প্রায় পৌঁনে দুইটা ছুঁইছুঁই অথচ ধূসর এখনও বাসায় ফিরেনি। নিশু ঘুমে অচেতন,দ্যুতি নিঃশব্দে শুয়ে আছে নিজ ঘরে। বুশরাও তাদের রুমে বসে কাঁদছে। আর পুরো বাড়ি যেন মৃত নীরবতায় ঢেকে গিয়েছে। দিলরুবা খাতুন সদর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এতক্ষণ,চোখ বারবার রাস্তার দিকে। রাতের বাতাসে উনার শাড়ির আঁচল দুলে উঠছে,মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিভিং স্পেসে আসতেই থমকালেন। ধ্রুব ল্যাপটপে কাজ করছে। উনার উপস্থিতি টের পেতেই চোখ তুলে তাকাল

‘কী হয়েছে,আম্মা?’
‘ঘুমাসনি,বাবা?’
‘না,কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। তুমি জেগে আছো যে?’
‘ধূসর এখনও বাসায় ফিরল না।’
চমকে তাকায়।
‘কোথায় গেল?’
‘জানি না। তখন যে বেরোল,আর এলো না। এত রাত করে তো কোনোদিন বাসার বাইরে থাকেনি।’
গম্ভীর হলো ধ্রুব।
‘ফোন দিয়েছ?’
‘হ্যাঁ রে,ফোন বন্ধ।’
ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীরে টেবিলের উপর রাখল ধ্রুব। ফোন তুলে ধূসরের শেষ লোকেশন ট্র্যাকিং করতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।

‘আম্মা,ঘুমাও গিয়ে। আমি খুঁজে দেখছি,চিন্তার কিছু নেই।’
মায়ের মন কি আর এত সহজে মানে! বাসা থেকে বেরিয়ে গ্যারেজ থেকে বাইক বের করে স্টার্ট দিয়ে হেডলাইট জ্বেলে বেরিয়ে গেল সে। ফাঁকা রাস্তায় বাতাসের সঙ্গে ছুটে চলল ইঞ্জিনের শব্দ। রাত তখন প্রায় আঁড়াইটার ঘরে। নগরীর অভিজাত অন্ধকারে ডুবে থাকা বনানীর রুফটপ বার- দ্য রিভারস্টোন ক্লাব। চারপাশে লাল-নীল আলো ঝিলমিল করছে,নিচে লেকের জলে প্রতিফলিত শহরের নিস্তব্ধ আলো। আকাশে মেঘের ফাঁক দিয়ে আধখানা চাঁদ ঝুলে আছে,বাতাসে ভিজে গন্ধ। সিগারেট,অ্যালকোহল আর হালকা বৃষ্টির মিশ্রণ। দূরে কোথাও থেকে বাজছে মৃদু জ্যাজ সুর,যেন কোনো ভাঙা মনের আর্তনাদ। ধূসর বসে আছে কোণার টেবিলে,চারপাশে আদিব,শাওন,সমীর আর ইনান। টেবিলের উপর আধখাওয়া বোতল,ছাঁইভরা অ্যাশট্রে,আর পাঁচটি গ্লাস। যেগুলোর কাচের ভেতর মদ নয়,জমে আছে অগণিত স্মৃতি ও অপরাধবোধ। ধূসরের চোখ লাল,যেন দগ্ধ ভালোবাসার ছাঁই। ঠোঁটে নিস্পৃহ এক হাসি- একরকম আত্মবিনাশের আমন্ত্রণ যেন। আদিব গ্লাস নামিয়ে তাকাল তার দিকে,ক্লান্ত গলায় বলল,‘দোস্ত,আর কত খাবি? আজ বাসায় ফিরবি না?’
ধূসর ধীরে গ্লাসটা ঘুরিয়ে বলল,‘না,ফিরতে ইচ্ছে করছে না।’

‘কেন?’
‘জীবনটা ভুল পথে চলে গিয়েছে,আদিব। কিছু মানুষকে হারালে আর ফিরে পাওয়া যায় না। তারা থেকে যায় শুধু বুকের ভিতর এক বিষাক্ত প্রতিধ্বনি হয়ে।’
সমীর ঠোঁটে সিগারেট তুলল,গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল,‘ভুলে যা দোস্ত,সময়ের সঙ্গে সব ফিকে হয়ে যায়।’
ধূসরের চোখে হঠাৎ আগুনের ঝলক।
‘কীভাবে ভুলব বল! তার এত কাছে থেকেও সে আমার ভালোবাসা বুঝল না। মেয়েদের নাকি ত্রিনয়ন থাকে,তাহলে সে দেখল না কেন আমার মনের আগুন?’
ইনান হেসে উঠল বিষণ্ণভাবে।

‘এখন তুই বিয়ে করেছিস,আর সেও অন্য কারো বউ। তোর স্ত্রী ব্যতিতি এখন অন্য কারো কথা ভাবাটাও তোর জন্য মহাপাপ। বিশেষ করে সে এখন তোর ভাবী। আর আমাদের ধর্মে কথিত আছে,দেবর ভাবীর জন্য মৃত্যুস্বরূপ। তোর উচিত ছিল অন্তত ধর্মের কথাটা মানা।’
‘ও-ই তো আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে।’
এক মুহূর্ত নীরবতা নেমে এলো। রাতের বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ আরও ঘন হলো। দূরের লেকের ঢেউ আলো প্রতিফলিত করে কাঁপছে।
‘না,দোস্ত। তুই নিজেই নিজের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছিস।’
ধূসর গ্লাসটা ঠোঁটে তুলল। চোখের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা।

‘ও না চাইতেও আমাকে বেঁধে দিলো অন্য এক নারীর সঙ্গে। একটা সম্পর্ক,যেখানে ভালোবাসা নেই,শুধু সামাজিক দায়িত্বের নাম। বুঝিস,আদিব.. আমি এখন প্রতিদিন একটা মৃত জীবন বয়ে বেড়াই।’
সমীর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,‘তুই কি আজীবন কুমার থাকতি নাকি ওত ভালোই করেছে। এছাড়াও মেয়েটাও তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আর মেয়েটারও বাজে কোনো রেকর্ড নেই।’
ধূসর গ্লাস নামিয়ে দিলো ধীরে। চোখে জল চিকচিক করছে,মুখে হালকা হাসি।
‘হ্যাঁ,থাকতাম। ওর জন্য আজীবন অপেক্ষা করতাম। ও যদি দশ বাচ্চার মা-ও হতো,তবুও বিয়ে করতাম ওকেই।’
এক মুহূর্তের জন্য চারপাশে স্তব্ধতা। কেবল বাতাসে ভেসে আসছে কোনো এক বিষণ্ণ হালকা সুর।

‘এটা তোর আবেগ।’
‘না,এটা আবেগ নয়,সমীর। আমার ভালোবাসার কোনো বয়স নেই।’
শাওন গ্লাসে মদ ঢালল চুপচাপ। তার কণ্ঠও কাঁপছে সামান্য-
‘তুই তোর ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর না দিলেই পারতি। দোষ তোর,ওর না। ও তোর সাথে ভাই,বন্ধুর মতো মিশেছে। তোর উচিত হয়নি তাকে অন্য চোখে দেখা।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধূসর।
‘আমার ভাই শুধু কবুল বলেছে,দায়িত্ব নেয়নি কোনোদিন। তাদের সম্পর্কটা ছিল একটা মিথ্যে নাটক। দীর্ঘ এগারটি বছর অব্ধি কোনো পজিটিভ লক্ষণও দেখিনি। আর আমি শুধু.. ওর নিঃসঙ্গতা বুঝতে চেয়েছিলাম।’
‘তুই এখন বলবি দোষ সবার?’

ধূসর চোখ বন্ধ করল।
‘হ্যাঁ,সবার.. আমারও।’
আদিব বলল,‘যা হয়েছে ভুলে যা। নিয়তিকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা কর,দোস্ত। নয়ত তোদের পারিবারিক সম্পর্কটা খারাপ পর্যায়ে চলে যাবে। আর সেও ভীষণ কষ্ট পাবে।’
‘হ্যাঁ,সেও ভীষণ কষ্ট পায় আমি জানি। কিন্তু তার চাইতে আমি বেশি কষ্ট পাই। আমার খোঁজ কে রাখে!’
‘দোস্ত.. প্লিজ!’
‘তাকে অন্য কেউ স্পর্শ করে,তার হাত ধরে,তার কাঁধে মাথা রাখে,তার ভেজা চুলের সুবাস নেয়,তাকে ভালোবাসি বলে,এইগুলো দেখতে পারি না আমি। সহ্য হয় না আমার,বুকের মাঝে ভীষণ যন্ত্রণা হয়!’
ইনান বলল,‘যন্ত্রণা হলেও নিজেকে সামলে নিতে হবে।’
‘সম্ভব না।’

সমীর বলল,‘তাকে ভুলে যা,দোস্ত। সময়ই একদিন সব মুছে দিবে।’
‘ভুলে যাওয়ার সাধ্য আমার নেই। সে রয়ে গিয়েছে আমার শ্বাসে,রক্তে,প্রতিটি নিঃশ্বাসের মধ্যে। নিজের করে পাওয়ার ভাগ্য আমার ছিল না,তবু সে আমার- আমার হৃদয়ের গভীরতম কোণে।’
আদিব বলল,‘কী আর করবি,তাহলে বরং তাকে কল্পনায় রাখ। কেন এত কষ্ট পুষে রাখিস নিজের ভিতরে? ভালোবাসা কি পেতেই হয় সবসময়? অনুভবটুকুই তো অনেক সময় জীবনের চূড়ান্ত পরিতৃপ্তি।’
শাওন বলল,‘চিরকাল কেউ কারো প্রিয় হয়ে থাকে না। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পছন্দ বদলায়,ভালো লাগা বদলায়,প্রিয় মানুষের নাম বদলায়! বাদ দে এইসব।’

চুপ করে রইল ধূসর। বাইরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন কথাগুলোর মধ্যে এক অনন্ত সত্যের প্রতিধ্বনি তুলল। ভালোবাসা মানে তো শুধু পাওয়া নয়,বরং হারিয়েও যার স্মৃতিতে শান্তি খুঁজে পাওয়া,সেই তো প্রকৃত প্রেম। নিঃশব্দে গ্লাসটা ঠোঁটে তুলল আবার। বৃষ্টির হালকা ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। টুপটাপ টুপটাপ- যেন আকাশও কাঁদছে। ধূসরের গ্লাসে শেষ ঢোকটা মিলিয়ে গেল,আর বনানীর রাত নিঃশব্দে গ্রাস করে নিলো সব শব্দ। শুধু বৃষ্টির আওয়াজ,ভাঙা হৃদয়ের প্রতিধ্বনি আর এক মানুষ,যাকে ভালোবাসা পুড়িয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণ। ঠিক তখনই বাইকের শব্দ ভেসে এলো নিচ থেকে। ধ্রুব গেট ঠেলে ঢুকল ক্লাবে। আলো-আঁধারির ভিতর ধূসরের মুখ চিনে নিলো। ধীরে এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াতেই চমকে উঠল ওরা। ধ্রুবকে দেখতেই থমকাল ধূসর। দ্রুত মদের গ্লাসটা আড়াল করে ফেলল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ধ্রুব।

‘কী করছিস এখানে?’
আমতাআমতা করে চোরা চোখে-মুখে তাকাল ধূসর।
‘তুই জানিস না আম্মা চিন্তা করছে?’
কাচুমাচু করতে লাগল ধূসর। আকস্মিক কষিয়ে তিনটে থাপ্পড় মারতেই থমকে গেল। প্রতিক্রিয়া করার ভাষা হারিয়ে ফেলল।
‘মদ পান করছিস তুই! মানসম্মান সব শেষ করার চেষ্টা করছিস,তাই না?’

মায়াকুমারী পর্ব ৬৩

ধূসর কিছু বলল না। কলার চেপে ধরে বাকিদের হুমকি দিলো,‘আজকে মাফ করলাম তোদের। বিশ্বাস কর আর একদিন তোদের যদি দেখেছি সেদিন বেল্ট দিয়ে পিটিয়ে সবগুলার ছাল-চামড়া তুলে ফেলব.. মনে রাখিস!’
কলার চেপে ধরে টেনে বেরিয়ে এলো। বাইকের সামনে এনে ছুঁড়তেই পড়ে গেল।
‘উঠে বস।’
উঠে পেছনে বসল। চোয়াল শক্ত করে স্টার্ট দিলো। মাঝপথে আসতেই আকস্মিক একদল মুখোশধারী পথরোধ করল তাদের। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই আক্রমণ শুরু করল।

মায়াকুমারী পর্ব ৬৬+৬৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here