মায়াকুমারী পর্ব ৬৮+৬৯
মেহেরিন আনজারা
গেইটের সামনে রিকশা থামতেই দূর্বল পায়ে নামতেই হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল দ্যুতি। ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন থেকে এসে বাইক ব্রেক কষল ধ্রুব। বাইক থেকে নেমে দ্রুত দ্যুতিকে তুলতেই তার বিমর্ষ মুখ দেখতেই থমকাল। চোখে জল,ঠোঁট দুটো কেমন শুকনো।
‘দ্যুতি! কী হয়েছে তোর?’
কণ্ঠে আতঙ্ক। ঝাপসা চোখে তাকাল সে। মাথাটা কেমন ভারি,ঝিমঝিম করছে,গলা শুকিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠে এবার বমি করল। থমকায় ধ্রুব। নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
‘এই কী হয়েছে তোর?এমন করছিস কেন?’
নিভু নিভু ঝাপসা চোখে তাকাল দ্যুতি।
‘কিছু না।’
‘ধীরাজ কোথায়.. ও তোকে আনতে যায়নি?’
দ্যুতি নিরুত্তর। ধ্রুবর মনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। আজ-কালকার দিন,যুগ- কিছুই ভালো যাচ্ছে না। শহরটা এখন অনিরাপদ। শহর নয় ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা থেকে আশি-নব্বই বছরের বৃদ্ধারাও এখন অনিরাপদ। তাই তো সে ভার্সিটি শেষ হওয়ার পূর্বেই তাদের আনতে যায়। সব মিলিয়ে কুঁকিয়ে উঠল তার মস্তিষ্ক। দ্যুতির সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে কিনা এই ভেবে কাঁপতে লাগল তার বুকের ভিতর। ঠিক তখনই ব্রেক কষল ধীরাজ। বাইক থেকে নেমে এগিয়ে আসতেই আকস্মিক গালে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারতেই হতভম্ব হলো সে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
‘তোকে না বারবার ফোন করে বলেছি ওকে নিয়ে আসতে,কোথায় ছিলি তুই?’
‘গিয়েছিলাম তো!’
আকস্মিক কোমরে একটা লাথি মারতেই ছিটকে পড়ল নিচে।
‘ফাজলামি করিস!’
ধ্রুবর চোখে তীব্র রাগ,আতঙ্ক,দুশ্চিন্তা সব। অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাইয়ের দিকে তাকায় দ্যুতি। তার জন্য তার ভাইয়ের কত দুশ্চিন্তা,কত উদ্বেগ! একটা মেয়ের জীবনে বাবা আর ভাই যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী ও চিন্তাহীন মানুষ হয়েই থাকে। এই দু’টি মানুষ যেন তার জীবনে থেকে যায় সারাজীবন মনে মনে সেই দেয়া করল। ঠিক তখুনি তানজিল আর তাসফিয়া গাড়ি থেকে নামল। দ্যুতির ওমন অবস্থা দেখতেই থমকে তাকিয়ে রইল তানজিল। ধ্রুব পাঁজাকোলে তুলে নিলো দ্যুতিকে।
‘তাড়াতাড়ি বমিগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার কর।’
বাসার দিকে পা বাড়াল। পানির লাইন হাতে নিতেই ধীরাজের দিকে তাকায় তাসফিয়া। মুহূর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। সিঁড়িতে পা রেখে উপরে চলে গেল ওরা। পেছন থেকে তাকিয়ে রইল ধীরাজ। বাসায় ঢুকতেই কপালে ভাঁজ ফেললেন সুফিয়া বেগম।
‘কী হয়েছে ওর?’
‘কিছু না।’
‘এই অবস্থা কেন?’
আগুন চোখে তাকাল ধ্রুব।
‘সবখানে তোমার সিআইডিগিরি না করলে হয় না?’
থমথমে হয়ে গেল উনার মুখ।
‘আমি আবার কী করলাম?’
‘সবকিছুতে নাক গলাও কেন?’
‘আস্তাগফিরুল্লাহ!’
‘নামাজ-কালামে মন দাও। ইবাদাত বন্দেগি করো,আমাদের নিয়ে মাথা ঘামিও না।’
দাদীমার উপর ভীষণ বিরক্ত ধ্রুব। এই দাদীমার কানপড়ার কারণে সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। অল্প বয়স ছিল একদিকে,এরপর তার ব্রেইনওয়াশ করত,সেও বাবা-মাকে ভীষণ ভুল বুঝত। এখন দ্যুতির সঙ্গে কী হয়েছে তা সে জানে না। কিছুই আঁচ করতে পারছে না। যদি খারাপ কিছু ঘটে থাকে,তাহলে এ পরিবার,এই বংশ,এক মুহূর্তে কলঙ্কের গল্পে ডুবে যাবে। শুধু তাই নয়,এখন যদি সত্যি দ্যুতির সাথে খারাপ কিছু হয়ে থাকে তাহলে দাদীমা সেটা জানতে পারলে বানিয়ে-ছুরিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবে- আসাদের মেয়ে ধর্ষ.. এই কথাটুকু মাথায় আসতেই কেমন ঝড় বয়ে গেল তার মনে। বাকিটা আর ভাবতে পারল না। বুকের ভিতর ভার হয়ে রইল এক অজানা আশঙ্কা,নিঃশব্দ এক আতঙ্ক। সে যাইহোক,তবে সবখানেই দাদীমাকে নাক গলাতেই হবে। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন দিলরুবা খাতুন।
‘কী হয়েছে,বাবা.. এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?’
‘সাধে!’
‘আমার মেয়ের কী হয়েছে?’
‘রিকশা থেকে নামতে পায়ে ব্যথা পেয়েছে।’
‘আহারে! সাবধানে নামবি তো! বেশি ব্যথা পেয়েছে রে?’
‘না। চিন্তা করো না,আম্মা.. ঠিক হয়ে যাবে।’
সিঁড়িতে পা বাড়াল ধ্রুব। তবুও চিন্তায় অস্থির হলেন দিলরুবা খাতুন। বয়স বাড়লেও মায়ের মন যে বুদ্ধির মতো পরিণত হয় না- তা যেন আজ আরও স্পষ্ট বুঝলেন তিনি। ছেলেমেয়েদের একটাকেও আর বুঝতে পারেন না তিনি। সবাই এখন কথাগুলো বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখে,মুখে হাসি রাখে অথচ চোখে কোনো ভাষা থাকে না। মনে হয়,বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মায়ের চিন্তা কমে না,বরং আরও বেড়ে যায়। একসময় কী সহজ ছিল জীবন! সামান্য ব্যথা পেলেই দৌঁড়ে মায়ের কোলে এসে কেঁদে ফেলত তারা। মা জানতেন কার কী কষ্ট,কোন চোখের জল কতখানি সত্যি। এখন আর কেউ আসে না,কাঁদে না- শুধু দরজার ওপাশে বন্ধ হয়ে থাকে নীরবতা। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ছোটকালটাই বোধহয় ভালো ছিল। ওদের রুমে ঢুকে বিছানায় শুইয়ে দিলো দ্যুতিকে। নিশু চোখ বুজে একপাশে শুয়ে রয়েছিল,মনভার তার। ওদের উপস্থিতি টের পেতেই শোয়া থেকে উঠে বসল।
‘নিশু,দ্যুতি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মাথায় পানি ঢালতো!’
আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু। কিছু না বলে একপ্রকার ছুটে একটি ছোট্ট বালতিতে করে পানি এনে হিজাব আর ওড়না খুলে ধীরে ধীরে মাথায় ঢালতে লাগল। এরপর কুলকুচি করিয়ে হাত-মুখ মুছে দিলো ঠাণ্ডা পানি দিয়ে।
‘কী হয়েছে ওর?’
‘বুঝতে পারছি না।’
চোখ বুজে রইল দ্যুতি। এখনও তার মাথা ঘুরাচ্ছে,শরীর কাঁপছে,বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে।
‘দ্যুতি,সত্যি করে বল কী হয়েছে তোর?’
‘কিছু হয়নি,ভাইয়া।’
নিস্তেজ গলা তার।
‘আমাকে বল।’
‘কিচ্ছু হয়নি।’
ধ্রুব বিশ্বাস করতে চাইল না,তার গায়ের ভিতর রাগ আর অস্থিরতা তীব্র।
‘আমাকে শুধু বল কে কী করেছে তোর সঙ্গে। আমি তাকে পাতাল থেকে হলেও বের করে আনব।’
‘কিচ্ছু হয়নি,কেউ কিচ্ছু করেনি। হঠাৎ দূর্বল লাগছিল।’
ধ্রুব হতাশ,রাগে কাঁপছে,তবু চেষ্টা করল ধৈর্য ধরে সঠিক বিষয়টি জানার। একপাশে নিয়ে গেল নিশুকে।
‘ওকে জিজ্ঞেস করে সত্যিটা জানার চেষ্টা কর.. তাড়াতাড়ি।’
চিন্তিত মুখে মাথা নাড়াল নিশু। একপলক তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। দ্রুত কাছে এগিয়ে এসে দ্যুতির পাশে বসল। মাথায় মমতার হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘আমাকে বল কী হয়েছে তোর?’
নিশুর কোলে মুখ গুঁজে দু’হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল দ্যুতি। ধক করে উঠে নিশুর বুকের ভিতর। অজানা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল।
‘দ্যুতি,কী হয়েছে বল?’
‘ও এসেছে,নিশু।’
চমকায় সে।
‘কে?’
নীরব রইল দ্যুতি।
‘বল না কে?’
‘অ.. অনিক।’
‘অনিক!’
‘হুঁ!’
‘আল্লাহ! কখন?’
‘এখন।’
‘কী বলেছে তোকে?’
‘ও জীবনেও ভালো হবে না,নিশু।’
‘মানে?’
‘আসলেই.. ওকে আমি আবারও দেখব,ও আমার সামনে আসবে,কথা বলবে এটা ছিল অবিশ্বাস্য,অনাকাঙ্ক্ষিত আর অপ্রত্যাশিত। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না,নিশু।’
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল নিশু।
‘জানিস,ও এসেই আমাকে বলল আমি নাকি প্রেগন্যান্ট; রিকশা ঠিক করে দিয়ে বলল সাবধানে যেতে.. বেবি ব্যথা পাবে। কত্ত ফাজিল চিন্তা কর।’
নিশুর মাথা ঘুরে গেল। চোখ ফেটে কেমন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল সে।
‘সত্যি বলছিস তো?’
‘হুম।’
নিশুর চোখে আনন্দের ঝিলিক।
‘তাহলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লি যে,খারাপ কিছু ঘটেছে তোর সঙ্গে?’
‘না,হঠাৎই কেন জানি অসুস্থ অসুস্থ লাগছিল।’
‘তোর ভাইয়া অপেক্ষা করছে,জিজ্ঞেস করলে কী বলব?’
‘ওর কথা বলার দরকার নেই।’
‘আচ্ছা,আমি আমার মতো কিছু একটা বুঝ দিয়ে বলি কেমন! নয়ত,চিন্তা করতেই থাকবে।’
নীরব রইল দ্যুতি। দরজায় নক করে ভেতরে ঢুকল ধ্রুব।
‘জানতে পেরেছিস কিছু?’
‘হ্যাঁ,খারাপ কিছু হয়নি.. চিন্তা করো না।’
তবুও ধ্রুব বিশ্বাস করল না।
‘মিথ্যা বললে দু’জনকেই এখন আছাড় দিয়ে কোমর ভেঙে ফেলব।’
নিরাশ চোখে তাকায় নিশু।
‘ধুর! এমন কেন তোমরা,একটু কিছু হলেই সিরিয়াস হয়ে যাও।’
‘দ্যুতি,তোর ফোন কোথায়?’
‘ভেঙে গিয়েছে।’
‘ঠিক করিয়েছিস?’
‘না,মেজ ভাইয়া দেয়নি।’
ধ্রুব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
‘বিপদে-আপদে কল দিলে পাওয়া যায় না তোদের।’
তাদের কী দোষ,ধূসরই তো তাদের ফোন ব্যবহার করতে দেয় না। দিলেও ফোনের এক্সেস থাকে তার কাছে। যা একটা ফোন ছিল সেটাও ভেঙে গিয়েছে,ঠিক করে দেয়নি আর। নিশু নিজেও ফোন ব্যবহার করে না। ধূসর চায়ও না নিশু ফোন ব্যবহার করুক। তবে ফোনে বুশরা ব্যতিত আর কারো সঙ্গে কথা বলত না এইটুকুই।
‘তোকে না আইফোন দিয়েছি সেটা কই?’
‘আলমারিতে।’
‘সাজিয়ে রাখার জন্য দিয়েছি নাকি!’
‘কান্ট্রি লক।’
‘সমস্যা হলে জানাবি না?’
আর কিছু বলল না।
‘নিশু,ফোনটা দে তো!’
আলমারি থেকে ফোনের বক্সটা বের করে ধ্রুবর হাতে তুলে দিতেই দ্রুত বেরিয়ে গেল সে নিজের রুমে ঢুকে নিশুর ফোনটাও নিলো,এরপর বাইরে চলে গেল। নিজের নামে দু’টি সীমকার্ড কিনে ল্যাপটপে সব অ্যাকাউন্ট খুলে দিলো- জিমেইল,ফেইসবুক,মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ। দু’টি ফোনের এক্সেস নিজের কাছে নিয়ে নিলো। যেন ওরা কোনো অশোভন কাজ করলে তা বের করতে পারে। আজ-কালকার যুগ তো আবার খারাপ। ফোন হাতে পেলেই বিগড়ে যায় ছেলেমেয়ে উভয়ই। ফের নক করে ফোনগুলো ওদের দিয়ে বলল,‘সব ঠিক করে দিয়েছি। আর শোন,বুশরার হাতেও ফোন নেই,তাকে এটা দিস। ধূসরকে বলিস তার পছন্দমত অ্যাকাউন্ট খুলে দিতে।’
মাথা নাড়ায় ওরা। বেরিয়ে গেল ধ্রুব। তিনটি ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। তিনটি তিন কালারের। নিশুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। ওরা দ্রুত তাদের সবাইকে ফ্রেন্ডলিস্টে এড করে নিতে লাগল।
‘বুশরাকে ওর ফোনটা দিয়ে আসি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘মাদার তেরেসাগিরি কম কর।’
মলিন মুখে তাকায় নিশু।
‘তুই ওকে সহ্য করতে পারছিস না কেন?’
‘ও আমাদের দু’জনকে ছোট করেছে।’
‘কীভাবে?’
‘আমার আব্বু-আম্মুর কাছে ছোট করেছে। তোকেও আমাকেও। আচ্ছা আমার আব্বু না-হয় একটু বদমেজাজি কিন্তু আমার আব্বু কি খুব খারাপ?’
‘এইসব কেমন কথা?’
‘আব্বুর সঙ্গে একটুও কথা বলেনি,ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেনি। আন্তরিকতা বা সৌজন্যমূলকও কথা বলেনি। আম্মুর সাথেও না। আচ্ছা,শ্বাশুড়ি বাদ- আম্মু কি মানুষ হিসেবে খুব খারাপ?’
‘বানিয়ে বলছি না,আমার ফুপির মতো মানুষই হয় না।’
‘নিজের মায়ের সুনাম করছি না যা সত্যি তাই। ও আমার আম্মুর সাথে একটুও কথা বলেনি। এতে আমরা দু’জন ছোট হয়েছি ওকে বড় মুখে বিয়ে করিয়ে। আব্বু-আম্মু এখন ভাববে তুই তাদের সংসারকে দুইভাগ করে দিয়েছিস। তাদের সন্তানকে কেঁড়ে নিয়েছিস। ওকে এত করে বুঝলাম আম্মুর সাথে টুকটাক কথা বল,দেখবি আমার আম্মু মানুষ হিসেবে কত নরম,কোমল,চমৎকার! দাদীমা রান্না করতে পাঠিয়েছে ও রিনা আপাকে জিজ্ঞেস করে তার থেকে হেল্প নেয়। অহংকার করছি না চিন্তা কর ও বাড়ির কাজের লোকের হেল্প চায় অথচ আমার আম্মাুকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। মানে কত অহংকার তার। এই সংসার তো আমার মায়ের হাতেই গড়া। কেন ও একটু আমার আম্মুকে বললে বা হেল্প চাইলে কী হত?এভাবেও তো বলতে পারত,আন্টি কী রান্না করব বা আমি তো পারি না আমাকে একটু শিখিয়ে দিন। আমার আম্মু কত খুশি হত! যদি আমার আম্মু ওকে গুরুত্ব না দিতো তাহলে আমি নিজেই ওর পক্ষ নিয়ে আম্মুর সঙ্গে লড়াই করতাম। আমার আম্মু কিন্তু তখনও দাদীমার সামনে ওকে সাপোর্ট করে গিয়েছিল অথচ দাদীমার সামনে ও আমার আম্মুকে ছোট করেছে।’
‘দ্যুতি প্লিজ বাদ দে। নতুন মানুষ বুঝতে পারেনি।’
‘ও ছোট বাচ্চা নয়। একজন মেয়ে যখন বিয়ের পর নতুন সংসারে আসে,তার প্রথম দায়িত্ব হয় সম্পর্কগুলোকে সম্মান করা। কিন্তু ও করেছে উল্টোটা।’
‘দেখা যাবে নিজে কেমন সংসার করো।’
‘হ্যাঁ দেখিস।’
‘তোর ভাই কোন মেয়ের বিরহে ভেসে যাচ্ছে,সেই তেজ আমাকে দেখাচ্ছে। বুশরা হয়ত চেষ্টা করছে তাকে সামলে নিতে। তাদেরকে সময় দেওয়া উচিত।’
‘বুঝি দশ মিনিটও পরিবারের মানুষকে সময় দিতে পারে না? আর জামাইকে সময় দিয়ে আঁচলে বাঁধতে পেরেছে জিজ্ঞেস করিস? কাল রাতে তো..’
‘কী হয়েছে?’
‘সেই মেয়ের জন্য ধাক্কাটাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।’
মলিন হয়ে গেল নিশুর মুখ। মদ খাওয়ার কথা আর বলল না,নিশু কষ্ট পাবে- নিজেকেই দোষী ভাববে। বিছানার একপাশে ফোন রেখে উঠে দাঁড়াল নিশু।
‘খিদে পেয়েছে না তোর?’
‘হুম।’
রুম থেকে বেরিয়ে প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো নিশু। বেডের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে ফোন চাপছে দ্যুতি। ওর পাশে বসে ভাত মাখাতে লাগল। মুখের সামনে লোকমা ধরতেই হাঁ করল দ্যুতি।
‘তুই খেয়েছিস?’
‘না।’
‘খেয়ে নে।’
ধূসর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী মিশে যাচ্ছে বাতাসে। ধোঁয়ার গন্ধে কাশতে লাগল বুশরা।
‘আর কত সিগারেট খাবেন,এবার তো বন্ধ দিন। আপনার সমস্যা হবে।’
‘একা থাকতে দাও!’
ধমকে উঠতেই ভড়কে উঠে রুম থেকে বেরিয়ে এলো বুশরা। ওদের রুমে ঢুকতেই দু’জন তাকায়। চোয়াল শক্ত করে মুখ ফিরিয়ে নিলো দ্যুতি। নড়েচড়ে বসল নিশু।
‘কী করছিস তোরা?’
‘ভাত খাই।’
‘দ্যুতির কী হয়েছিল?’
‘কখন?’
‘শুনলাম,অসুস্থ হয়ে পড়েছিল?’
ভ্রু কুঁচকে তাকায় দ্যুতি।
‘অসুস্থতার কথা শুনেও তোর আসতে এতক্ষণ লাগল?’
অপ্রস্তুত হয় বুশরা।
‘না ঠিক তা নয়। আসলেই..’
‘স্বামীকে ভালো লাগে আর স্বামীর পরিবারকে ঝামেলা মনে হয়,তাই না?’
অপ্রস্তুত হয় বুশরা।
‘এই সব কেমন কথা দ্যুতি?’
‘মাদার তেরেসা.. তুমি চুপ করো।’
‘উল্টাপাল্টা কথা কম বল।’
‘কীরে স্বামী তোরে পাত্তা দেয় না,ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বুঝি,এজন্যই এখন এসেছিস?’
থমথমে হয়ে গেল ওদের দু’জনের মুখ।
‘দ্যুতি,চুপ কর।’
‘তেরেসা,তুমি চুপ থাকো.. বলতে দাও।’
মেজাজ খারাপ হয় নিশুর। আহাম্মক বনে তাকিয়ে রইল বুশরা।
‘অকৃতজ্ঞ মেয়ে কোথাকার!’
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় বুশরা।
‘দ্যুতি থামবি?’
‘নিশু,তুই চুপ থাক। যার জন্য এই ঘরের বউ হয়ে আসতে পেরেছিস সবার আগে তাকেই তুই ছোট করলি! অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও পুরো একটা পরিবারের সঙ্গে লড়াই করে,সবার পায়ে পড়ে,কেঁদেকেটে তোর প্রিয় মানুষটাকে তোকে যে পাইয়ে দিয়েছে আজীবনের জন্য তাকেই তুই ছোট করলি! তোর কি মনে হয় এত কিছুর পরেও আমার ভাই তোকে বিয়ে করত! অন্য কারো কথা বাদ- এটা আমার ভাই ধূসর! হ্যাঁ.. ধূসর! সাতবার কেন এক কোটিবার জন্ম নিলেও তুই আমার ভাইকে কখনো নিজের করে পেতি না। নিশুর উছিলায় পেয়েছিস। এখন তোকে মেনে নিয়েছে বল? অনেক তো সময় দিয়েছিস!’
নিঃশব্দে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল বুশরার চোখ থেকে।
‘তুই মন্ত্রীর মেয়ে না কুলির মেয়ে- তাই বলে তুই আমার বাবা-মাকে সম্মান করবি না?তোর তথাকথিত স্বামী আসমান থেকে জন্ম নিয়েছে?’
দ্যুতির প্রতিটি কথা বুশরার হৃদয়কে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে। ঝাপসা হয়ে গেল নিশুর চোখজোড়া।
‘দ্যুতি থাম।’
‘তোকে আমরা কেউ কাজ করতে বলেছি নাকি! আল্লাহর নাম না নিয়ে সকালে উঠিস,গরম গরম নাস্তা পাস কে তৈরি করে সেটা একবার ভেবেছিস? দুপুরেও গরম গরম খাবার চাই,রাতেও সেই একই- এই সব কে করে? নিজের প্লেটটাও যেই মেয়ে ধুতে পারে না সেই মেয়ের এত দেমাক কীসের? মন্ত্রী না কুলির মেয়ে বলেই কী!’
‘দ্যুতি এবার থাম। ওর এই সবে অভ্যাস নেই। ও অনেক বড় পরিবারে বিলং করেছে,তাদের পরিবার আর আমাদের পরিবার আলাদা। মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।’
‘বলতে চাচ্ছিস আমরা ফেলে দেওয়া পরিবার?’
মাথায় থাপ্পড় মারল নিশু।
‘বেশি বুঝে মেয়েটা!’
‘ও সব জেনেশুনেই এসেছে। কবুল বলার সময় ওদের দু’জনকে কেউ জোর করেনি। দু’জনেই প্রাপ্ত বয়স্ক। কাউকেই ফোর্স করা হয়নি। আমাদের কোটি কোটি টাকা না থাকলেও আদর্শ,সুখী একটা পরিবার রয়েছে। আমাদের পরিবারের মানুষগুলো মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও কিন্তু আমাদের পরিবারটা সুস্থ। আমরা সবাই এখানে মিলেমিশে থাকি,একে-অপরের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে রাজি। যেটা কোটি কোটি টাকার মালকিন পরিবারেও নেই। হ্যাঁ,আমার পরিবারকে নিয়ে অহংকার নয় গর্ব করতে পারি। আমি গর্বিত এমন পরিবারে জন্ম নিয়ে।’
‘আল্লাহর ওয়াস্তে তুই এবার থাম। বুশরা বাদ দে ওর কথা। পাগল হয়ে গিয়েছে ও। অসুস্থ.. বুঝিস না মাথা ঠিক নেই।’
‘শোন,মন্ত্রীর মেয়ে হয়েছিস বলে অহংকার করিস না। সকালে যে পত্রিকা দশটাকায় বিক্রি হয় আর বিকেলে সেই পত্রিকা কেজিতে মাত্র দশটাকায় বিক্রি হয়; অপেক্ষা শুধু সময়ের।’
‘কী শুরু করলি,দ্যুতি?’
ঘৃণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ সরিয়ে নিলো দ্যুতি।
‘এই শোন,ওর কথা সিরিয়াসলি নিস না.. পাগল একটা। এই দেখ,তোর ভাসুর মশাই তোর জন্য আইফোন দিয়েছে। কেমন হয়েছে দেখ।’
বেসিন থেকে হাত ধুয়ে ফোন তুলে দিলো।
‘ওর একটা কথায়ও কান দিস না। পাগল একটা। একটা ননদ তো তাই একটু ঢং করছে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের মতো। চল আমরা দু জা মিলে কিছু করি।’
বুশরার হাত ধরে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা রাখতেই মুখোমুখি হলো ধীরাজের।
‘কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’
‘দামড়িটা বমি করেছে আর তোমার স্বামী আমাকে দিয়ে সব দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছে।’
‘কী!’
শব্দ করে হেসে উঠল নিশু।
‘হেসো না,রাগে শরীর জ্বলছে।’
তবুও নিশু হাসতে লাগল। বাঁকা চোখে তাকিয়ে রইলেন দাদীমা-ফুপি।
‘ধীরাজ,এই ফোনটা ঠিক করে দিস তো।’
ফোনটা হাতে নিয়ে মাথা নেড়ে রুমের দিকে পা বাড়াল সে। দাদীমা-ফুপিকে লিভিং স্পেসে বসে থাকতে দেখে ওরা আর সেদিকে গেল না,সরাসরি কিচেনে ঢুকল।বিকেলের আলো ততক্ষণে জানালা বেয়ে ঢুকছে। গ্যাসে ফুটছে কেটলির জল,তার ভেতর থেকে আসছে হালকা বাষ্প। ফ্রিজ খুলে বেশ কিছু সবজি বের করল নিশু।
‘সবজি পাকোড়া বানাব। আপা,এগুলো কেটে দাও তো!’
বটি নিয়ে কিচেনের এক কোণে বসে পড়ল রিনা। নিশু একটা শসা ধুয়ে বুশরার হাতে দিলো।
‘নে.. খা।’
আলতো করে শসায় কামড় দিলো বুশরা।
‘কী তৈরি করবি?’
‘ভাবছি.. পাকোড়া। আর কী করা যায়,আইডিয়া দে তো!’
‘যা ভালো লাগে তাই কর।’
নিশু থেমে গেল মুহূর্তের জন্য। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা বাতাসে উড়তে থাকা পর্দার দিকে তাকাল। তার মনে পড়ল ধূসরের কথা। জর্দা সেমাই ওর ভীষণ প্রিয়। বিশেষ করে নিশুর হাতেরটা। কিন্তু এখন সে রাগে তার তৈরি কিছুই খেতে চায় না। চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে নিশু আনমনে ভাবল,তার হাতেরটা না খাক তবে সে বুশরাকে শেখাবে। বুশরা আস্তে ধীরে করতে করতে একসময় শিখে যাবে সব। যাতে একদিন বুশরার হাতেও ধূসরের জন্য প্রিয় হয়ে ওঠে এই রান্নাঘর। ওর হাতের রান্নাতেই একদিন ধূসর হাসবে। ভাবনাটা বুকের ভিতর দৃঢ় হলো।
‘আয় আমার সঙ্গে। সংসার করতে হলে মন দিয়ে সব শিখতে হবে। এখন মন দিয়ে দেখ,সব কিছু কাজে লাগবে। আজ আমি করছি,এরপর থেকে তুই করবি।’
নীরবে মাথা নাড়াল বুশরা। তার চোখে ভরপুর একরাশ অনিশ্চয়তা কিন্তু তাতে ঝিলিক দিচ্ছে শেখার আকাঙ্ক্ষা। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে ফ্র্যানে ঢেলে স্টোভে বসাল।
‘ক্ষীর রান্না করব। তোর ভাসুর মশাইয়ের খুব পছন্দ!’
বুশরা মনোযোগ দিলো,সব শিখতে হবে তার।
‘ও.. শোন,দ্যুতির কথায় কান দিবি না। ও একটু এমনই,মুখে রাগ দেখায় কিন্তু মনটা কাঁচের মতো। বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভিতরে ভীষণ নরম। কথা শুনিয়ে আবার নিজেই কষ্ট পায়।’
বুশরার মুখে মৃদু দ্বিধার ছাপ। নিশু বোঝে,মনের দেয়াল একদিনে ভাঙে না।
‘আর শোন,তোর শাশুড়ি মা- তিনি কিন্তু ভীষণ দারুণ মানুষ। নিজের রক্ত বলে বলছি না। তিনি কিন্তু খুব সহজ-সরল,মন পরিষ্কার। তুই এখনও কোনো কথা বলিসনি,তাই দ্যুতি কষ্ট পেয়েছে।’
নীরব রইল বুশরা।
‘একটা কথা ভাব,যদি একদিন তোর ভাই বিয়ে করে,আর তার বউ তোর বাবা-মাকে উপেক্ষা করে,তখন তোর কেমন লাগবে? মা তো মা-ই,সে নিজের হোক বা পরের। তাদের জায়গা কেউ নিতে পারে না।’
মাথা নোয়ায় বুশরা।
‘দেখ বুশরা,সব সন্তানের কাছে আগে তার বাবা-মা এবং পরিবার। আর তাদের স্থান চিরস্থায়ী। যতই বিশেষ মানুষ হোক না কেন সে কখনো মায়ের জায়গা নিতে পারে না। একজন মা কতটা যুদ্ধ করে সংসার সামলায়,সন্তান মানুষ করে,তা কেবল মা নিজেই জানেন। আমরা সবাই বুঝি কিন্তু অনুভব করতে পারি না। তাই বাবা-মাকে সম্মান করা,খোঁজখবর নেওয়া- এটা দায়িত্ব না,এটা ভালোবাসার ভাষা। স্বামীরা সবচেয়ে খুশি হয় যখন দেখে তার বউ তার মায়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে। একটা পুরুষের চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হলো,তার মা আর স্ত্রী একসঙ্গে হাসছে। তুই যদি তোর শাশুড়ি আর ননদকে আপন করে নিতে পারিস,ধরে নিবি সংসারের নব্বই ভাগ জিতে গেছিস। শেষের কথাগুলো শুনতে মজার হলেও কিন্তু একদম সত্যি। বুদ্ধিমতী মেয়েরা জানে,সংসার জেতা মানে সম্পর্ক জেতা। মনে রাখিস,রান্না শুধু পেট ভরানোর কাজ না,এটা ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা। যে ঘরে রান্নাঘর হাসে,সে ঘরে মন খারাপ টেকে না।’
নিশুর দিকে তাকিয়ে রইল বুশরা। তার চোখে প্রথমবারের মতো প্রশান্তির রেখা দেখা গেল। যেন কেউ তাকে নিঃশব্দে বুঝিয়ে দিয়েছে,ঘর বানানোও একরকম সাধনা। নানান রকম কথাবার্তা বলতে বলতে নিশু একে একে ক্ষীর,জর্দা সেমাই,পাকোড়া,চিকেন ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ভেজে নিলো। রান্নাঘরজুড়ে তেলের হালকা গন্ধ,দুধে গলে যাওয়া এলাচের মিষ্টি সুবাস। সবশেষে বানিয়ে ফেলল চা-কফি। সব করতে করতে নিশু হাঁপিয়ে উঠল। কপালে ঘাম জমে উঠেছে। দ্যুতি ইচ্ছে করেই আজ তাকে সাহায্য করতে আসেনি। তবু মন খারাপ করল না। হাফ প্লেট এবং ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে খাবার সাজিয়ে রিনার হাতে পাঠিয়ে দিলো- দাদীমা,ফুপি,ধ্রুব আর ধীরাজের জন্য। তারপর আরও কয়েকটি প্লেট ও বাটিতে সুন্দর করে সাজিয়ে ট্রেতে রাখল। ট্রে বুশরার হাতে তুলে দিয়ে বলল,‘এগুলো তোর স্বামীর জন্য। নিয়ে যা। সুন্দর করে পরিবেশন করবি। রেগে কিছু বললে আপাতত চুপ থাকিস। সময়ই সব বোঝাবে।’
বুশরা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। তার চোখে একটা অনিশ্চয়তার ছায়া,ভয়,সংকোচ আর কিছুটা আশা। ট্রে হাতে নিয়ে ধূসরের রুমে ঢুকল সে। ঘরে এখনও সিগারেটের ধোঁয়া ভাসছে। আধো আলোয় ধূসর যেন একটা নীরব ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে।
‘আপনার নাস্তা নিয়ে এলাম।’
ধূসর কোনো জবাব দিলো না। ওভাবেই তাকিয়ে রইল দূরের দিকে,যেন কিছুই শোনেনি। বুশরার বুকের ভিতর হালকা কম্পন। গত রাতের ঘটনার কথা মনে পড়তেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে না তো! ধূসর সিগারেটের শেষাংশ পায়ের তলায় পিষে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকে কুলি করে মুখ-হাত ধুয়ে এলো। টাওয়াল এগিয়ে দিলো বুশরা কিন্তু ধূসর নিলো না। তার চোখ একবার ঘুরে পড়ল ট্রের দিকে। খাবারের ঘ্রাণেই বুঝতে পারল সবই নিশুর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি। ধূসর চোখ বুজে খাবারের ঘ্রাণ নিয়ে বলে দিতে পারে কোনটা তার মায়ের হাতের,কোনটা নিশু কিংবা দ্যুতির। কোনো প্রশ্ন করল না। নিঃশব্দে তুলে নিলো জর্দা সেমাইয়ের বাটি। সেমাই থেকে অরেঞ্জ ফ্লেভারের হালকা সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। এক চামচ মুখে দিয়েই ঠোঁট শক্ত করে ফেলল। ভড়কায় বুশরা। পরক্ষণেই ব্যালকনিতে গিয়ে বাটি সমেৎ নিচে ছুঁড়তেই কেঁপে উঠল সে। কিছু বলতে নিয়েও থেমে গেল। ভয় যেন গলার কাছে বাঁধা দিচ্ছে। ধূসর ঘুরে দাঁড়াল। চোখে যেন আগুন। মানুষটাকে আজ চিনতেই পারছে না বুশরা।
‘ফেলে দিলেন কেন ওভাবে? ভালো হয়নি বুঝি?’
তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ধূসর।
‘সেমাইটা আমরা দু’জনে মিলে করেছিলাম। নিশু শিখিয়ে দিয়েছিল আজ।’
‘আমি কী পছন্দ করি সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করবে,অন্যকে না। তুমি চাইলে কারো থেকে হেল্প নিতে পারো কিন্তু অনুকরণ নয়। যখন কেউ কাউকে নকল করে,তখন দু’জনেরই স্বকীয়তা হারায়। আমি চাই,তুমি নিজের মতো করো।’
‘কফিটা আমি বানিয়েছি।’
মগ তুলে এক চুমুক পান করল,তারপর রেখে দিলো।
‘ভালো হয়নি?’
‘লাস্ট ওয়ার্নিং! মিথ্যে বলবে না। এটাই শেষ!’
‘সত্যিই আমি বানিয়েছি।’
দ্যুতিকে দিয়ে এসে ফিরতেই সব শুনল নিশু। ধূসরের সেই কণ্ঠে ক্ষোভের তীব্রতা,বুশরার অসহায় কণ্ঠ,সব যেন ছু’রির মতো বিঁধে যাচ্ছিল তার বুকের ভিতর। মুহূর্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। দ্রুত কিচেনে ফিরে এলো। আবারও নাস্তা সাজাতে লাগল,হাত কাঁপছিল,তবু থামল না। নাক টেনে নিজের অশ্রু লুকিয়ে রাখল। যেমন বছরের পর বছর মেয়েরা লুকিয়ে রাখে তাদের না বলা কষ্টগুলো। ঠিক তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামছিল ধূসর। সেদিকে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। অভিমানী দৃষ্টি ফেলে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো নিশু। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল ধূসরের।
‘দুনিয়াতে এত মানুষ ছিল অথচ আমি শুধু তোকেই বেছে নিয়েছিলাম.. আমার সর্বনাশের জন্য।’
বিড়বিড়িয়ে বলে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। বুশরাকে দেখে চমকাল।
‘কী রে,এমন চুপচাপ কেন?খেয়েছে? কিছু বলেছে নাকি?’
বুশরা কিছু বলল না। চোখে জল টলমল করছে।
‘আমি অনেক চেষ্টা করি কিন্তু উনি কিছুতেই খুশি হন না। কেন এমন করছে!’
‘সব পুরুষের খুশি হবার পদ্ধতি এক না,বুশরা। কেউ কথায় খুশি হয়,কেউ কাজে,কেউ আবার নীরবতায়। কিন্তু একটা জিনিস সব জায়গায় চলে- শ্রদ্ধা আর ধৈর্য। তবে সব পুরুষই এমন হয়,প্রথমে একটু সময় নেয় তুই ভয় পাস না। ওর ভিতরেও রাগের নিচে আসলে মায়াই লুকিয়ে আছে।’
অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।
‘একটা সংসার গড়ে উঠতে ভালোবাসার থেকেও বেশি দরকার সহ্যশক্তি। পুরুষ মানে শক্ত কিন্তু তাদের ভিতরও ভাঙন আছে- শুধু প্রকাশ করে না। তাদের রাগে,নীরবতায়,অবহেলায় অনেক সময় ভয় লুকিয়ে থাকে। তুই যদি রাগের উত্তরে রাগ না দিস বরং শান্ত থাকিস,একদিন দেখবি সেই মানুষটাই তোর দিকে ফিরে তাকাবে। আর একটা কথা মনে রাখ,বউ হওয়া মানেই কেবল রান্না শেখা না। সংসার মানে একটা যুদ্ধক্ষেত্রও- যেখানে তুই প্রতিদিন লড়বি সম্মান আর ভালোবাসা ধরে রাখার জন্য। কখনও কথায় হারিস না,আবার অহংকারেও জিতিস না। বুদ্ধিমতি মেয়েরা জানে,কখন কথা বলতে হয়,আর কখন নীরব থাকলেই ভালোবাসা বাঁচে। তুই ভয় পাবি না। আজ রেগে গিয়েছে মানে এই না,সে তোকে ঘৃণা করে। ও এখনও মানসিকভাবে গুলিয়ে আছে। একটু সময় দে। দেখবি,একদিন তোর হাতের চা নিজে থেকেই চাইবে।’
বুশরার চোখ ভিজে উঠল আবারও। গলাটা ভারি হয়ে গেল-
‘আমার কোনো বড় বোন নেই,নিশু। তুই না থাকলে আমি কী করতাম!’
মৃদু হাসল নিশু।
‘আমরা মেয়েরা একে অপরের শক্তি,এই কথাটা যেন ভুলিস না কখনও। যখন পুরুষের ভালোবাসা কষ্ট দেয়,তখন আরেক নারীর মমতাই তো বাঁচায়। এখন চল,ফুপিদের দিয়ে আসি।’
ইতস্তত করল বুশরা।
‘আমার ভয় লাগে।’
‘কীসের ভয়?’
‘যদি কিছু বলে!’
‘বাপু,সংসারে ভয় পেলে বাঁচা যায় না। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি রাগ করবেন,বকবেন,আবার আদর করে কাছে টানবেন- এটাই স্বাভাবিক। যে বউ রাগ সহ্য করতে শেখে,সে-ই সংসার টিকিয়ে রাখে। এই সমাজে নারীর সহ্যশক্তিই তার একমাত্র ঢাল। কেউ নিরুপায় হয়ে,কেউ বুদ্ধি করে,কেউ ভালোবেসে সংসার চালায়। আমরা বাঙালি নারী- ভাতের সাথে অশ্রু গিলতেও শিখতে হয়,আর সেই অশ্রুতেই সংসারের শিকড় ভিজে থাকে।’
‘সব কথা শুনে চুপ থাকা কঠিন।’
‘চুপ থাকাটাই মাঝে মাঝে সবচেয়ে বড় উত্তর,প্রতিশোধ। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিবি। দেখবি,সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সহজ হয়ে যাবে।’
মাথা নাড়াল বুশরা। নিশুর চোখে মায়া,গলায় দৃঢ়তা। যেন এই নারীর ভিতরেই সংসারের পাঠ্যবই।
‘যেখানে আঠারো বছর হওয়ার আগেই মেয়েরা পরিবারের বোঝা হয়ে যায় সেখানে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সুখ খোঁজা বিলাসিতা,বুশরা। শুকরিয়া কর আমরা অনেক ভালো আছি,সম্মানের সহিত আল্লাহ আমাদেরকে হাজার গুণ ভালো রেখেছেন। এরচেয়ে বেশি আর কী চাই! কতশত মেয়েকে তাদের শ্বশুরবাড়িতে অপমান সহ্য করতে হয়। কেউ মার খায়,কেউ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। তোকে কেউ ওভাবে কিছু করছে না। হয়ত আমার ফুপা রাগে কিছু বলেছেন- এটা স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখ। বাবা-মা,শ্বশুর-শ্বাশুড়িরা এমন এক-আধটু বলেই। এটা খুঁত ধরে বসে থাকলে সংসার করা যাবে না। বাবা-মা রাগ করলে কিংবা বকাবকি করলে আমরা কি দূরে সরে যাই? কথা বলা বন্ধ করে দিই নাকি! সংসার করতে হলে সব শুনতে হয়।
আমরা বাঙালি নারী- কষ্ট গিলে রেখেও হাসতে জানতে হবে। এটা মেনে নিতে পারলে তবেই সংসার টিকে। বাবা-মা কখনো তার সন্তানের খারাপ চান না। তারা আমাদের ভালোর জন্যই বলেন হয়ত শুনতে কষ্ট হয় আরকি। শোন,সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো,জীবনের পথে নিন্দুক থাকা ভালো। কারণ যারা আমাদের সমালোচনা করে,আমাদের ভুল ধরিয়ে দেয়,তারা শুধু বিরক্তিকর নয়; বরং আমাদের উন্নতির এক অদৃশ্য পথপ্রদর্শক। নিন্দুক বা সমালোচক না থাকলে আমরা নিজেদের ভুল ও দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারব না এবং সেখান থেকে শিখে উন্নতি করার সুযোগও হারিয়ে যাবে। তারা আমাদের চরম হতাশার মুহূর্তেও আয়নায় দাঁড়িয়ে আমাদের বাস্তব মুখ দেখিয়ে দেয়। তাই তাদের কথা মনে কটু হলেও অন্তরে রাখবি,কারণ জীবনকে সত্যিকারের শক্তিশালী এবং সচেতনভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের ভূমিকা অপরিসীম।
তাই বাবা-মা,শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা আশেপাশের মানুষ যা-ই বলুক না কেন,ওসব কথা কখনও মন থেকে নিতে নেই। নেগেটিভভাবে না ভেবে পজিটিভভাবে নেওয়ার চেষ্টা কর। ভুল যদি হয়ে থাকে,তাহলে সেটা শুধরে নেওয়া- এটাই বড় মানুষের লক্ষণ। তারা তো শত্রু নয় বরং শুভাকাঙ্ক্ষী। যাদের কথায় তুই কষ্ট পাচ্ছিস,সেই কথাগুলোর মাঝেই হয়ত তোর নিজের উন্নতির রাস্তা লুকিয়ে আছে। অশিক্ষিত বন্ধুর চেয়ে শিক্ষিত শত্রু হাজার গুণ উত্তম। কারণ শত্রুই আমাদের ভুল চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়,প্রিয়জনের মতো চুপ করে থাকতে শেখায় না। সংসার খুব নাজুক জিনিস,বুশরা। এখানে সব কথার উত্তর দিতে নেই,সব ক্ষোভ প্রকাশ করাও ঠিক না। মাঝে মাঝে বয়রা,বোবা,কানা আর অন্ধ হয়ে থাকতে হয়- এই নীরবতাই সংসারের শান্তি ধরে রাখে। সময়ের নিজের একটা ভাষা আছে,ও নিজেই একদিন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। তুই শুধু ধৈর্য ধরবি,মন পরিষ্কার ও সৎ থাকবি। আল্লাহ সব দেখেন,যে মানুষ সত্যের পথে থাকে,শেষ পর্যন্ত জয় তারই হয়।’
বুশরার চোখে জল টলমল করছে। ঠোঁট কাঁপছে,তবু সে কিছু বলছে না। নিশু তার চুলগুলো কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল,‘চল,এখন ফুপিদের কাছে যাই। ওরা খুশি হলে ঘরের বাতাসটাও বদলে যায়।’
বুশরা নিঃশব্দে মাথা নাড়ল। দু’জনেই ট্রে হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল তাঁদের রুমের দিকে। দরজার সামনে পৌঁছাতেই ভেতর থেকে কাশির শব্দ শুনতে পেল। নক করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দিলরুবা খাতুন বিছানায় বসে তসবিহ পাঠ করছেন,পাশে আসাদ সাহেব। তাদের দেখে মুহূর্তেই বাতাস ভারি হয়ে গেল। বুশরাকে দেখে কপালে ভাঁজ ফেললেন আসাদ সাহেব,চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। পরিস্থিতি বুঝে হাসিমুখে এগিয়ে গেল নিশু। আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,‘তোমাদের সঙ্গে বিকেলের নাস্তা করতে চলে এলাম,ফুপি।’
দিলরুবা খাতুনের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল।
‘আয়।’
নিশু ট্রে-টা বিছানায় রাখল,আর বুশরা একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার ঠোঁট ঠোঁটের সঙ্গে চেপে আছে। যেন একটা শব্দ বেরোলে ভিতরকার ভয়টা ফাঁস হয়ে যাবে।
‘আব্বুর জন্য সবজি পাকোড়া।’
প্লেট এগিয়ে দিলো নিশু। দিলরুবা খাতুনের হাতে ক্ষীরের বাটি তুলে দিলো।
‘খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে!’
এক চামচ মুখে তুলে মাথা নাড়ালেন।
‘মিষ্টিটা ঠিক আছে। একদম পরিমিত।
‘আমরা দু’জনে করেছি।’
‘ওহ।’
‘কেমন হয়েছে,ফুপি?’
‘খুব ভালো।’
‘বুঝচ্ছ,ফুপি.. আমি তোমার মেজ ছেলের বউকে বলেছি,মন দিয়ে সব শিখ। সংসার সামলাতে গেলে সব জানা দরকার।’
‘ভালো।’
‘হুম,ফুপি। আমাদের ঘরে নতুন রোদের মতো তোমার মেজ ছেলের বউ এসেছে।’
মৃদু হাসলেন তিনি।
‘তুই না থাকলে কে জানে,এই সংসারটা কতটা জটিল হয়ে যেত।’
‘আমি তো আছি,ফুপি। সবাইকে একসাথে রাখা আমারও তো দায়িত্ব। এখন তোমার আরেকটা বউমা সরি.. মেয়ে হয়েছে,আমি চাই তুমি তাকে আপন করে বুকে টেনে নাও।’
বুশরাকে ইশারা দিলো নিশু। ভীত হয়ে এগিয়ে এলো সে। ওর হাত দিলরুবা খাতুনের হাতের উপর দিয়ে বলল,‘আজ থেকে ও তোমার আরেকটা মেয়ে,ফুপি।’
বুশরাকে ইশারা দিলো নিশু। সে মাথা নিচু করে বলল,‘আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি,আমাকে ক্ষমা করে দিন,আন্টি। আমি সত্যিই আপনাদের মন পেতে চাই।’
‘আন্টি নয় আম্মু বলবি।’
মায়াকুমারী পর্ব ৬৬+৬৭
মাথা নাড়ায় বুশরা। দিলরুবা খাতুনের চোখজোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল।
‘তোমার কোনো ভুল নেই।’
‘আমাদেরকে অনেক ভালোবাসো,ফুপি।’
নিশু দু’জনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরল। দিলরুবা খাতুনও তাদের জড়িয়ে ধরলেন। বুশরা অতি আবেগে কাঁদছে। মুহূর্তটা নিস্তব্ধ কিন্তু তাতে ছিল একটা অদ্ভুত মমতার উষ্ণতা। যেন দীর্ঘ সময়ের জমে থাকা ভুল বোঝাবুঝি মিশে যাচ্ছে নিঃশব্দ ক্ষমার ভিতর। নিশুর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো অতি আনন্দে। টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। তার মুখে মৃদু স্বস্তির হাসি। তার মনে হলো,এই ঘরটা আবার একটু আলোয় ভরে উঠল।
