mad for you part 6
তানিয়া খাতুন
কলেজের গেটটা পেরিয়ে রুহি আর সিমৱান ঢোকে ভয়ে ভয়ে।
দু’জনের মুখে অদ্ভুত এক চিন্তার ছায়া—যেন প্রতিটা পায়ে পায়ে আশঙ্কা, “এই বুঝি ক্ৰিশ সামনে এসে পড়বে।”
ক্যাম্পাসে হালকা বাতাস বইছে, সবাই নিজের মতো ছুটছে ক্লাসে, কিন্তু রুহির বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠছে।
ক্ৰিশ আৱ তাৱ বন্ধুদেৱ না দেখতে পেয়ে রুহি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
রুহি ফিসফিস করে বলে, “তাড়াতাড়ি ক্লাসে চল।”
সিমৱান ছোট্ট হেসে বলে, “হুম, সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোকে কী বলেছিলাম মনে আছে তো?”
রুহি হাসে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে রে, ছেলে দেৱ সাথে বেশি কথা বলবো, এটাই আমি পাৱি না।”
দু’জন শান্তভাবে ক্লাসে বসে, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু রুহির মনে ক্ৰিশেৱ চোখের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঘুরে ফিরে আসে।
ক্লাস শেষে দু’জন যায় ক্যান্টিনে। দুপুরের ঠান্ডা বাতাসে কফির গন্ধ, চারপাশে হাসাহাসি, গল্পগুজব—সব কিছুই স্বাভাবিক।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দু’জন এক কোণে চেয়ারে বসতেই দূৱ থেকে একজনেৱ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ে ৱুহিৱ ওপৱ।
ঠিক তখনই এক অচেনা ছেলে এসে সামনে বসে।
চোখে বন্ধুত্বের ঝিলিক, মুখে মিষ্টি হাসি।
ছেলেটা বলে: “হাই, আমি সোহম।”
রুহি একটু অবাক হয়ে: “সরি, আমি কি আপনাকে চিনি?”
সোহম হাঁসে: “আরে, আমি তো তোমাদেরই ক্লাসে পড়ি। তুমি কৱে বলো ‘আপনি’ বলছো কেন?”
সিমৱান পাশ থেকে কনুই মেরে বলে,
হাদারাম, সামনে ক্ৰিশ বসে আছে, তোর দিকেই তাকিয়ে আছে, তুই ওই ছেলেটার সঙ্গে ভালো করে কথা বল, যেন ক্ৰিশ রাগে তোৱ সাথে ব্ৰেকআপ কৱে নেয়!”
রুহি সঙ্গে সঙ্গে একটু হাঁসাৱ ভান কৱে।
ৱুহিঃ “ও হ্যালো, তুমি আমাদের ক্লাসে, সরি বুঝতে পারিনি! নাইস টু মিট ইউ।”
বলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
সোহমও হেসে হাত বাড়ায়। ঠিক তখনই—
ঝনঝন!!
একটা ভাঙা কাচের আওয়াজে পুরো ক্যান্টিন স্তব্ধ হয়ে যায়।
সবাই চমকে ওঠে।
রুহি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে, সিমৱানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে চোখ খুলে রুহি দেখে—সোহম মাটিতে পড়ে আছে, তার হাত কাটা, রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে।
চোখ ফেরাতেই রুহি দেখে, ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্ৰিশ।
হাতে কাচের ভাঙা বোতল, চোখ দুটো রক্তচোখের মতো লাল। তার নিজের হাত থেকেও রক্ত পড়ছে।
চারপাশে চিৎকার, ছাত্রছাত্রীরা ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
রুহির শরীর অবশ হয়ে আসে, চেয়াৱ থেকে মাটিতে পৱে যায় চেতনা হারায়।
আমান দৌড়ে এসে বলে: “ভাই, তুই কী করলি এটা?”
ক্ৰিশ দাঁত চেপে বলে: “ওকে হাসপাতালে ভর্তি কর, কিন্তু যাওয়ার আগে ওর হাতটা পুরো কেটে দিবি!”
তার কণ্ঠে যেনো ক্যান্টিন কেঁপে ওঠলো।
“রহিম, রুদ্র—তোরাও যা।”
ওরা সোহমকে তুলে নিয়ে যায়।
ক্ৰিশ ঘুরে তাকায় সিমৱানের দিকে।
ক্ৰিশ (ঠান্ডা গলায়): “ওকে আমি ঠিক সময়ে হোস্টেলে দিয়ে আসব। এখন তুমি যাও।”
সিমৱান ভয়ে একবার রুহির দিকে তাকায়, চোখে জল, তারপর মাথা নেড়ে চুপচাপ চলে যায়।
ক্যান্টিনে তখন শুধু টেবিলের ওপর পড়ে থাকা কাচের টুকরো, মেঝেতে ছড়ানো রক্ত, আর ক্ৰিশের নিঃশব্দ দাঁড়ানো শরীর—
যেন নীরবতা নিজেই চিৎকার করছে।
রুহি ধীরে ধীরে চোখ খুলল।
চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা, আলোটা নরম হলদে রঙের মতো।
মাথা কেমন ঘুরছে, বুকের ভিতর ভারী একটা চাপ—সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
মিনিট দু’য়েক পর চোখ একটু পরিষ্কার হতেই অবাক হয়ে চারদিকে তাকায়।
সে যে কোনো সাধারণ জায়গায় নেই, সেটা প্রথম দৃষ্টিতেই বোঝা যায়।
বড়, বিশাল একটা ঘর—মেঝেতে নরম কার্পেট, যেখানে পা রাখলেই যেন শরীর ডুবে যায়।
ঘরের মাঝখানে একটা সাদা নরম গদি দেওয়া বিছানা, সিল্কের চাদরে ঢাকা, পাশে ছোট ছোট বালিশ, যেন রাজকন্যার ঘুমের ঘর।
ডানদিকে একটা বড় জানালা, সাদা পর্দা বাতাসে দুলছে, বিকেলেৱ রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে—সোনালি ছায়ার মতো।
জানালার পাশে একটা বিশাল সোফা, হালকা ধূসর রঙের, তার গায়ে নরম কুশনগুলো এমনভাবে সাজানো যেন কেউ সদ্য বসে উঠে গেছে।
কোণের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে যায়—দুটি বড় ফুলদানিতে সাজানো লাল, সাদা আর বেগুনি গোলাপ।
তাজা ফুলের গন্ধে ঘর ভরে আছে, হালকা পারফিউমের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত শান্ত গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।
রুহি ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু মাথা ব্যথায় ভারী লাগে।
চারদিকের এই অচেনা সৌন্দর্য তাকে ভয় আর বিস্ময়ে একসাথে ভরিয়ে তোলে।
তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—
“আমি কোথায়?”
“আমাকে এখানে কে এনেছে?”
চুপচাপ ঘরের ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়, পর্দা দুলে ওঠে, ফুলের পাপড়িগুলো সামান্য নড়ে ওঠে,
আর দরজার বাইরে যেন কারও ভারী পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে…
ঘরের ভেতর তখন নিঃশব্দ।
রুহি বিছানায় একা বসে আছে, তার বুক ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে—মাথায় তখনও ঝিম ধরা ব্যথা।
ঠিক তখনই—
“ঠাস!”
দরজাটা ধীরে খুলে যায়।
সেই শব্দে রুহি চমকে ওঠে।
তার চোখ বড় হয়ে যায়, নিঃশ্বাস যেন থেমে যায় বুকের ভেতর।
দরজার ফাঁক দিয়ে আলো পড়ছে মেঝেতে।
সেই আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ক্ৰিশ।
চোখে অদ্ভুত শান্ত কিন্তু ভয়ংকর দৃষ্টি, ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি, আর তার ডান হাতে—
একটা চকচকে ধারালো ছুরি।
রুহির গলা শুকিয়ে যায়, ঠোঁট নড়ে কিন্তু শব্দ বেরোয় না।
ঘরটা যেন হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেছে, বাতাস ভারী।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে ঘরে পা রাখে—
তার প্রতিটা পদক্ষেপের শব্দ নরম কার্পেটের ওপর ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু রুহির কানে সেটা বজ্রপাতের মতো বাজছে।
তার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও রুহির মুখ থেকে সরে না।
বিছানার কাছে এসে থেমে যায়।
ছুরিটা হাতে ঘুরিয়ে ধরে ক্ৰিশ হালকা গলায় বলে—
“বাটারফ্লাই…”
রুহি কেঁপে ওঠে।
ক্ৰিশঃ “তোর হাত মেলানো টা ভালো না,” বলে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে,
“আজ আমি তোকে শেখাবো… হাত মেলতে হয় কীভাবে।”
ছুরির ধাতব ঝিলিকটা রোদে পড়ে রুহির মুখে প্রতিফলিত হয়।
রুহি ভয়ে পেছোতে থাকে, বালিশে ঠেস দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে যায়।
তার নিঃশ্বাস ভারী, বুক কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে।
ক্ৰিশ আরও এক পা এগিয়ে আসে, একদম সামনে এসে দাঁড়ায়—
দুজনের মাঝে শুধু সেই ছুরির ধারালো ঝিলিক আর জমে থাকা নীরবতা।
বাইরে হঠাৎ এক ঝাপটা হাওয়া আসে, পর্দা উড়ে গিয়ে ঘরের আলো নিভে যায়।
রুহির মুখে পড়ে কেবল ক্ৰিশেৱ ছায়া—
একটা ভয়, একটা পাগলামি, আর একটা অব্যক্ত ভালোবাসার মিশ্র প্রতিচ্ছবি।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে ঝুঁকে আসে — তার চোখে ক্রোধ, অপরাধবোধ আর ভালোবাসা মিলেমিশে এক অদ্ভুত ছায়া।
হঠাৎ সে রুহির পা ধরে টানে,
রুহি ভয় পেয়ে পেছন হটে, কিন্তু ততক্ষণে ক্ৰিশ তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে।
বিছানায় বসে পড়ে, রুহির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।
— “বাটারফ্লাই, কোন হাত দিয়ে তুই হ্যান্ডশেক করতে যাচ্ছিলি?”
তার কণ্ঠে একটা দমিত ক্রোধ, একটা পুড়ে যাওয়া অভিমান।
রুহি ভয় পেয়ে হাত সৱিয়ে নিতে যায়, চোখে জল টলমল করে।
— “ক্ৰিশ… প্লিজ… ছেৱে দিন… আমাৱ ভুল হয়ে গেছে , আমি আপনাৱ সব কথা শুনবো।
আমি আর কাউকে ছুঁবো না, কারও হাত ধরব না… প্লিজ, কিছু করবেন না, প্লিজ ছেৱে দিন।”
তার গলা কেঁপে ওঠে, অশ্রু ঝরে গাল বেয়ে।
ক্ৰিশ এক মুহূর্ত স্থির থাকে, তারপর তীক্ষ্ণভাবে বলে,
— “সরি, বাটারফ্লাই। ভুল যখন করেছিস, শাস্তিটাও পেতেই হবে… তাই না?”
রুহি মাথা নাড়ে, কাঁদতে থাকে,
— “না, ক্ৰিশ , প্লিজ কিছু করবেন না…”
কিন্তু ক্ৰিশেৱ চোখে তখন আগুন। তার হাতে চকচক করছে একটা ধারালো ছুরি।
সে ধীরে ধীরে রুহির ডান হাতটা তুলে নেয়, তারপর ছুরিটা রাখে তার হাতের তালুতে।
রুহি তড়িঘড়ি করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে,
কিন্তু ক্ৰিশ দু’হাতে তার কব্জি চেপে ধরে রাখে।
হঠাৎ—
ছুরির ফলা নরম চামড়া ভেদ করে ঢুকে যায়,
রুহির মুখ থেকে ভেসে আসে এক দীর্ঘ, যন্ত্রণাময় চিৎকার—
“আআআআ… ক্ৰিশ… না…!”
রক্ত গড়িয়ে পড়ে, সাদা বিছানার চাদর লাল হয়ে ওঠে।
ক্ৰিশের হাতও কেটে যায় সেই ছুরির ধারেই, রক্ত দু’জনের হাত মিশে একাকার হয়ে যায়।
রুহির চোখ আধবোজা, নিঃশ্বাস কাঁপছে।
আর ক্ৰিশ— চোখে আগুন, মুখে অদ্ভুত এক নীরবতা।
সে হঠাৎ রুহিকে নিজের দিকে টেনে নেয়, রুহির পিঠ ধাক্কা খেয়ে তার বুকের সঙ্গে লেগে যায়।
দু’জনের বুকের মাঝের ফাঁকটা মুছে যায় এক মুহূর্তে।
রুহির নিঃশ্বাস গলায় আটকে আসে,
— “ক্ৰিশ… ছাড়ুন আমায়…”
তার গলা কেঁপে ওঠে, চোখে জল।
ক্ৰিশ কিছু বলে না।
সে শুধু রুহির মুখটা দুই হাতে ধরে, আঙুলে রক্তের দাগ, তবুও সেই আঙুলের স্পর্শে একটা কাঁপুনি বয়ে যায় রুহির গা বেয়ে।
তাদের চোখ দুটো মিশে যায় —
একটায় ভয়, অন্যটায় পাগলামি।
তারপর কোনো সতর্কতা ছাড়াই ক্ৰিশ নিজের ঠোঁট চেপে ধরে রুহির ঠোঁটে।
প্রথমে রুহি দম বন্ধ করে রাখে, ঠোঁট শক্ত করে চেপে রাখে, চেষ্টা করে তাকে ঠেলতে।
কিন্তু ক্ৰিশের হাতগুলো তার গাল থেকে ঘাড় বেয়ে নেমে যায় পিঠের দিকে,
একটা হাত তার কোমরে, আরেকটা মাথার পেছনে,
আর সে ঠোঁটের গভীরে ডুবে যায় —
রাগে, অনুশোচনায়, ভালোবাসায়, সব মিলিয়ে এক উন্মত্ত চুম্বনে।
রুহি প্রথমে প্রতিরোধ করে, তারপর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে।
তার কাঁপুনি কমে আসে, চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
রক্ত, অশ্রু আর নিঃশ্বাস মিশে গিয়ে এক অদ্ভুত নীরবতা তৈরি করে।
রুহির চোখে তখন ভয় আর চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল।
কিছুক্ষণ পৱে ক্ৰিশ ছেড়ে দিলে দুজন দুজনেৱ দিকে তাকায়—ক্ৰিশেৱ চোখে রাগ, কষ্ট, অনুশোচনা সব একসাথে মিশে গেছে।
বিছানায় রক্তের দাগ, বাতাস ভারী হয়ে গেছে।
ক্ৰিশ নিচু গলায় বলে,
— “আমি ভুল করেছি বাটাৱফ্লাই… আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি… এখন আমি নিজেকে শাস্তি দেবো।”
রুহি বুঝে ওঠার আগেই ক্ৰিশ নিজের হাতে থাকা ছুরিটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
সে নিজের হাতের তালুতে একেৱ পৱ এক ছুরিৱ প্যাঁচ চালিয়ে দেয় — একটানে রক্ত বেরিয়ে আসে।
রুহি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে,
— “ক্ৰিশ! এটা কী করছেন? থামুন প্লিজ!”
ক্ৰিশের চোখে তখন পাগলামি, সে এ্কটু দূৱে গিয়ে আবার ছুরি তুলতে যায়,
— “আমি বাঁচার যোগ্য না, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি বাটাৱফ্লাই…”
রুহি তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে তার হাত ধরে ফেলে,
দু’হাতে চেপে ধরে ক্ৰিশের কব্জি।
— “না, ক্ৰিশ! থামুন! এসব ঠিক না!”
ক্ৰিশ হাত ছাড়াতে চায়, কিন্তু রুহি শক্ত করে ধরে রেখেছে।
ছুরিটা তাদের মধ্যে পড়ে যায়, মেঝেতে ঠক করে শব্দ হয়।
ক্ৰিশ হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ে, দু’হাত রক্তে ভেজা,
চোখ দিয়ে জল ঝরছে।
সে মাথা নিচু করে বলে,
— “আমি তোমাকে আঘাত দিয়েছি, আমি নিজেকেও মেরে ফেলব।”
রুহি কাঁদতে কাঁদতে তার পাশে বসে পড়ে,
তার হাত নিজের ওৱনায় জড়িয়ে ধরে, রক্ত বন্ধ করতে থাকে।
— “চুপ করুন… আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি… শুধু এমন করবেন না প্লিজ…”
ক্ৰিশ মাথা নিচু করে বসে ছিল, তারপর ধীরে ধীরে মাথাটা তুলল।
তার চোখে জল জমে আছে, ঠোঁট কাঁপছে।
সে রুহির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে—
“বাটাৱফ্লাই…”
তার কণ্ঠ ভাঙা, কাঁপা নিঃশ্বাসে শব্দগুলো বেরোচ্ছে কষ্ট করে,
— “প্লিজ … আমায় ছেড়ে যেও না কখনও… আমি খুব একা…”
রুহি স্তব্ধ হয়ে যায়।
তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে রুহিকে জড়িয়ে ধরে—
রুহি বাধা দেয় না, শুধু চুপ করে মাথা রাখে ক্ৰিশেৱ কাঁধে।
ক্ৰিশ তার চুলে হাত রাখে,
— “তুই জানিস, আমি পাপী… আমি খারাপ মানুষ… কিন্তু তুই তো একদম পবিত্র।
তুই আমার পবিত্র ফুল… তোকে পেলে আমি সত্যিই ভালো হয়ে যাবো…
আমি প্রমিস করছি… আমি বদলে যাবো, শুধু তুই আমায় ছেড়ে যাস না…”
রুহির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
দু’জনেই নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে,
কিন্তু সেই কান্নার মধ্যে একটা শান্তি আছে —
যেন অনেক ঝড়ের পর অবশেষে একটু শান্ত হাওয়া বইছে।
রুহি দরজাটা ধীরে খুলে হোস্টেলের রুমে ঢুকতেই সিমৱান দৌড়ে আসে।
চোখে চিন্তার ছাপ, গলায় কাঁপুনি —
“রুহি! আহা, কী করছিস তুই? এই হাতটায় ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে? ওই ক্ৰিশ কিছু করেছে তাই না?”
রুহি থেমে যায়, কিছু না বলে ধীরে ধীরে বিছানার দিকে যায়।
বসে পড়ে, চোখ নিচু। ঘরটা নিস্তব্ধ, শুধু জানলার বাইরে হালকা বাতাসে পর্দা দুলছে।
সিমৱান আবার বলে,
“বল না রে, কী হয়েছে? তোর মুখের চেহারাটাও কেমন ফ্যাকাশে!”
রুহি ধীরে ধীরে বলে,
“সিমৱান… ওনি সাধাৱন মানুষ না রে, ওনি একদম আলাদা।
ওনি সাধারণ কেউ না… ওনি একজন সাইকো।”
সিমৱানের চোখ বড় হয়ে যায়,
“সাইকো মানে? তুই sure?”
রুহি চুপ করে থাকে কয়েক সেকেন্ড, তারপর নিচু গলায় বলে,
“হ্যাঁ সিমৱান, আমি আগে জানতাম না।
কিন্তু এখন বুঝছি আমি শুনেছি ওদের দুনিয়া আলাদা, খুব ভয়ঙ্কর।
আমি এমন কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়ব ভাবতেই পারিনি।”
সিমৱান অবাক হয়ে বসে পড়ে রুহির পাশে,
“তাহলে এখন কী করবি তুই? ওকে ছাড়বি?”
রুহির চোখে জল এসে যায়,
“ছাড়তে পারব না, ওনি আমাকে ছাড়বেন না।
ওনি খুব জেদি মানুষ… আমি যদি দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমাকে এইভাবে তিলে তিলে মাৱবে।
সিমৱানঃ “তাহলে কী ভাবছিস তুই? পালাবি?”
রুহি মাথা নাড়ে, ধীরে ধীরে বলে,
“আমি একটা নাটক করব।”
সিমৱান একটু অবাক হয়ে বলে,
“নাটক? কিসের নাটক?”
রুহি জানলার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“ভালোবাসার নাটক।
আমি ওকে বুঝতে দেব না যে আমি দূরে যেতে চাইছি।
আমি এমন সাজব যেন ওর জন্যই বেঁচে আছি, যেন আমি ওর ভালোবাসায় পাগল।
আর এক মাস পর তো কলেজে ছুটি পড়বে, তখন আমি বাড়ি চলে যাবো।
যদি ওই এক মাস আমাকে না খুঁজে পায়,
তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে আমাকে ভুলে যাবে…”
সিমৱান হালকা হাসে,
“বাহ রে, এটা তো একদম সিনেমার মতো প্ল্যান!
তোর মাথাটা বেশ কাজ করে। এই এক মাস নাটক কর, তারপর উধাও হয়ে যা।”
রুহি হালকা মাথা নাড়ে, তার চোখে জল টলমল করে।
নরম কণ্ঠে বলে,
“হ্যাঁ রে, কিন্তু ভয় করছে…
আমি জানি না ওনি যদি জানতে পারে তাহলে কী করবে।
তবুও আমার হাতে আর কোনো রাস্তা নেই।
আল্লাহ, তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।”
সিমৱান এগিয়ে এসে রুহির কাঁধে হাত রাখে,
— “ভয় পাস না, আমি আছি তো তোর পাশে।”
রুহি তাকায় জানলার দিকে,
বাইরে রাতের অন্ধকার, হালকা চাঁদের আলো রুমের ভেতর ঢুকছে।
দু’জনেই কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে —
একজন ভয় নিয়ে, আরেকজন বন্ধুত্ব নিয়ে।
চাঁদের আলো এসে পড়ে রুহির মুখে,
তার চোখে অশ্রু ঝলমল করছে, ঠোঁট নরম কাঁপছে,
আর সে নিজের মনে শুধু একটাই কথা ভাবে—
“এক মাস… শুধু এক মাস টিকে থাকতে হবে… তারপর সব শেষ…”
পরদিন সকালটা ছিল শান্ত, হোস্টেলের উঠোনে নরম রোদ পড়ছে।
পাখিরা ডাকছে, মেয়েরা কেউ ক্লাসে যাচ্ছে, কেউ চা খাচ্ছে।
রুহি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।
চোখের নিচে ক্লান্তির ছাপ, তবুও আজ সে মুখে হাঁসি লাগিয়েছে।
সিমৱান পাশ থেকে বলে,
“রুহি, তুই নিশ্চিত তো? আজ থেকেই নাটক শুরু করবি?”
রুহি আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“হ্যাঁ রে, আজ থেকেই শুরু।
আজ থেকে আমি সেই রুহি,
যে নাকি ক্ৰিশ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না।”
সিমৱান মৃদু মাথা নাড়ে,
“তবে সাবধানে করিস, ক্ৰিশ ততটা সহজ মানুষ না।”
রুহি চুপচাপ ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয়,
“আমি জানি রে… তবুও চেষ্টা করতে হবে।
তুই তো যাবি না ভালো কৱে থাকিস।
কলেজের গেটে পৌঁছাতেই চারপাশে ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল।
রুহি ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে,
আর হঠাৎ দূরে দেখতে পায় — ক্ৰিশ দাঁড়িয়ে আছে গাছের পাশে।
কালো শার্ট, সানগ্লাস, ঠোঁটে হালকা হাসি।
ওর দৃষ্টি সরাসরি রুহির দিকে।
রুহির বুক কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে নিজেকে সামলায়।
মুখে মিষ্টি হাসি এনে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ওর দিকে।
“গুড মর্নিং, ক্ৰিশ…”
ক্ৰিশ একটু অবাক হয়।
গতকাল পর্যন্ত যে রুহি ওর দিকে তাকাতো না,
আজ সে এমন হেসে কথা বলছে?
ক্ৰিশ ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলে,
“আজ মেজাজ ভালো মনে হচ্ছে , বাটারফ্লাই।”
রুহি চোখ নামিয়ে হাসে,
“ভালো আছি, আপনি যত্ন করেন বলে।”
ক্ৰিশ একটু চেয়ে থাকে, ওর চোখে কিছু অচেনা ঝিলিক।
ভেতরে ভেতরে ওর হাত ঘামছে, বুক ধড়ফড় করছে,
কিন্তু মুখে সেই শান্ত মিষ্টি হাসি।
ক্ৰিশ এগিয়ে এসে ওর গালে হালকা স্পর্শ করে বলে,
mad for you part 5
“এই হাসিটা রাখিস সবসময়, বাটারফ্লাই।”
কিন্তু ভুল কৱেও আমাৱ থেকে দূৱে যাওয়াৱ চেষ্টা কৱলে তোকে জ্যান্ত কবৱ দিতেও আমাৱ হাত কাঁপবে না।
রুহির শরীর কেঁপে ওঠে,
কিন্তু সে কিছু বলে না।
দিনটা কেটে যায় ক্লাস, হাসি, কথায়।
ক্ৰিশ বারবার ৱুহিৱ দিকে তাকায়, রুহিও জোর করে হাঁসে।
আর প্রতিটা মুহূর্তে ওর ভেতরে একটাই ভাবনা ঘুরে বেড়ায়—
“এক মাস… শুধু এক মাস, তারপর আমি মুক্ত…”
