আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৬

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৬
অরাত্রিকা রহমান

ঢাকা থেকে অনেক দূরে, ফাঁকা হাইওয়ের পাশে নিঃশব্দ রাত।
রাস্তাটার গাঢ় অন্ধকারে শুধু একটি বিধ্বস্ত গাড়ির ধোঁয়া উঠছে ধীরে ধীরে। ধোঁয়ার ভেতর হেডলাইটের শেষ আলোটা নিভে যাওয়ার আগে যেন আকাশে একটুখানি ঝলক পাঠিয়ে দিল। গাড়ির দরজা আধখোলা, ভেতরে স্টিয়ারিং-এর উপর মাথা হেলানো রায়ান। তার মুখ নিস্তব্ধ, চোখ বন্ধ, কপালের ডান পাশে সামান্য কাটা — সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে তাজা রক্ত। তবু বুকের ওঠানামা খুব হালকা, একেবারে ধীর গতি, তবু সেটুকু নড়াচড়াই জানিয়ে দিচ্ছে, সে এখনো বেঁচে আছে। চারপাশের বাতাস নিস্তব্ধ, শুধু ধোঁয়ার গন্ধে ভারী।

দূরে একটা ঝিঁঝিঁ ডাকছে, আর গাড়ির ফাটা সাইলেন্সার থেকে বেরোচ্ছে ক্রমাগত হালকা গরম বাতাসের শব্দ।
তার ফোনটা পাশের সিটে পড়ে, স্ক্রিন ভাঙা, তবুও আলো জ্বলছে। স্ক্রিনে মাহির নাম টা ভাসছে। মাহির অনবরত কল করে যাচ্ছিল রায়ানকে হুট করে কল কেটে দেওয়ার পর থেকে।
ফোনটা বাজতে বাজতে অফ হয়ে গেল চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায়—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাহির টেনশনে আর ঘরে থাকতে পারছিল না তাই কল করতে করতেই রায়ানের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে শুরু করে। রায়ানের ফোনে কল করতে থাকার একপর্যায়ে মাহির কানে ভেসে এলো-
“আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন, ধন্যবাদ।
The number you have dialled is not reachable. please call after sometime, thank you.”
মাহির এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রায়ানের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে জানার পর। মাথায় যত ধরনের আজেবাজে চিন্তা আছে সব একসাথে জেকে বসলো-
“পাগলটা সত্যি সত্যি কার ক্র্যাস করলো নাকি আবার?”
মাহির নিজের শার্টটা দ্রুত পড়ে নিয়ে আবার নিজের ফোন থেকে কাউকে কল করতে করতে বিড়বিড় করলো-
“গার্লফ্রেন্ড বা বউয়ের জন্য টেনশন নেওয়ার বয়সে বন্ধুর টেনশন নিতে হচ্ছে। হায় আল্লাহ কি করতে এই পাগলের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল কে জানে।”
কল ডায়েল করে ফোনটা কানে ধরলো।

রাত এখন ২.১৫ মিনিট~
রুদ্র প্রায় ৩০ মিনিট ধরে রিমির বাড়ির কাছের মোরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু রিমি এখনো এসে পৌঁছায় নি। অপেক্ষা করতে রুদ্রর একটুও বিরক্ত লাগছিল না বরং বেশ আনন্দ নিয়ে রিমিকে এতো দিন পর এক নজর দেখার অপেক্ষায় গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বারবার রিমির বাড়ির গলির দিকে তাকিয়ে ছিল রিমি আসছে কিনা। হঠাৎ রুদ্র ফোন বাজলো, হয়তো রিমি কল করেছে এমনটা ভেবে রুদ্র তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নেয় কিন্তু ফোনের স্ক্রিনে মাহিরের নাম দেখে রুদ্র আশ্চর্য হলো। মাহির তখন রুদ্র কে কল করেছে না পারতে, কারণ একা একা কিভাবে রায়ানকে সামাল দেবে সে বুঝতে পারছিল না তাই রুদ্রর কথা মাথায় এসেছে তার।
রুদ্র স্বাভাবিক ভাবেই মাহিরের কলটা রিসিভ করে ফোন কানে নিয়ে মজার ছলে বলল-
“হ্যালো মাহির ভাই। কি অবস্থা তোমার? ভাইয়ার কাছে হেড়ে গেছ শুনলাম?”

মাহির রুদ্রর কথা শুনলো কিন্তু তার এখন মজায় তাল দেওয়ার মন মানসিকতা নেই। মাহির অশান্ত গলায় রুদ্র কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো-
“রুদ্র তুই কোথায় আছিস? বাড়িতে?”
রুদ্র অবাক হলো মাহিরের মুখে হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে। কিন্তু তাও প্রশ্নের উত্তর দিলো-
“না আমি একটা কাজে বাড়ির বাইরে আছি এখন। কেন কি হয়েছে? কোনো প্রয়োজন?”
মাহির চিন্তা করতে পারছিল না ঠিক কিভাবে রুদ্রকে সব বুঝাবে- কি হচ্ছে। মাহির একটু শান্ত হলো, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুদ্র কে খুব সিরিয়াস ভাব বলল-

“রুদ্র আমার কথা একটু মন দিয়ে শোন আর বোঝার চেষ্টা কর, ঠিক আছে? Rayan needs help. আমি কিভাবে সামাল দেব না বুঝে তোকে কল করেছি। তুই যেখানে আছিস তাড়াতাড়ি আয় প্লিজ।”
মাহিরের কথা রুদ্র কিচ্ছু বুঝলো না, বুঝার কথাও না। রুদ্র তো রায়ানকে চৌধুরী বাড়িতেই দেখে এসেছে, তাই একটু দুষ্টুমি করে মাহির কে বলল-
“ভাইয়ার কোনো হ্যাল্প লাগবে না। (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভেবে বলল) এখন হয়তো মিরার সাথেই আছে ওর ঘরে। যদিও বলেছে মিরার পারমিশন ছাড়া কিছুই করবে না, কিন্তু আমি ভালো মতো জানি আমার ভাইয়া ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নয়। যাক গে, I am happy for them.”

মাহির কি বলছিল তা রুদ্র বুঝছিল না এখন আবার রুদ্র কি বলছে তা মাহির বুঝতে পারছে না, আর না মাহিরের রুদ্রর কথা বুঝার সময় ছিল। মাহির রুদ্র কে আবার সোজা কথায় বোঝাতে চেষ্টা করে-
“রুদ্র ভাই আমার একটু আমার কথা টা শোন। রায়ান চৌধুরী বাড়িতে নেই আর না ভাবি আছে। ভাবি চট্টগ্রাম চলে গেছে আর তাকে ফেরাতে রায়ানও চট্টগ্রামে যাচ্ছে।”
রুদ্র মাহিরের কথায় ভ্রুকুচকালো সামান্য –

“কিহ? মিরা চট্টগ্রাম গেছে? কবে? কই না তো। আর ভাইয়াকেও তো বাড়িতেই দেখে এলাম। সবচেয়ে বড় কথা মিরা বাড়ি ছেড়ে চট্টগ্রাম যাবে কেন? কি সব আবোল তাবল বলছো মাহির ভাই!”
মাহিরের ধৈর্য আর কুলোচ্ছে না। বিরক্তি যে গালি দিয়েই রুদ্র কে বলল-
“আরে বোকাচ***, আমি যা বলছি তা শোন গাঁধা। মিরা ভাবি বাড়িতে নেই চট্টগ্রাম চলে গেছে কারণ সে রায়ানের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা জেনে গেছে। আর রায়ান ওর বউকে আবার ফিরিয়ে আনতে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে।”
রুদ্র মাহিরের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সম্পূর্ণ কথাটা কানে পৌছানোর পর যখনই বোধগম্য হলো তখনি সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠলো-

“What?! মিরা বিয়ের ব্যাপারে জেনে গেছে মানে? কিভাবে সম্ভব! কখন হলো এসব?! আর ভাইয়া! ভাইয়া ঠিক‌ আছে? মিরা কি কোনো ঝামেলা করেছে!?”
মাহির নিজের গাড়ির চাবি নিয়ে বেরলো খান বাড়ি থেকে।রুদ্রর একসাথে এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই ভাবলো গাড়িতেই বাকি কথা বলবে-
“এতো কিছু আমি জানি না। রায়ানের মুখে শুনলাম ভাবি নাকি ওই ডিভোর্স পেপার টা পেয়ে গেছিল আর ওইভাবেই জেনেছে। তবে রায়ান খুব খুশি ছিল, ভাবি ঝামেলা করেনি। উল্টো রায়ানকে ফিরিয়ে আনতে বলেছে হয়তো। এই জন্যই আমাদের বউ পাগলা রাতের বেলায় বউ আনতে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেছেন।”
রুদ্র মাহিরের সব কথা হজম করছে, যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মিরায়া বিয়ে ব্যাপারে জেনে গেছে শুনে যেমন চিন্তায় পড়ে গেছিল এখন মিরায়া বিয়ে মেনে নিয়েছে এইটা শুনে ঠিক তেমন ভালো লাগছে। কিন্তু সে মাহিরের এমন অদ্ভুত চিন্তার কারণ বুঝলো না-

“ওয়েট ওয়েট, মাহির ভাই। মিরা যদি বিয়ে মেনে নিয়ে থাকে তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ, খুব ভালো খবর। ভাইয়া ভাবিকে আনতে গেছে এইটাও ভালো খবর তাহলে তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন? কি নিয়ে টেনশন করছো?”
মাহির গাড়ি চালাচ্ছে এখন। স্টেয়ারিং-এ হাত শক্ত করে ধরে আছে, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু রুদ্রর কথায় ও প্রশ্নে সে বিরক্ত ও হচ্ছে শুভ অনেকটা। রায়ানের পরিস্থিতি কেমন সেই সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই এই সময় এমন কথা বলতেও তার ভালো লাগছে না। কিন্তু না খুলে বললে রুদ্র পরিস্থিতির গাম্ভীর্যতা বুঝবেনা বলে য়াহির সম্পূর্ণ টা রুদ্র কে বলল-
“সবই তো ভালোই ছিল, কিন্তু হঠাৎ রায়ানের গাড়ি ব্রেক ফেল করে গেছে তখন আমি ওর সাথে কলে ছিলাম।”
রুদ্র গাড়ির ব্রেক ফেল হওয়ার কথায় গাড়িতে হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়লো-
“কিহ্? কি করেছে গাড়ি? ব্রেকফেল?”
মাহির আবার রুদ্র কে বোঝাতে বলল-

“খালি যে গাড়ি ব্রেকফেল করেছে এমন না, তোর ভাইয়া আমাকে বলেছে সে নাকি ইচ্ছে করে গাড়ি ক্র্যাশ করাবে গাড়ি থামানোর জন্য। আর এরপর কল কেটে দিয়েছে। তখন থেকে ওর নাম্বার ট্রায় করছি। বন্ধ দেখাচ্ছে। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তাই তোকে কল করেছি।”
রুদ্রর পায়ের নিচে মাটি হঠাৎ যেন নড়ে উঠলো কিছু বলার বা অনুভব করার ইচ্ছে বা শক্তি টুকু হচ্ছে না। বাড়ি থেকে আসার আগ অব্দি সবকিছু ঠিক ছিলো অথচ এতো টুকু সময়ের মাঝে এসব কি হয়ে গেছে। রুদ্র ভালো করেই জানে রায়ান যেহেতু বলেছে গাড়ি থামাতে সে সত্যি সত্যি কার ক্র্যাস করবে। রায়ান ঠিক আছে কিনা অতশত ভাবনার মাঝে পড়ে মুখের বুলি আটকে গেছে রুদ্রর। কিন্তু নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার লক্ষ্যেই হালকা গলায় আওয়াজ ঠিক রেখে জিজ্ঞেস করলো-

“মা..মাহির ভাই, আমার ভাইয়ার কিছু হয়নি তাই না বলো? ঠিক থাকার কথা তো, তাই না?”
রুদ্রর মুখের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই মাহিরের বুকটা একটু কেঁপে উঠলো। তার নিজেরই কেমন হাত পা শিথিল হয়ে আসছে রায়ানের কথা ভাবলেই। এই মুহূর্তে রুদ্র কে ঠিক কি বললে ঠিক শুনাতে মাহির ভেবে পেলো না। কিন্তু বড় ভাইয়ের বন্ধু বড় ভাইয়ের চেয়ে কম কিসে? একপ্রকার বড় ভাইয়ের জায়গা থেকেই সাহস দিয়ে বলল-
“কেন ঠিক থাকবে না? অবশ্যই ঠিক থাকবে। রায়ান ও ঠিক থাকবে আর ভাবিকে ও ফিরিয়ে আনা হবে। তুই চিন্তা করিস না। যেখানে আছিস পারলে দ্রুত চলে আয়।”
রুদ্র আর কিছু না ভেবেই গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে বসতে বসতে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আসছে। তুমি আমাকে তোমার লোকেশন শেয়ার করো। আমার ভাইয়ার কিছু হবে না আমি জানি। He is the best, a superman.”

রুদ্র ছোট থেকেই খুব ইমোশনাল ঠিক যেমন রায়ান খুব একরোখা আর জেদি ছিল তার উল্টো। রুদ্র রায়ানের ছোটবেলার সুপার ম্যান সাজার স্মৃতি মনে করেই সে কথাটা বলল।
মাহির রুদ্রের কন্ঠের কম্পন শুনে ভালো বুঝতে পারছে রুদ্রর মানসিকতা এখন ঠিক নেই, খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছে হয়তো। মাহির রুদ্র কে শুধু সাবধান করতেই বলল-
“ঠিক আছে করছি শেয়ার। তুই সাবধানে ড্রাইভ করে আয়। রায়ান লাস্টলি ঢাকা হাইওয়ের কথা বলেছিল। তুই ওখানেই আয় আগে।”

দুইজনে কথা বলে ফোন রাখার পর রুদ্র একটু ঠান্ডা হয়ে গাড়ির সিটে বেল্ট লাগাতে শুরু করে। ঠিক তখনি তার মাথায় রিমির কথা আসে, রুদ্র চাতক পাখির ন্যায় রিমির বাড়ির গোলিটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কিন্তু সেখানে কারো উপস্থিতিই নেই। বুকে একরাশ হতাশা জমা হলো রুদ্রর-
“রিমি,আজ কেন এলেন না আপনি?”
তবে পরিস্থিতির ভয়াবহতার কাছে হতাশা বা চিন্তা ভাবনা সব টিকে থাকতে ব্যর্থ তাই নিজের অগোছালো মনটাকে শান্ত করে সিটি বেল্টা পড়েই গাড়ি স্টার্ট দেয়, আর কিছু সময়ের মাঝেই সে ওই জায়গা ত্যাগ করলো, ধীরে ধীরে রিমির বাড়ির গোলিটাও অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। রুদ্র শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাকিয়েই রইল সেই দিকে যদি রিমি আসে, কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।

প্রায় আধ ঘণ্টা পর,
গাড়ির ভেতরে সামান্য নড়াচড়া। রায়ানের নিঃশ্বাসে এক হালকা শব্দের কম্পন দেখা দিল। ভাঙা গলায় ভেতরের ভারী কণ্ঠে অস্পষ্টভাবে বেরিয়ে এলো কয়েকটা শব্দ-
“হা… হার্ট… বা…র্ড… মি… মিরা…”
তার কণ্ঠ ভারী, নিঃশ্বাসে কাঁপন, চোখ বন্ধ রেখেই রায়ান মিরায়ার নাম আওড়ে যাচ্ছিল বারবার—
“মিরা… মিরা… হৃদপাখি…”
তার কণ্ঠ যেন ভাঙা বাতাসে ভেসে আসা এক ব্যথার ডাক।
মাথার ভেতর যেন আলো আর শব্দের গুলমাল, কিন্তু ওই নামটাই এখন তার একমাত্র বোধ, অচেতনতার অন্ধকারে জেগে থাকা শেষ অনুভূতি। কণ্ঠে ক্লান্তি, তবু সেই নামের মধ্যে এক অবিশ্বাস্য টান।
ধীরে ধীরে রায়ান চোখ পিটপিট করতে লাগল।
চোখের পাতায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের খোসা,

পাপড়ির মাঝখানে লেগে আছে জমানো রক্তের দাগ।
সে চোখ খুলতে চাইলেও, আলো ভেদ করে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না—
সব কিছু যেন কুয়াশা মাখা অন্ধকারে ঢেকে গেছে।
ধীরে ধীরে সে চোখ পিটপিট করে খুলতে চেষ্টা করল।
চোখের পাতায় লেগে থাকা শুকনো রক্তের খোসা খুলে আসছে ব্যথা নিয়ে। পাতার ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সে চোখ খুলতে চাইলেও, আলো ভেদ করে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না-
সব কিছু কালো, অস্পষ্ট, ঝাপসা। সব কিছু যেন কুয়াশা মাখা অন্ধকারে ঢেকে গেছে।
রায়ান বুঝতে পারছে না কী ঘটেছে। মাথার ভিতর শূন্যতা, এক মুহূর্তে তার ভেতরে তীব্র বিভ্রান্তি- “কোথায় সে? কীভাবে এসেছে এখানে?”

মাথার ভেতর স্মৃতিগুলো এলোমেলো হয়ে রইল। শব্দ, আলো, বাঁক নেওয়া রাস্তাগুলো—সব কিছু একাকার।
সে দু’হাত তুলে নিজের মাথা চেপে ধরল, স্টিয়ারিং থেকে মাথাটা ধীরে তুলল। ব্যথা সাথে সাথে তীব্র হয়ে উঠল—
একটা ঝাঁকুনি পুরো শরীরটা কাঁপিয়ে দিল। ব্যথার তীব্রতা সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ল কপাল থেকে ঘাড় পর্যন্ত।
“আহ্…”
গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে।
রায়ান শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। বুকটা ভারী, প্রতিটি নিঃশ্বাসে যেন আগুনের ঝাঁপটা। তার হাতের তালু রক্তে ভিজে গেছে, আঠালো গরম তরল ছুঁয়ে বুঝতে পারছে—নিজেরই রক্ত। সে শ্বাস নিল ধীরে, গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে পড়ে রইল কিছুক্ষণ, চোখ বন্ধ করেও অস্থির ঠোঁটে একই নাম ঘুরছে—
“মি…রা… হৃদপাখি…”

অচেতনতার ভেতরেও সেই ডাক থামছে না। তার কণ্ঠে না আছে শক্তি, না আছে সজাগতা, তবু শব্দগুলো এমনভাবে বেরোচ্ছে, যেন রক্তের স্রোতের ভেতর দিয়ে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছে ভালোবাসার শেষ নিশ্বাস।
একটু পর রায়ান আবার চোখ খুলল, দৃষ্টিটা ভারী, কুয়াশা ঢাকা। সে সামনের দিকে তাকাতে চেষ্টা করল, কিন্তু কেবলই কালো অন্ধকার দেখতে পেল। একটা বিকল আলো, আর নিজের শ্বাসের শব্দ। সে চোখ জোর করে কয়েকবার বন্ধ করল,আবার খুলল, ভিউ পরিষ্কার করার চেষ্টা করল প্রাণপণে। মাথাটা হালকা ঘোরালো— সাথে সাথেই তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে গেল পুরো করোটিতে। কপাল দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল সিটে, আর রায়ান নরম গলায় একটুখানি যন্ত্রণাভরা শব্দ করল-“ইসস্…”

তার চারপাশ এখন নিস্তব্ধ,কেবল গাড়ির ক্ষীণ ধোঁয়া, রক্তের গন্ধ, আর রাত্রির নিঃশ্বাস। সবচেয়ে ভেতরে, তার মন যেন ফিসফিস করে নিজেকেই বলছে—
“বেঁচে থাকতে হবে… মিরা… অপেক্ষা করছে…”
রাত্রির নিঃস্তব্ধতার ভেতর সেই কণ্ঠ মিলিয়ে যায়, তবুও বাতাসে থেকে যায় তার গলার উষ্ণতা, এক আহত হৃদয়ের জীবনের শেষ জেদ-মিরার কাছে পৌঁছানো।
আরো কিছু টা সময় চলে গেল ওইভাবেই, মাঝে মাঝেই রায়ানের জ্ঞান ফিরছিল আবার অচেতন হয়ে পড়ছিল। শরীর ছেড়ে দিয়ে অনেকটা। রাত ৩টার কাছাকাছি সময়ে মাহির হাইওয়ে তে পৌঁছায়। সম্পূর্ণটা সময় সে গাড়ি খুব স্পিডে চালিয়েছে। যেহেতু রায়ানের অবস্থান সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিলনা তার, সে রাস্তার চারপাশটা বেশ খেয়াল করে গাড়ি চালাচ্ছে যদি রায়ানের গাড়ি দেখতে পায় সেই আশায়।

রুদ্র ও কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু মাহির বা রায়ান কোথায় সেটা জানা ছিল না বলে সে মাহির কে কল করে। রুদ্রর কাছে হাইওয়ের লোকেশন টা ছিল কিন্তু মাহিরের হয়তো তার লোকেশন শেয়ার করতে মনে নেই। রুদ্রর কল দেখে মাহির ও কলটা সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো। কল রিসিভ হতেই রুদ্র মাহির কে উৎকণ্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করলো –
“মাহির ভাই, ভাইয়ার কোনো খোঁজ পেলে? তুমি কোথায় আছো? আমি কাছাকাছি চলে এসেছি।”
মাহির অশান্ত গলায় বলল-
“নাহ্, এখনো খুঁজে পাইনি। তবে চেষ্টা করছি পেয়ে যাবো তুই চিন্তা করিস না। আমি হাইওয়ের ব্রীজের উপর আছি, তুই এইদিকে আয়।”
রুদ্র মাহির কথায় বলল-

“আমিও ব্রীজের কাছাকাছিই আছি। আসছি একটু সময় দেও।”
মাহির রুদ্র কে আবারো আশ্বস্ত করে সাবধান করলো-
“রুদ্র সাবধানে ড্রাইভ কর। তুই টেনশন নিস না রায়ানের কিছু হবে না। তোর ভাই অনেক স্ট্রং। বুঝতে পারছিস আমার কথা?”
রুদ্র মাহিরের কথা বুঝলো-“হুম।”
কলটা কেটে গেল। রুদ্র আর মাহির নিজেদের মতো করে রায়ানে খুঁজতে লাগলো আশেপাশের জায়গা গুলোতে।

কিছুটা সময় পর হঠাৎ রায়ানের আবার জ্ঞান ফিরলো। এবার কিছু টা সে আন্দাজ করতে পারছিল কি হয়েছে তার সাথে। মাথায় একটু চাপ প্রয়োগের ফলে তার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে ধরা দিল-“মি..মিরা! আমাকে মিরার কাছে পৌঁছাতে হবে।”
মাথাটা ধরে মৃদু স্বরে আওড়াল রায়ান।
গাড়ির দরজা আধখোলা ছিল, গাড়ির সামনের থেকে ধোঁয়া উড়ছে। রায়ান নিজের সব শক্তি সঞ্চয় করে গাড়ির দরজাটা ঠেলে বের হওয়ার চেষ্টা করলো। মাথার আঘাতে ব্যাথার অনুভূতি তার শরীরের সকল শিরা উপশিরায় বয়ে আনছিল মরণ যন্ত্রণা। রায়ান তারপরও নিজেকে ধরে রেখে নিজ পায়ে দাঁড়ালো। মাথা ঘুরছে, যেকোনো সময় পড়ে যাবে এমন মনে হচ্ছে। রায়ানের পায়েও চাপ পড়েছিল যার কারণে তার পা অনবরত কাঁপছিল। শেষ অব্দি থাকতে না পেড়ে হাঁটতে ভর দিয়ে বসে পড়লো রাস্তার কিনারায় একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে‌। সময় যতো যাচ্ছে ব্যাথায় তীব্র তা যত বাড়ছিল।

রায়ানের গাড়িটা ব্রীজটা পর হওয়ার পর ক্র্যাশ করেছিল। আর এই দিকে মাহির আর রুদ্র দুইজনেই ওই দিকেই যাচ্ছে। রুদ্র একটা সময় পর মাহিরের গাড়িটা খুঁজে পেয়ে ড্রাইভ করে মাহিরের পাশাপাশি গাড়িটা চালাতে চালাতে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলো-
“মাহির ভাই..!”
মাহিরের জানালাও খোলা ছিলো। সে রুদ্রর ডাকে পাশ ফিরে চেয়ে রুদ্র কে দেখে বলল-
“এতো স্পিডে গাড়ি চালাতে কে বলেছে তোকে। যদি কিছু হয়ে যেত।”
রুদ্র চিন্তিত তাই গাড়ি যতটা সম্ভব জোরে চালিয়েছে। রুদ্র নিজেঅএ আড়াল করতে মাহিরের কথা তুলে বলল-
“আমাকে যে বলছো না! তুমি নিজেই তো ১৫০+ স্পিডে চালাচ্ছ।”
মাহির আর কিছু বললো না রুদ্র কে। রায়ানকে খুঁজে পাওয়াটা এখন অনেক বেশি জরুরী। মাহির রুদ্র কে জিজ্ঞেস করলো-

“আসার সময় কোথাও কিছু দেখেছিস?”
রুদ্র হতাশা নিয়ে বলল-
“নাহ, মাহির ভাই ওই দিকে কিছু নেই। আমার মনে হয় এই ব্রীজ টা পরা করলে বোঝা যাবে। এতো টুকু সময়ে এর বাইরে ভাইয়া যাবে না।”
মাহির ও রুদ্রর কথায় শায় দিয়ে বলল-
“ঠিক আছে চল, ব্রীজ টা পার করি পরে বোঝা যাবে।”
রুদ্র মাহির দ্রুত ব্রীজ টা ক্রশ করলো। ব্রীজ পার হওয়ার পর দুইজনেই এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে মুখোমুখি হলো। চার রাস্তার একটা মোড়ের মাঝবরাবর দুইজনে দাঁড়ালো। রায়ান কোন রাস্তায় গেছে তা জানার উপায় নেই তাই সম্পূর্ণ জায়গাটা খুঁজতে হবে।
মাহির -“তুই ওই দিকটা দেখ আমি এই দিকটা দেখছি কেমন?”

(রাস্তার দুই দিকে পর পর ইশারা করে বলল)
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো-“ঠিক আছে। ভাইয়ার খোঁজ পেলে আমাকে জানিয়ো।”
এই বলে দুজনে দুই দিকে ছুটলো। আর যতটা সম্ভব চেঁচিয়ে রায়ান কে ডাকতে থাকলো-
মাহির- “রায়াননন….শুনতে পাচ্ছিস! রায়ান…!”
রুদ্র -“ভাইয়া….তুমি কোথায়?.. ভাইয়া…শুনতে পাচ্ছো?”
প্রায় ১৫ মিনিটের মতো হয়ে গেছে মাহির রুদ্র রায়ানকে পাগলের মতো খুঁজে যাচ্ছে। দুই জনে ডান ও বামের রাস্তা খুঁজেও রায়ানের হদিশ না পেয়ে আবার এক জায়গায় হলো।
মাহির হাঁপাতে হাঁপাতে-“এইদিকে নেই।”
রুদ্র ও হাপাচ্ছে -“এইদিকে ও নেই।”

দুইজন একসাথে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি করলো। কিছু বলার প্রয়োজন পড়লো না। দুজনেই চোখের ভাষা পড়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। একসাথে দুইজন এবার সামনের দিকে গাড়ি ছুটালো।
কমপক্ষে ৫ মিনিটের রাস্তা পর করার পর তাদের চোখে একটা গাড়ির আবছা হেড লাইটের আলো আর অনেক ধোঁয়া চোঁখে পড়লো। মাহির রুদ্র কে বলল-
“রুদ্র প
সামনের ওই বড় গাছটার কাছে চল। ওখানে কিছু হয়েছে।”
দুইজনে দ্রুত গাছটার কাছে যাচ্ছে। যতোই কাছে যাচ্ছে রায়ানের ভাঙাচোরা গাড়িটা তত স্পষ্ট হচ্ছে আর তাদের মনেও অসংখ্য ভয় জমা হচ্ছে। রায়ানের ভাঙাচোরা গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই মাহির রুদ্র তাদের গাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ির ওমনি অবস্থা দেখে দুইজনেরই মাথায় হাত দেওয়ার উপক্রম।

দুইজনেই দৌড়ে গাড়ির দরজার ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে দেখলো গাড়ির ভেতরে কেউ নেই। মাহির রুদ্র দুইজনই হতবাক হয়ে আছে। রায়ান ঠিক গাড়ির পিছনের গাছে হেলান দিয়ে বসে ছিল অন্ধকারে দুইজনের কেউ খেয়াল করছে না। এইদিকে মিটিমিটি আলোয় ভাই আর বন্ধুকে তাকে খুঁজতে দেখে রায়ান একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। মাহির রুদ্রর দিকে তাকিয়ে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে বলল-
“তোর ভাই কি আসলেও মানুষ আমাকে বল তো। গাড়িটার কি হাল হয়েছে দেখেছিস! ভাব একবার তাহলে ওর কি অবস্থা। এতো কিছুর মাঝেও সে স্থির নেই গাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো মাহিরের দিকে। সে চিন্তাও করতে চাইছে না রায়ানের এখনকার অবস্থা তবে গাড়িতেও রায়ানকে না দেখতে পেয়ে চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“মাহির ভাই, আমার ভাইয়া কোথায়?”

রুদ্রর বাচ্চা বাচ্চা কথা রায়ানের কানে যেতেই সে একটু মজা পেল। মাহির রুদ্রর প্রশ্নে আরো খেপে উঠলো –
“আমার মানি ব্যাগে তোর ভাই নে বের করে নিয়ে বাড়ি যা।”
মাহির পকেট থেকে নিজের মানিব্যাগটা বের করে রুদ্রর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল।
মাহিরের এই কথা শুনে রায়ান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। হাজারো যন্ত্রণার মাঝে ফিক করে হেঁসে উঠলো আর তারই সাথে হালকা কাশতে কাশতে বলল-
“আ..আমি এইখানে রে গাধার দল।”

মাহির রুদ্র নিজেদের ছাড়া তৃতীয় কারো আওয়াজ পেয়ে শব্দের অনুসরণ করে গাড়ির পিছনের দিকে তাকাতেই দেখলো রায়ান রক্তাক্ত অবস্থায় গাছের সাথে হেলান দিয়ে আছে। মাহির সাথে সাথে নিজের মানিব্যাগ টা পকেটে রাখতে রাখতে রায়ানের দিকে দৌড়ে গেল সাথে রুদ্র ও। দুইজনেই রায়ানের কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে রায়ানকে দেখলো। সম্পূর্ণ চেহারা রক্ত দিয়ে আবৃত, এমনকি রক্ত ও শুকিয়ে গেছে চামড়ায়। ফর্সা চেহারায় লাল রক্ত কেমন অদ্ভুত ভয়ংকর দৃশ্যের সৃষ্টি করছে। তবে রায়ানের জ্ঞান এখনো স্পষ্ট নয়, কেবল বাহ্যিক অবস্থা টুকু বুঝতে পারছে।
রুদ্র রায়ানের মুখে হাত রেখে একটু চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“ভা..ভাইয়া তুমি ঠিক আছো? ব্যাথা হচ্ছে?”

রায়ান রুদ্রর টেনশনে ভরা চেহারা দেখে বাঁকা হাসলো। মাহির উল্টো রায়ানের কাঁধে একটা হালকা চর দিয়ে বলল-
“কি পরিমান নির্লজ্জ হলে এই সময়ে একটা মানুষ হাসতে পারে খোদা তালা জানে।”
রায়ান মাহিরের চরে মৃদু আর্তনাদ করলো-“আহ্!”
রুদ্র মাহির একে অপরের দিকে তাকিয়ে পর মুহূর্তেই রায়ান কে চেংদোলা করে তুলে নিলো। আর ওইভাবেই মাহিরের গাড়িতে রায়ানকে তুলে নিলো। রায়ান কে সাজনের সিটে শুইয়ে দিয়ে মাহির ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে রুদ্র কে বলল-

“আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি তুই আয় তাড়াতাড়ি কেমন। বাড়িতে এখনি কিছু বলতে হবে না কালকে জানিয়ে দিস।”
ব্যাকসিটে শুয়ে থেকেই রায়ান হালকা বিড়বিড় করে বলল-
“চট্টগ্রামের রোডে চল। তোর ভাবিকে নিয়ে তার পর হসপিটালে যাবো।”
রায়ানের কথা শুনে রুদ্র আর মাহির রেগে চোখ ছোট ছোট করে পিছনে তার দিকে তাকালো। রায়ানের সেই দিকে কোনো খেয়ালি নেই সে আপন মনে বিড়বিড় করছে-
“মি..মিরা, আমার হৃদপাখি আমার অপেক্ষা করছে। আমাকে যেতে হবে।”
মাহির রায়ানের কথা শুনে তার থেকে চোখ সড়িয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিরমির করে বলল-
“রুদ্র তোর ভাইকে চুপ করতে বল নাহলে ওকে আমিই মেরে ফেলবো।”
রুদ্র কি বলবে আর মাহির কে রায়ানের মিরায়া প্রতি এমন আসক্তি দেখে সে নিজেও বিরক্ত। রুদ্র মাহির কে শান্ত করে বলল-

“তুমি ভাইয়াকে নিয়ে হসপিটালে যাও মাহির ভাই। আমি পিছন পিছন আসছি। আর ভাইয়ার কথা শুনো না। ওর মাথা গেছে পুরো। আর এখন তো মাথাটা ফেটেও গেছে। সাবধানে নিয়ে যাও। আমি আসছি।”
মাহির আরেকবার রায়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো-
“একটা মানুষ এভাবেও ভালোবাসতে পারে তাও আবার তাকে যাকে কিনা সহ্য করতে পারতো না। প্রকৃতির কি আজব খেলা এটা। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।”
অজান্তেই তার মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এর পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই জায়গা থেকে রায়ানকে নিয়ে রুদ্র ও মাহির ঢাকার সবচেয়ে কাছে কোনো একটা হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দিল।

চট্টগ্রাম~
ভোর ৪টার কাছাকাছি সময়। আসিফ আর মিরায়া অনেকটা পথ রাইড করে অবশেষে চট্টগ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছে। আসিফ আর মিরায়ার বাড়ির পাশাপাশি। সেভাবেই সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। মিরায়া আসিফের বাড়ির গ্যারেজেই নিজের বাইক রাখে এই সম্পর্কে সোরায়া আর রাইডিং কমিউনিটির রাইডার রা ছাড়া কেউ জানেনা। আসিফের মা বাবা নেই। তারা বিদেশে থাকেন তাই বাড়িতে আসিফ একাই থাকে এখন। তাই মিরায়ার বাইক রাখার জন্য খুব নিরাপদ একটা জায়গা। সোরায়া সোফায় সারাটা রাত জেগে বসে ছিলো মিরায়ার আসার অপেক্ষাতে কারণ তাকেই দরজা খুলতে হবে। আসিফ মিরায়া দুইজনেই রহমান বাড়িতে এলো বাইক রাখার পর। দরজার সামনে এসেই মিরায়া কলিং বেল টা প্রেস না করে সোরায়াকে কল করলো। কলিং বেলে চাচা-চাচি জেগে যাবে তাই। ফোনটা বাজতেই সোরায়া হঠাৎ কেঁপে উঠলো সোফায়, বাটন ফোনের রিং টোন খূব জোরালো এমনিতেই। অনেকক্ষণ বসে থাকায় হালকা চোখ লেগে এসেছিল সোরায়ার ঝিমুতে ঝিমুতে কলটা তুলতেই অপর দিক থেকে মিরায়া আস্তে বলল-

“বনু দরজা খোল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।”
মিরায়া চলে এসেছে শুনে সোরায়া কল কেটে ধপ করে সোফা থেকে নেমে দৌড়ে দরজার খুলতে যায়। দরজাটা খুলেই দুইদিন পর মিরায়াকে দেখে সোরায়া কাঁদো কাঁদো আহ্লাদি মুখ করে মিরায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“I missed you, আপু। খুব মনে পড়েছে তোমার কথা।”
মিরায়াও নিজের ছোট্ট বোনটাকে এতো দিন পর দেখে আবেগে ভেসে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল-
“I missed you more, আমার ছোট্ট বাঁদর। কেমন আছিস তুই?”
সোরায়া মিরায়াকে ছেড়ে বলল-
“আমি আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। তোমাদের কথা খুব মনে পড়েছে এই আর কি। তুমি ঠিক আছো তো? রেসের সময় কোথাও লাগেনি তো?”
মিরায়ার উত্তর দেওয়ার আগে আসিফ পিছন থেকে সোরায়াকে তার হেলমেট টা আগে করে দেখিয়ে বলল-
“তোর আপু ঠিকই আছে। কিন্তু আমার হেলমেট টা ঠিক নেই। তোর গুন ধর আপু একঘুষিতে এই হাল করেছে।”
সোরায়া এতো ভোরে আসিফ কে মিরায়ার সাথে দেখে অবাক হলো-
“আসিফ ভাই, তুমি? এতো ভোরে এই বাড়িতে ? আপু আসছে তুমি জানতে নাকি?”
ছোট্ট থেকে সোরায়া বেশ মিশুকে তাই আসিফকে বড় ভাই সম্বোধন করে তুমি করেই বলে যেখানে মিরায়া ঠিক তার উল্টো সবার সাথে একটা সম্মান জনক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে তার সাচ্ছন্দ্য অনুভব হয়। সোরায়ার প্রশ্নের উত্তরে মিরায়া বলল-

“শুধু যে জানতো তা নয় রে বনু। আমাকে ওয়েল কাম কারতে অনেকটা রাস্তা এগিয়ে গেছিল জানিস। ফল স্বরূপ তার হেলমেটটার এই হাল।”
সোরায়া মিরায়ার কোনো কথা বুঝলো না। আসিফ কি বলছে আর মিরায়া কি বলছে সব কেমন গুলিয়ে গেলো। সোরায়া বোকা বোকা ভাব নিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল-
“কি বলছো তোমরা কিছু বুঝতে পারছি না আমি। একটু খুলে বলবে?”
মিরায়া খুব আগ্রহ দেখিয়ে সোরায়াকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বলল কিভাবে আসিফ তার চট্টগ্রামে ফেরার কথা জানতে পেরেছে, কিভাবে দেখা হলো রাস্তায়, কিভাবে হেলমেট টা ভাঙলো সবটা। সোরায়া হেলমেট ভাঙার কথাটা শুনাল সাথে সাথে আসিফের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে উঠলো, সোরায়ার হাঁসি দেখে মিরায়াও হাসতে শুরু করলো আসিফের উপর। আর এই দিকে আসিফ আহাম্মকের মতো দুই বোনের হাসির পাত্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ আসিফের নজর উপরে সিঁড়ির দিকে যেতেই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা বিড়বিড় করলো-

“চা..চাচা-চাচি..!”
মিরায়া হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল-“কার চাচা-চাচি?”
আসিফ উপরের দিকে ইশারা করে বলল-“কার আবার তোর চাচা-চাচি।”
মিরায়া আর সোরায়ার হাঁসি তখনই চুপ হয়ে গেল। দুইজনের মুখে এখন আতংক, একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুইবোন একসাথে মাথা উঁচু করে সিঁড়ি দিকে তাকাতেই দেখলো রোকেয়া বেগম ও শফিক রহমান মানে চাচা-চাচি তাদের অবাক চোখে দেখছেন। ভোরবেলায় অতিরিক্ত আওয়াজে দুইজনের ঘুম ভেঙে যাওয়া পর বাইরে এসেই মিরায়াকে দেখে দুইজনেই অবাক। দুই পক্ষের কেউই বুঝে পাচ্ছে না কি হচ্ছে আর কি বলবে।
রোকেয়া বেগম ও শফিক রহমান দুইজন তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে মিরায়ার সামনে এলেন‌। রোকেয়া বেগম মিরায়াকে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার দেখে বললেন –

“মিরা? তুই এখানে? এই সময়! কখন এলি? কিভাবে এলি?”
মিরায়ার গলা শুকিয়ে এলো বাইকের হেলমেট টা এখনো তার হাতে। নিজের ঘরে লুকিয়ে রাখে সব সময় তাই নিয়ে এসেছে। মিরায়া কি বলবে ভেবে না পেয়ে বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো। সে রোকেয়া বেগমের হাত ধরে খিলখিলিয়ে হেসে একটু ঘুরে বলল-
“সারপ্রাইজ চাচি… I am back.”
চাচা শফিক রহমান পিছন থেকে গম্ভীর গলায় বললেন –
“তুই যে এসেছিস তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এলি কিভাবে? হাতে হেলমেট কার?”
মিরায়া জিভে কামড় দিলো এই প্রশ্নের উত্তরে এবার কি বলবে। কিন্তু আসিফকে দেখেই মাথায় বুদ্ধি এলো। মিরায়া নিজের হেলমেটটা আসিফের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
“হেলমেট আবার কার হবে চাচা, আসিফ ভাইয়ের। বাইক রাইডার তো এখানে একজনই আছে। হেলমেট আসিফ ভাইয়ের। তাই না আসিফ ভাই?”

আসিফ এবার ফেসাদে পড়ে গিয়ে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে আনমনে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার। হেলমেট তো আমারই।”
শফিক রহমান পাল্টা প্রশ্ন করলেন-
“তোর হেলমেট তো মিরার হাতে কেন? মিরার কাছে কি করছে ওটা?”
আসিফ কি বলবে ভেবে না পেয়ে মিরায়ার দিকে তাকায়। এইদিকে মিরায়া আবার কিছু একটা ভেবে বলল-
“ওমা কি আবার করবে? আমি পড়েছি আমার হাতেই তো থাকবে।”
শফিক রহমান আবার প্রশ্ন করলেন-
“তা তুই হেলমেট কেন পড়েছিস শুনি? ”
মিরায়াও সাথে সাথে জবাব দিলো-
“চট্টগ্রামে আসার জন্য বাইকে বসলে তো হেলমেট পড়তেই হতো চাচা।”
শফিক রহমান আবারো প্রশ্ন করলেন-
“মানে?”

মিরায়া এবার সুন্দর মতো মন গড়া কাহিনী সাজিয়ে বলল-
“বনুর কথা খুব মনে পড়ছিল আর তোমাদের নিয়েও খুব টেনশন হচ্ছিল। আর থাকতে পারি নি ঢাকায় তাই আসিফ ভাইকে বলেছিলাম তোমাদের সারপ্রাইজ দিবো আমাকে যেন ঢাকা থেকে নিয়ে আসে। আর আসিফ ভাই আমাকে নিয়ে এসেছে। যেহেতু বাইকে আছে আসিফ ভাইয়ের তাই বাইকেই এসেছি।”
মিরায়া কথা গুলো বলে মুখে নাদান অবুঝ শিশুর মতো একটা ভাব নিয়ে এলো যা দেখে আসিফ আর সোরায়া অবাক, শফিক রহমানের উপর কাজ না করলেও রোকেয়া বেগমের উপর ওই মুখের প্রভাব বিস্তার হলো। শফিক রহমান আরো কোনঝ প্রশ্ন করতে যাবেন তার আগে রোকেয়া বেগম তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-
“আহ্ হা, থামবে তুমি? আমার মেয়েটা কতদিন পর বাড়ি এলো। একটু দেখতে দেও আগে।”
মিরায়া আহ্লাদে আটখানা হয়ে চাচি কে জড়িয়ে ধরে বলল-

“চাচি তুমি ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না। আমার খুব খিদে পেয়েছে জানো।”
রোকেয়া বেগম মিরায়ার চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে তার মুখটা নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন-
“আহারে আমার মেয়েটার খিদে পেয়েছে?”
মিরায়া মাথা হ্যাঁ সূচক নাড়াতেই রোকেয়া বেগম বললেন-
“আগে বলে রাখলে তো তোর পছন্দের সব রান্না করে রাখতাম মা। সমস্যা নেই আপতত যা আছে তা খেয়ে নে। সকালে সব রান্না করে দেবো। ঠিক আছে?”
মিরায়া আবার মাথা নাড়লো। সোরায়া পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল-
“আমি সব খাবার গরম করে রেখেছি আপু। খাবে চলো।”
রোকেয়া বেগম সোরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন-

“ও বাবা , বেশ ভালো করেছিস। চল চল খাবি চল। আস ফ তুই ও খেতে আয়।”
আসিফ মিরায়া দুইজনেই খেতে চলে গেলো। শফিক রহমান গুরুজন হিসেবে মিরায়াকে জেরা করলেও। বাড়ির দুই মেয়ে বাড়িতে ফিরে এসেছে দেখে তিনিও মনে মনে খুব খুশি শুরু মিরায়ার দুঃসাহস দেখে একটু কঠোর হতে চেয়েছিলেন কিন্তু মেয়েটার মুখের মায়া এতো বেশি যে রাগ করাও অসম্ভব। তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন কিছুক্ষণ পর সকাল হলে বাজারে যাবেন মেয়ের পছন্দের সবকিছু কিনে আনতে এই চিন্তায়।
খাওয়া দাওয়া শেষে মিরায়া নিজের ঘরে পা রাখলো। প্রায় ৫ মাসের মতো হয়ে গেছে সে নিজের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আছে। কিন্তু তার ঘরটা সে ঠিক যেমন রেখে গেছিল তেমনি আছে। মিরায়া আরাম করে বিছানায় বসতে যাবে তখনি হঠাৎ আকাশে মেঘ ডেকে বৃষ্টি নামলো। একই সময়ে সোরায়া দরজায় খটখট করে মাথাটা ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে মিরায়াকে জিজ্ঞেস করলো-

“আপু, হবে নাকি?”
দুইবোন বৃষ্টি খুব পছন্দ করে। আর মানে বৃষ্টি পড়ে তারা একসাথে ছাদে উঠে বৃষ্টি যে ভিজে উপভোগ করে। যদিও শরীর ক্লান্ত ছিল মিরায়ার তবে ছোট বোনের কথায় আগের স্মৃতি চারণ করতে মন বা শরীর কোনোটাই বাঁধা দিলো না। অন্যদিকে সে আজ মহা খুশি তার বরের পরিচয় জানতে পেরে। বৃষ্টির চেয়ে বড় আনন্দের আর কি আছে এই সময়। মিরায়া সোরায়ার প্রস্তাবে এককথায় সম্মতি দিল-
“Why not. অবশ্যই হবে।”
মিরায়া দৌড়ে গিয়ে সোরায়ার হাতটা ধরল। দুইজন একসাথে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ছাদে গেল বৃষ্টি যে ভিজতে। বৃষ্টির পানিতে শরীর ভিজতেই সতেজ প্রাণের জাগরণে দুইজন গান গেয়ে গেয়ে নাচতে শুরু করলো-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৫

“Kaali Kaali raatein, Kali Raaton mein..
Yeh badarwa baras jaayega..
Gali Gali mujhko, megha dhoondega..
Aur gaarajkr palat jaayega..
Ghar, ssngan, angna..Aur Pani ka jharna..
Vul na Jana mujhe…Sab poochenge warnaa..

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here