বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২০
রানী আমিনা

“ফাতমা, ঝটপট আমার নাস্তা রেডি হওয়া চাই, আমি এক্ষুনি বেরোবো।”
কিচেনের দরজার কাছে এসে দ্রুতস্বরে বললো আনাবিয়া, পরক্ষণেই এগোলো বাচ্চাদের হলরুমের দিকে। ফাতমা শার্লট ওর এই হঠাৎ আগমন আর হঠাৎ প্রস্থানে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো কিয়ৎক্ষণ, তারপর একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে তড়িঘড়ি করে আবার হাত লাগালো কাজে।
আনাবিয়া হলরুমের দরজায় দুবার নক দিয়ে অতঃপর এক ধাক্কায় খুলে ভেতরে ঢুকে চেচিয়ে ডাকলো,

“কোকো!”
কোকো সবে ঘুমিয়েছিলো, আনাবিয়ার চিৎকারে লাফিয়ে উঠে পড়লো ও। কামরায় শুধুমাত্র আলফাদ ছিলো, ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পড়লো সেও। বড় বড় চোখ করে ওরা দুজন দেখতে লেগে গেলো আনাবিয়াকে। এখনো পর্যন্ত আনাবিয়া ওদের এই কামরায় আসেনি কোনোদিন, আজ হঠাৎ এমন সক্কাল সক্কাল তিনি কি মনে করে এটাই ঘুম ঘুম চোখে ভেবে চললো ওরা। কোকো চোখ কচলে তোতলানো গলায় বলল,
“জ্‌-জ্বী আম্মা, ব্‌-বলুন।”
আনাবিয়া সবগুলো বিছানায় চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“লিও কোথায়?”
“ওয় গিয়ে লিন্ডার সাথে ঘুমুচ্ছে।”
বিরস গলায় উত্তর করলো আলফাদ।
“আর ফ্যালকন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফ্যালকনের বিছানা ফাঁকা দেখে ভ্রু উঁচিয়ে শুধোলো আনাবিয়া। আলফাদ উত্তর করলো,
“ওর বর্ডার পাহারা দেওয়ার পালা পড়েছে শেহজাদী, ও কাঞ্জি আর ওকামি বর্ডারে আছে। পরশু চলে আসবে৷”
“জোভী কোথায়?”
“ওর গার্লফ্রেন্ড প্রেগন্যান্ট। আপনি আজ কদিন অনেক ব্যাস্ত ছিলেন, আর অনেক ঝামেলা গেলো বলে আপনাকে ও জানায়নি। ওরা নতুন বাসা করছে অ্যানিম্যাল টাউনের পাশে। হয়তো দ্রুতই মহল থেকে ও সেখানে শিফট হবে৷”
বলল কোকো। আনাবিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভেবে নিয়ে বলল,

“ঠিক আছে। দ্রুত তৈরি হবি তোরা দুজনে, আমাদের বেরোতে হবে। ফোন যেন সম্পূর্ণ চার্জড থাকে, মহলে ফিরতে দেরি হবে৷ ফাতমা নাশতা তৈরি করছে, সম্ভবত শেষ পর্যায়ে। খেয়েই বের হবো।”
বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো আনাবিয়া। তারপর নিজের কামরায় গিয়ে সোজা ঢুকলো গোসলে।
কোকো কিছুটা আঁচ করতে পারলেও কিছুই না জানা আলফাদ কোকোর দিকে অবুঝ, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় শুধোলো ব্যাপার টা কি?
কোকো দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো সেও কিছু জানেনা। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে দুজনেই বিছানা ছেড়ে উঠে লেগে গেলো রেডি হতে।

হাটতে হাটতে তিনজনে এগোচ্ছে ওরা লাইফ ট্রির দিকে। আনাবিয়া সামনে, কোকো আর আলফাদ পেছনে। আনাবিয়া যেদিকে যাচ্ছে চুপচাপ দুজন সেদিকে এগোচ্ছে। আনাবিয়ার পরণে কালো রঙা ওভার সাইজ হুডি আর ট্রাউজার, ট্রাউজারের দুদিকে ভার্টিক্যালি দুইটা সাদা রঙা চওড়া স্ট্রাইপ দেওয়া। পায়ে সাদা রঙা হাইকিং শু। সাদা রঙা চুলগুলো উঁচু পোনিটেল করে বেধে রাখা। পিঠে ব্যাকপ্যাক।
কোকোর পরণে সাদা শার্ট, ফর্মাল ফর্মাল ভাইব দিচ্ছে সে। এদিকে আলফাদ তাড়াহুড়োয় একটা টি শার্ট গায়ে দিয়ে এসেছে, অর্ধেক রাস্তায় এসে টের পেয়েছে ওর টি শার্টের বগোল ছেড়া। এটা নিয়ে এখন ওর দুঃখের শেষ নেই। যদিও কোকো বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছে যে ও জায়গা কেউ উঁকি মেরে দেখবেনা, দেখার মতোন কেউ নেই আশেপাশে। তবুও আলফাদের দুঃখ কমছে না।
তিনজনে মিলে লাইফট্রির কাছে পৌছলো ওরা, আনাবিয়া লাইফট্রির কাছে গিয়ে নিজের হাত ছোয়ালো লাইফট্রির ওপর, ছোয়াতেই নড়েচড়ে উঠলো লাইফট্রি। নিজের ছোট ছোট ফুল ওয়ালা নরম ডালগুলো দিয়ে লিখলো একটি বার্তা,

“হোয়াট ড্যু ইয়্যু ওয়ান্ট, মা’ সুয়্যিট লিটল বেইবি গার্ল?”
“আ’ ওয়ান্ট অ্যা ফ্যুল ম্যাপ অব দ্যা রেড জোন।”
বলল আনাবিয়া, লাইফট্রি ওর ছোট ছোট ডালগুলো একিয়েবেকিয়ে মুহুর্তেই তৈরি করে ফেললো একটা ম্যাপ। আনাবিয়া ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফটো তুলে নিলো তার একটা। তারপর এগোলো জঙ্গলের গভীরে যাওয়ার পথে।
ওর পেছন পেছন এগোতে এগোতে কোকো প্রশ্ন করলো,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি আম্মা?”
“ডার্ক প্যালেস।”

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। রেড জোনের ভেতরের উঁচু উঁচু প্রকান্ড গাছগুলোর ফাঁক গলিয়ে ম্যাপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে আনাবিয়া, ওর পেছন পেছন রোবটের মতোন এগোচ্ছে কোকো আলফাদ৷
এদিকে ওরা আগে কখনো আসেনি, এদিকে আসার প্রয়োজনই পড়েনা ওদের। এদিকে কোনো প্রাণী থাকেনা বললেই চলে। থাকার ভেতরে আদিম পশু গুলো এদিকে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়। সভ্য গুলো সচারাচর এদিকে আসেনা।
আলফাদ কোকো চারদিকে দেখতে দেখতে এগোলো। গাছের শেকড়গুলো মাটির ওপর জালের মতোন এঁকেবেঁকে ছড়িয়ে আছে। কালচে বেগুনি আর কালোর মিশেলের পাতাগুলো সূর্যের লাল আলোয় ঝকমক করছে। একমাত্র হাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই এদিকে।

এক ঝাঁক ছোট্ট লেজ ওয়ালা গোলগাল ঝাকড়া পশমের ঝিলমিলে প্রাণী লাফিয়ে চলেছে উঁচু গাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায়, মুখ থেকে কিটি কিটি জাতীয় শব্দ করছে ওরা। কোকো আলফাদ মাথা উঁচিয়ে দেখলো ওদের, ফ্লাফি বলের মতোন লাফাতে লাফাতে পর পর ছুটে চলেছে এ গাছ থেকে ও গাছে।

আনাবিয়াদের পায়ের শব্দে গাছের গায়ে লুকিয়ে থাকা একদল গোলুমোলু কাঠবিড়ালির মতোন প্রাণীরা হুটোপুটি শুরু করলো গাছ জুড়ে, পালিয়ে চলল অন্য কোনো গোপন জায়গা খুজতে। পালিয়ে যাওয়ার সময় অতিরিক্ত ঠেলাঠেলির কারণে টাল সামলাতে না পেরে উপর থেকে একটা ধাম করে পড়লো কোকোর সামনে, আরেকটু হলেই কোকোর পায়ের তলে পড়ে পিষে যেতো, কিন্তু শেষ মুহুর্তে কোকো ওর পা খানা কোনো রকমে সরিয়ে অন্য দিকে নিলো।
কাঠবিড়ালিটা নিচে এত আজব লম্বা লম্বা দু পেয়ে প্রাণীদের ভেতরে পড়ে ভয় পেয়ে দ্রুত জিভ খানিকটা বের করে চার হাত পা ছড়িয়ে মরার ভান ধরে স্ট্যাচু হয়ে পড়ে রইলো। তার পর আবার কি মনে করে উঠে ছোট্ট হাতখানা দিয়ে পাশ থেকে একটা শুকনো পাতা উঠিয়ে নিজের গায়ের ওপর দিয়ে নিজের মৃত্যুটাকে আরও রিয়্যালিস্টিক করার চেষ্টা করে আবার জিভ বের করে স্ট্যাচু হয়ে গেলো। ওর আত্মীয় স্বজনেরা পাতার আড়াল থেকে চুপচাপ দেখতে রইলো ওকে।

কোকো আলফাদ ওর এমন ফাটাফাটি অভিনয় দেখে শব্দ করে হাসলো একবার। আলফাদ জুতার আগা দিয়ে একটা গুতা দিলো সেটাকে, তবুও সে নড়ার নাম নিলোনা। আলফাদ কোকোর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“এটাকে হলিউডে দিয়ে আসি চলো ভাইজান।”
কোকো ওর মাথায় একটা চাটি মেরে এগোতে বলে নিজেও এগোলো সামনে।
ম্যাপ দেখতে দেখতে ক্রমশ ঘন জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়লো ওরা, কিন্তু ম্যাপ অনুযায়ী ডার্ক প্যালেসের অবস্থান পর্যন্ত পৌছেও ডার্ক প্যালেসের কোনো হদীসই পেলোনা। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই যে সেখানে কিভাবে যেতে হবে, কোন পথে যেতে হবে৷ আনাবিয়া বেশ অনেকবারই এইখান দিয়ে গেছে, এসেছে। কিন্তু ডার্ক প্যালেস যে এখানেই থাকতে পারে সেটা ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি।

কিছুক্ষণ ম্যাপের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আনাবিয়া কোকো আলফাদকে বলল,
“তোরা দু’জনে এই এরিয়ার মাটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করবি। প্রতিবার শব্দ করে পা ফেলে ভূমির সাউন্ড লক্ষ্য করবি, যেই মুহূর্তে মাটি ফাঁপা সাউন্ড দেবে আমাকে জানাবি। আমি আশেপাশেই থাকছি।”
বলে ম্যাপটা দেখতে দেখতে আনাবিয়া চলে গেলো ভেতরের দিকে৷ কোকো আর আলফাদ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে অতঃপর আর্মিদের মতোন মার্চ করে করে হাটতে শুরু করলো বিভিন্ন দিকে, দুড়ুম দাড়াম শব্দ করে হাটতে হাটতে দেখতে লেগে গেলো কোথাও কোনো শব্দ আসে নাকি।
ম্যাপে চোখ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ এক স্থানে চোখ আটকে গেলো আনাবিয়ার, ডার্ক প্যালেসের আশেপাশেই কোথাও কোনো স্থানের নাম ডার্ক ফরেস্ট। কিন্তু এমন কোনো নাম সে আগে শুনেছে বলে মনে পড়লো না। ম্যাপ ধরে ধরে ডার্ক ফরেস্টের দিকে এগোতে নিলো ও, কিন্তু কয়েক পা এগোনোর পরেই ডার্ক প্যালেস এরিয়া থেকে ভেসে এলো কোকোর কন্ঠস্বর,

“আম্মায়ায়ায়ায়া, পেয়ে গেছিইইই।”
“আসছিইই”
আনাবিয়া ডার্ক ফরেস্টে যাওয়ার রোডের দিকে একবার তাকিয়ে দোনোমনা করে আবার ফিরে গেলো ডার্ক প্যালেস এরিয়ার দিকে।
এসে দেখলো কোকো আর আলফাদ দুজনে বুকে হাত বেধে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে ওর অপেক্ষায়। ওকে দেখা মাত্রই বলে উঠলো,
“আম্মা এখান থেকে ফাঁপা সাউন্ড আসছে না, কিন্তু মেটালিক সাউন্ড আসছে।”
আলফাদ দুবার লাফিয়ে দেখিয়ে দিলো কেমন শব্দ আসছে। আনাবিয়া একবার সে স্থানটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এখান থেকে মাটি সরিয়ে ফেলে দে কোকো।”

কোকো শুধু ওর হাত জোড়া ট্রান্সফর্ম করে নিজের ধারালো কুমিরিয়ান নখ দিয়ে শুরু করলো মাটি সরানোর কাজ। আনাবিয়া বসে পড়লো পাশের সবুজ ঘাসের ওপর।
শক্ত হয়ে যাওয়া ঘাস যুক্ত মাটি সরাতে সরাতে একসময় কোকোর নখ ঠেকলো কোনো ধাতব পাতে। হাতের থাবার সাহায্যে মাটিগুলো সরাতেই একটা মোটা লোহার পাত উঁকি দিল সেখানে। বড়সড়, পুরনো একটি ধাতব দরজা, মরিচা ধরে গেছে সামান্য, গায়ে তার অদ্ভুত নকশার খোদাই। দরজার ঠিক মধ্যিখানে একটা হাতের নকশা আঁকা, যেখানে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অক্ষরে লেখা,

“অনলি দেমিয়ানস।”
কোকো সেটা দেখে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া ঝুঁকে এলো দেখতে। দরজার ওপর হাতের ছাপ দেখে ও কোনো কিছু না ভেবেই নিজের ডান হাতখানা দিলো চিহ্নের ওপর।
হাত রাখতেই মৃদু মেটালিক শব্দ করে ধাতব দরজার সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো কাঁপুনি, দীর্ঘশ্বাস ফেলার ভঙ্গিতে জেগে উঠলো যেন সে।
তারপরেই আনাবিয়ার হাতের চতুর্দিক থেকে হঠাৎ বিচ্ছুরিত হতে শুরু করলো নীলচে উজ্জ্বল আভা। দরজার গায়ে খোদাই করা লতাপাতার ন্যায় নকশা বেয়ে সে নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়লো প্রতিটি চিহ্নে। ছাপের নিচ থেকে বের হওয়া আলোর ফোয়ারা আনাবিয়ার হাত স্পর্শ করে লতার ন্যায় একিয়ে বেকিয়ে উঠে গেলো বাহু পর্যন্ত, দরজাটি যেন চিনে ফেলেছে তাদের শেহজাদীকে!

আর এরপরেই সমস্ত আলো দপ করে নিভে গিয়ে শব্দ করে দরজাটা খুলে সরে গেলো দুদিকে, ওদের সামনে উন্মুক্ত হলো একটি অন্ধকার গহবর।
কোকো উঁকি মেরে দেখলো ভেতরে, একটা কংক্রিটের সিঁড়ি নেমে গেছে অনেক অনেক নিচে। ভেতরের বাতাস ভারি, একটা গুমোট স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ঘুর্ণি পাকিয়ে উঠে আসছে ভেতর থেকে। ঘোলাটে কুয়াশা যেন চারদিকে, কিছুই দেখবার জো নেই!
“তোদের ভেতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তোরা এখানেই অপেক্ষা কর।”

বলে আনাবিয়া প্রস্তুতি নিলো সিড়ি বেয়ে নামার, কিন্তু তার আগেই কোকো বিরোধিতা করে বলে উঠলো,
“একদমই নয় আম্মা! আপনি একা একা ভেতরে কিভাবে যাবেন? ওখানে কি কি থাকতে পারে সেটার কি কোনো আইডিয়া আছে? আপনার একদম একা যাওয়া চলবেনা আম্মা, আমিও যাবো।”
কোকোর দেখা দেখি আলফাদও কিছুটা ইতস্তত স্বরে বলল,
“ত্‌-তাহলে আমিও যাবো শেহজাদী।”
আনাবিয়া ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
“সবাই নিচে গেলে এখানে কে থাকবে শুনি?”
কোকো আনাবিয়ার কথা শুনে এদিক ওদিক তাকালো, দূরেই একটা নেকড়ে কে মাটি শুকতে শুকতে কোথাও যেতে দেখে ও শিষ বাজিয়ে ডাকলো,

“হোই ন্যাকু।”
কোকোর গলা শুনে দূর থেকেই চমকে তাকালো সে, এদিকে ওদিক তাকিয়ে খুজতে লাগলো কন্ঠস্বরের মালিককে। কোকো কিছুক্ষণ সেন্টি খাওয়া মুখ করে নেকড়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধৈর্য হারা হয়ে বলল,
“হোই এদিকে আমি, কানাসো……!
শেষোক্ত সম্বোধন টা শেষ করার আগেই খেয়াল এলো ওরা আজ একা না, সাথে আজ ওর আম্মা আছে৷ তড়িতে থেমে গিয়ে তাকালো ও আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া কটমটে চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে কোকো মনে মনে জিভ কাটলো, তারপর মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ।
নেকড়ে টা ছুটে এলো এদিকে। এসেই হিউম্যান ফর্মে ট্রান্সফর্ম হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ও। এতক্ষণ আনাবিয়াকে তার চোখে বাধেনি, দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই হতভম্বের ন্যায় কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আনুগত্য জানানোর ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো। কোকো ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল,

“ন্যেকু তুই এখানে পাহারা দিবি, আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত নড়বিনা। ঠিকাসে?”
নেকড়েটা তড়িতে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। আর তার পরেই আনাবিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে, ওর পেছন পেছন কোকো আর আলফাদও নামলো।
অনেক নিচে নামার পর অবশেষে শেষ হলো সিঁড়ি। অন্ধকারের কারণে কিছু সময় কোকো আলফাদ কিছুই দেখতে পেলোনা। কিছুক্ষণ আঁধার চোখ সওয়া হয়ে এলেই ওরা চারদিকে চোখ বুলিয়ে চলল।
আনাবিয়া স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিজের স্থানে, ওর চোখ আটকে আছে সম্মুখের একটি দরজার ওপর। দরজার ভেতর এসে আবার দরজা!
বিশাল চওড়া ধাতব দরজার ওপর পাথর খোদাই করে দেমিয়ান রাজপরিবারের চিহ্ন অঙ্কিত, নীলচে আলো টিকরে বের হচ্ছে পাথরটি হতে। দরজার ওপর একটা বিরাট তালা ঝোলানো।

এগিয়ে গেলো আনাবিয়া, ওর পেছন পেছন কোকো আলফাদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এগোলো।
আনাবিয়া বিশাল তালাটার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে তালাটাকে দেখলো কিছুক্ষণ। কালো রঙা, মোটা, শেকলের মতোন আঁকাবাঁকা কোনো ধাতবে মোড়ানো। তালার শরীর জুড়ে অদ্ভুত খোদাই।
নিজের অজান্তেই আনাবিয়া হাত বাড়ালো তালার দিকে, ধীরে ধীরে ওর হাত এগোলো তালার নিকট। শুভ্র, সরু আঙুল গুলো তালার ওপর ছোয়াতেই মুহুর্তে তালার সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো বিদ্যুৎরেখার মতনো নীল রঙা স্নায়বিক নকশা! চকমকে নীল আলোর রেখা গুলো তালার গায়ে ছড়িয়ে যেতে যেতে একসময় সমস্তটা কেন্দ্রে এসে জমা হয়ে হঠাৎই থেমে গেলো। এরপর অকস্মাৎ ভীষণ জোর কাঁপা শুরু করলো সেটা, কাঁপতে কাঁপতে আচমকা ফাটল ধরলো তাতে!

শক্তিশালী কাঁপুনির প্রভাবে একটু একটু করে তালাটি ফেটে যেতে লাগলো যেন, চিড় চিড় শব্দ হতে লাগলো কিছুক্ষণ পর পর। কিন্তু ওরপর হঠাৎই তালাটা ভয়ানক জোরে কাঁপা-কাঁপি শুরু করলো।
কোকো আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে সরে যেতে চাইলো পেছনে, ধাতব তালাটা ভেঙে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লে মারাত্মক জখম হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। কিন্তু টেনেও আনাবিয়াকে একচুল সরাতে পারলো না কোকো, বিপরীতে আনাবিয়া শরীর ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো ওকে।
আর এরপরেই এক ভয়াবহ, বিস্মৃত বিকট ধ্বনি তুলে তালাটি ছিন্নভিন্ন হয়ে বিস্ফোরিত হলো, ধাতব কণা গুলো বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। শুধুমাত্র আনাবিয়াকে ধাতব টুকরো গুলোর একটি কণাও স্পর্শ করলো না৷ ওর শরীর স্পর্শ করার আগেই বাতাসের সাথে ধুলোর মতো মিলিয়ে গেল তা!

তালার সমস্ত চিহ্ন অদৃশ্য হতেই চওড়া দরজাটা ধাম শব্দ করে তড়িৎ গতিতে খুলে সরে গেলো দুদিকে। ভেতর থেকে গুমোট গন্ধ ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো সাথে সাথে৷ ঘন অন্ধকার সামনে, এক ফোটা আলোর অস্তিত্ব নেই কোথাও!
কিছুক্ষণের জন্য থমকালো আনাবিয়া, এর ভেতরে গেলে কি কি দেখতে হবে সেটা একবার ঝালাই করে নিলো মস্তিষ্কে। কিছুদিন আগেই ডার্ক প্যালেস নিয়ে সামান্য পড়াশোনা করেছে ও। খুব বেশি ইনফরমেশন পাওয়া যায়নি, যেটুকু ওর লাইব্রেরিতে ছিলো সেটুকুই।
ডার্ক প্যালেসের সমস্তটা গ্রেডে বিভক্ত। আসামী দের করা কৃতকর্মের ভার অনুযায়ী নির্ধারিত এই গ্রেড। লোয়ার গ্রেড, মিডিয়াম গ্রেড, আপার গ্রেড। এই তিনটেই আবার আরও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। আনাবিয়া অতোটা বিস্তারিত তথ্য জানতে পারেনি।

সর্বপ্রথমেই লোয়ার গ্রেড। এখানের সকল কম গুরুত্বপূর্ণ আসামীদের অবস্থান এই গ্রেডে। এই চওড়া সুড়ঙ্গপথ যতই গভীরে যাবে আসামীদের গ্রেড ততই বাড়বে৷ প্রত্যেকটি কুটিরে আলাদা আলাদা অপরাধী, একত্রে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
পাথরের দেয়ালের ভেতর স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি কুঠুরি গুলোর ভেতর শিকলবন্দি সব রাজ বন্দি, রাজদ্রোহী। তারা হয়তো কখনো সাম্রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ছিলো। কিন্তু এখন তাদের ঠিকানা শুধুই এই অন্ধকারের সাম্রাজ্য। সারাজীবনে আর কখনোই সূর্যালোক দেখা হবেনা তাদের৷
এই গোপন নগরের ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরির মতোন কারাগারগুলো অপরাধী দের নিকট একটি জাহান্নামের ন্যায়। এই সূর্যালোক বঞ্চিত অদ্ভুত কাঁচের চার দেয়ালের বন্দিশালায় পিনপতন নিরাবতার ভেতর টিকে থাকার মতোন ভয়াবহ শাস্তি আর কি হতে পারে? চারদিকে, প্রতিটা কামরায় এক একটি প্রাণ, কিন্তু দুটো কথা বলার মতোন কেউ নেই, কেউ না। হাজার চিৎকার, হাজার আর্তনাদ সকলই বৃথা। এই কাঁচের দেয়াল ভেদ করে একটা শব্দ কণাও বাইরে বের হতে পারে না যে!

আনাবিয়া বুক ভরে দম নিলো একটা। আর তারপর পা বাড়ালো সামনের দিকে। দরজার চৌকাঠ ডিঙিয়ে সামনে পা রাখতেই কেঁপে উঠলো সমস্ত ডার্ক প্যালেস!
পা ফেলার স্থানে মাটি ফুড়ে বেরিয়ে এলো নীলচে গোলাপি রঙা আলোর বাহার! সাথে সাথেই হাজার বছর ধরে নিস্তব্ধ থাকা ডার্ক প্যালেস যেন প্রাণ ফিরে পেলো। চারপাশের নীরবতা ভেদ করে আনাবিয়ার পায়ের নিচ থেকে অদ্ভুত শব্দ করে বেরিয়ে এলো লতাপাতার নকশা, দেয়াল জুড়ে সেগুলো ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ছুটে চলল আলোর ফোয়ারা নিয়ে! আলোকিত হতে লাগলো ডার্ক প্যালেসের প্রত্যেকটি ধাতব ইট, প্রতিটি শিকল, প্রতিটি বন্ধ কুঠুরি। পাথরের আড়ালের মৃত মাটির ফাঁক ফোকড় থেকে ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো রঙিন ক্ষুদ্র ফুল, অদ্ভুত আলোর কণা শিহরণ জাগিয়ে তুললো তাদের রঙীন পাপড়িতে। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে করিডোরের বাতাস কেঁপে উঠলো এই অদ্ভুত সুন্দর আলোর হঠাৎ আক্রমণে৷

আলোর রোশনাইতে বাতাসে ভেসে উঠলো ডার্ক প্যালেসের হাজার হাজার অর্ধ মৃত বন্দি দের দীর্ঘশ্বাস। কে এল? যার উপস্থিতিতে অন্ধকারেরও আর আঁধারে মুড়ে থাকার সাহস নেই! কার স্পর্শে এই মৃত নগরীর হৃদয় প্রাণ ফিরে পেয়ে আবার ধুকধুক করতে শুরু করলো?

আনাবিয়া আরেক পা বাড়াতেই দূরের অন্ধকার ছায়া হতে ছুটে বেরিয়ে এলো ধাতব আর্মরে মোড়া গার্ডের ঝাঁক। হঠাৎ এই মৃত্যুপূরীতে কে এলো? কে ভেদ করলো ওই কঠিন দরজা? বাদশাহ জাজীব ইলহান দেমিয়ান এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সম্পুর্নটা স্যিল করে দিয়ে গেছিলেন, শুধু বছরান্তে রেশন ছাড়া এখানে আর কিছুই আসেনা, তবে? তবে এই আলোর ফোয়ারা, এই শুভ্র রমনী কিভাবে এখানে প্রবেশ করলো?
গার্ড গুলো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ছুটে এসে থমকে দাঁড়ালো আনাবিয়ার সম্মুখে, ওই হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখ জোড়া দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো ক্ষণকালের জন্য। বুঝতে আর বাকি রইলোনা তিনি কে। তবুও গার্ড গুলো দাঁড়িয়ে রইলো, মাথা নুইয়ে আনুগত্য জানালো। ঢোক গিলে একজন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“শেহজাদী, এখানে আপনার প্রবেশের অনুমতি নেই। ডার্ক প্যালেসে কোনো শেহজাদীরই প্রবেশের অনুমতি নেই! দয়া করে ফিরে যান!”

আনাবিয়া তাকিয়ে ছিলো সম্মুখে, সামনের অন্ধকারের ভেতর ঢুকে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তার দিকে। যার ওপরে বড় বড় করে লেখা মিড-লোয়ার গ্রেড, যার দুপাশের দেয়াল জুড়ে পাথর বাধিয়ে বানানো কুঠুরি গুলোর ভেতরটা কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করে রাখা৷

গার্ডটির কথা শোনা মাত্রই ঝটিতে ফিরে তাকালো ও তার দিকে। ওর তীক্ষ্ণ, শীতল, হিংস্র দৃষ্টিতে গার্ড গুলো জমে গেলো যেন সেখানেই। মাথা নুইয়ে দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ধীর পায়ে ওরা সরে দাড়ালো আনাবিয়ার সামনে থেকে।
আনাবিয়া ধীর পায়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এগোলো সামনে, ওর প্রতিটি পদক্ষেপে আলো টিকরে পড়লো পাথর ফুড়ে। আশেপাশের সমস্ত কাঁচের কুঠুরি গুলোতে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝকমক করতে শুরু করলো। বহুবছর পর আলোর দেখা পেয়ে চোখ কুচকে ফেললো সেখানের বন্দী থাকা অপরাধী গুলো। তাদের কুঠুরির ভেতর ঢুকে পড়লো আনাবিয়ার উপস্থিতির প্রভাব, দেয়াল জুড়ে ফুটে উঠলো হরেক রঙা সুগন্ধি ফুলের বাহার! অবাক নয়নে তারা দেখতে লেগে গেলো এই অসাধারণ দৃশ্য, এত গুলো বছর পর নিজেদের অন্ধকারে পঁচে যাওয়া, ঘুণে ধরে যাওয়া দৃষ্টিতে এই রঙের বাহার দেখে ওরা স্তব্ধ হয়ে পড়ে রইলো!

আনাবিয়া হেটে চললো সামনে, সমস্ত ডার্ক প্যালেসকে আলোকিত করে তুলতে তুলতে। ও জানে এখানে আসার অনুমতি ওর নেই, ও এখানে প্রবেশ করা মানেই এই ডার্ক প্যালেস আর ডার্ক থাকবে না, হয়ে যাবে আলোকিত, অত্যন্ত আরামদায়ক!

তবুও এগোলো আনবিয়া, একটা দিনে না হয় অপরাধী গুলো একটু স্বস্তি পেলো! আনাবিয়া ওর ঝকমকে চোখে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সবকিছু। ঠিক যেন ধাতব ফ্রেমের কোনো গোপন শহর। সমস্তটা পাথর আর ধাতব পাতে গড়া।
কুঠুরির কাঁচের দেয়ালগুলো থেকে ভেসে আসছে এক অদ্ভুত গন্ধ। ও বইয়ে পড়েছে, এ কাঁচে মেশানো এক অদ্ভুত অজানা ধাতু, যেটা বন্দিদের শরীর থেকে তাপ শুষে নেয়। দুর্বল শরীর টাকে করে ফেলে আরও দুর্বল।
আনাবিয়া দৃষ্টি দিলো চারদিকে, ওর গন্তব্য এই ডার্ক প্যালেসের সর্বশেষ স্তর, রয়্যাল গ্রেডে। ওর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো এতদিন ধরে শেকলে আচ্ছাদিত হয়ে ঠান্ডা মেঝেতে বসে থাকতে থাকতে হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়া বন্দী গুলোর!

শক্ত বন্ধনীর কারণে সামান্য নড়াচড়ার অবকাশ নেই তাদের। চব্বিশ ঘন্টায় পাঁচ মিনিটের জন্য একবার খুলে দেওয়া হয় তাদের বাধন, ওই পাঁচ মিনিটেই তাদের যাবতীয় কাজ যাবতীয় প্রয়োজন সারার সময়৷ বাকি সমস্ত সময় একই স্থানে একই ভঙ্গিতে কঙ্কালসার শরীর নিয়ে স্থীর হয়ে বসে থাকা।
কখনো কখনো কারো কারো গলা থেকে উঠে আসে অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে যে শব্দটা তারা বের করে নিজেদের যন্ত্রণার পরিমাপ বোঝানোর জন্য!
বন্দিদের নাম, অপরাধ আর শাস্তির কাল লিপিবদ্ধ করা প্রতিটা দরজার সম্মুখে, ঠিক কবে থেকে সে এই ঠান্ডা নরকে আছে সেটা যেন মানুষ জানতে পারে।

কোনো কুঠুরিতেই নেই কোনো আলো, শুধু মাথার উপর ঝুলে আছে একটি নিঃসাড় নীল রঙা চোখের ন্যায় সিসি ক্যাম। বন্দির ওপর সর্বক্ষণ এক দৃষ্টিতে নজর রেখে যায় সেটা।
নিজের উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়াতে ছড়াতে কাঁচের ভেতর উঁকি দিয়ে আনাবিয়া উৎসুক, আনন্দিত চিত্তে দেখে চলল আসামী গুলোকে। যেগুলো বেঁচে আছে সবগুলোই কোনো না কোনো দিনে মীরের আদেশে বন্দি হয়েছে। তাদের কারো হাত নেই, কারো নেই পা, কারো নেই জিভ, কারো নেই অন্য কোনো অঙ্গ, কারো ঠোঁট জোড়া এফোড় ওফোড় সেলাই করে দেওয়া হয়েছে চিরতরে! কেউ অন্ধ, কেউ বধির, কেউ মূক! যার যে অঙ্গ দিয়ে অপরাধ সংঘটিত হয়ে ছিলো তার সেই অঙ্গই বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে শরীর হতে। কাঁচের ওপর দিয়ে দৃশ্যমান হচ্ছে তাদের আবছা অবয়ব। ভেতরে শেকল বাধা অবস্থায় পড়ে আছে মুমূর্ষু হয়ে।

গার্ড দেওয়ার জন্য এখানে যে গুলোকে রাখা হয়েছে তারা নিজেরাও অপরাধী। গার্ড দেওয়ার জন্য অপরাধীদের ভেতরের সবচেয়ে বাঘা বাঘা গুলোকে বেছে নেওয়া হয়, বেতন স্বরূপ তাদেরকে শেকল বন্দী জীবন থেকে অব্যাহতি আর অন্যান্য অপরাধী দের থেকে কিছুটা আরাম আয়েস দেওয়া হয়।
কোকো আলফাদ লোয়ার গ্রেডের গার্ড গুলোর ভেতর থেকে একজনকে নিজেদের সাথে ধরে নিয়ে এসেছে যেন কোথায় কি আছে জানতে ওদের সুবিধা হয়, গার্ডটি চুপচাপ এতক্ষণ এগোচ্ছিলো কোকো আলফাদের মাঝে।
কিছুদূর এগোতেই মিড গ্রেডের ভেতর ঢুকে পড়লো ওরা। ওদেরকে দেখা মাত্রই মিড গ্রেডের দায়িত্বে থাকা এক ঝাঁক গার্ড ছুটে এলো ওদের দিকে, হাতে তাদের অস্ত্র। ছুটে এসে ওরা আগলে দাড়ালো আনাবিয়ার পথ। পেছনেই নিজেদের সঙ্গীদের একজনকে জিম্মি দেখে কোনো কিছু না ভেবেই দূর থেকে ট্রিগার উঁচিয়ে ধরলো ওরা আনাবিয়ার দিকে। চেচিয়ে বলল,

“আর এক পাও এগোবেনা, যেখানে আছো সেখানেই থাকো। আর লোয়াল গ্রেডের গার্ডটাকে ছেড়ে দাও এখুনি, নইলে আমরা শ্যুট করতে বাধ্য হবো!”
আনাবিয়া ওদের কথা শুনে নির্বিকার মুখে নিজের তীক্ষ্ণ ভ্রু জোড়ার একটি তাচ্ছিল্য ভঙ্গিতে উঁচু করলো মাত্র!
কোকোদের সাথে থাকা গার্ডটি এদের নির্বুদ্ধিতা দেখে হতাশ হলো। এখানে এমন অনেক আসামী আছে যাদের শেহজাদী সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাই নেই, ওরা জানেও না সে কেমন! তবুও এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখেও তো তাদের বোঝা উচিত ছিলো! এদের জান বাঁচানোর জন্য গার্ডটি দ্রুত চেচিয়ে সাবধানী স্বরে বলল,
“প্রাণ খোয়াতে না চাইলে অস্ত্র নামাও এক্ষুনি! সরে যাও সামনে থেকে। আমাদেরকে যেতে দাও!”
কিন্তু ছেলে গুলো তা করলো না। জিম্মি গার্ডটি ভয় পাচ্ছে ভেবে আরও শক্ত হাতে নিজেদের অ্যাসল্ট রাইফেল গুলো ধরে রইলো, ট্রিগারে আঙুল রেখে নিশানা করে অল্প অল্প এগোতে এগোতে আনাবিয়াকে উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বলে উঠলো,

“প্রাণে বাঁচতে চাইলে লোয়ার গ্রেডকে আমাদের হাতে দিয়ে বেরিয়ে যাও এই মুহুর্তে! আমরা কিছুই বলবোনা৷”
আনাবিয়া ঠোঁটের কোণা বাকিয়ে হাসলো সামান্য। কোমরে ঢেউ তুলে ওদের দিকে এগোলো কয়েক পা। ও এগোতেই গার্ডদের চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো হঠাৎ! আনাবিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে বাতাস যেন আরও চেপে ধরলো ওদের, বেড়ে যেতে লাগলো ওদের হৃদপিণ্ডের গতি, দুড়ুম দুড়ুম শব্দে লাফাতে লাগলো সমস্ত শিরা ঊপশিরা, ঘেমে যেতে লাগলো শরীর!

আনাবিয়া তার অদ্ভুত রকমের শীতল, ধ্বংসাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগোলো আরও, যেন শুধুমাত্র এই চোখ দুটোই সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে যথেষ্ট, কোনো অস্ত্রের প্রয়োজনই নেই তার! ঠোঁটে তখনো ফুটে রইলো মৃদু বাকা হাসি।
গার্ড গুলোর হাত কাঁপলো, ট্রিগারে আঙুল রাখা অসম্ভব হয়ে দাড়ালো তাদের জন্য। কারো কারো হাত শিথিল হয়ে এলো, অস্ত্র গুলো হাত গলিয়ে নিজে থেকেই শব্দ করে পড়ে গেলো নিচে। অন্য যারা তখনো অস্ত্র তুলে রইলো তাদের আঙুল গুলো হয়ে রইলো অসাড়! যেন ভুলে গেলো কীভাবে ট্রিগার চাপতে হয়।

অতিরিক্ত চাপে হাঁপাতে শুরু করলো সবকজন, এমন ভয়ানক চাপে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো তাদের! শব্দ করে অস্ত্র ফেলে দিয়ে একে একে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়লো তারা। এক জন, শুধুমাত্র একজন তখনো হাটু শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো অস্ত্র হাতে। হাঁত জোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার।
আনাবিয়ার হাসি চওড়া হলো, ধীরে ধীরে সে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়া গার্ডগুলোর মাঝ দিয়ে নির্বিকার চিত্তে হেঁটে এগিয়ে গেলো সামনে, তখনো দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডটিকে অতিক্রম করার সময়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে উঠলো,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯

“গ্যুড জব, ক্যিপ ইট আপ।”
তারপরেই পা বাড়িয়ে চলে গেলো আপার গ্রেডের দিকে। কোকো আলফাদ জিম্মি গার্ডটিকে সাথে নিয়ে এগোলো ওর পেছন পেছন। ওরা চলে যেতেই দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডটা জ্ঞান হারিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলো নিচে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here