বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২
রানী আমিনা

মহলের বিরাট রোয়াকে দাঁড়িয়ে ভীষণ চিন্তিত, অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে লিও আর হাইনা। গতকাল সকাল থেকে শেহজাদী সহ কোকো আলফাদ নিখোঁজ! এখন বেলা দুপুর গড়াতে চলল তাদের কোনো খোঁজ নেই, ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কাউকেই। সবারই ফোন আউট অব রিচ৷
সিড়ির ওপর সার দিয়ে আছে বাকিরা, জোভি খবর পেয়ে ওর প্রেমিকাকে সাথে নিয়েই চলে এসেছে। ফ্যালকন, কাঞ্জি, ওকামি দের জানানো হয়েছে, ওরা ফিরছে। লিন্ডার চোখে পানি, সে ফাতমা কে জড়িয়ে বসে আছে সিড়ির এক কোণায়। শার্লট বসে আছে ব্রায়ানের কাছ ঘেঁষে।
ওরা গতকাল সকালে বেরিয়েছে, কোথায় গেছে বলে যায়নি। এমনটা হয়নি কখনোই, কেউই ফোন তোলেনি এমনটা খুব কমই হয়েছে। ফোন তোলা যেমন তেমন আউট অব রিচ বলছে। তবে কোথায় গেলো ওরা!
পায়চারি করতে করতে লিও চিন্তিত সুরে বলে উঠলো,

“এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না হাইনা, আমাদেরকে বেরোতে হবে। এমনও তো হতে পারে শেহজাদী কোনো বিপদে পড়েছেন! আলফাদ কোকো ভাইজান হয়তো তাকে ফেলে আসতে পারছেনা। বা তারাই কোনো বিপদে পড়েছে, শেহজাদী তাদের ফেলে আসতে পারছেন না! বা তিনজনেই কোথাও আটকে গেছে….!”
“কাঞ্জিরা এলো বলে, ওরা এলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো।সবাই একসাথে বের হলে আপডেট জানতে সুবিধা হবে।”
ওদের কথার মাঝেই বাইকে তুমুল শব্দ তুলে মহলে পৌছালো ফ্যালকন, কাঞ্জি আর ওকামি। কোনো রকমে বাইক গুলো সাইডে পার্ক করে তিনজনেই ছুটলো মহলের সিড়ির দিকে। সিড়ির ওপর এসে দাঁড়িয়ে লিওর দিকে তাকিয়ে ফ্যালকন উত্তেজিত গলায় শুধোলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“শেহজাদী আর ভাইজানদের কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?”
লিও হতাশ ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা নাড়ালো। বলল,
“তোরা ভালো সময়ে এসেছিস, দ্রুত বের হতে হবে আমাদের। আমি দক্ষিণের দিকে যাবো, ফ্যালকন তুই উত্তর দিকটাতে যাবি। হাইনা অ্যানিম্যাল টাউনের ওদিকটা যেহেতু ভালো চিনে তাই ওদিকে ও খুজবে। কাঞ্জি পশ্চিমে যাবি, ওকামি পূর্বের দিকে। আর জোভি তুই লিন্ডা শার্লটদের সাথে এখানেই থাকবি। আমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত মহল ছেড়ে কোথাও যাবি না। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবি, যেহেতু শেহজাদী নেই সেহেতু আমাদের বিপদ শ’ গুণ বেড়ে যাবে। মেয়েদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তোর ওপর।”

জোভি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। লিও ফ্যালকনের দিকে আর একবার তাকিয়ে ভাবলো কিছু, তারপর বলল,
“তুই….. তোর একা যেতে হবে না, তুই সাথে ব্রায়ানকে নিয়ে যা। এখানে যেহেতু জোভি থাকছে তাই ব্রায়ান না থাকলেও চলবে। তোর কোনো অসুবিধা আছে ব্রায়ান?”
শেষোক্ত প্রশ্নটা ব্রায়ানের দিকে ঘুরে করলো লিও। ব্রায়ান দুদিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলো,
“না ভাইজান, ফ্যালকনের সাথে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“গ্যুড, তবে সবাই টুকটাক কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়৷ লিন্ডা, তোমরা সবাইকে কিছু খাবার গুছিয়ে দাও সাথে। কে কখন ফিরতে পারবো বলা যায় না, হতে পারে সারা রাতেও আর ফেরা হলোনা৷”
লিন্ডা ফাতমা শার্লটকে নিয়ে তখুনি ছুটলো কিচেনের দিকে।

কোকোর ভয়ানক জ্বর, জ্বরের ঘোরে হুশ নেই ওর। রয়্যাল গ্রেডের একটি সুসজ্জিত কামরায় বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে ওকে, আলফাদ বসে আছে বিছানার পাশে রাখা একটি সোফার ওপর। গতকাল থেকেই ওরা আটকা পড়ে আছে এখানে, ডার্ক প্যালেস হতে বের হবার কোনো উপায় নেই। একবার জ্বরতপ্ত কোকোকে রেখে সমস্ত পথ পাড়ি দিয়ে ও একাই গেছিলো বের হওয়ার কোনো উপায় আছে কি দেখতে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে গিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়েছে ওকে।

ভূপৃষ্ঠের থেকে যে দরজা দিয়ে ওরা ভেতরে প্রবেশ করেছিলো সেটা দেমিয়ান সদস্য ব্যাতিত কোনো ভাবেই খোলা সম্ভব নয়! বাধ্য হয়ে তাই আবার ফিরে এসেছে সে। এখন বের হওয়ার আর কোনোই রাস্তা বাকি নেই ওদের।
কোকো জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে, অস্ফুটস্বরে বার বার আম্মা’ শব্দটা বেরিয়ে আসছে ওর গলা থেকে। মাথায় ওর জলপট্টি দেওয়া, শিয়রে বসে আছে একটি অল্পবয়সী মেয়ে। কপালের ওপর রাখা ভেজা রুমালটা কিছুক্ষণ পর পর সে-ই ভিজিয়ে দিচ্ছে।
আলফাদ একা উদাস ভঙ্গিতে বসে আছে দেখে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,

“ক্ষিদে পেয়েছে? কিছু খাবেন? এনে দিবো?”
ভাবনায় ডুবে থাকা আলফাদ চমকে তাকালো, বিনীত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“না না, আপনার এত কষ্ট করতে হবে না৷ আমার ক্ষিদে নেই।”
মেয়েটি উত্তর পেয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলো আলফাদের চিন্তিত মুখশ্রীর দিকে, পরক্ষণেই আবার তাকালো কোকোর দিকে। চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে সে৷ তপ্ত শরীর থেকে উষ্ণ ধোঁয়া বের হচ্ছে যেন!
মেয়েটি আবার তাকালো আলফাদের দিকে, খেয়াল করলো আলফাদের চোখ জোড়া। গাঢ় সবুজ রঙ জ্বলজ্বল করছে। কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে কৌতুহল দমাতে না পেরে ঘুমন্ত কোকোর একটি চোখের পাতা আলতো করে উঁচু করে দেখলো সে, হালকা ধুসর রঙের ভেতর একটা তীক্ষ, চেরা মণি।
কিঞ্চিৎ চমকালো সে, অবাক হয়ে আলফাদের দিকে চকচকে চোখে চেয়ে চাপা সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনারা এনিম্যাল টাউন থেকে এসেছেন?”
“জ্বি।”

মেঝের দিক থেকে মুখ তুলে উত্তর দিলো আলফাদ। পরক্ষণেই ওর চোখ গেলো মেয়েটির চোখের দিকে, এতক্ষণ টেনশনে ওর মেয়েটির দিকে কোনো খেয়ালই হয়নি!
মেয়েটি যেন একটু বেশিই ফ্যাকাসে, কিছুটা দুর্বল প্রকৃতিরও। ঠিক ওর কোকো ভাইজানের মতোই এক জোড়া চোখ মেয়েটির, অমনই লাইট গ্রে, অমনই চেরা, উলম্ব চোখের মণি।
কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো আলফাদ, উৎসাহের সাথে প্রশ্ন করলো,
“আপনি….. আপনিও কি অ্যানিম্যাল টাউনের মেয়ে?”
“অ্যানিম্যাল টাউন কেমন আমি জানিনা। আমার জন্ম এখানেই, এখানেরই আলো বাতাসহীন পরিবেশে আমি বেড়ে উঠেছি৷ শুধু বাবার কাছে শুনেছি অ্যানিম্যাল টাউন নামে একটি স্থান আছে যেটা আমাদের৷”
“আপনার বাবা?”
“জ্বি, কোনো এক অপরাধের জন্য তাকে এখানে বন্দি করা হয়েছিলো, সাথে মা কেও। কিন্তু তখন আমি মায়ের পেটে ছিলাম। এখানে তাদের আসার চার মাসের মাথায় আমি সহ আমার আরও অনেক ভাই বোনের জন্ম হয়, কিন্তু বাচ্চা জন্মের পরই মা ভয়ানক পুষ্টিহীনতায় ভুগতে থাকেন, একসসময় মারাও যান। আমার সাথের ভাই বোনও কেউ বেঁচে নেই, আস্তে আস্তে সকলেই…..”

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার বলল,
“শেষে আমিই বেঁচে রইলাম, যদিও মরারই মতো! কিন্তু আমাকে দেখে এনাদের দয়া হয়েছিলো হয়তো। আমাকে তাই এখানেই এই দাসীদের কাছে রাখা হয়েছিলো, সেই হতে আমি এদের কাছেই বড় হয়েছি।”
“আপনি তবে কখনোই বাইরে টা দেখেননি?”
সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলো আলফাদ। মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়ালো। তারপর কিছু একটা মনে পড়তেই বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে যেতে বলল,
“ দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে, এনাকে একটু তোলার চেষ্টা করুনতো! আমি খাবার আনছি, খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিবো।”

শেষ বিকেল। গোধূলির নরম আলোর চাদরে মুখ ঢেকে ধীরে ধীরে সমুদ্রের নীলচে পানির কোলে নেমে যাচ্ছে সূর্য। ঢেউগুলো ঘুম ঘুম ভাবে কূলে এসে আছড়ে পড়ছে। নরম, ধবধবে, ভিজে বালুর মাঝে ঝিকিমিকি করছে ছোট ছোট মুক্তোর মতো খোলস।
চোয়ালের ওপর কারো ছোট্ট জিভের আদুরে স্পর্শে ধীরে ধীরে এক চোখ মেলে কোনোরকমে তাকালো আনাবিয়া, চোখ মেলতেই দেখতে পেলো ওর মাথার কাছে বসে পরম যত্নে ওর চোয়াল চেটে দিচ্ছে একটা ছোট্ট শেয়াল ছানা। বেশ আগ্রহের সাথেই সে এ কাজ করছে।
আনাবিয়া চোখ বুজে নিলো আবার, ঘুম পুরেনি যেন। নড়ে চড়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গেলো আবার, কিন্তু নড়তেই টের পেলো কারো শক্ত বাহুবন্ধনীর ভেতর আটকে আছে সে৷ মুহুর্তেই গতদিনের সমস্ত স্মৃতি বিদ্যুৎ গতিতে এসে হামলে পড়লো ওর মানস্পটে। সর্বশেষ সেন্টিপেড গুলোর কথা মনে পড়তেই গলা শুকিয়ে এসে সমস্ত শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো ওর!

তবে কি ও মরে গেছে? সেন্টিপেড গুলো কি ওকে খেয়ে ফেললো? এটা কি পরকাল? কিন্তু পরকালে শেয়ালের বাচ্চা কি করছে? প্রাণীদের তো কোনো পরকাল নেই! তবে ও এখন কোথায়?
ঝট করে চোখ খুললো ও, চোখ মেলতেই সামনে দেখতে পেলো কারো কুচকুচে কালো, সুগঠিত, প্রশস্ত, রোমশ বক্ষ। এই বুক ও চেনে, খুব চেনে। এই বুক ও যতোটা চেনে নিজেকেও ও ততটা চেনেনা!
মুহুর্তেই ওর মনে পড়ে গেলো তখন কে যেন ভেঙে ফেলতে চাইছিলো ওই বিশাল পাথর, পাথর ভাঙার ভয়ানক শব্দ এসে বাড়ি খেয়েছিলো ওর কর্ণকুহরে।
তবে কি…. তবে কি……!
পরক্ষণেই নিজের চিরপরিচিত ঘ্রাণটা নাকে এসে ঠেকলো ওর, সাথে আরও কিছু বিশ্রী দুর্গন্ধ ভেসে এলো এই রোমশ বক্ষের মালিক হতে।
“ইয়াকহ্‌…!”

চোখ মুখ কুচকে নিয়ে আনাবিয়া ছাড়াতে চাইলো নিজেকে, মুখ তুলে তাকালো মীরের মুখের দিকে, মুখভর্তি বিশাল গোফ দাঁড়ির জঙ্গলের কারণে মুখখানা চেনার উপায় নেই। তবুও আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো অনেক অনেক ক্ষণ!
সময় কত গড়ালো হিসেব নেই। একসময় মীরের আলিঙ্গন হতে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসতে চাইলো আনাবিয়া, ভেবেছিলো অনেক কসরত করতে হবে, কিন্তু হাতের বন্ধন নিমিষেই আলগা হয়ে এলো।
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে মীরের বাহুবন্ধনী থেকে মুক্তি পেয়ে উঠে বসতেই দেখলো লালে লাল হয়ে আছে ওর শরীরের নিচের বালি।

মুহুর্তেই আঁতকে উঠলো আনাবিয়া, মীরের হাতের দিকে নজর যেতেই ক্ষতবিক্ষত, ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া হাত দুখানা চোখে বাধলো ওর। ক্ষতস্থান গুলোতে রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে, কিছু কিছু স্থান হতে তখনও সরু স্রোতে রক্ত চুইয়ে পড়ছে, মাংস বেরিয়ে এসেছে অনেক স্থান হতে। অপ্রকৃতিস্থের মতোন হাত দুখানা পড়ে আছে, ভেতরের হাড় গুলো যে আস্ত নেই আর তা দেখা মাত্রই টের পেলো আনাবিয়া!
বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো ওর, ঢোক গিলে মীরের মুখের ওপর ঝুকে পড়ে দ্রুত, উদ্বিগ্ন স্বরে ডেকে উঠলো,
“মীরি…. মীরি শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছো আমাকে?”

নিঃশ্বাসের ভারী শব্দ ব্যাতিত আর কোনো আওয়াজ এলোনা। গায়ের রঙটা অত্যাধিক কালো বর্ণ ধারণ করেছে তার, সারা শরীর হিংস্র প্রাণীদের মতোন ঘন পশমে আবৃত! হাতের লম্বা ধারালো নখ যে কারো ভবলীলা সাঙ্গ করতে যথেষ্ট! পেটটা ঢুকে আছে ভেতরে, বুকের পাঁজরের নিচের দিকের কয়েকটি হাড় ভেসে উঠেছে তাতে। বুক ওঠানামা করছে নিঃশ্বাসের তালে তালে! আনাবিয়া উৎকন্ঠিত চিত্তে ব্যাকুল ভঙ্গিতে মীরের মাথাটা টেনে কোলে তুলে নিলো।
রেডিশ পশমে মোড়ানো বাচ্চা শেয়ালটা তখনোও বসে আনাবিয়ার পাশে, উৎসুক দৃষ্টিতে দেখতে ব্যাস্ত এই সম্পুর্ন নতুন প্রজাতীর প্রাণী দুটিকে। কি মনে করে এগিয়ে গিয়ে মীরের ক্ষতবিক্ষত হাতে নাক ছোয়ালো সে। কিন্তু তাতে মীরের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো, যন্ত্রণায় মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে এলো একটা চাপা, হিংস্র গর্জন!
আনাবিয়ার বুকে বাজলো ভীষণ! ওই রুক্ষ, কঠিন হাতের অমন দশা, অমন ক্ষত দেখে ওর বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হলো দ্বিগুণ! রুক্ষ হাত দুখানায় নিজের মোলায়ের হাতের স্পর্শ বুলিয়ে দিতেই চোখ ভরে এলো ওর, কত যন্ত্রণাই তা এই হাত দুখানায় পেয়েছে মীর! কতটা আঘাত পেলেই না হাত জোড়া ছিন্নভিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে, এভাবে রক্ত ঝরেছে!

ফুপিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো আনাবিয়া। আর তা কানে যাওয়া মাত্রই ঝট করে চোখ মেলে তাকালো মীর!
যেন কেউ দূরদুরান্ত থেকে এক আর্তনাদেই ফিরিয়ে নিয়ে এলো ওকে, ভাঙিয়ে দিলো ওর গভীর ঘুম, কমিয়ে দিলো ওর যন্ত্রণার তোপ!
এ যে সেই কন্ঠস্বর যাকে সে খুঁজে চলেছে বহুবছর যাবৎ, সেই কন্ঠস্বর যার সুমধুর ধ্বনি ওর পাষাণ বুকে ঢেউ খেলিয়ে দিয়ে যেতো; ভুলিয়ে দিতো ওর সমস্ত যন্ত্রণা, ক্ষিদে, ঘুম! বাড়িয়ে দিতো মুক্তি পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা!
শরীরের সমস্ত যাতনা ভুলে মুহুর্তেই আনাবিয়ার কোল ছেড়ে ঝটিতে উঠে বসলো মীর। ঝট করে ঘুরে আনাবিয়ার মুখোমুখি হয়ে বিস্মিত অবিশ্বাসী নেত্রে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে। ওর চওড়া, বিশাল শরীরের সামনে আনাবিয়া নেই হয়ে এলো। ভ্রু তুলে শঙ্কিত, কাতর চোখে ও তাকিয়ে রইলো মীরের স্বর্ণাভ চোখের দিকে।
মীর যেন স্মৃতি হাতড়ালো; এ কে?

একে ও চেনে, খুব চেনে, কিন্তু এ কে? কি হয় ওর? খুব কি কাছের কেউ? কিন্তু কে? এত চেনা কেন? এত নিজের নিজের কেন? হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো সে, ধীরে ধীরে ঠোঁট জোড়া আলগা হয়ে আসলো ওর!
আনাবিয়া দিশেহারা হয়ে পড়লো, কি করবে কিছুই বুঝলোনা। শুকনো একটা ঢোক গিলে ও ইতস্তত, দ্বিধান্বিত কন্ঠে ডাকলো একবার,
“মীরি….!”

এই একটি ডাকই যেন যথেষ্ট ছিলো মীরের মস্তিষ্কের সমস্ত মরিচা ধরা স্মৃতিকে ঠুকরে দিতে। স্মৃতির তাড়নায় চোখ জোড়া ধীরে ধীরে বিস্ফোরিত হয়ে এলো ওর, ক্রমে শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিক রকম দ্রুততর হয়ে উঠলো, বুকটা হাপরের মতোন ওঠানামা শুরু করলো! মুহুর্তেই এক অসহ্য, বিধ্বংসী যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো ওর মুখের ওপর, ভ্রু জোড়া যন্ত্রণার তোপে কুচকে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে গেলো মুহুর্তেই!
হতচকিত হলো আনবিয়া, ব্যতিব্যস্ত হয়ে সামান্য এগিয়ে এসে অস্থির গলায় শুধোলো,
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে মীরি তোমার, বলো আমাকে! আমি সব ঠিক করে দি…..”

কিন্তু বাক্যটা শেষ করা হলোনা আনাবিয়ার তার আগেই মীর ঝাপিয়ে পড়লো ওর ওপর! রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া হাত জোড়া দিয়ে আনাবিয়ার শুভ্র মুখখানা দুহাতের ভেতর নিয়ে নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত যন্ত্রণা মিশিয়ে তুললো বজ্রের ন্যায় এক ভূবন কাঁপানো গর্জন। আর তারপর এক মর্মভেদী বিকট আর্তনাদের সাথে সে ছুড়ে দিলো সেই বিচ্ছেদের মুহুর্ত থেকে জমিয়ে রাখা একটি প্রশ্ন,
“হোয়াই……?”
পরমুহূর্তেই হাতের তীব্র যন্ত্রণার কাছে পরাজিত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে সে আছড়ে পড়লো আনাবিয়ার নরম বক্ষের ওপর।

ব্রায়ান রাতের আঁধারে একা একা হেটে চলেছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, ওর মাথার ওপর দিয়ে আগে আগে উড়ে চলেছে ফ্যালকন। চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে চলেছে সে, এতটুকু চিহ্নও পেলেও যেন বুকটা ঠান্ডা হতো ওর। কিন্তু কিছুই নেই কোথাও!
জঙ্গলের ঠিক কতটা গভীরে ওরা চলে এসেছে জানা নেই ওর। সেই থেকে একদণ্ড থামেনি দুজন, এগিয়ে চলেছে সমানে। মধ্যরাত হতে চললেও এক ফোটা খাবার পানি মুখে নেয়নি ফ্যালকন। ওর আদরের শেহজাদী; ওর মা, আর ওর দুই প্রাণপ্রিয় ভাইজান নিখোঁজ! ওদেরকে অনিশ্চিত বিপদের মুখে ফেলে রেখে ও কিভাবে নিজের পেট ভরাবে?
উড়তে উড়তে হঠাৎই চোখ গেলো ওর জমিনে। সেখানে এক স্থানে কেউ আগুন করেছে। মাংস পোড়া গন্ধ ভেসে আসছে সেদিক হতে। শা করে ঘুরে ঝড়ের বেগে নিচে নামলো ফ্যালকন। ওকে নিচের দিকে আসতে দেখে ব্রায়ান পা চালালো দ্রুত।

ফ্যালকন মাটিতে পা রেখেই হাটা ধরলো, ব্রায়ানের জন্য অপেক্ষা করলোনা৷ ব্রায়ান ওকে এভাবে এগোতে দেখে ছুটলো ওর নাগাল পাওয়ার আশায়। কিছুক্ষণ ছুটে ওর কাছাকাছি গিয়ে হাফাতে হাফাতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হিয়েছে ফ্যালকন? তুই এভাবে নেমে এলি কেন?”
“এদিকে কেউ আছে। আগুন জ্বলতে দেখেছি, মাংস পোড়াচ্ছে কেউ।”
ব্রায়ান ভড়কালো সামান্য, কিসের মাংস যে পুড়ছে ভেবে। তবুও সাহস না হারিয়ে এগোলো ফ্যালকনের পেছন পেছন। কিছুদূর যেতেই আগুনের শিখা চোখে পড়লো ওদের। পাশে বসে আছে কেউ, আগুনের ওপর মাংস পোড়ানো হচ্ছে, খুব সম্ভবত খরগোশের।
ফ্যালকন আরেকটু কাছে গিয়ে বিস্মিত কন্ঠে ডেকে উঠলো,

“ন্যাকু!”
ন্যাকু বসে বসে আগুনে জ্বাল করছিলো। এক ঢিবি শুকনো কাঠ খড় ওর পাশে, তা থেকে অল্প অল্প নিয়ে আগুনের ভেতর দিচ্ছে ও। ফ্যালকনকে দেখেই সম্ভ্রমের সাথে উঠে দাড়ালো, বলল,
“ফ্যালকন ভাই যে, আপনিও যাবেন নাকি?”
“যাবো মানে? কোথাও যাবো?”
“শেহজাদী কোকো ভাইজান আর আলফাদ ভাইজানকে নিয়ে মাটির তলে গিয়েছেন৷ আমি ভাবলাম আপনিও যাবেন নাকি!”
মেজাজ গরম হলো ফ্যালকনের, দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে রেগেমেগে ন্যেকুর জামার গলার ধরে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিয়ে এসে ক্রুদ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

“শেহজাদী কোকো ভাইজানদেরকে তুই দেখেছিস? কোথায় গিয়েছেন তারা? মাটির তলে গিয়েছে মানে কি?”
ন্যাকু ভয় পেলো, আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন ফ্যালকন ভাই? আমি সত্যি বলছি, শে-শেহজাদী কোকো ভাইজানদের সাথে মাটির তলে গিয়েছেন, মাটির তলায় একটা দরজা আছে, তার ভেতরে গিয়েছেন। আমাকে বলে গিয়েছেন তারা না ফেরা পর্যন্ত আমি যেন এখানেই থাকি!”

ফ্যালকন ঘাড় কাত করে মাটিটা পরখ করলো, কোথাও মাটি সরানোর কোনো চিহ্ন নেই! ন্যাকুর দিকে আবার কটমটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও চেচিয়ে বলে উঠলো,
“মজা করছিস আমার সাথে? কোথায় গিয়েছে? কোথায় দরজা?”
ন্যাকু এবার নিজেও দেখলো, কিন্তু বিস্ময়ে আর ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো ওর, ফ্যালকনের দিকে ফিরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

“বিশ্বাস করেন ফ্যালকন ভাই, আমি খরগোশ ধরতে যাওয়ার আগেও দেখে গিয়েছি এখানে দরজা টা ছিলো, এখন কিভাবে উধাও হয়ে গেলো আমি জানিনা৷ আমাকে মারবেন না।”
ফ্যালকন ভাবলো কিছুক্ষণ, ন্যাকু নিতান্তই সহজ সরল, ও মিথ্যা বলতে শিখেনি। তাছাড়া শেহজাদীকে নিয়ে মিথ্যা বলার মতো সাহস ওর কেন, পঞ্চদ্বীপের কারোরই হবে না! নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল,
“ কোথায় দরজা, দেখা আমাকে৷ না দেখাতে পারলে তোকে ক্রোকোডাইলদের লেকে ছেড়ে দিয়ে আসবো, মনে থাকে যেন।”

বলে ছেড়ে দিলো ও ন্যাকুকে। ন্যাকু ফ্যালকনের হুমকিতে ভয় পেলো। দ্রুত নিজের অ্যানিম্যাল ফর্মে এসে ও নাকে শুকে দেখলো কোথায় মেটালিক গন্ধটা পাওয়া যায়। কিছুক্ষণ খোঁজার পরই একস্থানে মাটি খোড়া শুরু করলো ও দুহাতে। কিছুটা গভীর হওয়ার পরই ওর নখের আগায় ঠেকলো ধাতব কোনো বস্তু। পুরোটা সরিয়ে ফ্যালকনকে দেখালো ও৷
ফ্যালকন আর ব্রায়ান খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো সম্পুর্নটা, হাত দিয়ে স্পর্শ করে পরখ করলো একবার। ভীষণ শক্তিশালী ধাতু, ওদের কারো পক্ষেই এ জিনিস সরানো সম্ভব নয়। ওপরে অনলি দেমিয়ানস লেখা দেখে ভাবনাটা আরও জোরালো হলো।
পকেট থেকে ফোন বের করে একবার চেষ্টা করলো লিওর সাথে যোগাযোগ করার, কিন্তু এদিকে নেটওয়ার্ক জিরো। কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা ন্যাকুকে নিয়েই ও আর ব্রায়ান ফিরে চলল মহলের দিকে।

ভোর বেলা আনাবিয়ার আবার ঘুম ভাঙলো বাচ্চা শেয়ালটার চাটাচাটির ঠেলায়। ঘুম থেকে উঠে পিচ্চিটার পেছনে একটা ছোটখাটো চটকানা দিয়ে সরিয়ে দিলো ও।
মীর ঘুমিয়ে আছে বালির ওপর আনাবিয়ার করা শুকনো পাতার বিছানায়। হাত জোড়া আনাবিয়ার হিল্যিং সঙ এর বদৌলতে ঠিক হয়ে গেছে। কাল জ্ঞান হারানোর পর এখনো জ্ঞান ফেরেনি তার। ওভাবেই সারারাত আনাবিয়ার বুকের কাছে মুখ লুকিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছে।
কিন্তু ভালো নেই আনাবিয়া, গতকাল পাথরের ওপর আছড়ে পড়ার ব্যাথা গুলো এখনো সারেনি। সম্পুর্ন গাটে গাটে ব্যাথা যেন। অপরের ক্ষত, যন্ত্রণা সারাতে পারলেও নিজের টোটকা নিজের ওপর কাজ করেনা ওর। যন্ত্রণা গুলো তাই সবসময় ওকেই সইতে হয়।

গতরাতের করা আগুনের কাঠকয়লা গুলো পড়ে আছে এক কোণে, বাচ্চা শেয়ালটা আনাবিয়ার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বার বার ওর চোখের সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছে, আনাবিয়া পাত্তা দিচ্ছেনা ওকে।
মীরের দিকে আর এক পলক তাকিয়ে উঠে বসলো ও, পরণে একটা ট্যাংক টপ আর লেটুস কাটের শর্টস। হুডি আর ট্রাউজার টা রাতেই ধুয়ে শুকোতে দিয়েছিলো পাশের একটি গাছের ডালের ওপর। উঠে দাঁড়িয়ে সেদিকে গেলো ও। পোশাক গুলো প্রায় শুকিয়ে এসেছে, কিন্তু গায়ে চড়ানোর মতো হয়নি।
গতরাতে একটা বনমোরগ ধরে পুড়িয়ে খেয়েছে, সেটার রঙিন পালক গুলো এখনো পড়ে আছে কাঠ কয়লার আশেপাশে। ভাগ্যিস ব্যাকপ্যাক টা কোথাও পড়ে যায়নি, পিঠেই বাধা ছিলো, নইলে বেশ ঝামেলায় পড়তে হতো ওর।

মীরের ঘুম ভাঙবে হয়তো দ্রুতই, ওর পেটে নিশ্চয় জনমের ক্ষিদে। উঠেই হয়তো ক্ষিধেতে চেচাবে। আনাবিয়া তাই আর দেরি করলোনা, ব্যাকপ্যাক থেকে একটি দড়ি, কয়েকটি পোড়ানো ভুট্টার দানা নিয়ে এগোলো জঙ্গলের দিকে। গতরাতে এগুলো দিয়ে ফাঁদ পেতে একটা বনমোরগ ধরেছিলো। কিন্তু আজ শুধু একটাতে কাজ চলবে না। ওর বড় কিছু ধরা চাই, হরিণ বা অন্য কিছু। সাথে করে তাই খঞ্জরটাও নিলো
শেয়ালের বাচ্চাটাও লাফাতে লাফাতে এগোলো ওর পেছন পেছন।

একটা গলা কাটা হরিণকে দড়ি বেধে টানতে টানতে নিয়ে এসে আনাবিয়া যখন সমুদ্র তীরে পৌছালো তখন বেলা অনেক হয়ে গেছে। ওদের ক্ষণস্থায়ী বাসস্থানের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো শুকনো পাতার তৈরি বিছানার ওপর থেকে মীর উঠে বসার চেষ্টা করছে প্রাণপণ, কিন্তু পারছেনা কোনোভাবেই।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১

আনাবিয়া হরিণটাকে দ্রুত টানতে টানতে নিয়ে এগিয়ে এলো মীরের দিকে। শেয়ালের বাচ্চাটা মুখে হরিণের লেজটা তুলে ধরে নিয়ে আসলো আনাবিয়ার পেছন পেছন, যেন এটুকু সাহায্য না পেলে আনাবিয়া পারতোই না!
পেছনে হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় কাত করে অতি কষ্টে তাকালো মীর, আর তাকিয়েই রক্তাক্ত খঞ্জর হাতে, অপার্থিব সৌন্দর্যে মোড়া এক অচেনা শুভ্র রমণীকে দেখে থমকে গিয়ে অবুঝ, মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওভাবেই তাকিয়ে রইলো এক ধ্যানে।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here