বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩
রানী আমিনা

আনাবিয়া হাত থেকে দড়ি ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেলো মীরের দিকে, মীর তখনো মুগ্ধ, অপলক চোখে তাকিয়ে ওর দিকে!
মীর উঠে বসার চেষ্টা করেও পারছেনা দেখে আনাবিয়া ওকে ধরে বসিয়ে দিলো সোজা করে। শরীরের রঙ বেশ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে মীরের, উজ্জ্বল শ্যাম বরণ দেহ ময়লা হয়ে থাকার কারণে বিবর্ণ দেখাচ্ছে।
আনবিয়া মীরের সম্মুখে এসে হাটু মুড়ে বসলো, বোঝার চেষ্টা করলো জংলিটার মনে ঠিক কি চলছে।

আর মীর অত্যন্ত আগ্রহের সহিত চোখ ঘুরিয়ে, খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে ব্যাস্ত রইলো তার সামনে উপবিষ্ট এই পরীর মতোন অসাধারণ সৌন্দর্যে মণ্ডিত মেয়েটির সাদা রঙা রেশমসম চুল, হীরকখন্ডের ন্যায় ঝকমকে চোখ, টেরাকোটা রঙা টসটসে ঠোঁট, লালিমা মাখা শুভ্র চোয়াল, তার নরম গাল, কোমল কণ্ঠদেশ, ফুটে ওঠা বিউটিবোন, পরক্ষণেই তার চোখ উঠে গেলো আবার আনবিয়ার ঝলমলে চোখে। হতভম্বের মতোন তাকিয়ে রইলো সে ওই বড়বড় জাদুকরী চোখ জোড়ায়। তার বুনো জান্তব মনে উদয় হলো এক ঝাঁক প্রশ্নের,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“এ কে? এ এতো ঝলমলে কেন? এর চোখ জোড়া এমন কেন? এটা কি আমার শিকার? উহু, শিকার হলে আমি আক্রমণ করতে উদ্যত হচ্ছি না কেন? এত সুন্দর কিছুকে আমি কিভাবেই বা শিকার করবো? আমি এখন কি করবো? একে ধরবো? ধরে দেখি? একটু…..?”
মীরের এমন দৃষ্টি তে আনাবিয়ার বুক কাঁপলো! মীরের চাহনি এমন অচেনা, দূরের দূরের ঠেকছে কেন? মীর কি ওকে চিনতে পারছেনা?
আনাবিয়া এগিয়ে গেলো মীরের আরেকটু কাছে, ডান হাতটা ধীরভাবে বাড়িয়ে স্পর্শ করতে নিলো মীরের চোয়াল। মীর দ্বিধাভরে সরে গেলো সামান্য, কিন্তু পরক্ষণে আনাবিয়া চোয়ালে হাত রাখতেই ওর মাখনসম হাতের শীতল স্পর্শে প্রচন্ড আরাম পেলো সে, চোখ জোড়া বুজে নিয়ে মুখের ভার ছেড়ে দিলো আনাবিয়ার হাতের ওপর। আনাবিয়া ডাকলো,

“মীরি…..!
মীরের ওপর এ সম্বোধনের কোনো প্রভাব দেখা গেলো না, যেন এ নাম হতে সে ক্রোশ ক্রোশ দূরে! চোখ বুজে আগের মতোই পড়ে রইলো।
আনাবিয়া আহত হলো প্রচন্ড, ওর ভ্রু জোড়া কুচকে এলো এক নামহীন বেদনায়! এক বুক হতাশা এসে গ্রাস করলো ওকে, বিষন্ন চোখে আনমনে কোনো একদিকে চেয়ে হাতটা সরিয়ে নিতে গেলো মীরের চোয়াল হতে, কিন্তু চোয়ালের ওপর থেকে হাতটা সরে যেতেই ঝট করে চোখ মেলে তাকালো মীর।
শিশুদের হাত হতে তার অত্যন্ত প্রিয় খেলনাটি কেড়ে নিলে সে ঠিক যেভাবে তাকায় সেভাবেই আনাবিয়ার দিকে তাকিলো মীর, পরক্ষণেই ওর নরম হাতটা তড়িতে নিজের রুক্ষ দুহাতের ভেতর ধরে টেনে এনে রাখলো আবার চোয়ালের ওপর। স্বর্ণাভ চোখ জোড়া দিয়ে শাসিয়ে যেন নিরব হুকুম করলো সে,

“আরও আদর চাই আমার, হাত সরিয়ে নিলে একদমই ভালো হবে না!”
আনাবিয়া বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, মাটিতে হাটু ভর দিয়ে এগিয়ে গেলো আরও একটু, মীরের চোয়ালে হাত বুলিয়ে দিলো আলতো করে। বোনাস আদর পেয়ে মীর চোখ বুজে নিলো আবারও। ওর শক্ত চোয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে আনাবিয়া মৃদু হেসে স্বগতোক্তি করলো,
“ভুলেই যখন গেছো তখন পুরোপুরি ভুলে যেও, আর কখনো আমাকে মনে কোরোনা। আমরা রাস্তা আলাদা করে নিবো যেন কখনো আমাদের মুখোমুখি না হতে হয়।”
যাকে বলা হলো সে কিছু বুঝলোনা, শুনলোনা। আদুরে হাতের স্পর্শে বুদ হয়ে রইলো। আনাবিয়া এবার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে নিলো। মীর হতচকিত হলো সামান্য, পরক্ষণেই ভ্রু কুচকে চোখে ক্রোধ ফুটিয়ে তাকালো। আনাবিয়া কন্ঠ দৃঢ় করে বলল,

“তোমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।
বলো, আমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান।”
মীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো, আনাবিয়া শক্ত হাতে ওর দাড়ি ভর্তি থুতনি ধরে কন্ঠে আক্রোশ মিশিয়ে বলে উঠলো,
“বলো, আমার নাম নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান!”
মীর উচ্চারণ করতে চাইলো, ঠোঁট নড়ে উঠলো ওর, দম নিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। গলায় আটকে যেতে লাগলো সমস্ত কথা, কিয়ৎক্ষণের চেষ্টার পর অতি কষ্টে মুখ থেকে একটি শব্দ বের করলো ও,
“অ্‌-আ…”

কিন্তু এটুকু শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েই যন্ত্রণায় চোখ ভর্তি হয়ে এলো ওর। আনাবিয়া অগত্যা থামিয়ে দিলো ওকে,
“ঠিক আছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর বলতে হবে না।”
আনাবিয়ার কথার অর্থ না বুঝলেও থেমে গেলো মীর, অবুঝ দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করলো সম্মুখের মেয়েটিকে।
পরক্ষণেই ওর দৃষ্টি পড়লো পাশেই বালুর ওপর পড়ে থাকা হরিণের গলা কাটা মৃত দেহের ওপর, যার পায়ের দিকটা নিজের ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে ছিড়ে খাওয়ার চেষ্টা করছে শেয়ালের বাচ্চাটা।
দেখা মাত্রই মীরের যেন ভোল পালটে গেলো! রেগেমেগে উঠে গর্জন তুলে হাটুতে ভর দিয়ে সে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে শেয়ালের বাচ্চাটার গলা ধরে সজোরে ছুড়ে দিলো অন্যদিকে, সে গিয়ে আছড়ে পড়লো দূরের বালুর ভেতর পড়ে থাকা একটি শুকনো, মোটা গাছের গুড়ির ওপর।

বাচ্চাটার আছাড় খাওয়ার স্থানের দিকে তাকিয়ে হিংস্র ভঙ্গিতে দাঁত মেলে গিরগিরে শব্দ করে মীর বুঝিয়ে দিলো এই খাবারের ওপর সম্পুর্ন ওর অধিকার, তাতে হাত লাগালে সে একদমই ছেড়ে কথা বলবে না!
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটলো যে ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে গেলো আনাবিয়া, একবার হরিণ আগলে বসে থাকা মীর আর একবার শেয়ালের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে ও বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কি হলো৷ শেয়ালের বাচ্চাটা ব্যাথা পেয়ে কুই কুই করে ডেকে উঠলো সাথে সাথে।
আনাবিয়া কটমটে চোখে মীরের দিকে একবার তাকিয়ে ছুটে গেলো শেয়ালের বাচ্চাটার দিকে, কোলে উঠিয়ে নিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিয়ে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো মীরের নিকট। শেয়ালের বাচ্চাটা মীরের চেহারা দেখা মাত্রই ভয়ে নুইয়ে গিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেললো আনাবিয়ার বাহুডোরে।

“তুমি ওকে ছুড়ে দিলে কেন?”
কন্ঠে ক্রোধ মিশিয়ে ভ্রু জোড়া কুচকে প্রশ্ন করলো আনাবিয়া। মীর ভাষা না বুঝলেও প্রশ্ন বুঝলো। নির্বিকার মুখভঙ্গিতে, নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে যা বুঝালো তার সারমর্ম এই যে,
“আমার জিনিসে ভাগ বসালে এমনি হবে, যা করেছি বেশ করেছি! দ্বিতীয় বার এমন কাজের পুনরাবৃত্তি হলে আমি আবারও তাকে আছাড় মারবো, এবং আমি খুবই গর্বের সহিত সে কাজ করবো৷”
আনাবিয়া কোমরে হাত বেধে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, পরক্ষণেই হতাশ ভঙ্গিতে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শেয়ালের বাচ্চাটাকে আদর দিয়ে নামিয়ে দিলো মাটিতে। বাচ্চাটা টলতে টলতে গিয়ে বসে পড়লো বালুর ওপর, মীরের থেকে নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখতে ভুললোনা।
মীরের ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ। আনাবিয়াকে একবার দেখে নিয়ে অতঃপর চকচকে, লোভাতুর চোখে চেয়ে, ঝুঁকে হরিণের মাংসের ওপর দাঁত বসাতে গেলো ও, আনাবিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে এ দৃশ্য দেখেই চেচিয়ে উঠে ধমকের সুরে বলল,

“অ্যাই কি করছো!”
মীর মাংস কামড়ে নেওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে এমন রাম ধমক খেয়ে স্ট্যাচু হয়ে গেলো, পরক্ষণেই মুখ সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে।
“শালার কালাভুনা জঙ্গলে থেকে থেকে রাক্ষস হয়ে গেছে!”
বলে হরিণের গলায় বাধা দড়িটা তুলে টানতে টানতে নিয়ে চলল সমুদ্রের দিকে।

কোকোর জ্বর কমেছে, এই মুহুর্তে বিছানার ওপর বালিশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সে, সারারাত জ্বরের ঘোরে থেকে এখন একটু ভালো বোধ করছে।
আলফাদ পাশের বালিশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সারা রাত কোকোর ভুলভাল বকা আর লেডি কুমিরের সেবাযত্নের চোটে ও ঘুমোতে পারেনি। অসুস্থ বড় ভাইকে ফেলে রেখে হা করে ঘুমোনোও কোনো ভালো মানুষের কাজের ভেতর পড়েনা, তার ওপর কামরায় একটা মেয়ে একা একাই তার বড়ভাইয়ের সেবা যত্ন করছে অথচ সে কিছুই করছেনা, উলটো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, ব্যাপারটা ভালো দেখায় না৷ তাই কিছু না করা সত্বেও জেগে জেগে সে পাহারা দিয়েছে কোকোকে।

শেষ রাতের দিকে কোকোর জ্বর কিছুটা কমলে আলফাদ আর মেয়েটি দুজনেই ঘুমিয়েছে। আলফাদ ঘুমিয়েছে বিছানায়, মেয়েটি ঘুমিয়েছে সোফার ওপর। গায়ের ওপর তার একটা পাতলা চাদর মাত্র।
কোকোর ক্ষিদে পেয়েছে। সে যে তিনবেলা হাতির খোরাকে অভ্যস্ত সেটা কাউকে বলতে পারেনি, আলফাদও বলেনি। প্যালেস থেকে দেওয়া অল্প খাবারে তাই ওর পেটের এক কোণাও ভরেনি কোনো বেলাতে।
কিন্তু এখন ঘুম থেকে উঠে ভয়ানক ক্ষিদে পেয়ে গেছে, মনে হচ্ছে পারলে ও এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব খাবার একসাথে খেয়ে ফেলে!
ক্ষিধের কথা কোকো কাকে বলবে ভেবে পেলোনা৷ এই মেয়েটিই যে ওর দেখাশোনা করছে সেটা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে কয়েকবার দেখেছে সে, কিন্তু যার সাথে ভালো ভাবে দেখা হয়নি, কথা হয়নি তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খাবার খেতে চাওয়াটা কোকোর কাছে বড্ড বেমানান লাগলো। তাছাড়া ডাকবেই বা কিভাবে, তাকে তো আর ‘এই মেয়ে’ বলে ডাকা যায় না, আবার ধাক্কা দিয়েও উঠানোর পথ নেই!
কোনো উপায় না পেয়ে শেষমেশ পাশে ফিরে আলফাদকে গুতো মেরে ডেকে বলল,

“এই স্নেক, উঠ!”
আলফাদ প্রথম ডাকে কোনো সাড়া দিলোনা, মরার মতোন পড়ে রইলো। কোকো এবার ওর শক্ত হাতের রাম আঘাত হানলো আলফাদের পিঠের ওপর। আলফাদ চমকে ঘুম ভেঙে উঠে পিঠের ওপর হাত চাপা দিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“সমস্যা কি তোর? ঘুম থেকে উঠেই মারা ধরা শুরু করেছিস! রাত জেগে তোর সেবা করাই আমার উচিত হয়নি, শালা!”
“তুই কি সেবা করেছিস আমার জানা আছে, চেগিয়ে বসে ছিলি সোফায়, আমি দেখিনি ভেবেছিস? ক্রেডিট নিলে ওই মহিলা নিবে, তুই লাফাস কেন?”
“এএএএহ্‌! বসে ছিলাম এটা যেন কোনো কাজ না! বসে থাকাও কম কষ্টের বিষয় না, ওইখানে বসে থেকে আমার মাজায় ব্যাথা হয়েছে। এর কোনো দাম নেই? দাম কে দিবে?”
কোকো কিছুক্ষণ নির্বিকার চোখে আলফাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠলো,
“আয় তোকে দাম দিই”
বলেই এক লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দিলো আলফাদকে। আলফাদ মেঝেতে দড়াম দিয়ে পড়ে চেচিয়ে উঠলো,

“একবার এখান থেকে বের হই, শেহজাদীর কাছে সব নালিশ করবো!”
আনাবিয়ার কথা উঠতেই চুপ হয়ে গেলো কোকো, স্থীর হয়ে নিজের জায়গায় বসলো, শুষ্ক মুখে যেটুকু হাসি ফুটেছিলো তা উবে গেলো মুহুর্তেই। আলফাদ নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসলো আবার বিছানায়, চুপ করে তাকিয়ে রইলো দেয়ালের দিকে।
মেয়েটির ততক্ষণে ঘুম উড়ে গেছে এদের দুজনের ধস্তাধস্তির শব্দে। উঠে বসে দুজনকেই হঠাৎ এভাবে চুপচাপ দুদিকে বসে থাকতে দেখে সেও চুপ হয়ে বসে বোঝার চেষ্টা করলো কি হচ্ছে৷
কিছুক্ষণ পর নিরাবতা ভেঙে আলফাদ কোকোকে শুধোলো,
“ডাকছিলি কেন?”
“এমনি।”
ছোট্ট করে উত্তর দিলো কোকো। আলফাদ ঘুরে তাকালো ওর দিকে, কিছুক্ষণ ওর শুকনো মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে নরম সুরে শুধোলো,
“ক্ষিদে পেয়েছে?”

আলফাদের গলার সুরে কি ছিলো কোকো জানেনা, কিন্তু এই ছোট্ট প্রশ্নে ওর ভয়ানক কান্না পেলো! এমন সকাল বেলা ওর আম্মা ওকে ঘুম থেকে টেনে তুলে খাওয়াতো, সকলের থেকে ওর পাতে বেশি খাবার থাকতো, খাবারের স্তুপ গড়ে দিতো ওর আম্মা। এ নিয়ে কারোই কোনো অভিযোগ ছিলোনা, শেহজাদীর যে সে প্রথম সন্তান! ঢালাও ভাবে শেহজাদীর সমস্ত আদর, ভালোবাসা প্রথম থেকে শুধু সেই পেয়েছে।
ওর নিজের মা কেমন ছিলো ওর মনে পড়েনা, বুঝ আসলে থেকে ওই শুভ্র মেয়েটিকেই সে মা বলে জেনেছে, নিজের চোখের সামনে হিজ ম্যাজেস্টির প্রচন্ড ভালোবাসায় পর্যবসিত হয়ে তাকে কিশোরী হতে যুবতীতে পরিণত হতে দেখেছে, পাঁচ পাঁচটি যুগ ওই শুভ্র মেয়ের ছায়াতলেই কেটেছে ওর। আজ সে কোথায় কিভাবে কোন অবস্থাতে আছে জানেনা কোকো, জানার কোনো উপায়ও নেই!

আনাবিয়ার শুভ্র, মায়ামাখা, স্নেহে পরিপূর্ণ ছোট্ট মুখখানা মনে পড়তেই ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো ও ছোট্ট বাচ্চাটির মতোন। আজ ওর আম্মা কাছে থাকলে ওকে কখনোই খাবারের কষ্ট পেতে হতো? ওর আম্মা ওকে ক্ষিদে পেটে থাকতেই দিতোনা! শেষ বার খাবারের কষ্ট পেয়েছিলো ওর আম্মা লাইফট্রি থেকে বের হওয়ার দিনে, তারপর আর কখনোই না!

আলফাদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলো, কোকোর ঘাড়ে হাত রেখে ধরে আসা গলা পরিষ্কার করে বলল,
“শেহজাদী যেখানেই আছেন ভালো আছেন ভাইজান। উনি শেহজাদী, যেকোনো পার্থিব বিপদ কাটিয়ে উঠার সামর্থ্য তার আছে। উনি যেখানেই থাকবেন ঠিক থাকবেন বলেই আমার বিশ্বাস, মন খারাপ করিস না!”
মেয়েটি প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করলো। এত্ত বড় হাতির মতোন ছেলে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে দেখে অবাক হলো কিছুটা, কিছুটা মনোক্ষুণ্ণও হলো। ছেলেটিকে বেশ শক্তপোক্ত ভেবেছিলো ও, কিন্তু এমন ছিঁচকাদুনে ছেলে ও আগে কখনো দেখেনি। অ্যানিম্যাল টাউনের ছেলে জেনে যে আগ্রহ দেখিয়েছিলো তা যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো, এই ছিঁচকাদুনে ছেলের জন্য ও রাত নষ্ট করলো?
কিছুটা বিরক্তি নিয়েই সে প্রশ্ন করলো,

“আপনাদের কিছু লাগবে?”
প্রশ্ন শুনে ওদের এতক্ষণে হুশ হলে ওদের সাথে আরও কেউ আছে। কোকো দ্রুত সামলে নিলো নিজেকে, দ্রুত গতিতে চোখ মুছে নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে রইলো। আলফাদ কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,
“আসলে ওর ক্ষিদে পেয়েছে…!”
“আচ্ছা, আমি খাবার আনছি।”

বলে মেয়েটি উঠে চলে গেলো বাইরে৷ আলফাদও কোকোর দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো মেয়েটির পেছন পেছন, একটু বেশি খাবার দেওয়ার কথা কিভাবে বলা যায় সেটাই ভাবতে ভাবতে ছুটলো ও৷
মেয়েটি গিয়ে ঢুকলো প্যালেসের বিরাট কিচেনে, রান্না ইতোমধ্যে সেখানে শুরু হয়ে গিয়েছে, প্রায় শেষের দিকে। আলফাদ গিয়ে এত মেয়ে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো, কি করবে ভেবে পেলোনা।
মেয়েটি খাবার গোছাতে গোছাতে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ওকে দেখা মাত্রই অপ্রস্তুত হলো যেন। বাকিদের দিকে একবার সাবধানী চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার কাছে, শুধোলো,

“কি ব্যাপার আপনি এখানে কেন?”
“ইয়ে, মানে…. কিভাবে যে বলবো!”
“যা বলার ঝটপট বলুন।”
“খাবার একটু…. মানে একটু বেশি করে দিতে পারবেন? আসলে ওর একটু বেশি খাওয়া অভ্যাস, এতটুকুতে ওর পেট ভরেনা৷”
বিনীত ভঙ্গিতে বলল আলফাদ। মেয়েটি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,
“ঠিক আছে, আমি একটু বাড়িয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।”

মেয়েটি যখন ওদের দুজনের খাবার নিয়ে কামরায় ঢুকলো তখন আলফাদ গোসলে চলে গেছে। কোকো গোসল শেষে এসে বসে আছে বিছানায়, হাতে একটা টেনিস বল। খালি গা, পরণে শুধু ওকটা ট্রাউজার।
বলটা হাতে নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে সে ভাবছিলো এই অন্ধকুঠিতে আবার টেনিস খেলার পুলক কার জেগেছিলো! তখনি মেয়েটা ট্রে হাতে কামরায় ঢুকে কোকোর অনাবৃত, বলিষ্ঠ শরীর দেখে চোখ নামিয়ে ফেললো সাথে সাথে। কোকো মেয়েটির উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই দ্রুত পাশে রাখা ভেজা টাওয়েল টা নিয়ে নিজের গায়ে জড়ালো। মেয়েটি ট্রে নামিয়ে চলে যেতে নিতেই কোকো ভ্রু কুচকে রুক্ষ স্বরে বলে উঠলো,

“এই আপনি নক না করে ঢুকলেন কেন?”
কোকোর প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো মেয়েটি। অপ্রস্তুত হয়ে তাকিতে রইলো কোকোর দিকে৷
কোকোদের মহলের কামরায় মেয়েদের ভেতরে একমাত্র শেহজাদী ছাড়া অন্য কেউ হুটহাট কখনোই ঢোকেনা, লিন্ডা পর্যন্ত না৷ শেহজাদী নিজে একবার হলেও নক করেন, যদিও তিনি একবার নক করেই ঢুকে পড়েন, কারণ তার কোনো প্রয়োজন হলে তখন দেরি সহ্য হয়না।
কিন্তু এ মেয়ে! বিন্দুমাত্র ভদ্রতা জ্ঞান নেই!
মেয়েটি দ্রুতই নিজের থতমত ভঙ্গি ছাড়িয়ে ফেলে কোকোর মতোই রুক্ষ স্বরে শুধোলো,

“তাতে কি হয়েছে শুনি? আপনার কোন গুরুত্বপূর্ণ, দামি জিনিস আমি দেখে ফেলেছি?”
কোকো ভ্রু কুচকালো, মেয়েটি কি এ কথা দিয়ে ওকে কম দামি প্রমাণ করতে চাইলো? ও কি দামি নয়? ওর কত দাম সেটা এই শরীর নিয়ে জঙ্গলে বেরোলেই সবাই টের পায়, সব গুলো সুড়সুড়িয়ে পালায় ওর অত্যাচার থেকে বাচার তাগিদে, এমনকি ওর স্বজাতীরা পর্যন্ত! আর এই মেয়ে কিনা ওকে কম দামী ঠাওরেছে? কোনো অত্যাচার ছাড়াই ফ্রি ফ্রি দেখে আবার এত বড় কথা?

“আপনি তো ভালোই বেহায়া! নক না দিয়ে ঢুকে পড়েছেন আবার জিজ্ঞেস করছেন গুরুত্বপূর্ণ কি দেখে ফেলেছেন?”
রাগী স্বরে বলল কোকো, মেয়েটি চোখ কুচকে বলল,
“এমন বিশেষ কিছু দেখিনি যে আপনার এত নাটক করতে হবে! ওই হলো দেহ তাই নিয়ে অহংকারের শেষ নেই!”
“ওহ, তাহলে আপনার লজ্জা লাগার জন্য বিশেষ কিছু দেখার প্রয়োজন হয়? সেটা আগে বলবেন না? বললে প্যান্ট খুলে বসে থাকতাম।”
তাচ্ছিল্যের সুরে বলল কোকো।
মেয়েটির কান গরম হয়ে গেলো। ছিঃ ছিঃ! এই ছেলেটাকে ও কিনা নরম সরম ভেবেছিলো! এর দেখি মুখে কিছুই আটকায় না! মেয়েটি কথা না বাড়িয়ে ভ্রু কুটি করে অত্যন্ত বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে যেতে নিলো, কিন্তু কোকোর রাগ পড়লোনা তখনো, মেয়েটাকে আরও খানিক শিক্ষা দিতে গমগমে গলায় ও বলল,

“কোথায় যাচ্ছেন? যা দেখেছেন ফেরত দিয়ে যান৷”
“ফেরত দেবো মানে? দেখলে আবার তা কিভাবে ফেরত দিতে হয় শুনি? আমি কি এখন আমার চোখ কেটে আপনাকে দিবো নাকি?”
রাগ ঝড়ে পড়লো মেয়েটির গলায়, কোকো বলল,
“না অতো কষ্ট করতে হবে না। জামা খুলুন, আমিও দেখবো, শোধে শোধ৷”
রাগে চোখে পানি এসে গেলো মেয়েটির। কোকো আবার বলল,
“আপনার মতোন আমিও এক পলক দেখেই চোখ নামিয়ে নেওয়ার অভিনয় করবো, এই নিন টাওয়েল, দেখা শেষে গায়ে জড়িয়ে নিবেন।”

বলে টাওয়েল টা ছুড়ে দিলো মেয়েটির মুখের ওপর। এমন সময় আলফাদ হুড়মুড়িয়ে বের হলো গোসল খানা থেকে। এতক্ষণ দুজনের ঝগড়া শুনতে শুনতে দুড়ুম দাড়াম করে গোসল শেষ করছিলো ও, কোকো যে মানুষ তাতে এক্ষুনি একটা ফাটাফাটি বেধে যাবে এই ভয়ে দ্রুত পোশাক পরছিলো ও, কিন্তু তার ভিত্রেই যা হবার হয়ে গেছে!
আলফাদকে বের হতে দেখে মেয়েটি চোখ ভর্তি পানি নিয়ে রাগে, লজ্জায় ছুটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আলফাদ একবার মেয়েটির যাওয়ার দিকে আরেকবার কোকোর দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনার গলায় বলল,

“কেন মেয়েটার সাথে এমন ব্যাবহার করলি বলতো! এমনিতেই আমরা এদের ওপর উড়ে এসে জুড়ে বসেছি, ওদের খাবার সাপ্লাই কম, সেখানে তোর আমার জন্য ওদের এক্সট্রা খাবার টানতে হচ্ছে। তার ওপর তোর হাতির খোরাক! তুই জ্বরে পড়ার পর থেকে ওই মেয়েটা রাত দিন এক করে তোর সেবা যত্ন করেছে, আর তুই কিনা এমন বিহেইভ করছিস!”
কোকো আলফাদের কথাটা তাচ্ছিল্যের সাথে মাথা নাড়িয়ে উড়িয়ে দিয়ে খেতে বসলো সাথে সাথে। আলফাদ একবার ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করতে করতে গেলো মেয়েটিকে খুঁজতে।

হরিণের মাংস আগুনে ঝলসাতে দিয়ে আনাবিয়া এখন দাঁড়িয়ে আছে মীরের সামনে, এই জংলীকে কিভাবে, কোন দিক দিয়ে সভ্য বানানোর কাজ শুরু করা যায় সেই চিন্তায় ভ্রু কুচকে আছে ওর৷ মীর আর শেয়ালের বাচ্চাটা পাশাপাশি বসে আছে।
একটু আগেই আবার দুটো ঠুনোঠুনি বাধানোতে আনাবিয়া ধমক দিয়ে বসিয়ে রেখেছে দুজনকে পাশাপাশি, বলেছে আর একবারও দুজনে কোনো অশান্তি বাধালে ও এখনি দুজনকে ছেড়ে চলে যাবে৷ আনাবিয়ার হুমকিতে তাই দুজনেই চুপচাপ বসে আনাবিয়ার কাজ কর্ম দেখছে।
আনাবিয়া এগিয়ে এসে বসলো মীরের সামনে, বলল,

“দাঁত দেখি, ইইই করো, ইইইইইইই…..!
মীর আনাবিয়ার দেখা দেখি দাঁত মেলে ধরলো, আনাবিয়া ভ্রু কুচকে মীরের দাঁত দেখার চেষ্টা করলো ভালো ভাবে। ঝকঝক তকতক করছে, কি খেয়েছে এমন যে দাঁতে সামান্য দাগ পড়েনি!
“আ করো এবার, আআআআআআ……!
মীর আনাবিয়ার দেখা দেখি মুখ আগলা করলো, আনাবিয়া কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে কিছু একটা ভেবে উঠে যেতে নিলো। তখনি শেয়ালের বাচ্চাটা লাফিয়ে ওর কোলের ওপর উঠে এসে নিজের দাঁত মেলে দেখাতে লেগে গেলো আনাবিয়াকে। আনাবিয়া ওর ঘাড়ের কাছের চামড়া ধরে উঁচু করে নামিয়ে দিতে দিতে বলল,
“তোর দাঁত এমনেও পরিষ্কার৷”

বাচ্চাটা মনোক্ষুণ্ণ হলো, মন খারাপ করে মীরের পাশে গিয়ে চুপচাপ বসলো আবার। মীর এক পৈশাচিক আনন্দ পেলো যেন তাতে, বাচ্চাটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণা বাকিয়ে হাসলো।
আনাবিয়া আগুন করার স্থান থেকে কিছু কাঠ কয়লা হাতে নিয়ে মীরের দিকে এগোতে এগোতে বলল,
“ব্রাশ ট্রাশ আমার কাছে নেই, এখন এই কাঠ কয়লা দিয়েই কাজ চালাতে হবে রাজামশাই।”
মীর কিছুই বললোনা, উৎসুক হয়ে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার সামনে দিয়ে হেটে বেড়ানো এই পাতলা গড়নের তুষার শুভ্র মেয়েটির দিকে, যার সফেদ চুলের বহরে ঢেকে আছে তার সম্পুর্ন পিঠ, নিতম্বের নিচ পর্যন্ত। সারাদিন দেখলেও এর রূপের বাহার যেন শেষ হবে না।
আনাবিয়া এসে দাড়ালো মীরের সামনে, তখনও মীর তাকিয়ে রইলো ওভাবেই। আনাবিয়া ওর চোখের সামনে দুবার তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলো,

“এই যে মিস্টার কাকতাড়ুয়া, এইভাবে সঙয়ের মতোন বসে থাকলে চলবে না, আসুন আমার সাথে।”
তারপরেই মীরের বাহু ধরে দাঁড়া করালো ও, কিন্তু বহুবছর যাবৎ একই ভঙ্গিতে বসে থাকার কারণে মীরের পা জোড়া ঠিকমতো খুলছে না, হাটুর কাছে আটকে আছে যেন। সেদিন সে কিভাবে তার বাধন ছিড়ে অতটা রাস্তা ছুটে গিয়ে আবার ফিরেছে তা মীর নিজেও জানেনা!

কোন আকর্ষণে, কিসের টানে সে যে ছুটে গিয়েছে! শুধু এক কন্ঠস্বর; যার মালকিন এই শুভ্র মেয়েটি। শান্তি শান্তি অনুভূতি হয় যার মুখের দিকে তাকানো মাত্রই, বুক শান্ত হয়, আগের মতোন অসহায় লাগে না, একা একা লাগে না! বিনা বাক্যব্যয়ে তাই এই শান্তির সমস্ত কথা মীর মেনে চলে, অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মতোন।
রক্ষাকর্ত্রী তার, কালো আঁধারের ভীষণ শক্ত বাধন হতে তার ছিড়ে চলে আসার একমাত্র প্রভাবক! এর সমস্ত আদেশ পালন না করে তার বুনো মন কোথায় যাবে?

আনাবিয়াকে অবলম্বন করে মীর দাঁড়ালো সোজা হয়ে, চেষ্টা করলো দুপায়ে হাটার, কিন্তু হাটুর নিচে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভূত হওয়ায় কিছুক্ষণ পর পরই থেমে যাচ্ছে সে৷ আনাবিয়ার কাঁধ জড়িয়ে আছে মীর শক্ত হাতে, আনাবিয়া এক হাতে ওর কোমর আকড়ে ধরে অন্য হাতে কাঁধে রাখা মীরের হাতখানা ধরে ওকে হাটিয়ে নিয়ে চলেছে সমুদ্রের দিকে৷
পায়ের ওপর সমুদ্রের ভেসে আসা ঢেউয়ের স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠলো মীর, সরে যেতে চাইলো পেছনে। তার শরীর যেন মানলো না এই নরম ঢেউ, ধাতব শিকলের জংধরা ঠাণ্ডায় তখনো যেন হাত বাধা তার!
মীরকে থমকে যেতে দেখে আনাবিয়া শক্ত করে ধরলো ওকে, মীর ভ্রু তুলে শঙ্কিত চোখে তাকালো ওর দিকে, আনাবিয়া চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো,

“ভয় নেই, আমি আছি।”
মীর অতটুকুতেই আস্বস্ত হলো, পা বাড়িয়ে দিলো সামনে, পানির ঝাপটা এসে ছুয়ে দিলো ওকে! অনেক অনেক দিন পর বৃষ্টির পানি ব্যাতিত অন্য কোনো পানিকে স্পর্শ করলো ও, সারা শরীরে আনন্দের শিহরণ বয়ে গেলো হঠাৎ!
খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনো রকমে হাটু সমান পানির ভেতরে গিয়ে পৌছালো দুজন। শেয়ালের বাচ্চাটা পেছন পেছন এলেও ঢেউ যখন তার দিকে তেড়ে এলো তখন ভয়ে সে ছুটে পালিয়ে আবার গিয়ে বসে রইলো নির্ধারিত স্থানে৷
মীরকে পানির ভেতর বসালো আনাবিয়া, মীর বুঝলোনা এই মেয়েটির মাথায় কি চলছে, কেন তাকে সকাল সকাল এভাবে সমুদ্রের মাঝখানে এনে বসানো হলো।

কিন্তু যখনই আনাবিয়া এসে মীরের মুখোমুখি হয়ে ওর কোলের ভেতর বসে পড়লো তখন মীরের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো! হতবিহ্বল হয়ে সে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখের দিকে, এক অদ্ভুত বুনো, আদিম অনুভূতির আলোড়নে তার সারা শরীর সিড়সিড় করে উঠলো।
আনাবিয়া মীরের ঊরুর ওপর হাটুতে ভর দিয়ে বসলো, কাঠ কয়লা হাতে গুড়ো করে আঙুল দিয়ে মীরের দাঁত ঘঁষে দিতে শুরু করলো। মীর পুরোটা সময় স্থীর হয়ে বসে রইলো সম্পুর্ন, আনাবিয়ার মুখখানা ছাড়া অন্য কোনোদিকে গেলোনা তার প্রচন্ড নেশালো দৃষ্টি।
দাঁত গুলো আরও ঝকঝকে তকতকে করে দিয়ে ধুয়ে মুছে আনাবিয়া বলল,

“বসো এখানে, আমি এখনি আসছি।”
বলে তীরে গিয়ে বনের ভেতর থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা সোপনাট আর অ্যালোভেরার সাথে নিজের খঞ্জরটি নিয়ে ফিরে এলো আবার। মীরের কোলে আগের মতো করে বসেই বলল,
“ভালো নাপিত আমি নই, কেটেকুটে গেলে আমার কিছুই করার নেই।”
অ্যালোভেরার জেল গুলো বের করে মীরের জঙ্গল দাঁড়িতে ভালোভাবে মাখিয়ে দিলো, তারপর খঞ্জর দিয়ে খুব ধীরে ধীরে সন্তর্পণে মীরের দাঁড়ির জঙ্গল সাফ করে ওর হুলিয়া পালটে দিলো সম্পুর্ন!
দাঁড়ি কাটা শেষে আনাবিয়া কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে ওকে দেখে অবশেষে মন্তব্য করলো,
“আরহামের হেনসাম পোলা।”

এরপর মীরকে সমুদ্রের আরও একটু গভীরে নিয়ে গিয়ে, পেট পর্যন্ত ডুবিয়ে পানিতে বসিয়ে, আজলা ভর্তি পানি নিয়ে ভিজিয়ে দিলো মীরের চুল। চুলের নোংরা জটের ভেতর আটকে যাওয়া শুকনো, মরা ছোট্ট ছোট্ট ডাল পাতা গুলোকে সরিয়ে নিজের আঙুলের সাহায্যে একটু একটু করে ছাড়াতে শুরু করলো চুলের জট।
আস্তে আস্তে একেকটা জট খুলে খুলে, পানি দিয়ে দিয়ে নরম করে ফেললো ও মীরের চুল। অতঃপর সোপনাট গুলো চটকে তার কিছু অংশ ওর চুলে দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে বের করে ফেললো এতদিনের জমে থাকা সমস্ত নোংরা।
আজলা ভর্তি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলল মীরের চুল। পিঠ ছাড়িয়েও নিচে নেমে গেছে মীরের পূর্বের কাঁধ সমান চুল! আনাবিয়া তা দেখে মৃদু হেসে মন্তব্য করলো,

“আরেকটু লম্বা হলেই আমাকে হারিয়ে দিবে দেখছি!”
মীর কোনো শব্দ করলোনা, আনাবিয়ার দিকে নিজের বুনো চোখ জোড়া দিয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে এই সভ্য হওয়ার সেবা টুকু মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলো। ওই নরম হাতের ছোয়া, একটু পর পর মেয়েটির রিনরিনে কন্ঠের হাসি-কথা, হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখের চাহনি, বুক থেকে ভেসে আসা নেশালো ঘ্রাণ সবকিছুকে যেন নিজের সকল ইন্দ্রিয় দিয়ে গিলে নিতে লাগলো! ওর মনে হলো কোন এক জাদুমন্ত্র বলে এই মেয়ে যেন ওকে আটকে নিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে ওর সকল ক্রোধ, ওর প্রতিবাদ-বিদ্রোহের সমস্ত ক্ষমতা!
আনাবিয়া বন হতে সংগ্রহ করে নিয়ে আসা একটা গাছের ছোট্ট পাতলা, শুকনো, ফাঁপা, নরম বাকলে চটকানো সোপনাটের কিছু অংশ নিয়ে ফ্যানা বানিয়ে পরিষ্কার করতে উদ্যত হলো মীরের শরীর।

মীরের গাল, চোখের নোংরা কোণা, ঠোঁটের পাশে ধীরে ধীরে টেনে টেনে মুছে দিলো। ঠিক ছোট্ট শিশুটিকে গোসল দেওয়ার মতোন আলতো হাতে মীরের গলা, কাঁধ, বুকে জমা ধুলোর আস্তরণ, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের চিহ্ন, জমে থাকা শুকনো ঘাম সমস্তই একটু একটু করে অত্যন্ত যত্নে পরিষ্কার করে দিলো আনাবিয়া।
ওর নিঃশব্দ স্নেহের স্পর্শে মীর থেকে থেকে কেঁপে উঠতে লাগলো, বহুবছর পর পাওয়া এই আদুরে স্পর্শ যেন ওর মরিচা ধরা হৃদয়ে নাড়া দিতে লাগলো একটু একটু করে!

আনাবিয়া মীরের হাত জোড়া নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আলতো করে মুছে দিলো ওর আঙুলের ফাঁকে জমে থাকা নোংরা, নখের নিচের ময়লা। তারপর আজলা ভর্তি পানি নিয়ে ঢাললো মীরের গাল, কপাল, ঘাড়, বুকে।
এক পর্যায়ে হঠাৎ প্রচন্ড কৌতুহলী হয়ে ওর গায়ে পানি ঢালতে থাকা আনাবিয়ার হাতখানা ধরে নিলো মীর নিজের হাতে, মুঠির ভেতর নিয়ে একবার চাপ দিয়ে উলটে পালটে দেখতে লাগলো কি আছে এই হাতে, এত প্রশান্তি এই হাত কিভাবে দিচ্ছে! এত কোমলতা এই হাত কিভাবে ধারণ করেছে? এই আশ্চর্যজনক হাতখানা এই মেয়েটা কোথায় পেয়েছে?

আনাবিয়া কাজে বাধা পাওয়ায় বিরক্ত হলো, হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার পানি ঢাললো মীরের মাথায়।
আকাশে মেঘ করেছে বেশ৷ সূর্য নিস্তেজ হয়ে আছে, সমুদ্রের ঢেউ হয়ে এসেছে নরম। শান্ত, নিস্তব্ধ শীতল বাতাসে পরিপূর্ণ এই অসাধারণ পরিবেশে আনাবিয়ার হঠাৎ ভালো লাগলো ভীষণ, এমন প্রশান্তিকর পরিবেশ ও শেষ কবে পেয়েছে মনে পড়লোনা। মৃদু হাসি খেলে গেলো ওর ঠোঁটে।
বুনোকে সভ্য বানাতে গিয়ে আনাবিয়া ভিজে গেছে সম্পুর্ন, গা বেয়ে ঝরে পড়ছে পানি৷ সফেদ চুলগুলো ভেজা, সাদা রঙা ট্যাংক টপ টা ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। শীতল বাতাসে শরীরটা কাঁপছে সামান্য৷ তবুও মুখখানা ছেয়ে আছে প্রশান্তিতে। মীরের কোলে ওভাবেই বসে ও ভাবতে লাগলো আর কি করা যায়!
হাত ধরে পাত্তা না পাওয়ায় মীরের দৃষ্টি গেলো এবার আনাবিয়ার সফেদ চুলে। পানিতে ভিজে, সূর্যের ওই সামান্য আলোতে ঝিকিমিকি করছে তা। ধীরে ধীরে চুলের দিকে এগিয়ে এলো মীরের হাত, বড় নিঃশব্দে, ভয়ে, যেন সে ছুঁয়ে দিতে চলেছে কোনো সদ্য ফোটা ছোট্ট পাখির নরম পালক!

আনাবিয়া বাধা দিলোনা, বসে রইলো তেমনি। মীরের আঙুল সামান্য দ্বিধা নিয়ে এসে ঠেকলো আনাবিয়ার চুলে। ছুঁয়েই সে আবার হাত সরিয়ে নিতে চাইলো, এই বুঝি শুভ্র মেয়েটা আবার বকা দেয় ওকে।
কিন্তু না, মেয়েটি যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালোনা! সাহস পেলো যেন, আস্তে ধীরে আঙুল গুলো আনাবিয়ার ভেজা চুলে জড়িয়ে নিলো।
চুলগুলো খুব নরম, হাত দিতে ওর ভাল্লাগছে খুব। মনে হচ্ছে যেন কত জনম জনমের চেনা এই চুল! আগে কতই না স্পর্শ করেছে, কতই না হাতে জড়িয়েছে! এক অন্যরকম ভালো লাগায় ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো মীরের, বুঝলোনা এই অনুভূতিকে ঠিক কি বলা যায়!
চুলের ভেতর হাত চালাতে গিয়ে ওর আঙুল হঠাৎ আটকে গেলো একটা ছোট্ট জটে। সাথে সাথেই হাত থামিয়ে ফেলেলো মীর, শঙ্কিত চোখে তাকালো আনাবিয়ার মুখের দিকে, ভয় হলো মেয়েটি বোধ হয় ব্যাথা পেলো, এই সুন্দর চুল বুঝি এবার ছিড়ে যাবে জটের স্থান হতে!
আনাবিয়া ওর হাতের ওপর নিজের হাত স্পর্শ করে আশ্বাস দিলো যে তার কিছুই হয়নি, সে একদম ঠিক আছে।
মীর স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো, আবার আঙুল রাখলো ছোট্ট জটটায়, তারপর আলতো হাতে খুব মনোযোগ দিয়ে একটু একটু করে জট ছাড়িয়ে দিলো।

ছাড়িয়েই আনাবিয়ার মুখের দিকে চেয়ে গর্ভ ভরে হাসলো, যেন খুব কাজের কাজ কিছু করে ফেলেছে, এখন সে প্রসংসার দাবিদার। আনাবিয়া ঠোঁট টিপে হাসলো, উঠে যেতে নিলো মীরের কোল থেকে।
কিন্তু ও উঠতে নিতেই মীর ঝটিতি দুহাতে আকড়ে ধরলো ওর কোমর, পরক্ষণেই এক টানে আবার বসিয়ে দিলো নিজের কোলে। মুখের ভাবে যা বোঝালো তার অর্থ এই,
“শুধু এতটুকুই? আরও অনেকক্ষণ কেন বসবে না আমার কোলে?”
নরম হাতের স্পর্শ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ক্ষোভে তেজ ভর্তি চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে। আনাবিয়া ওর হাত জোড়া ছাড়িয়ে নিয়ে উঠলো আবার, বলল,
“উঠতে হবে, ঠান্ডা লেগে যাবে। সারাদিন এখানে বসে থাকা চলবে না। দেখি….উঠো…!”
বলে মীরের বাহু ধরে টেনে উঠালো পানির ভেতর থেকে। তারপর মীরের ঘষামাজা সম্পুর্ন শরীর পরখ করে নিয়ে নাক ফুলিয়ে, মুখ বেকিয়ে বলল,

“শালা তো নোংরাই ভালো ছিলো, এখন এই হেনসাম থোবড়া নিয়ে বাইরে বের হলে তো বেয়াদব মেয়ে গুলো মৌমাছির মতন বো বো করতে করতে চলে আসবে।”
পরক্ষণেই কি ভেবে শক্ত হয়ে এলো ওর চোয়াল। মীরের হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিলো আনাবিয়া, ওর হঠাৎ এমন আচরণে ভ্যাবাচেকা খেলো মীর। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক কি হলো হঠাৎ!
আনাবিয়া গটগটিয়ে আগে আগে একা চলে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে বলল,

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২২

“যা ইচ্ছে করুক, আমার কি? মেয়েরা গিলে খাক, কামড়ে খাক আ’ ডোন্ট কেয়ার’! আমার দায়িত্ব শেষ।”
মীর সমুদ্রের মাঝে হাটু অব্দি পানিতে অনাবৃত শরীরে আনাবিয়ার যাওয়ার পানে চেয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো একা একা৷ আনাবিয়া অর্ধেক গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বাজখাঁই গলায় চেচিয়ে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন? হেটে এসো একা একা, আমি তোমাকে বইতে পারবোনা!”
বলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেলো তীরে, মীর এই হঠাৎ ক্রোধের কারণ বুঝতে না পেরে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here