mad for you part 13
তানিয়া খাতুন
সূর্যের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
নরম আলো এসে পড়েছে রুহির মুখে।
রুহি ঘুমের মধ্যে বারবার পাশ ফিরে শুচ্ছে, কখনো বালিশটা জড়িয়ে নিচ্ছে, কখনো আবার হাতটা মুখের উপর রাখছে।
হঠাৎ করেই চোখ খুলে যায় তার।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে—
“আল্লাহ! বেলা ১১টা!”
চোখ কচলাতে কচলাতে বিড়বিড় করে বলে,
“এতক্ষন ঘুমিয়েছি আমি?”
রুহি তাড়াতাড়ি উঠে বসে, চুলের এলোমেলো গোছাটা ঠিক করতে করতে চারপাশে তাকায়।
ঘরে নিস্তব্ধতা, শুধু জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পর্দাটা দুলছে।
বিছানার অপর পাশে তাকাতেই তার বুকটা কেমন হালকা হয়ে যায়—
ক্ৰিশ নেই।
মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে, যেন একটু স্বস্তি পেল।
“রাক্ষসটা মনে হয় বাইরে গেছে,” বিড়বিড় করে বলে,
“এই সময়টাই আমার সুযোগ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দ্রুত পা নামিয়ে বিছানা থেকে নামে, পায়ের শব্দ যেন না হয় সেই চেষ্টায় ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোয়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে মেইন দরজার কাছে এসে থেমে যায়।
দরজাটা আধখোলা, কিন্তু বাইরে উঁকি দিতেই চোখ কপালে—
বাইরে পাঁচ জন গার্ড দাঁড়িয়ে, চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।
রুহির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
“তাহলে পালাব কই?” সে নিজের সঙ্গে ফিসফিস করে।
মাথায় হঠাৎ একটা ভাবনা আসে— ছাদ!
ওর চোখে একটু জেদ, একটু সাহস জ্বলে ওঠে।
“ওরা নিচে পাহারা দিচ্ছে, কিন্তু ওপরটা নিশ্চয়ই ফাঁকা…”
চুপিচুপি পা ফেলে সিঁড়ির দিকে এগোয়।
প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর একটু সাহস পেয়ে দৌড়ে ওঠে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে তার নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে, গলার পাশে ঘাম জমে যায়।
অবশেষে ছাদের দরজাটা খুঁজে বের করে, ধীরে ঠেলে খোলে।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সকালবেলার উজ্জ্বল আলো চোখে এসে পড়ে।
ছাদে উঠে রুহি হালকা বাতাসে একটু নিশ্বাস নেয়, চুলগুলো মুখে এসে পড়ে, সে সরিয়ে নেয় হাতে।
এক পা এগিয়েই থেমে যায়।
চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার—
সামনেই ক্ৰিশ, খালি গায়ে পুশ-আপ দিচ্ছে।
সূর্যের আলোয় ঘামে ভেজা শরীর চকচক করছে, প্রতিটা মাংসপেশি স্পষ্টভাবে ওঠানামা করছে।
ওর নিঃশ্বাসের শব্দ ছাদে প্রতিধ্বনি তুলছে।
রুহি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
চোখ সরাতে পারছে না, অথচ নিজের মনে ভয়ও লাগছে।
আর ঠিক তখনই — ক্ৰিশ থেমে যায়।
ধীরে মাথা তুলে তাকায় সেই দিকেই, যেখানে রুহি দাঁড়িয়ে আছে।
ওদের চোখ এক মুহূর্তের জন্যে মিলিয়ে যায় —
রুহির নিঃশ্বাস আটকে যায়, আর ক্ৰিশের ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে ওঠে…
রুহি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্ৰিশ পুশ-আপ থামিয়ে ধীরে ধীরে শরীরটা সোজা করে বসে।
সূর্যের আলো তার কাঁধ, বুক, আর ঘামে ভেজা গায়ের উপর পড়ে এক অদ্ভুত দীপ্তি তৈরি করেছে।
চোখ দুটো সরাসরি রুহির দিকে নিবদ্ধ।
একফোঁটা হাসি ঠোঁটের কোণে খেলছে — এমন হাসি, যেটা ভয় আর আকর্ষণ দুই-ই জাগায়।
রুহির বুক ধড়ফড় করছে।
সে অজান্তেই এক পা পিছিয়ে যায়।
চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়েছে, ঘামের ফোঁটা কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু চোখ সরাতে পারছে না ক্ৰিশের দিক থেকে।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
তাঁর প্রতিটা পদক্ষেপে ছাদের মেঝে যেন ভারী হয়ে ওঠে।
রুহি পেছাতে থাকে, কিন্তু পেছনে দেয়াল — পালানোর আর জায়গা নেই।
ক্ৰিশ থেমে যায় রুহির সামনে, এক হাত দিয়ে ঘাম মুছে বলে,
“আমাকে খুব মিস কৱছিলে বুঝি।”
রুহির গলা শুকিয়ে যায়, কষ্ট করে বলে,
“আমি… আমি শুধু একটু বাতাস নিতে এসেছিলাম।”
ক্ৰিশ হালকা হেসে বলে,
“বাতাস নিতে?”
একটু কাছে এগিয়ে এসে নীচু স্বরে বলে,
“তুমি তো আমার নিঃশ্বাসটাই নিয়ে গেলে, বাটারফ্লাই।”
রুহিঃ “অতিরিক্ত কথা বলার দৱকাৱ নেই্ আমি গলবো না”
ক্ৰিশ আরও এক ধাপ কাছে আসে,
তার গলার স্বর কোমল হয়ে যায়,
“এত পালানোৱ চেষ্টা কৱো না বাটারফ্লাই, যতো দূৱে যেতে চাইবে আমি তোমাকে তত কাছে টেনে আনবো।
রুহি চোখ তুলে তাকায়, চুপচাপ।
দুজনের মাঝে মাত্র এক হাত দূরত্ব।
বাতাস থেমে গেছে যেন, সূর্যের আলো দুজনের মুখে নরমভাবে পড়ছে।
ক্ৰিশ হঠাৎ চোখ নামিয়ে নেয়,
তারপর ধীরে বলে,
“চলো, নিচে চল। আমি নাস্তা বানিয়েছি। খালি পেটে কেউ এত দৌড়ায় নাকি।”
রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
ইনি জানলো কী কৱে আমি দৌঁড়েছি।
ক্ৰিশ হেঁটে নিচে নামতে থাকে।
রুহি কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে তার পেছনে হাঁটে —
কিন্তু মনে মনে ভাবে,
“এই মানুষটার ভিতরটা আসলে কেমন।”
রুহি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে, কিন্তু ঠিক নীচে নামতেই ক্ৰিশ তার হাত ধরে ফেলে।
অপ্রত্যাশিত টানে রুহি সামান্য হোঁচট খায়, ক্ৰিশ স্থির গলায় বলে —
“চলো, বসো।”
সে রুহিকে ডাইনিং টেবিলের পাশে চেয়াৱে বসিয়ে দেয়, যেন আদেশও আছে, যত্নও আছে একসাথে।
ক্ৰিশ নিজের গলায় জড়িয়ে থাকা তোয়ালেটা খুলে ঘাম মুছতে শুরু করে।
ঘাম মুছতে মুছতে বোতল খুলে ঠান্ডা পানি গলায়
ঢেলে নেয়।
প্রতিবার গিলবার সঙ্গে সঙ্গে ক্ৰিশের Adam’s apple নড়ে ওঠে—
রুহি অজান্তেই চোখ আটকে রাখে সেই দৃশ্যে,
মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে কিছুক্ষণের জন্য।
ক্ৰিশ বোতলটা নামিয়ে রাখে।
তারপর রান্নাঘর থেকে একটা ট্রে এনে টেবিলে রাখে—
তার মধ্যে আছে ডিম সেদ্ধ , মাখন মাখানো রুটি, সুপ আর কাটা কলা।
ক্ৰিশ হাসিমুখে বলে,
“নাও বাটারফ্লাই, খেয়ে নাও। শুধু কলা খেও না।”
রুহি ভুরু কুঁচকে তাকায়,
“কেন?”
ক্ৰিশ ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে বলে,
“তোমার জন্য সব কলা নিষিদ্ধ। আমার কলা ছাড়া আর কিছু নয়।”
রুহির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়,
“আপনার… মানে?”
সে কপাল কুঁচকে হালকা বিস্ময়ে বলে,
“আপনি কি কলা চাষ করেন নাকি?”
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে,
তার শরীর থেকে পাৱফিউম আর ঘামের মিশ্র গন্ধ ভেসে আসে।
রুহির পাশে এসে সে নরম গলায় কানে ফিসফিস করে বলে —
“না বাটারফ্লাই… চাষ করিনি,
কিন্তু একটা কলা তৈরি করেছি প্রায় পঁচিশ বছর ধরে… সেটা সামলে ৱেখেছি।”
রুহির চোখ বড় হয়ে যায়।
সে হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ায়, মুখে একরকম ঘৃণা সুরে বলে —
“ছি! আপনার খাবার, আপনার কলা — সব আপনি খান! আমি কিছু খাব না।”
ক্ৰিশ স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে,
ঠোঁটে আরেকবার সেই অদ্ভুত, অস্পষ্ট হাসি ফুটে ওঠে —
রুহি ধীরে ধীরে পেছনে ফিরল, চোখে একরাশ রাগ, মুখে গাম্ভীর্য—
“আমি যাচ্ছি,” বলে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।
হঠাৎ পিছন থেকে ক্ৰিশেৱ শক্ত হাত তার কোমর ঘিরে ধরল।
“কোথায় যাবে বাটারফ্লাই,” গলা ভারী হয়ে এল ক্ৰিশেৱ।
সে এক টানে রুহিকে টেনে তুলে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিল।
টেবিলের ধারে রুহির হাত ঠেকে গেল, গায়ে গরম স্রোত বয়ে গেল।
ক্ৰিশ দুই হাত টেবিলের দুপাশে রেখে রুহির সামনে ঝুঁকে পড়ল—চোখ দুটো ওর চোখে গেঁথে আছে, নিঃশব্দে যেন বলছে “তুই আমার।”
রুহি একটু পেছোতে চাইলো কিন্তু পাৱলো না,
দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের মুখে এসে লাগছে, বাতাস ভারি হয়ে উঠছে।
ক্ৰিশ (চোখে হাসি নিয়ে): “তুমি না খেলে, আমিও খাব না বাটারফ্লাই… আর আমি না খেয়ে যদি মরে যাই, তুমি বিধবা হয়ে যাবে।”
রুহি (চোখ নামিয়ে, গলায় হালকা কাঁপুনি): “আপনি মৱলেই আমি বাঁচি।”
ক্ৰিশ ঠোঁটের কোণে হাসল, একটু দুষ্টু ভঙ্গিতে ধৱলো,
“আমার বউ বলেছে মরতে আমায়, কিন্তু আমি মরতে পারব না… রেল লাইনে বডি দেবো, মাথা দেবো না…”
সে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল। গলার সেই গভীর স্বর, অদ্ভুত গান শুনে ৱুহি
এক মুহূর্তের জন্য সে হেসে ফেলল, নিজের অজান্তেই।
সেই হেসে ওঠা যেন ক্ৰিশের চোখে আগুন ধরিয়ে দিল।
সে হাত বাড়িয়ে বাটাৱ রুটি নিয়ে রুহির মুখে ঠেলে দিল।
রুহি (বিস্মিত হয়ে): “উমম্… কি করছেন?”
ক্ৰিশ(কণ্ঠ নিচু করে): “চুপ করে খাও। মুখ দিয়ে বের করলে তোমার খবর আছে।”
রুহি ঠোঁট চেপে, চোখে জেদ নিয়ে, মুখ দিয়ে রুটিটা বের করার চেষ্টা করল।
ঠিক তখনই ক্ৰিশ ঝুঁকে এল—
তার এক হাত রুহির মাথার পেছনে, অন্য হাত টেবিলের ওপর।
তারপর নিজের ঠোঁট রুহির ঠোঁটে চেপে ধরল—
রুহির মুখের ভিতর থাকা রুটিটা যেন ওর ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট লেগে, নিঃশব্দে ঢুকে গেল ভিতরে।
এক মুহূর্ত নিঃস্তব্ধতা।
চোখে চোখ, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস—
রুহির বুক কাঁপছে, ক্ৰিশের গরম নিঃশ্বাস ওর গালে লাগছে।
রুহি ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
তার হাত অবচেতনে ক্ৰিশের বুক ছুঁয়ে গেল—জিম করা শরীরের তাপে ওর আঙুল কেঁপে উঠল।
ক্ৰিশের ঠোঁট তখনও রুহির ঠোঁটের ওপর, যেন সময় থেমে গেছে।
তারপর ক্ৰিশ ধীরে সরে এসে হাসল—
“এই তো হলো, এখন আমি মরব না। তুমিও না।”
রুহি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল, গাল লাল হয়ে উঠল।
তার বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কাঁপুনি, রাগ না ভালবাসা—সে নিজেও বুঝতে পারল না।
ক্ৰিশ কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে রুহির দিকে।
চারপাশে এমন নীরবতা—শুধু দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়।
ক্ৰিশ (হালকা স্বরে): “বাটাৱফ্লাই…”
রুহি ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। তাদের চোখ এক হলো।
দুজনার মাঝখানে যেন সময় থেমে গেল। বাতাসে এক অদ্ভুত কাঁপুনি, যেন পৃথিবীর সব শব্দ হারিয়ে গেছে এই এক মুহূর্তে।
ক্ৰিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল—এক পা, তারপর আরেক পা।
রুহি পিছু হটল না। শুধু চোখে এক অজানা আলো—ভয় না, প্রতিরোধ না, বরং একরাশ প্রশ্ন, এক চিলতে টান।
ক্ৰিশ ওর একদম কাছে এসে দাঁড়াল। দুজনার নিঃশ্বাস একে অপরের গালে লাগছে এখন।
ক্ৰিশ হাত বাড়িয়ে রুহির গাল ছুঁল—আঙুলের ছোঁয়ায় রুহির চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
এক মুহূর্তের নিঃশব্দতা।
তারপর ক্ৰিশ নিজের কপালটা এনে রাখল রুহির কপালে। দুজনের নিঃশ্বাস এক হয়ে গেল—ধীরে, গভীর, কাঁপা কাঁপা।
ক্ৰিশ (ফিসফিস করে): “আমি কখনো চাইনি তুই কষ্ট পাস… শুধু একটু কাছাকাছি আসতে চেয়েছিলাম।”
রুহি চোখ খুলল, নিঃশব্দে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল।
দুজনেই কিছু বলে না, কিন্তু দৃষ্টির ভেতর সব বলা হয়ে যায়।
ক্ৰিশের মুখ ধীরে রুহির মুখের কাছাকাছি এল—চোখে চোখ, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাস।
ক্ৰিশঃ “আমি বুঝতে পারছি বাটারফ্লাই…
তুই এখনো আমায় মানতে পারছিস না।
কিন্তু যেভাবেই হোক, বিয়েটা হয়ে গেছে—
আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী।”
রুহি মুখ তুলে তাকাল, চোখে অশ্রু জমে আছে। ক্ৰিশ তার চোখের দিকে চেয়ে আবার বলল—
“তুই চাইলে আমি তোকে সময় দেবো, নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে…
কিন্তু মনে রাখিস, আমি তোকে ছেড়ে যাবো না কখনো।
আর আমি নিজে গিয়ে তোর আব্বু-আম্মুর সঙ্গে কথা বলব, সব বুঝিয়ে বলব।
এই সম্পর্কের জন্য তোর পড়াশোনা বা ভবিষ্যৎ—কোনোটারই ক্ষতি হবে না।”
ক্ৰিশ (চোখে চোখ রেখে):
“শুধু একটা প্রতিশ্রুতি চাই—
তুই কোনোদিন আমায় ছেড়ে যাবি না।
যা-ই হোক, যতই ভুল বোঝাবুঝি হোক,
তুই প্রতিদিনের শেষে আমায় মনে রাখবি, পাশে থাকবি—এইটুকুই চাই।”
রুহি নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল ক্ৰিশের দিকে, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।
চোখের জল গড়িয়ে পড়ল গালে।
ক্ৰিশ ধীরে হাত বাড়িয়ে সেই অশ্রুবিন্দু মুছে দিল।
বাতাসে তখন এক গভীর নিস্তব্ধতা—
যেন পুরো ঘরটাই তাদের প্রতিশ্রুতির সাক্ষী হয়ে রইল।
কলেজের গেট দিয়ে ক্রিশের বাইক ঢুকতেই পুরো কলেজের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
কারণ আজ ক্রিশ একা নয়—তার বাইকের পিছনের সিটে বসে আছে রুহি।
সবাই চুপচাপ তাকিয়ে দেখছে, কেউ কেউ আবার ফিসফিস করছে, “ওটা রুহি না?”
আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি ক্রিশের বাইকে কোনো মেয়ে বসেছে।
সবসময় আমানকেই নিত সে। তাই আজকের দৃশ্যটা যেন সবাইকে চমকে দিল।
তার উপর, ইতিমধ্যেই পুরো কলেজে খবর ছড়িয়ে পড়েছে—ক্রিশ রুহিকে বিয়ে করেছে।
এখন কলেজে ছুটি চলছে, ক্লাস বন্ধ।
কিন্তু পরীক্ষা ফর্ম ফিল-আপের জন্য অনেকে এসেছে, তাই পুরো কলেজ চত্বরটা ছেলেমেয়েতে ভর্তি।
আর সবাই এখন একটাই দিকে তাকিয়ে—ক্রিশ আর রুহির দিকে।
রুহি মাথা নিচু করে বসে আছে, হালকা বাতাসে ওর চুল মুখে উড়ে আসছে।
ক্রিশ গাড়ি থামিয়ে পাশে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
“নামুন , ম্যাডাম।”
রুহি নামার সাথে সাথেই চারপাশে তাকিয়ে দেখলো। সবাই এখন শুধু ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে।
ক্রিশ বাইকটা পার্ক করে রুহির পাশে এসে দাঁড়াল।
তারপর ধীরে ধীরে ওর হাতটা ধরল, “চলো।”
দুজনেই হাত ধরে হাঁটা শুরু করল। ঠিক তখনই সিমরান দৌড়ে এসে বলল,
“তুই আসছিস?”
ক্রিশ হালকা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, তোমরা ফর্মটা ফিলাপ কৱে জমা দিয়ে দাও। আর এই কার্ডটা রাখ—সব পেমেন্ট এখান থেকে কৱবে।
আমাৱ একটু কাজ আছে, এক ঘণ্টা পর এসে ওকে নিয়ে যাব।
ততক্ষণ তুমি ওকে দেখে রেখো… কোনো ছেলে যেন ওর ধাৱে কাছে না আসে।”
সিমরান মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ওকে দেখে রাখব।”
ক্রিশ রুহির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল,
“বাটারফ্লাই, আমি তোমায় বিশ্বাস করতে পারি তো?”
রুহি মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল।
ক্রিশ এক পা এগিয়ে এসে রুহির কপালে হালকা করে একটা চুমু খেল।
চারপাশের সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল—বাতাসটাও যেন থেমে গেল মুহূর্তের জন্য।
তারপর ক্রিশ বাইকটা ঘুরিয়ে চলে গেল, আর রুহি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল—ওর কপালের উষ্ণ স্পর্শটা যেন এখনো রয়ে গেছে…
রুহি আর সিমরান ফর্ম ফিলআপ করে জমা কৱে এসে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে আছে।
হালকা রোদ, হাওয়া বইছে, কিন্তু দুজনের মনটাই ভারী।
সিমরান চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,
— “তুই কী ভেবেছিস, ক্রিশকে সত্যি সত্যিই মেনে নেবি?”
রুহি মৃদু হেসে বলে,
— “মানা ছাড়া আর কোনো রাস্তা পাচ্ছি না, সিমরান।
তার চোখে আমি যে ভালোবাসা দেখি, ওটা কি মিথ্যা হতে পারে? ওনার ওই পাগলামিগুলোও কি অভিনয়?”
সিমরান ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “তোর হঠাৎ এই অনুভূতিগুলো সত্যি মনে হচ্ছে কেনো?
তোকে তো সেদিনই বলেছিলাম, শিক্ষামন্ত্রীর বখাটে ছেলে ক্রিশের উপর বিশ্বাস করিস না।
আমি তো শুনেছি, অনেক মেয়ের সাথেই ও শুয়েছে!”
রুহি অবাক হয়ে তাকায়,
— “তুই কী বলছিস এসব?”
সিমরান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
— “বিশ্বাস না হলে কলেজের যেকোনো মেয়েকে জিজ্ঞেস করিস।
ও নাকি ক্লাবে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে রাত কাটাত।
এখন হয়তো তোর ভালোবাসা পেয়ে ‘ভালো’ হয়ে গেছে কৌতুক কৱে বলে সিমৱান!”
ঠিক তখনই এক অচেনা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে —
— “Excuse me…”
দুজনেই ঘুরে তাকায়। সামনে এক শর্ট ড্রেস পরা সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সিমরান বলে, “কিছু বলবে?”
মেয়েটা হালকা হেসে বলে,
— “Yes, but তোমাকে না, আমার রুহির সঙ্গে কথা আছে।”
রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, সিমরান কিছু না বলে উঠে পাশে সরে যায়।
অচেনা মেয়েটা রুহির সামনে এসে বসে।
— “আমি তোমাকে চিনি , কিন্তু তুমি আমাকে চেনো না। যাই হোক, বলো, কত টাকা লাগবে?”
রুহি ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “মানে?”
মেয়েটা ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,
— “মানে ক্রিশকে ছেড়ে দিতে কত টাকা নেবে?
তোমাদের মতো থার্ড ক্লাস মেয়েদের আমি ভালো করে চিনি।
বড়লোকের ছেলেদের পেছনে ঘুরে বেড়াও। পঞ্চাশ লাখ টাকা দেব, শুধু ক্রিশকে ছেড়ে দাও।”
রুহি রাগে গলা কাঁপিয়ে বলে,
— “Excuse me, মিস! আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন—আমি মি. ক্রিশের আইনসম্মত স্ত্রী।
আর আমি ওনার কাছে যাইনি, ওনিই এসেছে আমার কাছে।
তাই এইসব বাজে কথা আপনার ক্রিশকেই গিয়ে বলুন।”
বলে রুহি উঠে দাঁড়ায়।
মেয়েটা—কায়া—রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রুহিকে মারতে এগিয়ে আসে।
কিন্তু তার হাত থামিয়ে দেয় এক শক্ত হাত।
রুহি ঘুরে তাকাতেই দেখে—ক্রিশ!
কায়ার চোখে ভয় নেমে আসে।
ক্রিশ এক ঝটকায় জোরে একটা থাপ্পড় মারে,
— এত জোরে যে কায়া মাটিতে পড়ে যায়।
ক্রিশ আবার সামনে এগিয়ে যায়,
কিন্তু রুহি ছুটে এসে তার হাত ধরে ফেলে।
— “কি করছেন আপনি! পাগল হয়ে গেছেন নাকি?”
ক্রিশ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
— “আজ ওর হাত আমি ভেঙে দেব! ও তোমার গায়ে হাত দিতে যাচ্ছিল!”
কায়া ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দৌড়ে চলে যায়।
রুহি চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ বলে ফেলে,
— “আপনি ক’জন মেয়ের সঙ্গে বেডে গেছেন, মি. ক্রিশ?”
ক্রিশ চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নেয়,
— “ফালতু কথা বোলো না, বাটারফ্লাই। আমার মাথা গরম আছে এখন। পরে সব বুঝিয়ে বলব।”
রুহির চোখ ভিজে আসে, গলায় কাঁপুনি—
— “না, আমি এখনই সব জানতে চাই!
একটা নোংরা মানসিকতার, চরিত্রহীন মানুষের সঙ্গে আমি কোনোদিন থাকতে পারব না!”
ওর এই কথাতেই ক্রিশের ভিতরটা যেন আগুনে পুড়ে ওঠে।
রুহির এই কথাগুলো তার অন্ধকার অতীতকে যেন এক মুহূর্তে টেনে সামনে এনে দেয়।
রাগে, কষ্টে, যন্ত্রণায়—সে রুহির হাত ধরে টানতে টানতে বাইকের দিকে নিয়ে যায়।
রুহি চুপ, চোখ ভরা জল।
mad for you part 12
ক্রিশ বাইকে চেপে বসে, গর্জন দিয়ে ইঞ্জিন চালু করে।
বাইকটা ছুটে যায় পূর্ণ গতিতে…
রুহি কিছু বলে না, শুধু নিঃশব্দে বসে থাকে—
হয়তো ভেতরে ভেতরে সব ভেঙে যাচ্ছে, তবু সে সত্তি টা আজ জেনেই ছাৱবে।
