বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৬
রানী আমিনা
মীরের কোমরে পেচানো টাওয়েলের গিট্টু খুলে গেছে, প্রাণপণে সেটা আবার নতুন করে বাধার চেষ্টা করছে সে, মনে করার চেষ্টা করছে ঝিলমিলে মেয়েটি কিভাবে বেধেছিলো। কিন্তু চেষ্টা করেও যেন মনমতো হচ্ছে না, মেয়েটির মতন হচ্ছে না৷
ফক্সি মীরের থেকে দুরত্ব বজায় রেখে মীরের চারপাশে ঘুরঘুর করছে, মাথায় তার অনেক দুঃশ্চিন্তা। জঙ্গলের ভেতর একটা হায়েনা ওত পেতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে অনেকক্ষণ যাবৎ, সুযোগ খুঁজছে আক্রমণ করার। অথচ ওই সুন্দর মেয়েটি এখনো এলোনা।
এদিকে রাত নামতে চলেছে, এই টাওয়েলের গিট্টু বাধার চেষ্টারত দানবটার ওপর কোনো ভরসা নেই, কোনো জন্তু এসে ফক্সিকে ঘাড় কামড়ে ধরে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেলেও তার কিচ্ছুটি যাবে আসবে না। ওদিকে হায়েনাটা বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে ওকে বার বার নিরব হুমকি দিয়ে যাচ্ছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলার। উপায় না পেয়ে ফক্সি কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে অবশেষে আবার এসে বসলো মীরের কাছাকাছি।
মীর অবশেষে গিট্টু বাধতে সফল হলো, পাশে তাকিয়ে ফক্সিকে বসে থাকতে দেখলো। ফক্সি ওকে তাকাতে দেখে ভয়ে ছুটে পালাতে নিচ্ছিলো, কিন্তু মীর একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতেই কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে সাহস করে আবার এসে বসলো নিজের জায়গায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মীরের চিন্তা বাড়ছে, ঝিলমিলে মেয়েটা এখনো আসছেনা, সূর্য কমলা থেকে ক্রমশ লালের দিকে ঝুকছে, রাত নামবে কিছু পরেই। এখনো মেয়েটি কেন এলোনা ভেবে মীরের ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো।
এমন সময় কোনো কিছুর ক্ষীণ যান্ত্রিক গ্রুম গ্রুম আওয়াজে চোখ তুলে তাকালো ও ডান দিকে। সমুদ্র তীর বেয়ে ধেয়ে আসছে একটা ধুসর রঙা রাজকীয় গাড়ি।
মীর বসে রইলো নিজের স্থানে, বোঝার চেষ্টা করলো জিনিসটা কি।
গাড়িখানা ধীরে ধীরে ভালোভাবে দৃষ্টিগোচর হতে হতে এসে থামলো মীর হতে সামান্য দূরে। মীর টানটান হয়ে বসলো, দৃঢ়, সতর্ক চোখে তাকিয়ে, আসন্ন অজানা বিপদ হতে রক্ষা করতে পাশে বসা ফক্সিকে আড়াল করে নিলো এক হাতে।
গাড়ির দরজায় শব্দ হলো খট করে, মূহুর্তেই মীরের সমস্ত শরীর ওর অজান্তেই প্রস্তুত হয়ে গেলো প্রতিরক্ষার জন্য। সামান্য ঝুঁকে অন্য হাতটা শক্ত করে মাটিতে ঠেস দিয়ে রাখলো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে, শিকারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সে যান্ত্রিক ধতবে মোড়ানো বস্তুটির দিকে। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো চাপা গরগরে আওয়াজ। প্রতিপক্ষ কোনো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিলেই তাকে ছিড়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত করে নিলো ওর ধারালো দাঁত গুলোকে।
ভেতর থেকে ওকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো ইলহান, ভেবে নিচ্ছিলো তার দু মিনিটের ছোট ভাইয়ের ঠিক কতটা উন্নতি হয়েছে, সে কি কি করতে পারবে এই সময়ে। পরক্ষণেই মীরের ঝকঝকে চেহারা, কোমরে বাধা টাওয়েল আর সম্মুখের নিভে যাওয়া আগুনের ছাই, পোড়াকাঠ দেখে তার আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু।
দরজা ঠেলে নামলো ও গাড়ি থেকে। মীর উগ্র ভঙ্গিতে, তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো ওর দিকে। ইলহান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মীরকে পরখ করে নিয়ে অতঃপর মৃদু হেসে গাড়ির দরজা শব্দ করে বন্ধ করে ধীর পায়ে এগোলো মীরের দিকে। পরণের ঢোলা,পাতলা টি শার্টে মৃদুমন্দ বাতাসে ঢেউ খেলে গেলো।
মীরের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো আরও, ধারালো চাহনিতে সে তাকালো ইলহানের ডান হাতের মুঠিতে ধরা চকচকে অস্ত্রের হাতলের দিকে। মুহুর্তেই দ্বিগুণ সতর্ক হয়ে গেলো সে, এই ধারালো বস্তর মতো অবিকল একটি সে ওই ঝলমলে মেয়েটির হাতে দেখেছে, মাংস কাটার সময়ে মেয়েটি এই অস্ত্রই ব্যাবহার করেছিলো। নিঃসন্দেহে এটি বিপদজনক!
ইলহানের প্রতি পদক্ষেপের সাথে বাড়লো মীরের সতর্কতা, মুখ থেকে বের হওয়া জান্তব গরগরে আওয়াজ আরও তীক্ষ্ণ, ভারী হলো। ইলহান এগোতে এগোতে শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলল,
“আমি ভুলেই গেছিলাম, তোর বউ তোর হাতে মানুষ হয়েছে, ওকে তুই পেলে বড় করেছিস। এটা স্মরণে থাকলে তোকে আমি আরও আগেই মেরে ফেলতাম। এই দিনের জন্য অপেক্ষা করতাম না। দুর্বলতা…দুর্বলতা…!
দুর্বলতা শব্দটা অনেক ভয়ানক, বিশেষ করে দেমিয়ানদের জন্য। এটা তোর থেকে ভালো আর কে বুঝবে বল? আজ দুর্বলতার জন্যই তোর সাম্রাজ্য, ভালোবাসা, ক্ষমতা, মনুষ্যত্ব সবই হারিয়েছে!”
হাসলো ইলহান মৃদু শব্দে, মীর ওর দিকে শিকারী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তখনো। মনে হলো এই একই ভঙ্গিমার কথা, চলন, হাসি ও আগেও দেখেছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। ইলহানের দিকে দৃষ্টি রেখেই ও স্মৃতির পাতায় হাতড়ে চলল, কোথায় দেখেছে ও একে? কোথায় আলাপ হয়েছে এর সাথে?
ইলহান হাতের ধারালো কমব্যাট নাইফটা একবার শূণ্যে উড়িয়ে আবার ধরলো, তারপর কুটিল হেসে এগোলো মীরের আরও কাছাকাছি। ফক্সি ইতোমধ্যে ভয়ে মীরের পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে। এক উৎপাতের ভেতর অবিকল অন্য একটি উৎপাত দেখে ভীতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে তার।
স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে মীরের হঠাৎ মনে পড়লো ওর বন্দি জীবনের কথা৷ শিকলবন্দী অবস্থাতে এই লোকটির মতোই কেউ একজন ওকে কাঁচা মাংস খাওয়াতো, ছুড়ে ছুড়ে। এই লোকটির মতোনই কেউ ওর সামনে এসে এভাবেই কথা বলতো। তার ছুরির ফলা ছুয়ে যেতো ওর শরীরের চামড়া!
মুহূর্তেই বন্দি জীবনের সমস্ত স্মৃতি একের পর এক পাতা উলটে প্রকাশিত হতে থাকলো মীরের চোখের পরে। ওর কুঞ্চিত ভ্রুদ্বয় এই নতুন স্মৃতির আকস্মিক উন্মোচনে ক্রমে ক্রমে বিস্ময়ে, ক্রোধে সোজা হয়ে এলো। চোয়াল শক্ত করে কঠিন দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো ইলহানের দিকে।
ইলহান ওর চাহনির এই হঠাৎ পরিবর্তনে থমকালো সামান্য, একটু ভড়কালোও বোধ হয়। জানোয়ারটার মুভমেন্টের ওপর কোনো ভরসা নেই, কখন কোন দিক হতে বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ করে বসবে সেটা ইলহান ঠাওর করতেই পারবেনা!
হাতের মুঠির নাইফটা আরও শক্ত করে ধরলো ইলহান, মীরের অবস্থান আরও দৃঢ় হলো তাতে, শাণিত দৃষ্টি রাখলো ইলহানের গলার ওপর। সম্মুখের এই অজানা শত্রু এদিক ওদিক কিছু করলেই তার গলায় কামড় বসিয়ে এক টানেই ছিড়ে ফেলবে নলি!
ইলহান খুব ধীরে এগিয়ে এলো, এক পা এক পা করে। মীর এখন পূর্বের মতোন শক্তিশালী নেই, সমস্ত ভুলে বসে আছে, এটাই সুযোগ! এরপর এমন সুযোগ আর কখনোই আসবেনা, আর কখনোই মীরকে বাগে পাওয়া যাবেনা, ক্রমে ক্রমে ভয়ানক হয়ে উঠবে সে৷
ইলহান সাবধানী ভঙ্গিতে মীরের কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো, চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অতঃপর দম নিলো বুক ভরে। পরমুহূর্তেই মীর কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাতের কমব্যাট খানা তড়িতে ঘুরিয়ে সজোরে আঘাত করতে নিলো মীরের গলা বরাবর।
কিন্তু ছুরির ফলা মীরের গলা স্পর্শ করার ঠিক আগ মুহুর্তে কেঁপে উঠলো মীরের শরীরের সমস্ত পেশি, মস্তিষ্কের তড়িৎ আদেশে শরীরের ঊর্ধ্বাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঝটিতি সরে গেলো পেছনে!
পরমুহূর্তেই অবচেতনে তার হাত ঝড়ো গতিতে পৌছে গেলো ইলহানের ছুরি ধরা হাতের নিকট! ওর ইস্পাত দৃঢ়, প্রচন্ড দক্ষ হাতের তীব্র আঘাত পড়লো ইলহানের হাতের কব্জির ঠিক উপরিভাগে, আঘাতের তোপে ছুরিটা ইলহানের হাতের মুঠি থেকে তৎক্ষনাৎ ছিটকে বেরিয়ে সজোরে আছড়ে পড়লো বালুর ওপর!
ঘটনার আকস্মিকতায় ইলহান চমকালো প্রচন্ড, হতভম্ব হয়ে একবার নিজের হাত, আরেকবার মীরকে দেখতে রইলো সে৷
মীর আক্রমণ থেকে বেঁচে বালুর ওপর পড়ে দুই কনুইয়ের ভরে আধশোয়া হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মাটিতে পড়ে থাকা ছুরিটার দিকে। বুক হাপরের মতোন ওঠানামা করছে ওর। চোখে বিস্ময়! বিস্মিত চোখে নিজের হাত খানা ধীর গতিতে চোখের সামনে উঁচু করে ধরে একবার দেখে নিলো।
এখনো যেন বুঝে উঠতে পারেনি একটু আগে সে কিভাবে ওই লোকটার হাত থেকে অস্ত্রটা ছুড়ে ফেলে দিলো! ও এগুলো কিভাবে পারলো? কোথায় শিখেছে? কে শিখিয়েছে? কেন শিখিয়েছে?
পরক্ষণেই ওর মস্তিষ্কে এসে ঠোকর খেলো আরেকটি প্রশ্ন, এই লোকটি এখানে কেন এসেছে? সে কি কোনোভাবে ঝিলমিলে মেয়েটিকে তার থেকে কেড়ে নিতে চায়? ঝিলমিলে মেয়েটি এখনো কেন ওর কাছে ফিরলোনা, তবে কি ওই মেয়েটিকে এই লোক কোনোভাবে আটকে রেখেছে? কোনো ক্ষতি করেছে? ওকে নিজের কাছে রাখতে চায় বলে এখন মীরকে সরিয়ে দিতে এসেছে? এই লোকটি ওই ঝিলমিলে মেয়েটিকে চায়? ওর ঝিলমিলে মেয়েটিকে?
অসম্ভব!
মীরকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইলহান তড়িতে বালু হতে তুলে নিলো ছুরি, মীর নিজেও প্রতিপক্ষের হঠাৎ নড়াচড়ায় সতর্ক হয়ে গেলো আবার! ঝিলমিলে মেয়েটির কথা মনে আসতেই দাঁতে দাঁত পিষে গেলো ওর। আজ এটাকে একদম খুন করে ফেলবে, ওর জিনিসে হাত দিতে চাওয়ার স্বাধ এ জনমের মতোন মিটিয়ে দিবে!
ইলহান আরও সতর্ক হলো এবার, মীরকে সে যতোটা অবুঝ, বোধহীন ভেবেছিলো ততটা সে নয়। বিদ্যুৎ গতিতে ইম্প্রুভ হচ্ছে ওর, এভাবে চলতে থাকলে ইলহানের পতন হতে বেশিদিন প্রয়োজন হবে না! শুকনো একটা ঢোক গিলে ও দ্বিতীয়বার আক্রমণের প্রস্তুতি নিলো।
কিসের একটা ভীতি যেন গ্রাস করলো ওকে, মনে পড়লো বহুদিন পূর্বে কুরো আহমারে হওয়া ওদের দুজনের দ্বন্দ্বের স্মৃতি। মীরের সাথে ও কোনোদিক দিয়েই পেরে উঠবে, ধরা ওকে খেতেই হবে। দুর্বলতা দেখানোর বিন্দুমাত্র সুযোগ আর অবশিষ্ট নেই, নইলে সাম্রাজ্য আর জীবন দুটোই হারাতে হবে!
ইলহান কমব্যাট নাইফটা আবারও শূন্যে ঘুরিয়ে ফক্ষতার সাথে ধরলো, মীরের প্রতিটা পদক্ষেপ সম্পর্কে হুশিয়ার হতে মীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতি শাণিত নজর দিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে মীরের দিকে ধীর, সতর্ক লয়ে এগোলো ও।
কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মীর এবার আর পিছিয়ে গেলো না, দাঁড়িয়েও রইলো না! ইলহানের মতোই ধীর লয়ে, চোখে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত চাহনি ফুটিয়ে এগোলো সে প্রতিপক্ষের দিকে। ক্রমে ক্রমে ঠোঁট জোড়া হিংস্র ভঙ্গিমায় চওড়া হলো তার, ঝকঝকে ক্যানাইন দাঁতদ্বয় বেরিয়ে এলো তাতে, গলা হতে ভেসে এলো চাপা ভারী গরগরে আওয়াজ,
“গ্রাররররর!”
ইলহান সামান্য ভড়কালেও পরক্ষণেই সামলে নিলো নিজেকে, হয় আজ নয়তো আর কখনোই নয়! ঘাড় টেনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো সে, পরমুহূর্তেই তড়িতে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েলো সে মীরের ওপর!
বিদ্যুৎ বেগে মীরের বুকের ওপর শক্ত আঘাত হেনে ওকে ফেলে দিলো মাটিতে, মুহুর্তেই উঠে বসলো ওর পেটের ওপর, হাতে ধরা কমব্যাট খানা শক্ত মুঠি করে ধারালো ফলা দ্বারা আঘাত করতে গেলো মীরের গলার নলি বরাবর।
তৎক্ষনাৎ ওর ছুরি ধরা হাত খানা দুহাতে ধরে ফেললো মীর, ছুরির ফলার সূচালো অগ্রভাগ ছুয়ে দিলো ওর গলা! সামান্য লালের আভাস দেখা গেলো সেখানে। ইলহান গুমরে উঠে চাপ দিলো আরও জোরে, ফলাটা কণ্ঠনালীর ঠিক উপরে, আর একটু, অল্প একটু!
ইলহানের চাপের দমকে মীরের দুহাতের পেশিগুলো ফুঁসে উঠলো সহসা! মরিচা ধরে যাওয়া পেশিগুলো যেন মরিচা ছেড়ে দিলো অবিলম্বে! হঠাৎ এক বিকট গর্জন তুলে ইলহানের হাত জোড়া তড়িতে ঘুরিয়ে মুচড়ে দিলো দুদিকে, গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো ইলহানের বুক চিরে! পরমুহূর্তেই নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ওপরে তুলে বিদ্যুৎ বেগে ছুড়ে ফেললো কোথাও! ইলহান সজোরে আছড়ে পড়লো দূরের বালুর ভেতর, ব্যাথায় গুমরে উঠলো ও!
মীর এবার যেন নিয়ন্ত্রণ হারালো! ক্রোধে গর্জন করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝড়ো বেগে ছুটলো ও ইলহানের দিকে। ওকে ছুটে আসতে দেখে ইলহান তড়িঘড়ি উঠে দাড়ালো, ছুটে যেতে চাইলো গাড়ির নিকট, কিন্তু গাড়ির দরজার হাতল স্পর্শ করার আগেই নিজের পেছনে কারো উপস্থিতির তীব্র ঝড়ো বাতাস টের পেলো ও! পরমুহূর্তেই তার সাড়াশির মতোন শক্ত আঙুল ঝটিতি আক্রমণ করলো ওর ঘাড়ে, আর তার পর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে শূণ্যে আবিষ্কার করলো ইলহান। পরমুহূর্তেই বালুর ওপর এক তীব্র, সজোর আছাড়ে ঘুরে উঠলো ওর মাথার ভেতর! চোখের ওপর কিয়ৎক্ষণের জন্য নেমে এলো আঁধার!
বুকের ওপর ভীষণ আঘাত লাগায় কেশে উঠলো ইলহান, মুখ থেকে বেরিয়ে এলো রক্তমিশ্রিত থুতু! মীর থামলো না তবুও। নিজের জান্তব, ভারী হাঁটু জোড়া দিয়ে চেপে ধরে বসে রইলো ইলহানের পিঠের ওপর! তারপরেই নিজের ডান হাতের দৃঢ় মুষ্টির ভেতর শক্ত করে ধরলো ইলহানের চুলের মুঠি, পরক্ষণেই তীব্র গর্জন দিয়ে উঠে ঝটিতি মাথাটা বালুর ওপর থেকে উচু করে সজোরে আছাড় মারলো বালুর ওপর!
আছাড়ের তোপে সরে গেলো সেখানের বালির স্তর, তারপরেই আরও একটা আছাড়, আরও একটা আছাড়! বালুর স্তর সরে গিয়ে বেরিয়ে আসা ঝিনুকের ধারালো অগ্রভাগে লেগে ফালাফালা হতে শুরু করলো ইলহানের মাথার ডান পাশ! রক্তে রঞ্জিত হতে শুরু করলো বালুকাময় প্রান্তর!
সেই মুহুর্তেই দূর থেকে ভেসে এলো কোনো গাড়ির ইঞ্জিনের তীব্র আওয়াজ! আওয়াজটা দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে হতে প্রখর গতিতে গাড়িটি এসে সজোরে থমকে দাড়ালো ইলহানের গাড়ির পাশেই! পরক্ষণেই গাড়ির দরজা খুলে ছুটে নেমে এলো আনাবিয়া।
মীর তখনো নিজের সমস্ত আক্রোশ ঢালতে ব্যাস্ত ইলহানের অর্ধচেতন দেহের ওপর! আনাবিয়া দৌড়ে গিয়ে বন্য, ক্ষিপ্ত, জান্তব মীরের হাত থেকে ইলহানের মুঠি করে ধরে রাখা চুলের গোছা ছাড়াতে ছাড়াতে অস্থির গলায় বলল,
“মীর… ছেড়ে দাও ওকে, মরে যাবে ও!”
আনাবিয়ার হাতের স্পর্শ পেতেই মুঠি আলগা করলো মীর, ইলহানের পিঠের ওপর সোজা হয়ে বসে হাঁফাতে হাঁফাতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, চোখে ওর তখনো ফুটে রইলো অমানুষিক ক্রোধ! আনাবিয়া দ্রুত ধরে ওঠালো ওকে ইলহানের পিঠের ওপর থেকে।
ইলহান দম নিচ্ছে ঘন ঘন, কাশছে কিছুক্ষণ পর পর, উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই শরীরে! মুখ থেকে কিছুক্ষণ পর পর কাশির কারণে বেরিয়ে আসছে রক্তের ছিটেফোটা! ডান দিকের কপালের ওপর থেকে ভেসে যাচ্ছে রক্তে!
মীর উঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইলো ইলহানের দিকে, ক্রোধে তখনো দাঁতে দাঁত পিষে যেতে চাইছে ওর! আনাবিয়া ওকে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেলো অন্য দিকে, সেখানে ফক্সি কাচুমাচু হয়ে বসে আছে, আনাবিয়া মীরকে নিয়ে বসিয়ে দিলো ওর পাশেই। মীরের দৃষ্টি তখনো নিবদ্ধিত ইলহানের দিকে, যেন পারলে দাঁতে ছিড়ে ফেলে ওকে!
“মীর, মীর! আমার দিকে তাকাও, ওদিকে তাকিও না, এদিকে তাকাও, আমার দিকে!”
মীরের চোয়াল ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে নিতে বলল আনাবিয়া, কিন্তু মীরের দৃষ্টি সরতে চাইলোনা ইলহানের দিক থেকে, যেন দৃষ্টি সরালেই প্রতিপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিয়ে বসবে ওকে ধরাশায়ী করার! আনাবিয়া এবার ধমকে বলে উঠলো,
“এই আমার দিকে তাকাও!”
মীর চোখ ফেরালো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়ার ঝলমলে চোখে চোখ পড়তেই শিথিল হয়ে এলো ওর দৃঢ় চোয়াল দ্বয়। ক্রোধে পরিপূর্ণ চোখ জোড়া ধীরে ধীরে ক্রোধ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে এলো, পূর্বের মতোই এক মুগ্ধ, অবুঝ দৃষ্টি এসে ভর করলো ওর চাহনিতে।
আনাবিয়া হাত বুলিয়ে দিলো ওর ঘর্মাক্ত মুখে, সরিয়ে দিলো মুখের ওপর এসে পড়ে থাকা চুল। বলল,
“মহলে ফিরে তোমার চুলগুলো কেটে দিবো। এখন ভালো ছেলের মতোন বসে থাকো এখানে, আমি এখনি আসছি।”
বলে আনাবিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে যেতে নিলো ইলহানের দিকে, কিন্তু সেই মুহুর্তেই ওর কানে ভেসে এলো গান শটের তীব্র আওয়াজ! ওর কোমরের ঠিক পাশ দিয়ে সাই করে চলে গেলো একটি বুলেট!
বুলেটের আকস্মিক শব্দে আনাবিয়া যেন জমে গেলো নিজের স্থানে, ঘাড় ঘুরিয়ে মীরের দিকে তাকাতে সাহস হলোনা ওর হঠাৎ! তাকিয়ে দেখলো শুধু ইলহানের ডান হাতে ধরা গান, গাড়ির দরজায় এক হাত বাধিয়ে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ঝুলে আছে সে! অন্য হাতের গানের মুখ থেকে ধোয়া উড়ছে। পরক্ষণেই হাত শিথিল হয়ে গানটা পড়ে গেলো মাটির ওপর।
আনাবিয়ার শ্বাস থেমে গেলো যেন, দম বন্ধ করে একটু একটু করে ঘাড় ঘুরিয়ে সে তাকালো পেছন দিকে! রক্তে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে মীরের বা হাতের বাহুর ঠিক উপরের গভীর ক্ষতস্থানে থেকে, অর্ধনমিত চোখ জোড়া দিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে, চোখের পাতা জোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে, তবুও যেন জোর করে খুলে রাখার তীব্র চেষ্টা!
আনাবিয়া ইলহানের দিকে ঘুরে দাড়ালো তড়িতে, দাঁতে দাঁত চেপে গেলো ওর মুহুর্তেই! হঠাৎ করেই কঠোর রূপ ধারণ করলো সমুদ্র পাড়ের আবহাওয়া, সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসতে শুরু করলো প্রচন্ড গরম বাতাসের ঝাপটা! পায়ের তলার বালু হঠাৎ করেই হতে শুরু করলো উত্তপ্ত! জুতার তলা ভেদ করে উত্তাপ এসে স্পর্শ করলো ইলহানের পায়ের নিচে!
আনাবিয়া চোখে ভয়ানক কঠোরতা ফুটিয়ে ভারী পা ফেলে এগিয়ে গেলো ইলহানের দিকে, মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো ওর হাত জোড়া, নিমেষেই মাটি ফুড়ে বেরিয়ে এলো বিশাল, তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ বিশিষ্ট কাঁটা যুক্ত লতার এক ঝাঁক!
গাড়ির দরজায় শরীর ঠেকিয়ে রাখা ইলহানের নিকট পৌছে আনাবিয়া খপ করে ধরলো ওর গলা, অতঃপর ভীষণ চাপ দিয়ে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“দ্বিতীয় বার আমার স্বামীর শরীরে একটা আঁচড় কাটার স্পর্ধা করলে আমি আপনাকে যেখানে পাবো সেখানেই গেড়ে রেখে দেবো। একটি বারের জন্যও ভাববো না আপনি কে, কার ভাই, কার সন্তান, কার বংশধর! নট ফ’ অ্যা ন্যানোসেকেন্ড! মাইন্ড ইট!”
বলেই ইলহানের গলা ছেড়ে দিলো আনাবিয়া। ইলহান মাটিতে বসে পড়ে দম নিলো ভীষণ জোরে, অতঃপর হাসফাস করতে করতে পিঠ ঠেকিয়ে কোনোরকমে বসলো গাড়ির গায়ে!
আনাবিয়া দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে গেলো মীরের নিকট, মীরকে বাহুতলে হাত দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। পেছনের সিটে উঠিয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে৷ গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে তখনই দরজার কাছে ফক্সিকে লাফালাফি করতে করতে তারস্বরে ডাকতে দেখে থামলো আনাবিয়া। ফক্সির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুলে ফক্সির ঘাড়ের চামড়া ধরে উঠিয়ে নিলো গাড়ির ভেতর। পরমুহূর্তেই ছেড়ে দিলো গাড়ি, গ্রুম গ্রুম আওয়াজ তুলে সেটা ঝরো বেগে ছুটলো রেড জোনের ইনভিজিবল রোডের দিকে।
আনাবিয়া রেড জোনের কিছুটা ভেতরে গিয়ে ফোন চেইক করলো নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে কিনা। একটা দাগ দেখা দিতেই কল লাগালো কোথাও। রিসিভ হতেই বলে উঠলো,
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫
“গান শট ইন আপা’র আর্ম। ফারহা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে আগামী এক ঘন্টার ভেতর আমার একটা ভি আইপি রয়্যাল কেবিন চাই ফারিশ৷ আর হ্যাঁ, স্ট্রেচার সেভেন ফিট লং হওয়া চাই।”
বলেই খট করে বিচ্ছিন্ন করলো সংযোগ।

