বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩০
রানী আমিনা
শব্দ পেয়ে বসা থেকে উঠে তড়িঘড়ি পায়ে কামরার দিকে এগোতে গেলো আনাবিয়া, লম্বা পোশাকের সাথে হোচট খেয়ে আরেকটু হলেই পড়ে যেতে নিচ্ছিলো। দ্রুত পোশাকের নিম্নাংশ দুহাতে উঁচু করে নিয়ে ছুটলো ও দরজার দিকে। ক্লজেটের দরজা খুলে বাইরে বের হতেই কামরার অন্য কোণার মেঝেতে ভেঙে পড়ে থাকতে দেখলো সাইড টেবিলের ওপরে থাকা স্ফটিকের জগটা। নীল রঙা ডিম লাইটের আলো প্রতিফলিত হয়ে ঝিকিমিকি আলো ছড়াচ্ছে চূর্ণ টুকরো গুলো।
মেঝে থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকাতেই দেখতে পেলো এক হাতে সাইড টেবিলের এক কোণা ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, অন্য হাতে স্ফটিকের গাস হতে অ্যাডামস অ্যাপলে ঢেউ খেলিয়ে শব্দ করে পানি খাচ্ছে মীর।
দরজার খোলার শব্দ পেয়ে পানি খেতে খেতেই শব্দের উৎসের দিকে তাকালো মীর। ক্লজেটের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, নীল রঙা ঝলমলে পোশাকে আবৃত আনাবিয়াকে দেখে মাত্রই ঘুম ঘুম ভাব উড়ে গিয়ে বিস্ময়ে চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো মীরের। পরমুহূর্তে আনাবিয়ার ঝিকমিকে চোখে চোখ পড়তেই সমস্ত শরীর যেন কাজ করা বন্ধ করে দিলো ওর, স্তম্ভিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ, সঙ্গে সঙ্গে গলায় আটকে গেলো পানি, মুহুর্তেই খেলো বিষম!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
যেটুকু পানি মুখে পুরেছিলো তার পুরোটাই প্রচন্ড বিষমের তাড়নায় বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়লো ঘরময়৷ কাশি আর দম নেবার ফাঁকে ফাঁকে আনাবিয়ার দিকে আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইলো সে।
আনাবিয়া ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে কি করবে বুঝতে পারলোনা৷ মীর পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে অবিশ্বাস্য, বিস্ময়াভিভূত চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, গলায় পানি বেধে যাওয়ায় দম নিলো কয়েকবার জোরে, ঠোঁট জোড়া সামান্য আলগা হয়ে এলো সম্মুখের মেয়েটির রূপের দাপটে!
আনাবিয়া একটা ঢোক গিলে সাথে সাথেই আবার ক্লজেটে ঢুকে সশব্দে বন্ধ করে দিলো দরজা, তারপর ছুটলো ক্লজেটের অন্যদিকে। সেখানে ছোটখাটো দরজা আছে আরেকটি। অতীতে আনাবিয়ার গোসলের সময়ে ওই দরজা টা দিয়ে চুপিচুপি ঢুকে মীর ওর ওপর এইটিন প্লাস নির্যাতন চালাতো।
ছুটতে ছুটতে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠলো,
“আরেকটু হলে ওটুকু পানিতেই বোধ হয় ডুবে মরতো শালা!”
ছোট দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে আনাবিয়া ছুটলো কোকোর কামরার দিকে। কামরার সামনে গিয়ে বন্ধ দরজার ওপর করাঘাত করতে করতে ডাকলো,
“কোকো, অ্যাই কোকো! কোকো? মড়ার মতো ঘুমোচ্ছিস নাকি?”
কোকো একটু আগেই ঘুমিয়েছে, ওর ঘরের এক কোণায় ফক্সির জায়গা হয়েছিলো, কিন্তু ফক্সির গা থেকে বিশ্রী গন্ধ আসায় ঘুম আসছিলোনা ওর। পূর্বে এক হাঁসের বাচ্চার গায়ের গন্ধে ঘুম আসতোনা, এখন নতুন উপদ্রব!
বাইরে আনাবিয়ার কন্ঠস্বর শুনে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো কোকো বিছানা থেকে৷ দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে শঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে আম্মা?”
পরমুহূর্তে আনাবিয়ার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দুকদম পিছিয়ে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি সত্যিই আমার আম্মা তো? নাকি জঙ্গল থেকে আমার আম্মার রূপ ধরে আমাকে চিবিয়ে খেতে এসেছেন?
“মার খাবি কোকো!
মীর ঘুম থেকে উঠে গেছে, পানি খাচ্ছিলো, আমাকে দেখে বিষম খেয়েছে। আমি পালিয়েছি! তুই এখুনি কামরায় যাবি দেখবি একটা ভাঙা জগ পড়ে আছে মেঝেতে, তার সামনের সাইড টেবিলের ওপর স্লিপিং পিল রাখা, ওকে খাইয়ে দিবি এক্ষুনি। ডক্টর বলেছিলো ওর অন্তত আট ঘন্টা একটানা ঘুম প্রয়োজন, দ্রুত যা৷”
কোকো খালি গায়ে ছিলো, দ্রুত কামরায় ঢুকে গায়ে একটা টিশার্ট গলিয়ে ছুটলো ও মীরের কামরায়৷ আনাবিয়া ওকে কাজ বুঝিয়ে কোনদিকে ছুটে পালালো দেখতে পেলোনা কোকো।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো গ্লাস হাতে ক্লজেটের দরজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মীর। শব্দ পেয়ে তড়িতে তাকালো সে দরজার দিকে।
মীরের শকুনি দৃষ্টিতে ভড়কে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো কোকো। শুকনো ঢোক গিললো একটা।
শরীরের পুরুত্ব কমে গেছে মীরের, পাতলা হয়ে গিয়ে লম্বা শরীর আরও প্রচন্ড লম্বা দেখাচ্ছে। ডিম লাইটের মৃদু নীলচে আলোয় তাকে ঠেকছে একটা অতিপ্রাকৃত জীবের ন্যায়! যেন এখুনি দুহাতের নখ গুলো হরর সিনেমার চরিত্রের ন্যায় বেরিয়ে আসবে, ক্যানাইন দাঁত দ্বয় খট খট শব্দ করে বেরিয়ে এসে এক হিংস্র ভয়ানক সত্ত্বায় পরিণত হয়ে হামলে পড়বে কোকোর ওপর!
ভয়ানক সত্ত্বায় পরিণত না হলেও ভয়ানক হতে ছাড়লোনা মীর। একটা অচেনা লোককে দেখা মাত্রই সাইড টেবিলে রাখা কাঁচের তৈরি নকশাদার ফুলদানিটা বিদ্যুৎ গতিতে তুলে নিয়ে সজোর আছাড়ে তার নিম্নাংশ ভেঙে বাকি ধারালো অংশটুকু মারমুখী ভঙ্গিতে হাতে ধরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো,
“ওয়ান রঙ ম্যুভ, অ্যান্ড ইয়্যু আর ডেড৷”
কোকো স্যারেন্ডারের ভঙ্গিতে দ্রুত দুহাত তুলে দ্রুত স্বরে করে বলে উঠলো,
“আ-আমি কোনো খারাপ প্রাণী নই, আপনার মেডিসিন আছে সেটাই দিতে এসেছি।”
মীর কপালে ভাজ ফেললো সামান্য, বলতে গেলো কিছু। কিন্তু শব্দ করার চেষ্টা করতেই গলার অসহ্য যন্ত্রণায় ভ্রু দ্বয় কুচকে এলো সাথে সাথে! শব্দ করতে অপারগ হয়ে হাতের ভাঙা ফুলদানির অস্ত্রের ইশারায় কোকোকে ভেতরে আসতে বলল। কোকো দুহাত ওপরে তোলা অবস্থাতে একটু একটু করে এগিয়ে ভেতরে ঢুকলো, সাইড টেবিলের কাছে এসে স্লিপিং পিলের একটি বের করে মীরের দিকে বাড়িয়ে দিলো। মীর এক হাতে ফুলদানি ধরে অন্য হাতে পিল টা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ।
কোকো গলা খাকারি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“এটা খেয়ে ফেলুন, এটা ওষুধ, আপনার শরীর ভালো হয়ে যাবে দ্রুত।”
মীর সন্দিহান চোখে একবার কোকোর দিকে, আরেকবার ওষুধের দিকে তাকিয়ে পিলটা খপ করে মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে শুরু করলো। মুহুর্তেই তিক্ত স্বাদে চোখ মুখ কুচকে বিকৃত রূপ নিলো ওর। ফেলে দিতে নিলো সবটুকু মুখ থেকে। কোকো দ্রুত পাশ হতে গ্লাস হাতে নিয়ে দেখলো তাতে পানি নেই, জগটা পড়ে আছে নিচে। পানি সব শেষ।
“ফেলবেন না ফেলবেন না, একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনি আসছি।”
বলে বাইরে ছুট লাগালো কোকো। ত্রিশ সেকেন্ডের মাথায় গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এসে মীরের হাতে ধরিয়ে দিলো। মীর মুখ কুচকে ছিলো। পানি নিয়ে ঢক ঢক করে গিলে খেলো তিতকুটে ওষুধের গুড়ো হয়ে যাওয়া খন্ডাংশ।
মীরের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে কোকো ওকে বিছানা দেখিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে বলল আবার। মীর ওর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে বিছানায় গেলো ধীরে ধীরে। ভাঙা ফুলদানিটা হাতে নিয়েই শুয়ে পড়লো ও৷
সাধারণ স্লিপিং পিল ওকে ঘুম পাড়াতে পারবেনা বলে ডক্টর সবচেয়ে হাই পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়ায় কোনো ফার্মেসীতেই পাওয়া যায়নি, পরে গিয়ে চিফ ডক্টরের থেকেই নিতে হয়েছে সেটা।
বিছানায় যেতেই মীরের চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসতে চাইলো। কোকো ওর গায়ে চাদর উঠিয়ে দিলো ভালোভাবে। কোকোর দিকে তীক্ষ্ণ, শত্রু ভাবাপন্ন দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে কয়েকবার পলক ফেলে অবশেষে ঘুমোলো সে। সময় গড়ালো কিছুক্ষণ, শ্বাস ভারী হয়ে এলো সামান্য।
কোকো এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো ওর ঘুমানোর অপেক্ষায়। ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চিত হয়ে বিছানার কাছে এসে ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে নিতে গেলো ফুলদানিটা, কিন্তু তাতে হাত লাগানো মাত্রই ঝটিতি চোখ মেলে তাকালো মীর। কোকো আঁতকে লাফিয়ে উঠে ঝড়ের বেগে ছুটে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
“চাচাজি, বলো চা-চা-জি!”
“তা-তা-দিহ্….”
“আবার বলো, চা-চা-জি…”
“তা-তা-দিহ্….”
সফেদ চুলের ছোট্ট মেয়েটির মুখে আধো আধো সম্বোধন শুনে খুশিতে ফেটে পড়লো পার্পল রঙা চোখের গৌরবর্ণের সুপুরুষটি। হেসে উঠে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে মাথা ঘষলো বাচ্চা মেয়েটির ছোট্ট পেটে, চাচাজি হতে এই আদুরে সুড়সুড়ি পেয়ে সানন্দে মুচড়ে উঠে খিলখিল করে হেসে উঠলো সে, তার হাসির ঝঙ্কার প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো সাদা মার্বেল পাথরের দেয়ালে দেয়াল!
মেয়েটিকে সামনের টেবিলের ওপর বসিয়ে এবার পাশের চেয়ারে বসা মধ্যবয়সী এক সুপুরুষকে দেখিয়ে লোকটি জিজ্ঞেস করলো,
“উনি কে বলোতো, কি হয় তোমার?”
মেয়েটি মধ্যবয়সী লোকটার দিকে নিজের হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আধো আধো উৎসাহী গলায় বলে উঠলো,
“দ্যাদ্দাহ্…..”
মধ্যবয়সী লোকটি সোৎসাহে এগিয়ে এলো চেয়ার সুদ্ধ, দুহাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে বসা গোলাপি ফ্রকে মোড়ানো পুতুলের মতোন মেয়েটিকে সস্নেহে নিয়ে কোলের ভেতর বসালো, খুশি খুশি চেহারায় জিজ্ঞেস করলো,
“আবার বলো আমি কি হই তোমার, দাদুনি?”
“দ্যাদ্-দাহ্…..”
খুশি যেন উপচে পড়লো লোকটির মুখে, সস্নেহে টুপটুপিয়ে এক ঝাঁক চুমু খেলো সে নাতিনের মাথায় আর মুখে। আদর পেয়ে আনন্দ সূচক অর্থহীন শব্দ বেরিয়ে এলো বাচ্চাটির মুখ থেকে।
এমন সময়ে বারান্দার দেয়ালে সাটানো ঝাড়বাতির মৃদু আলোকে দৃষ্টিগোচর হলো আরেকটি শ্যাম রঙা অবয়ব, আলো আঁধারির ভেতর রহস্যময় হয়ে ধরা দিলো তার স্বর্ণাভ চোখ জোড়া!
তাকে দেখতে পাওয়া মাত্রই দাদাজির কোলে থাকা ছোট্ট মেয়েটি খুশিতে ছটফটিয়ে উঠলো, হাত পা ছুড়ে লাফিয়ে গিয়ে উঠলো চাচাজির কোলে, তারপর চাচাজিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলো আগন্তুকের দিকে।
স্বর্ণাভ দৃষ্টি ধারী কাছে আসা মাত্রই লাফিয়ে তার কোলে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো মেয়েটি, কোলের মালিক তাকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে গমগমে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,
“এখনো ঘুমোওনি কেন শিনজো?”
শিনজোর থেকে উত্তর এলো না কোনো, সে বুকে মুখ ঘষতে ব্যাস্ত। তার হয়ে উত্তর করলো চাচাজি, মিষ্টি করে হেসে বলল,
“কত চেষ্টা করা হলো তাকে ঘুম পাড়ানোর, কিন্তু সে ঘুমোবেই না, তার মীলি কে চাই।”
পেছন হতে চেয়ারে বসা দাদাজি বললেন,
“এখন থেকেই পার্টনারকে চিনে নিয়েছে, তাই তাকে ছাড়া ঘুমানো যাচ্ছেনা। কিছুদিন পর থেকে তো দাদুনি আমাদের চিনবেই না! এত ডাকাডাকি শিখিয়ে কোনো কাজেই আসলোনা, কি বলো ইলহান?”
গৌরবর্ণের সুপুরুষটি হাসলো তার কথায়। আগন্তুক তাদের থেকে বিদায় নিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে বুকে চেপে বারান্দা বয়ে এগোলো কোথাও। ছোট্ট মেয়েটি মুখ তুলে আধো আধো গলায় আবদারের সুরে বলল,
“উলামান…উলামান!”
তার আধো বোলে শ্যাম বরণ পুরুষটির ক্লান্ত মুখে ফুটে উঠলো স্নেহের হাসি। মেয়েটির কপালের মধ্যিখানে একটি আদুরে চুম্বন দিয়ে সম্মুখে তাকিয়ে হাটতে হাটতে ধীর গলায় গাইতে রইলো তার শিনজোর প্রিয় ঘুম পাড়ানী গান,
“There once was a ship that put to sea
The name of the ship was the Billy O’ Tea
The winds blew up, her bow dipped down
Oh blow, my bully boys, blow (huh)
Soon may the Wellerman come
To bring us sugar and tea and rum
One day, when the tonguing is done
We’ll take our leave and go……”
গমগমে প্রশান্তিকর কন্ঠের অদৃশ্য স্নেহপূর্ণ ছোয়ায় ঢুলুনি এলো সফেদ চুলের মেয়েটির, প্রশস্ত বুকের ওপর চঞ্চল মাথাটা বিশ্রাম দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো সে।
তাকে বুকে নিয়ে হাটতে হাটতে যেন অনেক অনেক পথ পাড়ি দিলো আগন্তুক, যেন পেরিয়ে গেলো শত সহস্র বছর। শেষ হলোনা বারান্দা, শেষ হলোনা রাত!
চলতে চলতে একসময়ে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লো শ্যাম বরণ পুরুষটি, দৃষ্টি দিলো বুকে থাকা মেয়েটির দিকে। সফেদ চুলের পরিপূর্ণা নারীটি তার ঝলমলে চোখ জোড়া মেলে তাকালো আগন্তুকের মুখপানে। স্নেহভরে ডাকলো আগন্তুক,
“শিনজো…!
মেয়েটি সম্বোধনে হাসলো মিষ্টি করে।
হঠাৎই কাঁপুনি অনুভূত হলো পায়ের নিচে, ভয় পেলো মেয়েটি! অসহায় চোখ করে মুঠি করে ধরে রইলো পুরুষটির পোশাকের বুকের অংশ, সর্বশেষ অবলম্বনের মতোন!
আগন্তুক দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরে রইলো তাকে নিজের সাথে, চোখে চোখ রেখে আশ্বাস দিলো,
“ভয় নেই, আমি আছি।”
পরমুহূর্তেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো পায়ের তলের কংক্রিটের মেঝে, মেয়েটি চোখ খিচে মুখ লুকোলো আগন্তুকের প্রসস্ত বক্ষমাঝে, আর শ্যামবর্ণ ব্যাক্তিটি ভেঙে পড়া বারান্দার ইট পাথরের খন্ডের সঙ্গে অভিকর্ষের প্রবল টানে সজোরে ভূপতিত হতে হতে প্রাণপণে বুকে চেপে ধরে রইলো তাকে। টেনে নিলো আরও নিকটে, আরও গভীরে!
আভিজাত্যপূর্ণ বারান্দার চূর্ণবিচূর্ণ অংশের সাথে যেন হারিয়ে যেতে রইলো অতলে, অসীমে!
মেয়েটি আরও জোর আকড়ে ধরলো তাকে, এখুনি হয়তো কোনো শক্ত কংক্রিটের নিকষ কালো মেঝের ওপর আছড়ে পড়বে তারা, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে একাকার হবে দুজনের শরীর, আত্মা!
মাটিতে আছড়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ঝটিতি ঘুম ভাঙলো মীরের, আঁতকে উঠে বড় বড় শ্বাস ফেললো সে কয়েকবার। নিজেকে সামান্য স্বাভাবিক করে নিয়ে সে দৃষ্টি ফেললো চারদিকে। অল্প স্বল্প বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে মৃদু ভঙ্গিতে দুলে উঠছে সিল্কের সফেদ পর্দা। ফাঁকফোকর দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ভেতরে ঢুকছে সূর্যের প্রকট আলোর ঝলক।
একটি শুকনো ঢোক গিলে নড়াচড়া করতে নিতেই ডান হাতে একটা ভাঙা ফুলদানির অংশবিশেষ দেখে ভ্রু কুচকালো মীর৷ এটার সাথে সে সারা রাত ঘুমিয়েছিলো?
বুক ভরে দম নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো বিছানায়, তারপর ফুলদানিটা সজোরে ছুড়ে দিলো মেঝেতে। আছড়ে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ঝনঝনিয়ে উঠলো তা, শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো সমস্ত কামরায়।
হাই তুলে, চোখ কচলে বোঝার চেষ্টা করলো সে ঠিক কোথায় আছে, মনে করতে চেষ্টা করলো এর পূর্বে কোথায় ছিলো। স্মৃতিতে আবছা ভেসে উঠলো একটি জঙ্গল, সমুদ্র, একটি পরীর মতোন মেয়ে আর একটি শেয়াল।
শেয়াল! শেয়াল কোথা থেকে আসলো? শেয়ালের সাথে ও কি করছিলো? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে দুহাতে মাথা ধরে চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো আরও কিছুক্ষণ,
তারপর কি হলো? একটা পিচ্চি মেয়েকে কোলে নিয়ে হাটছিলো কোন প্রাসাদে, পিচ্চি পেয়েটা টুকুস করে বড় হয়ে গেলো। সাদা চুল, ঝিকিমিকি চোখ, জঙ্গলের ওই মেয়েটির মতোনই দেখতে ছিলো!
ভাবতে ভাবতে চোখ গেলো ক্লজেটের দিকে। মুহুর্তেই মনে পড়লো মধ্যরাতে এই দরজায় একটা পরীর মতো মেয়েকে দেখেছিলো, ঠিক জঙ্গলের মেয়েটির মতোন, স্বপ্নে দেখা মেয়েটির মতোন, সাদা চুল, হীরের মতোন এক জোড়া চোখ, ঝিকিমিকি করছিলো!
তবে কি ও স্বপ্ন দেখছিলো এতক্ষন? এত লম্বা স্বপ্ন কে দেখে? মেয়েটি নিশ্চয় কোনো অতৃপ্ত আত্মা, নইলে বার বার ওর স্বপ্নে আসবে কেন? নিশ্চয় কোনো ঝোপ জঙ্গল থেকে ওর ওপর ভর করেছে।
কিন্তু চুল সাদা হবে কেন? কি সুন্দর একটা মেয়ে, তার চুল কিনা সাদা! সোনালি হলেও রিয়্যালিস্টিক লাগতো, তাই বলে সাদা!
কিন্তু স্বপ্ন দেখার আগে সে কোথায় ছিলো? আর এই কামরাই বা কার? নিজেকে প্রশ্ন করতে করতে কপালে ভাজ ফেলে চারদিকে আবার চোখ বুলালো মীর।
হঠাৎ নাকে এসে ঠেকলো একটা পরিচিত ঘ্রাণ, কোনো অদ্ভুত মন মাতানো মিষ্টি ঘ্রাণ। নাক টেনে ঘ্রাণ নিলো মীর। তার পরেই শব্দ করে খুলে গেলো কামরার দরজা, ভেতরে ঢুকলো কালো রঙা হুডি আর ট্রাউজারে আপাদমস্তক ঢাকা একটি লম্বা, পাতলা গড়নের মেয়ে।
মুখে মাস্ক, হাত জোড়া গ্লাভসে ঢাকা, চোখ জোড়া লাইট ব্লু, ঝকঝক করছে দুপুরের তপ্ত রোদ্দুর পড়া হ্রদের পরিষ্কার পানির মতোন। হুডির হুডের নিকট থেকে বেরিয়ে এসে কপালের ওপর পড়েছে এক গোছা লালচে কালো চুল।
মেয়েটির পেছন পেছন রেনেসাঁস যুগের নারীদের পোশাকের ন্যায় পোশাক পরিহিতা আরেকটি মেয়ে ঢুকলো, সে এসেই কাঁচের টুকরো গুলো তুলে নিয়ে আবার দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে৷
লম্বা মেয়েটি এসে দাড়ালো মীরের পাশে, সুদক্ষ দৃষ্টিতে মীরকে কিছুক্ষণ দেখলো সে। মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে শুধোলো,
“শরীর কেমন লাগছে আপনার এখন? কথা বলার চেষ্টা করুন তো একবার!”
মেয়েটির কন্ঠস্বরে হঠাৎ যেন চমকে উঠলো মীর। মিষ্টি স্বরটি এক আশ্চর্য শীতল স্পর্শ বইয়ে দিয়ে গেলো যেন ওর বুকে! শিউরে উঠলো ও সামান্য, মনে হলো এই কন্ঠস্বর ওর জনম জনমের চেনা।
মীর তার চোখ জোড়ার ওপর কিছুক্ষণ আবিষ্ট দৃষ্টি ফেলে বলার চেষ্টা করলো কিছু, কিন্তু সামান্য অহেতুক শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হলোনা ওর মুখ দিয়ে, গলার ভেতর যেন কিছু একটা চেপে ধরে আছে।
গলা খাকারি দিলো কয়েকবার, তারপর আবার চেষ্টা করলো, কিন্তু সফল হলোনা৷ মেয়েটি এক হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ গলায় বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর চেষ্টা করতে হবে না৷”
তারপর মীরের গভীর, সন্দিগ্ধ চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ক্ষিদে পেয়েছে?”
মীর উত্তর দিলোনা কোনো, তাকিয়ে রইলো দ্বিধাগ্রস্ত দৃষ্টিতে। এই মেয়েটিকে কেমন চেনা চেনা ঠেকছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছেনা৷ এই চোখ জোড়া সে আগেও দেখেছে, হয়তো বহুবার।
মেয়েটি ওর মুখের সামনে একবার তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলো,
“হোই মিয়া, ক্ষিদে পেয়েছে?”
মীর ভ্রু কুচকালো। ‘হোই মিয়া’ সম্বোধনটা যে সে খুব একটা পছন্দ করেনি সেটা তার চেহারাতেই প্রকাশ পেলো। টানটান হয়ে বসে, বিরস মুখে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো তার ক্ষিদে পেয়েছে।
মেয়েটি কিছু না বলে যেভাবে এসেছিলো ঠিক সেভাবেই চলে গেলো বাইরে। মীর তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে কিছু বকাবকি করলো বোধ হয়। তাকে কিনা বলে ‘হোই মিয়া’!
কোকো বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো, আনাবিয়াকে বাইরে আসতে দেখেই শুধোলো,
“কেমন কান্ডিশান আম্মা?”
“ভালো, একটু বেশিই ভালো। ভ্রু কুচকানো স্বভাব টা যায়নি, কিছু হলেই আগে যেভাবে তাকিয়ে থাকতো এখনো সেভাবেই তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি তার কোন পাকা ধানে বুল ডোজার চালিয়েছি।”
কোকো তার আম্মার এমন অভিযোগে আস্কারা পেয়ে বলল,
“গতরাতে ফুলদানিটা ছাড়লেনই না! নিতে গেলাম, এমন ভাবে তাকালেন যেন আমার কঙ্কাল পর্যন্ত ভস্ম করে দিবেন।সারা রাত ওটা সাথে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন বোধ হয়।”
“হ্যাঁ, সেটাই সকালে ছুড়ে ভেঙেছে৷ ওর কিছু মেডিসিন আছে খাবার আগে, সেগুলো ওকে খাইয়ে দিয়ে আয়। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“উরি বাবা, মাফ করবেন আম্মা, আমি যাচ্ছিনা। তিনি আগেও আমাকে পছন্দ করতেন না, এখনো করছেন না। আমি ভেতরে গেলে এবার কোন অস্ত্র ধরে আমাকে মার্ডারের চেষ্টা করবেন তার ইয়ত্তা নেই!
একটা কাজ করুন, ফারিশ জাবিন কে পাঠিয়ে দিন, ওকে দেখলে হিজ ম্যাজেস্টির সমস্ত স্মৃতি এক্কেরে তড়াক করে জেগে উঠবে৷ একটা খুন হলে হবে, তাই কি! ওরম তো অহরহ হচ্ছে।”
আনাবিয়া ওর দিকে কটমটে চোখে তাকিয়ে শাসনচ্ছলে বলে উঠলো,
“বেশি কথা বলিস তুই, যা ভেতরে!”
কোকো মুখ ভার করে চলে যেতে উদ্যত হতেই আনাবিয়া ডাকলো আবার,
“শোন..!”
কোকো ফিরে তাকালো, আনাবিয়া বলল,
“মহলে কারো কাছে কল করে বলে দে আমার ট্রি হাউজটা ক্লিন করতে। আমি ফিরে গিয়ে সেখানেই থাকবো।”
বলে কিচেনের দিকে এগোলো, আর কোকো আনাবিয়ার যাওয়ার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুকে ফু দিতে দিতে ঢুকলো কামরায়।
আনাবিয়া চিকেন রোস্ট আর পোলাও করেছে৷ ওর হাতের পোলাও রোস্ট মীরের ভীষণ পছন্দ ছিলো। পারতোনা থালাটা সুদ্ধ খেয়ে ফেলতো। সেইফ জোনে ওয়ার্কার্স দের সাথে থাকাকালীন এসে প্রায় প্রায় বায়না ধরতো রোস্ট খাওয়ার, আর আনাবিয়া মধ্যরাতে উঠে পূরণ করতো ওর সমস্ত খায়েশ।
প্লেটে খাবার সাজিয়ে আনাবিয়া ঘড়ি দেখলো, দুইটা বাজে। মীরকে খাইয়েই বেরিয়ে যাবে শিরো মিদোরির উদ্দেশ্যে। কিচেন থেকে বেরিয়ে এগোলো ওদের কামরার দিকে।
কিছুদূর যেতেই কোকোর চিৎকার কানে এলো আনাবিয়ার। সর্বনাশ করেছে! ওদিকে দুটো নিশ্চিয় কিছু বাধিয়েছে!
থালা হাতেই এক প্রকার ছুটে কামরায় ঢুকলো আনাবিয়া। ঢুকেই দেখলো কোকোর এক হাত পিঠ মোড়া করে মুচড়ে টেনে ধরে নির্বিকার চিত্তে ওর চিৎকার করা দেখে যাচ্ছে মীর।
ওকে দেখা মাত্রই কোকো আর্তনাদ করে ডেকে উঠলো,
“আম্মা!”
আনাবিয়া প্লেটটা কোনো রকমে কোথাও রেখে ছুটে এসে মীরের হাত থেকে কোকোর হাতটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে ভর্ৎসনার কন্ঠে বলল,
“কি করছো মীর! ছাড়ো ওকে, এভাবে ধরেছো কেন? হাত খুলে আসবে ওর, ছেড়ে দাও এখুনি!”
আনাবিয়ার হাত মীরের কব্জির উপরিভাগ স্পর্শ করতেই ছেড়ে দিলো কোকোর হাত। তৎক্ষনাৎ ওর সমস্ত মনোযোগ পড়লো আনাবিয়ার হাত জোড়ায়৷
কোকো ছাড়া পেয়ে নাক মুখ কুচকে বা হাত দিয়ে ডান হাতের কাধের অংশ চেপে ধরলো। প্রচন্ডরকম যন্ত্রণা শুরু হয়েছে, নিশ্চিত কোথাও কোনো জয়েন্ট ঢিলা হয়ে গেছে!
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯
মীর নীরিক্ষণী ভঙ্গিতে ঘুরে দাড়ালো আনাবিয়ার দিকে, জহুরি চোখ জোড়া নিবদ্ধ রইলো আনাবিয়ার গ্লাভস বিহীন হাতের দিকে৷ তড়িতে ওর দুহাতের কবজি নিজের চওড়া মুঠির ভেতর নিয়ে তুষার শুভ্র হাতের নরম তল জোড়া উঁচু করে ধরলো নিজের মুখের সম্মুখে, বিচক্ষণী দৃষ্টি রাখলো হাতের ওপর। এই হাত জোড়া ওকে স্পর্শ করতেই কি যেন হয়ে গেলো ওর! এই শিহরণ জাগানিয়া হাতের ভেতর কি আছে না দেখে ওর আর শান্তি নেই।
আনাবিয়া ঢোক গিললো, রান্না বান্নার ঝামেলায় গ্লাভস জোড়া হাতে পরতে ভুলে গেছিলো একদম! মীরের চোখের শকুনি মনোযোগের দিকে তাকিয়ে মন ভরে উঠলো শঙ্কায়….
