তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৭৩+৭৪
নৌশিন আহমেদ রোদেলা
সাহেলের সাথে জেনি আর হ্যারিও স্টলে ঢুকলো। একটি বড় টেবিল ঘিরে বসে আছে সবাই। জেনী বারবারই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। ডায়েরির বর্ননা অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষকে চেনার চেষ্টা করছে সে। স্টলে ঢুকতেই প্রথমে দুটো বাচ্চার উপর নজর পড়লো জেনির। বাচ্চাদুটো ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে আর হুটহাট হেসে উঠছে। জেনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। বাচ্চাদুটোর চেহারা এক কিন্তু কোথাও যেন সামান্য একটু পরিবর্তন আছে। কিন্তু পরিবর্তনটা ধরতে পারছে না জেনি। তাদের পাশেই বসে আছে লাল পাঞ্জাবী পড়নে আরেকটি ছোট্ট ছেলে। এতো বাচ্চা বয়সেই চোখে-মুখে দারুন গাম্ভীর্যতা। জেনি আর হ্যারি চেয়ার টেনে বসতেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো সাহেল,
— গাইস? আজকের জন্য ওরা আমাদের গেষ্ট। ওর নাম লুইস হ্যারিসন আমার ফ্রেন্ড পিটারের ছোট ভাই। আর উনি হচ্ছেন, জেনিফা কিংস্টোন —– হ্যারির উডবি।
হ্যারি-জেনিকে একগুচ্ছ মিষ্টিহাসি উপহার দিয়ে ওয়েলকাম জানালো সবাই। সাহেল বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললো,
— হ্যারি এন্ড জেনি? আমাদের বাচ্চাপার্টির সাথে পরিচিত হও। সেইম ডিজাইনের যে দুইটা বাচ্চা বসে আছে ওদের নাম আদ্র এন্ড রোদ্র। দু’জনেই প্রচুর দুষ্ট। ওদের চেনার উপায় হলো চুল আর টোল। একজনের চুল হালকা কুকরানো আর অন্যজনের গালে টোল। বাচ্চারা? আন্টিকে হাই বলো।
আদ্র- রোদ্র চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। হ্যারির মতো বাদামি চুলের শুভ্রমানব হয়তো এর আগে দেখে নি তারা। তবে পরমুহূর্তেই বিনা কারনেই হেসে উঠে দু’জনে একসাথেই বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— হাই আন্টি এন্ড আংকেল।
জেনি মিষ্টি করে হাসলো। সাহেল এবার পাশে বসে থাকা বাচ্চা ছেলেটার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
— এটা হলো আমার ছেলে যদিও স্বভাবগুলো একদমই আমার মতো নয়। বাচ্চাদের মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর এবং টিপটাপ। সবকিছুই পার্ফেক্ট চায় তার। উনিশ থেকে বিশ হলেই রাগে বাড়ি মাথায় তুলে নেন ইনি।
ছেলেটা বাবার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দেওয়ায় বাবার প্রতি চরম বিরক্ত সে। সাহেল ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
— বাবা? আন্টি আংকেলকে নিজের নাম বলো।
ছেলেটির কুঁচকানো ভ্রু আরো খানিকটা কুঁচকে গেলো। গম্ভীর মুখে বললো,
— হাই, মাই নেইম ইজ সাদাফ। নাবিল আল সাদাফ।
জেনি- হ্যারি দু’জনেই চমকে উঠলো। আড়াই বছরের পিচ্চি এতোটা স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে! কিভাবে? সাহেল এবার শুভ্রতাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
— আর ইনি হচ্ছেন আমাদের প্রিন্সেস, শুভ্রতা।
শুভ্র খুব মনোযোগ দিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিলো। নিজের নাম শুনে চোখ তুলে তাকালো সে। কথায় কোনো উৎসাহ না পেয়ে আবারও পাউরুটিতে মনোযোগ দিলো সে। পাশের চেয়ারে বসা শুভ্র মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললো,
— আম্মু? আন্টিকে সালাম দাও।
শুভ্রতা আবারও মুখ তুলে তাকালো। জেনিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে নিয়ে দু’একবার চোখ পিটপিট করে মিষ্টি হেসে বলে উঠলো,
— আছছামুয়াইকুম।
সাথে সাথেই পাশ থেকে প্রতিবাদী কন্ঠে বলে উঠলো আদ্র-রোদ্রের একজন,
— বোন? আছছামুয়াইকুম নয় আসসালামু আলাইকুম। তুই সবসময় ভুল করিস। সুন্দর করে বল।
শুভ্রতা এবার ভাইদের দিকে তাকালো। চোখ ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ জেনির দিকে তাকিয়ে থেকে চোখের ভারি পল্লব কাঁপিয়ে আবারও বলে উঠলো,
— আছছামুয়াইকুম।
পাশে বসে থাকে ওই লাল পাড়ের সাদা শাড়ির মেয়েটা এবার মিষ্টি হেসে পরম আদরে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
— আমার মা টা….
মায়ের আদর পেয়ে মায়ের দিকে তাকালো শুভ্রতা। চুল টেনে মায়ের মুখটা নিচু করে এনে সে-ও কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— আমাল মা তা!
সবাই হেসে উঠে এবার। জেনিরও শুভ্রতা নামের মেয়েটার কপাল,গাল সব জায়গা চুমুতে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাচ্চারা অপরিচিত ব্যক্তির অহেতুক আদর সহজভাবে নেয় না। তাই নিজের ইচ্ছেটাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরিষ্কার বাংলায় বললো,
— ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছো শুভ্রতা?
শুভ্রতা তাকায়। মুখ টিপে হেসে বলে,
— আমি ভায়ো আচি। তুমি কেমন আচো?
জেনি জানালো সে ভালো আছে। শুভ্রতা আবারও পাউরুটি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কেউ ভালো থাকলে তার বিপরিতে কিছু বলতে শেখানো হয় নি তাকে। অতএব, এখন অযথা কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই তার। আবারও কথা শুরুর আগেই খাবার চলে এলো টেবিলে। প্লেটে মচমচে ইলিশ মাছ ভাজা দেখে সেদিকে হাত ইশারা করে বললো সে,
— আম্মু? ওতা খাবো।
— ওটা ঝাল মা। ওটা খেলে তোমার জিভ জ্বলবে। ওটা খাওয়া যাবে না৷
শুভ্রতা একবার চোখ বড় বড় করে মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও প্লেটটির দিকে তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মায়ের কথা বিশ্বাস করে নিতেই অভ্যস্ত সে। মা যেহেতু বলেছে এটা ঝাল তারমানে এটা ভয়ানক ঝাল। সাহেল আর কারো সাথে পরিচয় না করিয়ে দেওয়ায় আশাহত হলো জেনি। সে কি সরাসরি রোদের কথা জিগ্যেস করবে? নাকি চুপ থাকবে? জেনির দ্বিধাদ্বন্দের মাঝেই একটা মেয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছছে সে। গায়ে বাঙালীদের মতো করে পড়া লাল-সাদা শাড়ি। পেটটা অস্বাভাবিক বড়। জেনি বুঝতে পারছে মেয়েটি প্রেগনেন্ট। তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন পুরুষ। মেয়েটি সবার দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলে উঠলো,
— আমাকে রেখেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন আপনারা? কি স্বার্থপর!
কথাটা বলে মুখ কালো করে পেছনে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকালো সে। রাগী গলায় বললো,
— শেষমেষ তো আনলেই মেলায় তাহলে এতো ঢং করলে কেন? আমি কতোকিছু মিস করে ফেলেছি। ধেৎ! ভালো লাগে না।
শুভ্র হেসে বললো,
— কিছুই মিস করো নি চিত্রা। খাবার তো একদমই না। তবে আমি কিন্তু শিশির ভাইকে সাপোর্ট করবো। এই অবস্থায় খাওয়ার লোভে দৌড়ে আসাটা একদমই উচিত হয় নি তোমার।
সবাই মুখ টিপে হাসলো। সাহেল বললো,
— সত্যিই। এতো খাই খাই করলে কি চলে চিত্রা? কন্ট্রোল!
চিত্রা এবার রাগে লাল। এদের সবাইকে খুব কঠিন কিছু কথা শুনাতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হুট করেই প্রশ্ন করলো জেনি,
— রোদ কোথায়?
“রোদ কোথায়?” কথাটা যেন বিস্ফোরণ ঘটালো। সবার হাসি হাসি মুখটা বিলীন হয়ে তাতে জমা হলো রাজ্যের বিস্ময়। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রর মুখটাও গম্ভীর।লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়া মেয়েটাও অবাক চোখে একবার শুভ্র তো একবার জেনির দিকে তাকাচ্ছে। সবার এমন রিয়েকশনে জেনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। একটা ঢোক গিলে আবারও প্রশ্ন করলো,
— রোদ কোথায়?
বিস্ময় কাটিয়ে জেনির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে উঠলো সাহেল,
— রোদের নাম কি করে জানেন আপনি?
জেনি নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো,
— আমি রোদের সাথে দেখা করতে চাই৷ উনার সাথে দেখা করতেই এতোটা দূর এসেছি আমি। ও কি বেঁচে আছে?
বিস্ময় ভাবটা যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো সবার। একটা মেয়ে ইউএস থেকে শুধুমাত্র রোদের সাথে দেখা করতে আসবে বিষয়টা বড্ড গোলমেলে লাগছে তাদের। সাদা শাড়ি পড়া মেয়েটা মৃদু গলায় বলে উঠলো,
— আমিই রোদ। কিন্তু আপনাকে তো চিনলাম না। কোথাও দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে না।
” আমিই রোদ ” এই একটি কথাতেই যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো জেনির। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না সে।হ্যারি চুপচাপ বসে আছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও কোনো ভাবাবেগ নেই তার। অন্য একটা কথা বেশ ভাবাচ্ছে তাকে। কথাটা শুনলে জেনি কেমন রিয়েক্ট করবে তাই ভেবে পাচ্ছে না সে। জেনি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আপনি রোদ? সত্যিই রোদ?
রোদ খানিকটা থতমত খেয়ে বললো,
— হ্যাঁ।কিন্তু কেন?
জেনি কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে রোদ-শুভ্রকে দেখে নিলো। ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে রোদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— এটা আপনার?
রোদ বেশ অবাক হলো। ডায়েরিটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নিজের ব্যাগ থেকে সেইম একটা ডায়েরী বের করে টেবিলে রাখলো সে। জেনি বিস্ফারিত চোখে দুটি ডায়েরিতে চোখ বুলিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
— সেইম ডায়েরি! তাহলে এটা কি আপনার নয়?
রোদ কিছু বলার আগেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে শুভ্র,
— ডায়েরি? এটা আবার কোন নতুন হিস্ট্রি? তাছাড়া, রোদ কখনো ইউএস যায় নি। তাহলে আপনি ওকে চিনেন কিভাবে? সবকিছুই কেমন অগোছালো লাগছে আমার।
শুভ্রর কথা শেষ হতেই জেনির হাত থেকে ডায়েরিটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সাহেল। কপাল কুঁচকে বললো,
— এটা তো কোলকাতায়…(একটু থেমে) আপনি এটা কি করে পেলেন মিস. কিংস্টোন? তবু এতোদিন পর!
জেনি এবার মুখ খুলে,
— বেশ কিছুদিন আগে বাবার স্টাডি রুমের এককোণায় হঠাৎই চোখে পড়ে ডায়েরিটা। ডায়েরিটা দেখে বেশ অবাক হই। ভেবেছিলাম, এটা হয়তো বাবার লেখা, আমার বাবা-মার জীবন কাহিনী। কিন্তু প্রথম পৃষ্ঠা খুলে বুঝতে পারলাম এটা রোদ নামের এক মেয়ের লেখা। তার জীবনের দারুন কিছু দিনকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই ডায়েরিটাতে। লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার ভালোবাসাকে —-শুভ্রকে! ভালোবাসার অনুভূতি যে এতোটা সুন্দর হতে পারে জানা ছিলো না আমার। অদ্ভুত এক আকর্ষনে রাত জেগে পড়ে ফেলি আবেগমিশ্রিত সেই ডায়েরি। কিন্তু ডায়েরির শেষ পাতাটিতে কেঁপে উঠি আমি। সেখানে রোদের কোলকাতায় পাড়ি জমানোর কথা লেখা আছে, তারপর ফাঁকা! এই সাদা কাগজগুলো বড্ড জ্বালাপোড়া করছিলো মনে।
একটা কথায় মনে হচ্ছিলো বারবার, কি হয়েছিলো তারপর? রোদ,শুভ্র আর তার সেই বাচ্চাটা কি বেঁচে আছে? এই আকর্ষন থেকেই বাবাকে ডায়েরির কথা জিগ্যেস করি। উনি জানান কোলকাতার এক ময়লার ঝুড়ি থেকে উদ্ধার করেছিলেন এই ডায়েরি তাও আবার প্রায় দু’বছর আগে। আমি আশাহত হই। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার আগ্রহটা এতো বেশি ছিলো যে হ্যারির প্ল্যানমতো চলে আসি বাংলাদেশে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো শুভ্রকে খোঁজা। এই অচেনা এক দেশের অচেনা এক শহরের বেশ কয়েকটি ভার্সিটির দারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াই শুধুমাত্র শুভ্রকে খুঁজবো বলে। রোদ তার ডায়েরিতে লিখেছিলো তার শুভ্র ভার্সিটির লেকচারার৷ কিন্তু ভার্সিটির নাম কোথাও উল্লেখ করে নি সে…. ভেবেছিলাম, খালি হাতে ফিরতে হবে আমাদের কিন্তু কাকতালীয়ভাবে “সাহেল” আর “আদ্র-রোদ্র” নামটা শুনেই থমকে দাঁড়াই। বুঝতে পারি গন্তব্য নিজেই আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবার।
জেনির কথার মাঝেই অবাক বিস্ময়ে বলে উঠে সাহেল,
— ডায়েরিতে যদি আমার নাম লেখা থাকে তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করলেই তো হতো? তাছাড়া, হ্যারি তো শুভ্রর নামটাও জানে। কেলিফোর্নিয়ায় থাকার সময় অনেকবারই শুভ্রর কথা বলেছি ওকে।
কথাটা জেনির মাথাতেও খেলে গেলো। হ্যারি সাহেলকে চিনে এই কথাটা এতোক্ষণ সেভাবে ভেবেই দেখে নি জেনি। জেনি কপাল কুঁচকে তাকালো,
— হ্যারি? তুমি সাহেল-শুভ্রকে চিনতে তাহলে আমায় বলো নি কেন?
হ্যারি অপরাধী চোখে তাকায়। মাথা চুলকে বলে,
— আই এম সরি,জেনি। অ্যাশ কেলিফোর্নিয়া থেকে প্রায় তিন-চার বছর আগে চলে এসেছিলো। যখন তোমার থেকে কাহিনীটা শুনলাম তখন অ্যাশের কথাটা মাথায়ই ছিলো না। আসলে,শোওবরোর এক্সিডেন্ট হওয়ার পর অ্যাশকে বাংলাদেশে আসার জন্য টিকেটটা আমিই ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম। আর তখনই শোওবরো আর রোওডের কথা বলেছিলো অ্যাশ বাট এতো বছর আগের সেই ছোট্ট কাহিনীর সাথে এই কাহিনীর লিংক থাকবে তা কখনো ভাবতেই পারি নি আমি। সো সরি সুইটহার্ট!
জেনি কি বলবে বুঝতে পারছে না। যে সমস্যার সমাধানটা মিনিটেই করে ফেলা যেত তারজন্য তিনদিন যাবৎ গাধার মতো খাটছে তারা। তবে সেই সুবাদে বাংলাদেশে তো আসা হলো! জেনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
—ইট’স ওকে হ্যারি। কিন্তু তারপর কি হয়েছিলো? আর রোদের কাছে এই দ্বিতীয় ডায়েরিই বা কিভাবে?
রোদ হাসলো। জেনির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
— আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আমার একটা ডায়েরি এতোটা দূর টেনে এনেছে আপনাকে। ডায়েরি লেখাটা আমার ছোট বেলার অভ্যাস। আমার ষষ্ঠতম জন্মদিনে নানুভাই আমাকে ছয়টা ডায়েরি উপহার দেন। ডায়েরিগুলো দেখতে ঠিক একইরকম ছিলো। সেদিন নানু বলেছিলেন, ” নানুভাই? ডায়েরিগুলো কিন্তু ফেলে রাখার জন্য নয়। এই ডায়েরিগুলোই ৮০ বছর পর আয়না হয়ে তোমার সামনে দাঁড়াতে পারে। ৮০ বছরের বুড়ো হয়ে ৬ বছরের রোদকে দেখতে পাওয়াটা মজার নয় নানুভাই?” আমি জিগ্যেস করেছিলাম, কিভাবে? উনি বলেছিলেন,” এখন থেকে জীবনের সব ঘটনাগুলো এই ডায়েরিগুলোতে বন্ধী করে রাখো নানুভাই। সুখ-দুঃখ সব। যখন আমার মতো বুড়ো হয়ে যাবে। মুখের সব কটা দাঁত পড়ে যাবে তখন ভারি চশমা চোখে ডায়েরিগুলো খুলবে। তখন ম্যাজিক হবে, এই ছোট্ট তুমি চট করে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে।”
সেদিন নানুভাইয়ের কথাগুলো অবাক হয়ে শুনছিলাম। কি বুঝেছিলাম জানি না তবে পরের দিন থেকেই ডায়েরি লেখা শুরু করে দিয়েছিলাম কেবলমাত্র বুড়ো হলে ম্যাজিক হবে বলে। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়। আমার স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ, ভার্সিটি লাইফ সবকটার জন্য আলাদা আলাদা ডায়েরি আছে আমার। কিন্তু দুঃখের বিষয় ছিলো, ভার্সিটি লাইফ শেষ না হতেই ডায়েরিটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম । সেই ডায়েরিই আজ দু’বছর পর আবারও ফিরে পাবো ভাবতেই পারি নি আমি।
জেনি বললো,
— ডায়েরির ব্যাপারটা তো বুঝলাম। কিন্তু হসপিটালের ব্যাপারটা এখনও একটা ধাঁধা। কি করে বেঁচে গেলেন আপনি? এটাও কি একটা ম্যাজিক? আর ডায়েরিটা হারালোই বা কিভাবে?
রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— ম্যাজিক নয়। আল্লাহর রহমত। সেদিন যখন জানতে পারি বাঁচার মতো সময় নেই হাতে। তখনই মনে মনে হাজারবার ধন্যবাদ দিই নানুভাইকে। আমার বাচ্চার কাছে “মা” না থাকলেও মায়ের জীবনের প্রতিটি ঘটনা জানতে পারবে সে সেই মুহূর্তে এটাও আমার কাছে ছিলো ভীষন আনন্দের। আমার মনে হয়েছিলো ডায়েরিগুলোর মাধ্যমেই আমার মেয়েটার সাথে বেঁচে থাকবো আমি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনের লাস্ট সময়গুলোও ডায়েরিতে তোলে দিয়ে যাবো যেন আমার মেয়ে তার মায়ের কষ্টগুলোও উপলব্ধি করতে পারে। কোলকাতায় রওনা দেওয়ার পর সাহেল ভাইয়াকে ডায়েরিগুলোর কথা বলি আমি। আমি চলে গেলে এই ডায়েরিগুলো শুভ্রকে দেওয়ার জন্যও রিকুয়েষ্ট করি। আর বাকি রাস্তাটুকুতে লিখে চলি সেদিন ঘটে যাওয়া সেই কষ্টবহ কাহিনীগুলো। কোলকাতা হসপিটালে ডক্টর বের হওয়ার পর শুভ্রও বেরিয়ে যান অটিতে ঢোকার জন্য পোশাক পাল্টাতে। নার্সকে রিকুয়েষ্ট করে পাঁচ মিনিট ওয়েট করতে বলে কয়েক লাইন লিখতে বসি কিন্তু সবটা লেখা হয়ে উঠে না। তার আগেই তাড়া পড়ে অপারেশনের জন্য। ডায়েরিটা থেকে যায় বেডের এক কোণে। ভেবেছিলাম শুভ্র অটিতে ঢুকলে, সেন্স হারানোর আগে ছোট্ট করে হলেও ডায়েরিটির কথা বলবো তাকে কিন্তু উনি আসেন নি।
রোদের কথার মাঝেই প্রশ্ন করে উঠলো জেনি,
— কেনো?
সাহেল বললো,
— উত্তরটা আমি দিচ্ছি। সানশাইনের সাথে অটিতে যাওয়ার বায়না করাটা সেদিন শুভ্রর পাগলামোরই একটা অংশ ছিলো। নিজেই অসম্ভব রকম অসুস্থ ছিলো সে। সেদিনই অপারেশন হয়েছিলো ওর। একা ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারতো না। তারওপর সানশাইনের কেবিন থেকে বেরিয়েই দু-তিনবার বমি হয় ওর। তার পরপরই সেন্স হারায়। আমি আর অভ্র ভাই দুজনেই যেন অকুল পাথারে পড়ি। শুভ্রকে হসপিটালের আইসিইউতে রাখা হয়। সেদিনের কথাটা মনে হলেও কেঁপে উঠি আমি। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় লাগছিলো সেদিন। একদিকে সানশাইন, একদিকে শুভ্র আর অন্যদিকে বাচ্চাটা। এক মুহূর্তের জন্য তো মনে হচ্ছিলো নিজেও মরে যাই। এতো টেনশন নেওয়াটা খুবই কঠিন ছিলো আমার আর অভ্র ভাইয়ের জন্য। প্রায় তিন-চার ঘন্টা অপারেশন চলার পর বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনে আমি আর অভ্র ভাই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। বুকের ভেতর আনন্দ না কষ্ট কাজ করছিলো তাই বুঝতে পারছিলাম না। ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন মেয়ে হয়েছে।
আমরা বুঝতেই পারছিলাম না কি বলবো। নিশ্চিত মৃত্যু জেনে যে মানুষটাকে অটিতে নেওয়া হলো তার অবস্থা কি করে জিগ্যেস করতে হয় জানা ছিলো না দু’জনের কারোরই। দু’জনের গলাতেই কথা আটকে গিয়েছিলো। এক পর্যায়ে ডক্টর নিজেই বললেন, “আপনাদের পেশেন্ট এখনও মারা যায় নি। অজ্ঞান অবস্থায় আছে অর্থাৎ এখনও পার্লস চলছে।তবে কতক্ষণ চলবে তা বলতে পারছি না। মারা যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা উনাকে আইসিইউতেই রাখবো।” ডক্টরের কথার প্রতিউত্তরে সেদিন কিছুই বলি নি আমরা। শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে আইসিইউ এর সামনে বসে ছিলাম চুপচাপ। আর রোদ-শুভ্র দু’জনেই শুয়ে ছিলো আইসিইউ এর হাজারও যন্ত্রপাতির ভীরে। একদিকে কষ্টে বুক কাঁপছিলো অন্যদিকে মনে হচ্ছিলো,যা হচ্ছে বেশ হচ্ছে। মরে যাক শুভ্র। কারণ, রোদের চলে যাওয়ার পর একা শুভ্রকে সামলানোর থেকে শুভ্রকে এখনই হারিয়ে ফেলাটা কম কষ্টের মনে হচ্ছিলো আমার। কয়েকঘন্টার মধ্যে শুভ্রতার বাঁচাটাও আশঙ্কাময় হয়ে উঠে ডক্টরদের কাছে। বাচ্চার খাবার চায় কিন্তু বাচ্চার মা-ই তো নেই। কিন্তু সব ছাড়িয়ে একটা ব্যাপারে অবাক হই আমরা।
আইসিইউ-তে শিফট করার ছয়ঘন্টা চলে যাওয়ার পরও সানশাইনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় নি। সারা শরীর কাজ করা বন্ধ করে দিলেও বেঁচে আছে সে। ডক্টররা আবারও দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। এটা তাদের কাছে বিগ এচিভমেন্ট! পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমাদের জানানো হয়, রোদের বেঁচে থাকা আর মারা যাওয়া একই। তারা রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য যে ইনজেকশন উদ্ভাবন করে ছিলেন সেটা রোদের উপরই টেস্ট করা হয়েছে প্রথম। রোদের ব্রেনের রক্তক্ষরণ হুট করেই থেমে গেছে কিন্তু এরপর কি হবে তা তারা নিজেরাও জানে না। হয়তো কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস চলবে। ঔষধের ইফেক্ট শেষ হলে থেমে যাবে নিঃশ্বাস! তাই বাঁচার আশাটা ছেঁড়ে দেওয়াটাই মঙ্গল। শুভ্রর সেন্স আসে আরো দু’ঘন্টা পর। ততক্ষণে নাবিলা আর আঙ্কেলও পৌঁছে গেছেন হসপিটালে। শুভ্র চোখ মেলে প্রথমেই জিগ্যেস করলো, “রোদ কোথায়?” আমাদের কাছে কোনো উত্তর ছিলো না।
আমরা জানতাম শুভ্র এখন ঠিক কি কি করতে পারে তাই ডক্টররা ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পারিয়েই রাখে ওকে। কিন্তু একটা মানুষকে কতক্ষণ ঘুম পারিয়ে রাখা যায়? শুভ্রও জেগে ওঠে। আবারও তার মুখে একই প্রশ্ন, “রোদ কোথায়? ” আবারও উত্তরহীন দাঁড়িয়ে থাকি আমরা। শুরু হয় শুভ্রর পাগলামো। ফাজিলটা কি কি না করেছে তখন। হাতে যা পেয়েছে ছুঁড়ে মেরেছে। আটকাতে গিয়ে অভ্র ভাইয়ার হাত আর আমার কপাল কেঁটেছে। শুভ্রর এসব পাগলামো দেখে আংকেলেরও পেশার ফল করেছে। আমাদের জন্য নরকীয় একটা সময় যাচ্ছিলো তখন। একসময় সব ছুঁড়াছুঁড়ি করে ক্লান্ত হয়ে হাত আর মাথার ব্যান্ডেজ নিয়ে টানাটানি শুরু করে শুভ্র। ডক্টররা আতঙ্কিত হয়ে আবারও জোরপূর্বক ঘুমের ঔষধ পুশ করে। ওর এমন পাগলামো দেখে শুভ্রতাকে ওর সামনে পর্যন্ত নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম আমরা।
যদি না বুঝে বাচ্চাটাকে কিছু করে! এভাবেই জিনিস ছুঁড়াছুঁড়ি আর ঘুমিয়েই কেটে গেলো পাঁচ/ছয়টি দিন। সানশাইনের বডিতেও কোনো রিয়েকশন দেখা দিলো না। ডক্টররা বললেন রুগী কোমাতে চলে গেছে। কোমা থেকে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না উনারা। তবে উনারা চেষ্টা করবেন। এটা উনাদের রিসার্চের জন্য একটা গুড সাইন। সেই মুহূর্তে ডক্টরদের ধরে খুন করতে ইচ্ছে করছিলো আমার। আমাদের রুগী মারা যাচ্ছে আর তারা তাদের রিসার্চ নিয়ে পড়ে আছে। এক সপ্তাহ পর শুভ্রর এমন একটা অবস্থা হলো যে চমকে উঠলাম আমরা। খাবার তো খাচ্ছেই না সেই সাথে ঔষধও না। যাকে দেখছে তার প্রতিই এগ্রিসিভ হয়ে পড়ছে। নার্স, ডক্টর তো দূরে থাক আমাদেরকে দেখেও পাগলামো শুরু করছে।
ডক্টর যখন বললো এভাবে চলতে থাকলে এই রোগীকেও বাঁচানো যাবে না তখন নাবিলা সাহস করে শুভ্রতাকে সামনে নিয়ে গেলো। আমরা শুধু ভয় করছিলাম, না-জানি বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়। নাবিলা রুমে ঢুকতেই আবারও শুরু হলো পাগলামো। হসপিটালের স্টিলের ট্রলি তোলে নিলো ছুঁড়ে মারবে বলে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। এতো শব্দে শুভ্রতা কেঁদে উঠতেই থেমে গেলো শুভ্র। ট্রলি দু’হাতে তোলে ধরেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। আমরা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। নাবিলা সাহস নিয়ে বললো, “শুভ্র তোর প্রিন্সেস। তোর আর তোর রোদপাখির প্রিন্সেস। কোলে নিবি না? দেখ, তোর প্রিন্সেস কাঁদছে।” শুভ্র একদমই শান্ত হয়ে গেলো। ট্রলি হাত থেকে ফেলে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রর সেই শান্ত চেহারাটা দেখে বুক থেকে একটা ভারি বোঝা নেমে গিয়েছিলো সেদিন। ১০ দিনের শুভ্রতাকে চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু কোলে নেয় নি।
তার যে শুধু তার রোদপাখিকেই চায়। এই দশদিনে সেদিনই শুধু চিৎকার করে কেঁদেছিলো শুভ্র। আঙ্কেল তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,” আমার শুধু রোদকেই চাই বাবা। আর কিচ্ছু না। আমার সাথেই এমনটা কেন হবে বাবা? আমার সাথেই কেন? যদি কোনো পাপ করে থাকি তো অন্যকোনো শাস্তি দিক আমি মাথা পেতে নিবো। একটু উফ ও করবো না বাবা। কিন্তু রোদকে দিয়ে আমি পাপমোচন করতে পারবো না। প্লিজ বাবা… প্লিজ! এনে দাও আমায়। আমার ওকে চাই। খুব প্রয়োজন ওকে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না দেখো। দমটা কেমন আটকে আসছে।” (এটুকু বলে থামে সাহেল। শ্বাস টেনে নিয়ে আবার বলে) সেদিন সেই দৃশ্যটুকু আমার মনটাকে হাজারো ক্ষতে রক্তাক্ত করে দিয়েছিলো। শুভ্রকে শান্ত করতেই আঙ্কেল বলে দিয়েছিলেন যে, রোদ বেঁচে আছে কিন্তু জেগে নেই। শুভ্রর কাছে শেষের বাক্যটি প্রাধান্য পায় নি। তার রোদ বেঁচে আছে সেটাই তো অনেক।
আরো কিছুদিন পর সানশাইনকে ঢাকায় ট্রান্সফার করা হয়। তখন থেকে নতুন এক শুভ্রকে দেখি আমরা। সানশাইনকে সেই অবস্থাতেই সম্পূর্ণ মেনে নিয়ে হসপিটালকেই বাসা বানিয়ে ফেলে সে। একমাস পর ডক্টরকে অনুরোধ করে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে রোদকে বাড়িতে ট্রান্সফার করে আনে শুভ্র। এতোটা ধৈর্য শুভ্রর মাঝে থাকতে পারে কখনো কল্পনায় করতে পারি নি আমি। শুভ্রতার দেখাশোনা, রোদের দেখাশোনা এবং নিজের দেখাশোনাও একা হাতেই করেছে সে। প্রতিদিন ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়া, মেয়েকে নিয়ে খেলা আর সানশাইনের খেয়াল রাখা কোনটাতেই কোনো কমতি রাখে নি সে। নিজেকেও ভেঙে পড়তে দেয় নি।
শুভ্রর বিশ্বাস ছিলো সানশাইন আবারও চোখ খুলবে, হাসবে, তাকে মুগ্ধ চোখে দেখবে! আর সেই দিনটির জন্য হলেও শুভ্রকে আগের মতোই থাকতে হবে। যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই সানশাইন বলে, “আমার বর সবথেকে কিউট। অন্নেক কিউট।” শুভ্রর সেই বিশ্বাস বাস্তবে পরিণত হয় টানা তিনমাস দশদিন পর জেগে উঠে সানশাইন। ছয়মাসের মাথায় ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনে। এই দীর্ঘ ছয়মাস পর আহমেদ পরিবারে আবারও খুশির ঝিলিক নামে। মেঘ কেটে গিয়ে আবারও দেখা দেয় রোদের হাসি।
একটানা কথাগুলো বলে থামে সাহেল। সামনে রাখা পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে সম্পূর্ণ পানিই এক নিশ্বাসে শেষ করে দেয় সে। জেনি সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বুকে খুব ভারি কিছু অনুভব করছে সে। টেবিলের বাতাসটা কখন যে এতো শান্ত আর বিষাদময় হয়ে উঠেছে খেয়ালই করে নি জেনি। ছোট্ট শুভ্রতা পর্যন্ত বাবার গায়ে মাথা এলিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। এই ছোট্ট বাচ্চাটাও কতোটা স্ট্রাগল করে এই পৃথিবীতে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। জেনির চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে আসছে। আচ্ছা, তার কি কান্না পাচ্ছে? টেবিলে বসে থাকা প্রত্যেকটি মানুষের চোখে-মুখে কষ্টের ছাপ। হয়তো বিগত দিনের কষ্টগুলোই আবারও চাড়া দিচ্ছে বুকে। জেনি আড়চোখে শুভ্রর দিকে তাকালো। শুভ্রর চোখ দুটো জলে টলমল করছে। হয়তো প্রিয়তমাকে হারানোর ভয়টা আবারও জেগে উঠেছে মনে। খুব সাবধানে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে শুভ্র,
— সাহেল, শালা তুই তো দেখি আমার মান-ইজ্জত কিছু রাখলি না। বউয়ের সামনে বলা এক কথা আর পাব্লিক প্লেসে এভাবে….
সাহেল হেসে বলে,
— যা পাগলামো করছিস তার তো দুইভাগও বলি নি। ওগুলো বললে তো মান-ইজ্জত যেটুকু আছে সেটুকুও থাকবে না। পাগলামো করার সময় মান-ইজ্জতের ভয় করে আমাদের একটু রেহাই দিলেই তো পারতি দোস্ত।
শুভ্র হাসে। জেনি জোরে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলে,
— থেংক গড ডায়েরিটা হারিয়েছিলো নয়তো এমন একটা ভালোবাসা দেখার সৌভাগ্যটা হতো না।
সাহেল হেসে বলে,
— কি করবো বলুন, এদের জামাই-বউয়ের চিন্তায় এই ডায়েরির কথা আর মাথায় ছিলো না। কিভাবে যে ওটা ময়লার ঝুড়িতে গেলো আল্লাহ মালুম।
এতোক্ষণে কথা বলে হ্যারি। বিস্ময় নিয়ে স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে উঠে,
— জেনি সবসময়ই লাভ ম্যাজিকের কথা বলে। আমার আজ কথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই হয়তো ভালোবাসা নামক ম্যাজিক আছে। যে ম্যাজিক পাওয়ারটা স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন।
মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে শুভ্রর ডানবাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে টলমলে চোখে বলে উঠে রোদ,
— চোখ খোলে আবারও এই পৃথিবীটাকে দেখতে পাবো ভাবি নি কখনো। যেদিন চোখ খুললাম আর নিজের ঘর নিজের স্বামীর মুখটা আবারও দেখলাম। আমি তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সবকিছুকে স্বপ্ন বা কল্পনাও ভাবতে পারছিলাম না। মৃত্যুর পর তো স্বপ্ন বা কল্পনা থাকে না। মনে হচ্ছিলো কোনো জান্নাতে আছি। যেখানে আস্ত একটি জান্নাত, আমার বর আমাকে বুকে আগলে রেখেছে সেই আগের মতো। আল্লাহকে এই নতুন জীবনের জন্য প্রতিটি মুহূর্তে শুকরিয়া জানাই। আমাকে এতোটা ভাগ্যবতী করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্যও শুকরিয়া জানাই।
কথা বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। শুভ্রতা মায়ের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। মাকে কাঁদতে দেখেই ঠোঁট ভেঙে কান্নাভাব নিয়ে বাবাকে বলে,
— বাবা? আম্মু কাঁদে…
শুভ্র হেসে রোদের কপালে চুমু দিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। নিচু হয়ে মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
— তুমি মানা করো তাহলেই আর কাঁদবে না।
শুভ্রতা খুব যত্নে জল মুছে দিয়ে মাথা দুলিয়ে বলে,
— তাক,কাঁদে না।
জেনির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। কেন কাঁদছে জানে না সে। শুধু জানে কান্না পাচ্ছে…প্রচুর কান্না পাচ্ছে। হঠাৎই কারো হাতের স্পর্শে ফিরে তাকায় জেনি। হ্যারি একহাত জড়িয়ে আছে তাকে। জেনি তাকাতেই হাসি ফুটে তার মুখে। ফিসফিস করে বলে,
— ইশ! বাচ্চাদের মতো কাঁদছো দেখি। ডোন্ট ক্রাই সুইট লিটল বেবি। হ্যারি লাভ’স ইউ…. এন্ড হি উইল লাভ ইউ ইন এভ্রি মোমেন্ট অফ হিজ লাইফ।
জেনি হাসে। আবারও শুরু হয় হাসি-মজা। খাওয়া শেষে স্টল থেকে বেরিয়ে বিদায় নেওয়ার সময় বলে উঠে রোদ,
— জেনি? আপনারা আমাদের অতিথি। আমাদের খুঁজে এতোটা দূর এসেছেন অথচ সামান্য আতিথেয়তার সুযোগ আমরা পাবো না। তা তো হতে পারে না। পরশো আমার ভাইয়ার বিয়ে। এই ক’টা দিন আমাদের বাড়িতে আমাদের সাথেই থাকুন না প্লিজ।
জেনি হেসে দেয়। এমন একটা দারুন সুযোগ কখনোই মিস করতে চায় না সে। রোদকে জানায় তারা আসবে তবে তার আগে হোটেলে যেতে হবে তাদের। রোদও হেসে সম্মতি জানায়।
রাদিব সাহেবের বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। একমাত্র ছেলের বিয়ে উপলক্ষে দুই মেয়ে আর নাতি-নাতনীরা এসে পাল্টে দিয়েছে বাড়ির পরিবেশ। ফাঁকা বাড়ি আজ বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরপুর। রাদিব সাহেব নাতি-নাতনীদের দেখছেন আর অবাক হচ্ছেন তার কাছে মনে হচ্ছে এইতো সেদিন, ছোট্ট ছোট্ট রোদ-রুহি সারা বাড়ি ছুটে ছুটে খেলতো, উনি অফিস থেকে ফিরলেই উনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো,একটু বকলেই কান্না করে চোখ ফুলাতো।কিন্তু আজ তাদেরই ছেলেমেয়েরা গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে। ছোট ছোট হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরছে। মেয়েরা যে কেন এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, কে জানে? রাদিব আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে চশমা পরিষ্কার করেন। চশমাটা চোখে পড়ে নিয়ে ড্রয়িংরুমে খেলারত বাচ্চাদের ডাকেন,
— নানুভাই? এইযে, নানুভাই? এদিকে আসো..
বাচ্চারা তাকায়। নানার ডাকে একছুটে এসে দাঁড়ায় উনার সামনে। রাদিব সাহেবের চোখে- মুখে সুখের হাসি। এই বাচ্চা তিনটির মাঝেই যেন মেয়ে দুটোর প্রতিচ্ছবি দেখতে পান তিনি। দুর্বল হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে চকলেট বের করে তিনজনের হাতেই দুটো করে চকলেট দেন। বাচ্চারা চকলেট পেয়েই রাদিব সাহেবের গালে চুমু দিয়ে দৌঁড় লাগায়। রাদিব সাহেব হেসে খানিকটা দূরে চেয়ার টেনে বসেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাচ্চাদের খেলা দেখেন। আজ থেকে ২০ বছর আগে এভাবেই ছুটে ছুটে খেলা করতো রোদ,রুহি আর রাহাত। চকলেট পেয়ে নিজের ভাগের থেকে অর্ধেকটা ছোট বোনের দিকে এগিয়ে দিতো দুজনেই।
এটা বোনের প্রতি ভালোবাসা বুঝানোর এক অদ্ভুত পদ্ধতি ছিলো তাদের। একের পর এক চেয়ার সাজিয়ে গাড়ি গাড়ি খেলছে বাচ্চারা। খেলার মাঝেই নিজেদের চকলেট থেকে একটা চকলেট শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দেয় আদ্র-রোদ্র। এমনটা করতে কেউ শিখিয়ে দেয় নি তাদের তবু কাজটি প্রায়ই করে তারা। হাতে কিছু পেলে তার অর্ধেকটা বোনকে দেওয়া যেন এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাদিব সাহেব চমকে উঠেন। পৃথিবীটা ভারি অদ্ভুত! ঘটনার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মানুষকে চমকে দেওয়াটা যেন এক খেলা। চমকে দেওয়ার খেলা। শুভ্রতার প্রতি বরাবরই খুব দুর্বল রাদিব সাহেব। রোদ যখন ডাক্তারদের হতাশা নিয়ে বিছানায় পড়ে ছিলো তখন রাতের পর রাত এই বাচ্চাটার কথায় ভেবেছেন উনি। মা ছাড়া দু’দিনের এই বাচ্চাটা থাকবে কিভাবে? বাবা হাজার আদর দিলেও কি মায়ের আদর পূরণ হয়? এই চিন্তা থেকেই রোদের মায়ের সাথে শুভ্রর আবার বিয়ে করা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন উনি। বাচ্চাটার জন্য হলেও শুভ্রকে আবার বিয়ে করা উচিত। মেয়ের যে ভরসা নেই। কে জানে প্রাণ ফিরে পাবে কিনা? নাতনীর ভবিষ্যৎটাও তো দেখতে হবে তাদের। এই কথাটাই কিভাবে যে শুভ্রর কানে গিয়েছিলো কে জানে? এই নিয়ে শুভ্রর কি রাগ। শুভ্রতার আশেপাশেও ঘেঁষতে দেয় নি তাদের।
মেয়ের জন্য কাউকে চায় না শুভ্র না চায় রোদের জন্য। সে বেঁচে থাকতে এই দুটো মানুষকে কারো দয়ার প্রয়োজন নেই আর না হবে। শুভ্রর রাগ ভাঙতে দু দুটো মাস লেগেছিলো রাদিব সাহেবের। সেদিন তিনি কেঁদেছিলেন। কষ্টে নয় মেয়ের স্বামী ভাগ্য দেখে খুশিতে কেঁদেছিলেন উনি। কিছুক্ষণের মাঝেই রোদদের বাড়িতে এসে পৌঁছালো সাহেল-নাবিলা। সাথে আছে একমাত্র ছেলে সাদাফ। জেনি আর হ্যারিও এসে পৌঁছেছে সেই ভোরে। চিত্রা দু’দিন আগে চলে এলেও শিশির আসে নি। সে আসবে বিয়ের আগের দিন রাতে। রুহুন-সাব্বিরও বিকেলের দিকে পৌঁছে যাবে।
অফিস থেকে ছুটি নিতে গিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে তাদের। দু’জনেই এখন বিবাহিত, বউরাও সাথে আসছে তাদের। রাতুল-সাকিব তো আছেই সাথে আছে ভার্সিটি ক্রাশ শ্রেয়া এবং হারের ডাক্তার আহান। শ্রেয়া এখন বিবাহিত। তার স্বামী ডিফেন্সে আছে। ডাক্তার আহানও দু’মাস আগে বিয়ের পিড়িতে বসেছেন। পরশো তার হানিমুনে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু রোদের রিকুয়েষ্ট আর দাওয়াত পেয়ে হানিমুনে যাওয়ার ডেটটাই পিছিয়ে দিয়েছে বেচারা।
বিকেল ৪ টা। মেয়েরা হলুদ শাড়ি আর ছেলেরা লুঙ্গি আর সেন্টো গেঞ্জি পড়েছে। লুঙ্গি পড়া নিয়ে সে কি হাঙ্গামা। শুভ্র কিছুতেই লুঙ্গি পড়বে না। সেন্টো গেঞ্জি পড়ে মেয়েদের সামনে ঘুরে বেড়ানোটাই বিশ্রী লাগছে তার। তারওপর লুঙ্গি, ইম্পসিবল! সাহেল, সাব্বিররা অনেক দস্তাদস্তি করেই শুভ্রকে লুঙ্গি পড়তে রাজি করিয়েছে। কিন্তু ফেসাদে পড়েছে বেচারা হ্যারি। জীবনেও লুঙ্গি পড়ে নি সে৷ লুঙ্গি নামে কোনো পোশাক আছে তা এই বাংলাদেশে এসেই জেনেছে সে। তার কাছে ভারি অদ্ভুত একটি পোশাক হলো লুঙ্গি। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। সাহেল আর রুহুন মিলে খুব কৌশলে লুঙ্গি পড়িয়েছে হ্যারিকে। লুঙ্গি পড়ার পর থেকেই কোমর চেপে ধরে চেয়ারে বসে আছে হ্যারি।
তার ধারনা, দাঁড়ালেই খুলে পড়ে যাবে এই পোশাক। আদ্র-রোদ্রও ছোট ছোট লুঙ্গি পড়েছে। দু’পা এগুতেই লুঙ্গি খুলে পড়ছে নয়তো লুঙ্গিতে পা বেজে নিজেরাই উল্টে পড়ছে। সাদাফ হলুদ ফতুয়া আর সাদা হাফপ্যান্ট পড়ে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। শুভ্রতা হলুদ ফ্রক পড়ে ভাইদের সাথে পানি ছুঁড়াছুড়িতে মেতে উঠেছে। কিছুক্ষণ পর পর পায়ে ঝুমঝুম শব্দ করা নুপুরের দিকে তাকাচ্ছে। এ বাড়িতে আসার সময় দিদা পড়িয়ে দিয়েছে এই নুপুর। জিনিসটার নাম না জানলেও এর ঝুমঝুম শব্দটা খুব পছন্দ হয়েছে শুভ্রতার। চিত্রা হলুদ শাড়ি পড়ে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগেই শিশিরের সাথে তুমুল কথা-কাটাকাটি হয়েছে তার।
কথা-কাটাকাটির মূল কারণ “শিশিরের না আসা”। যদিও যা বলার চিত্রাই বলেছে শিশির শুধু চুপচাপ শুনে গিয়েছে তবুও চিত্রার মন মানছে না। হলুদে সবাই রোমান্স করবে আর তার হাজবেন্ট বাসায় বসে ল্যাপটপে কাজ করবে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে।ছেলেরা ইতোমধ্যে গান ছেড়ে দিয়ে নিজেদের ক্রিয়েটিভিটি দেখানো শুরু করে দিয়েছে আর মেয়েরা হলুদের বাকিসব রীতি পালনের আয়োজন করছে। শুভ্রর গায়ে সাদা- সবুজ চেইকের লুঙ্গি আর সাদা সেন্টো গেঞ্জি। গলায় ঝুলছে লাল গামছা। সিল্কি চুলগুলো কপালের অর্ধেকটাই ঢেকে রেখেছে। ভ্রু দুটো কুঁচকে এদিক সেদিক তাকিয়ে রোদকে খুঁজছে সে। বাগানের এককোনায় শুভ্রতাকে পানি দিয়ে খেলতে দেখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার মুখে। মেয়ের মাকে খুঁজে না পেলেও মেয়েকে তো খুঁজে পাওয়া গেছে তাতেই রক্ষে। শুভ্র কিছুটা এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতাকে ডাকে,
— প্রিন্সেস? বাবা ডাকে, এদিকে এসো। ফাস্ট…
শুভ্রতা বাবাকে দেখে দৌঁড়ে আসে। সারা শরীর ভিজে চুপচুপে তার। মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় শুভ্র,
— জামা ভেজা কেন, মা? ঠান্ডা লাগবে তো তোমার আম্মু কোথায়?
শুভ্রতা ভারি পল্লব ঝাঁকিয়ে পিটপিট করে বাবার দিকে তাকায়,
— আম্মু খেয়ছে।
শুভ্র ভ্রু কুঁচকায়। রোদের কেয়ারলেসে খুবই বিরক্ত সে। নিজের কথা নাহয় বাদই দিলো মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখার সময়টাও কি নেই তার?শুভ্র মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে জিগ্যেস করে,
— কোথায় খেলছে তোমার আম্মু?
শুভ্রতা একহাতে বাবার গলা জড়িয়ে অন্যহাতে স্টেজের দিকে ইশারা করে বলে,
— ওইতে..
শুভ্র মেয়েকে নিয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়। চারপাশে তাকিয়ে রোদকে খুঁজে। রোদ স্টেজের এক কোণে কিছু একটা করছিলো। শুভ্রর ডাক কান পর্যন্ত পৌঁছায় না তার। এতো গান বাজনায় না শোনারই কথা। স্টেজে মেয়েদের ভীর থাকায় সেদিন আর পা বাড়ায় না শুভ্র। মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে আম্মুকে ডেকে আনতে বলে সে। শুভ্রতা বাবার কথা মতো এগিয়ে যায়। কিন্তু প্রতি পা এগুতেই থামতে হয় তাকে। যার পাশ দিয়েই যায় সে-ই দাঁড় করিয়ে গালে-কপালে চুমু দিয়ে দেয় নয়তো গাল ধরে টানে। শুভ্রতা ঠোঁট উল্টে একবার বাবার দিকে তাকায়। এদের এতো এতো আদরে মেয়ে বিরক্ত আর মেয়ের বাপ মহাবিরক্ত। আদর নামক অত্যাচার সহ্য করে মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় শুভ্রতা৷ মায়ের আঁচল টেনে ডাকে,
— আম্মু? আম্মু?
রোদ ফিরে তাকায়। মেয়ের ভেজা শরীর দেখেই চমকে ওঠে, না জানি কতক্ষণ যাবৎ ভেজা শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেয়েটা। মেয়ের গালে কপালে হাত দিয়ে গায়ের তাপ পরিক্ষা করে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। শুভ্রতা মায়ের চুল নিয়ে খেলতে খেলতে মৃদু স্বরে বলে,
— জয় নেই তো। বাবা দাকে তোমায়….ওইতে..
রোদ কপালে চুমু এঁকে দিয়ে শুভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়ের প্রতি বেখেয়ালিপনা একদমই সহ্য করে না সে। রোদ ইনোসেন্ট মুখে ঠোঁটের ইশারায় সরি বলে শুভ্রতাকে নিয়ে ঝটপট বাসার ভেতরে ঢুকে যায়। শুভ্রও মাথা চুলকাতে চুলকাতে রোদের পিছু নেয়। ওদের সবকিছুই খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে জেনি। নিজেও ওঠে যায় ওদের পিছু পিছু। রোদ মেয়ের শরীর মুছে দিয়ে কাপড় পাল্টে দেয়। চুল আঁচড়ে কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
— আম্মু? গায়ে পানি লাগাবে না আর। তাহলে কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে। ভাইয়াদের সাথে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে খেলবে। একদম দুষ্টুমি করবে না। তুমি না বাবার প্রিন্সেস? প্রিন্সেসরা সব কথা শুনে। কি মনে থাকবে?
শুভ্রতা মাথা দুলিয়ে মায়ের গালে টুপ করে একটি চুমু দিয়েই দৌড়ে পালায়। শুভ্র এতোক্ষণ দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। শুভ্রতা বেরিয়ে যেতেই খপ করে রোদের কোমর চেপে ধরে সে। দুষ্টু হাসি দিয়ে হাতের মুঠোয় থাকা লাল রঙে রাঙিয়ে দেয় ফর্সা পেটের অনেকটায়। রোদ নড়ে উঠতেই ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে,
— নো নড়াচড়া। চুপচাপ দাঁড়াও । পুরো দু’ঘন্টা ধরে খুঁজেও দেখা পাওয়া যায় না আপনার। এতো কেন বিজি আপনি?
— ভাইয়ের বিয়েতে বিজি থাকবো না?
— না থাকবেন না। আর এতো সুন্দর করে সেজেছেন কেন? আপনার এই সাজে কেউ যদি হার্ট অ্যাটাক করে তার দায়ভার কে নিবে শুনি? আমার কিন্তু অলরেডি বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। এখন আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। আর এই চিকিৎসার একমাত্র ঔষধ হলো “রোদপাখি”।
— বাইরে বেশ ভালো রোদ আছে। সেখানে বসে বসে পাখি তাড়ান। তাহলেই হয়ে যাবে রোদ+পাখি= রোদপাখি। এবার আমায় ছাড়ুন। সবাই খুঁজছে হয়তো।
— খুঁজুক। খুঁজতে খুঁজতে শহীদ হয়ে যাক। আগে হার্ট অ্যাটাক থেরাপি নিবো তারপর ছাড়াছাড়ি৷ সিরিয়াসলি রোদপাখি, তোমায় কিন্তু ব্যাপক লাগছে। প্রচুর হটটট….
— অসভ্য!
— অসভ্যই তো হতে চাই। মেয়ে নেই আশেপাশে, অসভ্য হওয়ার এটাই তো সুযোগ রোদপাখি….
কথাটা বলেই চোখ টিপে শুভ্র। রোদ অসহায় চোখে তাকায়। জেনি মুচকি হেসে জানালার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়। আবারও হাঁটা দেয় বাগানে। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় লেখা শব্দগুলোকে জীবন্ত দেখতে চায় সে। সেই ভালোবাসা, সেই রাগ,সেই কোমলতা আর সেই মিষ্টি সম্পর্কগুলো.. সব দেখতে চায় সে সব।
আজ রাহাতের বিয়ে। সবাই সাজুগুজু করে হুলস্থুল। জেনিও সেজেছে আজ। সবসময় শার্ট,প্যান্ট পড়া মেয়েটা রোদের রিকুয়েষ্টে লেহেঙ্গা পড়েছে আজ। লেমন কালারের লেহেঙ্গায় একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তাকে। হ্যারির গায়েও লেমন কালারের শেরওয়ানি। সোনালি চুলগুলো সুন্দর করে গোছানো। দৃষ্টি অস্থির। বাংলাদেশ আসার পর থেকেই জেনিকে নব নব রূপে দেখছে সে। কখনো শাড়ি আবার কখনো লেহেঙ্গায় মাতাল করা সৌন্দর্যে পাগল হচ্ছে হ্যারি। যতবার তাকাচ্ছে ততবারই বুকে হালকা পাতলা ব্যাথা করে উঠছে তার। কি অদ্ভুত সেই ব্যাথা! সবাই তৈরি হয়ে নিয়ে দুপুর ২ টো নাগাদ বেরিয়ে পড়লো কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে যে যার মতো আনন্দে মেতে উঠলো। হ্যারি মেতে উঠলো ছবি তোলায় আর জেনি চারপাশটা দেখায়।
বিয়ে বাড়ির মাঝ বরাবর ফাঁকা জায়গায় রোদ-শুভ্র, নাবিলা-সাহেলসহ সকলেই আড্ডায় মেতে উঠেছে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে ডেকোরেশনের ফুল ধরে টানাটানি করছে আদ্র-রোদ্র। গেইটের কাছে সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা আর সাদাফ। শুভ্রতা আজ লাল লেহেঙ্গা পড়েছে। ছোট্ট শুভ্রতার জন্য লেহেঙ্গা সামলানোটা কঠিন হলেও মায়ের মতো ড্রেস পড়তে পেরে ভীষন খুশি সে। সাদাফের গায়ে লাল শেরওয়ানি। সাদা ধবধবে শরীরে লাল রঙটা নজরকাড়ছে সবার। স্ট্রেট চুলগুলো সমান হয়ে পড়ে আছে কপালে। জেনি আরেকটু এগিয়ে যেতেই খেয়াল করলো সাদাফ শুভ্রতার ওড়না ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর ভ্রু কুঁচকে অন্যান্য মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে। জেনি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাকালো, সাদাফের এভাবে মেয়েদের দিকে তাকানোর কারণটা ধরতে চেষ্টা করছে সে।
সাদাফ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খেয়াল করে হাতে থাকা ওড়নাটির দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে আবারও মেয়েদেরকে দেখে নিয়ে ওড়নাটা শুভ্রতার গলায় জড়িয়ে লম্বা অংশটুকু পেছনদিক থেকে ঘুরিয়ে এনে ধরিয়ে দিলো শুভ্রতার বামহাতে। ওড়না সমস্যা সমাধান হওয়ায় সাদাফের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো শুভ্রতা। সাদাফ শুভ্রতার হাসিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে বিরক্তি ভাব নিয়ে পাশে রাখা সোফায় গিয়ে বসলো। জেনি সাদাফকে যতোবারই দেখছে ততবারই অবাক হচ্ছে। এই বয়সেই সবকিছুই এতোটা ম্যাচিউরিটির সাথে কিভাবে করে সে, বুঝে উঠে না জেনি। শুভ্রতা এদিক ওদিক তাকায়।হয়তো বাবা-মাকে খুঁজছে সে। কিছুক্ষণ অনুসন্ধান চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে সাদাফের পাশে গিয়ে বসে। সাদাফ গম্ভীর মুখে তাকাতেই শুভ্রতা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,
তোকে চাই সিজন ২ পর্ব ৭১+৭২
— আম্মু যাবো।
সাদাফ ভ্রু কুঁচকায়। বিরক্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজে সে।সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শুভ্রতার হাত ধরে শুভ্রদের দিকে এগিয়ে যায়। জেনি নিজের মনেই হেসে ওঠে বিরবির করে বলে, “ফিউচার লাভ বার্ডস্”
